বেহুলার ভেলা
অমিয়া বলল, পয়সা কি কামড়াচ্ছিল। কয়লাওয়ালার কাছে এখন দু-মনের দাম বাকি। তা ছাড়া ওই ক-টা আলুতে কী হবে, ঘরে যা আছে তাও দিতে হবে দেখছি। এরপর সে বললে, টাটকা খুব, চর্বিও কম দিয়েছে।
পুতুল বলল, রোববার কোর্মা বেঁধেছিল তৃপ্তির নতুন বউদি। খুব বেশি ঘি দিয়েছিল, তাই ক্যাটক্যাটানি শুরু করেছিল শাশুড়ি। এই নিয়ে সে কী ঝগড়া মায়েতে-ছেলেতে। তারপর সে বলল, আমি কিন্তু রাঁধব বলে দিলুম। বাবুদা বলছিল পাঞ্জাবির হোটেলে নাকি দারুণ রাঁধে, আজ আসুক-না একবার দেখিয়ে দোব ক্ষণ।
চাঁদু বলল, আগে জানলে জোলাপ নিয়ে পেটটাকে রবারের করে রাখতুম। খানিকটা কাল সকালের জন্যে তুলে রেখো, চায়ে বাসি রুটি ভিজিয়ে খেতে খেতে তো জিভে চড়া পড়ে গেল। শেষকালে সে বলল, যেই রাঁধো বাবা, জবাফুলের রসের মতো রং হওয়া চাই কিন্তু।
রাধু এখন বাড়ি নেই। পাঁচ বছরের খোকন শুনে শুনে কথা শেখে, সেও প্রমথর হাঁটু জড়িয়ে বলল, বাবা আমি খাব মাংস।
ওরা যা-ই বলুক প্রমথ লক্ষ করছিল চোখগুলো। ঝিকোচ্ছে বরফকুচির মতো। ওরা খুশি হয়েছে। ব্যাস, এইটুকুই তো সে চেয়েছিল, তা-না-হলে মাসের শেষ শনিবারে একদম পকেট খালি করে ফেলার মতো বোকামি সে করতে যাবে কেন।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথটা আরও ছোটো হয়ে যায় শোভাবাজারের মধ্যে দিয়ে গেলে। বিয়ের পর কয়েকটা বছর বাজারের মধ্যে দিয়েই অফিস থেকে ফিরত, সেও প্রায় বাইশ বছর আগের কথা। তারপর বাবা মারা গেলেন, দাদারা আলাদা হলেন, প্রমথও এখনকার বাড়িটায় উঠে এল। উঠে আসার তারিখটা পাওয়া যাবে ভব শ্রীমানির খাতায়। সেই মাস থেকেই অমিয়া মাসকাবারি সওদা বন্ধ করল, ওতে বেশি বেশি খরচ হয়। তারপর কালেভদ্রে দরকার পড়েছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার। আজ গরমটা যেন অন্য দিনের থেকে বেশি চড়ে উঠেছে, জুতোর তলায় পিচ আটকে যাচ্ছে, কোনোরকমে বাড়ি ফিরলে বাঁচা যায়।
ডাববোঝাই একটা ঠেলাগাড়ি পথজুড়ে মাল খালাস করছে, চারধারে যেন কাটামুণ্ডুর ছড়াছড়ি। তার ওপর বাজারের আঁস্তাকুড়টাও জিনিসপত্রের দামের মতো বেড়ে এসেছে গেট পর্যন্ত। পুব দিকের গেট দিয়েই বেরোনো ঠিক করল প্রমথ। দুটো রকের মাঝখানের পথটায় থইথই করছে জল। চাপা কল থেকে জল এনে ধোয়াধুয়ি শুরু করেছে দুটো লোক। ঝাঁটার জল যেন কাপড়ে না লাগে সেই দিকে নজর ছিল।
আর দু-পা গেলেই বাজারটা শেষ হয়, তখুনি আচমকা জল ছুড়ল লোকটা। কাপড়ে লাগেনি, কিন্তু লাগতে তো পারত। বিরক্ত হয়েই সে পিছন ফিরেছিল আর অবাক হল পিছন ফিরে।
বাজারের শেষ মাথায় দাঁড়িয়েছিল প্রমথ, যতদূর দেখা যায় প্রায় শেষ পর্যন্ত এখন চোখ চলে। ফাঁকা, খাঁ-খাঁ করছে; অদ্ভুত লাগল তার কাছে।
সকালে মাছির মতো বিজবিজ করে, তখন বাজারটা হয়ে যায় কাঁঠালের ভুতি। ঘিনঘিন করে চলতে ফিরতে। আর এখন, চোখটা শুধু যা টক্কর খেল কচ্ছপের মতো চটমোড়া আনাজের ঢিপিতে। নয়তো সিধে মাছের বাজার থেকে ফলের দোকানগুলো, দোকানে ঝোলানো আপেল–গুলো পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আপেল না-হয়ে নাশপাতিও হতে পারে কিন্তু লক্ষ্মী পুজোর দিনটায় একবার ওদিক মাড়াতে হয়। ফুল, পাতা ওই দিকটাতেই পাওয়া যায়, আর তখনই চোখে পড়ে ঝোলানো আপেল, সবরি কলার ছড়া, আনারস আর শীতের সময় চুড়করা কমলা লেবু। শীতের কথা মনে পড়লেই কপির কথা মনে আসে, আগেকার দিনে সের দরে কপি বিক্রি হত না। নাকের সামনে বাঁধাকপি লোফালুফি করতে করতে সগ্নেসিচরণ হাঁক ছাড়ত, খোকাবাবু এই চলল পাঁচ নম্বরি ফুটবল, ছোকা বেঁধে খাও গোস্ট পালের মতো শট হবে। সন্যেসিটা যেন কী করে জেনে ফেলেছিল স্কুল টিমে প্রমথ ব্যাকে খেলে, আর গোষ্ঠ পালকে তো সে পুজো করত মনে মনে। আজকাল অনেকেই নাম করেছে, চাঁদুর মুখে কত নতুন নতুন নাম শোনা যায়। ওই শোনা পর্যন্ত। মাঠে যেতে আর ইচ্ছে করে না। সন্নেসি একদিন ফুটপাথে মরে পড়ে রইল। আজেবাজে জায়গা থেকে রোগ বাধিয়ে শেষকালে বাজারের গেটে বসে ভিক্ষে করত। সন্ন্যেসির সঙ্গে সঙ্গে কুলদাকে মনে পড়ল প্রমথর, চেহারা কী! যাত্রাদলে বদমাইশের পার্ট করত। বাজারে শিবরাত্তিরে যাত্রা শুনতে আসার আগে হিসেব করে আসতে হত বাবার কাছ থেকে কতগুলো চড় পাওনা হবে। কুলদার হাতে আড়াইসেরি রুইগুলোকে পুঁটি বলে মনে হত। ওর মতো ছড়া কাটতে এখন আর কেউ পারে না। আজকাল যেন কী হয়েছে, সেদিন আর নেই। গুইরাম মরে গেছে, ওর ছেলে বসে এখন। ছেলেটা বখা। অথচ গুইরামের পানে পোকা হাজা কিংবা গোছের মধ্যে ছোটো পান ঢোকানো থাকত, কেউ বলতে পারত না সেকথাগুইরামের দোকানের পাশে এখন একটা খোটানি বসে পাতিলেবু নিয়ে। অমিয়ার জন্য রোজ লেবুর দরকার, একদিন ওর কাছ থেকে লেবু কিনেছিল প্রমথ। মাস ছয়েকের একটা বাচ্চা, বয়স দেখে মনে হয় ওইটেই প্রথম, কোলের ওপর হামলাহামলি করছিল, বুকের কাপড়ের দিকে নজর নেই। ওর কাছ থেকে আর কোনোদিন লেবু কেনেনি সে। দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের যেন হজমের গোলমাল শুরু হয়েছে আর লেবুও যেন এত বড়ো বাজারটায় ওই একজায়গাতেই পাওয়া যায়। দিন দিন যেন কী হয়ে উঠেছে। বুড়োধাড়িদের কথা নয় বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু কচিকাঁচারাও তো বাজারে আসে, বাজার পাঁচটা লোকের জায়গা।
প্রমথর বেশ লাগছে এখন বাজারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। ছোটোবেলার অনেক কথা টুকটাক মনে পড়ছে। পেচ্ছাপখানার সামনে চুনো মাছ নিয়ে বসে একটা বুড়ি, ওকে দেখলেই আবছা মনে পড়ে মাকে। বোকার মতো হাসে, আর পায়ের আঙুলগুলো বাঁকা। ওখানটায় এখন থইথই করছে চাপা-কলের জল। মাকে পুড়িয়ে গঙ্গায় চান করেছিল সে, সেই প্রথম গঙ্গায় চান করা। তখন কত ছোট্টই-না ছিল, স্টিমারের ভোঁ শুনে জলে নামতে ভয় করেছিল তার। মাসের শেষে বাজারের ওইদিকটায় আর যাওয়া হয় না। আলু, পান আর দু-একটা আনাজ কিনেই বাজার সারতে হয়। চাঁদুটাই শুধু গাঁইগুঁই করে, কেমন যেন বাঙালে স্বভাব ওর, মাছ না পেলেই পাতে ভাত পড়ে থাকে। খিটিমিটি লাগে তখন অমিয়ার সঙ্গে। চালের সের দশ আনা, পাতে ভাত ফেলা কেই-বা সহ্য করতে পারে, পয়সা রোজগার করতে না শিখলে চাঁদুটা আর শোধরাবে না। রাধু একটা টিউশনি পেয়েছে। তখন আইএ-টা পাস করলে অন্তত গোটাকুড়ি টাকা মাইনে হত। ওর কিংবা পুতুলের খাওয়ার কোনো ঝামেলা নেই, অমিয়ারও না। পাতে যা পড়ে থাকে অমিয়া পুতুলকে তুলে দেয়, বাড়ের সময় মেয়েদের খিদেটাও বাড়ে। শিগগিরই আর একটা দায় আসবে। পুতুলের বিয়ে। মুখটা মিষ্টি, রংটা মাজা, খাটতে পারে, দেখেশুনে একটা ভালো ছেলের হাতে দিতে হবে।
হটিয়ে বাবুজি।
এবার এইধারটা ধোয়া হবে, পিছিয়ে এল প্রমথ। সেই জায়গা দেখা যাচ্ছে। একটা বুড়ো বসত ওখানে। পেয়ারা, কদবেল ছোট্ট ঝুড়িতে সাজিয়ে বুড়োটা দুপুরে বসে বসে ঝিমোত। সে কি আজকের কথা। বাবা মারা যাওয়ার অনেক আগে, বড়দার তখন থার্ড ক্লাস, যুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। সরু চালের দর এগারো টাকা, কাপড়ের জোড়া বোধ হয় আট টাকায় উঠেছিল, সে আজ চল্লিশ বছর হয়ে গেল। স্কুলের টিফিনে একটা আধলা নিয়ে তিন-চার জন তারা আসত, পয়সায় আটটা কাঁচা আম। আর এ-বছর দশ পয়সা জোড়া দিয়ে একদিন মাত্র সে কাঁচা আম কিনেছে, তাও কুশিকুশি। আহা, সে কী দিন ছিল! প্রমথর ইচ্ছে করে বুড়ো যেখানটায় বসত সেখানে গিয়ে এক বার দাঁড়ায়। ওখানে তখন রক ছিল না, দেয়ালের খানিকটা বালি খসা ছিল। দুটো ইটের ফাঁকে গর্তটায় দোক্তা রাখত বুড়োটা। গর্তটা এখনও। আছে কি না দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেটা খুব ছেলেমানুষের মতো। এত বছর পরেও কি আর গর্তটা থাকতে পারে, ইতিমধ্যে কতই তো ওলটপালট হয়ে গেছে, ভেঙেছে, বেড়েছে, কমেনি কিছুই। তবু এই দুপুরের বাজারের চেহারাটা একরকমই আছে। ছেলেমানুষ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, বুকটা টনটন করছে, তবু ঝরঝরে লাগছে গা-হাত-পা।
এই যে আসুন বাবু।
প্রমথ পিছন ফিরল; গোড়ার দোকানটা লক্ষ করে সে এগিয়ে এল। সদ্য ছাল ছাড়িয়ে ঝুলিয়েছে। পাতলা সিল্কের শাড়ি-জড়ানো শরীরের মতো পেশির ভাঁজগুলোকে রাক্ষুসে চোখে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।
কত করে দর যাচ্ছে।
তিন টাকা।
ভাবলে অবাক লাগে। চাঁদুর মতো বয়সে ছ-আনা সের মাংস এই বাজার থেকেই সে কিনেছে। তখন প্রায় সবই ছিল মুসলমান কসাই। ছেচল্লিশ সালের পর কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল।
এক সের দিই বাবু?
উৎসুক হয়ে উঠেছে লোকটার চোখ আর ছুরি। এর মতো মুন্নাও হাসত, তার একটা দাঁত ছিল সোনার, তবে মুন্নাকে কিছু বলার দরকার হত না, গর্দান থেকে আড়াই সের ওজন করে দিত। সেই মুন্না বুড়ো হল, তার ছেলে দোকানে বসল। তখন সংসার আলাদা হয়ে গেছে। দেড় সের নিত তখন প্রমথ। ঘোলাটে চোখে তাকাত বুড়ো মুন্না, চোখাচোখি হলে হাসত, চোখ ঝিকিয়ে উঠত। রায়টের সময় মুন্নাকে কারা যেন মেরে ফেলল।
এক সের দিই বাবু?
না, তিন পো, গর্দান থেকে দাও।
ওজন দেখল প্রমথ, যেন সোনা ওজন করছে। পাসানটা একবার দেখে নেওয়া উচিত ছিল। থাক গে ওরা লোক চেনে। তিনটে টাকা পকেটে ছিল। বাকি বারো আনা থেকে আলু পেঁয়াজ কিনতে হবে। মাইনে হতে এখনও ছ-সাত দিন বাকি। ট্রামভাড়ার পয়সাও রাখতে হবে। মাংসের ঠোঙাটা তুলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল প্রমথ।
মেটুলি দিলে না যে, তিন টাকা দর নিচ্ছ। আমরা কি মাংস কিনি না ভেবেছ।
লোকটা এক টুকরো মেটুলি কেটে দিল। অনেকখানি দিয়েছে, অমিয়া দেখে নিশ্চয় খুশি হবে।
রাস্তায় পড়েই প্রমথর আবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। বাবার সঙ্গে বজ্যাঠা হরি শ্রীমানির দোকানে এসেছিল এক সন্ধ্যায়। পাশেই ছিল মাটির খুরি-গেলাসের দোকান। তখন বিয়ের মরশুম, এক হাজার খুরি-গেলাস কিনল কারা যেন। এক হাজার লোক খাওয়ানোর কথা তো এখন ভাবাই যায় না। স্বদেশ কনফার্মড হওয়ার পর বিয়ে করল। বরযাত্রী হয়েছিল আত্মীয়স্বজন, অফিসের ঘনিষ্ঠ কয়েক জন মিলিয়ে তিরিশ। কন্যাপক্ষ মাংস খাইয়েছিল। কায়দা করে রাঁধলে মাছের থেকে সস্তা হয়। স্বদেশের বিয়েও আজ সাত মাস হয়ে গেল। ছেলেও না কি হবে। তবু তো সে সাত মাস আগে মাংস খেয়েছে। কিন্তু বাড়ির ওরা, অমিয়া, পুতুল। রাধু হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে, একটা পয়সাও বাজে খরচ করে না। চাঁদু ভালো ফুটবল খেলে, হয়তো বন্ধুরা খাওয়ায়ও। ছেলেটা ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসে, আর খেতেও পারে। এইটেই তো খাওয়ার বয়স। অমিয়ার খুড়তুততা বোনের মেয়ে শিলুর বিয়ের কথা শুনে কী লাফালাফিটাই জুড়েছিল। নেমন্তন্নে অবশ্য যাওয়া হয়নি। অন্তত একটা সিঁদুরকৌটোও তো দিতে হয়। চাঁদুটা আজ খুব খুশি হবে, ওরা সকলেই খুশি হবে।
বড়ো রাস্তার ঠিক মধ্যিখানেই কালীমন্দির। হাতে মাংসের ঠোঙা। চোখ বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দূর থেকেই প্রণাম জানিয়ে প্রমথ রাস্তা পার হল। পর্দা-ফেলা রিকশা থেকে গলা বার করে দুটি বউ প্রমথর পাশ দিয়ে চলে গেল।
সিনেমা হলগুলো আজকাল এয়ারকণ্ডিশন করা হয়েছে। প্রমথ ভাবতে শুরু করল, তা না হলে এই অসহ্য দুপুরে পারে কেউ বন্ধ ঘরে বসে থাকতে। তবু শখ যাদের আছে তারা ঠিক যাবেই, অমিয়ার কোনো কিছুতেই যেন শখ নেই আজকাল। অথচ মেজোবউদি-তার আপন মেজদা, যিনি ডাক্তার হয়েই আলাদা হয়ে গেছেন, তাঁর বউ এখনও না কি এমন সাজে যে ছেলের জন্যে পাত্রী দেখতে গেলে মেয়ে-বাড়ির সকলে গা টেপাটেপি শুরু করেছিল। মেয়েকে ফিরে সাজতে হয়েছিল ওর পাশে মানাবার জন্যে। এ খবর অমিয়াই তাকে দিয়েছিল। ওর শখ এখন এইসব খবর জোগাড় করাতে এসে ঠেকেছে। অথচ সাজলে এখনও হয়তো পুতুলকে হার মানাতে পারে।
গলিটা এবার দেখা যাচ্ছে, ওখানে ছায়া আছে। এইটুকু পথ জোরে পা চালাল প্রমথ। ভাবনারও একটা মাথামুন্ডু আছে। অমিয়া যতই সাজগোজ করুক, পুতুলের বয়সটা তো আর পাবে না। সতেরো বছরের একটা আলাদা জেল্লা আছে, দেখতে ভালো লাগে। অমিয়ার বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছরে, সেও পুতুলের মতো লাজুক আর ছটফটে ছিল।
হাড়গোড়সার ছেলের হাত-পায়ের মতোই ন্যাতানো গলিটা। হলকা বাতাস পর্যন্ত স্যাঁতসেঁতিয়ে যায়। এ গলিতে ঢুকলে গায়ে চিটচিটে ঘাম হয়। কোঁচাটা পকেটে থাকছে না। আলু আর পেঁয়াজের জন্যে। পেটের কাপড়ে গুঁজে দিতে একটুক্ষণ দাঁড়াল প্রমথ। ওপর থেকে উকিলবাবুর বিধবা বোন দেখছে। প্রমথ ঠোঙার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ওপর থেকেও বোঝা যায় এর মধ্যে মাংস আছে। নন্দী বাড়ির সঙ্গে ওর খুব ভাব। ছোটোমেয়ের শ্বশুর বুঝি কোন এক উপমন্ত্রীর বন্ধু। তাই নন্দীগিন্নি ধরাকে সরা দেখে, অমিয়া দুচক্ষে দেখতে পারে না এই মানুষগুলোকে। উকিলবাবুর বোনের দেখা মানেই পাড়ার সব বাড়ির দেখা। খবরটা শুনলে অমিয়া নিশ্চয় খুশি হবে।
বাড়ি ঢোকার মুখে দোতলার মিহিরবাবুর সঙ্গে দেখা হল প্রমথর। এবাড়িতে অল্পদিন এসেছে। মুখচোরা, বউয়ের মতোই মেশে না কারুর সঙ্গে, শুধু কবিতা আর রাজনীতির কথায় মুখে খই ফোটে।
দেখেছেন তো আবার স্ট্রাইক কল করেছে বেস্পতিবার?
শুনেছি বটে, আপিসে বলছিল সবাই, যা মাগগিগন্ডার বাজার, আগের বার এগারো সিকে ছিল, এখন তিন টাকা।
ঠোঙাধরা হাতটা দোলাল প্রমথ। কিন্তু মিহিরবাবুর নজর তাতে আটকাল না।
এখন তবু তিন টাকা। এক-একটা ফাইভ ইয়ার যাবে আর দেখবেন দামও পাঁচগুণ চড়বে।
অন্য সময় হলে মিহিরবাবুর সঙ্গে একমত হত প্রমথ। কিন্তু সে যা চাইছিল তার ধার দিয়েও গেল না কথাগুলো। রোববার মিহিরবাবুদের মাংস রান্না হয়েছিল। গরমমশলাগুঁড়োবার জন্যে হামানদিস্তেটা নিয়েছিল। এখনও ফেরত দেয়নি। বোধ হয় ভেবেছে ওদের আর কীসে দরকার লাগবে, যখন তোক ফিরিয়ে দিলেই হবে। মিহিরবাবু তোক ভালো। তবু প্রমথর মেজাজ তেতে উঠল ক্রমশ।
আরে মশাই স্ট্রাইকফ্রাইক করে হবেটা কী, তাতে পাঁচ টাকার জিনিস এক টাকায় বিকুবে?
কিছুটা তো কমবে।
আপনাদের ওই এক কথা।
প্রমথ উঠোনের কোণে রান্নাঘরের সামনে রকে ঠোঙাটা নামিয়ে রাখল। গলার আওয়াজে অমিয়া বেরিয়ে এল। তার পিছনে পুতুল আর চাঁদু। মিহিরবাবু ওপরে উঠে গেলেন। তারপর ওরা কথা বলল। ওদের চোখগুলো বরফকুচির মতো ঝিকিয়ে জুড়িয়ে দিল প্রমথকে।
এইটুকুই সে চেয়েছিল। খুশি হোক অন্তত আজকের দিনটায়। জিনিসের দাম বাড়ছে, স্ট্রাইক হবে, মিছিল বেরোবে, ঘেরাও হবে, পুলিশ আসবে, রক্তগঙ্গা বইবে, এ তো হামেশাই হচ্ছে। মানুষকে যেন একটা কামার তাতিয়ে তাতিয়ে ক্রমাগত পিটিয়ে চলেছে বিরাট একটা ভারী হাতুড়ি দিয়ে। সুখ নেই, স্বস্তি নেই, হাসি নেই, খুশি নেই।
ওসব ভাবনা আজ থাক। খোকনকে কোলে নিয়ে হাসতে শুরু করল প্রমথ ওদের দিকে তাকিয়ে।
রোদের কটকটে জ্বলুনি এখন আর নেই। বেলা গড়িয়ে এল। অমিয়া তাড়া দিচ্ছে দোকানে যাওয়ার জন্যে। ঘরে আদা নেই। বঁটি সরিয়ে উঠল প্রমথ। এতক্ষণ তার মাংস কোটা দেখছিল খোকন। চাঁদু বিকেলের শুরুতেই বেরিয়েছে। কোথায় ওর ফুটবল ম্যাচ আছে। বাটনা বাটতে বাটতে পুতুল খোঁজ নিচ্ছে চৌবাচ্চার। দেরি হলে বালতিতে শ্যাওলাসুদ্ধ উঠে আসে।
পাড়ার মুদির দোকানে আদা পাওয়া গেল না। তাই দূরে যেতে হল প্রমথকে। ফেরার সময় খোকনকে দেখল রাস্তায় খেলছে। ওর সঙ্গীদের মধ্যে ভুবন গয়লার নাতিকে দেখে ডেকে নেওয়ার ইচ্ছে হল। তারপরেই ভাবল, থাক, এখন বাড়ি গিয়েই-বা করবে কী। তা ছাড়া-ঘুপচি ঘরের মধ্যে আটকা থাকতেই-বা চাইবে কেন। খোকনকে ভালো জামা-প্যান্ট কিনে দিতে হবে, উকিলবাবুর ছেলেদের কাছাকাছি যাতে আসতে পারে। উকিলবাবুর ছেলেরা বাসে স্কুল যায়…বেশ ইংরেজিও বলতে পারে এই বাচ্চা বয়সে।
মাংসে বাটামশলা মাখাচ্ছিল অমিয়া। প্রমথকে দেখামাত্রই ঝেঁঝে উঠল।
এত দেরি করে ফিরলে, এখন বাটবে কে।
কেন, পুতুল কোথায়?
বিকেল হয়েছে, তার কি আর টিকি দেখার জো আছে। সেজেগুজে বিবিটি হয়ে আড্ডা দিতে গেছে।
আচ্ছা, আমিই নয় বাটছি।
বঁটি পাতল প্রমথ আদার খোসা ছাড়াবার জন্যে। অনেকখানি শাঁস উঠে এল খোসার সঙ্গে। সাবধানে বঁটির ধার পরীক্ষা করল, ভোঁতা। তাহলে অত পাতলা করে খোসা ছাড়ায় কী করে অমিয়া, অভ্যাসে! অভ্যাস থাকা ভালো, তাহলে সময় কেমন করে যেন কেটে যায়। অবশ্য আলু বা আদার খোসা ছাড়িয়ে কতক্ষণ সময়ই-বা কাটে। তবু ঘরসংসার, রান্নাবান্না, ছেলেপুলে মানুষ করা, এটাও তো এক রকমের অভ্যাসেই করে যায় মেয়েরা, না কি স্বভাবে করে। অমন স্বভাব যদি তার থাকত—প্রমথ ভাবল, তাহলে বাঁচা যায়। জীবনটা যেন ডালভাত হয়ে গেছে। ওঠা-নামা নেই, স্বাদ-গন্ধ নেই, কিছু নেই, কিছু নেই, তবু কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। আশ্চর্য, এই ভোঁতার মতো বেঁচে থাকাটাও একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বদ অভ্যাস।
থাক, তোমার আর কাজ দেখাতে হবে না।
অমিয়ার হাতে মশলা লেগে, হাত ধুয়ে জলভরা বাটিটা রেখে দিল সে। শিলের ধারে আদাগুলো ঘষে নিয়ে বাটতে শুরু করল। কত সহজে কাজটা করে ফেলল ও, প্রমথ ভাবল, এটাও এসেছে ওই অভ্যাস থেকে। হাত-পোয়া জলটুকু অমিয়া তো নর্দমাতেও ফেলতে পারত।
বাড়িতেই বসে থাকবে নাকি, বেরোবে না?
কোনো কথা বলল না প্রমথ। অমিয়া মুখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে।
খোকনের একটা ভালো নাম ঠিক করতে হবে।
করো-না।
উকিলবাবুর ছেলেদের নামগুলো বেশ। ও
রা সাহেবি স্কুলে পড়ে শুনেছি, ছছাটোটা তো খোকনের বয়সি।
হ্যাঁ, বড়োটা শুনেছি ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।
রামগতির পাঠশালায় খোকনকে ভরতি করে দিয়ো, দুপুরে বড্ড জ্বালায়।
উঠে পড়ল প্রমথ। ভেবেছিল আজ আর বাড়ি থেকে বেরোবে না। মাংস ফুটবে, ছেলে মেয়েরা কাছাকাছি জড়ো হবে, গল্প হবে এটা-সেটার, আসন পেতে থালা সাজিয়ে দেবে অমিয়া, একসঙ্গে সকলে খেতে বসবে গরম ভাত, গরম মাংস। অমিয়া তাকিয়ে আছে; গলায় চটের মতো ঘামাচি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল প্রমথ।
উকিলবাবুর রকে বসে ছিলেন গৌর দত্ত। প্রমথকে দেখে কাছে ডেকে বললেন, দেখেছ কেমন গরম পড়েছে, এবার জোর কলেরা লাগবে।
নড়েচড়ে বসলেন গৌর দত্ত। প্রমথ ওঁর পাশে বসল।
শুধু কলেরা, আবার ইনফ্লুয়েঞ্জাও শুরু হয়েছে।
লক্ষ করে দেখলুম জানো…
গৌর দত্ত প্রমথর গা ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে প্রায় যে-সুরে অনিল কুন্ডুকে তার সংসার থেকে বিধবা ভাজকে আলাদা করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই সুরে বললেন, লক্ষ করে দেখলুম জানো বোমাটা ফাটার পরই এই ইনফ্লুয়েঞ্জা শুরু হয়েছে, গরমও পড়েছে, ঠিক কি না?
হ্যাঁ, গরমটা এবারে তিষ্টোতে দিচ্ছে না।
লক্ষ করেছ যত বোমা সব জাপানের কাছাকাছি ফাটাচ্ছে। তার মানে কী? ইণ্ডাস্ট্রিতে খুব ফরোয়ার্ড বলেই তো ওদের এত রাগ! আমাদের পুলুর আপিসে একটা জাপানি আসে, ভালো
ইংরেজি জানে না, কথা বলতে খুব অসুবিধে হয় পুলুর, ও তো ফার্স্ট ডিভিশনে বিএ পাস করা। তা জিজ্ঞেস করেছিল নেতাজির কথা। ওরা আবার আমাদের চেয়েও শ্রদ্ধাভক্তি করে। কী উত্তর দিলে জান? বোসের মতো কেউ থাকলে তোমাদের ফাইভ ইয়ার প্ল্যানগুলোয় চুরি হত না। ব্যাপারটা বুঝতে পারলে?
হ্যাঁ, জিনিসপত্তর যা আক্র হচ্ছে দিন-কে-দিন। মাংস তিন টাকায় উঠেছে।
এনেছ বুঝি আজ?
সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন গৌর দত্ত। অন্যমনস্কের মতো লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে আবার বললেন, কী গরম পড়েছে, টিকে নিয়েছ? খাওয়া-দাওয়া সাবধানে কোরো। ছেলেপুলের সংসার, বলা যায় না কখন কী হয়।
হলে আর কী করা যাবে, সাবধানে থেকেও তো লোকে রোগে পড়ে।
ওই তো ভুল কর। আজ তোমার যদি—ভগবান না করুন, ভালো-মন্দ কিছু-একটা হয় তখন সংসারের অবস্থাটা কী হবে ভেবেছ?
অস্বস্তিতে ছটফট করে উঠল প্রমথ। এসব কথা এখন ভালো লাগছে না। বোধ হয় সংসারে গৌর দত্তর আর কিছু দেওয়ার বা নেওয়ার নেই। চাগিয়ে তোলা দরকার, আহা বুড়ো মানুষ!
একটু চাখবেন নাকি?
কী এনেছ, খাসি? রাং না সিনা?
গর্দানা।
এ হে, খাসির রাং দারুণ জিনিস।
গৌর দত্তর গালে যেন পিঁপড়ে কামড়াল। চুলকোতে চুলকোতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
বুঝলে, আগে খুব খেতুম। সামনে জ্যান্ত পাঁঠা বেঁধে রেখেই হাঁড়ি হাঁড়ি ভাত উড়িয়ে দিতে পারতুম। এখন ছেলেরা লায়েক হয়েছে, রোজগার করছে, বউদের হাতে সংসার। পুলুটাও হয়েছে বইন্যাওটা, বুড়ো বাপের যত্ন-আত্তির দিকে নজর নেই। তোমার বউদি বেঁচে থাকলে এ অবস্থাটা হত না।
টিকিট কাটার সঙ্গে সঙ্গে বাস বিকল হলে যাত্রীদের মনের অবস্থার মতো আস্তে আস্তে থেমে গেলেন গৌর দত্ত।
দুঃখ হচ্ছে প্রমথর। বুড়ো মানুষটার নিজের বলতে আর কিছু নেই। এখন কোনোরকমে টেনেটুনে চিতায় ওঠার অপেক্ষা। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জীবনটা ধুকপুক করবে, সাধ-ইচ্ছে তৈরি হবে, পূরণ করতে চাইবে, অথচ পারবে না। এমন বাঁচার থেকে মরা ভালো। আহা, বুড়ো মানুষটা মরবেই-বা কেন?
চলুন গৌরদা, আজ একটু বেড়িয়ে আসা যাক গঙ্গার ধার থেকে।
সে বড়ো দূর ভাই, তার চেয়ে পার্কে বরং গোটা কতক চক্কর দিয়ে আসি।
দুজনে উঠে দাঁড়াল। রাধু বাড়ি ফিরছে। প্রমথ তাকিয়ে থাকল তার দিকে। জড়সড় ভঙ্গিতে ওদের পাশ দিয়ে রাধু চলে গেল।
তোমার বড়োছেলেটি ভালো।
হাসল প্রমথ।
হাঁটতে হাঁটতে গৌর দত্ত বললেন, ওরা আবার খুঁজবে হয়তো।
পার্কে ঢুকেও আগের কথার জের টেনে তিনি বললেন, খুঁজলে আর কী হবে, নিজেরাই গপ্পোটপ্পো করবে। আশুর মেয়েকে নাকি মারধর করেছে শাশুড়ি, আজ ওর যাওয়ার কথা ছিল, কী ফয়সালা হল কে জানে। আমি তো বলেছিলুম হাতে-পায়ে ধরে মিটিয়ে আসতে। খাট-বিছানা-টাকা তো এজন্মে দেওয়ার ক্ষমতা হবে না আশুর।
প্রমথর এসব কথায় কান নেই, সে তখন ভাবছে পুতুল এতক্ষণে ফিরেছে ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে। উনুন ধরিয়েছে। অমিয়া ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে কেমন করে খুন্তি ধরলে মাংস কষতে সুবিধে হয়। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে মেয়েটার কপালে, নাকের ডগায়। ঠোঁট দুটো শক্ত করে টিপে ধরেছে। চুড়িগুলো টেনে তুলেছে— দপদপে স্বাস্থ্য, বেশিদূর উঠবে না। পাতলা ভাপ উঠছে হাঁড়ি থেকে। না, এখনই কি উঠবে। এখন তো জলই বেরোয়নি। আগে তো কখনো রাঁধেনি, নিশ্চয় বুক দুরদুর করছে আর আড়চোখে তাকাচ্ছে অমিয়ার দিকে। অমিয়া কী করছে? গালে হাত দিয়ে পিঁড়িতে বসে দেখছে। কী দেখছে, পুতুলকে? তাই হবে। হয়তো খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে ওর কচি মুখটা; আর ভাবছে হয়তো যে-কটা গয়না আছে ভেঙে কী কী গড়াবে ওর বিয়ের জন্যে। এতক্ষণে গন্ধে ম-ম করছে বাড়িটা। থোকন নাক কুঁচকে শুকছে। ভালো লাগছে গন্ধটা, তাই মিটিমিটি হাসছে আর হাঁড়ির কাছে আসার তাল খুঁজছে। পারবে না, অমিয়ার নজর বড়ো কড়া।
দু-চার দিন হয়তো বলাবলি করবে, বলবে গল্পে লোক ছিল, বেশ জমিয়ে রাখত সন্ধেটা। তারপর একসময় ভুলে যাবে। যেমন নির্মলদা কি নীলুকাকা মরে যাবার পর আর এখন কেউ নামই করে না। তোমরাও তেমনি ভুলে যাবে আমাকে।
দগদগে লাল হয়ে আছে কেষ্টচুড়ো গাছের চিমসে ডালগুলো। ওদের ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে কেমন অন্যরকম লাগে যেন। লাগে চোখে নয় মনটায়। রাধু টিউশনিতে যাওয়ার আগে নিশ্চয় দেখেছে। দেখে কিছু বলেছে কি? বড়ো কম কথা বলে ছেলেটা। তেইশ বছরেই বুড়িয়ে গেছে ওর শরীর-মন। ওকে দেখলে অস্বস্তি হয়। মনে হয় হাসি-খুশি-আনন্দ যেন কিছুই নয়। জীবনটা শুধু দুঃখ, দুঃখু আর দুঃখু কাটানোর চেষ্টাতেই ভরা। অথচ ওর বয়স তেইশ। ওর বয়সটা যেন চিমসে-কাঠি ডালে ফুল ফোটার মতো। বয়সের ফাঁকফোকর দিয়ে যৌবনটাকে কেমন বুড়োটে দেখায়।
রকে বসে থাকলে এতক্ষণে আরও পাঁচজন জুটে যেত। তখন শুধু আমাকে নয়, চক্ষুলজ্জার খাতিরে ওদেরও বলতে হত। তার চেয়ে এই বরং ভালো হয়েছে, বেমালুম খিদেটাও বেশ চনচনে হল।
কী তখন থেকে ভ্যাজর ভ্যাজর করছে বুড়োটা। বয়স বাড়লে হ্যাংলামোও বাড়ে। আঃ, কী হুড়োচাল্লি শুরু করেছে ছেলেগুলো, মানুষ দেখে ছুটবে তো। লাগল হয়তো বুড়ো মানুষটার। আহা! ছেলেবউরা যত্ন করে না। ফাঁসির আসামিও তো শেষ ইচ্ছাপূরণের সুযোগ পায়, অথচ মুখ ফুটে ওর ইচ্ছের কথা বলতে পারবে না কাউকে। গুমরে গুমরে মনের মধ্যে গুমোট তৈরি করবে। এবারের গরমটা অসহ্য, তবু নাকি বেতিয়াফেরত মানুষগুলো হাওড়া ময়দানে ভাজাভাজা হচ্ছে। বাইরে-ভেতরে সবখানেই অসহ্য হয়ে উঠেছে মানুষ। এই যে সকলে পার্কে বেড়াতে এসেছে, সেও তো গুমোট কাটাতেই। অমিয়াও আসতে পারে। কী এমন কাজ তার, ওইটুকু তো সংসার। না, এখন সংসারের কথা থাক, তার চেয়ে বরং ওই গাছটার দিকে তাকানো যাক। রাধাচুড়ো। একটাও ফুল নেই গাছে। থাকা উচিত ছিল। কেননা কেষ্টচুড়োয় ফুল ধরেছে। এই হয়, একটা আছে তো আর একটা নেই, সুখে জোড় বাঁধে না কোনো কিছুই। এখন তার খুশি থাকতে ইচ্ছে করছে। অথচ অমিয়া, কী জানি এখন হয়তো পুতুলকে বকছে দু-পলা তেল বেশি দিয়ে ফেলেছে বলে।
চলুন গৌরদা, এবার ফেরা যাক।
এর মধ্যে? রান্না হয়ে গেছে কি?
রান্নার দেরি আছে। আপনাকে নয় বাড়িতে পাঠিয়ে দেব চাঁদুকে দিয়ে।
তাই দিয়ে, আমি বরং একটু ঘুরি, আর শোনো, চাঁদুকে বোললা আমার হাতে ছাড়া কাউকে যেন না দেয়, কেমন।
প্রমথ কাঁদুনে গ্যাসের শেল ফাটতে দেখেছে এই সেদিন, অনেকের সঙ্গে সেও রুদ্ধশ্বাসে ছুটেছে, ঘোড়সওয়ার পুলিশের নাগাল ছাড়িয়েও ছুটেছে। তাই সে বোঝে অমিয়ার অবস্থাটা যখন উনুনে আগুন পড়ে। কোথায় পালাবে সে ওইটুকু বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে? যেখানেই যাক-না ধোঁয়া তাকে খেতে হবেই, ওই সময়টায় সকলেই উনুন ধরায়। ছাদে যে উঠবে তারও ফুরসত নেই। ঘরে বিকেলে কেউ থাকে না। ভাড়াটেবাড়ির একতলা, সদর দরজা সবসময় হাট-করা, মুহূর্তের জন্যেও ঘর ছাড়ার উপায় নেই।
আজও সেই রোজকার অবস্থা, তবু রক্ষে উনুন প্রায় ধরে গেছে। নিজের মনে গজগজ করছে অমিয়া, আর হাওয়া দিচ্ছে। সাহায্য করতে গেল প্রমথ। তিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠল অমিয়া।
যাক, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না।
অমিয়া চুল বেঁধেছে, গা ধুয়েছে, শাড়িটাও পরিষ্কার। প্রমথ বলল, তুমি পুতুলকে ডেকে আনো, ততক্ষণে আমি হাওয়া দিচ্ছি।
পাখাটা নামিয়ে দম-কাটা স্পিঙের মতো উঠে দাঁড়াল অমিয়া।
দাঁড়াও, মেয়ের আড্ডা শেষ হোক, তবে তো ঘরের কথা মনে পড়বে। আসুক আজ, ওর। আচ্ছা ঘোচাচ্ছি।
তরতর করে ছাদে উঠে গেল অমিয়া। সেখান থেকে একটু গলা তুলে ডাকলে তৃপ্তিদের বাড়ি শোনা যায়। ছাদ থেকে অমিয়া নামল আর সদর ঠেলে পুতুলও বাড়ি ঢুকল প্রায় একইসঙ্গে। একটুও আভাস না দিয়ে অমিয়া এলোপাথাড়ি কতগুলো চড় বসিয়ে দিল পুতুলের গালে মাথায় পিঠে।
পইপই করে বলি সন্ধে হলেই বাড়ি ফিরবি, সেকথা গ্রাহ্যই হয় না মেয়েরা কী এত কথা ফিসফিস গুজগুজ, তৃপ্তির মাস্টারের সঙ্গে হাসাহাসি কেউ যেন আর দেখতে পায় না, না?
বারে, আমি হাসাহাসি করেছি নাকি?
যেই করুক, তুই ওখানে থাকিস কেন, ঘরে আমি একা, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে সে খেয়াল থাকে না কেন? হাঁড়িটা উনুনে বসা।
অমিয়া ঘরে চলে গেল। উঠোনে গোঁজ হয়ে আঁচলটা মুঠোয় পাকাতে থাকল পুতুল। খামোকা মার খেল মেয়েটা। এইটুকু তো বয়েস, খাঁচার মতো ঘরে কতক্ষণ আর আটকা থাকতে মন চায়। উঠে এল প্রমথ রান্নাঘর থেকে।
মা যা বলল তাই কর।
ওর পিঠে হাত রেখে আস্তে ঠেলে দিল প্রমথ। পিঠটা বেঁকিয়ে ঠেলাটা ফিরিয়ে দিল পুতুল। গঙ্গাজলের ছড়া দিতে দিতে ওদের দেখে গেল অমিয়া।
রাগ করতে হবে না আর, কী এমন অন্যায় বলেছে? আজ বাদে কাল বিয়ে হবে, হাসাহাসি না-করলেই তো হয়।
আমি মোটেই হাসাহাসি করিনি, তবু মিছিমিছি—
ওর পিঠে হাতটা রেখে দিয়েছিল প্রমথ, তাই আঙুল বেয়ে উঠে এল বাকি কথাগুলো। থরথরিয়ে পুতুল কাঁপছে।
বিয়ের পর যত পারিস হাসিস, কেউ বারণ করবে না। বড়ো হয়েছিস, বুদ্ধি হয়েছে। তোর, তৃপ্তিদের যা মানায় আমাদের কি তা সাজে?
শাঁখ বাজাচ্ছে অমিয়া। পুতুলের কাঁপুনি যেন বেড়ে গেল। বিশ্রী শাঁখের আওয়াজটা। শুভকাজে শঙ্খধ্বনি দেওয়া হয়, অথচ এখন মনে হচ্ছে মাটি টলছে ভূমিকম্পে, তাই মেয়েটা কাঁপছে। মৃদু ঠেলা দিল প্রমথ। এক-পা এগিয়ে তারপর ঘরে ছুটে গেল পুতুল।
দাও আরও আদর। দিন দিন যেন বাঁদরি তৈরি হচ্ছে। অনেক দুখ আছে ওর কপালে, বলে রাখলুম।
হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছে অমিয়া প্রমথ নরমসুরে বলল, আজকে না বলেই হত।
কেন, আজ রথ না দোল যে বকব না।
শোওয়ার ঘরে এল প্রমথ। পুতুল ফোঁপাচ্ছে স্তুপ করা বিছানায় মুখ গুঁজে। শব্দটা সর্দি ঝাড়ার মতো শোনাচ্ছে। তার ওপর প্যাচপেচে গরম।
লক্ষ্ম মা আমার ওঠ, যা রান্নাটা শিখে নে। আরে বোকা শ্বশুরবাড়িতে যখন রাঁধতে বলবে
তখন যে লজ্জায় পড়বি, আমাদেরও নিন্দে হবে।
পুতুলের ফোঁপানি থামল। একটা চোখ বার করে, স্বরটাকে নামিয়ে বলল, বিয়ে করলে
হেসে উঠল প্রমথ, পুতুল মুখ লুকোল।
তোর মাও বিয়ের আগে ঠিক অমন কথা বলত।
পুতুল আবার মুখ তুলল। চোখের কাজল ধ্যাবড়া হয়ে গেছে। আহা, মেয়েটা কেঁদেছে।
তুমি কি করে জানলে, মা বুঝি বলেছিল?
একই সঙ্গে দু-জনে দরজার দিকে তাকাল। না অমিয়া নয়, খোকন এল।
চোখাচোখি হল পুতুল আর প্রমথর, হাসল দুজনেই। মেয়েটা দারুণ ভীতু হয়েছে। ওর মাও অমন ছিল, খালি দরজার দিকে তাকাত। রাত্রে ছাদে উঠত, তাও কত ভয়ে ভয়ে।
বল না, মা বুঝি সেসব গপ্পো করেছিল?
হেসে খোকনের চুলে বিলি কাটল প্রমথ। সেসব গল্প কবে করেছিল অমিয়া, তা কি এখনও মনে আছে। চেষ্টা করলে টুকরো টুকরো হয়তো মনে পড়বে। কিন্তু সেকথা কি মেয়েকে বলা যায়। একদিন, গলি দিয়ে গিয়েছিল একটা বেলফুলওয়ালা, কত কান্ড করে মালা কেনা হয়েছিল। আর একদিন, ছাদের উত্তর-পুব কোনায় তুলসীগাছের টবটার পাশে একটা ছোট্ট পৈঠে ছিল, একজন মাত্র বসতে পারে। পাছে বাবার ঘুম ভেঙে যায় তাই চুড়িগুলোকে হাতে চেপে বসিয়ে, পা টিপেটিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ছুট দিয়েছিল অমিয়া রকটা লক্ষ করে। আচারের শিশি বিকেলে তুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিল, ছাদের মধ্যিখানেই পড়েছিল সেগুলো। তারপর সে কী কেলেঙ্কারি। বড়োবউদি ছাদে উঠে এসেছিল, আর অমিয়া পাঁচিল ঘেঁষে বসে পড়েছিল দু-হাতে মুখ লুকিয়ে।
হাসছ কেন!
এমনি। একটা কথা মনে পড়ল তাই।
অমন করে হাসলে কিন্তু তোমায় কেমন কেমন যেন দেখায়। বেশ লাগে দেখতে।
চোখ নামিয়ে হাসল প্রমথ। খোকন চলে গেল রান্নাঘরে। খুন্তি নাড়ার শব্দ আসছে, গন্ধও আসছে কষা মাংসের, রান্নাঘরে অমিয়ার কাছে এখন কেউ নেই। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছে গালে, কপালে, নাকের ডগায়। বার বার কাঁধে গাল ঘষার জন্যে ঘোমটা খুলে গেছে। দুহাত সকড়ি, ঘোমটা তুলে দেওয়ার কেউ নেই কাছে।
বসেই থাকবি, নাকি রান্নাঘরে যাবি।
না, আমি শিখব না।
তোর মার কাছে শেখার জন্যে পাড়ার মেয়েরা আসত, বাটি বাটি মাংস যেত এবাড়ি ওবাড়ি।
অবস্থা ভালো ছিল তাই মা শিখতে পেরেছিল, আমি তো কোনোদিন রাঁধলুমই না।
ওর বয়সেই মেয়েরা বিয়ের কথা ভাবে। অমিয়া বলেছিল, সেও ভাবত, আর ভাবে বলেই একতলার ঘুপচি ঘরে জীবনটা সহনীয় হতে পারে। সচ্ছল ঘরে পুতুলকে দেওয়া যাবে না, টাকা কোথায়। মেয়েটা সে কথা ভেবেও হয়তো ভয় পায়। আসলে ভয় তো সকলেই পাচ্ছে, পুরুষ-মেয়ে সকলে। নতুন বউ অমিয়ার সময় মাংসের সের ছিল ছ আনা আট আনা, পুতুলের সময় তিন টাকা। জিনিসপত্তরের দাম বাড়ার জন্যে স্ট্রাইক হবে, হোক। মিহিরবাবু কবিতা লিখলেও বাজে কথা বলে না। খুন্তির শব্দ আসছে, কষা মাংসের গন্ধ আসছে, মেয়েটার মুখ শুকনো। অসহ্য লাগছে এই ঘরটা।
পুতুল আর প্রমথকে দেখে গম্ভীর হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসল অমিয়া। আলুর খোসা নিয়ে খেলা করছিল খোকন। পুতুল তাড়াতাড়ি কেড়ে নিয়ে কুটনোর ঝুড়িতে রেখে দিল, খোসা-চচ্চড়ি হবে।
গন্ধ উঠছে। এমন গন্ধ অমিয়ার হাতেই খোলে। ফুসফুস ভরিয়ে ফেলল প্রমথ। অমিয়ার গা ঘেঁষে পুতুল বলল, দাও না আমাকে।
উত্তর না দিয়ে অমিয়া শুধু খুন্তিটা নাকের কাছে ধরল। গনগনে আঁচ। একটুক্ষণ খুন্তি-নাড়া থামলেই তলা ধরে যাবে। পুতুলের কথায় কান দেওয়ার ফুরসত নেই, পুতুল করুণ চোখে তাকাল প্রমথর দিকে।
দাও না ওকে, যখন রাঁধতে চাইছেই।
সবই যখন করলুম তখন বাকিটুকুও করতে পারব। খোকনের ঘুম পেয়েছে শুইয়ে দে।
সত্যিই তো! এখন আর করার আছে কী। জলভরা কাঁসিটা হাঁড়ির মুখে চাপা দেওয়া ছাড়া। মাংসের জল বেরোলে, কাঁসির উষ্ণ জলটা ঢেলে দেওয়া, সে তো একটা আনাড়িতেও পারে। তারপর সেদ্ধ হলে আলু, নুন আর ঘিয়ে রসুন ভেজে সাঁতলানো, ব্যস। হতাশ হয়ে তাকাল প্রমথ। হনুর গড়নের জন্যে এমনিতেই পুতুলের গালদুটো ফুলো দেখায়, এখন যেন আরও টেবো দেখাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা স্বরে সে বলল, তৃপ্তিকে ওর বউদি নিজে থেকে রান্না শিখিয়েছে, গোটা ইলিশ কাটা শিখিয়েছে, এবার ওদের মাংস এলে তৃপ্তি রাঁধবে সেদিন আমায় খাওয়াবে বলেছে।
তাহলে তো তোকেও একদিন খাওয়াতে হয়।
হয়ই তো, আজকেই তো ওকে বললুম আমাদের মাংস এসেছে, মা বলেছে আমি রাঁধব।
অমিয়ার দিকে চোখ রেখে এরপর পুতুল কিন্তু কিন্তু করে বলল, ওকে আমার রান্না খাওয়াব বলেছি।
গৌরদাও আজ বলল, দিও হে বউমার হাতের রান্না। অনেকদিন খাইনি, কোথেকে শুনল কে জানে, বললুম দেব পাঠিয়ে। আহা বুড়ো মানুষটার যা কষ্ট, ছেলেবউরা তো একটুও যত্ন করে না।
হ্যাঁ, পুলুদার বউ কী ভীষণ চালবাজ, একদিন গেছলুম সে কী কথাবার্তা যেন কত বি এএম এ পাস। কারুর আর জানতে যেন বাকি নেই দু-দুবার আই এ-ফেল, তবু বলে বেড়ায় পাস করেছে। আর রাস্তা দিয়ে হাঁটে যখন, তুমি দেখেছ বাবা যেন, সুচিত্রা সেন চলেছে।
বোকার মতো হেসে প্রমথ বলল কে বলল তোকে।
তৃপ্তি। ও তো ভীষণ বায়স্কোপ দ্যাখে, তবে হিন্দি বই দ্যাখে না, খুব অসভ্য নাকি, মাস্টারমশাইও দ্যাখে না।
এমনি শুনে শুনেই মেয়েটা বায়স্কোপের খবর নেয়। মনে পড়ছে না কোনো দিন বায়স্কোপে যাব বলে বায়না ধরেছে। বাপের অবস্থা বুঝে সাধ-আহ্লাদগুলো চেপে রাখে, বাবা মাকে লজ্জায় ফেলে না। এ একমাত্র মেয়েরাই পারে, পুতুলের মতো মেয়েরা। চাঁদুটা সামান্য হুজুগ উঠলেই পয়সা পয়সা করে ছিঁড়ে খেত, এখন আর পয়সা চায় না। টাকা নিয়ে এখানে ওখানে খেলে খেলে বেড়ায়। ভাড়া খাটলে মান-ইজ্জত থাকে না, কিন্তু কী করবে, উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে কখনও ফাঁকা পকেটে থাকতে পারে? রাধুর মতো ছেলে আর ক-টা হয়, পানটুকু পর্যন্ত খায় না। ভালো, ওরা সবাই ভালো, আহা বেঁচেবর্তে থেকে মানুষ হোক।
একদিন তোর মাকে নিয়ে যাস-না বায়স্কোপে।
খোকনকে কোলে নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে এসে গলা চেপে পুতুল বলল, হ্যাঁ, মা আবার যাবে। বলে, কতদিন সাধলুম চলো চলো, সকলেই তো যায়। তা নয়, মার সবটাতেই বাড়াবাড়ি। একমিনিট বাড়ি না থাকলে সে কী ডাকাডাকি যেন পালিয়ে গেছি, এমন বিচ্ছিরি লাগে, সবাই হাসাহাসি করে। বাবুদার সামনেও মা অমন করে।
ঘরে আইবুড়ো মেয়ে থাকলে অমন ডাকাডাকি সবাই করে, তোর মেয়ে থাকলে তুইও করতিস।
প্রথম হাসল। তিতকুটে গলায় পুতুল বলল, তা বলে দিনরাত ঘরে বসে থাকব? বেরোতে ইচ্ছে করে না আমার? ঘরকন্নার কাজ সবসময় ভালো লাগে? তুমি হলে পারতে?
শেষদিকে সপসপ করে উঠল পুতুলের গলা। খোকনকে নিয়ে সে ঘরে চলে গেল। রকে পা ঝুলিয়ে বসল প্রমথ। একতলাটা শান্ত। দোতলায় সামান্য খুটখাট, তিনতলায় ছাদ, বলা যায় বাড়িটা চুপচাপ। শুধু গোলমাল করছে পাশের বাড়ির স্কুল ফাইনাল ফেল-করা ছেলেটা।
ঘরে থাকতে ভালো লাগে না মেয়ের, বাইরেই বা যাবে কোথায়, গিয়ে করবেই বা কী। এবাড়ি-ওবাড়ি যাওয়া আর আজেবাজে কথা বলা—এতে লাভ কী? দেয়ালে ঠেস দিয়ে প্রমথ ঘাড়ের জাড় ভাঙার জন্যে মাথা পিছনে হেলাল। ক্ষতিই বা কী, এমনি করেই তো বাকি জীবনটা কেটে যাবে। মেঘের নামগন্ধ নেই, শুধু ঝকঝক করছে গুচ্ছেরখানেক তারা। অসহ্য গরম, অসহ্য।
হঠাৎ একদমক হাওয়া পেরেকে ঝোলানো বাসনমোছা ন্যাতাটা ফেলে দিল। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে গা এলিয়ে দিল প্রমথ। ছটফটে গরমের মধ্যে একটুখানি হাওয়া বড়ো মিষ্টি লাগে। খোশবাই গন্ধ আসছে, হাঁড়ির ঢাকনাটা বোধ হয় খুলল অমিয়া।
ঝিমুনি এসেছিল প্রমথর, ভেঙে গেল সদর দরজা খোলার শব্দে। চাঁদু এল। অমিয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছে ওর, রাত্রে কিছু খাবে না বলছে। উঠে এল প্রমথ।
খাবি না কেন?
খাইয়ে দিল ওরা রেস্টুরেন্টে, সেমিফাইনালের দিনও খাওয়াবে। দুটো গোল হয়েছে, দুটোই আমার সেন্টার থেকে।
ভালোই হল, কাল তো বাজার আসবে না।
অমিয়া কালকের জন্যে চাঁদুর ভাগটুকু সরিয়ে রাখল। আড্ডা দিতে বেরুচ্ছিল চাঁদু, ডেকে ফেরাল প্রমথ।
তোর গৌর জ্যাঠাকে খানিকটা দিয়ে আয়।
কেন?
বিরক্তি, তাচ্ছিল্য আর প্রশ্ন, একসঙ্গে তিনটিকে অমিয়ার মুখে ফুটতে দেখে দমে গেল প্রমথ।
ওকে যে বলেছি, পাঠিয়ে দেব।
দেব বললেই কি দেওয়া যায়, অমন কথা মানুষ দিনে হাজারবার দেয়। এইটুকু তো মাংস। একে তাকে খয়রাত করলে থাকবে কী, কাল বাজার হবে না, খাবে কী কাল?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেওয়ার দরকার কী, বলে দিও নয় ভুলে গেছলুম।
অমিয়া আর চাঁদুর মুখের দিকে তাকাল প্রমথ। একরকমের হয়ে গেছে ওদের মুখদুটো। ওরা খুশি হয়নি।
কিন্তু বুড়ো মানুষটা যে আশা করে বসে থাকবে।
থাকে থাকবে।
কথাটা বলে চাঁদু দাঁড়াল না। অমিয়া চুপ করে আছে। তার মানে, ওইটে তারও জবাব। আবার পা ঝুলিয়ে বসল প্রমথ। আকাশে গুচ্ছেরখানেক তারা। আচমকা তখন হাওয়াটা এসে পড়েছিল, আর আসছে না। পুতুল চুপিচুপি পাশে এসে বলল, দিলে না তো! জানি, দেবে না। তখন মিথ্যে বলেছিলুম, তৃপ্তিকে মোটেই বলিনি যে মাংস খাওয়াব।
বেড়ালের মতো পুতুল ফিরে গেল। হয়তো তাই, বোকামি হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষটা বসে থাকবে, বসেই থাকবে। ঝিমুনি আসছে আবার, দেয়ালে ঠেস দিয়ে গা এলিয়ে দিল প্রমথ।
সদর দরজায় আবার শব্দ হতে প্রমথর মনে হল গৌরদা বুঝি। ফিটফাট, ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাবু সটান রান্নাঘরের দরজায় এসে চাঁদুর খোঁজ করল, তারপর নাক কুঁচকে গন্ধ টেনে বলল, ফাসক্লাস গন্ধ বেরোচ্ছে কাকিমা।
আঁচল দিয়ে শরীরটাকে মুড়ে পুতুল যেন ভেসে এল।
চেখে যাবেন কিন্তু।
তারপরই তাকাল অমিয়ার দিকে ভয়ে ভয়ে।
বাবারে বাবা, মেয়ের যেন তর সইছে না। খালি বলছে, বাবুদা কখন আসবে, ওকে দিয়ে চাখাব। নিজে বেঁধেছে কিনা।
যে কেউ এখন দেখলে বলবে, অমিয়া হাসছে। কিন্তু প্রমথর মনে হচ্ছে ও হাসছে না। হাসলে অত কুচ্ছিত দেখায় কাউকে? নাকি তার নিজের দেখার ভুল! প্রমথ তাকাল বাবুর দিকে। চৌকো করে কামানো ঘাড়, চুড়ো করে সাজানো রুক্ষ চুল। বুক, কোমর, পাছা সমান। চোঙার মতো আঁটসাঁট প্যান্ট, উলটে দিলেই গুলতির বাঁট হয়ে যাবে চেহারাটা, ভাবলে হাসি পায়। কিন্তু হাসল না প্রমথ, ছেলেটা শ-দেড়েক টাকার মতো চাকরি করে।
মুখে আঁচল চেপে হাসছে পুতুল। আমিয়া জিজ্ঞাসা করল, কেমন হয়েছে।
ফুড়ুত করে হাড়ের মজ্জা টেনে বাবু বলল, গন্ধ শুকেই তো বলেছিলুম, ফাস ক্লাস!
অমিয়া ওর খাওয়া দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করল, চাঁদুর সেই কাজের কী হল?
বাবুর জিভ বাটিতে আটকে রইল কিছুক্ষণ, তারপরই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, সে আর মনে করিয়ে দিতে হবে না। তবে বুঝলেন তো, স্কুল ফাইনালটাও যদি পাস করত তাহলে ভাবনা ছিল না। আজকাল বেয়ারার চাকরির জন্যে আই এ পাস ছেলেরাও লাইন লাগায়। তবে আমিও এটুলির মতো লেগে আছি সুপারভাইজারের সঙ্গে, রোজ ত্যালাচ্ছি।
চাঁদু না হয়, রাধুর জন্যে দ্যাখো।
না কাকিমা। রাধুটা আজকাল যেন কেমন হয়ে গেছে, চাকরিতে ঢুকে শেষকালে ইউনিয়নে ভিড়ক আর আমায় নিয়ে টানাটানি শুরু করবে তখন। এর ওপর আবার যা গরম বাজার চলছে।
হ্যাঁ, মিহিরকাকু বলছিলেন বেস্পতিবার নাকি স্ট্রাইক হবে।
আরে ও তো খুচরো স্ট্রাইক। বেশ বড়োসড়ো অল ইণ্ডিয়া স্ট্রাইকের কথাবার্তা হচ্ছে নাকি।
হলে হয় একবার, ব্যাটা সুপারভাইজারটাকে বাগে পেলে আচ্ছাসে ধোলাই দিয়ে দেব। মেজাজ কী ব্যাটার, যেন মাইনে বাড়ানোর কথা বললে ওকেই গ্যাট থেকে টাকাটা দিতে হবে। পাবলিকের টাকা নেবে, তাতে ক্ষতিটা কী হয়?
খালি বাটিটা নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল বাবু, পুতুল টেনে নিল হাত বাড়িয়ে, জলের গ্লাসটাও এগিয়ে দিল সে। রুমালে ঠোঁট মুছে বাবু জিজ্ঞেস করল, চাঁদুটা গেল কোথায়, একটা কার্ড ছিল একস্ট্রা।
কার্ড কীসের, আপনাদের সেই অফিসের থিয়েটারের?
উঁহু, যুব উৎসব। বলেছিলুম না আমার এক বন্ধু গল্প-টল্প লেখে, এর মধ্যে আছে, সে-ই জোগাড় করে দিল কার্ডটা। চাঁদু বলেছিল সতীনাথের গানের দিন যাবে, তা সেদিন আর জোগাড় হয়ে উঠল না।
কোন গানটা গাইল? সোনার হাতেটা গেয়েছে।
ওটা, তারপর আকাশ প্রদীপ জ্বলেটাও নাকি গেয়েছে।
আপনাকে তো সেধে-সেধে মুখ ব্যথা হয়ে গেল, তবু গানটা লিখে দিলেন না।
বেশ চলো, এখুনি লিখে দিচ্ছি।
কয়লা দিয়ে উনুনে হাওয়া করছে অমিয়া। পুতুল আর বাবু যেন ভাসতে ভাসতে ঘরে চলে গেল। প্রমথর গা ঘেঁষেই প্রায়।
চটপটে, চালাকচতুর ছেলে। ও কি বিয়ে করবে পুতুলকে? ছেলেমানুষ, বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যাবে। তার থেকে ওর বাবাকে গিয়ে ধরতে হবে। মুশকিল বাঁধবে জাত আর দেনা-পাওনা নিয়ে। বাপের মুখের ওপর ওর কথা বলার সাহস হবে না।
তুমি এখানে বসে রইলে কেন, ঘরে ওরা একা রয়েছে না?
প্রমথ তাকিয়ে রইল অমিয়ার দিকে। কত সাবধানে আঙুলের ফাঁক দিয়ে চাল-ধোয়া জলটা ফেলছে। অমন করে মনের কুৎসিত সন্দেহগুলোকেও তো হেঁকে ফেলে দিতে পারে। থাকলই বা ওরা একসঙ্গে একটুক্ষণ, ক্ষতিটা কী তাতে।
ঘরে নয়, ছাদে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল প্রমথ। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে থামল। ঘরে ওরা হাসাহাসি করছে, ছাদে গেলে অমিয়া রাগ করবে নিশ্চয়। আজ ওকে রাগাতে ইচ্ছে করছে না। রান্নাঘরে গিয়ে গল্প করলে কেমন হয়, আগডুম-বাগডুম যা খুশি। মেজবউদিকে সেদিন দেখলুম ধর্মতলায় গাড়ি থেকে নামছে, এখনও পেট-কাটা জামা পরে; কিংবা, দক্ষিণাবাবু কীসব ওষুধ খাইয়ে বউকে প্রায় মেরে ফেলার জোগাড় করেছিল। তবে কাজ ঠিকই হাসিল হয়েছে। পেটেরটা বাঁচেনি। কিংবা, একটা দিন দেখে গুরুঠাকুরের কাছে গিয়ে মন্তর নেওয়ার কথাটা পাড়লে হয়, ভাবছিল প্রমথ। পুতুল ঘর থেকে বেরিয়ে তার কাছে এল।
ছোড়দা তো নেই, কার্ডটা নষ্ট হবে, ওর বদলে আমি যাব? বাবুদা বলছে এমন উৎসব নাকি এর আগে হয়নি, না দেখলে জীবনে আর দেখা হবে না, নাচ গান সিনেমা থিয়েটার সব নাকি দেখা যাবে, যাব?
গেলে ফিরবি কখন?
কত আর দেরি হবে, ঘণ্টাখানেক দেখেই চলে আসব।
কচি শসার মতো কবজিটা যেন মুট করে ভেঙে ফেলবে পুতুল আঙুলের চাপে। এইটুকু কথা বলেই ও হাঁপিয়ে পড়েছে।
তোর মাকে একবার বলে যা।
রান্নাঘরের দরজা থেকে কোনোরকমে পুতুল বলল, ছোড়দা তো নেই। তাই আমিই যাচ্ছি তাড়াতাড়ি ফিরবক্ষণ।
একটা কাঁচা কয়লা বিরক্ত করে মারছে। সেটাকে তুলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাতে অমিয়া ব্যস্ত। প্রমথ কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল, বাড়ি থেকে বেরোয়-টেরোয় না তো, যাক ঘুরে। আসুক।
কে?
সাঁড়াশিতে চেপে ধরে কয়লাটা থেকে বার করে আনতে আনতে অমিয়া বলল, কে পুতুল?
হ্যাঁ, কী যেন উৎসব হচ্ছে বলল।
চলে গেছে?
না, কেন।
রান্নাঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল অমিয়া। পথ আটকে দাঁড়াল প্রমথ।
কেন আবার, রাত্তিরে মেয়েকে ছেড়ে দেবে একটা ছেলের সঙ্গে।
দিলেই বা কী দোষ হবে। হাঁপিয়ে ওঠে না ঘরে বসে থাকতে? শুধু ছাদ আর গপ্পো করা। এ ছাড়াও তো অনেক কিছু আছে। মারধর করলেই কি মেয়ে ভালো হবে?
প্রমথ চুপ করল বুকভরে বাতাস টেনে। দাঁত চেপে কথা বলতে বেশ কষ্ট হয় কিন্তু উপায়ই বা কী, ওঘরে পুতুল আর বাবু রয়েছে। থমথম করছে অমিয়ার মুখ। ঘাম নামছে থুতনি-বেয়ে কিলবিলে পোকার মতো, ফরসা গালে সেঁটে-বসা উড়ো চুলকে চীনেমাটির ফাটা দাগের মতো দেখাচ্ছে। সত্যিই ফেটে পড়ল অমিয়া।
আমি যখন পারি, ও পারবে না কেন, কেন পারবে না। শুধু ওর কথাই ভাবছ, কেন ভাবার আর কিছু নেই তোমার? বলে দিচ্ছি ওর যাওয়া হবে না।
চুপ, আস্তে, দোহাই আজ আর চেঁচিয় না।
আঙুল বাঁকিয়ে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল প্রমথ। দপদপ করছে তার রগের পেশি। পিছু হটে এল অমিয়া। প্রমথর নখের ডগাগুলো ভীষণ সরু।
চুপ করব কেন। আমি অন্যায় কথা বলেছি? মেয়েকে কেন তুমি ছেড়ে দিতে চাও একটা ছেলের সঙ্গে, তা কি বুঝি না ভেবেছ।
চোখে চোখ রেখে ওরা তাকাল। অমিয়ার চাউনি কসাইয়ের ছুরির মতো শান দিচ্ছে। মাংসের খোলা হাঁড়িতে চোখ পড়ল প্রমথর, থকথক করছে যেন রক্ত।
কী বুঝেছ তুমি, বলো কী বুঝেছ?
দু-হাতে অমিয়ার কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিল প্রমথ। খোঁপাটা খুলে পড়ল, চোখদুটো মরা পাঁঠার মতো ঘোলাটে হয়ে এল, ঠোঁট কাঁপিয়ে অমিয়া বলল, তুমি আমার গায়ে হাত তুললে।
অন্ধকার উঠোনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পুতুল আর বাবু। কোনো সাড় নেই যেন ইন্দ্রিয়গুলোর। তবু ছাদে যাওয়ার সময় প্রমথর নাকে চড়াভাবে লাগল পাউডারের গন্ধ। মেয়েটা সেজেগুজে অপেক্ষা করছে, করুক। মাথা নীচু করে প্রমথ ওদের পাশ দিয়েই ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ধরল।
ছাদেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাধু ডেকে তুলল প্রমথকে। থালার সামনে বসে আছে অমিয়া। ঠাণ্ডা ভাত আর মাংস। ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়েছে।
পুতুল শুয়ে পড়ল যে এর মধ্যে।
শরীর খারাপ, কিছু খায়নি।
কথা দুটো শুকনো কড়কড়ে। খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আর কেউ উচ্চবাচ্য করল না। মাংসের সবটুকুই খেল প্রমথ। শুধু মেটুলির টুকরোগুলো ছাড়া। মেটুলি ভীষণ ভালোবাসে অমিয়া, অথচ সবটুকুই সে প্রমথকে দিয়ে দেবে। প্রমথও না খেয়ে বাটিতে রেখে দেবে। তখন মিষ্টি ঝগড়া ভালো লাগত আর মাংসও আসত নিয়মিত। আজকেও প্রমথ মেটুলি রেখে উঠে পড়ল। কলতলায় অনেকক্ষণ ধরে কষের দাঁত থেকে মাংসের আঁশ টেনে বার করল। ভিজে গামছা দিয়ে গা-মুছে যখন সে শুয়ে পড়ল তখনও অমিয়ার রান্নাঘর ধোয়া শেষ হয়নি।
অনেক রাতে উঠোনে বেরিয়ে এল প্রমথ। ঘরের মধ্যে যেন চিতা জ্বলছে। একটুও হাওয়া নেই, মেঘও নেই। পায়চারি শুরু করল সে রকের এমাথা-ওমাথা। একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল। মুখ তুলে তাকল প্রমথ। একটুখানি দেখা গেল, লাল আর সাদা আলোটা পালটা পালটি করে জ্বলছে আর নিভছে। মাত্র কতকগুলো তারা দেখা যায় উঠোন থেকে। ছাদে উঠলে আরও দেখা যাবে। দেখেই বা কী হবে ওরাও তো দেখল আজ মাংস এসেছে অনেকদিন পর, কিন্তু তাতে হল কী? পাতে মেটুলি রেখে সে উঠে পড়ল আর নির্বিকার হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল অমিয়া। এখন মনে হচ্ছে অমিয়া যন্ত্রের মতো তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সেও তো যন্ত্রের মতোই শুধু অভ্যাস মেনে মেটুলিগুলো পাতে রেখে দিয়েছিল। পায়চারি থামাল প্রমথ। অমিয়াও উঠে এসেছে।
ঘুম আসছে না বুঝি?
না, ভয়ানক গরম লাগছে।
পিঠের কতকগুলো ঘামাচি মারল অমিয়া। দু-একটা শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল প্রমথ।
ছাদে যাবে?
কেন, এই তো বেশ।
বরাবরই তোমার কিন্তু ঘামাচি হয়।
অমিয়া পিঠের উপর কাপড় টেনে দিল।
বসবে?
পাশাপাশি বসল দুজনায়।
পুতুলের জন্য ছেলে দ্যাখো এবার।
হ্যাঁ, দেখব।
চাঁদুটাকেও একটা যা হোক কাজেকম্মে ঢুকিয়ে দাও, কদ্দিন আর টোটো করে কাটাবে।
হ্যাঁ, চেষ্টা করতে হবে।
রাধু বলছিল আই এ পরীক্ষাটা দেবে সামনের বছর।
ভালোই তো।
শান্ত রাত্রির মাঝে ওদের আলাপটা, কল থেকে একটানা জল পড়ার মতো শোনাল। ওরা অনেকক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, পাশাপাশি। কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। দুজনেরই চোখ সামনের শ্যাওলা-ধরা দেয়ালটাকে লক্ষ করছে।
কী দরকার ছিল মাংস আনার।
অমিয়ার স্বরে ক্ষোভ নেই, তাপ নেই, অনুমোদন নেই। শুধু যেন একটু কৌতূহল। তাও ঘামাচি মারার মতো নিস্পৃহ। মুখ না ফিরিয়ে প্রমথ বলল, কী জানি। তখন কেমন ভালো লাগল, অনেক কথা মনে পড়ল, মনটাও খুশি হল। ভাবলুম আজ সবাই মিলে একটু আনন্দ করব।
চুপ করে রইল প্রমথ। মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল। অমিয়াও তার দিকে তাকিয়ে।
আজ পুতুলকে দেখে বার বার তোমার কথা মনে পড়ছিল। কত মিষ্টি ছিলে, চঞ্চল ছিলে, ছটফটে ছিলে। আর ওকে কাঁদিয়ো না।
মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল প্রমথ, তারা জ্বলছে। একটা কামার মানুষকে তাতিয়ে বিরাট এক হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চলেছে, তারই ফুলকিগুলো ছিটকে উঠেছে আকাশে। ছাদে উঠলে আরও অনেক দেখা যাবে। অমিয়ার পিঠে হাত রাখল প্রমথ। থরথর করে কাঁপছে ওর পিঠটা।
জানো অমি, মনে হচ্ছে আমি আর ভালোবাসি না, বোধহয় তুমিও বসো না। তা-না-হলে তোমার মনে হবে কেন আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে পারি। অথচ সত্যি সত্যি তখন ইচ্ছে হয়েছিল তোমার গলা টিপে ধরি। অমি, এখন একটা মড়া আগলে বসে থাকা ছাড়া আর আমাদের কাজ নেই।
অমিয়ার পিঠে হাত বোলাল প্রমথ। খসখসে চামড়া, মাংসগুলো ঝুলে পড়েছে আলগা হয়ে, মেরুদন্ডের গিটগুলো হাতে আটকাচ্ছে। মুখ তুলল প্রমথ, যে-কটা তারা দেখা যায়, সেদিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, কেঁদো না, মরে গেলেই মানুষ কাঁদে, আমি কি মরে গেছি।
তারপর ওরা বসে রইল অন্ধকারে কথা না বলে।