ভাত ঘুম
রোববার দুপুর বেলায় একটা ভাত ঘুম আমায় আচ্ছন্ন করে, বলতে পারেন এটা আমার একটা হবি। অন্যদিনের থেকে রোববার একটা বিশেষ আলাদা দিন, একটু ভালো মন্দ খাবার দিন। আর এই ভালো মন্দ খাওয়ার পরে খবরের কাগজের গল্পের পাতাটা চোখের সামনে মেলে ধরে চিৎ হয়ে শুলেই রাজ্যের ঘুম পাড়ানি মাসি পিসিরা দুচোখ ভরে ঘুম জড়িয়ে দিতে হাজির হয়। ওদের ঠেকাতে পারিনা কিছুতেই, কিন্তু আজ প্রতিজ্ঞা করেছি ওদের ঠেকাবই। কাগজ অবশ্যই চোখে দেবো, তবে চিৎ হবোনা। সেইমতো বিছানায় না গিয়ে টেবিল চেয়ারে বসলাম, সামনের জানলা টা খুলে দিতেই দখিনা বাতাস এসে ঝাপটা মারলো। একটু দূরে অম্বুজার বাড়ি গুলো দেখা যাচ্ছে, বিশাল উচ্চতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে মানুষ জন বড়ো একটা দেখা যায় না। নিম গাছের ডালে একটা বউকথাকও পাখি এসে বসলো। আমি গভীর মনোযোগ সহকারে দ্বারভাঙ্গা মহারাজের কালী মন্দিরের উপাখ্যান পড়ছি। আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো, রিংটোন টা ভারী সুন্দর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই রাত তোমার আমার। এটা শুনলেই আমার বহু পুরাতন ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতি গুলো সামনে এসে দাঁড়ায়, আমার চোখ দুটো ক্রমশ ই ঝাপসা হয়ে আসে।
বোতাম টিপে হ্যালো বলতেই এক মহিলার কন্ঠস্বর, কোনো ভণিতা না করেই বললো, তুমি কি আমায় সত্যিই ভুলে গেলে, ঠিক আছে বাবা অন্যায় টা না হয় আমিই করেছি, তোমাকে লুকিয়ে বিয়ে করেছি, আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজ, আমাকে একটা সুযোগ দাও, অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি প্রস্তুত। আমি তোমার কাছেই ফিরে যেতে চাই। মহিলা অনর্গল আরও কিছু বলে চলেছেন, আমার ব্রহ্মতালু দপদপ করছে, গলাটা চেনা লাগছে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিনা। বললাম, কে আপনি, কি আবোলতাবোল বকছেন?
আমাকে স্তম্ভিত করে মহিলা আবার বললেন, অনিমেষ, আমি সঠিক জায়গাতেই আমার আবেদন পেশ করেছি। তুমি কি ভাবলে, আমি ভুল জায়গায় নিজেকে অনাবৃত করেছি?
এটা শীলার এক বিশেষ বাচনভঙ্গী। ও বরাবরই একনাগাড়ে অনেক কথা বলে, উত্তরের অপেক্ষা না করেই। আমি জানি অভিমানিনী শীলা কতো অনায়াসে আমার মন জয় করে নিতে পারে। শীলাও আমার মনের এই দুর্বলতা জানে। ভাবছি, শীলা এতোদিন পরে আমার সেই দুর্বলতাকে মূলধন করতে চাইছে না তো? মুখে বললাম, আজ এতোদিন পরে অনিমেষ কে মনে পড়লো হঠাৎ!
হঠাৎ নয় গো হঠাৎ নয়, ভাবছো তোমার নম্বর পেলাম কোথা থেকে? সেদিন লেনিন সরণীতে তোমাকে দেখলাম, গাড়ি নিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেলে। আমি তো জানি তোমার অফিস টা কোথায়, তুমি যে অন্য কোথাও বদলি হওনি সেটা তোমার অফিস থেকেই নিশ্চিত হয়েছি। তারপর তোমার নম্বর পাওয়াটা আমার কাছে কোনো ব্যাপার ই নয়।
বললাম, বেশ তো, নাম্বার পেয়ে ফোন করেছ ভালো কথা, কিন্তু প্রথমেই অমন নাটক করলে কেন?
শীলা বললো, অনিমেষ, তুমি তো এখন নাটকের কথাই বলবে, অথচ একটা সময় ছিলো, আমার নাটক দেখার জন্য দিনরাত, সকাল সন্ধ্যে এমনকি ভোরের বেলাতেও হাপিত্যেশ করতে। বলো, করতে না?
বললাম,ঝেড়ে কাশো, ভণিতা না করে সরাসরি বলো কি বলতে চাও।
শীলা বললো, অনিমেষ, তোমাকে আমার ভীষণ দরকার। টেলিফোনে সব কথা হবেনা, তুমি আমাকে একটু সময় দেবে অনিমেষ? তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে, জানি তুমি সাংঘাতিক রেগে আছো, কিন্তু একথা হলফ করে বলতে পারি আমি পরিস্থিতির শিকার মাত্র। স্বেচ্ছায় আমি কিছু করিনি।
শীলা নিজে ফোন করেছে, অনুতপ্ত হয়েছে, মিনতি করছে, আর আমি হৃদয়হীনের মতো বলে দেবো আমার সময় হবে না! অতো বড়ো পাষণ্ড আমি নই।
আজ শনিবার, শীলার সাথে দেখা করার সেই নির্দিষ্ট দিন। ম্যান অব ওয়র জেটির কাছে নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছি। শীলা বরাবরই দেরি করে আসে। ওর জন্যে অপেক্ষা করা আমার অভ্যাস আছে। বসে বসে নদীর ঢেউ গুনছি, সুন্দর সুন্দর গাছ গুলোর পাতা নড়া দেখছি, গোয়লিয়র মনুমেন্টের রেস্তোরাঁয় সুখী সুখী মানুষ জন দেখছি, পায়চারি করছি, ঘড়ি দেখছি, মাঝি দেখছি। হুস করে গায়ের কাছ দিয়ে চক্র রেলের চলে যাওয়া দেখছি। মাঘ মাস, বাতাসে শির শিরানি আছে, পড়ন্ত রোদের ঝিলিমিলি নদীর জলে। জেটিতে দাঁড়ানো বিদেশি জাহাজটায় ঢোকার অনুমতি পত্র আমার কাছে আছে। আজ ইচ্ছে করছে না, শীলা আসবে। রোদ পড়ছে, গাছ গাছালির সাথে আমার ছায়াও প্রলম্বিত হচ্ছে। পশ্চিমের আকাশ ক্রমশ সিঁদুরে হয়ে উটছে, জলে সেই সিঁদুরের আভাস। শীলার দেখা নেই।
হাঁটতে হাঁটতে আউট্রাম ঘাটের কাছে পৌঁছে গেলাম। কাটা ফল বিক্রি হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগকে কলা দেখিয়ে। লুচি ভাজা হচ্ছে। মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে। ছোলা বাদাম ভাজা হচ্ছে, শীলার খুব প্রিয় খোসাসমেত বাদাম ভাজা। বেশ খানিকটা কিনলাম, শীলার সাথে আমিও মুখ চালাবো। কতোদিন পরে যে ওর সান্নিধ্য পাবো। মনের মধ্যে শিহরণ হচ্ছে, কতো কথা জমে আছে, কতো ব্যথা জমাট বেঁধেছে, কতো অভিমান গুমরে আছে। আমাদের হেঁটে যাওয়া কতো পথ ইতিহাস হয়ে গেছে।
দেখা হলে শুরুটা করবো কীভাবে তার রিহার্সাল দিচ্ছি মনে মনে। বেশী করে মনে হচ্ছে, ও হঠাৎ এতোদিন পরে আমার সাথে দেখা করে কি বলতে চায়? কী চায় ও আমার কাছে? ও এখন অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী। আমি নিজে যদিও এখনো অবিবাহিত, বলা যায় শীলার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েই। তারপর থেকে মেয়েদের প্রতি আমার একটা অবিশ্বাস জন্মে গেছে। বাড়িতে অন্য কিছু জানে,ভাবে, বাউন্ডুলে, তাই বিয়ে করতে চায় না।
হাজারো প্রশ্ন এবং তার সম্ভাব্য উত্তর মনে মনে সাজাচ্ছি আর শীলার আসার সম্ভাব্য রাস্তার দিকে এগিয়ে চলেছি। আগ বাড়িয়ে ওকে রিসিভ করবো।
ওইখানে রাস্তায় জটলার মধ্যে থেকে হঠাৎই গেলো গেলো চীৎকার, হুটোপুটি, দৌড়াদৌড়ি। একজনকে পিষে দিয়ে একটা বাস উর্ধশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে। পিছনে পাবলিক ছুটছে, দৌড়ে গেলাম, ভীড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখে স্তম্ভিত, শীলা নয়তো! মুখটা ওপাশে ঘোরানো, রক্তক্ষরণ টা না দেখলে মনে হবে কোনো মহিলা মনের ভুলে রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন। মনের মধ্যে উথাল-পাথাল হচ্ছে। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম, খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম, শীলার মতো ই দেখতে কিন্তু শীলা নয়।
এতোক্ষণ মনের মধ্যে যে ভয়ানক উৎকন্ঠা ছিলো, দম বন্ধ করা বাতাসটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে যেতেই শরীরে একটা ক্লান্তি অনুভব করলাম। চাপা পড়া মেয়েটি শীলা নয়, এই বোধটা তীব্রতর হতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। পুলিশ এসে গেছে, ওরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো, বললো, আপনার কেউ?
আমি বললাম, না, আমার কেউ নয়।
ওরা আবার জিজ্ঞেস করল, তাহলে ওভাবে কি দেখছিলেন? বললাম, আমার পরিচিত একজনের সাথে মিল খুঁজছিলাম।
ওরা আমাকে আর আমল দিলো না, ক্যামেরায় ছবি তুললো, কি সব মাপজোখ করলো, তারপর দেহটি তুলে নিয়ে চলে গেলো।
ভীড় পাতলা হতে শুরু করেছে, লোকজন সরে যাচ্ছে, বাসের দোষ না কন্ডাকটরের দোষ, নাকি মহিলার উল্টো দিকে নামার চেষ্টা ইত্যাদি আলোচনায় জায়গা টা সরগরম। আমার হাতে গরম বাদামের ঠোঁঙা। সরে আসছি, আপন মনে ফিরে চলেছি ম্যান অব ওয়র জেটির দিকে।
জেটির কাছে বয়ার সঙ্গে বাঁধা আছে একটা ছোট রিলিফ লঞ্চ, ছোট একটা ডিঙিতে চেপে কতো দিন ওখানে গেছি আমি আর শীলা। আমার পিসেমশাই আছে ওই লঞ্চে, কতোবার যে আমাদের তোপসে মাছের ঝোল খাইয়েছে নদী থেকে টাটকা ধরে। পুরানো কথা মনে পড়ছে। শীলা কিন্তু এখনো আসেনি।
পনেরো বছরের পুরানো সম্পর্ক, আজ সামনে আসবে বলেছে, বুকের মধ্যে একটু গুরগুরানি তো আছেই। শীলা বরাবরই দেরি করে আসতো বটে, কিন্তু এতো দেরি কখনও করতো না। ভারাক্রান্ত মনে আমাদের সেই পুরানো জায়গায় বসলাম।
মাঝিদের নৌকা থেকে পুরানো সেই দিনের কথা গানটা ভেসে আসছে। মন কু গাইছে। মন মনকে বলছে, আজ আর শীলার সাথে পুরানো সেই দিনের কথা হবে না, শীলা আসবে না। চোখ বলছে, আর একটু দেখ না, আসতেও তো পারে।
দেখতে দেখতে রাত ন’টা বাজলো, শীলা সত্যিই এলো না। হতাশ হলাম, বিরক্ত হলাম, ক্রুদ্ধ হলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, এই শেষ, সম্পর্ক টা তো শীলাই চুকিয়েছে, প্রেম করবো কবির সাথে আর বিয়ে করবো বণিকের সাথে! স্বার্থপর, ডাহা স্বার্থপর। গোটা নারীকূলের প্রতিই মনটা গভীর বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো।
গা ঝাড়া দিলাম, প্রতিজ্ঞা করলাম, নারীজাতির প্রতি কখনোই আর দুর্বলতা প্রকাশ করবো না। আসলে এতোদিনকার পুরানো সম্পর্ক, ওইভাবে বিট্রে করার পরেও মুখের উপর না বলতে না পারার দরুন নিজেকে খিস্তি করতে ইচ্ছে করছে। নিজেই নিজেকে টিটকারি দিলাম, কি অনিমেষ, কানমলা টা খেলে তো? এই নাকি তুমি সংযমী হয়েছ, বিয়ে করবে না বলে ধনুর্ভাঙা পণ করেছ, আর পনের বছর পরে শীলার এক ডাকে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে এক ঠ্যাং তুলে ভাসিয়ে দিলে? নিজেই নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করছে। বেহালা গামী বাসের দেখা পেয়ে ইচ্ছেটা আপাতত ঠেকানো গেল।
বেহালা ট্রাম ডিপোয় নেমে ইউনিক পার্কের রাস্তাটা হেঁটেই মেরে দেবো। গুরুতর কোনো কারণ না ঘটলে রিক্সায় চড়া পছন্দ করি না। কিন্তু এতো ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়িতেও ঢুকতে ইচ্ছে করছে না, ভাবলাম ঢালীপাড়া দিয়ে যাই। সুব্রত যদি তার সরিষার বাড়িতে না গিয়ে থাকে তবে ওর ওখানে খানিক জুড়িয়ে তবে বাড়ি যাবো, চাই কি ওর ওখানে রাত্তিরটা থেকেই যেতে পারি। সুব্রত বাড়িতেই দিব্যি আছে, ব্যাংকের চাকরি, খায় দায় ঘুরে বেড়ায়, এখনো বিয়ে থা করেনি, তবে মেয়ে দেখা চলছে।
দরজায় টোকা দিতেই সুব্রত বললো, খোলা আছে, ভিতরে আয়। বোস, তোর জন্যে একটা খারাপ খবর আছে। সুব্রতর কথায় আমল দিলাম না, বললাম, আমার মনে যে অসন্তোষের আগুন জ্বলছে তাকে আগে নেভানোর ব্যবস্থা কর, কি আছে বের কর। সুব্রত বললো, আগে হাত মুখ ধো, স্থির হয়ে বস।
আমি কিন্তু অধীর, বললাম, ছাড়তো, হাত মুখ ধোয়া, শুধু জলে আমার মনের আগুন নিভবে না, ভালো কিছু থাকলে বের কর, সঙ্গে ভাজাভুজি কিছু থাকলে আন। সুব্রত বোতল বের করলো, বললো, কাজু কিসমিস আছে ওই দিয়ে চালিয়ে নে।
টেবিলে দুজন মুখোমুখি বসলাম, লম্বা এক চুমুক মেরে ওকে বললাম, তোর খারাপ খবরের থেকে আমার খারাপ খবর টা বেশি খারাপ। আগে সেটা শোন।
সুব্রত বুঝলো আমি ভীষণ উত্তেজিত, আমাকে শান্ত করার জন্যেই ও আমার অত্যন্ত প্রিয় দেবব্রত বিশ্বাসের গান চালিয়ে দিলো। প্রথম গান শুরু হলো, এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে। গানটা কান পেতে শুনলাম, মন খানিক টা শান্ত হলো। এরপরে সবিস্তারে শীলার ফোন, ম্যান অব ওয়র জেটিতে অপেক্ষার দীর্ঘক্ষণ, সব ঘটনাই ওকে জানালাম। সুব্রত গুম হয়ে সবই শুনলো। আমার আশা, আনন্দ, রাগ, দু:খ, আঘাত, অভিমান, প্রতিজ্ঞা, প্রতিশোধ স্পৃহা সব কিছু শোনার পর খুব নিরুত্তাপ গলায় শান্ত ভাবে সুব্রত বললো, শীলা তোকে কবে ফোন করেছিলো?
বললাম, কেন রোববার দুপুর নাগাদ। আজ শনিবার আমাদের দেখা করার কথা।
সুব্রত আরও শান্ত ভাবে বললো, শীলা অনেক দিন ধরেই ভুগছিল, জরায়ুতে ক্যান্সার, অনেক পরে ধরা পড়েছিল, ডাক্তারদের কিছু করার ছিলো না। গেলো রোববার ভোরে ও মারা যায়।
শোনা মাত্রই আমার হাতেধরা কাঁচের গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। গ্লাস ভাঙার শব্দে ধড়মড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। পেপার ওয়েট টা টেবিলের তলায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, সম্বিত ফিরলো। আজ বিছানায় নয় ভাত ঘুমটা টেবিলেই সারা হয়েছে।।