মাত্র দুটো ঘটনা
সারাদিন ধরে ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং করে বড় একটা ডিল ফিক্স করে ফেলে সমরেশ।এই ডিলটা নিয়ে সমরেশের কোম্পানীর কয়েকজন ভীষণভাবে উত্তেজিত।তারা আশাবাদী ছিলেন ডিলটার ব্যাপারে।
সমরেশের পিএ রুদ্রাণীর ওপর সমরেশের ভীষণ ভরসা। রুদ্রাণীও সেই ভরসার মর্যাদা দিতে কোন ফাঁক রাখে না।রুদ্রাণী জানে এই ডিলটা নিয়ে স্যার কতটা স্ট্রেসে ছিলেন সুতরাং এরপর একটা রিফ্রেশমেন্ট ভীষণ ইমপরটেন্ট। তাই তো বুদ্ধি করে “দ্য মোহিনী ইন” এ একটা পার্টির বন্দোবস্ত করেই রেখেছিলো রুদ্রাণী। খুব ক্লোজ নিয়ার এ্যান্ড ডিয়ার ছাড়াও অনেক বিজনেস পার্টনাররাও আমন্ত্রিত।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে সমরেশ অধিকারীর গাড়ি এগিয়ে চলেছে “দ্য মোহিনী ইন ” এ —
গাড়িটা ট্রাফিক সিগনালে আটকে যেতেই মেজাজটা কেমন যেন বিগড়ে যায় সমরেশের।
ঠিক তখনই গাড়ির কাঁচে ঠকঠক আওয়াজ।একরাশ বিরক্তি নিয়ে জানলাটা নামাতেই একটা বছর দশেকের বাচ্চা মেয়ে ” বাবু , বেল ফুলের মালা নাও না বাবু ।”
“না , না , ওসব মালা ফালা নেব না — যা এখান থেকে।”
মায়ামাখা কালো মুখখানি তখনও হাল ছাড়ে নি।
“নাও না বাবু মাত্র পনের টাকা — ঠিক আছে দশ টাকাই দাও “
মিষ্টার সমরেশ অধিকারীকে ফুটপাত বাসিন্দার থেকে পনেরো টাকার জিনিস দশটাকায় কেনার লোভ দেখানো ?
কি একটা ভেবে সমরেশ পকেট থেকে ওয়ালেট খুলতেই শুনতে পায় ” বাবু,তোমরা ফুলের গন্ধ নিলে আমরা ভাতের গন্ধ পাই।”–
কথাটা বোধগম্য হবার আগেই পয়সাটা নিয়ে ততক্ষণে ফুলওয়ালি অন্যগাড়ির দিকে ছুটে গেছে।
সিগনাল সবুজ হতেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির হর্ণে আর কিছুই শুনতে পায় না সমরেশ।
এমনতর মালা , গোলাপ মাঝে মধ্যে কেনে — খুব সখ করে কেনে তেমন নয় ঐ আর কি নাছোড়বান্দাদের হাত থেকে ছাড়া পেতেই কেনে ।
অন্যদিন এসমস্ত ফুলের মালা,ফুল ছুঁয়েও দেখে না —ইনফ্যাক্ট দেখার কথাও নয়।হয়তো বা গাড়ি থেকে নামবার সময় সেটা পড়ে গিয়ে পদপিষ্ঠ হয়ে যায় নতুবা পরদিন রবি গাড়ি পরিষ্কার করার সময় ডাষ্টবিনে ফেলে দেয়।
কিন্তু আজ সমরেশ মালাখানি নাকের সামনে এনে ঘ্রাণ নিয়ে চোখবন্ধ করেই বলে ” অপূর্ব “—
রবি স্যারের আচরণে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। পার্টি থেকে ফেরার সময় হলে অবশ্য ভ্যাবাচ্যাকা খেতো না কারণ বুঝতেই পারতো হয়তো দু এক পেগ বেশি হয়ে গেছে।
কিন্তু হঠাৎ কি এমন হলো —-
রবিকে বেল ফুলের মালাখানাকে গাড়ির সামনে রেখে দিতে বলে সমরেশ গাড়ি থেকে নামে।
“দ্য মোহিনী ইন “–এর দরজার সামনেই রুদ্রানী বিশালকায় একখানা তোড়া নিয়ে স্যারের জন্য অপেক্ষারত। অতিথি অভ্যাগতরাও দুজন একজন করে আসতে শুরু করেছেন।
সকলেই সমরেশকে কনগ্রেচুলেট করছেন। ওয়েটাররা ড্রিংক্স সার্ভ করছে সাথে রয়েছে ভেজ ননভেজ নানান ধরণের সার্টার।
রুদ্রাণী বরাবরের মতো পুরো দেখভালের দায়িত্বে আছে।মাঝে মধ্যে সমস্ত অতিথি অভ্যাগতদের সুবিধে অসুবিধে মতো অর্ডার করে চলেছে।
রাত বাড়বার সাথে সাথে পার্টিও জমে উঠেছে।
ডিজে ফ্লোরে চলছে একের পর ডান্স পারফরমেন্স — এক কথায় মশগুল সকলে ।
সমরেশ এসে অবধি গ্লাসে সেই যে একবার নিয়েছে সেটাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক আধবার চুমুক দিয়ে চলছে।
রুদ্রাণী স্যারের এই অন্যরূপ লক্ষ্য করেই বলে ” হোয়াট হ্যাপেন স্যার ? এনি থিঙ্ক রং?”
খুব স্মার্টলি সমরেশ রুদ্রাণীকে ” নাথিং — আই এম ইনজয়িং”—
সমরেশের চোখগুলো আজ এই পার্টিতে যেন অন্যকিছুই দেখতে পাচ্ছে যেখানে বারে বারে চোখে পড়ছে এক আধবার মুখে দেওয়া প্লেটের পর প্লেট পরিত্যাক্ত এঁটো খাবারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কেউ না কেউ এসে অতি যত্ন করে সেগুলোকে পরিষ্কার করে নিয়ে যাচ্ছে।
এমনি একজন সমরেশের পাশের টেবিল থেকে উচ্ছিট খাবার তুলতে তুলতে আপনমনে বলতে থাকে ” হে ভগবান কেন যে তুমি আমাকে দিয়ে এমন পাপ কাজ রোজ রোজ করাও — “
আজ সমরেশ অন্য এক সমরেশ।সব কথা সব দৃশ্যই যেন সব দেখতে পাচ্ছে।
কৌতুহল বশতঃ সেই মাঝবয়সী লোকটির কাছে গিয়ে বলে ” কি পাপ কাজ হচ্ছে বলো তো।”
সেই মানুষটির এবার থরহরি কম্প অবস্থা।
লম্বা জিভ কেটে বলে “না , না,স্যার ও কিছু না — আমার আপনমনে কথা বলার অসুখ আছে কি না তাই হয়তো কিছু বলে ফেলেছি।”
“তুমি জানো আজকের পার্টিটা আমিই দিচ্ছি — সেখানে পাপ হলে সেটা কি পাপ আমাকে তো জানতে হবে।”
“মাফ করুন স্যার , আমি জানতাম না আপনি পার্টি দিচ্ছেন। কি বলতে কি বলছি। মাফ করুন স্যার।আপনি যদি মালিকের কাছে বলে দেন তাহলে আমার চাকরিটা চলে যাবে স্যার। অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।”
ওদিকে এরমধ্যেই রুদ্রাণী বার কয়েক এসে সমরেশকে বলে গেছে “স্যার আপনি এখানে কি করছেন সবাই আপনাকে খুঁজছে তো —“
সমরেশ একটু হেসে বলে ” আজ তুমি আর একটু ওদিকটা সামলাও আমি একটুপরেই আসছি।”
সেই চাকরি হারাবার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ মানুষটির দিকে তাকিয়ে সমরেশ বলে ” বেশ তাই হবে আমি তোমার মালিককে কিছু বলবো না তবে একটা শর্তে।”
আমসির মতো শুকিয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে ” কি শর্ত স্যার ?”
“তুমি কোন পাপ কাজের কথা বলছিলে।”
মাথা নিচু করে মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলে ” স্যার প্রতিদিন এখানে পার্টি হয়। আর মানুষ যত না খায় তার থেকে বেশি খাবার নষ্ট করে। খাবার নষ্ট করা তো পাপ। আর আমি সেই নষ্ট খাবার ডাষ্টবিনে ফেলি — তারমানে আমিও তো পাপ কাজের সাথী।”
সমরেশ মানুষটিকে আশ্বস্থ করে বলে তুমি এসো এবার।
কোনরকমে সেই মানুষটি যেন পালিয়ে বাঁচে।
সমরেশ অতিথিদের সামনে গিয়ে মাইক হাতে নিয়ে ” লেডিজ এ্যান্ড জেন্টেলম্যান আমি এখন একটা এ্যানায়ুন্সমেন্ট করতে চলেছি সবাই একটু মন দিয়ে শুনবেন প্লিজ —“
সবাই হাততালি দিয়ে সমরেশ অধিকারীর এ্যানায়ুন্সেমন্টের অপেক্ষায়—-
“লেডিজ এ্যান্ড জেন্টেলম্যান আপনারা আপনাদের প্রয়োজনীয় খাবারটুকুই প্লেটে নিন। তার থেকে বেশি নয়।প্রয়োজনে বারে বারে নিন। অযথা একসাথে একগাদা খাবার প্লেটে নিয়ে খাবার নষ্ট করবেন না — খাবার নষ্ট করা পাপ। আজ এই শুভদিনে আমি কোন পাপকাজের সাথী হতে চাই না।”
সমরেশ অধিকারীর মতো বিত্তশালী ব্যাক্তির পার্টিতে এমন বেইজ্জতি যে অতিথি অভ্যাগতদের পছন্দ হবে না এটাই স্বাভাবিক।
ধীরে ধীরে পার্টি হালকা হতে শুরু করে। মেইন কোর্স তখনও থরে থরে সাজানো।
রুদ্রাণী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে “স্যার এটা আপনি কি করলেন ? আপনার রেপুটেশন কতটা ড্যামেজ হলো স্যার। “
“দেখো নেম , ফেম , মানির পেছনে ছুটে ছুটে একটা জিনিস একদম ভুলতে বসেছিলাম।আজ দু দুটো ঘটনা আমার স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলেছে — আমি এতেই ভীষণ খুশি।”
সমরেশ মেইন কোর্সের খাবারগুলো প্যাক করিয়ে রেষ্টুরেন্টের সমস্ত সাফাইকর্মীদের হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা করে।আর সাথে পরেরদিনের জন্য কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে আসে।
পরেরদিন একই সময় সেই ট্রাফিক সিগনালে এসে পৌঁছে গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এদিকে ওদিকে কাকে যেন খুঁজতে থাকে সমরেশ অধিকারী।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দূরে দেখতে পায় খুঁজতে থাকা মানুষটিকে।
হাত দিয়ে ইশারায় ডাকতেই মেয়েটি ছুটে এসে “বাবু , আজ কিন্তু দশটাকায় মালা দিতে পারবো না।কিনেছিই বারো টাকায়—“
সমরেশ বলে ” আমি যদি আজ তোর থেকে বিশ টাকা করে কিনি — “
“না , বাবু — সেটাও পারবো না। “—
“সে কি রে ?— কেন?”
“মা বলেছে ব্যবসা সবসময় সততার সাথে করতে হয় মানুষ ঠকিয়ে নয়। তাই যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই নিতে হয়।”
ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির কথা শুনে স্যালুট করতে ইচ্ছে করছিল সমরেশের।
মেয়েটির হাতের সব মালা গুলো কিনে নিয়ে সমরেশ বাকি পয়সা বুঝে নিতে বাচ্চাটির মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
“শোন কাল তুই বলছিলি না তোমরা ফুলের গন্ধ নিলে আমরা ভাতের গন্ধ পাই।”
পয়সা ট্যাঁকে গুঁজতে গুঁজতে বলে ” হ্যাঁ বলেছি ই তো “–
“এবার তুই আমার দেওয়া প্যাকেটের স্বাদ নিলে আমি হারিয়ে যাওয়া একটা জিনিসের স্বাদ পাব — নিবি ?
মিষ্টি হাসি হেসে বলে “কিসের প্যাকেট গো —“
“তার আগে তুই দৌঁড়ে গিয়ে তোর বন্ধুবান্ধবদের ডেকে নিয়ে আয় দেখি।”
“পুঁটি , নান্টু , পটলা , কমলি , বিন্তি — একবার এইদিকে আয় দেখি বলে একটা সিটি মারতেই এরা সবাই এসে হাজির হয়।”
“কিরে ? কি হয়েছে ? এই গাড়িওয়ালা বাবু করেছে? বল বল তাড়াতাড়ি বল ?”—
“নারে কিছু করে নি তবে এবার কিছু করবে বলছে।”—
ডিকি থেকে প্যাকেট করা খাবার গুলো বাচ্চাগুলোর হাতে তুলে দিয়ে যে তৃপ্তি সমরেশ পায় তা এতদিনের বড় বড় পার্টিতেও পায় নি।
এরপর থেকে সমরেশ অধিকারীর পার্টির ঠিকানাটা “দ্য মোহিনী ইন ” বদলে পাঁচমাথার মোড়ের এই ট্রাফিক সিগনাল হয়ে যায়।
তবে ময়না , বিন্তি ,পুঁটি ,.নান্টু পটলারাও কেউ খালি হাতে আসে না পার্টিতে কার হাতে থাকে জংলী ফুল দিয়ে তৈরী করা তোড়া , কারোর হাতে নিজের হাতে বানানো পরিত্যাক্ত কোন জিনিসের অপূর্ব শিল্প কর্ম।কেউ বা সমরেশকে ভাঙা থালার সাথে লাঠি দিয়ে মিউজিক কম্পোজ করে শোনায় নিজের গাঁথা গান।
মনুষত্ব ফিরে পেয়ে সমরেশ অধিকারী বুঝেছে এই মানুষগুলোর কাছে আত্মমর্যাদা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ — তাই এদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অত্যন্ত সন্তর্পনে পাছে এদের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়।