Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শিক্ষক করুণাময় || Sanjit Mandal

শিক্ষক করুণাময় || Sanjit Mandal

আমাদের ছোট বেলায় আমাদের শিক্ষক মহাশয়রা কিভাবে গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন সেই গল্প। আমার দ্বিতীয় ভগবান শ্রীযুক্ত করুণাময় চক্রবর্তী ভূতপূর্ব কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালার ব্রতচারী শিক্ষকতা সম্পন্ন করে বেহালায় আর্যবিদ্যা মন্দির নামক স্কুলে শিক্ষকতায় যোগদান করেন ও ঢালিপাড়ার উপান্তে রয়েড পার্কে সর্বশিক্ষা দানের জন্য একটি কোচিং সেন্টার খোলেন। সেখানে প্রকৃত শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে সামান্য অর্থের বিনিময়ে ( মাসে ১০ টাকা মাত্র )। সমস্ত বিষয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষকও নিয়োগ করেছিলেন। এই সমস্ত শিক্ষকরাও কেবল মাত্র যাতায়াতের খরচ টুকু নিয়ে আত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে আমাদের প্রতিটি বিষয় বুঝিয়ে দিতেন। সেখানে গোপাল ব্যানার্জি স্যার ইংরেজি গ্রামারের বিভীষিকা শুধু দূর করেই দেননি, কত সহজেই গ্রামার রপ্ত করা যায় তার কতকগুলো সহজ পদ্ধতি ও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। নিকুঞ্জ বিহারী স্যার যেমন ধোপদুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবী পরে আসতেন তেমনি সুন্দর করেই বাংলা সাহিত্য ও গ্রামার আমদের জলবৎ তরলং করে দিয়েছিলেন।

আমি তখন ক্লাশ নাইনে পড়ি। এক দিন কি কারণে কোন এক ছাত্রের একটু রূঢ় ও কর্কশ কথা করুণাময় স্যারের কানে এসেছিল। উনি সেদিন আমাদের সংস্কৃত ক্লাশে এসে বললেন, আইজ তোদের একটা গল্প বলি। গল্পের কথায় আমরা সবাই নড়ে চড়ে বসলাম। উনি শুরু করলেন।
পুরাকালে রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় নবরত্নের অন্যতম কালিদাস ছিলেন সভা কবি । নব রত্নের বাকি আট রত্নের নাম এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, তারা হলেন ,অমরসিনহ , ধ্বন্বতরি , হরিসেন, ক্ষপনক , শঙ্কু , বরাহমিহির , বররুচি , বেতালভট্ট । যাই হোক, সেই সময় ভবভূতিও লিখতেন, কাব্য কবিতায় তারও সুনাম ছিল, তবে কালিদাসের মত ছিল না। তার ধারণা ছিল কালিদাসের জন্যেই তিনি সভাকবি হতে পারেননি। সেই জন্যে কালিদাসের প্রতি তার একটু ঈর্ষাও ছিল।
প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে একদিন দুজনেরই মুখোমুখি দেখা। ভবভূতিই আগ বাড়িয়ে বললেন, লোকে যেটা বলে, সেটা ততখানি সত্যি নয়। কালিদাস বললেন, বন্ধু , মানে তো বুঝলামনা কিছু। ভবভূতি বলেন, এই তোমার কাব্য লেখার কথা বলছি আর কি। আমি তো তোমার থেকেও ভালো লিখি , আমার লেখায় ব্যাকরণগত পরিশুদ্ধি লক্ষ্য করার মতো।তুমি যে ইনিয়ে বিনিয়ে কি লেখো ছাই বুঝি না কিছুই।
কালিদাস মিটিমিটি হাসছিলেন, বললেন , ঠিক আছে বন্ধু এসো একটা পরীক্ষা করা যাক। ওই যে সামনে একটা মরা গাছ দাঁড়িয়ে আছে, এসো ওকে নিয়েই কাব্য করা যাক । ভবভূতি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এ আর এমন কি , আমার কাব্য শোনো, শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে। এবার তুমি বলো দেখি। কালিদাস বললেন , নীরস তরুবর পুরতঃ ভাতি । ভবভূতি শুনেই বললেন, আমিই সঠিক বর্ণনা করেছি , তুমি ইনিয়ে বিনিয়ে কি যে বললে । কালিদাস ও ছাড়ার পাত্র নন । বললেন ওই দেখো এক কৃষক চলেছে জমিতে হলকর্ষণ করতে , ওকেই জিজ্ঞাসা করা যাক । ভবভূতি বললেন , ও বেটা চাষা , ও আমাদের কাব্যের বুঝবেটা কি ? কালিদাস বলেন , উনিই আমাদের কাব্যের শ্রেষ্ঠ বিচারক হতে পারেন , চলো জিজ্ঞাসা করি।
যথারীতি তারা সামনের শুকনো গাছ আর সেটা নিয়ে তাদের কাব্যের নমুনা পেশ করতেই কৃষক বলে, কত্তা আমি মূর্খ মানুষ , আমারে দিসেন বিচারের ভার ! দিসেন যহন , যা কমু হেইডা আপনাগো ভালো লাগবে তো ? দুজনেই বলে , ভালো হোক মন্দ হোক তুমি তোমার কথা বলো , আমরা শুনবো। কৃষক বলে, তইলে আর একবার কয়েন কত্তা ,আর একবার শুনি। ভবভূতি বলেন , শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে । কালিদাস বলেন , নীরস তরুবর পুরতঃ ভাতি । কৃষক তার কানটা ভালো করে নাড়িয়ে নিয়ে বলে, কত্তা , আমি তো চাষা, চাষ কইর‍্যা খাই । তা মাঠে যহন হাল চষি, গ্রীষ্ম কালের শুকনা মাটিতে লাঙ্গলের ফলা পইড়লে পরে ঠকাং ঠকাং কইর‍্যা ঠিকরাইয়া যায় , আপ্নের শুষ্কং কাষ্ঠং শুইন্যা, আমার লাঙ্গলের ফলাখান যেন ঠিকরাইয়া যাইত্যাসে। আর অই যে ওনার নীরস তরুবর শুইন্যা , কি কমু কত্তা, বর্ষাকালে ভিজা মাটিতে লাঙ্গল চালাইলে যেমন ফরফর ফরফর কইর‍্যা কেমন মোলায়েম চলে ঠিক হেইডার মতো। একবার শুনলেই প্রাণ জুড়াইয়া যায়।এইবার আপনেরাই বুইঝা লন কত্তা কারডা ভালো হইসে ।
গল্পটা বলে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় করুণাময় স্যার আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিক চুপ করে রইলেন, তার পরে বললেন , তোরা বুঝছস নি, কারডা ভালো হইসে। আমরা তো বুঝেছিলাম কেন উনি এই গল্পটা বললেন , আমাদের মৌন দেখে উনি আবার বললেন,
“কাক কারো করে নাই সম্পদ হরণ , কোকিল করে নি কারে ধন বিতরণ ,
কাকের কঠোর রব বিষ লাগে কানে, কোকিল অখিল প্রিয় সুমধুর গানে।”
তিনি আরও বলেছিলেন,
বিদ্যা দদাতি বিনয়ম, বিনায়দ যাতি পাত্রতাম,
পাত্রতাদ ধনমাপ্নোতি, ধনাঢ্যম তৎ সুখম্।
এই ধ্রূবপদ উনি বেঁধে দিয়েছিলেন সেই ছাত্রাবস্থায়, বলতে দ্বিধা নেই যে, সেই গুরুমন্ত্র আজ পর্যন্ত বাজে আমার কানে আর আমিও সেই মন্ত্র আজ অবধি মেনে চলি অন্তত আমার জীবন গানে।
কবিগুরুর পূজা পর্বের একটা গান দিয়ে আমার লেখা সম্পূর্ণ করবো,
যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে
মিলাব তাই জীবনগানে।।
গগনে তব বিমল নীল- হৃদয়ে লব তাহারি মিল,
শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে।।
বাজায় উষা নিশীথকুলে যে গীতভাষা
সে ধ্বনি নিয়ে জাগিবে মোর নবীন আশা।
ফুলের মতো সহজ সুরে প্রভাত মম উঠিবে পুরে,
সন্ধ্যা মম সে সুরে যেন মরিতে জানে।।

আজকের দিনে শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশাতেও আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা এতোটুকুও কমে যায়নি, বরং সমাজ দেশ ও জাতি গঠনে আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এই বিশ্বাস রেখে বিশ্বের সমস্ত শিক্ষকদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress