শিশিরের ইতিবৃত্ত
“শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী
শিউলি ঝরানো দিন আনে সে
চিরদিনের বাণী,
ভোরের আগমনী..”
এ যেন শারদপ্রাতে ভোরের সম্মোহন বার্তা।
কিংবা কবিগুরুর ভাষায়-
“বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা দেখেতি গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু –“
সত্যি বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে শিশির কেমন যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছে। হেমন্তের সন্ধ্যা কিংবা প্রাকভোরে যখন ঘাসের ওপর শিশির বিন্দু টলমল করে হালকা বাতাসের মৃদু ধাক্কায় ,তখন মনটা ছন্দে ভরে ওঠে। অথবা নতুন সূর্যের মোলায়েম স্নিগ্ধ শোভন আলোয় ধানের শীষের ওপরে জমা শিশির বিন্দু যখন মুক্তার মতো ঝকমক করে ওঠে,তখন কবিমন উদাস হয়ে ওঠে। মূলত শীতকালীন সকালবেলায় শিশিরের আধিক্য বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। শিশির ভেজা সকাল বেলার মনোরম রূপ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আসুন জেনে নিই – এই শিশিরের উৎপত্তির বিজ্ঞান।
শিশির সারা বছরে যেকোনো সময় বায়ুমণ্ডলে তৈরি হতে পারে। তবে আমরা শীতকালীন আবহাওয়াতেই এর অস্তিত্ব টের পেয়ে থাকি। দিনের বেলা পৃথিবী সূর্যের তীব্র তাপ শোষণ করে উষ্ণ হয় এবং সন্ধ্যার পর সেই তাপ বিকীরণ করে শীতল হতে থাকে। ফলে তাপমাত্রা কমতে থাকে। মূলত শেষ রাতের দিকে তাপমাত্রা অনেক কমে যায় এবং ভূপৃষ্ঠও অনেক শীতল হয় । ভূ-পৃষ্ঠের সংলগ্ন বায়ুস্তরও শীতল হয় এবং এর মধ্যে অবস্থিত জলীয় বাস্প দ্বারা সম্পৃক্ত হয়। তাপমাত্রা শিশিরাংকের নীচে নেমে যায়। ফলে বায়ুমন্ডলের জলীয়বাস্প ঘণীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলবিন্দু’তে পরিণত হয়। আর এজন্যই ভোরবেলায় গাছের পাতায় , ধানের শীষে, ছাদে, ঘাসের উপর শিশির বিন্দু দেখা যায়।
এবারে আসবো উপরোক্ত ‘শিশিরাঙ্ক’ আসলে কী?- এটি মূলত একটি তুল্য তাপমাত্রা। শিশিরাঙ্ক হলো এমন তাপমাত্রা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যাতে পৌছালে বায়ু তাতে উপস্থিত জলীয়বাষ্প দ্বারা সম্পৃক্ত হয়। বায়ুকে আরো শীতল করলে এতে উপস্থিত জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তরল জল (শিশির) উৎপাদন করে। এটা কোনো যাদুর মতো মনে হয়। বাতাসের চেয়ে শীতল এমন কোনো পৃষ্ঠের সংস্পর্শে এসে যখন বায়ু শিশিরাঙ্কে পৌছায়, তখন জল ঐ পৃষ্ঠের উপর ঘনীভূত হয়।
বায়ুমণ্ডল জলীয়বাষ্প ধরে রাখতে না পারলে জলীয় বাষ্প ফোটা ফোটা শিশির বিন্দু রূপে ঘাসের উপরে কিংবা পাতার উপরে ঝরতে থাকে। ঘাসের পাতার উপর সূক্ষ্ম রোম থাকে যা শিশিরবিন্দুকে ছড়িয়ে যেতে বাধা দেয় এবং শিশির বিন্দুকে গোলাকার দেখায়। এর জন্য কিন্তু জলের পৃষ্ঠটান দায়ী। আর প্রভাত সূর্যের আলো এই শিশিরের কণার উপরে যখন পড়ে তখন কিছু ক্ষেত্রে সেই আলোর অভ্যান্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে। ফলতঃ শিশির বিন্দু চকচক করে।
আগেই বলেছি শুধু শীতকালেই শিশির পড়ে থাকে এমন নয়। শীতকালে তাপমাত্রা কম থাকার কারণে শিশির জমার ঘটনাটি বেশি ঘটে থাকে। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও শিশির পড়তে পারে। পুরোটা নির্ভর করে রাতের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার উপর। অন্য ঋতুতেও যদি রাতের তাপমাত্রা শিশিরাংকের নীচে নেমে যায়, সেক্ষেত্রে শিশির তৈরি হতেই পারে। রাতের তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকলে শেষ রাতের দিকে হালকা শিশির জমতে দেখা যায়। তবে গ্রীষ্মের দিনে এই শিশির আমাদের কাছে অদৃশ্য কারণ সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এ শিশির পুনরায় বাষ্প হয়ে যায়। যে কারণে বছরের অন্যান্য সময় শিশির পড়লেও আমরা খুব একটা দেখতে পাই না।
শিশির তার মনোরম সমাগমে যুগ যুগ ধরে বাংলার জনমানসে গভীর প্রভাব ফেলে আসছে। বাংলা মায়ের ভূপ্রকৃতি যেন শিশির স্নানে মেতে ওঠে। শরতের কাশ থেকে শুরু করে মিষ্টি শিউলি সকলেই যেন শিশির স্নানে মেতে ওঠে শরৎ প্রভাতের স্নিগ্ধ বাতায়নে। প্রকৃতি যেন শিশির কণা হয়ে স্নিগ্ধতা খোঁজে তাঁর ভালোবাসার ধরিত্রীর মুগ্ধ ছোঁয়ায়। কবিগুরুর লেখাংশ দিয়ে শেষ করা যাক-
“শিশির কহিল কাঁদিয়া
তোমারে রাখি যে বাঁধিয়া
হে রবি,এমন নাহিকো আমার বল।
তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন
কেবলি অশ্রুজল।”