ল্যাটিন আমেরিকান কবিতার রূপরেখা
(এক).
তারাই আজকের ল্যাটিন আমেরিকানদের পূর্বপুরুষ, যারা আজ থেকে বিশ হাজার বছর আগে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত যে-জনগোষ্ঠী সাইবেরিয়া থেকে আলাস্কা, উত্তর ও মধ্য আমেরিকা, পরে পানামা খাল পার হয়ে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তারা দক্ষিণ আমেরিকার শেষ অবধি পৌঁছায় আজ থেকে প্রায় চার-পাঁচ হাজার বছর আগে। আর ১৪৯২-১৫০৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কলম্বাসের চার বার স্পেন-আমেরিকা যাতায়াতের মধ্য দিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার শুরু হয় ঔপনিবেশিকায়ন। আজ ল্যাটিন আমেরিকা বলতে যে বিশাল ভূখন্ডকে বোঝায় তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলো, মেক্সিকো, ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলো, পর্তুগিীজ-ভাষী ব্রাজিল ও স্প্যেনিশ আমেরিকা। স্প্যানীয় ও পর্তুগীজদের তিনশো বছরের শাসন এখানে মহৎ কোন সাহিত্যর সৃষ্টি হয়নি। প্রথম ছাপার যন্ত্র চালু হয় ল্যাটিন আমেরিকায় ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মেক্সিকো-সিটিতে। একজন ব্রাজিলীয়র লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে। তিনশো বছরে সেখানে কোনো যথার্থ উপন্যাস লেখা হয়নি। নাটকের অবস্থাও সে’রকম ছিল। তবে সাদামাঠা গদ্য-কাহিনী প্রচলিত ছিল। কবিতার অবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে ভালো। মেক্সিকো শহরে এক কবিতা প্রতিযোগিতায় তিনশোর মতো কবি অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৮২৬ থেকে ’৭০ পর্যন্ত রোমান্টিক ধারা, এরপর বাস্তববাদী ও প্রকৃতিবাদী ধারার মধ্য দিয়ে ১৮৮৮ থেকে ১৯১০-এর দিকে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য আধুনিকতায় পৌঁছায়। ১৮৮৫ সালে নিকারাগুয়ার রুবেন দারিও, কিউবার হোসে মার্তি প্রমুখ কবির নেতৃত্বে ফরাসি শিল্প-সাহিত্যপ্রভাবিত ‘মদের্নিসমো’ নামের এক আধুনিক কাব্য-ধারার গোড়াপত্তন ঘটে। আবার এ-ধারার বিপরীতে একটি শক্তিশালী সংরক্ষণবাদী ধারারও আবির্ভাব ঘটে, যারা স্বদেশ, দেশের মানুষ ও ঐতিহ্যকে কবিতার বিষয় করেছিলেন। কবিতার ব্যাপকার্থে সাহিত্যের এই আন্তর্জাতিকতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী ধারার বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে, বাস্তবতায় আবার জন্ম নিল এক প্রগাঢ় নিরীক্ষাভিত্তিক ‘avant grade’ বা ‘অগ্রগামী সাহিত্য’, যা পূর্বোক্ত দু’ধারার সংশ্লেষণও বটে। ‘মদের্নিসমো’-পরবর্তী বিশ শতকের পাঁচ বিখ্যাত কবি হলেন গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, হোর্হে লুইস বোর্হেস, কার্লোস দ্রামন্দ দে আন্দ্রাদে, পাবলো নেরুদা এবং অক্টাভিও পাস। তাঁদের মধ্যে মিস্ত্রাল, নেরুদা ও অক্টাভিও পাস নোবেল পেয়েছেন। তাঁদের পাশাপাশি আরও অনেকের কবিতা আজ বিশ্ব-কবিতার অংশ। তেমন কিছু কবিতার অনুবাদ পাঠকদের জন্যে –
রুবেন দারিও (১৮৬৭-১৯১৬)(নিকারাগুয়া)
আমরা যখন স্প্যানিশ-আমেরিকান কবিতা নিয়ে যখন কথা বলি, তখন প্রথম যে নামটি প্রকাশ পায় তিনি নিঃসন্দেহে রুবেন দারিও , যার সাথে আধুনিকতা তথা স্প্যানিশ-আমেরিকান কবিতার শিকড়ের যোগাযেগ রয়েছে।
অমোঘ নিয়তি
বৃক্ষেরা সুখী কারণ তারা নিশ্চেতন বললেই চলে কঠিন শিলা সংবেদনহীন বলে আরো বেশি সুখীবেঁচে থাকার মতো এতো বিপুল যন্ত্রণা কিছুতে নেইসজ্ঞান জীবনের মতো কোনো বোঝা এতো ভারী নয়।
কী যে হবো জানা নেই, জ্ঞান নেই, এটা সেটা ত্রুটিযা আছি তাতেই ভয়, যা হবে আতংক তার…কালকেই পটল তোলার সুনিশ্চিত বিভীষিকা,আজীবন কষ্ট পাওয়া, অন্ধকার পার হওয়াপার হওয়া যা জানি না, যা সন্দেহও করি নাএবং যে মাংস শীতল আঙুরগুচ্ছের সাথে আমাদের টানে,যে কবর শেষকৃত্যের শুচিজলের অপেক্ষায় থাকেএবং যে আমরা জানি না কোথায় যাবোএবং জানি না কোথা থেকে আমরা এসেছি!…
হোসে মারিয়া ইগুরে (১৮৭৪-১৯৪২)(পেরু)পরলোকগতরা
বিষণ্ণ আকাশের নিচেবরফাবৃত পরলোকগতরাঅনিঃশেষ বেদনার পথ ধরে হাঁটে।
নিশ্চুপ জ্যোতির্ময়তায়তাদের দেহাবয়ব হেঁটে চলেএবং মৃতদের দেশ থেকে ওরাউইলো ও শ্বেতদূর্বাফুলের কাছেহিমশীতলতা পাঠায়।
নির্জন সড়কে ওরাধীরে ধীরে সফেদ আলোর রূপ নেয়তাদের বাসনা জাগে, আহা, বিগত উৎসবের দিনগুলো,ভালোবাসাবাসির সেই যাপিত জীবনগুলো যদি ফিরে পাওয়া যেতো।
হাঁটতে হাঁটতে মৃতেরাআকাশ সন্ধান করে;নিগূঢ় চিন্তায় মগ্ন তাদের বিষণ্ণ অবয়বচোখ রাখে কেবল কাস্তের উপর।
কুয়াশার নিঃসঙ্গ রাতে,কারাগারে এবং ভয়ংকর আতংকেসুদূরের পথিকেরা অন্তহীন পথ ধরেহাঁটে আর হাঁটে।
গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল(১৮৮৯-১৯৫৭)(চিলি)শিল্পীর জন্যে দশ আদেশনামা –
১). তুমি অবশ্যই সুন্দরকে ভালবাসবে; সুন্দর হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের ওপর ঈশ্বরের ছায়া।২). ঈশ্বরহীন কোনো শিল্প নেই। তুমি স্রষ্টাকে ভালো না বাসলেও তাঁর প্রতিরূপ সৃষ্টি করে তাঁর সাক্ষী হতে পারো।৩). তুমি সুন্দরের স্রষ্টা হবে, কিন্তু তোমার সৃষ্ট সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ভোগের জন্যে নয় আত্মার পুষ্টির জন্যে নিবেদিত হোক।৪). কখনো সুন্দরকে বিলাসিতা ও অহংকারের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করো না, তাকে বরং আধ্যাত্ম নিবেদনের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করো।৫). কখনো আনন্দোৎসব বা মেলায় সুন্দরকে খুঁজতে যেও না, সেখানে তোমার শিল্পকেও উৎসর্গ করো না, কারণ সৌন্দর্য কৌমার্যও বটে এবং তাকে আনন্দোৎসব বা মেলায় পাওয়া যায় না।৬). সুন্দরের উত্থান হবে তোমার অন্তর থেকে সংগীতের রূপ ধরে এবং তুমি তাতে প্রথম পরিশুদ্ধ হবে।৭). তুমি সুন্দরকে এমনভাবে সৃষ্টি করো তা যেন করুণার প্রতিমূর্তি হয় এবং মানুষের হৃদয়কে সমবেদনায় ভরে দেয়।৮). মা যেমন নিজের রক্ত থেকে, অন্তর থেকে সন্তানের জন্ম দেয়, তুমিও শিল্পের জন্ম দেবে সেভাবে।৯). সুন্দরকে ঘুম-পাড়ানো আফিমের মতো নিও না; সুন্দর হবে কড়া মদের মতো, যা তোমাকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করে। তুমি যদি যথার্থ পুরুষ বা যথার্থ নারী হতে ব্যর্থ হও, তুমি শিল্পী হতেও ব্যর্থ হবে।১০). প্রতিটি সৃজনকর্মের শেষে নিজেকে বিনয়ী করো কারণ তোমার সৃষ্টি কখনো তোমার স্বপ্নের মতো মহৎ নয় এবং তা অবশ্যই ঈশ্বরের সবচেয়ে অসাধারণ স্বপ্ন প্রকৃতির চাইতে নিকৃষ্ট।
হোর্হে লুইস বোর্হেস(১৮৯৯-১৯৮৬)(আর্জেন্টিনা)চার লাইনের পদ্য –
অন্যেরা গেছে মরে, কিন্তু সে তো অতীতের কথা যে অতীত মৃত্যুর জন্যে অতিশয় অনুকূল কাল ছিল (সে কথা কে না জানে)।
এটা কি সম্ভব যে আমাকেও, যে কি না ইয়াকুব আল মনসুরের প্রজা,তাবৎ গোলাপ ও অ্যারিস্টটলের মতো ওভাবে মরতে হবে?
কার্লোস দ্রামন্দ দে আন্দ্রাদে(১৯০২-৮৭)(ব্রাজিল)নিজেকে হনন করো না
কার্লোস, শান্ত হও,তুমি যা দেখছো তা-ই ভালোবাসা :আজ কপালে যদি একটি চুমো থাকে তো আগামীকাল নেই,চুমু নেই পরশু রোববারেওএবং সোমবারে কী ঘটবেকেউ জানে না।
প্রতিরোধ কিংবাআত্মহনন সমান নিরর্থক,নিজেকে হনন করো না। নিজেকে হত্যা করো না।
তোমার যা কিছু আছে রেখে দাও বিয়ে ও বাসরের জন্যে,যদিও কেউ জানে না কখন সেসব আসবেবা আদৌ আসবে কি না।
ভালোবাসা, কার্লোস, পার্থিব ভালোবাসাএককালে তোমার নিশিকুটুম ছিল,এখন তোমার সব নাড়িভুঁড়ি একাট্টা হয়েঅনির্বচনীয় কোলাহল,প্রার্থনাও হারমোনিয়ামের সুর তুলছে,সন্তরা ক্রুশ আঁকছেন বুকে,শ্রেয় সাবানের শোরগোল তুলছে বিজ্ঞাপন,কেন কী কারণে এতোসব কোলাহলকেউ জানে না।
ইত্যাবসরে তুমি তোমার পথেবিষণ্ণ, উল্লম্ব যেতে থাকো।তুমি তালগাছ, তোমার চিৎকারযা কেউ কখনো শোনেনিথিয়েটারে, সব বাতি নিভে গেলে।
বলা হয়ে থাকে, অন্ধকারে ভালোবাসা, না,দিবালোকে ভালোবাসা সবসময় দুঃখদায়ক,কার্লোস, বালক আমার,তুমি কিন্তু এ কথা কাউকে বলো না,এ কথা কেউ জানে না এবং জানবেও না।
পাবলো নেরুদা(১৯০৪-৭৩)(চিলি)———————- নেরুদা শুধুমাত্র লাতিন আমেরিকা নয়, বিশ্ব কবিতার ইতিহাসে অন্যতম একটি নাম। শুধু আপনার কাজের নামকরণ করে “বিশটি প্রেমের কবিতা এবং একটি মরিয়া গান”, ১৯২৪ সালে প্রকাশিত, আমরা সবই বলছি … থেকে
” আপনি আমাকে শুনতেআমার কথাতারা মাঝে মাঝে পাতলা হয়ে যায়সমুদ্র সৈকতে সিগলগুলির পায়ের ছাপগুলির মতো।
নেকলেস, মাতাল রটলসনেকেআঙুরের মতো নরম তোমার হাতের জন্য।
এবং আমি আমার কথাগুলি দূর থেকে দেখি।আমার চেয়েও বেশি তারা আপনার।তারা আইভির মতো আমার পুরানো ব্যথায় চড়ে।
তারা এইভাবে স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে আরোহণ করে।এই রক্তাক্ত গেমটির জন্য আপনিই দোষী।
তারা আমার অন্ধকার লায়ার থেকে পালাচ্ছে।আপনি সব পূরণ করুন, আপনি সবকিছু পূরণ করুন।
আপনার আগে তারা যে একাকীত্বকে দখল করে রেখেছে,তারা আপনার চেয়ে আমার দুঃখের প্রতিবেশী অভ্যস্ত।এখন আমি তাদের বলতে চাই যা আমি আপনাকে বলতে চাইযাতে আপনি আমার কথা শুনতে চান তেমনই আপনি তাদের শুনতে পান।
ইচ্ছের বাতাস এখনও তাদের টেনে নিয়ে যায়।স্বপ্নের হারিকেনগুলি এখনও মাঝে মধ্যে এগুলিকে নক করে।আপনি আমার কণ্ঠে অন্য কণ্ঠস্বর শুনতে পান hearপুরানো মুখের অশ্রু, পুরনো বিনতির রক্ত।আমাকে ভালোবাসো, সঙ্গী। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমাকে অনুসরণ করআমাকে অনুসরণ করুন, অংশীদার, যে যন্ত্রণার তরঙ্গে।
তবে আমার কথাগুলি আপনার ভালবাসায় দাগ পড়ছে।আপনি সবকিছু দখল, আপনি সবকিছু দখল।
আমি তাদের সব থেকে একটি অনন্ত নেকলেস তৈরি করছিআপনার সাদা হাতের জন্য, আঙ্গুরের মতো নরম।
মুঠোবন্দী মন
আরো একটি গোধূলি এসে গেল।চরাচরজুড়ে নীল রাত নামছে,অথচ সন্ধ্যায় আমাদের হাত-ধরাধরি হাঁটাই হলো না।
আমি জানালা দিয়ে দেখলামঅনেক দূরের পাহাড়চূড়ায়সূর্যাস্তের উৎসব বসেছে।
কখনো কখনো আমার হাতের তালুতেমুদ্রার মতোএকটুকরো সূর্য পুড়তে থাকে।মনটা বিষণ্ণ –তোমার কথা খুব মনে পড়ছিলযে মনের কথা তুমি ছাড়া বেশি কে জানে!
তুমি কোথায় ছিলে তখন?সাথে আর কে ছিল?কী কথা তাহার সাথে?যখন মনটা খুব খুব খারাপ থাকেটের পাই, তুমি অ-নে-ক-দূ-রে,
বলো তো তখন হঠাৎ সব ভালোবাসা আমাকে পেয়ে বসে কেন?
গোধূলি এলে আমার পড়ার বন্ধ বইটা হাত থেকে পিছলে পড়ে,চোট পাওয়া কুকুরের মতো আমার নীল সোয়েটারটিআমারই পায়ের কাছে গড়াগড়ি যায়।
প্রতিটি দিন সন্ধ্যা এলেতুমি সন্ধ্যাকে পেছনে ফেলেস্মৃতির মূর্তি মুছে ক্রমশ এগোতে থাকো গোধূলি-দিকে।
পরাবাস্তববাদী কবিতা—————————-কার্লোস ওকেন্দো দে আমাত(১৯০৫-৩৬)(পেরু)হস্তী ও সংগীতবিষয়ক
অস্থিরোগাক্রান্ত গজকূল শুরুর দিকে অনবরতআপেলে রূপান্তরিত হবেকারণ বৈমানিকেরা ফুলের মতো বহ্নিমাননগর ভালোবাসেশীতকালে ওভারকোটের ভেতর বোনা হয়েছে সংগীতক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী ইশারা-ইঙ্গিতের উৎস তোমার মুখতোমার উচ্চারিত কথামালার চারপাশে উত্তপ্ত খেজুর বৃক্ষসহজ ভ্রমণের পথপঞ্জিসূর্যের সামনে প্রস্ফুটিত ভায়োলেটের মতো আমাকে গ্রহণ করো।
অক্টাভিও পাস(১৯১৪-৯৮)(মেক্সিকো)একটি অন্তর্গত বৃক্ষ
আমার মস্তিষ্কের ভেতর একটি বৃক্ষ বেড়ে ওঠে।একটি অন্তর্গত বৃক্ষ বেড়ে ওঠে।এর শেকড়গুলো শিরা,শাখা-প্রশাখা স্নায়ু,ঘন পত্রসমষ্টি এর ভাবনা।তুমি তাকালেই তাতে আগুন লাগে;রক্ত-কমলাএবংঅগ্নিশিখার ডালিমএর ছায়াফল।
দেহের রাতেদিনের আলো ফোটে।সেখানে, আমার মস্তিষ্কের ভেতরেবৃক্ষ কথা বলে।
আরো কাছে আসো – তুমি কি সেকথা শুনতে পাচ্ছো?
নিকানর পারা(১৯১৪- )(চিলি)মমি
একটি মমি তুষারের ওপর হাঁটেআরেকটি মমি বরফের ওপর হাঁটেআরেকটি মমি বালির ওপর হাঁটে।
একটি মমি তৃণভূমিতে হাঁটেদ্বিতীয়টি তার নারীর সঙ্গে যায়একটি মমি ফোনে কথা বলেনারী মমি আরশিতে মুখ দেখে।
একটি মমি (নারী) গুলি ছোড়েসকল মমি জায়গা বদল করেপ্রায় সকল মমিই সটকে পড়ে।
গুটিকয়েক টেবিল ঘেঁষে বসেকতেক মমি বিড়ি-সিগারেট সাধেএকটি মমি নাচের ভঙ্গি তোলে।
একটি মমি, বাকিদের চেয়ে বুড়ি,তার বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়ায়।
রোকে ডালটনরোকে ডালটন। জন্ম ১৯৩৫ সালে। লাতিন আমেরিকার-এল সালভাদরের-লড়াকু কম্যুনিস্ট কবি। ১৯৫৫ সালে নিজ দেশে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
কেবল তো শুরু
আমার সুহৃদু, এক সম্ভাব্য কবি,মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর হা-হুতাশকেএভাবে করলেন চিত্রায়িত:‘আমি তো বুর্জোয়ার কয়েদবন্দী,তা ছাড়া আমি আর কীই বা হতে পেরেছি।’
এদিকে মহান বের্টোল্ট ব্রেখট,কম্যুনিস্ট, জর্মন নাট্যকার ও কবি(পদবিক্রমটা ঠিক এমনি) লিখেছিলেন:‘ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অপরাধের তুলনায়ব্যাংক ডাকাতি তেমন কি আর মন্দ কাজ?’
এ থেকে আমি যে উপসংহার টানি, তা দাড়ায়:নিজেকে অতিক্রম করতে গিয়েযদি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীব্যাংক ডাকাতি করেই ফেলেতবে বলতে হবে সে তেমন কিছুই করেনিকেবল নিজেকে একশ’ বছরের ক্ষমাপাইয়ে দেওয়া ছাড়া।
গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল————————- গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল, তাঁর কবিতায় বাস্তবতা, দৈনন্দিন বাস্তবতা আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন এবং ঘনিষ্ঠতার আশ্রয় নিয়েছিলেন।গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের জন্ম ১৮৮৯ এ, চিলির ভিকুনায়। প্রকৃত নাম লুসিয়া গড়োই আলকাইয়াগা। তিনি লাতিন আমেরিকার প্রথম নোবেল বিজয়িনী। ব্যর্থ প্রেম এবং গভীর মাতৃত্বের অনুভব তাঁর কবিতার মূল প্রবাহ। পাবলো নেরুদা কৈশোরে তাঁর রচনা থেকে প্রেরণা খুঁজেছিলেন। ১৯৫৭ সালে এই বিদূষী নারীবাদী কবি ও প্রজ্ঞাময়ী শিক্ষাবিদের জীবনাবসান ঘটে।গ্যাব্রিয়েলা, যিনি ১৯৪৫ সালে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন “মৃত্যুর সনেটস”, তাঁর অন্যতম সেরা এবং উল্লেখযোগ্য কাজ। এটি দ্বারা অনুপ্রাণিত রোমেলিয়ো উরেটার আত্মহত্যা, তার পুরানো ভালবাসা। এবং প্রথম সনেট এরকম হয়:
১).
” পুরুষরা আপনাকে যে হিমশীতল কুলুঙ্গি দিয়েছিল তা থেকে,আমি তোমাকে নীচু এবং রৌদ্রোজ্জ্বল দেশে নামিয়ে দেব।এতে আমার ঘুমোতে হবে যে পুরুষরা জানত না,এবং আমাদের একই বালিশে স্বপ্ন দেখতে হবে।
আমি তোমাকে একটি দিয়ে রোদে পৃথিবীতে শুয়ে দেবঘুমন্ত ছেলের প্রতি মায়ের মিষ্টি,এবং পৃথিবীকে ক্র্যাডল কোমলতায় পরিণত হতে হবেআপনার শরীরে ব্যথা হওয়া শিশু হিসাবে
তারপর আমি ময়লা এবং গোলাপ ধুলা ছিটিয়ে দেব,এবং চাঁদের নীল ও হালকা ধুলায়হালকা অফেল বন্দী করা হবে।
আমি আমার সুন্দর প্রতিশোধ গেয়ে চলে যাব,কারণ সেই লুকানো সম্মানীর কাছে নং-এর হাতআপনার মুষ্টিমেয় হাড়গুলি বিতর্ক করতে নেমে আসবে!
২). ” গোধূলিআমি টের পাচ্ছি আমার হৃদয় গলে পড়ছেনরম মোমের মত গলে পড়ছেআমার শিরা উপশিরা তেলের মত ধীরে বহমানএবং একেবারেই মাতাল নয়,আমি ছুঁতে পারছি আমার অনুভবস্থির, প্রচ্ছন্ন, সোনার হরিণের মতো।
জোসে মার্টি——————- কিউবার জোসে মার্তির একটি কবিতা ছিল আন্তরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে, যা সরল এবং প্রতিদিনের মাধ্যমে একটি আনুষ্ঠানিক উপায়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কবি নিজেকে চিহ্নিত করেন “সরল আয়াত” তাঁর কবিতা দিয়ে, কারণ এতে তিনি নিজের আত্মাকে যেমন রূপ দিয়েছিলেন তেমন আকার দিয়েছেন। এই আয়াতগুলি লেখার সময় তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন: বৈষম্যমূলক এবং বিপরীত উপাদানগুলির দ্বারা গঠিত একটি ইউনিট, যখন নাম লেখায় তখন ঘটে “হরিণের দুর্বলতা” সামনে “ইস্পাত শক্তি”। এটি সংহতি ও বিরক্তি বিলোপের মতো অনুভূতিগুলিও প্রতিফলিত করে:
” একটি সাদা গোলাপ চাষ করুনজানুয়ারীর মতো জুনেওসৎ বন্ধুর জন্যকে আমাকে তার স্পষ্ট হাত দেয়।
এবং নিষ্ঠুরতার জন্য যা আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়আমি যে হৃদয়ের সাথে থাকি,থিসল বা নেটপাল চাষ;আমি সাদা গোলাপ বৃদ্ধি।”
চিলিনিকানোর পাররা জন্ম ১৯১৪। পাবলো নেরুদার পর চিলির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আশ্চর্য শক্তিশালী কবি নিকানোর পাররা। প্রচলিত লোকগীতির ধারাকেই কথ্য ভাষার সাথে মিশিয়ে শ্লেষাত্মক দুর্লভ কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর “কবিতা ও বিরুদ্ধ কবিতা” একটি উল্লেখ্য কাব্যসংকলন। কবি ২০১৪ সালে শতায়ু পূর্ণ করেছেন।
” আমার বলা কথাগুলো আমি ফিরিয়ে নিতে চাইচলে যাবার আগেআমার একটি প্রত্যাশা পূরণের বাসনা আছে।শ্রদ্ধেয় পাঠকআমার বইগুলো পুড়িয়ে ফেলুন।আমি যা বলতে চেয়েছিলাম এতে মোটেও তা নেইযদিও এসব রক্ত দিয়েই লেখা হয়েছিল,কিন্তু এগুলো তা নয়যা আমি বলতে চেয়েছিলাম।এরা কেউই আমার চেয়ে বেশী বিষাদ বহন করতে পারে না,কিন্তু আমি আমার ছায়ার কাছেই হেরে গেছি :আমার শব্দরা আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছেক্ষমা করুন পাঠক, প্রিয় পাঠকযদি আমি আপনাকেউষ্ণ আলিঙ্গনে বিদায় জানাতে না পারি,যদি আমি একটি বিষণ্ণ হাসি রেখেজোর করে বিদায় নিতে চাই।
হয়ত এই লেখাগুলোর সবটাই আমিতবু আমার শেষ কথাটুকু শুনুন :আমি ফিরিয়ে নিতে চাই আমার কথাগুলো।এক পৃথিবী বিষাদ নিয়ে বলাআমার কথাগুলো আমি ফিরিয়ে নিতে চাই।
এল সালভাদর
রোকে দালতোন—————————- রোকে দালতোনের জন্ম ১৯৩৫ সালে, সালভাদরের এক উচ্চবিত্ত পরিবারে। উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৬ তে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৫৯-৬০ এ কৃষক অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁর মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে স্বৈরাচারী একনায়ক সরকার। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ফাঁসির দিনেই সেই স্বৈরশাসকের পতন ঘটে, আর তিনি বেঁচে যান।১৯৬১ তে দেশত্যাগ করে মেক্সিকো চলে যান। এখান থেকেই তাঁর কাব্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটে। এরপর তিনি চলে যান কিউবা। এখানে এসে তিনি প্রচুর লেখালেখি করেন। এবং লাতিন আমেরিকার একজন অন্যতম প্রধান বিপ্লবী কবি হয়ে ওঠেন। কিউবা থেকে যান প্যারাগুয়ে, সেখানে তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতা অনেককে চমৎকৃত করে।
এরপর ১৯৬৫ তে ফিরে আসেন দেশে। যোগদেন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে। প্রথমে মার্ক্সবাদী – লেনিনবাদী দল তাঁকে সামরিক শাখায় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি। তিনি প্রমাণ করেন যে তিনি কবি হতে পারেন কিন্তু প্রয়োজনে বন্দুক ধরতেও পারেন।
সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। এবারেও ফাঁসির আদেশ হয় তাঁর। কিন্তু এবারেও অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ফাঁসির জন্য নির্ধারিত দিনের আগেই ভুমিকম্পে জেলের দেওয়াল ধসে পড়ে। তিনি পালিয়ে যান। সন্তের ছদ্মবেশে গোপনে আবার তাঁর কমরেডদের সাথে যোগাযোগ করেন।
কিন্তু অত্যন্ত বেদনার বিষয় হল, লাতিন আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী বিপ্লবী কবি, যাঁকে চে গুয়েভারার পরেই স্থান দেয় লাতিন বিশ্ব, তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৫ এর ১০ মে, বিপ্লবীদের মধ্যে চলা এক আন্তঃসংঘর্ষে।
” তোমাকেই চাই আমি তোমাকেইভালবাসা, এই জীবন চাওয়া পাওয়ার,মিষ্টি গন্ধের মতো, নীল আকাশের মতোজানুয়ারির সুন্দর প্রকৃতির রঙে উজ্জ্বল।আমার রক্ত ফুটছে টগবগ করেআমি চোখ জুড়িয়ে হাসছি,যদিও হাসিরা জানে এখানে অনেক অশ্রুকুঁড়ি আছে।আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবী সুন্দর, বড় বেশী সুন্দর,আর এই কবিতাও, রুটির মতোই সবার জন্য, সবার।
আমার শিরাপ্রবাহ আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, একেবারেই নয়,এ তো তাদেরই একতার ভেতরে বয়ে যাচ্ছেযারা সংগ্রাম করেছে জীবনের জন্যভালবাসার জন্য, ছোট ছোট চাওয়া পাওয়ার জন্য,সুন্দর প্রকৃতি আর রুটির জন্য।আর একটি কবিতার জন্য যা সবার, একান্তই সবার!
(১৯৯২).আমের খোসার নীচে লুকনো মাথার খুলি——————————————————-
মহিলাটি আতঙ্কের ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে বলছিলঃআর্মির লোকেরা এখানেই সবাইকে খুন করেছিল!কিন্তু কোথাও কোনও চাষীর লাশ ছিল নাকোনও সাদা ক্রস এমনকি বাড়িগুলিও উবে গিয়েছিল।ক্যামেরাগুলি অনবরত খচখচ করে ছবি তুলছিলনোটবুকগুলি ভরে যাচ্ছিল লাইনের পর লাইন শব্দেঅনেকে ফিসফিস করে বলছিল এই গণহত্যার বিষয়টি আসলে একটি কুসংস্কারনতুন চুক্তি আর ব্যালট বাক্সের দেশে ঐসব হয় না।
সবাই মাটিতে পড়ে থাকা আম জড়ো করছিলযাওয়ার আগে একজন মার্কিন সাংবাদিকদু’হাত ভর্তি আম নিয়ে মাটি থেকে বেরিয়ে থাকাএকটি উঁচু জিনিসে হোঁচট খেল।সে নিজেকে সামলে নিলতাকিয়ে দেখল তার স্নিকারের নীচেআমের মাংসের মত হলুদ হয়ে যাওয়াএকটি মানুষের খুলির কপাল।
সাংবাদিকটি ভাবল, প্রতিদিন এরকম কত খুলি আমের সঙ্গেবাজারে চালান হয়ে যাচ্ছেহলুদ মাংস, কাঁচা সবুজ চামড়া নিয়েকাঠের বাক্সের ভেতর প্রতিদিন কত মানুষেরমাথার খুলি আমেরিকার বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে!‘আসলে এটা থেকেই বোঝা যায়’, সাংবাদিকটি আমাকে বলেছিল‘এল সালভাদরে যে লাশগুলি পাওয়া যায়কেন সেগুলির মাথা কাটা থাকে!’
চিনানদেগায় বন্যার পরনিকারাগুয়াআসলে একটি বাদামী রঙের মেয়েরিফুজি ক্যাম্পের কাদার মধ্যেযে দাঁড়িয়ে আছেআর যার মাথার ওপরে কোনমতে দাঁড়িয়ে একটি সবুজ পাখিঠোঁট ফাঁক করে হাসতে হাসতে রাস্তার দিকে নজর রাখছে
একটি বৈপ্লবিক স্প্যানিশ শিক্ষা যখনই কেউ আমার নামভুল উচ্চারণ করে,আমার ইচ্ছে হয় একটি খেলনা পিস্তল কিনিচোখে কালো সানগ্লাস পরিটুপিটাকে একটু তেরছা করি দাড়িটাকে আরও ছুঁচলো করে আঁচড়াইআর উইসকন্সিন থেকে আসা রিপাব্লিকান টুরিস্টদের একটি বাসহাইজ্যাক করি,তারপর তাদের স্প্যানিশেআমেরিকা-বিরোধীস্লোগান দিতে বাধ্য করি,যতক্ষণ না পর্যন্ত এসডাব্লিউএটি-র দোভাষী সেনারা এসেমাথার ওপর হেলিকপ্টার নিয়ে চক্কর কাটছেআর আমার সঙ্গেরফা করতে চাইছে।
কলম্বিয়াআর্মান্দো ওরোজকো তোভার——————————————- তোভারের জন্ম ১৯৪৩ সালে। তিনি একাধারে কবি ও চিত্রশিল্পী। কলম্বিয়ার বোগোটা শহরে তাঁর জন্ম। কিউবার হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা নিয়ে পাশ করে রেডিও হাভানায় চাকরি করেছেন। পরে কলম্বিয়ায় ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি তাঁর বাবার প্রভাবে সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহী হন। প্রথমদিককার লেখালেখি শুধু প্রেম বিষয়েই সীমাবদ্ধ ছিল, পরে মায়াকোভস্কি,নেরুদা, হারনানদেজ,ভালেজোর প্রভাব তাঁর উপর পড়ে। কিউবা বিপ্লবের দিনগুলোয়, যখন তিনি কিউবায় ছিলেন, তখন প্রচুর লেখালেখি করেছেন। পুরস্কার পেয়েছেন। তার কয়েক বছর পর দেশে ফিরে সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন, কিন্তু পরে আবার সেই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে লেখায় মনযোগী হন। বহুবার মতবাদ ও লেখনির জন্য কারাবাস সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক এবং বস্তুবাদী ভাবতেই পছন্দ করেন। ৩০ জানুয়ারির ২০১৭সালে তিনি প্রয়াত হয়েছেন।
উদাহরণ
(আউগুস্তো লারা সাঞ্চেজের জন্য)
” সংগ্রামের ভেতর জয়লুকানো থাকে রূপকের আকারেআয়নার পিছনে থাকামুখের মতই।
*যে কোনো দিন হয়ে যেতে পারে তোমার লড়াইআর প্রতিটি কোণে একটি স্বপ্নঅথবা বর্শা থাকতে পারে তোমার প্রতীক্ষায়।
*পরাজয়ের আশা কোরো নাযদি এখনো নিশ্চিহ্ন হয়ে না যাওতাহলে তোমার আত্মার ভেতর মরচে তরবারির ক্ষয় করতে থাকবে।
*মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা কোরো না,মৃত্যুর জন্য একটি উদাহরণ দরকার।
পেরুহাভিয়ের হেরাউদ————————- পেরুর চিরতরুণ কবি হাভিয়ের হেরাউদ পেরেজের জন্ম ১৯৪২ এ। যৌবনে তিনি পেরুর ন্যাশানাল লিবারেশন আর্মিতে যোগ দেন। বলিভিয়ায় গিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হন। ১৯৬৩ -র জানুয়ারিতে তাঁর নেতৃত্বে একটি ছোট গেরিলা দল দক্ষিণ পেরু সীমান্ত পেরিয়ে দেশে প্রবেশ করে। কিন্তু একধরণের পরজীবী ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে অসুস্থ অবস্থায় নিকটবর্তী শহরে চিকিৎসার জন্য প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে তাঁকে পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়। এবং ১৫ মে মাত্র ২১ বছরের প্রাণবন্ত হেরাউদকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে।
” গেরিলার মন্ত্রকেননা আমার স্বদেশ সুন্দর,যেন আকাশে উঁচানো তলোয়ার,এবং শুধু আজকের নয় চিরকালের জন্য মহানসেই সঙ্গে আরো বেশী রূপময়আমি তার কথাই বলি তাকেই রক্ষা করিআমার জীবনের বিনিময়ে।
বিশ্বাসঘাতক কী বললো আমি তার পরোয়া করি না।আমরা অতীতকে চাপা দিয়েছিইস্পাতের গাঢ় অশ্রুতে।আমাদের স্বর্গ,আমাদের প্রতিদিনের রুটি,আমরা রুয়েছি, গোলায় তুলেছিগম আর মাটি,এবং গম আর মাটিআমাদেরই,এই সমুদ্রএই পাহাড় আর পাখিরাচিরকালের জন্য হবে আমাদেরই ।
জোসে ভালদিভিয়া দোমনিগুয়েজ ‘ জোভালদো’————————————- পেরুর জনগণের কবি জোভালদোর জন্ম ১৯৫১ সালে। তিনি পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পেরুতে চলমান বিপ্লবী গণযুদ্ধের একজন সৈনিক হিসেবে তিনি যোগ দেন। এইসময়ে তাঁর কবিতা অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। তিনি গ্রেপ্তার হন। এল ফ্রন্টন নামে একটি দ্বীপে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৮-১৯ জুন জেলবিদ্রোহ দমনের অছিলায় পেরুর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ৩০০ জন বন্দির সঙ্গে জোভালদোকেও হত্যা করে।
” প্রিয় জনতার জন্য গানআমায় ক্ষমা কোরো যদি আমি গোলাপের জন্য কবিতা লিখতে না পারি,অথবা আমার অচেতন থেকে কোনো বুর্জোয়া ভাবনা বেরিয়ে না আসে,অথবা যদি আমার হাতে কোনো রত্ন বা সুগন্ধ না থাকে।ক্ষমা কোরো মাগোআজ যদি ঘরের কাজে কোনো সাহায্য করি,ক্ষমা কোরো আমায়, কিন্তু এও তো ঠিক… আমি কখনও এসব পারি না!জঞ্জাল আর একাকিত্বে ভরা প্রাচীন রাস্তায়আমি পারি না ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতে।
আমি কখনোই সেই নিষ্কর্মা ছেলেটির মতো হতে চাই না অথবা প্রতিবেশী সেই বাচ্চাটির মতো,যে রুটি কখনোই মিলবে না তার জন্য যে দীর্ঘ ক্ষুধার কামড় সয়েই চলবে।আমাদের দরজার সামনে থেকে যতদূর যাওয়া যাক শুধুই রক্তের দাগ।ক্ষমা করো আমায় হে জীবনযদি একটি শিশুর মতো আমি ভাবতাম তোমাকে নিয়ে যাবএকটি বিলাসবহুল কামরায় ধনীরা যেমন যায়এবং তোমাকে সাজাব রূপকথার স্বপ্নগুলো দিয়েক্ষমা করো আমায়, কিন্তু এই যে…..আমার রক্তেরা আবার বেঁচে উঠেছে ভোরের আলোয়,আমার গালে,নতুন স্বদেশের স্বপ্নে।
আমার অশ্রুর উজ্জ্বল লাল চিহ্ন জেগে আছে হাওয়ায়আমার দুপায়ে দাঁড়ানো চেতনার মতো।আমার রক্তের মশাল যেমন গানের সাথে তাল রাখেতেমনই মাটিকে চুম্বন করবে আমার হাত।আমার গান ঝড়ের গান,পুনা মালভূমির,গমখেতের ভাষাআমার ভাষা,গরিব মানুষের অতি সহজ ভাষা।এ’জন্য আজ আমায় ক্ষমা কোরো
আমি লিখতে পারিনিযা তুমি ভালবাস, অথচ যা আমার পক্ষে বেমানান,আমি পারিনি কারণ পৃথিবী কাঁপছেধ্বসে পড়ছে পুরোনো দুনিয়াআরো আরো কাছে শোনা যাচ্ছে নদীর গর্জনবিদ্যুৎ তরঙ্গ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রাচীরগুলো।এসব কিন্তু আমার কথা নয়এ’কথা বলছে ইতিহাসবলছে মেহনতি জনতাতাই আমিও বলতে চাই এই কথাগুলোএসো উঠে দাঁড়াওপুনাগুলোর দিকে তাকাওদেখ গমখেতগুলো জয়ী হচ্ছেধ্বসে পড়ছে ভয়তাদের রক্তদানের ভিতর দিয়েদারুন সূর্যোদয়ের মত।জনতার উজ্জ্বল দীপ্তিমানএই পদযাত্রা এগিয়ে চলেছেতারা দেখতে পাচ্ছে ফুটনোন্মুখ নতুন পৃথিবী।
ক্ষমা কোরো আমায়কারণ আমার দেশের মানুষএখন লড়াই করছে খেতে আর কারখানায়।
মেক্সিকোফিল গোল্ডভার্গ————————— জন্ম ১৯৩৪। ফিল গোল্ডভার্গ আদতে আমেরিকার মানুষ। সেখানকার ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর জন্ম। জাপাতিস্তা আন্দোলনের পটভূমিকায় তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। তিনি ছিলেন জাপাতিস্তা সলিডারিটি কনসলিডেশনের একজন অন্যতম সংগঠক। ২০০৪ এ তিনি প্রয়াত হন।
হারাবার কিছু নেই
“We have nothing to lose, absolutely nothing…”
……. হারাবার কিছু নেই…….সত্যিই কিছু নেই,…….সব চলে গেছে,অদৃশ্য হয়েছে উত্তরের কোনো গোপন কক্ষে…… লোভী চোখের পাহারায়……. তাই ন্যায় বিচারের দেখা নেই
নিপীড়ন
……. তীব্র বঞ্চনা,এখানে কোনো বিদ্যালয় নেইকেবল মৃত্যুর শ্রেণীকক্ষগুলো ছাড়া……. যেখানে শিশুরা শেখে কেমন করে মরতে হয়খিদের জ্বালায়……. অথবা কোনো কমজোরি পোকার মত,কোনো জমি নেই এখানে,……. কেবল এবড়োখেবড়ো পাথর……. এমনকরে নিঙড়ে নেওয়া যার আর দেবার কিছুই নেইআর আছে বন্ধ্যা প্রতিশ্রুতির…….. কাগুজে ভূচিত্রগুলো
এখানে কোনো ঘর নেই,……. শুধু পাতলা কাঠের আবরণ……. বাতাসকে বোকা বানাবার জন্য,যে জানে আমরা ধর্ষিত হয়েছি……. আর পড়ে আছি ক্ষতবিক্ষত হয়ে,……. আবরণহীন পা-জোড়া শীতের দিকে বাড়িয়ে,এখানে কোনো পরিকল্পনা নেই……. কেবল ধনীদের মধ্যকার মুক্তবাণিজ্য ছাড়া,
যখন এসবের বিরুদ্ধে আমাদের নাক কুঁচকে ওঠে……. তখন শস্যরাঙানো জানালাগুলোয়আঠার মতো লেগে থাকে……. আমাদের পুয়েবলো শুকনো রক্ত……. আমাদের পূর্বপুরুষের,এখানে কোনো ন্যায়বিচার নেই……. বন্ধ আদালত,বিচারপতির হাতুড়ি গুঁড়ো করে দেয় আমাদের মাথা,……. আমাদের হার্ট আর্তনাদ করেবাস্তা — বাস্তা — বাস্তা**……. তারা আর্তনাদ করে……. আমাদের হারাবার কিছু নেই।
গুয়াতেমালাঅটো রেনে কাস্তিল্লো—————————– গুয়াতেমালার বিপ্লবী গেরিলা যোদ্ধা, কবি অটো রেনে কাস্তিল্লোর জন্ম ১৯৩৬ এ। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা CIA ১৯৫৪ সালে আরবানেজের গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্যু দ্বারা উৎখাত করলে কাস্তিলো দেশত্যাগ করে সালভাদরে চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে কবি রোকে দালতোন এবং অন্য বিপ্লবী কবি ও লেখকদের সঙ্গে। তাঁদের সাহায্যে তাঁর প্রথমদিককার লেখাগুলি প্রকাশ পায়। ১৯৫৭ তে স্বৈরাচারী আরামাসের মৃত্যুর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। তারপর ১৯৫৯ এ উচ্চশিক্ষা নিতে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানিতে যান। ১৯৬৪ তে দেশে ফেরেন এবং ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দেন। এরপর ‘এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার’ নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই সময় তিনি প্রচুর কবিতাও লেখেন। এই একই বছরে আবার তিনি গ্রেপ্তার হন, কিন্তু জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন। তারপর ইউরোপ চলে যান। পরে গোপনে দেশে ফিরে আসেন এবং জাকাপা পাহাড়ের সশস্ত্র বিপ্লবী গেরিলা সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯৬৭ তে তিনি আচমকাই তাঁর কয়েকজন কমরেড ও স্থানীয় সহযোগীসহ আটক হন। শত্রুপক্ষ তাঁদের অকথ্য নির্যাতন করে এবং বর্বরের মতো জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে।
অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা
” একদিনআমার দেশেরঅরাজনৈতিকবুদ্ধিজীবীদেরসহজ সরল লোকেরাপ্রশ্ন করবে।
*তাদের জানতে চাওয়া হবেযখন ছোট্ট নিঃসঙ্গমধুর আগুনের মতোতাদের জাতি ধীরে ধীরে মরতে বসেছিলতখন তারা কী করছিল?
*কেউ তাদের জিজ্ঞাসা করবে নাতাদের পোষাক,তাদের মধ্যাহ্নভোজনের পরদীর্ঘ দিবানিদ্রা সম্পর্কে,কেউ জানতে চাইবে নাতাদের ‘শূন্যগর্ভ ভাবনার’নিস্ফল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারে,তাদের উঁচু টাকাকড়ির বিদ্যেকেকেউ পরোয়াই করবে না।
*গ্রীক পুরাণ সম্পর্কে
প্রশ্ন করা হবে না তাদের,কিংবা সম্মান জানানো হবে না তাদেরব্যক্তিগত বিরক্তির প্রতি,যখন তাদের মধ্যে কেউ একজনমরতে বসেছেকাপুরুষের মতো।
*তাদের কিছুই জিজ্ঞাসা করা হবে নাতাদের অযৌক্তিকন্যায্যতা সম্পর্কে,সম্পূর্ণ মিথ্যার ছায়ায়যার জন্ম হয়েছে।
*সেই দিনসবচেয়ে সরল মানুষেরা আসবে
*অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদেরবইয়ে আর কবিতায়যারা ঠাঁই পায়নি,কিন্তু প্রতিদিন তাদেরযুগিয়েছে দুধ আর রুটি,তর্তিলা আর ডিম,তারা, যারা তাদের গাড়ি চালিয়েছেযারা তাদের কুকুর আর বাগানের যত্ন নিয়েছেএবং তাদের জন্য মেহনত করেছেতাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে :
*“তোমরা কী করছিলে যখন গরিবেরাযন্ত্রণা ভোগ করছিল, যখন জীবনআর সহানুভূতিতাদের জন্য পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল?”
*আমার প্রিয় দেশেরঅরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরাতোমরা উত্তর দিতে পারবে না
*তোমাদের নাড়িভুঁড়ি গিলে ফেলবেএক শকুনের স্তব্ধতা
*তোমাদের নিজেদের দুর্দশাকুরে কুরে খাবে তোমাদের আত্মাকে
*আর তোমরা চুপ হয়ে থাকবে নিজেদের লজ্জার ভেতর।
মারিও পায়েরাজ————————–জন্ম ১৯৪০,গুয়াতেমালার চিমালতিনানগোয়। ছাত্রজীবনেই গুয়াতেমালার লেবার পার্টিতে যোগ দেন। এরপর কিউবায় থাকাকালীন মার্কসবাদী দার্শনিক-কবি-গদ্যকার মারিও পায়েরাজ, গুয়াতেমালার “গরীব গেরিলা দলে” ( people’s guerrilla army) যোগ দেন এবং অন্যতম প্রধান গেরিলা নেতা হয়ে ওঠেন। পরে সংগঠন পরিচালনায় রণকৌশলগত পার্থক্যের কারনে তিনি সেই সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে “বিপ্লবী অক্টোবর” নামে একটি নতুন সংগঠন গড়েন। ১৯৯৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে আত্মগোপনে থাকাকালীন তিনি প্রয়াত হন। তাঁর যা কিছু ছিল তা দূরবর্তী একটি গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়,কিন্তু কিছু দিন পরে কবর থেকে সেসব লোপাট করে দেয় সমাজবিরোধীরা, আজও তা ফিরে পাওয়া যায় নি। তিনি গুয়াতেমালার অন্যতম সেরা লেখক ও কবি হিসেবে পরিচিত। গুয়াতেমালা অরণ্যের বিপ্লবী গেরিলাযুদ্ধ নিয়ে লেখা তাঁর গ্রন্থ “The days of jungle” (“বিষুব অরণ্যের দিন”) বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে।
তাম্বোরিলো
অরণ্যে যে লড়াই চালাতে চায়তাকে তাম্বোরিলো ফুলের কাছে পাঠ নিতে হবেকোনো জেনারেলই তার শত্রুপক্ষকে ঘেরাও করতে পারবে না হলদে কুঁড়ির কর্তৃত্ব নিয়েপ্রত্যেক ফেব্রুয়ারিতে এর আক্রমণ শুরু হয়এবং বসন্তে ফুটে ওঠে সম্পূর্ণ ফুলতারপর পশ্চাদপসরণ করে রুটমার্চের কোনো শব্দ ছাড়াই।
হন্ডুরাসজোসে লুই কোয়েসাদা——————————- জন্ম ১৯৪৮। কোয়েসাদা ১৯৭৪ এ তাঁর প্রথম বই প্রকাশের পর পরই হন্ডুরাসের বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান কবি ও লেখকদের সঙ্গে নিয়ে সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাহিত্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮০ সালে হন্ডুরাসের ইউনিভার্সিটি অব হন্ডুরাস পোয়েট্রি পুরস্কারে ভূষিত হন এই স্বনামখ্যাত কবি।
দুরারোগ্য প্রেম
তোমার নাম দৈনিক কিংবা সাময়িকপত্রেপ্রকাশিত হয় না।তোমার নামে কটুক্তির গন্ধও মেলে কদাচিৎ।কে-ই বা বেদনার গল্প শোনায় তোমার কথা ভেবে,ভিনদেশিরা মনেই রাখেনি তুমি আছ,কিন্তু আমি তোমায় অনুভব করিহন্ডুরাস, আমার সংকীর্ণ গিরিখাত, আমার নিয়তি, আমার শিকল।আমার ঠোঁট থেকে এই উষ্ণ পানপাত্র সরিয়ে নিও না,জানি তোমার কটুগন্ধ আছে,তবু তোমার থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন কোরো না!
নিকারাগুয়াআর্নেস্তো কার্দেনাল—————————- জন্ম ১৯২৫। নিকারাগুয়া তথা লাতিন আমেরিকার স্বনামখ্যাত কবি আর্নেস্তো কার্দেনাল মার্তিনেজ। তিনি একজন ধর্মযাজক হয়েও নিকারাগুয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিপ্লবের ধর্মতত্ব বা লিবারেশন থিয়োলজির অন্যতম জনক তিনি। সান্দানিস্তা বিপ্লবের পর কার্দেনাল নিকারাগুয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেন। এই মার্কসবাদী ধর্মযাজকের সঙ্গে পোপ দ্বিতীয় জন পলের বিরোধ বাধে, কার্দেনাল যাজক হিসেবে গুরুত্ব হারান। পরে সান্তানিস্তা সরকারের, সরকার পরিচালন ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করে মন্ত্রীত্বও ছেড়ে দেন কবি।
তোতাপাখিরা
আমার বন্ধু মাইকেল হন্ডুরাস সীমান্তেরউত্তর সোমোতোর একজন সেনা অফিসার,তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি কিছুবে-আইনি তোতার খোঁজ পেয়েছিলেনযেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চোরাচালান হবার জন্যঅপেক্ষা করছিল, সেখানে গিয়ে ইংরিজি বুলি শেখানো হবে।*সেখানে ১৮৬টি তোতাপাখি ছিলযার মধ্যে ৪৭টি তখনই খাঁচার ভেতর মারা গিয়েছিল।যেখান থেকে তাদের ধরা হয়েছিল সেখানেতিনি ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসছিলেনকিন্তু সেই লরি এসে যেই প্রবেশ করল সেই সমতলে*ঐ পর্বতমালার কাছে, যেখানে ছিল তোতাদের বাসা(সমতলভূমির পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বিরাট পর্বতসারি)পাখিগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠল, শুরু করল ডানা ঝাপটাতেধাক্কা দিতে লাগলো খাঁচার গায়ে।*যখন খাঁচাগুলো খুলে গেলতারা ঠিক যেন তীর বৃষ্টির মতো ছুটে গেলসোজা তাদের পাহাড়গুলোর দিকে।*আমার মনে হয় বিপ্লব ঠিক এই কাজটাই করে :সে খাঁচা থেকে আমাদের মুক্ত করেযেখানে ওরা আমাদের ইংরিজি বুলি শেখাতে ফাঁদবন্দি করেছিলসেখান থেকে সে আমাদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনেযেখান থেকে আমাদের উৎখাত করা হয়েছিল,তাদের সবুজ পাহাড়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেয় তাদেরই সবুজ তোতাসাথীরা।*কিন্তু সেখানে ছিল আরো ৪৭টি, যারা নিহত হয়েছে।
গিয়াকোন্দা বেল্লি————————– বেল্লির জন্ম ১৯৪৮ সালে নিকারাগুয়ার মানাগুয়ায়। উচ্চশিক্ষিত এবং বিত্তবান পরিবার থেকে আসা নিকারাগুয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী তিনি। বেল্লি ১৯৭০ এ সামোজা স্বৈর সরকারের বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ার সান্দানিস্তা ন্যাশানাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্বে শুরু হওয়া জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। বিপ্লবের পরেও তিনি একজন সাহসী গণতান্ত্রিক কন্ঠ হিসেবে সমালোচনা করেছেন সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপের।
হরতাল
আমি একটা হরতাল চাই যেখানে আমরা কেউ ঘরে থাকব না।এ হবে কাঁধ, মাথা, চুলের হরতাল,শরীরে শরীরে জন্ম নেবে যে হরতাল।আমি একটা হরতাল চাইশ্রমিকের ঘুঘুপাখিরচালকের ফুলেরকারিগরের শিশুরচিকিৎসকের মায়ের
আমি একটা বিরাট হরতাল চাইযাতে এমনকি থাকবে প্রেমওএকটি হরতাল যাতে সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যাবেঘড়ি কারখানানার্সারি ইউনিভারসিটিবাস হাসপাতালরাজপথ বন্দরএ হবে চোখের, হাতের, চুম্বনেরও হরতাল,এমন একটি হরতাল যেখানে নিষিদ্ধ থাকবে শ্বাস চলাচল
একটি হরতাল যেখানে নীরবতার জন্ম হবেস্বৈরাচারীর পলায়নরত পায়ের শব্দ শোনার জন্য।
জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা—————————————– নিকারাগুয়ার স্পেনীয়-রোমান ধর্মযাজক, কবি জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানার জন্ম ১৯৪১ সালে। তিনি গ্রামের কৃষক ও দরিদ্র জনসাধারণের ভেতরে কাজ করতে গিয়ে অবর্ণনীয় শোষণ অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে সেসবের প্রচন্ড সমালোচক হয়ে ওঠেন। লিবারেশন থিয়োলজিতে বিশ্বাসী লাভিয়ানাকে সামোজার ন্যাশানাল গার্ড দুবার গোপনে হত্যার চেষ্টা চালায়। তিনি দেশত্যাগ করে কোস্টারিকায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। এখানে এসে তাঁর পরিচয় হয় দেশত্যাগী সান্দানিস্তা ন্যাশানাল ফ্রন্টের বিপ্লবীদের সঙ্গে। তিনি তাঁদের চিন্তা ও আদর্শের সাথে নিজের ভাবনার মিল খুঁজে পান এবং FLSN এ যোগ দেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালে কোস্টারিকা সীমান্তে সান্দানিস্তা গেরিলা বাহিনীর যে ইউনিটে তিনি ছিলেন, সেটি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়, লাভিয়ানা নিহত হন। বিপ্লবের পরে নিকারাগুয়ার খ্যাতনামা কবি আর্নেস্তো কার্দেনালের তত্বাবধানে তাঁর লেখাপত্র ও কবিতাগুলি সংকলিত হয়।
সরোবরে ধ্যান
নদীতীরে ধ্যানস্থ এই তোমার থেকে আমি অনেক দূরেসুরচ্যুত স্বরলিপি বাঁধছি এখন আবার সুরে সুরেঅবিরাম ঢেউ বুনছি নিবিড় শব্দ পুরে ছন্দে এবং ভাষায়যেমন ছিল সেই সে লিপি পেলাম ফেরত তরঙ্গরা আসায়সরোবর ফের পাঠ বলে যায়জল নাচিয়ে ফেনায় ফেনায়আবার বলে এবং আবার কন্ঠে তুমুল সেই অবিরাম নামমুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তির সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!
(দুই).———
আরও দশজন লাতিন আমেরিকান কবি-লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের বয়স নেহাত কম নয়। বাচিক এবং লিখিত, দুই রূপ মিলিয়ে এ-সাহিত্যের বয়স পাঁচশ বছরের বেশি। এবং অবশ্যই সেটা কেবল হিস্পানি বা পর্তুগিজ ভাষায় রচিত হয়নি। স্বদেশি বা আদিবাসী নানান ভাষাতেও লাতিন আমেরিকার সাহিত্য রচিত হয়েছিল এবং সেটি ছিল বাচিক। আশ্চর্য শোনালেও এ-কথা সত্য যে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে বাচিক ঐতিহ্যের ক্ষীণ একটি ধারা এখনো বহমান। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি বাংলাভাষীদের আগ্রহ যেন অনিঃশেষ এবং কিছুটা হুজুগপ্রবণও বটে। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে এই সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রচনা, বিশেষ ক’রে উপন্যাস, ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ‘বুম’ [The Boom] নামের প্রবল প্রপঞ্চ সৃষ্টি করার পর সেই আগ্রহের ঢেউ অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যা থেকে বাংলাভাষী পরিসরও, সঙ্গত কারণেই, বাদ পড়ে নি। উপন্যাস এবং ছোটগল্পের পাশাপাশি, প্রাক-কলম্বীয় যুগের কবি, দার্শনিক, যোদ্ধা ও স্থপতি নেযাহুয়ালকয়তাল [আনুমানিক ১৪০২-১৪৭২] থেকে শুরু ক’রে উপনিবেশিক যুগ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতক পেরিয়ে সমসাময়িক আলেয়দা কুয়েভেদো [জন্ম ১৯৭২, কিটো] অব্দি নানান লাতিন আমেরিকান কবি যে বিচিত্র ও সমৃদ্ধ কাব্যজগতের সৃষ্টি করেছেন তার পরিচয় পেতে বাঙালি রসনা উন্মুখ হয়েছে এবং কিছু অনুবাদকের সুবাদে—তাঁদের মধ্যে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধায় অগ্রগণ্য—সেই রসভাণ্ডারের খানিকটা পরিচয় বাংলাভাষী পাঠক পেয়েছেন। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে রবার্ট ফ্রস্টের সেই নৈরাশ্যবাদী ও প্রতিহারীসুলভ মন্তব্য আমাদের মনে পড়ে গেলেও, সৌভাগ্যক্রমে অনুবাদকেরা তাতে কর্ণপাত করেন নি। অনুবাদে যা হারিয়ে যায় তা আগলে রাখার চাইতে তাঁরা মনোযোগী হয়েছেন তাতে যা পাওয়া যায় তার সন্ধানে। তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ আমরা পাঠকেরা লাভ করেছি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন কবির নির্বাচিত কবিতার পৃথক বাংলা অনুবাদ, সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে দুই মলাটের মধ্যে নানান কবির কবিতার সংকলন।
মোশতাক আহমেদ নিজে কবি হিসেবে যশস্বী, দীর্ঘ দিন ধ’রে তিনি কাব্যচর্চায় রত। তাঁর এই তন্নিষ্ঠ যাত্রায় তিনি বিশ্বকবিতা অনুবাদে ব্রতী হয়েছেন বছর দশেক হবে। উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়া থাকাকালীন-ই কাজটি শুরু করলেও এ-বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে শুরু করেন ২০১১ সালে এবং তাঁর এই অনুবাদ পরিক্রমা লাতিন আমেরিকায় নোঙর ফেলে বছর তিনেক আগে। এখানে যে সাতজন লাতিন আমেরিকান কবির কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন—সিজার ভায়েহো [১৮৯২-১৯৩৮], মানুয়েল বানদেইরা [১৮৮৬-১৯৬৮], আলফোনসিনা স্তোর্নি [১৮৯২-১৯৩৮], হাভিয়ের আবরিল [১৯০৫-১৯৯০], রাফায়েল মেন্দেস দরিখ [১৯০৩-১৯৩৬], সালভাদোর নোভো [১৯০৪-১৯৭৪] এবং অক্তাভিও পাস [১৯১৪-৯৮]—তাঁদের মধ্যে প্রথম এবং শেষোক্ত কবির কবিতার অনুবাদ আমরা বাংলাভাষীরা প্রায়ই পেয়ে থাকলেও বাকি পাঁচজন-এর কবিতার অনুবাদ সহজলভ্য নয়, যদিও তাঁদের মধ্যে আলফোনসিনা স্তোর্নি যথেষ্ট খ্যাতিমান। এবং অক্টাভিও পাস ছাড়া তাঁদের প্রায় সবার জন্ম ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে বিংশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে। অর্থাৎ তাঁদের কাব্যকীর্তি লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে যে পর্বটি বিখ্যাত ‘মদার্নিজমো’ [modernismo] নামে সুপরিচিত তার পরের সময়ের।
কবিতাগুলো নেয়া হয়েছে মূলত Dudley Fits সম্পাদিত Anthology of Contemporary Latin American Poetry’র ১৯৬৭ সালের সংস্করণ হতে, যদিও বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। নির্বাচিত কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু মৃত্যু, পলায়ন, ক্ষতি, অদম্য জীবন, প্রেম, প্রেমহীনতার বেদনা, প্রকৃতি, নিজ সংকল্পে অটল নারী, কবিতা, ইত্যাদি। কবি মোশতাক আহমেদ কবিতাগুলো ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমাদের জন্যে বাংলায় পরিবেশন করেছেন।
জি এইচ হাবীব
সিজার ভায়েহোআক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন দ্রষ্টা। নিজের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘এক প্রবল বর্ষার দিনে প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে, বৃহস্পতিবারে’—ঘটেছিলও তাই! সিজার ভায়েহো [মার্চ ১৬, ১৮৯২-এপ্রিল ১৫, ১৯৩৮] ছিলেন পেরুনিবাসী কবি, নাট্যকার ও সাংবাদিক। জীবিতাবস্থায় মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হলেও স্বাতন্ত্র্যগুণে যে কোনো ভাষায় বিশ শতকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে তিনি বিবেচিত হন। সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে তিনি নিজেকে রাখতেন এগিয়ে। প্রকাশমাত্রই তাঁর তিনটি কবিতার বইই বৈপ্লবিক আবির্ভাব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। তবে নির্যাতন আর দারিদ্র্য সইতে হয়েছে কম না। কোনো কোনো সমালোচক তাঁকে দান্তের পরে সবচেয়ে বড় বিশ্বজনীন কবি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
মিগুয়েল◘পুরনো গোলঘরে বসে আছিতোর না-থাকার পাশে, পাতকুয়োটির ধারে।আমরা খেলতে শুরু করতে পারি, এখনই…মা চেঁচাবেন, ‘ছেলেরা একটু আস্তে…’আমরা হাসব, হাসতে হাসতেই লুকাব সিঁড়ির পেছনে,কিংবা হলঘরে বা চিলেকোঠায়—মা আর দেখতে পাবেন না আমাদের।লুকোচুরি খেলায় আমরা ওস্তাদ ছিলাম, মিগুয়েল!কিন্তু সব খেলাই চোখের জলে শেষ হয়।
আগস্ট মাসের সেই রাত্রিবেলা তুই যখন আবারো লুকালি—কেউ আর হাসছিল না; ভোর হয়ে গেল ক্রমে।তোর ভাই ক্রমাগত খুঁজেই চলেছে তোকে,ঘিরে ধরেছে চতুর্দিকের ছায়ারা।মিগুয়েল, ক্ষান্ত দে না এ বেলা, চাঁদমুখটা দেখা;
মা মিছিমিছি চিন্তা করবে।
প্যারিস, অক্টোবর ১৯৩৬◘সমস্ত দৃশ্য থেকে আমিই কেবল পালিয়ে যাই।পার্কের বেঞ্চি থেকে, নিজের পাতলুন থেকে,সমস্ত সুবিধা থেকে, সমস্ত কাজ ফেলে দিয়ে,নিজের প্রিয় সংখ্যাগুলো থেকে, সারাবেলাসব কিছু থেকে আমিই কেবল পালিয়ে বেড়াই।
প্যারিস রোড থেকে পালিয়ে আমি চাঁদের টিলায় হাঁটি।মৃত্যু আমাকে ছেড়ে যায়, ছেড়ে যায় টেলিফোন,এবং চারপাশে ঘিরে থাকা লোকজন নিয়েও একাকীআবারও নিজের চেহারা ফুটিয়ে তুলতে হয়,এক এক করে বিদায় করি সবগুলো ছায়া।
এবং সমস্ত দৃশ্য থেকে আমিই কেবল সরে যাই, কেননাআমার জুতো—তার ফিতে বাঁধবার ঘর, এমনকিজুতোর তলায় লেগে থাকা কাদা, জামার ভাঁজ—প্রত্যেকেই আমার চিহ্ন রাখতে চেয়েছিল।
সমস্ত দৃশ্য থেকে আমিই কেবল পালিয়ে যাই।
অক্টাভিও পাস
মেক্সিকোতে জন্ম নেয়া ১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কবি অক্টাভিও পাসকে [১৯১৪- ১৯৯৮] বিশ শতকের লাতিন আমেরিকার অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয়,১৯৯০-তে, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। আজীবন স্প্যানিশ ভাষায় কাব্যচর্চা করে চলা পাজ়ের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন স্যামুয়েল বেকেট, চার্লস টমলিনসন, এলিজ়াবেথ বিশপের মতো বিশিষ্ট লেখকরা। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল পাজ়ের। তাঁর সাহিত্যে মেক্সিকোর সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটে। উদ্ধৃত কবিতাটিতে মানব অস্তিত্ব ও দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন পাজ়, সুচারু দক্ষতায়। যিনি আঁদ্রে ব্রেতোঁ কথিত ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে খাঁটি কবি’। তিনি কূটনীতিক ছিলেন। কবিতা সমগ্র ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হচ্ছে দ্যল্যাবিরিন্থ অব সলিচ্যুড, দ্য বো অ্যান্ড দা লাইর, এ ড্রাফট অব শ্যাডোজ, ঈগল অর সান ইত্যাদি। নোবেল কমিটি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছে ‘বিস্তৃত দিগন্ত প্রসারী অনুভূতিপূর্ণ লেখা, সংবেদন ও বুদ্ধিমত্তার যুগলবন্দি এবং মানবতাবাদী সততা দ্বারা চিহ্নিত।’
তাঁর কবিতাসৌভ্রাতৃত্ব
একজন মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্ব আর কতটুকুকিন্তু রাত্রি অসীম।ওপরে তাকিয়ে দেখিতারকালিখিত এক পৃষ্ঠা।জানা নেই কিন্তু মনে হল আমিও লিখিত এভাবেএবং ঠিক সেই মুহূর্তেইকেউ একজন আমায় লিখে উঠল।
প্রতিপক্ষ◘সূর্যটা অরণ্যে ডুবে গেছে বলেঅন্ধকারে, পর্বত ভেবেআমার দেহে আরোহণ করছ!আর আমি এই ভাসমান মধ্য রাতেতোমাকে আঁকড়ে ধরেছিনৌকা ভেবে!
সেতু◘বর্তমান আর বর্তমানের মাঝেতোমার আর আমার মাঝেশব্দের সেতু।
সেতুতে উঠছ ধীরে, যেনবানিজেকেই ঢোকাচ্ছ সন্তর্পণে :শব্দে শব্দে জোড়আংটির মতো বৃত্তাবদ্ধ।
এক পাড় থেকে অন্য পাড়েরংধনুর মতোশরীর বেঁকে যাচ্ছে :ওই খিলানের নিচে আমার সুখনিদ্রা।
আর কোনো ক্লিশে নয়◘যেভাবে সূর্যের দিকে ডেইজির পাপড়ি মেলে,তেমনিভাবে তোমার সুন্দর মুখউঁকি দিয়ে যায়ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টানোর ফাঁকে।পুরুষঘাতী জাদুকরী হাসি—আহা! পুরো ম্যাগাজিনটাই অনিন্দ্য হয়ে উঠল!
নারী, তোমার জন্য নৈবেদ্য সাজিয়েছেন কত কবি?কত দান্তে তোমাকে সাজিয়েছেন হে বিয়াত্রিচে?মরীচিকার মোহে ফ্যান্টাসিভরা এই কবিতাকলা।
আজ আমি যদিও নতুন কবিতা লিখছি তোমার জন্য,রচনা করব না নতুন কোনো ক্লিশে।
এই কবিতা সেই নারীদের জন্যযাদের সৌন্দর্য তাঁদের প্রীতি সম্ভাষণে, তাঁদের আচরণে,প্রসাধন চর্চিত চেহারায় নয়।
এই কবিতা তোমার জন্য, নারী—যে শেহেরজাদি রোজ সকালে জেগে ওঠেনতুন একটি গল্প বলবে বলে—যে গল্পে আছে নতুন কোনো সুর,যুদ্ধের মাঠে আশার দূত,ভালোবাসার রণক্ষেত্রে বেঁচে থাকার লড়াই,নতুন দিনের স্বপ্ন কিংবা আরও একটি রাত নিশ্চিত বেঁচে থাকার গল্প।
বেদনাগাঢ় এই পৃথিবীতেহে উজ্জ্বল তারকাহে অনমনীয় যোদ্ধাহে আমার হৃদয়ের বন্ধু,এখন থেকে আরাত্রি কাটবে নক্ষত্রের ধ্যানেকোনো রঙিন ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে নয়,আর কোনো ক্লিশে নয়।
মানুয়েল বানদেইরাব্রাজিলের জনপ্রিয়তম কবি মানুয়েল বানদেইরা [১৮৮৬- ১৯৬৮]। তিনি ছিলেন সাহিত্যের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমালোচক। অসুস্থতার কারণে ১৯২২ সালের দিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ইউরোপ চলে যান এবং সেখানে আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন যা কিনা ব্রাজিলে ফিরে এসে কবিতা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গঠনমূলক সমালোচনায় অবদান রাখতে রসদ জুগিয়েছে; ব্রাজিলের এই আধুনিকতার আন্দোলনের নাম ছিল ‘মদার্নিজমো’। কবির উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হচ্ছে লিবার্টিনিজম, কার্নিভাল, মর্নিং স্টার, ইভনিং স্টার, দিস আর্থ দ্যাট স্কাই, অ্যাশেস অব আওয়ারস ইত্যাদি।
মাতাল বন◘বনের এ মাথা থেকে ও মাথা করে কানাকানি,কিছু কি বলবে আজ!
ট্র্যাজেডি নাটকের অভিনেত্রীর ধরণে দুলছে সমূলেবিদ্রোহী ডালপালাদুলছে বিশ্বাসঘাতিনীর আশঙ্কায়;নয়তোবা আছে নির্ঘাত জরুরি কোনো আবেদন।
বন কী জানে চাহিদা কি তার?চাইছে কি জল?—নিশ্চয়ই না;দু’দিন আগের বানের তোড়েই দিশেহারা আছে বন।তবে কি শতাব্দীর জং মুছে শুদ্ধ হতে অগ্নি চাইছে আজ?নাকি কোনোই চাহিদা নেই?বোবা বন শুধু চাইছে কথা কইতে!পৃথিবীর কোনো গোপন কথাজমেছে কি গভীর মূলের কানে?
বনের এ মাথা ও মাথা করছে কানাকানিমতিভ্রমের জঙ্গি মিছিল।
এক বাঁশঝাড়, একাকীদূরে দাঁড়িয়েহালকা চালে দুলতে দুলতেওদের পাগলামি দেখে আর হাসে।
বাতাস ও জীবনের গান◘বাতাস উড়িয়ে নিল পাতাদেরবাতাস উড়িয়ে নিল ফুলবাতাস উড়াল যত মেওয়াতবুও এ জীবন ভরপুরফুল ফল লতা পাতায়।
বাতাস উড়িয়ে নিল আলোবাতাস উড়িয়ে নিল গানবাতাস উড়াল যত সৌরভতবুও এ জীবন ভরপুরসুগন্ধী, তারায়, গানে গানে।
বাতাস উড়িয়ে নিল স্বপ্নগুলোবাতাস উড়িয়ে নিল বন্ধুদেরবাতাস উড়াল কত বান্ধবীতবুও এ জীবন ভরপুরনারী ও ভালোবাসায়।
বাতাস উড়িয়ে নিল মাসগুলোবাতাস উড়িয়ে নিল উপমাবাতাস উড়িয়ে নেয় সবকিছুতবুও এ জীবনসবকিছুতেই পূর্ণ—ভরপুর।
নিশীথে◘নিশীথেল্যাম্পপোস্টের ধারেমশাশিকারি ব্যাঙের দৌরাত্ম্য।রাস্তা নির্জন,এমনকি মাতালশূন্য।আমি নিশ্চিত, ছায়ার মিছিল যাচ্ছে;যারা চলে গেছে—কেউ এখনো জীবিত, কেউবা মৃত।রাতের ঝরণা কাঁদছে নিরালায়কিংবা কোনো বিগত বিশাল বিষাদ
আলফোনসিনা স্তোর্নিআর্জেন্টিনার কবি আলফোনসিনা স্তোর্নি [১৮৯২-১৯৩৮] একজন গুরুত্বপূর্ণ লাতিন আমেরিকান কবি। তিনি শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা এবং নাটকের দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার দশটি কবিতার বই এবং কয়েকটি কাব্য সমালোচনার সংকলন আছে। স্তোর্নির জন্ম সুইজারল্যান্ডে। শৈশবে আর্জেন্টিনায় আসেন। আর্জেন্টিনার ছোট শহর করোনডাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন; পাশাপাশি মুনডু আর্জেন্টিনোসহ অন্যান্য পত্রিকায় কাজ করতে শুরু করেন। ১৯১২ সালে তিনি বুয়েন্স আয়ার্সে গিয়ে কষ্টসাধ্য জীবনযাপন করতে শুরু করেন। ১৯১৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই লা ইনকুইদত দেল রোজাই [গোলাপেরঅস্থিরতা] প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালে তিনি ল্যানগুইদেজ গ্রন্থের জন্য জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য পুরস্কার পান। তাঁর লেখায় ক্রমশ নারীবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে ইউরোপ সফর তাঁর চেতনায় আরো পরিবর্তন আনে এবং তিনি মুনডো দে সেইতে পোজোছ [১৯৩৪] ও মাসকারিনা [১৯৩৮] বইতে নতুনতর নারীবাদী চেতনার স্বাক্ষর রাখেন। কথিত আছে কবি স্বেচ্ছায় সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হচ্ছে এল দুইচে দানো [মধুর আঘাত]।
উত্তরাধিকার◘তুমি বলেছিলে—আমার পিতা কাঁদে নি কখনো;তুমি বলেছিলে—আমার পিতামহ কাঁদে নি কখনো;আমার বংশে পুরুষের কান্না বিরল,ইস্পাতে মোড়ানো পৌরুষ।
এ কথা বলতে বলতে তোমার এক ফোঁটা অশ্রুগড়িয়ে এল আমার মুখের ওপর, নোনাযেন বা এক ফোঁটা বিষপান করলাম আজ।
বোকার হদ্দ বোঝ নি কি নিজেই,শতাব্দী-প্রাচীন দুঃখের স্বাদ তোমার অশ্রুতে;আহ, বইতে পারছি না এই ভার—এই এক ফোঁটা অশ্রুর!
ঘুমুতে যাচ্ছি◘ফুলের পাপড়ি, কুয়াশার জাল আরগুল্মের কোল দিয়ে গড়া বিকল্প ধাত্রীআমার জন্যেই গড়েছ মৃত্তিকার চাদরশ্যাওলার নকশি কাঁথা।
ঘুমুতে যাচ্ছি আমি, হে ধাত্রী, শুইয়ে দাও আমাকেমাথার কাছে মেলে দিয়ে তারাপুঞ্জের বাতিযে ভাবে সাজাতে চাও—এই নাবালে সবই আপন।
একা থাকতে দাও, শেষবার শুনি কলি ফোটার নৈঃশব্দ্য!আকাশের ওই স্বর্গীয় ইশারায়পাখিরাও শুধু তোমার জন্যেই গান গায়।
সব কিছু ভুলে যাবে, তবুও ধন্যবাদশুধু মনে রেখ—সে যদি কখনও জানতে চায়, বলে দিওযা কিছু ফেলে এসেছি, ফেলেই এসেছি তাঘামাই না মাথা আর।
মধুর উৎপাত◘তোমার করপুটে ছড়িয়ে দিয়েছি এ জীবন—আমার বিষণ্নতাগুলো সোনার গুঁড়োর মতো ঝিকমিক করছেতোমার প্রশস্ত হাতে।আমার সমুদয় মিঠেপনা, সেও তো ছিনিয়ে নিয়েছ দুই হাতে;আমি এখন উপুড় করে দেয়া শূন্য সুগন্ধী শিশি।
নীরবে সয়ে গেছি সহস্র মধুর উৎপাত—বিষাদ গাছের ছায়ায় এলিয়ে থাকা জীবনবেঁচে থাকবার চালাকিগুলো জানে,রেখে যাচ্ছে সকল চুম্বনজীবন উজাড় করে নেয়া নির্বিকল্প দুই করতলে।
হাভিয়ের আবরিলহাভিয়ের আবরিল ১৯০৫ সালে পেরুর রাজধানী লিমায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা ও গদ্য লেখার পাশাপাশি তিনি কবি সিজার ভায়েহোকে নিয়েও গবেষণা করেছেন।
তারুণ্যে তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। প্যারিসে অবস্থানকালে সুররিয়ালিস্টদের সান্নিধ্যে আসেন এবং এক পর্যায়ে জাঁ ককতোর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন। শুরুতে তাঁর কবিতা সুররিয়ালিজম ঘরানার হলেও পরবর্তীকালে তাঁর কবিতায় ছায়া ফেলে বিষণ্ণতা, রোমান্টিক নব্য প্রতীকবাদীদের মতো।
পেরুর এই গুরুত্বপূর্ণ কবির উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে : হলিউড, দ্রিফিসিল ত্রাবেজো, দেসকাব্রিমিয়েন্তো দেল আলবা ইত্যাদি।
১৯৯০ সালে তিনি মন্টিভিডিওতে মারা যান।
নৈশ সংগীত◘(ছায়াহীনপ্রতিধ্বনিহীন প্রেমআর নীরবতা)
প্রেমহীন এই রাত্রির নীরবতায়শিশিরকণার মতো ঢুকে পড়েছবেদনায় ভাঙাচোরানিঃসঙ্গ চোরাকুঠুরি অনিঃশেষ আলোয় ভরে!
চলে গিয়েছিলাম নিজেরও আড়ালেঘৃণার প্রান্তরে বধির।
এক গভীর ঐকতানআর এক অপলক চোখআত্মহারা করে দিল আমাকে!
ভৈরবী◘এই ভোরেগাইল আবারওছোট্ট পাখিরা,ভোরকে বাজাল ভৈরবীতে।
আগের মতোই আছে দেখছিএই আত্মার পাখিরা!সমস্ত কিছুর গভীরে তাইসংগীতের চোরাস্রোত।আমার হৃদয় হরণ করেহৃদয় দিয়ে গড়েছে নীড়ছোট্ট পাখিরা।
রাফায়েল মেন্দেস দরিখ[১৯০৩-১৯৩৬] আর্জেন্টিনার কবি
‘আলো হাতে চলিয়াছে’◘আলো হাতে চলছিল মেয়েটি;বলছিল, ‘কখনও নিভতে দেবো না!’
বুকের কাছে জড়িয়ে রাখল আলোজ্বলে ওঠে উজ্জ্বল শিখা তার‘কখনও নিভতে দেবো না!’ দমকা বাতাসউসকে দিতেই চোখজোড়া গেল পুড়েপাগল মেয়ে হাসছে তবু;‘কখনও নিভতে দেবো না’ বলছিল,
বুকের কাছে জড়ানো তার আলোকবর্তিকা।
সালভাদর নোভোসালভাদর নোভো লোপেজ [১৯০৪- ১৯৭৪] একজন মেক্সিকান কবি, নাট্যকার, অনুবাদক, টিভি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি মেক্সিকোর সমসাময়িক সমাজ ও সাহিত্যে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
কবি ও কবিতা◘যে কবির তীব্র রোমান্টিক আর আবেগী জীবনরাষ্ট্র ঘরে ঘরে—তাঁর বই ফেরে হাতে হাতেতাকে নিয়ে লেখা হয় বই, ভরে থাকে পত্রিকার পাতাতাঁর ছবি দিয়ে।হৃদয়ঘটিত, নারীঘটিত আর প্রকৃতি-খচিত পঙ্ক্তিময়ভালোবাসা অঙ্কুর মেলে বেদনা-গভীর মৃত্তিকায়।
পয়ারে তাকে ধরে রাখেছন্দবিচ্যুতিহীননতুন নতুন রূপকের ঝলকানি!
কবিতার সুর সংক্রামক বড়—শ্রোতার চোখে আনবে জলঅনুপ্রাণিত কবিতাগুলো,কবির আবৃত্তি মথিত করবে হাততালিশিরোপা বসবে মাথায়।
আমিও তো লিখতে পারি খাসা কবিতাঅনুপ্রাসে ঠাসাআত্মহারা পাঠক বলে—‘বেড়ে লিখেছ বাপু!’তাদের বলি তখনকিভাবে লিখার শুরু কিশোরবেলায়,অনুক্ত থেকে যায়অগ্রজের কাছে আজীবনের দেনা।দক্ষ অভিনেতার মতো বুঝিয়ে দেবোপাঠকের মন কিভাবে বুঝতে পারি।
রাত্রি গভীর হলে, নির্জনে ভাবিস্মৃতি ছাড়া, অন্য কবির কণ্ঠ ছাড়াআমার কবিকণ্ঠ কী লতিয়ে উঠত অবেলায়!
কবি পরিচিতি:পেরুর কবি সিজ়ার ভ্যালেজোসিজার ভ্যালেজো (Caesar Vallejo), যাঁর পুরো নাম সিজার আব্রাহাম ভ্যালেজো মেনডোসা, ১৮৯২ সালে পেরুতে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা রচনা করেছেন স্প্যানিশ ভাষায়। তিনি ছিলেন শিমু সংস্কৃতি ও স্প্যানিশ ক্যাথলিক ধারার সংমিশ্রণের সম্পন্ন উত্তরাধিকারবাহী। ফলে তাঁর চেতনায় গভীর আধ্যাত্মিকতার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। উচ্চশিক্ষিত কবির সৃষ্টিতে ছিল সমাজচেতনা, রাজনীতি, এমনকী সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইয়ের উজ্বল উপস্থিতি। জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি বই ছাপা হলেও প্রতিটিও ছিল ভাষা ও চেতনার দিক থেকে বৈপ্লবিক। ভ্যালেজোর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতাদর্শের কারণে তাঁকে ১৯৩০-এ পেরু থেকে নির্বাসিত করা হয়। তিনি ইউরোপ চলে যান।
“আমার আর্তি ছুঁয়ে থাকে অপার নৈঃশব্দ, অবিরাম বর্ষণ ও অফুরান রাস্তাগুলিকে…”সিজার ভ্যালেজো।
নীচের কবিতাটি তাঁর প্যারিসে বসবাসকালে লিখিত।
” সাদা পাথরের ওপর শুয়ে কালো পাথর”
এক বর্ষণমুখর দিনে প্যারিসে আমার জীবনাবসান হবেআমার স্মৃতিতে সে দিন বিমূর্ত।প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে। সেদিন এক পা-ও নড়ব না।সম্ভবত বৃহস্পতিবার, যেমন আজও শরৎকালের এক বৃহস্পতিবার।এ বৃহস্পতিবার না হয়ে যায় না কারণ আজই অবতীর্ণ হচ্ছেএই পঙক্তিগুলি, ঘোর আসঞ্জনে স্পর্শ করে আছিসমূহ ভুল, আজকের মতো কোনওদিনই নিজের সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যায়নিসম্মুখে প্রসারিত রাস্তাগুলিতে, একা।সিজার ভ্যালেজো প্রয়াত। ওরা তাকে প্রহার করে তৃপ্তি পাবেযদিও সে কখনও কারও প্রতি বিরূপ ছিল না;তাঁকে নির্দয় বেত্রাঘাত করবে এবংশত্রু দড়িতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতেও ছাড়বে না, প্রত্যক্ষদর্শনের এই অভিঘাতবৃহস্পতিবারেরই, এবং আমার আর্তি ছুঁয়ে থাকেঅপার নৈঃশব্দ, অবিরাম বর্ষণ ও অফুরান রাস্তাগুলিকে…
আলেজান্দ্রা পিয়ারনিক। কবি পরিচিতি:আলেজান্দ্রা পিয়ারনিক (Alejandra Pizernik) ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতচা রচনা করতেন স্প্যানিশ ভাষায়। তিনি ছিলেন রাশিয়া থেকে আসা এক ইহুদি অভিবাসী পরিবারের সন্তান। তাঁর লেখা ও দর্শন প্রবল নারীবাদী চেতনার প্রতিফলন। ভালবাসা ও মৃত্যু তাঁর লেখায় সম্যক রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাঁর লেখায় আত্মজীবনীমূলক ভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উক্ত কবিতাটিতে ভালবাসা ও মৃত্যুর বিষাদ উপস্থাপিত।
তাঁর কবিতা: বিদায়
আলো নেভাও, আগুন পরিত্যক্ত হোকএকটি বিরহী পাখির সুরে ভেসে আসে ভালবাসা আমার নৈঃশব্দ ঘিরে কত লিপ্সা প্রাণিত হয়ে আছেএবং এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত আমাকে সান্নিধ্য দেয়
লাতিন আমেরিকার কবি’মনচো আজুয়াগা’র কবিতা(প্যারাগুয়ের কবি।)কাব্যশাস্ত্র
আর লেখালেখি করবে না।আর কোন কথা বলবে না, আমাকে শুধালো ওরা।চুপ থাকবে।সব কিছুই নিরর্থক, ওরা বললো আমাকে।এত কষ্ট খাটা-খাটনি নেহাইত বেগার খাটা।কিন্তু তবুওবাহিরে, রাস্তায়বেনামী কন্ঠগুলো, প্রতিচ্ছায়া, আধো-ছায়াচেয়ে বসলো বাতাস, নীলাভ বৃষ্টিনভোমণ্ডল।
Arte Poetica
Que ya no escriba.Que ya no hable, me pidieron.Que calle.Que todo es inútil, me dijeron.Que no vale la pena tanto esfuerzo.Sin embargo,afuera, en la calle,voces anónimas, sombras, casi sombrasreclamaban el viento, la lluvia azul,el cielo.
অক্টাভিও পাজের কবিতামেক্সিকোর গান
আমার দাদা কফি খেতে খেতেগল্প করতেন – হুয়ারেজ আর পোরফিরিও,জুয়াভ বাহিনী আর প্লাতেয়াদোর ডাকাত দল।টেবিলক্লথ থেকে ভেসে আসতো বারুদের গন্ধ।
আমার বাবা পানীয় পানের ফাঁকেশোনাতেন জাপাতা আর ভিয়াসোতো, গামা আর ফ্লোরেস মাগোন ভাইদের কাহিনী।টেবিলক্লথ থেকে ভেসে আসতো বারুদের গন্ধ।
আমি চুপ করে থাকতামআমি কার গল্প বলবো?
Cancion mexicana
Mi abuelo, al tomar el café,Me hablaba de Juárez y de Porfirio,Los zuavos y los plateados.Y el mantel olía a pólvora.
Mi padre, al tomar la copa,Me hablaba de Zapata y de Villa,Soto y Gama y los Flores Magón.Y el mantel olía a pólvora.
Yo me quedo callado:¿De quién podría hablar?
কবি পরিচয়সেলভা কাসাল (১৯৩০-) উরুগুয়ের কবি। উরুগুয়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুলিও কাসালের কন্যা, পঞ্চাশের দশক থেকে লেখালেখির শুরু। উপরের কবিতাটি তার ২০০১ সালের কবিতাগ্রন্থ ‘ভিভির এস পেলিগ্রোসো’ (‘বেঁচে থাকা বিপদজনক’) গ্রন্থ থেকে নেয়া।
সেলভা কাসালের কবিতাসব মৃতই কখনো শিশু ছিল
তারাদের মত খসে যাবার আগে, মস্তক মাটিতেগড়াগড়ি দেয়ার আগেএসো বিলাপ করি, যে পশুদের বধ করেছিযে মানুষদের হত্যা করেছিযে প্রেমিকদের ক্রুশবিদ্ধ করেছি বিনা কারণেযে অভিযানে যোগ দিয়েছিএকটিবারও বিস্মৃত না হয়েযে সব মৃতই কখনো শিশু ছিলসব মানুষই।
Todos los muertos fueron niños
Antes que como astros las cabezas caigany ruedenlloremos por los animales que hemos matadolos hombres que hemos asesinadolos amores que hemos crucificado para nadalos viajes que no hicimossin olvidarque todos los muertos fueron niñostodos los hombres.
কবি পরিচয়হোসে এমিলিও পাচেকো (১৯৩৯-) – বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মেক্সিকোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ২০০৯ সালে লাভ করেন হিস্পানিক বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার ‘প্রেমিও সের্ভান্তেস’।
অনুবাদ – হোসে এমিলিও পাচেকো’র কবিতাতেওতিহুয়াকান
তেওতিহুয়াকান-এ বৃষ্টি পড়ছে।কেবল মাত্র বৃষ্টিইরহস্যোদ্ধার করতে পেরেছে এই মৃত্যুপুরীর।
Teotihuacan
Llueve en Teotihuacán.Sólo la lluviaha descifrado a esta ciudad de muerte.
টীকা -তেওতিহুয়াকান – মায়া সাম্রাজ্যের প্রাচীন নগরী, মেক্সিকো সিটি থেকে অনতিদূরে অবস্থিত। প্রাক-কলম্বাস যুগে পশ্চিম গোলার্ধের বৃহত্তম শহর ছিল। ৮৩ বর্গ কিমি জুড়ে এর বর্তমান ধ্বংসাবশেষ।
কবি পরিচয়আলবের্তো ব্লাংকো (১৯৫১-) – আধুনিক মেক্সিকান কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রকাশ করেছেন কুড়িটিরও বেশী নিজস্ব কবিতার সংকলন, এবং সমপরিমাণ অনূদিত কবিতার বই।
অনুবাদ – আলবের্তো ব্লাংকো’র কবিতাপালেংকে’র ভালবাসা
পৃথিবীর সকলস্বচ্ছতা এই ভোরের শিশিরে
স্নেহশীল হাতেবোনা শিলা এখানে প্রস্ফুটিত
প্রবালখন্ডগুলোমন্দির আর কাপোকের মাঝে সাগরের পূর্বাভাস
ভেসে বেড়ায়, নিরুদ্দেশ;নদী যেন শ্বেতবর্ণ বাঘের এক লিকলিকে ফিতে
Amor de Palenque
Presente todala claridad del mundo en el rocío
Manos amorosassiembran piedras y los hacen florecer.
Formas de coral,presagio del mar entre templos y ceibas.
Navegan, se pierden:el río es una cinta de jaguares blancos.
টীকা -পালেংকে – দক্ষিণ মেক্সিকোর চিয়াপাস প্রদেশে অবস্থিত প্রাচীন মায়ান শহর। এর ধ্বংসাবশেষ মায়া সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পালেংকের প্রাচীন দেয়ালে খোদাই কারুকাজ ও মূর্তি আজও বিস্ময়কর, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং পর্যটকদের কাছে সমতুল্য আকর্ষনীয়, এবং ব্লাংকোর কবিতার উদ্দীপনা।
কাপোক গাছ – মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার স্বজাতীয় এক উদ্ভিদ প্রজাতি। বিশালাকৃতির গাছ, উচ্চতায় ২০০ ফুট ছাড়িয়ে যেতে পারে আর ব্যাসে ১০ ফুট। মায়া পুরানে অর্থবহ, পুণ্যময়ী গাছ। সেইবা নামেও পরিচিত।
কবি পরিচয়আন্দ্রেস এলোয় ব্লাংকো (১৮৯৭-১৯৫৫) ভেনেজুয়েলার কবি ও রাজনীতিবিদ। তৎকালীন সামরিক শাসক হুয়ান ভিসেন্তে গোমেজ’এর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ‘২৮-এর প্রজন্ম’-র অন্যতম সদস্য।
অনুবাদ – আন্দ্রেস এলোয় ব্লাংকো’র (১৮৯৭-১৯৫৫) কবিতাদরিদ্র ছন্দের সনেট
আমায় দাও রুটি তোমার নিজের হাতে দলাআমায় দাও রুটি তোমার উনুনেতে সেঁকাআমায় দাও রুটি তোমার যাতাকলে পেষাআমায় দাও রুটি তোমার বেলনেতে বেলা
আমায় দাও জমি তোমার হাতের তালুয়ে গোঁজাআমায় দাও পালং তোমার ঘরের কোনে ঠেসাআমায় দাও চুমুক তোমার পিয়াসে নিংড়ানোআমায় দাও পোশাক তোমার গায়ের ঘামে ভেজা
(অসমাপ্ত)
Soneto de la Rima Pobre
Me das tu pan en tu mano amasado,me das tu pan en tu fogón cocido,me das tu pan en tu piedra molido,me das tu pan en tu pilón pilado.
Me das tu rancho en tu palma arropado,me das tu lecho en tu rincón sumido,me das tu sorbo, a tu sed exprimido,me das tu traje, en tu sudor sudado.
Me das, oh Juan, tu dame de mendigo,me das, oh Juan, tu toma de pobrero,tu clara fe, tu oscuro desabrigo,y yo te doy, por lo que dando espero,el oscuro esperar con que te sigoy el claro corazón con que te quiero.
কবি পরিচয়মারিও বেনেদেত্তি (১৯২০-২০০৯) উরুগুয়ের কবি, ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক। বিংশ শতাব্দীর হিস্পানিক সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তার উপন্যাস লা ত্রেগুয়া (The Truce বা যুদ্ধবিরতি) কুড়িটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
অনুবাদ – মারিও বেনেদেত্তি’র কবিতা।এগারো
গীর্জার কোন পাদ্রীইএখনো ব্যাখ্যা দিতেন পারেননিকি কারণেএকাদশ কোন বিধান নেইযেটি নারীকে নিষেধ করবেতার পড়শীর স্বামীকেকামনা না করতে।
(আরেকটি ভার্শন)
পড়শীর স্বামীকে ভালোবাসা নিষেধনারীকে আদেশ করেএমন কোন একাদশ বিধানকেন নেইগীর্জার কোন পাদ্রীইআজ অব্দি তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
Once
Ningún padre de la iglesiaha sabido explicarpor qué no existeun mandamiento onceque ordene a la mujerno codiciar al hombrede su prójima.
টীকা -সিনাই পাহাড়ের চূড়ায় মুসা নবীর প্রাপ্ত দশটি বিধানের (Ten Commandments) শেষটি ছিল “তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীকে কামনা করবে না” (thou shalt not covet thy neighbour’s wife)।
মার্টিন এস্পাদার কবিতা
১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মার্টিন এস্পাদা। ১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দা ইমিগ্রান্ট আইসবয়’স বোলেরো’ প্রকাশিত হ্য।‘সিটি অফ কাফিং অ্যান্ড ডেড রেডিয়েটরস’, ‘ইমাজিন দা এঞ্জেলস অফ ব্রেড’, ‘আলাবাঞ্জা’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।লাতিন আমেরিকা বিশেষ করে পুয়ের্তো রিকোর বিভিন্ন অনুষঙ্গ উঠে আসে এস্পাদার কবিতায়। দীর্ঘদিন লাতিন আমেরিকার শ্রমিকদের অভিবাসনের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি এবং আইনি পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন।‘ রবার্ট ক্রেলি এ্যাওয়ার্ড’, ‘প্যাটারসন পোয়েট্রি প্রাইজ’ ছাড়াও ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কল অ্যাওয়ার্ড’- এর জন্য মনোনীত হয়েছিলেন এস্পাদা। বর্তমানে তিনি ম্যাসাচুসেটস-আমহাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
মার্টিন এস্পাদার কবিতা
শুকনো ভাত আমরা পুয়ের্তোরিকানরা বলিহাড়ির তলায়শুকনো ভাত লেগে থাকারমজাটাই আলাদা!রান্নাঘরের প্রত্নতাত্মিকদের মতোহাতা দিয়ে ঐ শুকনো ভাতগুলিকেচেঁছে তুলি আমরা।
হয়ত ভাতের দামটাই এর কারণহয়ত হাঁড়ির তলায় শুকনো ভাতআটকে থাকাটাকে আমরা রূপক হিসেবে দেখিআবার এমনও হতে পারেহাঁড়ির তলায় লেগে থাকা শুকনো ভাতের যন্ত্রণাটাই আমরা চিবিয়ে খেতে শিখে ফেলেছি। যে মানুষগুলি লাল রঙের গাছ হয়ে গিয়েছেআমি যখন লাল মেপল গাছগুলিকে দেখি আমার ঐ মুচিটির কথা মনে পড়ে যায়ঐ মাছওয়ালাটির কথাও মনে পড়েপাতার মত টকটকে লাল,ম্যাসচুসেটস সরকার যাদের ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলেছিল। আমি যখন লাল মেপল গাছগুলিকে দেখিআমার লাল ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলের কথা মনে পড়ে ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলের মতো দুজন কবিকব্জিতে দড়ি বাঁধানেভির গানবোট ছাড়াই যারাসান খুয়ান উপসাগরের কথা ভেবেছিল। আমি যখন ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলগুলিকে দেখিঠাকুমার কথা মনে পড়ে যায় আমারক্যাটালানে লাল রঙকে যা বলা হয় সেটাই ঠাকুমার নাম ছিল,স্পেনের যুদ্ধহাজার হাজার নামহীন শ্রমিকভাঙা রাইফেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
যখন আমি আমার ঠাকুমাকে দেখিক্যাটালানে যার নামের অর্থ লাল রঙ, আমার য়ুনিয়নের সংগঠকদের কথা মনে পড়ে যারা নামহীন কবরে পড়ে থেকে শুধুলাল গাছগুলিরখাওয়ার জুগিয়ে যাচ্ছে।
যখন আমি একটি পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়েকয়েকশ বছরের পুরনো লাল গাছগুলিকে দেখিআমার মনে হয়, লাল পাতাগুলি আসলে জেলে মরে যাওয়া সন্ত্রাসবাদীদের হাত আর লাল ফুলগুলি, দড়ি দিয়ে বাঁধা কবিদের চোখ-মুখওদের কথা মনে রাখার জন্যেই ফুলগুলি ফুটে আছে।
আমি দেখি লাল রঙের গাছ হয়ে যাওয়া মানুষগুলিভাঙা রাইফেলের মতো তাদের ডালপালা আকাশে তুলে ধরেছে। ———————————————————সংগৃহীত ও সম্পাদিতঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার -১). সুরেশ রঞ্জন বসাক (ভূমিকা ও অনুবাদক)।২). রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় (অনুবাদক)।৩).মৃন্ময় চক্রবর্তী (অনুবাদক)।৪).মোশতাক আহমদ (অনুবাদক)।৫). শৌভিক দে সরকার (অনুবাদক)।