বিশ্বাসের ছলন
জঙ্গলমহলের রাঙ্গা পথের বাঁকে বাঁকে লোক দেব দেবীর আটন বা থান। সে বড় শাহী সড়কের পাশে হতে পারে কিংবা আদিম অরন্যের গভীরে, পাহাড়ের চূড়ায় কিংবা উধাও ধূ ধূ নদীর চরে। যেখানেই এই আটন থাকুক না কেন সর্বত্রই ছলনের উপস্থিতি।”ছলন” হল পোড়ামাটির বিভিন্ন পশু মূর্তি— ঘোড়া, হাতি ,শুকর, সাপ ইত্যাদি! তবে ছলন হিসাবে ঘোড়া ও হাতির আধিক্য ই বেশি। জঙ্গলমহলের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রাম দেবতা বা বড়াম থান থাকে। এই বড়াম থানের বৈশিষ্ট্য হলো ছলনস্তূপ। গাছগাছালি বেষ্টনীতে পোড়ামাটির ছলনস্তূপে, শোলার চাঁদ মালা ও সিঁদুরের মহিমায় জাগ্রত হন দেবতা। এই বড়াম দেব বা দেবী হিসেবে পূজিত।
ওড়িশা লাগোয়া সীমান্ত বাংলার এক বড়ামথানে অদ্ভুত ভাবে সাজানো ছলন স্তুপ দেখেছিলাম । বন তুলসীর ঝোপে ঘেরা চল্লা সাবরা গাছের বেষ্টনীতে নাম-না-জানা বনলতার আচ্ছাদনে ছায়া সুনিবিড় বড়াম থান– লোকদেবতার আটন। সুন্দর শান্তির পরিবেশ।ঘন শাল জঙ্গলের মাঝে এই বড়াম থানটির উপস্থিতি আদিম অরণ্যচারী আদিবাসীদের আন্তরিক প্রকৃতি আরাধনার পরিচয় দেয়।
মাকডা বা ঝামা পাথরের বেষ্টনী রএকপাশে ঘোড়া অন্যপাশে হাতির ছলন সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে। অতি প্রাচীন ছলন থেকে শুরু করে সদ্য অর্পিত ছলন ও রয়েছে। জঙ্গলমহলের অন্য কোথাও এইভাবে ছলনের বিভাগ দেখি নি। একমাত্র এই উড়িশা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যেটা দেখলাম। এই থানটি যে জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত তা হাতির পরিযান পথে পড়ে এই পথেই দলমা র দামালরা উড়িষ্যা যায় আবার ফিরে চলে দলমার পথে। পুরো জঙ্গল পথটাই ওদের লীলাক্ষেত্র। এই আটনটি থেকে কয়েক পা হাঁটলে একটা ছোট সোঁতা —ঝামাপাথরের ঝোরা থেকে জল বেরিয়ে নালার মতো এঁকেবেঁকে বনের গভীরে চলে গেছে। পায়ের পাতা ডোবা জল তির তির করে বয়ে চলেছে। পাথর চাট্টানের মাঝে যেন এক উচ্ছল আদিবাসী কন্যা। নালাটার পাশে জলজ ঘাস নলখাগড়া জন্মেছে। কটা বক একপা একপা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। বেনাঘাসের র ঝোপে তেলে মুনিয়ার ঝাঁক। কোলাহল মুখর করে রেখেছে ছোট্ট নদী র দুই তীর কে। বড় মন ছোঁয়া পরিবেশ। হরিয়ালের ঝাঁক গাছের মাথা ছেয়ে রেখেছে। ওদের কলকাকলিতে বন সরগরম।
একদল আদিবাসী কিশোর তীর ধনুক গুলতি নিয়ে বনের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো। শিকারে এসেছে ওরা। ওদের মুখেই এই বড়াম থানের কথা জানলাম। পৌষ সংক্রান্তি ও এখান দিনে এখানে পুজো হয়। তখন বিভিন্ন দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে সবাই এখানে মানসিক শোধ করতে আসে। এই ছলনে গুলি সেই মানত পূরণের প্রতিচ্ছবি। শবর দেহুরি পূজিত এই লোকদেবতা এই প্রান্তিক মানুষজনের বড় আপনার জন। যেকোনো বিষয়ে এরা এই আটনে পুজো করে— তা ছেলে মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে কিংবা ভালো ফসল হলে কিংবা রোগ ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করলেই! এই দেবতার সাথে তাদের আন্তরিক সম্পর্ক! গাছের প্রথম ফল তারা এখানেই উৎসর্গ করে! বড় ভালো লাগলো এই রীতি। এই মাটির মানুষদের দেবতাকে আত্মার আত্মীয় করে নেওয়ার পদ্ধতিতে মন ভরে গেল। এরাই তো শাশ্বত ভারতের প্রতিচ্ছবি।
নমি নমি চরণে।