মিতার সংসার
প্রথম পর্ব
মিতা তিন বছরের শিশুকে নিয়ে এক বস্ত্রে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে আসে।অমৃত , মিতাকে বিয়ের আগে বলেছিল,তোমার চাকরি কোনমতেই বিয়ের পর ছেড়ো না।ঐ সন্দেহবাতিক বর বিয়ের তিনমাস পর থেকেই শারীরিক অত্যাচার করতেই থাকে।ঘর থেকে ছাদেেও যেতে দেয় নি।মিতার আরো দুই দিদি গীতা ও রীতার শ্বশুরবাড়িতে ভাল আছে।তাই বাবা, মা মিতার জন্য খুব চিন্তা করতেন। এক দাদা ছিল মিতার, সেও অনেক বছর আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছিল।
মিতার আত্মসম্মানে লাগে বাবার বাড়ি থাকতে।অন্যত্র থাকতে গেলে টাকার দরকার।একদিন সকলের অজান্তে মেয়েকে নিয়ে পুরানো অফিসে যায়।কাজটা হয়েও যায়।অফিসের কাছে একটা ঘর ভাড়া করে আসে।বাইরে বেড়িয়েছিল বলে ঐ দিন সন্ধার থেকে অমৃত, মিতাকে নানাভাবে মারধর করে।বাধ্য হয়ে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ,মিতা মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি পালিয়ে আসে।মিতা মা কে বলে তোমরা ও বৌদিকে এত অত্যাচার করেছ,বৌদি ঘর ছেড়ে গেছিল ,আমার ও তাই কপাল। কথায় বলে না…পাপ বাপকেও ছাড়েনা।মিতার মনে আছে,দাদা মরে যাবার পর বাবা ,মা বৌদিকে অপয়া বলে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল।
পর্ব..২
মিতা প্রায় দেড় বছর কাজ করছে,হঠাৎ দেখে বর অমৃত অফিসে এসেছে।একটুর জন্য দেখতে পাই নি মিতাকে।তারপর মিতা দেখে অমৃতঅফিসের এক কলিগের সাথে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে যায়।কলিগ ক্ষমা সেদিন হয়ত ছুটি নিয়ে বাইরে গিয়েছিল,তাই সেদিন অফিস ফিরে আসেনি।পরদিন টিফিনের সময় অন্যান্য বন্ধুরা ক্ষমাকে নিয়ে নানান মশকরা করছিল।কবে বিয়ে করছিস?ক্ষমা বলতে শুরু করে ওর বিয়েতে একটু অসুবিধা আছে,হবু বরের আগের বউটা ডির্ভোস না করেই অন্য কারর সঙ্গে দেড় বছর হল পালিয়েছে।এখন ভয় ,যদি বিয়ে করি তাহলে বিয়েটা অবৈধ হয়ে যাবে।
ভাবো ঐ বৌটা কি পাঁজি ।বউটা সন্দেহবাতিক ও ছিল।
তখন মিতা বলে,ক্ষমা সব বিচার করে বিয়ে করো।আর লিখিয়ে নিও তোমায় চাকরি করতে দেবে কিনা।ক্ষমা সবাইকে ছবি ও দেখাল হবু বরের।মিতা চোখ থেকে জল গড়াতেই মুছে নেয়।সারারাত নিজেকে প্রশ্ন করে ,এটা কি হওয়া উচিৎ।আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।তাছাড়া মিতার ছবি কোন ভাবে ক্ষমা দেখে ফেলে,তাহলে মুশকিল হয়ে যাবে।পরদিন একটা ডির্ভোস পেপারে সই করে ক্ষমাকে দেয়,বলে তোমার হবু বর কে দিয়ে সই করে এনো।মিতা বলে আর আজ প্রশ্ন করো না।একটাই অনুরোধ আমি এখানে চাকরি করি সেটা বলো না।কিন্তু মিতাদি তুমি তো এরকম মেয়ে নও।তুমি শুধু বলো তোমার অফিসে আমি দিয়ে গেছি।একটু সই করে দিতে বলো।ক্ষমা সব কলিগদের ঘটনা জানায়।সবাই বলে বাবা মিতাদির এরকম চরিত্রের।
পর্ব..৩
আবার কেউ বলে মিতাদির কাছে ঘটনাটা কি জানা দরকার।সবাই চেপে ধরাতে ,মিতা তার অতীত সবাইকে জানায়, সব শুনে সকলে তাজ্জব।মিতা ও ক্ষমা দুজনেই কাঁদতে থাকে।ক্ষমার প্রচেষ্ঠায় ডির্ভোস পাই মিতা।ক্ষমা ও তারপর হবু স্বামি কে ঠান্ডা মাথায় ত্যাগ করে।মিতা ক্ষমাকে বলে তুমি আমার বড্ড উপকার করলে,ক্ষমাও বলে তুমিও আমার জীবন বাঁচিয়েছ।এদিকে বউটা হাতছাড়া ওই দিকে ক্ষমাকে হারানোর জন্য মিতার প্রাক্তন বর অমৃত একদিন ক্ষমাকে অ্যাসিড বালব ছুঁড়ে সারাদেহ পুড়িয়ে দেয়।ক্ষমা মারা ও যায়।আজ বদমাশটা জেলে,যাবজ্জীবন কারাবাস।মিতা ভেবেছিল ফাঁসি হবে।এরকম লোকরা বেঁচে থাকলে আরে কত মিতা ,ক্ষমা নষ্ট হবে কে জানে।
পর্ব..৪
ছোট্ট মেয়েটার আজ লেডি হয়ে গেছে।এতদিন মেয়েটা বৌদির কাছে মানুষ হচ্ছিল।যে বৌদিকে বাপের বাড়ির বাবা মা জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল,যেহেতু দাদা নিজে বিয়ে করেছিল,দাদা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর অপয়া বলে ঘর থেতে বার করে দিয়েছিল।বৌদিও বাপের বাড়িতে কষ্টে ছিল।তারপর ননদিনী একদিন অফিস যাবার সময় বৌদিকে রাস্তায় দেখতে পায়,বাড়ি নিয়ে আসে।বাচ্চাটা মামির কাছে মানুষ হতে থাকে।মিতার মেয়ে মামীকে, মামী বলে তাই সবাই জানে মামীই হল মা।মিতাকে মিমি বলে।মিতার মেয়ে অমৃতার পুলিশ ট্রেনিং শেষ।বাইরে ছমাস কাজ করার পর হলদিয়া সংশোধনাগারে পোস্টিং।
মিতার বুকটা ছাঁক করে ওঠে,যখন হলদিয়া সংশোধনাগারের নাম শোনে।লোক মারফত মিতা জানতে পেরেছিল ওইদিকে অমৃতার বাবা জেলে ছিল,হয়ত এতদিনে ছাড়া পেয়ে গেছে,যাবজ্জীবন মানে তো চোদ্দ বছরের পর ছাড়া ও পেয়ে যায়।ভালবেসে তো বিয়ে ছিল,দুঃখের স্মৃতির সাথে তো সুখের স্মৃতিও তো ছিল।।অমৃতা মিতার কাছে তার বাবার ছবি দেখেছিল।মিতা লক্ষ্য করেছিল অমৃতার চোখে জল চিকচিক করতে,কোন ঘৃণা দেখে নি।এক কথায় মা কে বলেছিল ,অমৃতবাবুর ওটা রোগ ছিল,বিনা কারণে বউকে মারা ,চাকুরিজীবী মহিলাকে ঘরে আটকে রাখা।মা সব অসুস্হ মস্তিষ্কের লক্ষণ।মিতা ভাবে এই মেয়ে কোনদিন বাবার কোলেও চড়ে নি ,বাবার কোন স্মৃতি ও নেই তবুও রক্তের কি টান।
মিতা তারপর মেয়েকে বলে ওনার অ্যাসিড মারার কি দরকার ছিল।অমৃতা বলে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ডির্ভোস করার পর ঐ মহিলাকে ও পাই নি,তাই হয়ত এ ভুল করেছিল।
মিতা ,মেয়েকে বাবার দিকে টেনে কথা বলতে দেখে চুপ করে গেছিল।
পর্ব..৫
সাতদিন হল অমৃতা হলদিয়াতে আছে। কোয়াটারে বৌদি রাখতে গেছে মিতাকে।মিমি ও মামিকে পেয়ে অমৃতার খুব আনন্দ।অমৃতা মামিকে বলে তুমি এখানে থেকে গেলে মিমিকে কে দেখবে।মিতা বলে থাকুক তোর মামি।আমি চালিয়ে নেব।
মামি আর মিমিকে নিয়ে সংশোধনাগারে গেছে অমৃতা।আজ সংশোধনাগারে যারা বাড়ি যায় নি,ভাল জীবন বেঁচে নিয়েছে,এছারা অন্যান্য কয়েদিদের সুশিক্ষা দিচ্ছে,নানান কাজ কর্মে আছে,তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান।পড়াশোনা করছে কত ছেলে ,মেয়ে।যারা ভুল করে অন্যায় করেছে।কত বড় বড় মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার সবাই এসেছেন কয়েদিদের গান শুনতে।
সব অনুষ্ঠানর শেষে বলা হল, ইনি অমৃতলাল দত্ত,একটা ভুল জীবনে করেছিলেন,কিন্তু তিনি ভাল কাজ করার জন্য মেয়াদ পুর্ণ হবার আগেই মুক্ত হয়েছিলেন।উনি এখানেই থেকে জেলের শৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন।তবে ওনার স্ত্রী ও কন্যা আছে,তবে কোথায় জানেন না।তাদের উৎসর্গ করে একটা বই লিখেছেন।বইটা এত হারে বিক্রী হয়েছে,এত সুন্দর লেখা।এমনকি যা টাকা পেয়েছেন অর্ধেক বৌ-মেয়ের নামে আর বাকি টাকা এখানকার কয়েদিরা যাতে আরো ভালভাবেই থাকতে পারেন,তাই সংশোধনাগারে দান করেছেন।
পর্ব..৬
মিতা কাকে দেখছে।এক মাথা সাদা চুল।সবাই হাততালি দিচ্ছে।মিতা তালি দিয়েই যাচ্ছে।অমৃতা ভাবে ,সবাই তো থেমে গেছে।ও মা মিমি স্টেজের দিকে যাচ্ছে কেন?তাহলে উনি কি আমার বাবা।মিমি কে অমৃতলাল বাবু বলেন আমার অমৃতা কোথায়?সে কি তার বাবার কথা জানে।মিমিকে বলতে শুনি শুনুন আমিই অমৃতলাল বাবুর প্রাক্তন স্ত্রী আর ঐ যে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছেঅমৃতা,এই অমৃতবাবুর কন্যা।মিতা এতটা সাহস পাই অমৃতাকে দেখে।ওর সাথে আগে কথা বলে বুঝতে পেরেছিল,বাবাকে ঘৃণা করে না।বরঞ্চ বাবার কথা উঠলেই চোখে জল চিকচিক করত।
মেয়ে বাবার দিকে এগিয়ে যায়,বাবাকে স্যালুট জানায়।সবার অনুরোধে বাবার হাতে মেয়ে ফুলের স্তবক দেয়। মেয়ে বলে এবার থেকে আমার কাছে থাকতে চলো।বাবা ও মেয়ের মিলন হয়।অমৃতার একটাই কাজ বাবা ও মিমির চারহাত মিলিয়ে দেওয়া।এরজন্য মামির সাহায্যের প্রয়োজন।পুলিশ হলেও কি হবে অমৃতা এখনো মিমিকে খুব ভয় পায়।
মামি বলে মায়ের বিয়ের নহবত আর মেয়ের বিয়ের নহবত একদিনেই বাজবে,খরচ টা কিছু কমবে। সবাই হা হা করে হাসতে থাকে।