যোগাযোগ-1
আজ ৭ই আষাঢ়। অবিনাশ ঘােষালের জন্মদিন। বয়স তার হল বত্রিশ। ভাের থেকে আসছে অভিনন্দনের টেলিগ্রাম, আর ফুলের তোড়া।
গল্পটার এইখানে আরম্ভ। কিন্তু আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যাবেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানাে।
এই কাহিনীর পৌরাণিক যুগ সন্ধান করলে দেখা যায় ঘােষালরা এক সময়ে ছিল সুন্দরবনের দিকে, তার পরে হুগলি জেলায় নুরনগরে। সেটা শহির থেকে পর্টুগীজদের তাড়ায়, না ভিতর থেকে সমাজের ঠেলায় ঠিক জানা নেই। মরিয়া হয়ে যারা পুরানাে ঘর ছাড়তে পারে, তেজের সঙ্গে নূতন ঘর বাঁধবার শক্তিও তাদের। তাই ঘােষালদের ঐতিহাসিক যুগের শুরুতেই দেখি, প্রচুর ওদের জমিজমা, গােরু-বাছুর, জনমজুর, পালপার্বণ, আদায়বিদায়। আজও তাদের সাবেক গ্রাম শেয়াকুলিতে অন্তত বিঘে _শেক আয়তনের ঘােষাল-দিঘি পানা-অবগুণ্ঠনের ভিতর থেকে পঙ্করুদ্ধ কন্ঠে অতীত গৌরবের সাক্ষ্য দিচ্ছে। আজ সে-দিঘিতে শুধু নামটাই ওদের, জলটা চাটুজ্যে জমিদারের। কী করে একদিন ওদের পৈতৃক মহিমা জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল সেটা জানা দরকার।
এদের ইতিহাসের মধ্যম পরিচ্ছেদে দেখা যায়, খিটিমিটি বেধেছে চাটুজ্যে জমিদারের সঙ্গে। এবার বিষয় নিয়ে নয়, দেবতার পূজো নিয়ে। ঘােষালরা স্পর্ধা করে চাটুজ্যেদের চেয়ে দু-হাত উঁচু প্রতিমা গড়িয়েছিল। চাটুজ্যেরা তার জবাব দিলে। রাতারাতি বিসর্জনের রাস্তার মাঝে মাঝে এমন মাপে তােরণ বসালে যাতে করে ঘােষালদের প্রতিমার মাথা যায় ঠেকে। উঁচু-প্রতিমার দল তােরণ ভাঙতে বেরোয়, নিচু-প্রতিমার দল তাদের মাথা ভাঙতে ছােটে। ফলে, দেবী সে-বার বাঁধা বরাদ্দর চেয়ে অনেক বেশি রক্ত আদায় করেছিলেন। খুন-জখম থেকে মামলা উঠল। সে-মামলা থামল ঘোষালদের সর্বনাশের কিনারায় এসে।
আগুন নিবল, কাঠও বাকি রইল না, সবই হল ছাই। চাটুজ্যেদেরও বাস্তুলক্ষ্মীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দায়ে পড়ে সন্ধি হতে পারে, কিন্তু ভাতে শান্তি হয় না। যে-ব্যক্তি খাড়া আছে, আর যে-ব্যক্তি কাত হয়ে পড়েছে দুই পক্ষেরই ভিতরটা তখনও গর্গর্ করছে। চাটুজ্যেরা ঘোষালদের উপর শেষ-কোপটা দিলে সমাজের খাঁড়ায়। রটিয়ে দিলে এককালে ওরা ছিল ভঙ্গজ ব্রাহ্মণ, এখানে এসে সেটা চাপা দিয়েছে, কেঁচো সেজেছে কেউটে। যারা খোঁটা দিলে, টাকার জোরে তাদের গলার জোর। তাই স্মৃতিরত্নপাড়াতেও তাদের এই অপকীর্তনের অনুস্বার-বিসর্গওআলা ঢাকি জুটল। কলঙ্কভঞ্জনের উপযুক্ত প্রমাণ বা দক্ষিণা ঘোষালদের শক্তিতে তখন ছিল না, অগত্যা চণ্ডীমণ্ডপবিহারী সমাজের উৎপাতে এৱা দ্বিতীয়বার ছাড়ল ভিটে। রজবপুরে অতি সামান্যভাবে বাসা বাঁধলে।
যারা মারে তারা ভোলে, যারা মার আর তারা সহজে ভুলতে পারে না। লাঠি তাদের হাত থেকে খসে পড়ে ব’লেই লাঠি তারা মনে-মনে খেলতে থাকে। বহু দীর্ঘকাল হাতটা অসাড় থাকাতেই মানসিক লাঠিটা ওদের বংশ বেয়ে চলে আসছে। মাঝে মাঝে চাটুজ্যেদের কেমন করে ওরা জব্দ করেছিল সত্য মিথ্যে মিশিয়ে সেসব গল্প ওদের ঘরে এখনও অনেক জমা হয়ে আছে। খোড়ো চালের ঘরে আষাঢ়সন্ধ্যাবেলায় ছেলেরা সেগুলো হাঁ করে শোনে। চাটুজ্যেদের বিখ্যাত দাশু সর্দার রাত্রে যখন ঘুমোচ্ছিল তখন বিশপঁচিশ জন লাঠিয়াল তাকে ধরে এনে ঘোষালদের কাছারিতে কেমন করে বেমালুম বিলুপ্ত করে দিলে সে-গল্প আজ এক-শ’ বছর ধরে ঘোষালদের ঘরে চলে আসছে। পুলিস যখন খানাতল্লাসি করতে এল নায়েব ভুবন বিশ্বাস অনায়াসে বললে, হাঁ, সে কাছারিতে এসেছিল তার নিজের কাজে, হাতে পেয়ে বেটাকে কিছু অপমানও করেছি, শুনলেম নাকি সেই ক্ষোভে বিবাগি হয়ে চলে গেছে। হাকিমের সন্দেহ গেল না। ভুবন বললে, হুজুর এই বছরের মধ্যে যদি তার ঠিকানা বের করে দিতে না পারি তবে আমার নাম ভুবন বিশ্বাস নয়। কোথা থেকে দাশুর মাপের এক গুণ্ডা খুঁজে বার করলে— একেবারে তাকে পাঠালে ঢাকায়। সে করলে ঘটি চুরি, পুলিসে নাম দিলে দাশরথি মণ্ডল। হল এক মাসের জেল। যে-তারিখে ছাড়া পেয়েছে ভুবন সেইদিন ম্যাজেস্টেরিতে খবর দিলে দাশু সর্দার ঢাকার জেলখানায়। তদন্তে বেরোল দাশু জেলখানায় ছিল বটে, তার গায়ের দোলাইখানা জেলের বাইরের মাঠে ফেলে চলে গেছে। প্রমাণ হল সে-দোলাই সর্দারেরই। তার পর সে কোথায় গেল সে-খবর দেওয়ার দায় ভুবনের নয়।
এই গল্পগুলাে দেউলে-হওয়া বর্তমানের সাবেক কালের চেক। গৌরবের দিন গেছে; তাই গৌরবের পুরাতত্ত্বটা সম্পূর্ণ ফাঁকা বলে এত বেশি আওয়াজ করে।
যা হােক, যেমন তেল ফুরােয়, যেমন দীপ নেবে, তেমনি এক সময়ে রাতও পােহায়। ঘােষাল-পরিবারে সূর্যোদয় দেখা দিল অবিনাশের বাপ মধুসূদনের জোর কপালে।
মধুসূদনের বাপ আনন্দ ঘোষাল রজবপুরের আড়তদারদের মুহুরি। মােটা ভাত মােটা কাপড়ে সংসার চলে। গৃহিণীদের হাতে শাঁখা-খাড়ু, পুরুষদের গলায় রক্ষামন্ত্রের পিতলের মাদুলি আর বেলের আটা দিয়ে মাজা খুব মোটা পইতে। ব্রাহ্মণ-মর্যাদার প্রমাণ ক্ষীণ হওয়াতে পইতেটা হয়েছিল প্রমাণসই।
মফস্বল ইস্কুলে মধুসূদনের প্রথম শিক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে অবৈতনিক শিক্ষা ছিল নদীর ধারে, আড়তের প্রাঙ্গণে, পাটের গাঁটের উপর চ’ড়ে ব’সে। যাচনদার খরিদদার গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের ভিড়ের মধ্যেই তার ছুটি, যেখানে বাজারে টিনের চালাঘরে সাজানো থাকে সারবাঁধা গুড়ের কলসী, আঁটিবাঁধা তামাকের পাতা, গাঁটবাঁধা বিলিতি র্যাপার, কেরোসিনের টিন, সরষের ঢিবি, কলাইয়ের বস্তা, বড়ো বড়ো তৌল-দাঁড়ি আর বাটখারা, সেইখানে ঘুরে তার যেন বাগানে বেড়ানোর আনন্দ।
বাপ ঠাওরালে ছেলেটার কিছু হবে। ঠেলেঠুলে গোটা দুত্তিন পাস করাতে পারলেই ইস্কুলমাস্টারি থেকে মোক্তারি ওকালতি পর্যন্ত ভদ্রলোকদের যে-কয়টা মোক্ষতীর্থ তার কোনো-না-কোনোটাতে মধু ভিড়তে পারবে। অন্য তিনটে ছেলের ভাগ্যসীমারেখা গোমস্তাগিরি পর্যন্তই পিলপে-গাড়ি হয়ে রইল। তারা কেউ বা আড়তদারের কেউ বা তালুকদারের দফতরে কানে কলম গুঁজে শিক্ষানবিশিতে বসে গেল। আনন্দ ঘোষালের ক্ষীণ সর্বস্বের উপর ভর করে মধুসূদন বাসা নিলে কলকাতার মেসে।
অধ্যাপকেরা আশা করেছিল পরীক্ষায় এ-ছেলে কলেজের নাম রাখবে। এমন সময় বাপ গেল মারা। পড়বার বই, মায় নোটবই সমেত, বিক্রি করে মধু পণ করে বসল, এবার সে রোজগার করবে। ছাত্রমহলে সেকেণ্ডহ্যাণ্ড বই বিক্রি করে ব্যবসা হল শুরু। মা কেঁদে মরে— বড়ো তার আশা ছিল, পরীক্ষা-পাসের রাস্তা দিয়ে ছেলে ঢুকবে ‘ভদ্দোর’ শ্রেণীর ব্যুহের মধ্যে। তার পরে ঘোষাল-বংশদণ্ডের আগায় উড়বে কেরানিবৃত্তির জয়পতাকা।
ছেলেবেলা থেকে মধুসুদন যেমন মাল বাছাই করতে পাকা, তেমনি তার বন্ধু বাছাই করবারও ক্ষমতা। কখনো ঠকে নি। তার প্রধান ছাত্রবন্ধু ছিল কানাই গুপ্ত। এর পূর্বপুরুষেরা বড়াে বড়ো সওদাগরের মুচ্ছুদ্দিগিরি করে এসেছে। বাপ নামজাদা কেরোসিন কোম্পানির আপিসে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত।
ভাগ্যক্রমে এঁরই মেয়ের বিবাহ। মধুসূদন কোমরে চাদর বেঁধে কাজে লেগে গেল। চাল বাঁধা, ফুলপাতায় সভা সাজানাে, ছাপাখানায় দাঁড়িয়ে থেকে সােনার কালিতে চিঠি ছাপানো, চৌকি কার্পেট ভাড়া করে আনা, গেটে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা, গলা ভাঙিয়ে পরিবেষণ, কিছুই বাদ দিলে না। এই সুযােগে এমন বিষয়বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিলে যে, রজনীবাবু ভারি খুশি। তিনি কেজো মানুষ চেনেন, বুঝলেন, এ-ছেলের উন্নতি হবে। নিজের থেকে টাকা ডিপজিট দিয়ে মধুকে রজবপুরে কেরােসিনের এজেন্সিতে বসিয়ে দিলেন।
সৌভাগ্যের দৌড় শুরু হল; সেই যাত্রাপথে কেরােসিনের ডিপাে কোন্ প্রান্তে বিন্দুআকারে পিছিয়ে পড়ল। জমার ঘরের মােটা মােটা অঙ্কের উপর পা ফেলতে ফেলতে ব্যবসা হু-হু করে এগােল গলি থেকে সদর রাস্তায়, খুচরো থেকে পাইকিরিতে, দোকান থেকে আপিসে, উদ্যােগপর্ব থেকে স্বর্গারােহণে। সবাই বললে, “একেই বলে কপাল।” অর্থাৎ, পূর্বজন্মের ইস্টিমেতেই এ-জন্মের গাড়ি চলছে। মধুসূদন নিজে জানত যে, তাকে ঠকাবার জন্যে অদৃষ্টের ত্রুটি ছিল না, কেবল হিসেবে ভুল করে নি বলেই জীবনের অঙ্ক-ফলে পরীক্ষকের কাটা দাগ পড়ে নি; হিসেবের দোষে ফেল করতে মজবুত পরীক্ষকের পক্ষপাতের ’পরে তারাই কটাক্ষপাত করে থাকে।
মধুসূদনের রাশ ভারি। নিজের অবস্থা সম্বন্ধে কথাবার্তা কয় না। তবে কিনা আন্দাজে বেশ বোঝা যায়, মরা গাঙে বান এসেছে। গৃহপালিত বাংলাদেশে এমন অবস্থায় সহজ মানুষে বিবাহের চিন্তা করে, জীবিতকালবর্তী সম্পত্তি-ভােগটাকে বংশাবলীর পথ বেয়ে মৃত্যুর পরবর্তী ভবিষ্যতে প্রসারিত করবার ইচ্ছা তাদের প্রবল হয়। কন্যাদায়িকেরা মধুকে উৎসাহ দিতে ত্রুটি করে না; মধুসূদন বলে, “প্রথমে একটা পেট সম্পূর্ণ ভরলে তার পরে অন্য পেটের দায় নেওয়া চলে।” এর থেকে বােঝা যায় মধুসূদনের হৃদয়টা যাই হােক পেটটা ছােটো নয়।
এই সময়ে মধুসূদনের সতর্কতায় রজবপুরের পাটের নাম দাঁড়িয়ে গেল। হঠাৎ মধুসূদন সব-প্রথমেই নদীর ধারের পােড়ো জমি বেবাক কিনে ফেললে, তখন দর সস্তা। ইঁটের পাঁজা পােড়ালে বিস্তর, নেপাল থেকে এল বড়ো বড়ো শালকাঠ, সিলেট থেকে চুন, কলকাতা থেকে মালগাড়ি-বােঝাই করোগেটেড লােহা। বাজারের লােক অবাক। ভাবলে, “এই রে! হাতে কিছু জমেছিল, সেটা সইবে কেন! এবার বদহজমের পালা, কারবার মরণদশায় ঠেকল ব’লে!”
এবারও মধুসূদনেব হিসেবে ভুল হল না। দেখতে দেখতে রজবপুরে ব্যবসার একটা আওড় লাগল। তার ঘূর্ণিটানে দালালরা এসে জুটল, এল মাড়ােয়ারির দল, কুলির আমদানি হল, কল বসল, চিমনি থেকে কুণ্ডলায়িত ধূমকেতু আকাশে আকাশে কালিমা বিস্তার করলে।
হিসেবের খাতার গবেষণা না করেও মধুসূদনের মহিমা এখন দূর থেকে খালি-চোখেই ধরা পড়ে। একা সমস্ত গঞ্জের মালিক, পাঁচিল-ঘেরা দোতলা ইমারত, গেটে শিলাফলকে লেখা ‘মধুচক্র’। এ-নাম তার কলেজের পূর্বতন সংস্কৃত অধ্যাপকের দেওয়া। মধুসূদনকে তিনি পূর্বের চেয়ে অকস্মাৎ এখন অনেক বেশি স্নেহ করেন।
এইবার বিধবা মা ভয়ে-ভয়ে এসে বললে, “বাবা, কবে মরে যাব, বউ দেখে যেতে পারব না কি?”
মধু গম্ভীরমুখে সংক্ষেপে উত্তর করলে, “বিবাহ করতেও সময় নষ্ট, বিবাহ করেও তাই। আমার ফুরসত কোথায়?”
পীড়াপীড়ি করে এমন সাহস ওর মায়েরও নেই, কেননা সময়ের বাজার-দর আছে। সবাই জানে, মধুসূদনের এক কথা।
আরও কিছুকাল যায়। উন্নতির জোয়ার বেয়ে কারবারের আপিস মফস্বল থেকে কলকাতায় উঠল। নাতিনাতনীর দর্শনসুখ সম্বন্ধে হাল ছেড়ে দিয়ে মা ইহলােক ত্যাগ করলে। ঘােষাল-কোম্পানির নাম আজ দেশবিদেশে, ওদের ব্যবসা বনেদি বিলিতি কোম্পানির গা ঘেঁষে চলে, বিভাগে বিভাগে ইংরেজ ম্যানেজার।
মধুসূদন এবার স্বয়ং বললে, বিবাহের ফুরসত হল। কথার বাজারে ক্রেডিট তার সর্বোচ্চে। অতিবড় অভিমানী ঘরেরও মানভঞ্জন করবার মতাে তার শক্তি। চারদিক থেকে অনেক কুলবতী রূপবতী গুণবতী ধনবতী বিদ্যাবতী কুমারীদের খবর এসে পৌঁছােয়। মধুসূদন চোখ পাকিয়ে বলে, ওই চাটুজ্যেদের ঘরের মেয়ে চাই।
ঘা-খাওয়া বংশ ঘা খাওয়া নেকড়ে বাঘের মতো, বড়াে ভয়ংকর।
এইবার কন্যাপক্ষের কথা।
নুরনগরের চাটুজ্যেদের অবস্থা এখন ভালাে নয়। ঐশ্বর্যের বাঁধ ভাঙছে। ছয়-আনি শরিকরা বিষয় ভাগ করে বেরিয়ে গেল, এখন তারা বাইরে থেকে লাঠি হাতে দশ-আনির সীমানা খাবলে বেড়াচ্ছে। ছাড়া রাধাকান্ত জীউর সেবায়তি অধিকার দশে-ছয়ে যতই সূক্ষ্মভাবে ভাগ করবার চেষ্টা চলছে, ততই তার শস্য অংশ স্থূলভাবে উকিলমােক্তারের আঙিনায় নয়-ছয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ল, আমলারাও বঞ্চিত হল না নুরনগরের সে-প্রতাপ নেই— আয় নেই, ব্যয় বেড়েছে চতুর্গুণ। শতকরা ন-টাকা হারে সুদের ন-পাওআলা মাকড়সা জমিদারির চারদিকে জাল জড়িয়ে চলেছে।
পরিবারে দুই ভাই, পাঁচ বােন। কন্যাধিক্য-অপরাধের জরিমানা এখনও শেষ হয় নি। কর্তা থাকতেই চার বােনের বিয়ে হয়ে গেল কুলীনের ঘরে। এদের ধনের বহরটুকু হাল আমলের, খ্যাতিটা সাবেক আমলের। জামাইদের পণ দিতে হল কৌলীন্যের মােটা দামে ও ফাঁকা খ্যাতির লম্বা মাপে। এই বাবদেই ন-পার্সেন্টের সূত্রে গাঁথা দেনার ফঁসে বারো পার্সেন্টের গ্রন্থি পড়ল। ছােটো ভাই মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললে, বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে আসি, রােজগার না করলে চলবে না। সে গেল বিলেতে, বড় ভাই বিপ্রদাসের ঘাড়ে পড়ল সংসারের ভার।
এই সময়টাতে পূর্বোক্ত ঘােষাল ও চাটুজ্যেদের ভাগ্যের ঘুড়িতে পরস্পরের লখে লখে আর-একবার বেধে গেল। ইতিহাসটা বলি।
বড়ােবাজারের তনসুকদাস হালওআইদের কাছে এদের একটা মােটা অঙ্কের দেনা। নিয়মিত সুদ দিয়ে আসছে, কোনাে কথা ওঠে নি। এমন সময়ে পূজোর ছুটি পেয়ে বিপ্রদাসের সহপাঠী অমূল্যধন এল আত্মীয়তা দেখাতে। সে হল বড়ো অ্যাটর্নি-আপিসের আর্টিকেল্ড্, হেড্-ক্লার্ক। এই চশমা-পরা যুবকটি নুরনগরের অবস্থাটা আড়চোখে দেখে নিলে। সেও কলকাতায় ফিরল আর তনসুকদাসও টাকা ফেরত চেয়ে বসল; বললে, নতুন চিনির কারবার খুলেছে, টাকার জরুরি দরকার।
বিপ্রদাস মাথায় হাত দিয়ে পড়ল।
সেই সংকটকালেই চাটুজ্যে ও ঘোষাল এই দুই নামে দ্বিতীয়বার ঘটল বন্দ্ব-সমাস। তার পূর্বেই সরকারবাহাদুরের কাছ থেকে মধুসূদন রাজখেতাব পেয়েছে। পূর্বোক্ত ছাত্রবন্ধু এসে বললে, নতুন রাজা খােশমেজাজে আছে, এই সময়ে ওর কাছ থেকে সুবিধেমতাে ধার পাওয়া যেতে পারে। তাই পাওয়া গেল— চাটুজ্যেদের সমস্ত খুচরো দেনা একঠাঁই করে এগারাে লাখ টাকা সাত পার্সেট সুদে। বিপ্রদাস হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
কুমুদিনী ওদের শেষ অবশিষ্ট বােন বটে, তেমনি আজ ওদের সম্বলেরও শেষ অবশিষ্ট দশা। পণ জোটানাের, পাত্র জোটানাের কথা কল্পনা করতে গেলে আতঙ্ক হয়। দেখতে সে সুন্দরী, লম্বা ছিপ্ছিপে, যেন রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ড; চোখ বড়ো না হােক একেবারে নিবিড় কালাে, আর নাকটি নিখুঁত রেখায় যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি। রঙ শাঁখের মতো চিকন গৌর; নিটোল দুখানি হাত; সে-হাতের সেবা কমলার বরদান, কৃতজ্ঞ হয়ে গ্রহণ করতে হয়। সমস্ত মুখে একটি বেদনায় সকরুণ ধৈর্যের ভাব।
কুমুদিনী নিজের জন্যে নিজে সংকুচিত। তার বিশ্বাস, সে অপয়া। সে জানে, পুরুষরা সংসার চালায় নিজের শক্তি দিয়ে, মেয়েরা লক্ষ্মীকে ঘরে আনে নিজের ভাগ্যের জোরে। ওর দ্বারা তা হল না। যখন থেকে ওর বােঝবার বয়স হয়েছে তখন থেকে চারিদিকে দেখছে দুর্ভাগ্যের পাপদৃষ্টি। আর, সংসারের উপর চেপে আছে ওর নিজের আইবুড়ো-দশা, জগদ্দল পাথর, তার যতবড়ো দুঃখ, ততবড়াে অপমান। কিছু করবার নেই, কপালে করাঘাত ছাড়া। উপায় করবার পথ বিধাতা মেয়েদের দিলেন না, দিলেন কেবল ব্যথা পাবার শক্তি। অসম্ভব একটা কিছু ঘটে না কি? কোনাে দেবতার বর, কোনাে যক্ষের ধন, পূর্বজন্মের কোনাে একটা বাকিপড়া পাওনার এক মুহূর্তে পরিশােধ? এক-একদিন রাতে বিছানা থেকে উঠে বাগানের মর্মরিত ঝাউগাছগুলাের মাথার উপরে চেয়ে থাকে, মনে-মনে বলে, “কোথায় আমার রাজপুত্র, কোথায় তােমার সাতরাজার ধন মানিক, বাঁচাও আমার ভাইদের, আমি চিরদিন তােমার দাসী হয়ে থাকব।”
বংশের দুর্গতির জন্য নিজেকে যতই অপরাধী করে, ততই হৃদয়ের সুধাপাত্র উপুড় ক’রে ভাইদের ওর ভালােবাসা দেয়— কঠিন দুঃখে নেংড়ানো ওর ভালোবাসা। কুমুর ’পরে তাদের কর্তব্য করতে পারছে না বলে ওর ভাইরাও বড়ো ব্যথার সঙ্গে কুমুকে তাদের স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এই পিতৃমাতৃহীনাকে উপরওয়ালা যে স্নেহের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন ভাইরা তা ভরিয়ে দেবার জন্যে সর্বদা উৎসুক। ও যে চাঁদের আলোর টুকরাে, দৈন্যের অন্ধকারকে একা মধুর করে রেখেছে। যখন মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যের বাহন বলে নিজেকে সে ধিক্কার দেয়, দাদা বিপ্রদাস হেসে বলে, কুমু, তুই নিজেই তো আমাদের সৌভাগ্য— তােকে না পেলে বাড়িতে শ্রী থাকত কোথায়?”
কুমুদিনী ঘরে পড়াশুনা করেছে। বাইরের পরিচয় নেই বললেই হয়। পুরােনাে নতুন দুই কালের আলাে-আঁধারে তার বাস। তার জগৎটা আবছায়া— সেখানে রাজত্ব করে সিদ্ধেশ্বরী, গন্ধেশ্বরী, ঘেঁটু, ষষ্ঠী; সেখানে বিশেষ দিনে চন্দ্র দেখতে নেই; শাঁখ বাজিয়ে গ্রহণের কুদৃষ্টিকে তাড়াতে হয়, অম্বুবাচীতে সেখানে দুধ খেলে সাপের ভয় ঘোচে; মন্ত্র প’ড়ে, পাঁঠা মানত ক’রে, সুপুরি আলো-চাল ও পাঁচ পয়সার শিন্নি মেনে, তাগাতাবিজ প’রে,সে জগতের শুভ-অশুভের সঙ্গে কারবার; স্বস্ত্যয়নের জোরে ভাগ্য সংশোধনের আশা— সে-আশা হাজারবার ব্যর্থ হয়। প্রত্যক্ষ দেখা যায় অনেক সময়েই শুভলগ্নের শাখায় শুভফল ফলে না, তবু বাস্তবের শক্তি নেই প্রমাণের দ্বারা স্বপ্নের মােহ কাটাতে পারে। স্বপ্নের জগতে বিচার চলে না, একমাত্র চলে মেনে-চলা। এ-জগতে দৈবের ক্ষেত্রে যুক্তির সুসংগতি, বুদ্ধির কর্তৃত্ব, ভালাে-মন্দর নিত্যতত্ত্ব নেই বলেই কুমুদিনীর মুখে এমন একটা করুণা। ও জানে, বিনা অপরাধেই ও লাঞ্ছিত। আট বছর হল সেই লাঞ্ছনাকে একান্ত সে নিজের বলেই গ্রহণ করেছিল— সে তার পিতার মৃত্যু নিয়ে।
পুরোনাে ধনী-ঘরে পুরাতন কাল যে-দুর্গে বাস করে তার পাকা গাঁথুনি। অনেক দেউড়ি পার হয়ে তবে নতুন কালকে সেখানে ঢুকতে হয়। সেখানে যারা থাকে নতুন যুগে এসে পৌঁছােতে তাদের বিস্তর লেট হয়ে যায়। বিপ্রদাসের বাপ মুকুন্দলালও ধাবমান নতুন যুগকে ধরতে পারেন নি।
দীর্ঘ তাঁর গৌরবর্ণ দেহ, বাবরি-কাটা চুল, বড়ো বড়াে টানা চোখে অপ্রতিহত প্রভুত্বের দৃষ্টি। ভারি গলায় যখন হাঁক পাড়েন, অনুচর-পরিচরদের বুক থর্ থর্ করে কেঁপে ওঠে। যদিও পালােয়ন রেখে নিয়মিত কুস্তি করা তাঁর অভ্যাস, গায়ে শক্তিও কম নয়, তবু সুকুমার শরীরে শ্রমের চিহ্ন নেই। পরনে চুনট-করা ফুরফুরে মসলিনের জামা, ফরাসডাঙা বা ঢাকাই ধুতির বহুযত্নবিন্যস্ত কোঁচা ভূলুণ্ঠিত, কর্তার আসন্ন আগমনের বাতাস ইস্তাম্বুল আতরের সুগন্ধবার্তা বহন করে। পানের সােনার বাটা হাতে খানসামা পশ্চাদ্বর্তী, দ্বারের কাছে সর্বদা হাজির তকমাপরা আরদালি। সদর-দরজায় বৃদ্ধ চন্দ্রভান জমাদার তামাক মাখা ও সিদ্ধি কোটার অবকাশে বেঞ্চে বসে লম্বা দাড়ি দুই ভাগ করে বার বার আঁচড়িয়ে দুই কানের উপর বাঁধে, নিয়তন দারােয়ানরা তলােয়ার হাতে পাহারা দেয়। দেউড়ির দেওয়ালে ঝােলে নানারকমের ঢাল, বাঁকা তলােয়ার, বহুকালের, পুরানাে বন্দুক বল্লম, বর্শা।
বৈঠকখানায় মুকুন্দলাল বসেন গদির উপর, পিঠের কাছে তাকিয়া। পারিষদেরা বসে নিচে, সামনে বাঁয়ে দুই ভাগে। হুঁকাবরদারের জানা আছে এদের কার সম্মান কোন্ রকম হুঁকোয় রক্ষা হয়, বাঁধানাে, আবাঁধানাে, না, গুড়গুড়ি। কর্তামহারাজের জন্যে বৃহৎ আলবােলা, গােলাপজলের গন্ধে সুগন্ধি।
বাড়ির আর-এক মহলে বিলিতি বৈঠকখানা, সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিলিতি আসবাব। সামনেই কালােদাগ-ধরা মস্ত এক আয়না, তার গিলটি-করা ফ্রেমের দুই গায়ে ডানাওআলা পরীমূর্তির হাতে-ধরা বাতিদান। তলায় টেবিলে সােনার জলে চিত্রিত কালাে পাথরের ঘড়ি, আর কতকগুলাে বিলিতি কাঁচের পুতুল। খাড়াপিঠওআলা চৌকি, সােফা, কড়িতে দোদুল্যমান ঝাড়লণ্ঠন সমস্তই হল্যাণ্ড-কাপড়ে মােড়া। দেয়ালে পূর্বপুরুষদের অয়েলপেন্টিং, আর তার সঙ্গে বংশের মুরুব্বি দু-একজন রাজপুরুষের ছবি। ঘরজোড়া বিলিতি কার্পেট, তাতে মােটা মোটা ফুল টক্টকে কড়া রঙে আঁকা। বিশেষ ক্রিয়াকর্মে জিলার সাহেবসুবাদের নিমন্ত্রণােপলক্ষ্যে এই ঘরের অবগুণ্ঠন মােচন হয়। বাড়িতে এই একটা মাত্র আধুনিক ঘর, কিন্তু মনে হয়, এইটেই সবচেয়ে প্রাচীন ভূতে-পাওয়া কামরা, অব্যবহারের রুদ্ধ ঘনগন্ধে দম-আটকানাে দৈনিক জীবনযাত্রার সম্পর্কঞ্চিত, বোবা।
মুকুন্দলালের যে শৌখিনতা সেটা তখনকার আদবকায়দার অত্যাবশ্যক অঙ্গ। তার মধ্যে যে নির্ভীক ব্যয়বাহুল্য, সেইটেতেই ধনের মর্যাদা। অর্থাৎ ধন বােঝা হয়ে মাথায় চড়ে নি, পাদপীঠ হয়ে আছে পায়ের তলায়। এঁদের শৌখিনতার আমদরবারে দানদাক্ষিণ্য, খাসদরবারে ভােগবিলাস, —দুই-ই খুব টানা মাপের। একদিকে আশ্রিতবাৎসল্যে যেমন অকৃপণতা, আর-একদিকে ঔদ্ধত্যদমনে তেমনি অবাধ অধৈর্য। একজন হঠাৎ-ধনী প্রতিবেশী গুরুতর অপরাধে কর্তার বাগানের মালীর ছেলের কান মলে দিয়েছিল মাত্র; এই ধনীর শিক্ষাবিধান বাবদ যত খরচ হয়েছে, নিজের ছেলেকে কলেজ পার করতেও এখনকার দিনে এত খরচ করে না। অথচ মালীর ছেলেটাকেও অগ্রাহ্য করেন নি। চাবকিয়ে তাকে শয্যাগত করেছিলেন। রাগের চোটে চাবুকের মাত্রা বেশি হয়েছিল বলে ছেলেটার উন্নতি হল। সরকারি খরচে পড়াশুনা করে সে আজ ডাক্তারি করে।
পুরাতন কালের ধনবানদের প্রথামতো মুকুন্দলালের জীবন দুই-মহলা। এক মহলে গার্হস্থ্য, আর-এক মহলে ইয়ার্কি। অর্থাৎ এক মহলে দশকর্ম, আর-এক মহলে একাদশ অকর্ম। ঘরে আছেন ইষ্টদেবতা আর ঘরের গৃহিণী। সেখানে পূজা-অর্চনা, অতিথিসেবা, পালপার্বণ, ব্রত-উপবাস, কাঙালিবিদায়, ব্রাহ্মণভােজন, পাড়াপড়শি, গুরুপুরােহিত। ইয়ারমহল গৃহসীমার বাইরেই, সেখানে নবাবি আমল, মজলিসি সমারােহে সরগরম। এইখানে আনাগোনা চলত গৃহের প্রত্যন্তপুরবাসিনীদের। তাদের সংসর্গকে তখনকার ধনীরা সহবত শিক্ষার উপায় বলে গণ্য করত। দুই বিরুদ্ধ হাওয়ার দুই কক্ষবর্তী গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে গৃহিণীদের বিস্তর সহ্য করতে হয়।
মুকুন্দলালের স্ত্রী নন্দরানী অভিমানিনী, সহ্য করাটা তাঁর সম্পূর্ণ অভ্যাস হল না। তার কারণ ছিল। তিনি নিশ্চিত জানেন বাইরের দিকে তাঁর স্বামীর তানের দৌড় যতদূরই থাক তিনিই হচ্ছেন ধুয়ো, ভিতরের শক্ত টান তাঁরই দিকে। সেইজন্যেই স্বামী যখন নিজের ভালােবাসার ’পরে নিজে অন্যায় করেন, তিনি সেটা সইতে পারেন না। এবারে তাই ঘটল।
রাসের সময় খুব ধুম। কতক কলকাতা কতক ঢাকা থেকে আমােদের সরঞ্জাম এল। বাড়ির উঠোনে কৃষ্ণযাত্রা, কোনােদিন বা কীর্তন। এইখানে মেয়েদের ও সাধারণ পাড়াপড়শির ভিড়। অন্যবারে তামসিক আয়ােজনটা হত বৈঠকখানাঘরে; অন্তঃপুরিকারা, রাতে ঘুম নেই, বুকে ব্যথা বিঁধছে, দরজার ফাঁক দিয়ে কিছু কিছু আভাস নিয়ে যেতে পারতেন। এবারে খেয়াল গেল বাইচের ব্যবস্থা হবে বজরায় নদীর উপর।
কী হচ্ছে দেখবার জো নেই বলে নন্দরানীর মন রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে আছড়ে আছড়ে কাঁদতে লাগল। ঘরে কাজকর্ম, লােককে খাওয়ানো দাওয়ানাে, দেখাশুনা হাসিমুখেই করতে হয়। বুকের মধ্যে কাঁটাটা নড়তে-চড়তে কেবলই বেঁধে, প্রাণটা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে, কেউ জানতে পারে না। ওদিকে থেকে-থেকে তৃপ্ত কণ্ঠের রব ওঠে, জয় হােক রানীমার।
অবশেষে উৎসবের মেয়াদ ফুরােল, বাড়ি হয়ে গেল খালি। কেবল ছেঁড়া কলাপাতা ও সরা-খুরি-ভাঁড়ের ভগ্নাবশেষের উপর কাক-কুকুরের কলররমুখর উত্তরকাণ্ড চলছে। ফরাশেরা সিঁড়ি খাটিয়ে লণ্ঠন খুলে নিল, চাঁদোয়া নামাল, ঝড়ের টুকরো বাতি ও শােলার ফুলের ঝালরগুলাে নিয়ে পাড়ার ছেলেরা কাড়াকাড়ি বাধিয়ে দিল। সেই ভিড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে চড়ের আওয়াজ ও চীৎকার কান্না যেন তারস্বরের হাউইয়ের মতাে আকাশ ফুঁড়ে উঠছে। অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণ থেকে উচ্ছিষ্ট ভাত-তরকারির গন্ধে বাতাস অম্লগন্ধী; সেখানে সর্বত্র ক্লান্তি, অবসাদ ও মলিনতা। এই শূন্যতা অসহ্য হয়ে উঠল যখন মুকুন্দলাল আজও ফিরলেন না। নাগাল পাবার উপায় নেই বলেই নন্দরানীর ধৈর্যের বাঁধ হঠাৎ ফেটে খান্-খান্ হয়ে গেল।
দেওয়ানজিকে ডাকিয়ে পরদার আড়াল থেকে বললেন, “কর্তাকে বলবেন, “বৃন্দাবনে মার কাছে আমাকে এখনই যেতে হচ্ছে। তাঁর শরীর ভালাে নেই।”
দেওয়ানজি কিছুক্ষণ টাকে হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “কর্তাকে জানিয়ে গেলেই ভালাে হত, মাঠাকরুন। আজকালের মধ্যে বাড়ি ফিরবেন খবর পেয়েছি।”
“না, দেরি করতে পারব না।”
নন্দরানীও খবর পেয়েছেন, আজকালের মধ্যেই ফেরবার কথা। সেই জন্যেই যাবার এত তাড়া। নিশ্চয় জানেন, অল্প একটু কান্নাকাটিসাধ্যসাধনাতেই সব শোধ হয়ে যাবে। প্রতিবারই এমনি হয়েছে। উপযুক্ত শাস্তি অসমাপ্তই থাকে। এবারে তা কিছুতেই চলবে না। তাই দণ্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েই দণ্ডদাতাকে পালাতে হচ্ছে। বিদায়ের ঠিক পূর্বমুহুর্তে পা সরতে চায় না—শােবার খাটের উপর উপুড় হয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কান্না। কিন্তু যাওয়া বন্ধ হল না।
তখন কার্তিক মাসের বেলা দুটো। রৌদ্রে বাতাস আতপ্ত। রাস্তার ধারের শিশুতরুশ্রেণীর মর্মরের সঙ্গে মিশে ক্কচিৎ গলাভাঙা কোকিলের ডাক আসছে। যে রাস্তা দিয়ে পালকি চলেছে, সেখান থেকে কাঁচা ধানের খেতের পরপ্রান্তে নদী দেখা যায়। নন্দরানী থাকতে পারলেন না, পালকির-দরজা ফাঁক করে সেদিকে চেয়ে দেখলেন। ওপারের চরে বজরা বাঁধা আছে, চোখে পড়ল। মাস্তুলের উপর নিশেন উড়ছে। দূর থেকে মনে হল বজরার ছাতের উপর চিরপরিচিত গুপি হরকরা বসে; তার পাগড়ির তকমার উপর সূর্যের আলাে ঝক্মক্ করছে। সবলে পালকির দরজা বন্ধ করে দিলেন, বুকের ভিতরটা পাথর হয়ে গেল।
মুকুন্দলাল, যেন মাস্তুল-ভাঙা, পাল-ছেঁড়া, টোল-খাওয়া, তুফানে আছাড়-লাগা জাহাজ, সসংকোচে বন্দরে এসে ভিড়লেন। অপরাধের বােঝায় বুক ভারি। প্রমােদের স্মৃতিটা যেন অতিভােজনের পরের উচ্ছিষ্টের মতাে মনটাকে বিতৃষ্ণায় ভরে দিয়েছে। যারা ছিল তাঁর এই আমােদের উৎসাহদাতা উদ্যোগকর্তা, তারা যদি সামনে থাকত তাহলে তাদের ধরে চাবুক কষিয়ে দিতে পারতেন। মনে-মনে পণ করছেন, আর কখনাে এমন হতে দেবেন না। তাঁর আলুথালু চুল, রক্তবর্ণ চোখ আর মুখের অতিশুষ্ক ভাব দেখে প্রথমটা কেউ সাহস করে কর্ত্রীঠাকরুনের খবরটা দিতে পারলে না; মুকুন্দলাল ভয়ে-ভয়ে অন্তঃপুরে গেলেন। “বড়োবউ, মাপ করো, অপরাধ করেছি, আর-কখনাে এমন হবে না” এই কথা মনে মনে বলতে বলতে শােবার ঘরের দরজার কাছে একটুখানি থমকে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলেন। মনে-মনে নিশ্চয় স্থির করেছিলেন যে, অভিমানিনী বিছানায় পড়ে আছেন। একেবারে পায়ের কাছে গিয়ে পড়বেন, এই ভেবে ঘরে ঢুকেই দেখলেন ঘর শূন্য। বুকের ভিতরটা দমে গেল। শােবার ঘরে বিছানায় নন্দরানীকে যদি দেখতেন তবে বুঝতেন যে, অপরাধ ক্ষমা করবার জন্যে মানিনী অর্ধেক রাস্তা এগিয়ে আছেন। কিন্তু বড়ােবউ যখন শােবার ঘরে নেই তখন মুকুন্দলাল বুঝলেন তাঁর প্রায়শ্চিত্তটা হবে দীর্ঘ এবং কঠিন। হয়তাে আজ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, কিংবা হবে আরও দেরি। কিন্তু এতক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। সম্পূর্ণ শাস্তি এখনই মাথা পেতে নিয়ে ক্ষমা আদায় করবেন, নইলে জলগ্রহণ করবেন না। বেলা হয়েছে, এখনও স্নানাহার হয় নি, এ দেখে কি সাধ্বী থাকতে পারবেন? শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, প্যারী দাসী বারান্দার এক কোণে মাথায় ঘােমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, “তাের বড়ােবউমা কোথায়?”
সে বললে, “তিনি তাঁর মাকে দেখতে পরশুদিন বৃন্দাবনে গেছেন।”
ভালাে যেন বুঝতে পারলেন না, রুদ্ধকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় গেছেন?”
“বৃন্দাবনে। মায়ের অসুখ।”
মুকুন্দলাল একবার বারান্দার রেলিং চেপে ধরে দাঁড়ালেন। তার পরে দ্রুতপদে বাইরের বৈঠকখানায় গিয়ে একা বসে রইলেন। একটি কথা কইলেন না। কাছে আসতে কারও সাহস হয় না।
দেওয়ানজি এসে ভয়ে ভয়ে বললেন, “মাঠাকরুনকে আনতে লোক পাঠিয়ে দিই?”
কোন কথা না বলে কেবল আঙুল নেড়ে নিষেধ করলেন। দেওয়ানজি চলে গেলে রাধু খানসামাকে ডেকে বললেন, “ব্র্যাণ্ডি লে আও।”
বাড়িসুদ্ধ লোক হতবুদ্ধি। ভূমিকম্প যখন পৃথিবীর গভীর গর্ভ থেকে মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে তখন যেমন তাকে চাপা দেবার চেষ্টা করা মিছে, নিরুপায়ভাবে তার ভাঙাচোরা সহ্য করতেই হয়— এ ও তেমনি।
দিনরাত চলছে নির্জল ব্র্যাণ্ডি। খাওয়াদাওয়া প্রায় নেই। একে শরীর পূর্ব থেকেই ছিল অবসন্ন, তারপরে এই প্রচণ্ড অনিয়মে বিকারের সঙ্গে রক্তবমন দেখা দিল।
কলকাতা থেকে ডাক্তার এল— দিনরাত মাথায় বরফ চাপিয়ে রাখলে।
মুকুন্দলাল যাকে দেখেন খেপে ওঠেন, তাঁর বিশ্বাস তাঁর বিরুদ্ধে বাড়িসুদ্ধ লোকের চক্রান্ত। ভিতরে ভিতরে একটা নালিশ গুমরে উঠছিল— এরা যেতে দিলে কেন?
একমাত্র মানুষ যে তাঁর কাছে আসতে পারত সে কুমুদিনী। সে এসে পাশে বসে; ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাঁর মুখের দিকে মুকুন্দলাল চেয়ে দেখেন,— যেন মার সঙ্গে ওর চোখে কিংবা কোথাও একটা মিল দেখতে পান। কখনো কখনো বুকের উপরে তার মুখ টেনে নিয়ে চুপ করে চোখ বুজে থাকেন, চোখের কোণ দিয়ে জল পড়তে থাকে, কিন্তু কখনো ভুলে একবার তার মার কথা জিজ্ঞাসা করেন না। এদিকে বৃন্দাবনে টেলিগ্রাম গেছে। কর্ত্রীঠাকরুনের কালই ফেরবার কথা। কিন্তু শোনা গেল কোথায় এক জায়গায় রেলের লাইন গেছে ভেঙে।
সেদিন তৃতীয়া; সন্ধ্যাবেলায় ঝড় উঠল। বাগানে মড়্ মড়্ করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। থেকে-থেকে বৃষ্টির ঝাপটা ঝাঁকানি দিয়ে উঠছে ক্রুদ্ধ অধৈর্যের মতো। লোকজন খাওয়াবার জন্যে যে-চালাঘর তােলা হয়েছিল তার করােগেটেড লােহার চাল উড়ে দিঘিতে গিয়ে পড়ল। বাতাস বাণবিদ্ধ বাঘের মতাে গোঁ গোঁ করে গােঙরাতে গােঙরাতে আকাশে আকাশে লেজ ঝাপটা দিয়ে পাক খেয়ে বেড়ায়। হঠাৎ বাতাসের এক দমকে জানলাদরজাগুলো খড়্ খড়্ করে কেঁপে উঠল। কুমুদিনীর হাত চেপে ধরে মুকুন্দলাল বললেন, “মা কুমু, ভয় নেই, তুই তাে কোনাে দোষ করিস নি। ওই শোন্ দাঁতকড়মড়ানি, ওরা আমাকে মারতে আসছে।”
বাবার মাথায় বরফের পুঁটুলি বুলােত বুলােতে কুমুদিনী বলে, “মারবে কেন বাবা? ঝড় হচ্ছে, এখনই থেমে যাবে।”
“বৃন্দাবন? বৃন্দাবন…চন্দ্র…চক্রবর্তী! বাবার আমলের পুরুত—সে তাে মরে গেছে—ভূত হয়ে গেছে বৃন্দাবনে। কে বললে সে আসবে?”
“কথা কোয়াে না বাবা, একটু ঘুমােও।”
“ওই যে, কাকে বলছে, খবরদার, খবরদার।”
“কিছু না, বাতাসে বাতাসে গাছগুলােকে ঝাঁকানি দিচ্ছে।”
“কেন, ওর রাগ কিসের? এতই কী দোষ করেছি, তুই বল্ মা।”
“কোনাে দোষ কর নি বাবা। একটু ঘুমােও।”
“বিন্দে দূতী? সেই যে মধু অধিকারী সাজত।
মিছে কর কেন নিন্দে
ওগাে বিন্দে শ্রীগােবিন্দে—”
চোখ বুজে গুন্ গুন্ করে গাইতে লাগলেন।—
“কার বাঁশি ঐ বাজে বৃন্দাবনে।
সই লাে সই
ঘরে আমি রইব কেমনে?”
“রাধু, ব্র্যাণ্ডি লে আও।”
কুমুদিনী বাবার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, “বাবা, ও কী বলছ?” মুকুন্দলাল চোখ চেয়ে তাকিয়েই জিভ কেটে চুপ করেন। বুদ্ধি যখন অত্যন্ত বেঠিক তখনও এ কথা ভােলেন নি যে, কুমুদিনীর সামনে মদ চলতে পারে না।
একটু পরে আবার গান ধরলেন,
“শ্যামের বাঁশি কাড়তে হবে,
নইলে আমায় এ বৃন্দাবন ছাড়তে হবে।”
এই এলােমলো গানের টুকরােগুলাে শুনে কুমুর বুক ফেটে যায়— মায়ের উপর রাগ করে, বাবার পায়ের তলায় মাথা রাখে, যেন মায়ের হয়ে মাপ-চাওয়া।
মুকুন্দ হঠাৎ ডেকে উঠলেন, “দেওয়ানজি!”
দেওয়ানজি আসতে তাকে বললেন “ওই যেন ঠক্ ঠক্ শুনতে পাচ্ছি।”
দেওয়ানজি বললেন, “বাতাসে দরজা নাড়া দিচ্ছে।”
“বুড়ো এসেছে, সেই বৃন্দাবনচন্দ্র— টাক মাথায়, লাঠি হাতে, চেলির চাদর কাঁধে। দেখে এস তো। কেবলি ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ করছে। লাঠি না খড়ম?”
রক্তবমন কিছুক্ষণ শান্ত ছিল। তিনটে রাত্রে আবার আরম্ভ হল। মুকুন্দলাল বিছানার চারিদিকে হাত বুলিয়ে জড়িতস্বরে বললেন, “বড়ােবউ, ঘর যে অন্ধকার! এখনও আলাে জ্বালবে না?”
বজরা থেকে ফিরে আসবার পর মুকুন্দলাল এই প্রথম স্ত্রীকে সম্ভাষণ করলেন— আর এই শেষ।
বৃন্দাবন থেকে ফিরে এসে নন্দরানী বাড়ির দরজার কাছে মূর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁকে ধরাধরি করে বিছানায় এনে শােয়াল। সংসারে কিছুই তাঁর আর রুচল না। চোখের জল একেবারে শুকিয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সান্ত্বনা নেই। গুরু এসে শাস্ত্রের শ্লোক আওড়ালেন, মুখ ফিরিয়ে রইলেন। হাতের লােহা খুললেন না— বললেন, “আমার হাত দেখে বলেছিল আমার এয়ােত ক্ষয় হবে না। সে কি মিথ্যে হতে পারে?”
দূরসম্পর্কের ক্ষেমা ঠাকুরঝি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “যা হবার তা তাে হয়েছে, এখন ঘরের দিকে তাকাও। কর্তা যে যাবার সময় বলে গেছেন, বড়োবউ ঘরে কি আলাে জ্বালবে না?”
নন্দরানী বিছানা থেকে উঠে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাব, আলাে জ্বালতে যাব। এবার আর দেরি হবে না।” বলে তাঁর পাণ্ডুবর্ণ শীর্ণ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন হাতে প্রদীপ নিয়ে এখনই যাত্রা করে চলেছেন।
সূর্য গেছেন উত্তরায়ণে, মাঘ মাস এল, শুক্লা চতুর্দশী। নন্দরানী কপালে মােটা করে সিঁদুর পরলেন, গায়ে জড়িয়ে নিলেন লাল বেনারসি শাড়ি। সংসারের দিকে না তাকিয়ে, মুখে হাসি নিয়ে চলে গেলেন।
বাবার মৃত্যুর পর বিপ্রদাস দেখলে, যে-গাছে তাদের আশ্রয় তার শিকড় খেয়ে দিয়েছে পােকায়। বিষয়সম্পত্তি ঋণের চোরাবালির উপর দাঁড়িয়ে— অল্প করে ডুবছে। ক্রিয়াকর্ম সংক্ষেপ ও চালচলন খাটো না করলে উপায় নেই। কুমুর বিয়ে নিয়েও কেবলই প্রশ্ন আসে, তার উত্তর দিতে মুখে বাধে। শেষকালে নুরনগর থেকে বাসা তুলতে হল। কলকাতায় বাগবাজারের দিকে একটা বাড়িতে এসে উঠল।
পুরােনাে বাড়িতে কুমুদিনীর একটা প্রাণময় পরিমণ্ডল ছিল। চারিদিকে ফুলফল, গােয়ালঘর, পূজোবাড়ি, শস্যখেত, মানুষজন। অন্তঃপুরের বাগানে ফুল তুলেছে, সাজি ভরেছে, নুন-লঙ্কা-ধনেপাতার সঙ্গে কাঁচা কুল মিশিয়ে অপথ্য করেছে, চালতা পেড়েছে, বােশেখ-জষ্টির ঝড়ে আমবাগানে আম কুড়িয়েছে। বাগানের পূর্বপ্রান্তে ঢেঁকিশাল, সেখানে লাড়ুকোটা প্রভৃতি উপলক্ষ্যে মেয়েদের কলকোলাহলে তারও অল্প কিছু অংশ ছিল। শ্যাওলায়-সবুজ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা খিড়কির পুকুর, ঘন ছায়ায় স্নিগ্ধ, কোকিল-ঘুঘু-দোয়েল-শ্যামার ডাকে মুখরিত। এইখানে প্রতিদিন সে জলে কেটেছে সাঁতার, নালফুল তুলেছে, ঘাটে বসে দেখেছে খেয়াল, আনমনে একা বসে করেছে পশম সেলাই। ঋতুতে ঋতুতে মাসে মাসে প্রকৃতির উৎসবের সঙ্গে মানুষের এক-একটি পরব বাঁধা; অক্ষয় তৃতীয়া থেকে দোলযাত্রা বাসন্তীপূজো পর্যন্ত কত কী। মানুষে প্রকৃতিতে হাত মিলিয়ে সমস্ত বছরটিকে যেন নানা কারুশিল্পে বুনে তুলছে। সবই যে সুন্দর, সবই যে সুখের তা নয়। মাছের ভাগ, পূজোর পার্বণী, কত্রীর পক্ষপাত, ছেলেদের কলহে স্ব-স্ব ছেলের পক্ষসমর্থন প্রভৃতি নিয়ে নীরবে ঈর্ষা বা তারস্বরে অভিযােগ, কানে কানে পরচর্চা বা মুক্তকণ্ঠে অপবাদঘােষণা এ-সমস্ত প্রচুর পরিমাণেই আছে— সব-চেয়ে আছে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ব্যস্ততার ভিতরে ভিতরে নিয়ত একটা উদ্বেগ— কর্তা কখন কী করে বসেন, তাঁর বৈঠকে কখন কী দুর্যোগ আরম্ভ হয়। যদি আরম্ভ হল তবে দিনের পরে দিন শান্তি নেই। কুমুদিনীর বুক দুর্ দুর্ করে, ঘরে লুকিয়ে মা কাঁদেন, ছেলেদের মুখ শুকনাে। এই সমস্ত শুভে অশুভে সুখে দুঃখে সর্বদা আন্দোলিত প্রকাণ্ড সংসারযাত্রা।
এরই মধ্য থেকে কুমুদিনী এল কলকাতায়। এ যেন মস্ত একটা সমুদ্র কিন্তু কোথায় একফোঁটা পিপাসার জল? দেশে আকাশের বাতাসেরও একটা চেনা চেহারা ছিল। গ্রামের দিগন্তে কোথাও বা ঘন বন, কোথাও বা বালির চর, নদীর জলরেখা, মন্দিরের চূড়ো, শূন্য় বিস্তৃত মাঠ,বুনাে ঝাউয়ের ঝোপ, গুণটানা পথ— এরা নানা রেখায় নানা রঙে বিচিত্র ঘের দিয়ে আকাশকে একটি বিশেষ আকাশ করে তুলেছিল, কুমুদিনীর আপন আকাশ। সূর্যের আলােও ছিল তেমনি বিশেষ আলো। দিঘিতে, শস্যখেতে, বেতের ঝাড়ে, জেলে-নৌকোর খয়েরি রঙের পালে, বাঁশঝাড়ের কচি ডালের চিকন পাতায়, কাঠালগাছের মসৃণ-ঘন সবুজে, ওপারের বালুতটের ফ্যাকাশে হলদেয়— সমস্তর সঙ্গে নানাভাবে মিশিয়ে সেই আলাে একটি চিরপরিচিত রূপ পেয়েছিল। কলকাতার এই সব অপরিচিত বাড়ির ছাদে দেয়ালে কঠিন অনম্র রেখার আঘাতে নানাখানা হয়ে সেই চিরদিনের আকাশ আলাে তাকে বেগানা লােকের মতাে কড়া চোখে দেখে। এখানকার দেবতাও তাকে একঘরে করেছে।
বিপ্রদাস তাকে কেদারার কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কী কুমু, মন কেমন করছে?”
কুমুদিনী হেসে বলে, “না দাদা, একটুও না।”
“যাবি বােন, ম্যুজিয়ম দেখতে?”
“হ্যাঁ, যাব।”
এত বেশি উৎসাহের সঙ্গে বলে যে, বিপ্রদাস যদি পুরুষমানুষ না হত তবে বুঝতে পারত যে এটা স্বাভাবিক নয়। ম্যুজিয়মে না যেতে হলেই সে বাঁচে। বাইরের লােকের ভিড়ের মধ্যে বেরােনাে অভ্যেস নেই বলে জনসমাগমে যেতে তার সংকোচের অন্ত নেই। হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, চোখ চেয়ে ভালাে করে দেখতেই পারে না।
বিপ্রদাস তাকে দাবাখেলা শেখালে। নিজে অসামান্য খেলােয়াড়, কুমুর কাঁচা খেলা নিয়ে তার আমােদ লাগে। শেষকালে নিয়মিত খেলতে খেলতে কুমুর এতটা হাত পাকল যে, বিপ্রদাসকে সাবধানে খেলতে হয়। কলকাতায় কুমুর সমবয়সী মেয়ে-সঙ্গিনী না থাকাতে এই দুই ভাইবােন যেন দুই ভাইয়ের মতাে হয়ে উঠেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে বিপ্রদাসের বড়াে অনুরাগ; কুমু একমনে তার কাছ থেকে ব্যাকরণ শিখেছে। যখন কুমারসম্ভব পড়লে তখন থেকে শিবপূজায় সে শিবকে দেখতে পেলে, সেই মহাতপস্বী যিনি তপস্বিনী উমার পরম তপস্যর ধন। কুমারীর ধ্যানে তার ভাবী পতি পবিত্রতার দৈবজ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে দেখা দিলে।
বিপ্রদাসের ফটোগ্রাফ তােলার শখ, কুমুও তাই শিখে নিলে। ওরা কেউ বা নেয় ছবি, কেউ বা সেটাকে ফুটিয়ে তােলে। বন্দুকে বিপ্রদাসের হাত পাকা। পার্বণ উপলক্ষ্যে দেশে যখন যায়, খিড়কির পুকুরে ডাব, বেলের খােল, আখরােট প্রভৃতি ভাসিয়ে দিয়ে পিস্তল অভ্যাস করে; কুমুকে ডাকে, “আয় না কুমু, দেখ না চেষ্টা করে।”
যে-কোনাে বিষয়েই তার দাদার রুচি সে-সমস্তকেই বহু যত্নে কুমু আপনার করে নিয়েছে। দাদার কাছে এসরাজ শিখে শেষে ওর হাত এমন হল যে, দাদা বলে, “আমি হার মানলুম।”
এমনি করে, শিশুকাল থেকে যে-দাদাকে ও সব চেয়ে বেশি ভক্তি করে, কলকাতায় এসে তাকেই সে সব চেয়ে কাছে পেলে। কলকাতায় আসা সার্থক হল। কুমু স্বভাবতই মনের মধ্যে একলা। পর্বতবাসিনী উমার মতােই ও যেন এক কল্প-তপােবনে বাস করে, মানস-সরােবরের কুলে। এইরকম জন্ম-একলা মানুষদের জন্যে দরকার মুক্ত আকাশ, বিস্তৃত নির্জনতা, এবং তারই মধ্যে এমন একজন কেউ, যাকে নিজের সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভক্তি করতে পারে। নিকটের সংসার থেকে এই দুরবর্তিতা মেয়েদের স্বভাবসিদ্ধ নয় বলে মেয়েরা এটা একেবারেই পছন্দ করে না। তারা এটাকে হয় অহংকার, নয় হৃদয়হীনতা বলে মনে করে। তাই দেশে থাকতেও সঙ্গিনীদের মহলে কুমুদিনীর বন্ধুত্ব জমে ওঠে নি।
পিতা-বর্তমানেই বিপ্রদাসের বিবাহ প্রায় ঠিক, এমন সময় গায়ে হলুদের দুদিন আগেই কনেটি জ্বরবিকারে মারা গেল। তখন ভাটপাড়ায় বিপ্রদাসের কুষ্টিগণনায় বেরোল, বিবাহস্থানীয় দুর্গ্রহের ভোগক্ষয় হতে দেরি আছে। বিবাহ চাপা পড়ল। ইতিমধ্যে ঘটল পিতার মৃত্যু। তার পর থেকে ঘটকালি প্রশ্রয় পাবার মতো অনুকুল সময় বিপ্রদাসের ঘরে এল না। ঘটক একদা মস্ত একটা মোটা পণের আশা দেখালে। তাতে হল উলটো ফল। কম্পিত হস্তে হুঁকোটি দেয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে সেদিন অত্যন্ত দ্রুতপদেই ঘটককে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল।
সুবোধের চিঠি বিলেত থেকে আসত নিয়মমতো। এখন মাঝে মাঝে ফাঁক পড়ে। কুমু ডাকের জন্যে ব্যর্থ হয়ে চেয়ে থাকে। বেহারা এবার চিঠি তারই হাতে দিল। বিপ্রদাস আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছে, কুমু ছুটে গিয়ে বললে, “দাদা, ছোড়দাদার চিঠি।”
দাড়ি-কামানো সেরে কেদারায় বসে বিপ্রদাস একটু যেন ভয়ে ভয়েই চিঠি খুললে। পড়া হয়ে গেলে চিঠিখানা এমন করে হাতে চাপলে যেন সে একটা তীব্র ব্যথা।
কুমুদিনী ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “ছোড়দাদার অসুখ করে নি তো?”
“না, সে ভালােই আছে।”
“চিঠিতে কী লিখেছেন বলো না দাদা।”
“পড়াশুনাের কথা।”
কিছুদিন থেকে বিপ্রদাস কুমুকে সুবােধের চিঠি পড়তে দেয় না। একটু-আধটু পড়ে শােনায়। এবার তাও নয়। চিঠিখানা চেয়ে নিতে কুমুর সাহস হল না, মনটা ছট্ফট্ করতে লাগল।
সুবােধ প্রথম-প্রথম হিসেব করেই খরচ চালাত। বাড়ির দুঃখের কথা তখনও মনে তাজা ছিল। এখন সেটা যতই ছায়ার মতাে হয়ে এসেছে, খরচও ততই চলেছে বেড়ে। বলছে, বড়োকম চালে চলতে না পারলে এখানকার সামাজিক উচ্চশিখরের আবহাওয়ায় পৌঁছানাে যায় না। আর তা না গেলে বিলেতে আসাই ব্যর্থ হয়।
দায়ে পড়ে দুই-একবার বিপ্রদাসকে তার-যােগে অতিরিক্ত টাকা পাঠাতে হয়েছে। এবার দাবি এসেছে হাজার পাউণ্ডের— জরুরি দরকার।
বিপ্রদাস মাথায় হাত দিয়ে বললে, পাব কোথায়। গায়ের রক্ত জল করে কুমুর বিবাহের জন্যে টাকা জমাচ্ছি, শেষে কি সেই টাকায় টান পড়বে? কী হবে সুবােধের ব্যারিস্টার হয়ে, কুমুর ভবিষ্যৎ ফতুর করে যদি তার দাম দিতে হয়?
সে-রাত্রে বিপ্রদাস বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। জানে না, কুমুদিনীর চোখেও ঘুম নেই। এক সময়ে যখন বড়াে অসহ্য হল কুমু ছুটে এসে বিপ্রদাসের হাত ধরে বললে, “সত্যি করে বলো দাদা, ছােড়দাদার কী হয়েছে? পায়ে পড়ি, আমার কাছে লুকিয়ােনা।”
বিপ্রদাস বুঝলে গােপন করতে গেলে কুমুদিনীর আশঙ্কা আরও বেড়ে উঠবে। একটু চুপ করে থেকে বললে, “সুবােধ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে, অত টাকা দেবার শক্তি আমার নেই।”
কুমু বিপ্রদাসের হাত ধরে বললে, “দাদা, একটা কথা বলি, রাগ করবে না বলো।”
“রাগ করবার মতাে কথা হলে রাগ না করে বাঁচব কী করে?”
“না দাদা, ঠাট্টা নয়, শােনো আমার কথা— মায়ের গয়না তাে আমার জন্যে আছে— তাই নিয়ে—”
“চুপ, চুপ, তাের গয়নায় কি আমরা হাত দিতে পারি?”
“আমি তাে পারি।”
“না, তুইও পারিস নে। থাক সে-সব কথা, এখন ঘুমােতে যা।”
কলকাতা শহরের সকাল, কাকের ডাক ও স্ক্যাভেঞ্জারের গাড়ির খড়খড়ানিতে রাত পােয়াল। দূরে কখনাে স্টীমারের, কখনাে তেলের কলের বাঁশি বাজে। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে একজন লােক মই কাঁধে জ্বরারি বটিকার বিজ্ঞাপন খাটিয়ে চলেছে; খালি-গাড়ির দুটো গােরু গাড়ােয়ানের দুই হাতের প্রবল তাড়ার উত্তেজনায় গাড়ি নিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান; কল থেকে জল নেবার প্রতিযােগিতায় এক হিন্দুস্থানি মেয়ের সঙ্গে উড়িয়া ব্রাহ্মণের ঠেলাঠেলি বকাবকি জমেছে। বিপ্রদাস বারান্দায় ব’সে; গুড়গুড়ির নলটা হাতে; মেজেতে পড়ে আছে না-পড়া খবরের কাগজ।
কুমু এসে বললে, “দাদা, ‘না’ ব’লো না।”
“আমার মতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবি তুই? তাের শাসনে রাতকে দিন, না-কে হাঁ করতে হবে?”
“না, শােনাে বলি;—আমার গয়না নিয়ে তােমার ভাবনা ঘুচুক।”
“সাধে তােকে বলি বুড়ী? তাের গয়না নিয়ে আমার ভাবনা ঘুচবে এমন কথা ভাবতে পারলি কোন্ বুদ্ধিতে?”
“সে জানি নে, কিন্তু তােমার এই ভাবনা আমার সয় না।”
“ভেবেই ভাবনা শেষ করতে হয় রে, তাকে ফাঁকি দিয়ে থামাতে গেলে বিপরীত ঘটে। একটু ধৈর্য ধর্, একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
বিপ্রদাস সে-মেলে চিঠিতে লিখলে টাকা পাঠাতে হলে কুমুর পণের সম্বলে হাত দিতে হয়; সে অসম্ভব।
যথাসময়ে উত্তর এল। সুবােধ লিখেছে, কুমুর পণের টাকা সে চায় না। সম্পত্তিতে তার নিজের অর্ধ অংশ বিক্রি করে যেন টাকা পাঠানাে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই পাওআর অফ অ্যাটর্নি পাঠিয়েছে।
এ-চিঠি বিপ্রদাসের বুকে বাণের মতাে বিঁধল। এতবড়ো নিষ্ঠুর চিঠি সুবােধ লিখল কী করে? তখনই বুড়ো দেওয়ানজিকে ডেকে পাঠালে। জিজ্ঞাসা করলে, “ভূষণ রায়রা করিমহাটি তালুক পত্তনি নিতে চেয়েছিল না? কত পণ দেবে?
দেওয়ান বললে, “বিশ হাজার পর্যন্ত উঠতে পারে।”
“ভূষণ রায়কে তলব দিয়ে পাঠাও। কথাবার্তা কইতে চাই।”
বিপ্রদাস বংশের বড় ছেলে। তার জন্মকালে তার পিতামহ এই তালুক স্বতন্ত্র ভাবে তাকেই দান করেছেন। ভূষণ রায় মস্ত মহাজন, বিশ-পঁচিশ লাখ টাকার তেজারতি। জন্মস্থান করিমহাটিতে। এই জন্যে অনেক দিন থেকে নিজের গ্রাম পত্তনি নেবার চেষ্টা। অর্থসংকটে মাঝে মাঝে বিপ্রদাস রাজি হয় আর কি, কিন্তু প্রজারা কেঁদে পড়ে। বলে, ওকে আমরা কিছুতেই জমিদার বলে মানতে পারব না। তাই প্রস্তাবটা বারে বারে যায় ফেঁসে। এবার বিপ্রদাস মন কঠিন করে বসল। নিশ্চয় জানে সুবােধের টাকার দাবি এইখানেই শেষ হবে না। মনে মনে বললে, আমার তালুকের এই সেলামির টাকা রইল সুবােধের জন্যে, তার পর দেখা যাবে।
দেওয়ান বিপ্রদাসের মুখের উপর জবাব দিতে সাহস করলে না।
গােপনে কুমুকে গিয়ে বললে, “দিদি, তােমার কথা বড়োবাবু শােনেন। বারণ করো তাঁকে, এটা অন্যায় হচ্ছে।”
বিপ্রদাসকে বাড়ির সকলেই ভালােবাসে। কারও জন্যে বড়ােরাবু যে নিজের স্বত্ব নষ্ট করবে এ ওদের গায়ে সয় না।
বেলা হয়ে যায়। বিপ্রদাস ওই তালুকের কাগজ পত্র নিয়ে ঘাঁটছে। এখনও স্নানাহার হয় নি। কুমু বারে বারে তাকে ডেকে পাঠাচ্ছে। শুকনাে মুখ করে এক সময়ে অন্দরে এল। যেন বাজে-ছোঁয়া পাতা ঝলসানাে গাছের মতাে। কুমুর বুকে শেল বিঁধল।
স্নানাহার হয়ে গেলে পর বিপ্রদাস আলবােলার নল-হাতে খাটের বিছানায় পা ছড়িয়ে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসল যখন, কুমু তার শিয়রের কাছে বসে ধীরে ধীরে তার চুলের মধ্যে হাত বুলােত বুলােত বললে, “দাদা, তােমার তালুক তুমি পত্তনি দিতে পারবে না।”
“তােকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূতে পেয়েছে নাকি? সব কথাতেই জুলুম?”
“না দাদা, কথা চাপা দিও না।”
তখন বিপ্রদাস আর থাকতে পারলে না, সােজা হয়ে উঠে বসে কুমুকে শিয়রের কাছ থেকে সরিয়ে সামনে বসালে। রুদ্ধ স্বরটাকে পরিষ্কার করবার জন্যে একটুখানি কেশে নিয়ে বললে, “সুবােধ কী লিখেছে জানিস? এই দেখ্।”
এই বলে জামার পকেট থেকে তার চিঠি বের করে কুমুর হাতে দিলে। কুমু সমস্তটা পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বললে, “মাগাে, ছােড়দাদা এমন চিঠিও লিখতে পারলে?”
বিপ্রদাস বললে, “ওর নিজের সম্পত্তি আর আমার সম্পত্তিতে ও যখন আজ ভেদ করে দেখতে পেরেছে, তখন আমার তালুক আমি কি আর আলাদা রাখতে পারি? আজ ওর বাপ নেই, বিপদের সময়ে আমি ওকে দেব না তাে কে দেবে?”
এর উপর কুমু আর কথা কইতে পারলে না, নীরবে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বিপ্রদাস তাকিয়ায় আবার ঠেস দিয়ে চোখ বুজে রইল।
অনেকক্ষণ দাদার পায়ে হাত বুলিয়ে অবশেষে কুমু বললে, “দাদা, মায়ের ধন তাে এখন মায়েরই আছে, তাঁর সেই গয়না থাকতে তুমি কেন—”
বিপ্রদাস আবার চমকে উঠে বসে বললে, “কুমু, এটা তুই কিছুতে বুঝলি নে, তাের গয়না নিয়ে সুবােধ আজ যদি বিলেতে থিয়েটার-কনসার্ট দেখে বেড়াতে পারে তাহলে আমি কি তাকে কোনােদিন ক্ষমা করতে পারব,—না, সে কোনােদিন মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে? তাকে এত শাস্তি কেন দিবি?”
কুমু চুপ করে রইল, কোনাে উপায় সে খুঁজে পেল না। তখন, অনেকবার যেমন ভেবেছে তেমনি করেই ভাবতে লাগল,—অসম্ভব কিছু ঘটে না কি? আকাশের কোনাে গ্রহ, কোনাে নক্ষত্র এক মুহূর্তে সমস্ত বাধা সরিয়ে দিতে পারে না? কিন্তু শুভলক্ষণ দেখা দিয়েছে যে, কিছুদিন থেকে বার বার তার বাঁ চোখ নাচছে। এর পূর্বে জীবনে আরও অনেকবার বাঁ চোখ নেচেছে, তা নিয়ে কিছু ভাববার দরকার হয় নি। এবারে লক্ষণটাকে মনে-মনে ধরে পড়ল। যেন তার প্রতিশ্রুতি তাকে রাখতেই হবে—শুভলক্ষণের সত্যভঙ্গ যেন না হয়।
বাদলা করেছে। বিপ্রদাসের শরীরটা ভালাে নেই। বালাপােশ মুড়ি দিয়ে আধশােওয়া অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছে। কুমুর আদরের বিড়ালটা বালাপােশের একটা ফালতো অংশ দখল করে গােলাকার হয়ে নিদ্রামগ্ন। বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুরটা অগত্যা ওর স্পর্ধা সহ্য করে মনিবের পায়ের কাছে শুয়ে স্বপ্নে এক-এক বার গোঁ গোঁ করে উঠছে।
এমন সময়ে এল আর-এক ঘটক।
“নমস্কার।”
“কে তুমি।”
“আজ্ঞে, কর্তারা আমাকে খুবই চিনতেন, (মিথ্যে কথা) আপনারা তখন শিশু। আমার নাম নীলমণি ঘটক, ৺গঙ্গামণি ঘটকের পুত্র।”
“কী প্রয়ােজন?”
“ভালাে পাত্রের সন্ধান আছে। আপনাদেরই ঘরের উপযুক্ত।”
বিপ্রদাস একটু উঠে বলল। ঘটক রাজাবাহাদুর মধুসূদন ঘােষালের নাম করলে।
বিপ্রদাস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “ছেলে আছে না কি?”
ঘটক জিভ কেটে বললে, “না তিনি বিবাহ করেন নি। প্রচুর ঐশ্বর্য। নিজে কাজ দেখা ছেড়ে দিয়েছেন, এখন সংসার করতে মন দিয়েছেন।”
বিপ্রদাস খানিকক্ষণ বসে গুড়গুড়িতে টান দিতে লাগল। তার পরে হঠাৎ এক সময়ে একটু যেন জোর করে বলে উঠল, “বয়সের মিল আছে এমন মেয়ে আমাদের ঘরে নেই।”
ঘটক ছাড়তে চায় না, বরের ঐশ্বর্যের যে পরিমাণ কত, আর গবর্নরের দরবারে তার আনাগােনার পথ যে কত প্রশস্ত ইনিয়ে-বিনিয়ে তাই ব্যাখ্যা করতে লাগল।
বিপ্রদাস আবার স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। আবার অনাবশ্যক বেগের সঙ্গে বলে উঠল, “বয়সে মিলবে না।”
ঘটক বললে, “ভেবে দেখবেন, দু-চারদিন বাদে আর-এক বার আসব।”
বিপ্রদাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবার শুয়ে পড়ল।
দাদার জন্যে গরম চা নিয়ে কুমু ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। দরজার বাইরে গামছাশুদ্ধ একটা ভিজে জীর্ণ ছাতি ও কাদামাখা তালতলার চটি দেখে থেমে গেল। ওদের কথাবার্তা অনেকখানি কানে পৌঁছল। ঘটক তখন বলছে, “রাজাবাহাদুর এবার বছর না যেতে মহারাজা হবেন এটা একেবারে লাটসাহেবের নিজ মুখের কথা। তাই এতদিন পরে তাঁর ভাবনা ধরেছে, মহারানীর পদ এখন আর খালি রাখা চলবে না। আপনাদের গ্রহাচার্য কিনু ভটচাজ দূরসম্পর্কে আমার সম্বন্ধী, তার কাছে কন্যার কুষ্ঠি দেখা গেল—লক্ষণ ঠিকটি মিলেছে। এই নিয়ে শহরের মেয়ের কুষ্ঠি ঘাঁটতে বাকি রাখি নি—এমন কুষ্ঠি আর-একটিও হাতে পড়ল না। এই দেখে নেবেন, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, এ-সম্বন্ধ হয়েই গেছে, এ প্রজাপতির নির্বন্ধ।
ঠিক এই সময়ে কুমুর আবার বাঁ চোখ নাচল। শুভলক্ষণের কী অপূর্ব রহস্য! কিনু আচার্যি কতবার তার হাত দেখে বলেছে, রাজরানী হবে সে। করকোষ্ঠীর সেই পরিণত ফলটা আপনি যেচে আজ তার কাছে উপস্থিত। ওদের গ্রহাচার্য এই কদিন হল বার্ষিক আদায় করতে কলকাতায় এসেছিল; সে বলে গেছে, এবার আষাঢ় মাস থেকে বৃষরাশির রাজসম্মান, স্ত্রীলোকঘটিত অর্থলাভ, শত্রুনাশ; মন্দের মধ্যে পত্নীপীড়া, এমন কি হয়তো পত্নীবিয়োগ। বিপ্রদাসের বৃষরাশি। মাঝে মাঝে দৈহিক পীড়ার কথা আছে। তারও প্রমাণ হাতে হাতে, কাল রাত থেকে স্পষ্টই সর্দির লক্ষণ। আষাঢ় মাসও পড়ল—পত্নীর পীড়া ও মৃত্যুর কথাটা ভাববার আশু প্রয়োজন নেই, অতএব এবার সময় ভালো।
কুমু দাদার পাশে বসে বললে, “দাদা মাথা ধরেছে কি?”
দাদা বললে, “না।”
“চা তাে ঠাণ্ডা হয়ে যায় নি? তােমার ঘরে লােক দেখে ঢুকতে পারলুম না।”
বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা সব চেয়ে অসহ্য, যখন সে সােনার রথ আনে যার চাকা অচল। দাদার মুখভাবে এই দ্বিধার বেদনা কুমুকে ব্যথা দিলে। দৈবের দানকে কেন দাদা এমন করে সন্দেহ করছেন? বিবাহ-ব্যাপারে নিজের পছন্দ বলে যে একটা উপসর্গ আছে এ চিন্তা কখনো কুমুদিনীর মাথায়। আসে নি। শিশুকাল থেকে পরে পরে সে তার চার দিদির বিয়ে দেখেছে। কুলীনের ঘরে বিয়ে—কুল ছাড়া আর বিশেষ কিছু পছন্দর বিষয় ছিল তাও নয়। ছেলেপুলে নিয়ে তবু তারা সংসার করছে, দিন কেটে যাচ্ছে। যখন দুঃখ পায় বিদ্রোহ করে না; মনে ভাবতেও পারে যে, কিছুতেই এটা ছাড়া আর কিছুই হতে পারত। মা কি ছেলে বেছে নেয়? ছেলেকে মেনে নেয়। কুপুত্রও হয়, সুপুত্রও হয়। স্বামীও তেমনি। বিধাতা তো দোকান খােলেন নি। ভাগ্যের উপর বিচার চলবে কার?
এতদিন পরে কুমুর মন্দভাগ্যের তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে এল রাজপুত্র ছদ্মবেশে। রথচক্রের শব্দ কুমু তার হৃৎস্পন্দনের মধ্যে ওই যে শুনতে পাচ্ছে। বাইরের ছদ্মবেশটা সে যাচাই করে দেখতেই চায় না।
তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়েই সে পাঁজি খুলে দেখলে আজ মনােরথ-দ্বিতীয়া। বাড়িতে কর্মচারীদের মধ্যে যে-কয়জন ব্রাহ্মণ আছে সন্ধ্যাবেলা ডাকিয়ে তাদের ফলার করালে, দক্ষিণাও যথাসাধ্য কিছু দিলে। সবাই আশীর্বাদ করলে, রাজরানী হয়ে থাকো, ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ হােক।
দ্বিতীয়বার বিপ্রদাসের বৈঠকখানায় ঘটকের আগমন। তুড়ি দিয়ে শিব শিব বলে বৃদ্ধ উচ্চস্বরে হাই তুললে। এবারে অসম্মতি দিয়ে কথাটাকে শেষ করে দিতে বিপ্রদাসের সাহস হল না। ভাবলে এতবড়াে দায়িত্ব নিই কী করে? কেমন করে নিশ্চয় জানব কুমুর পক্ষে এ-সম্বন্ধ সব চেয়ে ভালাে নয়? পরশুদিন শেষকথা দেবে বলে ঘটককে বিদায় করে দিলে।
সন্ধ্যার অন্ধকার মেঘের ছায়ায় বৃষ্টির জলে নিবিড়। কুমুর আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই। এক পাশে ছােটো খাট, আলনায় গুটি দুয়েক পাকান শাড়ি আর চাঁপা রঙের গামছা। কোণে কাঁঠাল-কাঠের সিন্ধুক, তার মধ্যে ওর ব্যবহারের কাপড়। খাটের নিচে সবুজ রঙ-করা টিনের বাক্সে পান সাজবার সরঞ্জাম, আর একটা বাক্সে চুল বাঁধবার সামগ্রী। দেয়ালের খাঁজের মধ্যে কাঠের থাকে কিছু বই, দোয়াতকলম, চিঠির কাগজ, মায়ের হাতের পশমে-বােনা বাবার সর্বদা ব্যবহারের চটিজুতাে-জোড়া; শোবার খাটের শিয়রে রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপের পট। দেয়ালের কোণে ঠেসানাে একটা এসরাজ।
ঘরে কুমু আলাে জ্বালায় নি। কাঠের সিন্দুকের উপর বসে জানলার বাইরে চেয়ে আছে। সামনে ইঁটের কলেবরওআলা কলিকাতা, আদিম কালের বর্মকঠিন একটা অতিকায় জন্তুর মতো, জলধারার মধ্য দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার গায়ে গায়ে আলােকশিখার বিন্দু। কুমুর মন তখন ছিল অদৃষ্টনিরূপিত তার ভাবীলােকের মধ্যে। সেখানকার ঘরবাড়ি-লােকজন সবই তার আপন আদর্শে গড়া। তারই মাঝখানে নিজের সতীলক্ষ্মী-রূপের প্রতিষ্ঠা, কত ভক্তি, কত পূজা, কত সেবা। তার নিজের মায়ের পুণ্যচরিতে এক জায়গায় একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। তিনি স্বামীর অপরাধে কিছুকালের জন্যেও ধৈর্য হারিয়েছিলেন। কুমু কখনো সে-ভুল করবে না।
বিপ্রদাসের পায়ের শব্দ শুনে কুমু চমকে উঠল। দাদাকে দেখে বললে, “আলো জ্বেলে দেব কি?”
“না কুমু দরকার নেই” বলে বিপ্রদাস সিন্দুকে তার পাশে এসে বসল। কুমু তাড়াতাড়ি মেজের উপর নেমে বসে আস্তে আস্তে তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
বিপ্রদাস স্নিগ্ধস্বরে বললে, “বৈঠকখানায় লোক এসেছিল তাই তোক ডেকে পাঠাই নি। এতক্ষণ একলা বসে ছিলি?”
কুমু লজ্জিত হয়ে বললে, “না, ক্ষেমা পিসি অনেকক্ষণ ছিলেন।” কথাটা ফিরিয়ে দেবার জন্যে বললে, “বৈঠকখানায় কে এসেছিল, দাদা?”
“সেই কথাই তোকে বলতে এসেছি। এ-বছর জষ্টি মাসে তুই আঠারো পেরিয়ে উনিশে পড়লি, তাই না?”
“হাঁ দাদা, তাতে দোষ হয়েছে কী?”
“দোষের কথা না। আজ নীলমণি ঘটক এসেছিল। লক্ষ্মী বোন, লজ্জা করিস নে। বাবা যখন ছিলেন, তোর বয়স দশ—বিয়ে প্রায় ঠিক হয়েছিল। হয়ে গেলে তোর মতের অপেক্ষা কেউ করত না। আজ তো আমি তা পারি নে। রাজা মধুসূদন ঘোষালের নাম নিশ্চয়ই শুনেছিস। বংশমর্যাদায় ওঁরা খাটো নন। কিন্তু বয়সে তোর সঙ্গে অনেক তফাত। আমি রাজি হতে পারি নি। এখন, তোর মুখের একটা কথা শুনলেই চুকিয়ে দিতে পারি। লজ্জা করিস নে কুমু।”
“না লজ্জা করব না।” বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। “যার কথা বলছ নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ঠিক হয়েই গেছে।” এটা সেই ঘটকের কথার প্রতিধ্বনি—কখন কথাটা এর মনের গভীরতায় আটকা পড়ে গেছে।
বিপ্রদাস আশ্চর্য হয়ে বললে, “কেমন করে ঠিক হল?”
কুমু চুপ করে রইল।
বিপ্রদাস তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, “ছেলেমানুষি করিস নে, কুমু।”
কুমুদিনী বললে, “তুমি বুঝবে না দাদা, একটুও ছেলেমানুষি করছি নে।”
দাদার উপর তার অসীম ভক্তি। কিন্তু দাদা তাে দৈববাণী মানে না, কুমুদিনী জানে এইখানেই দাদার দৃষ্টির ক্ষীণতা।
বিপ্রদাস বললে, “তুই তাে তাঁকে দেখিস নি।”
“তা হােক আমি যে ঠিক জেনেছি।”
বিপ্রদাস ভালাে করেই জানে এই জায়গাতেই ভাইবােনের মধ্যে অসীম প্রভেদ।
কুমুর চিত্তের এই অন্ধকার মহলে ওর উপর দাদার একটুও দখল নেই। তবে বিপ্রদাস আর একবার বললে, “দেখ কুমু, চির জীবনের কথা, ফস করে একটা খেয়ালের মাথায় পণ করে বসিস নে।”
কুমু ব্যাকুল হয়ে বললে, “খেয়াল নয় দাদা, খেয়াল নয়। আমি তােমার এই পা ছুঁয়ে বলছি আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”
বিপ্রদাস চমকে উঠল। যেখানে কার্যকারণের যােগাযােগ নেই সেখানে তর্ক করবে কী নিয়ে? অমাবস্যার সঙ্গে কুস্তি করা চলে না। বিপ্রদাস বুঝেছে কী একটা দৈব-সংকেত কুমু মনের মধ্যে বানিয়ে বসেছে। কথাটা সত্য। আজই সকালে ঠাকুরকে উদ্দেশ করে মনে মনে বলেছিল, এই বেজোড় সংখ্যার ফুলে জোড় মিলিয়ে সবশেষে যেটি বাকি থাকে তার রঙ যদি ঠাকুরের মতাে নীল হয় তবে বুঝব তাঁর ইচ্ছা। সব-শেষের ফুলটি হল নীল অপরাজিতা।
অদূরে মল্লিকদের বাড়িতে সন্ধ্যারতির কাঁসরঘণ্টা বেজে উঠল। কুমু জোড়হাত করে প্রণাম করলে। বিপ্রদাস অনেকক্ষণ রইল বসে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে; বৃষ্টি ধারার বিরাম নেই।
বিপ্রদাস আবও কয়েকবার কুমুদিনীকে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করলে। কুমু কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে আঁচল খুঁটতে লাগল। বিয়ের প্রস্তাব পাকা, কেবল একটা বিষয় নিয়ে দুই পক্ষে কিছু কথাচালাচালি হল। বিয়েটা হবে কোথায়? বিপ্রদাসের ইচ্ছে কলকাতার বাড়িতে। মধুসূদনের একান্ত জেদ নুরনগরে। বরপক্ষের ইচ্ছেই বাহাল রইল।
আয়োজনের জন্যে কিছু আগে থাকতেই নুরনগরে আসতে হল। বৈশেখ-জষ্টির খরার পরে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামলে মাটি যেমন দেখতে দেখতে সবুজ হয়ে আসে, কুমুদিনীর অন্তরে-বাহিরে তেমনি একটা নূতন প্রাণের রং লাগল। আপন-মনগড়া মানুষের সঙ্গে মিলনের আনন্দ ওকে অহরহ পুলকিত করে রাখে। শরৎকালের সোনার আলো ওর সঙ্গে চোখে চোখে কথা কইছে, কোন্ এক অনাদিকালেব মনের কথা। শোবার ঘরের সামনের বারান্দায় কুমু মুড়ি ছড়িয়ে দেয়, পাখিরা এসে এসে খায়; রুটির টুকরো রাখে, কাঠবিড়ালি চঞ্চল চোখে চারিদিকে চেয়ে দ্রুত ছুটে এসে লেজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়; সামনের দুই পায়ে রুটি তুলে ধরে কুটুর কুটুর করে খেতে থাকে। কুমুদিনী আড়াল থেকে আনন্দিত হয়ে বসে দেখে। বিশ্বের প্রতি ওর অন্তর আজ দাক্ষিণ্যে ভরা। বিকেলে গা খোবার সময় খিড়কির পুকুরে গলা ডুবিয়ে চুপ করে বসে থাকে, জল যেন ওর সর্বাঙ্গে আলাপ করে। বিকেলের বাঁকা আলো পুকুরের পশ্চিম- ধারের বাতাবিলেবুগাছের শাখার উপর দিয়ে এসে ঘন কালাে জলের উপরে নিকষে সােনার রেখার মতাে ঝিকিমিকি করতে থাকে; ও চেয়ে চেয়ে দেখে, সেই আলােয় ছায়ায় ওর সমস্ত শরীরের উপর দিয়ে অনির্বচনীয় পুলকের কাঁপন বয়ে যায়। মধ্যাহ্নে বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় একলা গিয়ে বসে থাকে, পাশের জামগাছ থেকে ঘুঘুর ডাক কানে আসে। ওর যৌবন-মন্দিরে আজ যে-দেবতার বরণ হচ্ছে ভাবঘন রসের রূপটি তার, কৃষ্ণরাধিকার যুগলরূপের মাধুর্য তার সঙ্গে মিশেছে। বাড়ির ছাদের উপরে এসরাজটি নিয়ে ধীরে ধীরে বাজায়, ওর দাদার সেই ভূপালী সুরের গানটি:
আজু মাের ঘরে আইল পিয়রওয়া
রােমে রােমে হরখীলা।
রাত্রে বিছানায় বসে প্রণাম করে, সকালে উঠে বিছানায় বসে আবার প্রণাম করে। কাকে করে সেটা স্পষ্ট নয়,—একটি নিরবলম্ব ভক্তির স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস।
কিন্তু মনগড়া প্রতিমার মন্দিরদ্বার চিরদিন তাে রুদ্ধ থাকতে পারে না। কানাকানির নিশ্বাসের তাপে ও বেগে সে-মূর্তির সুষমা যখন ঘা খেতে আরম্ভ করে তখন দেবতার রূপ টিঁকবে কী করে। তখন ভক্তের বড়ো দুঃখের দিন।
একদিন তেলেনিপাড়ার বুড়ী তিনকড়ি এসে কুমুদিনীর মুখের সামনেই বলে বসল, “হ্যাঁ গা, আমাদের কুমুর কপালে কেমন রাজা জুটল? ওই যে বেদেনীদের গান আছে,
এক-যে ছিল কুকুর-চাটা শেয়ালকাঁটার বন,
কেটে করলে সিংহাসন।
এ-ও সেই শেয়ালকাঁটা-বনের রাজা। ওই তাে রজবপুরের আন্দো মুহুরির ছেলে মােধো। দেশে যে-বার আকাল, মগের মুলুক থেকে চাল, আনিয়ে বেচে ওর টাকা। তবু বুড়ী মাকে শেষদিন পর্যন্ত রাঁধিয়ে রাঁধিয়ে হাড় কালি করিয়েছে।”
মেয়েরা উৎসুক হয়ে তিনকড়িকে ধরে বসে; বলে, “বরকে জানতে না কি?”
“জানতুম না? ওর মা যে আমাদের পাড়ার মেয়ে, পুরুত চক্রবর্তীদের ঘরের। (গলা নিচু করে) সত্যি কথা বলি বাছা, ভালাে বামনের ঘরে ওদের বিয়ে চলে না। তা হােক গে, লক্ষ্মী তাে জাতবিচার করেন না।”
পূর্বেই বলেছি কুমুদিনীর মন একালের ছাঁচে নয়। জাতকুলের পবিত্রতা তার কাছে খুব একটা বাস্তব জিনিস। মনটা তাই যতই সংকুচিত হয়ে ওঠে ততই যারা নিন্দে করে তাদের উপর রাগ করে; ঘর থেকে হঠাৎ কেঁদে উঠে ছুটে বাইরে চলে যায়। সবাই গা-টেপাটেপি করে বলে, “ইস, এখনই এত দরদ? এ যে দেখি দক্ষযজ্ঞের সতীকেও ছাড়িয়ে গেল।”
বিপ্রদাসের মনের গতি হাল-আমলের, তবু জাত-কুলের হীনতায় তাকে কাবু করে। তাই, গুজবটা চাপা দেবার অনেক চেষ্টা করলে। কিন্তু ছেঁড়া বালিশে চাপ দিলে তার তুলাে যেমন আরও বেশি বেরিয়ে পড়ে, তেমনি হল।
এদিকে বুড়ো প্রজা দামােদর বিশ্বাসের কাছে খবর পাওয়া গেল যে, বহুপূর্বে ঘােষালেরা নুরনগরের পাশের গ্রাম শেয়াকুলির মালেক ছিল। এখন সেটা চাটুজ্যেদের দখলে। ঠাকুর-বিসর্জনের মামলায় কী করে সবসুদ্ধ ঘােষালদেরও বিসর্জন ঘটেছিল, কী কৌশলে কর্তাবাবুরা, শুধু দেশছাড়া নয়, তাদের সমাজছাড়া করেছিলেন, তার বিবরণ বলতে বলতে দামোদরের মুখ ভক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঘোষালেরা এককালে ধনে মানে কুলে চাটুজ্যেদের সমকক্ষ ছিলেন এটা সুখবর, কিন্তু বিপ্রদাসের মনে ভয় লাগল যে, এই বিয়েটাও সেই পুরাতন মামলার একটা জের না কি?
অঘ্রান মাসে বিয়ে। পঁচিশে আশ্বিন লক্ষ্মীপূজো হয়ে গেল। হঠাৎ সাতাশে আশ্বিনে তাঁবু ও নানাপ্রকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে ঘোষাল-কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওভারসিয়র এসে উপস্থিত, সঙ্গে একদল পশ্চিমি মজুর। ব্যাপারখানা কী? শেয়াকুলিতে ঘোষালদিঘির ধারে তাঁবু গেড়ে বর ও বরযাত্রীরা কিছুদিন আগে থাকতেই সেখানে এসে উঠবেন।
এ কী রকম কথা? বিপ্রদাস বললে, “তাঁরা যতজন খুশি আসুন, যতদিন খুশি থাকুন, আমরাই বন্দোবস্ত করে দেব। তাঁবুর দরকার কী? আমাদের স্বতন্ত্র বাড়ি আছে, সেটা খালি করে দিচ্ছি।”
ওভারসিয়র বললে, “রাজাবাহাদুরের হুকুম। দিঘির চারিধারের বনজঙ্গলও সাফ করে দিতে বলেছেন,—আপনি জমিদার, অনুমতি চাই।”
বিপ্রদাস মুখ লাল করে বললে, “এটা কি উচিত হচ্ছে? জঙ্গল তো আমবাই সাফ করে দিতে পারি।”
ওভারসিয়র বিনীতভাবে উত্তর করলে, “ওইখানেই রাজাবাহাদুরের পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি, তাই শখ হয়েছে নিজেই ওটা পরিষ্কার করে নেবেন।”
কথাটা নিতান্ত অসংগত নয়, কিন্তু আত্মীয়স্বজনেরা খুঁত খুঁত করতে লাগল। প্রজারা বলে, এটা আমাদের কর্তাবাবুদের উপর টেক্কা দেবার চেষ্টা। হঠাৎ তবিল ফেঁপে উঠেছে, সেটা ঢাকা দিতে পারছে না; সেটাকে জয়ঢাক করে তোলবার জন্যেই না এই কাণ্ড? সাবেক আমল হলে বরসুদ্ধ বরসজ্জা বৈতরণী পার করতে দেরি হত না। ছোটোবাবু থাকলে তিনিও সইতেন না, দেখা যেত ওই বাবুগুলো আর তাঁবুগুলো থাকত কোথায়।
প্রজারা এসে বিপ্রদাসকে বললে, “হুজুর ওদের কাছে হটতে পারব না। যা খরচ লাগে আমরাই দেব।”
ছয়-আনার কর্তা নবগোপাল এসে বললে, “বংশের অমর্যাদা সওয়া যায় না। একদিন আমাদের কর্তারা ওই ঘোষালদের হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লাগিয়েছেন, আজ তারা আমাদেরই এলাকার উপর চড়াও হয়ে টাকার ঝলক মারতে এসেছে। ভয় নেই দাদা, খরচ যা লাগে আমরাও আছি। বিষয় ভাগ হোক বংশের মান তো ভাগ হয়ে যায় নি।”
এই বলে নবগোপালই ঠেলেঠুলে কর্মকর্তা হয়ে বসল।
বিপ্রদাস কয়দিন কুমুর কাছে যেতে পারে নি। তার মুখের দিকে তাকাবে কী করে? কুমুর কাছে বরপক্ষের স্পর্ধার কথা কেউ যে গলা খাটো করে বলবে সমাজে সে-দয়া বা ভদ্রতা নেই। তারই কাছে সবাই বাড়িয়ে-বাড়িয়ে বলে। মেয়েদের রাগ তারই ’পরে। ওরই জন্যে পূর্বপুরুষের মাথা যে হেঁট হল। রাজরানী হতে চলেছেন! কীযে রাজার ছিরি!
জাতকুলের কথাটাকে কুমু তার ভক্তি দিয়ে চাপা দিয়েছিল। কিন্তু ধনের বড়াই করে শ্বশুরকুলকে খাটো করার নীচতা দেখে তার মন বিষাদে ভরে উঠল। কেবলই লোকের কাছ থেকে সে পালিয়ে বেড়ায়। ঘোষালদের লজ্জায় আজ যে ওরই লজ্জা। দাদার মুখ থেকে কিছু শোনবার জন্যে মনটা ছটফট করছে। কিন্তু দাদার দেখা নেই, অন্দরমহলে খেতেও আসে না।
একদিন বিপ্রদাস অন্তঃপুরের বাগানে ভিয়েনঘরের জন্যে চালা বাঁধবার জায়গা ঠিক করতে গিয়ে হঠাৎ খিড়কির পুকুরের ঘাটে দেখে কুমু নিচের পৈঠের উপর বসে মাথা হেঁট করে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদাকে দেখে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে এল। এসেই রুদ্ধস্বরে বললে, “দাদা, কিছুই বুঝতে পারছি নে।” বলেই মুখে কাপড় দিয়ে কেঁদে উঠল।
দাদা ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলিয়ে বললে, “লোকের কথায় কান দিস নে বোন।”
“কিন্তু ওঁরা এ-সব কী করছেন? এতে কি তোমাদের মান থাকবে?”
ওদের দিকটাও ভেবে দেখিস। পূর্বপুরুষের জন্মস্থানে আসছে, ধুমধাম করবে না? বিয়ের ব্যাপার থেকে এটাকে স্বতন্ত্র করে দেখিস।”
কুমু চুপ করে রইল। বিপ্রদাস থাকতে পারলে না, মরিয়া হয়ে বললে, “তোর মনে যদি একটুও খটকা থাকে বিয়ে এখনও ভেঙে দিতে পারি।”
কুমুদিনী সবেগে মাথা নেড়ে বললে, “ছি ছি, সে কি হয়?”
অন্তর্যামীর সামনে সত্যগ্রন্থিতে তো গাঁঠ পড়ে গেছে। বাকি যেটুকু সে তো বাইরের।
বিপ্রদাসের একেলে মন এতটা নিষ্ঠায় অধৈর্য হয়ে ওঠে। সে বললে, “দুই পক্ষের সততায় তবেই বিবাহ-বন্ধন সত্য। সুরে-বাঁধা এসরাজের কোনো মানেই থাকে না যদি বাজাবার হাতটা হয় বেসুরো। পুরাণে দেখ না, যেমন সীতা তেমনি রাম, যেমন মহাদেব তেমনি সতী, অরুন্ধতী যেমন বশিষ্ঠও তেমনি। হাল-আমলের বাবুদের নিজেদের মধ্যে নেই পুণ্য তাই একতরফা সতীত্ব প্রচার করেন। তাঁদের তরফে তেল জোটে না সলতেকে বলেন জ্বলতে—শুকনো প্রাণে জ্বলতে জ্বলতেই ওরা গেল ছাই হয়ে।”
কুমুকে বলা মিথ্যে। এখন থেকে ও মনে মনে জোরের সঙ্গে জপতে লাগল, তিনি ভালােই হন, মন্দই হন তিনি আমার পরম গতি।
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ
বীতরাগভয়ক্রোধঃ—
শুধু যতিধর্মের নয়, সতীধর্মেরও এই লক্ষণ। সে ধর্ম সুখদুঃখের অতীত,—তাতে ক্রোধ নেই, ভয় নেই। আর অনুরাগ? তারই বা অত্যাবশ্যকতা কিসের। অনুরাগে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব থাকে, ভক্তি তারও বড়ো। তাতে আবেদন নেই নিবেদন আছে। সতীধর্ম নির্ব্যক্তিক, যাকে ইংরেজিতে বলে ইম্পার্সোনাল। মধুসূদন-ব্যক্তিটিতে দোষ থাকতে পারে, কিন্তু স্বামী নামক ভাব পদার্থটি নির্বিকার নিরঞ্জন। সেই ব্যক্তিকতাহীন ধ্যানরূপের কাছে কুমুদিনী একমনা হয়ে নিজেকে সমর্পণ করে দিলে।
ঘােষালদিঘির ধারে জঙ্গল সাফ হয়ে গেল,—চেনা যায় না। জমি নিখুঁতভাবে সমতল, মাঝে মাঝে সুরকি দিয়ে রাঙানাে রাস্তা, রাস্তার ধারে ধারে আলাে দেবার থাম। দিঘির পানা সব তােলা হয়েছে। ঘাটের কাছে তকতকে নতুন বিলিতি পাল-খেলাবার দুটি নৌকা; তাদের একটির গায়ে লেখা “মধুমতী”, আর-একটির গায়ে “মধুকরী”। যে-তাঁবুতে রাজাবাহাদুব স্বয়ং থাকবেন তার সামনে ফ্রেমে হলদে বনাতের উপর লাল রেশমে বােনা “মধুচক্র”। একটা তাঁবু অন্তঃপুরের, সেখান থেকে জল পর্যন্ত চাটাই দিয়ে ঘেরা ঘাট। ঘাটের উপরেই মস্ত নিমগাছের গায়ে কাঠের ফলকে লেখা “মধুসাগর”। খানিকটা জমিতে নানা আকারের চানকায় সূর্যমুখী রজনীগন্ধা, গাঁদা দোপাটি, ক্যানা ও পাতাবাহার, কাঠের চৌকো বাক্সে নানা রঙের বিলিতি ফুল। মাঝে একটি ছােটো বাঁধানাে জলাশয়, তারই মধ্যে লােহার ঢালাই-করা নগ্ন স্ত্রীমূর্তি, মুখে শাঁখ তুলে ধরেছে, তার থেকে ফোয়ারার জল বেরােবে। এই জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছে “মধুকুঞ্জ”। প্রবেশপথে কারুকাজকরা লােহার গেট, উপরে নিশান উড়ছে—নিশানে লেখা “মধুপুরী”। চারদিকেই “মধু” নামের ছাপ। নানা রঙের কাপড়ে কানাতে চাঁদোয়ায় নিশানে রঙিন ফুলে চীনালণ্ঠনে হঠাৎ-তৈরি এই মায়াপুরী দেখবার জন্যে দূর থেকে দলে দলে লােক আসতে লাগল। এদিকে ঝক্ঝকে চাপরাস-ঝােলানাে হলদের উপর লালপাড় দেওয়া পাগড়ি-বাঁধা, জরির ফিতে-দেওয়া লাল বনাতের উর্দিপরা চাপরাসির দল বিলিতি জুতাে মস্মসিয়ে বেড়ায়, সন্ধ্যাবেলায় বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ করে, দিনরাত প্রহরে প্রহরে ঘণ্টা বাজায়, তাদের কারও কারও চামড়ার কোমরবন্ধে ঝােলানাে বিলিতি তলােয়ারটা জমিদারের মাটিকে পায়ে পায়ে খোঁচা দিতে থাকে। চাটুজ্যেদের সাবেক কালের জীর্ণসাজপরা ববকন্দাজেরা লজ্জায় ঘর হতে বার হতে চায় না। কাণ্ড দেখে চাটুজ্যে-পরিবারের গায়ের জ্বালা ধরল। নুরনগরের পাঁজরটার মধ্যে বিঁধিয়ে দিয়ে শেলদণ্ডের উপর আজ ঘােষালদের জয়পতাকা উড়েছে।
শুভপরিণয়ের এই সূচনা।