মিষ্টি ভূতের তৈরি নৌকা
পাহাড় আর নদীতে ঘেরা গাঁ।নাম আন্তেগাঁ।সে গাঁয়ের জমি পাথুরে।তাই ফসল ফলে না।বিদেশি বণিকরা নৌকো করেই আন্তেগাঁয়ের জন্য খাদ্য সামগ্রী নিয়ে আসে।সেই বণিকরা খালি হাতে ফেরে না।আন্তেগাঁয়ের লোকেদের হাতে গড়া মাটির পুতুল নিয়ে যায়।সে ও তারা জলের দরে কেনে আন্তে গাঁয়ের থেকে। যেমন সস্তা দরে কিনে নিয়ে যায় পুতুল,তেমনি বেশি দরে রসদ বিকোয় বিদেশি বণিকরা।সব সময় বিদেশি বণিকদের মুনাফাটা বেশিই হয়।তা হোক খাবার তো পাচ্ছে আন্তেগাঁয়ের লোকজন।ওদের সাহায্য না পেলে আন্তেগাঁয়ের লোকজনের না না খেয়ে মরতে হতো। নিকোলাস শুধু ভাবে,আর ভাবে।কি করে নিজেদের রসদ নিজেরাই আনতে পারে।সেই চিন্তাই করে চলেছে নিকোলাস।শিশুকালেই নিকোলাস এর বাপ,মা মারা গেছে।তাই হয়তো একটু নিডর হয়ে বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ায় নিকোলাস।যখন তখনই বাঁশী নিয়ে ছোটে এদিক সেদিকে।রাত নিঝুম হলে নিকোলাসের বাঁশির ধুন ছড়িয়ে পড়ে আন্তেগাঁয়।নিশুতি রাতে নিকোলাস এর বাঁশীর ধুন শুনে মাদাম মার্গার বুকটা হু হু করে ওঠে।মনে ভাবেন,আহা!বাপ মা মরা ছেলেটা”। কতোবার বলেছেন,”হ্যাঁরে নিকোলাস সক্কলে যেখানে পা মাড়ায় না সেখানে তুই কিনা রাত বেরাতে ঘুড়ে বেড়াস?ভয় পাস নারে ডাকা বুকোটা?মাদামের কথায় হেসেছে নিকোলাস।বলেছে,”কি যে বলো মাদাম।ভয় করবো কাকে?এতো আমাদের নিজেদের গাঁ। মাদাম বলেছেন,কবর খানা,বট গাছ এসব জায়গায় ভূতের বাস।এই সব জায়গায় রাতের বেলা যায়? নিকোলাস বুঝতে পেরেছে,মাদাম কাল রাতের কথা বলছে।কাল সাঁঝবেলা থেকেই গরম বেশি পড়েছিল। নিম গাছের নিচে শুয়েছিল।বাঁশি বাজাতে বাজাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছিল তা বুঝতেও পারেনি সে। আধো ঘুমে কানে এসেছিল বাবা মায়ের ডাক।কেমন যেন নিম ফুলের গন্ধে মাখা সেই ডাক।সেই কবেকার শোনা গলা।একটুও পাল্টায়নি সে স্বর—-‘নিকোলাস’- —‘নিকোলাস’। —-আরে মা!তুমি এই সন্ধ্যেবেলায়?এখানে কি করছো? বাবাও এসেছ?তোমাদের চেহারা এতো খারাপ হয়েছে কেন?—-নিকোলাস বললো। —-“কি আর বলবো বাবা!গ্রামের লোকের কষ্ট দেখতে পারিনা।বাবা নিকোলাস একটা নৌকো তৈরী কর।তাহলে যখন যা দরকার তা নিয়ে আসতে পারবি। বিদেশি বণিকদের ওপরে নির্ভর করতে হবে না।না খেয়ে এ গাঁয়ের লোক মরবে না।যাবার সময় আঁন্তে গাঁয়ের জিনিস পত্র নিয়ে যাবি।চড়া দরে বিকিয়ে দিবি দিশি পুতুল।আর ফেরার সময় রসদ ভরে নিয়ে আসবি।” নিকোলাস বলে —-বাবা,তোমরা কোথায় যাচ্ছো?— —–আমাদের আর থাকা চলবে না।আলো ফুটছে এবার।যাই আমরা। নিকোলাস এর কানে এলো অসংখ্য কন্ঠ স্বর । —আঁলো আঁসতে দেঁরি নাঁই। চঁল তঁবে কঁবরে যাঁই। নিকোলাস ভাবে,এতো নাঁকি সুর কাদের?বাবা মায়ের গলার স্বর ও নাঁকিসুর।এমনতো শুনিনি কখনও। হঠাৎ চোখে পড়লো কঙ্কাল গুলো চারদিকে ছুটোছুটি করছে।লুটোপুটি করছে কঙ্কালগুলো।কে আগে কবরে ঢুকবে তাই নিয়ে ছুটোছুটি। ঝটপট ঝটপট কফিনের ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।যে যার কফিনে ঢুকে পড়ছে।হঠাৎই চারদিক শুনসান।কে বলবে এই একটু আগেই এঁরা এখানে ছিল। মোরগ ডাকছে।সকাল হয়ে গেছে।টুপ টাপ করে নিম ফুল পড়ছে।ঝটকা দিয়ে গায়ের ওপরে পড়া ফুল গুলো ঝেড়ে ফেলে নিকোলাস।রাগ হয় নিকোলাসের। একটু ঘুমোবার জো নেই।ঘুম ভেঙ্গে গেল নিকোলাসের। চোখ খুলে বুঝল যে নিম ফুল গুলো গায়ের ওপরে টুপ টাপ করে পড়েছে।মন ভরে গেল নিম ফুলের গন্ধে। কি সুন্দর সকাল।কাল রাতে বাঁশী বাজাতে বাজাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল গাছের তলে।আরে!সেই স্বপ্নটা? সেই কঙ্কালগুলো?আর তাদের সুরেলা ছড়াটা কিন্তু দারুণ ছিল। ভুত বিশ্বাস করে না নিকোলাস।তবে কি বাবা ও মায়ের কথা ভেবেছিল নিকোলাস!তাই হয়তো স্বপ্নে দেখেছিল বাবা আর মা কে। সকালে সোজা মাদাম মার্গার কাছে চলে গেছে।সেই নৌকা বানানোর কথাটা বলেছে তাঁকে। মাদাম দারুণ খুশি নৌকো বানানোর কথায়।উচ্ছসিত হয়ে বলেন —- —-নৌকো বানাবি সে তো খুব ভালো কথা।কিন্তু তুই একা তো পারবিনা।তবে তুই শুরু করলে সবাই হাত লাগাবে। নিকোলাস হেসে বলেছে —–সে তুমি চিন্তা করো না। আমি ঠিক পারবো।তাছাড়া এরিক,রবার্ট আর কেভিন ওরা আমার পাশেই আছে। এদিকে মাদামের মুখে নৌকো বানানোর কথা শুনে গ্রামের সক্কলে দারুণ খুশি। আঙ্কেল মাইক আনন্দে নিকোলাসকে জড়িয়ে ধরেছেন।বলেছেন,’ নিকোলাস দিনে রাতে আমি তোর সঙ্গে আছি।আমরা ঠিক নৌকা বানাবো।’ কেভিন,রবার্ট আর এরিক বলেছে, আঙ্কেল মাইক ঠিকই বলেছেন।আমরা সবাই তোর সাথে আছি। সেদিন বিকেলে সবাই জড়ো হয়েছে চার্চে।ফাদার এ্যালেক্স মাঝখানে বসেছেন।আর গাঁয়ের লোকজন চারপাশে গোল হয়ে বসেছে।সকলে দারুন খুশি। ফাদার নিকোলাসকে বলেছেন —-মাই সন,তুমি নাকি নৌকো বানাতে চাও? ——হ্যাঁ ফাদার,খিদেতে যাতে কারও কষ্টে না থাকতে হয়।যাতে খিদের জ্বালায় মানুষকে না মরতে হয়।যাতে আমরা দরকারে আমরা রসদ জোগাড় করতে পারি। কারো উপর নির্ভর না করতে হয়। গ্যাব্রিয়েল বলে—–ঠিক বলেছিস।বণিকরা দেরি করে এলে খাদ্যের অভাবে মানুষ কে আর মরতে হবে না। ফাদার বললেন,—-ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন নিকোলাস।725 সেই গোল বৈঠকে ঠিক হলো বেশ কয়েকটা ওক গাছ আর তাল গাছ কাটা হবে।সেই কাঠ দিয়েই নৌকো বানানো হবে। এরিক বলল —–তাহলে কাল থেকেই নৌকোর কাজ শুরু হোক কি বলো মাইক আঙ্কেল? মাইক বলেন—ঠিক বলেছিস।কাল থেকেই হোক। বেলা পড়তেই যে যার ঘরে চলে গেল।যাবার আগে অবধি মেয়েদের কথা আর শেষ হয় না।মেয়েরা বেশি খুশি কারণ রসদে টান পড়লে স্বামী ও সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে পারে না।তাই নৌকো যারা বানাবে তাদের কে কি খাওয়ার পাঠাবে তা নিয়ে ও কথা হয়ে গেছে।মাদামের মেয়ে ইসাবেলা বলেছে —-দেখো রাতের খাবার টা আমি দিয়ে যাবো। তা শুনে সুদখোর মিসেস মারিয়া বলেছেন —-রাতের আহার আমি রোজ দিয়ে আসবো। গাঁয়ের কাফের মালকিন বলেছেন —–দেখো বাপু আমি বেশি খরচ করতে পারবো না তবে প্রতিদিন বিকালে কফি তো করতে হয় তারই সাথে না হয় আরও কয়েক কাপ কফি বানানো হবে। তবে তোমরা কেউ গিয়ে কফিটা নিয়ে আসবে।কারণ আমিতো কাফে ছেড়ে নড়তে পারবো না।অবশ্য এক পিস করে কেক ও সবাই পাবে।এরপর যে যার বাড়ি চলে গেল। পরদিন ঝাঁ ঝাঁ কড়া রোদ উঠলো সকালে।নিকোলাস রোদের ধার ধারেনা।যা হবার তা হবে।তাছাড়াএই রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তো শিশুকালে বনে বাদাড়ে ছুটে বেড়িয়েছে। পথে এরিক আর রবার্ট এর সাথে দেখা হয়ে গেল।এরিক বলল,–তুই তৈরি নিকোলাস?তাহলে মাদামের ওক গাছ আগে কাটা যাক।মাদামের ওখানে বড়ো করাত রেখে এসেছি। নিকোলাস বলল—- বড়ো দড়ি এনেছিস? —হ্যাঁ রে,ওখানেই সব রেখে এসেছি।তোকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।চল। কাঠ চেরাই হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল।এরিক এর মা কাফে থেকে কফি নিয়ে এলেন।সবাই খুশি। গাঁয়ের সবাই ঘর বাড়ি ছেড়ে বটতলায় আসর জমিয়েছে।এ আসর গল্পের নয়।এ আসর ছেলেদের উৎসাহ দেবার আসর। মাইক বললেন—-তোরা কাজ কর দরকার হলে বলবি।আমি আছি। রবার্ট বলল—–তুমি এবার বাড়িতে যাও।অনেকক্ষন এখানে রয়েছো।আমরা আছি চিন্তা করো না। নিকোলাস বলল —-রবার্ট ঠিক বলেছে।দরকার হলে তোমাকে ডাকবো। নিকোলাস এর কথায় এরিক আঙ্কেল মাইক কে টেনে ওঠালো।বলল—–তুমি এবার যাও।যোয়ান ছেলেরা থাকতে তোমার এতক্ষণ থাকার দরকার নেই। এখন কাজ করার অনেক হাত এসে গেছে।র্যাদা করা শেষ।এবার পালিশ হবে।সন্ধ্যা হয়ে গেছে।রাতের খাবার ও এসে গেছে।মাদাম মার্লোনার এক বোতল মদ ভাগ বাটোয়ারা করা হলো।মাদামই বসে থেকে সবাই কে সুরা পান করালেন। বললেন—-খাও খাও।এতে কাজের শক্তি পাবে।বুঝলে? দিনের কাজে ছিল আঠারো জন।রাতে একটু বেশি সাহসী যারা তারা থাকবে।পোড়োবাড়ি আর বট গাছের ধারে কেউ আসে না ভয়ে।তায় আবার রাতের বেলার কাজ।তাই সাহসীরাই এগিয়ে এসেছে।পোড়োবাড়ির চার পাশে চার টা অগ্নি কুন্ড করেছে।পাশেই কবরখানা তাই ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। রাতের দশজনের মধ্যে নিকোলাসই একটু বেশি সাহসী।হঠাৎ একটা শীতল হাওয়া ছড়িয়ে পড়লো পোড়ো বাড়িতে।অনেকেই চিৎকার করে উঠল—- নিকোলাস আগুন নিভে গেল যে।ওরে বাবারে।চল আমরা পালাই। নিকোলাস বলল—–ভয় পাচ্ছিস কেন?বাইরের আগুন নিবলেও ভেতরের আগুন এখনো জ্বলছে। এবার গ্যাব্রিয়েল বললেন,—যে যে যেতে চাও চলে যাও। একমনে নিকোলাস কাজ করে চলেছে।কেএলো,কে গেল তার হিসেব রাখেনি সে।র্যাদা করতে করতে কানে এলো ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ।আগুনের দিকে চোখ পড়তে দেখল আগুনের মধ্যে একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে।মনের ভুল ভেবে চোখ ফিরিয়ে নিলো নিকোলাস।আবার কাজে ডুবে গেল। বারবার ঢুলুনি আসছে নিকোলাসের।চোখ রগড়ে নেবার চেষ্টা করে আবার র্যাদা চালালো।একটা কালো হাত এগিয়ে এলো।নিকোলাসের হাত থেকে কেড়ে নিলো র্যাদাটা।কে যেন বলল,—নিকোলাস তুই ঘুমা। আমি করছি। গুটিশুটি শুয়ে পড়লো নিকোলাস। অনেক লোক কাজ করছে।কেমন অদ্ভুত লোকগুলোর চেহারা।না খেতে পাওয়া শরীর ওদের।একজন আর একজনের হাতে তক্তা দিচ্ছে।র্যাদা করছে আবার পালিশ করতে আর একজনের হাতে তুলে দিচ্ছে। সুর করে বলছে—–আঁমি দিঁতে থাঁকি, তুঁই নিঁতে থাঁক। কবরখানার ঢাকা খুলে একে একে কঙ্কাল গুলো বেড়িয়ে আসছে।এটা যেন বিশাল একটা কারখানা। কঙ্কালরাই কাজ করছে।এঁরা কারা?হিঁহিঁহিঁহিঁ করে হাসছে ওরা।ওরাই বলল —-ওঁঠ নিঁকোলাস। ওদের সঙ্গে কোথায় চলেছে সে!পোড়োবাড়ির ভেতরেই একটা সুড়ঙ্গে ঢুকল।আগে চলেছে নিকোলাস পেছনে চলেছে এক দঙ্গল কঙ্কাল।নিকোলাসের দু পাশে দুজন চলেছে চাদর মুড়ি দিয়ে।এদের শরীর দেখা যায় না। সুড়ঙ্গের এবড়ো খেবড়ো পথ।বড়োজোর হাত খানেকের মতো প্রশস্ত।হঠাৎ দু পাশের চারজন উধাও হয়ে গেল। চিৎকার করে উঠলো নিকোলাস।—–তোমরা কোথায়? আর তখনই কানে এলো নাঁকি সুর——কেঁ এঁলোরে? এঁ রাঁজ্যে মাঁনুষ কেঁন এঁল? সেই চার জন আবার এলো।তাদের কথা কানে এল। ——–ভঁয় নেঁই।ভঁয় নেঁই। ত্বঁরা কঁরে চঁল যাঁই। চঁল যাঁই।চঁল যাঁই চঁল যাঁই।চঁল যাঁই। নিঁকোলাস এঁসেছে তোঁরা সঁব সঁরে যাঁ। সঁরে যাঁ।সঁরে যাঁ। সবাই ছুটছে।নিকোলাস ও ছুটছে।একেএকে দুটো বাঁশ ঝাড় পেরোলো ওরা।আঁধারে টেমস্ নদীর জল চিক্ চিক্ করছে।আজ কি অমাবস্যা?ঘাটে বড়ো নৌকো বাঁধা।নৌকোয় ওদের সাথেই উঠে বসল সে। বিশাল নৌকা আঠারো জন মাঝি মল্লা।ছপ্ ছপ্ করে দাঁড় টানছে মাঝি।সাঁসাঁ করে তীর বেগে ছুটছে নৌকো। ঘাটে ভীড়লো নৌকো। পিঁপে পিঁপে মদ,সবজি,ফল,চাল,ডাল,মাখন সবই নৌকায় চাপানো হলো।মোট বইছে কঙ্কালরা।আবার চলতে লাগল নৌকা। একেবারে সেই সুরঙ্গের মুখে ভীড়লো নৌকা।নৌকা বাঁধা হলো। আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হয়ে আসছে। নিকোলাস এর কানে আসছে —– “নিঁকোলাস চঁলি বাঁবা কাঁজ সঁব হঁলো সাঁরা। একে একে সেই না খেতে পাওয়া মানুষ গুলো ছুটে চলেছে।মানুষগুলোর শরীরের ঢাকা খুলে পড়লো। এ যে নরকঙ্কাল! ছুটোছুটি পড়ে গেল।কবরের ঢাকা ঝখুলে যে যার কবরে ঢুকে পড়ল।সুর করে বলতে লাগল আঁলো ফুঁটতে দেঁরী নাঁই, চঁল তঁবে কঁবরে যাঁই। চওড়া একটা হাত এগিয়ে এলো নিকোলাস এর দিকে। সেই হাতে মাংস নেই।ভয়ে সরতে চায় নিকোলাস।সরতে পারেনা।সেই ভুতের হাত নিকোলাস এর কপালে এক থাপ্পর কষালো।ঠাঁই করে নিকোলাস মাটিতে পড়ে গেল।কপাল জ্বালা করছে।কে চড় মারলো তা দেখতে ভালো করে তাকায় নিকোলাস।বুঝলো,সে স্বপ্ন দেখছিলো।আর ঝিমোতে গিয়ে র্যাদাতে মাথা ঠুকে গেল।নিকোলাস কপালে হাত দিয়ে দেখল হাতে রক্ত লেগে আছে।এবার ঘুমটা সত্যি সত্যি ছুটে গেল। চেয়ে দেখলো সে পোড়ো বাড়িতে মাটিতে শুয়েছিল। গ্যাব্রিয়েল আঙ্কেল ছাড়া কেউ নেই।আঙ্কেলও গুটি শুটি শুয়ে আছে মেঝেতে।উঠে পড়লো নিকোলাস।বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ঘরে এসে ও কাল রাতের সেই স্বপ্ন টা তাড়া করে বেড়াচ্ছিল নিকোলাসকে।নাঁকি সুরে কথা বলছিল ওরা। ওরা কারা?আর সেই সুরঙ্গ!নৌকোয় ভরা খাদ্য দ্রব্য? ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। বেলা দশটায় নিকোলাস পোড়োবাড়িতে পৌঁছালো। গ্যাব্রিয়েল আঙ্কেল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন নিকোলাসকে।বললেন—–একি করেছিস?রাতেই তো সব কাজ সেরে রেখেছিস।দেখবি চল। নিকোলাস বলল —–কতো আর সারলাম।ঘুমিয়েই তো রাত কাবার করলাম। আঙ্কেল বলেন —-আর লজ্জা পেতে হবে না।বট তলায় দেখবি চল। বট তলায় এসে তাজ্জব বনে গেল নিকোলাস।এ কী! রাশি রাশি কাঠ র্যাদা করে পালিশ অবধি করে রেখেছে।নাট বোল্ট লাগাবার ছ্যাঁদা অবধি করে রেখেছে।বাধ্য হয়ে আঙ্কেলকে সব কথা বলেই ফেলে। —-আঙ্কেল এতো কাজ আমি করিনি।তবে সবাই যে পোড়োবাড়ির ভুতের কথা বলে সেটা সত্যি।অলৌকিক কিছু ঘটেছে কাল রাতে। গ্যাব্রিয়্যালের যে সন্দেহ হয়নি তা নয়।তবে মনে মনে সান্ত্বনা খুঁজেছেন নিকোলাসের কথা ভেবে।তবে এই কথা জানা জানি হলে নৌকা আর তৈরি হবে না।ভয়ে সবাই পালাবে। নিকোলাস কে বললেন—এসব কথা কাউকে বলবি না। নিকোলাস ভাবে ঐ অপদেবতারা তো আমাদের গাঁয়ে ই ছিলেন।আমাদের ভালোই চান ওঁরা। গ্যাব্রিয়্যাল আঙ্কেল বাড়ি চলে গেছেন।নিকোলাস ভাবে অতীতের ভুত আর ভবিষ্যতের ভুত একাকার হয়ে গেছে।না খেতে পেয়ে আঁন্তে গাঁয়ে অনেক জীবন্ত কঙ্কাল আছে।তাই নৌকা গড়তে সাহায্য করছে অতীতের মানুষেরা। অতীতে যা হয়েছে তা আর হতে দেবে না ঐ কঙ্কালরা। দুদিনেই নৌকা তৈরী হয়ে গেল।সেই ঘাটে নৌকা বাঁধা হলো।সারা গাঁ ভেঙ্গে পড়েছে নৌকা দেখতে।সকলেই নিকোলাস কে আশীর্বাদ করছে।মাদাম মার্গা বলেন। —-ফাদার,আমরা সবাই জিসাসের কাছে প্রার্থনা করতে চাই। ফাদার খুশি হয়ে বললেন,সে তো ভালো কথা।তাঁকে স্মরণ করলে বিপদ মুক্ত হওয়া যায়।সকলে সমস্বরে গাইলো,শাওয়ার্স অব ব্লেসিং উই নীড।মার্সি ড্রপ রাউন্ড আস আর ফলিং।বাট ফর দা শাওয়ার্স উই প্লীড। যাত্রা শুরু হবার আগে ফাদার বললেন—-মে গড ব্লেস ইউ মাই চাইল্ড। সাহসী দল নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। মাইক বললেন, এখানেই বুঝি নদীর মোহনা।বেশ উত্তাল নদীর ঢেউ।টাল খাচ্ছে নৌকা। এরিক চিৎকার করে উঠলো —-আঙ্কেল মাইক আমরা বঝি ডুবে যাবো। আঙ্কেল বললেন—–ভয় নেই।জিসাস কে ডাকো। ঈষৎ হেলে গেল নৌকা।হৈহৈ রব উঠলো।কিন্তু কাত হলো না নৌকা।একবারে সোজা চলতে লাগল নৌকা। মনে হলো অসংখ্য হাত নৌকা ধরে রেখেছে। কেভিন “ভুত”বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল। ভয় পাবার ই কথা। উথাল পাতাল নৌকা কে অসংখ্য কঙ্কালের হাত ধরে রেখেছে।যাতে নৌকা ডুবে না যায়। অনেকেই ভয় পেয়েছে ঐ হাতের সার দেখে। নিকোলাস চেঁচিয়ে উঠেছে —-রবার্ট,কেভিন কে ধরো। নৌকা বাঁধো।বাঁধো বললেও নৌকা দাঁড়াচ্ছে না। চেঁচিয়ে উঠলো সবাই —নৌকো বাঁধা যাচ্ছে না। নৌকা ভিড়ল শেষ অবধি।পাহাড়ের পাশে এবড়ো খেবড়ো জায়গায়।দেখে মনে হলো পথ আছে সেখানে। শক্ত করে নোঙর ফেলা হলো।যাতে নৌকা ভেসে না যায়। আঙ্কেল মাইক বলেন —-তোরা নেমে চোখে মুখে জল দে। কেভিন এর জ্ঞান ফিরতেই এক রাউন্ড কফি ও কেক খাওয়া হলো। নৌকো ভেড়ার সাথে সাথে জায়গাটা চেনা চেনা লাগছিল নিকোলাস এর।হঠাৎ কাল রাতের সেই নৌকার কথা মনে পড়লো।চারদিকে একটা চ্ক্কর কাটবার জন্য দল থেকে সরে পড়ল নিকোলাস।নদীর ধার ঘেঁষে কিছু টা এগিয়ে তখনই চোখে পড়ল বিশাল নৌকোখানা তাতে নানান রকমের রসদে ভরা।কাল রাতের সেই নৌকাই মনে হচ্ছে।সবাইকে কাল রাতের কথা বলা যাবেনা।তবে এই নৌকার কথা বলতে হবে। দলে ফিরতে ছুটলো নিকোলাস। দুর থেকে ওকে দেখে মাইক বলেন,কোথায় গিয়েছিলে?চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। নিকোলাস বলল —-আঙ্কেল ওপাশে একটা বড়ো নৌকা দেখলাম।অনেক কিছু রয়েছে ঐ নৌকায়। ইচ্ছে করেই বাকিটুকু চেপে গেল।কারণ কালকের কথা শুনলে সবাই ভয় পেয়ে যাবে।এবার সকলেই চলল সেই নৌকা দেখতে।পাথরের সিঁড়ি গুলো দেখিয়ে নিকোলাস বলল —–আঙ্কেল আমি ঐ দিকটা একটু দেখে আসি ঐ দিক দিয়ে আমাদের গাঁয়ে ফেরার পথ আছে নাকি।গ্যাব্রিয়েল নিকোলাস কে একা ছাড়লেন না। বললেন—চল সবাই এক সঙ্গে যাব। পাথরের খাঁজে খাঁজে পা ফেলে উঠতে হচ্ছে।সকলের পায়ে বুট।তাই অসুবিধা হচ্ছে না।এক্কেবারে খাড়া উঠেছে পথ।কিছুটা উঠেই নজরে পড়ল পাহাড়ি ঝর্ণা। তির্ তির্ করে বেয়ে চলেছে।আরও উপরে উঠে রবার্ট চেঁচিয়ে বলল —–ঐ দেখো জলপ্রপাত। সেদিকে এগিয়ে গেল সবাই।যেখানটায় জলের উৎস সেই পাথরটার রং গাঢ়ো নীল।সেই নীল রং জলে নীল আভা ছড়াচ্ছে।আর একটু গিয়ে গম্বুজাকৃতি একটা ঘর দেখা গেল। নিকোলাস বলল—-হুর্ রে।পেয়ে গেছি। সবাই বলল—-কি পেয়েছিস? নিকোলাস বলল —-কি আবার? আমাদের গাঁয়ে ফেরার পথ। সকলে গম্বুজের ভেতরে একেএকে ঢুকে পড়লো।রবার্ট টর্চ বার করল।গম্বুজের ভেতরে সুরঙ্গ দিয়েই এগোতে হচ্ছে।এঁকে বেঁকে চলেছে সুরঙ্গপথ।আগে চলেছে নিকোলাস।পেছনে আর সকলে।সব শেষে আঙ্কেল মাইক।পেছন থেকে সাহস জুগিয়েছেন তিনি। হঠাৎ গুমোট হয়ে গেল।তারপরই হাঁ হাঁ হাঁ হাঁ হিঁহিঁ হাসি। —-কেঁ যাঁয় রেঁ? —-আমি নিকোলাস।–নিকোলাস বলল। —-মাঁইক নাঁ?গ্যঁব্রিয়েল ও আঁছো?ছোঁড়া গুঁলো আঁমাদের ভঁয় পাঁয় কেঁন? হতবাক হয়ে চেয়ে আছে সবাই।কোথাও কেউ নেই। আবার নাঁকাসুরে বলে—- —-চঁলে যাঁ,চঁলে যাঁ,ভঁয় নেঁই,ভঁয় নেঁই। মোঁরা সঁব তোঁদের আঁপন জঁন হঁই। কেভিন নিকোলাসকে জড়িয়ে ধরেছে।নিকোলাস অভয় দিয়েছে।—–ভয় পাসনা এঁরা আমাদের পূর্ব পুরুষ। পাক খেয়ে ধূলোর ঝড় উঠলো সেখানে।পথ দেখা যায় না।চোখ কচলে নিলো সকলে।গ্যাব্রিয়েল বলেন। —–কোন দিকে যাবিরে নিকোলাস? এই বলার কারণ দু দিকে দু টো পথ চলে গেছে। নিকোলাস কিছু বলার আগেই কানে আসে নাঁকা সুর। —–অঁধোমুখী চেঁয়ে যাঁ।ডাঁনে গিঁয়ে বাঁয়ে যাঁ। ঝাঁড়ে ঝাঁড়ে বাঁশ বঁন।পাঁয়ে পাঁয়ে ছঁ’শো গোঁন। ভয়ে কেভিন কেঁদে ফেলে বলে—-ওরে বাবা এতো ভুতের রাজ্য। আবার সেই গলা কানে এলো। —–ভঁয় নেঁই।বাঁরে বাঁরে ভুঁত কঁস। তুঁই তঁবে ভুঁত হঁস। চঁলে যাঁ।চঁলে যাঁ। নিঁকোলাস এঁসেছে,ভুঁত সব,সঁরে যা। ভয়ে কেভিন আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। এরিক ছুটে এসে ধরে ফেলে কেভিনকে। এরিক বলে—-এখানে না এলেই হতো। আঙ্কেল মাইক এরিককে ধমক দিলেন।—- —-কথা না বলে এগিয়ে চলো।কেভিনকে কাঁধে তুলে নাও।তুমি না পারলে আমাকে দাও। লজ্জা পেয়েছে এরিক।বলেছে—–না না আমি নিতে পারবো। রবার্ট বলেছে—-আমরা থাকতে আপনাকে নিতে হবে কেন? ডানে কিছুটা যাবার পর কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিকোলাস ভাবছে, এ কোথায় এলাম?দুরে একটা অগ্নিকুন্ড দেখা যাচ্ছে।থমকে গেছে সকলে। নিকোলাস বলল—-আঙ্কেল বাঁয়ে যেতে হলে অগ্নি কুন্ড পার হতে হবে।আমরা বরং আমাদের পিতৃপুরুষের ধ্যান করি।সবাই তাঁর মৃত পূর্ব পুরুষের ধ্যান করল। নিকোলাস তাঁর বাবা মা কে ডাকতে লাগল। দেখতে দেখতে অগ্নিশিখা আর ও বেড়ে গেল।আগুনের বড়ো বড়ো গোলা ছুটে আসতে লাগল।প্রতিটা গোলা মাটিতে পড়ে ফেটে যেতে লাগল।তার থেকে রক্তের ঢল নামতে লাগল।সেই রক্ত থেকে অক্টোপাস এর মতো ভয়ানক জীব ছুটে আসছে ওদের দিকে। নিকোলাস বলল —-মা রক্ষা করো।বাবার গলা কানে এলো।—–যা বলছি তাই তোরা সকলে বল।দেখবি সব পরিস্কার হয়ে যাবে।আর কোনো বিপদ হবে না। নে শুরু কর।—- —–দেঁখতে আঁমরা মাঁনুষ বঁটি,দিঁনে রাঁতে দাঁনোর সাঁথে ছুঁটি।জাঁনিস নাঁ কিঁ মোঁরা পিঁপে পিঁপে রঁক্ত চুঁষি,ধঁরে তোঁদের ডঁজন খাঁনেক টুঁটী? আশ্চর্য ভুতের মন্ত্র বলতে বলতে আগুন টা ক্রমে ছোট হয়ে উপরে উঠে গেল।তারপর ভুস করে হাউই বাজীর মতো উবে গেল সেই আগুন।গুহার ওপরের ছাদ ভেদ করে বেড়িয়ে গেল।বজ্রপাতের মতো শব্দে চমকে উঠলো সবাই।যেখান দিয়ে পাহাড় ভেদ করে বেড়িয়েছে সেখান থেকে পাহাড় ছেদ করে সূর্যের আলোয় ভরে গেল সেই গুহার চারদিক। —হাহা হিহি হাসিতে ভরে গেল চারদিক।অনেক কন্ঠ শোনা গেল।—-ভাঁলো হঁল দাঁনো গেঁল। আঁসা যাঁওয়ার পঁথ হঁলো। থাঁক তোঁরা দুঁধে ভাঁতে মোঁরা এঁবে যাঁই চঁলে কঁবরেতে। —–কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে কেন?গ্যাব্রিয়েল বলেন। আমি দাঁড় করালাম?কেন তোমরা আগুনের কুন্ড দেখোনি? —–না।কোথায় আগুন?তবে তখন অন্ধকার ছিল আর এখন আলোয় ভরে গেছে। -“—–আর কিছু দেখোনি? —-না তোকেই দেখছিলাম।ঘামে ভিজে গিয়েছিলি। কি সব বিড় বিড় করছিলি।যা খাটুনি গেছে তোর। আশ্চর্য নিকোলাস!তবে কি স্বপ্ন দেখছিল সে?মাইক বললেন—- রবার্ট,নিকোলাসকে ভদকা দে। সকলে ই একটু একটু করে ভদকা খেয়ে নিল। শরীর টা বেশ হাল্কা লাগছে। নিকোলাস বলল —–তোরা কেউ পা গুনেছিস?কতো পা আমরা হেঁটে এলাম? রবার্ট হেসে বলল ——ভুতের পা? না আমাদের পা? হ্যাঁ রে গুনছি।পাঁচ শো পা অবধি হয়েছে। বাঁশ ঝাড় শেষ হলেই পথ শেষ হল। রবার্ট বলল—-নিকোলাস ছয় শো পা তো শেষ হলো।কই পথ তো পেলাম না।চল এই ঘরে ঢোকা ছাড়া আর পথ নেই। নিকোলাস বলল —–এখানেই পথ আছে। আমার বাবা বলেছে রাস্তা।ভুল হতে পারে না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে ঢুকে গেল সবাই।সেই ঘরের চার দিকে দেয়াল।চামচিকে উড়ছে চারদিকে।ছেলেরা হৈ চৈ শুরু করলো।—-নিকোলাসের কথা শুনে এই অবস্থায় পড়তে হলো। চার দিক অন্ধকার।মাইক বললেন—–নিকোলাস কোথায় গেল? নিকোলাস ছুটে এলো।মুখে হাসি ধরে না। বলল —আঙ্কেল,রাস্তা খুঁজে পেয়েছি। হৈহৈ করে সকলে পৌঁছে গেল সেখানে।একটা চাতাল তাতে একটা ছিটকিনি। হাত দিতে ই চি চিং ফাঁকের মতো সরে গেল সেই চাতাল।সিঁড়িনেমে গেছে যেখানে সেটা ও একটা ঘর।চারদিকে হাতুরি,বাটারি ছেনী সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। “আমরা এসে গেছি আঙ্কেল”।—-বললো নিকোলাস। আরে এটাই তো আমাদের পোড়ো বাড়িটা।সবাই উৎফুল্লিত।সবাই আশ্চর্য তিন ঘন্টার পথ ফিরে এল চল্লিশ মিনিটের মধ্যে!এরিক বলল—–কি রে কয় পা হলো? রবার্ট বলল —–ছয়শো পা হলো। বেঁটে হেন্ড্রিক বলল—-ভুতের পা? কেভিন বলল—–ভুতের পা না। আমাদের পূর্ব পুরুষের পা। ছেলেরা যে যার বাড়ির দিকে গেল।মাদাম র্মাগা ছুটে এসেছেন।ফাদার ও ছুটে এসেছেন।কেউ বাকী নেই। সবাই আবার সেই সুরঙ্গ পথে ছুটে গেছে নৌকার খাদ্য সামগ্রী নিয়ে আসতে। পরদিন মজলিশ বসেছে পোড়োবাড়িতে।এখন আর কারও ভয় নেই ভুতকে।ওদের শক্তি তেই যে সব সম্ভব হয়েছে তা ওরা বুঝতে বাকি নেই আঁন্তে গাঁয়ের মানুষের ।ওদের সাহায্য না হলে কি দু দুটো নৌকা ওদের হতো?