মেঘনাদ বধ কাব্যের হাত ধরে কল্পসমাজের বুকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মহাকবিকে প্রণাম জানিয়ে তারই অমর উক্তি দিয়ে শুরু করি,” রেখো মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে। সাধিতে মনের সাদ, ঘটে যদি পরমাদ, মধুহীন করো নাগো তব মন: কোকনদে”।
বঙ্গজননীর মনপদ্মে চিরস্থায়ী আসনের বন্দোবস্ত তিনি করে নিয়েছেন মাত্র কয়েক বছরের মাতৃভাষার সাধনায়। বাংলার সাহিত্য জগতে তার আবির্ভাবকে ধূমকেতুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। তার আত্মপ্রকাশ এক মহা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো। তার সাহিত্য সৃষ্টি শাশ্বত শিল্প মূল্যে শীর্ষস্থানীয়। কবির সাহিত্য সাধনা যেমন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগান্তকারী ভাবনার উন্মেষ ঘটাল, তেমনি তার জীবনকথাও বিস্ময়কর ও কৌতুহলোদ্দীপক। উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী ঔজ্জ্বল্যে, বীর্যে এবং নাট্যচমকে বিদ্যুতপৃষ্ট। তিনি
হিন্দু কলেজের ছাত্র ও ডিরোজিও সাহেবের ভাবশিষ্য। সে সময়ে কাপ্তেন রিচার্ডসন, গণিত বিশারদ রিজ, হালফোর্ড, ক্লিন্ট প্রভৃতি শিক্ষক, অধ্যাপনা করতেন। তাই একথা হলফ করে বলা যায়, যে, ইউরোপীয় রেনেসাঁর ছোঁয়ায় তার মন প্রাণ আলোকিত হয়েছিল। নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা, নতুন যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে তিনিই প্রথম দেখালেন, প্রকৃত মহানুভব, বীর, ধার্মিক,এবং উদারচেতা রাবণ ও তার বীরপুত্র মেঘনাদকে।
যে অন্যায় যুদ্ধে প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধ না করেই যে ভাবে পূজারত নিরস্ত্র মেঘনাদকে বধ করা হয়েছিল তা কবির মনে কাপুরুষোচিত কাজ বলে বিবেচিত হয়েছিল। তারই ফলস্বরূপ তার যুগান্তকারী মহাকাব্য মেঘনাদ বধ। একই সাথে আমরা পেলাম আরো একটি কাব্যগ্রন্থ ব্রজাঙ্গনা এবং কৃষ্ণকুমারী নামে আর একটি নাটক । বিস্ময়! নিদারুণ বিস্ময়! কারণ মেঘনাদ বধ কাব্যে যে বীররসের প্রাবল্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য তেমনি ভক্তিরসে আপ্লুত, আর কৃষ্ণকুমারী নাটক সামাজিক ও রাজনৈতিক উপাদানে গঠিত। বিস্ময় এই কারণে যে তিনটিই একসাথে ১৮৬১ সালে রচিত। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন না হলে এটা করা যে সম্ভব নয় তা গুণীজন মাত্রেই স্বীকার করবেন। ১৮৫৯ সালে তার প্রথম নাটক শর্মিষ্ঠা থেকে শুরু তার যাত্রা আর ১৮৭১ সালে হেক্টর বধ দিয়ে যাত্রা শেষ। অবশ্য বিদেশী ভাষায় তার সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল১৮৪৯ সালে। আবার দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ অনুবাদ করেন ১৮৬১ সালেই। বিস্ময়কর বৈকি। তার মৃত্যুর পর মায়াকানন প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালে।
নিতান্ত স্বল্প পরিসরে তার মতো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের সাহিত্য সাধনা তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে তার খেদোক্তি যেমন তাকে মহিমান্বিত করে তাও প্রণিধানযোগ্য। ” আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায় তাই ভাবি মনে, জীবন প্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায় ফিরাব কেমনে।”
মধুকবিই লিখতে পারেন নিজের সমাধি লিপি,
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ- তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!
যে যুগান্তকারী মহাকাব্য তাকে খ্যাতির শীর্ষাসনে বসিয়েছে তার নাম মেঘনাদ বধ কাব্য আর সেই মহাকাব্যের হাত ধরে বাংলা ভাষার সাবালোকত্ব প্রাপ্তি ঘটে মধুকবির হাত ধরেই। প্রচলিত প্রথা, ধ্যান ধারণাকে তছনছ করে নতুন ভাবনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সাহিত্যের আঙিনা। রেনেসাঁর প্রকৃত প্রতিফলন শুরু হয় বাংলা সাহিত্যে মধুকবির হাত ধরেই।