শিক্ষা
সপ্তাহখানেক আগে দুপুরবেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ বাইকে করে বাড়ি ফিরছিলাম একটা দরকারি কাজ সেরে।। একটা চৌমাথার মোড়ের সিগনাল লাল হতে বাইকটা দাঁড় করালাম। প্রবল রোদ,সিগন্যালের নাম্বারের দিকে আমার চোখ, কখন সবুজ হবে।
হঠাৎ একদম কাছেই একটা ধাক্কার শব্দ আর আর্তনাদের আওয়াজ শুনে রাস্তার বাঁ দিকটাতে তাকিয়ে দেখলাম ,একটা স্কুটিতে খাবার সরবরাহকারী সংস্থার ইউনিফর্ম পরে একটা ছেলে পিছনের ডিকিতে করে খাবার ডেলিভারি দিতে যাচ্ছিল।
তাকে পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা মারাতে সে ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। স্কুটিটা উল্টে পড়েছে , ছেলেটা রাস্তায় পড়ে আছে,পায়ে লেগেছে তার, বেশ রক্ত পড়ছে । আশেপাশের লোকজন হৈহৈ করে ছুটে এলো। আমি আমার বাইকটাকে রাস্তার পাশে লক করে রেখে সেখানে দৌড়ে গেলাম, ততক্ষণে আশেপাশের লোকজন ছেলেটাকে রাস্তা থেকে তুলেছে ।
যে গাড়িটা ধাক্কা মেরেছিল সেটার গতিবেগ খুব বেশি ছিল না ,আর দাঁড়িয়েও পড়েছিল । সম্ভবত সঠিক সময় ব্রেক অ্যপ্লাই করতে ভুল হওয়ার দরুন ছেলেটির স্কুটিতে ধাক্কা মেরেছে গাড়িটি।
সেই গাড়ির ড্রাইভারকে কয়েকজন গাড়ি থেকে নামিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছিল।
সেই লোকজনদের বুঝিয়ে শুনিয়ে সরিয়ে দিয়ে সেই গাড়িটাতে ছেলেটাকে তুলে আমি আর দুজন ভদ্রলোক মিলে চললাম কাছের হাসপাতালে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ছেলেটাকে নিয়ে গেলে জরুরী বিভাগের ডাক্তার ছেলেটির পায়ের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন আর টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিলেন ।
তারপর বললেন, একটা এক্স রে করতে হবে, পায়ের হাড়ে কোথাও ভেঙেছে বা চিড় ধরেছে কিনা।
এদিকে ছেলেটি সমানে বলে যাচ্ছিল, কাস্টমারের বাড়িতে তার খাবার সরবরাহ করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
খাবারটার ডেলিভারিটা করতে দেরি হয়ে গেলে আর কাস্টমার কমপ্লেন করলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
কোম্পানি ডেলিভারি চার্জ -এর টাকা তো দেবেই না, উল্টে টাকা কেটে নেবে ,আর কয়েকদিন কাজও দেবে না।
কিন্তু তার কোন কথা না শুনে তার পায়ের এক্স রে করানো হলো ওই হাসপাতালে ।
এক্স রে রিপোর্ট আসার পরে দেখা গেল তার পায়ের হাড় ভাঙ্গেনি বা চিড় ধরেনি।
ডাক্তার বাবু কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলেন প্রেসক্রিপশনে, আর পাটাকে ২-৩ দিন রেস্ট দিতে বললেন।
হসপিটালে থেকে ওষুধগুলো নিলাম, তারপর যে গাড়িটাতে করে আমরা ছেলেটিকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই গাড়িটাতে করেই আবার আমরা দুর্ঘটনার জায়গাটাতে এসে পৌঁছলাম।
ওই গাড়ির ড্রাইভারকে ছেড়ে দিলাম তার কারণ আমরা বুঝেছিলাম যে ইচ্ছে করে ড্রাইভার ধাক্কা মারেনি ছেলেটি স্কুটিতে, ব্রেক অ্যপ্লাই এর একটু এদিক ওদিকের জন্য ছেলেটির স্কুটিতে ধাক্কা লেগেছে, তাও অল্পের উপর দিয়ে গেছে, এটাই রক্ষে।
ছেলেটির স্কুটিটাকে আমার বাইকের পাশে কারা যেন দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছে।
ছেলেটির নাম সুজয়, ডাক্তার বাবু হাসপাতালে যখন প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন তখনই জেনেছি,একদম অল্পবয়সী ছেলে, বয়স মেরে কেটে ২২- ২৩ বছর ,তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, কলেজে পড়ে, সংসার খরচ চালাবার জন্য খাবার ডেলিভারি সংস্থায় কাজ করে কিছু উপার্জনের চেষ্টা করছে।
বাড়িতে কে আছে জিজ্ঞাসা করাতে বলল, সে আর তার মা থাকে একটা ভাড়া বাড়িতে ,বাবা নেই, মারা গেছে অনেকদিন আগে। মা কয়েকটা বাড়িতে রান্নার কাজ করে।
আমি ছেলেটাকে বললাম , তোমার তো পায়ে বেশ লেগেছে, ব্যথাও আছে,তুমি তো মনে হয় এখন স্কুটি চালাতে পারবে না, আর উচিতও নয়। তোমার স্কুটিতে করে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি ,কাস্টমারের বাড়িতে খাবারটা ডেলিভারি করতে, তারপরে তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেব।
আমি আমার বাইকটাকে লক করে রাস্তার পাশে রেখে দিলাম, পাশের দোকানে বলে দিয়ে।
ছেলেটা একটু কিন্তু কিন্তু করতে লাগলো, কিন্তু আমি তার কোন ওজর আপত্তি শুনলাম না।
সুজয়কে তার স্কুটিতে পেছনে বসিয়ে আমি স্কুটিটাতে স্টার্ট দেওয়ার জন্য ইলেকট্রনিক বোতামে চাপ দিতে প্রথমে স্কুটিটা স্টার্ট না নিলেও ,দু একবারের চেষ্টায় স্টার্ট হল।
কিন্তু দেখলাম , স্কুটিটার পেট্রল রিজার্ভের একেবারে শেষ দাগে, আমি বুঝলাম তেল ভরতে হবে ,কাছাকাছি একটা পেট্রোল পাম্পে নিয়ে গেলাম, ৫০০ টাকার তেল ভরলাম, টাকাটা আমিই দিলাম, ছেলেটির কাছে যে এখন তেল ভরাবার টাকা নেই ,সেটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছি ।
ছেলেটির মুখে চোখে একটা ইতস্তত ভাব।
এরপর ছেলেটির নির্দেশমত স্কুটি চালিয়ে কাস্টমারের বাড়িতে গেলাম।
সুজয় খাবারটা ডেলিভারি দেওয়ার পর কাস্টমার সুজয়কে প্রথম একটু বেশ রুঢ়ভাবেই দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করল।
তখন আমি গিয়ে কাস্টমারকে দুর্ঘটনার বিষয়টা সংক্ষেপে বললাম ,কাস্টমার সব শুনে শান্ত হল।
এরপর সুজয়কে স্কুটিতে চড়িয়ে ওর বাড়ির দিকে রওনা হলাম ওর নির্দেশ মত। ওর বাড়ি আমার বাড়ি থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয়,খালপাড়ের দিকে। সুজয় দের ঘরে গিয়ে দেখলাম , একটা ছোট ঘরে ও আর ওর মা থাকে ,ঘরের ছাদ এসবেসটসের।
সুজয়ের সাথে আমাকে আর সুজয়ের পায়ের ব্যান্ডেজ দেখে ওর মা তো খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ব্যস্ত সমস্ত ভাবে দরজার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন ,’কি হয়েছে সুজয়ের ?’
তখন আমি সংক্ষেপে অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা সুজয়ের মাকে বললাম। সুজয়ের মা সব শুনে একটু শান্ত হলেন তারপরে বললেন,’ আমি কতবার বলেছি এই রোদে রোদে বাইক না চালিয়ে , ওই কাজটা তুই ছেড়ে দে,পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর।
পড়াশোনা শেষ করে , পাস করার পর কাজকর্ম করে রোজগার করবি। আমি তো এখনো অল্প হলেও কিছু রোজগার করছি। ‘
সুজয় বলল,’ তুমি আর কত করবে ? আমার কলেজের ফি দিতে হচ্ছে ,এছাড়া পড়াশোনার অন্যান্য খরচা আছে, ঘর ভাড়া আছে, দুজনের খাওয়ার খরচ আছে, আমাকে তো কিছু একটা কাজ করতেই হবে না হলে চলবে কি করে? এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ,হতেই পারে, তবে আমার তেমন কিছু হয়নি তুমি অতো চিন্তা করো না। এই কাকুরা ছিলেন, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন ,ওষুধ খেতে দিয়েছেন এক্সরে হয়েছে, হাড় ভাঙ্গেনি। দু-একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।’
সুজয়ের মা বললেন ,’দেখ বাবা, মায়ের মন তো, চিন্তা তো হবেই ।’
এর পরে আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব ,সে ভাষা আমার নেই’।
আমি বললাম ,’কি যে বলেন ,আমি আর কি করেছি? ধন্যবাদের কিছু নেই,এটা তো আমার কর্তব্য ছিল। আমার ক্ষেত্রেও যদি এরকম হতো ,তাহলে আপনার ছেলেও তো এরকমই করতো।’ সুজয়ের মা বললেন ,’না ,আজকাল সবাই এরকম করে না। সবাই আজকাল যে যার কাজে ব্যস্ত। অনেক সময়ই দেখা যায়,কোন ঘটনা ঘটলে পাশ কাটিয়ে চলে যায় নিজের কাজে। ‘ তারপর বললেন,’আমাদের এই গরিবের বাড়িতে এসেছেন, এই গরমে অন্তত একটু শরবত খেয়ে যান।’ আমি বললাম ,’না , শরবত নয়,আমাকে শুধু এক গ্লাস জল দিন, বেলা হয়ে গেছে আমি এখন বাড়ি ফিরব।’
সুজয়ের মা যখন জল আনতে গেলেন সুজয়দের অবস্থা দেখে আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটো ৫০০ টাকার নোট সুজয়ের হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা রাখো।’
সুজয় কিছুতেই টাকা নিতে চাইল না উল্টে বলল ,’আপনি তো স্কুটির তেল ভরানোর জন্য ৫০০ টাকা দিয়েছেন। ওই টাকাটা আমাকে ফেরত দিতে হবে, কিন্তু এখন তো আমার কাছে টাকা নেই, আপনার বাড়ির ঠিকানাটা দিন, আমি গিয়ে দিয়ে আসবো।’
আমি তবু সুজয়কে টাকাটা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলাম, সেই সময় সুজয়ের মা আমার জন্য জল নিয়ে এলেন।
তিনি বললেন ,’আপনি সুজয়কে টাকা দিচ্ছেন কেন?
বিনা পরিশ্রমে কারুর কাছ থেকে টাকা নেওয়া আমি একদম পছন্দ করি না আর সুজয়কেও আমি সেই শিক্ষাই দিতে চেষ্টা করেছি। ‘
আমি বললাম ,’ না সুজয় তো আমার কাছে টাকা চায় নি , বরং ওতো টাকা নিতেই চাইছে না। আর আমি এই টাকাটা আমি ওকে দান করছি না ,ওর হয়তো এখন হয়তো কলেজের জন্য দরকার, সেজন্য ধার দিচ্ছি, পরে শোধ করে দেবে। আমাকে যখন কাকা বলে ডেকেছে, এটুকু তো আমি করতেই পারি। ‘
এরপর আর আপত্তি না করে সুজয় আমার কাছ থেকে টাকাটা নিল।
তারপর আমার মোবাইল নাম্বার আর ঠিকানাটা চাইল। আমি আমার মোবাইল নাম্বারটা দিলাম আর বললাম, ফোন নাম্বারটা দিলাম যদি কোনদিন আমাদের বাড়ি যেতে চাও ,তখন আমাকে ফোন করে নিও, আমি বাড়ির ঠিকানা বলে দেবো । আমার বাড়ি ,তোমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়।’
সুজয়ের মা এক গ্লাস জল আর চারটে বাতাসা একটা রেকাবিতে করে এনেছিলেন আমার জন্য। এই গরমে দুটো বাতাসা দিয়ে জল খেলাম , খুব ভালো লাগলো।
এরপরে আমি ওদের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সুজয় বললো,’ আপনি এই ভর দুপুরবেলায় এতটা রাস্তা যাবেন , আপনার খুব কষ্ট হবে, আমার জন্য আজ আপনার এতটা অসুবিধা হলো’।
আমি বললাম , ‘কি যে বল ,অসুবিধার কি আছে ? আমি এখন একটা রিক্সা নিয়ে নেব, তারপর বাইকটা নেব , কোনো অসুবিধাই নেই , তুমি সাবধানে থেকো, আর ওষুধগুলো খেও।’
এরপর নানা কাজের মাঝে সুজয়ের কথাটা প্রায় মাথা থেকে প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল, একদম ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা ।
আজ সকাল বেলায় মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজের শব্দ শুনে মোবাইলটা খুলে দেখলাম কে যেন দেড় হাজার টাকা ফোন- পে করে পাঠিয়ে দিয়েছে আমার মোবাইল নম্বরে। তখন মনে পড়ে গেল সুজয়ের কথা, যে এক হাজার টাকা আমি ওকে সেদিন দিয়েছিলাম জোর করে,তার সাথে ওর স্কুটির পেট্রোল ভরানোর ৫০০ টাকা যোগ করে , মোট দেড় হাজার টাকা আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে সুজয় ।
সুজয়ের মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল, বিনা পরিশ্রমে কারোর কাছ থেকে টাকা না নেওয়ার শিক্ষা উনি ছেলেকে দিয়েছেন।
সুজয়ের মোবাইল নম্বরটা আমি আমার মোবাইলে সেভ করে রাখলাম,’শিক্ষিত সুজয়’ বলে।