Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভাই ভাই || Sharadindu Bandyopadhyay

ভাই ভাই || Sharadindu Bandyopadhyay

বাপ মারা যাবার পর দুমাস কাটতে না কাটতেই দুই ভায়ে তুমুল ঝগড়া বেধে গেল। বড় ভাই দুগদাসের বয়স ঊনত্রিশ, ছোট ভাই চণ্ডীদাস বছর তিনেকের ছোট। দুজনেই বিবাহিত, কিন্তু এখনো ছেলেপুলে হয়নি।

দুর্গাদাসের মেজাজ স্বভাবতই গরম, সে-ই ঝগড়া বাধালো। কিন্তু এক পক্ষের তর্জন-গর্জন শুনতে শুনতে অপর পক্ষও গরম হয়ে ওঠে। চণ্ডীদাসও চিৎকার শুর করল। দুই বউ ভয়ে জড়সড় হয়ে রইল। একটা কথা বলতে হবে, ভায়ে ভায়ে ঝগড়ার জন্য বউদের কোনও দায়-দোষ ছিল না। দুই বউ-এর মধ্যে গভীর প্রীতি ছিল।

পাড়ার বয়স্থ ব্যক্তিরা এসে ঝগড়া থামালেন। কিন্তু বিরোধ মিটল না। বাপ অনেক বিষয়-সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন, শহরের মাতব্বরেরা বসে সম্পত্তি ভাগ করে দিলেন। বড় ভাই। দুর্গাদাস সাবেক বসতবাড়ি পেল, শহরের অন্য প্রান্তে আর একটা বাড়ি ছিল, সেটা চণ্ডীদাসের ভাগে পড়ল। সে স্ত্রীকে নিয়ে অন্য বাড়িতে চলে গেল। যাবার আগে দুই বউ রেবা আর শান্তা পরস্পরের গলা জড়িয়ে খুব কাঁদল।

তারপর দীর্ঘকাল দুই ভায়ের মধ্যে আর মুখ দেখাদেখি নেই। কেউ কারুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে

। কিন্তু ছোট শহরে মজা-দেখা বন্ধু অনেক থাকে, তারা গিয়ে দুজনকে দুজনের খবর শোনায়। চণ্ডীদাস চুপ করে শুনে যায়, দুর্গাদাস গলার মধ্যে গরগর করে।

ওহে শুনছ, চণ্ডীদাস নতুন মোটর কিনেছে। দুর্গাদাস বলে—কিনেছে তো কিনেছে, আমার তাতে কি! তোমারও কেনা উচিত। ও কিনেছে ফিয়েট; তুমি বড়, তোমার উচিত মিনার্ভা কেনা। দুর্গাদাস গর্জন করে বলে—ওর দেখাদেখি আমি মোটর কিনব! কিনব না। বছর দেড় বছর কেটে যায়। বন্ধু এসে বলে—ওহে শুনেছ, চণ্ডীদাসের ছেলে হয়েছে।

দুর্গাদাসের ওইখানেই সব চেয়ে বেশী ব্যথা। তার প্রায় সাত-আট বছর বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সন্তান-সন্ততি হয়নি। ডাক্তারেরা সন্দেহ করেন দুর্গাদাসের স্ত্রী রেবা সম্ভবত বাঁজা। তার সন্তান-সম্ভাবনা কম।

বন্ধুর মুখে খবর শুনে দুর্গাদাস রাগে একেবারে ফেটে পড়ে—তুমি কে হে? তোমার এত মাথাব্যথা কিসের! চণ্ডীদাসের দশটা ছেলে হোক, পঞ্চাশটা ছেলে হোক, তোমার কি! যাও, বেরোও আমার বাড়ি থেকে। আর কোনও দিন এ বাড়িতে মাথা গলিয়েছ মাথা ফাটিয়ে দেব।

তারপর একটি একটি করে বছর কাটতে থাকে। দুগদাসের বয়স তিরিশের কোঠা পেরিয়ে চল্লিশের রাস্তা ধরেছে। ডাক্তারদের অনুমানই সত্যি, দুর্গাদাসের স্ত্রী রেবা বন্ধ্যা। শুন্য বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী প্রেতের মতো বাস করে। বন্ধু বান্ধব যারা আগে আসা-যাওয়া করত, দুর্গাদাসের অসংযত মেজাজের জন্য তারাও সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। যার পয়সা আছে তাকে কাজ করতে হয় না, কাজের সূত্রে কারুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ নেই। মধ্যবয়সে উপস্থিত হয়ে দুর্গাদাস দেখল সংসারে সে একা, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ।

এই অনাহত নিঃসঙ্গতার মধ্যে কেবল একটি জিনিস তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, বন্ধ্যা স্ত্রী রেবার প্রতি তার অন্ধ ভালবাসা। স্বামী-স্ত্রী যেন মরীয়া হয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে ছিল।

একদিন গ্রীষ্মের রাত্রি শেষ হয়েছে কি না হয়েছে, দুর্গাদাস ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। রেবা ঘুম-ভাঙা চোখে উৎকণ্ঠা ফুটিয়ে বলল—কি হলো?

দুর্গাদাস বলল—হয়নি কিছু। অনেকক্ষণ জেগে শুয়ে আছি। আর পারছি না, যাই একটু বেড়িয়ে আসি।

ইতিপূর্বে দুর্গাদাস কখনো প্রাতঃভ্রমণে বেরোয়নি। বেলা পর্যন্ত বিছানায় পড়ে থাকা তার অভ্যাস। রেবা চা তৈরি করে তাকে ডাকে, তখন সে ওঠে।

রেবা ঘাড় উঁচু করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল—আচ্ছা। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু, আমি সাড়ে ছটার সময় চা তৈরি করব।

আচ্ছা।

দুর্গাদাস যখন রাস্তায় বেরুল, তখন রাত্রির ঘোর সবেমাত্র কেটেছে, রাস্তায় লোকজন নেই। সে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে শেষে নদীর ধারে উপস্থিত হলো। শহরের পাশ দিয়ে একটি ছোট নদী গিয়েছে, তারই একটি পুরনো ভাঙা ঘাট। বহুকাল থেকে ঘাটটি ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে, কেউ ব্যবহার করে না। দুর্গাদাস ঘাটের প্রথম পৈঠায় গিয়ে দাঁড়াল। তখন বেশ আলো ফুটেছে, কিন্তু সূর্যোদয় হয়নি।

এদিক ওদিক চাইতে তার চোখে পড়ল, ঘাটের এক পাশে কয়েক ধাপ নীচে একটি ছেলে পিছনে ঠেস দিয়ে বসে একমনে বই পড়ছে। ছেলেটির বয়স আন্দাজ বারো বছর; পাতলা চেহারা, তরতরে মুখ। সে একবার দুর্গাদাসের দিকে মুখ তুলে আবার পড়ায় মন দিল।

দুর্গাদাসের সন্দেহ হলো ছেলেটি লুকিয়ে লুকিয়ে নভেল পড়ছে। আজকালকার ছোঁড়াদের তাই তো হয়েছে, লেখাপড়ায় মন নেই, ভোর হতে না হতে বাড়ি থেকে পালিয়ে নদীর ঘাটে বসে নভেল পড়ছে।

রাগী মানুষের রাগ চড়ে গেল। দুগার্দাস ছেলেটির কাছে গিয়ে উগ্র সুরে বলল—কি হে ছোকরা, সাতসকালে উঠে কী বই পড়ছ?

ছেলেটি চমকে মুখ তুলল। আচমকা গলার আওয়াজ শুনে যেন ধাঁধা লেগে গেছে এমনিভাবে চেয়ে থেকে বলল—আজ্ঞে

দুর্গাদাস তিরস্কারপূর্ণ তর্জনী দেখিয়ে বলে—ওটা কি বই?

ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বলল—আজ্ঞে জিওমেট্রি।

দুর্গাদাসের মনে বিস্ময়ের সঙ্গে অবিশ্বাস মিশল। সে হাত বাড়িয়ে বলল—দেখি বইখানা।

ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বইখানা তার দিকে এগিয়ে ধরল। সত্যিই ইউক্লিডের জিওমেট্রি। দুর্গাদাস বই হাতে নিয়ে সিঁড়ির ধাপের ওপর বসল, বই-এর পাতা ওল্টাতে লাগল। ছেলেটি তার সামনে নীচের ধাপে দাঁড়িয়ে রইল।

অতঃপর দুর্গাদাস যখন কথা বলল, তখন তার গলা নরম হয়েছে। সে মুখ তুলে বলল-তোমার বয়স কত?

বারো বছর।

কোন ক্লাসে পড়?

সেভেন্থ ক্লাসে।

ছেলেটি সপ্রতিভ অথচ শান্ত। দুর্গাদাস বই ফেরত দিয়ে বলল—তুমি এখানে এসে পড় কেন? বাড়িতে কি পড়ার জায়গা নেই।

ছেলেটি বলল—আজ্ঞে বাড়িতে পড়ার ঘর আছে। কিন্তু সকালবেলা এখানে এলে পড়ায় মন বসে। আমার বাড়ি বেশী দূর নয়।

তার ভাবভঙ্গি, কথা বলার ধরন দুর্গাদাসের ভাল লাগল, তার মনটা প্রসন্ন হলো। সে। বলল—বেশ বেশ। আচ্ছা আমি যাই। তুমি পড়াশুনো কর।

সে দুধাপ ওপরে উঠে ফিরে দাঁড়াল, প্রশ্ন করল—তোমার নাম কি?

ছেলেটি বলল—দেবীদাস রায়।

দুর্গাদাসের বুকের মধ্যে ধ করে উঠল। সে খানিকক্ষণ তীব্র চক্ষে ছেলেটির পানে চেয়ে রইল, তারপর গলার স্বর যথাসাধ্য সহজ করে বলল—বাপের নাম?

শ্রীচণ্ডীদাস রায়।

দুর্গাদাস আর দাঁড়াল না—

.

রেবা সাড়ে ছটার সময় চা তৈরি করে বসে ছিল, দুর্গাদাস ফিরল আটটার পর। ঘাট থেকে বেরিয়ে সে শহরময় ঘুরে বেড়িয়েছে। রেবার তার মুখ দেখেই বুঝল, একটা গুরুতর কিছু ঘটেছে। সে ব্যগ্র উৎকণ্ঠায় প্রশ্ন করল-কি হয়েছে গা?

দুর্গাদাস গলার মধ্যে কেবল ঘোঁত ঘোঁত ঘড় ঘড় শব্দ করল। সে রাগী এবং একগুঁয়ে মানুষ, হঠাৎ ঠিক করে বসেছে কাউকে কিছু বলবে না, রেবাকেও না। রেবা বার বার কী হয়েছে কী হয়েছে প্রশ্ন করেও তার মুখ থেকে কিছু বার করতে পারল না। কথায় বলে, মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল—দুর্গাদাসের সেই অবস্থা। কেবল মুখে কথা নেই।

সারা রাত দুর্গাদাস জেগে রইল, তারপর ভোর হতে না হতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। রেবারও ভাল ঘুম হয়নি, সে ঘাড় তুলে বলল—কোথায় চললে?

দুর্গাদাস একটু দম নিয়ে বলল—বেড়াতে। তুমি যাবে?

যাব। রেবা বিছানা থেকে নেমে পড়ল।

পাঁচ মিনিট পরে দুজনে বেরুল। নদীর ঘাটে গিয়ে দেখল দেবীদাস কাল যেখানে বসে ছিল, আজও ঠিক সেইখানে বসে বই পড়ছে। দুগার্দাস নিঃশব্দে তার দিকে আঙুল দেখাল। রেবা প্রশ্নভরা বিস্ফারিত চোখে তার পানে চাইল। প্রশ্ন করতে হলো না, দুর্গাদাস ঘাড় নাড়ল।

রেবা তখন পা টিপে টিপে দেবীদাসের কাছে গিয়ে বসল। দেবীদাস চমকে মুখ তুলে একটি মহিলাকে দেখে একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। রেবা মুখে হাসি আনল বটে, কিন্তু কথা বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে গেল—তোমার নাম কি?

দেবীদাস। তার কণ্ঠস্বর সঙ্কোচরুদ্ধ।

রেবা আঙুল দিয়ে তার চিবুক ধরে মুখখানি নিজের দিকে ফিরিয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল, কতকটা নিজের মনেই বলল—কি সুন্দর মুখ, যেন কুঁদে কাটা। বাবা, তোমরা ক ভাই-বোন?

দেবী বলল—আমরা দুই ভাই, এক বোন।

তুমি বুঝি বড়?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আরো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রেবা বলল—আমি কে জানো? আমি তোমার জেঠাইমা।

দেবী সন্দেহ করেছিল, এখন চট করে ব্যাপার বুঝে নিল, হাসিমুখে রেবার পায়ের ধুলো নিয়ে বলল—আপনাদের কথা মার মুখে শুনেছি। সে উঠে গিয়ে দুর্গাদাসের পায়ের ধুলো নিয়ে আবার এসে বসল।

রেবা তার হাত ধরে বলল—বাবা, তোমার মাকে আমাদের কথা বোলো। বোলো আমাদের কেউ নেই। বলেই রেবা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল।

দুর্গাদাস এতক্ষণ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে ছিল। এখন রুক্ষ স্বরে বলল—চল, এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

.

দুজনে বাড়ি ফিরে এল, কিন্তু রেবার কান্না থামল না। একদিন গেল দুদিন গেল, রেবা কেঁদেই চলেছে। কারুর প্রতি তার নালিশ নেই, ভগবানকে সে আক্ষেপ জানাল না, শুধু তার দুচোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল।

তিনদিনের দিন ভোরবেলা দুর্গাদাস মরীয়া হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। সোজা নদীর ঘাটে গিয়ে দেখল, দেবী যথাস্থানে বসে বই পড়ছে। দুর্গাদাস তার কাছে যেতেই দেবী উঠে দাঁড়াল। দুর্গাদাস তার হাত ধরে বলল—আয় আমার সঙ্গে।

দেবী আপত্তি করল না, নিঃশব্দে তার সঙ্গে চলল; সে দেখল দুর্গাদাস তাকে তাদের বাড়ির দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। সে তার মাকে সব কথা বলেছিল, তার মা-ও তাকে চুপি চুপি সব বলেছিল; দুর্গাদাস যখন তাকে তার বাড়ির দিকেই নিয়ে চলল, তখন তার বুঝতে বাকি রইল না যে, আজ একটা গুরুতর ঘটনা আসন্ন হয়েছে। সে মনে মনে তৈরি হয়ে রইল।

যেতে যেতে দুর্গাদাস হঠাৎ বলল—তোর জেঠাই বোধ হয় বাঁচবে না। কেঁদে কেঁদে মরে যাবে। কেবল তুই তাকে বাঁচাতে পারিস।

দেবী তার পানে একাগ্র দৃষ্টি তুলল; দুর্গাদাস বলল—তুই আমাদের কাছে থাকবি?

বারো বছরের ছেলের পক্ষে কঠিন প্রশ্ন, কিন্তু দেবী মনে বল এনে বলল—থাকব।

দেবীর কব্জির ওপরে দুগদাসের মুঠির চাপ আরো শক্ত হলো।

চণ্ডীদাসের বাড়ির ফটকের সামনে এসে দুর্গাদাস একবার থমকে দাঁড়াল, তারপর গটগট করে এগিয়ে চলল। বাড়িটা ফটক থেকে প্রায় বিশ গজ পিছনে।

বাড়িতে চণ্ডীদাস তখন বৈঠকখানায় বসে প্রাতঃকালীন তামাক খাচ্ছিল, আর শান্তা পাশের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে ছেলের পথ চেয়ে ছিল। শান্তাই আগে ওদের দেখতে পেল।

দুর্গাদাস দেবীকে নিয়ে বৈঠকখানার দোরগোড়ায় পৌঁছুলে চণ্ডীদাস তাকে দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল, তার হাত থেকে গড়গড়ার নল খসে পড়ল। এই সময় শান্তা পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে গলায় আঁচল দিয়ে ভাসুরকে প্রণাম করল।

সে উঠে দাঁড়াতেই দুর্গাদাস হতভম্ব ভায়ের দিকে একটা কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্তাকে সম্বোধন করে বলল—বউমা, আমি দেবীকে নিয়ে যাচ্ছি, ও আমার কাছে থাকবে। আজ থেকে আমিই ওকে মানুষ করব।

প্রায় অস্ফুট নীচু গলায় শান্তা বলল—আচ্ছা দাদা। বিয়ের পর থেকে সে ভাসুরকে দাদা বলেই ডেকেছে।

দুর্গাদাস দেবীর হাত ধরে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এতক্ষণ চণ্ডীদাস জড়বস্তুর মতো বসে ছিল, যেন ধারণা করতেই পারছিল না, তার চোখের সামনে কী ঘটছে। ওরা ফটক পার হয়ে যাবার পর সে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, চিল্কার করে বলল—আঁ! আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়ে গেল! এ কি মগের মুল্লুক! দাঁড়াও, আমি মজা দেখাচ্ছি। আজ খুনোখুনি হয়ে যাবে।

সে দোর পর্যন্ত এসেছে, শান্তা গিয়ে তাকে দুহাতে জাপটে ধরল, বলল—না, আর আমি তোমাকে দাদার সঙ্গে ঝগড়া করতে দেব না।

চণ্ডীদাস তার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলল—ছেড়ে দাও, আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে

শান্তা বাহুবন্ধন শিথিল করল না, বলল—তোমার ছেলেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেন না, দেবী নিজের ইচ্ছেয় ওঁর সঙ্গে গিয়েছে। তুমি কি চোখেও দেখতে পাও না?

চণ্ডীদাসের রোখ একটু নরম হলো বটে, তবু সে বলল—কিন্তু আমার ছেলে

শান্তা বলল—তোমার ছেলে তোমার কাছে যত সুখে আছে, ওঁদের কাছেও তেমনি সুখে থাকবে। বরং বেশী তো কম নয়।

চণ্ডীদাস গোঁ-ভরে আবার বলল কিন্তু আমার বড় ছেলে

শান্তা চণ্ডীদাসকে যেমন আঁকড়ে ছিল তেমনি আঁকড়ে রইল, ব্যগ্র মিনতির সুরে বলল-ওগো, কেন তুমি বুঝতে পারছ না? ওঁরা নিঃসন্তান, ওঁদের কেউ নেই। ওঁরা যদি বুড়ো বয়সে একটা অবলম্বন না পান, তাহলে বাঁচবেন কি নিয়ে! আমাদের তিনটি আছে। এমন তো নয় যে, দেবী চিরদিনের জন্যে আমাদের পর হয়ে যাবে। বরং দেবীকে দিয়ে আমরা ওঁদের ফিরে পাব। বলতে বলতে স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে শান্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

শহরের অন্য প্রান্তে রেবা তখনো চোখ বুজে বিছানায় পড়ে ছিল। দুর্গাদাস দেবীকে নিয়ে খাটের পাশে দাঁড়াল, বিজয়ীর কণ্ঠে বলল—ওগো, চোখ খুলে দেখ কাকে নিয়ে এসেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *