বিহারীলাল চক্রবর্ত্তী
‘সারদামঙ্গলে’র কবি বিহারীলাল চক্রবর্ত্তীর নাম সুপরিচিত হইলেও তাঁহার কাব্য যে তেমন পরিচিত নয়, আধুনিক কালের সাহিত্যরসিক-সমাজে তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইবে। অথচ আমরা জানি, যুগ-নায়ক রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আরও একাধিক সমসাময়িক কবি এককালে বিহারীলালকে কাব্যগুরু বলিয়া স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। আধুনিক বাংলা কাব্যের উৎস সন্ধান করিলে আমরা মাইকেল মধুসূদন দত্তের যে স্থান নির্দ্দেশ করি বিহারীলালের স্থান তাহা হইতে দূরে নহে। বরং উত্তরকালে বিহারীলাল প্রবর্তিত কাব্যসাধনাই সমধিক ফলবতী হইয়াছে; বিহারীলালের কাব্যপ্রেরণা আরও সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত, বাঙ্গালীর জাতিগত ভাবনার অনুকূল। তাই আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে বিহারীলালও এক হিসাবে যুগপ্রবর্ত্তক কবি।
কিন্তু বিহারীলালের কবি-কীর্তি নদীর উৎসস্থানের মত, গিরিদরীর অন্ধকারে অগোচর হইয়াই রহিল। আধুনিক কাব্যধারার সেই দুর্গম উৎসমুখ আবিষ্কার করিবার কৌতূহল ও দুঃসাহস যাঁহাদের আছে, তাঁহারাই এই উৎসমুখ খুঁজিয়া বাহির করিবেন, এবং তাহার গহন-গূঢ় তরঙ্গলীলা ও নির্জ্জনতা লক্ষ্য করিয়া বিস্মিত ও পুলকিত হইবেন। আমি সেই দুঃসাহস করিয়াছি, কিন্তু সেই কবি-হৃদয়ের যে ভাবোন্মাদ ও ধ্যান-গভীর পরমানন্দের পরিচয় পাইয়াছি তাহা সত্যই অনিৰ্ব্বচনীয়; অতএব, আমি বিহারীলালের যে কাব্যপরিচয় লিপিবদ্ধ করিতেছি তাহাতে পাঠকের কৌতূহল পরিতৃপ্ত হইবে কিনা জানি না, কথঞ্চিৎ আভাসও যদি ফুটিয়া উঠে, তাহা হইলে আমার উদ্যম সার্থক হইয়াছে বলিয়া মনে করিব।
এই কাজ দুরূহ এই জন্য যে, বিহারীলালের কাব্যে প্রকৃত কাব্যসৃষ্টি অপেক্ষা কবির নিজ প্রাণের পরিচয়ই বিশেষ করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাঁহার ‘বাউল বিংশতি’, ‘সঙ্গীত-শতক’ প্রভৃতি কাব্য পাঠ করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন এই কবির কাব্যসাধনার প্রধান লক্ষণ কি। বিহারীলালের কাব্য যেন আদি ‘লিরিক জাতীয়, তাহার প্রেরণা একেবারে গীতাত্মক। বাহিরের বস্তুকে, গীতি-কবি নিজস্ব ভাব-কল্পনায় মণ্ডিত করিয়া যে একটি বিশেষ রূপ ও রসের সৃষ্টি করেন, ইহা তাহা হইতেও ভিন্ন, কবি নিজের আনন্দে, ধ্যান কল্পনার আবেশে, সর্ব্বত্র নিছক ভাবের সাধনা করিয়াছেন; তাঁহার কাব্যের প্রধান লক্ষণ ভাব বিভোরতা। তাঁহার কল্পনা অতিমাত্রায় Subjective; তিনি যখন গান করেন, তখন সম্মুখে শ্রোতা আছে এমন কথাও ভাবেন না, ভাবকে স্পষ্ট রূপ দিবার আকাঙ্ক্ষাই তাঁহার নাই। কিন্তু এই আত্মনিমগ্ন কবির স্বতঃ—উৎসারিত গীতধারায় এমন সকল বাণী নিঃসৃত হয়, যাহাতে সন্দেহ থাকে না যে, তাঁহার মনোভৃঙ্গ সরস্বতীর আসন কমলের মর্ম্মমধু পান করিয়াছে, সেই পদ্মের পরাগ-ধূলি সৰ্ব্বাঙ্গে মাখিয়া কবিজীবন সার্থক করিয়াছে। তাঁহার কাব্যে ভাবের ঐকান্তিকতা ও গভীরতা যতটা হৃদয়গ্রাহী, ভাবের মূৰ্ত্তি ততটা স্পষ্ট হইয়া উঠে নাই। এই কারণে, তিনি আধুনিক কাব্যে একটা নূতন সাধন-রীতির দীক্ষাগুরু হইলেও কাব্যরচয়িতা হিসাবে কাব্যামোদী পাঠকের পিপাসা মিটাইতে পারেন নাই।
তাঁহার কাব্যে কবি-মানুষ হিসাবে তাঁহার যে পরিচয় বহুস্থানে ছড়াইয়া আছে, আমি প্রথমে তাহার কিছু কিছু উদ্ধৃত করিব। এমন সবল সহজ আত্মপ্রকাশ অতি অল্প কাব্যেই আছে। বিহারীলালের কাব্যগুলির মধ্যে এ হিসাবে এই কয়খানি বিশেষ উল্লেখযোগ্য—‘প্রেমপ্রবাহিনী’, ‘বন্ধুবিয়োগ’, ‘নিসর্গসন্দর্শন’। এই কাব্যগুলি পড়িতে আরম্ভ করিলেই যে কোনও পাঠক লক্ষ্য করিবেন, ইহার ভাষা। কবি যেন কবিতা লিখিতে বসেন নাই, তাঁহার মনে যেন সে বিষয়ে এতটুকু ভানও নাই। তাঁহার ভাব যেমন শিশুর মত সরল, ভাষাও তেমনই শিশুর মতই উলঙ্গ। এমন অসঙ্কোচ সারল্য, কবিতা লিখিবার কালে এমন আত্ম-বিস্মৃতি— এমন নিরহঙ্কার ও নিরলঙ্কারের স্ফূর্ত্তি আর কোনও কাব্যরচনায় দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। আজকাল যে প্রাচীন ও অর্ব্বাচীনের দল ভাষাকে সরল করিবার জন্য তথাকথিত কথ্যভাষার ওকালতী করিয়া থাকেন, তাঁহাদের আদর্শ কি তাঁহারাই জানেন, তথাপি বিহারীলালের এই সকল কাব্যের ভাষা যদি তাঁহারা দেখিয়া থাকেন তবে তাঁহাদিগকে হতাশ হইতে হইবে। কারণ, কৃত্রিম কথ্যভাষা অপেক্ষা অনায়াসসাধ্য সাধুভাষা যে বহুক্ষণে অকৃত্রিম, তাহাতে সন্দেহ নাই। এবং ভাষাকে যদি সহজ ও সরল করিতে হয় তবে বিহারীলালের মত, ভাবের সারল্যই শুধু নয়, খাঁটি বাংলাভাষাভাষী হওয়া চাই। এ ভাষা আমরা ভুলিয়াছি, এবং বিহারীলালের মত বুকে-মুখে এক হওয়ার মত আন্তরিকতাও দুর্লভ; কাজেই সরল হইতে গিয়া ভাষা যে কত কুৎসিৎ ও কৃত্রিম হইয়া ওঠে, তাহার প্রমাণ আজকাল সর্ব্বত্র। ইংরাজ কবি Wordsworth ও এইরূপ ভাষাকেই কাব্যের বাহন করিবার পক্ষে ওকালতী করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনিও এ আদর্শ রক্ষা করিতে পারেন নাই। বিহারীলালের এই ভাষা লক্ষ্য করিয়াই তাঁহার কবি-প্রেরণার বৈশিষ্ট্য সহজেই ধরা পড়িবে। কাব্যসৃষ্টিতে ভাষার আর্ট যেটুকু থাকিবেই—’unpremeditated art’-র ভাষাতেও কবি-প্রতিভা যে অনায়াস-দীপ্তি দান করে, ভাব-মুখর কবির বাণী শব্দের যে মণিমাণিক্যভূষণে আপনা হইতেই ভূষিত হইয়া উঠে—বিহারীলালের কাব্যে, বিশেষতঃ ‘সারদামঙ্গলে’, তাহার প্রচুর নিদর্শন আছে। কিন্তু সাধারণতঃ বিহারীলালের কবি-প্রকৃতিতে সে ধরণের উন্মাদনা—কবি কীটস যে কবি স্বপ্নকে
—upon the night’s starred face
Huge cloudy symbols of a high romance,
বলিয়াছেন, সে ধরণের রূপ-রসের উৎকণ্ঠা ছিল না। বায়ু, জল,সূর্যালোকের যে অতি সহজ প্রীতি-প্রেরণা—সমাজ, সংসার ও প্রকৃতির সেই অতি পরিচিত পরিবেশের প্রভাবেই তাঁহার কবি-হৃদয় বিকশিত হইয়াছিল। এই নিত্যপরিচিত বহিঃপ্রকৃতিকে, এই নিত্যকার ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখকেই তিনি অতি গভীর ভাবে অনুভব করিয়াছিলেন; এইজন্য তাঁহার কাব্যে আমরা ভাবনা অপেক্ষা ভাব, কল্পনা অপেক্ষা প্রীতি-বিভোরতা, যাহা-নাই তাহার উদ্ভাবনা অপেক্ষা যাহা আছে তাহা হইতেই ‘আনন্দলোক বিরচন’ করিবার সাধনা লক্ষ্য করি। ইহারই প্রমাণ স্বরূপ আমি কিছু উদ্ধৃত করিব।
বাল্যবন্ধুদিগকে স্মরণ করিয়া কবি তাঁহার ‘বন্ধুবিয়োগ’-নামক কাব্য রচনা করেন; সেই প্রীতি ও তাহার স্মৃতির একটি চিত্র এইরূপ—
স্নানের সময় পড়িতেম গঙ্গাজলে,
সাঁতার দিতেম মিলে একত্রে সকলে।
তুলার বস্তার মত উঠিতেছে ঢেউ,
ঝাঁপাতেছে, লাফাতেছে, গড়াতেছে কেউ।
আহ্লাদের সীমা নাই, হোহো কোরে হাসি,
নাকে মুখে জল ঢুকে চক্ষু বুজে কাসি।
তবু কি নিবৃত্তি আছে, ধুম বাড়ে আরো,
ডুবাডুবি লুকাচুরী খেল যত পারো।
তারপর-
চিনের বাদাম কিনে মাঝখানে ধোরে,
খেতেম সকলে মিলে কাড়াকাড়ি কোরে।
হেসে খেলে কোথা দিয়ে কেটে যেত দিন
সে দিন কি দিন, হায় এ দিন কি দিন!
বাল্যবন্ধু পূর্ণচন্দ্রের উদ্দেশে বলিতেছেন—
পূর্ণচন্দ্র! ছিলে তুমি পূর্ণ দয়া গুণে;
কেঁদে ভেসে যেতে ভাই পর দুখ শুনে।
তাদৃশ ছিল না কিছু সঙ্গতি তোমার,
কোরে গেছ তবু বহু পর উপকার।
সেই দিন, চির দিন রয়েছে স্মরণ,
যে দিনেতে নেয়ে এলে উলঙ্গ মতন।
নটার সময় তুমি করিতেছ স্নান,
সেদিন হয়েছে গাঙে বেতর তুফান;
ঝড়ের ঝাপটে এক নৌকা ডুবে গেল,
একজন ডুবে ডুবে তীরে বেঁচে এল।
জল থেকে উঠিবার কি হবে উপায়,
বস্ত্র নাই, কিন্তু কার কাছে গিয়ে চায়।
থর থর কাঁপিতেছে শীতেতে শরীর,
দর দর বহিতেছে দুই চক্ষে নীর।
দুৰ্দ্দশা দেখিয়া কেঁদে উঠিল পরাণ,
পরিধান বস্ত্র তার করে করি দান,
ছেঁড়া গাম্ছাখানি খুলে আপনি পরিয়ে,
হাসিতে হাসিতে এলে বাটিতে চলিয়ে।
আবরুর প্রতি ছিল বিলক্ষণ বোধ,
গ্রাহ্য কর নাই তবু তার অনুরোধ।
সেই দিন চির দিন রয়েছে স্মরণ,
যে দিনেতে নেয়ে এলে উলঙ্গ মতন।
এ কাহিনীর মধ্যে কোনও কবিত্ব আছে? ভাষা, ছন্দ, উপমার কোন কারিগরি আছে? ‘পলাশীর যুদ্ধ’ বা ‘বৃত্রসংহারের তুলনায় এ কবিতার কবিত্ব কোথায়? সাধারণ পাঠকের মনে কাব্যের যে আদর্শ আছে, তাহাতে এ কবিতা কোনও কবিনামধারী ব্যক্তির উপযুক্ত বলিয়া মনে হইবে কি? কিন্তু বিহারীলালের কাব্য বুঝিতে হইলে আগে কবিমানুষটিকে বুঝিতে হইবে। এই সকল কবিতায় মানব—চরিত্রের যে দিকটির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পাইয়াছে, ইহাতে যে ধরণের বীরত্ব স্পৃহা ও সৌন্দর্যপ্রীতির নিদর্শন আছে, তাহাই বিহারীলালের কবিকল্পনার উৎস— সারদামঙ্গলের কবির সেই ভাব-বিভোরতার মূলে, এই ধরণের বাস্তব-প্রীতিই প্রবল। পদ্ম যেমন তাহার সর্ব্বাঙ্গ-শতদল মেলিয়া বায়ু, আলোক ও হিমকণা পান করিয়া মধু-সৌরভে পরিপূর্ণ হয়, বিহারীলালের কবিহৃদয়ও সেইরূপ সহজ নৈসর্গিক পুষ্টিলাভ করিয়া বাংলা কাব্যে একটি গাঢ় ও গূঢ় রস সঞ্চার করিয়াছে।
বিহারীলালের ভাষা ও বর্ণনা-ভঙ্গীর আরও কিছু নমুনা উদ্ধৃত করিলাম। ‘নভোমন্ডল’কে সম্বোধন করিয়া কবি বলিতেছেন—
তোমার প্রকান্ড ভান্ড অনন্ত উদরে,
প্রকান্ড প্রকান্ড গ্রহ বোঁবোঁ কোরে ধায়,
কিন্তু যেন তারা সব অগাধ সাগরে
মাছের ডিমের মত ঘুরিয়া বেড়ায়।
‘ঝটিকাসম্ভোগ’ নামক কবিতায় কবি ‘আশ্বিনে ঝড়ের সুখ-সম্ভোগ করিতেছেন—
খাটে শুয়ে আছি, দেখ বন্ধ আছে ঘর,
তবুও দুলিছে খাট লইয়া আমায়;
বেশ তো, রয়েছি যেন বজ্রার ভিতর,
ঢলঢল করে তরী লহরী-লীলায়।
কবি বলিতেছেন, এ ঝড়ে যদি সবাই মরে, আমারই বাঁচিয়া কি লাভ?
একা ভেকা হয়ে আমি বাঁচিতে না চাই,
মরি যদি সকলের সঙ্গে যেন মরি;
যত খুশী ঝোড়, ঝুড়ি! লাফাই ঝাঁপাই
মোরীয়া মেজাজ মোর, তোরে নাহি ডরি।
ভাষায় rhetoric বা declamation-এর লেশ নাই বলিয়া এই উচ্চ প্রাণপূর্ণ অনুভূতিও আমাদের চিত্ত স্পর্শ করে না, আমাদের কাব্য-সংস্কার এমনই মিথ্যা ও কৃত্রিম! পাঠকের বোধ হয় ধৈর্য্যচ্যুতি হইতেছে—এ কাব্য যে একেবারে সাদা জল! ইহাতে না আছে সুগন্ধি মসলার ঝাঁজ, না আছে রঙের নেশা— কিন্তু উপায় কি? কবি যেন পণ করিয়াছেন, তিনি কাব্যকলার দিক দিয়াও যাইবেন না—কেবল নিজের প্রাণের কথা মুখের ভাষায় ব্যক্ত করিবেন। নিম্নোদ্ধৃত শ্লোকগুলিতে কবি যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু কবিত্ব করিয়া ফেলিয়াছেন—
কভু ভাবি’ কোনো ঝরণার—
উপলে বন্ধুর যার ধার,
প্যাক প্রচন্ড প্রপাত-ধ্বনি,
নিক বায়ুবেগে প্রতিধ্বনি
চাকরি চতুৰ্দ্দিকে হতেছে বিস্তার,
গিয়ে তার তীরতরুতলে,
পুরু পুরু নধর শাদ্বলে
ডুবাইয়া এ শরীর
শব সম রব স্থির
তার কান দিয়ে জল কলকলে।
কভু ভাবি পল্লীগ্রামে যাই,
নাম ধাম সকলই লুকাই;
চাষীদের মাঝে রয়ে
চাষীদের মত হয়ে
চাষীদের সঙ্গেতে বেড়াই।
বাজাইয়া বাঁশের বাঁশরী,
শাদা সোজা গ্রাম্য পথ ধরি।
সরল চাষার সনে
প্রমোদ-প্রফুল্ল মনে
কাটাই আনন্দে শব্বরী।
বরষায় যে ঘোর নিশায়
সৌদামিনী মাতিয়ে বেড়ায়,
ভীষণ বজ্রের নাদ,
ভীষণ বজ্রের নাদ,
ভেঙ্গে যেন পড়ে ছাদ,
বাবু সব কাঁপেন কোঠায়—
সে নিশার আমি ক্ষেত্রতীরে
নড়বোড়ে পাতার কুটিরে,
স্বচ্ছন্দে রাজার মত
ভূমে আছি নিদ্রাগত,
প্রাতে উঠি দেখিব মিহিরে।
বিহারীলালের কবিতার ক্রমবিকাশে, ভাব ও সুরের যে ভঙ্গী অতঃপর বাংলা কাব্যের মর্মমূলে রস-সঞ্চার করিয়াছে তাহার প্রথম স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় তাঁহার ‘বঙ্গ সুন্দরী’-কাব্যে; উপরি-উদ্ধৃত পংক্তিকয়টি এই কাব্যের অন্তর্গত। ইহার পর আমি যে কবিতাটি উদ্ধৃত করিব তাহাতে বিহারীলালের কবিশক্তির পূর্ণ পরিচয় ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই কবিতাটি পড়িবার সময়ে পূর্ব্বোদ্ধৃত কবিতাগুলি স্মরণ করিলে—সেই কাব্য-বীজ কেমন অঙ্কুরিত হইয়া অপূর্ব্ব পুষ্পরূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা সহজেই অনুমিত হইবে। কবিতাটির নাম—’নিশান্ত সঙ্গীত’। প্রথমে প্রভাত—সমীরণকে সম্বোধন করিয়া কবি বলিতেছেন—
আলুথালু হয়ে প্রিয়া
আছে সুখে ঘুমাইয়া,
আলুথালু কুন্তলে সুখে খেলা কর।
বড় তুমি চুলবুলে
গোলাপের দল খুলে
আগত কমি
ছড়ায়ে কপোলে-চুলে হাসিয়া আকুল।
তোমারি আনন্দোৎসবে
মত্ত ফুলতরু সবে
মুদিত নয়ন-পদ্ম করে দুল দুল। —
তারপর প্রেয়সীর মুখপানে চাহিয়া—
আহা এই মুখখানি
প্রেমমাখা মুখখানি— দ্বা
ত্রিলোক-সৌন্দৰ্য্য আনি কে দিল আমায়!
সদাই দেখিরে ভাই,
তবু যেন দেখি নাই,
যেন পূৰ্ব্বজন্মকথা জাগে মনে মনে;
অতিদূর দিগন্তরে
কে যেন কাতর স্বরে
কেঁদে কেঁদে উঠে ক্ষণে ক্ষণে!
তারপর কবি তাঁর প্রিয়তমাকে জাগাইতেছেন; এই জাগরণী গান অতুলনীয়। মিল্টনের মহাকাব্যে Eve-কে জাগাইবার জন্য Adam-এর উক্তি, এবং তাহারই অনুকরণে মেঘনাদবধকাব্যে নিদ্রিতা প্রমীলার কর্ণে ইন্দ্রজিতের সপ্রেম গুঞ্জরণ, অথবা Victor Hugo-র সুবিখ্যাত Serenade —গান—কাব্যসাহিত্যে অমূল্য সম্পদ; কিন্তু এ কবিতায় শুধু কাব্য নয়—শিশিরবিন্দুতে সূর্য্যবিম্বের মত, কবির সমস্ত কল্পনা—মন্ডল প্রতিফলিত হইয়াছে। একাধারে বাস্তব-প্রেম ও অবাস্তব সৌন্দর্য্য-পিপাসা মিটাইবার যে সাধনা তিনি করিয়াছিলেন, তাহারই একটি সহজ ও সরল, অথচ গভীর ও মধুর গীতোচ্ছ্বাস এই কয়টি শ্লোকে ধ্বনিত হইয়াছে—
উঠ প্রেয়সী আমার,
উঠ প্রেয়সী আমার,
হৃদয়-ভূষণ, কত যতনের হার!
হেরে তব চন্দ্রানন
তাঁর যেন পাই ত্রিভুবন
অন্তরে উথলি উঠে আনন্দ অপার!
উঠ প্রেয়সী আমার!
প্রতিদিন উঠি’ ভোরে
আগে আসি’ দেখি তোরে,
মন-প্রাণ ভরি’ ভরি’ সাথে করি দরশন।
বিমল আননে তোর
জাগিছে মুরতি মোর,
ঘুমন্ত নয়ন দু’টি যেন ধ্যানে নিমগন।
তোমার পবিত্র কায়া—
প্রাণেতে পড়েছে ছায়া,
মনেতে জন্মেছে মায়া, ভালবেসে সুখী হই।
ভালবাসি নারী-নরে
ভালোবাসি চরাচরে,
সদাই আনন্দে আমি চাঁদের কিরণে রই।
উঠ প্রেয়সী আমার,
উঠ প্রেয়সী আমার—
জীবন-জুড়ানো ধন, হৃদি-ফুলহার!
উঠ প্রেয়সী আমার।
মধুর মুরতি তব
ভরিয়া রয়েছে ভব,
সমুখে ও মুখশশী জাগে অনিবার।
কি জানি কি ঘুমঘোরে
কি চক্ষে দেখিছি তোরে,
এ জনমে ভুলিতে রে পারিব না আর।
নয়ন-অমৃতরাশি প্রেয়সী আমার!
ওই চাঁদ অস্তে যায়,
বিহঙ্গ ললিত গায়,
মঙ্গল-আরতি বাজে নিশি অবসান;
হিমেল হিমেল বায়,
হিমে চুল ভিজে যায়,
শিশির মুকুতাজালে ভিজেছে বয়ান—
উঠ প্রেয়সী আমার মেল নলিন নয়ান!
এই ‘নিশান্ত সঙ্গীত’ শুধুই দাম্পত্য প্রেমের পূর্ণ সুখ সম্ভোগ নয়; এ প্রেম বিশ্ব নিখিলের সঙ্গে কবিহৃদয়কে যুক্ত করিয়াছে; কবির চিত্তাকাশে দিগন্তব্যাপিনী ঊষার সমারোহে মঙ্গল আরতি-গানের সঙ্গে সঙ্গে “নিশি অবসান’ হইতেছে। এইখানেই এই গীত-কল্পনার মৌলিকতা; এই মানব-সুলভ স্বাভাবিক প্রেমই শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য্য-ধ্যানের সহায় হইয়াছে—বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবহৃদয়ের এই যে মিলন-তীর্থ কবি আবিষ্কার করিয়াছেন, ইহাই তাঁহার কাব্যসাধনার মূলমন্ত্র। প্রীতি, প্রেম, স্নেহ, ভক্তি প্রভৃতি সাধারণ হৃদয়বৃত্তি হইতে খাঁটি সৌন্দর্য্য-পিপাসা যে স্বতন্ত্র, আধুনিক Aesthetics-শাস্ত্রের ইহাই গোড়ার কথা। বাস্তব প্রয়োজনের মতই, বাস্তব হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে খাঁটি সৌন্দর্য্যপ্রীতির সম্পর্ক নাই; সৌন্দৰ্য্যবোধ মানব মনের এমন একটা বৃত্তি যে, তাহার পূর্ণ স্ফূর্ত্তির কালে Intellect বা Emotion, এ দুয়ের কোনটাই ক্রিয়াশীল থাকে না; এজন্য কবি যখন সেই আদি সৌন্দর্য্যরূপিণীকে সম্বোধন করিয়া বলেন—
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী
হে নন্দনবাসিনী ঊৰ্ব্বশী।
—তখন কথাটা বুঝিতে বিলম্ব হয় না। কিন্তু বিহারীলাল যখন ঠিক ইহার উল্টা কথাই বলেন, অর্থাৎ—তুমি মাতা, তুমি কন্যা, তুমি বধূ, যথা—
মানবের কাছে কাছে
সদা সে মোহনী আছে,
যে যেমন তার ঘরে
তেমনি মুরতি ধরে—
—তখন সৌন্দর্য্যের এই ধারণায় বাধা জন্মে। তবে কি বিহারীলালের সৌন্দর্য্যবোধ খুব সূক্ষ্ম, সুমার্জ্জিত নয়? রসাবস্থার যে ব্রহ্মাস্বাদ শ্রেষ্ঠ কবি বা রসিকেরই আয়ত্ত তাহা কি বিহারীলালের ঘটে নাই?—এই প্রশ্নের মীমাংসাই বিহারীলালের কাব্য—আলোচনার মূল সমস্যা। এইটি বুঝিয়া লইতে পারিলেই ‘সারদামঙ্গলের’ কবিকে আমরা কতকটা চিনিয়া লইতে পারিব। এইজন্য এইখানে বিহারীলালের কাব্য-পরিচয় একটু স্থগিত রাখিয়া আমি এই সৌন্দর্য্যতত্ত্বের একটা মোটামুটি আলোচনা করিব, তাহাতে বিহারীলালের কবি-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য বুঝিবার পক্ষে সুবিধা হইতে পারে।
আলোচনার সুবিধার জন্য বিহারীলালের পরে যে একমাত্র কবির কাব্যে এই সৌন্দর্য্যতত্ত্বের একটা সজ্ঞান ধারণা বহুস্থলে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে—সেই রবীন্দ্রনাথের কাব্য হইতেই আমি উদাহরণ সংগ্রহ করিব। রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের ঠিক সমপন্থী না হইলেও তাঁহার কাব্যে বিহারীলালের প্রকৃষ্ট প্রভাব আছে, এই জন্য রবীন্দ্রনাথের তুলনায় বিহারীলালকে বুঝিবার সুবিধা হইবে। কিন্তু তৎপূৰ্ব্বে আমি রবীন্দ্রনাথের এমন একটি কবিতা উল্লেখ করিব, যাহার বিচার এ প্রসঙ্গে বড়ই উপযোগী বলিয়া মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বশী’—কবিতাটি ভাষা, ছন্দ ও চিত্র—রচনার ইন্দ্রজালে যতই মনোহর হউক, ঐ কবিতায় কবির মূল কল্পনা বিচলিত হইয়াছে। ঊর্ধ্বশীর যে-চিত্র এখানে ফুটিয়াছে, তাহাতে সৌন্দর্য্যলক্ষ্মী কামনা—লক্ষ্মীরূপেই দেখা দিয়াছে। উৰ্ব্বশীকে কামনা-লক্ষ্মীরূপেই বরণ করিতে কাহারও আপত্তি নাই, বরং তাহার সেই রূপই এখানে রসসৃষ্টি করিয়াছে। কিন্তু উৰ্ব্বশীকে কবি আদর্শ-সৌন্দর্য্যের আদি-প্রতিমা রূপে কল্পনা করিয়া এমন সকল চিত্র ও বিশেষণ যোজনা করিয়াছেন যে, তাহাতে স্ববিরোধী ভাবের সমাবেশ হইয়াছে। কবি এই কবিতায় কামনাকে যে-রূপ দিয়াছেন তাহাই পাঠককে মুগ্ধ করে, কিন্তু এই কামনার সম্পর্কে তিনি যে সৌন্দর্য্যের আদর্শ খাড়া করিতে চাহিয়াছেন একটু ভাবিয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে, তাহা এ কল্পনার কত বিরোধী। এইজন্য সৌন্দর্য্যতত্ত্বের দিক দিয়া আমি এই কবিতাটি একটু বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইতে চাই।
কবি বলিতেছেন, এই উৰ্ব্বশী, ‘আদিম বসন্তপ্রাতে উঠেছিল মন্থিত সাগরে, ডান হাতে সুধাপাত্র, বিষভান্ড লয়ে বাম করে।’ বেশ, কিন্তু বিষভান্ডের ভাবনা যেখানে আছে সেখানে খাঁটি সৌন্দর্য্যানুভূতির কথা আসিতে পারে না-কাম বা প্রেমের কথাই বড় হইয়া উঠে, কারণ— ‘a thing of beauty is a joy of ever’; খাঁটি aesthetic pleasure যেখানে আছে, সেখানে বিষও অমৃত হইয়া উঠে। উর্ধ্বশীর রূপ যে কামনার উদ্রেক করে তাহাতে—
মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল,
তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল, …
অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা,
নাচে রক্তধারা।
কবি এ কোন্ সৌন্দর্য্যের বন্দনা করিতেছেন? নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ’ বলিয়া যাহার উদ্বোধন করিয়াছেন, সে ‘ঊষার উদয় সম অনবগুণ্ঠিতা’, এবং ‘অকুণ্ঠিতা’ হইতে পারে; কিন্তু তাহারই ‘কটাক্ষঘাতে’ যদি ‘ত্রিভুবন যৌবন-চঞ্চল’ হইয়া উঠে, তবে মাতা, কনা বা বধূ না-হওয়াটা তার গৌরবের কারণ নয়-সে মোহিনী, শ্রেষ্ঠ ভাব-সমাধির বিঘ্নরূপিণী স্বর্গবেশ্যা মাত্র; তাই ‘সৰ্ব্বাঙ্গ কাঁদিবে তাঁর নিখিলের নয়ন-আঘাতে’ ইহাই অধিকতর সত্য। এইরূপ সৌন্দর্য্যের উদয়, শুধুই আদি যুগে নয়, যুগে যুগে মানবচিত্তে হইয়া থাকে; এ সৌন্দর্য্যে—স্বর্গের উদয়াচল নয়, মর্ত্যেরই উদয়াচল ও অস্তাচল-উভয়াচলবাসিনী; এবং ইহার জন্য যে ক্রন্দন তাহা আদি যুগ হইতে আজ পর্য্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন হইয়া আছে। এই কবিতার স্ববিরোধী কল্পনার আরও প্রমাণ এই যে, যাহাকে কবি বালিকারূপে ‘আঁধার পাথারতলে’ ‘অকলঙ্ক হাস্যমুখে প্রবাল-পালঙ্কে ঘুমাইতে দেখিবার কল্পনা করিয়াছেন এবং যৌবনে যাহার কিটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবন-চঞ্চল’ বলিয়াছেন, তাহাকেই নিত্যপূর্ণ ও স্বয়ম্প্রকাশ সৌন্দর্য্যের প্রতীক রূপে কল্পনা করিয়া প্রশ্ন করিতেছেন—’বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশি কবে তুমি ফুটিলে উৰ্ব্বশী?’ এখন প্রশ্ন হইতেছে রবীন্দ্রনাথের মত কবির কল্পনায় এমন গোল বাধিল কেন? ইহার একমাত্র উত্তর—রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায়, য়ুরোপীয় কাব্যের অতিরিক্ত প্রভাবে নিজের কবি—ধৰ্ম্ম বিস্মৃত হইয়াছেন, তাই কল্পনারও সঙ্গতি রক্ষা হয় নাই। এ ঊৰ্ব্বশী লক্ষ্মীও নয়, বেদ-পুরাণের ঊর্ধ্বশীও নয়, অথবা রবীন্দ্রনাথের নিজের সৃষ্টিও নয়; এ উৰ্ব্বশী—কাম-জননী গ্রীক দেবী Aphrodite’র নব্য য়ুরোপীয় রোমান্টিক সংস্করণ—”Mother of Love” এবং “Mother of Strife.”। য়ুরোপীয় কাব্যে সৌন্দর্য্যের সহিত কামনার ও বেদনার যে অপূৰ্ব্ব উৎকণ্ঠা যুক্ত হইয়া সাহিত্যকে মানুষের জীবনের বাস্তবতম অনুভূতির প্রকাশ-কলায় পরিণত করিয়াছে—যার মৰ্ম্মস্থল হইতে ‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thought’ –কবির এই কাতরোক্তি নিঃসৃত হওয়াই স্বাভাবিক, রবীন্দ্রনাথ এখানে সৌন্দর্য্যের সেই আদর্শে আকৃষ্ট হইয়াছেন; কিন্তু সে আকর্ষণ সত্ত্বেও রূপের এই পার্থিবতা, এই ইন্দ্রিয়সৰ্ব্বস্বতাকে মনে-প্রাণে বরণ করিতে পারেন নাই। তাই তাঁহার ঊৰ্ব্বশী ‘নন্দনবাসিনী’ ও সুর সভার নর্তকী হইলেও ‘স্বর্গের উদয়াচলে মূৰ্ত্তিমতী তুমি হে ঊষসী’—ঋষির এই ঋমন্ত্রে তাহাকে বন্দনা করিতে তাঁহার বাধে না। আবার যাহার নৃত্যচ্ছন্দে-—
ছন্দে ছন্দে নাচি’ উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল,
—এমন কামনা-লেশহীন প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য-মহিমায় মহিমময়ী, ‘যার স্তনহার হ’তে দিগন্তরে খসি পড়ে তারা’, তাহারি ‘কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবন-চঞ্চল’ এবং ‘অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা, নাচে রক্ত-ধারা’! ঊর্ধ্বশীর কল্পনায় এই স্ববিরোধী ভাব কবিতাটির পূর্ণ রস-পরিণতির পক্ষে বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কারণ, যে কামনার দিকটি ইহাতে স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে তাহাকে পূর্ণ প্রকটিত করা হয় নাই; ঊর্ধ্বশীর বাম করে কবি যে বিষভান্ড দিয়াছেন তাহাতে অনন্ত যৌবনা’ ‘বিলোল হিল্লোল’-ঊর্ধ্বশীর সেই কটাক্ষঘাত, এবং—
জগতের অশ্রুধারে ধৌত তব তনুর তনিমা,
ত্রিলোকের হৃদি-রক্তে আঁকা তব চরণ-শোনিমা—
ও ‘মুক্তবেণী বিবসনে’ প্রভৃতি সম্বোধনে পাঠকের মনে যে রসের উদ্রেক হয় তাহাই এই কবিতার প্রধান রস-সেই কামনা ও কামনার সেই বিষর্জ্জরতার ক্রন্দন—উদ্দীপনেই এখানে সেই Sweetest song-এর সার্থকতা। যে ইংরেজী কবিতার প্রভাব এ কবিতায় আছে বলিয়া আমার বিশ্বাস Atalanta in Calydon-এর সেই সুবিখ্যাত Chorus হইতে কিছু উদ্ধৃত করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন, আমি প্রভাবের কথা কেন বলিয়াছি, এবং আরও বুঝিবেন, Swinburne-এর কবিতায় এই রস কেমন গাঢ় ও উজ্জল হইয়া উঠিয়াছে—রবীন্দ্রনাথের কল্পনা, রক্ত-মাংসের বিক্ষোভ ও কামের প্রাধান্য স্বীকার করে না বলিয়া ইন্দ্রিয়ার্থকেও অতীন্দ্রিয় ভাববিলাসে কতকটা আচ্ছন্ন করিয়াছে। এই ঊৰ্ব্বশী বা Aphrodite-এর উদ্দেশে Swinburne গাহিয়াছেন—
An evil blossom was born
Of sea-foam and the frothing of blood,
Blood-red and bitter of fruit,
And the seed of it laughter and tears,
And the leaves of it madness and scorn;
A bitter flower from the bud,
Sprung of the sea without root,
Sprung without graft from the years.
The weft of the world was untorn
That is woven of the day on the night,
The hair of the hours was not white
Nor the raiment of time overworn,
When a wonder, a world’s delight,
A perilous goddess was born;
And the waves of the sea as she came
Clove, and the foam at her feet,
Fawning, rejoiced to bring forth
A fleshly blossom, a flame
Filling the heavens with heat
To the cold white ends of the north.
What hadst thou to do being born,
Mother, when winds were at ease,
As a flower of the springtime of corn,
A flower of the foam of the seas?
For bitter thou wast from thy birth,
Aphrodite, a mother of strife;
For before thee some rest was on earth,
A little respite from tears,
A little pleasure of life;
For life was not then as thou art,
But as one that waxeth in years
Sweet-spoken, a fruitful wife;
Earth had no thorn, and desire
No sting, neither death any dart;
What hadst thou to do amongst these,
Thou, clothed with a burning fire,
Thou, girt with sorrow of heart,
Thou, sprung of the seed of the seas
As an ear from a seed of corn,
As a brand plucked forth of a pyre,
As a ray shed forth of the morn,
For division of soul and disease,
For a dart and a sting and a thorn?
What ailed thee then to be born?
………. but the
Who shall discern or declare?
In the uttermost ends of the sea
The light of thine eyelids and hair,
The light of thy bosom as fire
Between the wheel of the sun
And the flying flames of the air?
Wilt thou turn thee not yet nor have pity,
But abide with despair and desire
And the crying of armies undone,
Lamentation of one with another
And breaking of city by city;
The dividing of friend against friend,
The severing of brother and brother;
Wilt thou utterly bring to an end?
Have mercy, mother!
এই কবিতা আমি সংক্ষেপে উদ্ধৃত করিলাম। এই কবিতা রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় কতখানি প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, তাহা নিরূপণ করা এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ সম্প্রতি কাব্যবিচার প্রসঙ্গে অনুকরণ ও স্বীকরণের যে প্রভেদ নির্দ্দেশ করিয়াছেন—তাহা এই প্রসঙ্গে পাঠককে স্মরণ করিতে বলি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বশীর কল্পনামূলে Swinburne-এর Aphrodite যে অনেকখানি আবেগ সঞ্চার করিয়াছে, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ এই উদ্ধৃত অংশগুলির মধ্যে মিলিবে। Swinburne-এর Aphrodite-র সৌন্দর্য্য যেমন “An evil blossom… blood red and bitter of fruit. And the seed of it laughter and tears, “ রবীন্দ্রনাথের উব্বশীও তেমনই উঠেছিল মন্থিত সাগরে, ডান হাতে সুধাপাত্র, বিষভান্ড লয়ে বাম করে, Swinburne-এর Aphordite যেমন ‘Sprung of the sea without root, sprung without graft from the years’ তেমনই রবীন্দ্রনাথও তাঁহার উব্বশীকে প্রশ্ন করিতেছেন— ‘বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশি করে তুমি ফুটিলে উৰ্ব্বশী!’ Swingburne-এর Aphrodite অবশ্য উর্ধ্বশীর মত নর্তকী নয়, তথাপি উব্বশীর নৃত্যছন্দে যেমন ‘সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল’ এবং শস্যশীর্ষে ধরার অঞ্চল’ হিল্লোলিত হইয়া উঠে, তেমনি Aphrodite-র সৌন্দর্য্যের ব্যাপ্তি ও বিকাশ এইরূপ—
In the uttermost ends of the sea
The light of thine eyelids and hair.
—এখানে Aphrodtie-র অপেক্ষা উর্ধ্বশীর কবির কল্পনা অধিকতর স্ফূর্ত্তি পাইয়াছে। কিন্তু—
The light of thy bosom as fire
Between the wheel of the sun
And the flying flames of the air?
—এই পক্তি কয়টির সংক্ষিপ্ত paraphrase—’তব স্তনহার হ’তে দিগন্তরে খসি পড়ে তারা’ রবীন্দ্রনাথের উর্ধ্বশীর সৌন্দর্য্যকে স্নিগ্ধ করিয়া তুলিয়াছে— ‘flying flames of the air’-র পরিবর্তে ‘খসি পড়ে তারা’ original-র চেয়ে যেন শতগুণে suggestive হইয়াছে। আবার—
Wilt thou turn thee not yet nor have pity,
But abide with despair and desire
এবং
জগতের অশ্রুধারে ধৌত তব তনুর তনিমা,
ত্রিলোকের হৃদি-রক্তে আঁকা তব চরণ-শোনিমা।
—প্রকৃতি, ভাবনার বিভিন্ন ভঙ্গী হইলেও, অথবা স্থানে স্থানে, যেমন—
And the waves of the sea as she came
Clove, and the foam at her feet
Fawning, —
তরঙ্গিত মহাসিন্ধু মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মত
পড়েছিল পদপ্রান্ত উচ্ছ্বাসিত কণা লক্ষ শত
করি অবনত।
—একেবারে অনুবাদের মত হইলেও, উভয়ের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য আছে, তাহা এই ‘উৰ্ব্বশী’ কবিতাটিকে দুর্ব্বল করিয়াছে; এবং যেখানে কল্পনার যেটুকু সাদৃশ্য সেইখানেই তাহা পাঠককে মুগ্ধ করে। দুয়েরই সৌন্দর্য্যের মূল কারণ কামনা। সেই কামনাকেই রবীন্দ্রনাথ একটি স্নিগ্ধ অতিন্দ্রিয়তায় মন্ডিত করিতে গিয়া পারেন নাই, কেন্দ্রগত ভাবটি দ্বিধাভিন্ন হইয়া রসাভাস ঘটাইয়াছে।
এই কবিতাটি লইয়া এইরূপ বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন এক্ষেত্রে না থাকিলেও বিষয়টি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয়। সৌন্দর্য্যকল্পনার একটা দিক—যে সৌন্দর্য্য মানুষের কামনায় প্রদীপ্ত হইয়া সাহিত্যের একদিক উজ্জ্বল করিয়াছে, এখানে তাহারই কিঞ্চিৎ পরিচয় করিলাম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাব্যেই সৌন্দর্য্যের যে আর একটি আদর্শ ফুটিয়া উঠিয়াছে এইবার সংক্ষেপে তাহারও উল্লেখ করিব; উদ্ধৃতি—বাহুল্য ভয়ে আমি সে সকল কবিতা উদ্ধৃত করিব না; নির্দ্দেশ করিব মাত্র। পাঠক দেখিবেন, ‘বলাকা’র দুইনারী’-শীর্ষক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উব্বশী ও লক্ষ্মী দুয়েরই দুই-রূপ বর্ণনা করিয়া লক্ষ্মীর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হইয়াছেন। “বিজয়িনী’-কবিতায় কবি অচ্ছোদ সরসীতীরে সৌন্দর্য্যের একখানি অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিমা নির্ম্মাণ করিয়া মদনকে তাহার নিকট পরাভাব স্বীকার করাইয়াছেন। ‘চিত্রাঙ্গদা’-কাব্যে চিত্রাঙ্গদার স্বর্গীয় রূপ-লাবণ্য দর্শনে অৰ্জ্জুনের সেই চিত্ত—চমৎকার স্মরণ করুন—
“কেন জানি অকস্মাৎ
তোমারে হেরিয়া বুঝিতে পেরেছি আমি
কি আনন্দকিরণেতে প্রথম প্রত্যুষে
জাতি ক অন্ধকার মহার্ণবে সৃষ্টি-শতদল
দিগ্বিদিকে উঠেছিল উন্মেষিত হয়ে
আমার এক মুহূর্ত্তের মাঝে—
“*** চারিদিক হতে
দেবের অঙ্গুলি যেন দেখায়ে দিতেছে
মোরে, ওই তব অলোক আলোক মাঝে
গ্রীন কীর্ত্তিক্লিষ্ট জীবনের পূর্ণ নির্ব্বাপণ।”
অথবা অন্যত্র
“ভাবিলাম
কত যুদ্ধ, কত হিংসা, কত আড়ম্বর,
পুরুষের পৌরুষ-গৌরব, বীরত্বের
নিত্য কীৰ্ত্তিষা, শান্ত হয়ে লুটাইয়া
পড়ে ভূমে, ওই পূর্ণ সৌন্দর্য্যের কাছে,
নারী পশুরাজ সিংহ যথা সিংহবাহিনীর
ভুবন-বাঞ্ছিত অরুণ চরণতলে!”
—সৌন্দর্য্যেবোধের এই আর এক আদর্শ। এখানে শুধু কামনা নয়, পুরুষের পৌরুষ স্তম্ভিত হইয়া যায়, যেন জীবন-মুক্তি ঘটে। এখানে কোনও কৰ্ম্ম-প্রবৃত্তি হৃদয়বৃত্তির অবকাশ নাই; আমরা জীবন বলিতে যাহা বুঝি, সেই দ্বন্দ্ব ও বিক্ষোভ এখানে শান্ত হইয়া যায়; ক্ষুদ্র চেতনা যেন এক বৃহত্তর চেতনায় বিলীন হয়—ইহারই নাম “জীবনের পূর্ণ নির্ব্বাপণ।” কিন্তু এই সৌন্দর্য্যপ্রীতির নামই Aestheticism Artistic, Monasticism; ইহাতে বাস্তব জীবন ও জগতের প্রতি ঔদাসীন্য ঘটে, অতএব ইহার মধ্যে সৃষ্টির পূর্ণ সত্য নাই—ইহাও সূক্ষ্মতর ইন্দ্রিয়বিলাস বা অতীন্দ্রির ভাববিলাস। কিন্তু নিছক সৌন্দৰ্য্যধ্যান ইহাকেই বলে। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কবিজীবনে এই আদর্শের বিচিত্র বিকাশ আমরা দেখিয়াছি। অনাসক্ত হৃদয়ে জগৎ ও জীবনকে রসসাধনার বস্তু করিয়া তিনি যে একটি সত্য উপলব্ধি করিবার ও করাইবার অপূর্ব্ব সাধনা করিয়াছেন, তাহাতে সত্য ও সুন্দরের একটা intellectual সমন্বয় ঘটিয়াছে বটে,—অবাস্তব বাস্তব এবং বাস্তব অবাস্তব হইয়া দ্বন্দ্বহীন হইয়াছে, কিন্তু জীবনের সত্যকার বাস্তব অনুভূতি হইতেই এই অবস্থায় আরোহণ করার সোপান ইহাতে নাই। অতি উচ্চ মনোবিলাসের যে সৌন্দর্য্যবোধ তাহারই প্রয়োজনে, জগৎ ও জীবনকে একটি ভাবকল্পনার অধীন করিয়া, অতি সুন্দর pattern-এ সাজাইয়া লইয়া তাহা হইতে যে রস আস্বাদন করা যায়, রবীন্দ্রনাথের কাব্যে তাহাই অপূৰ্ব্ব সঙ্গীতে প্রকটিত হইয়াছে
কিন্তু এমন করিয়া জীবন ও আর্টের দ্বন্দ্ব-নিরসন হয় না। অত্যুগ্র কামনার সৌন্দর্য্যসৃষ্টিও যেমন কাব্যের গৌরবহানি করে, তেমনই কামনাকে অতীন্দ্রিয়-লোকে প্রতিষ্ঠা করিয়া নিছক সৌন্দর্য্যের সাধনাও মানুষের আত্মাকে আশ্বস্ত করে না; বরং বাস্তব হৃদয়-বেদনা যখন সুরময় হইয়া উঠে, তখন যে রসের উদ্রেক হয়, তাহাতে জীবনের সহিত, তথা নিজ গূঢ় সত্তার সহিত, গভীরতর পরিচয়ে একটা আনন্দ আছে। কিন্তু পূর্ব্বোক্ত সৌন্দর্য্যবাদের মূলে আছে—কবির মনে প্রথমে একটা—Principle of Beauty-র স্বগত উপলব্ধি; পরে, জগতের মধ্যে সেই আদর্শের অনুযায়ী সৌন্দর্য্যের উদ্ভাবনা; অর্থাৎ, জগতের যেটুকু কবির সেই মানস—আদর্শের অনুগত সেইটুকু স্বীকার করিয়া, অথবা বস্তু সকলের উপরে যতদূর সম্ভব সেই সৌন্দর্য্য আরোপ করিয়া, তাহা হইতেই একটি সুসঙ্গত মনোজগৎ সৃষ্টি করা। কবি-মানসের এই প্রবৃত্তিই আধুনিক। বাংলা কাব্যে এই আধুনিক ভঙ্গি সৰ্ব্বপ্রথম সুস্পষ্ট দেখা দিয়াছে বিহারীলালের কবিতায়। কিন্তু বিহারীলালের কল্পনায় বাস্তব—প্রীতি ও অবাস্তব সৌন্দর্য্য-ধ্যান একটি অতি অভিনব যোগসূত্রে— যোগসাধনার মত—কাব্যসাধনায় নিদ্বন্দ্ব হইতে চাহিয়াছে। আমি অতঃপর সেই সূত্রটির সন্ধান করিয়া বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গলে’র ‘সারদা’কে পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করিব। —
বাংলা কাব্যে, বিশেষতঃ মাইকেল, হেমচন্দ্রের যুগে, কবি-মানসের এই ভঙ্গি যেমন আচম্বিত তেমনি বিস্ময়কর। একালে কাব্যের আদর্শ বিচলিত হইয়াছিল—প্রাচীন আদর্শকে বর্জ্জন না করিয়া উপায় ছিল না। কিন্তু য়ুরোপীয় আদর্শের অনুকরণে যে নব-সাহিত্য-সৃষ্টির উদ্যোগ চলিয়াছিল, তাহাতে অনুকরণ-সর্ব্বস্ব কবি-প্রতিভার প্রণের ফাঁকি বিহারীলালের মত কবির পক্ষে পীড়াদায়ক হইয়াছিল; কারণ, য়ুরোপীয় আদর্শের প্রভাবে একালের অধিকাংশ কবি একটা বাহিরের উত্তেজনা অনুভব করিয়াছিলেন; তাহার ফলে, কবিগণ আন্তরিকতা হারাইতেছিলেন, প্রকৃত ভাবানুভূতির পরিবর্তে গুরুগম্ভীর বাক্যযোজনা কতকগুলি অতিসুলভ ভাবের উদ্দীপনাই তখন সকল কাব্যের প্রেরণা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। বিহারীলাল প্রথম হইতেই ইহার বিরোধী ছিলেন। তিনি কেমন ভাষায় ও কি বিষয়ে কবিতা রচনা আরম্ভ করিয়াছিলেন তাহার পরিচয় পাঠকগণ ইতি পূৰ্ব্বেই পাইয়াছেন। বাহিরের সকল প্রকার রীতি বা ফ্যাশন একেবারে বর্জ্জন করিয়া, বাহিরের প্রতিষ্ঠা, নিন্দা—প্রশংসা অগ্রাহ্য করিয়া বিহারীলাল আপনার প্রাণকেই প্রমাণ্য করিয়া নিজের সঙ্গে নিজেই নিভৃতে আলাপ করিতে বসিলেন; কাব্যের কি দেশী কি বিদেশী-বাহিরের কোন আদর্শ গ্রাহ্য করিলেন না। অতি সহজ ও অতি সাধারণ জীবনযাত্রার পথে তিনি যাহা দেখিয়াছেন, শুনিয়াছেন ও প্রাণে অনুভব করিয়াছেন, তাহাই হইল তাঁহার কাব্যসাধনার দীক্ষা-মন্ত্র। তিনি কবিতার কোনও আদর্শ চিন্তা করে নাই; কবির লক্ষ্য বা কাব্যরচনার কলা-কৌশল সম্বন্ধেও তিনি কোনও বিশেষ ধারণার ধার ধারিতেন না। ধর্ম্মনীতি বা দর্শনের কোনও তত্ত্ব তাঁহার হৃদয়ের স্বধর্ম্মকে বিচলিত করে নাই। মানুষের সঙ্গে নানা সম্পর্কে তিনি যে তৃপ্তি পাইতেন, সরল স্বার্থহীন অকপট প্রীতির পরিচয়ে তাঁহার প্রাণে মনুষ্যজীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে পুলক-রোমাঞ্চ ও বিস্ময়বোধ হইত, তাহাতেই তিনি একটি অপরূপ সৌন্দৰ্য উপলব্ধি করিতেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন প্রীতির যে অপূর্ব্ব পুলক—অতিশয় সরল স্বতঃস্ফূর্ত যে রসমাধুরী—মানুষের প্রতি মানুষের অতিশয় সহজ কল্পনালেশহীন ভালবাসার আবেগে নানা ভঙ্গিতে উৎসারিত হয়, তাহার মধ্যেই জগৎ-রহস্য নিহিত আছে। কোন সৌন্দর্য্যই সৌন্দর্য্য নয় যাহা এই প্রীতির রসে সিঞ্চিত নয়—কারণ, মানুষ যদি ভাল না বাসে, তবে সৌন্দর্য্য যেমন হৌক, তাহাকে উপলব্ধি করিবে কোন্ বুদ্ধির দ্বারা? প্রাণ যদি না জাগে তবে চোখে সেই দৃষ্টি আসিবে কোথা হইত? এই প্রীতিমন্ত্রের সাধনায় বিহারীলাল যে সৌন্দর্য্যের আদর্শ সন্ধান করিয়াছিলেন তাহাতে বাহিরের রূপ বা বিশ্বপ্রকৃতির শোভা, ও অন্তরের অনুভূতি—বাস্তব ও কল্পনা, ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয়, সৌন্দর্য্য-পিপাসা ও হৃদয়বৃত্তি—একই রসচেতনায় নির্বিরোধ নির্দ্বন্দু হইয়া উঠিয়াছে। কথাটা আর একটু ভাল করিয়া বুঝিয়া লইতে হইবে। পূর্ব্বে আমি সৌন্দর্য্যবাদের দুই দিক আলোচনা করিয়াছি; একটিতে, মানুষের কামনাকে, রক্তমাংসের সংস্কারকে, দেহ ও মনের ক্ষুধাকেই সৌন্দর্য্যের প্রতিষ্ঠাভূমি করিয়াছি—বিষ-পুষ্পের গন্ধ-মাধুরীর মত মানুষের প্রাণে সে একটি সান্ত্বনাহীন তীব্র উৎকণ্ঠার উদ্রেক করে; অপরটিতে মানুষের কামনা বা রক্তমাংসের বিক্ষোভকে অস্বীকার করিয়া সকল ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে অতিসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়-বিলাসে পরিণত করিয়া, কামের বিষদন্ত ভাঙ্গিয়া তাহাকে হৃদয়হীন রূপ-মোহে পরিণত করিয়া, মানুষের সত্যকার সুখদুঃখকে আর্টের বিষয়ীভূত করিয়া নিশ্চিন্ত আনন্দবাদের প্রতিষ্ঠা হয়। অতএব দেখা যাইতেছে, এই দুইয়ের মধ্যে একই তত্ত্বের প্ররোচনা রহিয়াছে—সে তত্ত্বটি কাম। একটিতে কামের পূর্ণ প্রভাবে আত্মসমর্পণ, অপরটিতে কামকে স্তিমিত বা আবৃত করিয়া রক্তমাংসের ক্ষেত্র হইতে তাহাকে উঠাইয়া লইয়া কল্পনা-বিলাসের দর্পণে তাহার তাপহীন শিখাটিকে চিত্রবৎ প্রতিফলিত করিয়া নিশ্চিন্ত সৌন্দর্যসম্ভোগ। কামই উভয়বিধ সৌন্দর্য্যের আদি প্রেরণা—
যে আনন্দ-কিরণেতে প্রথম প্রত্যুষে
অন্ধকার মহার্ণবে সৃষ্টি-শতদল
দিগ্বিদিকে উঠেছিল উন্মেষিত হয়ে
এক মুহূর্ত্তের মাঝে—
—সেও এই কামেরই প্রেরণা। কিন্তু এই দুই ধরণের সৌন্দর্য্যবাদের কোনটিতেই সৃষ্টির পূর্ণসত্যের অভিজ্ঞান নাই। তার একমাত্র প্রমাণ, ইহার কোনটিতেই মানুষের মনুষ্যত্ব চরিতার্থ হয় না। সৌন্দর্য্যের পূর্ণ উপলব্ধিতে কামনার আত্যন্তিক অভাব নাই, আবার কামনার উৎকট অভিব্যক্তিও নাই। বিহারীলাল যে সৌন্দর্য্যরূপিণীর ধ্যানে শেষে সৰ্ব্বদুঃখ ভুলিয়াছেন—সে সৌন্দৰ্য-পিপাসা ও প্রাণের পিপাসা একই; এই পিপাসা ইন্দ্রিয়ভোগাকাঙ্ক্ষার জ্বালা নয়, আপনাকে বিলাইয়া দেওয়ার যে সুখ, সেই সুখের পিপাসা।
আবার সেই পিপাসা আছে বলিয়াই তিনি Artistic Monasticism-এর পক্ষপাতী নহেন। অতএব আধুনিক গীতি-কবিগণ সৃষ্টির অন্তরালে যে সৌন্দর্য্য—লক্ষ্মীর সন্ধানে নিজ নিজ ভাব-কল্পনাকে নিয়োজিত করিয়াছেন, আপনার অন্তরে বিশ্বজগৎকে প্রতিফলিত করিয়া যে আদি-রহস্যের ভাবনায় বিভোর হইয়াছেন—সৌন্দর্য্যকে একটি পরম তত্ত্বরূপে উপলব্ধি করিয়া তাহারই অখন্ড অনুভূতিকে সত্য-দর্শনের সহায় বলিয়া স্থির করিয়াছেন— আধুনিক কাব্যের সেই কল্পনা, কবি-মানসের subjectivity, কেমন করিয়া বিহারীলালে ফুটিয়া উঠিল এইবার আমরা তাহাই দেখিব। কিন্তু এই প্রেম হইতেই সেই সৌন্দর্যের কল্পনা—যে সৌন্দর্য্য ‘বিশ্ববিকাশিনী’—যে সৌন্দর্য্য বাস্তব প্রত্যক্ষের মধ্যেই অতিশয় বিশুদ্ধভাবে ও পূর্ণমহিমায় অধিষ্ঠান করিতেছে,—বিহারীলালের কল্পনায় প্রেম ও সৌন্দর্যের সেই অদ্বৈতসিদ্ধি বুঝিয়া লইবার কোনও যুক্তি পন্থা নাই; কবি তাহা নিজেও বুঝাইতে গিয়া বুঝাইতে পারেন নাই—কেবল সেই ভাবাবস্থাটি তিনি তাঁহার ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যে, ভিতরে যেমন বাহিরেও তেমনই ভাবে ধরিয়াছেন; এবং ‘সাধের আসন’ নামক কাব্যে ইহাই একটু ব্যাখ্যা করিতে গিয়া ইহাকে আরও অনির্বচনীয় করিয়া তুলিয়াছেন।
প্রথমেই ‘প্রেম-প্রবাহিনী’ কাব্যের কিছু উদ্ধৃত করিলে ভাল হত। এই কবিতায় কবি তাঁহার কবি-মানসের ইতিহাস নিজেই দিয়াছেন। তাঁহার প্রাণের বুভুক্ষা বন্ধু জায়া প্রভৃতির স্নেহে তৃপ্ত হইলেও তিনি যে কেন অধীর হইয়া কাব্যসুন্দরীর শরণাপন্ন হন, সেই কথাই এখানে বলিতেছেন। এই প্রীতি বা প্রেম শুধু তাঁহারই হৃদয়বাসী, অথবা দুই চারিজন আত্মীয়-বন্ধুর মধ্যেই তাহা গন্ডিবদ্ধ, এমন ধারণা কবির অসহ্য। তিনি এই প্রেমকেই সর্ব্বত্র উপলব্ধি করিতে চান—বাস্তব-সীমার মধ্যে যাহার নিঃসশয় প্রমাণ পাইয়াছেন, তাহাই তাঁহার প্রাণে বিশ্বসৃষ্টির মূলাধাররূপে জাগিয়া উঠিয়াছে—যাহা ব্যক্তি সম্পর্কের বাস্তব-প্রীতিরসে সমুজ্জ্বল তাহাকেই তিনি বিশ্বময় দেখিবার প্রয়াসী। ইহাই তাঁহার Idealism। ‘প্রেম-প্রবাহিনী’তে তিনি বাস্তবের সহিত আদর্শের এই বিরোধ, শেষে আদর্শের জয়লাভ-যে ভাবে বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য তাঁহারি কথায় স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আমরা দেখিব, তিনি নিজ-হৃদয়ের সত্য-অনুভূতির উপরেই কতখানি আস্থাবান, এবং তৎকালীন কবিত্বের উপর তাঁহার কিরূপ অনাস্থা। যে হৃদয়হীনতার নামই কবিত্বহীনতা, এবং যে মহানুভবতার নাম তেজস্বিতা—বর্তমানে তাহার একান্ত অভাব লক্ষ্য করিয়া কবি আক্ষেপ করিয়া বলিতেছেন, একালে তাঁহার মত কবির কোনও ভরসা নাই—
এই পোড়া বৰ্ত্তমানে নাই গো ভরসা,
তাই আরো দমে যাই ভেবে ভাবী দশা।
কিন্তু তথাপি স্বজাতির প্রতি তাঁহার বিশ্বাস আছে—
বাঙ্গালীর অমায়িক ভোলা খোলা প্রাণ
একদিন হবে নাকি তেজে বলীয়ান?
যদি হয়, নাহি ভয়, সেই দিন তবে
গিয়ে দাঁড়াতেও পার আপন গৌরবে।
এই সকল কথা তিনি তাঁহার অন্তর-বাসিনী প্রীতি-ঠাকুরাণীকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন; সত্যকার প্রীতির অভাব যেখানে সেখানে কবিরা কি করিবে?—
পরের পাতড়া চাটা, আপনার নাই—
মতামত-কর্তা তাঁরা, বাঙ্গালার চাই।
মন কভু ধায় নাই কবিত্বের পথে,
কবিরা চলুক তবু তাঁহাদেরি মতে।
জনমতে পান নাই অমৃতের স্বাদ,
অমৃত বিলাতে কিন্তু মনে বড় সাধ।
বা সাধারণ ইহাদের ধামা ধরে আছে,
কাজে কাজে আদর পাবে না কারো কাছে।
এখন মোহন বীণা নীরবেই থাক,
এ আসরে পেঁচাদের নৃত্য হয়ে যাক।
পরে নিজের সম্বন্ধে বলিতেছেন—
মরিতে তিলার্ধ মম ভয় নাহি করে,
কী ডুবিতে জনমে খেদ বিস্মৃতি-সাগরে।
ছাড়া কার রেখে যাব জগতে এমন কোন ধন,
নারিবে করিতে লোক শীঘ্র অযতন।
তারপর কবি কোনখানে তাঁহার এই মনোমত আদর্শের সন্ধান না পাইয়া, তাঁহার অন্তরের সেই প্রেমকে বাহিরে খুঁজিয়া না পাইয়া, আপনার মধ্যে আপনি মরিয়া গিয়া, নূতন করিয়া বাঁচিয়া উঠিলেন; অর্থাৎ আপনাকেই বিশ্বময় ব্যাপ্ত করিয়া দ্বন্দ্বের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন—
কিছুতেই তোমাকে যখন না পেলেম,
একেবারে আমি যেন কি হয়ে গেলেম!
শূন্যময় তমোময় বিশ্বসমুদয়,
অন্তর বাহির শুষ্ক সব মুরুময়;
আসিয়ে ঘেরিল বিড়ম্বনা সারি সারি,
দুর্ভর হৃদয়ভার সহিতে না পারি;
কাতর চীৎকার স্বরে ডাকিনু তোমায়—
কোথা ওহে দেখা দাও আসিয়ে আমায়!
—এ কল্পনা নয়। সকল সত্য-সাধকের সাধনায় এই বিশেষ সোপানটির কথা আমরা সকলেই জানি। বিহারীলালের কাব্য সাধনায় শুধু কল্পনা নয়—তাঁহার প্রাণে যে আলোক জ্বলিয়াছিল তাহা কেবলমাত্র দৈবী প্রেরণার ফল নয়। তিনি এইরূপ সাধনাই করিয়াছিলেন, তাই আমরা তাঁহার কাব্যে কবি-মানুষটির এমন আন্তরিকতা ও আত্মপ্রত্যয়ের পরিচয় পাই। তারপর—
অমনি হৃদয় এক আলোকে পূরিত
মাঝে বিশ্ববিমোহন রূপ বিরাজিত। দী
আমি কী মধুময়, সুধাময়, শান্তিসুখময় ি
মূৰ্ত্তিমান প্রগাঢ় সন্তোষ-রসোদয়!
কেমন প্রসন্ন আহা কেমন গম্ভীর,
অমৃতসাগর যেন আত্মার তৃপ্তির!
এইবার আমরা ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যে কবির সিদ্ধিলাভের অবস্থা কিরূপ তাহা দেখিব।
এই ‘সারদা’ যে কে, আমরা এ পর্য্যন্ত বিহারীলালের কবিহৃদয়ের যেটুকু পরিচয় পাইয়াছি, তাহাতে কিঞ্চিৎ ধারণা করিতে পারি। তথাপি এই সারদার ধ্যানে তাঁহার যেন তিনটি অবস্থা আছে—জাগর, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। প্রথম দুইটি অবস্থার কথা বুঝিব, কিন্তু সুষুপ্তির অবস্থাটি বুঝিবার বা বুঝাইবার নয়; তথাপি প্রথম দুইটি অবস্থা বুঝিতে পারিলে বোধ হয় কবির ‘সুষুপ্তি’ অবস্থাটিও (বা ‘মত্তদশা’র অবস্থায় সারদার ধ্যান) যোগাযোগে বুঝিয়া লওয়া সম্ভব। কিন্তু এ কথা বুঝিতে ও মানিতে হইবে যে, এই তিন অবস্থাতেই সারদা সেই একই সারদা—কবির এই তিন অবস্থা একই সাধনার তর-তম অবস্থা মাত্র। জাগর-অবস্থার সারদাকে আমরা কবির প্রেম-দেবতা বলিব—তিনি বাস্তব হৃদয়বৃত্তির উৎসরূপিণী। এই অবস্থায় কবি সারদাকে তাঁহার প্রেমময়ী পত্নীর রূপে দেখিতেছেন…..
সদানন্দময়ী আনন্দরূপিণী
স্বরগের জ্যোতি মূরতিমতী।
মানস সরস—বিকচ-নলিনী,
আলয়-কমলা করুণাবতী।
প্রিয়ে তুমি মোর অমূল্য রতন
তিনি যুগযুগান্তরে তপের ফল,
তব প্রেম স্নেহ-অমিয় সেবন
দিয়েছে জীবনে অমর বল।
এই সারদা—
যে যেমন তার ঘরে
তেমনি মুরতি ধরে,
মানবের কাছে কাছে
সদা সে মোহিনী আছে।
এই সারদাকেই সম্বোধন করিয়া কবি বলেন—
তুমিই মনের তৃপ্তি,
তুমি নয়নের দীপ্তি,
তোমা-হারা হলে আমি প্রাণহারা হই।
ইহাকে আমি জাগর-অবস্থা বলি। স্বপ্ন-অবস্থার এই সারদা বিশ্বের সৌন্দর্য্যরূপিণী—
তুমিই বিশ্বের আলো তুমি বিশ্বরূপিণী।
প্রত্যক্ষে বিরাজমান,
সৰ্ব্বভূতে অধিষ্ঠান,
তুমি বিশ্বময়ী কান্তি, দীপ্তি অনুপমা;
কবির যোগীর ধ্যান,
ভোলা প্রেমিকের প্রাণ,
মানব-মনের তুমি উদার সুষমা।
এখানে জাগর হইতে স্বপ্নে কবির সঙ্গে যাইতে বিশেষ বেগ পাইতে হয় না। কবি বাস্তব হৃদয়-পিপাসার বিশুদ্ধ পরিণতিকে—‘ভোলা প্রেমিকের প্রাণ’ ও ‘মানব—মনের উদার সুষমা’–নাম দিয়া, তাহারই সহিত ‘বিশ্বময়ী কান্তি’র অভিন্নতা উপলব্ধি করিয়াছেন। অর্থাৎ তাঁহার মতে বাস্তব হৃদয়বৃত্তির প্রসার ঘটিলে তাহাতেই বিশ্বময়ী কান্তির অধিষ্ঠান হইয়া থাকে। অতএব, মানুষের জাগ্রত জীবনের যে প্রেম, এবং কবির স্বপ্নদৃষ্ট যে সৌন্দর্য্য, এই দুই-এর মধ্যে কোন সত্যকার বিরোধ নাই। Ideal ও Real-এর এই সমন্বয় সাধন বিহারীলালের কাব্যের একটি মৌলিক লক্ষণ। এ সম্বন্ধে পরে আলোচনা করিব। কিন্তু তাঁহার এই স্বপ্ন আরো গাঢ় হয়, তখন কবি ‘বিশ্ব-বিকাশিনী’ সৌন্দর্য্যলক্ষ্মীর ধ্যান করিতে করিতে গাহিয়া উঠেন—
ব্রহ্মার মানস সরে
তিন ফুটে ঢলঢল করে
নীল জলে মনোহর সুবর্ণ-নলিনী!
পাদপদ্ম রাখি তার
হাসি হাসি ভাসি যায়
ষোড়শী রূপসী বামা পূর্ণিমা-যামিনী।
ফটিকের নিকেতন
দশদিকে দরপণ,
বিমল সলিল যেন করে তক্ তক্;
সুন্দরী দাঁড়ায়ে তায়
হাসিয়ে যে দিকে চায়
সেই দিকে হাসে তার কুহকিনী ছায়া,
নয়নের সঙ্গে সঙ্গে,
ঘুরিয়া বেড়ায় রঙ্গে,
অবাক দেখিলে, হয় অমনি অবাক; চক্ষে পড়েনা পলক।
তেমনি মানস সুরে
লাবণ্য-দর্পণ-ঘরে
দাঁড়ায়ে লাবণ্যময়ী দেখিছেন মায়া।
যেন তারে হেরি হেরি
শূন্যে শূন্যে ঘেরি ঘেরি,
রূপসী চাঁদের মালা ঘুরিয়া বেড়ায়;
চরণকমলতলে
নীল নভ নীল জলে
কাঞ্চন-কমলরাজি ফুটে শোভা পায়।
চাহিয়া তাঁদের পানে
আনন্দ ধরেনা প্রাণে,
আনত আননে হাসি জলতলে চান;
তেমনি রূপসী-মালা
মালাটি চারি দিকে করে খেলা,
অধরে মৃদুল হাসি আনত বয়ান।
রূপের ছটায় ভুলি
শ্বেত শতদল তুলি
আদরে পরাতে যান সীমন্তে সবার,
তাঁরাও তাঁহারি মত
পদ্ম তুমি যুগপত
পরাতে আসেন সবে সীমন্তে তাঁহার।
অমনি স্বপন প্রায়
বিভ্রম ভাঙ্গিয়া যায়,
চমকি আপন পানে চাহেন রূপসী,
চমকে গগনে তারা,
ভুধরে নির্ঝরধারা,
চমকে চরণতলে মানস-সরসী।
তারপর এই ধ্যান-স্বপ্ন হইতেই সুষুপ্তির অবস্থা, সে অবস্থা অনির্বচনীয়। কবির ‘সারদা’ তখন কবির মুগ্ধ-চেতনার একটি অপূর্ব্ব অনুভূতিরূপে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন;
সে যেন—
কায়াহীন মহা ছায়া,
বিশ্ববিমোহিনী মায়া,
মেঘে শশী-ঢাকা রাকা-রজনীরূপিণী
অসীম কানন-তল
ব্যেপে আছে অবিরল,
উপরে উজলে ভানু, ভূতলে যামিনী।
যেন—
প্রগাঢ় তিমিররাশি
ভুবন ভরেছে আসি,
অন্তরে জ্বলিছে আলো, নয়নে আঁধার।
কবি বলেন—
বিচিত্র এ মত্তদশা,
ভাবভরে যোগে বসা—
হৃদয়ে উদার জ্যোতি কি বিচিত্র জ্বলে!
কি বিচিত্র সুরতান
ভরপুর করে প্রাণ—
কে তুমি গাহিছ গান আকাশমন্ডলে!
বিহারীলাল এই ‘সারদা’কে যেমন ‘কান্তিরূপিণী’ বলিয়াছেন, তেমনি তাঁহার আর এক নাম ‘করুণা’। বিহারীলালের কাব্যে এই ‘করুণা’ শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ আছে
—শুধুই ব্যথিত-বেদনের সহানুভূতি নয়, ভক্তি প্রেম স্নেহ মমতা প্রভৃতির এক সাধারণ নাম ‘করুণা’। ইহা হইতে বুঝা যাইবে, বিহারীলাল আদর্শবাদী হইলেও বাস্তব কামনা বা কামকেই প্রীতির আকারে শোধন করিয়া লইয়া সেই বিশুদ্ধ কামমন্ত্রে তিনি তাঁহার সারদা বা সৌন্দর্য্যলক্ষ্মীর প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। এইরূপে, তিনি একদিকে যেমন বাস্তবকে পরিহার করেন নাই, তেমনই অপরদিকে, প্রাণের শ্রেষ্ঠ প্রেরণার যে সৌন্দর্য্যবোধ তাহাকেও ক্ষুণ্ণ করেন নাই। অতএব আমি পূর্ব্বে যে সৌন্দর্য্যতত্ত্বের দুইদিক আলোচনা করিয়াছি, এখানে তাহা অপেক্ষা একটা পূর্ণতর তত্ত্বের সন্ধান মিলিতেছে। বিহারীলাল তাঁহার সারদাকে যে আদর্শ-কল্পনায় মন্ডিত করিয়াছেন, তাহার সহিত শেলীর আদর্শ-সৌন্দর্য্যরূপিণী Archetypal Beauty -র একটা সাদৃশ্য আছে বলিয়া মনে হইতে পারে। কিন্তু বিহারীলাল বস্তু-জগৎকে Idealise-করিলেও কোথাও তাহাকে অস্বীকার করেন নাই; বরং বারংবার ইহাই বলিয়াছেন যে এই ‘বিশ্ববিকাশিনী’ কান্তি-দেবতা শুধুই ‘বিশ্বের আলো’ নয়—’বিশ্বরূপিনী। বিহারীলাল কায়ারই সৌন্দর্য্যচ্ছায়া-প্রত্যক্ষেরই অপ্রত্যক্ষ মহিমায় মুগ্ধ ও চরিতার্থ হইয়াছিলেন। শেলী Idea-কেই শরীরিণী দেখিতে চাহিয়াছিলেন—
“In many mortal forms I rashly sought
The shadow of that idol of my thought.”
এবং পরিশেষে হতাশ হইয়া এই কায়াকে বিসর্জ্জন দিয়াছিলেন। তিনি এই বহু ও বিচিত্রকে অস্বীকার করিয়া গাহিয়াছিলেন—
The One remains, the many change and pass;
Heaven’s light for ever shines, Earth’s shadows fly;
Life, like a dore of many-coloured glass,
Stains the white radiance of Eternity,
Until Death tramples it to fragments.
বিহারীলাল এই কায়াকে বাদ দিয়া শুধু ছায়া বা কান্তিটুকুই চান না; তিনি বলেন—
মহা প্রলয়ের কথা,
কি বিষম বিষণ্ণতা,
বিশ্ব গেছে, কান্তি আছে— অনুভবে আসে না।
ইহার কারণ তিনি মানুষকে ভালবাসেন, মর্ত্যজীবনের প্রীতি-পিপাসা তাঁহার প্রবল। কবি কীট্স নিছক সৌন্দৰ্য-সাধনায় ক্লান্ত হইয়া যাহাদের কথা স্মরণ করিয়া বলিয়াছিলেন—
“They seek no wonder but the human face.”
—কবি বিহারীলাল আদর্শ-সৌন্দর্য্যের পূজারী হইয়াও তাহাদেরই একজন। তিনি কল্পনায় স্বর্গের উৎকৃষ্ট সুখচিত্র রচনা করিয়াও তৃপ্তি পান না; কারণ সেখানে সকলই কামনাহীন, কিছুই যেন জীবন্ত নয়; সেখানে মানব-মায়ার অবকাশ নাই। তিনি কল্পনায় এই স্বর্গ ভ্রমণ করিয়া আসিয়া বলিতেছেন—
স্বর্গেতে অমৃত সিন্ধু—
পাই নাই এক বিন্দু,
কারণ, যে ‘অশ্রুবিন্দু’ ‘অমৃত-অধিক ধন’, তাহা সেখানে নাই। তিনি বলেন—
‘অমরের অপরূপ স্বপ্নসুখ নাহি চাই।
কেবল পরমানন্দ,
কি যেন বিষম ধন্দ,
বিকল্পবিহীন দশা না জানি কেমন!
অনন্ত সুখের কথা—
শুনে প্রাণে পাই ব্যথা,
অন্-অনন্ত নরকেও ততটা যন্ত্রণা নাই।’
তাই স্বর্গের কল্পধেনুর উদ্দেশে কবি বলিতেছেন—
থাক মায়াবিনী গাভী,
সকল দেবতা পাবি,
পাবি নি আমায়।
মায়া-দুগ্ধ পানে তোর
তারাও নেশায় ভোর;
পয়োধর দিয়া মুখে
সাধের স্বপন-সুখে
দেবতাদিগের মত
অঘোরে ঘুমাব কত?
এবং ব্রহ্মের ‘নাম-গোত্রহীন’ নির্লিপ্ত অবস্থার জ্বালা স্মরণ করিয়া বলিতেছেন— সেই ব্ৰহ্ম—
জ্বালা জুড়াবার তরে
এলেন নন্দের ঘরে
নব কুতূহলভরে, মুখে হাসি ধরে না!—
কত কান্না কত হাসি, কত মান অভিমান!
বিহারীলালের কবি-হৃদয় ও কাব্যসাধন-রীতির পরিচয় বোধ হয় আর অধিক দিবার প্রয়োজন নাই। এইবার আমি যথাসাধ্য তাঁহার কবি-প্রতিভার মূল্যনিরূপণের চেষ্টা করিব।
বিহারীলালের কবি-প্রতিভার বিশিষ্ট লক্ষণ সম্বন্ধে পূর্ব্বেই কিছু আলোচনা করিয়াছি, এক্ষণে দুইটি প্রধান লক্ষণ সম্বন্ধে পুনরায় কিছু বলিব। প্রথম লক্ষণ— তাঁহার কবিদৃষ্টির মৌলিকতা; দ্বিতীয়—তাঁহার কবিতায় ‘রূপ’ অপেক্ষা ‘ভাবের’ প্রাধান্য। এই দুইয়েরই কারণ এক—তাঁহার অভিনব ও ঐকান্তিক ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য। তাঁহার কল্পনার মৌলিকতা এই যে, তিনি কবি-প্রেরণাকে বাহির হইতে ভিতরে ফিরাইয়াছেন, কাব্য অপেক্ষা কবিকে বড় করিয়াছেন। তাঁহার নিকট কাব্যকলা অপেক্ষা কবি-হৃদয় বা কবি-চরিত্র বড়। সরস্বতীকে আবাহন করিবার অধিকার পাইতে হইলে খাঁটি মানুষ হইতে হইবে। ‘সারদা মঙ্গলের’ কবি এই বলিয়া আক্ষেপ করিতেছেন—
আহা সে পুরুষবর
না জানি কেমন তর
দাঁড়ায়ে রজতগিরি, অটল সুধীর।
উদার ললাট ঘটা,
লোচনে বিজলী ছটা,
নিটোল বুকের পাটা, নধর শরীর!
সৌম্য মূর্ত্তি স্ফূর্ত্তি-ভরা,
পিঙ্গল বল্কল পরা,
নীরদ-তরঙ্গ-লীলা জটা মনোহর;
শুভ্র অভ্র উপবীত
উরস্থলে বিলম্বিত,
যোগপাটা ইন্দ্রধনু রাজিছে সুন্দর।
সে মহাপুরুষ-মেলা,
সে নন্দনবন-খেলা,
সে চিরবসন্ত-বিকশিত ফুলহার,
কিছুই হেথায় নাই;
মনে মনে ভাবি তাই,
কি দেখে আসিতে মন সরিবে তোমার!
—পড়িয়া কীসের সেই উক্তি মনে পড়ে—”I am convinced more and more every day that a fine writer is the most genuine being in the world”. এই ‘genuine being’-এর আদর্শ যে কবির যেমনই হৌক, মূলে একটা সত্য আছে। কবি মিলটনেরও বোধ হয় এমনই একটা আদর্শ-নিষ্ঠা ছিল বলিয়াই তিনি তাঁহার মহাকাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হইতে বহুদিন সাহস পান নাই। কাব্যসৃষ্টির প্রতিভা ও কবি-জীবনের এই আদর্শ উভয়ের মধ্যে সত্যকার সম্পর্ক যাহাই হৌক, বিহারীলালের পরবর্তী বাংলা কাব্য যে কবি-জীবন বা কবি-চরিত্রের পরিবর্তে কবি—কল্পনা বা কাব্যনিৰ্ম্মাণ-কৌশলের প্রতিভাকেই জয়যুক্ত করিয়াছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই; এবং তাহারই ফলে বাংলা কাব্য আবার যেখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহার প্রমাণ নকল হুইট্ম্যান হইতে নকল ওমার খৈয়াম পর্যন্ত সৰ্ব্বত্র জাজ্জ্বল্যমান।
বিহারীলালের এই আদর্শ তাঁহার ব্যক্তিগত কাব্যসাধনায় যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছে। প্রাচীন বাংলা কাব্যে বৈষ্ণবকবিগণের কাব্য সাধনা যেমন আধ্যাত্মিক সাধনার অঙ্গ হইয়াছিল, বিহারীলালের কবি-জীবনেও সেইরূপ সাধক-জীবনের পরিচয় রহিয়াছে, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। কাব্য এবং সমগ্র অন্তর ও বহির্জীবনের এই যোগসাধনার আদর্শ তাঁহার পরে আর কোনও কবির জীবনে প্রকাশ পায় নাই; বিহারীলাল intellect বা মনের উপর হৃদয়কে প্রাধান্য দিয়া বাঙ্গালী কবিকে তাঁহার মত হৃদয়বান করিয়া তুলিতে পারেন নাই, বরং কবি-মানস হইতে বস্তু জগৎকে অনেক পরিমাণে অপসারিত করিবার প্রবৃত্তি দিয়া, উল্টা দিকে ব্যক্তি—স্বাতন্ত্র্যমন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছিলেন। এইরূপ ফল হওয়াই স্বাভাবিক। তথাপি আরও কারণ ছিল; বিহারীলাল কাব্য অপেক্ষা কবি-হৃদয়কে বড় করিয়াছিলেন; উভয়কে সমান বড় করিয়া একই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন নাই। কারণ, মানুষের হৃদয়বৃত্তি অর্থে শুধুই প্রীতি-প্রেমের ভাবসাধনা নয়; বাস্তবের সঙ্গে কবি-হৃদয়ের সম্পর্ক যতদূর সম্ভব ব্যাপক হওয়া চাই। জগতের সব কিছু কোমল, মধুর, উদার ও মহৎ নয়—কঠোর কঠিন, কুৎসিতও আছে। কবি-হৃদয় আরও উন্মুক্ত ও প্রসারিত না হইলে জগৎ ও জীবনের সমগ্রতা বোধ হয় না, কবি-কল্পনা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। উৎকৃষ্ট কবি-কল্পনার লক্ষণ এই যে, তাহাতে কিছুই বাদ যায় না,—সৃষ্টির সর্ব্ব বিরোধ বা বৈচিত্র্যের মধ্যেই একটি harmony বা সঙ্গতি ফুটিয়া উঠে, তখন বাস্তবের বাস্তবতাই একটি অপূর্ব্ব রসের উদ্রেক করে, বাহিরের সঙ্গে অন্তরের বিরোধ আর থাকে না, মৃত্যু মৃত্যু-রূপেই অমৃত হইয়া উঠে। কবি-হৃদয় বলিতে আমরা সেই অনুভূতি বুঝিব, যাহাতে সৰ্ব্ব বস্তু সহজে ও সমভাবে ইন্দ্রিয়-চেতনার বিষয় হয়, এমন একটি বোধের বিকাশ হয় যাহাতে কবির আত্ম-চেতনা ও জগৎ-চেতনা এক হইয়া সৃষ্টির মন্মদ্বার উদ্ঘাটিত হয়। এই আত্ম-চেতনার আশ্রম-মানুষের মন : কিন্তু জগৎ-চেতনার আশ্রয়, সকল, ইন্দ্রিয়ানুভূতির রসায়নাগার-হৃদয়। ইন্দ্ৰিয়ানুভূতি যখন হৃদয়ের সেবায় নিয়োজিত না হইয়া মনেরই সেবায় নিয়োজিত হয়, তখন আমরা কবি-হৃদয় বলিতে যাহা বুঝি তাহার সম্যক্ বিকাশ হয় না। কিন্তু মনের ক্রিয়ারও আবশ্যকতা আছে। মনের ধর্ম্ম—কৌতূহল; মন ভ্রমণ করিতে চায়, বস্তু সংগ্রহ বা experience-এর প্রসার কামনা করে; হৃদয়ের ধর্ম্ম—একনিষ্ঠা। মন আত্মচেতনা ও আত্ম-প্রতিষ্ঠার যন্ত্রস্বরুপ, তাহার বস্তুজ্ঞান অন্তর ও বাহিরের ভেদ—জ্ঞানকেই দৃঢ় করে। আত্ম-চেতনা ও জগৎ-চেতনা এই রস-চেতনায় নির্দ্বন্দ্ব হইয়া, যে ঐক্য-বোধের সৃষ্টি করে—উৎকৃষ্ট কবি-কল্পনার যে সত্য, যে উপলব্ধি, আর কোনও শক্তিতে সম্ভব নয়—মন তাহার অন্তরায়। যেখানে ইন্দ্রিয়ানুভূতি প্রবল, অর্থাৎ হৃদয়ের সিংহদ্বারে জগৎ আসিয়া প্রবেশ করে, এবং মন তাহার বৈচিত্র্যবোধ অক্ষুণ্ণ রাখিয়াই হৃদয়ের অধীন হইয়া কাজ করে, সেইখানে উৎকৃষ্ট কবি-প্রতিভার জন্ম হয়। এই জন্যই কবি কীট্স কবি-মানসের দুর্ভেদ্য রহস্য ভেদ করিবার যে আশ্চর্য্য প্রয়াস করিয়াছিলেন তাহাতে তাঁহার এই উক্তি অতিশয় মূল্যবান— “The Heart is the Mind’s Bible”, অর্থাৎ উৎকৃষ্ট কাব্য সাধনায় জীবন ও জগতের যে রহস্য ভেদ হয়, তাহাতে মন হৃদয়কেই গুরুরূপে বরণ করে। এ রহস্য-ভেদ শ্রেষ্ঠ কবির পক্ষেই সম্ভব, এবং সেইজন্যই যিনি জগতের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ কবি তাঁহার মুখে, মানুষের মন ও মানুষের হৃদয়, এই দুই-এর মিলিত চরম অভিজ্ঞতার বাণী এমন সত্য ও সুন্দর হইয়া উঠে—
“Men must endure
Their going hence even as their coming hither:
Ripeness is all.”
কিন্তু বিহারীলাল তাঁহার ‘সারদা’কে যে কবি-হৃদয়ের সহধর্মিণী করিয়াছেন, সে কবি—হৃদয় সঙ্কীর্ণ, তাহাতে বাস্তবের সমগ্রতার উপলব্ধি নাই। এজন্য তিনি শুধু প্রীতিপ্রেমকে সম্বল করিয়া বাস্তবের সঙ্গে যেটুকু যোগ রক্ষা করিয়াছেন, তাহার তুলনায় তাঁহার নিজেরই সৌন্দর্য্য-কল্পনা এত বড় যে, এই উভয়ের মধ্যে যোগসূত্রটি তিনিও আবিস্কার করিতে পারেন না; তাই তাঁহার মনে যেমন বিস্ময় তেমনি সংশয় জাগে—
তবে কি সকলই ভুল?
নাই কি প্রেমের মূল?—
বিচিত্র গগন-ফুল কল্পনা-লতার?
মন কেন রসে ভাসে,
প্রাণ কেন ভালবাসে
আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?
ইহার উত্তর নাই, উত্তরে কেবল ইহাই মনে হয়—
এ ভুল প্রাণের ভুল,
মৰ্ম্মে বিজড়িত মূল,
জীবনের সঞ্জীবনী অমৃত-বল্লরী!
এ এক নেশার ভুল,
অন্তরাত্মা নিদ্রাকুল—
স্বপনে বিচিত্ররূপা দেবী যোগেশ্বরী!
এইজন্যই বিহারীলাল তাঁহার সারদাকে প্রায়ই ‘যোগেন্দ্রবালা’, ‘যোগেশ্বরী’, ‘যোগানন্দময়ী তনু’, ‘যোগীন্দ্রের ধ্যান-ধন’ প্রভৃতি নামে সম্বোধন করেন; তিনি এই বাস্তব ও অবাস্তবের দ্বন্দ্ব একটি গভীরতর ভাবানুভূতি বা ধ্যান-কল্পনার সাহায্যে উত্তীর্ণ হইতে চাহিয়াছেন। কবি বলেন—
রহস্য ভেদিতে তব আর আমি চাব না;
না বুঝিয়া থাকা ভাল,
বুঝিলেই নেবে আলো,
সে মহাপ্রলয়-পথে ভুলে কভু যাব না।
এই ‘রহস্য’কেই কবি বরণ করিয়া লইয়াছেন—
রহস্য মাধুরীমালা,
রহস্য রূপের ডালা,
রহস্য স্বপন-বালা
খেলা করে মাথার ভিতরে,
চন্দ্রবিম্ব স্বচ্ছ সরোবরে।
কবিরা দেখেছে তাঁরে নেশার নয়নে,
যোগীরা দেখেছে তাঁরে যোগের সাধনে।
এই রহস্য-ধ্যানে নিমগ্ন হইয়া কবি কাব্যসৃষ্টি না করিয়া কাব্যলক্ষ্মীরই আরতি করিয়াছেন। ইহাই তাঁহার কাব্যের যে দ্বিতীয় লক্ষণটির কথা বলিয়াছি—তাঁহার সেই Mysticim বা তত্ত্বরস-রসিকতার কারণ; এই Mysticism প্রকৃত কাব্যসৃষ্টির পক্ষে বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এইজন্য বিহারীলালের কাব্য হইতে অতি উৎকৃষ্ট বিচ্ছিন্ন শ্লোক বা শ্লোক-সমষ্টি উদ্ধার করা যত সহজ, ভাবে ও আকারে একটি সম্পূর্ণ কবিতা সংগ্রহ করা তার তুলনায় কঠিন। বিহারীলাল যে রহস্যভেদ করিতে চান না বলিয়াছেন, কবিকে সে রহস্যভেদ করিতে হয় না বটে—অর্থাৎ তাহার কোনও অর্থ করিবার প্রয়োজন হয় না। সে কাজ কবির নয়; কিন্তু সেই রহস্যকে সকল কবিকেই কাব্য-সৃষ্টি দ্বারা এমন একটি রস-রূপে সুপ্রকাশ করিতে হয়, যে তাহাতেই রসিক-চিত্ত চরিতার্থ হয়। কবি এই রহস্য-ধ্যানে বিভোর থাকিলে চলিবে না-সে রহস্য কবিরই মাথার ভিতরে, স্বচ্ছ সরোবরে চন্দ্রবিম্বের মত খেলা করিলেই কাব্যের উদ্দেশ্য সাধন হয় না। এ প্রসঙ্গে, আমি অন্যত্র একজন কবিসমালোচকের যে উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছি এখানেও তাহা পাঠককে স্মরণ করিতে বলি—
“The poet is not a mystic: contemplation of the mystery is no end in itself for him. He is a doer, a maker, a revealer, a creator. ‘
তথাপি বিহারীলাল সৌন্দর্য্য-পিপাসাকে হৃদয়বৃত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত করিয়া কবি-প্রাণকে নূতন করিয়া আবিষ্কার করিয়াছেন; তিনি কবিধর্ম্মকে মানুষের মনুষ্যত্বের সঙ্গে যুক্ত করিয়া, বাস্তব ও অবাস্তবের দ্বন্দ্ব একটি নূতনতর-রস-সাধনার দ্বারা উত্তীর্ণ হইবার পন্থা নির্দেশ করিয়াছেন। মাইকেল যেমন কাব্যে নব নব রূপ সন্ধান করিয়া বঙ্গকবি-প্রতিভাকে বিচিত্র ও বৃহত্তর কাব্যসৃষ্টির কারুকলায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন, বিহারীলাল তেমনই কাব্য ও কবি-মানসের এমন একটা নিগূঢ় সম্বন্ধের ইঙ্গিত করিয়াছিলেন যে, অতঃপর বাংলা কাব্যে একটা সম্পূর্ণ নূতন ভাব—কল্পনার লীলা চলিয়াছে—কবিগণ জগৎ ও জীবনকে নিজেদের মানস-দর্পণে প্রতিফলিত করিয়া বাংলার কাব্য-কানন একটি অপূর্ব্ব সুর-মূর্ছনায় প্লাবিত করিয়াছেন। কাব্যে আত্মভাব-সাধনার এই ভঙ্গী বিহারীলাল হইতেই আরম্ভ। পরবর্ত্তী কবিগণের উপরে বিহারীলালের এই প্রভাব ঠিক কিরূপ বা কতখানি সে আলোচনার অবকাশ এখানে নাই; তথাপি, আমি অক্ষয়কুমার, দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের
কাব্য হইতে কিছু কিছু নিদর্শন উদ্ধৃত করিয়া এ প্রসঙ্গ শেষ করিব।
অক্ষয়কুমার বড়াল—
ফুটোনা, ফুটোনা রবি,
থাক্ ঘোর-ঘোর ছবি, —
ধরা যেন ঋষি-স্বপ্ন মদির মধুর!
নাহি শোক নাহি তাপ,
নাহি মোহ নাহি পাপ!—
কেটো না আব্ছা-জাল—প্রত্যক্ষ নিষ্ঠুর!
অন্যত্র, —
দাও শিক্ষা যোগময়ী যেখানে থাক না তুমি
কিসে দেখি সৌন্দর্য্য তোমার,
কী তোমাতে মগন হয় সত্তা তব ভুলে গিয়ে
একা হই পূর্ণ অবতার!
ভাবিয়া বিন্দুরে এক ব্যাপ্ত হই বিশ্বময়—
শিখারে শিখা সে প্রেমযোগ,
কি ছিঁড়ে যাক্ নাভি-শিরা ঘুচে যাক্ জীবনের
চির-জন্মগত স্বার্থ-রোগ!
আবার—
কবি যোগী ঋষি লয়ে সে প্রেম উধাও হয়ে
পলায়েছে স্বর্গে কিম্বা নন্দনে, নির্ব্বাণে—
লয়ে তার শুভহাসি গড়ি টীকা রাশি রাশি
প্রাণ-গত অশ্রু লয়ে বাদ-প্রতিবাদ!
দেবেন্দ্রনাথ সেন—
হে প্রকৃতি একি লীলা বুঝিবারে নারি—
যে-দিকে তাকায়ে দেখি সেই দিকে সখা-সখি
তরুরাজ্যে জীবরাজ্যে যত নরনারী!
প্রজাপতি উড়ে ঘুরে বসে আসি মোর শিরে
মুচকিয়া হাসে সব কুসুম-কুমারী;
প্রতিবেশী ব্রাহ্মণের শিখীটি পেয়েছে টের
আমিগো স্বজন তার!—রঙ্গ দেখ তার—
সম্মুখে আসিয়া দেয় নৃত্য-উপহার।
শ্যামলীর বৎসপাশে কাছে গিয়ে মহাত্রাসে
সকলে পলায়ে আসে; আমি কাছে গেলে
সহর্ষ সুরভি-সুতা কিছুই না বলে!
উষার দিগন্তপানে চেয়ে দেখি, স্নানাননে
শশী অস্ত যায় যায়, নেহারি আমায়
শিথিল করিয়া-গতি থমকি দাঁড়ায়।
হে প্রকৃতি, জানিয়াছি হে জননী বুঝিয়াছি
এই ভাঙ্গা দেহমাঝে (এ কি গো তামাসা!)
ঢালিয়াছ একরাস প্রীতি-ভালবাসা!
কবিত্বের অহঙ্কার হয়েছে মা চুরমার
আমিত্ব ডুবিয়া গেছে প্রীতি-পারাবারে;
ডুবুক মা ক্ষতি নাই, একরাশি ভগ্নী ভাই
আমি-বিনিময়ে মাগো, পেয়েছি সংসারে।
এইবার রবীন্দ্রনাথের কাব্য হইতে আমি এমন একটি কবিতা উদ্ধৃত করিব, যাহাতে বিহারীলালের কাব্যসাধন-রীতিই যেন অতি সংক্ষেপে, অতি অপূৰ্ব্ব ভাষায় ও ছন্দে বিবৃত হইয়াছে। এই কবিতাটির নাম ‘চিত্রা’। রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় কবি ও কাব্য সম্বন্ধে, তাঁহার মনোগত আদর্শের একটি গভীর উপলব্ধি ছন্দোবদ্ধ করিয়াছেন। এই কবিতাটির প্রথম স্তবকে তিনি নিখিল-কাব্যকলা বা কবিকর্ম্মের প্রেরণারূপিণী সৌন্দর্য্যদেবতার বন্দনা করিয়াছেন; ইহার দ্বিতীয় স্তবকে তিনি এই সৌন্দর্য্যদেবতাকে কাব্যকলা হইতে বিমুক্ত করিয়া, নিভৃত অন্তর-মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়া কবির যে ভাবাবস্থা হয়, তাহাই বর্ণনা করিয়াছেন। এই দ্বিতীয় স্তবকে রবীন্দ্রনাথ কাব্যলক্ষ্মীকে যে ধ্যানমন্ত্রে আরাধনা করিয়াছেন, সেই মন্ত্র একান্তভাবেই বিহারীলালের; এ মন্ত্র যদি কখনও কোনও কবির জীবনে সত্যকার কাব্যসাধনার বস্ত হইয়া থাকে, তবে সে কবি যে বিহারীলাল, আশা করি, এই দীর্ঘ পরিচয়ের শেষে সে বিষয়ে কেহ সন্দেহ মাত্র করিবেন না। এই দ্বিতীয় স্তবকটিই এখানে উদ্ধৃত করিলাম।
অন্তর-মাঝে তুমি শুধু একা একাকী
তুমি অন্তরব্যাপিনী।
একটি স্বপ্ন মুগ্ধ সজল নয়নে,
নাকি একটি পদ্ম হৃদয়বৃত্তশয়নে,
একটি চন্দ্র অসীম চিত্তগগনে
চারি দিকে চির-যামিনী।
অকুল শান্তি, সেথায় বিপুল বিরতি,
একটি ভক্ত করিছে নিত্য আরতি
নাহি কাল দেশ, তুমি অনিমেষ মুরতি,
তুমি অচপল দামিনী।
ধীর গম্ভীর গভীর মৌন-মহিমা,
স্বচ্ছ অতল স্নিগ্ধ নয়ন-নীলিমা,
স্থির হাসিখানি উষালোকসম অসীমা,
অয়ি প্রশান্তহাসিনী।
অন্তর-মাঝে তুমি শুধু একা একাকী,
তুমি অন্তরবাসিনী।
পাঠক লক্ষ্য করিবেন, এই কবিতার একস্থানে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, বিহারীলালের শুধু ভাব নয়, ভাষাও কেমন প্রতিধ্বনিত হইতেছে—
‘একটি চন্দ্র অসীম চিত্তগগনে,
চারি দিকে চির-যামিনী।’
—ইহার সহিত বিহারীলালের পূর্ব্বোদ্ধৃত শ্লোক কয়টি পাঠ করুন—
প্রগাঢ় তিমির রাশি
ভুবন ভরেছে আসি—
অন্তরে জ্বলিছে আলো, নয়নে আঁধার।
এবং
কায়াহীন মহা ছায়া
বিশ্ব বিমোহিনী মায়া,
মেঘে শশী ঢাকা রাকা-রজনী রূপিণী
অসীম কানন-তল
বোপে আছে অবিরল,
উপরে উজলে ভানু, ভূতলে যামিনী।
রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের নিকট এই মন্ত্র-দীক্ষা গ্রহণ করিয়াও কাব্যসৃষ্টির প্রাচুর্য্যে নিজের প্রতিভাকে এমন সার্থক করিয়াছেন কোন্ কৌশলে, তাহার ইঙ্গিতও এই কবিতাটিরই প্রথম স্তবকে আছে। তাঁহার কাব্য-লক্ষ্মী শুধু অন্তর মাঝেই একা একাকী, নহেন—জগতের মাঝেও তিনিই ‘বিচিত্ররূপিণী’। বিহারীলালের একনিষ্ঠ কবি-হৃদয় এই ‘বিচিত্ররূপিণী’র প্রতি তেমন আকৃষ্ট হন নাই, তিনি তাঁহার ‘অন্তরব্যাপিনী’ হইয়াই আছেন। বিহারীলাল এ বিষয়ে অদ্বৈতবাদী; রবীন্দ্রনাথ বিশিষ্টাদ্বৈতাবাদী, মন ও প্রাণ এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে তিনি মনকে প্রশ্রয় দিলেও সর্বত্র প্রাণের একটি সূক্ষ্ম আবরণ রক্ষা করিয়াছেন; বিহারীলাল মনকে বড় একটা আমল না দিয়া প্রাণকেই প্রামাণ্য করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের কাব্যও ‘ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া আসা’র তত্ত্ব কতটা রস-স্ফুর্ত্তি লাভ করিয়াছে, এখানে সে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক, কেবল এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবির প্রতিভা বিকাশে বিহারীলালের কাব্য-মন্ত্র, মুখ্যভাবে না হইলেও গৌণভাবে, কতখানি সাহায্য করিয়াছে, তাহারই ইঙ্গিত করিয়া আমি বিহারীলালের কাব্য-পরিচয় শেষ করিলাম।
আশ্বিন ১৩৩৬