বাঘের মাংস
আউ কেত্তে বাট্ট হব্ব দণ্ডধর টুল্লকা বাংলো? দণ্ডধরকে প্রশ্ন করলাম চলতে চলেতে।
আমার দিকে মুখ না ফিরিয়েই, ডোন্ট কেয়ার উত্তর দিল দণ্ড, হব্ব, দ্বি কোশখণ্ডে। আউ কঁড়?
বাপ্পালো বাপ্পা! দ্বি ক্বোশ? মু আউ চালি পারিবনি। হতাশ গলায় বললাম আমি।
চালি পারিবুনি? ইঃ, আউ কঁড় করিবি? এই ভীষ্বণ গহন জঙ্গলরে রহিবি কি মরিবা পাঁই? চঞ্চল করিকি চালুন্ত ঋজুবাবু। এইঠি বহত্ব গন্ধ আছি। বড্ড বড্ড গল্ব।
প্রায় কেঁদে ফেলে একটা পাথরে বসে পড়ে দণ্ডকে বললাম, না ম। মোর গোডুটা কেম্বতি ফুলি গল্লা দেখিলু! মু আউ জমারু চালি পারিবুনি।
কাম্ব সারিলা! বলেই, প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে আমি যে পাথরে বসে পড়েছিলাম, তারই পাশেরই একটা পাথরে বসল সে। নিজে বসার লোক দণ্ডধর আদৌ নয়; যদিও অন্যকে যখন-তখন পথে বসানোই তার কাজ।
আমাদের জিপটা খারাপ হয়ে গেছিল পুরুনাকোট থেকে টুল্বকাতে আসার পথে। এ পথে এমন জঙ্গল পাহাড় যে, দিনমানে চলতেই বুক দুরুদুরু করে। আর এখন তো রাত বারোটা। তাও আবার কৃষ্ণপক্ষের রাত। চাঁদ উঠবে শেষ রাতে। কেন যে জিপেই শুয়ে থাকলাম না। তাই ভাবছিলাম। এই দণ্ডটার পাল্লায় পড়ে আজ যে কত দণ্ড দিতে হবে তা ভগবানই জানেন। জীবনটাই যাবে হয়তো। পাঁচটা নয়, দশটা নয়, মাত্র একটাই জীবন।
দণ্ড জলের বোতলটা এগিয়ে দিল কথা না বলে। রেগে গেলে ও কথাবার্তা বলে না। মাঝে-মাঝে গলা দিয়ে পিলে-চমকানো একটা আওয়াজ করে, আর পিচিক পিচিক করে তিনহাত দূরে থুথু ফেলে। মিস্টার ডাকুয়ার এই ব্যাপারটা ঠিক কাসিও নয় হাঁচিও নয়, গলা-খাঁকারিও নয়। এক কথায় তাকে কাহাঁখাঁ বলা চলে। ওর ওই কাঁহাঁখা হঠাৎ শুনে আমি কোন্ ছার অনেক বড় বড় হিম্মতদার লোককে পর্যন্ত ঘাবড়ে যেতে দেখেছি।
ডিসেম্বরের রাতেও আমার জার্কিন ঘামে ভিজে গেছে। বসে, বন্দুকটা দু হাঁটুর মধ্যে রেখে একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর পাইপের পোড়া তামাক খুঁচিয়ে ফেলে আবার নতুন করে টোব্যাকো ঠাসতে লাগলাম। দণ্ডকে খুশি করার জন্যে পাইপের টোব্যাকো এগিয়ে দিয়ে বললাম, টিকে তামাকু?
মুখে শব্দ না করে ও দুদিকে মাথা নাড়ল দক্ষিণ ভারতীয়দের মতো। তারপর নেড়েই চলল।
বুঝলাম প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে আমার উপর। ও যখন তামাক নিলই না। অগত্যা তখন দেশলাই ঠুকে পাইপটা ধরালাম। ঠিক সেই সময়েই মহানদীর দিক থেকে একটা বড় বাঘ জঙ্গলের গভীরে ডেকে উঠল। অবশ্য বেশ দূরে। তার এবং আমাদের পথের মধ্যে একটা বড় টিলাও ছিল। ডাক শোনামাত্রই দণ্ড তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। অন্ধকারে তার চোখ দুটো বাঘের চোখের মতোই জ্বলে উঠল। বলল, ই সে বাঘটা হব্ব নিশ্চয়ই।
আমি ইচ্ছে করেই টিপ্পনী কেটে বসলাম, হঃ। তাংকু বদনরে টিক্কিট্ব লাগিছি। তু ত সব্ব জানিচি!
ভীষণ রেগে গিয়ে দণ্ড বলল, মু জানিচি না কঁড় তম্বমানংকু সান্যাল ডি. এফ. ও. জানিচি?
সান্যাল ডি. এফ. ও.-এর উপর দণ্ডর ভীষণ রাগ। আমারও রাগ কম নয়। কিন্তু সে-গল্প এখানে নয়। এই সব্ব জানিচি কথাটা প্রায়ই দণ্ড দর্পভরে বলত বটে কিন্তু সেই দর্প বা দম্ভ মিথ্যা আস্ফালন একেবারেই ছিল না। সব কৃতী মানুষেরই বোধহয় একটু দম্ভ থাকে। বিশেষ করে সেই কৃতিত্ব যদি চালাকি বা চুরি করে না অর্জিত হয়। দণ্ড সেইসব সত্যিকারের কৃতীরই একজন। আসলে, একে দম্ভ না বলে বোধহয় আত্মসম্মান বলাই ভাল। বার্ট্রাণ্ড রাসেলের ভাষায় যা হচ্ছে দ্য বেটার হাফ অফ প্রাইড। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে এই অঞ্চলের বনজঙ্গল দণ্ডর মতো ভাল করে কেউ জানত বলে আমার মনে পড়ে না। তবে বাঘেদের ঠিকানায় তো আর পিনকোডের ছাপ মারা থাকে না। কখনও কখনও এক রাতে তারা পঞ্চাশ মাইলও টহল মেরে ফেলে। এইটাই বাঘমুণ্ডার বাঘ, এ-কথাটা আন্দাজে ঢিল।
আমার পাইপ-খাওয়া আর সহ্য হল না। ধমকে বলল, চালুন্ত, চালুন্ত, আউ কেত্তে ভুশভুশ করিবে?
উঠলাম অগত্যা।
জিপটা পথের বাঁ পাশে ঠেলে পার্ক করে রেখে এসেছি আমরা। ভয় হচ্ছে, রাতে হাতিতে ফুটবল না খেলে তা দিয়ে। অংগুল থেকে ফার্স্টক্লাস পোড়-পিঠা কিনেছিলাম। সেগুলো সঙ্গে নিয়ে এলে অথবা পেটে ভরে নিয়ে এলেও মন্দ হত না। জিপ খারাপ হয়েছিল পুরুনাকোটের গেট পেরুনোর মাইলখানেক পরেই। পুরুনাকোটে গেলেই ভাল হত। অনেক কাছেও হত। কিন্তু কে কার কথা শোনে! টুকা বাংলোতে দণ্ডর দুই চেলা ভীম আর দুর্যোধন গুরান্টির নলা-পোড়া বানিয়ে রাখবে যত্ন করে। রাতে ফিরে নলা-পোড়ার সঙ্গে খিচুড়ি না খেতে পারলে এ ছার জীবন রাখারই আর কোনও মানে হয় না’ বলে জেদ ধরল দণ্ড। নলা-পোড়া খেতে অবশ্য চমৎকার। গুরান্টি অর্থাৎ মাউস্-ডিয়ারের মাংস ডুমো ডুমো করে কেটে নুন না-ছুঁইয়ে কাবারের মশলা মাখিয়ে নলা বাঁশের একমুখ ফুটো করে তার ভেতরে পুরে কাদা দিয়ে সেই মুখ সেঁটে বন্ধ করে ক্যাম্প ফায়ারের আগুনের মধ্যে ফেলে দিতে হয়। তারপর বাঁশের মধ্যে কাবাব তৈরি হয়ে গেলে ফটাং শব্দ সহকারে নলুবাঁশ ফেটে যায়। তখন আগুন থেকে বের করে প্লেটে জম্পেশ করে নুন মাখিয়ে, কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে খেতে এক্কেবারে ফাসটোকেলাস। হাজারিবাগের হান্নানের দোকানের কাবাবও হেরে যাবে নলাপোড়ার কাছে। এসব দণ্ডধরের পক্ষেই সম্ভব। নইলে, ভীম আর দুর্যোধনের মধ্যে এমন গলাগলি ভাবই বা কী করে যে হয় তাও আমার মোটা বুদ্ধির বাইরে। এমন অহি-নকুলের ভালবাসা একমাত্র গ্রেট দণ্ডধর ডাকুয়াই ঘটাতে পারে।
জিপ থেকে নেমে মাইলখানেক আসার পরেই আমার ডানপায়ের জুতোটি বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার সোটিকে মুক্তি দিয়েছিল। একটি ধারালো পাথরের মুখে পড়ে তার কিছু আগে হিলটিও হাপিস হয়ে যায়। তাই ডান পায়ে আমার জুতোর উপরের খোলসটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ঐ ঠাণ্ডা আইসক্রিমের মতো ধুলো, বরফের ছুরির মতো পাথর আর আলপিনের মতো কাঁটায় পা আমার ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল।
রাত আড়াইটে নাগাদ টুল্বকায় পৌঁছে মুগের ডাল খিচুড়ি এবং গুরান্টির নলা-পোড়া খেয়ে পায়ের সব কষ্টই যেন লাঘব হয়ে গেল। পথে ঘটনা তেমন আর বিশেষ ঘটেনি। একটা ভাল্লুকের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হত, যদি না দণ্ড তার রোলেক্স গামছা মাথার উপর ধরে ‘ওরে মোরো সজনী, ছাড়ি গল্লা গুণমনি, কা কর ধরিবি’ গেয়ে গেয়ে তাকে নাচ না দেখাত। রুপোলি জরি বসানো ঘোরতর লাল রঙের রোলেক্স গামছাটি দণ্ডর সব সময়ের সঙ্গী। এমন মালটিপারপাস গামছা বড় একটা দেখিনি। সবসময়ই কাঁধে শোভা পায়।
.
বেলা এগারোটা নাগাদ অবধি ঘুমিয়ে উঠেছি। খুব ভোরে উঠেই চলে গেছিল দণ্ড রফিককে সঙ্গে করে নিয়ে। ট্রাকে, কুলিদেরও নিয়ে গেছিল। সুরবাবুকে বলে। আমার ঘুম ভাঙার পর ও জিপ নিয়ে হৈ-হল্লা করতে করতে ফিরে এল। সঙ্গে একটা কুটরা হরিণ। হরিণটাকে দেখিয়ে বলল, তোমাদের কালীঘাটের পাঁঠার মতো ঝোল রাঁধব আজকে। সিম্পিল রান্না। মাংসের ঝোল আর ভাত।
খেয়ে খেয়েই দণ্ড মরবে একদিন, যদিও ওর যা কার্যকলাপ, তাতে বাঘের কামড় খেয়ে মরাটাই অনেক বেশি স্বাভাবিক বা বাঞ্ছনীয় ছিল। দণ্ড বোধহয় কামড় খেয়ে মরার চেয়ে সুস্বাদু সব খাবার জিনিস কামড়ে খেয়ে মরাটা অনেক ভাল বলে সাব্যস্ত করেছে।
ঘর থেকে চেয়ার বের করে রোদে এনে দিল দণ্ড। আমি বসলাম। এখন গরম জামা কাপড় খুলে ফেলেছি। আস্তে আস্তে শরীর গরম হয়ে উঠছে। রাত-শিশিরের ওসে-ভেজা ভারী ধুলো রোদের ওমে গরম হয়ে, পাতাঝরানো রুখুশুখু হাওয়ায় সবে উড়তে আরম্ভ করেছে। বাংলোর হাতার উল্টোদিকের জঙ্গল থেকে বড়কি ধনেশ ডাকছে কুচিলাগাছ থেকে। হ্যাঁক-হ্যাঁক, হ্যাঁক-হ্যাঁক করে। গ্রেটার ইন্ডিয়ান হর্নবিলকে এখানে বড়কি ধনেশ বলে। আর লেসার ইন্ডিয়ান হর্নবিলকে বলে, ছোটকি ধনেশ। হোমিওপ্যাথিতে বিখ্যাত ওষুধ আছে নাক্সভমিকা। এই নাক্সভমিকা ওষুধ তৈরি হয় কুচিলা থেকেই। এই গাছগুলোর পাতার মাঝখানটিতে একটু সাদাটে রঙ থাকে। হাল্কা সাদা। অনেক সময় বড়কি ধনেশরা যখন মগডালে বসে থাকে, তখন তাদের বুকের সাদা আর পাতার সাদায় এমনভাবে মিশে যায় যে পাখিরই বুক না পাতারই মুখ, তা ঠাহর করতে অসুবিধে হয়; বিশেষ করে অন্ধকার পাহাড়তলি অথবা গভীর ছায়াচ্ছন্ন জঙ্গলে।
এই বড়কি ধনেশরা বড্ড আওয়াজ করে। তা তারা যেখানেই থাক না কেন! তাই এদের শিকার করা বেশ সোজা। এদের তেল দিয়ে কবিরাজমশাই এবং হাকিমসাহেবরা বাতের ওষুধ বানান।
ছোটকি ধনেশদের বেশি দেখা যায় ভালিয়া গাছে বসে ফল খেতে। কুচিলার মতো ভালিয়াও একরকমের বন্য গাছ। ওদের ভালিয়া গাছে বসে থাকতেও দেখা যায় বলে ছোটকি ধনেশদের নাম এখানে ভালিয়া-খাই। প্রকাণ্ড বড় বড় বাদামি কাঠবিড়ালিগুলো চিঙ্ক-চিঙ্ক-চিঙ্ক আওয়াজ করতে করতে বড় বড় গাছের এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে ডাল ঝাঁকিয়ে শীতের রোদ-পিছলানো চিকন উজল পাতার পথে পথে ঝরনার মতো শব্দ করে ঘূর্ণা হাওয়ায় রোদকণা উড়িয়ে ছড়িয়ে সমস্ত জঙ্গলকে মুখর প্রাণবন্ত করে তুলেছে। অদৃশ্য, কোনও দারুণ-জুয়ারির গায়ক যেন সমস্ত প্রকৃতিকে অসংখ্য বাজনার মতো ভরপুর সুরে বেঁধে নিয়ে গাইছেন :
প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে,
অলস রে, ওরে, জাগো জাগো ॥
শোনো রে চিত্তভবনে অনাদি শঙ্খ বাজিছে–
অলস রে, ওরে জাগো, জাগো ॥
চুপ করে সেই শীতের পাহাড়-জঙ্গলে ফ্যাকাসে মাটির ধূলি-ধূসর সড়কে হাওয়ার অলিগলিতে ঝরাপাতার নাচের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকিয়ে বসে আছি। দণ্ড, ভীম, দুর্যোধন এবং আরও অনেকের চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই আমার কানে আসছে না। কুচিলা-খাঁইদের ডাক, বাদামি কাঠবিড়ালিদের চিকন চিঙ্কচিঙ্ক, ঝরা-পাতার মচমচানি, সবুজ টুঁই, মসৃণ মৌটুসিদের শিস্ আর হাওয়ার ফিসফিস্ সব মিলেমিশে এমন এক ভিডিও-স্টিরিওর এফেক্ট হচ্ছে আমার অবচেতনে যে তা বুঝিয়ে বলতে পারি এমন কলমের জোর আমার নেই। কোনওকালে হবেও না। জঙ্গলের মধ্যে এলে এই সবই উপরি পাওনা। বোনাস। যদি কখনও বিনা আন্দোলনে এই বোনাস পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করো তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ জঙ্গলে এসে, তাহলে জানবে যে, তোমরা ভাগ্যবান।
বড় চমৎকার এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎই কানের কাছে দণ্ডধরের ডাকে সেই ঘোর কেটে গেল।
বলল, সে কুটুরা দেইকি আউ কঁড় রাঁধিবু? ঝোল্ ত হউচি। টিকে কষা মাংস ভি হেল্লে মন্দ হইথান্তি না। কহন্তু আইজ্ঞা। কঁড় করিবু?
বিহ্বল ছিলাম অন্য এক দেবদুর্লভ জগতে। চলে এলাম মাংসের ঝোল আর কষা-মাংসের রাজ্যে। দণ্ডধর ডাকুয়াও একরকমের বিহ্বলতা আমার।
যদিও একেবারেই অন্যরকমের।
একটা বড় বাঘ, বাইসনের বাচ্চা ধরেছিল কাল রাতে। ধরে অনেকদূর টেনে নিয়ে গেছে বাইসনদের দলের চোখ এড়াতে, বাইসন-চরুয়া মাঠ পেরিয়ে। খাড়া পাহাড়ের গায়ে একটা গুহার মধ্যে নিয়ে গিয়ে তাকে রেখেছিল। আমি রোদে বসে থাকতে থাকতেই দণ্ডর ইনফরমাররা খবর নিয়ে এল। দণ্ড বলল, নিশ্চয়ই কাল রাতের বাঘটার কাজ।
বললাম, আমার পায়ের যে হাল, তাতে খাড়া পাহাড়ে চড়ার অবস্থা একেবারেই নেই। অন্য কোনও কিল করুক তখনই মাচায় বসা যাবে। নইলে, পরে হাঁকা করার বন্দোবস্ত কোরো।
ও বলল, তা হলে সন্ধেবেলা কী করবে? সন্ধেবেলাও কি বাংলোয় বসে আগুনের পাশে বই পড়বে? বই-ই পড়বে তো কলকাতাতেই পড়তে পারতে! বই পড়ার জন্যে এত কষ্ট করে এতদূর ঠেঙিয়ে আসার দরকারটা কী ছিল?
পায়ের অবস্থাটা দেখলে না?
দেখেছি। শিকারে এলে এমন কত কী হয়! যাবে কি না বলো।
তুমি তো মহা অবুঝ!
আমি অবুঝ? না তুমি? কাল কী খাবে? আজ না হয় কুটরা হল?
খাওয়াই কি সব দণ্ড?
দণ্ডধর হতাশ হয়ে দুহাত দুদিকে কাঁধসমান তুলে ঢেউ খেলিয়ে বলল, আল্লো। মু আউ কঁড় কহিবি! কিচ্ছি কহিবাকু নাই।
অনেক তর্কাতর্কির পর শেষ রফা হল যে, বন্দুকটা নিয়ে এক চক্কর হেঁটে আসব সন্ধের পর। সঙ্গে ফোর-সেভেন্টি ডাবল ব্যারেল রাইফেলটাও নেব। যদি কোনও অভদ্র অসভ্য বড় জানোয়ার ঘাড়ে এসে পড়ে তবে তার গায়ে ঠেকিয়েই দেগে দেব। কালকে ক্যাম্পে সকলের খাওয়ার জন্যে কিছু পট-হান্টিং-এর জন্যেই যাওয়া। ও বলল, যিব্বি আর আসিবি। টিকে বুলি বুলিকি পলাই আসিবি চঞ্চল।
বিকেল হল। জঙ্গলে শীতকালে দ্রুতগতি চিতার মতো বিকেল আসে হরিণীর মতো দুপুরকে তাড়া করে। ক্রমশই তাদের ব্যবধান কমে আসতে থাকে। তারপর হঠাৎই সন্ধে এসে মস্ত হলুদ দিগন্তজোড়া বাঘেরই মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কালো থাবা চালায় তাদের দুজনেরই উপর। রাত নামে। সব কালো হয়ে আসে।
আমাদের দণ্ডধরের শীতকালীন শিকারের পোশাকের একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার। পায়ে একটি ডাকব্যাকের গামবুট। নিম্নাঙ্গে কাছা-কোঁচা গোঁজা। এইমারি কি সেই-মারি ভঙ্গিতে পরা খাটো ধুতি। ঊর্ধ্বাঙ্গে হলুদরঙা হাফশার্ট। তারও উপরে ঘোরতর মারদাঙ্গা লালরঙের একটি আলোয়ান। ওর নুয়াগড়ের বাড়ি ছেড়ে যতদিন জঙ্গলে এসে থাকে দণ্ডধর ততদিন দাড়ি কামায় না। কাঁচা-পাকা, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি মুখময়। এবং মিটিমিটি হাসি। হাসির ফাঁকফোকর দিয়ে গুণ্ডি-পানের গন্ধ। এই সন্ধেয় বাঁ কাঁধে লাঠির মতো করে শোয়ানো ফোর-সেভেন্টি ডা ব্যারেল রাইফেলটি। ডান হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ।
রেডি হয়ে এসেই ও বললে, চালুন্ত আইজ্ঞা। চঞ্চল যিবি, চঞ্চল আসিবি। গুলি বাজ্জিবে কী প্রাণ যিব্বে।
কিছুটা গিয়ে ভীমধারার ঝরনা পেরিয়ে বাঁ-দিকে ঢুকে গেলাম আমরা। তখন সবে অন্ধকার হয়েছে। আলো না-জ্বেলে দণ্ড আগে আগে চলেছে। আমার লোকাল গার্ডেন, ফ্রেন্ড অ্যান্ড ফিলসফার। জঙ্গলে কৃষ্ণপক্ষ রাতেও তারাদের আলো থাকে। তবে সে-আলোর সুবিধা পাওয়া যায় শুধু জলের ধারে বা ফাঁকা জায়গাতেই। কৃষ্ণপক্ষের রাতে জঙ্গলের গভীরে একবার ঢুকে পড়লে, তারা তেমন কোনও কাজে আসে না। তবু জানোয়ার-চলা সুঁড়িপথটা দেখা যাচ্ছিল একটু একটু, আবছা। অন্ধকারে, মায়ের খুব কাছে শুয়ে আলোনিবনো ঘরে মায়ের মাথার সিঁথি যেমন দেখতে পাও তোমরা, তেমন।
মিস্টার ডাকুয়া চলেছে তো চলেছেই। আমি ভেবেছিলাম, জলের পাশে কচি ঘাসে বুঝি চিতল হরিণের খোঁজে চলেছে সে। অথবা টুল্বকা গাঁয়ের শেষ সীমানাতে বিবি-ডালের খেতে শম্বরের দলের খোঁজে। দণ্ডধরের পূর্ব-চিহ্নিত কোনও বিশেষ শুয়োরেরও খোঁজেও হয়তো হতে পারে। কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার দেখে সেরকম আদৌ মনে হচ্ছে না। অথচ শিকার যাত্রায় বেরিয়ে পড়ার পর দণ্ডধরের গতিবিধি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করি এমন দুঃসাহস আমার আদৌ ছিল না। অধমের পায়ের অবস্থার কথাও ও বিলক্ষণই জানে। মনের অবস্থা জানে না এমনও নয়। সব জেনেশুনেই ও এমন হেনস্থা করছে আমার। অ্যালগারনন ব্ল্যাকউডের একটা দারুণ বই দিয়েছিল দেবু। সেই বইটা অর্ধেক পড়ে রেখে এসেছি। মনটা আমার এখন সেই মূজ-শিকারির বুকপকেটে গোঁজা আছে। মনে হচ্ছে মিস্টার ডাকুয়ার হাতে পড়ার চেয়ে ডাকাতের হাতে পড়াও অনেক ভাল ছিল।
এখনও টর্চটা একবারও জ্বালায়নি ও। উদ্দেশ্য, গভীর সন্দেহজনক। আমার ডান-পাটা যাতে চিরদিনের মতোই যায়, তারই বন্দোবস্ত পাকা করতে চায় বোধহয়।
হঠাৎই দেখলাম সামনে জঙ্গলটা ফাঁকা হয়ে এল। যেন ভোজবাজিতে। সামনে অনেকখানি সমান ফাঁকা জায়গা। কোনওকালে ক্লিয়ার-ফেলিং হয়েছিল সেগুনের। তারপর জংলি ঘাস জবরদখল নিয়েছে। ফাঁকা জায়গাটার কাছে পৌঁছে দণ্ড মুখে দু আঙুল পুরে শিস্ দিল একবার। ফাঁকা জায়গাটার ওপাশের জঙ্গল থেকে অন্য কেউ শিস দিয়ে উত্তর দিল। তারার আলোয় দেখলাম ও-পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একটি প্রায়-উলঙ্গ ছায়ামূর্তি টলতে টলতে আমাদের দিকে আসছে। লোকটা যখন কাছে এল তখন দেখলাম তার পরনে একটি ছেঁড়া গামছা। গায়েও একখানি গামছা। দণ্ড কথা না বলে, তার আলোয়ানের নীচ থেকে একটি থলি বের করে লোকটিকে দিল। বলল, ভাল করে খাস্। পেট ভরে।
লোকটা বলল, হঁ।
কষা মাংস আর রুটি আছে।
হঁ। লোকটা আবার বলল।
তারপর দণ্ড আমাকে কিছুটা পাইপের তামাক দিতে বলল লোকটাকে। দিলাম। খৈনির মতো হাতে ডলে ঠোঁটের নীচে দিয়ে দিল লোকটা সঙ্গে-সঙ্গে।
অন্ধকারেও ওর পাঁজরের হাড় গোনা যাচ্ছিল। দণ্ডধর ওকে জিজ্ঞেস করল ঘড়িংয়ের পায়ের দাগ সে দেখেছে কি না! লোকটা বলল, একটু এগিয়েই একটা নুনি আছে। সেখানে শম্বর, ঘড়িং, গন্ধ, সব নিয়মিত আসে। বাঘও আসে তাদের পেছন-পেছন। নুনির পাশে একটা ঝাঁকড়া শিশুগাছ আছে। তার নীচে বড় বড় পাথর, আর ঝোপঝাড়। তার আড়াল নিয়ে বোসো গিয়ে নির্ঘাত শিকার। কিন্তু সাবধান! বেশি রাত অবধি থেকো না ওখানে ভুল করেও।
কেন? দণ্ডধর শুধোল, কোমরের বটুয়া থেকে আরেকটা গুণ্ডিপান মুখে ফেলে।
ঠাকুরানি আছেন ওখানে।
দণ্ডধর গালাগালি দিয়ে বলল, আফিং খেয়ে খেয়ে আফিংখোর, তোর মগজটা একেবারেই গেছে রে, শিব্ব।
না রে, দণ্ড। আমার কথা শুনিস্। নইলে বিপদ হবে। লোকটা ভয়-পাওয়া গলায় বলল।
দণ্ডধর ডাকুয়াকে বিপদের ভয় দেখাস না। তুই এখন বউয়ের সঙ্গে কুটরার কষা-মাংস আর রুটি খা গিয়ে যা পেট ভরে। সঙ্গে সেগুন-পাতায় পোড়া আমলকীর আচারও আছে।
শিব্ব নামক লোকটি ফিসফিস করে বলল, খাবে নাকি?
দণ্ড যেন খুব অনিচ্ছার সঙ্গেই বলল, দে।
বাড়ি চল তাহলে।
শিব্বর সঙ্গে একটু হেঁটে হেঁটে ওর কুঁড়ের কাছে গেলাম আমরা। এক ঘটি জল এনে ও দণ্ডকে কী যেন খেতে দিল। নাড়ুর মতো দেখতে। কিন্তু কালো। দণ্ড আমাকেও দিল দুটো। বলল, খেয়ে নাও কথা না বলে।
কী? জিনিসটা কী?
প্রসাদ। ঠাকুরানির কাছে যাচ্ছ, শিব্বর কথা শোনো। ভাল ছাড়া খারাপ হবে না কোনও।
নাড়ুদুটো জল দিয়ে বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে ফেললাম।
.
শিব্ব আমাদের এগিয়ে দিল একটু। তারপর ছায়ামূর্তিরই মতো মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। অন্ধকারে দণ্ড আর আমি জঙ্গলের গভীরে ফিরে জানোয়ার-চলা পথটি ধরলাম।
ফিসফিস করে দণ্ডকে শুধোলাম, ওই ভুতুড়ে লোকটি কে হে?
ওর নাম শিব্ব। শুনলে তো!
তোমার কে হয়?
আমার ভাই।
ভাই? কখনও দেখিনি তো। কীরকম ভাই?
দেশের ভাই। মাটির ভাই। সবচেয়ে কাছের ভাই।
ওঃ। আমি বললাম।
আজকে একটা খুব বড় গল্ব মেরে দাও তো, ঋজুবাবু। কথা ঘুরিয়ে ও বলল।
বড় গল্ব তো গত সপ্তাহেই মেরেছি। খামোকা বাইসনের মতো অতবড় জানোয়ার মেরে কী হবে দণ্ড? আমাদের খেতে তো অত মাংস লাগবে না। তাছাড়া বাইসনের বা নীলগাইয়ের মাংস আমি তো খাই না। এ তো অন্যায়।
কিসের অন্যায়? দণ্ডধর ডাকুয়ার চোখ অন্ধকারে আবার বাঘের মতো দপ করে জ্বলে উঠল। ও বলল, জানো ঋজুবাবু এই শিব্ব মাংস খেয়েছিল গত বছরের আগের বছর যখন আমরা এখানে শিকারে এসে একটা বড় শম্বর মারি। তারপরে আর কোনওরকম মাংসই ও খায়নি। গত সপ্তাহে তোমার মারা গল্বর মাংস অবশ্য খেয়েছিল পেট পুরে। মাছ খেয়েছিল গত দু বছরে মাত্র তিন-চারদিন। ভীমধারার দহে কখনও-সখনও কুঁচো মাছ জমে। তাও দাবিদার অনেক। টিকরপাড়ার কনট্রাক্টর। খাইয়েছিলেন এখানকার গ্রামের সব্বাইকেই গত বছরে তাঁর জঙ্গলে খুব ভাল কাঠ বেরিয়েছিল বলে।
হেসে বললাম, মাছ-মাংস তো কত লোকেই খায় না।
দণ্ডধর দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তা খায় না বটে, কিন্তু তারা তো অন্য অনেক কিছু খায়। দুধ খায়, মাখন খায়, ঘি খায়, তরি-তরকারি, ফলমূল, ডাল-ভাত কত কী খায়!
শিব্ব কী খায়। শিব্বও তো এ-সব খায়। ঘি-মাখন না হয় নাই খেল!
শিব্ব? তাচ্ছিল্যের গলায় দণ্ড বলল। দিনে একবেলা, একহাঁড়ি খুদের মধ্যে জল আর আফিঙের একটু গুঁড়ো মিশিয়ে সেদ্ধ করে খেয়ে থাকে ও আর ওর বৌ। পেটের পিলেটা দেখলে না, পাঁচ-নম্বরি ফুটবলের মতো। আর বছরের জামা কাপড়? একটা পাঁচ টাকা দামের গামছা দু ভাগ করে কেটে গায়ে দেয় ও পরে শিব্ব। সারা বছর। একটা বারো টাকা দামের শাড়ি পরেই ওর বউ বারোটা মাস কাটিয়ে দেয়। করবে কী? ওদের সঙ্গে তুমি কাদের তুলনা করছ ঋজুবাবু?
আমি চুপ করে ছিলাম।
দণ্ড বলল, একটা গল্ব মারলে কতগুলো গ্রামের লোক মাংস খেতে পারে তার ধারণা তো তোমার আছে। নিজের চোখে দেখোনি? কত পাহাড়-নদী পেরিয়ে মেয়ে-পুরুষরা গত সপ্তাহে-মারা বাইসনটার মাংস নিতে এসেছিল? কত ঘন্টা তারা ধৈর্য ধরে বসেছিল।
কিন্তু আমার পারমিটে যে মোটে একটাই বাইসন ছিল। গত সপ্তাহে তা তো মেরেইছি দণ্ডধর। অন্যায় হবে না বনবিভাগের পারমিটের বাইরে শিকার করলে?
দণ্ডধর দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ আমার দুচোখের উপর পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা ফোকাস করল। যেন আমিই কোনও সাংঘাতিক শ্বাপদ। আলোর তোড়ে আমার চোখদুটো বুজে এল। তারপর ওর মুখটা আমার বাঁ কানের কাছে এনে ফিসফিস করে দণ্ড বলল, একটা বড় ন্যায়ের জন্যে পাঁচটা ছোট অন্যায় করার মধ্যে কোনওই পাপ নেই। এ-গ্রামের এবং অন্য অনেক গ্রামের লোককে সমানভাবে মাংস ভাগ করে দেব আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। তুমি দেখো। কত মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাবে তুমি! সে কি আনন্দের নয়? পুণ্যের নয়? সব পুণ্য বুঝি কেতাবি আইন মানারই মধ্যে?
এই অবধি বলেই, আমাকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই রাইফেলটা ধপ্পাস্ করে আমার কাঁধে ফেলে দিয়ে বলল, চলো। আজ নুনিতে বসে বড্ড গল্ব মারব আমরা।
জলের গভীরে বসে দন্ডধর ডাকুয়ার কথা অমান্য করার সাহস তখন কেন, কোনওসময়ই আমার ছিল না। তা ছাড়া, কতই বা বয়স তখন আমার। বড়জোর বাইশ-তেইশই হবে। কলেজ থেকেই পাইপ ধরেছিলাম। অন্য কিছুর জন্যে নয়, পয়সা খরচ প্রায় একেবারেই নেই বলে। দণ্ডধর জেঠুমণিকে পর্যন্ত ডোন্টকেয়ার করত আর আমি তো কোন ছার।
ফোর-সেভেন্টি রাইফেলটা কাঁধে ঠিক করে তুলে নিলাম। কেন, বুঝলাম বাংলোতে থ্রি-সিক্সটি-সিক্স ম্যানকিলার শুনার রাইফেলটা (আমার প্রিয় রাইফেল) থাকতেও ও ইচ্ছে করেই ফোর-সেভেন্টি ডাবল ব্যারেল রাইফেলটা নিয়ে এসেছিল। এটি অনেক বেশি শক্তিশালী রাইফেল। জেরি নাম্বার টু। মোক্ষম মার। বড় জানোয়ার মারতে এতেই সুবিধা।
আর কোনও কথা না বলে নুনিতে এসে পৌঁছলাম আমরা। আমাদের দেশের এবং অন্য অনেক দেশের জঙ্গলের গভীরেই এরকম কিছু জায়গা থাকে যেখানে মাটিতে নুন থাকে। জংলি তৃণভোজী জানোয়ারেরা সেই নুন চাটতে আসে। ছোট্ট হরিণ থেকে গণ্ডার সবাইই চাটে। ইংরিজিতে একেই বলে সল্ট-লিক। অনেক জায়গায় বনবিভাগ বস্তা বস্তা নুন ফেলেও কৃত্রিম নুনি বানান অথবা স্বাভাবিক নুনির এলাকা বাড়ান।
শিব্বর কথামতো নুনিতে পৌঁছে আমরা ঐ ঝাঁকড়া শিশুগাছের নীচেই আড়াল নিয়ে বসলাম ঝোপঝাড়ের পেছনে। নুনির উপরের আকাশ ফাঁকা। মাঝের ঘাস, শিশিরে ভিজে গেছে। কোনও বড় জানোয়ার জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে নুনিতে এসে দাঁড়ালে তাকে মারা কঠিন হবে না, আলো ছাড়াই। কিন্তু দণ্ড বলল, কোনওই চিন্তা নেই। আমি আলো দেব তোমার ডান কাঁধের উপর দিয়ে রাইফেলের ব্যারেলের উপরে, যাতে ব্যাক্সাইট ফ্রন্টসাইট দুইই দেখতে পাও। মারবে আর পড়ে যাবে। গুলি বাজ্জিবে কী প্রাণ যিব্বে। তারপর তোমাকে আর পায়ের ব্যথা নিয়ে হেঁটে যেতে হবে না। আমিই কাঁধে করে বাংলোতে নিয়ে যাব।
তুমি নিজেই কেন মারছ না দণ্ডধর? তুমি তো আমার চেয়ে হাজারগুণ ভাল শিকারি?
দণ্ড হাসল। বলল, তুমি ঋজুবাবু কত ক্ষমতাবান লোক; বড়লোক। জেঠুমণির ভাইপো। আইন-কানুন সব তোমাদের হাতে ভাঙলেই মানায় ভাল। তোমাকে কেউই কিছু বলবে না। কিন্তু যদি আকাশের তারারাও দেখে ফেলে যে এইসব গ্রামের লোকদের একদিনের জন্যে মাংস খাওয়াবার জন্যে, ইংরিজিতে তোমরা পোচিন্ কী বলো যেন; তাই করে নিজে হাতে একটি ঘড়িং বা গন্ধ মেরেছি আমি; নুয়াগড়ের ভিখারি ডাকুয়ার ছেলে এই সমান্য মানুষ দণ্ডধর ডাকুয়া, তাহলেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খাতায় আমার নাম উঠে যাবে। আমাকে, আমার ছেলেকে, এমনকী আমার নাতিকে পর্যন্ত অপরাধী থাকতে হবে তাদের কাছে। যুগযুগান্ত ধরে কান মুলতে হরে। নাকে খত দিতে হবে। তুমি আর আমি কি এক হলাম ঋজুবাবু? আইন তোমাদের কাছে তামাশা, আর আমাদের কাছে তা ফাঁসি।
তোমার বক্তৃতার চোটে তো কোনও জানোয়ার এদিকে আর আসবে বলে একটুও মনে হচ্ছে না দণ্ডধর।
এইই চুপ করলাম। ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে দণ্ডধর বলল। একটু পরই আবার রাতের জঙ্গলকে চমকে দিয়ে বলল, আসবে না তো যাবে কোথায়? আমি কি গুণ্ডিপান না-খেয়ে থাকতে পারি? গুড়াখু দিয়ে দাঁত না মেজে পারি?, তুমি পারো পাইপ না খেয়ে? নেশা বলে ব্যাপার। জানোয়ার নুনিতে আসতে বাধ্য। খুব বড় সাইজের একটা দেখেশুনে একেবারে মোক্ষম মার মারবে কিন্তু। অনেক মণ মাংস হয় যাতে। ফসকিয়ে যায় না যেন!
.
বসে আছি তো বসেই আছি। শিব্বর সেই কেলে নাড়তে কী ছিল কে জানে। কেমন ঘুম-ঘুম পাচ্ছে! হাত-পা অবশ-অবশ লাগছে। মনে হচ্ছে, আমার হাতদুটো বেহাত হয়ে গেছে।
ফিসফিস্ করে দণ্ডকে সে-কথা জিজ্ঞেস করলাম।
ও মাথা নেড়ে বলল, রাইফেলের গুলির চেয়েও মারাত্মক। আস্তে-আস্তে দেখবে এর ফল। সফট-নোজড় বুলেটের মতোই ক্রিয়া। হঁ!
ক্রিয়ার কথা শুনে পুলকিত হলাম। কিন্তু তারপর কর্মটা যে কী হবে, সেইটেই দেখার।
একদল চিতল হরিণ এল। নুন চাটল খসখসে জিভ দিয়ে খচর-খচর করে। চলে গেল। আমাদের পেছনে খানিকটা দূরে হাতির একটি ছোট দল চরে খাচ্ছিল। ডালপালা ভাঙার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। হাতিদের পেটে সবসময়েই যজ্ঞিবাড়ির উনুনের মতো কত কী সব রান্না হয়। নিস্তব্ধ জঙ্গলে। অনেকদূর থেকেই সেই ফোঁসফোঁস, ভুটুর-ভাটুর আওয়াজ শোনা যায়। ওরা বাঁশ ভাঙছে মটাস-মটাস করে। হাতিরা আছে। কিন্তু নীলগাই অথবা বাইসন কারও দলেরই দেখা নেই। নীলগাইকে ওরা বলে ঘড়িং। আর বাইসন বা ইন্ডিয়ান গাউরকে বলে গন্ধ। একদল শুয়োর, ধাড়ি-বাচ্চা, মদ্দা-মাদিতে ভরপুর, জোরে দৌড়ে পার হয়ে গেল নুনিটা। কিসের এত তাড়া ওদের কে জানে! ঘন্টা-দেড়েক বসে থাকার পর কেবলই মনে হতে লাগল অনেক জানোয়ারই যেন জঙ্গলের কিনারা অবধি আসছে কিন্তু নুনিতে নামছে না। বিভিন্ন জানোয়ারের পায়ের শব্দ পাচ্ছি স্পষ্ট পাথুরে জমিতে। তারপরই আওয়াজগুলো আশ্চর্যজনকভাবে মিলিয়ে যাচ্ছে। নুনির কিনারা অবধি আসার আওয়াজ পাচ্ছি। কিন্তু ফিরে যাওয়ার কোনও আওয়াজই কানে আসছে না। আশ্চর্য ব্যাপার! দণ্ডধরকে ফিসফিস করে শুধোলাম, এখানে তুমি আগে এসেছ কখনও?
নাঃ। সংক্ষিপ্ত জবাব দিল ও।
আমার মনে, কু-ডাক দিচ্ছিল। মনে হচ্ছে, জায়গাটায় আশ্চর্য সব ব্যাপার-স্যাপার ঘটে। তবে, ভয় করছিল না; কৌতূহল হচ্ছিল খুব। মাথাটাও খুব ভার-ভার মনে হচ্ছিল। এরকম কখনও আগে বোধ করিনি। অন্ধকারে চোখের সামনে ময়ূরের পালকের মতো রঙ দেখছিলাম ঝলঝলক। হঠাৎ খুব বড় একটা একলা-শিঙাল শম্বর ঘা-ঘাক করে ডাকতে ডাকতে প্রচণ্ড জোরে পুবদিক থেকে পশ্চিমে দৌড়ে নুনিটা পার হয়ে গেল। মুখ উঁচু করে ডালপালাওয়ালা প্রকাণ্ড শিংটাকে পিঠের উপর শুইয়ে পাথরের উপর পায়ের খুরে খটখটানি আওয়াজ তুলে। এবং তার সামান্য পরেই একটা বড় বাঘ নিঃশব্দে জঙ্গলের গভীর থেকে লাফ মারল। নুনিটার মাঝখানে লাফিয়ে পড়েই ঘাপটি মেরে বসে যেন ঝোপঝাড় ভেঙে শম্বরটার চলে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে লাগল দু-কান খাড়া করে। বাঘ কিন্তু সচরাচর এমন ফাঁকায় আসে না। সবসময়ই আড়ালে-আবডালে চলে ছায়ার মতো। জাত-শিকারি সে। আমাদের দিকে ব্রড-সাইড ছিল বাঘটির। আমার পারমিটের বাঘ এখনও মারা হয়নি। দণ্ডধরের সঙ্গে আমার যেন মনে-মনে কথা হল টেলিপ্যাথিতে। দণ্ডধর মুখে কথা না বলে আমার পিঠে খোঁচা দিল। মুহূর্তের মধ্যে রাইফেল তুললাম আমি। কিন্তু চোখ ঝাপসা। মগজ ফাঁকা। পায়ে দলদলি। হাত বেহাত।
আমার মাথার মধ্যে কে যেন বলল, এ একেবারেই ঠাকুরানির দান। এই বাঘ। দণ্ডধর আলো ফেলল সঙ্গে-সঙ্গে। দু চোখ খুলে বাঘের বুকে নিশানা নিয়ে গুলি করলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল। নুনির চতুর্দিক থেকে পাগলাঘন্টির মতো কিন্তু গৃহস্থ বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর সময় যেমন নিচুগ্রামে ঘন্টা বাজে তেমন, অনেক ঘণ্টা একসঙ্গে বেজে উঠল। অসংখ্য লোক হাত নেড়ে-নেড়ে যেন সেই ঘণ্টা বাজাচ্ছিল। সেই ঘণ্টার আওয়াজের সঙ্গে রাইফেলের গুলির আওয়াজ এবং বাঘের চাপা গর্জনের আওয়াজ মিশে গেল। কিছু বোঝার আগেই দেখলাম একলাফে বাঘ উধাও। তারপর যাকে সে একটু আগে শিকার করবে বলে তাড়া করেছে বলে মনে হয়েছিল সেই শম্বরের মতো সে-ও জঙ্গল ঝোপঝাড় লণ্ডভণ্ড করতে করতে উধাও হয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে ঘণ্টাধ্বনিও থেমে গেল। হঠাৎ গুলির শব্দে রাতের বনে যে-সব বাঁদর ও নানারকম পাখি চেঁচামেচি করে উঠেছিল, তারাও হঠাৎ থেমে গেল। অথচ, এমন হঠাৎ তারা থামে না কখনও।
দণ্ডধর আমার পিঠে আঙুল দিয়ে আবার খোঁচা মেরে উঠতে বলল।
ঠিক দশটার সময় বাঘটাকে গুলি করেছিলাম। দণ্ডধরকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। খণ্ডিয়া মানে জখম বাঘ যেদিকে গেছে তার বিপরীত দিকে ভীমধারার উঁচু মালভূমির দিকে আমরা এগোতে লাগলাম।
বেশ কিছুদূর এসে দণ্ডধর বলল, ঠিক দশটার সময় তুমি বাঘটাকে গুলি করেছিলে, তাই না?
হবে। ঘড়ি তো দেখিনি! কিন্তু ঘন্টাগুলো কী ব্যাপার?
দণ্ডধর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, কথা বোলো না। চুপ
আরও কিছুটা গিয়ে ও বলল, শিব্বকে কান ধরে পিটব আমি। এখানের ঠাকুরানি যে এমন জাগ্রত এ-কথা সে বলে তো দেবে! আমাদের প্রাণ চলে যেত একটু হলে। জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে চুল পাকালাম এমন আজব ব্যাপার কখনও দেখিনি বা শুনিনি। এখন দ্যাখো। এ যদি সত্যি বাঘ হয়, মায়ার বাঘ না হয় তবে কাল এই খণ্ডিয়া বাঘ আমাদের অশেষ কষ্ট দেবে। একে খুঁজে বের করে মারতে হবে। এভাবে তো আর ছেড়ে রেখে চলে যাওয়া যাবে না।
চলতে চলতে বললাম, মায়ার বাঘ মানে?
বাঃ! রামায়ণে মায়ামৃগের কথা পড়োনি! ঠাকুরানি পঞ্চাশ হাতে ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন আর মায়া বাঘ হাজির করতে পারেন না? আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল। আচ্ছা, নানা জানোয়ারের নুনিতে আসার শব্দ পেয়েছিলে তুমি?
বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু ফেরার কোনও আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। আশ্চর্য!
ঠিক! তখনই আমাদের ঐ নুনি ছেড়ে চলে আসা উচিত ছিল। আমি ভাবলাম, তোমাকে কোনওমতে রাজি করিয়েছি একটা বড় গল্ব মারতে, চলে গেলে, যদি কাল আবার তুমি মত পাল্টে ফেলো? আমার লোভেই এমন হল। এখন কাল কী আছে কপালে, তা ঠাকুরানিই জানেন।
ভীমধারার মালভূমিতে এদিক দিয়ে উঠতে হলে অত্যন্ত চড়াই বেয়ে উঠতে হয়। ঐ শীতেও আমরা ঘেমে গেলাম। উত্তেজনায় শরীরে ও মস্তিষ্কেও সাড় ফিরে এসেছিল। কিন্তু নিচ দিয়ে যাওয়ার সাহস ছিল না। গুলি-লাগা খণ্ডিয়া বাঘ কোথায় ওৎ পেতে বসে থাকবে কৃষ্ণপক্ষের রাতের নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে তা কে জানে! ওদিকে জঙ্গল অত্যন্ত ঘনও। এবং এখন গভীর রাত। তার উপরে দণ্ডধর বলেছে : ঠাকুরানির বাঘ!
ভীমধারার মালভূমির উপরে পৌঁছে একটু দম নিলাম আমরা। কুলকুল করে বয়ে চলেছে পরিষ্কার জল চ্যাটালো পাথরের বুক বেয়ে অনেক ধারায় ভাগ হয়ে সমান্তরাল রেখায়। কিছুটা গিয়েই আমাদের বাঁদিকে প্রপাত হয়ে পড়েছে। তারার আলোতে পরিষ্কার মালভূমিটিকে স্বর্গীয় বলে মনে হচ্ছে। আমরা জলের কাছে এসে রাইফেল, বন্দুক, টর্চ সব পাথরের উপর শুইয়ে রেখে আঁজলা ভরে জল খেলাম। দণ্ডধর আলোয়ানটাকেও নামিয়ে রাখল পাথরের উপরে। জল খেয়ে, মুখে, চোখে, ঘাড়ে, ঠাণ্ডা জল দিয়ে আমরা যখন উঠে দাঁড়িয়ে বন্দুক রাইফেল তুলে নেওয়ার জন্যে পেছনে ফিরেছি, দেখি আমাদের সম্পত্তিগুলো আর আমাদের মধ্যে আড়াল করে কালো পাহাড়ের মতো একটি এরা বাইসন দাঁড়িয়ে আছে। নিথর হয়ে। তার চোখ আমাদের দিকে।
আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছি দুজনেই। খালি হাত। এত বড় বাইসন এ-অঞ্চলেও কখনও দেখিনি। পুরুনাকোট-টুকার বাইসনদের নাম আছে সারা ভারতবর্ষে। কিন্তু তবু এ-অঞ্চলেও এত প্রাচীন বাইসন কখনও দেখিনি। তার গায়ের কালো রঙ বয়সের দরুণ যেন পেকে বাদামি হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে সাদা জায়গাটা, হাঁটু ও পায়ের কাছের সাদা জায়গাগুলো পরিষ্কার দেখাচ্ছে। নীলাভ দ্যুতি ছড়ানো তারাভরা কালো আকাশের পটভূমিতে নিথর হয়ে মহাকালের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। যেন, পাথরে গড়া মূর্তি।
হঠাৎই দণ্ডধর হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বিড়বিড় করে কী সব বলতে লাগল অস্ফুটে। আর আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। অত বড় বাইসনটা পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে এঙ্গে যে শব্দ হত তা বহুদূর থেকেই শোনা যেত। এইখানে অত বড় তৃণভোজী জানোয়ারের লুকিয়ে থাকার মতো কোনও আড়ালও ছিল না। মাংসাশী জানোয়ারেরা লুকোবার অনেক কায়দা জানে। কিন্তু এরা তা জানে না। এও কি ঠাকুরানিরই কারসাজি! এ এখানে কখনওই ছিল না আমরা যখন জল খেতে নামি ঝরনাতে। আমরা জল খেতে নামার পরেও আসা একেবারেই অসম্ভব ছিল।
দণ্ডধর কী সব বলেই চলল। আবারও হঠাৎ সববেত ঘন্টাধ্বনি হল জোরে জোরে। এ যেন কৃষ্ণপক্ষের ঘোরা রাত নয়, যেন কোজাগরী পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলোয় ঘরে ঘরে কমলাসনার পুজো হচ্ছে। পরক্ষণে হঠাৎই ঘণ্টা থেমে গেল। এবং এত বড় বাইসনটিও উধাও হয়ে গেল। চোখের নিমেষে।
দণ্ডধর মাটিতে থেবড়ে বসে পড়ল। ট্যাঁকের বটুয়া থেকে বের করে। একমুঠো গুণ্ডি ঢেলে পান সাজল একটা। পানটা মুখে পূরল। আমিও ওর পাশে বসে পাইপে ঠেসে তামাক পুরে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে মাথা পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে লাগলাম। পাগল-টাগল হয়ে যাব না তো? কী কুক্ষণে এবার এখানে এসেছিলাম! তাইই ভাবছিলাম।
বাংলোয় ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। কাল সকালের কথা ভাবতেই গায়ে জ্বর আসছিল। আহত বাঘকে অনুসরণ করে এর আগে অনেকবারই মেরেছি। এই সব মুহূর্তেই শিকারির স্নায়ু, সাহস, ধৈর্য আর অভিজ্ঞতার পরীক্ষা হয়। তাতে, সত্যিকারের শিকারির উত্তেজনাই বাড়ে। একরকমের আনন্দও হয়। যে আনন্দের কথা শুধু শিকারিরাই জানেন। কিন্তু ভয় করে না। শিকারের সমস্ত আনন্দ তার বিপদেরই মধ্যে। কিন্তু খণ্ডিয়া বাঘকে নিয়ে ঠাকুরানি যে কী খেলা খেলবেন তা তিনিই জানেন।
শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম, দণ্ডধর, ভীম, দুর্যোধন, ওরা সকলে মিলে ফিসফিস করে ঠাকুরানির নানারকম অলৌকিক কীর্তিকলাপের কথা আলোচনা করছে। তারপরই দুর্যোধন খালি গলায় রাতের জঙ্গল মথিত করে উদাত্ত স্বরে আবেগভরে গান ধরল :
দয়া করো দীনবন্ধু, শুনে যাউ আজদিন
করজোড়ে তুম পাদে করছি মু নিবেদন
সত্য শান্তি প্রদায়ক, দুষ্ট দণ্ড বিধায়ক
রুকমিনী প্রাণনায়েক প্রভু পতিতপাবন।
অনাদি অনন্ত হরি নৃসিংহ মুরতি ধরি
হিরণ্য দৈত্যকু মারি বুক কৈল বিদারণ।
দোয়াপর যুগরে হরি গুপ্তে বরি গুপপুরী
দুষ্ট কংসকু নিবারি রজা কল উগ্রসেন
ভারতভূমি মধ্যরে সুদর্শন ধরি করে
পাণ্ডবংক ছলে হরি, কৌরবে কল দহন
কলি যুগে জগরনাথ বিজে চক্ৰহস্ত
সাধিয়ে পউঠি অন্ন আপে করুছ ভবন
তুমে এ সংসারে সার, আভি সব মায়া ঘর
কুতাংত ডর উঠরো কহে দীন জনহীন।
দুর্যোধনের গলার সুন্দর ভক্তিকম্পিত জগন্নাথ-বন্দনার গান শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল চেঁচামেচিতে। বাইরে এসে দেখি অনেক মেয়ে-পুরুষ জমা হয়েছে বাংলোর সামনে। তারা সমস্বরে অনুযোগ করছে, তম্বে এট্টা কঁড় করিলু বাবু? সে বড় বাঘটাকু খণ্ডিয়া করিকি ছাড়ি দেলু? আম্মেমানে ঝাড়া দেইবাকু যাউ পারি নান্তি। কঁড় হব্ব এব্বে?
মানে, তুমি এটা কী করলে বাবু? বড় বাঘটাকে আহত করে ছেড়ে রাখলে? আমরা জঙ্গলে প্রাতঃকৃত্য পর্যন্ত করতে যেতে পারছি না। কী হবে এবারে?
দেখলাম, দণ্ডধর তাদের শান্ত করে বলল, এক্ষুনি হাঁকা করব আমরা। খণ্ডিয়া বাঘকে মেরে তবেই মুখে জলদানা দেব। বাঘটা কোথায় আছে যারা দেখেছে তারা চলো আমাদের সঙ্গে। মেয়েরা আর ছোটরা বাদে।
এমন সময় দেখা গেল, গামছা-পরা একটা হাড়সাল নোক আসছে গেট পেরিয়ে। দণ্ডধর ভাল করে দেখে বলল, আরে, শিব্ব না?
কাল রাতের অন্ধকারেই তাকে দেখেছিলাম। দিনের আলোয় আমার চেনার কথা নয়। তার পেছনে পেছনে কঙ্কালসার একটি নারীমূর্তিকেও আসতে দেখলাম।
শিব্ব কাছে এলে, তাকে পাশে ডেকে দণ্ডধর কী সব জিজ্ঞেস করল। দণ্ডধরকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
শিব্ব বলল, সেও যাবে হাঁকা করতে। খণ্ডিয়া বাঘ যদি মারা পড়ে, তাহলে গল্বর মাংসর বদলে বাঘের মাংসই খাবে। বাঘের মাংস তো কী, তাই-ই সই। মাংস তো!
ভাবছিলাম, বাঘের মাংস চিবোনোই যায় না। রবারে কামড় দিলে দাঁত যেমন লাফিয়ে ওঠে তেমন করেই লাফিয়ে ওঠে দাঁতের পাটিও। বাঘের তলপেটের কাছে যতটুকু চর্বি থাকে তা তো লোকে বাঘের চামড়া ছাড়ানো হলে কাড়াকাড়ি করেই নিয়ে নেয় ওষুধ বানাবার জন্যে। শিব্ব তার এই জিরজিরে চোয়াল আর আফিংয়ে গুঁড়ো আর কন্দসেদ্ধ খাওয়া পেট নিয়েও বাঘ খাবার আশা রাখে দেখে তাজ্জব হয়ে গেলাম।
আধঘণ্টার মধ্যেই কেরোসিনের টিন, শিঙে, ঢোল, করতাল এবং টাঙ্গি ও তীর-ধনুক নিয়ে প্রায় জনা-পঞ্চাশেক লোক জমে গেল। কিন্তু অধিক সন্ন্যাসিতে গাজন নষ্ট হওয়ার ভয়। একথা দণ্ডধরকে বলতেই সে বেছে-বেছে জনাকুড়ি লোককে সঙ্গে নিল। বাকি যারা, তারা তাদের বউ শালিদের সামনে রিজেটেড হওয়াতে প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করল মনে হল।
দণ্ডধরকে শটগানটা দিয়েছি। ডান ব্যারেলে লেথাল বল এবং বাঁ ব্যারেলে স্ফেরিক্যাল বপুরে। আরও চারটে গুলি নিয়েছে সে শার্টের পকেটে। আমি নিয়েছি ফোর-সেভেন্টি-ফাইভ ডাবল-ব্যারেল। সফট-নোজড গুলি নিয়েছি চারটি সঙ্গে।
এখন কথাবার্তা কম। প্রায় নিঃশব্দে সিঙ্গল ফরমেশানে এগিয়ে গিয়ে ভীমধারার নদী পেরিয়ে নদীটা যেখানে অন্য একটা-নালা হয়ে সরে গেছে গ্রামের দিকে, সেখানে এসে দণ্ডধর অবস্থাটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল। বাঘের পায়ের দাগ এবং নদীর পাশের সঁড়িপথের কোনও-কোনও জায়গায় শুকিয়ে-যাওয়া রক্তের দাগও পাওয়া গেল। তারপর ওদের সঙ্গে ফিসফিস করে পরামর্শ করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল দণ্ডধর। বুঝলাম, বিটাররা নালার মধ্যে নামবে দুপাশের পাড়ের জঙ্গলে জঙ্গলে গিয়ে। তারপর পেছন থেকে হাঁকা করবে যাতে বাঘটা তাড়া খেয়ে এদিকে আসে।
বসার মতো তেমন ভাল জায়গা নেই এদিকে। দণ্ডধর আমাকে একটা জায়গায় আড়াল করা কালো বড় পাথর দেখিয়ে নিজে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে একটা পিয়াশাল গাছে উঠে গেল তরতর করে কাঠবিড়ালির মতো। ততক্ষণে বিটাররা আমাদের ফেলে দু ভাগে ভাগ হয়ে চলে গেছে নালার ওদিকের পাড়ে-পাড়ে হেঁটে।
সময় এতই অল্প যে ব্যাপারটা যে কী দাঁড়াবে বুঝতে পারছিলাম না। কথা ছিল, ভীম প্রথমে শিঙা বাজিয়ে সকলকে হাঁকা শুরু করার সঙ্কেত দেবে। ভীম আছে বাঁ-দিকের পাড়ে-পাড়ে যে-দলটি গেছে-তাদেরই মঙ্গে। পাথরে বসে সামনে থেকে আগাছার বেড়া হাত দিয়ে ফাঁক করে দেখে নিলাম নালা দিয়ে বাঘ যদি দৌড়ে যায় তাহলে তাকে মারা যাবে কি না? মনে হল, যাবে। তবে বাঘের সঙ্গে আমার তফাত থাকবে মাত্র হাত পাঁচেকের। উপায় নেই। তা ছাড়া দিনের বেলায় হাতে এই মাত্র রাইফেলের দু ব্যারেলে দুটি সফ্ট-নোজন্ড গুলি থাকলে এবং ঠাকুরানির ঘণ্টা আবারও না বাজলে, খণ্ডিয়া বাবাজিকে খণ্ডিত হতেই হবে।
যাতে নালার মধ্যেটা আর একটু ভাল করে দেখতে পারি, তার জন্য পাথরটার আরও একটু পেছনে উঠে এলাম। পেছনেই একটা গুহমতো। তার মধ্যে থেকে বাড়দের গায়ের বোঁটকা গন্ধ আসছে। শীতের সকাল, তখনও গাছ-পাতা বালি-পাহাড়ে শিশিরে ভেজা। তুলোর মতো শিশির-পড়া মাকড়সার জালে আর বুনো নাম-না-জানা ফুলের উপর সকালের রোদ পড়াতে হাজার হাজার হিরে ঝলমলিয়ে উঠছে। যে একবার এই হিরের খনির খোঁজ পেয়েছে সে আর কলকাতার সাতরান্দাস ধালাম, পি সি চন্দ্র বা বম্বের জাভরি ব্রাদার্সের হিরে ছুঁয়েও দেখবে না।
টুঁই পাখি ডাকছে পেছন থেকে। দূর থেকে বড়কি ধনেশের ডাক আসছে অস্পষ্ট। এক ঝাঁক টিয়া সকালের রোদ-ঠিকরানো জঙ্গলের সবুজকে টুকরো করে লাল ঠোঁটে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঝকঝকে নীল-নির্জন আকাশে।
বড় শান্তি এখন এইখানে।
হঠাৎ ভীমের শিঙা বেজে উঠল। আরম্ভ হল হাঁকাওয়ালাদের চিৎকার। কেরোসিন-টিন পেটানোর আওয়াজ। হাততালি। অদৃশ্য এবং বাস্তব ও কল্পিত সমস্ত শত্রুদের প্রতিই সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য সবরকম গালাগালি। আওয়াজটা এগিয়ে আসছে। গাছে-গাছে টাঙ্গির মাথা দিয়ে বাড়ি.মেরেও ওরা আওয়াজ করছে।
এমন সব সময়েই রক্ত শিরায় শিরায় একটু জোরেই ছোটাছুটি করতে থাকে। হাতের পাতা ঘামতে থাকে। ছেলেবেলায় এই উত্তেজনা আরও অনেক বেশি হত। যত দিন যাচ্ছে, ততই একে কিছুটা কায়দা করতে পারছি বলে মনে হচ্ছে। বিটাররা যে-গতিতে এগোচ্ছে, সেই গতিতে এগিয়ে এলে এবং হাঁকা পূর্ব-পরিকল্পনামতো হলে বড়জোর দশমিনিটের মধ্যেই আমার সামনের নালা দিয়ে বাঘের যাওয়া উচিত। কাল রাতের গুলিটা খুবসম্ভব ডান পায়ে লেগেছে। এবং পায়ের নীচের দিকে, মানে হাঁটুর আর থাবার মধ্যে। শিব্ব যে নাড়ু খাইয়েছিল তা সাধারণ নাড়ু নিশ্চয়ই নয়। অসাধারণও নয়। সে-নাড়ুর নাম দেওয়া উচিত জ্ঞানহরণ। কালো দেখতে এবং মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ। খাওয়ার পর থেকেই খুব পিপাসা পাচ্ছিল আমার। দণ্ড বলেছিল যে বাংলোতে ফিরে দুধ খেতে হবে আমাদের। ওকে মনে করিয়ে দিতে। কী ব্যাপার তখন বুঝিনি। কিন্তু বাঘটার উপর যখন দণ্ড রাতে টর্চের আলো ফেলেছিল, তখন একটা বাঘ নয়, অনেকগুলো বাঘ দেখেছিলাম আমি। নুনিময়ই বাঘ। ছোট বাঘ, বড় বাঘ, মেজো বাঘ, সেজো বাঘ, বাঘে বাঘে বাঘারি! গুলি যে কোন্ বাঘকে করেছিলাম এবং কোন্ বাঘে লেগেছিল তা বুঝিনি।
আজ সকালে ঘুম ভাঙতে চাইছিল না। রাতে নানারকম স্বপ্নও দেখেছিলাম। দেখি একজন তাঁতি শান্তিপুরের সেই কাঁচা রাস্তাটার পাশে বসে লাল-নীল সবুজ সুতো দিয়ে কোনও সুন্দরীর জন্য যেন দারুণ আঁচলের আর পাড়ের এক শাড়ি বুনছে। এখনও ঘুম লেগে আছে আমার চোখে। টুকটুকে বউয়ের জন্যে যেন দারুণ আঁচলের আর পাড়ের এক শাড়ি বুনছে। এখনও ঘুম লেগে আছে আমার চোখে। হাঁকা শেষ হলে আজকে দণ্ডধর আর শিব্বকে এ নিয়ে ভাল করে জেরা করতে হবে। কেন এবং কী জিনিস খাইয়েছিল ওরা আমাকে। একটু হলে আমার প্রাণ নিয়েই টানাটানি হত। বাঘের সঙ্গে ইয়ার্কি!
এমন সময় হঠাৎই বাঘের গর্জন শোনা গেল। সর্বনাশ। বাঘ বিটারদের লাইন ভেঙে ফিরে যাচ্ছে বলে মনে হল সকলের ভয়ার্ত চিৎকারে। ওদের সঙ্গে ভীম আর দুর্যোধন আছে। ভীমের হাতে আমার শটগানটাও আছে; বদলে থ্রি-সিক্সটি-সিক্স রাইফেলটা নিয়েছে দণ্ড। দুর্যোধনের হাতেও আছে একটি সিঙ্গল ব্যারেল লাইসেন্সবিহীন মাজল-লোডার।
কয়েক সেকেন্ড পরেই শটগানের একটি গুলির পরেই আওয়াজ হল। বাঘের ঘন ঘন গর্জনে এবারে গাছপালা সব পড়ে যাবে মনে হল পাহাড় থেকে খসে। সঙ্গে-সঙ্গে হাঁকাওয়ালাদেরও সমবেত ভয়ার্ত চিৎকার, দণ্ড রে! এ দণ্ডধর! ডাকুয়াবাবু! ঋজুবাবু! কাম্ব সারিলা! সে খণ্ডিয়াটা তাংকু মারি দেলে! শিব্বকু! সে কি আউ বাঁচিছি? গল্লা রে, গল্লা।
আমি নালা ধরে দৌড়তে লাগলাম ঊর্ধ্বশ্বাসে। দণ্ডও তরতরিয়ে পিয়াশাল গাছ থেকে নেমে এসে আমার সঙ্গে দৌড়ল। ঘটনার জায়গাতে পৌঁছে দেখি, নালার বালি আর পায়ের পাতা-ভেজা জলে শিব্ব পড়ে আছে। টাটকা রক্তের ঝিরঝিরে স্রোতে ভিজে যাচ্ছে বালি আর জল। ওর ঘাড় আর মাথাটাকে বাঘটা ডাঁশাপেয়ারার মতোই চিবিয়ে দিয়ে চলে গেছে। শিব্বর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল দণ্ড। দেখেই, ছেড়ে দিল।
আমার এত অপরাধী লাগল নিজেকে! কাল যদি বাঘটার বে-জায়গায় গুলি করে তাকে খণ্ডিয়া না করতাম তবে তো এমন হত না। এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমারই একার। মানুষ খুন করারই মতো অপরাধ এ। আমি আর কোনও কথা না বলে হাঁকাওয়ালারা বাঘ যেদিকে লাফিয়ে চলে গেছে বলল, সেইদিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম।
দেখলাম, নালার পাড়টা দুলাফে পেরিয়ে গেছে বাঘটা। রক্ত বেশি পড়েছে। এখানে। প্রথম থেকেই বালিতে পায়ের দাগ দেখে এবং ঘাসপাতায় রক্ত যেখানে যেখানে লেগেছে সেই সব জায়গার উচ্চতা দেখে গুলির চোটটা কোথায় হতে পারে তা অনুমান করেছিলাম। পায়ের থাবার দাগ অবিকৃতই ছিল, কিন্তু ডানপায়ের সামনের থাবার দাগটা অন্য পায়ের থাবার তুলনায় ছিল অস্পষ্ট। এটা বাঘ নয়, সব ঠাকুদার ঠাকুর্দা। তাছাড়া শিব্বকে যখন ধরে বাঘটা তখন বিটারের মধ্যে অনেকে এবং একজন গাছে-বসা স্টপারও বাঘটাকে চোখে দেখেছিল। তারা সকলেই বলছিল যে ডান পায়ের হাঁটু একদম ভেঙে গেছে। ফুলেও গেছে পা-টা।
নালাটা খুব সাবধানে পেরোলাম। এখানে হরজাই জঙ্গল। কুচিলা, বেল, অর্জুন, করম, পালধুয়া, হাড়কঙ্কালি, পুটকাসিয়ার লতা। না-নউরিয়া এবং আরও নানারকম ঝোপ-ঝাড়। একটা পাথরের স্তূপের পাশ দিয়ে বাঘটা জঙ্গলে ঢুকে গেছে রাইফেলের ব্রিচ খুলে গুলি দুটোকে আর একবার দেখে নিলাম। পাপটা আমার। সুতরাং প্রায়শ্চিত্তও একা আমাকেই করতে হবে।
আহত বাঘকে অনুসরণ করে মারার মধ্যে যে বিপদের আশঙ্কা এবং উত্তেজনা থাকে তাই-ই শিকারিদের গর্বিত করে তোলে। যে-সব প্রাণী-দরদী সমস্ত শিকারকেই একধরনের নীচ স্পোর্টস বলে মনে করেন, তাঁদের বোধহয় ঠিক ধারণা নেই যে শিকার ব্যাপারটা সকলের জন্যে নয়। এবং শিকারিও নানারকমের হয়ে থাকেন। আইন মেনে বিপজ্জনক জানোয়ার শিকার করার মধ্যে কোনও লজ্জা আছে বলে কখনও মনে হয়নি। বরং শিকার, একজন শিকারিকে হয়তো মানুষ হিসেবেও অনেক বড় করে। দেশকে চেনায়, দেশের সাধারণ মানুষদের সম্পর্কে জানবার সুযোগ দেয়, তাদের প্রতি দরদী করে তোলে, যা খুব কমসংখ্যক শহুরে লোকের পক্ষেই সম্ভব। যে-সময়ের কথা বলছি সে সময়ে শিকার করার মধ্যে কোনও অন্যায়বোধও ছিল না। জানোয়ার প্রচুর ছিল এবং চুরি করে শিকার করতাম না আমরা।
অনেকেরই ধারণা যে মাচায় বসে বা হাঁকোয়াতে একটি বাঘ মেরে দেওয়া। বোধহয় খুবই সোজা। কিন্তু যাঁরা জানেন, তাঁরাই জানেন যে, There are many a slips between the cup and the lips. এবং এই কথাটা শিকারের বেলা কতখানি প্রযোজ্য। একজন শিকারি যেভাবে ব্যর্থতাই হল সাফল্যের সিঁড়ি এই কথাটি হৃদয়ঙ্গম করেন এবং নিজের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারেন তা বোধহয় অন্য ধরনের খুব কম খেলোয়াড়ের পক্ষেই সম্ভব।
আজকে কিন্তু মনটা খুবই দুর্বল লাগছে। ভয়ও লাগছে ভীষণ। বাঘ যে কত ক্ষমতাবান, তার গলার স্বরে যে পৃথিবী সত্যিই কাঁপে, তার সামনের দুটি পায়ে যে সে কতখানি বল রাখে, তা যারা জানে, বাঘকে ভয় না করে তাদের কোনও উপায়ই নেই। শিব্বর রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন ঘাড়, মুখ আর মাথাটা মনে পড়ছিল, আর আমার নিজের মাথা তখনও ঘুরছিল। কিন্তু এখন মাথা ঠিক না রাখতে পারলে আমার মাথার অবস্থাও শিব্বর মতোই হবে।
পাথরের স্তূপটার আড়ালে বাঘটার পক্ষে লুকিয়ে থাকা খুবই সম্ভব। তাই, যেদিক দিয়ে বাঘটা সেদিকে গেছে, সে-দিক দিয়ে না এগিয়ে, অনেক ঘুরে বাঁ-দিক দিয়ে এগোলাম এক-পা এক-পা করে। নিঃশব্দে। সেই মুহূর্তে ডান পায়ের অবস্থার কথা একেবারেই ভুলে গেলাম। যা-পরে রাতে শুয়েছিলাম তাই পরেই চলে এসেছিলাম আমরা। পায়ে রবারের হাওয়াই চটি। নিঃশব্দে চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। তবে, গোড়ালি আর পায়ের পাতায় কাঁটা ও ঘাসের খোঁচা লাগছিল! আস্তে-আস্তে বড় গাছের আড়াল নিয়ে নিয়ে অনেকখানি এগিয়ে এলাম বাঁদিকে।
জমিটা ওখানে পৌঁছে নরম চড়াই হয়ে একটি টিলার দিকে উঠে গেছে। আরও একটু এগিয়ে গেলাম টিলার দিকে। যাতে সেখানে পৌঁছে ঐ কালো পাথরের ভ্রুপের পেছনটা পরিষ্কার দেখতে পাই। বাঁ-দিকে একটি ময়ূর ও চারটি ময়ূরী চরছিল। ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। তবু, খুবই ঘাবড়ে গেলাম। ময়ূররা যেমন বাঘ দেখলে কেঁয়া কেঁয়া করে ডেকে ভয় পেয়ে উড়ে গাছে গিয়ে বসে, জঙ্গলের গভীরে কাছাকাছি মানুষ দেখলে তাই-ই করে। ওরা আমাকে দেখতে পেলেই ওদের আওয়াজে বাঘ বুঝতে পারবে। বনের রাজার কাছে। বনের কোনও খবরই গোপন থাকে না।
ভাগ্য ভাল। ময়ূরগুলো আমাকে অনেকক্ষণ পর্যন্ত লক্ষই করল না। করল, কারণ এদিকে তারা মুখই ফেরাল না। যারা সাপ ধরে খায়, তাদের চোখ ভীষণই তীক্ষ্ণ। এদিকে মুখ ফেরালেই ওরা দেখতে পেত আমাকে। কিন্তু না-ফিরিয়ে পেখম ছড়িয়ে চরতে-চরতেই ওরা নালার দিকে নেমে গেল। নালা তখন শান্ত। আমাদের দলের অন্য সকলেই ততক্ষণে হতভাগা শিব্বর প্রাণহীন শরীরটি নিয়ে টুকা গ্রামের দিকে চলে গেছে। বোধহয় দণ্ডধরেরই নির্দেশে। দণ্ডও হয়তো গেছে ওদের সঙ্গে।
একটি সুবিধামতো জায়গাতে পৌঁছে বড় একটি অর্জুন গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিলাম। ফোর-সেভেন্টি ডাবল-ব্যারেল রাইফেলটির ব্যালান্স চমৎকার। বইতে একটুও কষ্ট হয় না। তবুও ভীত এবং উত্তেজিত অবস্থায় তাকেও খুব ভারী বলে মনে হচ্ছিল।
জখম ডান-পায়ের তলাটাও দপদপ্ করছিল দাঁড়িয়ে পড়লেই। আমারই এই হচ্ছে, তাহলে না-জানি খণ্ডিয়া বাঘটার কতই কষ্ট হচ্ছে রাইফেলের গুলিতে ভাঙা পায়ের জন্য। যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত হয় ততই ভাল।
নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিকে খুব আস্তে-আস্তে মাথা ঘোরাতে লাগলাম। নাঃ, কোথাও কোনও চিহ্ন নেই বাঘের। খুব সম্ভব সে কোনও নিভৃত জায়গার খৈাঁজে গেছে। কিন্তু, যেখানেই যাক তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত! ফোর-সেভেন্টি রাইফেলের গুলিতে পা ভেঙে গেলে বাঘের পক্ষে বাঁচা মুশকিল। মরার আগে আরও অনেক মানুষ মেরে এবং বড় যন্ত্রণার মধ্যে গড়াগড়ি দিয়ে তিল তিল করে তাকে মরতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। তা ছাড়া কোনও জন্তুকেই এমন কষ্ট দেওয়ার অধিকার কোনও শিকারির নেই।
শিব্বর উপর খুবই রাগ হচ্ছিল আমার। দণ্ডর উপরেও। কী যে নাড় খাওয়াল কাল রাতে! ঐ নাড় না-খেলে এমনভাবে গুলিও করতাম না এবং গুলি হয়তো অমন বে-জায়গাতেও লাগত না। শিব্বকে হয়তো মরতে হত না এমন করে। বাঘটার আঘাত এমন মারাত্মক মোটেই হয়নি যে, সে একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। ভাবলাম, এখানে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে বরং জঙ্গলের কী বলার আছে তা শোনা যাক। জঙ্গলের পাখি আর জানোয়াররাই বলে বাঘের গতিবিধির কথা। কিন্তু যেহেতু তার চলচ্ছক্তি পুরোপুরিই আছে তাই অল্প সময়ের মধ্যে সে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অবশ্য, নাও যেতে পারে। কারণ, দণ্ডধর বলছিল এই জঙ্গলেই ওই বাঘের বাড়ি। তাই নুনিতে গুলি খেয়ে সে এখানেই ফিরে এসেছে।
বাঘটা গুলি খেয়ে অন্য জঙ্গলে গেলেও আমাদের তাকে খুঁজে বের করতেই হত। সে যদি বাংলোর কাছের জঙ্গলে না আসত তবে নুনিতে ফিরে গিয়ে আজ সকালে তার খোঁজ শুরু করতেই হত। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমাদের কষ্ট কমই হচ্ছে। সবই হত যদি না শিব্ব…
শিব্বর রক্তাক্ত শরীরটার ছবি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। গা গুলিয়ে উঠছিল আমার। মাঝে-মাঝে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল দৌড়ে বন বাংলোর নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাই। বাঘটাঘ মারা আমার কর্ম নয়। এই খণ্ডিয়া বাঘ নিশ্চয়ই যমের দূত। পুরো ব্যাপারটাই কাল রাত থেকে একটা দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসে আছে মনে। শরীরও আদৌ সুস্থ নেই।
দণ্ডধরই বা গেল কোথায়? আমার চেয়ে ওর অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। সাহসও বেশি। এই সময়ে, এই জঙ্গলে, ও আমার পাশে থাকলে অনেক বেশি জোর পেতাম।
অর্জুন গাছটার নীচে বসে পড়লাম আমি। পাইপটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করলাম। লাইটারটা বাংলোর ঘরের টেলেই পড়ে আছে। তাড়াতাড়িতে আনা হয়নি। একজন হাঁকাওয়ালার দেশলাই চেয়ে নিয়েছিলাম।
গভীর জঙ্গলে একটি দেশলাইকাঠি জ্বাললেও অঅঅঅনেকই শব্দ হয়। এবং সবচেয়ে বড় কথা সেই শব্দ বনের স্বাভাবিক শব্দ নয়। হালকা-বেগুনি খদ্দরের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরে ছিলাম। আসা উচিত হয়নি এমন করে। এই পোশাকে ক্যামোফ্লেজ করা যায় না, তা ছাড়া সারাদিনই হয়তো এই বাঘের পেছনেই ঘুরতে হবে আমাকে আজ। কে জানে!
রাইফেলটা আড়াআড়ি করে দুপায়ের উপরে রেখে পাইপটা ধরালাম, দেশলাই জ্বেলে। বাঘ যেখানেই থাকুক সে আমার খুব কাছে নেই। শব্দ শুনে সে যদি তেড়ে আসে তাহলে তো ভালই। গুলি করার সুযোগ পাব। সে আসতে আসতে রাইফেল তুলে নিতে যে পারব, সে-বিশ্বাস আমার ছিল। চোখ সামনে সজাগ রেখে, দেশলাইটা জ্বেলে পাইপ ধরালাম। নাঃ। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই।
একজোড়া বেনেবউ বসে ছিল ঐ পাথরের স্কুপের ওপাশের একটি বুনো জামগাছের ডালে। তারা দুজনে হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে ডানা ফরফর করে উড়ে গেল উল্টোদিকে। চমকে উঠে জ্বলন্ত পাইপ পকেটে পুরে ফেলে রাইফেলের স্মল অব দ্য বাট-এ হাত ছোঁয়ালাম।
আবার সব চুপচাপ। আমার পেছনের ছায়াচ্ছন্ন গভীর জঙ্গল থেকে সমানে একটি কপারস্মিথ পাখি ডেকে যাচ্ছি। আর তার সঙ্গী সাড়া দিচ্ছিল অনেক দূর থেকে। দিনের বেলায় এদের ডাক জঙ্গলের নানারকম শব্দের মধ্যে অন্যরকম শোনায়। আশ্চর্য এক গা-ছমছমে ভাব আছে এই পাখির ডাকে।
এবার একঝাঁক টিয়া উড়ে এসে বসল ঐ পাথরের স্তূপেরই কাছের একটি গাছে। কিন্তু বসেই সঙ্গে সঙ্গে আবার ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ করে উড়ে গেল।
এবারে আমার সন্দেহ হল। উঠে দাঁড়ালাম। এবং খুব সাবধানে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম এক গাছের আড়াল থেকে অন্য গাছের আড়াল নিয়ে। স্তূপটার কাছাকাছি এসে রাইফেল রেডি পজিশনে ধরে খুব সাবধানে এগিয়ে যেতেই দেখলাম বাঘটার পেছনের একটি পায়ের সামান্য অংশ আর লেজ মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে ঝাঁটি-জঙ্গলের মধ্যে।
দেরি হয়ে গেছিল। ভালভাবে নিশানা না নিয়ে আহত বাঘকে আবারও বে-জায়গায় গুলি করার কোনও ইচ্ছাই ছিল না আমার।
বাঘটা নালাতেই নেমে গেল আবার। নালার দিকে সরে এসে দাঁড়াব কি না ভাবছি এমন সময় আমার ঠিক পেছনে শুকনো পাতা-মাড়ানো আওয়াজে চমকে উঠে পিছন ফিরলাম। দেখি, দণ্ড। নীল লুঙ্গি দুভাঁজ করে কোমরে গোটানো। গায়ে সেই হলুদ শার্ট। খালি পা। হাতে থ্রি সিক্সটি-সিক্স রাইফেলটি। নীল লুঙ্গির গায়ে ছোপ-ছোপ লাল রক্ত লেগে আছে। শিব্বর রক্ত।
দণ্ড আমার দিকে চেয়ে চোখ দিয়ে শুধোল, কোনদিকে?
কথা না বলে আঙুল দিয়ে ওকে দেখালাম। ইশারায় বোঝালাম যে বাঘ আবার নালায় নেমে যাচ্ছে ঝাঁটি-জঙ্গলের আড়াল নিয়ে। মতলবটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
দণ্ড ইশারাতে বলল যে এবার বাঘের পেছন পেছন যাব আমরা। দুজন আছি। বাঘকে এবার আমাদের দিকে চার্জ করে আসতে প্ররোচনা দেওয়াই ভাল হবে। তার চেহারা দেখামাত্র দুজনে একসঙ্গে গুলি করব। এখন আর ব্যাপারটা স্পোর্টসের পর্যায়ে নেই। তার যন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া যেমন দরকার শিব্বর মৃত্যুর বদলা নেওয়াও তেমনই দরকার। যদিও সে খণ্ডিয়া না হলে শিব্বকে আদৌ মারত না। দোষটা পুরোপুরিই আমার।
অন্যায় আমরা অনেকেই করি। জীবনে সবসময় ন্যায়ই করছেন এমন ভাব দেখান যাঁরা তাঁরা ঘোরতর ভণ্ড। মানুষ মাত্রই দোষগুণে ভরা। অন্যায় সকলেই করে। কেউ জেনে কেউ না-জেনে। যে ভাবেই করুন না কেন, অন্যায় যে আমরা করেছি, সেটা স্বীকার যদি করি, তাহলে বোধহয় দোষের অনেকখানিই লাঘব হয়ে যায়।
আমিই আগে আগে চললাম। কারণ আমার হাতেই হেভি রাইফেল। কিন্তু দণ্ডর অভিজ্ঞতা, সাহস ও বাঘ সম্বন্ধে জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশি। ঝাঁটি-জঙ্গলে একটু গিয়েই বাঘ নালায় নেমেছে এক লাফে। বোধহয় অসমান পাথুরে জঙ্গলের চেয়ে নালার সমান নরম বালিতে ভাঙা-পা নিয়ে হাঁটতে তার সুবিধে হবে ভেবেই সে নালায় নেমেছিল।
গত সপ্তাহে এ-দিকেই শুয়োর মারতে এসেছিলাম। নালার এই অংশটা অজানা ছিল না। আরও একটু আগে গিয়ে নালার মধ্যে একটু দহর মতো আছে। জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন। দু পাশ দিয়ে ঘন জঙ্গলে ঝুঁকে পড়ে চাঁদোয়ার মতো সৃষ্টি হয়েছে নালার উপরে সেখানে। দহতে জল আছে সামান্য।
নালায় নামতেই রক্তের দাগের সঙ্গে বাঘের পায়ের দাগও আবার পেলাম। লাফিয়ে নামতে বেচারার কষ্ট যেমন হয়েছে তেমনি রক্তও পড়েছে অনেকখানি। ওকে হাঁটাচলা করতে না হলে রক্ত-পড়াটা অন্তত এতক্ষণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বনের এই জানোয়ারদের জীবনীশক্তি এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতে সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য।
কিছুটা গিয়েই নালাটা হঠাৎ একটা বাঁক নিয়েছে বাঁ-দিকে। এবং সেখানে নালার বুকে অনেক বড় বড় পাথর জড়ো হয়ে আছে। গত বর্ষায় কী তারও আগের বর্ষায় বানের তোড়ে ভেসে এসেছিল হয়তো। আহত বাঘের পক্ষে ঐ সব পাথরের যে-কোনও একটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আদৌ অসম্ভব নয়। নালার বাঁকটার মুখ থেকে যাতে বেঁকে-যাওয়া নালাটা পুরোপুরি দেখতে পাই, সেইজন্যে একেবারে ডান প্রান্তে চলে গেলাম। গিয়ে, সাবধানে আস্তে আস্তে মাথা দুপাশে ঘুরিয়ে সমস্ত জায়গাটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখলাম, নিশ্চল পায়ে দাঁড়িয়ে।
ঐখানে দাঁড়িয়েই হঠাৎ লক্ষ করলাম যে, নালার বালিতে ঐ বাঁকের পরে বাঘের থাবার আর কোনও দাগ নেই। বাঘটা বাঁকের মুখে এসেই নালার ডানপাড়ে উঠে গেছে আবার এক লাফে। বোধহয় আমরা যে তাকে অনুসরণ করছি, তা বুঝতে পেরেছে। অথবা এমনিতেই ও গভীর জঙ্গলে নিরুপদ্রব কোনও আশ্রয়ের খোঁজে গেছে।
কী করব ভাবছি। দুতিন সেকেন্ড সময়ও কাটেনি, হঠাৎই পেছন থেকে দণ্ডর ভয়ার্ত চিৎকার শুনলাম : বাঘঘ্র : ডান পাখখেরে।
সঙ্গে সঙ্গে ডানদিকে মুখ ঘুরিয়েই দেখি বাজ পড়ে পুড়ে যাওয়া একটা শিমুল গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বাঘটা আমার উপর লাফিয়ে পড়ার জন্যে জমির সঙ্গে লেপ্টে শুয়ে থাকার মতো করে বসে আছে। লেজটা পেছনে লাঠির মতো সোজা সমান্তরাল হয়ে আছে। আমার চোখের সঙ্গে তার চোখের দৃষ্টি যখন মিলল তখন অনেকই দেরি হয়ে গেছে। সেটি ক্যাচটি ঠেলারও সময় পেলাম না। সে ততক্ষণে লাফ দিয়েছে। কিন্তু বাঘটা লাফাবার সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে দণ্ডর হাতের রাইফেল গুডম্ করে গর্জে উঠল। হলুদকালোয় ডোরাকাটা একটি সাইক্লোনের মতোই বাঘটা কানে তালা লাগানো বুক কাঁপানো গর্জন করে উড়ে এল আমার উপর। রাইফেল কাঁধে তুলে আমি একলাফে এগিয়ে গেলাম কিছুটা, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম বাঘের ছোঁয়া এড়াবার চেষ্টাতে। বাঘটা চার হাত পা এবং লেজসমেত যখন আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল তখনই রাইফেল সুইং করে ট্রিগার, টেনে দিলাম প্রায় তার বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে।
এত সব ঘটনা ঘটতে কিন্তু লাগল মাত্র কয়েক মুহূর্ত।
হেভি রাইফেলের রিপোর্টে সমস্ত বন-পাহাড় গমগম করে উঠল। বাঘটা আছড়ে পড়ল জলের মধ্যে ঝপাং করে। জল ছিটকে উঠল চারদিকে। নালার দহের পাড়ে একটা ছোট্ট নীল মাছরঙা মরা গাছের ডালে বসে ছিল। গুলির আওয়াজে ও বাঘের গর্জনে অন্য অনেক পাখির সঙ্গে সেও গলা মিলিয়ে ভয়ার্ত গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল।
বাঘটা জলে পড়েই এক মোচড়ে শরীরটাকে বিদ্যুতের মতো ঘুরিয়ে আবারও আমাকে ধরার জন্যে তেড়ে এল। কিন্তু ততক্ষণে আমার ও দণ্ডর আর-এক রাউণ্ড গুলি গিয়ে তার বুকে ও মাথায় লেগেছে। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে।
খালি রাইফেল হাতে আমি বাঘটার দিকে চেয়ে রইলাম। সেও চেয়ে রইল। আমার দিকে। তার কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে এল। তার দুচোখ লাল হয়ে ধীরে ধীরে বুজে এল। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। মনে হল আমারই মতো ওরও খুব ঘুম পেয়েছে।
মনটা ভীষণই খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। রাইফেলের ব্যারেলটা একটা পাথরের উপরে রেখে বাট্টা বালিতে পুঁতে বালিরই মধ্যে বসে পড়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাইপটা আবার বের করে ধরালাম। দণ্ড পাশে এসে বসল।
আজ দণ্ড না থাকলে আমার অবস্থা এতক্ষণশঙ্কর মতোই হত। কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় ভয়ে আমার গায়ে কাঁপুনি এল।
.
দণ্ড হাত পাতুল। বলল, টিক্কে তামাকু।
তামাক দিয়ে বললাম, আজ তোমার জন্যেই আমার প্রাণটা বাঁচল দণ্ড।
নিচু গলায় দণ্ড বলল, আমি প্রাণ বাঁচাবার কে? সবই ঠাকুরানির দয়া!
ততক্ষণে অতগুলো গুলির শব্দ আর বাঘের গর্জন শুনে গ্রাম থেকে অনেকে দৌড়ে এসেছিল। সবচেয়ে আগে দেখা গেল দুর্যোধনকে। তার হাতে আমার দোনলা শটগানটি। সে সাবধানে আমাদের খোঁজে অন্যদের চেয়ে আগে-আগে এগিয়ে এসেছিল। আমাদের বসে থাকতে দেখেই হাত দিয়ে পেছনে ইশারা করল। এবং পরক্ষণেই চিৎকার করে বলল, মরিচি! বাপ্পালো বাপ্পা! কেত্বে বড্ড বাঘটা মঃ।
দৌড়ে এল ওরা সকলেই। হুড়োহুড়ি করে। পুরুষদের পেছনে পেছনে মেয়ে ও বাচ্চারাও। দণ্ড, পাইপের টোব্যাকোটা হাতে খৈনির মতো মেখে, মুখে ফেলার আগেই হাতে-হাতে বাঘের গোঁফ সব উধাও হয়ে গেল। দুর্যোধন চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
বাঘকে বয়ে বাংলোর হাতায় নিয়ে আসার ভার দুর্যোধনের উপরে দিয়ে আমি আর দণ্ড বাংলোর দিকে হেঁটে চললাম। বাঘ মরেছে। এবারে শিব্বর মৃতটা আমার মনে ফিরে এল। গভীর গ্লানি আর পাপবোধ ভারী করে তুলল আমার মাথা।
চলতে চলতেই দণ্ড বলল, শিব্ব! বাঘু খাইবাপাঁই হাঁকা করিবাকু এইঠি আসিথেল্লে। আউ বাঘঘটা, তাংকু খাই নেল্লে। তার বড্ড ক্ষুধা থিল্লা।
কার? শিব্বর আবার কার? অন্য মাংস না পেয়ে বাঘের মাংসই খাবে বলে হাঁকা করবার জন্যে লাফিয়ে লাফিয়ে এল আর তাকেই খেল বাঘে! বডই খিদে ছিল শিব্বর। মাংসর উপর দারুণ লোভ ছিল ওর! পরের জন্মে ঠাকুরানির দয়ায় ও হয়তো বাঘ হয়েই জন্মাবে। আশ মিটিয়ে মাংস খাবে তখন। কে জানে, সবই ঠাকুরানির ইচ্ছা।
প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে বললাম, আচ্ছা দণ্ড, সেদিন কিসের নাড়ু খাইয়েছিল বলো তো শিব্ব আমাদের? ওই নাড়ু না-খেলে বাঘের পায়ে গুলি করে তাকে খণ্ডিয়াও করতাম না আর না করলে শিব্ব তার হাতে মারা যেত না। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্যময়। রাতের নুনিতে এবং ভীমধারার মধ্যে ঐ আশ্চর্য ঘন্টা বাজা। সবই কি স্বপ্ন? মনের ভুল? ঐ মাটি খুঁড়ে-ওঠা পেল্লায় বাইসন! কাল রাতের সব কিছুই!
দণ্ড দাঁড়িয়ে পড়ে লাল চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, কী বলতে চাইছ তুমি?
কিছুই বলতে চাইছি না। জানতে চাইছি শুধু।
ঐ নাড়ু সিদ্ধির নাড়। আর যা-কিছুই রহস্যময় ব্যাপার-স্যাপার কাল ঘটেছে তার কিছুই স্বপ্ন নয়। সব সত্যি। ও সব ঐ ঠাকুরানির লীলাখেলা। শিব্ব জেনেশুনেও আমাদের ঠাকুরানির ঠাঁইয়ে গল্ব মারবার জন্যে পাঠিয়েছিল বলেই হয়তো ঠাকুরানিই বাঘের রূপ ধরে এসে তোমাকে দিয়ে বে-জায়গায় গুলি করিয়ে নিজে খন্ডিয়া হয়ে শিব্বকে মেরে গেলেন। ঠাকুরানিকে নিয়ে জঙ্গলের যে-সব লোক তামাশা করে, তাদের শেষ এই-ই হয়। কে জানে? পেট পুরে যাতে মাংস খেতে পারে তার জন্যে এই মরা বাঘের আত্মাটা ঠাকুরানি শিব্বকেই দিয়ে দেবেন হয়তো। শিব্ব বাঘ হয়ে যাবে। তাঁর লীলা, তিনিই জানেন।
ঠাকুরানির বাঘ আর নুনির রহস্যময় ব্যাপার-স্যাপার, সব কিছুরই মূলে তাহলে ওই সিদ্ধির নাড়ু! ছি ছি!
দণ্ডর কথা আমি কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু ওদের অনেক কথাই আমি এবং আমরা বোধহয় বুঝি না। এই শিব্ব এবং দণ্ড, ভীম, দুর্যোধন, টুকা বন-বাংলোর চৌকিদার, বেঁটেখাটো ছোট্ট বলিরেখাময় গোল মুখের খুকি, এরা এক অন্য জগতের মানুষ। এদের আমরা কখনও বুঝিনি, বুঝি না এবং বুঝবও না। এরাও বোঝে না আমাদের। আমাদের এই দুই জগতের মাঝে একটা সাঁকো থাকলে বোধহয় ভাল হত।
দণ্ড বলল, শিব্বর বউয়ের জন্য আমাদের তো কিছু করা উচিত? কী বলো?
নিশ্চয়ই। আমি বললাম। কিন্তু তোমার কী মনে হয়? কী করা উচিত?
ওকে গ্রামে কিছু জমি কিনে দাও। ওদের তো ছেলেমেয়ে নেই। বউটার বয়সও বেশি নয়। ওর আবার বিয়ে দিতে বলব গ্রামের লোকদের শিব্বর শোক মরে গেলে। তুমি দুশো টাকা দেবে? জেঠুমণির কাছ থেকে চেয়ে? তাইই যথেষ্ট। দুশো টাকা কী কম টাকা! ওরা কেউই একসঙ্গে কখনও দুটো টাকা চোখে দেখেনি।
দুশো টাকা? একজন মানুষের জীবনের দাম মাত্র এইটুকু?
বললাম, হাজার টাকা দেব জেঠুমণিকে বলে। যেন একজন মানুষের জীবনের দাম হাজার টাকা! আবার বললাম, আর সুরবাবুদের বলে দেব যে, শিব্বর বউকে এবং ও যদি আবার বিয়ে করে তো তবে তাকেও যেন একটা চাকরি করে দেন ওঁরা ওদের ক্যাম্পে।
আমি আর দণ্ড যখন টুল্লকা বাংলোর হাতাতে ঢুকলাম তখন দেখলাম বাংলোর সামনেই ডানদিকে যে বড় উঁচু সাদাটে পাথরটা আছে সেই পাথরের উপর শিব্বর বউ বসে রোদ পেয়াচ্ছে পা ছড়িয়ে। কী সান্ত্বনা দেব ওকে জানি না। কী করে সামনে গিয়ে দাঁড়াব আমি?
শিব্ব? ওর কাছে পৌঁছে দণ্ড জিজ্ঞেস করল। মানে, মৃতদেহের কথা।
নিরুত্তাপ গলায় বউ বলল, তাংকু নেই গল্লে…
স্বামীকে ওরা সকলে নিয়ে গেল অথচ তার গলাতে একটুও দুঃখের আভাস পেলাম না। অবাক হলাম।
পরক্ষণেই শিব্বর বউ বলল, বাবু, তুমি কি কখনও বাঘের মাংস খেয়েছ? শিব্বর তো খাওয়া হল না কিন্তু আমি খাব বলে বসে আছি। বাঘ কখন কাটা হবে? চামড়া ছাড়ানোর পর?
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। উত্তর না দিয়ে ঘরে গেলাম। মেয়েটার বোধহয় মাথাই খারাপ হয়ে গেছে।
বাঘের মাংস আমি জেঠুমণির সঙ্গে একবারই খেয়েছিলাম। নাগাল্যাণ্ডের মোককচঙের কাছের এক গ্রামে। চিবোনো যায় না। দাঁতের পাটি লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের এই বনজঙ্গলের বড় গরিব, ক্ষুধাতুর, সরল, সাধারণ মানুষগুলোর জীবনযাত্রা ও চাওয়া-পাওয়ার আসল রকমটি দেখে ও জেনে আমার মনে হল বাঘের মাংস হজম করার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন ওদের আসল দুরবস্থার সত্যটি হজম করা।
রাইফেলটা ঘরে রেখে বারান্দার চেয়ারে এসে বসলাম। চৌকিদার খুকি, চা নিয়ে এল। শিব্বর বউকেও একটু চা দিতে বললাম ওকে।
খুকি আপত্তি জানিয়ে বলল, শিব্বর বউ তো পুরো আধ-হাঁড়ি খিচুড়ি খেয়েছে। কালকের খিচুড়ি বেঁচেছিল অনেক।
কখন খেল? অবাক হয়ে শুধোলাম ওকে।
শিব্বকে অংগুলে নিয়ে গেল যখন ওরা ট্রাকে করে তারপরেই নিরিবিলিতেই খেয়েছে। বিরক্ত করার কেউই ছিল না। পেট পুরে খেল।
চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে অবিশ্বাসী চোখে খুকির মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
জঙ্গল থেকে বাংলোর দিকে ফেরার পথে একটু আগেই দণ্ড বলছিল যে আমাদের কাছে ভাগ্যিস জিপ এবং ট্রাক আছে তাই আজই শিব্বর পোস্টমর্টেম হবে হয়তো। না, তবু আজ হবে না। আজ যে রবিবার। কাল হবে। কিন্তু যখন মোষের গাড়িতে চাটাই-মুড়ে মৃতদেহ নিয়ে যেতে হয়, কেউ গাছ-চাপা পড়লে বা বাঘ, হাতি বা বাইসনের হাতে মরলে তখন অংগুলে পৌঁছে পোস্টমর্টেম হতে হতে অনেকসময় সাতদিনও লেগে যায়। বাঘের হাতে মরেও নিস্তার নেই। তারপর পড়তে হয় পুলিশের হাতে। বাঘের চেয়েও বিপজ্জনক তারা।
খুকিকে বললাম, তোমাদের আপনজন মরলে তোমরা শোক করো না? দুঃখ লাগে না তোমাদের?
খুকি আমার কথা শুনে খুব জোরে হেসে উঠল। বলিরেখাভরা কপাল কুঁচকে উঠল। ফোকলা দাঁতের মধ্য দিয়ে হাসির টুকরো-টাকরা লাফিয়ে আসতে চাইছিল বাইরে। কিন্তু সামলে নিয়ে তার চোখ আমার চোখে রেখে বলল, ঋজুবাবু শোকটোক দুঃখ-টুঃখ সব তোমাদের মতো বড় মানুষদেরই জন্যে। আমাদের ওসব বিলাসের সময় কোথায়? প্রতিটি দিনই আসে বড় দাপটে। এক-একটা ঝড়ের মতো। ডানাভাঙা পাখির মতো গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়, আমাদের দিন গুজরান করতেই প্রাণান্ত। আমরা তাইই তো গাই : দয়া করো। দীনবন্ধু শুভে যাউ আজ দিন, করজোড়ে তুমপাদে করুছি এ নিবেদন। এই এমনি করেই কেটে যাচ্ছে দিন। তোমরা যে কদিন আছ, ভাল খাচ্ছি-দাচ্ছি, তোফা আছি। চলে গেলেই আবার যে কে সেই।
বলেই খুকি রান্নাঘরে চলে গেল।
চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বসে সামনে তাকিয়ে ছিলাম। শীতের হাওয়ায় পাতা ঝরে যাচ্ছে গাছ থেকে। হাওয়ার সওয়ার হয়ে ব্যালেরিনার মতো ঘুরতে ঘুরতে উড়তে-উড়তে মাটিতে নামছে তারা। ঝরঝর করে ঝরনার মতো শব্দে পাথরের উপর দিয়ে সেই পাতার পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাখাল হাওয়াটা।
পাতার মতো দিনও ঝরে। ঝরাপাতার মতো দিন। আমার দেশবাসীর দিন। আমার ভাইবোনের দিন। ঠাকুরানির জঙ্গলের বাঘে-চিবোনো এই সাধারণ শিব্ব, তার বউ, ভীম, দুর্যোধন, এবং অসংখ্য অজানা অচেনা মানুষদের প্রত্যেকেরই দিন।
বাঘের মাংসের মতো দিন!