রইল না আর কেউ
০১.
বৃষ্টির দু-চারটে ফোঁটা গায়ে পড়তেই শান্তনু চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু সামনের দুটো বাইক যেরকম আওয়াজ করে ছুটছিল তাতে শান্তনুর কথা কেউ শুনতে পেল বলে মনে হল না।
শান্তনু জোরে-জোরে কয়েকবার হর্ন দিল প্যাঁ–প্যাঁ–প্যাঁপ।
ওর বাইকের পিছনে বসা টুনটুনি চেঁচিয়ে বলল, হারা! জিকো! বাইক থামা–বৃষ্টি পড়ছে।
সামনের দুটো বাইক চালাচ্ছিল হারা আর জিকো। শান্তনুর হর্ন আর টুনটুনির মিহি গলা– দুটোই ওরা শুনতে পেল। তাই বাইকের গতি কমিয়ে পিছন ফিরে তাকাল দুজনে। দেখল টুনটুনি ছটফটে হাত নেড়ে বাইক থামাতে ইশারা করছে।
একটা বিরক্তির ভাব করে হারা বাইক নিয়ে গেল রাস্তার পাশে দাঁড় করাল। জিকোও বাইক সাইড করে হারার বাইকের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর শান্তনু নিজের ক্যারিজমা সাবধানে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল ওদের পাশে।
তিনটে মোটরবাইকের পিছনে বসে থাকা তিনজন টনি, মউলি আর টুনটুনি–নেমে দাঁড়াল রাস্তায়। ওদের পিঠে ঝোলানো রুকস্যাক ভারে ঝুলে পড়েছে নীচের দিকে।
আর তারপরই বৃষ্টি নিয়ে ওদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হল। এই বৃষ্টিতে বাইক চালিয়ে এগোনো ঠিক হবে, নাকি ওরা রাস্তার ধারে গাছের নীচে অপেক্ষা করবে–তারপর বৃষ্টি থামলে আবার বাইক নিয়ে রওনা হবে।
হারা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বৃষ্টির ধরনটা কীরকম সেটা বোঝার জন্য হাত পাতল। মউলি সঙ্গে-সঙ্গে একটা পঞ্চাশ পয়সার কয়েন ওর হাতের চেটোয় দিয়ে ঠাট্টা করে বলল, এর বেশি পারব না–মাপ করো। তারপর বিরক্তভাবে বলল, :, কী না আমার বৃষ্টি তা আবার মাপতে বসেছে! সাধে কি বলে হারাধন!
হারা খেপে গিয়ে কয়েনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রাস্তায়। তারপর বলল, মউলি, লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি–আমার নাম হারা, হারাধন নয়। শান্তনু আর টুনটুনি ওরকম হইচই করল বলে বাইক থামিয়েছি। নইলে এ আর কী বৃষ্টি! ব্যাঙের ইয়ে। শুধু আকাশটা কালো বলে…।
শান্তনু আকাশের দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে কপালে ভাঁজ ফেলে আকাশটা বেশ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল।
আকাশে চাপ-চাপ ঘন কালো মেঘ। সেগুলো খুব ধীরে ধীরে ভেসে বেড়াচ্ছে, একে অপরের সঙ্গে জোড়া লেগে যাচ্ছে। যেখানটায় জোড়া এখনও লাগেনি সেই সামান্য ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল ঘোলাটে আকাশ দেখা যাচ্ছে।
বৃষ্টি যে পড়ছে তার ফোঁটাগুলো মাপে বেশ বড় হলেও সংখ্যায় কম। তাই রাস্তায় ফোঁটাগুলোর দাগ চিতল হরিণের গায়ের মতো দেখাচ্ছে। এই বৃষ্টিতে বাইক চালানো যায় না এমন নয়। কিন্তু শান্তনু একটু সাবধানী–তাছাড়া বাইক চালায়ও একটু ধীরেসুস্থে। এ নিয়ে হারা আর জিকো মাঝেমধ্যেই ওকে ঠাট্টা করে।
ওরা ছজন তিনটে বাইক নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে–কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা গোছের অ্যাডভেঞ্চার। দরকারি জিনিসপত্র সব তিনটে রুকস্যাকে আর তিনটে বাইকের ডিকিতে ঠেসে নিয়ে ওরা ছজন মাঝে-মাঝেই এরকম বেরিয়ে পড়ে কখনও গরমের ছুটিতে, কখনও বা পুজোর ছুটিতে।
ওরা ছজন পাড়ায় তৈরি করেছে অভিযাত্রী ক্লাব। তার নামটা ভারী অদ্ভুত ও দেখব এবার জগৎটাকে। ওদের ক্লাবে আরও চার-পাঁচজন উৎসাহী ছেলেমেয়ে নাম লিখিয়েছে। সপ্তাহে একদিন করে ক্লাবে আসেন অভিজ্ঞ কোনও অভিযাত্রী। তিনি অভিযানের নানান বিষয় শেখান। আর রোজকার মাস্টারমশাই শিবেন্দ্র বিশ্বাস–শিবুদা। তিনি নাঘুন্টি, অন্নপূর্ণা, এরকম বেশ কয়েকটা অভিযানে গিয়েছিলেন। এখন শিবুদার বয়েস হয়েছে। কিন্তু পাড়ার এই ছেলেমেয়েগুলোকে অভিযানমুখী করে তোলার ব্যাপারে তার আগ্রহ কিছু কম নয়। এমনকী ক্লাবের নামটাও শিবুদারই দেওয়া।
শান্তনু আকাশ পরীক্ষা শেষ করে মুখ নামাল, গম্ভীর স্বরে বলল, হারা, মালি–কেস সুবিধের নয়। এ-বৃষ্টি বাড়বে।
শান্তনুর মতো টনিও আকাশ পরীক্ষা করছিল। ওর রোগা বেঁটেখাটো চেহারা, চোখে চশমা। কথাবার্তায় গম্ভীর ইনটেলেকচুয়াল ভাব। ও যে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানী হবে সেটা গোটা কলকাতার সবাই জানে। কারণ, ওই সর্বত্র এটা প্রচার করে বেড়ায়।
ও নানান কায়দায় ঝুঁকে পড়ে, লম্বা হয়ে, একচোখ বুজে আকাশটা পরীক্ষা করছিল।
হারা ওকে আওয়াজ দিল, কী সায়েন্টিস্ট, কী বুঝছ?
টনি আকাশের দিক থেকে চোখ নামাল। ওর শৌখিন চশমার কাঁচে জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামছে।
ও সামান্য পা টেনে-টেনে হারাদের কাছে এগিয়ে এল। পিঠের রুকস্যাকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঠিকঠাক করে নিল। হাইট কম হওয়ায় ওকে অনেকটা পিঠে-ব্যাগ স্কুলছাত্রের মতো লাগছিল।
কান খোল কর সুন লো, ভাইসব। মজার সুরে বলল টনি, প্রচণ্ড বৃষ্টি নামবে। ক্যাস অ্যান্ড ডগস। অ্যাট লিস্ট আমার তাই মনে হচ্ছে।
রিস্টওয়াচের দিকে চোখ রাখল হারা। সওয়া তিনটে।
একটা সাদা রঙের টাটা সুমো ঝড়ের বেগে ছুটে গেল রাস্তা দিয়ে। জলে ভেজা রাস্তায় চড়বড়-চড়বড় শব্দ হল।
ওরা ছজন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জটলা করতে লাগল।
কী করা যায় এখন?
তর্কের ঝড় চলল তিন মিনিট কি চার মিনিট। তারও হয়তো বেশি চলত যদি না বৃষ্টির তেজ আচমকা বেড়ে উঠত।
গাছের ঘন পাতা ভেদ কর জলের ফোঁটা এখন নীচে পড়ছে। ওরা ভিজতে শুরু করেছে।
শান্তনু হাতের তালু দিয়ে বৃষ্টির জল আড়াল করে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। নিজের কেঁকড়ানো চুলের বাহার নিয়ে ওর বেশ ম্যানিয়া আছে। তা নিয়ে টুনটুনি মাঝে-মাঝেই ওকে হেনস্থা করে। বলে, তুই চুলে কেয়োকার্পিন মাখ–তারপর বিনুনি করেনে।
শান্তনু মাথা নেড়ে বলল, না ভাই, আর পারা যাচ্ছে না–শেলটার খোঁজো কুইক।
জিকো বলল, এখানে কোথায় শেলটার পাবি? দুপাশে গাছপালা আর জঙ্গল…।
আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল, মেঘ ডাকল গুড়ুম-গুড়ুম। বৃষ্টির তোড় আরও বেড়ে গেল।
টনি হারার হাত ধরে টান মারল : অনেক হয়েছে, বস্–এবার চলো–মাথা গোঁজার একটা আস্তানা খুঁজি…।
হারা আর শান্তনু বাইকে উঠে পড়ল। ওদের পিছনে উঠে বসল টনি আর টুনটুনি। বাইকে স্টার্ট দিল ওরা।
তাই দেখে জিকো বলে উঠল, শিট।
ওর মুখ বেয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছিল। হাত বুলিয়ে জল মুছে নিয়ে ও বাইকে চড়ে বসল। মউলিকে ডাকল, কাম অন, মউলি, আমরা এখন শেলটারে বেড়াতে যাচ্ছি।
মউলি আর দেরি করল না। প্রায় লাফিয়ে বাইকের পিছনে উঠে বসল। নিয়ম করে জিম এ যায় বলে ওর মধ্যে একটা অ্যাথলিট ভাব আছে।
তিনটে বাইক আবার চলতে শুরু করল–তবে রাস্তা ধরে নয়, গাছপালার আড়াল ভেদ করে।
হারা, জিকো, মউলিরা প্রথম-প্রথম ছোট-ছোট দূরত্বে অভিযান চালিয়েছে। যেমন, ভোরবেলা বেরিয়ে রাতে ফিরে আসা। তারপর ধীরে-ধীরে ওদের অভিজ্ঞতাও বেড়েছে, সেইসঙ্গে দূরত্বও বেড়েছে। ওরা পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ খুঁটিয়ে দেখে বইপত্র পড়ে এক-একটা নাম-না-শোনা জায়গা খুঁজে বের করে আর তারপর প্রবল উৎসাহে সেদিকে বাইক ছুটিয়ে দেয়। বাড়ির লোকেরা শুরুতে বিস্তর ঝামেলা করেছিল, কিন্তু ওদের জেদ আর উৎসাহের কাছে শেষ পর্যন্ত তারা হার মেনেছে। এবারে ওদের গন্তব্য ছিল পত্ৰসায়র। কিন্তু পথে এই বিপত্তি।
ওদের সামনে বড়-বড় গাছ, ছোট-বড় ঝোঁপ আর এবড়োখেবড়ো পথ। এই তিনের মোকাবিলা করে ওদের বাইক চলছিল। আকাশ আঁধার–তাই হেডলাইট জ্বালতে হয়েছে। শান্তনু, জিকো আর হারা চোয়াল শক্ত করে বাইক চালাচ্ছে। বাইকগুলো থেকে-থেকেই লাফিয়ে উঠছে, আবার নীচে পড়ছে। টুনটুনি, মউলি আর টনি হাতল আঁকড়ে ধরে বসে আছে। টনি তো বেশ ভয় পাচ্ছিল, ঝাঁকুনিতে বাইক থেকে না পড়ে যায়। বারবার হারাকে বলছিল, কেয়ারফুল, হারা…।
কিন্তু হারা কোনও জবাব দিচ্ছিল না।
ওরা কষ্ট করে এগোচ্ছিল বটে কিন্তু কোনও শেলটার চোখে পড়ছিল না। আকাশে বিদ্যুৎ, মেঘের ডাক আর বৃষ্টির তুমুল রাজ চলছিল। ওরা যেরকম ভিজে গিয়েছিল তাতে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করে আর কোনও লাভ ছিল না।
হঠাৎই হারা দেখতে পেল বাড়িটা। দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, শেলটার! শেলটার!
হারার বাইক সবার আগে ছিল। তাই বাড়িটা ও প্রথম দেখতে পেয়েছে।
গাঢ় কালো আকাশ আর গাছগাছালির পটভূমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বৃষ্টি-ঝাপসা একটা জীর্ণ মলিন দোতলা বাড়ি। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, সিমেন্ট-বালির কুৎসিত ঢিবি একটা। কিন্তু কুৎসিত ঢিবির অন্য একটা আকর্ষণ ছিল–যেটা হারাদের সবচেয়ে অবাক করেছে।
কালচে ছায়াময় বাড়িটায় আলো জ্বলছে। বৃষ্টি ভেদ করেও সে-আলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে।
হারার পরেই বাকি পাঁচজন বাড়িটা দেখতে পেল।
গাছপালা আর আগাছা শেষ হয়ে গেছে হঠাৎই। তারপর বিঘেখানেক ফাঁকা জায়গা। সেখানে স্রেফ ঘাস ছাড়া আর কোনও গাছের চিহ্নমাত্র নেই। মনে হতে পারে, কেউ যেন যত্ন নিয়ে ঘাসের চাষ করেছে। তবে এ কোনও শৌখিন ঘাস নয়–অতি সাধারণ ঘাস–মাঠে ঘাটে যে-ঘাস দেখা যায়।
বাড়িটা সেই ফাঁকা জমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ঝাপসা বিমূর্ত ছবির মতো।
আকাশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত বিদ্যুতের সাদা উজ্জ্বল আলো ঝলসে উঠল। ফ্ল্যাশবা জ্বেলে বাড়িটার যেন ফটো তুলল কেউ।
টনি শান্তনুকে ডেকে বলল, শান, ব্যাপক লাক আমাদের–ওই যে শেলটার!
শান্তনু চেঁচিয়ে গানের সুরে বলে উঠল, আমরা করব জয়…।
বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মোটরবাইকের গর্জন সঙ্গত করছিল আগে থেকেই। এবার তার সঙ্গে জুড়ে গেল ওদের ছজনের হুল্লোড়। শেলটার খুঁজে পাওয়ার আনন্দে ওরা মেতে উঠল পলকে। ফাঁকা জমিতে ওদের বাইক গতি বাড়িয়ে দিল।
একটু পরেই ওরা এসে পড়ল বাড়ির দরজায়। চারপাশের ঘাসজমি জলে জলাকার। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ব্যাঙের ডাক।
বাইকগুলো বাড়ির কাছ ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে সবাই নেমে পড়ল বাইক থেকে। মুখ-চোখের জল মুছতে মুছতে এগিয়ে গেল বাড়ির দরজার কাছে।
মউলি প্রথম খেয়াল করল ব্যাপারটা।
বাড়ির সদর দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। আর সেখানে যত রাজ্যের ধুলো আর মাকড়সার জাল। বাড়ির ভেতর থেকে ছিটকে আসা আলোয় মাকড়সার জালের সুতোগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
বাড়িটায় বোধহয় কেউ থাকে না। ওই দেখ, স্পাইডার্স ওয়েব–। মউলি দরজার জোড়ের কাছটায় আঙুল দেখিয়ে বলল।
হারা কখন যেন একটা টর্চ বের করে নিয়েছিল। মউলির কথায় ও টনি আর শানকে ঠেলে সরিয়ে দরজার কাছে এল। টর্চের আলো ফেলল দরজার ওপরে।
ঠিকই বলেছে মউলি। বাড়িটায় কেউ থাকে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে।
কী অদ্ভুত ব্যাপার!
বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠল আবার। কড়কড় করে বাজ পড়ল কোথাও। টুনটুনি ভয়ে আঁতকে উঠে শানের জামা চেপে ধরল।
হারা দরজার আশেপাশে তাকিয়ে কলিংবেলের বোতাম খুঁজল–পেল না। তখন দরজার কড়া নাড়ল জোরে। চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, কেউ আছেন?
কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
এইবার হারার পাশে এসে দাঁড়াল জিকো। দরজার কড়া ধরে এমনভাবে নাড়া দিল যে, মনে হল এই বুঝি কড়াটা উপড়ে চলে আসবে ওর হাতে।
কড়ার প্রচণ্ড খটাখট শব্দের পর ওরা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল। কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
টুনটুনি জিকোর পাশ থেকে চাপা গলায় বলল, মনে হল বাড়িতে কেউ নেই…।
সঙ্গে-সঙ্গে জিকো ধুত্তেরি বলে শক্ত হাতের এক ধাক্কায় দরজার পাল্লা দুটো ঠাস করে খুলে দিল। তারপর ওরা ছজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে।
মেঝেতে জমে থাকা ধুলোর ওপরে ওদের এলোমেলো ভেজা পায়ের ছাপ পড়তে লাগল। ওদের কৌতূহলী চোখ এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগল।
নাঃ, কেউ নেই।
টনি কেমন যেন ভিতু গলায় বলে উঠল, এ তো আজব বাড়ি দেখছি!
ঠিক তখনই চোখ ঝলসানো সাদা আলো কালো আকাশ চিরে দিল। তারপরই কানফাটানো শব্দে বাজ পড়ল।
.
০২.
আশ্রয় তো পাওয়া গেল। কিন্তু এ কেমন আশ্রয়! ফাঁকা মাঠের মাঝে একটা জীর্ণ বাড়ি। বাড়িতে কেউ নেই অথচ দরজা-জানলা খোলা…কয়েকটা ঘরে, বারান্দায় আলো জ্বলছে!
ওরা ছজন এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। চোখের ভাষায় অনেক প্রশ্ন। কিন্তু ওদের পা এগিয়ে যাচ্ছিল।
সদর দরজার পর একটা অলিন্দ। অলিন্দের শেষ প্রান্তে হলদেটে বা জ্বলছে। ওরা ভেজা গায়ের জল ঝাড়তে ঝাড়তে একটা খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল।
ঘরে টিউবলাইট জ্বলছে। একপলক দেখেই বোঝা যায়, ঘরটা এককালে বসবার ঘর ছিল। তবে এখন তার ধূলিমলিন হতমান অবস্থা। একটা সঁতসেঁতে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে চারপাশে।
ঘরের দুটো জানলাই হাট করে খোলা। খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়ে একটা জানলার পাল্লা খটাখট শব্দে পাগলের মতো বাড়ি খাচ্ছে দেওয়ালে।
ব্যাপক বাড়ি মাইরি! মন্তব্য করল জিকো ও আলো-ফালো জ্বেলে বাড়ির লোকজন সব হাওয়া!
মউলি বলল, ধুলোর যা ক্যারেকটার দেখছি তাতে এ-বাড়ির লোকেরা অন্তত ছমাস আগে হাওয়া হয়েছে। এই শান, জানলা দুটো বন্ধ করে দে-জলের ছাট আসছে।
শান সঙ্গে সঙ্গে এগোল একটা খোলা জানলার দিকে। আর হারা অন্য জানলাটায় হাত লাগাল।
শান নীচু গলায় হারাকে বলল, বাড়িটা বোধহয় হন্টেড।
হারা ভূত-টুতে বিশ্বাস করে না। তাই তাচ্ছিল্যের একটা শব্দ করে বলল, ধুস!
ঘরে পুরোনো আমলের সব চেয়ার, টেবিল, আর একটা বেঢপ আলমারি। আলমারির দরজার ওপরের দিকের খানিকটা অংশ কাচের। সেই মলিন কাচের ভেতর দিয়ে ঠাসা কাগজপত্র আর বইয়ের গাদা চোখে পড়ছে। এ ছাড়া টেবিলেও বই আর কাগজপত্রের ডাঁই।
এসবের ওপরে চোখ বুলিয়ে টনি বলল, যারা থাকত তারা হেভি পড়ত। বোধহয় সায়েন্টিস্ট ফায়েন্টিস্ট হবে…।
হ্যাঁ, তোমারই মতন– হেসে বলল হারা।
জিকো চেঁচিয়ে উঠল, ও. কে., গাইড। এসব বাজে কথা পরে হবে–আগে কাজের কথা শোনো।
বাকি পাঁচজন নিজেদের গুঞ্জন থামিয়ে জিকোর দিকে তাকাল।
জিকো বলল, বাইরে বৃষ্টির যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে আজকের রাতটা আমাদের এখানেই থাকতে হবে–এই শেলটারে।
টুনটুনি একটু ভিতু গলায় বলল, এখানে রাতে থাকতে হবে? এই ভূতুড়ে বাড়িতে? এখন তো সবে চারটে বাজে। বৃষ্টি থেমে গেলে..মানে, আকাশ ক্লিয়ার হয়ে গেলে…।
এক ধমকে ওকে থামিয়ে দিল জিকো।
তুই একটা ক্যাবলা, টুনি। ধর পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটায় বৃষ্টি ধরে গেল। তারপর বাইক নিয়ে বেরিয়ে আমরা কোথায় যাব? একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। তখন সেই আবার শেলটার খুঁজতে হবে। আমাদের রুটম্যাপ কী বলছে, শান?
ওরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরোলে রুট-ম্যাপ স্টাডি করার দায়িত্ব শান্তনুর। ও কবিতা লেখে, দু-একটা কবিতা ছোট কাগজে ছাপাও হয়েছে। তারপর থেকে ও কবি কবি ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু কবি হলে কী হবে, রুট-ম্যাপ স্টাডির ব্যাপারে ও নাম্বার ওয়ান।
ও চটপট বলে উঠল, আমি অলরেডি ক্যালকুলেশান করেছি। জিকো ঠিকই বলছে, টুনি। আজ আমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে। ভয় পাচ্ছিস কেন? জাস্ট একটা তো রাত!
শানের কথায় টুনি বোধহয় কিছুটা ভরসা পেল। ও কাঁচুমাচু হয়ে ওপর-নীচে মাথা নাড়ল।
জিকো বলল, আর কোনও কথা নয়। আমাদের ফার্স্ট কাজ হল বাইকের ডিকি থেকে মালপত্রগুলো নিয়ে আসা। হারা, শান–চল–চটপট কাজ সেরে নিই। এর মধ্যেই আমার আবার খিদে পাচ্ছে।
হারা আর শান জিকোর সঙ্গে দরজার দিকে এগোল। যেতে-যেতে হারা বলল, জিকো, তোর দেখছি ঘণ্টায়-ঘণ্টায় খিদে পায়–এটা কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি…।
জিকো হারার চুল ধরে টেনে দিল : তুমিও কম কীসের, বস্–?
শান টুনিদের দিকে ফিরে বলল, তোরা এবার রুকস্যাকগুলো পিঠ থেকে নামা। এই ঘরেই সব গুছিয়ে রাখ–আমরা এক্ষুনি আসছি।
ওরা বেরিয়ে যেতেই টুনটুনি, মউলি আর টনি ঘরের এক কোণে গিয়ে ভেজা রুকস্যাক মেঝেতে নামাল। খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে রুকস্যাক খুলে জিনিসপত্র বের করে সাজিয়ে রাখতে লাগল।
হারা, শান আর জিকো একটু পরেই ফিরে এল। হাতে মালপত্র, গা থেকে জল ঝরছে। বৃষ্টির তেজ এখনও কমেনি।
ওরা জিনিসগুলো টনিদের সামনে নামিয়ে রাখল। জিকো বলল, তোরা এগুলো গুছিয়ে রাখ, আমরা ততক্ষণে বাড়িটা একবার ইন্সপেক্ট করে আসি। দেখে আসি বাড়ির ভূতুড়ে মালিক কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে কি না। অচেনা লোকের বাড়িতে এভাবে আমরা হুট করে ঢুকে পড়লাম…পারমিশান না নিয়ে…।
শান বলল, থাক, থাক, ঢের হয়েছে–এবার চল, অ্যাডভেঞ্চারে বেরোই…।
ওরা তিনজন বাড়িটা ঘুরে দেখতে বেরোল।
পিছন থেকে মউলি আওয়াজ দিল, দেখিস, অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে আবার হারিয়ে যান না!
শান হেসে বলল, আমি হারিয়ে গেলে টুনি আমাকে খুঁজে বের করবে।
এ-কথায় হেসে উঠল সবাই। শান মউলিদের হাত নেড়ে টা-টা করে অলিন্দে বেড়িয়ে পড়ল।
ভেজা পোশাক ছাড়তে মউলি আর টুনটুনি শুকনো জামাকাপড় নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। টনিও নিজের পাজামা আর টি-শার্ট বের করে ভেজা পোশাক পালটাতে লাগল।
গোয়েন্দা পুলিশের মতো বাড়িটায় তন্নতন্ন করে চিরুনি তল্লাশি চালাল শান্তনুরা।
নাঃ, বাড়িতে সত্যিই কেউ নেই। তবে একসময় যে কেউ থাকত তার বেশ কিছু চিহ্ন পাওয়া গেল। ধুলোমাখা জামাকাপড়, চটি, চুতো, রান্নার বাসনপত্র, আরও কিছু টুকিটাকি ছড়িয়ে রয়েছে। বাড়ির এখানে-সেখানে।
বাড়িটায় মোট পাঁচটা ঘর–একতলায় তিনটে, আর দোতলায় দুটো। এ ছাড়া একতলায় রান্নাঘর আর বাথরুম, দোতলায় শুধু একচিলতে বাথরুম। দোতলায় ঘর দুটোর সামনে বেশ খানিকটা খোলা ছাদ। ছাদে ছোট-ছোট টবে অনেক গাছ।
প্রথমে একতলাটা ঘুরে দেখল ওরা।
দ্বিতীয় ঘরটা প্রথম ঘরটার মতো। কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। ঘরটা মাপে ছোট কিন্তু অগোছালো। ঘরে এলোমেলোভাবে ছড়ানো জিনিসপত্র দেখে বোঝা যায় ঘরটা কাজ-চালানো গোছের ল্যাবরেটরি। ঘরের আসবাব বলতে একটা প্রকাণ্ড মাপের কাঠের টেবিল। তার ওপরে পড়ে আছে বেশ কয়েকটা টেস্টটিউব, কাচের বোতল, বকযন্ত্র, স্ট্যান্ড, হিটার, আরও সব টুকিটাকি। একটা র্যাকে বেশ কয়েকটা কেমিক্যালের বোতল আর ছোট-ছোট মাটির টব। টবে কয়েকটা গাছ। গাছগুলো শুকিয়ে গেছে।
শান, জিকো আর হারা অনেকক্ষণ ধরে ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর শান বলল, টনি ঠিকই গেস করেছে। লোকটা সায়েন্টিস্ট ছিল।
কীসের সায়েন্টিস্ট? গাছপালার? হারা জিগ্যেস করল।
জিকো হারার মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, গাছপালার সায়েন্টিস্ট কী রে! বল বোটানিস্ট।
ওই হল– হারা মন্তব্য করল।
ল্যাবরেটরিটা অযত্ন আর অবহেলার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ঘরে ছোট-ছোট দুটো জানলা। জানলা দিয়ে মেঘলা আলো এসে পড়েছে। ঘরের সিলিং-এ, র্যাকে, সর্বত্র ঝুল আর মাকড়সার জাল।
এরপর ওরা গেল দোতলায়।
সেখানেও ওই সর্বনাশা হাল।
বাড়িটা শুধু যে পুরোনো তা নয়। তৈরিও হয়েছে যেমন-তেমন করে, বদখত ভাবে। দেখে মনে হয়, রাজমিস্ত্রিদের মারাত্মক তাড়াহুড়ো ছিল। তাছাড়া প্ল্যানেরও কোনও মাথামুণ্ডু নেই। জানলাগুলো বেঢপ ছাঁদের। সিঁড়ির ধাপগুলো এক-একটা এক-এক মাপের। ওঠা-নামা করতে কষ্ট হয়।
বাড়ির আনাচে-কানাচে বাদুড় আরশোলা আর চামচিকে বাসা বেঁধেছে। সেইসঙ্গে ঝুল-কালি তো আছেই। দেওয়ালের বেশিরভাগ জায়গায় প্লাস্টার নেই। সিঁড়ির রেলিং কোথাও আছে কোথাও নেই।
বাড়িটায় দোতলায় ছাদে অসংখ্য মাটির টব। জলে-বাতাসে টবগুলোয় শ্যাওলা ধরে গেছে। কোনও-কোনও গাছ অযত্নে মরে গেছে। তবে বেশিরভাগই এখনও তাজা সবুজ।
টবের একটা গাছও ওরা চিনতে পারল না। তবে এটুকু খেয়াল করল যে, গাছগুলো অদ্ভুত ধরনের। উচ্চতায় বেঁটে-খাটো–অনেকটা বনসাইয়ের মতো। আর পাতাগুলো কারও সরু-সরু, আবার কারও-বা চওড়া।
বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে পাতাগুলো নড়ছিল। হঠাৎ করে মনে হচ্ছিল, পাতাগুলো বুঝি সাধারণ উদ্ভিদ নয়, প্রাণীর মতো জীবন্ত।
শান্তনু বলল, টুনি হলে দু-চারটে গাছ চিনতে পারত। ওর তো বাগান করার ম্যানিয়া আছে।
জিকো মন্তব্য করল, কিছু মাইন্ড করসি না, শান, বড়লোকের মেয়েদের ওরকম অনেক ম্যানিয়া থাকে।
শান কোনও উত্তর না দিয়ে গম্ভীর হয়ে রইল।
এর কারণটা হারা জানে। শান আর টুনির বন্ধুত্বটা বড্ড বেশি ক্লোজ। তা ছাড়া জিকো টুনিকে যে দারুণ পছন্দ করে এমন নয়।
প্রসঙ্গ পালটাতে হারা বলল, শোন, টুনি আর মউলিকে দোতলায় একটা ঘর ছেড়ে দে–।
শান বলল, তা হলে পাশের ঘরটায় আমি আর টনি থাকব।
হারা ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ও. কে.। আমি আর জিকো তা হলে একতলার পেছনের ঘটায় আস্তানা গাড়ছি..।
জিকো ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকাল : ও. কে. উইথ মি।
তদন্ত আর তল্লাশি সেরে ওরা তিনজন নীচে নেমে এল। ততক্ষণে প্রথম ঘরটাকে টনি, মউলি আর টুনি সাফসুতরো করে দিব্যি গুছিয়ে ফেলেছে। মউলির কানে ওয়াকম্যানের হেডফোন, কোমরে ছোট্ট বিদেশি ওয়াকম্যান। ও গানের তালে-তালে শরীর দুলিয়ে নাচছে আর সুর মিলিয়ে গাইছে? কল হো না হো…।
ঘরে ঢুকেই হারা চেঁচিয়ে বলল, শোনো সবাই। গুড নিউজ। বাড়িটার মালিক আমরা। বাড়িতে আর কেউ নেই।
শান টনিকে বলল, তুই ঠিক ধরেছিস। এ-বাড়ির মালিক সায়েন্টিস্ট ছিল। একতলায় লাস্টের
ঘরটা ওর ল্যাবরেটরি ছিল। মনে হচ্ছে, লোকটা গাছপালা নিয়ে রিসার্চ করত।
টনি গম্ভীরভাবে বলল, হু। ল্যাবটা আমাকে একবার দেখতে হবে।
টুনটুনি মজা করে মন্তব্য করল, সে আর বলতে! মিনি সায়েন্টিস্ট বলে কথা!
টনি একবার টুনির দিকে তাকাল শুধু–কোনও কথা বলল না।
হারা, শান আর জিকো রুকস্যাক খুলে যার-যার শুকনো পোশাক বের করে নিল। বাকিদের দাঁড়া, ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি বলে চলে গেল।
একটু পরে ওরা ফিরে এল।
জিকো জোরে জোরে হাততালি দিয়ে বলল, লি এভরিবডি। ব্যাক টু বিজনেস। নাচা গানা পরে হবে। অ্যাই, মউলি!
মউলি তখনও নাচ-গানে মশগুল ছিল। তাই ওকে আলতো করে ঠেলা মারল জিকো? আগে শোন, পরে নাচবি–।
মউলি থামল। কান থেকে হেড-ফোন খুলে নিয়ে হাত দিয়ে মাথার ভিজে চুল ঝাড়ল। ওর বয়কাট চুল বৃষ্টিতে ভিজে খোঁচা-খোঁচা হয়ে আছে।
বল, কী বলবি– জিকোর দিকে তাকিয়ে বলল ও।
জিকো বলল, আমরা ঠিকই গেস করেছি। দেয়ারস্ নোবডি ইন দ্য হাউস। তবে ইনভেস্টিগেট করে মনে হল, মাত্র একজনই থাকত এ-বাড়িতে…হোয়াট ডু ইউ সে, হারা?
হারা ঠোঁট কামড়াল। এক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, আমার তো সেটাই মনে হল। জামা, প্যান্ট, জুতো–যা-যা পেয়েছি সেগুলোর সাইজ চেক করে দেখি সব এক মাপের। একটাই লোক থাকত এখানে…।
হ্যাঁ জিকো সায় দিল : গ্রোন-আপ ম্যান। তবে সে সবকিছু ফেলে রেখে পালাল কেন সেটাই বুঝতে পারছি না…।
শান গালে হাত বোলাতে-বোলাতে বলল, হয়তো কোনও কিছু দেখে…ইয়ে…মানে, ভয়ে পালিয়েছে…।
মউলি জিগ্যেস করল, গোস্ট-টোস্ট কিছু? অর সামথিং লাইক দ্যাট…।
টুনটুনি আমতা-আমতা করে বলল, পালিয়েছে, নাকি মারা গেছে?
চোখের চশমাটা একটু টাইট করে বসিয়ে টনি বলল, মারা গেলে বডিটা গেল কোথায়? ওটা তো আর হেঁটে বা দৌড়ে পালাতে পারে না!
জিকো হাত নেড়ে বলল, সে যাই হোক, যে এখানে থাকত সে এখান থেকে চলে গেছে… পর রিজত্স আনোন…।
টনি মেঝেতে বসেছিল। হঠাৎই হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সামান্য খুঁড়িয়ে হেঁটে জিকোর কাছে এল।
ছোটবেলায় সাইকেল-ভ্যানের ধাক্কায় টনি চোট পেয়েছিল। তারপর থেকে ও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। ওর পা-টা পুরোপুরি সারেনি।
টনি বলল, জিকো, ডিডাকটিভ লজিক দিয়ে আরও একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে। লোকটা চলে গেছে রাতের বেলায় কারণ, কয়েকটা ঘরে আলো জ্বেলে রেখে গেছে। সে ভেবেছিল তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। তাই দরজা খোলা রেখে গিয়েছিল কিন্তু আর ফেরেনি…।
কিংবা ফিরতে পারেনি। টনির কথার পিঠে মন্তব্যটা জুড়ে দিল শান।
ফিরতে পারেনি কেন? হারা প্রশ্ন করল।
সেটাই তো মিস্ট্রি– ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল জিকো, হয়তো বাইরের জঙ্গল থেকে কোনও অ্যানিম্যাল এসে তাকে অ্যাটাক করেছে..।
এই জঙ্গলে আবার কী অ্যানিম্যাল থাকবে? মউলি প্রশ্ন তুলল ও এখানে নিশ্চয়ই বাঘ টাগ নেই…।
বাঘ না থাকুক, হায়েনা থাকতে পারে। একটু ভেবে জিকো আবার বলল, কিংবা ধরো নেকড়ে। এনিওয়ে, পসিলি কোনও অ্যানিম্যাল লোকটাকে অ্যাটাক করে মেরে ফেলেছে। তারপর…।
শান্তনু জিকোকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ওসব ছাড়। মোদ্দা কথা, লোকটা উধাও হয়ে ভালোই হয়েছে। বাড়িটায় আমরা শেলটার পেয়েছি। ও থাকলে হয়তো আমাদের গ্রুপটাকে ঢুকতেই দিত না। শুধু চেক করে দেখ বাড়িটা হন্টেড কিনা।
শানের মুখের সামনে বুড়ো আঙুল নেড়ে ঠাট্টা করে মউলি বলল, এখন আর কোনও চয়েস নেই, শান। এটা আমাদের ওনলি শেলটার।
শান মউলির দিকে কটমটিয়ে তাকাল।
জিকো থুতনিতে হাত বুলিয়ে বলল, একটা কথা মনে হচ্ছে। এ-বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই পিকিউলিয়ার টাইপের। এইরকম ফাঁকা একটা জায়গায় বাড়ি করেছে। সেখানে ব্যাপক খরচ করে পোল বসিয়ে ইলেকট্রিক কানেকশান নিয়েছে। ডিপ টিউবওয়েল আর পাম্প বসিয়েছে…কারণ, আমি দেখেছি, ছাদে জলের ট্যাঙ্ক রয়েছে–বাথরুমে কল দিয়ে ফাইন জল পড়ছে…।
এ থেকে কী প্রমাণ হয়? জিকোর কথার মাঝে টনি প্রশ্ন তুলল।
প্রমাণ হয় এটাই যে, এত ট্রাবল আর পয়সা খরচ করে যখন কেউ একটা থাকার জায়গা তৈরি করে তখন তার একটা মেগা পারপাস থাকবে। সো, সেই মানুষটা নিজের ইচ্ছেয় ভ্যানিশ হবে না।
সে তো নেকড়ের ইচ্ছেয় ভ্যানিশ হয়েছে। মউলি ফুট কাটল।
এই মন্তব্যে হারা, টুনি আর শান হেসে উঠল।
জিকো খেপে গিয়ে হাত নেড়ে বলল, হাসি নয়, ব্যাপারটা সিরিয়াস। গেস করার চেষ্টা করো হোয়াট ইজ দ্যাট মেগা পারপাস…।
টনি হাত নেড়ে জিকোকে বাদা দিল ও ফরগেট অ্যাবাউট পারপাস। লোকটা সায়েন্টিস্ট ছিল। হয়তো খানিকটা পাগল ছিল, কিংবা হয়তো এখানে একটা টুরিস্ট স্পট ডেভেলাপ করতে এসেছিল…সো হোয়াট? টু হেল উইথ হিজ ব্লাডি পারপাস। আমরা এখানে থাকছি–তো হইচই করে থাকব, হুল্লোড় করে কাটাব। মোট কথা, এখন এই বাড়িটা আমাদের–ও. কে.?
অফ কোর্স! বলে মউলি এগিয়ে এসে টনির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল।
জিকো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে। রাতে আমরা কে কোন ঘরে থাকব শুনে নাও। তারপর কিছু একটা খাওয়ার ব্যবস্থা করো..আমার পেটে আগুন জ্বলছে।
ওরা আলোচনা শুরু করল। মউলি আর টুনি প্যাকেট খুলে প্রত্যেকের হাতে একটা করে কেক ধরিয়ে দিল। টনি তিন বোতল জল বের করে সবার সামনে রাখল। শান্তনু গান ধরল ও শ্রাবণ তুমি বাজনা বাজাও পাগলাঝোরা হয়ে…।
বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ হচ্ছিল। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল, শব্দের তেজ আগের চেয়ে কমে এসেছে।
.
০৩.
দোতলায় টনি আর শানের ঘরের দরজায় পাগলের মতো ধাক্কা দিচ্ছিল হারা। আর একইসঙ্গে ওদের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছিল ও শান! টনি! শিগগির ওঠ! শান! এই শান! টনি।
হারার ধাক্কায় পুরোনো দরজাটা এমনভাবে থরথর করে কাঁপছিল যেন এক্ষুনি ভেঙে পড়বে।
হারার মুখ-চোখ ভয়ে পালটে গেছে। মনে হচ্ছে, ওকে কোনও প্রেতাত্মা তাড়া করেছে, আর ও প্রাণের ভয়ে আতঙ্কে ছুটে এসেছে টনিদের দরজায়।
আরও কয়েকটা জবর ধাক্কার পর দরজা খুলে দিল টনি। চোখে চশমা নেই। মাথার চুল এলোমেলো। কপালে বিরক্তির ভাঁজ।
চোখ ডলতে ডলতে টনি জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? এই মাঝরাতে চিল্লিয়ে কঁচা ঘুম চটকালি কেন?
হারা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, জিকো নেই।
নেই মানে?
নেই মানে নেই–ওকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।
দরজার ধাক্কায় ঘুম না ভাঙলেও ওদের কথাবার্তার সঙ্গে শান্তনুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ও এসে দাঁড়াল টনির পিছনে। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, পায়ে পাজামা।
করিডরের বাবের আলোয় হারাকে বেশ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। ও এমনিতে মোটেই ভিতু নয় কিন্তু এখন যে-কোনও কারণে হোক ভয় পেয়েছে।
শান জিগ্যেস করল, কটা বাজে?
সাড়ে চারটে মতন– হারা বলল, এখন কী হবে?
টনি ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। একটু পরেই চশমা চোখে দিয়ে ফিরে এল। তারপর শান্তনু আর টনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। ওদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
মউলিদের ডাকব! টনি শান্তনুর কাছে জানতে চাইল।
শান্তনু হাত নেড়ে বলল, একদম না। ওরা এসব শুনলে ভয়ে হয়তো কান্নাকাটি শুরু করে দেবে।
অবশ্য মউলি শক্ত ধাতের মেয়ে। ও হয়তো সিনক্রিয়েট করবে না। কিন্তু টুনটুনিকে ভরসা নেই। ভাবল টনি।
শান হারার হাত চেপে ধরে জিগ্যেস করল, কেসটা এজ্যাকুলি কী হয়েছে খুলে বল দেখি।
হারা হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে শুরু করল।
রাত তখন কটা হবে কে জানে! হঠাৎই একটা শব্দে হারার ঘুম ভেঙে যায়। বৃষ্টি ধরে গিয়েছিল বলে হারা আর জিকো একটা জানলা খুলে শুয়েছিল। হারার মনে হয়, জানলা দিয়েই শব্দটা আসছে। তাই ও বিছানা ছেড়ে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারে।
আকাশে চাঁদ ছিল না। তার ওপর আকাশ ছিল ঘোলাটে, আর টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। তাই বাইরে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায়নি হারা। শুধু দূরের জঙ্গলটাকে ঘোর কালো ছায়ার মতো দেখিয়েছে। তবে শব্দটা আলতোভাবে হলেও শোনা যাচ্ছিল।
কীরকম টাইপের শব্দ? টনি জিগ্যেস করল।
কীরকম শব্দ? হারাকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। কিছুক্ষণ ভেবে ও আমতা-আমতা করে বলল, ভেজা মাটিতে চাবুক মারার মতন–তারপর পা ঘষে ঘষে যাওয়ার মতো আওয়াজ…।
হারার উত্তর শুনে এই বিপদেও হেসে ফেলল শান আর টনি।
শান বলল, ভেজা মাটিতে চাবুক মারার শব্দ মানে…।
না, মানে, ভেজা ঘাসের ওপরে সরু কিছু বারবার আছড়ে পড়লে যেমন শোনায়..ওইরকম টাইপের…।
টনি বলল, চল, নীচে চল।
ওরা বেখাপ্পা সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল।
শান বলল, তারপর কী হল বল…।
হারা হাত নেড়ে বলতে শুরু করল? .তারপর তো আমি শুয়ে পড়েছি। ঘুমে চোখ টেনে গেছে। আর কিছু টের পাইনি। অনেক পরে…কতক্ষণ অবশ্য জানি না…ঠান্ডায় ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠেই টের পেলাম বেশ শীত শীত করছে। কোথা থেকে যেন ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে।
উঠে দেখি জিকো পাশে নেই… আর ঘরের দরজা খোলা। ব্যস, চোখের পলকে ঘুম উধাও। তখনই লক্ষ করলাম, দরজা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া ঢুকছে।
লাফিয়ে উঠে ঘরের বাইরে এসে দেখি সদর দরজাটাও ভোলা। ছুটে গেলাম সেদিকে। ভাবলাম, জিকো বোধহয় কোনও কারণে বাইরে বেরিয়েছে। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর চালিয়ে ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না। তা ছাড়া ওই অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখার উপায় আছে! তো তখন আমি ওর নাম ধরে দু-চারবার ডাকলাম। কোনও সাড়া নেই। তারপরই আগের সেই পিকিউলিয়ার শব্দটা শুনতে পেলাম। ভাবলাম, সাপ-টাপ হতে পারে। তাই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তোদের ডাকতে গেছি…।
হারার কথা শুনতে-শুনতে ওরা নীচে নেমে এসেছিল। তারপর বারান্দার আলো জ্বেলে সোজা চলে গিয়েছিল সদর দরজার কাছে।
শান দরজাটা হাট করে খুলে দিল। বৃষ্টিভেজা বাতাস ছুটে এল ওদের দিকে।
বাইরেটা ঘোর অন্ধকার। এ সময়ে আকাশে যে সামান্য আলোর আভা থাকার কথা সেটা শুষে নিয়েছে জমাট কালো মেঘ। বাতাসে চঞ্চল দুরের গাছপালার শব্দ হালকাভাবে ভেসে আসছে। আর তাকে ছাপিয়ে ব্যাঙের ডাক।
শান বেশ কয়েকবার জিকো! জিকো। বলে ডাকল।
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।
ও তখন বলল, হারা, কুইক ছুট্টে একটা টর্চ নিয়ে আয়।
হারা ছুটল।
শান দরজার চৌকাঠ ছেড়ে নীচে নামতে যাচ্ছিল, পিছন থেকে টনি ওর পাজামা টেনে ধরল : না, বাইরে যাবি না!
শান ফিরে তাকাল টনির দিকে। আগামী দিনের বিজ্ঞানীর চোখে ভয়।
টনি বলল, দিনের আলো ফুটুক তারপর যা খোঁজ করবার করবি। এখন বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।
শান দরজার বাইরে ভেজা ঘাস-জমির দিকে তাকাল। কল্পনায় যেন দেখতে পেল, সেই জল থইথই জমিতে অসংখ্য বিষধর সাপ কিলবিল করে বেড়াচ্ছে।
হারা টর্চ নিয়ে এল। শান টর্চটা নিয়ে তার আলো ছুঁড়ে দিল বাইরের অন্ধকারে।
বৃষ্টির জলে ভিজে নেয়ে একসা ঘাসের দল যেন ঘুম ভেঙে তাকাল ওদের দিকে। জায়গায় জায়গায় বৃষ্টির জল জমে পুঁচকে পুকুর। আর চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের কোরাস।
নেই। জিকো কোথাও নেই।
দরজা বন্ধ করে হারার ঘরে ফিরে এল ওরা তিনজন। ওদের মুখচোখ দেখলেই বোঝা যায়। অ্যাডভেঞ্চার করার খুশি-খুশি মেজাজটার বিশ্রীভাবে তাল কেটে গেছে।
মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল টনি। হাতের কাছে রাখা প্লাস্টিকের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে বলল, হারা, দিস ইজ টু মাচ। জিকোর মতো একটা হাট্টাকাট্টা ইয়াং ছেলে কখনও স্রেফ হাওয়ায় ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে?
ওর পাশে বসে পড়ে শান বলল, আকাশে আলো ফুটলেই আগে চেক করতে হবে ওর বাইকটা আছে কি না।
হারা বসল শানের পাশে। অবাক হয়ে জানতে চাইল, মাঝরাত্তিরে ও বাইক নিয়ে কোথায় যাবে?
সত্যিই তো! অজানা-অচেনা জায়গায় মাঝরাত্তিরে বাইক নিয়ে দোকানপাটের খোঁজে বেরোনোটা শুধু যে অবাস্তব তা-ই নয় হাস্যকরও।
ওরা মনের ভেতরে হাতড়াতে লাগল পাগলের মতো। জিকোর মুখটা ওদের চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
লম্বা-লম্বা চুল। দারুণ চেহারা। ডানপিটে। আর হিন্দি ছবির পোকা ছিল জিকো। গানের তালে-তালে শরীর ঝাঁকিয়ে নাচতে পারত। কোনও একটা ব্যান্ডের সঙ্গে ট্রিল বাজাত। ওর হিরো হওয়ার শখ ছিল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই শানের হঠাৎ মনে হল, জিকো সম্পর্কে সবকিছুই ও কেমন যেন পাস্ট টেন্স-এ ভাবছে ছিল, পারত, বাজাত।
শানের বুকের ভেতরটা হঠাৎই কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। কান্না পেয়ে গেল ওর। মনে পড়ল, গত সপ্তাহে ও যখন নতুন লেখা একটা কবিতা বন্ধুদের পড়ে শোনাচ্ছিল তখন জিকো আচমকা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, তোকে একটা কথা দিতে হবে, শান।
কী কথা?
তুই আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখবি।
উঁহু সম্ভব নয়। গম্ভীরভাবে বলেছিল শান্তনু।
কেন?
কেন জানো না? হেসে প্রশ্ন করেছিল, কাউকে নিয়ে কবি কবিতা লেখে সে মারা যাওয়ার পর। তুমি তো এখনও বিন্দাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ।
আর সবাই হেসে উঠেছিল এ-কথায়।
একটু পরে জিকো শানের বুকে একটা ঠোকা দিয়ে বলেছিল, তা হলে মরে গেলে লিখবি তো? কথা দে।
আগে মরো, ইয়ার–তারপর দাখো কী ফাটাফাটি কবিতা লিখি…।
সবাই হেসে উঠেছিল আবার।
সেই কথাগুলো শান্তনুর মনে পড়ছিল। জিকো যেন ওর কানের পাশে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলছে, কী রে শান, এবার কবিতা লেখ। তুই তো কথা দিয়েছিলি, বস্।
শান্তনু হঠাৎই কেঁদে ফেলল। চোখে হাত চাপা দিল ও।
হারা আর টনি কাছে এসে ওর পিঠে হাত রাখল। অন্তরের আবেগে ফুঁপিয়ে উঠল শান্তনু। ওর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল।
ভাঙা গলায় ও বলল, জিকো আর নেই…।
টনি আর হারা ধমক দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিল। বলল, আলো ফুটলেই জিকোর আসল খোঁজ শুরু হবে।
.
সকাল হল বটে, তবু সেটাকে রাতের চেয়েও অন্ধকার মনে হল শান্তনুর। ও যখন নিজের কবিতাকে নিজের তৈরি সুরে গানের মতো গাইত তখন জিকো তাল ঠুকত। কখনও ওর আঙুল চলত কোনও বাড়ির জানলার পাল্লায়, কখনও টিফিন ক্যারিয়ারের ওপর বাজাত, আবার কখনও বা স্রেফ কিছু খুচরো পয়সা মুঠো করে তাল ঠুকত।
সেই বাজনা বাজানো হিরো হতে চাওয়া ডাকাবুকো ছেলেটাকে এখন খুঁজতে বেরোতে হবে।
বৃষ্টি আর নেই, যদিও আকাশ ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে পরদার পিছনে স্তিমিত সূর্যকে মরা চাঁদের মতো নিস্তেজ দেখাচ্ছে। প্রকৃতির সব জায়গাতেই বৃষ্টির ভেজা সিলমোহরের ছাপ।
ওরা পাঁচজন আর সময় নষ্ট করেনি। জিকোর খোঁজে উতলা হয়ে উঠেছে। টুনি দরজার চৌকাঠ ছেড়ে মাঠে নামেনি। তবে বাকি চরাজন বেরিয়ে পড়েছে বাইরে।
প্রথমেই ওরা গেল বাইকগুলোর কাছে।
বাইক তিনটে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কাল রাতে ওরা হয়তো অনেক কিছু দেখেছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছে না।
বর্ষার জলছবি চোখ টানার মতো। যেদিকে চোখ যায় ঘন সবুজ। হালকা বাতাস বইছে। বাতাসে ভেসে আসছে বুলবুলির শিস। এ ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ সুন্দর।
জলময় ঘাস-জমিতে ছপাৎ-ছপাৎ করে পা ফেলে ওরা জিকোর উধাও হওয়ার রহস্যটা বুঝতে চাইল।
শান বলল, বাইক যখন নেয়নি তখন ও বেশি দূর যেতে পারেনি…।
কিন্তু ও মাঝরাতে হঠাৎ দরজা খুলে বাইরে বেরোল কেন? হারা জিগ্যেস করল।
তারপর আপনমনেই কিছুক্ষণ কী ভেবে বলে উঠল, ও আমার মতো ওই শব্দ শুনে জেগে ওঠেনি তো?
টনি লম্বা-লম্বা ঘাসের ডগা সরিয়ে মাটির কাছে কী দেখছিল। হারার কথায় মুখ তুলে তাকাল : আমিও সেটাই ভাবছিলাম। ওই চাবুকের মতো শব্দে ওর হয়তো ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারপর কিউরিয়োসিটিতে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে বাইরে।
তারপর? শান্তনু জানতে চাইল।
টনি আর কোনও উত্তর দিতে পারল না। কেমন বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল, কী একটা ও বলতে চায় কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে।
মউলি কোমরে দু-হাত রেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর সবুজ সালোয়ার অনেকটা করে গোটানো। বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুলে পাঁচ রঙের নেলপালিশ। হঠাৎ করে মনে হয় নানা রঙের ফুল ফুটে আছে।
ও ভুরু উঁচিয়ে বলল, তারপর কী হল সেই স্টোরিটাই তো আমরা বুঝতে চাইছি।
টনি একটু আমতা-আমতা করে বলল, সেই লোকটার কথা মনে পড়ছে–এই বাড়িটার যে মালিক আঙুল তুলে বেঢপ বাড়িটায় দিকে দেখাল টনি? সেই লোকটাও বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি। আলো জ্বেলে দরজা হাট করে খুলে রেখে সে চলে গিয়েছিল। ঠিক এই মোমেন্টে আমরা পাঁচজন ভ্যানিশ হয়ে গেলে যে সিচুয়েশান হবে।
ওরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বোধহয় টনির কথাটা নাড়া দিয়ে গেল সবাইকে।
শান বলল, জিকো হায়েনা আর নেকড়ের কথা বলছিল…।
ওরা তাকাল দুরের গাছপালার দিকে। কাল রাতে ওই ঘন সবুজের আড়াল থেকে হঠাৎই কি বেরিয়ে এসেছিল কোনও হায়েনা কিংবা নেকড়ে? তারপর নিরস্ত্র জিকোকে আক্রমণ করেছে?
কিন্তু জিকো তো লড়াই না করে হার মানার পাত্র নয়!
দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে টুনটুনি চিৎকার করে জানতে চাইল, কী রে, কিছু পেলি?
ওরা চারজনেই টুনির দিকে তাকিয়ে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল।
শান হঠাৎই হারার দিকে তাকিয়ে বলল, হয়েনা বা নেকড়ে না হয়ে অন্য কিছুও হতে পারে…।
অন্য কিছু মানে?
একটু ইতস্তত করে শান জবাব দিল, ভূত-টুত..মানে, নিশির ডাকে এরকম…।
মউলি খিলখিল করে হেসে একেবারে যেন গড়িয়ে পড়ল। তারপর হাসির দমক সামলে বলল, বোগাস!
শান আহত গলায় বলল, হেসে উড়িয়ে দিলেই হল! জিকোর ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও তা হলে বোগাস! তুই ওকে আমাদের সামনে হাজির কর দেখি!
ঠিক তখনই টনি ঘাসের আড়াল থেকে কী একটা খুঁজে বের করে হাতে তুলে নিল।
জিনিসটা আকাশের ঘোলাটে আলোতেও চকচক করে উঠল।
শান আর মউলি প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠল, জিকোর আংটি!
আংটিটা ওদের সকলের চেনা। হোয়াইট মেটালের তৈরি ডিজাইন করা একটা চওড়া রিং। জিকোর ডানহাতের বুড়ো আঙুলে ওটা ছিল।
আংটিটা দেখেই ওরা চারজন কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। ওদের মনে হল, জিকোকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আংটিটা ঘিরে ভিড় করল ওরা। ওটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
হঠাৎই শ্বাস টানল মউলি। আংটির গায়ে কীসের দাগ? রক্ত মনে হচ্ছে।
এই দেখ, আংটির গায়ে ব্লাড-স্টেইন লেগে আছে! মউলি বলল।
সঙ্গে-সঙ্গে বাকি তিনজন ঝুঁকে পড়ল আংটিটার ওপরে। ওটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। দেখল রক্তের ছিটে লেগে আছে আংটির বাইরে-ভেতরে দু-দিকেই। আংটিটা জিকোর হাত থেকে খুললই বা কে, আর ওটার ভেতর দিকে রক্তের দাগ লাগলই বা কেমন করে?
শান আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কাঁপা গলায় বলে উঠল, জিকো আর নেই…। তারপর মাথা নীচু করে চোখ ঢাকল হাতে।
হারা বলল, জিকোর কথাই তা হলে সত্যি হল…।
টনি চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, চল, আর একটু খুঁজে দেখি। হারা, তুই জিকোর হান্টিং নাইফটা নিয়ে আয়।
শান আর মউলির দিকে একপলক তাকিয়ে হারা ছুটল বাড়ির দিকে। ভেজা ঘাস-জমিতে ছপছপ শব্দ হল।
বাইরে কোথাও অ্যাডভেঞ্চারে বেরোলে জিকো সবসময় ওর শখের একটা হান্টিং নাইফ সঙ্গে নিত। এবারেও সেটা নিতে ভোলেনি।
ঘর থেকে ছুরিটা নিয়ে আসার সময়ে হারার মনে হল, রাতে বেরোনোর সময় জিকো যদি ছুরিটা সঙ্গে নিয়ে বেরোত তা হলে বোধহয়…।
সদর দরজায় হারাকে দাঁড় করিয়ে টুনটুনি প্রশ্নে-প্রশ্নে ওকে জ্বালিয়ে মারছিল। জিকোর আংটির কথা শুনে ও কেঁদে ফেলল।
হারা ওর পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিল। বলল, আমরা এখনও সার্চ করে যাব। হয়তো দেখব জিকো স্লাইটলি উন্ডেড হয়ে জঙ্গলে পড়ে আছে। লেট আস হোপ…।
হারা দৌড়ে চলে এল মউলিদের কাছে।
ওরা আবার শুরু করল ওদের খোঁজ।
খুঁজতে খুঁজতে ঘাস আর আগাছার এলাকা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। হারার হাতে বাগিয়ে ধরা হান্টিং নাইফ। ওর দুপাশে টনি আর শান্তনু। পিছনে মউলি।
কিন্তু বহু খোঁজ করেও ওরা কিছু পেল না। হতাশ হয়ে বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে। ওদের পিছন থেকে ভেসে আসছিল নাম-না-জানা পাখির ডাক।
শান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছছিল বারবার।
মউলি বড়-বড় শ্বাস ফেলছিল। ওর মুখ থমথমে। ভয়ের চোখে বারবার এপাশ-ওপাশ দেখছিল।
হারার কপালে ভাঁজ। ওর চোখ হায়েনা কিংবা নেকড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
টনি চোখা নজরে ঘাসের দিকে তাকিয়ে অনুসন্ধানের কাজ চালাচ্ছিল। ওর মন বলছিল জিকোর আরও কোনও চিহ্ন কোথাও না-কোথাও অবশ্যই পাওয়া যাবে।
শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল।
লম্বা-লম্বা ঘাসের ফাঁকে জিকোর ছিন্নভিন্ন গেঞ্জি আর পাজামা পাওয়া গেল। ছেঁড়া পোশাকগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। রক্তে, জলে, কাদায় মাখামাখি।
পোশাকগুলো শুধু যে শতছিন্ন তাই নয়–সেগুলোর গায়ে রক্তের ছাপ। আর সেই পোশাক থেকে আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে।
ওরা চারজন ভীষণ ভয় পেল। শান পোশাকগুলো বুকে জড়িয়ে ডুকরে উঠল।
মউলি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল ভেজা জমিতে।
হারা বিভ্রান্তের মতো স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে।
আর টনি শানকে জাপটে ধরে ওর গায়ে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। ওর চোখের কোণে জল।
কিছুক্ষণ পর নিজেদের সামলে নিয়ে ওরা বাড়ির দিকে ফিরে চলল। কিন্তু সংশয়ের খোঁচা থেকেই গেল। জিকোর যে সত্যি-সত্যি কী হয়েছে সেটা যেন ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না। ওরা সেই রহস্য নিয়েই আলোচনা করছিল। বুঝতে চাইছিল রহস্যের সমাধানটা। কিন্তু মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল।
.
০৪.
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর হারা একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। ও মাঝে-মাঝে লুকিয়ে সিগারেট খায়। তবে এখন সিগারেট ধরিয়েছে জিকোর ব্যাপারটা সামলে নিয়ে সহজ হওয়ার জন্য।
ওকে সিগারেট ধরাতে দেখেই টুনি নাক কুঁচকে ওর কাছ থেকে দূরে সরে বসল।
শান বলল, হারা, তুই যে কেন জোর করে এই নেশাটা ডেভেলাপ করছিস কে জানে! সাধ করে ক্যানসারকে কেউ ইনভাইট করে না।
হারা সিগারেটে টান দিয়েই কয়েকবার কেশে উঠল। কাশি থামলে পর বলল, না রে, আমি নেশা ডেভেলাপ করব না। একটু প্র্যাকটিস করেই ছেড়ে দেব। জিকোর কিন্তু কাশি হত না…।
আবার ঘুরে ফিরে সেই জিকো!
আজ সকাল থেকে কতবার যে জিকোর নাম এসে পড়ল কথায় কথায়।
টনি বোধহয় বাথরুমে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকেই শানকে জিগ্যেস করল, কী রে, কী ঠিক করলি? আমরা কি রওনা হচ্ছি, না থাকছি?
শান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ইশারায় ওকে কাছে ডাকল ও আয়, বোস। সেটাই এখন ডিসকাস করব।
টনি এসে বসে পড়ল ওদের মাঝে।
শান একটু ভারী গলায় বলল, শোনেনা সবাই। যদি আমরা এখন রওনা দিই তা হলে রাত নটার মধ্যে কলকাতা পৌঁছে যাব। আর যদি জিকোর ব্যাপারটা নিয়ে আর একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখতে চাই তা হলে আজ নয়, কাল সকালে স্টার্ট দিতে পারব।
টুনটুনি বলল, এখানে কোনও টাওয়ার নেই। মোবাইলে কলকাতার কানেকশান পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা পুলিশে…।
টনি ওর কথার ওপরে কথা বলে উঠল, হা, সেইজন্যেই আমরা পুলিশে কোনও খবর দিতে পারছি না। আর এখানে লোকাল থানা কোথায় কে জানে!
একটু থেমে টনি আবার বলল, জিকো যে… আর নেই…সেটা নিয়ে আমার কয়েকটা খটকা আছে–
মউলি বলল, আমারও। ও. কে., তুই আগে বল–।
টুনটুনি একটা কৌটো থেকে জোয়ান নিয়ে সবাইকে বিলি করছিল। ও বিড়বিড় করে বলল, যদি থেকে যেতে হয় তা হলে আজকের রাতটা কেয়ারফুল থাকতে হবে…।
মউলি অপছন্দের চোখে ওর দিকে একবার তাকাল শুধু।
টনি বলল, জিকোকে সাধারণ কোনও পশু মারেনি। কারণ, ওর ড্রেসের সঙ্গে ফ্লেশ বা বোনের কোনও টুকরো নেই। মাংস কিংবা হাড়ের টুকরো না থাকায় মনে হচ্ছে মুরগির পালক ছাড়ানোর মতো পশুটা যেন আগে থাবা দিয়ে জিকোর পাজামা আর গেঞ্জি ছাড়িয়েছে, তারপর রেলিশ করে ওকে সাবাড় করে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে..।
টনির কথা শুনে হারা ঘেন্নায় শিউরে উঠল। জানলার কাছে গিয়ে হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে। তারপর মাথার কদমছাঁট চুলে হাত বুলিয়ে জানলার পাশে হেলান দিয়ে উনি আর মউলির দিকে তাকিয়ে রইল।
মউলি টনির দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলে উঠল, ঠিক বলেছিস। তার মানে অ্যানিম্যালটা নিশ্চয়ই আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। তা ছাড়া ওয়ান মোর পয়েন্ট ও জিকোর আংটি পাওয়া গেল এক জায়গায়, আর ড্রেসগুলো পাওয়া গেল অন্তত বিশ-তিরিশ ফুট দূরে। এর মানে কী? আংটিটা জিকোর আঙুল থেকে খুলে পড়ল কেমন করে?
শান একপাশে চুপচাপ বসে জোয়ান চিবোচ্ছিল আর চোয়ালে আঙুল চালাচ্ছিল। ও শান্ত গলায় বলল, মউলি, তোর আর টনির কথার সঙ্গে আমি আরও কয়েকটা মিস্ট্রি অ্যাড করছি। আংটিটা যেই জিকোর আঙুল থেকে খুলে নিক না কেন এটা শিয়োর যে, জিকো তখন উল্ডেড– কারণ, আংটির গায়ে রক্তের ছিটে।…এরপর আসা যাক জামা কাপড়ে। ড্রেসগুলো রক্তে এমন মাখামাখি যে, স্পষ্ট বোঝা যায়, জিকো তখন সাংঘাতিক উন্ডেড–হয়তো বেঁচে ছিল না এমনও হতে পারে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মনোযোগী মুখগুলোকে দেখল শান। তারপর? এখন মিস্ত্রি হল, ঘাসে বা মাঠে কোথাও একফোঁটা রক্ত নেই কেন?
সবাই চুপ করে রইল।
একটু পরে হারা বলল, মে বি বৃষ্টির জলে সব ধুয়ে গেছে।
ধুয়ে যাবেটা কোথায়? গম্ভীর ভাবে জানতে চাইল টনি, আমি পা দিয়ে খুঁচিয়ে ঘাসের গোড়াগুলো ভালো করে দেখেছি। আংটির জায়গাতে কোনও রক্তের দাগ ছিল না, কিংবা জামাকাপড়ের আশেপাশেও কোনও দাগ-টাগ পাওয়া যায়নি। এই ব্যাপারটা দারুণ মিস্টিরিয়াস।
তা হলে কি আকাশপথে কোনও প্রাণী এসে জিকোকে অ্যাটাক করেছে? ওকে শূন্যে তুলে নিয়ে খতম করে তারপর রক্ত চুষে খেয়েছে? একেবারে ইংলিশ হরার মুভির মতো?
কথাগুলো বলেছে মউলি। হারা সঙ্গে-সঙ্গে ওকে হাত তুলে থামতে ইশারা করেছে। বলেছে, প্লিজ, মউলি–আমার ভালো লাগছে না। গা গুলিয়ে উঠছে।
মউলি সিরিয়াস গলায় বলল, আমি এসব বলছি এইজন্যে যে, এগুলো অ্যাবসোলিউটলি অ্যাবসার্ড। আর সেইজন্যেই আমার মনে হচ্ছে, মে বি জিকো ইজ স্টিল অ্যালাইভ। হয়তো উন্ডেড…কিন্তু বেঁচে আছে।
বাকি চারজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মউলি বুঝতে পারল, ওরা ওর কথা বিশ্বাস করতে চাইছে, অথচ ওদের চোখে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠেছে।
টনি হাত তুলে ইশারা করে সকলের মনোযোগ চাইল। তারপর ধীরে-ধীরে বলল, অনেক তো আলোচনা হল…এবার লাখ টাকার প্রশ্নটা করি। তোমরা কেউই এই প্রশ্নটা করোনি। অথচ এটাই সবচেয়ে ভাইটাল কোশ্চেন… একটু থামল টনি। চশমার কাচের আড়াল থেকে উৎসুকভাবে দেখল সবাইকে। তারপর নিজেই মুখ খুলল, বলতে পারো, জিকো চিৎকার করেনি কেন? কোনও জন্তু-জানোয়ার অ্যাটাক করলে সেটাই তো ছিল স্বাভাবিক।
ওরা সবাই চুপ।
সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটা এতক্ষণ কারও মনে আসেনি, সত্যিই তো, জিকো চিৎকার করেনি কেন? তা ছাড়া ধস্তাধস্তির কোনও শব্দও কেউ শুনতে পায়নি।
মউলি হঠাৎই বিষণ্ণ থমথমে ভাবটা কাটিয়ে একলাফে উঠে দাঁড়াল ৪ টনির কোশ্চেনটা আমার থিয়োরিকেই সাপোর্ট করছে। মানে, পুরো ব্যাপারটাই অ্যাবসোলিউটলি অ্যাবসার্ড। সো, লেট আস তোপ জিকো এখনও বেঁচে আছে। সুতরাং শান, উই আর স্টেয়িং টুডে-ও.কে.?
শান মাথা নেড়ে বলল, আমার তো সেটাই ইচ্ছে…।
টনি বলল, আমারও।
হারা ঠোঁট উলটে বলল, আমার কোনও আপত্তি নেই।
টুনটুনি করুণ চোখে চার বন্ধুর দিকে তাকাল। তারপর মিনমিন করে বলল, আমি একা আর কোথায় যাব।
শান বলল, ও. কে, তা হলে আজ আমরা থাকছি। কাল কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। এই থাকার ব্যাপারে কয়েকটা পয়েন্ট সবাইকে বলে দিই। আমাদের হান্ড্রেড পারসেন্ট কেয়ারফুল থাকতে হবে। রাতে আমরা কেউই বাইরে বেরোব না কিছুতেই না। আর আমি, টনি আর হারা জানলা দিয়ে বাইরেটা ওয়াচ করব। দরকার হলে রাত জাগব। কী, টনি ঠিক আছে? হারা, ও.কে.?
টনি আর হারা মাথা নেড়ে সায় দিল।
শান বলল, তা ছাড়া দিনের বেলাতেও বাইরে না বেরোনোই ভালো। অ্যাজ সাচ বাইরে বেরোনোর তো কোনও দরকার নেই। স্টিল যদি কেউ বেরোয় তা হলে সবাইকে জানিয়ে বেরোবে।
এরপর ওদের জমায়েতটা ভেঙে গেল।
টুনি আর মউলি দোতলায় উঠে এল। ঘরে না ঢুকে ওরা ছাদে এসে দাঁড়াল। শান্তনুও কখন যেন এসে দাঁড়াল ওদের পাশে।
এখন দুপুর হলেও চারপাশটা শীতের শেষ বিকেলের মতো ঠান্ডা ধূসর। আকাশে ঘোলাটে মেঘ। মেঘ আর-একটু গাঢ় হলেই আবার বৃষ্টি নামতে পারে।
যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। গ্রাম যদি দূরে কোথাও থেকে থাকে তা হলে সবুজ তাকে আড়াল করে দিয়েছে।
প্রশান্ত ভেজা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে শান ভাবছিল প্রকৃতি সত্যিই রহস্যময়। কোথা থেকে আচমকা বৃষ্টি ঢেলে দিয়ে ওদের ছজনকে এক জটিল রহস্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার মধ্যে একজন এখন আবার নেই।
ওরা যাচ্ছিল পত্রসায়রের দিকে। অথচ এখন পড়ে রইল পত্ৰসায়র–চলে এল অচেনা এক গ্রামে। এমন এক অদ্ভুত গ্রাম যেখানে একটি মাত্র বাড়ি। সেটাও আবার সিমেন্ট-বালি দিয়ে তৈরি।
বাড়িটা এত পুরোনো আর ভাঙাচোরা যে, আলো-টালো না থাকলে দিব্যি ভূতুড়ে বাড়ি বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। বাড়িটার মালিকও বেশ অদ্ভুত। আলো জ্বেলে দরজা খুলে রেখে সে উধাও জিকোর মতো। কিন্তু সেটা হয়তো বিজ্ঞানীর খেয়াল। জিকোর মধ্যে তো সেরকম খামখেয়ালি ব্যাপার ছিল না!
শান এসব ভাবছিল আর জিকোর জন্য দুঃখ পাচ্ছিল। এরকম একটা জায়গায় কত কবিতার লাইন মনে আসার কথা, অথচ একটাও মনে আসছে না। তার বদলে একটা চাপা কষ্ট বুকের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
টুনি ঝুঁকে পড়ে টবের গাছগুলো দেখছিল। ও গাছের ভক্ত হলেও এই গাছগুলো ঠিক চিনে উঠতে পারছিল না। কোনও গাছই এক-দেড় ফুটের চেয়ে লম্বা নয়। তার মধ্যে কয়েকটা আবার লতানে গাছ। কোনও গাছের পাতা ছোট মাপের, কোনওটার-বা আবার বড়। এক-একটা গাছে ফুটে আছে ছোট-ছোট রঙিন ফুল।
টুনি উবু হয়ে বসে অবাক চোখে দেখছিল। কারণ, একসঙ্গে এতগুলো অচেনা গাছ ও কখনও দেখেনি। গাছের শখ মেটানোর টানে ও বেশ কয়েকটা বই কিনেছে–তাতে ছবিও আছে অনেক। কিন্তু সেই ছবিগুলোর একটাও এই গাছগুলোর সঙ্গে মিলছিল না।
ছাদের যেদিকটায় টবগুলো রাখা আছে সেদিকটা শ্যাওলা ঢাকা। টবগুলোও কালচে-সবুজ শ্যাওলায় মলিন। কিছু কিছু টব ফাটা, ভাঙাচোরা। ভাঙা টবের কয়েকটা গাছ হেলে গেছে। আবার কয়েকটা গাছ লতিয়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে।
মউলি বলল, কী রে, কয়েকটা গাছ নিয়ে যাবি নাকি?
টুনি ওর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল ও নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। গাছগুলো বেশ রেয়ার– আগে কখনও দেখিনি।
শান ওদের কাছে এল। একটা গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই গাছটা নিয়ে চল– ব্যাপক দেখতে।
শানের দেখানো গাছটার দিকে তাকাল টুনটুনি আর মউলি। ওদের কাছ থেকে তিনটে টবের পিছনে রয়েছে গাছটা। মাঝারি মাপের সবুজ পাতা। আর তারই ফাঁকে-ফাঁকে ফুটে রয়েছে লম্বা লম্বা সবুজ ফুল। ফুলের চারপাশে ছোট-ছোট হলুদ রোঁয়া। আর প্রতিটি ফুলের নীচের সুতোর মতো সরু কয়েকটা করে শুঁড় ঝুলছে।
গাছটা টুনির মনে ধরল। ও দুটো টবের ফাঁকে শ্যাওলা ধরা মেঝেতে বাঁহাতের ভর দিল। তারপর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল একটা সবুজ ফুলের দিকে।
সবুজ ফুল ওরা আগে কখনও দেখেনি। ফুলগুলো যেন সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে গেছে। টুনি হাত বাড়িয়ে একটা ফুল ছিঁড়তে গিয়েছিল। কিন্তু ফুলের নীচে গাছটার গায়ে ওর আঙুলের ছোঁয়া লাগতেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।
সুতোর মতো সরু চারটে শুঁড় চোখের পলকে টুনির আঙুল জড়িয়ে ধরল। পাকের পর পাক দিয়ে জড়িয়ে গেল লাটাইয়ের সুতোর মতো।
টুনি আঃ! শব্দ কর এক হ্যাঁচকা টানে হাতটাকে ফেরত নিয়ে এল। শুঁড়গুলো ছিঁড়ে এল গাছের কাণ্ড থেকে।
শান আর মউলি চমকে উঠল। মউলি টুনিকে জাপটে ধরে টেনে নিয়ে এল টবগুলোর কাছ থেকে।
শুঁড়গুলো তখনও টুনির ডানহাতের আঙুলে জড়িয়ে রয়েছে। আর সবুজ কেঁচোর মতো অল্প-অল্প নড়ছে।
টুনির গা ঘিনঘিন করে উঠল। ও হাতটা ঝাড়া দিতে লাগল বারবার। ওর গলা চিরে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল।
শান চট করে চলে এল ওর কাছে। ওর পাশটিতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। তারপর পোকামাকড় ঝেড়ে ফেলার ঢঙে টুনির আঙুল থেকে ছেঁড়া শুঁড়গুলো ছিটকে ফেলে দিল।
মেঝেতে পড়েও শুঁড়গুলো নড়তে লাগল। ওরা তিনজন তাড়াতাড়ি কয়েক হাত পিছিয়ে গেল।
যন্ত্রণায় আকুলিবিকুলি করা মিনি লাউডগা সাপের মতো সবুজ শুঁড়গুলো মোচড়াতে লাগল, পাক খেতে লাগল। যেন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করছে।
একটু পরেই শুঁড়গুলো স্থির হয়ে গেল।
টুনি ভয়ের গলায় বলে উঠল, এ কীরকম গাছ রে বাবা! হরিবল!
মউলি ওর আঙুলের ওপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, তোর আঙুলে কিছু হয়নি তো!
না, সেরকম কিছু হয়নি–শুধু আঙুলগুলো একটু চুলকোচ্ছে। এই বলে ওড়না দিয়ে আঙুলগুলো ভালো করে ঘষে ঘষে মুছতে লাগল টুনি।
শান এদিক-ওদিক খুঁজে একটা শুকনো কাঠি জোগাড় করল। তারপর সেই কাঠিটা এগিয়ে ধরল সবুজ ফুলগুলোর সামনে। ফুলের গোড়ায় খোঁচা দিল।
কিন্তু কিছুই হল না।
এবারে শুঁড়ের গায়ে কাঠি ছোঁয়াল শান। কিন্তু শুঁড়গুলো মোটেই কাঠিটাকে জড়িয়ে ধরল ।
শান অবাক হয়ে বলল, স্ট্রেঞ্জ! টুনির আঙুলের বেলায় টেন্ট্যাক্সগুলো চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অথচ এই কাঠিটার বেলায় কেমন কোল্ড…।
মউলি গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, রিয়েলি স্ট্রেঞ্জ। অন্য গাছগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখবি নাকি?
কী দরকার? টুনি বলল।
শান কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ছাদের এককোণে। ছাদের পাঁচিলের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে তাকাল নীচের দিকে।
ঘাসের কার্পেট ছন্নছাড়াভাবে ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। কোথাও ভয়ের কোনও নাম-গন্ধ নেই। এমনকী লম্বা-লম্বা ঘাস আর আগাছার মধ্যে অন্য কোনও অদ্ভুত গাছও চোখে পড়ছে না।
ছাদের ছোট্ট টবে যে-ভয়ংকর গাছ ওরা এইমাত্র আবিষ্কার করল, সেরকম কোনও শিকারি গাছ যদি লুকিয়ে থাকে ওই ঘাসজমিতে। কিংবা জঙ্গলের ভেতরে! হয়তো ওরা শিকারি পশুর মতো চলে বেড়ায়। শিকার দেখলেই অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শান্তনু শিউরে উঠল। ওর কবি-মন কল্পনায় কল্পনায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
ও ফিরে তাকাল টুনি আর মউলির দিকে। মেজাজটা হালকা করার জন্য টুনিকে জিগ্যেস করল, কী রে, একটু আগে বলছিলি যে, ওই গাছের চারা নিয়ে যাবি নাকি কলকাতায়?
রক্ষে করো! প্রায় আঁতকে উঠে বলল টুনি, ওই রাক্ষুসে গাছ লাগালে আমার বাকি গাছ সব সাবাড় হয়ে যাবে।
এরপর ওরা দোতলার ঘরে গিয়ে ঢুকল। সকলের মন ভালো করার চেষ্টায় শান্তনু কয়েকটা কবিতা শোনাল। মউলি ওর স্কুলের ফেস্ট-এর গল্প শোনাল। আর টুনি শোনাল আমেরিকার গল্প। ওর কাকা সদ্য ফিরেছেন ও-দেশ থেকে। ওঁর কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো দারুণ থ্রিলিং আর ইন্টারেস্টিং। কারণ, টুনির কাকা জিয়োলজিস্ট-ও-দেশে গিয়ে কয়েকটা অভিযান চালিয়েছেন।
কিন্তু ওদের গল্প মোটেই জমছিল না। জিকো বারবার এসে হাজির হচ্ছিল ওদের মাঝখানে। ওদের ডেকে বলছিল, কী রে, আমাকে খুঁজে বের করবি না?
ওদের গল্পের তাল কেটে যাচ্ছিল।
একটু পরেই ওদের সব গল্প কোনও ম্যাজিকে ফুরিয়ে গেল। ওর মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে রইল।
.
০৫.
টনি আর হারা একতলার ঘরে বসে জিকোর কথা আলোচনা করছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, পড়াশোনা আর বেড়ানো নিয়ে যত সব পুরোনো স্মৃতিকথা। যেসব কথা বহুদিন মনে পড়েনি সেসব কথাও আজ স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে। যেন কেউ স্মৃতিকথার বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেলেছে একটানে।
কথা বলতে-বলতে জানলার কাছে গেল টনি। বাইরে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হারার দিকে ফিরে বলল, কাল রাতের ওই পিকিউলিয়ার সাউন্ডটা আর-একবার ডেসক্রাইব করতো।
হারা শব্দটার চরিত্র সাধ্যমতো বর্ণনা করার চেষ্টা করল।
টনিও খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করল। বারবার জানতে চাইল, শব্দ ছাড়া আর কোনও অদ্ভুত ব্যাপার ও টের পেয়েছে কি না। উত্তরে হারা মাথা নেড়ে না বলল বটে, কিন্তু ওর মধ্যে একটা দোনামনা ভাব ছিল।
সেটা লক্ষ করে টনি আবার ওকে চাপ দিল। বলল, ভালো করে ভেবে বল। এর ওপর আমাদের বাঁচা-মরা ডিপেন্ড করছে।
হারা তখন আমতা-আমতা করে বলল, বলছি কিন্তু ব্যাপারটা আমার মনের ভুলও হতে পারে। আমি..মানে…ঠিক শিয়ের না…কিন্তু…
ওসব ইয়ে ছেড়ে বলে ফেল…।
শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে পারফিউমের মতো একটা গন্ধ পেয়েছিলাম খুব হালকা মিষ্টি গন্ধ। গন্ধটা পেয়ে বেশ অবাক লেগেছিল।
কেন?
কারণ, মউলি বা টুনি ওই পারফিউম লাগায় না। ওদেরটা অন্যরকম…।
তারপর?
তারপর আর কী! আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল–শুয়ে পড়েছি।
এরপর টনি ভাবতে বসল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভেবেও কোনও কুল পেল না।
ঘরের একপাশে বেঢপ মাপের টেবিল। টেবিলে কাগজের গাদা। তার পাশে একটা কলমদানিতে তিনটে বলপয়েন্ট পেন।
টেবিলের ঠিক পাশেই বিশাল আলমারিটা। বই আর কাগজপত্রে ঠাসা। আলমারির পাল্লার কাচগুলো ময়লা পড়ে ঘোলাটে হয়ে গেছে। দুটো পাল্লায় পুরোনো আমলের দুটো পিতলের কড়া লাগানো।
বাড়িওয়ালার জিনিসপত্রের সঙ্গে ওদের মালপত্র রেখে বসবার ঘরটা এখন একেবারে গোডাউনের চেহারা নিয়েছে।
আলমারি আর টেবিলের কাগজপত্র-বইয়ের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল টনি। আচমকা ও বলে উঠল, অ্যাই হারা, চল তো, ওই পেপার্সগুলো ঘেঁটে দেখি–যদি কোনও ক্ল পাওয়া যায়…।
টনির প্রস্তাবে হারা তেমন উৎসাহ পেল না। এখন আবার ওই কাগজপত্রের ধুলো আর ময়লা ঘাঁটতে হবে!
কিন্তু টনিকে থামায় কে! আগামী দিনের বিজ্ঞানী বলে কথা! ও চট করে চলে গেল টেবিলের কাছে। একপাশে পড়ে থাকা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারটা টেবিলের কাছে টেনে নিয়ে বসে পড়ল। মাইনাস পাওয়ারের চশমাটা চোখ থেকে খুলে হারার দিকে ফিরে ওকে ইশারায় ডাকল টনি? কীরে, আয়।
হারা অনিচ্ছায় পা ফেলে ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল টনির কাছে।
টনি ততক্ষণে চশমাটা টেবিলের একপাশে রেখে কাগজপত্রের একটা গোছা সামনে টেনে নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে।
কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে টনি আর হারার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। কারণ, বেশিরভাগ পৃষ্ঠাতেই দুর্বোধ্য সব জটিল অঙ্ক কষা। আর কোনও-কোনও পৃষ্ঠায় নানান রাসায়নিক যৌগের নাম আর তাদের নিয়ে সমীকরণ।
টনি আর হারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল আর একে-একে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উলটে যেতে লাগল।
হঠাৎই একটা পৃষ্ঠায় পৌঁছে টনি দেখল আর অঙ্ক বা রাসায়নিক সমীকরণ নয়, বরং ইংরেজিতে কত কী লেখা রয়েছে। তার মধ্যে প্লান্ট গ্রুপিং হেডিংটা টনির চোখ টানল। তার নীচে এক দুই-তিন-চার করে নম্বর দিয়ে কতকগুলি শব্দ লেখাঃ
- Serracenia
- Nepenthes
- Darlingtonia
- Drosera
- Pinguicula
- Utricularia
- Diomea
- X (?)
আট নম্বরে লেখা X এবং তার পাশে জিজ্ঞাসার চিহ্নটা দেখে টনির ভুরু কুঁচকে গেল।
আরও কয়েক পৃষ্ঠা ঘেঁটে দেখার পর টনির মনে হল ভদ্রলোক গাছপালা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। দোতলার ছাদে যে অতগুলো টব আর তাতে অতরকম গাছ–এখন মনে হচ্ছে ওটা স্রেফ শখের বাগান নয়, একতলার ল্যাবরেটরির একটা অংশ।
আরও কাগজপত্র ঘেঁটে টনি বেশ কিছু গাছের ছবি দেখতে পেল, তার সঙ্গে কয়েকটা ফুলের ছবি। সব ছবিই হাতে আঁকা। আর ছবির নানা অংশের দিকে তীরচিহ্ন দিয়ে নানান মন্তব্য লেখা।
বেশ কয়েক বান্ডিল কাগজ হাতড়ে দেখার পর আলমারি থেকে কয়েকটা বই নামিয়ে নিল টনি। ও আর হারা হাত দিয়ে চাপড় মেরে বইগুলোর ধুলো ঝাড়ল। তারপর একে-একে বইগুলো দেখতে লাগল।
বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় বইয়ের মালিকের নাম লেখা : সোমেশ চ্যাটার্জি। হাতের লেখা দেখে বোঝা গেল, হাতে লেখা কাগজপত্রগুলো ওঁরই। সুতরাং আন্দাজ করা যায় তিনিই এ-বাড়ির মালিক।
বইগুলো সবই গাছপালা নিয়ে। কারণ, বইগুলোর নাম সেরকমই। যেমন, একটার নাম প্লান্ট লোকোমোশান, আর-একটা বইয়ের নাম কার্নিভোরাস প্লান্ট, এ ছাড়া প্লান্ট রিপ্রোডাটিভ সিস্টেম আর ডাইজেস্টিভ এনজাইমস ইন প্লান্টস নামেও দুটো বই রয়েছে।
হারা বলল, টনি, বোঝা যাচ্ছে, এই সোমেশ চ্যাটার্জি ভদ্রলোক ছিলেন বোটানিস্ট। গাছপালা নিয়ে ছিল ওঁর যত কারবার। ওঁর ল্যাবরেটরিটা দেখেও সেরকম ইমপ্রেশান হয়।
টনি হারার কথায় ছোট্ট করে হু বলল। ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ওর মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে।
ও হঠাৎ হারার দিকে তাকাল, বলল, কার্নিভোরাস প্লান্টস মানে জানিস?
হারা মাথা নাড়ল? না জানি না।
মাংসাশী গাছ।
তো?
না, ভাবছি এর সঙ্গে জিকোর ভ্যানিশ হওয়ার কোনও কানেকশান আছে কি না।
তুই কি বলতে চাস গাছ জিকোকে খেয়ে ফেলেছে? তা হলে ওকে খেয়ে গাছটা গেল কোথায়? জঙ্গলে পালিয়ে গেছে? নাকি ওই ঘাসগুলোই তোর মাংসাশী গাছ? হাত নেড়ে পাত্তা না দেওয়ার একটা ভঙ্গি করল হারা।
হারার কথায় যুক্তি ছিল। তাই দমে গেল টনি। কিন্তু সন্দেহের একটা কাটা ওর মনের ভেতরে খচখচ করতে লাগল।
ও সোমেশবাবুর কাগজপত্রগুলো আবার ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রাখল। পরে সময় করে ও সোমেশবাবুর বাকি জিনিসপত্র ঘেঁটে দেখবে। যদি নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যায়। কারণ, পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে আর কাউকে কিছু বলাটা ঠিক হবে না। তাই টনি হারাকে বলল, শোন, আমার এই আইডিয়ার কথা কাউকে এখন বলার দরকার নেই। বললে ওরা সবাই মিলে আমাকে চাটবে। আমি আরও একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখি, তারপর…।
হারা ভালোমানুষের মতো ঘাড় নাড়ল। তারপর জানলার কাছে এসে নিরীহ ঘাসগুলোর দিকে চেয়ে রইল।
ওরা কি কখনও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে?
অন্য সময় হলে এ প্রশ্নের উত্তরে হারা হেসে উঠত। কিন্তু এখন হাসতে পারল না। টনির কথাগুলো ওর মনটাকে দুলিয়ে দিতে চাইছে।
.
ঘুম ভাঙতেই সুন্দর গন্ধটা মউলির নাকে ঢুকে পড়ল।
মউলি পারফিউম চর্চা করে বটে, কিন্তু এর আগে এত মিষ্টি মন-টানা গন্ধ কখনও ওর নাকে আসেনি। বড়-বড় শ্বাস টেনে গন্ধটাকে বুকের ভেতরে মিশিয়ে নিতে চাইল ও। মনে হল, এই গন্ধটা ওর প্রাণ ভরিয়ে দিচ্ছে।
ঘর গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। শুধু একটা খোলা জানলা দিয়ে ছায়াঅন্ধকার আকাশ দেখা যাচ্ছে। সারাদিনে আজ তেমন বৃষ্টি হয়নি। শুধু সন্ধের পর আধঘণ্টা মতন ঝিরঝিরিয়ে জল পড়েছে আকাশ থেকে।
ভালো করে কান পাতল মউলি। কোনও শব্দ কি শোনা যাচ্ছে?
নাঃ কোনও শব্দ কানে আসছে না। শুধু টুনটুনির শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অথচ আগের দিন রাতে হারা কেমন যেন চাবুক মারার মতো শব্দ শুনেছে। যত্তসব আজগুবি ব্যাপার!
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল মউলি। কিছুতেই আর ঘুম আসতে চাইছে না। মাথার ছোট ছোট চুলে বারকয়েক হাত চালিয়ে ও চলে এল দরজার কাছে।
এর মধ্যে অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছিল। তাই ঘুমন্ত টুনটুনির দিকে তাকিয়ে ওর ছোট্ট শরীরের আবছা হাইলাইট দেখা গেল। ও জেগে থাকলে মউলিকে কিছুতেই ঘরের বাইরে বেরোতে দিত না। মেয়েটা যা ভিতু! দড়িকে সবসময় সাপ বলে ভুল করে।
দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল মউলি। গন্ধটা যেন আরও তীব্র হয়েছে। কেমন যেন নেশার মতো টানছে। মউলির মনে হল গন্ধটা যেন ছাদের দিক থেকে আসছে। ছাদে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ থাকলেও তার পাশের জানলাটা খোলা। হয়তো সেখান দিয়েই ঢুকে পড়েছে এই পাগল করা গন্ধটা।
ছাদের দিকে এগিয়ে গেল মউলি। দরজাটা সহজ ভঙ্গিতে খুলে ফেলল। না, ওর এতটুকুও ভয় করল না। নিজের সাহস নিয়ে বেশ একটু অহংকার আছে মউলির। ও সাইকেল চালাতে পারে, নিয়ম করে জিমে যায়, সাঁতার কাটে। সুযোগ পেলে পাহাড়ে ওঠার তালিম নেওয়ার সাধ আছে। সব সময়েই ওর মনে হয়, ছেলেদের চেয়ে ও কম কীসে!
দরজাটা খুলতেই ঠান্ডা বাতাস মউলির প্রাণ জুড়িয়ে দিল। তার সঙ্গে অপরূপ গন্ধটা আরও তেজি হয়ে ওকে প্রায় নেশা ধরিয়ে দিল।
আকাশের ঘষা চাপা আলো হালকাভাবে ছাদে ছড়িয়ে পড়েছে। টবের গাছগুলোকে গাঢ় ছায়া বলে মনে হচ্ছে। সেই আঁধারে তারার মতো কয়েক টুকরো আলো ঝিকমিক করছে।
মউলি নিজের চোখকে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। গাছের পাতায় রাত্রিবেলা জোনাকির মতো আলো জ্বলছে! নাকি সত্যি-সত্যিই ওগুলো জোনাকি পোকা? কিন্তু জোনাকির আলো হলে সেগুলো নড়েচড়ে বেড়াত। এই আলোর ফুলকিগুলো স্থির।
দুপুরের সেই অদ্ভুত গাছটার কথা মনে পড়ল মউলির। যে-গাছটার শুঁড় টুনটুনির আঙুল জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু সে-গাছটা তো আছে ওই দক্ষিণ দিকের কোণে! এখন আলো জ্বলছে উত্তর দিকের একটা গাছে।
আশ্চর্য! গাছগুলো কী বিচিত্র! টনির কাছে মউলি শুনেছে, এই বাড়ির মালিক সোমেশ চ্যাটার্জি গাছপালা নিয়ে গবেষণা করতেন, তার মধ্যে নাকি কার্নিভোরাস প্লান্টও রয়েছে। টবের ওই ছোট ছোট গাছগুলো কোন জাতের কে জানে!
ফুরফুরে বাতাস মউলির মুখে-চোখে আরাম বুলিয়ে দিল। মউলি আকাশের দিখে মুখ তুলে লম্বা শ্বাস টানল। আর ঠিক তখনই নীচ থেকে সপাৎ-সপাৎ শব্দ ভেসে এল।
তাড়াতাড়ি ছাদের পাঁচিলের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল মউলি। তাকাল নীচের ঘাস-জমির দিকে। আর তাকিয়েই ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
নীচের জমিতে কোথাও কোথাও যেন দেওয়ালি শুরু হয়েছে। নানান জায়গায় দেখা যাচ্ছে আলোর ফুলকি। সেগুলো স্থিরভাবে জ্বলে রয়েছে একই জায়গায়।
চাবুক মারার মতো শব্দটা মউলিকে অতটা টানেনি। ওকে টানছিল গন্ধটা, আর ওই অদ্ভুত আলো। নীচের জমি থেকেই গন্ধটা আসছে বলে ওর মনে হল। নাঃ, নীচে গিয়ে ব্যাপারটা একবার দেখা দরকার।
মউলি ছাদ থেকে চলে এল বারান্দায়। পা টিপে টিপে নীচে নামতে শুরু করল। ও জানে, হারা, টনি আর শান একতলার ঘরে জেগে বসে আছে। জানলা দিয়ে অতন্দ্র চোখে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। মউলিকে দেখতে পেলে কিছুতেই ওরা বাইরে যেতে দেবে না। আর নিজেরাও এত সাবধানী, কিংবা ভিতু, যে বাইরে পা ফেলবে না।
একতলায় নেমে এসে হালকা পা ফেলে বারান্দা পেরোল মউলি। তারপর আস্তে করে খুলে ফেলল সদর দরজা।
সদর দরজার দাঁড়িয়ে আলোর বিন্দুগুলো দেখতে পেল না মউলি। ঘাসের শিষের আড়ালে ওগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। একতলার ঘরের জানলা থেকে শান কিংবা টুনিরা ওই আলো দেখতে পেয়েছে কিনা কে জানে! তবে আলো দেখতে না পেলেও গন্ধটা পাওয়ার কথা অবশ্যই।
কিন্তু মউলি জানত না যে, তখন হারা, টনি বা শান কেউই জেগে নেই। ওরা পালা করে বাইরের মাঠের দিকে চোখ রাখছিল। এখন ছিল শানের পালা। কিন্তু শান নিজের অজান্তেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
সুতরাং মউলি যখন সদর দরজা খুলে ঘাস জমিতে পা দিল তখন কোনও সাক্ষী ছিল না।
মউলিকে গন্ধটা টানছিল অনেকটা নিশির ডাকের মতো। সেই ডাকে ও ভুলে গেল জিকোর কথা। তাছাড়া সাহসের অহঙ্কার ওকে বাড়ির ভেতরে ধরে রাখতে পারল না।
বাইরে হাওয়া বইছিল। মউলির নাইটি অবাধ্য হয়ে উড়ছিল। সেটা সামলাতে-সামলাতে সামনের দিকে এগোচ্ছিল ও। কোথায় ওই আলোর ফুলকিগুলো?
বেশিক্ষণ ওকে খুঁজতে হল না। হঠাৎই ও ভীষণভাবে চমকে উঠল। ওর সারা শরীর পলকে অবশ হয়ে গেল।
কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর ওপরে। কী অমানুষিক তার শক্তি!
মউলির শরীরটা লাট খেয়ে পড়ে গেল ঘাসের ওপরে। যন্ত্রণায় ও শিউরে উঠল। ধারালো নখে কেউ যেন চিরে ফালাফালা করে ফেলছে ওর দেহ। ওঃ!
মউলি চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু চিৎকার করার জন্য হাঁ করতেই একটা নরম থাবা যেন এঁটে বসল ওর মুখের ওপরে।
অন্ধকারের মধ্যে ওকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল কেউ। ওকে নিয়ে খেলা করতে লাগল। একইসঙ্গে ওর রক্তাক্ত পোশাকগুলো কলার খোসার মতো ছাড়িয়ে নিতে চাইছিল।
মৃত্যুর মুহূর্তে মউলির ভীষণ ইচ্ছে করছিল এই শিকারিকে একবার দ্যাখে।
কিন্তু শিকারির বোধহয় দেখা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তাই অন্ধকার যেন সত্যি-সত্যিই মউলিকে গ্রাস করল।
.
০৬.
হিস্টিরিয়ার রুগির মতো চিৎকার করছিল টুনটুনি। সে-চিৎকার কিছুতেই থামছিল না।
হারা, শান আর টনি সাধ্যমতো ওকে থামাতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। চোখ বড় বড় করে হাত-পা ছুঁড়ে পাগলের মতো চিৎকার করছিল ও, এ-বাড়িতে আমি আর একটা সেকেন্ডও থাকব না। আমাকে তোরা এক্ষুনি কলকাতায় নিয়ে চল।
সকালে টুনটুনিই প্রথম দ্যাখে যে, মউলি নেই। তারপর জিকোর মতো ওর খোঁজ শুরু হয়– টয়লেটে, ছাদে, একতলায়, সিঁড়ির নীচে কিন্তু কোথাও ওকে পাওয়া যায়নি।
তখন হারা, টনি আর শান্তনু বাইরে বেরিয়ে মউলিকে খোঁজার কথা বলে। কিন্তু টুনি বাড়িতে একা থাকতে চায়নি। তাই শান আর বেরোয়নি বাড়ি থেকে। হারা আর টনি কাজে নেমে পড়েছে।
কোথা থেকে একটা লাঠি জোগাড় করেছিল টনি। আর হারা নিয়েছিল জিকোর হান্টিং নাইফ। এই দুটো অস্ত্র হাতে নিয়ে ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়েছিল ঘাস-জমিতে।
তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওরা মউলিকে পায়নি। তবে জিকোর মতোই মউলির চিহ্ন পেয়েছে।
পাওয়া গেছে ওর রক্তাক্ত পোশাক, আংটি আর একটা রিস্ট ব্যান্ড। এদিক-সেদিকে ছড়িয়ে পড়ে ছিল।
সেগুলো হাতে নিয়ে হারা আর টনি বাড়িতে ঢুকতেই টুনির চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। শান, হারা, টনি, কেউই আর চোখের জল রুখতে পারেনি। মউলি এত হাসিখুশি, উচ্ছল ছিল যে, ওর চলে যাওয়াটা সবাইকেই ধাক্কা দিয়েছে। তাছাড়া পাহারা দিতে বসে ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা টনি, হারা আর শানকে অপরাধী করে রেখেছিল।
শান চোখের জল মুছে বলল, এইভাবে কি আমরা একে একে সবাই উধাও হয়ে যাব?
হারা চোয়াল শক্ত করে বলল, কিছুতেই না। ওদের আমরা খুঁজে বের করব। ফিরিয়ে আনব।
টনি সজল চোখে মাথা নাড়ল, বলল, না রে, ওদের বোধহয় আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে একটু চেষ্টা করলে মিস্ট্রিটা হয়তো সম্ভ করা যাবে। তাতে সুবিধে এই, ইন ফিউচার আর কেউ এভাবে…।
শান বলল, তুই মিস্ট্রি সলভ কর। আমি এ-বাড়িতে আর থাকতে চাই না। বাড়িটা অপয়া আমি আর টুনি বেরিয়ে পড়ছি। যদি আমরা কাল চলে যেতাম তা হলে এখন মউলি আমাদের সঙ্গে থাকত।
টনি ওর জায়গা ছেড়ে উঠে এল শানের কাছে। ওর চোখে চোখ রেখে বলল, চমৎকার। বন্ধুর উপযুক্ত কথাই বটে! ও. কে., একটা প্রশ্নের জবাব দে দেখি। মউলির বাড়িতে গিয়ে তুই কোন মুখে আঙ্কল আর আন্টির সামনে দাঁড়াবি? যখন ওঁরা জিগ্যেস করবেন, মউলি কোথায়, তখন কী উত্তর দিবি? জিকোর বাড়িতে গিয়েও বা তুই কী উত্তর দিবি? এবার ব্যঙ্গের খোঁচায় ধারালো হল টনির গলা, বলবি যে ওরা জঙ্গলে উধাও হয়ে গেছে, তাই আমরা ভয়ে পালিয়ে এসেছি। ডরপোক কঁহাকা!
এখানে আরও একটা রাত থেকে লাইফ রিস্ক কে নেবে? শান ঝঝিয়ে উঠল, তুই নিবি?
নেব। ঠান্ডা গলায় বলল টনি, কারণ, জিকো আর মলির যদি আমাদের ওপর কোনও দাবি থেকে থাকে তো সেটা হল, টু ফাইন্ড আউট হু ডিড ইট। নিজের বিবেককে জিগ্যেস করে দেখ, শান–এটা ওদের পাওনা। আজ জিকোর বদলে যদি তোর কিছু একটা হত, তা হলে কি আমরা চটজলদি পালিয়ে যেতাম? বুকে হাত রেখে বল তো, সেটা তোর ভালো লাগত?
কথা বলতে বলতে টনির চোখে জল এসে গিয়েছিল। মউলি আর জিকোর মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার।
শান থমথমে আবেগে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। হঠাৎই ও টনিকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল, বলল, তুই ঠিক বলেছিস। কাপুরুষ হলে আমাদের চলবে না।
হারা এগিয়ে এসে ওদের পিঠে হাত রেখে বলল, তাছাড়া আমরা এখনও তো হান্ড্রেড পারসেন্ট শিয়োর নই যে, জিকো আর মউলি মারা গেছে।
টুনির চোখেও জল এসে গিয়েছিল। দোটানায় ওর মনটা দুলছিল। আজ যদি মউলির জায়গায় ওর কিছু একটা হত, আর বাকি বন্ধুরা পালিয়ে যেত, তা হলে টুনির কি সেটা ভালো লাগত? মোটেই না।
শান, টনি আর হারা টুনটুনির কাছে এসে মেঝেতে বসে পড়ল।
টনি হাত নেড়ে ওকে বোঝাতে চাইল, শোন, টুনি, এটা বোঝা গেছে যে, বাড়িটা পুরোপুরি সেফ। বাড়ির ভেতরে থাকলে কোনও ভয় নেই, রাইট?
টুনি মাথা নেড়ে সায় দিল, আলতো স্বরে বলল, রাইট।
সুতরাং, তুই কোনও অবস্থাতেই এ-বাড়ির বাইরে বেরোবি না। তা হলে তোর আর কোনও বিপদের ভয় নেই।
টনির এই যুক্তিটা শানের ভালো লাগল।
টনি আবার বলতে শুরু করল, আমার নেক্সট পয়েন্ট হল, দিনের আলোয় গোটা জায়গাটাই সেফ। মানে, বাইরে বেরোলে ওইরকম মিস্টিরিয়াস অ্যাটাকের কোনও ভয় নেই। কী রে, হারা, ঠিক বলছি? শান, তোর কী মনে হয়?
ওরা তিনজনেই বুঝল, টনির লজিকে কোনও ফাঁক নেই।
হারা বলল, ঠিক বলেছিস।
শান সায় দিয়ে মাথা নাড়ল, কারেক্ট।
তা হলে আমরা এমন কোনও হান্টিং অ্যানিম্যালের খোঁজ করব, যে শুধু অন্ধকারে অ্যাটিভ–!
সব হান্টিং অ্যানিম্যালই তো অন্ধকারে অ্যাকটিভ. টুনটুনি বাদ সাধল টনির নতুন যুক্তিতে।
টনি হেসে বলল, তুই যাদের কথা বলতে চাইছিস তারা দিনের বেলাতেও অ্যাটিভ। তা ছাড়া বাঘ, নেকড়ে বা হায়েনা রোজ একটা করে মানুষ মারে না। আরও একটা ব্যাপার আছে : এ-বাড়ি থেকে রাতে মানুষ বেরোতে পারে এই পসিবিলিটির কথা ভেবে এইসব জন্তু জানোয়ার কখনও জঙ্গল ছেড়ে ঘাস জমিতে এসে ওয়েট করবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টনি, হাতে হাত ঘসে বলল, আসলে আমি বলতে চাইছিলাম এমন একটা হান্টিং অ্যানিম্যালের কথা যে দিনের বেলায় পুরোপুরি ইনঅ্যাকটিভ বুঝেছিস?
এবার ওরা টনির কথাটা পুরোপুরি বুঝতে পারল।
সত্যিই তো, এর আগে তো ওরা যুক্তি সাজিয়ে ব্যাপারটাকে এমন করে ভাবেনি!
শান জিগ্যেস করল, এখন আমরা কী করব?
টনি বলল, একটা টেস্ট আপাতত ভেবেছি। দিনের বেলা এই টেস্টটা করা যাবে না– তাই রাতে করত হবে।
কী টেস্ট? হারা প্রশ্ন করল।
তুই আর শান একটা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়। আশপাশের কোনও গ্রাম-টাম খুঁজে একটা মুরগি বা হাঁস কিনে নিয়ে আয়। রাতে ওটাকে বাইরে ছেড়ে দিয়ে দেখব কী হয়…।
একথা শুনে এ ওর মুখের দিকে তাকাল। তারপর শান ধীরে-ধীরে বলল, ও.কে.দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি আর হারা বেরোচ্ছি। মনে হয়, হাঁস বা মুরগি পেয়ে যাব। না পেলে খরগোশ, পায়রা, বেড়ালছানা, যা তোক একটা কিছু নিয়ে আসব, তাই তো?
ইয়েস, টনি বলল, আর আমাকে সোমেশ চ্যাটার্জির বাকি পেপার্সগুলো স্টাডি করতে হবে– সেই সঙ্গে ল্যাবটাও–যদি কোনও ক্লু-টু পাওয়া যায়…।
টুনটুনি একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, ওপরের ঘরটায় একা-একা থাকতে আমার বাজে লাগে। মউলির মেমোরি খুব হন্ট করছে…।
শান ওকে বলল জিনিসপত্র নিয়ে নীচে ওদের ঘরে চলে আসতে। আজ রাতে আর ঘুমোনোর ব্যাপার নেই কারণ, রাতে অনেক কাজ।
শানের কথায় টুনি খানিকটা ভরসা পেল। ও শানকে সঙ্গে করে দোতলার রওনা হল। যেতে যেতে অনুযোগের সুরে ও বলছিল, মোবাইল ফোনে কোনও কানেকশান পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কেন যে কোনও টাওয়ার নেই কে জানে!
.
আকাশ আজও মেঘলা। গোটা আকাশে কেউ যেন ছাই রঙের তুলি বুলিয়ে দিয়েছে। সেই ধূসর পটভূমিতে পায়চারি করছে আরও গাঢ় রঙের বাদল মেঘ।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল টনি। ভাবছিল, আজকের রাত আবার নতুন কোনও ঘটনা নিয়ে আসবে। ওরা চারজন যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। যে-বাসিন্দারা একে-একে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
টুনির ঘটনা শোনার পর গতকালই ছাদের টবগুলোকে পরীক্ষা করেছে টনি। সেখানে ও সাতটা গাছ পেয়েছে যাদের মধ্যে লজ্জাবতী লতার ক্যারেকটার আছে। মানে, গাছের পাতা কিংবা ফুলে হাত দিলেই গাছটা নড়াচড়া করে রেসপন্ড করে। আজ রাতে গাছগুলোর ক্যারেকটার খুঁটিয়ে দেখবে টনি। বলা যায় না, হয়তো নতুন কোনও সূত্রের হদিস পাওয়া যেতে পারে।
টনির সামনে টেবিলে ছড়ানো সোমেশ চ্যাটার্জির কাগজপত্র। এগুলো নিয়ে ও পাগলের মতো পড়াশোনা করছে–যেন সামনে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। একটা উত্তর ওকে খুঁজে বের করতেই হবে–আজ রাতের মধ্যেই।
যতই পড়ছে ততই যেন ব্যাপারগুলো মাথায় ঢুকছে টনির। কিন্তু ইংরেজিতে লেখা বলে বেশ কিছুটা অসুবিধে থেকেই যাচ্ছে।
হঠাৎই আলমারির একেবারে নীচের তাক থেকে একটা বড় বাঁধানো খাতা খুঁজে পেল টনি। খাতার বাঁধাইটা জীর্ণ হয়ে খুলে গেছে বলে খাতাটা লাল-সাদা সুতলি দিয়ে যোগচিহ্নের মতো করে বাঁধা। খাতার ধারগুলো পোকায় খেয়ে দিয়েছে।
ধুলো ঝেড়ে বাঁধন খুলতেই টনি বুঝতে পারল, খাতাটা আসলে একটা পাণ্ডুলিপি। মাংসাশী গাছ নামে বাংলায় একটা বই লিখতে শুরু করেছিলেন সোমেশবাবু।
লেখাটা খুব গোছানো নয়। খাপছাড়াভাবে নানান অংশ লিখে তারিখ দেওয়া। শেষ তারিখটা এক বছরেরও বেশ পুরোনো। সোমেশবাবু হয়তো ভেবেছিলেন, পরে মাঝের অংশগুলো লিখে পাণ্ডুলিপিটা সম্পূর্ণ করবেন, কিন্তু তার আর সময় পাননি।
টনি খাতাটা পড়তে শুরু করল। ওর চঞ্চল চোখ লাইনের পর লাইন ডিঙিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দরকারি জায়গায় চোখ পড়লেই ও থামছিল, ভালো করে পড়ে নিচ্ছিল সেই জায়গাগুলো।
…মাংসাশী গাছ পোকামাকড় বা ছোট-ছোট প্রাণী ধরে খায়, তবে অন্যান্য প্রাণীর মতো এরা শিকারকে সত্যি-সত্যি চিবিয়ে গিলে খায় না। বেশিরভাগ মাংসাশী গাছের ক্ষেত্রে একরকম রস নিঃসৃত হয়, যাকে পাঁচক রসের মতো ভাবা যেতে পারে। এই রস শিকারকে পচিয়ে-গলিয়ে দেয়। তারপর সেই গলিত পদার্থ গাছ শুষে নেয় নিজের শরীরে। কিছু কিছু মাংসাশী গাছে রস নিঃসরণের ব্যবস্থা নেই। ওরা শিকার ধরার পর তাকে পচানোর জন্য জীবাণুর ওপরে নির্ভর করে। অর্থাৎ শিকারকে মেরে ফেলার পর ওরা প্রাকৃতিক পচনের জন্য অপেক্ষা করে। তারপর সেই গলিত পদার্থ শরীরে শুষে নেয়।
….অন্যান্য সবুজ গাছপালার মতো মাংসাশী গাছও নিজের খাদ্য নিজের শরীরে তৈরি করে। কিন্তু এ ছাড়াও শিকার ধরে কেন তারা বাড়তি খাদ্য সংগ্রহ করে সে-বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা স্পষ্ট নয়। তবে অনেক সময় দেখা গেছে, কিছু কিছু প্রজাতির মাংসাশী গাছ এমন মাটিতে জন্মায় যেখানে নাইট্রোজেন ও গাছের অন্যান্য প্রয়োজনীয় মৌলের ঘাটতি আছে। তারা শিকার ধরে খাদ্য সংগ্রহ করে এই অভাব মেটায়।
এরপর কয়েকটা পৃষ্ঠায় টনি দেখল, নানান প্রজাতির মাংসাশী গাছের কথা লেখা আছে। এই নামগুলো ও আগে একবার দেখেছিল। তবে এখানে X চিহ্ন দিয়ে কোনও গণের কথা বলা নেই।
গণের নামের পর বিভিন্ন প্রজাতির গাছের উদাহরণ দেওয়া আছে। যেমন, কলস উদ্ভিদ, সূর্যশিশির, ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ, ব্লাডারওয়র্ট ইত্যাদি।
পাতা ওলটাতে-ওলটাতে এক জায়গায় ওর নজরে পড়ল শিকার ধরার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক।
..পোকামাকড়দের কাছে টেনে এনে ফাঁদে ফেলার নানারকম পদ্ধতি আছে। যেমন, সারাসেনিয়া, নিপেনথেস বা ডার্লিংটোনিয়া গণের বিভিন্ন রকম কলস উদ্ভিদের ফাঁদ পাতার ঢং বিভিন্ন হলেও ওদের মূল নীতি একটাই ও মিষ্টি মধুর গন্ধ ছড়িয়ে ওরা পোকামাকড়কে পাতার কাছে টেনে নিয়ে আসে। কলসির ভেতরে পোকা একবার পড়ে গেলে সে তেলা দেওয়াল বেয়ে উঠে আর বাইরে বেরোতে পারে না। তা ছাড়া ওই দেওয়ালে নিম্নমুখী সূক্ষ্ম রোঁয়া থাকে। এর ফলে ফাঁদে পড়া পোকার বেরিয়ে আসা অসম্ভব।
সূর্যশিশিরের চামচের মতো বাঁকানো পাতায় থাকে অনেক শুঁড়। প্রতিটি শুঁড়ের ডগায় থাকে একফোঁটা করে আঠালো লালা। সূর্যের আলোয় এই লালা শিশিরবিন্দুর মতো চকচক করে। কোনও পোকা সূর্যশিশিরের পাতায় বসলেই ওই আঠায় জড়িয়ে পড়ে। আর সে বেরোতে পারে না।
বাটারওয়র্টের পাতার আকৃতি ডিমের মতো। রং হলদেটে সবুজ। এই পাতায় লালা মাখানো থাকে। কোনও পোকামাকড় একবার এই পাতায় বসলেই শেষ। সে ওই লালার আঠায় আটকে যায়, আর পাতাগুলো ভেতরদিকে গুটিয়ে গিয়ে তাকে বন্দি করে ফ্যালে। তখন আরও লালা বেরিয়ে আসে। তার একটু পরেই বেরিয়ে আসে পাঁচক রস।
মাংসাশী গাছ সাধারণত গন্ধ আর রং দিয়ে পোকামাকড়কে টানে। এ ছাড়া তাদের অন্য কোনও আকর্ষণ পদ্ধতি আছে কিনা তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে।
সবচেয়ে বড় মাপের মাংসাশী গাছ পাওয়া যায় নিপেনথেস গণে। এই গাছগুলো দশ/পনেরো মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা পোকামাকড় ছাড়াও বড় মাপের শিকার ধরতে পারে। যেমন, ব্যাং। আবার কখনও কখনও পাখি বা ইঁদুর ধরেছে বলেও শোনা গেছে।
অনেক গাছের ফাঁদ কাজ করে চোখের পলকে। সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যারা শিকার ধরে তারা হল ইউট্রিকুলারিয়া গণের মাংসাশী গাছ। এরা জন্মায় জলের তলায়। এক সেকেন্ডের তিরিশ ভাগের একভাগ সময়ে তারা শিকারকে ভেতরে টেনে নেয়।
প্রায় ছশোর বেশি মাংসাশী গাছের প্রজাতি এবং উপ-প্রজাতির খোঁজ পাওয়া গেছে। আরও খোঁজ চলছে। তবে গত দু-দশক ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে যে-যুগান্তকারী গবেষণা চলছে তা হল জিন মিশ্রণের সাহায্যে নতুন-নতুন ধরনের মাংসাশী গাছ তৈরি করে তাদের যুদ্ধের কাজে লাগানো। গোপনে শত্রুবিনাশ করার জন্য এ-ধরনের গাছ খুবই জরুরি। আমার ধারণা, সাধারণ গাছের সঙ্গে মাংসাশী গাছের জিন মিশ্রণ ঘটিয়ে অলৌকিক ফল পাওয়া সম্ভব। যদি সেরকম কোনও গাছ কখনও তৈরি করা সম্ভব হয়, তা হলে সে হবে যুদ্ধের অপরাজেয়। শত্রু বুঝতেই পারবে না আঘাত কোনদিক থেকে আসবে, কখন আসবে।
খাতার শেষদিকের পৃষ্ঠাগুলো পড়তে-পড়তে টনি বেশ অবাক হয়ে গেল। ওর মনে পড়ল, গবেষণার কাগজপত্রগুলো ঘাঁটতে গিয়ে ও জিন, ক্লোনিং এই শব্দগুলো পেয়েছিল। তা হলে কি সোমেশ চ্যাটার্জি নতুন ধরনের কোনও মাংসাশী গাছ তৈরির চেষ্টা করছিলেন? সেই অজানা গ্রুপের নাম দিয়েছিলেন X? চেষ্টা করতে করতে তিনি সত্যি-সত্যি সেরকম গাছ তৈরি করে ফেলেননি তো?
দোতলার ছাদের টবগুলোর কথা মনে পড়ল টনির। সেখানে এই নতুন গাছের নমুনা নেই। তো! কিন্তু নতুন গাছ যে, সেটাই বা টনি বুঝবে কেমন করে?
নানান চিন্তায় জড়িয়ে পড়ছিল টনি। সোমেশ চ্যাটার্জির পাণ্ডুলিপিটায় ও বারবার চোখ বোলাল। তারপর সব কাগজপত্র সরিয়ে রেখে চোখ বুজে চেয়ারে বসে রইল।
ও মনে-মনে জিকো আর মউলির কথা ভাবতে লাগল।
প্রথম প্রশ্ন, ওরা রাতের আঁধারে বাইরে কেন বেরোল।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাইরে বেরোনোর পর কে কীভাবে ওদের আক্রমণ করল।
কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল টনি। একঘেয়েমি কাটাতে ও চলে এসেছিল দোতলার ছাদে। ওর পিছন পিছন টুনিও চলে এসেছিল দোতলায়। কারণ, হারা আর শান হাঁস মুরগির খোঁজে বেশ কিছুক্ষণ আগে বাইক নিয়ে বেরিয়েছে ফলে বাড়িতে এখন টনি ছাড়া ওর সঙ্গী আর কেউ নেই।
টুনির বারবারই মনে হচ্ছে, ওকে যেন কে পা টিপে টিপে অনুসরণ করছে। তাই ও সবসময় একটা আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে। টনি এ নিয়ে বেশ কয়েকবার ওকে ঠাট্টাও করেছে।
টনি উবু হয়ে বসে ছাদের টবগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল আবার। ওর ভুরু কুঁচকে গেছে। চোখের নজর তীক্ষ্ণ। জটিল কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে প্রাণপণে।
টুনটুনি বারবারই ওকে জিগ্যেস করছিল, কীরে, কিছু পেলি?
উত্তরে টনি মাথা নাড়ছিল। আর মনে-মনে ভাবছিল, ওই ছোট-ছোট গাছগুলোর মধ্যে আসল উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে কি না।
একটু পরেই বাইকের শব্দ ওদের কানে এল।
টুনটুনি দৌড়ে গেল ছাদের পাঁচিলের কাছে। দেখল, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘাম-জমির ওপর দিয়ে ছুটে আসছে হারাদের মোটরবাইক। হারা চালাচ্ছে, আর শান পিছনে বসে আছে। ওর হাতে একটা মুরগি।
টনি উঠে এসেছিল পাঁচিলের কাছে। শানের হাতে মুরগিটা দেখতে পেল ও। সঙ্গে সঙ্গে ও আজ রাতের চরম পরীক্ষাটার কথা ভাবতে শুরু করল।
.
০৭.
ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার ঘরে পৌঁছতেই ওরা চারজন তৈরি হয়ে নিল।
সন্ধের পর থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন বৃষ্টির তেজ না বাড়লেও বজ্রপাতের তেজ বেড়েছে। আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠছে সাদা তরোয়াল।
টনি, হারা, শান আর টুনি সাবধানী পা ফেলে-ফেলে এগিয়ে চলল সদর দরজার দিকে। ওদের সঙ্গে রয়েছে বেচারি নিরীহ মুরগিটা। কঁক কঁক শব্দ করছে।
মুরগিটার পায়ে একটা লম্বা দড়ি বাঁধা। দড়ির অন্য প্রান্তটা হারার হাতে। আর টনির হাতে টর্চ।
টনি সবাইকে হাত নেড়ে বোঝাচ্ছিল, ও ঠিক কী করতে চায়।
রাত আর-একটু বাড়লে আমরা মুরগিটাকে বাইরের ঘাসের মধ্যে ছেড়ে দেব। তারপর ওয়াচ রাখব, কেউ ওটাকে অ্যাটাক করে কি না। যেই অ্যাটাক করবে সঙ্গে-সঙ্গে আমরা বাইরে লাইটটা জ্বেলে দেব। আর অ্যাট দ্য সেম টাইম টর্চ মারব মুরগিটার গায়ে…তা হলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
বাড়ির সদর দরজার বাইরে একটা ল্যাম্প হোলডার লাগানো ছিল, কিন্তু তাতে কোনও বাম্ব ছিল না। আজ বিকেলে দোতলার ঘর থেকে একটা বাম্ব খুলে নিয়েছে টনি। তারপর হারার কোলে উঠে অনেক কসরত করে সেই বাটা লাগিয়ে দিয়েছে সদর দরজার বাইরের হোলডারটায়। সুইচ অন-অফ করে দেখে নিয়েছে বাটা ঠিকমতো জ্বলছে নিভছে কিনা। বাটা জ্বলে উঠলে বাইরের ঘাস জমির অনেকটা জায়গায় আলো ছড়িয়ে পড়ছে যদিও সেই আলোর তেজ তেমন বেশি নয়।
ওরা সদর দরজার কাছে অলিন্দের মেঝেতে বসে পড়ল। সামনে টনি আর শান, পিছনে হারা আর টুনটুনি। মুরগিটা ওদের কাছ ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ওটার পায়ে বাঁধা দড়ির খোলা মাথাটা হারা বেঁধে দিয়েছে সদর দরজার একটা কড়ায়।
বাড়ির সব আলো ওরা আগেই নিভিয়ে দিয়েছিল। এখন টনির কথায় টুনটুনি উঠে গিয়ে অলিন্দের আলোটাও নিভিয়ে দিল।
ওদের চোখের সামনে হঠাৎ করে অন্ধকার নেমে এল। অন্ধকার হতেই মুরগিটা চুপ করে গেল।
টনি টর্চটা কয়েকবার জ্বেলে টেস্ট করে নিল।
তারপর শুরু হল অপেক্ষা।
টুনটুনি হারার জামা খামচে ধরে বসেছিল।
হারা ওকে বলল, এত ভয় পাওয়ার কী আছে বল তো!
টুনি বলল, ভয়ে নয়–এমনি।
হারা কোনও জবাব দিল না।
শান টনিকে জিগ্যেস করল, আমরা কতক্ষণ ওয়েট করব রে?
টনি বলল, সেটাই তো বোঝা মুশকিল। দেখা যাক সিচুয়েশান কী হয়…।
একটু পরেই অন্ধকারে ওদের চোখ সয়ে এল। বাইরের ঘাসের শিষ আবছা দেখা যাচ্ছিল। তার ওপরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ পাচ্ছিল ওরা।
চারপাশ নিস্তব্ধ হওয়ায় ওদের কেমন যেন ভয়-ভয় করছিল। টুনটুনি তো একবার বলেই ফেলল, হুট করে বাঘ কিংবা নেকড়ে এসে পড়লে কী হবে?
টনি শান্ত গলায় বলল, টর্চের আলো ফেললেই ওরা ভয় পেয়ে থেমে যাবে। তখন চট করে দরজা বন্ধ করে দিলেই হবে।
শান টুনটুনিকে সাহস দিতে হালকা গলায় গান ধরল।
টনি আর হারা তাকিয়ে রইল বাইরের অন্ধকারের দিকে। কাল রাতের মতো আজ কিছুতেই ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। রাত যত গভীরই হোক, সজাগ থাকতে হবে।
সময় কাটানোর জন্য টনি হারাদের সোমেশ চ্যাটার্জির গবেষণার কথা বলছিল। বলছিল অদ্ভুত সব মাংসাশী গাছের কথা।
একসময় টনি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারপর ওরা চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল।
একঘেয়েভাবে অপেক্ষা করতে করতে ঘড়ি দেখতেও ভুলে গেল ওরা। বারবার চোখ টেনে আসতে চাইল, কিন্তু জিকো আর মউলির কথা ভেবে ওরা ঘুম তাড়াল। কয়েকবার উঠে গিয়ে চোখে জল দিয়ে এল।
রাত তখন কত কে জানে! টনি চোখ পুরোপুরি আর খুলে রাখতে পারছিল না। হঠাৎই ওর নাকে একটা গন্ধ এল। মনে হল, নাম-না-জানা কোনও মিষ্টি পারফিউম যেন কেউ বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে।
টনি নড়েচড়ে বসল। শান আর হারাকে ঠেলা মারল। ফিসফিসে গলায় ডাকল, অ্যাই, শান! হারা!
শানের একটু তন্দ্রা মতন এসে গিয়েছিল। টনির ধাক্কায় ও চটপট সোজা হয়ে বসল।
হারা জেগেই ছিল। বলল, একটা গন্ধ পাচ্ছিস?
পাচ্ছি। ফিসফিস করে বলল শান।
হারা বলল, অ্যাই, টুনি ঘুমিয়ে পড়েছে।
শান বলল, ওকে আর ডাকিস না ঝামেলা বাড়বে।
গন্ধটা বাড়ছিল। সেই গন্ধে ওদের মেজাজটা দারুণ চনমনিয়ে উঠল। কিন্তু এতক্ষণ এই গন্ধটা ছিল কোথায়? তা হলে কি ওই ঘাসের আড়ালে নতুন কোনও ফুল ফুটেছে এই মাঝরাতে?
শান একটা ঘোরের মধ্যে উঠে দাঁড়াল। চৌকাঠ ডিঙিয়ে পা বাড়াতে গেল সামনে।
ধাক্কা মেরে ওকে পিছনে ঠেলে দিল টনিঃ কী করছিস পাগলের মতো! ফিসফিসে গলায় ও ধমকে উঠল।
হারা শানের হাত চেপে ধরল।
ওটা-ওটা কীসের গন্ধ? শান শিশুর মতো গলায় প্রশ্ন করল।
ওটা বিপদের গন্ধ। জবাব দিল টনি।
ঠিক তখনই ওর নজরে পড়ল, ঘাসের শিষের ফাঁকফোকর দিয়ে দু-একটা রঙিন আলোয় বিন্দু যেন দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিতে বাতাসে ঘাসের শিষগুলো নড়ছে বলে থেকে-থেকেই আলোয় ফুটকিগুলো আড়াল হয়ে যাচ্ছে। তাই মনে হচ্ছে যেন জ্বলছে আর নিভছে।
আলোয় ফুটকিগুলো ঠিক যেন কলকাতায় রাস্তায় গেঁথে দেওয়া ডিভাইডারের আলোয় মতো। মিটমিট করছে।
টনি উঠে দাঁড়াল। বলল, তোরা চুপচাপ এখানে থাক, আমি দোতলার ছাদ থেকে কেসটা একবার ভালো করে দেখে আসি। ভুলেও জায়গা ছেড়ে নড়বি না। মনে রাখবি, জিকো আর মউলি কিন্তু ফেরেনি। আমি যাব আর আসব।
টনি টর্চ হাতে করে রওনা হল দোতলার সিঁড়ির দিকে।
ওর সামান্য গা-ছমছম করছিল, কিন্তু ও জানে, বাড়ির ভেতরের চেয়ে বাইরের ভয় অনেক বেশি।
দোতলার ছাদে এসে অবাক হয়ে গেল টনি। এখানেও সেই আলো!
ছাদের যেদিকটায় থরেথরে টব সাজানো সেদিকটায় জমাট অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই কয়েকটা আলোর বিন্দু তারার মতো মিটমিট করছে।
এ-দৃশ্য টনি আগে কখনও দেখেনি। তাই ও অবাক হয়ে রঙিন ফুটকিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ভাবছিল, কোন গাছটা এই দেওয়ালি উৎসব শুরু করেছে।
ঘোরলাগা গন্ধটা টনির নাকে এখনও আসছিল। গন্ধটা যেন ওকে আয়, আয় বলে টানছিল।
বোধহয় সেই টানেই ও ছাদের পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গেল। কারণ, গন্ধের বেশিরভাগটাই সেদিক থেকে ঢেউয়ের মতো ভেসে আসছিল।
ছাদের পাঁচিলের ওপর দিকে ঝুঁকে পড়ল টনি। আর তখনই ও অসংখ্য আলোয় বিন্দু দেখতে পেল।
টনির ভেতরে একটা প্রবল কৌতূহল আর টান কাজ করতে শুরু করল। কী রয়েছে ওই ঘাস জমির মধ্যে?
অদ্ভুত এক তাড়াহুড়ো নিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে চলল টনি। তারপর সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি নামতে লাগল। এই দু-তিনদিনে বাড়ির বেখাপ্পা সিঁড়িগুলো ওর তেমন মুখস্থ হয়ে ওঠেনি।
একতলায় সদর দরজার কাছে যখন এল তখন ও সামান্য হাঁপাচ্ছে। দেখল টুনটুনি এর মধ্যে জেগে উঠেছে। ওকে দেখতে পেয়েই জিগ্যেস করল ওপর থেকে কী দেখলি?
ঘাসের ফাঁকে-ফাঁকে ছোট ছোট আলো জ্বলছে…অনেক আলো…ওইরকম…। আঙুল তুলে বাইরের অন্ধকারে জ্বলে ওঠা কয়েকটা আলোর বিন্দুর দিকে দেখাল টনি।
হারা চাপা গলায় বলল, এদিকে কী ঝামেলা বল তো! শান বারবার বাইরে যেতে চাইছে…আমি কোনওরকমে ঠেকিয়ে রেখেছি…।
শান অনুযোগের সুরে বলল, কেন, বাইরে গিয়ে ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করলে ক্ষতি কী?
টনি শান্ত গলায় বলল, তা হলে তুই হয়তো আর ফিরে আসবি না–জিকো আর মউলির মতো…।
শান সঙ্গে-সঙ্গে দমে গেল। ওর চেতনা বোধহয় ফিরে এল।
টনি ভাবল, এবারে মুরগিটাকে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে দেখা যাক কী হয়।
আর ঠিক তখনই বাইরে ঘাসের জটলা থেকে একটা চাপা সপসপ শব্দ ভেসে এল। হারার ভাষায় যে-শব্দ ভেজা মাটিতে চাবুক মারার মতন।
টনি আর দেরি করল না। হারাকে বলল, শিগগির মুরগিটাকে তুলে এনে ছুঁড়ে দে বাইরে!
টনি আন্দাজে ভর করে টর্চের আলো ফেলল মুরগিটার গায়ে। হারা চোখের নিমেষে মুরগিটার কাছে পৌঁছে গেল। এক ঝটকায় ওটাকে তুলে নিল। তারপর সদর দরজার কাছে এসে ওটাকে বাইরে ছুঁড়তে যাবে, অমনি টনি চেঁচিয়ে উঠল, বেশি দূরে ছুড়বি না। পাঁচ-ছহাতের মধ্যে…।
হারা মুরগিটাকে ছুঁড়ে দিল অন্ধকারের মধ্যে।
ডানা ঝাপটে কঁক কঁক করে ডেকে উঠল মুরগিটা। শুন্যে টাল খেয়ে ঘাসের মাঝে গিয়ে পড়ল।
আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল চূড়ান্ত ঝটাপটি–যেন হিংস্র মোরগ-লড়াই চলছে।
অদৃশ্য কোনও শত্রুর সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করছিল মুরগিটা। অন্তত শব্দ শুনে তাই মনে হচ্ছিল।
টনি চেঁচিয়ে বলল, শান, শিগগিরই বাইরের লাইটটা জ্বেলে দে–।
শান একলাফে সুইচের কাছে গিয়ে বাইরের লাইট জ্বালার আগেই টনির টর্চের আলো গিয়ে পড়েছে মুরগিটার ওপরে।
সবুজ সাপের মতো ওগুলো কী কিলবিল করছে মুরগিটার গায়ে।
কেঁচোর মতো সরু অসংখ্য লাউডগা সাপ যেন ঘেঁকে ধরেছে অসহায় মুরগিটাকে। মুরগিটা কর্কশ গলায় প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে।
টুনটুনি ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল।
দু-তিন সেকেন্ড পরেই জ্বলে উঠল বাইরের আলোটা। সঙ্গে-সঙ্গে কিলবিলে সাপগুলো মুরগিটাকে ছেড়ে লাটাইয়ের সুতো গোটানোর মতো সড়সড় করে ঢুকে গেল মাটির ভেতরে।
দড়ি টেনে মুরগিটাকে কাছে নিয়ে আয়– চেঁচিয়ে বলল টনি।
হারা সঙ্গে-সঙ্গে দড়ি ধরে টান মারল। ঘাসের শিষ নুইয়ে দিয়ে মুরগিটার কাহিল শরীর ওদের দিকে খানিকটা এগিয়ে এল। ফলে চলে এল আলোয় কাছাকাছি।
পারফিউমের গন্ধটা এখন আরও তীব্রভাবে নাকে আসছিল।
টনি আর হারা সামনে ঝুঁকে পড়ে মুরগিটাকে ভালো করে দেখল।
বেচারি এখনও বেঁচে আছে। থরথর করে কাঁপছে ওর দেহ। ওর সাদা আর হালকা বাদামি পালকে রক্ত লেগে আছে।
সরু-সরু সাপের মতো ওগুলো কী? টুনি কাঁপা গলায় জানতে চাইল। আঙুল তুলে দেখাল বাইরের ঘাসের দিকে।
টনি বলল, মনে হচ্ছে গাছ, মাংসাশী গাছ। ওরা…ওরা…ওদের গায়ে ছোট-ছোট রোঁয়া ছিল…।
গাছগুলো মাটির ভেতরে ঢুকে গেল কেন? হারা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।
জানি না…। টনি নিজেও এই ব্যাপারটা দেখে অবাক হয়েছিল। ও ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল মুরগিটার দিকে।
শান ভয় পাওয়া টুনিকে ভরসা দিচ্ছিল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। টনির উত্তর শুনে বলে উঠল, আর এক্সপেরিমেন্ট করে কাজ নেই। চল, দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যাই। কাল সকাল হলেই…।
টনি আনমনাভাবে বলল, একমিনিট, শান, একমিনিট। একটা আইডিয়া এসেছে। এটাই লাস্ট এক্সপেরিমেন্ট প্লিজ।
কী এক্সপেরিমেন্ট? হারা জিগ্যেস করল।
শান বিরক্তির একটা শব্দ করল মুখে।
টনি বলল, কী এক্সপেরিমেন্ট এখনই দেখতে পাবি। শান, লাইটের সুইচটা তোকে আর-একবার অফ করতে হবে।
অন্ধকারেই ঠোঁট ওলটাল শান। তারপর হাত বাড়িয়ে বাইরের আলোয় সুইচটা অফ করে দিল।
টনি দরজার প্রায় চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল। শান বাইরের আলোটা নেভানোর সঙ্গে-সঙ্গে ও টর্চটা নিভিয়ে দিল।
আবার অন্ধকার নেমে এল।
কয়েক সেকেন্ড পরেই শোনা গেল সপসপ শব্দ। সেই সঙ্গে পারফিউমের মন কেড়ে নেওয়া গন্ধটা নেশা ধরিয়ে দিতে চাইল।
আর তখনই শোনা গেল মুরগিটার কঁক কঁক চাপা ডাক। সঙ্গে দুর্বলভাবে ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
টনি টর্চ জ্বেলে আলো ফেলল মুরগিটার দিকে। চেঁচিয়ে শানকে বলল, শিগগির আলো জ্বেলে দে!
বাইরের আলোটা জ্বলে উঠতেই স্পষ্টভাবে সব দেখা গেল।
হিলহিলে সরু সাপগুলো আবার মুরগিটাকে সাপটে ধরেছে। কিন্তু আলো জ্বলে ওঠামাত্রই ওরা নিস্তেজ হয়ে গেল যেন। সড়সড় করে আবার ফিরে গেল মাটির ভেতরে।
হারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, এসব কী অ্যাবসার্ড ব্যাপার দেখছি!
শান আর টুনি চলে যাচ্ছিল ভেতরে। টনি ওদের ডেকে থামাল। তারপর তিনজনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এক্সপেরিমেন্টটা আরও একবার চালাল-তবে অন্তত মিনিট দশেক পর।
এবারে আলো জ্বলতেই শুধু মুরগির রক্তমাখা পালক চোখে পড়ল–এখানে-সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু পালক ছাড়ানো মুরগিটার আর কোনও চিহ্ন নেই।
মউলি আর জিকোর কথা মনে পড়ল ওদের। রক্তমাখা জামাকাপড়, আংটি আর রিস্টব্যান্ড ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
ওদের গায়ে কাঁটা দিল।
খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টিভেজা ঘাস-জমির দিকে তাকিয়ে ওদের এই প্রথম বিশ্বাস হল, জিকো আর মউলি আর কখনও ফিরবে না।
ওদের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে ওরা চলে এল বাড়ির ভেতরে।
টনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বলল, সাপের মতো ওই শুঁড়গুলো মানে, গাছগুলো, নকটার্নাল।
নকটার্নাল মানে? জানতে চাইল হারা।
নিশাচর। বলল, টনি, ওই গাছগুলো নকটার্নাল কার্নিভোরাস প্লান্ট। নিশাচর মাংসাশী গাছ।
একটু চুপ করে থেকে সকলের মনের ভাবনাটা মুখে উচ্চারণ করল টনি, জিকো আর মউলিকে হায়েনা, নেকড়ে কিংবা বাঘ নয়–এই ভয়ংকর গাছগুলোই শেষ করেছে…।
.
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল হারার।
খোলা জানলা দিয়ে তাকাল বাইরে। বৃষ্টি নেই, তবে আকাশ বিষণ্ণ।
পাশে তাকিয়ে দেখল শান আর টনি নেই। বোধহয় গোছগাছের জন্য আগেই উঠে পড়েছে। কারণ, আজ ওদের চলে যাওয়ার দিন।
হঠাৎই হারার কান্না পেয়ে গেল। বুকের ভেতরটা ভার হয়ে গেল। মউলি আর জিকো আগেই চলে গেছে। ওদের সঙ্গে আর দেখা হবে না।
টুনটুনি চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল। মুখ ভার। চোখ ভেজা।
হারা চুপচাপ ওকে দেখল। ও হঠাৎ যেন বড় হয়ে গেছে। সবকিছু বুঝতে শিখেছে।
কাল রাতে টনির ওই ভয়ংকর পরীক্ষার আগে পর্যন্ত ওদের মনে একটা আবছা বিশ্বাস ছিল, জিকো আর মউলি ফিরে আসবে। তাই দুঃখের অন্ধকারের মধ্যেও একবিন্দু আশার আলো ছিল।
এখন আলো নিভে গেছে।
টুনির হাত থেকে চায়ের কাপ নিল হারা। চুমুক দিল।
ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল টনি আর শান। শানের হাতে একটা ছোট হাতব্যাগ।
টনি বলল, হারা, আধঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়েনে। দেরি করলে বৃষ্টিতে ফেঁসে যেতে পারি। আমি আর শান চটপট সব গুছিয়ে নিচ্ছি–তুই আয়।
টনির কথায় প্রাণের ছোঁয়া ছিল না। ওর কথাগুলো অনেকটা যন্ত্রস্বরের মতো শোনাল।
হারা বলল, যা, যাচ্ছি– ।
বাইরের ঘরে এসে ছড়ানো জিনিসপত্রে আবার হাত লাগাল শান আর টনি। টুনটুনিও এসে ওদের সাহায্য করতে লাগল।
টনির হঠাৎ মনে হল, সোমেশ চ্যাটার্জির কাগজপত্রগুলো ও সঙ্গে নিয়ে যাবে। তাতে পুলিশি তদন্তের হয়তো সুবিধে হবে। এখানে কাগজপত্রগুলো ফেলে রেখে গেলে হারিয়ে যাওয়ার কিংবা নষ্ট হওয়ার ভয় থাকবে।
ও শানকে সেকথা বলতেই শান জোর গলায় সায় দিল : অফ কোর্স! এখানে ফেলে রেখে যাওয়ার রিস্ক নেওয়ার কোনও মানে হয় না।
সুতরাং টনি ওর কাজ শুরু করল।
পাশের ঘর থেকে সোমেশ চ্যাটার্জির বিছানার একটা চাদর নিয়ে এল টনি। সেটার ধুলো ঝেড়ে পেতে নিল মেঝেতে। তারপর গবেষণার কাগজপত্রের তাড়া একে-একে সাজিয়ে রাখতে লাগল চাদরের ওপরে।
এদিকে হারা এসে টুনি আর শানের সঙ্গে গোছানোর কাজে হাত লাগিয়েছে। ওরা ওদের মনে কাজ করছিল, আর টনি টনির মনে।
পাণ্ডুলিপিটাও তুলে নিল টনি। রাখল কাগজপত্রের সঙ্গে। তারপর আর কোনও দরকারি কাগজ আছে কি না সেটা ভালো করে দেখার জন্য টেবিলটাকে ও টেনে সরাল। হাট করে খুলে দিল আলমারির দরজা। দেখল, একেবারে নীচের তাকে বেশ কিছু কাগজের তাড়া রয়েছে।
নাকে হাত চাপা দিয়ে ধুলোমাখা কাগজপত্রগুলো ঘাঁটতে লাগল টনি। তার মধ্যে থেকে বেছে কয়েকটা কাগজের গোছা তুলে নিল।
ঠিক তখনই ওর চোখে পড়ল ডায়েরিটা।
গাঢ় বাদামি রেক্সিনে মোড়া বড় মাপের ডায়েরি। তার মলাটের কোনাগুলো ধাতুর পাতে বাঁধানো।
ডায়েরিটা সোমেশ চ্যাটার্জির–প্রথম পাতায় নাম লেখা আছে।
ওটা হাতে নিয়ে কয়েকটা পাতা ওলটাল টনি। দ্রুত চোখ বোলাতে লাগল। ওর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
ডায়েরিটা পড়তে-পড়তেই ও আন্দাজে হাত বাড়াল চেয়ারের দিকে। চেয়ারটা খুঁজে পেয়ে তাতে বসে পড়ল। তারপর একমনে পাতার পর পাতা উলটে চলল।
টনির বিমূঢ় অবস্থাটা প্রথম খেয়াল করল হারা। ও টনির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, কী রে, কী হল তোর? হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলি কেন?
টনি তাকাল হারাদের দিকে। ওর চোখে বিভ্রান্ত ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি।
হাতের কাজ ফেলে টুনি, হারা আর শান প্রায় ছুটে চলে এল টনির কাছে। তাকাল ওর হাতে ধরা ডায়েরিটার দিকে।
কী ব্যাপার বল তো? শান জিগ্যেস করল।
টনি আলতো গলায় বলল, এই ডায়েরিটার সোমেশ চ্যাটার্জি সব লিখে গেছেন। আমাদের এখনই এ-বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। এই বাড়িটা একটা ফাঁদ। যদি আমরা এখানে আরও কদিন থেকে যাই, তা হলে আমরাও একে-একে জিকো আর মউলির মতো হারিয়ে যাব। সোমেশ চ্যাটার্জিও বোধহয় এইভাবে হারিয়ে গেছেন। কার্নিভোরাস প্লান্ট এক্স সবাইকে খতম করে দিয়েছে।
হারা ঝুঁকে পড়ল ডায়েরিটার ওপরে ও এসব কী বলছিস!
ঠিক বলছি। ডায়েরিটা পড়–সব কোশ্চেনের আনসার পেয়ে যাবি…।
ওরা তিনজন ঝুঁকে পড়ল টনির ঘাড়ের ওপরে। টনির বেছে দেওয়া জায়গাগুলো পড়তে লাগলঃ
অবশেষে আমার এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হতে চলেছে। অন্তত আমার তাই মনে হচ্ছে। কার্নিভোরাস প্লান্টের একটা নতুন গণ বোধহয় আবিষ্কার করতে পেরেছি আমি–জেনাস এক্স। এই নতুন লতানে গাছটা মাপে বেশি বড় নয়, তবে এর শুঁড়গুলো সরু হলেও বেশ শক্ত। সহজে ছেঁড়া যায় না।
এই লতানে গাছটা মানুষের কী উপকারে লাগবে জানি না। তবে সব আবিষ্কার তো মানুষের উপকারের কথা ভেবে হয় না। আবিষ্কার হয়ে যায় সায়েন্টিস্টদের কৌতূহলের টানে। যেমন, মাংসাশী গাছ নিয়ে গবেষণা আমাকে চিরকাল টেনেছে। তাই এক্সকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমি চালিয়ে যাব।
আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলাম।
প্লান্ট এক্সটা বোধহয় সাবালক হয়ে উঠেছে। কারণ, আগে আমিই ওকে নিয়ম করে পোকামাকড় ধরে দিতাম। সেটা দেওয়ামাত্রই ও শুঁড় দিয়ে পোকাটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরত। তারপর সেটার প্রাণরস শুষে নিত। ওর শুঁড়ের মধ্যে ছোট-ছোট সাকার আছে–যেগুলো দিয়ে চোষা যায়। তা ছাড়া ওর শরীর থেকে যে-ডাইজেস্টিভ জুস বেরোয় সেটার অ্যাসিডিটি বেশি–পিএইচ ভ্যালু সাতের চেয়ে অনেক কম–প্রায় চারের কাছাকাছি। ফলে খুব তাড়াতাড়ি শিকারকে হজম করে ফেলতে পারে প্লান্ট এক্স।
কিন্তু আজ একটা পিকিউলিয়ার ব্যাপার দেখলাম।
একটা ছোট্ট প্রজাপতি উড়তে উড়তে গাছটার কাছে এসেছিল। লতানে গাছটার দুটো শুঁড় আচমকা উড়ন্ত প্রজাপতিটাকে বিদ্যুতের মতো ছোবল মারল। তারপর চোখের পলকে সাপটে ধরল ওটাকে। এবং সাকারগুলো তাদের কাজ শুরু করে দিল।
ঘটনাটা আমাকে অবাক করেছে। না, ওর শিকার ধরা নয়। বরং সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হল, এক্স বুঝল কেমন করে যে, প্রজাপতিটা উড়তে-উড়তে ওর নাগালের মধ্যে এসেছে!
যা ভেবেছিলাম তাই।
এক্স-এর মধ্যে ইনফ্রারেড ওয়েভ সেন্সর আছে–টিভির রিমোট সেন্সিং এর মতো। কোনও পোকামাকড় বা প্রজাপতি এক্স-এর কাছাকাছি এলে তাদের শরীরের তাপ-তরঙ্গ এক্স টের পায়। ওর শুঁড়ের গায়ে যে সূক্ষ্ম রোঁয়া আছে সেগুলো সেই অবলোহিত তরঙ্গ অনুভব করতে পারে। তারপর শুঁড়গুলো শিকার ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শিকার ধরার এই মারমুখী ধরন দেখে এক্সকে মাংসাশী গাছ না বলে যোদ্ধা গাছ বা ওয়ারিয়র প্লান্ট বললেই বোধহয় বেশি মানায়। মাংসাশী গাছের ইতিহাসে এরকম হিংস্র গাছের কোনও নজির নেই।
আজ এক্স একটা চড়ুই পাখি ধরেছে।
পদ্ধতি সেই একই প্রজাপতিটার মতন। আচমকা ছোবল। জড়িয়ে ধরা। খতম।
ওর শুঁড়গুলো আগের চেয়ে মোটা হয়েছে। লম্বাও। এখন শুঁড়গুলোর ডায়ামিটার আড়াই মিলিমিটার। আর লেংথ তিন ফুট মতন।
একটু পরেই চড়ুই পাখিটার শুধু পালকগুলো পড়ে রইল। বাকিটা এক্স খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আমি ওকে এখনও স্টিমুল্যান্ট আর এক্সাইটার ইনজেক্ট করে যাচ্ছি। কেমিক্যালের মাধ্যমে নাইট্রোজেন ইত্যাদির জোগান দিয়ে যাচ্ছি। আমি চাই, এক্স রাতেও ওর অ্যাকটিভিটি বজায় রাখুক। কারণ, রাতে অ্যাকটিভ না হলে এক্স শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে পারবে না। আর যদি সত্যি-সত্যিই ও সেরকমভাবে অ্যাকটিভ হয় তা হলে ওকে রোখা মুশকিল হয়ে পড়বে।
এক্স রাতে অ্যাটিভ হতে পেরেছে।
কাল রাতে ও একটা ইঁদুর ধরেছে।
আমি পাশের ঘরটাতেই ছিলাম। অন্য টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত থাকলেও মন পড়েছিল ছাদের দিকে।
হঠাৎই একটা চি-চি গোছের চাপা শব্দ পেয়েই টর্চ নিয়ে ছুটে গেছি ছাদে। আলো ফেলেই দেখি এক্স একটা নেংটি ইঁদুরকে জড়িয়ে ধরেছে।
আলো পড়তেই এক্স-এর শুঁড়গুলো কেমন যেন থমকে গেল। তারপর বেশ ধীরে ওর কাজ শুরু করল।
কিন্তু আমি টর্চের আলো নিভিয়ে দিতেই এক্স-এর কাজের গতি আবার বেড়ে গেল।
আকাশে চাঁদ ছিল। চাঁদের আলোয় এক্স-কে আমি পর্যবেক্ষণ করে চললাম।
শেষ পর্যন্ত বুঝলাম, আলো পড়লেই এক্স কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে। আর অন্ধকার হলেই ও চঞ্চল, চনমনে হয়ে উঠছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইঁদুরটা শেষ হয়ে গেল।
তা হলে কি এক্স-এর মধ্যে নকটার্নাল ক্যারেকটার ডেভেলাপ করছে? বুঝতে পারছি, আমার ইনজেকশান চালিয়ে যেতে হবে। থামলে চলবে না।
..আজ মন খুব খারাপ।
কারণ, এক্স বোধহয় মারা যাবে–আর ঠেকানো যাবে না।
ওর পাতা, শুঁড়, সব শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও আমি কিছু করতে পারছি না। আমার এতদিনের পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত পণ্ডশ্রম হয়ে দাঁড়াল।
এক্স আর নেই। আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি। ওকে নিয়ে লেখা আমার রিসার্চ পেপারটা প্রায় কমপ্লিট হয়ে এসেছিল, এখন সেটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। ভেবেছিলাম, এই আবিষ্কারের কথা সারা দুনিয়াকে বেশ ঘটা করে জানাব। তারপর আমাকে নিয়ে কত হইচই হবে সারা পৃথিবী জুড়ে। সমস্ত আশায় এখন ঠান্ডা জল পড়ে গেল। ওই টবটার দিকে তাকিয়ে আমার কান্না পাচ্ছে।
অবাক কাণ্ড! এক্স আবার শিকার ধরেছে কিন্তু কীভাবে জানি না। কারণ, আজ সকালে দেখি এক্স-এর টবের মাটির ওপরে সবুজ রঙের পাখির পালক পড়ে আছে। পালকের রং দেখে মনে হল পাখিটা বসন্তবৌরী। কিন্তু পাখিটাকে মারল কে? আর তার দেহটাই বা কোথায় গেল?
যদি বেড়াল পাখিটা মেরে থাকে তা হলে পালকগুলোকে এত গুছিয়ে রেখে যেতে পারত না।
তা হলে কে?
এক্স-এর পাশের কোনও টব থেকে কোনও মাংসাশী গাছ এই অপকীর্তি করেনি তো? জানি না, এক্স-এর মধ্যে কোনও ছোঁয়াচে জীবাণু আছে কি না।
ভাবলাম, রাতে একটা পরীক্ষা করে দেখব।
রাত দশটা নাগাদ একটা ব্যাং নিয়ে ছাদে এলাম। এসে বেশ একটু অবাক হলাম। এক্স-এর টবের দিকটায় অন্ধকারে কয়েকটা আলোর ফুটকি দেখতে পেলাম। রঙিন আলোর বিন্দুগুলো স্থির হয়ে স্কুলে আছে। সেইসঙ্গে একটা গন্ধও আমার নাকে এল। গন্ধটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধের মতন। কেমন যেন নেশা ধরিয়ে টানছে।
আমি টবটার কাছে গেলাম। ঝুঁকে পড়ে দেখলাম। হ্যাঁ, এক্স-এর টবেই জ্বলছে আলোগুলো। আর গন্ধটাও মনে হল একটু জোরালো। কিন্তু এক্স তো এখন নেই। শুধু ভেজা মাটি পড়ে আছে।
আমি আর দেরি না করে ব্যাংটাকে টবের মাটিতে ছেড়ে দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে, বলতে গেলে চোখের পলকে, এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।
আমি চাঁদের আলোয় সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম, তবে আবছাভাবে। তা সত্ত্বেও ঘটনাটা দেখতে কোনও অসুবিধে হল না। আমি পাথর হয়ে গেলাম।
এ কী দেখছি আমি!
ব্যাংটাকে টবের মাটির ওপরে ছাড়ামাত্রই কয়েকটা শুঁড় মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এল। চাবুকের মতো শিস তুলে জড়িয়ে গেল ব্যাংটার শরীরে। ব্যাংটাকে দেখতে হল অনেকটা সুতো জড়ানো লাটাইয়ের মতো। তারপর পাঁচ-দশ সেকেন্ডের মধ্যেই সব শেষ। ব্যাং উধাও হয়ে গেল। শুঁড়গুলো সড়সড় করে ফিরে গেল গর্তে।
ঘটনাটা আমাকে হতবাক করে দিলেও আনন্দ পেলাম এই কথা ভেবে যে, আমার পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত তা হলে পণ্ডশ্রম হয়নি।
..গত কয়েকদিন আমার চিন্তা-ভাবনা কেমন যেন জট পাকিয়ে গিয়েছিল। এ কোন মারাত্মক গবেষণায় জড়িয়ে গেলাম আমি।
এ কটা দিন আমি রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। বিবেকের তাড়নায় শুধু ছটফট করেছি। আমি কি আমার গবেষণা এখানেই থামিয়ে দেব, না কি আরও এগিয়ে নিয়ে যাব?
শেষপর্যন্ত আমার কৌতূহল জিতেছে। অথবা বলা ভালো, বিজ্ঞান জিতেছে।
এক্স-কে নিয়ে আমি আরও কয়েকবার পরীক্ষা চালালাম। ব্যাং, ইঁদুর, টুনটুনি পাখি এসব ছেড়ে দিয়ে দেখলাম।
দেখলাম, ফলাফল সেই একই। তবে শিকার ধরার সময় আলো ফেললে ও সঙ্গে-সঙ্গে থমকে যাচ্ছে। আলো কোনও-না-কোনওভাবে ওর কোশকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে।
অর্থাৎ, আমি একটা ভয়ংকর নিশাচর শিকারি গাছ তৈরি করে ফেলেছি। কারণ, দিনের বেলা এক্স নিষ্কর্মা হয়ে থাকে, আর রাতে সজাগ হয়ে ওত পেতে থাকে।
রঙিন আলোগুলো ওর রাতের অ্যাট্রাক্টর-সূর্যশিশিরের শিশিরবিন্দুর মতো। আর মিষ্টি ওর গন্ধটাও আর-একটা অ্যাট্রাক্টর। রাতে এক্স আলো আর গন্ধ দিয়ে শিকারকে কাছে টানে। আর দিনের বেলা মাটির নীচে ও স্রেফ ঘুমিয়ে থাকে–মানে, ইনঅ্যাকটিভ হয়ে থাকে।
ছোট্ট এইটুকু টবে এক্স-এর বাহাদুরি রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয়। যদি এক্স বড় জমি পেত তা হলে নিশ্চয়ই আরও শক্তিশালী, আরও ভয়ংকর হয়ে উঠত।
আমার মনের মধ্যে একটা কৌতূহল মাথাচাড়া দিল। বাইরের ঘাস-জমিতে এই টবটা মাটি খুঁড়ে বসিয়ে দিলে কেমন হয়!
কয়েকটা দিন টানাপোড়েনে কাটার পর মনস্থির করলাম।
আজ সকালে আমি বাড়ির দরজা থেকে অন্তত দশমিটার দূরে এক্স-এর টবটা মাটির তিনহাত নীচে পুঁতে দিয়েছি।
এবার শুধু অপেক্ষা।
বড় জমি পেয়ে এক্স-এর তেজ অনেক বেড়ে গেছে। আস্পর্ধাও।
আজ থেকে আমি ওকে কন্ট্রোল করার রিসার্চ শুরু করেছি। এমন একটা কেমিক্যাল আমাকে আবিষ্কার করতে হবে যা ছড়িয়ে দিলে এক্স-এর অ্যাকটিভিটি স্লো হয়ে যাবে। ও রাতের বেলাতেও নিস্তেজ কিংবা অকেজো হয়ে পড়বে।
রাতে আমি বাড়ি থেকে আর বেরোই না। তবে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছি এক্স বাড়ির চারদিকে আলো জ্বেলে গন্ধ ছড়িয়ে বসে আছে। কখনও কখনও ওর বাদুড় কিংবা পাচা ধরার শব্দ শুনেছি। তবে এক্স-এর টেনট্যাকলগুলো এত দ্রুত কাজ করে যে, বেশিরভাগ সময়েই কোনও শব্দ শোনা যায় না–অথবা, খুব চাপা শব্দ হয়।
অনেক সময় মাটিতে চাবুক আছড়ানোর মতো সপসপ শব্দ শুনেছি। আন্দাজে আমার মনে হয়েছে, খিদের টানে এক্স-এর শুঁড়গুলো অস্থির হয়ে মাটিতে আছাড় খাচ্ছে।
এক্স-এর বড় বাড় বেড়েছে। যে করে হোক ওকে কন্ট্রোল করতে হবে।
ওর অ্যান্টিডোট আমাকে বের করতেই হবে।
আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। এক্স-এর একটা অ্যান্টিডোট বোধহয় আমি বের করে ফেলেছি। সামনের শনিবার রাতে বাইরে বেরিয়ে অ্যান্টিডোটটা পরীক্ষা করব। তবে খুব সাবধানে আমাকে পরীক্ষা চালাতে হবে। কারণ, এক্স-কে বিশ্বাস নেই।
এটাই ডায়েরির শেষ লেখা। লেখাটার তারিখ প্রায় তিনমাসের পুরোনো।
ডায়েরিটা শব্দ করে বন্ধ করল টনি। শানদের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
শান বলল, এরপর কী হয়েছে সেটা মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছে।
টনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, অ্যান্টিডোটটা কাজ করেনি। অথবা সোমেশ চ্যাটার্জি ভুল করে প্লান্ট এক্স-এর ফাঁদে পা দিয়েছেন। তারপর…।
তারপর আর ফিরতে পারেননি। হারা যেন টনির কথাটা শেষ করল।
টুনি বলল, চল, তাড়াতাড়ি রেডি হয়েনে…দেরি হয়ে যাচ্ছে।
টনি উঠে দাঁড়াল। ডায়েরিটা মেঝেতে রাখা কাগজের থাকের ওপরে রাখল। তারপর চাদরের চারটে খুঁট জড়ো করে গিঁট বাঁধতে লাগল।
টুনি, শান আর হারা গোছগাছের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
যেকরে হোক, একঘণ্টার মধ্যেই ওরা এ-বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। তারপর খবর দেবে পুলিশে, খবরের কাগজে আর নানান টিভি চ্যানেলে।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবাই জেনে যাক এই নিষিদ্ধ এলাকার কথা।
সত্যি, ওদের সামনে এখন অনেক কাজ।