Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিষফোঁড়া || Sabitri Das

বিষফোঁড়া || Sabitri Das

বিষফোঁড়া

কে জানতো বিচিত্রের জন্য  আজএত বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছে।যতই দেখছে ততই যেন আশ্চর্য লাগছে তার।নিজেকে কেমন যেন  নূতন  নূতন  তো লাগছে ই ,সে না হয় এতদিন রোগ ভোগের পর রোগমুক্ত হয়েছে। এতদিনে কষ্টের শেষ হয়েছে।শেষ হয়েছে দুর্ভোগের। শুধু কিতাই! মনের ভার তার কমে গেছে।মাত্র  দশটা দিন সে ছিল না।এর মধ্যে মানসী  যেন বিলকুল বদলে গেছে। এ যেন নূতন  এক মানসী! মানসীর জন্য তার দুশ্চিন্তাও কি কিছু কম ছিল নাকি! সেই মানসী! কি বিচিত্র অভিজ্ঞতাই  না হলো তার ।
এ যেন সেই মানসী ই নয়!দিনরাত মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ানো মানসী র সঙ্গে এই মানসী র আকাশ পাতাল তফাৎ।ভেবে ভেবে কূল পায় না সে।মানসীর ও কি কোন চিকিৎসা হলো নাকি,তার মতো!পুরো দুনিয়াটাই যে তার চোখে আজ বদলে গেছে!
“অনিকেত তাহলে ঠিকই বলেছিল দেখছি!” ভাবলো বিচিত্র।
   বিচিত্রের মন আর স্বভাবটিও ছিল তার নামের মতো বড়োই বিচিত্র।ছোটবেলায় মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করলেন। নিজের মায়ের কথা  একটু একটু  মনে  পড়তো   বৈকী তার ,সে খেতে  চাইতো না বলে খাবার টা  নিয়ে  সাধতো! গরমে ঘুম  আসছে না  দেখলে  হাতপাখা নিয়ে  হাওয়া  করতেই থাকত।
বিচিত্রের সৎ মা যখন খেতে চাইলে বিরক্ত হতো, মায়ের কথা  বড়ো মনে  পড়তো তার। তারপর যখন ছুতোয় নাতায় তার উপর অত্যাচার করতে লাগলো তখন সেই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিচিত্র একদিন বাড়ি থেকে সেই যে পালিয়ে গেল।আর  ফিরলো না।বাপও হাঁফ ছেড়ে  বাঁচলো। তখন থেকেই সে এখানে সেখানে এ কাজ সে কাজ করে কোনরকমে দুটো ভাতের জোগাড় করতে শুরু করলো।বছরের পর বছর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে আর সাতান্ন ঘাটের জল খেয়ে  আজ সে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ব্যবসায়ী মহলে। বিচিত্রের জীবনে  আজ কোন কিছুরই কোন অভাব নেই। জীবনের এই দিন গুলি বিভিন্ন পরিবেশের মধ্যে কাটানোর ফলে বিচিত্রের জীবনে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিল।তাই তার মনের মধ্যে নানা সন্দেহ আসত ।এমনিতে সে যে খুব খারাপ লোক,তা কিন্তু নয় !সত্যি বলতে কী মানসী ,তার বউ।সেই বউয়ের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসাই কাল হলো বিচিত্রের।কারো সাথেই তার সম্পর্ক খারাপ নয় কিন্তু সমস্যা হলো মানসী!মানসী কে সুরক্ষিত রাখতে কি না করে সে। বেচারা মানসী র কাছে সেটা অত্যাচারের ই নামান্তর ।চুল শুকোতে ছাতে যাওয়া চলবে না,বাগানে পায়চারি করা চলবে না এরকম হাজারো বায়নাক্কা! একবার মানসী তাকে বলেও ছিল” তুমি কি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো না?” “তা কেন ,রাখবো না।তোমাকে বিশ্বাস করি নিশ্চয় ই।কিন্তু পারিপার্শ্বিক  পরিস্থিতি ভালো নয়,তোমাকে নিয়ে তাই তো বড়ো ভয়ে ভয়ে থাকি!” বলেছিল বিচিত্র। মানসী সে সময় কোন উত্তর দেয়নি।কিইবা উত্তর দেবে! মুক্তির জন্য ছটফট করতে থাকে মানসী।তবুও অপেক্ষা করে দেখতে চায় সে।
এমনি করেই  দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। মানসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল ক্রমশ।মানসী তো জেরবার ,ছাতে উঠলেই পিছু পিছু  ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বিচিত্র আসে।এদিক ওদিক চারদিক দেখে শুনে নিশ্চিন্ত হয় যে কেউ  ছাতে উঠে মানসীকে দেখছে না তবেই তার শান্তি! এসব কি  সহ্য হয়, না হবার কথা!
বাগানে পূজোর  জন্য ফুল আনতে গেলেও সেই একই গল্প। ঘরে মজুত থাকে সবসময়ের কাজের লোক গেনি, সারাদিন কাজ কর্ম করে যায় মন দিয়ে। দেখা শোনাও। মনিবের মন মর্জি বুঝেই চলে সর্বদা।অসুবিধা একটাই সে রাতকানা,তা  রাতে তো বিচিত্র  ঘরেই থাকে।এসবের মাঝে অতিষ্ঠ মানসী উপায় খোঁজে। অবরুদ্ধ এক যন্ত্রনা বুকের ভেতর। কিইবা পেয়েছে সে এতদিন!বিচিত্রের কাছথেকে সন্দেহ আর উদ্বিগ্নতা ছাড়া কি পেলো! মানসীকে এক বিপজ্জনক খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সে।যেকোন মুহূর্তে মানসী পা পিছলে তলিয়ে যেতে পারে খাদের অতল তলে। ভাবতে পারে না সে! নিজের প্রতি নিজের প্রতিরোধ ক্রমশ ভেঙে পড়তে চাইছে যে!
     একদিন সকালে দোতলার জানলা দিয়ে দেখতে পায় দূরে বানজারা দের তাঁবু পড়েছে ।কাল বিকেলেও তো ফাঁকাই ছিল মাঠটা। ভাবে মানসী কি সুন্দর জীবন ওদের ! বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ।ওদের দেখে মুক্তির জন্য  প্রাণটা তার আবারও ছটফট করতে থাকে।
নিজের জীবনে কোন কিছুরই অভাব নেই। অভাব শুধু শান্তির।বিচিত্র তাকে সেই অর্থে সন্দেহ করে না ঠিকই তবুও তার ভালোবাসার অত্যাচারে সব সুখ শান্তি আজ নষ্ট হতে বসেছে। ভাবে সে সুখ কি সত্যিই কোনদিন ছিল তার জীবনে! এও জানে মানসী এই যে সন্দেহ এটাও আসে অতিরিক্ত ভালোবাসা থেকেই।তাই সে বিচিত্রকে ছেড়ে যেতে পারে নি আজও। তবুও মানসী যে মানুষ! রক্ত মাংসের খুব সাধারণ এক মানবী। যার সুখ পেতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় সঙ্গী পেতে,প্রাণ খুলে মনের কথা বলতে।দাম্পত্য বলতে তো শুধুই বিচিত্রের বিচিত্র মনোভাব! টাকা দিয়ে আর কতটুকু হয়! নিজের প্রতি নিজের প্রতিরোধ ক্ষমতাও তার এখন কমে আসছে। যে কোন মুহূর্তে সে পড়ে যেতে পারে ওই খাদের অতল তলে।হারিয়ে যেতে পারে চিরতরে।
    জানলা দিয়ে হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখে যতটুকু দেখা যায়।
ওইসব পরিযায়ী লোকগুলি নানারকম রঙীন পাথর,পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো গয়না ,অসুখ সরানোর নানা জড়িবুটি এসব  নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে বেড়ায়।
একদিন সকালে বিচিত্র ঘরে ছিল না।গেনি গেছে খিড়কির পুকুরে কাপড় কাচতে।এমন সময় ওই বানজারাদের  দলের  অনিকেত আসে ওর সামগ্রী নিয়ে। অনিকেত কে চেনে মানসী। অনিকেত এক বাঙালী ছেলে,বহুদিন ধরে বানজারাদের সঙ্গে থেকে থেকে  সেও তাদের মতোই হয়ে গেছে।একসময় এই অনিকেত কে মানসীর ভীষণ ভালো  লাগতো। পরবর্তী  সময় অনিকেত বাড়ী ছাড়ে, বাধাবন্ধহীন জীবনের  টানে। বানজারাদের  সঙ্গে চলে যায়।
  মানসী কে শুকনো বিষণ্ন মুখে বেরিয়ে আসতে দেখে বলে ওঠে-” তোমার কি অসুখ করেছে?”
মানসী বলে” অসুখ  তো আমার নয়…….” এক এক করে সবটুকু বলে যায় মানসী।
সব শুনে অনিকেত বলে”  তোমার জন্য বড়ো কষ্ট হয়, তোমার মুখে হাসি ফোটাতে চাই।আমি আমার গুরু গুল্লাকে বললে সে ঠিক সারিয়ে দেবে।শুধু যেমন করে হোক  বিচিত্রকে আমাদের কাছে পাঠাবে।”

রাতে মানসী বিচিত্র কে বলে-“পায়ের ব্যথার জন্য হাঁটতে কত কষ্ট হয়!এত ডাক্তার তো দেখালে যাও না একবার ঐ বানজারাদের কাছে।ওরা শুনেছি জড়ি বুটি দিয়ে অনেক অসুখ সারিয়ে দিতে পারে।”
“কথাটা মন্দ বলে নি।”ভাবে বিচিত্র । অনেক তো হলো!একবার ওদের কাছে গিয়ে  দেখাই যাক না! কিন্তু মানসী! তাকে যে একা রেখে যেতে হবে।যদিও গেনি তো আছে।
     ব্যাগ ট্যাগ  গুছিয়ে নিয়ে বিচিত্র  চলে যাবে বানজারাদের  তাঁবুতে।কতদিন  লাগবে  কে জানে!
  মানুষ ভাবে এক হয় আর ।বিধাতার লেখা চিত্রনাট্য অনুযায়ী কেবল অভিনয় করে যাওয়া ছাড়া কেউ কিচ্ছুটি করতে পারে না।

পরের দিনই সে যায় । গুল্লা তাকে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আসতে দেখে। পরীক্ষা করে বলে-
“তোমার পায়ে মস্ত একটা বিষ- ফোঁড়া রয়েছে।ওটার শেকড় তোমার মন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।সেই বিষের জ্বালাতে তুমি জ্বলে যাচ্ছ! ওটা  অপারেশন করে তুলে ফেলা ছাড়া তোমাকে বিষমুক্ত করার  আর কোনো রাস্তা নাই। শেষ পর্যন্ত না ক্যানসার হয়ে যায়!” মনে হচ্ছে ঠিকই বলছে!”ভাবলো বিচিত্র।বলল “কি করতে হবে আমাকে ?”
“কিছু না শুধু আমরা তোমার অপারেশন করবো।তোমাকে  এখানেই  এ কটা দিন থাকতে  হবে  আর যা বলবো সব কথা শুনে চলতে হবে,কি পারবে তো !” বিচিত্র সম্মতি দিতে যথা সময়ে অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু হলো।

  বিচিত্র বানজারাদের কাছে  যাবার পরদিনই গেনি মেয়ের আগুনে পোড়ার খবর পেল আর পড়িমরি করে ছুটলো মেয়ের বাড়ী।
মানসী তো পড়লো অকূল  পাথারে! বিচিত্র নাই,এসময় গেনির এত বড়  বিপদে না ছাড়লেও  তো নয়!যাহোক করে এ কটাদিন ঠিক  পেরিয়ে  যাবে! ভাবলো মানসী।
এতবড় বাড়ী তে মানসীর ভয় ভয় করলেও সেরাতটা কোনো রকমে  কেটে গেলে  ভাবলো গেনি মেয়েকে দেখে  তাড়াতাড়ি  ফিরে  এলেই ভালো  হয়।
মানসী ভাবলে কীহবে,গেনি মেয়েটাকে ছেড়ে আসতে পারলো না।

   পরেরদিন  দুপুরে  অনিকেত  এলো বিচিত্রের খবর নিয়ে। শুনলো গেনি নেই, এতবড় বাড়ী তে মানসীকে একা ফেলে রেখে  সে যায়ই বা কী করে ! গেনি না আসা পর্যন্ত সে থাকবে বলাতে মানসীও হাঁফ ছেড়ে  বাঁচলো। ভেতরে ভেতরে  একটু  অস্বস্তি যে হচ্ছিল না  এমন নয়,তবুও যাহোক মানুষ  তো একটা  ঘরে রইলো।
সেদিন  বিকেলের দিকে পুকুর থেকে  এক গোছা  পদ্ম পাতা নিয়ে  এসে বললো “নাও ধরো এই পদ্ম পাতাতে খাবার খেলে আর বাসন ধুতে হবে না। “
মানসী তো অবাক! মনে মনে তারিফ না করে পারলো না।
বেশ লাগলো । খেতে খেতে  কেমন  একটা  সুন্দর  গন্ধ  পেলো মানসী। অনিকেতকেও ডেকে খেতে বসালো।বহুদিন পর মানসী  যেন আগের চেনা জীবনটা একটুখানি  ফিরে পেল।
নিচের  বৈঠকখানা ঘরে থাকবে  অনিকেত।
কী বিচিত্র  এই মানুষের জীবন! হাসি পেল অনিকেতের। একদিন  ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে বাইরের পৃথিবীর টানে, আর  আজ!…..
  বড্ড ঘুম  পাচ্ছে  তার, পাশ ফিরে  শুলো অনিকেত, ঘুমিয়ে  পড়তেও দেরী হলো না তার।
ভাবছে মানসীও। ভাবছে কি আশ্চর্য এক  অনুভূতি! বিয়ের পর থেকে তো কেবলই  সন্দেহ  আর ভয়!  অবিশ্বাস  আর অবিশ্বাস! চারদিকে  একটা গুমোট ভাব সর্বদা। অদ্ভূত  এক মানসিকতা বিচিত্রর। বিচিত্রর কথা মনে হতেই  একটা অস্বস্তি  একটা আশঙ্কা পেয়ে  বসলো  যেন। কেমন আছে সেখানে! যদিও অনিকেত খবর যা দিয়েছে তাতে  বরং খুশি থাকারই কথা মানসীর।
ভাবতে ভাবতে  কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। ঘুম  ভেঙে  তড়বড় করে উঠে  বসে মানসী ।জানলা দিয়ে   রোদ হাসছে যেন। মুখে চোখে জল  দিয়ে  সিঁড়ি  দিয়ে  নেমে আসতে আসতে গিয়ে দেখল  একগোছা পদ্মফুল হাতে নিয়ে   বাইরের দরজা দিয়ে বাড়ীতে ঢুকছে অনিকেত।বড়ো ভালো লাগে  তার।মনটা গুণগুণিয়ে ওঠে  “মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি….. ” মনে পড়ে  মানসীর এ গানটা একসময় বড়োই প্রিয় ছিল তার!  যখনই মনটা খুব  খুশি  খুশি  থাকতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে  এই গানটা  বারবার গাইতো মানসী।  ভুলেই গেছিল সব!   বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে  তার।
পরের দিন সকালে উঠে  অনিকেত মানসীকে বলে সে ওদের ডেরায় যাচ্ছে, বিচিত্রর খবর নিতে।
ফিরে এসেছে অনিকেত, বিচিত্রের চিকীৎসা চলছে।
বিচিত্রের খবর শুনে মানসী আশ্বস্ত হয়। অনিকেত তার  হাতে তুলে দেয়    ফলের ঠোঙা আর পাথরের  গয়না  গুলি ।বড়ো ভালো লাগে মানসীর।
অনিকেত প্রতিদিন  পদ্মপাতা আর ফুল তো আনেই । কখনও আনে বুনো কুল, কামরাঙা,পেয়ারা।

এমনি করে   দিনগুলো   কেটে গেল বড়ো নিস্তরঙ্গ ভাবে, যদিও পারস্পরিক  মুগ্ধতার  চোরা স্রোতটুকু  টের পাচ্ছিল দুজনেই।
গেনির মেয়ে ভালো আছে। গেনি কাল সকালে  আসবে  খবর পাঠিয়েছে। এদিকে  বিচিত্র ও দু একদিনের  মধ্যেই  এসে যাবে।

সকাল সকাল  রান্না  সেরে নিয়েছে  মানসী। অনিকেতকেও চলে যেতে হবে কাল সকালে,  গেনি আসার আগেই। মানসীর মনে  বড়ো দোলাচল।
কিন্তু  অনিকেত! সেই  যে  জলখাবার  খেয়ে বেরিয়েছে, আর   দেখা  নেই। দুপুরের  খাওয়ার সময়  কখন পেরিয়ে গেছে ! খাওয়া  হয়নি মানসীরও।

দোলাচল তো অনিকেতের  মনেও।মানসীর মুখে হাসি  ফোটাতেই  তো  চেয়েছিল সে! কিন্তু  মানসী! অনিকেতের  মনে হয়  সে মানসীকে এক যন্ত্রনা  থেকে  আরেক যন্ত্রণা ভোগ করতে  বাধ্য করে  বসল!  এ কী করে  বসল!  প্রবল ঝড়ে উথাল পাথাল হলো মন। সে যাযাবর, পুরুষ মানুষ  সে।
  সারাদিন নিচের ঘরে অনিকেত চুপটি করে বসে থাকল।খেতে পর্যন্ত  গেল না। মানসীও  যে  না খেয়ে থাকতে পারে  একথা তার  মনেও  এলো না। জানালা দিয়ে  বাইরে  তাকিয়ে দেখে  বেলা পড়ে আসছে। মনঃস্থির করে নেয়।যেটুকু সময় আছে ,পূর্ণ  করে তুলবে ভরিয়ে দেবে  সে মানসীকে ।  নিঃস্ব  রিক্ত মানসীর অপূর্ণ হৃদয়ে আর রক্তক্ষরণ হতে দিতে পারবে না সে।এক গোছা পদ্ম পাতা আর ফুল  নিয়ে  এসেছে।সোজা  এসে দাঁড়ায়  সিঁড়িতে, মানসীকে ডাকে।
মানসী এসে দাঁড়ায় সিঁড়িতে ।বড়ো অসহায় লাগে তাকে। অনিকেতের বুকের ভেতর  মোচড় পড়ে। নিঃস্ব-রিক্ত , নিসঙ্গ মানসী, জীবনের পাত্রটি খালিই রয়ে গেছে আজও। ভালোবাসা কী অনুভব করতে  পারে নি বোধহয়। আমি কি করবো  আজ!নিজের  মনেই ভাবতে থাকে  সে।  ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে, মানসীর হাতে তুলে দেয় সেই একগুচ্ছ পদ্মফুল।বলে সে -‘ মানসী ভুল বুঝো না আমায়, তোমার  মুখে হাসি  ফোটাতে এসে তোমার দুঃখের  বোঝা বাড়িয়েই দিলাম আমি। ‘

-না অনিকেত  ও কথা বলো না।
-আমি  তোমার  ভালো  চাই  মানসী, বিশ্বাস  করো।
-এর চেয়ে বড় সত্যি জীবনে যে আর নেই!
– হয়তো নেই তবুও …….
-আমাদের জীবনে এই চরম সত্য তো উপলব্ধির বিষয়
দারুন গভীরে এর বিস্তার।তোমায় পেয়ে আমি ধন্য!
–  আমি   যে   অতি  নগন্য মানসী!

-কোন অজুহাতে এই  অনুভূতি টুকু নষ্ট হবার নয়।এর গভীরতা অনেক ভেতরে ।
-সুখে দুঃখে কাছে দূরে সব সময় তুমি থাকবে আমার উপলব্ধিতে।
– জানিনা তোমার মতো করে ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারবো কিনা, এখানেও আমি হেরে গেছি।
-সবসময় তোমার সাহচর্যে আমি ধন্য হই
-আর আমি কৃতজ্ঞতার সাথে তা স্বীকার করি।
-আমার  শূন্য উঠোন ঘিরে রাতের  যে অন্ধকার,  তা তুমি আলোয় ভরিয়ে দিতে চাও ।
আমার  অবহেলিত  নারীত্ব কে তুমি  সাদরে  বরণ করতে  চেয়েছো, আমার অনাদৃত জীবনে  আলোর দূত তুমি !তোমাকে  ফেরাই সাধ্য কী!
হেসে ওঠে অনিকেত বলে ,-এখানেই  দাঁড় করিয়ে  রাখবে! ভীষণ খিদে পেয়েছে  ।আপাতত কিছু  খেতে  দাও ।পরে কথা হবে  না হয়।লজ্জা  পায় মানসী। তাড়াতাড়ি  খাবারের ব্যবস্থা করতে  থাকে। মনে হয়  সে  নিজেও তো এখনো কিছু খায় নি।………..

পূর্ণিমার  চাঁদ , বাইরে  প্রকৃতি দুধ সাদা  জোৎস্নায় ভেসে  যাচ্ছে ।কামিনী  ফুলের  গন্ধে  মাতাল  হয়ে উঠেছে বাতাস ।
জানলা দিয়ে  চাঁদের আলো  এসে  লুটিয়ে  পড়েছে বিছানায়। বসে আছে  মানসী। তার মুখে আলো এসে  পড়েছে। ভেতরটা তোলপাড়  হয়ে  যাচ্ছে  এই মুহূর্তে। অনিকেত   জানালা দিয়ে  তাকিয়ে আছে   বাইরের দিকে ।
তোলপাড়  চলছে  অনিকেতের মনেও।  একদিকে পরিপূর্ণ প্রস্ফূটিত মানসী ভোরের  অমলিন শিউলি উন্মুখ হয়ে অপেক্ষায় ,অন্য দিকে ন্যায়  অন্যায়ের  চাপান উতোর।

উত্তাল হৃদয়ের মাঝে এই মুহূর্তে অনেক  প্রশ্ন !এই কদিন আগে ও যে ছিল  একজন উদাসীন পথিক মাত্র। পরিযায়ী পাখি মাত্র। মানসীকে যত দেখেছে যত চিনেছে তত ই তার  জন্যে  মন পুড়েছে অনিকেতের।
এতো ঐশ্বর্যময়ী হয়েও কত উপেক্ষা  আর অনাদরে  বয়ে যাচ্ছে তার বসন্তের বেলাখানি।

ভারি আশ্চর্য  লাগে  । প্রাণময়ী মানসীর  থেকে  কিভাবে  মুখ ফিরিয়ে  থাকতে  পেরেছে বিচিত্র! দুর্ভাগ্য  বিচিত্রের,  সে বুঝতে  পারছে না কি সম্পদ সে হেলায় হারাচ্ছে। করুণা হয় বিচিত্রর জন্য।  কেন বোঝে না সে তার নিরাসক্ত ঔদাসীন্য  নিস্পৃহতা মানসীকে পাষাণ  প্রতিমা করে তুলবে। বিচিত্রের এমন অবহেলা ,অস্বাভাবিক  আচরণ  কেন!বিচিত্রের  মানসীকে  জীবনের  রূপ রস বর্ণ গন্ধ থেকে  বঞ্চিত  করার কোন  অধিকার নেই, থাকতে পারে না।

    মানসী  অন্যের স্ত্রী  হলেও সে অনিকেত কে ভালোবাসে।অনিকেতও মানসীকে ভালোবাসে।তাদের ভালোবাসায় কোন খাদ  নেই।
    বিচিত্র  যদি স্বামীত্বের অধিকারে  ওকে এমন ভাবে  বঞ্চনা করতে পারে  তবে প্রেমের  অধিকারে ও ই বা কেন মানসীকে  ভরিয়ে দিতে পারবে না।
একটার পর একটা যুক্তি দিয়ে  অনিকেত সব দ্বন্দ্ব  আর দ্বিধা  কাটিয়ে উঠতে  থাকে।…….

মানসীর অবরুদ্ধ  আবেগ আজ মুক্তি পেয়ে  নির্ঝরিণীর মতো বয়ে যেতে  লাগলো। বুকের ভেতরের  পুঞ্জীভূত শৈত্য আজ গলে গলে বইতে থাকলো।প্রকৃতির অনাবিল আনন্দ  আজ মানসীর সর্বাঙ্গে  উপচে পড়ছে।এক হয়ে মিশে যেতে  লাগলো  দুটি মন প্রাণ। অনিকেত ও মানসী পরস্পর  পরস্পরকে  ভরিয়ে  তুললো এক অনিবর্চনীয় আনন্দে। নরনারীর মিলনে যে এত সুখ এর আগে  কোনোদিন  মানসী ভাবতেও পারেনি। তার নিবেদন ব্যর্থ  হয়নি। অনিকেত তাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করেছে। সম্মানিত  করেছে তার  অবহেলিত  যৌবন কে।
তার অপমানিত  নারীত্বকে আজ অনিকেত যোগ্য  সম্মান দিতে  এতটুকু  কার্পণ্য করেনি। অনিকেতের  কাছে তার  কৃতজ্ঞতার শেষ  নেই। তার স্বামীর কাছে  পেয়েছে শুধু  উপেক্ষা  আর অবহেলা। তার অবহেলিত  নারীত্বকে চরম অসম্মানের মধ্যে  রেখে  কী আনন্দই বা পেত তার স্বামী! একটা কুকুরও  গৃহস্থের দুয়ারে একবেলা বসে থাকলে দুটো খাবার পায়, মানসী এতদিন  বিশ্বস্ত  থেকে কিইবা পেয়েছে! অসম্মান, নারীত্বের চরম অপমান ! বিয়ের পর  থেকে  সাত সাতটা বছর  সে সব মুখ বুজে সয়ে এসেছে। সহ্যের ও যে একটা সীমা আছে! আজ সে কানায় কানায়  পূর্ণ।
সাত বছর পর আজ ই  সে প্রথম ঘুমের ওষুধ ছাড়াই ঘুমিয়ে  পড়ে।
পরিপূর্ণ প্রশান্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে  দেখে অনিকেত চুপটি করে বসে আছে। মানসীর দিকে তাকিয়ে  বলে, -এখন যে আমায় চলে যেতে হবে  মানসী! অবরুদ্ধ আবেগ আজ কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে। মানসী বলে-আমাকেও নিয়ে চলো!
-তা হয় না মানসী, যাযাবর মানুষ  আমি।কবে কোথায়  হারিয়ে  যাবো…. দুহাত দিয়ে  তার গলা জড়িয়ে ধরে  মানসী। বলে-‘ না না এমন কথা বলো না। আমি কি  নিয়ে  বাঁচবো তাহলে! ‘
-না মানসী আমি হারিয়ে  যেতে পারি না। আমার  প্রাণ ভোমরা তুমি। তোমার  কাছে আমাকে  যে ফিরে আসতেই হবে!
সুখ স্বপ্নের   ঘোর লেগে আছে  তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই  সুখের  রেশ এখনো  কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই! বাড়ী ঘর  ছেড়ে  সব বন্ধন  ছিন্ন করে  একদিন  সে  বেরিয়ে  পড়েছিল পথের টানে,  ফেরানোর জন্য মা সেদিন  কত কেঁদেছিল! আর আজ! এই  সুখের  বন্ধন  ছিন্ন  করে  চলে  যেতে  মন যে কিছুতে ই সায় দিচ্ছে  না। মায়ের  কথা ভেবে আজ হঠাৎ  মনটা খারাপ হয়ে গেল। যেতে তো হবেই! গেনি  এসে পড়তে পারে যে কোন সময়।ওদের এভাবে দেখলে মানসীর বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। অনিকেত বলে-
‘নিজেকে সামলে নাও মানসী। আমার আসার সময় হলো।  ‘মানসী কিছু বলার আগেই অনিকেত বেরিয়ে  পড়ে।

যথা সময়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর অপারেশন হলো।তখন বিচিত্রকে বেহুঁশ করতে হয়েছিল।
দেখতে দেখতে দশ দিন পেরিয়ে গেল।এ কটাদিন আচ্ছন্ন অবস্থায় কেটেছে।এখন ভারী আরাম লাগছে বিচিত্রের।কোথায় পায়ের ফোঁড়া কোথায় কী!  বেশ তো চলতে পারছে সে। অনিকেত বলে ” দেখো এখন থেকে তোমার জীবনটাই কত বদলে যাবে! সব নুতন করে ভালো লাগবে।”
পায়ে হেঁটেই বিচিত্র সোজা চলে গেল বাড়ী! এতটুকু কষ্ট নেই! না শরীরে না মনে।
ভাবলো চমকে দেবে মানসীকে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress