Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শেষ শিক্ষা || Shesh Siksha by Rabindranath Tagore

শেষ শিক্ষা || Shesh Siksha by Rabindranath Tagore

একদিন শিখগুরু গোবিন্দ নির্জনে
একাকী ভাবিতেছিলা আপনার মনে
আপন জীবনকথা ; সে সংকল্পলেখা
অখণ্ড সম্পূর্ণরূপে দিয়েছিল দেখা
যৌবনের স্বর্ণপটে , যে আশা একদা
ভারত গ্রাসিয়াছিল , সে আজি শতধা ,
সে আজি সংকীর্ণ শীর্ণ সংশয়সংকুল ,
সে আজি সংকটমগ্ন । তবে একি ভুল !
তবে কি জীবন ব্যর্থ ! দারুণ দ্বিধায়
শ্রান্তদেহে ক্ষুব্ধচিত্তে আঁধার সন্ধ্যায়
গোবিন্দ ভাবিতেছিল ; হেনকালে এসে
পাঠান কহিল তাঁরে , ‘ যাব চলি দেশে ,
ঘোড়া – যে কিনেছ তুমি দাও তার দাম ।’
কহিল গোবিন্দ গুরু , ‘ শেখজি , সেলাম ,
মূল্য কালি পাবে , আজি ফিরে যাও ভাই ।’
পাঠান কহিল রোষে , ‘ মূল্য আজই চাই ।’
এত বলি জোর করি ধরি তাঁর হাত —
চোর বলি দিল গালি । শুনি অকস্মাৎ
গোবিন্দ বিজুলি – বেগে খুলি নিল অসি ,
পলকে সে পাঠানের মুণ্ড গেল খসি ;
রক্তে ভেসে গেল ভূমি । হেরি নিজকাজ
মাথা নাড়ি কহে গুরু , ‘ বুঝিলাম আজ
আমার সময় গেছে । পাপ তরবার
লঙ্ঘন করিল আজি লক্ষ্য আপনার
নিরর্থক রক্তপাতে । এ বাহুর’পরে
বিশ্বাস ঘুচিয়া গেল চিরকালতরে ।
ধুয়ে মুছে যেতে হবে এ পাপ , এ লাজ —
আজ হতে জীবনের এই শেষ কাজ ।’


পুত্র ছিল পাঠানের বয়স নবীন ,
গোবিন্দ লইল তারে ডাকি । রাত্রিদিন
পালিতে লাগিল তারে সন্তানের মতো
চোখে চোখে । শাস্ত্র আর শস্ত্রবিদ্যা যত
আপনি শিখালো তারে । ছেলেটির সাথে
বৃদ্ধ সেই বীরগুরু সন্ধ্যায় প্রভাতে
খেলিত ছেলের মতো । ভক্তগণ দেখি
গুরুরে কহিল আসি , ‘ একি প্রভু , একি !
আমাদের শঙ্কা লাগে । ব্যাঘ্রশাবকেরে
যত যত্ন কর , তার স্বভাব কি ফেরে ?
যখন সে বড়ো হবে তখন নখর ,
গুরুদেব , মনে রেখো হবে সে প্রখর ।’
গুরু কহে , ‘ তাই চাই , বাঘের বাচ্ছারে
বাঘ না করিনু যদি কী শিখানু তারে ? ‘


বালক যুবক হল গোবিন্দের হাতে
দেখিতে দেখিতে । ছায়া – হেন ফিরে সাথে ,
পুত্র – হেন করে তাঁর সেবা । ভালোবাসে
প্রাণের মতন — সদা জেগে থাকে পাশে
ডান হস্ত যেন । যুদ্ধে হয়ে গেছে গত
শিখগুরু গোবিন্দের পুত্র ছিল যত —
আজি তাঁর প্রৌঢ়কালে পাঠানতনয়
জুড়িয়া বসিল আসি শূন্য সে হৃদয়
গুরুজির । বাজে – পোড়া বটের কোটরে
বাহির হইতে বীজ পড়ি বায়ুভরে
বৃক্ষ হয়ে বেড়ে বেড়ে কবে ওঠে ঠেলি ,
বৃদ্ধ বটে ঢেকে ফেলে ডালপালা মেলি ।


একদা পাঠান কহে নমি গুরু – পায় ,
‘ শিক্ষা মোর সারা হল চরণকৃপায় ,
এখন আদেশ পেলে নিজভুজবলে
উপার্জন করি গিয়া রাজসৈন্যদলে ।’
গোবিন্দ কহিলা তার পিঠে হাত রাখি ,
‘ আছে তব পৌরুষের এক শিক্ষা বাকি ।’



পরদিন বেলা গেলে গোবিন্দ একাকী
বাহিরিলা ; পাঠানেরে কহিলেন ডাকি ,
‘ অস্ত্র হাতে এসো মোর সাথে । ‘ ভক্তদল
‘ সঙ্গে যাব’ ‘ সঙ্গে যাব’ করে কোলাহল —
গুরু কন , ‘ যাও সবে ফিরে ।’


দুই জনে
কথা নাই ধীরগতি চলিলেন বনে
নদীতীরে । পাথর – ছড়ানো উপকূলে
বরষার জলধারা সহস্র আঙুলে
কেটে গেছে রক্তবর্ণ মাটি । সারি সারি
উঠেছে বিশাল শাল , তলায় তাহারি
ঠেলাঠেলি ভিড় করে শিশু তরুদল
আকাশের অংশ পেতে । নদী হাঁটুজল
ফটিকের মতো স্বচ্ছ , চলে এক ধারে
গেরুয়া বালির কিনারায় । নদীপারে
ইশারা করিল গুরু ; পাঠান দাঁড়ালো ।
নিবে – আসা দিবসের দগ্ধ রাঙা আলো
বাদুড়ের পাখা – সম দীর্ঘ ছায়া জুড়ি
পশ্চিমপ্রান্তর – পারে চলেছিল উড়ি
নিঃশব্দ আকাশে । গুরু কহিলা পাঠানে ,
‘ মামুদ , হেথায় এসো , খোঁড়ো এইখানে ।’
উঠিল সে বালু খুঁড়ি একখণ্ড শিলা
অঙ্কিত লোহিত রাগে । গোবিন্দ কহিলা ,
‘ পাষাণে এই যে রাঙা দাগ , এ তোমার
আপন বাপের রক্ত । এইখানে তার
মুণ্ড ফেলেছিনু কেটে , না শুধিয়া ঋণ ,
না দিয়া সময় । আজি আসিয়াছে দিন ,
রে পাঠান , পিতার সুপুত্র হও যদি
খোলো তরবার — পিতৃঘাতকেরে বধি
উষ্ণ রক্ত – উপহারে করিবে তর্পণ
তৃষাতুর প্রেতাত্মার । ‘ বাঘের মতন
হুংকারিয়া লম্ফ দিয়া রক্তনেত্রে বীর
পড়িল গুরুর’পরে ; গুরু রহে স্থির
কাঠের মূর্তির মতো । ফেলি অস্ত্রখান
তখনি চরণে তাঁর পড়িল পাঠান ।
কহিল , ‘ হে গুরুদেব , লয়ে শয়তানে
কোরো না এমনতরো খেলা । ধর্ম জানে
ভুলেছিনু পিতৃরক্তপাত ; একাধারে
পিতা গুরু বন্ধু বলে জেনেছি তোমারে
এতদিন । ছেয়ে থাক্‌ মনে সেই স্নেহ ,
ঢাকা পড়ে হিংসা যাক মরে । প্রভু , দেহো
পদধূলি । ‘ এত বলি বনের বাহিরে
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল , না চাহিল ফিরে ,
না থামিল একবার । দুটি বিন্দু জল
ভিজাইল গোবিন্দের নয়নযুগল ।


পাঠান সেদিন হতে থাকে দূরে দূরে ।
নিরালা শয়নঘরে জাগাতে গুরুরে
দেখা নাহি দেয় ভোরবেলা । গৃহদ্বারে
অস্ত্র হাতে নাহি থাকে রাতে । নদীপারে
গুরু – সাথে মৃগয়ায় নাহি যায় একা ।
নির্জনে ডাকিলে গুরু দেয় না সে দেখা ।


একদিন আরম্ভিল শতরঞ্জ খেলা
গোবিন্দ পাঠান – সাথে । শেষ হল বেলা
না জানিতে কেহ । হার মানি বারে বারে
মাতিছে মামুদ । সন্ধ্যা হয় , রাত্রি বাড়ে ।
সঙ্গীরা যে যার ঘরে চলে গেল ফিরে ।
ঝাঁ ঝাঁ করে রাতি । একমনে হেঁটশিরে
পাঠান ভাবিছে খেলা । কখন হঠাৎ
চতুরঙ্গ বল ছুঁড়ি করিল আঘাত
মামুদের শিরে গুরু ; কহে অট্টহাসি ,
‘ পিতৃঘাতকের সাথে খেলা করে আসি
এমন যে কাপুরুষ , জয় হবে তার ! ‘
তখনি বিদ্যুৎ – হেন ছুরি খরধার
খাপ হতে খুলি লয়ে গোবিন্দের বুকে
পাঠান বিঁধিয়া দিল । গুরু হাসিমুখে
কহিলেন , ‘ এতদিনে হল তোর বোধ
কী করিয়া অন্যায়ের লয় প্রতিশোধ ।
শেষ শিক্ষা দিয়ে গেনু — আজি শেষবার
আশীর্বাদ করি তোরে হে পুত্র আমার ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress