Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

গোলাম আহাদ মহিউদ্দিন কাদেরী গৌরকান্তি দীর্ঘদেহী শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রাক প্রৌঢ়ত্বেও সুঠাম সৌখিন পুরুষ। নিয়মিত ব্যবহারের কিছু উপাচার যেমন প্রিয় বন্ধু আবদুর রহমানের উপহার মেরুন রংয়ের ফেজ টুপি। হাতির দাঁতের কারুকার্য খচিত লোহা কাঠের ছড়ি। রুপালী তারের ফ্রেমে বাঁধানো ডিম্বাকৃতি একজোড়া চশমা। আর জর্ডানের পর্বত থেকে আহৃত দুষ্প্রাপ্য সুরমা তার অতি প্রিয়। বাইরে বেরুবার আগে তিনি সযত্নে চেপে চেপে ফেজ টুপিটি শিরোদেশে ধারন করেন। ঘি রংয়ের শেরোয়ানির সাথে মানানসই কারুকার্যময় বাদশাহী নাগরা। ফেজ টুপিটি মাথায় পরে ছড়ি হাতে যখন তিনি একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান মনে হয় বুঝি তার টুপির ঝালরগুলো নেচে নেচে মেঘ ছুঁইয়ে দেবে। রিক্সা ডাকতে তিনি তার ছড়িখানি বাতাসে দুলিয়ে দেন। রিক্সা থেমে যায়।
অনেক আগে নাসিমা আক্তার হাসতে হাসতে একদিন বলেছিলেন-
– সমশেরের আব্বু! আপনারতো চোখের নজর এখনও ভাল। চলাফেরায়ও কোন অসুবিধা নাই। তবুও আপনি চশমা আর লাঠি ব্যবহার করেন ক্যান?
গোলাম আহাদ হেসেই জবাব দিয়েছিলেন-
– আরে সমশেরের আম্মিজান! আপনি ওসব বুঝবেন না । এটা হলো স্টাইল। বয়সের সাথে লাগসই কিছু আচার ব্যবহার থাকা দরকার। সাধ আহ্লাদ বলে একটা কথা আছে না!
বলে তিনি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। নাসিমা আক্তারও খিলখিলিয়ে হেসেছিলেন চোখে মুখে কিশোরী মেয়ের কৌতুক মেখে। কিন্তু সেসব তো নাসিমা আক্তারের সুখের দিনের স্মৃতি। সেই স্মৃতিময় সুখের কাল কবেই অতীত হয়ে গেছে তার! নাসিমা আক্তারের বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
গোলাম আহাদ মহিউদ্দিন কাদেরী পরিস্কার চিন্তা ভাবনার মানুষ। ভরণপোষণে সক্ষম স্বচ্ছল পুরুষ মানুষের দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে তিনি কোন অন্যায় অধর্ম দেখেন না। তার দীর্ঘ দিনের গোপনে লালিত বিবাহ চিন্তার শুভ্র পালে জোর হাওয়া লেগেছে সম্প্রতি মরক্কোর অধিবাসী জানের দোস্ত আবদুর রহমান আল কাহতানির সাথে ঘন ঘন চিঠিপত্র বিনিময়ের পর । আবদুর রহমানের এক স্ত্রী বিয়োগ আর একটি তালাকের পরও তিন বিবি বর্তমান। জ্যেষ্ঠা গতায়ু যৌবনা। সুতরাং গমনের অযোগ্যা। মেজো অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী হলেও চির রুগ্না। বছরভর শয্যাশায়িনী। আবদুর রহমানের ভাষায় এশক্ আয়েশের অনুপযোগী। কিন্তু তাতে তার তেমন কোন ঘাটতি বোধ নেই। কেননা তার পালের সেরা কনিষ্ঠা মাশাল্লাহ তরতাজা বোগদাদী গোলাপ, চনমনে অষ্টাদশী। ষোল কলার নৈপুণ্যে পরিপূর্ণ পারদশির্নী। কী সুন্দও তারা মিলেমিশে রঙ্গরসে একত্রে বসবাস করেন। আহা! তাদের সুখের সংসার দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রাণ মন বেচইন হয়ে ওঠে!
বিবাহ কাতর গোলাম আহাদ মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আবদুর রহমান আল কাহতানির লাগাতার প্রেরণা আর ইয়ার বন্ধুদের সক্রিয় প্ররোচনার তোড়ে একদিন তিনি মেহেরবানু নান্মী এক পরমা সুন্দরী অষ্টাদশীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লেন। মেহেরবানুর সুযোগ সন্ধানী লোভী পিতা গোলাম আহাদের অপ্রতিরোধ্য অর্থায়নের টোপটি সমূলে গিলে ফেললেন। গোল বাঁধালেন গোলাম আহাদের বর্তমান স্ত্রী নাসিমা আক্তার এবং দুই ছেলে সমশের আবেদ ও জমশের সাজেদের এই বিয়েতে ঘোর আপত্তি নিয়ে। অনুনয় বিনয় হুমকি আস্ফলনে ফলোদয় হল না। শেষাবধি এই সমস্যার একটা মোক্ষম মধ্যস্থতা করার জন্য কুমিল্লা থেকে গোলাম আহাদের জ্যেষ্ঠা ভগিনী হুমায়রা গুলশান আরা ছাহেবান আসছেন। ইতিমধ্যে গোলাম আহাদ টেলিফোনে ঘটনার পূর্বাপর প্রসঙ্গাদি সবিস্তারে জানিয়ে তার বুবুজানকে একটি ব্রিফিং দিয়ে রেখেছেন। বুবুজান হুমায়রা গুলশান আরা স্নেহার্দ্র কন্ঠে তার একমাত্র আদরের ভাইটিকে আশ্বাস দিয়েছেন-
– তুই একটুও ভাবিসনে খোকন। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভেবে শরীর খারাপ করিসনে সোনা ভাইটি আমার। আমি এসে সব ঠিক করে দিবনে।
তো তিনি এসেছেন আজ দুদিন। দুই অবাধ্য ভাতিজা আর অবিবেচক ভাতৃবধূ নাসিমা আক্তারের ওপর তিনি বড়ই নারাজ। তার এত আদরের ভাইটিকে এরা সামান্য কারণে কী পেরেশানিতেই না রেখেছে! আসার পর থেকে কারো সাথে তিনি এ পর্যন্ত মুখ খুলেননি। খাওয়ার সময় খাবার টেবিলেও আসেননি। বাড়ির পরিচারিকারা তার থাকার জন্য নির্ধারিত ঘরের ভেতরেই প্রতিবেলা খাবার পরিবেশন করছে। সেখান থেকেই হেঁকে ডেকে তিনি তাদের ফাই ফরমাস খাটাচ্ছেন। গোলাম আহাদ বড় খোশ মেজাজে আছেন। পুলকিত বোধে তিনি মনে মনে অবিরত লেজ নাড়ছেন। আড়ালে আবডালে দু‘একবার খিক খিক করে হেসেও নিয়েছেন তিনি। তার বদ্ধমূল ধারনা হুমায়রা গুলশান আরা নামক দজ্জাল বাঘিনীর হিংস্র থাবার কাছে ক্ষীণপ্রাণ হারিণ শাবক নাসিমা আক্তার আর কতক্ষণ টিকবে? আর দুই নাবালেক তো ফুপি আম্মি ফুপি আম্মি করেই কুল পাবে না। বিজয় তার অবধারিত। পরমা রূপসী মেহেরবানু গমন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
গোলাম আহাদ একটি হাতল বিহীন চেয়ারে উবু হয়ে বসে আছেন। দুই হাতের মুঠোয় ধওে তার প্রিয় ছড়িটিকে ঠেকিয়ে রেখেছেন মেঝের উপর। ভাঁজ করা মুঠোর উপর স্থাপিত তার থুতনিটি। যেখানে থেকে গুচ্ছে ঝুলে আছে দীর্ঘ শুভ্র শস্রু দল।
হুমায়রা ছাহেবানই প্রথমে দর কষাকষির অধিবেশনের ঢাকনাটি উন্মোচন করলেন উপস্থিতদের উদ্দেশে একটি নাতিদীর্ঘ সূচনা ভাষণে।
– আজকাল দ্বিতীয় বিবাহ কোন ব্যাপার নাকি ? পুরুষ মানুষের এরকম একটু সাধ আহ্লাদ তো থাকেই। আমাদের খোকনতো বাইরে গিয়ে দুষ্টামি বদমায়েশী করে না!
– আবদুর রহমান আল কাহতানির তিন স্ত্রী বর্তমান বুবুজান!
সময়োপযোগী একটি বাক্য সংযোগ করলেন গোলাম আহাদ।
– এই সংসারের জন্য আমার ভাই কী না করেছে ? কোথা থেকে তোমাদের আজ কোথা এনেছে। তোমাদের এই ধনসম্পদ আরাম আয়েশ বিলাস ব্যাসনের জন্যে আমার ভাইটা জীবনভর পরিশ্রম করেছে। ওর এখন একটা সখ হয়েছে আর সেটা তোমাদের সহ্য হচ্ছেনা, না?
– আপনিই বলেন বুবুজান! আবারও কথায় ভর দেন গোলাম আহাদ।
– একজন শক্তসমর্থ স্বচ্ছল পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করতেই পারে। এটা আবার কোন সমস্যার কথা হলো ?
– কিতাবের কথা বুবুজান!
গোলাম আহাদ যথারীতি তার বুবুজানের বক্তব্যে ক্রমাগত রি-ইনফোর্সমেন্ট দিয়ে চলেছেন। হুমায়রা গুলশান আরা ছাহেবান এবার কিন্তু তার ডিম্বাকৃতি ক্ষুদ্রকায় চশমার উপর দিয়ে ভাইকে একটি স্নেহের নিক্ষেপ করলেন। ইশারা খানা যেন এই রকম- আমিই তো বলছি খোকন, তুই আবার মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটছিস কেন?
গোলাম আহাদ সহোদরার এই নীরব অনুযোগ খানি অনুধাবন করলেন। তিনি দুইবার চোখ পিট পিট করে থুতনিটি যথারীতি আবার ছড়ির উপর স্থাপন করলেন।
– আব্বা হুজুর!
জ্যেষ্ট পুত্র সমশের আবেদ এতক্ষণ নীরব শ্রোতা হয়েই বসেছিল। এবার যথেষ্ট বিনয়ী হয়ে পিতাকে বুঝাবার চেষ্টা করল-
– একটু চিন্তা করে দেখেন আব্বা হুজুর। আপনি এমন পাগলামি করলে মানুষ কি বলবে! সমাজে আমরা মুখ দেখাবো কেমন করে? এটা আমাদের পরিবারের মান সম্মানের ব্যাপার, আব্বা হুজুর!
– এ নিয়ে বাইরের লোকের কী বলার আছে ? আমি কারো খাই, না পড়ি? গোলাম আহাদের স্পষ্ট যুক্তি।
– আব্বা হুজুর! আমাদের আম্মিজানের কথাটাও আপনার ভেবে দেখা দরকার। আম্মিজানকে আপনি এতটা অপমান কিভাবে করেন ?
– মান অপমানের তো কিছু দেখিনা!
গোলাম আহাদ যথারীতি অনড়। হুমায়রা গুলশান আরা এবার সরাসরি নাসিমা আক্তারকে নিয়ে পড়লেন।
-তোমারও বাছা কেন যে এত নখরা! মেয়ে মানুষ বুঝি আর সতীনের ঘর করেনা? ছেলে মেয়েদের হাত করে আমার ভাইটিকে কোনঠাসা কেরে রেখেছো। খোকন এমন কোন অন্যায় আবদার তো করে নাই।
– মরদের হক বুবুজান!
গোলাম আহাদের পেটানো যুক্তি। কনিষ্ঠ পুত্র জমশের সাজেদ এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। হঠাৎ হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-
– আচ্ছা ফুপি আম্মা! আপনি আমার আম্মি জানকে যে এত কথা শুনাচ্ছেন, আপনি হলে কী করতেন, হ্যাঁ ? এখন আমাদের ফুপাজানের যদি আর একটা শাদী করার মতলব হয় আপনি কি হাসিমুখে মেনে নিবেন ফুপি আম্মা ?
কী একটা বলতে গিয়ে হুমায়রা গুলশান আরা একটা বিষম খেলেন। তার কন্ঠে কথা আটকে গেল। এই অর্বাচীন বালকের কাছ থেকে এহেন আচানক আক্রমণ তিনি মোটেও প্রত্যাশা করেননি। কত কিছু বলতে গিয়ে কেবলই তার তোতলামির ভাব এসে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। তার ফর্সা গোল মুখটি গোলাপী ও লম্বা হয়ে গেল। গোলাম আহাদ মহিউদ্দিন কাদেরী তার হুমায়রা বাঘিনীর এই বেহাল দশা লক্ষ্য করে ছেলের প্রতি গর্জে উঠলেন-
– তুমি চুপ কর নালায়েক কাহিকা! তোমাকে ফোপর দালালী করতে কে বলেছে ?
– আপনিই তো ডেকেছিলেন আব্বা হুজুর! কথা বলতে না দিলে এখানে থেকে লাভ কি ?
বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল জমশের। এই কুপোকাত অবস্থা থেকে হুমায়রা সহেবা আর রিকভার করতে পারলেন না। তিনি নীরবে উঠে দাঁড়ালেন।
– আপনি কোথায় যান বুবুজান? ব্যস্ত হয়ে ওঠে গোলাম আহাদ।
– তোর বেয়াদপ বৌ ছেলেমেয়েকে তুই-ই সামলা খোকন। আমি আর এর মধ্যে নেই। বলেই গোলাম আহাদের দজ্জাল বাঘিনী রণে ভঙ্গ দিলেন।
– বুবুজান!
বড় অসহায় শোনালো গোলাম আহাদের বুবুজান ডাক খানি! হুমায়রা বাঘিনী লেজ গুটিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। ভেঙ্গে গেল হুমায়রা গুলশান আরা ছাহেবানের গোল টেবিল আলোচনা। গোলাম আহাদের গৌরকান্তি মুখমন্ডল ক্রমশঃ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। তার কপাল ঘেমে উঠল। একটি খুক খুক কাশির বেগ তাকে বড্ড জ্বালাতন করতে শুরু করল। গোলাম আহাদ যন্ত্রতাড়িতের মত ঘর বারান্দা উঠোন সর্বত্র চক্রাকারে পায়চারী করে চলেছেন। খুক খুক কাশিটি নাছোড়বান্দা মাছির মত সেই যে পিছু নিয়েছে কিছুতেই ছাড়ছে না। অধিক মাত্রায় উত্তেজনা দুঃখ বেদনা হতাশা কিংবা নিবিড় আনন্দের মুহূর্তে কখনো কখনো গোলাম আহাদের এহেন কাশির বেগ প্রায় বিনা নোটিসে এসে হাজির হয়। এর চিৎকিসা অবশ্য নাসিমা আক্তারের অজানা নয়। অন্য সময় হলে এখন তিনি গৃহ পরিচারক আজগর আলীকে ডেকে পাঠাতেন। আজগর আলী প্রথমে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে আনত। একটি চেয়োরে বসে গোলাম আহাদ ছপ ছপ শব্দ করে লেবুর শরবত পান করতেন। আজগর আলী একটি ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছে দিত আর হাত পাখা দিয়ে মাথায় জোরে জোরে হাওয়া করত। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতেন। আজকে এখন নাসিমা আক্তার এসবের কিছুই করলেন না। এই সময় আজগর আলী কী কাজে ঘরে ঢুকে গোলাম আহাদের দিকে তাকিয়েই সোৎসাহে জানতে চাইল-
– আব্বা হুজুরের দেখি কাশির আলামতটি ফিরে এসেছে। আব্বা হুজুরের জন্য লেবুর শরবত করে আনবো আম্মিজান ?
– ভাগ হারামজাদা কাহিকা!
নাসিমা আক্তার কিছু বলার আগেই গোলাম আহাদ গর্জে উঠলেন। আজগর আলী জ্বে আব্বা হুজুর বলে নির্বিকারে অন্য ঘরে চলে গেল। অতঃপর গোলাম আহাদ দুইদিন জ্ব্ররে ভুগলেন। তৃতীয় দিন একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন। চতুর্থ দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি নিখোঁজ হয়ে গেলেন। চতুর্দিকে অনেক খোঁজ খবর করেও গোলাম আহাদেও কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। তবে তিনি যেমন ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ, সবাই ধরে নিলো তিনি বহাল তবিয়তেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছেন। এই আত্মগোপনের উপাখ্যান নাসিমা আক্তারের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টির অপকৌশল বই কিছুই নয়। নাসিমা আক্তারও মনের সাথে বুঝাপড়া করে ফেলেছেন। তিনি বুঝে নিয়েছেন তার জন্য গোলাম আহাদের একদার সেই উত্তাল ভালবাসার কিছুই আর আজ অবশিষ্ট নেই। সংসার বৈতরণী পাড়ি দিতে দিতে নাসিমা আক্তাররূপী শুভ্র পালে গোলাম আহাদ নামক ঝড়ো হাওয়ার দাপাদাপি কবে মিইয়ে গেছে তা তিনি একটুও টের পাননি। নাসিমা আক্তার একদিন ছেলেদের ডেকে বলে দিলেন-
– তোদের বাপকে ঘরে ফিরে আসতে বল । জানিয়ে দে উনি যা খুশি করুন তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। পরের দিনই দৈনিক রঙ্গিন ভোরের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ব্লক করে একটি বিজ্ঞাপন বেরুলো-
আব্বা হুজুর ! আপনার দ্বিতীয় বিবাহে আম্মিজান সম্মত আছেন। আপনি যেখানেই থাকুন সত্বর গৃহে প্রত্যাবর্তন করুন। আপনার কুশল সংবাদের জন্য আমরা সবিশেষ চিন্তিত আছি।
ইতি
সমশের আবেদ মহিউদ্দিন কাদেরী
৭/৩, উত্তর শাহজাহানপুর, ঢাকা
ঠিক তার পরের দিনই গোলাম আহাদের ইয়ার বন্ধুরা টেলিফোনে জানালেন তিনি মরক্কোর রাবাতে তার বন্ধু আবদুর রহমান আল কাহতাগনির গৃহে অবস্থান করছেন। এবং শীঘ্রই তিনি ঢাকায় ফিরবেন। ঢাকায় ফিওে গোলাম আহাদ নির্বিবাদে বিবাহের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। কন্যাপক্ষকে গোলাম আহাদ নিশ্চিত করেছেন এই বিাবহ সংগঠনে তাদের তরফে একটি কানাকড়িও খরচ করার প্রয়োজন হবে না। যাবতীয় খরচপাতি স্বয়ং গোলাম আহাদই বহন করবেন। তদুপরি আছে মেহেরবানুর লোভী পিতার মুখিয়ে থাকা পকেটের জন্য বৃহৎ অংকের সওগাত। কথা আছে নব বিবাহিত স্ত্রীর প্রতি উপঢৌকন হিসেবে বিবাহের মজলিসেই গোলাম আহাদ মেহেরবানুর নামে তার লালমাটিয়ার বাড়িখানি রেজিস্ট্রি করে দেবেন। প্রাক বিবাহ দহরম মহরম বেশ জমে উঠল দুই পক্ষে। ঘন ঘন এবাড়ি-ওবাড়ি আসা যাওয়া দাওয়াত নিমন্ত্রন চলল পুরোদমে। নাসিমা আক্তার অবশ্য এসব থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেই রাখলেন। বিবাহের শুভদিন ধার্য হয়েছে আগামী সতেরই রবিউল-সানি বৃহস্পতিবার দিবাগত রজনী আট ঘটিকা। এরই মাঝে নাসিমা আক্তার একদিন কৌতূহলের বশে চলে এলেন লালমাটিয়ায়। নতুন সাজে সাজছে গোলাম আহাদের লালমাটিয়ার বাড়িখানি। তিন মাসের ভাড়া ছাড় দিয়ে বিদেয় করা হয়েছে অনেক বছরের পুরানো ভাড়াটিয়াদের। পুরানো খসে পড়া মাটির দেয়াল ভেঙ্গে নির্মিত হয়েছে ইটের উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের উপরে সংস্থাপিত হয়েছে ভাঙ্গা কাচের বেড়ি বাঁধ। বসেছে প্রশস্ত লোহার গেট। গেটের দুই পাটিতে স্থাপিত হয়েছে মীরপুরের প্রখ্যাত রহিম মিস্ত্রীর তৈরি ধাতব জোড়া হরিণ। বাড়ির নতুন নামকরণ করা হয়েছে মৃগয়া! এই মৃগয়া নামক উপবনে গোলাম আহাদ মহিউদ্দিন কাদেরী আগামী সতেরই রবিউস-সানি রোজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রজনী বাদ আট ঘটিকায় মেহেরবানু নামক এক মৃগ শিশুর নিধন যজ্ঞ সম্পন্ন করবেন। ঘরের ভিতরের দেয়ালে লাগানো হয়েছে কচি কলাপাতা রংয়ের ডিস্টেম্পার। বৃহদাকৃতি শয়ন কক্ষের লাগোয়া নির্মিত হয়েছে একটি নতুন গোসলখানা । শয়ন কক্ষের মাঝখানে বসেছে সেগুন কাঠের কারুকার্য খচিত উঁচু পালংক। আরও এসেছে ড্রেসিং টেবিল আলনা আলমারী ফ্রিজ ও রঙ্গিন টেলিভিশন। প্রক্ষালন কক্ষে সংযোজিত হয়েছে মসৃণ আরামপ্রদ গোসলের নিমিত্ত ঝকঝকে রূপালী ঝর্ণা কল। নিশ্চিত করা হয়েছে পর্যাপ্ত উষ্ণ জলের সরবরাহ। মেহেরবানুর নতুন সংসারের নিটোল আয়োজনে কোন ফাঁক রখেননি গোলাম আহাদ।
নাসিমা আক্তার এতক্ষনে ঘুরে ঘুরে সমস্ত বাড়িখানা দেখছিলেন। শোবার ঘরে ঢুকে পালংকের দিকে তাকিয়েই তিনি কর্মরত মিস্ত্রিদেও ডেকে পাঠালেন। নির্দেশ দিলেন এই পালংকের পায়া যেন কেটে ছোট করে ফেলা হয়। এক ফুটের বেশি যেন একটুও নয়। বললেন এত উঁচু পালংকে গোলাম আহাদ শুতে পারবেন না। ওনাকে রাতে বোবায় ধরে। বোবায় ধরলে ঘুমের মধ্যে গোঁ গোঁ করতে করতে উনি প্রায়ই খাট থেকে পড়ে যান। খাট এত উঁচু হলে পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙ্গে এই বয়সে তিনি ঝামেলা বাঁধাবেন।
নাসিমা আক্তারদের ঘরের কাছে একটি রিক্সা এস থামল। রিক্সা থেকে নেমে এলো অপূর্ব রূপসী এক তরুণী। সারা মুখে মিষ্টি হাসির পশরা সাজিয়ে মেয়েটি বলল-
-আমি মেহেরবানু। আপনার সাথে দেখা করতে এলাম আপা!
নাসিমা আক্তার যেন চকিতে চন্দ্রাহত। মুগ্ধ চোখে অবলোকন করে চলেছেন মেহেরবানুকে। এতো সুন্দরও মানুষ হয়! হালকা গোলাপী ডিম্বাকৃতি মুখাবয়ব জুড়ে যেন কোন নিপুণ শিল্পী পরম যত্নে বসিয়ে দিয়েছে একজোড়া স্বপ্নীল চোখ। ধনুক বাঁকা সুচারু যুগল ভ্রূ। দীর্ঘ টিকালো নাসিকা। ফিনফিনে পাতলা ঠোঁটের বাঁকে বাঁকে যেন পূর্ণিমার জোসনা মাখানো। নাসিমা আক্তার ভাবলেন এই অনুপম রূপসী মেহেরবানু বুঝিবা মানুষ নয়। শিল্পীর আঁকা পটের ছবি। এখনই বুঝি পরম আদরে দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া যায়। নাসিমা আক্তার ভাবলেন এই ইলিশ আঁকা চোখের হেলা ফেলার একটুখানি ঠার ঠমক শুধু দুর্বল চিত্ত গোলাম আহাদ কেন পৃথিবীর তাবৎ পুরুষকে মুহূর্তে ভূপাতিত করে দিতে সক্ষম। এই মেহেরবানুতে ধাবমান গোলাম আহাদের অবশ্যম্ভাবী উল্কাপাত রোধে কার সাধ্যি ? নাসিমা আক্তার তখনও মুগ্ধ চোখে অপলক অবলোকন করে চলেছেন মেহেরবানুকে। হেসে ফেলল মেহেরবানু-
– কি আপা! বসতে বলবেন না ? নাসিমা আক্তার একটু লজ্জা পেলেন।
– হ্যাঁ হ্যাঁ এসো মেহেরবানু! বোসো।
বলে তিনি মেহেরবুনুকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। মেহেরবানু হালকা পায়ে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ালো, এটা সেটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল ছোট্ট মেয়েটির মত।
– ইস কী যে সুন্দর আপনাদের বাড়িটা আপা! আমার খুব ভাল লেগেছে। দুলাভাই কোথায গেছে আপা ?
নাসিমা আক্তার বলতে চাইলেন খুব তো মজেছিস অভাগী! শরীরে এই রূপের পশরা আর মনের মধ্যে দুঃসহ জ্বালা নিয়ে সারা জীবন তো জ্বলে পুড়ে মরবিরে পোড়ামুখী। গোলাম আহাদের পৌরুষের দৌড় তো তার জানা আছে। ক‘দিন খাবলা-খাবলি করে শেষে নেতিয়ে যাবে দু‘দিনেই। তারপর এই রূপের ভার তুই বইবি কেমন করে ? নাসিমা আক্তারের একবার মনে হলো সাবধান করে দেন এই অবুঝ বালিকাকে। পর মুহূর্তেই তিনি ভাবলেন, ধূর! এসব কথা কি কাওকে বলা যায় ? না বলা উচিৎ ?
বেশিক্ষণ বসলো না মেহেরবানু।
– দুলাভাইকে বলবেন আপা, আমি এসেছিলাম। বলে গেটের পাশে অপেক্ষমান রিক্সার দিকে এগিয়ে গেল। কী ভেবে আবার ফিরে এলো নাসিমা আক্তারের খুব কাছটিতে। আলতো করে নাসিমা আক্তারের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মেহেরবানু। তারপর নাসিমা আক্তারের পায়ের কাছটিতে বসে পড়ে টুক করে একটা কদমবুসি করেই দ্রুতহেঁটে রিক্সায় গিয়ে বসলো। মেহেরবনুর এই অদ্ভূত আচরণে নাসিমা আক্তার স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। কেন এসেছিলয় মেহেরবানু? এ কি নাসিমা আক্তারের অনুমোদন প্রার্থনা ? নাকি গোলাম আহাদের প্রশ্রয় পুষ্ট ঔদ্ধত্যের ঘোষণা ? কেমন যেন দিশেহারা বোধ করেন নাসিমা আক্তার।
এরই মাঝে একদিন দুপুরে মেহেবানুদের বাসার বুয়া পাশের বাড়ি থেকে গোপনে টেলিফোন করে নাসিমা আক্তারকে একটি অবিশ্বাস্য সংবাদ দিল। মেহেরবানু বিয়েতে বেঁকে বসেছে। মেহেরবানুর পিতা তাকে অমানুষিকভাবে প্রহার করছে। মেয়েকে এই বলে শাসিয়েছে, বিয়েতে রাজী না হলে তাকে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে ফালা ফালা করে কেটে ফেলা হবে। প্রহারের ধকলে মেহেরবানুর গায়ে জ্বর এসে গেছে। তার গায়ে মুখে কালসিটে পড়ে গেছে। বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে সে। জ্বরের ঘোরে আম্মাগো আম্মাগো বলে প্রলাপ বকছে। নাসিমা আক্তারের স্নেহময়ী মাতৃ হৃদয় হু হু করে ওঠে। নীরবে তিনি আঁচলে অশ্রু মুছেন। ইচ্ছে হয় এখনই ছুটে যান মেহেরবানুদের বাড়ি। মাতৃহীন এই অভাগী মেয়েটিকে একটিবার একটু আদর করে আসেন। চোখে মুখে বুলিয়ে দেন কোমল স্নেহের পরশ। মেহেরবানুর জন্য এক অসহনীয় মমত্ববোধে নাসিমা আক্তার দিশেহারা হয়ে পড়েন।
পরের কয়েকদিন ধরে গোলাম আহাদকে খুব বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মনে হলো। ঘরে ফেরার কি বাইরে বেরোবার কোন সময় অসময় নেই। মন মেজাজ বিগড়েই আছে সারাক্ষণ। কেউ তার কাছে পাশে যাবার সাহস পাচ্ছে না। তার এই তিরিক্ষি মেজাজের সবটা লোড এসে পড়েছে শেষ পর্যন্ত আজগর আলীর ওপর। গোলাম আহাদের ধমক আর হয়রানিতে আজগর আলীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। আজগর আলী একবার এসে গোপনে নালিশও জানিয়ে গেল নাসিমা আক্তারের কাছে।
– আব্বা হুজুরের দিগদারি আর সহ্য হয় না গো আম্মিজান!
নাসিমা আক্তার বুঝতে পারছিলেন গোলাম আহাদের এই উদ্ভ্রান্ত আচরণের পটভুমিতে রয়েছে মেহেরবানুর সাথে বিবাহের বর্তমান অনিশ্চয়তা। কিন্তু তিনি এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখাই সমীচীন মনে করলেন।
অতঃপর একদিন অকস্মাৎ গোলাম আহাদের মুড বদলে গেল। বড় প্রশান্ত ও প্রফুল্ল চিত্ত তিনি আজ। সব কিছুর সাথেই নির্বিবাদ ও ধাতস্থ যেন। সারাদিন ধরে প্রসন্ন মনে ঘরে বাইরে কত কী করে বেড়ালেন। বাড়ির সামনের চিলতে বাগানে যত্ন করে একটি মোরগ ফুলের চারা লাগালেন। টুক টুক করে পেরেক ঠুকে দেয়ালে টাঙ্গালেন একটি প্রমাণ সাইজের মাছরাঙ্গা পাখির ছবি। ছবিটির দিকে অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক সময় উদাস বিষণ্ণ কন্ঠে বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন-
– কোথায় কোথায় উডে যাও হে শোভন দর্শন বর্ণালী পক্ষী ?
গোলাম আহাদের এই ভাবান্তরে নাসিমা আক্তার মনে করলেন বিবাহ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তাটুকু বোধহয় কেটে গেছে তাহলে। মেহেরবানু কি বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে ?
– নাসিমা আক্তার সাহেবান! আজ আপনার শরীলটা ভাল আছে তো ?
হঠাৎ গোলাম আহাদ অন্য ঘর থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন নাসিমা আক্তারকে।
মানুষটার আদিখ্যেতা দেখে বাঁচিনে! হঠাৎ শরীলের খবরে এত এত উৎসাহ! মনে মনে ভাবলেন নাসিমা আক্তার। আড়াল থেকে আড়চোখে দেখলেন গোলাম আহাদের অবয়বে একটি দুষ্টু হাসি খেলা করছে। নাসিমা আক্তার মনে মনে বললেন, আমি তো ভালই আছি। আপনিই এবার গা গতর ঠিকঠাক করেন গিয়ে। সামনে তো আপনার জোয়ানীর পরীক্ষা আছে! ভেবেই তিনি জিভ কাটলেন। ছিঃ ! কি এসব নোংরা কথা ভাবছেন তিনি! নাসিমা আক্তারের মানস চোখে গোলাম আহাদ আর মেহেরবানুর প্রগাঢ় প্রণয় লীলার একটি কাল্পনিক ছবি ভেসে উঠল। শত চেষ্টাতেও তিনি মন থেকে সেই ছবিটি সরাতে পারলেন না। তার হৃদয় মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইল। দ্রুত পায়ে তিনি প্রক্ষালন কক্ষে গিয়ে ঢুকলেন। ওজু করলেন। দু রাকাত নফল নামাজ আদায় না করা পর্যন্ত এই বিপন্ন বিপর্যস্ত মন শান্ত হবে না তার। গোলাম আহাদ এক সময় নাসিমা আক্তারকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন-
– সমশেরের আম্মিজান! আগামী শুক্রবার আমরা লালমাটিয়ার বাড়িতে মুভ করছি। এখন থেকে ছেলেরা এই বাড়িতে থাকবে। আর আমরা থাকবো লালমাটিয়ায়।
– আমাকে নিয়ে আর টানাটানি কেন ? আমার ছেলেদের সাথে আমি এই বাড়িতেই থাকব। মেহেরবানুকে নিয়ে আপনিই থাকেন লালমাটিয়ায়।
গোলাম আহাদের চোখে মুখে বিটকেলে হাসি। তিনি নাসিমা আক্তারের খুব কাছে গিয়ে বসলেন। নাসিমা আক্তারের একটি হাত তুলে নিলেন নিজের হাতে। নাসিমা আক্তার খুব ধীরে হাতখানি সরিয়ে নিলেন।
– এসব এখন থাক সমশেরের আব্বু। দু‘দিন পরই তো আপনার শাদী।
নাসিমা আক্তারের কন্ঠে ফুটে ওঠে কিশোরীর অভিমান। গোলাম আহাদ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ফিচফিচিয়ে হাসলেন। তারপর খুব ঘন হয়ে নাসিমা আক্তারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
– আরে ধুর। কোথায় মেহেরবানু? কিসের শাদী?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress