Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu

মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu

উপন্যাস কী এই নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। এমন নয় যে আমরা সব লেখক বা অধ্যাপক বা সমালোচক, বা সাহিত্যের হালচাল এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত উদ্বিগ্ন সৎ-পাঠক। আসলে আমরা কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের বন্ধু যারা মহা আড্ডাবাজ। এখন আড্ডার অধিকার সাধারণত পুরুষদেরই একচেটিয়া বলে মনে করা হয়। শুধু একচেটিয়া নয়, শুধু অধিকার নয় মনে করা হয় এবং ঠিকই মনে করা হয় এই আড্ডার একটা আলাদা তাৎপর্য একটা আলাদা স্বাদ আছে। ডমরুধর মহাশয়ের সেই সব আড্ডার কথা মনে করুন যাতে গুল, ধাপ্পা, কেচ্ছা, ভূত-প্রেত, গোলেবকাওলি, রূপকথা সবই চলত, অথবা পরশুরামের সেই আড্ডা যেখানে চাটুজ্জেমশাই জাঁকিয়ে বসতেন আর রায়বাহাদুর বংশলোচনের তামাক ধ্বংস করতেন, এঁদেরও লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সুরসাল বিনিময়, সঙ্গে সঙ্গে ‘ভুটে’ নামে পাঁঠা ক’সের মাংসের জোগানদার হয়ে উঠছে, সুযোগ পেলে ভুটেকে টিপে-টুপে নইলে স্রেফ শ্যেন দৃষ্টি ফেলে জরিপ করে নেওয়া। এ ছাড়াও ক্রিয়েটিভ আড্ডা আছে, লেখক সাহিত্যিকদের আড্ডা, বড় বড় ইনটেলেকচুয়ালদের আড্ডা, তাদের জাতই আলাদা। এই সব আড্ডা বলাবাহুল্য নারীবিবর্জিত , ‘পথে নারী বিবর্জিতা’ না বলে ‘আড্ডায় নারী বিবর্জিতা’ বলে কোনও মহাজনবাক্য থাকলে তার উদাহরণ হয়ে থাকত আড্ডার এই নারীহীনতা। মেয়েরা থাকলে আড্ডার প্রধান যে মজা— কাঁচা রগরগে ভাষা, তার চেয়েও রগরগে তামাশা এ-সব সেঁতিয়ে যায়, মেয়েরা জোরজার করে উপস্থিত থাকলেও গোলমালে পড়ে যাবেন, না পারবেন হাসতে, না পারবেন কাশতে। এ ছাড়াও অবশ্য এক ধরনের আড্ডা আছে মিক্সড্‌ ডাব্‌ল্‌স্‌-এর মতো। জোড়ায় জোড়ায় দম্পতি একটি দুটি ব্যাচেলরও থাকতে পারেন— এঁরা দিন ঠিক করে গল্প-সল্প করেন। এর মধ্যে একটা অন্তঃস্রোতা আদিরস থাকে, কথাবার্তাও একটু ফষ্টিনষ্টির ধার ঘেঁষে যায়। এই মিক্সড্‌ ডাব্‌ল্‌স্ আড্ডা এখনও সাবালকতা অর্জন করেনি। যাই বলুন আর তাই বলুন। অল্পবয়সী ছাত্র-ছাত্রী ক্যাডারদের যারা কফি হাউজে জাঁকিয়ে বসে এবং যাদের রেঞ্জ অলোকরঞ্জনের গদ্য থেকে ইয়ানি ইন তাজমহল, জাক দেরিদা থেকে চার্লস শোভরাজ, ফুলন দেবী থেকে জ্যাকলিন কেনেডি ওনাসিস পর্যন্ত, তাদের মধ্যেও কিন্তু একটা এগজিবিশনিজ্‌ম্‌-এর প্রেতচ্ছায়া থাকে, যত প্রাণ থাকে তত রস থাকে না। যত উচ্ছ্বাস তত শাঁস থাকে না। জেনুইন আজ্ঞা জীবনের পরিপূরক। জেনুইন আড্ডা থেকে বেশ ঋদ্ধ হয়ে বাড়ি ফেরা যায়। কাথারসিসের মতো একটা বর্জন-প্রক্রিয়া থাকে এতে। আত্মমোচন বা আত্মমোক্ষণ। অসমোসিসের মতো একটা গ্রহণ প্রক্রিয়াও থাকে যাতে করে শেষ পর্যন্ত প্রাতিস্বিকতা বজায় রেখেও বেশ যূথবদ্ধ হওয়া যায়।

আমার বলার কথা, মেয়েদের মধ্যেও ঠিক এই জাতের আড্ডা আছে। চিরকালই ছিল। গাব্বু বা বিন্তি খেলা উপলক্ষ্য করে, বাড়ির ছেলে বা মেয়ের বিয়ে, শাদি উপলক্ষ করে এই ধরনের পুংবর্জিত মেয়েলি আড্ডা জমে উঠত, যেগুলোকে মেয়েদের ব্যাপার বা বড়জোর মহিলামহল— কুরুশ-কাঠি-গয়না-বড়ি-রান্নাবান্না-সাজগোজ আর গা-টেপাটেপি কেচ্ছার আসর বলে উন্নাসিক আড্ডাবাজরা (পুং) জাতে ঠেলে রেখেছেন। এর কিছু আসলের-চেয়েও-আসল-শুনতে উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘ইন্দিরায়’ বিশেষ করে দিয়েছেন। তার থেকেই আপনারা জানেন মেয়েদের আড্ডাও কী পরিমাণে ‘কাঁচা’ অর্থাৎ হাস্য-উদ্ভট-আদি (অশ্লীল) রসের আধার হতে পারে। তবু, এই মেয়েলি আড্ডার কথা আপনারা মোটেই জানেন না। অবহেলার আড়ালে আবডালে এ আড্ডার বিবর্তনের এবং বর্তমান চেহারার কথাও আপনাদের জানা নয়। এ আড্ডা পুরুষবর্জিত এবং কোনও কারণে কোনও পুরুষের প্রবেশ ঘটলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আড্ডাংশীদের কথাবার্তা দেহভঙ্গি ইত্যাদির একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়, ফলে আপনারা সেই তিমিরেই থেকে যান যে তিমিরে অদ্যাবধি ছিলেন।

আমাদের আড্ডা ডমরুধর বা পরশুরাম বা লেখক-সাহিত্যিক-সম্পাদক বা কমলকুমার-সত্যজিৎ-বংশী চন্দ্রগুপ্ত আড্ডার প্রতিস্পর্ধী এমন দাবি আমরা কেউই করি না। আমাদের আড্ডা ঠিক আমাদের আড্ডারই মতো। নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা রসে বশে আছি। উপরন্তু আমাদের আড্ডা ফোনেও চলে।

মালবিকাদি আমাদের, কখনও রসা কখনও খাজা কাঁঠাল, চিবিয়ে চিবিয়ে রস বার করতে হয় কখনও, আবার কখনও সুড়ুৎ করে এমন গলা গলে যায় যে কখন টের পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সুমিতা আছে ধানি লংকা। কাজলরেখা মিত্তিরকে বলা হয় সাড়ে বত্রিশ ভাজা। আমাকে ওরা ওদের মুড অনুযায়ী কখনও বলে ঝুনো নারকেল কখনও বলে ‘চাই কচি ডাব’। মোট কথাটা একই বাইরে ঢাকাঢুকি, ফাটালেই টইটম্বুর। আর শিল্পী যে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে ছোট এবং চেহারায় লম্বা তাকে আমরা সাধারণত বলে থাকি ‘যার-পর-নাই’— কেন সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। আরও একজন আজকাল থাকছে তার নাম শেফালি। সে আমার কম্বাইন্ড হ্যান্ড।

উপন্যাস কী এই নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। একমাত্র আমিই এখানে একটু-আধটু লিখি এবং সেই সুবাদে কিছু প্রতিষ্ঠিত লেখিকা যেমন কণা বসুমিশ্র, কৃষ্ণা বসু (কবি), মল্লিকা সেনগুপ্ত, অনীতা অগ্নিহোত্রী— এঁদের সঙ্গে আলাপ-সালাপ আছে। সুমিতা একটি কলেজের সাইকলজির অধ্যাপিকা। তার অবশ্য প্রচুর চেনাশোনা— গীতা ঘটক, সুমন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গায়ক, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার, মমতাশংকর প্রমুখ নৃত্যশিল্পী, পার্থ-গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ-ঊর্মিমালা বসু প্রমুখ শ্রুতিশিল্পী, শানু লাহিড়ি, দীপালি ভট্টাচার্য প্রমুখ চিত্রশিল্পী— এঁদের সঙ্গে নাকি ওর ওঠা বসা। এঁদের ও দিদি দাদা বলে। মালবিকার একটি নারীসমিতি আছে, সেই সুবাদে যখন তখন সে প্রদর্শনী করে, উচ্চমূল্যে মেয়েদের নানা রকম হাতের কাজ বিক্রি করে সে নিজের এবং তার সমিতির নারীদের জন্য প্রচুর পয়সা কামায়। বৃহত্তর কলকাতার কোনও কোণে এমন কোনও পয়সা-অলা নারী নেই যে মালবিকাদির ফাঁদে না পড়েছে। আড্ডার বাইরে মালবিকাদি একরকমের পৌরাণিক সাপ, তার শর্মিলি হাসি, প্রচুর বয়-ছাঁট নুন-মরিচ চুল, চোখা নাক এবং চোখাতর কলাকৌশল ঠিক মন্ত্রমুগ্ধ হরিণের মতোই তার খরিদ্দারদের কাছে টেনে আনে, তারপর মালবিকাদি তাকে টপ করে গিলে ফেলে। যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা। অর্থাৎ যে কাস্টমার গ্রীষ্মে মলমলের ছাপা নিয়ে গেছে সে শীতে আবার সিল্কের ছাপের জন্য ফিরে আসবে। বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে পরবার জন্যে মধ্যবয়স্কার দুধ গরদের ওপর সোনালি খাড়ি ও বাদলার কাজ, গরমের দিনে অন্নপ্রাশনে পরবার জন্য সাউথ কটনের ওপর তাঁত প্রিন্ট, জন্মদিনের পার্টিতে যাবার জন্যে গর্জাস কালো শিফনের সালোয়ার-কুর্তা-এ সবের জন্যে এঁরা মালবিকা সান্যাল ছাড়া কোথাও যাবেন না। বাকি দুজন অর্থাৎ কাজলরেখা মিত্তির এবং শিল্পী বরাট বিশুদ্ধ গৃহবধূ। তবে অদূর ভবিষ্যতে গৃহবধূদের অ্যালাউয়েন্স পাশ হবার অনেক আগেই এদের স্বামীরা এদের নানা রকম অ্যালাউয়েন্স দিয়ে রেখেছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে যদিও বাধ্য হওয়ার ব্যাপারটা তারা আদৌ বুঝতে পেরেছে কি না সন্দেহ।

অর্থাৎ উপন্যাস, শিল্পের সঙ্গে আমরা কেউই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নই। তবু যেহেতু উপন্যাস পড়ে থাকি, সেহেতু অধিকারের তোয়াক্কা না করেই এ বিষয়ে মতামত আদান-প্রদান করতে আমরা ছাড়ি না।

দিনটা ছিল শুককুরবার। বেস্পতিবার রাত্তিরে সুমিতা আমায় ফোন করে, ফোন ধরে হ্যালো বলতেই খরখর করে উঠল— ‘কী রে? বাটা মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খাচ্ছিলি?’

‘খাচ্ছিলুম ঠিকই। কিন্তু বাটা মাছের ঝাল এবং ভাত এই কংক্লুশনে কী করে এলি?’

‘ভাত খাওয়ার সময়ে একটা ভ্যাদভেদে গলা বেরোয়, তোর সেটা বেরোচ্ছে। দাঁতের ফাঁকে একটা কুচো কাঁটা আটকেছে, যা একমাত্র বাটাতেই সম্ভব, তাতে তুই ফোকলার মতো ফকফক করছিস। অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট মাই ডিয়ার ওয়াটসন।’

আমি বলি— ‘কংগ্র্যাটস হোম্‌স্‌ ফর রং ইনফারেন্স। আজকে আমার উপোস।’

‘এই যে বললি খাচ্ছিলি? ধাপায় শীগগিরই পা রাখবি মনে হচ্ছে!’

‘আজ বেরস্পতিবার সে খেয়াল আছে? চৈতলক্ষ্মীর পুজো সেরে এই মিনিট দশ উঠছি। পেসাদ খাচ্ছি।’

‘তুই আজকাল লক্ষ্মীপুজা করবার ধইচ্‌ছিস? মুই ভাবিছু মোর রঞ্জু দিদির সরস্বতীক পুজা করা নাগে।’

‘আরে বাবা, লক্ষ্মী সরস্বতীর পুরনো ঝগড়াটা অনেকটা মিটে এসেছে।’

‘তা সত্ত্বেও উপোসটা বিশ্বাস করলুম না। পেসাদ না আরও কিছু। লক্ষ্মীপুজোয় বেশ ভালই সাঁটানোর ব্যবস্থা আছে। লুচি-ফুচি।’

আমি বলি— ‘ফুচি একদম বলবি না। আমার শাশুড়ির নাম। তিনি স্বর্গে গিয়ে থাকতে পারেন কিন্তু তাঁর নামের কোনও অপমান আমি হতে দেব না। তবে তুই ধইচ্‌ছিস ঠিকই। নুচির ব্যবস্থা আছে। সাঁটানোও হয়ে গেছে। ওটাই তো পেসাদ। তবে দ্যাখ এই চোত মাসের জ্বলি-জ্বলি গরমে ভাত বন্ধ মানেই উপবাস। জানিস তো উপবাস-এর আসল মানে সংযম। ভেতোর কাছে ভাত না খাওয়াটাই একটা মস্ত সংযম।’

‘এটাও বাজে কথা বল্লি, মানে ধাপে পা। লক্ষ্মী পুজো নিজে করতে না পারি কিন্তু পুজোর সকালে যে নৈবিদ্যির চাল ভাতে-ভাত করে গাওয়া ঘি দিয়ে খাওয়া হয় এ কথা আমার জানা আছে।’

‘সে তো সকালে। রাত্তিরে দ্যাখ নুচি। নুচি হল গিয়ে জলখাবার।’

‘শোন ভাতাহারী, বাজে কথা রাখ, কাল আমার নতুন অফ ডে, তোর বাড়িতে মেলাদ হবে, নামাজ করতে যাব।’

‘খুব বাংলাদেশি উপন্যাস পড়ছিস মনে হচ্ছে?’

‘পড়ছি-ই তো। ওদের সব হাতে-গরম পাতে-গরম। এক বার ব্যানটা উঠে গেলেই আর তরা হালে পানি পাইচ্‌ছিস না। ঢাকাই-চাটগাঁই-সিলেটি-আরবি-ফারসি মিলিয়ে ভাষাডা এক্কেরে ভোল পাল্টাইয়া ফ্যালাইসে।’

আমার প্রান্তে অতঃপর নীরবতা। ওদিক থেকে আবার প্রশ্ন এল— ‘কী রে? কিছু-কিঞ্চিৎ বুঝলা? লিটর‍্যালি হতবাক কইর‍্যা থুইসি তয়!’

এতক্ষণে ক্ষীণ কণ্ঠে বলি— ‘ব্যাবাক।’

‘গুড, চটপট লেসন নিয়ে নিতে পারিস। এই গুণেই ভবসাগর তরে যাবি।’

‘খাস বাত কুছ হ্যায়?’ —আমি জিজ্ঞাসা করি।

‘শিল্পী ফিরেছে ব্যাংকো থেকে। ওকে নিয়েই যাচ্ছি। তোর জন্য পেপার ওয়েট এনেছে। ট্রান্সপেরেন্ট। ভেতরে চাকা চাকা হাসি-হাসি খোকা খুকু মুখ ভেসে বেড়াচ্ছে। যেই লিখতে না পেরে মন-খারাপ হবে অমনি পেপার ওয়েটটা দেখবি আর মন ভাল হয়ে যাবে।’

‘আর তোর জন্যে?’

‘বলব কেন?’

‘নিশ্চয়ই আরও ভালও। আরও দামি কিছু’…

‘হিঁসকুটেপনা করিস না।’ —বলে সুমিতা ওর জন্যে শিল্পী কী এনেছে না বলেই কটাং করে ফোন রেখে দিল।

আমিও কাজলকে ফোন করে দিই। সুমিতাকে সামলানো আমার একার কম্মো নয়। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আবার আছে ব্যাংকক-ফেরত শিল্পী।

শিল্পী আমি কাজল সুমিতা। এ কী? চারজন হয়ে গেল যে? এ তো দেখছি শিল্পীতে-আমাতে কাজল-সুমিতাতে লেডিজ ডাবলস হয়ে যাবে! সার্ভিসের সময়ে কর্নার টু কর্নার হবে ঠিকই। কিন্তু পরবর্তী খেলাটাতে শিল্পী-আমি কাজল-সুমিতা এমন আলাদা হয়ে যাব যেন দুটো সিংগলস হচ্ছে। এক দিকে মেরি পেয়ার্স-এর সঙ্গে ইয়ানা নোভোৎনা, আর এক দিকে সাবাতিনির সঙ্গে সানচেজ ভিকারিও। নাকটা ঠিকঠাক গলাবার জন্যে একজন পঞ্চমী চাই। মালবিকাদিকে ফোন করলুম— নামটা করবার একটু পরেই টেলিফোনটা কোঁ কোঁ করতে লাগল। এ আবার কী ঢং? সম্প্রতি মালবিকা সান্যালের ফোনে মুরগি ছানা ঢুকেছে। এই মুরগিকে পবিত্র কুরবানি করবার জন্যে আমার হাত নিশপিশ করতে লাগল। কিন্তু সাড়ে ন’টা বাজে, এখন তো আর কমপ্লেন সেল চালু নেই!

কাজলকেই আবার ফোন করলুম, মালবিকাদির মহিলা-সমিতি কাজলদের বাড়ির খুব কাছে, ওখান থেকেই ধরে আনবে এখন। মহিলা-সমিতিতে সারা বছর মহিলা কুটোটি নাড়ে না। খালি অর্ডার ধরাবার সময়ে আর বিক্রির সময়ে দেখা যায় ওর খেল। আড্ডার গন্ধ পেলেই ঠিক চলে আসবে। ‘আবার কী?’ কাজল খেকিয়ে উঠল, ‘এই তো এক ঘণ্টা ধরে ফোন করলি শিল্পী তোর জন্যে কম দামের, সুমিতার জন্যে বেশি দামের গিফ্‌ট্‌ এনেছে বলে নাকি কান্না কাঁদলি—।’ এ সব একদম ঝুট। এক ঘণ্টা কেন আমি দশ মিনিট ধরেও ফোন করিনি। করব কেন? বিল তো আমারই উঠবে? আর শিল্পীর গিফ্‌ট্‌ আসছে বলে আনন্দ করেছি, নাকি-কান্না মোটেই কাঁদিনি। আমি যা করেছি তাকে বলে স্টেটমেন্ট অফ ফ্যাক্ট। বলেছি ‘শিল্পী আমার জন্যে পেপার-ওয়েট এনেছে। সুমিতার জন্যে কী এনেছে কিছুতেই বলল না।’

সুতরাং ফোনযন্ত্রের মধ্যে আমিও ডবল খেঁকিয়ে উঠি— ‘কেন তোর অসুবিধে কী? ছেলে-মেয়ের পড়া অনেক দিন ধরেই ধরতে পারিস না। অধ্যাপক মশাই আপনভোলা মানুষ— সাপ খেতে দিলি কি ব্যাঙ খেতে দিলি বুঝতেও পারবেন না। তা ছাড়া ফোনটা করেছি আমি ; তোর তো আর…’

‘হ্যাঁ, আপনভোলা মানুষ! ঘর করতে হলে বুঝতে পারতে তার হ্যাঁপা কত! রাত্তিরেই জুতোর জোড়া মিলিয়ে রাখতে হয় তা জানো? নইলে এক পায়ে মোকাসিন এক পায়ে পাম্প পরে হাঁটা দেবে। পাঞ্জাবি-ধুতির সঙ্গে গেঞ্জি সাঁটিয়ে রাখতে হয়, নইলে গেঞ্জি ছাড়াই চলে যাবে আর পাতলা আদ্দির পাঞ্জাবির মধ্যে দিয়ে— ম্যাগো। ছি ছি!’

কাজল এমন করে উঠল যেন ওর বর বর নয়। বরনারী।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেক কাজ তোর, জানি। গেঞ্জি রাখবি, পাঞ্জাবি রাখবি, ধুতি রাখবি না হলে তোর আপনভোলা হয়তো ধুতি পরতেও…’

‘ঠিকাছে, ঠিকাছে আমার বর ভুলো, বোম্‌ভোলা, পাগল, তার পেছনে কুকুর চেঁচালে তোরা খুশি হোস, আমি…’

‘আমি তোমার সঙ্গে গপ্পো ফাঁদতে বসিনি বাবা। আমার অনেক কাজ। মালবিকাদিকে কাল মহিলাসমিতি থেকে তুলে নিয়ে এসো। ফোনে পাচ্ছি না। এটাই বলার ছিল।’ ‘কেন? আবার মালবিকা সান্যাল কেন? শুধু কাজলিকাতে হবে না? মালবিকাদি শেষে আবার ওর সমিতির জন্যে চাঁদা তুলবে। আমার ভাই টিনের বাক্সে রেস্ত কম। সব লক্ষ্মীর হাঁড়িতে ফেলে দিয়েছি।’

‘সেই জন্যেই চারদিকে এত রেজগির হাহাকার, বুঝেছি। তবে মালবিকাদির চাঁদা তোলা ছাড়াও আরও গুণ আছে।’

‘কী গুণ? বেগুন? না গুনিনের তুকতাক।’

‘ওই হল, স্টকে প্রচুর গপ্পো।’

‘তোর কি রাজকন্যা কম পড়িয়াছে?’

‘আমার তো সব সময়েই কম পড়ে যাচ্ছে। যত ডিমান্ড তত সাপ্লাই নেই।’

‘তো দেখি।’

কাজলা আমাকে আশ্বস্ত করে বোধ হয় বরের তত্ত্ব গোছাতে গেল।

ফোন থেকে মুখ তুলে দেখি জানলার ফ্রেমে লাল আকাশ। রাতের রং। আর ঝড়ের রং মিলে টকটকে লাল। রাগী বাইসনের কুচি চোখের মতো। এই রে, কোথাও থেকে এটা টুকলুম নাকি? বাইসন তো কখনও জ্যান্ত দেখিনি। রাগী তো দূরের কথা! রাগী বাইসন স্বচক্ষে দেখলে বোধ হয় সে-কথা কাউকে জানাবার আর উপায়ও থাকে না। এক যদি কেউ দয়া করে প্লানচেটে ডাকে। তারপরে মনে পড়ল—না, টুকিনি, আমি আসলে বুল ফাইটের বুলদের কথা ভাবছি। বুল ফাইট টি.ভি স্ক্রিনে দেখেছি। বুল এবং তার মাটাডর।

সারা কলকাতা এখন সওনা বাথ নিচ্ছে। কী শুকনো গরম! মনে হচ্ছে একটা দেশলাই কাঠির ওয়স্তা। কেউ বিড়ি ধরিয়ে জ্বলন্ত কাঠিটা ছুড়ে ফেলবে আর আমরা সব বাড়ি-ঘর মাঠ-ময়দান রাস্তা-ঘাট সব সুদ্ধ নিয়ে দপ করে জ্বলে উঠব। দা গ্রেট ক্যালকাটা ফায়ার।

অদূরে একটা ধুলোর ঘূর্ণি উঠল, কলেজ স্ট্রিটের ট্রামের তারগুলো ঝাপসা লাগছে। মরুঝড়! মরুঝড়! মুখ গোঁজা উচিত। কিন্তু তা হলে দেখব কী করে? হু হু করে কনকনে ঠাণ্ডার একটা পুঁটলি মরুঝড়ের বৃহত্তর ঘুরনচাকির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। আ-হ। তারপরেই গোঁ-ও-ও, হুটপাট দুমদাম ঝড়ের শব্দকল্পদ্রুম শুরু হয়ে গেল।

আমি জানলা বন্ধ করি না। প্রচুর ধুলো ঢুকতে দিই কার্বন, লেড মেশানো ধুলো। তা হোক। ঝড়কে না হলে বুকে নেব কেমন করে? এই ভাবেই তো ঝড়কে আলিঙ্গন করতে হয়। ঝড়ের কড়া দাড়িয়াল মুখের চুমু খাই গালে, কপালে, চামড়া-ছেড়া দুঃসহ আদর। তারপরই বুনোদের বিষাক্ত তীরের ফলার মতো ফটাফট বৃষ্টি। পূব-দক্ষিণের জানলার মধ্যে দিয়ে ইঁট-কাঠ-লোহার বাধা হাজার হাতে সরিয়ে ঝড় আমাকে নেয়। আমি ঝড়কে নিই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
Pages ( 1 of 18 ): 1 23 ... 18পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress