ভুল, না ভুল
প্রত্যন্ত এক গাঁয়ের কথা বলি। রাজচন্দ্রপুর। সেখানে সিতাপুর পাড়ায় খুব দারিদ্র্যের সংসারে বাবা-মার সাথে টুনা আর বীথি দুই যমজ বোনের বাস। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তবু মনুষ্যপ্রাণ বলে কথা।
কুশলবাবু সামান্য লেবারের কাজে ব্যস্ত। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যৎসামান্য উপার্জনে দিন গুজরান। এত অভাবেও ওনার সদাহাস্যময় মুখটা সত্যি তারিফ করার মতন। বাড়ির কর্ত্রী নির্জলাও কর্তার সাথে ছন্দ মিলিয়ে চলে।
এর মধ্যেই টুনার আবদার, বাবা, আমার সুগন্ধি তেল, দামি সেন্ট, লিপস্টিক,কাজল, চুলের ফিতে দরকার।
বীথিও বোনের সাথে গলা মেলায়। এ যে ভারী বজ্রপাত! কোথায় মিলবে অত টাকা? কুশলবাবু মগজে হাত বুলিয়ে ভাবনার অতলে তলিয়ে যায়।
নির্জলাও স্বামীর চিন্তিত মুখখানা দেখে হতবাক হয় না। এমন অবস্থা আগেও বহুবার এই সংসারে থাবা বসিয়েছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়।
এবার শান্ত স্বরে বললেন, এখন এতসব কি করে আনব মা? সবই তো জানিস।
সেই আগের মতন টুনা বিমর্ষ হয়ে যায়। বীথিরও মুখমন্ডলে কালো মেঘের চলাচল।
কেমন এক অস্বস্তি দুজনাকেই ঘিরে ধরে! অপ্রাপ্তির এক ভয়ানক ছোবলে দুই বোনই পর্যুদস্ত।
সেখান থেকে মুক্তি আসবে কি করে? এ যে লাখ টাকার প্রশ্ন!
টাকা-টাকা-টাকা।অর্থাভাবের বিকট দৈত্যটা যেন গোগ্ৰাসে গিলতে আসে।
এদিকে বয়োঃবৃদ্ধির সাথে সাথে শরীর ও মনে হিল্লোলের স্রোতে বসন্তের ফুরফুরে আমেজে দুজনেই ভাসছে।
টুনা কয়েক মিনিটের বড়বোন। সে-ই পাড়ার এক উঠতি ছোকরার চোখে ধরা দেয়। অবশ্যম্ভাবী রতিপতির আগ্ৰাসন কি এড়ানো যায়?
এমন ফাঁদ থেকে মুক্তিও অসহজ। তবুও বাঁচবার জন্য টুনা যেন মরীয়া। সুশ্রী, আয়তচোখের অধিকারিণী মেয়েটি অন্তত অভাবের তাড়না থেকে বাঁচবে! ওই ছেলেটা অতি ধনবানের একমাত্র সন্তান। তাই অনুমান, চারচক্ষুর মিলন হলে অর্থকষ্ট হবে না। প্রতিদিন আড়ালে-আবডালে দুজনের সাক্ষাৎ চলতে থাকে।
কথার ছলে কুদ্দুস বলে, চলো না টুনা, ওই রাজপাড়ার পার্কে গিয়ে বসি।
-চলো।
ওই ছেলেটির সাথে দিদির চলে যাওয়া বীথিও তীক্ষ্ণ নজরে দেখে।
এদিকে পার্কে বসে কুদ্দুস বলে, খুব কষ্ট না তোমাদের!
-হ্যাঁ।
-কি করবে তুমি ঐ অভাব থেকে বাঁচতে?
-মানে?
-আমি তোমাকে যদি উদ্ধার করি।
টুনা এর মর্মার্থ বুঝতে পারে। কোনভাবে ফেঁসে যাবে না তো?
দুজনার মন দেওয়া নেওয়া চলল বছর খানেক ধরে। তারপরে একদিন পরিণয়। বাবা-মাও কোনো বাধা দেয় নি।
বেশ কিছুদিন সংসার যাপনের পর টুনা বোঝে, সে এক মহা জালিয়াতির ফাঁপরে পড়েছে।
কুদ্দুসের এক গোপন চক্র আছে। এর কাজই হচ্ছে নারী পাচার। আর ওর রোজগার সেখান থেকেই। আর শেষ পর্যন্ত সেই নারীর পতিতালয়ে স্থান। এক্ষেত্রে টুনারাও জীবনে সেই ভয়ংকর সত্যতা বাস্তবে পরিণত হয়। সেও এক ব্যক্তির হাত ঘুরে মুম্বাইয়ের এক বেশ্যালয়ে।
ভয়াবহ অনটনের সাক্ষী থেকে সুখের সন্ধানে এসে এই চরম পরিণতি।
এখানে মাসির কড়া শাসনে অবাধ্য হওয়া না-মুনকিন। অন্যথা বেদম প্রহার আর অশ্রাব গালাগালি।
বাবুদের কাছে যে টাকা পায়, তার সিংহভাগটা মালকিন ছিনিয়ে নেয়।
কি করবে? এখানেও সেই অভাবের হাতছানি?
আর নরকের অসহ্য যন্ত্রণা উপরি পাওনা। মা-বাবা আর বোনের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু সেখানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অতঃপর তীর্থের কাকের মতন উজ্জ্বল দিবালোকের প্রত্যাশায় টুনাকে থাকতেই হবে।