জামিরের ঘন বন অইখানে রচেছিলো কারা?
এইখানে লাগে নাই মানুষের হাত।
দিনের বেলায় যেই সমারূঢ় চিন্তার আঘাত
ইস্পাতের আশা গড়ে- সেই সব সমুজ্জ্বল বিবরণ ছাড়া
যেন আর নেই কিছু পৃথিবীতেঃ এই কথা ভেবে
যাহারা রয়েছে ঘুমে তুলীর বালিশে মাথা গুঁজে;
তাহারা মৃত্যুর পর জামিরের বনে জ্যোৎস্না পাবে নাকো খুঁজে;
বধির-ইস্পাত খড়্গ তাহাদের কোলে তুলে নেবে।
সেই মুখ এখনও দিনের আলো কোলে নিয়ে করিতেছে খেলাঃ
যেন কোনো অসংগতি নেই- সব হালভাঙা জাহাজের মতো সমন্বয়
সাগরে অনেক রৌদ্র আছে ব’লে;- পরিব্যস্ত বন্দরের মতো মনে হয়
যেন এই পৃথিবীকে;- যেখানে অঙ্কুশ নেই তাকে অবহেলা
করিবে সে আজো জানি;- দিনশেষে বাদুড়ের-মতন-সঞ্চারে
তারে আমি পাবো নাকো;- এই রাতে পেয়ারার ছায়ার ভিতরে
তারে নয়- স্নিগ্ধ সব ধানগন্ধী প্যাঁচাদের প্রেম মনে পড়ে।
মৃত্যু এক শান্ত ক্ষেত- সেইখানে পাবো নাকো তারে।
পৃথিবীর অলিগলি বেয়ে আমি কত দিন চলিলাম।
ঘুমালাম অন্ধকারে যখন বালিশেঃ
নোনা ধরে নাকো সেই দেওয়ালের
ধূসর পালিশে
চন্দ্রমল্লিকার বন দেখিলাম
রহিয়াছে জ্যোৎস্নায় মিশে।
যেই সব বালিহাঁস ম’রে গেছে পৃথিবীতে
শিকারির গুলির আঘাতেঃ
বিবর্ণ গম্বুজে এসে জড়ো হয়
আকাশের চেয়ে বড়ো রাতে;
প্রেমের খাবার নিয়ে ডাকিলাম তারে আমি
তবুও সে নামিল না হাতে।
পৃথিবীর বেদনার মতো ম্লান দাঁড়ালামঃ
হাতে মৃত সূর্যের শিখা;
প্রেমের খাবার হাতে ডাকিলাম;
অঘ্রাণের মাঠের মৃত্তিকা
হ’য়ে গেলো;
নাই জ্যোৎস্না- নাই কো মল্লিকা।
সেই সব পাখি আর ফুলঃ
পৃথিবীর সেই সব মধ্যস্থতা
আমার ও সৌন্দর্যের শরীরের সাথে
ম্যমির মতনও আজ কোনোদিকে নেই আর;
সেই সব শীর্ণ দীর্ঘ মোমবাতি ফুরায়েছে
আছে শুধু চিন্তার আভার ব্যবহার।
সন্ধ্যা না-আসিতে তাই
হৃদয় প্রবেশ করে প্যাগোডার ছায়ার ভিতরে
অনেক ধূসর বই নিয়ে।
চেয়ে দেখি কোনো-এক আননের গভীর উদয়ঃ
সে-আনন পৃথিবীর নয়।
দু-চোখ নিমীল তার কিসের সন্ধানে?
‘সোনা- নারী- তিশি- আর ধানে’-
বলিল সেঃ ‘কেবল মাটির জন্ম হয়।’
বলিলামঃ ‘তুমিও তো পৃথিবীর নারী,
কেমন কুৎসিত যেন,- প্যাগোডার অন্ধকার ছাড়ি
শাদা মেঘ-খরশান বাহিরে নদীর পারে দাঁড়াবে কি?’
‘শানিত নির্জন নদী’- বলিল সে- ‘তোমারি হৃদয়,
যদিও তা পৃথিবীর নাদী- ন্দী নয়ঃ
তোমারি চোখের স্বাদে ফুল আর পাতা
জাগে না কি? তোমারি পায়ের নিচে মাথা
রাখে না কি? বিশুস্ক- ধূসর-
ক্রমে-ক্রমে মৃত্তিকার কৃমিদের স্তর
যেন তারা; -অপ্সরা –উর্বশী
তোমার উৎকৃষ্ট মেঘে ছিলো না কি বসি?
ডাইনির মাংসের মতন
আজ তার জঙ্ঘা আর স্তন;
বাদুড়ের খাদ্যের মতন
একদিন হ’য়ে যাবে;
যে-সব মাছিরা কালো মাংস খায়- তারে ছিঁড়ে খাবে।’
কান্তারের পথে যেন সৌন্দর্যের ভূতের মতন
তাহারে চকিত আমি করিলাম;- রোমাঞ্চিত হ’য়ে তার মন
ব’লে গেলোঃ ‘তক্ষিত সৌন্দর্য সব পৃথিবীর
উপনীত জাহাজের মাস্তুলের সুদীর্ঘ শরীর
নিয়ে আসে একদিন, হে হৃদয়,- একদিন
দার্শনিকও হিম হয়- প্রণয়ের সম্রাজ্ঞীরা হবে না মলিন?’
কল্পনার অবিনাশ মহনীয় উদ্গিরণ থেকে
আসিল সে হৃদয়ের। হাতে হাত রেখে
বলিল সে। মনে হ’লো পাণ্ডুলিপি মোমের পিছনে
রয়েছে সে। একদিন সমুদ্রের কালো আলোড়নে
উপনিষদের শাদা পাতাগুলো ক্রমে ডুবে যাবে;
ল্যাম্পের আলো হাতে সেদিন দাঁড়াবে
অনেক মেধাবী মুখ স্বপ্নের বন্দরের তীরে,
যদিও পৃথিবী আজ সৌন্দর্যেরে ফেলিতেছে ছিঁড়ে।
প্রেম কি জাগায় সূর্যকে আজ ভোরে?
হয়তো জ্বালায়ে গিয়েছে অনেক- অনেক বিগত কাল,
বায়ুর ঘোড়ার খুরে যে পরায় অগ্নির মতো নাল
জানে না সে কিছু,- তবু তারে জেনে সূর্য আজিকে জ্বলে।
চীনের প্রাচীর ভেঙে যেতে-যেতে-
চীনের প্রাচীর বলেঃ
অনেক নবীন সূর্য দেখেছি রাতকানা যেন নীল আকাশের তলে;
পুরোনো শিশির আচার পাকায় আলাপী জিভের তরে;
যা-কিছু নিভৃত- ধূসর- মেধাবী- তাহাদের রক্ষা করে;
পাথরের চেয়ে প্রাচীন ইচ্ছা মানুষের মনে গড়ে।
অথবা চীনের প্রাচীরের ভুল- চেনেনি নিজের হাল;
কিংবা জ্বালায়ে গিয়েছে হয়তী অনেক বিগত কাল;
অগ্নিঘোড়ার খুরে যে পরায় জলের মতন নাল
জানে না সে কিছু,… তবু তারে জেনে সূর্য আজিকে জ্বলে;-
ববিনে জড়ানো মিশরের ম্যমি কালো বিড়ালকে বলে।