বনহুরের অন্তর্ধান
গভীর রাত্রির নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে প্রতিধ্বনি জাগে–খট খট খট খট…
আস্তানায় বিশ্রাম করছিলো রহমান। সেদিন সর্দারের নিরুদ্দেশের পর আজ পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান নেই। কান্দাই জঙ্গল থেকে কান্দাই শহর রহমান চষে ফিরেছে, কোথাও সর্দারের সন্ধান পায়নি। সমস্ত অনুচর সর্দারের খোঁজে দেশ হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তন্ন তন্ন করে সন্ধান চালিয়েছে তারা শহরে-নগরে-বন্দরে। আবার সবাই এক এক করে ফিরে এসেছে–কেউ জানেনা কোথায় তাদের সর্দার।
সেদিনের পর থেকে রহমানের চোখের ঘুম অন্তর্ধান হয়েছে। সদা-সর্বদা ঐ এক চিন্তা, সর্দার কাউকে কিছু না বলে গেলো কোথায়? বনহুরের মনে অশান্তির কথা আর কেউ না জানলেও জানে রহমান, কাজেই সর্দারের জন্য রহমান আশঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
হঠাৎ অশ্বপদ শব্দে রহমান চমকে উঠে, অন্যান্য অনুচরগণের মনেও দোলা লাগে, এ শব্দ যে তাদের অতি পরিচিত। দস্যু বনহুরের অশ্ব তাজের পদশব্দ এটা।
রহমান সুড়ঙ্গ মুখে দাঁড়ায়। দূরবীণ চোখে লাগিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিন্তু অন্ধকারে কিছুই সে দেখতে পায় না।
আস্তানায় সার্চলাইট জ্বেলে দেওয়া হলো। যেদিন থেকে অশ্বপদ শব্দ আসছিলো সেই দিন সার্চলাইটের আলো পড়তেই রহমান বিস্ময়ে চমকে উঠলো, তাজ বেগে ছুটে আসছে–কিন্তু তার পিঠ শূন্য।
রহমান সুড়ঙ্গ পথের বাইরে এসে দাঁড়ালো।
ক্রমে তাজের পদশব্দ স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। অল্পক্ষণেই তাজ এসে দাঁড়ালো। একি! তাজের লাগাম এমন ঘেঁড়া কেন? অর্ধেকটা লাগাম তাজের মুখের মধ্যে ঝুলছে।
রহমান তাজের পিঠে-গলায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো–ওরে, সর্দারকে তুই কোথায় রেখে এলি? বল, ওরে বল…
তাজ যেন রহমানের কথা বুঝতে পারলো, সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো সে, কোনো কথা যেন তাজ তাকে বুঝিয়ে বলতে চায়।
রহমান এবং আরও অন্যান্য অনুচরগণ এসে তাজকে ঘিরে দাঁড়ালো। সকলের চোখেই বিস্ময়, তাজের লাগাম এভাবে অর্ধেকটা ছিন্ন কেন।
তাজ পশু, সে বলতে পারলো না–জবাব দিতে পারলো না বনহুরের অনুচরদের কাছে।
বনহুর যখন তাজকে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে রেখে বিশ্রাম করছিলো, ঠিক তখন তার কানে ভেসে এসেছিলো পরিচিত একটি সুর। তন্দ্রাগ্রস্তের মত যখন সে অগ্রসর হয়েছিলো, এগিয়ে গিয়েছিলো গহন বনের দিকে।
তারপর আর ফিরে আসেনি বনহুর।
ঝড় উঠেছিলো–সেকি ভীষণ তুফান! আকাশ গাঢ় মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো, গাছ-পালা মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ছিলো। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছিলো জলস্রোত। তাজ নিজকে আর স্থির রাখতে পারেনি, তুফানের ঝাপটায় সে অস্থির হয়ে পড়েছিলো। শেষ পর্যন্ত লাগাম ছিঁড়ে ছুটে ছিলো মনিবের সন্ধানে।
পাহাড়ের পাদমূলে এসে আর সে উঠতে পারেনি উপরে। অনেক চেষ্টা করেছিলো তাজ, অনেক খুঁজেছিলো সে প্রভুকে। যখন সে প্রভুর কোনো সন্ধান পেলো না, তখন সে ছুটলো কান্দাই অভিমুখে। পথে কোনো বাধা-বিঘ্নই সে মানলো না, অবিরাম ছুটে কয়েকদিন পর সে তাদের আস্তানায় এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। তাজের মুখের সঙ্গে ঝুলছে এখনও সেই ছিন্ন লাগাম খানার খানিকটা অংশ।
রহমান অনুমানে বুঝে নিলো নিশ্চয়ই তাদের সর্দারের কোনো বিপদ হয়েছে। না হলে তাজ এভাবে একা কখনও ফিরে আসতো না। তাছাড়া তাজের যে অবস্থা তাতে বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে–তাজ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
রহমান তার কয়েকজন সেরা অনুচর সহ তাজের সঙ্গে অশ্ব নিয়ে আবার আরাকান অভিমুখে রওনা দিলো।
সুচতুর তাজ সর্বাগ্রে ছুটলো, পিছনে রহমান দুর্কীর পিঠে। অন্যান্য অশ্বপৃষ্ঠে আর আর অনুচরগণ।
আরাকানে পৌঁছে রহমান দলবল নিয়ে সমস্ত বন-জঙ্গল পাহাড় প্রান্তর সব নিপুণভাবে খুঁজলো। তাজ যেদিকে চলে সেই দিকেই রহমান ছোটে তার দলবল নিয়ে।
এমন কোনো যায়গা রইলো না যেখানে রহমান সন্ধান করলো না তাদের সর্দারের!
কিন্তু কোথায় বনহুর? পৃথিবীর বুকে থাকলে রহমানের চোখে সে নিখোঁজ হতে পারবে না।
এদিকে রহমান যখন বনহুরের সন্ধানে আরাকানের মাটি তন্ন তন্ন করে ফিরছে, তখন বন্ধাই এর গভর্ণর হাউসে ভীষণ এক ডাকাতি হয়ে যায়। দুর্দান্ত দস্যু বনহুরই এই দস্যুতা করেছে পুলিশ রিপোর্টে এই রকম বলা হয়েছে। দস্যু শুধু অর্থ আর ধন-সম্পদই লুটে নিয়ে যায়নি, গভর্ণর কন্যা মিস্ এরুনাকেও হরণ করে নিয়ে গেছে।
দস্যু বনহুর গভীর রাতে বন্ধাই এর গভর্ণর হাউসে প্রবেশ করে কয়েকজন পুলিশ এবং পাহারাদারকে নিহত এবং আহতও করেছে।
বন্ধাই এর এই ভীষণ ডাকাতি-সংবাদ শুধু বন্ধাইতেই সীমাবদ্ধ রইলো না, দেশ হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়লো। এতোবড় দস্যুতা কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম হলো। কি ভাবে গভর্ণর হাউসে সশস্ত্র পাহারা পরিবেষ্টিত থাকা সত্বেও দস্যু প্রবেশ করে গভর্ণর মিঃ রাজেন্দ্র ভৌমকে অজ্ঞান করে তাঁর যথাসর্বস্ব নিয়ে পালিয়েছে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
পুলিশ মহলে সাড়া পড়ে গেছে।
সমস্ত পুলিশ অফিসার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, টেলিগ্রাফে খবরটা প্রতিটি পুলিশ অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ অফিসে অফিসে আবার পড়ে গেছে সাজো সাজো রব।
শুধু এক দেশেই নয়–প্রত্যেকটা দেশে দস্যু বনহুরের নামে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ মহলই শুধু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েনি, প্রতিটি দেশের মানুষের বুকে কম্পন শুরু হয়েছে। বেশ কিছুদিন দস্যু বনহুরের অত্যাচার থেকে তারা মুক্ত ছিলো, আবার আঁতঙ্ক সৃষ্টি হলো সকলের মনে।
কান্দাই শহরের পুলিশ মহলও জেগে উঠলো, দস্যু বনহুর আবার উপদ্রব শুরু করলো! এতোদিন বেশ নিশ্চিন্ত মনেই পুলিশ অফিসারগণ নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ করে আবার এই সংবাদে দেশের আবহাওয়া যেন পাল্টে গেলো। সবাই সজাগ হয়ে উঠলো আপন আপন কাজে।
বন্ধাই থেকে ডাক এলো পুলিশ সুপার মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরীর।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী এ ক’মাসে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তেমন কোনো কাজ না থাকায় অস্বস্তি বোধ করছিলেন তারা। দস্যু বনহুরের পুনঃ আবির্ভাবে আবার সজাগ হয়ে উঠলেন। কর্মময় জীবন তাঁদের, বসে থাকার জন্য নয়।
মিঃ আহমদ ও মিঃ জাফরী বন্ধাই অভিমুখে রওনা দিলেন। সঙ্গে তাদের কয়েকজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার রইলো। বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় মিঃ জাফরীর মনে দারুণ একটা ক্ষোভ ছিলো। তিনি এবার বদ্ধ পরিকর হলেন, দস্যু বনহুরের পুনঃ আবির্ভাব যখন ঘটেছে তখন একবার দেখে নেবেন–দস্যু বনহুর মানুষ না অশরীরি আত্না। তাকে এবার গ্রেপ্তার না করে ছাড়বেন না কিছুতেই। দস্যু বনহুর তাকে যে নাকানি চুবানি খাইয়েছে তা তিনি কোনোদিন ভুলবেন না। দস্যু বনহুরের প্রতি তার শুধু রাগই নেই, ভীষণ আক্রোশ আছে, ওকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে তিনি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না।
কান্দাই ছেড়ে পৃথক এক দেশ বন্ধাই।
যদিও প্লেনে যাওয়া-আসার সুবিধে আছে তবু মিঃ আহম্মদ ও মিঃ তাঁদের সহকারীদের নিয়ে জলপথে রওনা দিলেন।
কান্দাই বন্দর থেকে জাহাজযোগে বন্ধাই যাবেন মনস্থ করে নিলেন পুলিশ সুপার মিঃ আহম্মদ আর মিঃ জাফরী। নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়লেন।
কান্দাই থেকে বন্ধাই এ পৌঁছতে সপ্তাহ কয়েক লেগে যাবে। পথে বন্দরে বন্দরে জাহাজ নোঙর করবে। মিঃ আহম্মদ এবং জাফরীর ইচ্ছা–তারা এ সব বন্দরে অবতরণ করে নানারূপ সন্ধান চালিয়ে খোঁজখবর নেবেন।
জাহাজ শাহান শাহ’ বন্দর ত্যাগ করবার পূর্বে মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী ক্যাপ্টেন জমরুদীর সঙ্গে গোপনে কিছু আলাপ করে নিলেন।
মিঃ জাফরী ক্যাপ্টেন জমরুদীকে বললেন–দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে আমরা বন্ধাই রওনা দিলাম বটে, কিন্তু আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
ক্যাপ্টেন জমরুদীর মুখে স্মিত একটুকরো হাসি ফুটে উঠলো, তিনি গম্ভীর স্থির কণ্ঠে বললেন–দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে আমি আপনাদের সর্বান্তকরণে সাহায্য করবো।
থ্যাঙ্ক ইউ ক্যাপ্টেন; আপনার সহযোগিতাই হবে আমাদের এ যাত্রার একমাত্র কামনার বস্তু।
‘শাহান শাহ’ কান্দাই এর সর্বশ্রেষ্ঠ জাহাজ। যাত্রীবাহী এ জাহাজে প্রায় পাঁচ শত লোক এক সঙ্গে আরোহণ করতে পারে। সুন্দর সুসজ্জিত মনোরম এই জাহাজখানায় এমন কিছুর অভাব নেই, যা যাত্রীদের অসুবিধায় ফেলতে পারে। দোকান-পাট, বাজার, হোটেল, এমন কি সিনেমা হলও রয়েছে শাহান শাহে।
এহেন সর্ব উৎকৃষ্ট জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন মিঃ জমরুদী বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে। বলিষ্ঠ সুঠাম গঠন, দীপ্ত উজ্জ্বল চোখ। মুখে ছাট করা দাড়ি। দু’চারটে চুলে পাক ধরেছে। দাড়িও পেকেছে মাঝে মাঝে। ক্যাপ্টেন জমরুদী গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, কথা কম বলেন–কাজ করেন বেশি।
জাহাজে তিনি আরোহীদের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করেন। ক্যাপ্টেন হয়েও তিনি সমস্ত জাহাজের সর্বত্র ঘুরে ফিরে দেখাশোনা করেন, কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা নিজে খবর রাখেন।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী অফিসারদ্বয়ের জন্য সুসজ্জিত দু’টি ক্যাবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং নিজে সব সময় তাঁদের খোঁজখবর নিতে লাগলেন।
কান্দাই বন্দর ত্যাগ করে জাহাজ শাহান শাহ’ সাগরবক্ষে অগ্রসর হলো।
গভীর নীল উচ্ছল জলরাশি প্রচন্ড আস্ফালন করে তীর-বেগে ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে জাহাজের গায়ে। ভীম গর্জন করে জাহাজখানা এগিয়ে যাচ্ছে সাগরের মধ্যস্থানে।
ক্রমে কান্দাই বন্দর ঝাপসা হয়ে এলো, এক সময় অদৃশ্য হলো বন্দরটা সম্পূর্ণরূপে।
ডেকে দাঁড়িয়ে সিগারেট পান করছিলেন মিঃ আহম্মদ। মিঃ জাফরী দাঁড়িয়েছিলেন পাশে। দৃষ্টি তাদের সীমাবদ্ধ দূরে সাগর আর আকাশখানা যেখানে মিশে এক হয়ে গেছে।
মিঃ জাফরী বললেন মিঃ আহম্মদকে লক্ষ্য করে–স্যার, দস্যু বনহুর বেশ কিছুদিন ডুব মেরে থাকার পর আবার সে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
সেই কারণেই আমরা বন্ধাই চলেছি মিঃ জাফরী; আশা করি আমরা এবার তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবো।
এমন সময় ক্যাপ্টেন জমরুদীর আগমনে চুপ হলেন পুলিশ অফিসারদ্বয়, বিশেষ করে যখন তখন দস্যু বনহুরের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করাটা ভাল লাগলো না তাদের।
ক্যাপ্টেন জমরুদী বললেন–চলুন বৈকালের নাস্তাটা আমার ওখানেই করবেন।
মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী অমত করতে পারলেন না। কারণ এ জাহাজে আরোহণ করার পর ক্যাপ্টেনের ব্যবহারে তাঁরা মুগ্ধ।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী ক্যাপ্টেন জমরুদীকে অনুসরণ করলেন।
জাহাজখানা তখন ভীম গর্জন করে বিরাট জলজন্তুর মত সাগরবক্ষে এগিয়ে চলেছে।
মন্থনা দ্বীপের মহারাজ জয়কান্ত সেন আহার নিদ্রা সব ত্যাগ করেছেন। মহারাণী মায়াবতীর অবস্থাও তদ্রূপ। পুত্রশোকে মুহ্যমান রাজদম্পতী।
রাজকুমার প্রদীপ সেনের অভাবে সমস্ত মন্থনা দ্বীপ ঝিমিয়ে পড়েছে। রাজ্যময় একটা অশান্তির ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। রাজার মনে সুখ নেই, প্রজাদের আনন্দ থাকবে কি করে।
রাজবংশের একমাত্র দীপশিখা প্রদীপ কুমার।
জয়কান্ত সেন বহুদিন নিঃসন্তান থাকার পর কোনো এক সন্ন্যাসীর আশীর্বাদে লাভ করেছেন। প্রদীপকে। মহারাজ এবং মহারাণীর শিবরাত্রির সলতে প্রদীপ কুমার। একমাত্র সন্তানকে তারা কোনো সময় দৃষ্টির আড়াল হতে দিতেন না। শুধু মহারাজ এবং মহারাণীই নয়, সমস্ত রাজপরিবারের নয়নের মণি ছিলো প্রদীপ।
প্রজারা ভালবাসতো, সমীহ করতো–রাজকুমারের আচরণে মুগ্ধ ছিলেন তারা।
প্রদীপ কুমার শুধু সুন্দরই ছিলো না, তার হৃদয় ছিলো বড় উদার। শিকার করা ছিলো প্রদীপের। নেশা।
মাঝে মাঝে প্রদীপ কুমার তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে শিকারে যেতো। বন হতে বনান্তরে ছুটতে অশ্ব নিয়ে।
প্রতিবারের মত এবারও প্রদীপ শিকারে গিয়েছিলো সঙ্গীদের নিয়ে।
সঙ্গে শুধু সঙ্গীরাই ছিলো না, প্রদীপ কুমারের দেহরক্ষী ছিলো অনেক।
শিকার করা রাজকুমারের নেশা হলেও রাজরাণী এতে সব সময় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করতেন। না জানি কখন কোন্ বিপদ এসে পড়ে। একমাত্র সন্তানের অমঙ্গল চিন্তায় রাজদম্পতী সদা-সর্বদা চিন্তিত থাকতেন। ছোট শিশু নয় যে ধরে রাখবেন। বয়স হয়েছে–এখন প্রদীপ যুবক।
মহারাজ জয়কান্তা সেন এখন বৃদ্ধ; রাজ্য চালনায় তিনি আর আগের মত উৎসাহী নন। এখন পুত্র প্রদীপকে রাজ্যভার সমর্পণ করে তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করতে চান।
কিন্তু প্রদীপের ইচ্ছে ঠিক তার উল্টো, রাজ্যভার গ্রহণ করতে সে কিছুতেই রাজি নয়, আরও কিছু পরে সে এ দায়িত্ব গ্রহণ করবে বলে পিতার কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মহারাজ জয়কান্ত এবং মহারাণীর ইচ্ছা পুত্রের অমতে তারা জোরপূর্বক কিছু করবেন না।
প্রদীপ ভালবাসে মন্ত্রীকন্যা মীরা দেবীকে, মীরাও প্রদীপের জন্য সদা ব্যাকুল।
মহারাজার ইচ্ছা না থাকলেও মহারাণীর অনুরোধে তিনি পুত্রকে মন্ত্রীকন্যা মীরা দেবীর সঙ্গেই বিয়ে দেবেন মনস্থ করে রেখেছেন। মন্ত্রি চন্দ্রনাথ জাতীকুলে মহারাজের সমকক্ষ। কন্যা মীরা অপূর্ব রূপবতী, সর্বগুণে গুণবতী কাজেই মহারাজের অমত করবার কোনো কিছু রইলো না। মীরাকে পুত্রবধু করে নেবেন মনস্থ করে রাখলেন।
মীরা আর প্রদীপের মধ্যে তাই ছিলো না কোনো বাধার প্রাচীর। উভয়ে মিলিত হতো উভয়ের সঙ্গে, হাসি-গানে মেতে উঠতো ওরা! জোছনা রাতে নদীবক্ষে বজরা ভাসিয়ে চলে যেতো দূরে, অনেক দূরে। কখনও বা ছিপ নৌকায় রাজকুমার আর মন্ত্রিকন্যা বেরিয়ে পড়তো, মাছ ধরতো বড়শী নিয়ে। কোনো কোনো সময় বনে যেতো ওরা শিকার করতে প্রদীপ কুমারের সঙ্গে মীরাও পরতো শিকারীর ড্রেস। প্রদীপ আর মীরার মধ্যে ছিলো না কোন সংকোচ বা দ্বিধা। উভয়ে। উভয়কে গভীরভাবে ভালবেসেছিলো।
এবার প্রদীপ শিকারে যাবার সময় মীরাকে সে সঙ্গে নেয়নি, কারণ মীরা অসুস্থ ছিলো।
মীরার কাছে প্রদীপ বিদায় নিয়ে গিয়েছিলো, হাসিমুখে তাকে বিদায় দিয়েছিলো মীরা।
কিন্তু শিকার থেকে প্রদীপ আর ফিরে আসেনি।
ফিরে এসেছে তার সঙ্গী-সাথীরা। ফিরে এসে তারা জানিয়েছে এক মহা দুঃসংবাদ।
গহন বনে যখন তারা শিকার করছিলো, তখন ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি আর তুফান শুরু হয়। সেই ঝড়-বৃষ্টি-তুফানের মধ্যে শিকারীর দল কে কোথায় ছিটকে পড়েছিলো তা কেউ জানে না।
ঝড়-বৃষ্টি-তুফান যখন থেমে গেলো তখন দেখা গেলো,দলের অনেকেই আহত হয়েছে, কারো অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হয়ে পড়েছে। কিন্তু কুমার কোথায়!
সবাই ফিরে এলো, শুধু একমাত্র ফিরে এলো না প্রদীপ।
সেদিনের পর থেকে রাজ্যময় একটা অশান্তির কালোছায়া ঘনিয়ে এলো, রাজারাণী পুত্রশোকে মূহ্যমান হয়ে পড়লেন। রাজপরিবার থেকে মুছে গেলো সব আনন্দ। প্রজাদের মনে রেখাপাত করলো রাজপরিবারের এই অশান্তির করাল ছায়া।
মন্থনা দ্বীপ একমাত্র প্রদীপকে হারিয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো।
রাজ্যময় গভীর শোকের হাওয়া বইতে লাগলো।
মন্ত্রিকন্যা মীরা দেবী রাজকুমারের বিরহ বেদনায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়লো, সদা-সর্বদা সে প্রদীপের জন্য অশ্রুবিসর্জন করে চললো।
মীরা দেবী পিতামাতার আদুরিনী কন্যা–তাছাড়া ভাবী রাজপুত্রবধু, তার এই করুণ অবস্থায় মন্ত্রিপরিবার মুষড়ে পড়লো। কন্যাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন মন্ত্রি চন্দ্রনাথ।
কিন্তু মীরার চোখের অশ্রু শুষ্ক হলো না, বরং আরও বেড়ে গেলো।
প্রদীপকে না পেলে তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। মীরার কক্ষে ছিলো প্রদীপ ও মীরার যুগল একটি বড় ছবি। মীরার সব সময় ঐ ছবিখানার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নীরবে রোদন করতো।
একদিন নয়, দুদিন নয়–বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। রাজকুমার প্রদীপের সন্ধানে যারা গিয়েছিলো সবাই বিমুখ হয়ে ফিরে এলো। মন্থনা দ্বীপের শান্তি লোপ পেলো চিরতরে।
মন্থনা দ্বীপে যখন প্রদীপকুমারের নিরুদ্দেশ ব্যাপার নিয়ে মহা হুলস্থুল পড়ে গেছে তখন জাহাজ শাহানশাহ’ এসে নোঙর করলো মন্থনা বন্দরে।
এখানে শাহানশাহ’ দুদিন অপেক্ষা করবে। তারপর আবার রওনা দেবে বন্ধাই অভিমুখে। পথে আরও কয়েকটি বন্দরে শাহনশাহ’ নোঙর করবে বলে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন জমরুদী।
মিঃ জাফরী এবং পুলিশ সুপার মিঃ আহম্মদ মন্থনা দ্বীপে অবতরণ করবেন বলে জানালেন। মন্থনার পুলিশ অফিসে।
খবর পেয়েই পুলিশ সুপার এলেন কান্দাই এর পুলিশ সুপারকে অভ্যর্থনা জানাতে। মন্থনার পুলিশ সুপার মিঃ মুখার্জী ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারগণ কান্দাই এর পুলিশ অফিসারদের অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন নিজেদের অফিসে।
শহরময় একটা সাড়া পড়ে গেলো–কান্দাই পুলিশ সুপার এসেছেন মন্থনা দ্বীপ পরিদর্শনে। তাঁর সঙ্গে এসেছেন মিঃ জাফরী এবং আরও অন্যান্য পুলিশ অফিসারগণ।
মিঃ মুখার্জী শাহানশাহর’ ক্যাপ্টেন জমরুদীকেও আমন্ত্রণ জানালেন। প্রথমে ক্যাপ্টেন জমরুদী তার দাওয়া কবুল করছিলেন না, পরে রাজি হলেন মিঃ জাফরীর অনুরোধে।
পুলিশ অফিস পরিদর্শনের পর মিঃ মুখার্জী পুলিশ অফিসারগণ এবং ক্যাপ্টেন জমরুদীকে নিজ বাসভবনে নিয়ে গেলেন, সেখানে তাঁদের দ্বিপ্রহর ভোজনে আপ্যায়িত করলেন।
মিঃ মুখার্জী মন্থনার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ভোজনকালে একথা-সেকথা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিলো। মন্থনা দ্বীপের রাজকুমার প্রদীপের নিরুদ্দেশ ব্যাপার থেকে শুরু করে মুখার্জী তার কন্যা রীতার বিয়ের কথা পর্যন্ত তুললেন। অবশ্য মিঃ আহম্মদ তাঁর পুরানো বন্ধু লোক, তাই নিঃসঙ্কোচে কথাবার্তা চলছিলো।
মিঃ মুখার্জী কথায় কথায় তার কন্যা রীতার বিয়েতে অনেক মূল্যবান একটি হার দিচ্ছেন জানালেন। হারটির মূল্য প্রায় পঞ্চাশ হাজার। আরও অনেক গহণা তিনি কন্যার জন্য তৈরি করে রেখেছেন। আগামী সপ্তাহে বিয়ে।
খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ হলো, তারপর চললো দাবা খেলা। মিঃ আহম্মদ ও মিঃ মুখার্জী বহুদিন পর একত্র হয়েছেন, কাজেই তারা মেতে উঠলেন আনন্দে।
জাহাজে ফিরতে রাত হয়ে গেলো।
ফিরে আর কোনো আলাপ-আলোচনা করবার মত কারো মনের অবস্থা ছিলো না। সবাই আজ বেশ পরিশ্রান্ত। গোটা মন্থনা দ্বীপ তারা আজ ঘুরে ফিরে দেখেছেন।
নিজ নিজ ক্যাবিনে প্রবেশ করে সবাই বিশ্রামের আয়োজন করতে লাগলেন।
রাত বেড়ে আসছে।
শাহানশাহ’ নিস্তব্ধ। সমস্ত আরোহীরা যার যার স্থানে নিদ্রায় মগ্ন। একটা সার্চলাইট জাহাজের মাথায় আপন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সার্চলাইটের আলোতে আবার সমস্ত জাহাজখানায় আলোর তুলি বুনিয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রের উচ্ছল ঢেউ এর বুকে।
ঠিক আলোটা যখন সমুদের বুকে গিয়ে পড়লো, জাহাজটা তখন অন্ধকারে ছেয়ে গেলো–ঐ মুহূর্তে একটা জমকালো ছায়া-মূর্তি জাহাজের পিছন ডেকের দিকে দ্রুত অগ্রসর হলো।
সার্চলাইটের আলো সমুদ্রের বুক থেকে ফিরে আসার পূর্বেই ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হলো পিছন ডেকের আড়ালে।
জাহাজের পিছনে একটা মোটা রাশি ঝুলছিলো, তার নিচেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বোট।
ছায়ামূর্তি রশি বেয়ে নিচে নেমে গেলো, তারপর লাফিয়ে পড়লো বোটের উপর।
তর তর করে বোটখানা তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জমকালো মূর্তিটা বসে আছে, আর দু’জন কালো পোশাক পরা লোক দাঁড় বেয়ে চলেছে।
নিপুণ অভিজ্ঞ চালক ওরা।
অল্পক্ষণেই বোটখানা তীরে এসে ভিড়লো।
উঠে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি, চাপা গম্ভীর গলায় বললো–সাবধান, কেউ যেন তোমাদের দেখে না। ফেলে। তোমরা সতর্কভাবে আশেপাশে কোথাও অপেক্ষা করো, যতক্ষণ আমি ফিরে না আসি।
লোক দু’জন মাথা নিচু করে অভিবাদন করলো।
একজন বললো–আচ্ছা সর্দার।
ছায়ামূর্তি বোটের উপর থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লো তীরে।
অদূরে বন্দরের নিকটে কয়েকটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিলো। ছায়ামূর্তি প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভারখানা বের করে নিয়ে এগিয়ে গেলো। যে ট্যাক্সিখানা সর্বপ্রথম দাঁড়িয়েছিলো, সেই ট্যাক্সির পাশে এসে দাঁড়ালো। দেখলো ড্রাইভার নিশ্চিন্ত মনে নাক ডেকে পিছন আসনে ঘুমাচ্ছে।
ছায়ামূর্তি রিভলভারখানা আবার পকেটে রাখলো, তারপর রুমালটা বের করে নিয়ে উঠে পড়লো গাড়ির মধ্যে। বলিষ্ঠ হাত দিয়ে কৌশলে ঘুমন্ত ড্রাইভারের মুখটা বেঁধে ফেললো মজবুত করে। তারপর হাত দু’খানাও বাধলো পকেটে সিল্ক-কর্ড ছিলো তাই দিয়ে। এবার ড্রাইভারের দেহটা গড়িয়ে দিলো আসনের নিচে।
ছায়ামূর্তির হাতে গাড়িখানা উল্কাবেগে ছুটে চললো। শব্দ-হীন গাড়িখানা–কাজেই তেমন কোনো আওয়াজ হচ্ছিলো না।
ঠিক পুলিশ সুপার মিঃ মুখার্জীর বাড়ীর পিছনে এসে থেমে পড়লো গাড়িখানা। ছায়ামূর্তি নেমে পড়লো, অতি সতর্কতার সঙ্গে পিছন প্রাচীর টপকে প্রবেশ করলো ভিতরে।
পুলিশ সুপারের বাড়িতে যদিও বহু পাহারাদার সদা-সর্বদা নিয়োজিত হয়েছে তবুও এদিকটায় পাহারার তেমন কোনো প্রয়োজন হয় না। সুউচ্চ প্রাচীর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ছায়ামূর্তি সেই বিরাট উঁচু প্রাচীর অতি সহজে পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো, তারপর অতি নিপুণতার সঙ্গে পিছন পাইপ বেয়ে উঠে গেলো উপরে।
কৌশলে খুলে ফেললো জানালার কাঁচের শার্শী।
কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলো ছায়ামূর্তি।
শয্যায় অঘোরে ঘুমাচ্ছেন মিঃ মুখার্জী। বহুদিন পর পুরাতন বন্ধুর সঙ্গে বেশ আনন্দে কেটেছে সন্ধ্যা রাতটা, পরম নিশ্চিন্ত মনে এখন তিনি ঘুমাচ্ছেন।
জমকালো ছায়ামূর্তি শয্যার পাশে এগিয়ে গেলো। রিভলভারের আগা দিয়ে মিঃ মুখার্জীর গা থেকে চাদর সরিয়ে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে মুখার্জীর সুখনিদ্রা ভঙ্গ হলো, আচম্বিতে উঠে বসে তাকালেন, সম্মুখে জমকালো একটি ছায়ামূর্তি দেখে মুহূর্তে বিবর্ণ হলো তার মুখমন্ডল, বললেন–কে! কে তুমি?
চাপা গম্ভীর কণ্ঠস্বর–আমি যেই হই–চাবি দাও, চাবি।
চাবি! কিসের চাবি?
সিন্দুকের চাবি।
কেন?
দাও, বেশি কথা আমি বলতে আসিনি।
মিঃ মুখার্জী বিবর্ণ ফ্যাকোশে মুখে তাকালেন ছায়ামূর্তির হস্তস্থিত উদ্যত রিভলভারের দিকে।
ছায়ামূর্তি আবার চাপা কণ্ঠে বলে উঠলো–বিলম্ব হলে মৃত্যু নিশ্চিত…।
মিঃ মুখার্জী হঠাৎ এমন অবস্থায় পড়বেন কল্পনাও করতে পারেননি। এতো পাহারা পরিবেষ্টিত থাকা সত্বেও দস্যু কি করে প্রবেশে সক্ষম হলো। পাশেই টেবিলে ফোন, কলিং বেল রয়েছে কিন্তু হাত দেবার উপায় নেই। দস্যুর রিভলভার তার বুক লক্ষ্য করে উদ্যত রয়েছে।
মিঃ মুখার্জী চাবির গোছছা বালিশের তলা হতে বের করে এগিয়ে দিলেন, চোখ দুটো তার আগুনের ভাটার মত জ্বলে উঠলো। তিনি কত দস্যকে গ্রেপ্তার করেছেন আর আজ একটা দস্যুর কাছে তাঁর এতোবড় পরাজয়!
দস্যু চাবির গোছা হাতে নিয়ে বললেন–উঠুন।
সুবোধ বালকের মত উঠে দাঁড়ালেন মিঃ মুখার্জি।
দস্যু চাবির গোছা পুনরায় মিঃ মুখার্জীর হাতে দিয়ে বললো–চলুন আপ্নার সিন্দুকের পাশে।
মিঃ মুখার্জী বাধ্য হয়েই দস্যুর কথামত কাজ করলেন।
কন্যার বিবাহের জন্য যত গহনা তিনি তৈরি করিয়ে রেখেছিলেন সব তুলে দিলেন দস্যু-হস্তে; শুধু অলঙ্কারই নয়, যা কিছু অর্থ ছিলো বাড়িতে সব তুলে দিতে হলো।
দস্যু সব কিছু গ্রহণ করার পর যে পথে কক্ষে প্রবেশ করেছিলো সেই পথে বেরিয়ে গেলো।
দস্যু বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভার তুলে নিলেন হাতে, ফোন করলেন পুলিশ অফিসে। কলিং বেল বাজিয়ে সবাইকে ডাকলেন।
অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিশ সুপারের বাড়ি পুলিশে ছেয়ে গেলো।
অফিস থেকে ছুটে এলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং ও, সি। ঘটনা শুনে সবাই থ’ খেয়ে গেলেন। কি অদ্ভুত কান্ড–পুলিশ সুপারের বাড়িতে দস্যুতা!
চারিদিকে পুলিশ ফোর্স দস্যুর সন্ধানে ছুটলো কিন্তু কোথায় দস্যু–সব যেন হাওয়ায় মিশে গেছে।
পরদিন ঘটনাটা পত্রিকায় ছড়িয়ে পড়লো। শুধু পত্রিকাতেই নয়, লোকের মুখে মুখে নানাভাবে কথাটা বিচিত্র রূপ ধারণ করলো।
এমন সাহস কোন্ দস্যুর হতে পারে–একমাত্র দস্যু বনহুরই পারে একাজ করতে!
মন্থনা দ্বীপের অধিবাসীগণ রাজকুমারের শোকে একেই মূহ্যমান হয়ে পড়েছিলো, কারো মনে। ছিলোনা কোনো শান্তি বা আনন্দ, তার মধ্যে এক ভয়াবহ ডাকাতি, মন্থনার পুলিশ সুপারের বাড়িতে দস্যুতা। সে যে সে দস্যু নয়–স্বয়ং দস্যু বনহুর।
মন্থনার পুলিশ মহল নড়ে উঠলো, সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রইলো, কখন কোথায় আবার দস্যু বনহুর হানা দিয়ে বসবে কে জানে।
দ্বীপের অধিবাসীরা আশঙ্কায় দুরু দুরু বক্ষে কানাঘুষা করতে লাগলো। সবাই ভীত আতঙ্কিত; সন্ধ্যায় বাইরে পথেঘাটে কারো সাধ্য নেই একা সাহস করে বের হয়।
মন্থনার মহারাজ জয়কান্ত পুত্রশোক বিস্মৃত হয়ে প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণের সুব্যবস্থায় নিয়োজিত হলেন। দস্যু বনহুর যেন তাঁর প্রজাদের সর্বস্ব লুটে নিতে না পারে বা কাউকে হত্যা করতে না পারে।
শাহানশাহ’ বসে সংবাদ পেলেন মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী। সংবাদপত্রে জানাবার পূর্বেই রেডিও-সংবাদে তারা অবগত হলেন সব।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী বিস্ময়ে আড়ষ্ট, দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে তারা বন্ধাই শহরে চলেছেন, কিন্তু কি আশ্চর্য! সেই দস্য তাদের আগমনের পূর্বেই পৌঁছে গেছে মন্থনা দ্বীপে।
মিঃ আহম্মদ বললেন–আমি ভাবতেও পারিনি, এমনভাবে দস্যু বনহুর…কথা শেষ না করেই থেমে পড়লেন। দেখলেন ক্যাপ্টেন জমরুদী ক্যাবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে। মিঃ আহম্মদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই হাস্য উজ্জ্বল মুখে ক্যাবিনে প্রবেশ করতে করতে বললেন মিঃ জামরুদী–আপনাদের সঙ্গে সঙ্গেই সেও বিচরণ করবে।
সত্যি ক্যাপ্টেন, এ যেন কল্পনার অতীত। আমরা যাকে গ্রেপ্তারের জন্য বন্ধাই চলেছি–সে। আমাদের পূর্বেই এসে পড়েছে মন্থনায়।
এটা শুভ সংবাদ মিঃ আহম্মদ।
হাঁ, শুভ সংবাদই বটে। বন্ধাই যাবার আর প্রয়োজন হলো না। কিন্তু বড় আফসোস দস্যু আমার বন্ধু মিঃ মুখার্জীর সব কিছু হরণ করেছে।
মিঃ জাফরী বলে উঠলেন–নরপিশাচ তাঁর কন্যার বিবাহের গহনা চুরি করে নিয়েছে। এতোটুকু মায়া-মমতা যদি থাকতো!
হাঃ হাঃ হাঃ! দস্যুর মায়া-মমতা…অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন ক্যাপ্টেন জমরুদী।
মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী অবাক হয়ে তাকালেন ক্যাপ্টেন জমরুদীর মুখের দিকে।
ক্যাপ্টেন জমরুদী বললেন–আমি আগামীকল্য জাহাজ মন্থনা দ্বীপ ত্যাগ করবার আদেশ দেবো।
মিঃ আহম্মদ বললেন–ক্যাপ্টেন, আমার অনুরোধ আর কয়েকটা দিন আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।
সম্ভব নয় মিঃ আহম্মদ, কারণ আরোহীরা এতে বিগড়ে যাবে। তাছাড়া মন্থনায় দস্যু বনহুরের আবির্ভাব-সংবাদ প্রচার হবার সঙ্গে সঙ্গে শাহানশাহের’ যাত্রীদের মধ্যে বেশ একটা আতঙ্ক ভাব। দেখা দিয়েছে।
মিঃ জাফরী গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিলেন, তিনি বললেন ক্যাপ্টেন, আপনি দস্যু বনহুরের ভয়ে জাহাজ নিয়ে পালাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন, কিন্তু দস্যু বনহুর যদি আপনার জাহাজেই আপনাকে অনুসরণ করে?
মিঃ জাফরীর কথায় কক্ষমধ্যে ক্ষণিকের জন্য একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করে।
মিঃ জাফরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্যাপ্টেন জমরুদীর মুখে।
ক্যাপ্টেন জমরুদীর মুখোভাব মুহূর্তের জন্য পরিবর্তন হয়, পরক্ষণেই নিজকে সামলে নিয়ে হেসে বলেন–সে কথা অবশ্য মিথ্যা নয় ইন্সপেক্টার। দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই, সে যে কোনো দন্ডে যে কোনো স্থানে আগমন করতে পারে।
মিঃ জাফরীর ভূ কুঞ্চিত হলো, তিনি বললেন–ঠিকই বলেছেন ক্যাপ্টেন, দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই, সে এই মুহূর্তে এখানেও উপস্থিত হতে পারে।
এমন সময় মিঃ মুখার্জী এবং মন্থনার কয়েকজন পুলিশ অফিসার ক্যাবিনে প্রবেশ করলেন।
মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন। মিঃ মুখার্জীর বিবর্ণ মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হলেন তারা। এক রাত্রির ব্যবধান–মিঃ মুখার্জীর বয়স যেন আরও দশ বছর বেড়ে গেছে। চোখমুখ বসে গেছে দুশ্চিন্তায়, ললাটে ফুটে উঠেছে গভীর চিন্তারেখা।
মিঃ আহম্মদ নিজের শোফার পাশের শোফায় বসালেন মিঃ মুখার্জীকে, তিনি ঘটনাটা বিস্তারিত জানতে চাইলেন।
মিঃ জাফরী আগ্রহান্বিতভাবে তাকালেন মিঃ মুখার্জীর দিকে।
অন্যান্য অফিসারগণ নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। ক্যাপ্টেন জমরুদী ক্যাবিন ত্যাগ করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, মিঃ আহম্মদ তাঁকে থাকার জন্য অনুরোধ জানালেন।
জমরুদী কতকটা বাধ্য হয়েই বসলেন ওদিকের শোফায়।
মিঃ আহম্মদ জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ মুখার্জীকে–আপনি বলুন দেখি ঘটনাটা?
মিঃ মুখার্জী যতদূর সম্ভব নিজকে সংযত রেখে বললেন–আহম্মদ, আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। দস্যু আমাকে জীবনে না মারলেও আমাকে নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে।
সব জানতে পেরেছি মুখার্জী; সব সংবাদ পেয়েছি। এমনভাবে দস্যু সব লুটে নিয়ে যাবে– কল্পনার অতীত।
হাঁ, আমি কোনোদিন ভাবতেও পারিনি আমার বাড়িতে দস্যু হানা দেবে। একটু থামলেন মিঃ মুখার্জী, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন–এতো পাহারা থাকা সত্বেও কি করে দস্যু আমার। শয়নকক্ষে প্রবেশে সক্ষম হলো জানি না। হঠাৎ আমার নিদ্রা টুটে গেলো, আমি চোখ মেলে তাকাতেই দেখি জমকালো পোশাক পরিহিত একটি লোক আমার সম্মুখে দন্ডায়মান; হস্তে তার উদ্যত রিভলভার।
ক্যাবিনের সকলেই স্তব্ধ হয়ে শুনছিলেন, মিঃ জাফরী সকলের অলক্ষ্যে একবার ক্যাপ্টেন জমরুদীর মুখে তাকিয়ে দেখে নিলেন।
ক্যাপ্টেন জমরুদী তখন একটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করছিলেন।
মিঃ মুখার্জী বলে চলেছেন–আমি ফোন বা কলিং বেলে হাত রাখতে পারলাম না। দস্যু আমার কাছে সিন্দুকের চাবি চাইলো, আমি বাধ্য হলাম তার কথা অনুযায়ী কাজ করতে। সব নিয়ে তবেই সে বিদায় নিলো।
মিঃ জাফরী বললেন–স্যার, একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে, দয়া করে জবাব দেবেন?
হতাশা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন মিঃ মুখার্জী মিঃ জাফরীর দিকে।
মিঃ জাফরী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–দস্যুর চেহারা নিশ্চয়ই আপনার স্মরণ আছে স্যার?
আছে।
দস্যুর দেহে জমকালো পোশাক ছিলো বলেছেন!
হাঁ, দস্যুর দেহে জমকালো পোশাক ছিলো।
মাথায় টুপী?
না, দেহের পোশাকের মতই কালো পাড়ি ছিলো।
পাগড়ির কিছুটা অংশ….
পাগড়ির কিছুটা কাপড় দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকা ছিলো। কিন্তু তার চোখ দুটো আমি দেখেছি, তীব্র সে চাহনি…একটু থেমে আবার বললেন মিঃ মুখার্জী–দস্যু যে সাধারণ কোনো মানুষ নয় তা আমি বুঝতে পেরেছি…
হাঁ, আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য, দস্যু সাধারণ জন নয়।
মিঃ জাফরীর কথায় বলে উঠেন মিঃ আহম্মদ–আপনার কি মনে হয় দস্যু বনহুর মন্থনায় আগমন করেছে?
শুধু মন্থনা দ্বীপেই নয় আমাদের জাহাজেও যে তার আগমন হয়নি, তা নয়। দস্যু বনহুর আমাদের পিছু নিয়েছে।
মিঃ আহম্মদ বললেন–তাহলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে এসেছে, দস্যু বনহুরকে আমরা মন্থনা দ্বীপেই পেয়ে গেলাম।
হাঁ, এখন কৌশলে তাকে বন্দী করা! কথাটা বলে ফিরে তাকালেন মিঃ জাফরী ক্যাপ্টেন জমরুদীর মুখে, বললেন–ক্যাপ্টেন, কারণবশতঃ আপনাকে ‘শাহানশাহ’ নিয়ে মন্থনায় কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আপনিও আমাদের সাহায্য করবেন। আশা করি।
নিশ্চয়ই করবো, কিন্তু আমার জাহাজের যাত্রীগণ এতে মত করবে কিনা সন্দেহ।
মিঃ জাফরী বললেন–আমি সে দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। যাত্রীদের কাছে আমি আমাদের অসুবিধার কারণ জানিয়ে দেবো।
ধন্যবাদ, আপনি যদি এমন কোনো ব্যবস্থা করে নিতে পারেন তাহলে আমার কোনো অমত নেই।
মিঃ মুখার্জীকে যতটুকু সম্ভব সান্ত্বনা দিতে লাগলেন সবাই।
মন্থনার পুলিশ মহলে সাড়া পড়ে গেলো।
মিঃ আহম্মদ, মিঃ জাফরী দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মন্থনার পুলিশদের সাহায্যে।
মহারাজের মনে শান্তি নেই। সমস্ত মন্থনা দ্বীপের অধিবাসী রাজকুমার প্রদীপের জন্য শোকে মূহ্যমান, এমন দিনে আবির্ভাব হলো সেই দেশে দস্যু বনহুরের। মহারাজ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
রাজসৈন্যদেরও প্রস্তুত রাখা হলো, কখন কোথায় দস্যু বনহুর আবার হানা দিয়ে বসবে কে জানে।
মন্থনাবাসীদের বুকের রক্ত পানি হতে বসেছে, দস্যু বনহুরের মন্থনায় আগমন–এ যেন মহা ভয়ানক এক দুঃসংবাদ।
মন্থনা দ্বীপ ছোট হলেও খুব ক্ষুদ্র নয়। যে কোনো একটি দেশের মতই এর পরিধি। মন্থনা দ্বীপটি দুই ভাগে বিভক্ত। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সারথী নদী। ছোটখাট নদী নয় এটা খুব বড় নদী। জাহাজ-ষ্টিমার, বড় বড় নৌকা সারথী নদীবক্ষে চলাচল করে থাকে।
মন্থনা বন্দর কিন্তু সারথী নদীর ঠিক বিপরীত দিকে। বন্দর ছেড়ে নদীটা প্রায় হাজার মাইল দূরে। মহারাজ জয়কান্তের রাজপ্রাসাদ এই সারথী নদীর তীরে।
মহারাজ সারথী নদীর ধারে তার সৈন্য পাহারায় নিযুক্ত করলেন। কোনো নৌকা বা ষ্টীমার বিনা অনুমতিতে যেন রাজ্যে প্রবেশ করতে না পারে।
সমস্ত মন্থনা দ্বীপে সতর্ক পাহারা মোতায়েন রইলো, দস্যু বনহুর যেন আবার কোথাও হানা দিতে না পারে।
মন্থনা দ্বীপবাসী যখন দস্যু বনহুরের ভয়ে আতঙ্কিত, তখন হঠাৎ একদিন ফিরে এলো প্রদীপ কুমার।
মন্ত্রি চন্দ্রনাথ তাকে মন্থনা হসপিটালে আবিষ্কার করলেন সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন অবস্থায়। মাথায় ভীষণ আঘাত পাওয়ার দরুন প্রদীপ তার স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
মহারাজ জয়কান্ত খবর পেয়ে ছুটে গেলেন মন্থনা হসপিটালে। পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে রোদন করলেন অনেক।
প্রদীপ পিতাকে চিনতে পারলো না।
হসপিটালের সার্জন বললেন–কুমার মাথায় ভীষণ চোট পেয়েছে, অপারেশান হয়েছে একটা কাজেই তার স্বাভাবিক জ্ঞান ফিরে আসতে সময় লাগবে কিছুদিন।
মহারাজ পুত্রকে হসপিটালে রাখা আর উচিৎ মনে করলেন না, তিনি প্রদীপকে নিয়ে এলেন প্রাসাদে।
আবার মন্থনায় আনন্দের স্রোত বইলো কিন্তু স্বাভাবিক শান্তি ফিরলো না, কারণ দস্যু বনহুরের ভয়ে দ্বীপবাসী আতঙ্ক ভরা হৃদয় নিয়ে বসবাস করছে।
একমাত্র রাজকুমারের আগমনবার্তা সর্বত্র প্রচার করা হলো।
মীরা দেবীর মুখে আবার হাসি ফুটলো, সে অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে এলো রাজপ্রাসাদে!
প্রদীপ তার নিজের ঘরে বসেছিলো মুক্ত বাতায়ন পাশে।
মীরা কক্ষে প্রবেশ করে ছুটে গেলো, উচ্ছাসিত কণ্ঠে ডেকে উঠলো সে–প্রদীপ, তুমি ফিরে এসেছে! সুকোমল বাহু দুটি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওর গলা–প্রদীপ!
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো প্রদীপ মীরার মুখের দিকে।
কোনো কথা সে বললো না, বরং আশ্চর্য হলো মীরার আচরণে।
মীরা ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকলো–প্রদীপ! কথা বলছো না কেন? তবু প্রদীপ নিরুত্তর।
মীরা বার বার ডাকলো–প্রদীপ! প্রদীপ…প্রদীপ-কথা বলছো না কেন, বলো? বলো প্রদীপ?এ তুমি কি হয়ে গেছো! মীরা কেঁদে উঠলো ফুঁপিয়ে।
প্রদীপের মুখে চোখে অদ্ভুত একটি ভাব, কিছু যেন স্মরণ করতে চেষ্টা করছে–কিন্তু পারছে না যে! দক্ষিণ হস্তে নিজের চুলগুলি টেনে ধরে উবু হয়ে বসলো।
মীরা ছুটে বেরিয়ে গেলো যেমন এসেছিলো তেমনি করে।
কক্ষের বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন মহারাজ জয়কান্ত এবং মন্ত্রিবর। মীরা পিতার পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো–বাবা, একি হলো, প্রদীপ আমাকে চিনতে পারছে না।
সান্ত্বনা দিয়ে বললেন জয়কান্ত–মা মীরা, প্রদীপ এখন সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন। তার মাথায় ভীষণ আঘাত পাওয়ায় সে এই রকম হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন–প্রদীপের স্বাভাবিক জ্ঞান ফিরে আসতে কিছুদিন সময় লাগবে।
কিন্তু সে যদি আমাকে কোনোদিন চিনতে না পারে?
তোমার ভুল ধারণা মীরা, প্রদীপ কোনোদিন তোমাকে চিনতে ভুল করবে না। বললেন চন্দ্রনাথ।
আমারও তাই মনে হয়। কথাটা বললেন জয়কান্ত।
মীরার মনে তখন অশান্তির ঝড় বয়ে চলেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মীরা।
পুত্রকে ফিরে পেয়েও মহারাজের মনে শান্তি নেই। মহারাণী কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে পড়লেন। রাজপ্রাসাদের শান্তি ফিরে এসেও যেন আসেনি। প্রদীপকে ফিরে পেয়েও যেন কোথায় না পাওয়ার ব্যথা।
মীরা তখন বেরিয়ে গেলেও মন তার বেশিক্ষণ প্রদীপকে ছেড়ে থাকতে পারলো না।
আবার এক সময় এসে দাঁড়ালো মীরা প্রদীপের পাশে।
প্রদীপ আপন মনে শুয়েছিলো বিছানায়, পদশব্দে মুখ তুলে তাকালো–কে?
মীরা। আমি তোমার মীরা।
প্রদীপ আবার বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো।
মীরা বসলো ওর পাশে, পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠলো প্রদীপ।
মীরা গভীর আবেগে ডাকলো–প্রদীপ!
না,আমি প্রদীপ নই। আমি প্রদীপ নই।
প্রদীপ, তুমি আমাকে একবার মীরা বলে ডাকো। লক্ষ্মীটি, তোমার মুখে কতদিন আমি মীরা ডাক শুনিনি। ডাকো–একবার ডাকো মীরা বলে।
প্রদীপ ধীরে ধীরে ফিরে তাকালো, মীরার মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার দৃষ্টি নত করে নিলো।
মীরা উন্মুখ হৃদয় নিয়ে বললো–আমাকে চিনতে পারলে না?
প্রদীপ কোনো জবাব দিলো না।
মীরা ওর মাথার চুলে আংগুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললো–প্রদীপ, শিকারে যাবার সময় তুমি আমাকে কি বলেছিলে? মনে করে দেখো দেখি? স্মরণ করো আমার হাত ধরে বলেছিলে, মীরা তুমিই যে আমার প্রাণ, প্রাণ রেখে আমি দেহটা বয়ে নিয়ে চললাম…উঃ! সব ভুলে গেছো, সব ভুলে গেছো তুমি!
মীরা আবার উচ্ছাসিত ভাবে কেঁদে উঠে।
প্রদীপ শয্যায় উঠে বসে, বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে মীরার সুন্দর কোমল মুখের দিকে।
মীরা কেঁদে কেঁদে শান্ত হয়, তাকায় প্রদীপের দিকে, অন্তরে অতৃপ্ত বাসনা–বুকে ঝড়ের তান্ডব। প্রদীপ তাকে আজও চিনতে পারলো না।
প্রদীপ সরে যায় মীরার পাশ থেকে দূরে মুক্ত জানালার পাশে, তাকায় সীমাহীন আকাশের দিকে।
মীরা এসে দাঁড়ায়, বলে সে–প্রদীপ, চলো বাইরে যাই। হাত ধরে মীরা প্রদীপের।
প্রদীপ আপত্তি করতে পারে না। মীরার সঙ্গে বেরিয়ে যায়। সুন্দর মনোরম বাগান। নানা বর্ণের ফল-ফুলের গাছে বাগানটি ভরে রয়েছে।
মীরা আর প্রদীপ দাঁড়ায় এসে বাগানের মধ্যস্থ একটি সন্ধ্যারাগ ফুলের গাছের নিচে। সন্ধ্যারাগ ফুলের সুরভী নিয়ে সন্ধ্যার বাতাস তখন মত্ত হয়ে রয়েছে।
মীরা ডাকে–প্রদীপ!
প্রদীপ তাকায় মীরার দিকে, কোনো জবাব দেয় না।
মীরা এক থোকা সন্ধ্যারাগ তুলে নিয়ে প্রদীপের হাতে দেয় নাও। মাথাটা এগিয়ে ধরে খুঁজে দাও আমার খোঁপায়।
প্রদীপ চিত্রার্পিতের ন্যায় ফুলটা গুঁজে দিলো মীরার খোঁপায়।
মীরার চোখেমুখে ফুটে উঠলো একটা খুশির উচ্ছ্বাস। মাথা রাখলো প্রদীপের বুকে।
আকাশে চাঁদ হাসছে।
জোছনায় ভরে উঠে সমস্ত বসুন্ধরা।
সন্ধ্যারাগ ফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাগানের চারিদিকে।
মীরা প্রদীপের হাত ধরে বসে পড়ে ঝরনার পাশে।
জোছনার আলোতে ঝরনার পানিগুলি ঝিমিক্ করে উঠে মুক্তবিন্দুর মত। প্রদীপ অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।
মীরা প্রদীপের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে, প্রদীপের হাতখানা হাতের মুঠায় চেপে ধরে ডাকে–প্রদীপ!
প্রদীপের দিক থেকে কোনো সাড়া আসে না।
মীরা উঠে বসে, ব্যস্ত কণ্ঠে বলে–প্রদীপ, এমন করে আর কতদিন আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে কাটাবে বলো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছিনে।
প্রদীপ তেমনি নিরুত্তর।
মীরা বলে–তুমি কি পাষাণ দেবতা? এমনি করে আর কতদিন আমাকে কাঁদাবে? ওগো একবার ডাকো মীরা বলে। একবার তুমি ডাকো!
প্রদীপ অধর দংশন করে, বুকের মধ্যে যেন ঝড় বইছে ওর। মুখোভাবে ফুটে উঠে একটা অস্থিরতা, কিছু যেন স্মরণ করতে চেষ্টা করছে প্রদীপ। ঠোঁট দুখানা নড়ে উঠে ওর, কিন্তু কিছু বলে না–বলতে পারে না সে।
মীরা ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে–প্রদীপ!
প্রদীপ অস্থিরভাবে নিজের চুলে হাত বুলায়…না, কিছু স্মরণ হচ্ছে না ওর। কে সে? মীরাই বা কে?
অনেক করেও প্রদীপ তার সজ্ঞানে ফিরে এলো না।
মন্থনার ডাক্তর কবিরাজ সব হিমসিম খেয়ে গেলো। রাজারাণী কেঁদেকেটে আকুল হলেন, প্রদীপ আজও তার পিতা-মাতাকে চিনতে পারলো না।
মীরা কাছে এলে প্রদীপ কেমন চমকে উঠে। মীরাকে সে কিছুতেই পূর্বের মত করে গ্রহণ করতে পারে না।
মীরাও বুদ্ধিমতি যুবতী, প্রদীপকে সে নতুন করে ফেরাতে চেষ্টা করে। প্রদীপের হৃদয় সিংহাসনে সে নিজকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
প্রদীপকে নিয়ে কখনও সে বাগানে গিয়ে বসে, হাসি-গানে মুখর করে তুলতে চায়। ফুল তুলে মালা গাঁথে, পরিয়ে দেয় প্রদীপের গলায়। কখনও সারথী নদীতে বজরা ভাসিয়ে দেয়, প্রদীপ থাকে মীরার পাশে।
মীরা তার পূর্বের কার্যকলাপ দিয়ে প্রদীপের স্মরণশক্তি ফেরাতে চেষ্টা করে।
সেদিন মীরা প্রদীপসহ সারথী নদীতীরে এসে দাঁড়ালো।
সূর্যাস্তের শেষ রশ্মি তখনও পৃথিবীর বুক থেকে মিলিয়ে যায়নি। সারথী নদীর জল লাল হয়ে উঠেছে। অপূর্ব এক ভাসময় পরিবেশ। অদূরে নদীবক্ষে তাদের বজরা।
মীরা বললো–প্রদীপ, মনে পড়ে সেই আর একদিনের কথা? বজরায় উঠতে গিয়ে পা পিছলে হঠাৎ পড়ে গিয়েছিলাম আমি। তখন তুমি দিশেহারার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে নদীবক্ষে। কত কষ্ট করে সাঁতার কেটে আমাকে তীরে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলে? সেদিন আমি দেখেছিলাম তোমার মধ্যে অপূর্ব এক জ্যোতির্ময় রূপ, যা আজও আমি ভুলতে পারিনি। প্রদীপ কি করে তুমি ভুলে গেলে, বিস্মৃত হল সব? বলো–বলো প্রদীপ–মনে পড়ে কি তোমার সেই সেদিনের কথা?
মাথা নাড়ে প্রদীপ–না!
উঃ! তুমি কি হয়ে গেছো? আমি যে আর সইতে পারছি না। তোমাকে ফিরে পেয়েও আমি আজ তোমাকে যেন সম্পূর্ণভাবে পাইনি। প্রদীপ, প্রদীপ জবাব দাও?
অস্ফুট কণ্ঠে প্রদীপ উচ্চারণ করে–মীরা!
মীরা প্রদীপের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দুটি আঁখি ওর মুদে আসে, আবেগভরা কণ্ঠে বলে– প্রদীপ!
প্রদীপ নিশ্চল নিশ্চুপ।
মীরা বলে–আবার ডাকো আমাকে মীরা বলে। আমি যে তোমার মুখে মীরা ডাক শুনবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।
প্রদীপ আবার বলে–মীরা।
চলো প্রদীপ বজরায় যাই।
চলো।
মীরার আনন্দ আর ধরেনা, কতদিন পর আজ প্রদীপ তার নাম ধরে ডেকেছে। উচ্ছল আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে সে।
প্রদীপের হাত ধরে বজরায় উঠে বসে।
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন নববধুর মত ঘোমটা টেনে দিয়েছে।
বজরা সারথী নদীর বুক চিরে অগ্রসর হয়।
প্রদীপের বুকে হেলান দিয়ে বসে আছে মীরা দৃষ্টি তার সম্মুখস্থ জলরাশির দিকে।
মীরা বলে–প্রদীপ, সেই গানটা আজ গাওনা? যে গান তুমি গাইতে।
গান!
হাঁ সেই গান, যে গান ছিলো তোমার অতি প্রিয়।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ালো প্রদীপ–মনে নেই।
আচ্ছা, আমি গাইছি তুমি শোন। মীরা গান গায়।
তন্ময় হয়ে শোনে প্রদীপ, নির্বাক আঁখি মেলে তাকিয়ে থাকে। পূর্ব আকাশে তখন চাঁদ ভেসে উঠেছে। জ্যোছনার স্নিগ্ধ আলোতে ভরে উঠেছে নদীবক্ষ।
মীরা তার শুভ্র কোমল বাহু দুটি দিয়ে প্রদীপের কণ্ঠ বেষ্টন করে তাকিয়ে বলে–প্রদীপ, তুমি তো এমন ছিলেনা?
মীরা লক্ষ্য করে প্রদীপের নিঃশ্বাস দ্রুত বইছে, নিজকে যেন কিছুতেই প্রকৃতিস্থ রাখতে পারছে না, ধীরে ধীরে ওর হাত দু’খানা মীরার দেহ বেষ্টন করে ধরে ফেলে।
মীরা নিজকে এলিয়ে দেয় প্রদীপের বাহুবন্ধনে।
প্রদীপ আরও নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করে মীরাকে। মীরার হৃদয়ে অভূতপূর্ব এক অনুভূতি নাড়া দিয়ে যায়। ব্যাকুলভাবে তাকায় প্রদীপের মুখের দিকে।
প্রদীপ ওকে মুক্ত করে দেয়– না না, আমি প্রদীপ নই। আমি প্রদীপ নই– দক্ষিণ হাতখানা দিয়ে নিজের চোখ দুটো চেপে ধরে।
মীরার মুখ মুহূর্তে ব্যথায় বেদনায় ম্লান হয়ে উঠে, করুণ কাতর আঁখি দুটি তুলে ধরে প্রদীপের মুখে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বজরার অদূরে দেখা যায় একখানা ছিপনৌকা তর তর করে এগিয়ে আসছে তাদের বজরার দিকে।
একজন মাঝি ছুটে আসে দিদিমনি, একটি ছিপনৌকা এদিকে আসছে। মনে হচ্ছে কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই ছিপনৌকা খানা আসছে।
মীরা আর প্রদীপ উঠে দাঁড়ায়।
মীরা বলে উঠে–আমাদের বজরা দ্রুত চালাও।
কিন্তু মীরার কথামত বজরা দ্রুত চালিয়েও ছিপনৌকার কবল থেকে রক্ষা পেলোনা প্রদীপ আর মীরা।
ছিপ নৌকাখানা অত্যন্ত বেগে আসছিলো, অল্পক্ষণে বজরার নিকটে এসে পড়লো।
বজ্রকঠিন স্বরে ছিপনৌকা থেকে কে যেন বললো–দাঁড়াও নইলে গুলী ছুড়বো।
বজরাখানা থামাতে বাধ্য হলো মাঝিরা।
ছিপনৌকা থেকে একজন জমকালো পোশাক পরিহিত লোক লাফিয়ে নেমে পড়লো বজরার উপর। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তার হস্তস্থিত রিভলভার উদ্যত করে ধরলো, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–তোমাদের হাতের অস্ত্র নদীতে নিক্ষেপ করো। বিলম্ব হলে এক্ষুণি মৃত্যু ঘটবে।
বজরার পাহারাদারগণ নিজ নিজ হস্তস্থিত রাইফেল নিক্ষেপ করলো নদীবক্ষে। তারা প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারলো দস্যু বনহুর তাদের বজরা আক্রমণ করেছে। এবার আর রক্ষা নেই। তাদের। ভয়ে প্রত্যেকের হৃদকম্প শুরু হলো কে কোন দিকে লুকিয়ে পড়লো তার ঠিক নেই।
বজরার ছাদে বসেছিলো প্রদীপ আর মীরা, তারা বজরার সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। মীরা ভয়াতুর কণ্ঠে বললো–প্রদীপ, আর রক্ষে নেই, দস্যু বনহুর আমাদের বজরা আক্রমণ করেছে।
প্রদীপ নিরুত্তর নীরব।
একি, তুমি অমন চুপ করে আছো কেনো, দস্যু বনহুর আমাদের বজরা আক্রমণ করেছে।
মীরা বজরার আলো নিভিয়ে দিলো।
দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই। বজরার মধ্যে প্রবেশ করে রিভলভার উদ্যত করে ধরলো।
মীরা প্রদীপকে আড়াল করে দাঁড়ালো নিজের প্রাণ দিয়ে সে প্রদীপকে রক্ষা করবে। দ্রুত হস্তে নিজের শরীর থেকে অলঙ্কার খুলে এগিয়ে ধরলো–নিয়ে যাও।
হাত বাড়িয়ে মীরার অলঙ্কারের স্তূপ হাতে নিলো দস্যু। তারপর বললো–শুধু অলঙ্কার নিয়েই যাবোনা সুন্দরী, তোমাকেও যেতে হবে আমার সঙ্গে।
মীরা করুণ কণ্ঠে বললো–তুমি আমাকে ক্ষমা করো। যা চাও তাই পাবে, আমাকে রেহাই দাও।
দস্যু মীরার কথায় কান না দিয়ে প্রদীপকে বেঁধে ফেললো। দ্রুত হস্তে, তারপর মীরাকে তুলে নিলো কাঁধে।
বজরার একটি প্রাণীও টু শব্দ করবার সাহসী হলোনা।
প্রদীপকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রাখলো বজরার মধ্যে।
মীরা-হরণ রহস্য পরদিন মঙ্গলা দ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যে ভীষণ এক আতঙ্ক সৃষ্টি করলো। শুধু তাই নয় রাজকুমার প্রদীপকে দস্যু বনহুর বজরার মধ্যে মজবুত করে বেঁধে ফেলে রেখে গেছে। এতবড় সাহস তার!
একি অদ্ভুত কান্ড পর পর ঘটে চলেছে। বন্ধাই-এ গভর্ণর হাউসে হানা দিয়ে দস্যু বনহুর তাঁর সর্বস্ব লুটে নিয়ে গেছে। এমনকি তার কন্যাকেও হরণ করে নিয়ে গেছে সে। আবার মন্থনার পুলিশ সুপার মিঃ মুখার্জীর বাড়ীতে হানা দিয়ে তার কন্যা রীতার বিবাহের মূল্যবান অলঙ্কারাদি সব আত্মসাৎ করেছে। আবার প্রদীপের বজরায় আক্রমণ চালিয়ে প্রদীপকে বন্দী করে, মীরাকে নিয়ে পালিয়েছে।
পুলিশ মহল তো যারপর নাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো। চারিদিকে এতো পাহারা থাকা সত্ত্বেও দস্যু বনহুর এই ভীষণ উপদ্রব আরম্ভ করেছে।
মন্থনাবাসীরা একরকম প্রায় আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলো। এতো পাহারা পরিবেষ্টিত থাকা অবস্থাতেও যখন মীরা দেবীকে বনহুর হরণ করে নিয়ে গেলো, তখন নগরবাসীদের তো কথাই নেই। কখন কার বাড়িতে হানা পড়বে কে জানে, সুন্দরী স্ত্রী-কন্যা নিয়ে সবাই দুরু দুরু বক্ষে কাল যাপন করতে লাগলো।
ক্যাপ্টেন জমরুদী জানিয়ে দিয়েছেন মন্থনায় আর বিলম্ব করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এতে শুধু জাহাজের কর্মচারীদের অসুবিধা হচ্ছেনা, সমস্ত যাত্রীগণ ক্ষেপে উঠেছে। কাজেই অচিরে মন্থনা বন্দর ত্যাগ করতে না পারলে একটা বিভ্রাট দেখা দিতে পারে।
কিন্তু মন্থনা পুলিশ কমিশনার জাহাজ শাহানশাহ’কে বন্দর ত্যাগ করার অনুমতি দিলেন না। তাছাড়া অন্যান্য কোনো জাহাজ মন্থনা বন্দর ত্যাগ করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হলো। কারণ দস্যু বনহুর যে এখন মন্থনা দ্বীপেই আছে সেটা সুনিশ্চিত। মন্থনা দ্বীপ থেকে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যানবাহন চলাচলের সুযোগ ছিলোনা, সমুদ্র পথেই জাহাজ বা ষ্টীমারে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না কোনো।
পুলিশ বিভাগ তাই সজাগ হলেন, কোনো জাহাজ বা জলযান এখন মন্থনা বন্দর ত্যাগ করতে পারবে না।
ক্যাপ্টেন জমরুদী চরম অশ্বস্তি বোধ করলেন, মহা বিপদে পড়লেন তিনি। কিন্তু কোনো উপায় নেই, যতদিন দস্যু বনহুর গ্রেফতার না হয়েছে ততদিন তাকে মন্থনাতেই অপেক্ষা করতে হবে।
মিঃ আহাম্মদ এবং মিঃ জাফরী তাদের দলবল নিয়ে দস্যু বনহুরের সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এটা কান্দাই শহর বা কোনো সমতল ভূমি পূর্ণ দেশ নয়। এটা দ্বীপ, চারিদিকে সাগর আর মাঝখানে মন্থনা দ্বীপ, কেউ গোপনে এখান থেকে পালিয়ে যাবে, তার সাধ্য নেই।
মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী শাহানশাহ’ জাহাজে থেকেই তাদের দলবল নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। ক্যাপ্টেন জমরুদীও এ ব্যাপারে পুলিশ বিভাগকে যথাসাধ্য সাহায্য করে যেতে লাগলেন।
মন্থনা দীপে মন্ত্রিকন্যা মীরার অপহরণ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। প্রদীপকে দস্যু বেঁধে রেখে মীরাকে হরণ করে নিয়ে গেছে–এ কম কথা নয়।
মহারাজা জয়কান্ত এবং মহারাণী প্রদীপকে সুস্থ দেহে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
গভীর রাত।
গাঢ় অন্ধকারে আকাশ আচ্ছন্ন। সন্ধ্যা থেকে আকাশের অবস্থা সচ্ছ নয়। বর্ষণের পূর্বে গভীর। থমথমে ভাব বিরাজ করছে। সাগরবক্ষে শুধুমাত্র জল-কল্লোলের উচ্ছাসিত শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ডেকের উপর খালাসীরা কম্বল মুড়ি দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। যাত্রীগণ যার যার ক্যাবিনে বা বাইরে ডেকে নিদ্রায় মগ্ন। সমস্ত শাহানশাহ’ নীরব নিঝুম।
মিঃ জাফরী তার ক্যাবিনে বসে একখানা বই পড়ছিলেন। মিঃ আহম্মদের ক্যাবিন অন্ধকার, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছেন তিনি।
জাহাজের আর একটি ক্যাবিনেও আলো জ্বলছিলো সেটা ক্যাপ্টেন জমরুদীর ক্যাবিন।
এক পাশে টেবিলে ল্যাম্প জ্বলছে বাইরের শার্শী দিয়ে দেখা যাচ্ছে টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে আছেন ক্যাপ্টেন জমরুদী। তার পিঠের দিকটাই দেখা যাচ্ছে। ক্যাপটা তার মাথায় আছে। ঝুঁকে বসে আছেন জমরুদী। নিশ্চয়ই তিনি কিছু করছেন, টেবিলে একটা ম্যাপ খোলা।
মিঃ জাফরী হাতঘড়ির দিকে তাকালেন, রাত দুটো বিশ। বই রেখে উঠে দাঁড়ালেন, প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলেন রিভলভারখানা ঠিক জায়গায় আছে কিনা। তারপর অতি সতর্কতার সঙ্গে বেরিয়ে এলেন ক্যাবিন থেকে। ক্যাবিনের দরজা সন্তর্পণে খুলে এগিয়ে চললেন মিঃ জাফরী।
অন্ধকারে ডেকের পাশ কেটে এগুতে লাগলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা অগ্রসর হলেন ক্যাপ্টেন জমরুদীর ক্যাবিনের দিকে। দক্ষিণ হস্তে মিঃ জাফরীর গুলীভরা রিভলভার।
জমরুদীর ক্যাবিনের পিছনে শার্শীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন মিঃ জাফরী, উঁকি দিয়ে দেখলেন–টেবিলের পাশে জমরুদী ঝুঁকে বসে একটা কিছু দেখছেন।
জাফরী শার্শির কাঁচে মৃদু আঘাত করলেন।
একবার দু’বার তিনবার –আশ্চর্য! ক্যাপ্টেন জমরুদী একটুও নড়লেন না। যেমন ঝুঁকে বসে কিছু দেখছিলেন তেমনি বসে রইলেন।
মিঃ জাফরী ক্যাবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন। তবু ক্যাপ্টেন জমরুদী তেমনি টেবিলের পাশে বসেই রইলেন একচুল তিনি নড়লেন না।
মিঃ জাফরী সন্তর্পণে মিঃ জমরুদীর পিছন দিকে তাঁর হস্তস্থিত রিভলভারখানা চেপে ধরলেন।
কি আশ্চর্য! তবু জমরুদী নীরব।
মিঃ জাফরী বামহস্তে চেপে ধরলেন ক্যাপ্টেন জমরুদীর কাঁধটা।
সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে হতবাক হলেন, কোথায় ক্যাপ্টেন জমরুদী, একটা কাপড়ের কুন্ডলিকে কোট-টাই পরিয়ে হ্যাট মাথায় দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। মিঃ জাফরী স্তম্ভিত হলেন।
ঠিক্ সেই মুহূর্তে মিঃ জাফরী তার কাঁধে কারো হস্তের স্পর্শ অনুভব করলেন।
চমকে ফিরে তাকাতেই ক্যাপটেন জমরুদী একমুখ হেসে বললেন–থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ জাফরী এতো রাতে আপনি আমার কক্ষে আসবেন ভাবতে পারিনি। বসুন।
মিঃ জাফরী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–ক্যাপ্টেন, আমার সন্দেহ হয়েছিলো–আপনি—
আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই, তাই না?
হাঁ, আপনার কার্যকলাপ আমাকে সন্দিহান করে তুলেছে। বলুন, এতো রাতে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
আপনার প্রশ্নের জবাব আজ দেবো না, দেব পরে।
জবাব আপনাকে আজই দিতে হবে ক্যাপ্টেন।
আপনি কি মনে করেন আমিই দস্যু বনহুর?
আপনাকে গ্রেপ্তার করার পর সে জবাব পাবেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মিঃ জাফরী।
হাঃ হাঃ হাঃ! হেসে উঠলেন ক্যাপ্টেন জমরুদী–বেশ, আমাকে আপনি গ্রেপ্তার করুন।
বলুন, এতো রাতে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
আবার সেইপ্রশ্ন! যদি সঠিক জবাব না দেই?
আপনার কথাতেই আমি বুঝতে পারবো আপনার জবাব সত্য না মিথ্যা।
বেশ, তাহলে বসুন আমি বলছি।
বসতে হবে না, বলুন?
আমিও আপনার মতই দস্যু বনহুরের সন্ধানে মন্থনায় প্রবেশ করেছিলাম।
হেসে উঠলেন মিঃ জাফরী–ছেলে ভুলানো কথা অন্য জায়গায় বলবেন আসল কথা বলুন?
বেশ, আমি আসল কথা বলছি, শুনুন। ক্যাপ্টেন জমরুদী ক্যাবিনের মেঝের একস্থানে পা দিয়ে চাপ দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মেঝেটা ফাঁক হয়ে গেলো, মিঃ জাফরী পড়ে গেলেন একটা গর্তের মধ্যে। মিঃ জাফরী শুনতে পেলেন মুহূর্তের জন্য ক্যাপ্টেন জমরুদীর হাসির শব্দ।
ভোরে শয্যা ত্যাগ করে মিঃ আহম্মদ অন্যান্য দিনের মত বেড টি পান করছিলেন এমন সময় পুলিশ ইনস্পেক্টার মিঃ হোসেন ব্যস্তসমস্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন–গুড মর্নিং স্যার।
গম্ভীর গলায় মিঃ আহম্মদ উচ্চারণ করলেন–গুড মর্নিং।
মিঃ হোসেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন এবার–স্যার, মিঃ জাফরীকে তাঁর ক্যাবিনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মিঃ জাফরী! তা ব্যস্ত হবার কি আছে, নিশ্চয়ই দস্যু বনহুরের সন্ধানে মন্থনা দ্বীপে গেছেন।
না স্যার, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ সব যেমন তেমনি আছে। নাইট ড্রেস তাঁর শরীরে ছিলো।
গম্ভীর গলায় বললেন মিঃ আহম্মদ। তাহলে নাইট ড্রেস পরে তিনি কোথায় গেলেন? নিশ্চয়ই জাহাজে কোথাও আছেন।
সমস্ত জাহাজ খোঁজা হয়েছে কিন্তু তিনি কোথাও নেই।
বলেন কি মিঃ হোসেন?
হাঁ স্যার।
মিঃ আহম্মদের মুখমন্ডল গম্ভীর ভাবাপন্ন হলো, তিনি তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে বললেন– চলুন ক্যাপ্টেনকে শীঘ্র সংবাদটা দেওয়া যাক্।
ক্যাপ্টেন জমরুদী সবেমাত্র শয্যা ত্যাগ করে ডেকের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ঠোঁটের ফাঁকে তার দামী চুরুট। মিঃ আহম্মদকে দেখেই হেসে বললেন–গুড মনিং পুলিশ সুপার। তারপর খবর কি? রাতে আকাশে মেঘ থাকায় গরমটা অত্যন্ত বেশি ছিলো, কাজেই ঘুম হয়নি বুঝি?
মিঃ আহম্মদ ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন বড় দুঃসংবাদ ক্যাপ্টেন বড় দুঃসংবাদ।
দুঃসংবাদ!
হাঁ, মিঃ জাফরীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হয়তো দস্যু বনহুরের সন্ধানে কোথাও ডুব মেরেছেন।
আমিও প্রথমে সেই রকম মনে করেছিলাম কিন্তু তিনি নাইট ড্রেস পরেই—
নাইট ড্রেস পরে!
হাঁ স্যার, নাইট ড্রেসটাই শুধু তাঁর ক্যাবিনে নেই, তা ছাড়া অন্যান্য জামা-কাপড়-টাই সব আছে। কথাগুলো বললেন ইনস্পেক্টর মিঃ হোসেন।
ক্যাপ্টেন জমরুদীর ললাটে চিন্তারেখা ফুটে উঠলো তিনি বললেন–নাইট ড্রেস পরে তিনি গেলেন কোথায়?
অল্পক্ষণের জন্য স্থানটায় নীরবতা বিরাজ করলো।
বললেন আবার ক্যাপ্টেন জমরুদী–পুলিশের লোক, হয়তো কোনো ছদ্মবেশে কোথাও গিয়ে থাকবেন। দেখুন অপেক্ষা করে ফিরে আসেন কিনা।
কিন্তু গোটা দিনটা চলে গেলো মিঃ জাফরী আর ফিরে এলেন না।
পুলিশ মহলে আবার নুতন এক আতঙ্ক দেখা দিলো।
মন্থনার আশে পাশে জলে-স্থলে-জঙ্গলে সব জায়গায় পুলিশ ছুটাছুটি করে ফিরতে লাগলো।
মিঃ আহম্মদ স্বয়ং কয়েকজন পুলিশ অফিসার সহ চষে ফিরতে লাগলেন মন্থনা দ্বীপটা– কোথায় মিঃ জাফরীকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এটাও যে দস্যু বনহুরের কাজ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর একবার মিঃ জাফরী দস্যু বনহুরের হস্তে বন্দী হয়েছিলেন, তারপর থেকে তিনি সব সময় দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু আবার মিঃ জাফরী বন্দী হলেন দস্যু বনহুরের হস্তে।
সমস্ত পুলিশ মহল ক্ষেপে উঠলো ভীষণভাবে। দস্যু বনহুর চরম আকার ধারণ করেছে, তাকে গ্রেপ্তার না করা অবধিস্বস্তি নেই কারো।
শুধু মন্থনা দ্বীপেই নয়, দেশ হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়লো দস্যু বনহুরের এই দুর্দান্ত অভিযান-সংবাদ।
পত্রিকায় পত্রিকায় প্রকাশ পেলো, দস্যু বনহুর নবোদ্দমে আবার আত্মপ্রকাশ করেছে।
কান্দাই শহরে মনিরা এ সংবাদ পাঠ করে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লো। মা মরিয়ম বেগমও দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়লেন–না জানি তার মনির কখন কোন্ বিপদে পড়বে কখন কোথায় আহত বা নিহত হবে।
মনিরা পুত্র নূরকে বুকে চেপে ধরে স্বামীর স্মৃতি স্মরণ করতে লাগলো। একমাত্র খোদার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া কোনো উপায় রইলো না তাদের।
রহমান মাঝে মাঝে এসে সংবাদ নিতো, বেশ কিছুদিন হলো সেও আর আসে না। বড় অস্বস্তি বোধ করে মনিরা। চিরজীবন সে কেঁদে এসেছে; এখন চোখেও আর পানি আসে না। মনিরা স্বামীর জন্য সব ত্যাগ করেছে, জীবনের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়েছে।
প্রতিদিন মনিরা স্বামীর অপেক্ষায় প্রহর গুণে, না জানি কখন এসে দাঁড়াবে তার সম্মুখে। কিন্তু দিন যায় রাত আসে, গোটা রাত বিছানায় ছটফট করে কাটায়। ঘুমন্ত নূরকে বুকে চেপে ধরে আকুল হয়ে কাঁদে। এক সময় ভোর হয়ে যায়। মনিরার অবশ চোখের পাতা মুদে আসে।
নূর আজকাল নিয়মিত স্কুলে যায়।
সরকার সাহেব যান তার সঙ্গে। রোজ ড্রাইভার গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসে, আবার নিয়ে আসে তাকে। পড়াশোনায় স্কুলে প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে নূর। তার সুন্দর চেহারায় সবাই মুগ্ধ।
স্কুল মাষ্টারগণ নূরকে অত্যন্ত স্নেহ করে, ভালবাসে।
কিন্তু স্কুলের মাষ্টারগণ জানে না–এটা কারে সন্তান!
বৃদ্ধ সরকার সাহেবই নূরের অভিভাবক হিসাবে থাকেন।
নূর সরকার সাহেবকে দাদু বলে ডাকে। সর্দা-সর্বদা সরকার সাহেবের নিকটেই যত কিছু আবদার করে, কখনও কোলে, কখনও কাঁধে চেপে নানারকম প্রশ্নে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
নূরকে নিয়ে ভুলে থাকে চৌধুরী বাড়ির লোকজন তাদের অন্তরের গোপন ব্যথা।
আজ কদিন হলো প্রদীপ যেন একটু অন্যরকম হয়ে উঠেছে। ডাক্তার বলেছেন–আর কিছুদিনের মধ্যেই প্রদীপ তার স্বাভাবিক জ্ঞান লাভ করবে।
প্রদীপ আগে ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকতো কেউ কোনো প্রশ্ন করলে সহজে জবাব দিতোনা। কথা বলতো কিন্তু অত্যন্ত কম। খেতো–কিন্তু যেন তাকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে।
ডাক্তারের কথায় মহারাজ জয়কান্তের মনে খুশির বান বয়ে যায়। মহারাণী কালীমন্দিরে জোড়া বলি দেবেন মানত করেন।
শুধু শান্তি নেই মন্ত্রি চন্দ্রনাথের মনে। একমাত্র মীরাকে হারিয়ে তিনি সংসার অন্ধকারময় দেখছেন। কোনো কাজে তিনি মনোযোগ দিতে পারছেন না, অশান্তি আর বেদনায় হৃদয়টা যেন তাঁর বিষিয়ে উঠেছে।
বৃদ্ধ মন্ত্রির এই অবস্থায় রাজপরিবারেও শান্তি নেই, ভাবী পুত্রবধু মীরার অন্তর্ধানে রাজবাড়ি কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। যেমন ফুল বিহনে বাগান অন্ধকার তেমনি। মন্ত্রিকন্যা হলেও মীরা সব সময় যেতো রাজবাড়িতে; প্রদীপ ছাড়া মীরা এক দন্ড থাকতে পারতোনা। প্রদীপও তেমনি ভালবাসতো মীরাকে।
প্রদীপ আর মীরার প্রেমানন্দে মুখর হয়ে উঠেছিলো সমস্ত মন্থনা দ্বীপ।
হঠাৎ আলো নিভে গেলে কক্ষ যেমন অন্ধকারময় হয়ে উঠে তেমনি প্রদীপ আর মীরার জীবন আকাশের ঘনঘটা নিরানন্দে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে সমস্ত দ্বীপবাসীর অন্তর।
শুধু তাই নয়, প্রদীপ আর মীরার মধ্যে যখন একটা মহাঝঞ্ঝা বয়ে চলেছে, এমন দিনে। আবির্ভাব হলো দস্যু বনহুরের। শুধু দস্যুতা করেই ক্ষান্ত হলোনা সে, হরণ করলো মন্ত্রিকন্যা মীরাকে। দুর্দান্ত দস্যুর এ অমানুষিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো মন্থনা দ্বীপবাসী। সবাই স্ত্রী কন্যা-ভগ্নি নিয়ে আতঙ্কে দিন যাপন করতে লাগলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ জাফরীর নিরুদ্দেশ। একা মহা আশঙ্কার সৃষ্টি করলো। অহরহ পুলিশ মন্থনা দ্বীপকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
মন্থনার কোনো লোকের মনে শান্তি নেই। অশান্তির বহ্নিজ্বালা তাদের নিষ্পেষিত করে চলেছে। সবাই দস্যু বনহুরের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত।
মীরা চোখ মেলে তাকালো, বিস্ময়ে আরষ্ট হয়ে গেলো সে। বিছানায় উঠে বসলো, সে কি স্বপ্ন দেখছে! চোখ মেলতেই মীরা দেখতে পেলো প্রদীপের ছবিখানা। এযে তার নিজের কক্ষ।
মীরা নিজের শরীর চিটি কেটে বুঝতে পারলো সে স্বপ্ন দেখছেনা।
শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো।
পাশের মুক্ত জানালা খুলে দিতেই এক হাল্কা ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া তার শরীরে মধুর পরশ বুলিয়ে গেলো। মীরা বুঝতে পারলো, ভোর হয়েছে।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো, তখনও বাড়ির কেউ জেগে উঠেনি। মীরা আনন্দে উচ্ছল হয়ে ছুটে গেলো, পিতা মাতার বন্ধ দরজায় আঘাত করে ডাকালো–বাবা, বাবা, মা, মাগো– মা, মা আমি এসেছি–
কন্যার কণ্ঠস্বর কানে যেতেই ধড়মড় করে শয্যায় উঠে বসেন মন্ত্রি চন্দ্রনাথ, স্ত্রীকে ডেকে বলেন–কে ডাকে দেখোত! ঠিক মীরার গলা বলে মনে হচ্ছে যে?
মীরা! আমার মীরা ফিরে এসেছে! তাড়াতাড়ি মন্ত্রিপত্নী লতারাণী দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। কন্যাকে সুস্থ দেহে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকেন–মীরা!
মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে–মা, মাগো।
ততক্ষণে মন্ত্রি চন্দ্রনাথ এসে দাঁড়িয়েছেন কন্যা এবং স্ত্রীর পাশে।
মন্ত্রি চন্দ্রনাথ বলেন–মীরা কি করে ফিরে এলি মা?
বাবা, সব বলছি, চলো।
চল্ মা, চল্ কিন্তু দস্যু তোকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, প্রদীপকি আর তোকে ফিরে নেবে?
বাবা, তোমরা শুনে আশ্চর্য হবে, দস্যু আমাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো সত্য, কিন্তু আমাকে সে স্পর্শ করেনি বাবা। দস্যু হলেও তার মত মহৎ আমি দেখিনি। তুমি বিশ্বাস করো বাবা, আমি সেখানে এতটুকু কষ্ট পাইনি। আমাকে সেখানে রাজকন্যার মত রাখা হয়েছিলো।
তাহলে তোকে চুরি করে নিয়ে যাবার কারণ কি ছিলো দস্যুর?
জানিনে বাবা। কিন্তু এইটুকুই জানি, দস্যু অতি মহৎ প্রাণ। আমার যে অলঙ্কারগুলি নিয়েছিলো সব ফেরৎ দিয়েছে।
সত্য বলছিস মীরা? বললেন লতা দেবী।
মীরা তার শরীরের দিকে তাকিয়ে সব অলঙ্কার দেখালো।
মন্ত্রি চন্দ্রনাথের চোখে মুখে বিস্ময়!
লতাদেবীর খুশিতে মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বললেন তিনি–মা মীরা তোকে ফিরে পাবো সে আশা আমার ছিলোনা। আমি অবাক হচ্ছি দস্যু তোর গহনাগুলো কেড়ে নেয়নি।
মা, আমিও প্রথম ভেবেছিলাম দস্যু আমার উপর না জানি কত উপদ্রব করবে কিন্তু–কিন্তু আমাকে সে বোনের মত দেখেছে।
সব ঘটনা খুলে বল্ মা, আমি যে সব শুনতে চাই? বললেন চন্দ্রনাথ। মীরা পিতামাতা সহ কক্ষে গিয়ে বসলো।
মীরা বললো–বাবা, প্রদীপকে বেঁধে রেখে দস্যু যখন আমাকে কাঁধে উঠিয়ে নিলো তখন আমি হাত-পা ছুঁড়ে নিজকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু দস্যুর বলিষ্ঠ বাহু থেকে আমি মুক্তি পেলাম না।
মীরা বলে চললো মন্ত্রি এবং মন্ত্রিপত্নী সব মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলেন।
মীরা বলে চলেছে–একটা ছিপনৌকায় আমাকে নামিয়ে রেখে দস্যু গম্ভীর গলায় বললো, খবরদার নড়বে না, নড়লেই পড়ে যাবে নদীতে। আমি তোমাকে কিছু বলবোনা, তুমি চুপ করে বসে থাকো। আমি দস্যুর কথায় চোখ তুলে তাকালাম দেখলাম লোকটার শরীরে কালো পরিচ্ছদ মুখে কালো মুখোস–কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেমন দেখতে লোকটা তাও দেখতে পেলাম না। কিন্তু আমি আশ্বস্ত হলাম তার কথায়। নদীতে ঝাঁপিয়ে না পড়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম তার পরবর্তী কার্যের জন্য। কিন্তু আমি অবাক হলাম একটা মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে লাগলো ঠিক কোনো অজানা ফুলের সুরভীর মত।
তারপর? বললেন চন্দ্রনাথ।
তারপর আমি ধীরে ধীরে নৌকাখানার উপরে ঢলে পড়লাম আর মনে নেই।
মীরা, দস্যু তোকে অজ্ঞান করেছিলো?
হাঁ মা, তারপর যখন জ্ঞান হলো চেয়ে দেখি সুন্দর সুসজ্জিত একটি কক্ষে সজ্জিত বিছানায় শুয়ে আছি। বিছানায় উঠে বসতেই একটি বৃদ্ধলোক আমাকে দুধ আর ফলমূল খেতে দিলো। আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, এখন আমি কোথায়? বৃদ্ধলোকটি বললো, তুমি ভাল জায়গায় আছো এ সব খেয়ে বিশ্রাম করো। আমি কাঁদাকাটা শুরু করলাম, যখন কিছু মুখে দিলাম না, তখন এক সময় সেই লোকটি এলো, যার মুখমণ্ডল আমি কোনো সময় দেখতে পাইনি। কালো আবরণে তার মুখ ঢাকা ছিলো। সে বললো, তোমাকে আমি কিছুদিন এখানে আটকে রাখবো তারপর আবার তুমি ফিরে যাবে তোমার প্রিয় রাজকুমারের পাশে। আমি তার কথা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, সে যা বলেছে সব সত্য।
তোকে সে নিজেই রেখে গেছে?
না মা, আমি রাতে আমার সেই কক্ষে ঘুমিয়েছিলাম। ভোরে জেগে দেখি আমি এখানে–
চন্দ্রনাথ বিজ্ঞেরমত মাথা দুলিয়ে বললেন–দস্যু বনহুর ছাড়া এটা অন্য কারো কাজ নয়। শুনেছি দস্যু বনহুর নাকি শুধু মহৎই নয় তার অন্তর অত্যন্ত উঁচু।
মা, প্রদীপ কেমন আছে?
আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ হয়েছে সে।
আমি তার সঙ্গে দেখা করে আসি।
যাও মা, যাও–বললেন চন্দ্রনাথ।
মীরা ছুটে গেলো চঞ্চল হরিণীর মত।
প্রাতঃভ্রমণ করছিলো প্রদীপ তাদের বাগানের মধ্যে। পায়চারী করছিলো আর গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিলো।
মীরা ছুটে এলো, প্রদীপকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে–প্রদীপ!
প্রদীপ নীরব, পাথরের মূর্তির মত স্থির।
মীরা ব্যাকুল কণ্ঠে বললো–প্রদীপ, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছোনা? কথা বলো, কথা বলো প্রদীপ?
প্রদীপ তবুও নিরুত্তর।
মীরা প্রদীপের জামার আস্তিন ধরে ঝাঁকুনি দেয়–কথা বলছেনা কেনো? তুমি কোনেদিন আমাকে অবিশ্বাস করবে না, করতে পারবেনা। প্রদীপ, আমি যে তোমার–তোমারই আছি।
মীরা।
বলো? বলো কি বলতে চাও?
আমি কে মীরা?
একি কথা বলছো প্রদীপ? তুমি আমার প্রদীপ।
না না মীরা, আমি প্রদীপ নই। আমি প্রদীপ নই—
চুপ করো, চুপ করো প্রদীপ। আশ্চর্য তুমি মানুষ। কতদিন পর ফিরে এলাম অথচ তুমি আমাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলে না। দস্যু আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে আমি কেমন ছিলাম তাও তুমি জানতে চাইলে না? প্রদীপ এ কদিন আমি শুধু তোকেই ধ্যান করেছি, তোমার ঐ মুখখানা আমি মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারিনি। প্রদীপ, চলো প্রাসাদে যাই, তোমার বাবা মা আমাকে সচ্ছ মনে গ্রহণ করবেন কিনা জানিনে। যদি তারা আমাকে সন্দেহ করে তাহলে কি হবে প্রদীপ?
আমি তো তোমাকে গ্রহণ করেছি মীরা।
প্রদীপের কথায় মীরার চোখদুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে, বলে সেই আজ আমার কি আনন্দ! কি আনন্দ প্রদীপ! কেমন করে তোমাকে বোঝারো! মীরা প্রদীপের বুকে মাথা রাখে।
প্রদীপ ওকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করতে যায় সঙ্গে সঙ্গে মীরাকে মুক্ত করে দিয়ে বলে না না মীরা, তুমি যাও। তুমি যাও মীরা।
কেনো তুমি অমন করছো?
প্রদীপ দক্ষিণ হাতের আংগুলে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে, অধর দংশন করে বার বার।
মীরা লক্ষ্য করলো, প্রদীপের মুখমন্ডল কেমন যেন বিবর্ণ লাগছে।
মীরা বললো–প্রদীপ, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো?
হাঁ, আমি বড় অসুস্থ বোধ করছি। মীরা আমাকে একা থাকতে দাও। আমাকে একা থাকতে দাও–
প্রদীপ! প্র
দীপ তখন বসে পড়েছে বাগানস্থ পাথরাসনে।
মীরা বসে ওর চুলে-পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মীরার মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ ভেসে উঠেছে।
যে প্রদীপ তার সঙ্গ ছাড়া একমুহূর্ত বাঁচতো না, আজ সেই প্রদীপ তাকে চলে যাবার জন্য। বলতে পারছে! মীরার অন্তরে একটা ব্যাথার খোঁচা লাগে। কিন্তু সে প্রদীপের কথা মত চলে গেলো না; মীরা জানে প্রদীপ মাথায় আঘাত পাওয়ার দরুণ তার স্মৃতি বিস্মৃতি ঘটেছে। মীরা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো, প্রদীপের পিঠে মাথা রেখে বললো–প্রদীপ, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না। আমি যে তোমার। তুমি ছাড়া মীরা বাঁচতে পারে না।
প্রদীপ কোনো জবাব দেয়না, ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মীরার দিকে।
মীরা এগিয়ে আসে প্রদীপের পাশে, মুখটা তুলে ধরে তার চোখের সম্মুখে, বলে মীরা–অমন করে আমার মুখে তাকিয়ে কি দেখছো প্রদীপ?
কিছু না মীরা। কিছু না!
প্রদীপ, তুমি যেন আগের সেই প্রদীপ নেই, কেমন যেন হয়ে গেছে। কোনোদিন কি তুমি আমাকে আগের মত করে বুকে টেনে নিতে পারবে না? সেই আবেগ মধুর কন্ঠে ডাকতে পারবে না মীরা বলে! কেন কেন তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছো?
জানি না।
প্রদীপ, ডাক্তার বলেছিলো তোমার স্মৃতি বিস্মৃতি ঘটেছে।
হয়তো তাই হবে।
আগের কথা তুমি স্মরণ করতে চেষ্টা করো?
পারছি না। পারছি না কোনো কথা স্মরণ করতে।
আমি কে আমাকে তুমি আজও চিনতে পারোনি?
না।
উঃ! মীরা দু’হাতে বুক চেপে ধরলো, তারপর ছুটে চলে গেলো সেখান থেকে!
প্রদীপ মীরার অদ্ভুত আচরণে আশ্চর্য হলোনা। ওর চলে যাওয়া পাথর দিকে তাকিয়ে কি যেন। গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো।
মিঃ আহম্মদ কয়েকজন পুলিশ অফিসার ও সশস্ত্র পুলিশ মন্থনা গিয়ে দ্বীপের আশে পাশে পাহাড়ে জঙ্গলে সন্ধান করে চললেন।
গহন জঙ্গল।
দ্বীপের মধ্যে একজন একটা জঙ্গল থাকতে পারে প্রথমে ভাবতেই পারেনি মিঃ আহম্মদ। তিনি দলবল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। জঙ্গলের এদিকটা মানুষ প্রবেশে সক্ষম নয়। তবু অনেক কষ্টে মিঃ আহম্মদ চলেছেন সাথীদের নিয়ে।
এ জঙ্গলটা মন্থনার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। বড় বড় শাল আর সেগুন গাছে জঙ্গলটা ঘন হয়ে উঠেছে। বন্য জীবজন্তুর অভাব নেই। সাবধানে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছেন মিঃ আহম্মদ তাঁর দলবল নিয়ে।
একটা ব্যাপারে আহম্মদ সাহেব আজ অনেকটা আশ্বস্ত হতে পেরেছেন গত কয়েকদিন পূর্বে মন্ত্রিকন্যা মীরা ফিরে এসেছে। মীরার জবানবন্দীতে জানতে পেরেছেন–দস্যু তাকে হরণ করে নিয়ে গেলেও সে তার উপর কোনোরকম খারাপ আচরণ করেনি। মীরার মুখে আরও জেনেছেন–দস্যুর যে বর্ণনা সে দিয়েছে তাতে বোঝা যায়, দস্যু বনহুরেরই এ কাজ। তাতে মিঃ আহম্মদ বদ্ধপরিকর হয়েছেন, মন্থনায় বসে দস্যু বনহুর তার কার্য সমাধা করে চলেছে; এবং মিঃ জাফরীকেও সে-ই বন্দী করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মিঃ আহম্মদ বিপুল বিক্রমে তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মিঃ মুখার্জী মন্থনার পুলিশ বাহিনী নিয়ে তাঁকে সর্বান্তকরণে সাহায্য করে চলেছেন। এটা তাঁরও কর্তব্য।
আজ মন্থনা দ্বীপের শেষ প্রান্তে তারা এসে পৌঁছেছেন, মন্থনা শহর ছেড়ে প্রায় একশত মাইল। দূরে এ জঙ্গল।
মিঃ জাফরী এবং মিঃ মুখার্জী তাদের পুলিশ বাহিনী নিয়ে জঙ্গলটা চষে বেড়াচ্ছেন তাঁদের ধারণা–এ জঙ্গলেই কোথাও দস্যু বনহুর তার আস্তানা গেড়েছে।
সমস্ত বনে সন্ধান চালাতে পুরো তিন দিন কেটে গেলো। পুলিশ অফিসার গণ কেউ কেউ বাঘ এবং হরিণ শিকার করলেন। মস্ত বড় একটা অজগর সাপ শিকার করলেন মিঃ আহম্মদ তৃতীয় দিনে!
অজগর সাপটা মারলেন তাঁরা জঙ্গলের উত্তর-দক্ষিণ অঞ্চলের শেষ প্রান্তে। বিরাট অজগর, একটা গাছের গুঁড়ির মত গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিলো, হয়তো বা শিকারের সন্ধানে সর্পরাজ চলেছিলেন মন্থর গমনে।
অজগর সাপটাকে নিহত করার পর পুলিশ বাহিনী সাপটাকে ঘিরে ধরে দেখছিলেন এমন সময় হঠাৎ একজনের দৃষ্টি চলে গেলো দূরে অনেক দূরে একটা নদীর তীরে। ঝোপ-জঙ্গলের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে একটি জমকালো পোশাক-পরা লোক নদী-তীরে এগিয়ে যাচ্ছে। পিঠের সঙ্গে লোকটার রাইফেল বা বন্দুক জাতীয় কিছু বাঁধা রয়েছে। লোকটি দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মিঃ আহম্মদের।
মিঃ আহম্মদ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা বের করে চোখে লাগিয়ে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চাপা কণ্ঠে বললেন–পেয়েছি, আমরা যাকে সন্ধান করে ফিরছি সেই দুর্দান্ত দস্যু বনহুর। দূরবীক্ষণে চোখ লাগিয়ে স্পষ্ট দেখলেন–জমকালো পোশাক-পরা মাথায় পাগড়ি লোকটা নদীর ধরে হাটু গেড়ে বসে দু’হাতে পানি পান করছে।
মিঃ আহম্মদ ইংগিৎ করলেন সমস্ত পুলিশ বাহিনীকে প্রস্তুত হয়ে নিতে। তাঁর চোখ দুটো আগুনের গোলার মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে যেন।
মুহূর্তে সমস্ত পুলিশ বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে পড়লো। তারপর দ্রুত অগ্রসর হলো ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে।
মিঃ আহম্মদ দলবল নিয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলো তাদের নির্দিষ্ট স্থানে।
নদীতীরে পানি পান করে একটা বৃক্ষতলে এসে কেবলমাত্র বসেছে দস্যু বনহুর।
চারিদিক থেকে অস্ত্র উদ্যত করে পুলিশ বাহিনী তাকে ঘিরে ধরলো। মিঃ আহম্মদ কঠিন বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বললেন–খবরদার নড়োনা। এক চুল নড়লেই মরবে।
মিঃ আহম্মদের রিভলভার দস্যু বনহুরের বুক লক্ষ্য করে উদ্যত রয়েছে–চারিদিকে অসংখ্য রাইফেল আর পিস্তল।
বনহুর উঠে দাঁড়ালো হঠাৎ এভাবে আক্রমণের জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা।
মিঃ আহম্মদ তার দলবলকে ইংগিৎ করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে মিঃ মুখার্জী স্বহস্তে দস্যু বনহুর হস্তে হাত কড়া পরিয়ে দিলেন। দস্যু বনহুরকে একটি শব্দও উচ্চারণ করবার সময় না দিয়ে তাকে মজবুত করে বেঁধে ফেলা হলো।
দস্যু বনহুর বন্দী হওয়ায় মন্থনা দ্বীপে এক মহা আনন্দ স্রোত বয়ে চললো। নগরের সৌধচূড়ায় বড় বড় অক্ষরে লেখা “দস্যু বনহুরের কবল থেকে মন্থনা দ্বীপের মুক্তি।
আবার মন্থনায় ফিরে এলো স্বাভাবিক স্বস্তি। দ্বীপবাসী নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো এবার।
বহুদিন ধরে যে সব জলযান মন্থনা বন্দরে অবস্থান করছিলো সবগুলিকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলো।
শাহানশাহ’ জাহাজ ঘটা করে মন্থনা বন্দর ত্যাগ করলো। মিঃ আহম্মদ এবং অন্যান্য পুলিশ বাহিনী দস্যু বনহুরকে বন্দী করে জাহাজ রকেটে কান্দাই অভিমুখে রওয়ানা দিলো।
‘রকেট অতি দ্রুতগামী মজবুত জাহাজ। দস্যু বনহুরের জন্য এই জাহাজেরই প্রয়োজন।
মিঃ আহম্মদ পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ জাফরীর জন্য অত্যন্ত ব্যথা অনুভব করলেন, কিন্তু তিনি আর মন্থনায় বিলম্ব করতে পারলেন না। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করেছেন, সে এখন তাদের হাতে বন্দী, এ অবস্থায় আর দেরী করা উচিৎ নয়। কান্দাই-এ হাঙ্গেরী কারাগার ছাড়া বনহুরকে আটকে রাখার মত আর কেনো কারাগার ছিলো না।
কিন্তু মিঃ আহম্মদ যে মুহূর্তে মন্থনা দ্বীপ ত্যাগ করবেন ঠিক সেই মুহূর্তে কান্দাই থেকে মিঃ আহম্মদের নিকটে তারাবার্তা এলো। আশ্চর্য হলেন তিনি তারবার্তা পেয়ে। কান্দাই থেকে মিঃ জাফরী তাঁকে এ তার পাঠিয়েছেন, জাহাজ ‘শাহান শাহ’কে আটক করার জন্য তিনি। জানিয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন জমরুদীকে যেন বন্দী করা হয়।
মিঃ আহম্মদ যখন কান্দাই থেকে মিঃ জাফরীর তারবার্তা পেলেন তখন শাহনশাহ’ মাঝ দরিয়ায়।
মিঃ আহম্মদ তারবার্তা সম্বন্ধে মিঃ মুখার্জীকে সব খুলে বলেন, এবং একখানা ষ্টীমার নিয়ে শাহানশাহ’কে ফলো করবার জন্য নির্দেশ দিলেন। আরও জানালেন শাহনশাহে’র ক্যাপ্টেন জমরুদীকে যেন বন্দী করা হয়। তিনি নিজেই শাহনশাহ’কে অনুসরণ করতেন, কিন্তু দস্যু বনহুরকে বন্দী করতে পেরেছেন এটাই তার সৌভাগ্য, বিশেষ করে দস্যুকে নিয়ে মন্থনায় আর একটি দিনও অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
মিঃ আহম্মদ ‘রকেটে’ দস্যু বনহুরকে বন্দী করে নিয়ে কান্দাই-এর পথে রওয়ানা দিলেন।
দস্যু বনহুরকে বন্দী করা কম কথা নয়, সেই দস্যুকে বন্দী করে নিয়ে ফিরে চলেছেন মিঃ আহম্মদ তার দলবল নিয়ে। মজবুত লৌহশিকলে বনহুরের দেহ শৃঙ্খলাবদ্ধ। এবার আহম্মদ সাহেব ভুল করেননি, পা এবং হাত লৌহশিকলে আবদ্ধ করেছেন যেন কোনোরকমে পালাতে। সক্ষম না হয়।
‘রকেটের একটি সুদৃঢ় ক্যাবিনে তাকে আটক করে রাখা হয়েছে। ক্যাবিনের দরজার আশে পাশে সশস্ত্র পুলিশ সদা দন্ডায়মান। এবার যেন কোনো রকম সুযোগ না পায় যে ফাঁকে সে। পালাতে পারে।
মিঃ আহম্মদের মনে আনন্দ–এবার তার যাত্রা সাফল্য মন্ডিত হলো। নিজে তিনি দস্যুসম্রাট বনহুরকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছেন।
পৌঁছানোর পূর্বেই মিঃ আহম্মদ কান্দাই পুলিশ অফিসে খবর পাঠিয়েছেন, দস্যু বনহুরকে নিয়ে তিনি কান্দাই অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছেন।
দস্যু বনহুর সহ ‘রকেট’ তার গন্তব্যস্থান কান্দাই বন্দরে পৌঁছে গেলো।
মিঃ আহম্মদ যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। দস্যু বনহুরকে নিয়ে তিনি ভালোয় ভালোয় কান্দাই এসে পৌঁছতে পেরেছেন।
বন্দরে অবতরণ করতেই দেখলেন মিঃ আহম্মদ মিঃ জাফরী অসংখ্য পুলিশ ফোর্স নিয়ে বন্দরে অপেক্ষা করছেন। মিঃ আহম্মদ জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে আনন্দের আতিশয্যে। কেমন করে তিনি কান্দাই এলেন এবং কি ব্যাপার সব জানতে চাইলেন।
মিঃ জাফরী নিজের কথা বলার পূর্বে ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন শাহনশাহ’ জাহাজটিকে আটক করা হয়েছে কিনা এবং ক্যাপ্টেন জমরুদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা।
মিঃ আহম্মদ জানালেন, কান্দাই থেকে তারবার্তা পাওয়ার পূর্বেই শাহানশাহ’ মন্থনা বন্দর ত্যাগ করেছিলো, কাজেই মিঃ জাফরীর কথামত কাজ করতে সক্ষম হয়নি তারা। মন্থনার পুলিশ। বাহিনী ষ্টিমার যোগে শাহনশাহ’কে অনুসরণ করেছেন। মিঃ মুখার্জী স্বয়ং এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, নিশ্চয়ই সফলকাম হবেন।
মিঃ জাফরী এ ব্যাপারে কতখানি আশ্বস্ত হলেন তিনিই জানেন। মিঃ জাফরীর মনে একটা সন্দেহ দোলা দিচ্ছিলো, ক্যাপ্টেন জমরুদী যে স্বাভাবিক কোনো মানুষ নয়, সেই যে দস্যু বনহুর এমনি একটা ধারণা তাঁর মনে সুদৃঢ় হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু যখন মিঃ আহম্মদ দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলেন, অথচ শাহানশাহ’তে ক্যাপ্টেন জমরুদী বন্ধাই অভিমুখে চলেছে। জানতে পারলেন তখন তিনি একটু চিন্তায় পড়লেন তবে ক্যাপ্টেন জমরুদী লোকটা কে?
মিঃ আহম্মদকে তিনি সংক্ষেপে বললেন তার বন্দী হবার কাহিনী। শাহানশাহে’র একটি চোরা কুঠরীতে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো এবং সেখানেই তিনি বেশ কিছুদিন বন্দী অবস্থায় ছিলেন, তার উপর কোনো রকম অত্যচার বা উৎপীড়ন করা হয়নি।
মিঃ জাফরীর কথা শুনে মিঃ আহম্মদ অবাক হলেন, তাঁরা যে জাহাজে ছিলেন সেই জাহাজেই বন্দী ছিলেন মিঃ জাফরী এ যেন তাদের কল্পনার অতীত।
মিঃ জাফরী আরও বললেন–একদিন আমি নিদ্রাভঙ্গের পর হঠাৎ চোখ মেলে দেখি, আমি কান্দাই-এ আমার কক্ষে ঘুমিয়ে আছি। আশ্চর্য, আমাকে শয়তান কিভাবে ঘুম পাড়িয়ে সুদূর মন্থনা দ্বীপ হতে কান্দাই নিয়ে এসেছিলো, এতটুকু আমি জানতে পারিনি। কিন্তু আমি সন্দেহ করেছিলাম ক্যাপ্টেন জমরুদীই দস্যু বনহুর। তার কার্যকলাপে সেই রকম আমার মনে হয়েছিলো। এখন দেখছি জমরুদী পৃথক জন।
কিন্তু মিঃ জাফরীর সন্দেহ সত্যে পরিণত হলো দস্যু বনহুরকে কারাগারে বন্দী করার পর।
মিঃ মুখার্জী তার পাঠিয়েছেন, শাহানশাহ’ জাহাজটিকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আশ্চর্য! ক্যাপ্টেন জমরুদী উধাও হয়েছে! জাহাজের দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন লোহানী জানিয়েছেন তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় মন্থনা দ্বীপেই রয়ে গেছেন।
মিঃ জাফরী মিঃ মুখার্জীর তারবার্তা পেয়ে বুঝতে পারলেন দস্যু বনহুরই ক্যাপ্টেন জমরুদী এবং জমরুদীই দস্যু বনহুর। দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারের মাধ্যমেই লুকানো রয়েছে জমরুদীর অন্তর্ধান।
সমস্ত কান্দাই শহরে দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার বাণী বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়লো। রেডিও ঘোষণা করলো, পত্রিকায় প্রকাশ পেলো, টেলিভিশনে জানানো হলো–দস্যু বনহুর মন্থনা দ্বীপের অদূরে ঝাঁম জঙ্গলে গ্রেপ্তার হয়েছে।
মনিরা সংবাদ শোনামাত্র অস্থির হয়ে পড়লো।
মরিয়ম বেগম নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। জায়নামাজে খোদার কাছে মোনাজাত করতে শুরু করলেন। তিনি ছাড়া আর কিইবা উপায় আছে তার?
সরকার সাহেবও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন, তাঁর মনেও অশান্তির ঝড় উঠলো।
সংবাদটা বনহুরের আস্তানাতেও পৌঁছে গেলো। বনহুরের অনুচরগণ এতোদিন জানতো তাদের সর্দার দূরে কোথাও আত্মগোপন করে তার কাজ করে যাচ্ছে, তবু সান্ত্বনা ছিলো সকলের মনে। হঠাৎ সর্দারের গ্রেপ্তারবাণী শুনে মুষড়ে পড়লো সবাই।
রহমান ছিলো–সেও ডুব মেরেছে কোথায় কে জানে! সর্দারের নিরুদ্দেশের পর রহমানও একদিন কোথায় চলে গেছে কাউকে কিছু না জানিয়ে।
উপস্থিত আস্তানার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলো কায়েস। আর নাসরিন যোগাতো তাতে উৎসাহ।
বনহুরের অনুচরগণ ছিলো অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। বনহুর এদের তৈরি করে নিয়েছিলো নিজ মনের মত করে। যেমন দুর্দান্ত সাহসী ছিলো ওরা তেমনি ছিলো নিষ্ঠাবান। সর্দারের বিনা। অনুমতিতে তারা সামান্য কোনো দস্যুতাও কখনও করতো না। সর্দারের অভাবে তারা বাধ্য হতো রহমানের আদেশ পালন করতে।
সর্দার নেই, রহমান নেই, কাজেই অনুচরগণ সবাই নীরবে দিন যাপন করছিলো। তাই বলে কেউ বসে থাকতো না, যার যা কাজ করে যেতে মনোযোগ সহকারে। সর্দার ফিরে এলে তাদের ক্রটি যেন ধরতে না পারে।
হঠাৎ এমন দিনে সর্দারের গ্রেপ্তার-সংবাদ আস্তানার সবাইকে ভাবিয়ে তুললো। সমস্ত অনুচরগণ একত্রিত হয়ে যুক্তি-পরামর্শ করে চললো। নাসরিনও যোগ দিলো সকলের সঙ্গে।
সেদিন দরবার কক্ষে দস্যু বনহুরের অনুচরদের মধ্যে একটা আলোচনা সভা বসেছিলো।
কায়েস সর্দারের সুউচ্চ আসনের পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলো–ভাইসব, আজ যে সংবাদ আমরা শুনলাম তাতে আমাদের মুষড়ে পড়ার কিছু নেই। আমরা জানি, আমাদের সর্দারকে কোনো কারাগার আটকে রাখতে সক্ষম হবে না। তবু আমাদের উপায় খুজতে হবে–কিভাবে আমরা তাকে মুক্ত করে আনতে পারি বা পারব। সব চেয়ে বড় আফসোস আজ রহমান ভাই নেই, সে থাকলে এ ব্যাপারে আমরা তার কাছে যথেষ্ট পরামর্শ পেতাম…
কায়েসের কথা শেষ হয় না, রহমান কক্ষে প্রবেশ করে। সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের সমস্ত অনুচর আনন্দধ্বনি করে উঠে। কায়েস উচ্চস্থান হতে নেমে এসে রহমানকে কুর্ণিশ করে দাঁড়ায়, বলে সে–রহমান ভাই, তুমিও সর্দারের সঙ্গে এমন করে কোথায় ডুব মেরেছিলে বলোতো? এসেছো ভালোই হলো, সর্দারের গ্রেপ্তার-সংবাদ শুনে আমরা বড় অস্থির হয়ে পড়েছি।
রহমান মৃদু হেসে বললো–নিশ্চিন্ত থাকো ভাই সব, সর্দার বন্দী হয়েছে, তাতে অস্থির হবার কি আছে। তাকে আটকে রাখে, এমন শক্তি পৃথিবীর কারো নেই।
দরবার কক্ষস্থ সকলে জয়ধ্বনি করে উঠলো।
রহমান আসন গ্রহণ করে বললো-কায়েস, তোমাকে একটি কাজ করতে হবে।
বলো রহমান ভাই।
জাহাজ ‘রকেটে আমার অনেক মাল আছে।
মাল! বললো কায়েস।
হাঁ,সোনা-দানা-মনি-মুক্তা অনেক কিছু–
কিন্তু সংবাদে জানতে পারলাম রকেটেই নাকি সর্দারকে বন্দী করে কান্দাই আনা হয়েছে।
হাঁ, আমিও সেই জাহাজে ছিলাম। আর শোন, ঐ জাহাজেই একটি গোপনকক্ষে বন্দী আছে ‘শাহানশাহ জাহাজের ক্যাপ্টেন জমরুদী!
ক্যাপ্টেন জমরুদী’রকেটে বন্দী আছে! বলো কি রহমান ভাই?
রহমান এবার বললো–চলো বিশ্রামকক্ষে যাই, অনেক কথা আছে।
তখনকার মত দুবারকক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো রহমান আর কায়েস।
অন্যান্য অনুচরগণ যে যার কাজে চলে গেলো।
রহমান তার নিজের বিশ্রামকক্ষে এসে বসলো। কায়েসকে বসার জন্য ইঙ্গিত করলো সে।
কায়েস আসন গ্রহণ করে বললো–রহমান ভাই, আমার কাছে সব যেন কেমন ঘোরালো লাগছে!
ঘোরালোর চেয়েও ঘোরালো ব্যাপার। সব শোনে কায়েস।
বলো রহমান ভাই।
হ কি বলছিলাম, জাহাজ ‘রকেটে একটি চোরা ক্যাবিনে বন্দী আছে ‘শাহানশাহের আসল। ক্যাপ্টেন জমরুদী। আর জমরুদীর বেশে শাহানশাহ’র ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম আমি।
তুমি?
হাঁ, শুধু ক্যাপ্টেন জমরুদীর ভূমিকায় অভিনয়ই করিনি, দস্যু বনহুরের ভূমিকাও অবশ্য করেছিলাম।
বলো কি রহমান ভাই!
বন্ধাই-এর গভর্ণর মিঃ রাজেন্দ্র ভৌমের কন্যা মিস এরুণকে হরণ করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। মিঃ ভৌমের যথাসর্বস্ব আমি কেড়ে নিয়েছিলাম, শুধু তার আচরণে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে এ কাজ করেছি।
তার অপরাধ?
গভর্ণর হয়ে তিনি গোপনে চোরা চালানিদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা শুধু তার অপরাধ নয়–তার চরম পাপ। মিস এরুণাকে হরণ করার পিছনে আমার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না, কিন্ত তাকে বন্দী করে রেখে মিঃ ভৌমকে আরও ভাবিয়ে তোলাই ছিলো আমার উদ্দেশ্য।
মিস এরুণা এখন কোথায়?
তাকে বন্ধাই তার পিতার কাছে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছি।
তার অসৎ উপায়ের অর্থ?
সেগুলো আমার কাছে আছে। শুধু সেগুলোই নয়, মন্থনার পুলিশ সুপার মিঃ মুখার্জীর প্রচুর সম্পদ আমি চুরি করে নিয়েছি। সেগুলো তাকে ফেরৎ দেওয়া সমীচীন মনে করিনি।
কারণ মন্থনা দ্বীপবাসীদের যা অবস্থা, সে সম্পদগুলি আমি মন্থনা দ্বীপবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দেবো মনস্থ করেছি।
তাহলে রহমান ভাই, তুমিই–
হ কায়েস, যদিও এটা আমার চরম অপরাধ হয়েছে।
সর্দারের বেশ ধারণ করে আমিই দস্যু বনহুরের ভূমিকা অবলম্বন করেছিলাম। কান্দাই থেকে মন্থনা দ্বীপ, মন্থনা দ্বীপ থেকে বন্ধাই পর্যন্ত আমি প্রচন্ড এক ঝড় বইয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেনো। জানো? গলাটা কেমন যেন ভার হয়ে এসেছে রহমানের।
কায়েস একটু অবাক হয়ে তাকালো রহমানের মুখের দিকে।
রহমান আবার বলে চললো–সর্দারের সন্ধানে আমি বাধ্য হয়েছিলাম তার বেশ ধারণ করতে। জানতাম তার নাম নিয়ে কেউ যদি জঘন্য কুকর্ম শুরু করে তিনি তা সহ্য করবেন না, যেখানেই থাক বেরিয়ে পড়বেন, কুকর্মকারীকে শায়েস্তা না করে তিনি স্বস্তি পাবেন না। কায়েস, শুধুমাত্র সর্দারের আত্মপ্রকাশ কারণেই আমি এ কাজ করেছি, শুধু দস্যুতাই নয়–আমি মনের বিরুদ্ধে নারীহরণ পর্যন্ত করেছি।
রহমান ভাই, তুমিই তাহলে—
হাঁ, এসব আমারই কাজ। সেই কারণেই আমাকে ক্যাপ্টেন জমরুদীকে আটক রেখেছিলাম এবং সে এখনও ‘রকেটের একটি গুপ্ত ক্যাবিনে বন্দী রয়েছে। আমার কিছু মালও আছে জাহাজটিতে।
কায়েস বলে উঠলো এবার–রহমান ভাই, সর্দার বন্দী হলেন কি করে?এবার বলো –পুলিশের কবল থেকে তার উদ্ধারের কি উপায় আছে?
উদ্ধারের উপায় একটা করতেই হবে। কিন্তু–কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো রহমান।
কায়েস তাকিয়ে দেখলো, রহমানের মুখভাব গম্ভীর চিন্তাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে কিছু ভেবে নিলো রহমান, তারপর বললো কায়েস,রকেট এক সপ্তাহ কান্দাইয়ে অপেক্ষা করবে। এই কদিনের মধ্যে ক্যাপ্টেন জমরুদীকে মুক্তি দিতে হবে, তারপর আমার মালগুলিও নামিয়ে নেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু কি করে এ সব সম্ভব হবে, রহমান?
সব সম্ভব হবে। আমার মালগুলি জাহাজের খোলসের মধ্যে রয়েছে তেলের ড্রামের মধ্যে। খালাসীরা আমার মাল নামিয়ে দেবে, তুমি মহাজনের ছদ্মবেশে ড্রামগুলি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আসবে। আর আমি ক্যাপ্টেন জমরুদীর মুক্তির ব্যবস্থা করবো।
এবার বনহুরকে হাঙ্গেরী কারাকক্ষেই ফাসী দিয়ে হত্যা করা হবে। তাকে আর দুনিয়ার। আলো দেখতে দেওয়া হবে না। কি করে এবার সে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে হাঙ্গেরী কারাকক্ষ থেকে পলায়ন করতে সক্ষম হয় দেখা যাবে।
৭ই জুন রাত্রি ১টায় দস্যু বনহুরকে হাঙ্গেরী কারাকক্ষে ফাঁসী দেওয়া হবে।
সংবাদটা পুলিশ মহল গোপন রাখতে চেষ্টা করলেও সুচতুর রহমানের কাছে গোপন রইলো না।
রহমানের মুখেই বনহুরের আস্তানার লোক জেনে ফেললো এ কথা। সমস্ত আস্তানা জুড়ে একটা দুশ্চিন্তার ঘনঘটা নেমে এলো। রহমান কিন্তু নীরব নিশ্চুপ, তার মুখে কোনো কথা নেই।
নাসরিন কেঁদে-কেটে আকুল হলো, এবার তাদের সর্দারের নিস্তার নেই। হাঙ্গেরী কারাগারে। মৃত্যু তার সুনিশ্চিত।
আস্তানার সবাই যখন বনহুরের মৃত্যুদন্ডাদেশ শ্রবণ করে মুষড়ে পড়েছে তখন রহমান এক সময় হাজির হলো চৌধুরী বাড়িতে।
অনেকদিন পর রহমানকে দেখে মনিরা প্রথমে নিজকে সংযত রাখতে পারলোনা। তার অন্তরের ব্যথা অশ্রু হয়ে নেমে এলো দু’নয়নে। বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো মনিরা–রহমান, তোমাদের সর্দার কোথায়?
প্রথমে রহমান মনিরার কথায় কোনো জবাব দিতে পারলো না, কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললো–সর্দারের সন্ধান আমি জানিনা বৌরাণী।
মিথ্যে কথা বলতে তোমার এতোটুকু বাঁধলো না রহমান? তোমাদের সর্দার হাঙ্গেরী কারাকক্ষে বন্দী, একথা তুমি গোপন করতে চাও?
না।
তবে বলছিলে জানোনা?
এখনও বলছি আমি জানি না বৌরাণী।
রহমান, আমার কাছে মিথ্যে কথা! তোমাদের সর্দার মন্থনা দ্বীপে বন্দী হয়ে হাঙ্গেরী কারাকক্ষে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুণছে, এ কথা তুমি অস্বীকার করতে চাও?
বৌরাণী! বৌরাণী…আমি জানিনা…আমি জানিনা।
আমি পাষাণ হয়ে গেছি রহমান। তুমি ভেবেছো, আমি তার বন্দী হবার কথা শুনে ভেঙে পড়বো, কিন্তু আর মুষড়ে পড়বো না। যাকে কোনোদিন বেঁধে রাখতে পারবো না, বৃথা তার মায়া…গলা ধরে আসে মনিরার।
রহমান বলে উঠলো–বৌরাণী, আজ আপনাকে একটা অনুরোধ করবো।
আঁচলে চোখ মুছে বললো মনিরা–বলো?
হাঙ্গেরী কারাগারে আপনাকে যেতে হবে।
কেন?
সর্দারের সঙ্গে আপনি সাক্ষাৎ করবেন।
কি করে তা সম্ভব রহমান?
আমি তার ব্যবস্থা করবো।
কান্দাই শহরে হাঙ্গেরী কারাগারে দস্যু বনহুর আবদ্ধ। তার মৃত্যুদন্ডের আদেশ প্রচার করা হয়েছে। এমতাবস্থায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যে অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার তাতে সন্দেহ নেই।
রহমান মনিরার সঙ্গে আরও কিছু সময় আলাপ আলোচনা করার পর নূরকে দেখতে চাইলো।
মনিরা নূরকে ডেকে পাঠালো, অল্পক্ষণেই সরকার সাহেবের সঙ্গে নূর এসে পৌঁছে গেলো।
রহমান ছদ্মবেশে এলেও নূর তাকে চিনে নিলো, লাফিয়ে কোলে চেপে গলা জড়িয়ে ধরলো–কাক্কু, আমার বাপি কই? আমার মাম্মী?
তোমার বাপি অনেক দূরে আছে নূর। আর তোমার মাম্মীতে এই তোমার সামনে।
না ও আমার মাম্মী নয়, আমার মা। বলোনা কাকু, মাম্মী আর আসেনা কেন?
আর সে কোনোদিন আসবে না। তুমি মার কাছে থাকো নূর।
মনিরা একটু গম্ভীর হলো, নূরকে লক্ষ্য করে বললো–যাও এবার নূর।
সরকার সাহেব হাত বাড়ালেন।
নূর রহমানের কোল থেকে সরকার সাহেবের কোলে লাফিয়ে পড়লো, তারপর হেসে বললো–কাক্কু টা টা…
সরকার সাহেব নূরকে নিয়ে চলে গেলেন।
রহমান নূরের দিকে তাকিয়েছিলো, কি যেন চিন্তা করছিলো সে গভীরভাবে। হয়তো বা সর্দারের স্মৃতি স্মরণ হচ্ছিলো তার মনে।
মনিরা বললো রহমান!
বলুন বৌরাণী?
একটা কথা আজ আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো, সঠিক জবাব দেবে তো?
নিশ্চয়ই দেবো। নিশ্চয়ই দেবো বৌরাণী, বলুন?
রহমান, নূরের কথা-বার্তা ও আচরণে আমি বেশ বুঝতে পারি নূর তোমাদের আস্তানাতেই ছিলো, এবং তোমাদের সর্দার এমন কাউকে তার মাম্মীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো যাকে সে আজও ভুলতে পারছে না।
রহমান মনিরার কথাগুলো নিশ্চুপ শুনে চললো।
মনিরা বলেই চলেছে রহমান, তুমি ঠিক জবাব দাও কে সে নারী এবং তোমাদের সর্দারের সঙ্গে কি তার সম্বন্ধ?
রহমান দস্যু বনহুরের সহকারী শ্রেষ্ঠ অনুচর। আজ সে একটা নারীর কাছে কাবু হয়ে গেলো। কি জবাব দেবে চট করে ভেবে উঠতে পারলোনা। ঢোক গিলে বললোহ, নূর আমাদের আস্তানাতেই ছিলো, কিন্তু কিছুদিন হলো সে আরাকানে আমার সঙ্গে গিয়েছিলো।
আরাকানে?
হাঁ, সেখানে আমার…মানে আমার স্ত্রীর কাছে থাকতো। কাজেই আমার স্ত্রীকে সে মাম্মী বলে ডাকতো…আমার স্ত্রী নূরকে মনি বলে ডাকতো। ওরা উভয়ে উভয়কে নিবিড়ভাবে মা ও সন্তানের মত ভালবেসে ফেলেছিলো…রহমান কথাগুলো বেশ থেমে থেমে বললো–দস্য হলেও মিথ্যাবাদী নয় সে, মিথ্যা বলতে তার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিলো।
মনিরা রহমানকে বিশ্বাস করতো, কাজেই রহমানের কথা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলো।
রহমান এতোবড় একটা মিথ্যা কথা বলে আর দাঁড়াতে পারছিলোনা তাদের বৌরাণীর সম্মুখে, তখনকার মত বিদায় নিলো সে।
এতোদিন স্বামীর প্রতি একটা সন্দেহের দোলা লাগছিলো মনিরার মনে। রহমানের কথায় তার মনের আকাশ সচ্ছ হয়ে আসে। স্বামীর উপর যা অভিমান ছিলো সব নিঃশেষ হয়ে গেলো আজ।
আগের চেয়ে প্রদীপ অনেকটা এখন ভাল।
মীরার সান্নিধ্য প্রদীপকে করে তুলেছে আরও সুষমামন্ডিত। মীরা সব সময় প্রদীপকে ঘিরে থাকে আবেষ্টনীর মত। মহারাজ জয়কান্ত বলেছেন আর এক সপ্তাহ পর প্রদীপ আর মীরার বিয়ে হবে।
মন্থনার ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসব বয়ে চলেছে। সমস্ত মন্থনা দ্বীপ আলোকমালায় সজ্জিত করা হচ্ছে। নগরের সৌধ চূড়ায় এখন থেকেই বেড়ে চলেছে নহবতের সুমিষ্ট সুর। নারী-পুরুষ সকলে মুখেই আনন্দ উচ্ছ্বাস। মীরা আর প্রদীপকে কেন্দ্র করে মহানগরীর বুকে বয়ে চলেছে খুশির ফোয়ারা। মন্থনার ধনী-দরিদ্র সবাই মেতে উঠেছে–আনন্দে আত্মহারা সবাই।
মীরা প্রদীপকে নিয়ে স্বপ্নসৌধ গড়ে। হাসি-গানে সব সময় ওকে মাতিয়ে রাখে সে।
মন্থনা দ্বীপের সব বিপদ কেটে গেছে। এখানের প্রতিটি মানুষ আজ মুক্তির নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছে। দস্যু বনহুরের ভয়ে আজ তারা আর আতঙ্কগ্রস্ত নয়। কারণ দস্যু বনহুর হাঙ্গেরী কারাগারে বন্দী। ৭ই জুন রাত্রিতে তাকে হাঙ্গেরী কারাগারে ফাঁসী দিয়ে হত্যা করা হবে।
এ সংবাদ সুদূর মন্থনা দ্বীপেও পৌঁছে গেছে।
শুধু পুলিশ মহলেই নয়, সমস্ত নগরবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে কথাটা, ৭ই জুন। রাত্রিতে হাঙ্গেরী কারাকক্ষে দস্যু বনহুরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে।
মহারাজ পুত্রবধূ মীরাকে বহু মূল্যবান অলঙ্কারে ভূষিত করবেন। বিনা দ্বিধায় আজ তিনি ঘোষণা করেছেন, মীরার অলঙ্কারের মূল্যের পরিমাণ। মীরা আজ উচ্ছল আনন্দে আত্মহারা, প্রদীপের পাশে ছুটে গেলো খুশির আবেগে। সুডোল বাহু যুগল দিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রদীপের কণ্ঠ, ডাকলো–প্রদীপ!
উ।
এখনও তোমার মধ্যে দ্বিধা?
উ হু।
আজও তুমি আমাকে নিজের করে নিতে পারলেনা?
প্রদীপ তার বলিষ্ঠ বাহু দুটি দিয়ে দৃঢ়ভাবে আকর্ষণ করলো মীরাকে, কিন্তু পর মুহূর্তে শিথিল হয়ে এলো তার হাত দুখানা।
মীরা বললো–কি হলো তোমার?
কিছু না। চলো মীরা, ঘরে ফিরে যাই।
কেন, এই মনোরম সুন্দর ফুলে ফুলে ভরা বাগান, লতা-গুল্মে ঘেরা কুঞ্জবন ভাল লাগছেনা তোমার কাছে?
না।
কেন? ওঃ ভয় হচ্ছে বুঝি তোমার? আবার যদি দস্যু বনহুর হানা দিয়ে বসে…
অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো প্রদীপ–দস্যু বনহুর! প্রথম যেন তার কানে প্রবেশ করলো শব্দটা।
মীরা বললো আবার–তুমি শোননি প্রদীপ, দস্যু বনহুর আজ কান্দাই হাঙ্গেরী কারাগারে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে!
প্রদীপের চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে মীরার মুখে।
মীরা বলে চলেছে–আর সে আসতে পারবেনা মন্থনা দ্বীপে। কাজেই ভয় নেই তোমার।
প্রদীপ তখনও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে, মীরার মুখে কিসের যেন সন্ধান করে ফিরছে। প্রদীপের মুখভাব গম্ভীর হয়ে উঠলো।
মীরা ব্যস্ত কণ্ঠে বললো–কি হলো তোমার?
প্রদীপ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলো, আবার তাকালো মীরার দিকে।
সে দৃষ্টি যেন প্রদীপের নয়। চমকে উঠলো মীরা, কম্পিত গলায় বললো–অমন করে কি দেখছো আমার মুখে?
প্রদীপ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, গম্ভীর গলায় বললো–দস্যু বনহুর বন্দী হয়েছে, এ কথা তুমি জান কি করে?
এবার মীরা হেসে উঠলো–সমস্ত পৃথিবীর লোক জানে আর আমি জানবোনা। দস্যু বনহুর যা উপদ্রব শুরু করেছিলো, দেখলে তো তোমার উপর কিভাবে সে অন্যায় আচরণ করলো? তোমাকে বেঁধে রেখে আমাকে নিয়ে কিভাবে উধাও হয়েছিলো। তুমি যাই বলো প্রদীপ, দস্যুটাকে লোকে যতই বদ বলুক, আমি কিন্তু তাকে সমীহ করি…
আবার তাকালো প্রদীপ মীরার মুখে।
মীরা বলে চলেছে–আমাকে বন্দী করে নিয়ে যাবার পর সে এতোটুকু কোনো অন্যায় আচরণ করেনি আমার সঙ্গে।
প্রদীপ এততক্ষণে কথা বললো–দস্যু বনহুরকে তুমি দেখেছো নিশ্চয়ই?
এবার মীরা ভাবাপন্ন হলো প্রদীপ, দস্যু বনহুর আমাকে হরণ করে নিয়ে গেলেও আমি তাকে দেখবার সৌভাগ্য লাভ করিনি।
কারণ?
কারণ তার মুখ সব সময় মুখোসে ঢাকা থাকতো।
প্রদীপ কুঞ্চিত করে কিছু চিন্তা করতে লাগলো।
মীরা বললো–কি ভাবছো প্রদীপ?
উ!
কি ভাবছো তুমি?
উঠে দাঁড়ায় প্রদীপ,চলো প্রাসাদে যাই, রাত অনেক হলো।
মীরা অনেক দিন পর আজ প্রথম শুনলো প্রদীপের গলার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। আনন্দে আপ্লুত হলো তার হৃদয়। বললো মীরা–চলো যাই।
প্রদীপ আর মীরা পায়ে পায়ে এগুচ্ছে, প্রতিদিনের মত প্রদীপের বাম হস্তখানা মীরার দক্ষিণ হস্তের মুঠায় ধরা রয়েছে।
প্রদীপ বললো–মীরা তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
বেশ তো বলো?
এখানে নয়, রাজপ্রাসাদে চলো।
আচ্ছা প্রদীপ, তুমি একদিন আমার ওখানে না গেলে বাঁচতে না। অস্থির হয়ে পড়তে, নানা ছলনায় তুমি হাজির হতে আমার কক্ষে। তারপর মনে পড়ে–তুমি আর আমি কোন্ অসীমে মিশে যেতাম? কত কথা, কত হাসি রাত ভোর হয়ে আসতো, তবু তুমি যেতে চাইতে না…
তারপর মীরা, তারপর? ব্যাকুল আগ্রহে প্রশ্ন করলো প্রদীপ।
আমি তোমাকে জোর করে তাড়িয়ে দিতাম, তুমি বলতে–মীরা, তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছা হয় না মনে হয়, তোমাকে সব সময় বাহুবন্ধনে বেঁধে রাখি…
মীরা!
হাঁ, সব তুমি ভুলে গেছো প্রদীপ?
তারপর মীরা?
চলো আমার ঘরে বসে সব বলবো। যাবে আজ আমার ওখানে?
চলো, যাবো।
প্রদীপ আর মীরা মন্ত্রি-প্রাসাদের দিকে অগ্রসর হলো, এক্কা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রওনা দিলো ওরা।
প্রদীপ আর মীরা বসে আছে পাশাপাশি। মীরার ওড়নার আঁচলখানা বাতাসে উড়ে উড়ে পড়ছিলো প্রদীপের চোখে-মুখে।
প্রদীপ নিশ্চুপ বসেছিলো পথের দিকে তাকিয়ে, কিছু যেন সে গভীরভাবে চিন্তা করছে! ললাটে ফুটে উঠেছে গভীর চিন্তার ছাপ।
মীরা প্রদীপের হাতখানা নিজের হাতের মুঠায় টেনে নিয়ে বলে–প্রদীপ, কি ভাবছো?
কিছু না।
প্রদীপ, তুমি কিন্তু আগের চেয়ে অনেক গম্ভীর হয়ে গেছে, কই আগে তো তুমি অমন ছিলে না? কত দুষ্ট ছিলে তুমি! আমাকে অস্থির করে তুলতে, এক মুহূর্ত তুমি আমাকে চুপ থাকতে দিতে না। একটু গম্ভীর হলেই বলতে, আমার উপর রাগ করেছে মীরা? যতক্ষণ না হাসতাম ততক্ষণ তুমি যেন স্বস্তিই পেতে না। আর এখন তুমি যেন কেমন হয়ে গেছো? প্রদীপ, জানি শিকারে গিয়ে তুমি মাথায় আঘাত পেয়েছিলে?
শিকারে?
হাঁ, মনে নেই তোমার? তা থাকবে কি করে! ডাক্তার বলেছিলেন–তোমার স্বাভাবিক জ্ঞান ফিরতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
প্রদীপের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে, বিপুল আগ্রহে বলে সে–মীরা, আমি সব জানতে চাই তোমার কাছে।
চলো, সব বলবো। তবু যদি স্মরণ হয় তোমার! আবার যদি তোমাকে আগের মত করে ফিরে পাই!
তুমি বলো মীরা, আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না।
প্রদীপ, যেদিন তুমি শিকারে যাও তখন আমি অসুস্থ ছিলাম—
হাঁ, মনে পড়েছে একটু একটু…
সত্যি?
হা মীরা।
বার বার শিকারে যাওয়া কালে আমি তোমার সঙ্গে যেতাম, মনে আছে তোমার?
প্রদীপ গভীরভাবে চিন্তা করে বলে–হাঁ, এবার ঠিক স্মরণ হচ্ছে। আমি যখন শিকারে। যেতাম, তুমি থাকতে আমার পাশে।
প্রদীপের মুখে পূর্ব কথা শুনে মীরার আঁখি দুটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে, বলে চলে মীরা আমি সেবার অসুস্থ থাকার জন্য তোমার সঙ্গে যেতে পারলাম না। বিদায় কালে আমার হাত ধরে তুমি বলেছিলে–শিকারে গেলাম মীরা কিন্তু আমার প্রাণ পড়ে রইল এখানে…
মীরা!
প্রদীপ, তারপর শিকার থেকে সবাই ফিরে এলো, শুধু এলেনা তুমি। সবাই এসে বললো ঝড়-তুফানে কোথায় তুমি হারিয়ে গেছে। প্রাণে বেঁচে আছে কিনা তাও কেউ বলতে পারলো না। তোমার অভাবে মন্থনা দ্বীপে এক মহাশোকের ছায়া নেমে এলো। মহারাজ আর মহারাণী একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে বিশ্বকে অন্ধকার দেখলেন। মন্থনার আনন্দ-হাসি-গান চিরতরে মুছে গেলো, মুছে গেলো সবার খুশি। আমার মনের অবস্থা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না প্রদীপ…
গলা ধরে আসে মীরার।
প্রদীপ তন্ময় হয়ে শোনে।
বলে আবার মীরা…মন্থনা দ্বীপবাসী যখন শোকে মূহ্যমান, মহারাজ মহারাণী যখন কেঁদে কেঁদে অন্ধ হবার জোগাড়, তখন হঠাৎ তোমাকে পাওয়া গেল মন্থনার হসপিটালে তিন নম্বর বেডে। জানা গেলো, কোন্ জেলে নৌকায় তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছে সারথী নদীবক্ষ থেকে।
সারথী নদী! অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো প্রদীপ।
হাঁ, সারথী নদী থেকেই তোমাকে জেলেরা উদ্ধার করে মন্থনা হসপিটালে দিয়েছিলো। সার্জন বলেছিলেন তখন তোমার যা অবস্থা ছিলো, অতি আশঙ্কাজনক। মাথায় ভীষণ আঘাত পেয়ে তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। সম্পূর্ণ তিন সপ্তাহ পর ফিরে এলো বটে, কিন্তু স্বাভাবিক জ্ঞান তুমি লাভ করলে না। তুমি তোমার আত্মীয়-স্বজন, এমন কি তোমার পিতা-মাতাকে চিনতে পারলে না, আমাকেও না…প্রদীপ, বলো এখনও কি তুমি আমাকে চিনতে ভুল করছো?
না, মীরা।
তবে তুমি ঠিক আগের মত করে আমাকে গ্রহণ করতে পারছে না কেন?
মীরা…
বলো?
না, থাক বলবো পরে।
মীরা বললো–এই তো এসে গেছি।
ঘোড়াগাড়ি থেমে পড়লো, প্রদীপ আর মীরা নেমে দাঁড়ালো।
প্রদীপ নতুন দৃষ্টি নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
মীরা হেসে বললো–আজ কি তুমি নতুন এলে প্রদীপ? অমন করে কি দেখছো?
কিছু না, চলো।
মীরাকে অনুসরণ করে প্রদীপ।
মীরা অন্তপুরে প্রবেশ করে ডাকে–মা মা, দেখে যাও কে এসেছে।
কন্যার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে মন্ত্রিপত্নী লতারাণী এগিয়ে আসেন, মীরার সঙ্গে রাজকুমার প্রদীপকে বহুদিন পর তার বাড়িতে আসতে দেখে উচ্ছল খুশিভরা কণ্ঠে বলেন–প্রদীপ, বাবা তুমি এসেছো?
প্রদীপ কোনো জবাব দিতে পারে না, থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
মীরা হেসে বলে–কই মাকে প্রণাম করছে না যে?
ও! প্রদীপ কেমন যেন বিব্রত বোধ করে। মীরার কানে মুখ দিয়ে বলে–কেমন করে প্রণাম করতে হয় শিখিয়ে দাও মীরা?
হেসে উঠে মীরা–প্রণাম করাটাও ভুলে গেছো? মীরা মায়ের পায়ের কাছে বসে প্রণাম করে প্রদীপকে শিখিয়ে দেয়।
প্রদীপ মীরার অনুসরণে লতাদেবীকে প্রণাম করে।
মীরার কক্ষে প্রবেশ করতেই প্রদীপ থমকে দাঁড়ালো, বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে অগ্রসর হলো প্রদীপ ওপাশের দেয়ালে টাঙ্গানো প্রদীপ আর মীরার বড় ছবিখানার দিকে।
ছবিখানার নিচে এসে দাঁড়ালো প্রদীপ, স্থির অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। ছবিখানা যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে, মীরা আর প্রদীপ দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশাপাশি। উভয়ের হাতের মুঠায় হাত, শরীরে শিকারীর ড্রেস। দু’জনার পিঠের সঙ্গেই রাইফেল বাধা রয়েছে। হাসছে ওরা আপন মনে।
প্রদীপ অবাক হয়ে দেখছে ছবিখানা।
মীরা এসে দাঁড়ালো তার পাশে, হেসে বললো–অমন আশ্চর্য হয়ে কি দেখছো? ভুলে গেছ বুঝি তোমার আর আমার সেদিনের কথা?
প্রদীপের আঁখি দুটি ছবি থেকে ফিরে এলো মীরার মুখে, প্রদীপের চোখে রাশিকৃত বিস্ময়।
মীরা প্রদীপের হাত ধরে বললো–এসো।
খাটের উপর প্রদীপকে বসিয়ে দিয়ে মীরা ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো, বামহস্ত দিয়ে প্রদীপের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে বললো–কতদিন পর আমার ঘরে এলে বলতো?
উ।
কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছো তুমি?
প্রদীপ যেন অস্বস্তি বোধ করছে। মীরার হাতখানা ক্রমে আকর্ষণ করছে প্রদীপকে।
মীরা কিসের প্রতিক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে। কোমল পাপড়ির মত আঁখি দুটিতে ভাবময় চাহনি, সরু ওষ্ঠদ্বয়ে মৃদু মৃদু হাসির রেখা, বাহু দুটি তার কণ্ঠ বেষ্টন করে আছে।
প্রদীপ মীরার মুখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তাকায় দেয়ালে ছবির প্রদীপের মুখে।
মীরা অভিমান ভরাকণ্ঠে বলে–প্রদীপ কি দেখছো?
ঐ ছবির চোখ দুটো আমার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে দেখো।
হেসে উঠে মীরা–সে তো তুমি। প্রদীপ, আজ তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দেবো না।
কি করবে তুমি আমাকে নিয়ে?
অনেক কথা জমে আছে, অনেক হাসি-গান সব আজ উজাড় করে শোনাবো তোমাকে।
কিন্তু আমি যে বড় অস্বস্তি বোধ করছি মীরা।
অস্বস্তি! কি হয়েছে তোমার?
বড্ড মাথা ব্যথা। বড্ড মাথা…দুই হাতে প্রদীপ নিজের মাথাটা টিপে ধরে!
খুব কি অসুস্থ বোধ করছো?
খুব।
তাহলে ডাক্তার ডাকি?
না না, ডাক্তারের কোনো দরকার হবে না। মীরা, একটু ঘুমাতে পারলে আমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবো, কিন্তু তোমার ঘরে ঘুমানো তো চলবে না।
কেন?
বিয়ে তো আমাদের এখনও হয়নি, তাই যদি তোমার বাবা মা..
আজ কি তুমি নতুন এসেছো আমার ঘরে? আমার বাবা মা তোমাকে অনেক দিন বরণ করে নিয়েছেন প্রদীপ, আমাদের মনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। লোক দেখানো লৌকিকতাটুকু বাকি আছে মাত্র; একথা তুমিই তো বলেছে আমাকে।
মীরা, সব ভুলে গেছি, সব ভুলে গেছি আমি। আমি নিজকে নিজেই জানিনে–কে আমি!
প্রদীপ!
হা মীরা।
তুমি বড় অসুস্থ, এসো আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ো, আমি তোমার চুলে আংগুল বুলিয়ে দিই।
প্রদীপ মীরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
রাত বেড়ে আসছে।
প্রদীপ ঘুমিয়ে পড়লো এক সময়।
মীরার চোখেও নেমে এলো নিদ্রার পরশ।
প্রদীপের মাথাটা ধীরে ধীরে বালিশে নামিয়ে রেখে নিৰ্ণিমেশ নয়নে তাকিয়ে রইলো ওর নিদ্রিত মুখের দিকে। এক সময় মোহগ্রস্তের মত মীরার মুখখানা ঝুঁকে এলো প্রদীপের মুখে। অপূর্ব এক অনুভূতি নাড়া দিয়ে গেলো মীরার হৃদয়ে।
প্রদীপের বুকের উপর হাত রেখে মীরাও ঘুমিয়ে পড়লো।
নিস্তব্ধ কক্ষে শুধু জেগে রইলো দেয়াল ঘড়িটা। টিক্ টিক্ করে বেজে চলেছে, কালের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে এক এক করে মুহূর্তগুলি।
ঢং ঢং করে দেওয়াল ঘড়িটা রাত দুটো ঘোষণা করলো। আধুনিক মডার্ণ ঘড়ি, একটা সুমিষ্ট সুরের রেশ ঘরময় ছড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণের জন্য।
বুকের উপর থেকে মীরার হাতখানা আস্তে সরিয়ে রেখে উঠে বসলো প্রদীপ, মীরাকে তাকিয়ে দেখে নিলো। এক থোকা রজনীগন্ধার মত মীরার দেহটা এলিয়ে পড়ে আছে তার পাশে। প্রদীপের চোখ দুটো উজ্জ্বল তীব্র হয়ে উঠলো, হাতখানা এগিয়ে গেলো ওর দিকে, কিন্তু পর মুহূর্তে প্রদীপ সরিয়ে নিলো হাতখানা, শয্যা ত্যাগ করে প্রদীপ আর মীরার ছবিখানার পাশে এসে দাঁড়ালো। স্থির নয়ন মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর আবার তাকালো নিদ্রিত মীরার দিকে, আবার তাকালো সে ছবির প্রদীপের মুখে, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো–প্রদীপ, তুমি আজ হাঙ্গেরী কারাগারে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। আর দস্যু বনহুর তোমার আসনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে রাজকুমার প্রদীপ বনে বসে আছে। প্রদীপের মৃত্যু হবে, মন্থনার রাজা হবে দস্যু বনহুর, অপ্সরীর মত সুন্দরী মীরা হবে তার প্রেয়সী…নিয়তির কি পরিহাস! কিন্তু দস্যু বনহুর নিয়তিকেও প্রশ্রয় দেবেনা, এতো বড় একটা নির্মম অন্যায় সে হতে দেবেনা কখনও। রাজ্য-সুখ, নারী-রত্ন। লাভ দস্যু বনহুরের কামনা নয়। নিয়তিকে পরিহার করে বনহুর ফিরিয়ে আনবে প্রদীপকে।
প্রদীপ রূপ মুছে যায়, সেখানে জেগে উঠে এক দূর্দান্ত কঠিন পুরুষ-প্রাণ।
অন্তপুর থেকে বেরিয়ে আসে দস্যু বনহুর।
অদূরে সিংহদ্বারে রাইফেলধারী পাহারাদার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছিলো।
বনহুর সন্তর্পণে পিছন থেকে এগিয়ে যায়, দৃঢ় মুষ্ঠিতে চেপে ধরে পাহারাদারের গলা। একটা গোঙ্গানীর মত শব্দ বেরিয়ে আসে পাহারাদারের কণ্ঠ দিয়ে। বনহুরের হাতের মধ্যে শিথিল হয়ে আসে পাহারাদারের দেহটা, আস্তে করে ভূতলে শুইয়ে দিয়ে ওর শরীর থেকে খুলে নেয় ড্রেসটা।
অল্পক্ষণের মধ্যে পাহারাদারের ড্রেসে সজ্জিত হলো দস্যু বনহুর। রাইফেলটা তুলে নিলো হাতের মুঠায়।
অন্য একজন পাহারাদার বুঝি গোঙ্গানীর শব্দটা শুনতে পেয়েছিলো, তাই লণ্ঠন হাতে এগিয়ে আসছিলো এইদিকে।
বনহুর দ্রুত হস্তে পাহারাদারের জ্ঞানহীন শিথিল দেহটা সিংহদ্বারের আড়ালে সরিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুতে লাগলো।
পাহারাদারটি লণ্ঠন উঁচু করে এগিয়ে এলো–এদিকে কিসের শব্দ হলো ভাই?
হাঁ, আমিও ঐ রকম শব্দ শুনতে পেয়েছি, কিন্তু এদিকে কেননা–ঐদিকে।
ঐদিকে?
হ।
পাহারাদার অপর দিকে চলে গেলো।
বনহুর ঘোড়াশালের দিকে এগিয়ে গেলো, সহিসদের একজন ঘোড়াশালের পাশে ঘুমিয়েছিলো লোকটা হঠাৎ জেগে উঠলো–কে?
বনহুর ব্যস্তকণ্ঠে বললো–রাজকুমার প্রদীপ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছে, রাজপ্রাসাদে খবর দিতে হবে, একটা ভাল অশ্ব বেছে দাও।
আচ্ছা হুজুর, দিচ্ছি।
সহিস ঘোড়াশালে প্রবেশ করে একটা বলিষ্ঠ অশ্ব নিয়ে ফিরে এলো।
বনহুর আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে চেপে বসলো অশ্বপৃষ্ঠে।
মন্থনার পথঘাট বনহুরের পরিচিত নয়, কাজেই কোন্ দিকে যাবে; বনহুরের উদ্দেশ্য বন্দরে পৌঁছে কান্দাইগামী জাহাজে সে ফিরে যাবে। যেমন করে হোক উদ্ধার করবে সে প্রদীপ কুমারকে।
কিন্তু কোনদিকে বন্দর জানা নেই দস্যু বনহুরের। একটি টাঙ্গীওয়ালা পথের ধরে টাঙ্গী রেখে তার উপর নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলো।
বনহুর অশ্ব থেকে নেমে পড়লো, এক ধাক্কায় টাঙ্গীওয়ালাকে জাগিয়ে দিয়ে বললো–এই, রাজার হুকুম, তোকে আমার সঙ্গে বন্দরে যেতে হবে টাঙ্গী নিয়ে।
টাঙ্গী ওয়ালা চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো–রাজমন্ত্ৰী-চিহ্নযুক্ত পোশাক পরিহিত পাহারাদার তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। বুকটা কেঁপে উঠলো টাঙ্গী চালকের, বিনীত কণ্ঠে বললো– হুজুর, এতো রাতে বন্দরে যেতে হবে কেনো?
রাজ-আত্নীয় আসবেন, তাই তাকে আনতে।
আর কোনো কথা বলতে সাহসী হলোনা টাঙ্গীচালক।
বনহুর অশ্ব সংযত করে টাঙ্গীর পিছনে অগ্রসর হলো।
বন্দরে পৌঁছতে বহু সময় লাগলো তার।
টাঙ্গী চালকের জিম্মায় অর্শ্ব রেখে বনহুর বন্দরের দিকে চলে গেলো। বলে গেলো বনহুর– আমার ফিরতে যদি খুব বিলম্ব হয় তবে তুমি ফিরে যেও, এবং অশ্বটি মন্ত্রি-বাড়িতে পৌঁছে দিও।
আচ্ছা হুজুর, তাই করবো। বললো টাঙ্গীচালক।
বনহুর বন্দরে প্রবেশ করতেই সবাই রাজপাহারাদার দেখে সম্মানে পথ ছেড়ে দিলো।
বাৎ ভাল বলতে হবে, বনহুর বন্দরে পৌঁছতেই শুনতে পেলো–একটি জাহাজ এই দন্ডে কান্দাই অভিমুখে রওয়ানা দিবে।
বনহুর রাজপাহারাদারের বেশেই জাহাজে উঠে বসলো, জাহাজের ক্যাপ্টেন তার সুখ সুবিধামত ব্যবস্থা করে দিলো।
মন্থনা দ্বীপের রাজপাহারাদার হিসাবে বনহুর জাহাজে যথেষ্ট সম্মান পেতে লাগলো।
দুইদিন দুই রাত্রি জাহাজে কাটানোর পর বনহুর কান্দাই বন্দরে অবতরণ করলো।
নতুন জীবন লাভ করার পর বনহুরের এই প্রথম কান্দাই আগমন। বনহুর কান্দাই পৌঁছে। একটা হোটেলে আশ্রয় নিলো। কান্দাই এর পুলিশ মহলের অনকেই দস্যু বনহুরের আসল রূপ চেনেন, কাজেই স্বাভাবিক ড্রেসে বনহুর এ শহরে প্রবেশ করলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। বনহুরের মনে পড়লো আস্তানার কথা, মনে পড়লো স্ত্রী মনিরার কথা আর পুত্র নূর। কিন্তু সব মুছে ফেললো সে মন থেকে, সব কাজের প্রথম তাকে উদ্ধার করতে হবে মন্থনার রাজকুমার প্রদীপকে। কান্দাই পৌঁছেই সে জানতে পেরেছে–আর তিন দিন মাত্র বাকি আছে দস্যু বনহুরকে ফাঁসীমঞ্চে ঝোলাবার। ৭ই জুন এগিয়ে আসছে দ্রুতগতিতে; তার পূর্বে প্রদীপ কুমারকে মুক্ত করে আনতে হবে।
বনহুর হোটেলের কামরায় পায়চারী করছে আর গভীরভাবে চিন্তা করছে, সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে সে।
কান্দাই পৌঁছেই বনহুর তার ড্রেস পরিবর্তন করে নিয়েছিলো। শুধু পাজামা আর পাঞ্জাবী শোভা পাচ্ছিলো তার শরীরে। হোটেলের বয় বনহুরের অর্ডারমত খাবার দিয়ে গেলো।
বনহুর তখন পিছন দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
বয় চলে যাচ্ছিলো, বনহুর বললো–বাথরুমে পানি আসছেনা কেনো দেখোতো? টাঙ্কিতে কি পানি নেই?
স্যার, পানি থাকবেনা কেন, সমস্ত হোটেলের জন্য প্রচুর পানি মজুত আছে টাঙ্কিতে। আচ্ছা আমি দেখছি…
বয় বাথরুমে প্রবেশ করতেই বনহুর প্রবেশ করলো তার পিছনে।
তারপর বনহুর যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন তার সম্পূর্ণ রূপ পাল্টে গেছে। কেউ দেখলে তাকে চিনতেই পারবে না; হোটেলের বয় বলেই মনে হচ্ছে তাকে সম্পূর্ণভাবে।
বনহুর ট্রে আর প্লেট হস্তে বেরিয়ে এলো। তারপর আলমারী খুলে সব চেয়ে মূল্যবান ভাল মিষ্টি সাজিয়ে নিলো একটা টিফিন ক্যারিয়ারে। আবার ফিরে গেলো সে নিজের ক্যাবিনে।
হোটেলের অন্যান্য লোকজন সবাই মনে করলো–সাতাশ নম্বর ক্যাবিনের ভদ্রলোক বুঝি। মিষ্টির অর্ডার দিয়েছে।
নিজের কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর দ্রুত হস্তে বয়ের ড্রেস খুলে পরে নিলো নিজের পাজামা আর পাঞ্জাবী; তার পর খচ খচ করে দুটো চিঠি লিখে নিয়ে পকেটে রাখলো। টিফিন ক্যারিয়ার হস্তে বেরিয়ে এলো সকলের অলক্ষ্যে ফুটপাতে।
অদূরে একটা ভাড়াটে ট্যাক্সি যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ষ্টার্ট নিচ্ছিলো, বনহুর দ্রুত এগিয়ে উঠে। বসে বলে–চলো পুলিশ অফিসে, আর শোন, একটা চিঠি পোষ্ট করবো, পথে কোনো পোষ্ট বক্স দেখলে এক মিনিটের জন্য গাড়ি রাখবে।
আচ্ছা স্যার। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়লো।
কয়েক মিনিট চলার পর একটা পোষ্ট বক্স দেখে গাড়ি রাখলো ড্রাইভার, বললো–দিন স্যার, আমি দিয়ে আসি।
বনহুর চিঠিখানা বের করে ড্রাইভারের হাতে দিলো, ড্রাইভার নেমে গেলো গাড়ি থেকে।
বনহুর লক্ষ্য করছে–ড্রাইভার চিঠিখানা পোষ্ট বক্সে ছেড়ে দিতেই, সে চট করে ড্রাইভ আসনে বসে হ্যান্ডেল চেপে ধরে ষ্টার্ট দিলো।
ড্রাইভার প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেলো, তারপর দ্রুত দৌড়ে এলো কিন্তু গাড়ীখানা নিকটে পৌঁছাবার পূর্বেই তার সম্মুখ দিয়ে সাঁ করে চলে গেলো গাড়িখানা।
ড্রাইভার হাবার মত দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য, তারপর চিৎকার করে হই হুল্লোড় শুরু করে দিলো!
এখানে ড্রাইভার যখন চেঁচামেচি করছে, তখন হোটেলের মধ্যেও শুরু হয়েছে এক মহা হই চই কান্ড।
বনহুর সোজা তখন গাড়ি নিয়ে অগ্রসর হলো জজ কোয়ার্টারের দিকে।
জজ সাহেব বিচারালয়ে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
বনহুর তার গাড়িখানা নিয়ে পৌঁছে গেলো জজ সাহেবের গাড়ির পাশে। দারওয়ান এসে জিজ্ঞাসা করলো–আপ কাহা ছে আয়া?
বনহুর বললো-জজ সাহাব কো মিঠাই লে আয়া, তুম লে যাও অন্দর মে।
মিঠাই, কোন্ ভেজা?
তুমি লে যাও, জজ সাহাব জানতে সব।
বহুৎ আচ্ছা। চলে যায় দারওয়ান।
ড্রাইভারটা ছাড়া আর কেউ নেই আশেপাশে, বনহুর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললো–ভাই, আমার গাড়িখানা হঠাৎ কেমন যেন বেয়াড়া হয়ে পড়েছে, একটু যদি আমাকে সাহায্য করতেন!
ড্রাইভার গর্বিতভাবে বললো–কি রকম?
মানে, ঠিক বুঝতে পারছিনে, একটু চালিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। হাজার হলেও আপনি ড্রাইভার–গাড়ি সম্বন্ধে আপনাদের তুলনায় আমরা একেবারে অজ্ঞ। মেহেরবানী করে যদি একটু…মানে দু’মিনিট…
ড্রাইভার জানে, সাহেব বেরুতে আরও অর্ধঘন্টা সময় লাগবে। নেমে এলো গাড়ি থেকে।
বনহুর ড্রাইভ আসনের পাশে উঠে বসে দরজা খুলে ধরল–আসুন।
ড্রাইভার বনহুরের ভদ্র ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেছে, কোনোরকম বিলম্ব না করে উঠে পড়লো–স্টার্ট দিয়ে গাড়ি বের করে নিয়ে চললো রাস্তায়।
বনহুর তার সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে গুঁজে দিলো ড্রাইভারের ঠোঁটের ফাঁকে, তারপর ম্যাচ জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে দিলো।
বনহুর ঠোঁটের কুঁকে সিগারেট চেপে ধরে এক মুখ ধুয়া ছেড়ে বললো–কিছু বুঝতে পারছেন?
ড্রাইভারের ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট, দাঁতে চেপে ধরে বললো–আছে, খুব একটা দোষ আছে গাড়িখানার। আপনারা তেমন ধরতে পারবেন না, আচ্ছা আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
কথায় কথায় বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তারা। বনহুর বললো–আর একটু চালালেই আরও ভালভাবে অনুভব করবেন।
কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারছিনে, কারণ স্যার বেরিয়ে পড়বেন।
ওদিকের গলির ভিতর দিয়ে চলুন ড্রাইভার সাহেব, মাত্র দু’মিনিট সময় লাগবে।
ঠিক বলেছেন। ড্রাইভার গাড়ি ব্রেক করে গলির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিলো। জনহীন গলিপথ।
গলির মাঝপথে গাড়ি আসতেই হঠাৎ পাঁজরে ঠান্ডা কিছু অনুভব করলো ড্রাইভার।
বনহুর কঠিন কণ্ঠে বললো–খবরদার, চিৎকার করবে না! সঙ্গে সঙ্গে মরবে!
ড্রাইভার হঠাৎ চমকে উঠলো, ভাবতেও পারে নি, তার পাজরে একটি আগ্নেয় অস্ত্র ঠেশে ধরা হয়েছে। বনহুরের কণ্ঠস্বরে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠলো ড্রাইভারের মুখমন্ডল। একটু আড়নয়নে দেখে নিয়ে আবার তাকালো সম্মুখে রাস্তায় জন-হীন নির্জন গলিপথ। ড্রাইভার বুঝতে পারলো যে নিশ্চয়ই কোনো ডাকু বা দস্যু কবলে পড়েছে–উপায় নেই রক্ষার।
বনহুর কঠিন কণ্ঠে বললো–গাড়ি রুখো।
বাধ্য হলো ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিতে।
এবার বনহুর রিভলভার ঠিক রেখে ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে নামতে বললো–পাশেই একটি বাড়ি, দরজায় চক মাটি দিয়ে লিখা আছে “বাড়ি ভাড়া দেওয়া হইবে”। বনহুর ডাইভারসহ সেই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো। তখনও ড্রাইভারের পিঠে ঠেকে রয়েছে বনহুরের হস্তের রিভলভারের শক্ত আগাটা।
একটু শব্দ করতে পারলো না ড্রাইভার, মৃত্যুভয় কার না আছে!
বনহুর একটা খালি কক্ষে ড্রাইভারকে বন্দী করে তার শরীর থেকে ড্রাইভারের ড্রেস খুলে নিলো, তারপর দ্রুত পরে নিলো ড্রেসটা। যদিও ঠিকভাবে শরীরে খাপ খাচ্ছিলো না তবু কোনো রকমে চাপিয়ে নিলো।
অতি দ্রুত ড্রেস পরে নিয়ে শিকল টেনে দিলো দরজায়। ভাগ্যিস বাড়ির সদর গেটটা আগলা ছিলো। তাই বেগ পেতে হলো না দস্যু বনহুরকে।
ড্রাইভারের ড্রেসে গাড়ি নিয়ে ছুটলো জজ কোয়ার্টারের দিকে।
কিন্তু বনহুর এবার গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো না। গাড়িখানা পথের উপর একধার করে রেখে তাড়াহুড়ো করে ভিতরে প্রবেশ করলো, এবং খুশি হলো–তখনও জজ সাহেব গাড়ির নিকটে এসে উপস্থিত হননি দেখে।
বনহুর ড্রাইভ আসনের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো, যেমনভাবে ড্রাইভারগণ দাঁড়িয়ে থাকে।
জজ সাহেবের আজ একটু বিলম্ব হয়ে গেছে, তিনি ব্যস্তভাবে গাড়িতে এসে চেপে বসলেন।
ড্রাইভারও বসলেন তার আসনে।
নতুন ঝকঝকে মডেল পন্টিয়াক গাড়িখানা দস্যু বনহুরের হস্তে উলকা বেগে ছুটলো।
মাত্র কয়েক মিনিট, গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে গলিপথে প্রবেশ করলো।
জজ সাহেব বললেন–জজকোর্টে যাবার পথ ভুল করলে কি?
পুরোন অভিজ্ঞ ড্রাইভার, কাজেই জজ সাহেব হালকা ভাবেই কথাটা বললেন।
বনহুর সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বললো–বিলম্ব হয়ে গেছে, তাই পথ খাটো করে নেবার জন্যে…
বেশ তাই চলো। একটা সিগারেট বের করে সেটিতে অগ্নি সংযোগ করলেন জজ সাহেব।
গাড়িখানা এখন নির্জন গলিপথ ধরে এগুচ্ছে। হঠাৎ ড্রাইভার-বেশি বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো–জজ সাহেব, একটি কথা বলতে চেষ্টা করবেন না। করলেই এই দেখুন…রিভলভারখানা বের করে দেখায় সে এর এক গুলীতে খতম করে দেবো, কাজেই চুপ করে সিগারেট সেবন করুন।
ড্রাইভারের কথায় জজ সাহেবের বুকটা ধক্ করে উঠলো, কম্পিত বক্ষ নিয়ে তাকালেন ড্রাইভারের বাম হস্তে-উদ্যত রিভলভারখানার দিকে, পর মুহূর্তে তাকালেন তার মুখে কে তুমি?
বনহুর চাপা কণ্ঠে বললো–আমি কে একটু পরে বলবো!
আমাকে এভাবে তুমি কোথায় নিয়ে চলেছো?
একটু অপেক্ষা করুন, সব টের পাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন একটু টু শব্দ করলেই মরবেন। আমি আপনার সাথে কোনো অন্যায় করবো না।
জজ এতোকাল কত শত শত ব্যক্তির ভাগ্য নিয়ে গবেষণা করে এসেছেন, আজ তার নিজের ভাগ্যে এও ছিলো! বুদ্ধিমান জজ সাহেব নিশ্চুপ থাকাই বাঞ্চনীয় মনে করলেন। কারণ চিৎকার করে কোনো ফল হবে না, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও ঘটতে পারে, কাজেই তার আসনে চুপ করে বসে রইলেন।
অল্পক্ষণের মধ্যেই একটি বিরাট বাড়ির সম্মুখে এসে পৌঁছলো তাদের গাড়ি, আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই। ড্রাইভারবেশী বনহুর ড্রাইভ আসনে বসেই নিজের মাথার ক্যাপটা খুলে, দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে ইংগিৎ করলো।
দারওয়ান বনহুরকে দেখতে পেয়ে মুহূর্তে চিনে নিলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে কুর্ণিশ করে সোজা গিয়ে দাঁড়ালো।
বনহুর গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরলো–নেমে আসুন।
জজ সাহেব বাধ্য হলেন নেমে পড়তে।
দারওয়ান ফটক ধরলো, বনহুর আর জজ সাহেব প্রবেশ করলো ভিতরে।
এ বাড়ি দস্যু বনহুরের শহরের আস্তানা।
অনুচরগণ বহুদিন পর প্রভুকে ফিরে আসতে দেখে আনন্দে আপুত হলো। সবাই কুর্নিশ জানিয়ে অভিনন্দন জানাতে লাগলো। সকলের মনেই প্রশ্ন তাদের সর্দার এতদিন কোথায় ছিলেন, কিন্তু কেউ জিজ্ঞাসা করার সাহসী হলো না।
বনহুর জজ সাহেব সব পর পর কয়েকখানা কক্ষ পার হয়ে একটা কক্ষের সম্মুখে এসে, দাঁড়ালো। কক্ষের দরজা ভিতর হতে বন্ধ, বাইরে কোনো তালা-চাবি বা ঐ ধরণের কোনো জিনিস নেই। বনহুর ওদিকে একটা সুইচে হাত রাখতেই দরজা আপনা হতে খুলে গেলো। জজ সাহেবকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর–আসুন ভিতরে।
জজ সাহেব দ্বিধা করছিলেন, বনহুর হেসে বললো–ভয় নেই, আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।
জজ সাহেব বনহুরের সঙ্গে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন, আশ্চর্য হলেন এবার, কক্ষটা কোনো হলঘর বলে মনে হলো, কক্ষমধ্যে নীলাভ আলো জ্বলে উঠেছে দরজা খুলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে। জজ সাহেব দেখলেন, মেঝেতে সুন্দর দামী গালিচা বিছানো রয়েছে। মূল্যবান সোফাসেট থরে থরে সাজানো। মাঝখানে একটা মার্বেল পাথরের গোল টেবিল। টেবিলে কয়েকটা এ্যাসট্রে। একটা বড় ফুলদানীও রয়েছে টেবিলের মাঝখানে।
দেয়ালে কয়েকখানা ছবি, কিন্তু কোনো ব্যক্তির নয়। সব ক’ খানাই হিংস্র জন্তুর তৈলচিত্র।
জজ সাহেব আরও অবাক হলেন–একটা আসন, ঠিক সিংহের মুখাকৃতি। সিংহের চোখ দুটো ঠিক জীবন্ত সিংহের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে।
বনহুর সেই আসনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর সিংহের দক্ষিণ চোখে আঙ্গুলের চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে মেঝের একস্থানে একটা সুড়ঙ্গ পথ বেরিয়ে এলো।
বনহুর বললো–আসুন জজ সাহেব।
জজ সাহেব এবার কথা বললেন–আমাকে তুমি কি করতে চাও?
কিছু না। শুধু দু’চারটে প্রশ্নের জবাব দেবেন, আর দু’চারদিন আমার বিশ্রামকক্ষে বিশ্রাম করবেন–এই যা।
জজ সাহেব বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তার মুখোভাবেই বোঝা গেলো। যদিও বনহুরের আশ্বাসবাণী তাঁকে কিছুটা আশ্বস্ত করেছে তবু সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।
বনহুর বললো–বিলম্ব করবেন না, কারণ এখন প্রতিটি মুহূর্ত আমার অত্যন্ত মূল্যবান। আসুন আমার সঙ্গে।
বনহুর সুড়ঙ্গ মুখের দিকে অগ্রসর হলো।
অল্পক্ষণের মধ্যে বনহুর আর জজ সাহেব বিরাট একটি কক্ষে প্রবেশ করলো।
এ কক্ষটা মাটির নিচে তৈরি। কক্ষে স্বাভাবিক আলো জ্বলছে। দেয়ালটা সম্পূর্ণ পাথরে তৈরি, কোনো রঙের ছোঁয়া পড়েনি দেয়ালে। চারিদিকে অনেকগুলি পাথরে তৈরি ছড়ানো। ওদিকে একটু উঁচু আসন, আসনটা পাথরে তৈরি বলেই মনে হলো। আসনের পাশেই একটা গোলাকৃত উঁচু টেবিল। টেবিলে একখানা ছোরা গাঁথা রয়েছে।
ছোরাখানা যদিও সূতীক্ষ্ণ ধারালো কিন্তু এখন সেটা মরচে ধরে ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
বনহুরের শহুরে দরবারকক্ষ এটা।
বনহুর এ কক্ষে কত দিন পর আজ পা রাখলো তার কোনো সঠিক হিসাব নেই।
পাশাপাশি দু’খানা চেয়ারে বসলো বনহুর আর জজ সাহেব।
জজ সাহেব বার বার উদ্বিগ্নভাবে তাকাচ্ছে ড্রাইভারবেশী দস্যু বনহুরের মুখে। চোখেমুখে। এখন তার ভীতিভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বনহুর একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে-নিলো, তারপর বললো–আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করবো, সঠিক জবাব দেবেন তো?
দেবো। বললেন জজ সাহেব।
বনহুর সিগারেট কেস বের করে মেলে ধরলো জজ সাহেবের দিকে নিন। জজ সাহেবের এখন যে অবস্থা তাতে সিগারেট সেবন করাতো দূরের কথা, তিনি কোনোদিন সিগারেট সেবন করেছিলেন কিনা তাও তার স্মরণ নেই। বললেন–মা করো, সিগারেট সেবন করবোনা, বলো–কে তুমি?
আমি কে তা জানতে পারবেন, কিন্তু এখন নয় পরে। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন, : বলুন–দস্যু বনহুর এখন কোথায়?
দস্যু বনহুর!
হাঁ, বলুন?
এখন সে হাঙ্গেরী কারাকক্ষে বন্দী।
বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে?
হাঁ।
সে দন্ড কি আপনি দিয়েছেন?
হাঁ, তার অপরাধের জন্য তাকে বাধ্য হয়েছি মৃত্যুদন্ড দিতে। ৭ই জুন তাকে হাঙ্গেরী কারাকক্ষে ফাঁসী দিয়ে হত্যা করা হবে।
আর যদি সে দস্যু বনহুর না হয়?
বনহুরের কথায় জজ সাহেব চোখ তুলে তাকান তার মুখে, বলেন–কান্দাই এর পুলিশ সুপার মিঃ আহম্মদ নিজে তাকে গ্রেপ্তার করেছেন এবং দক্ষ পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ জাফরী তাকে সনাক্ত করে দস্যু বনহুর বলে প্রমাণ করেছেন।
তাহলে যে ব্যক্তি এখন হাঙ্গেরী কারাগারে আছে সে সুনিশ্চিত দস্যু বনহুর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই?
না!
সে যদি দস্যু বনহুর না হয়?
উপযুক্ত প্রমাণ পেলে তাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু যাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে–সে দস্যু বনহুর।
বেশ, আপনি আমার বিশ্রামকক্ষে কয়েকদিন বিশ্রাম করুন। তারপর আপনি মুক্তি পাবেন। এখানে আপনার কোনো অসুবিধা হবেনা। আসুন, পাশের কক্ষে আপনি থাকবেন,
বনহুর দক্ষিণ পাশের দেয়ালে একটা সুইচ টিপতেই দেয়ালটা ফাঁক হয়ে গেলো। বনহুর ভিতরে প্রবেশ করে আলো জ্বাললো। তারপর ডাকলো সে–আসুন এখানে।
জজ সাহেব বনহুরের কথামত কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন। সুন্দর সুসজ্জিত বেড রুম, এক পাশে খাট, মাঝখানে টেবিল, পাশে একটা চেয়ার। সেলফে সাজানো নানা রকম বই।
এ কক্ষেই দস্যু বনহুর তার প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের সম্মানে আটকে রাখে।
জজ সাহেবকে আরও কয়েকটা মূল্যবান প্রশ্ন করার পর বনহুর বললো–আপনি এবার আপনার পরিচ্ছদ ত্যাগ করুন, ঐ ধারের আলমারীতে আপনার জন্য বিভিন্ন রকম পোশাক রয়েছে। ইচ্ছামত আপনি যা খুশি ব্যবহার করতে পারেন। একটু থেমে বললো–আপনার এই ড্রেসটা আমার এই মুহূর্তে প্রয়োজন। কিছু মনে না করে যদি খুলে দেন তাহলে আমি উপকৃত হবো।
জজ সাহেব দেখলেন,ওর কথামত কাজ না করে কোনো উপায় নেই। কাজেই তিনি পাশের আলমারী থেকে পাজামা আর পাঞ্জাবী বেছে নিলেন।
বনহুর বললো আবার–ওদিকে ছোট্ট কুঠরী আছে, আপনি ড্রেস পরিবর্তন করে আসুন।
জজ সাহেব দেখলেন, একটা দরজা রয়েছে ওদিকে বাথরুম হবে। তিনি কাপড়গুলি হাতে নিয়ে প্রবেশ করলেন পাশের রুমে, দেখলেন কক্ষটা বাথরুমই বটে! সুন্দরভাবে আলো এবং পানির ব্যবস্থা রয়েছে। দেওয়ালে বেলজিয়াম আয়না, সাবান, তোয়ালে, চিরুণী, সেভের যন্ত্রপাতি–সব আছে তার মধ্যে।
জজ সাহেব তার পরিচ্ছদ ত্যাগ করে পরে নিলেন পাজামা আর পাঞ্জাবী। ঠিক মাপমত না হলেও একটুও অসুবিধা হলোনা।
বনহুর জজ সাহেবের পরিচ্ছদ হস্তে বিদায় গ্রহণ করলো। যাবার সময় বললো–যখন। আপনার যা প্রয়োজন হবে, কলিং বেল টিপূবেন আমার লোক আসবে, তাকে জানাবেন।
বনহুর বড় কক্ষটার পূর্বদিকের দেয়ালের পাশে এসে একটা সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে এ পাশেও বেরিয়ে এলো ঐরকম একটা দরজা–যেমন দক্ষিণ পাশের দেয়ালে। বনহুর এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে। কক্ষটিতে প্রবেশ করতেই আলো জ্বলে উঠলো, তীব্র উজ্জ্বল আলো। বনহুরের ছদ্মবেশ ধারণের কক্ষ এটা। দেয়ালের চারপাশে আয়না, মাঝে মাঝে টেবিল বসানো রয়েছে, প্রত্যেকটা টেবিলে ছদ্মবেশের নানা-রকম আসবাবপত্র।
বনহুর কিছুক্ষণের মধ্যে নিজকে সম্পূর্ণ জজ সাহেবের রূপে সজ্জিত করে নিলো। নিজেই নিজকে দেখে অবাক হলো, এতোটুকু ভুল হয়নি কোথাও। জজ সাহেবের পোশাকটা একটু আটসাট হচ্ছিলো কিন্তু কোনো অসুবিধা হলোনা।
এবার বনহুর ঠিক প্রৌঢ় জজ সাহেব বনে গেছে!
বনহুর কলিং বেলে হাত রাখতেই দরজায় এসে দাঁড়ালো একজন অনুচর, প্রথম তাদের সর্দারকে চিনতে না পেরে ক্রুদ্ধ মূর্তি ধারণ করলো, রাইফেল উদ্যত করে ধরলো সে, দু’চোখে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।
বনহুর তার দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে ধরলো।
বনহুরের হস্তে একটি চিহ্নযুক্ত অংগুরী ছিলো। সে যখন ছদ্মবেশ ধারণ করতো তখন তার আংগুলে ঐ চিহ্নযুক্ত অংগুরী পরতো। কারণ সেই অংগুরী দেখামাত্র তার লোক তাকে চিনতে পারতো।
অনুচরটির দৃষ্টি বনহুর হস্তের আংগুলের অংগুরীতে পড়তেই উদ্যত রিভলভার নত করে নিয়ে কুর্ণিশ জানালো। বনহুর বললো তাকে লক্ষ্য করে–কাসেমকে পাঠিয়ে দাও।
চলে গেলো অনুচরটি, অল্পক্ষণেই এলো কাসেম। প্রভুকে তার চিনতে বিলম্ব হলো না, বললো সে–সর্দার, আদেশ করুন?
এই কক্ষে মেঝেতে যে ড্রাইভারের ড্রেস পড়ে রয়েছে সেই ড্রেস দ্রুত পরে নাও, জজকোর্টে যেতে হবে।
কাসেম দ্বিতীয়বার কোনো প্রশ্ন না করে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলো। যদিও কাসেমের কাছে সব আশ্চর্য লাগছিলো তবু নীরবে সর্দারের আদেশ পালন করে গেলো। অল্প সময়ের মধ্যেই। কাসেম ড্রাইভারের ড্রেসে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এলো।
জজ সাহেবের বেশে দস্যু বনহুর আর ড্রাইভারবেশী কাসেম এসে দাঁড়ালো গাড়িখানার পাশে।
আদালত কক্ষ।
ডায়াসের ওপাশে উচ্চ আসনে জজ সাহেবের বেশে উপবিষ্ট স্বয়ং দস্যু বনহুর। চোখেমুখে তার সুস্পষ্ট বার্ধক্যের ছাপ।
শহরের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ কক্ষমধ্যে নিজ নিজ আসনে বসে আছেন। সকলেরই চোখে মুখে একটা ভয়ঙ্কর উন্মাদনা। বিচারকক্ষ নীরব।
ডায়াসের সম্মুখস্থ আসনে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে উপবিষ্ট মিঃ আহম্মদ এবং আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার। মিঃ জাফরী দন্ডায়মান, তাঁর হস্তে দু’খানা চিঠি। তিনি চিঠি দু’খানা অত্যন্ত মনোযোগে দেখছিলেন।
কক্ষস্থ সকলের দৃষ্টি মিঃ জাফরীর মুখে সীমাবদ্ধ।
মিঃ জাফরী বেশ কিছুক্ষণ চিঠি দু’খানা লক্ষ্য করে বললেন–এ চিঠি দু’খানা একই হাতের লিখা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবার তিনি নিজ পকেট থেকে একখানা ছোট্ট পুরোন চিঠি বের করে মেলে ধরলেন হস্তস্থিত চিঠি দু’খানার পাশে, তারপর বললেন–এক বছর আগে দস্যু বনহুরের লিখা এই চিঠি। মিঃ জাফরী এবার তার হাতের তিনখানা চিঠিই এগিয়ে দিলেন জজ সাহেবের টেবিলে–মাইলর্ড, আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহে বলছি এই তিনখানা চিঠি একই হস্তের লিখা এবং দস্যু বনহুরের হস্তের তাতে কোনো ভুল নেই।
জজ সাহেব তিনখানা চিঠি পাশাপাশি মেলে ধরে নিপুণ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলেন, তারপর গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–হাঁ, আপনার অনুমান সত্য। এই তিনখানা চিঠি একই হস্তের লিখা। প্ৰথমখানা লিখা হয়েছে আমাকে, দ্বিতীয়খানা মিঃ আহম্মদকে, আর তৃতীয়খানা এক বছর পূর্বে মিঃ জাফরীকে।
বিচারকক্ষ নীরব নিস্পন্দ। প্রত্যেকেই বিপুল আগ্রহে তাকিয়ে আছে জজ সাহেবের মুখে। দস্যু বনহুরের মৃত্যুদন্ডাদেশের পর হঠাৎ এই অভিনব চিঠির উদ্ভব!
জজ সাহেব প্রথম চিঠিখানা হাতে তুলে নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন–এই চিঠিখানা দস্যু বনহুর আমাকে লিখেছে। আমি পড়ে শোনাচ্ছি। চিঠিখানা পড়তে শুরু করলেন–
“সম্মানিত বিচারপতি আপনি সুদক্ষ বিচারক হয়ে এত বড় ভুল করে গেছেন যা অতি অসত্য। যাকে। আপনি দস্যু বনহুর ভ্রমে মৃত্যুদন্ডাদেশ। দিয়েছেন সে দস্যু বনহুর বা তার কোনো অনুচর নয়। কাজেই তাকে। পুনরায় ভালভাবে সনাক্ত করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
আপনাদের মঙ্গলপ্রার্থী
–দস্যু বনহুর।“
প্রথম চিঠিখানা পড়া শেষ হলে ভাঁজ করে রেখে দ্বিতীয় চিঠিখানা তুলে নিলেন জজ সাহেব হাতে।
বিচারকক্ষ মধ্যে একটা গুঞ্জনধ্বনি উঠেছে, সকলেই বিস্ময়ভরা কণ্ঠে একে অপরকে বলছেন, “দস্যু বনহুর তাহলে মুক্ত আছে!” বহু লোকের মিলিত কণ্ঠে কক্ষটা গম গম করে উঠলো।
জজ সাহেব টেবিলে আঘাত করে সবাইকে চুপ হবার জন্য নির্দেশ দিলেন।
আবার বিচারকক্ষ নীরব হলো।
জজ সাহেব এবার দ্বিতীয় চিঠিখানা সম্মুখে মেলে ধরে বললেন–এটা লিখা হয়েছে পুলিশ সুপার মিঃ আহম্মদের নিকটে। আমি পড়ছি–
“মিঃ আহম্মদ, আপনি অভিজ্ঞ পুলিশ হয়ে এতো বড় একটা সাংঘাতিক ভুল করেছেন। ভাবতেও আমার হাসি পায়। দস্যু বনহুরকে আপনি বহুবার দেখা সত্বেও এমন ভুল করা আপনার মত বিজ্ঞজনের শোভা পায় না। যাকে আপনি মন্থনা দ্বীপের পূর্ব দক্ষিণ বনাঞ্চলে গ্রেপ্তার করেছেন সে দস্যু বনহুর নয়। একজন নিরপরাধী, দস্যু বনহুর ভ্রমে মৃত্যু বরণ করলে আমি তা সহ্য করতে পারবো না। কাজেই সাবধান”… –
দস্যু বনহুর”
চিঠি দু’খানা পড়া শেষ করে তাকালেন জজ সাহেব দন্ডায়মান মিঃ জাফরীর মুখে, তারপর বললেন–যতদূর সম্ভব মনে হচ্ছে দস্যু বনহুর এখনও মুক্ত রয়েছে। এ চিঠি দু’টি যে দস্যু। বনহুরের হস্তের লিখা তা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে।
মিঃ জাফরী বললেন–মাইলড়, আমারও সেই রকম মনে হচ্ছে। তাছাড়া বন্দীব্যক্তি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব সময় নিজকে দস্যু বনহুর বলে অস্বীকার করে এসেছে।
জজ সাহেব পুনরায় বললেন আমার মতে যে ব্যক্তি দস্যু বনহুরকে ভালভাবে চেনেন তিনি। সনাক্ত করবেন।
বিচারকক্ষে আবার গন্ডগোল হলো।
জজ সাহেব আবার টেবিলে রোলারের আঘাত করে থামিয়ে দিলেন।
সেদিনের মত বিচারসভা ভঙ্গ হলো।
জজ সাহেব তার গাড়িতে গিয়ে বসলেন।
ড্রাইভার গাড়ি ছাড়লো।
মিঃ আহম্মদ, মিঃ জাফরী ও আরও দু’চারজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার দস্যু বনহুরের কারাকক্ষের দরজায় উপস্থিত হলেন।
মিঃ আহম্মদ মিঃ জাফরীকে লক্ষ্য করে বললেন–মিঃ জাফরী, আপনিই আমার চেয়ে বেশি দস্যু বনহুরকে চেনেন, কাজেই আপনি সনাক্ত করবেন।
ইয়েস স্যার, আমি তাকে ভালভাবে লক্ষ্য করলেই চিনতে পারবো। বললেন জাফরী।
দস্যু বনহুরের কক্ষের দরজা মুক্ত করা হলো। কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী। পুলিশ অফিসারদ্বয় কারাকক্ষে প্রবেশ করতেই করাকক্ষের লৌহদরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেলো। মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী উন্মুক্ত রিভলভার হস্তে বন্দী যুবকের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।
বন্দী যুবক তখন মেঝেতে এক পাশে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে বসে আছে, মুখমন্ডল মলিন বিবর্ণ ফ্যাকাশে, চোখ দুটো বসে গেছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি জন্মেছে। চুলগুলো এলোমেলো তৈলহীন। তবুও যুবকের চেহারা সুন্দর সুঠাম দৃষ্টিতে এক মোহময় চাহনী। প্রশস্ত ললাট দ্বীপ্ত উজ্জ্বল। দস্যু বনহুরের চেরারার সঙ্গে হুবহু মিল যুবকের।
মিঃ জাফরী এবং মিঃ আহম্মদ রিভলভার ঠিক রেখে তার পাশে দাঁড়ালেন।
বন্দী যুবক উঠে দাঁড়ালো।
মিঃ আহম্মদ বললেন–দস্যু, আর দু’দিন পর তোমার মৃত্যু।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো যুবক মিঃ আহম্মদের দিকে, কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা।
মিঃ আহম্মদ আবার বললেন–মৃত্যুর পূর্বে তুমি কাকে দেখতে চাও? বলো শেষবারের মত তাকে আমরা তোমার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবো।
মিঃ আহম্মদ যখন বন্দীকে পর পর প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন তখন মিঃ জাফরী তীক্ষ্ণভাবে বন্দীর মুখোভাব লক্ষ্য করছিলেন। তিনি আরও কয়েকবার বনহুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ করবার সুযোগ পেয়েছেন, কাজেই আজ তিনি বন্দীর মুখোভাবে তাকে সনাক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। মিঃ। জাফরী জানেন– দস্যু বনহুর কোনো সময় ভীতভাব প্রকাশ করতে জানেনা। যত বিপদই আসুক তার চোখেমুখে এক হিংস্র ভাব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
মিঃ আহম্মদের প্রশ্নে বন্দী ঢোক গিলে বললো–আমি দস্যু বনহুর নই। তাকে আমি কোনোদিন চোখে দেখিনি। বিনা অপরাধে আমার মৃত্যুদন্ড হলে আমি ঈশ্বরের নিকটে অভিযোগ করবো। আমাকে আপনারা যা খুশি করুন, চাইনে আমি কাউকে দেখতে বা কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
এবার মিঃ জাফরী বললেন–স্যার, ওদিকে চলুন।
মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী কারাগারের এক পাশে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন।
মিঃ জাফরী বললেন–স্যার, আমার বিশ্বাস–এ ব্যক্তি দস্যু বনহুর নয়। তবে দস্যু বনহুরের সঙ্গে এর চেহারা এবং কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত মিল আছে। যার জন্য আমাদের এ ভুল হয়েছে।
মিঃ জাফরীর কথায় মিঃ আহম্মদের জ কুঞ্চিত হলো, তিনি বললেন–মিঃ জাফরী, আপনি জানেন দস্যু বনহুর কত বড় দুর্দান্ত। সে যে কোনো সময় নিজের রূপ পাল্টাতে অদ্বিতীয়। এ ব্যক্তি দস্যু বনহুর নয় প্রমাণ করার পূর্বে তাকে আরও ভালভাবে সনাক্ত করা দরকার।
মিঃ জাফরী কিছু ভাবলেন, তারপর বললেন–স্যার, এখন চলুন, আবার বিকেলে আসবো।
কারাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন পুলিশ নায়কদ্বয়।
গাড়িতে বসে বললেন মিঃ জাফরী–স্যার, একবার চৌধুরী বাড়ি যেতে হবে।
চৌধুরী বাড়ি, মানে?
দস্যু বনহুরের স্ত্রী মনিরা দ্বারা তার স্বামীকে সনাক্ত করতে হবে।
ঠিক বলেছেন মিঃ জাফরী, অদ্ভুত আপনার বুদ্ধিবল!
কিন্তু প্রকাশ্যে তাকে জানতে দেওয়া হবে না যে তার দ্বারা আমরা তার বন্দী স্বামীকে সনাক্ত করতে নিয়ে যাচ্ছি। তাকে জানানো হবে তার স্বামীর মৃত্যুদন্ডের পূর্বে তাকে শেষবারের মত তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
অতি উত্তম। বেশ, সেইভাবেই কাজ করা হবে। তাহলেই বোঝা যাবে সব।
হাঁ স্যার, স্ত্রী কোনোদিন স্বামীকে চিনতে ভুল করবে না।
ঠিক বলেছেন, স্ত্রী আর জননী এই দু’জন তাদের আপন স্বামী এবং সন্তানকে কখনও চিনে নিতে ভুল করেননা।
ড্রাইভারকে চৌধুরী বাড়ি যাওয়ার জন্য বললেন মিঃ আহম্মদ।
গাড়িখানা কালাবাগ রোড দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হলো জান্নবী রোডের দিকে। হাঙ্গেরী রোড ছেড়ে চলে এসেছে অনেক দূরে।
চৌধুরী বাড়ির গেটে গাড়ি পৌঁছতেই সরকার সাহেব পুলিশ অফিসারদ্বয়কে অভ্যর্থনা করে হলঘরে নিয়ে বসালেন। ভদ্র মহোদয় দু’জনকে বসিয়ে ছুটলেন তিনি উপরে, বেগম সাহেবা আর মনিরাকে জানালেন পুলিশ অফিসারদ্বয়ের আগমনবার্তা।
অফিসারদ্বয়ের আগমন-সংবাদ শুনে আশ্চর্য না হলেও আশঙ্কিত হলেন মরিয়ম বেগম, না জানি আবার কোনো ব্যাপার নিয়ে এসেছেন তারা।
কিন্তু মনিরা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত স্থির।
সরকার সাহেবকে লক্ষ্য করে বললো মনিরা–চলুন আমি যাচ্ছি।
মরিয়ম বেগম বাধা দিয়ে বললেন–মনিরা, তুমি অপেক্ষা করো, আমি বরং শুনে আসি।
মনিরা বললো–মামীমা, এ তুমি কি বলছো আজ? কোনোদিন তুমি কারো সঙ্গে দেখা করতে যাওনা, আর….।
মা, আবার কি অভিসন্ধি নিয়ে যে তারা এসেছেন কে জানে। আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে।
গম্ভীর গলায় বললো মনিরা–কোনো চিন্তা করোনা মামীমা, বিপদের সঙ্গে মোকাবেলা করে আমি শক্ত হয়ে গেছি। আমার স্বামী আজ মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত, ভয় কাকে বলে জানিনে। স্বামীর জন্য আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত আছি!
ওঁনারা কেন এসেছে কিছুই তো জানিসনে মা?
জানিনে, তবে জানবার জন্যই যাচ্ছি। চলুন সরকার সাহেব। মনিরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো, সরকার সাহেব অনুসরণ করলেন তাকে।
মনিরা কক্ষে প্রবেশ করে সোজা মিঃ জাফরী ও মিঃ আহম্মদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো– বলুন, অসময়ে কি প্রয়োজন আমার কাছে আপনাদের?
মিঃ জাফরী বললেন–বসুন মিসেস মনিরা!
বসতে হবে না, বলুন?
মিসেস মনিরা, আপনি জানেন–আপনার স্বামী হাঙ্গেরী কারাগারে আবদ্ধ। শুধু আবদ্ধই নয় তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে।
শুনেছি, কিন্তু আপনারা কি কষ্ট করে আমাকে ঐ সংবাদ জানাতেই এসেছেন?
শুধু ঐ সংবাদ জানানোর জন্যেই আমরা আসিনি। হাজার হলেও আপনি তার স্ত্রী। দস্য বনহুরকে মৃত্যুদন্ড দেবার পূর্বে তাকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম কাউকে সে দেখতে চায় কিনা।
আমার স্বামী তাহলে আমাকেই দেখবেন বলে জানিয়েছেন?
হাঁ, ঐ রকম বাসনা সে করেছে।
বেশ, আমি যাবো। কিন্তু আমি জানি–আমার স্বামী কোনো সময় কাউকে শেষ বারের মত দেখতে চান না। মনিরা এবার সরকার সাহেবকে বললেন ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলুন। চলে গেলো মনিরা। মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলেন।
অল্পক্ষণ পর মনিরা তৈরি হয়ে ফিরে এলো, মিঃ জাফরী এবং মিঃ আহম্মদকে লক্ষ্য করে বললো–চলুন।
গাড়ি-বারেন্দায় সরকার সাহেব গাড়ি নিয়ে মনিরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশ কার।
মনিরা এবং পুলিশ অফিসারদ্বয় এসে পৌঁছলেন।
মনিরা গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে ধরলো, মনিরা উঠে বসতেই সরকার সাহেব ড্রাইভ আসনের পাশের সীটে উঠে বসলেন।
অফিসারদ্বয় উঠে বসলেন তাদের পুলিশ কারে।
হাঙ্গেরী কারাগারে পৌঁছতে সম্পূর্ণ দিনটাই লেগে গেলো তাদের। সন্ধ্যার পূর্বে তারা পৌঁছলো হাঙ্গেরী কারাগারের লৌহফটকের মধ্যে। পুলিশ অফিসারদ্বয় থাকায় পুলিশগণ মনিরাদের গাড়িও ছেড়ে দিলো বিনা আপত্তিতে।
হাঙ্গেরীর প্রাচীর ঘেরা ময়দানে গাড়ি রেখে নেমে পড়লেন মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী। মনিরাকেও নামার জন্য তারা অনুরোধ করলেন।
মনিরা এবং সরকার সাহেব নেমে পড়লেন।
মিঃ জাফরী বললেন–মিসেস মনিরা, শুধু আপনিই যেতে পারবেন।
মনিরা সরকার সাহেবকে লক্ষ্য করে বললো–সরকার চাচা, আপনি অপেক্ষা করুন। চলুন ইন্সপেক্টার সাহেব।
মিঃ আহম্মদ, মিঃ জাফরী এবং জেলার সাহেব সহ মনিরা অগ্রসর হলো হাঙ্গেরী কারাকক্ষের দিকে। মনিরার দু’চোখে বিস্ময়, এতোদিন হাঙ্গেরী কারাকক্ষের নাম সে শুনে এসেছে আজ স্বামীর কল্যাণে স্বচক্ষে দেখবার সৌভাগ্যলাভ তার ঘটলো। মনিরার অন্তরে আলোড়ন চলেছে, তার স্বামী আজ মৃত্যুপথের যাত্রী। আজ ৫ই জুন, ৭ই জুনে তার স্বামীর ফাঁসী হবে এই হাঙ্গেরী কারাকক্ষের এক নিভৃত কক্ষে।
মনিরার বুক ফেটে গেলেও সে মুখোভাবে বেদনা বয়ে আনলোনা। অতি কষ্টে নিজকে সংযত রেখে এগুতে লাগলো পুলিশ অফিসারত্রয়ের সঙ্গে।
পরপর অনেকগুলি ফটক পেরিয়ে এগিয়ে চললো তারা। প্রত্যেকটা ফটকে চারজন করে রাইফেলধারী পুলিশ দন্ডায়মান। চারিদিক শুধু পুলিশ আর পুলিশ। প্রত্যেক পুলিশের হস্তে আগ্নেয় অস্ত্র।
প্রায় বারোটি তালাযুক্ত কক্ষ পেরিয়ে একটি লৌহদরজা বিশিষ্ট কক্ষের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন জেলার সাহেব, মিঃ আহাম্মদ ও মিঃ জাফরীও দাঁড়ালেন পাশাপাশি।
মনিরাও তাদের সম্মুখে রয়েছে।
জেলার সাহেব স্বয়ং কারাকক্ষের দরজা মুক্ত করলেন।
মনিরার বুকটা তখন ধক ধক করছিলো। তার মনে হচ্ছিলো–নাজানি কি অবস্থায় আজ স্বামীকে সে দেখবে। মনিরা অতি কষ্টে নিজকে সংযত রেখে পুলিশ অফিসারত্রয়ের পিছনে কারাকক্ষে প্রবেশ করলো। পা দু’খানা যেন পাথরের মত ভারী মনে হচ্ছিলো তার। স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে কিন্তু মনে এতোটুকু শান্তি পাচ্ছে না সে। সম্মুখে তাকাতে সাহস হচ্ছিলো না মনিরার। কারাগারে বন্দী অবস্থায় তাকে কেমন দেখায় কোনোদিন দেখেনি, ভয় হচ্ছিলো–যদি সে স্বামীকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ে, কিছুতেই যদি নিজকে সংযত রাখতে না পারে তখন কি হবে। সে একজন সাধারণ বন্দীর স্ত্রীর মত আকুল হয়ে কাঁদবে! না না তা হয় না, নিজকে মনিরা কঠিন করে নিলো।
মিঃ জাফরীর কথায় চোখ তুললো মনিরা।
মিঃ জাফরী মনিরাকে লক্ষ্য করছিলেন, বললেন–চোখ তুলুন মিসেস মনিরা।
মনিরা চোখ তুললো, সম্মুখে দৃষ্টি পড়তেই দু’পা এগিয়ে গেলো, কিন্তু পরমুহূর্তেই থেমে। পড়লো সে।
মিঃ জাফরী মিঃ আহম্মদ এবং জেলার সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
বন্দী যুবক মনিরার দিকে অপরিচিত দৃষ্টি নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে। মনিরাও নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে, তার চোখে যেন রাজ্যের বিস্ময়।
কিছুক্ষণ কেটে গেলো, কারো মুখে কোনো কথা নেই।
এবার মিঃ জাফরী বললেন মিসেস মনিরা, আপনার স্বামীকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে আপনার?
মনিরার দৃষ্টি এবার ফিরে গেলো মিঃ জাফরীর মুখে, স্থির কণ্ঠে বললো মনিরা আমি জানতাম আমার স্বামী কোনদিন মৃত্যুকালে তার পরম জনকে দেখতে চাইবেন না। যাকে আমার স্বামী বলে আপনারা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছেন সে আমার স্বামী নয়।
এক সঙ্গে সবাই তাকালো বন্দী যুবকের দিকে, তারপর মনিরার দীপ্ত উজ্জ্বল মুখের দিকে।
মনিরা বললো–বিনা দোষে আপনারা এক নিরপরাধ জনকে হত্যা করতে যাচ্ছিলেন, আশ্চর্য আপনাদের দৃষ্টিবল। আজ এই যুবকের চেহারা যদিও হুবহু আমার স্বামী দস্যু বনহুরের মত, কিন্তু তার কি ললাটের পাশে কোনো তিল ছিলো?
এতোক্ষণে মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন বন্দী যুবকের ললাটে। তাই তো বন্দীর ললাটের বামপাশে একটি তিল আছে, বনহুরের এমন কোনো তিল ছিলো না।
মনিরা বললো আবার–এ যুবক আমার স্বামী নয়। আমার স্বামীর দক্ষিণ বাহুতে একটি বড় জট চিহ্ন আছে।
সঙ্গে সঙ্গে মিঃ জাফরী বন্দী যুবকের দেহ থেকে জামাটা খুলে ফেলার জন্য বললেন।
যুবক কথামত জামা খুলে ফেললো তার দেহ থেকে। শুধু মনিরাই নয়, আর সবাইও দেখলো–তার দক্ষিণ বাহুতে কোনো রকম জট চিহ্ন বা ঐ ধরনের কোনো কিছু নেই।
মনিরার মুখোভাব আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, বন্দী যুবক তার স্বামী নয়। তার স্বামী তাহলে গ্রেপ্তার হয়নি। বললো মনিরা–এবার যেতে পারি?
হাঁ চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। মিঃ জাফরী বললেন।
মনিরা বেরিয়ে এলো কারাগার কক্ষ হতে।
অদূরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সরকার সাহেব।
মনিরা দীপ্ত উজ্জ্বল আনন্দভরা মুখে গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো।
পরদিন।
আদালত কক্ষের বাইরে আজ লোকে লোকারণ্য। এতোটুকু তিলমাত্র স্থান নেই সম্মুখস্থ। ময়দানটায়। কক্ষমধ্যেও তেমনি ভীড়।
জজ সাহেব আসনে উপবিষ্ট।
ডায়াসের পাশে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সেই বন্দী যুবক, যাকে মিঃ আহম্মদ দস্যু বনহুর ভ্রমে গ্রেপ্তার করেছিলেন। ৭ই জুন যার মৃত্যুদন্ডাদেশ ঘোষণা হয়েছিলো। মন্থনার রাজকুমার প্রদীপ আজ কান্দাই বিচারালয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান।
বিচারকক্ষে প্রতিটি লোক তাকিয়ে আছে আসামীর দিকে। সকলেরই চোখে মুখে বিস্ময়, দস্যু বনহুর এ নয় কিন্তু তাকে দস্যু বনহুর ভ্রমে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো।
বিচারকক্ষ নীরব।
সম্মুখস্থ আসনগুলিতে বসে আছে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। মিঃ আহম্মদ, মিঃ জাফরী এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসারগণ।
কক্ষমধ্যে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে।
জজ সাহেব এবার গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন-আদালত বন্ধ থাকায় আমি দু’দিন কান্দাই এর বাইরে গিয়েছিলাম কোনো এক জরুরি কাজে। আজ ফিরে এসে জানতে পারলাম মিঃ আহম্মদ এবং মিঃ জাফরী তাদের বন্দী আসামী সম্বন্ধে সনাক্ত কাজ শেষ করেছেন। কারণ আসামী দস্যু বনহুর নয়।
আদালতকক্ষ করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো।
জজ সাহেব পুনরায় বললেন–আসামী যদিও নিজকো প্রথম থেকেই দস্যু বনহুর বলে অস্বীকার করে এসেছে কিন্তু সে এখনও তার নিজস্ব পরিচয় আদালতের নিকটে পেশ করেনি। আমি আবার তাকে তার নিজস্ব পরিচয় দান করার জন্য বলছি।
প্রদীপ বলে উঠলো–আমি আমার পরিচয় দিতে রাজি নই।
আদালতকক্ষে একটা গুঞ্জনধ্বনি উঠলো। হয়তো সবাই জানতে চাইলো কে এই যুবক।
জজ সাহেব টেবিলে হাতুড়ীর আঘাত করে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। তারপর বললেন– যুবক তার পরিচয় দিতে ইচ্ছুক নয়, কাজেই তাকে প্রশ্ন না করাই শ্রেয়। আসামী নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মুক্তি দেওয়া হলো।
আদালতকক্ষ আবার আনন্দ ধ্বনিতে ভরে উঠলো।
মন্থনার রাজকুমার প্রদীপ মুক্তিলাভ করার পর বেরিয়ে এলো মুক্ত আকাশের তলে। কিন্তু কোথায় যাবে সে, কান্দাই এর পথঘাট সব তার অপরিচিত।
জনতার ভীড়ে নিজকে আড়াল করে দিকহীনভাবে অগ্রসর হচ্ছিলো প্রদীপ। হঠাৎ পাশে গাড়ি থামার শব্দে ফিরে তাকালো সে। বিস্মিত হলো, জজ সাহেবের গাড়ি এসে থেমে পড়েছে তার পাশে।
প্রদীপ তাকাতেই স্বয়ং জজ সাহেব তাকে আহ্বান জানালেন–আসুন আমার গাড়িতে।
বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগলো প্রদীপের মনে, জজ সাহেব তাকে আহ্বান জানাচ্ছেন–কিন্তু কেনো? আবার তাকে বন্দী করা হবে?
প্রদীপকে চিন্তা করতে দেখে বললেন জজ সাহেব–চিন্তার কোনো কারণ নেই, আসুন আপনাকে আপনার স্বদেশে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবো।
এবার প্রদীপ কতকটা যেন আশ্বস্ত হলো। ধীরে পদক্ষেপে গাড়ীতে উঠে বসলো।
সেই বাড়ি।
বনহুরের শহরের আস্তানা।
জজ-বেশি দস্যু বনহুর প্রদীপ কুমার সহ বাড়িটার ভিতরে প্রবেশ করলো।
প্রদীপ সহ একেবারে আসল জজ সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর। তার দেহে তখনও জজ সাহেবের ছদ্মবেশ রয়েছে। কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই জজ সাহেব বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। ঠিক তারই মত একজন ব্যক্তিকে তার কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে।
জজ সাহেবের বিস্ময় ঘোর কাটেনি বনহুর হেসে বললো- আপনি নিশ্চয়ই এখনও সম্পূর্ণ ব্যাপারখানা বুঝে উঠতে পারেননি। আমি সব বলছি শুনুন।
জজ সাহেব তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন জজ সাহেব-বেশি দস্যু বনহুরের মুখের দিকে।
বনহুর বললো–প্রথম এর পরিচয় আপনার দরকার, এই যুবকই দস্যু বনহুর ভ্রমে গ্রেপ্তার হয়েছিলো এবং বিচারে তার মৃত্যু দন্ডাদেশও প্রদান করা হয়েছিলো কিন্তু সে ভুল আমি কার্যকরী হতে দেইনি। এবার বনহুর তার নিজ মুখ থেকে নকল দাড়ি গোঁফ খুলো টেবিলে রাখলো। তারপর মাথার নকল চুল খুলতে খুলতে বললো–এবং সেই কারণেই আমি বাধ্য হয়েছিলাম আপনাকে কয়েক দিনের জন্য আটকে রাখতে। কাজ সমাধা হয়েছে–এখন আপনি মুক্ত। যাকে আপনি বিচারে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন সে দস্যু বনহুর নয়–দস্যু বনহুর আমি!
এক সঙ্গে চমকে উঠলো জজ সাহেব আর প্রদীপ কুমার।
জজ সাহেব অবাক কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন–তুমি দস্যু বনহুর!
হাঁ, আমিই দস্যু বনহুর।
প্রদীপ তখন বিস্ময় ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখে, সত্যিই সে-ও আশ্চর্য হয়ে গেছে ওর চেহারার হুবহু মিল দেখে।
বনহুর জজ সাহেবকে লক্ষ্য করে বললো–কিন্তু একটি কথা আপনি স্মরণ রাখবেন, এই ব্যাপারটা যেন কোনো সময় কাউকে জানাবেন না। মানে, আপনার ছদ্মবেশে আমি আদালতের সামনে উপবিষ্ট হয়ে আপনার কাজ করেছি। এতে আপনার কোন লাভ হবেনা বরং আপনি লোকসমাজে লজ্জিত এবং হেয় পরিগণিত হবেন। আবার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এ ব্যাপার নিয়ে নিশ্চুপ থাকাই আপনার মঙ্গল হবে। বনহুর পাশের কক্ষে প্রবেশ করে জজ সাহেবের ড্রেস পরিবর্তন করে ফিরে এলো–নিন, আপনি এবার পাশের ঘরে গিয়ে আপনার ড্রেস পরে নিন। আপনার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে, আমার ড্রাইভার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু সাবধান আমার ড্রাইভারের কোনো রকম ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না।
না না, তুমি তো আমার কোনো ক্ষতি করনি।
হাঁ, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। নির্দোষ একটি প্রাণ অকালে যাতে নিভে না যায় তাই আমি বাধ্য হয়েছিলাম এ কাজ করতে। যান, পাশের ঘরে গিয়ে আপনি নিজ ড্রেস পরিধান করে নিন।
জজ সাহেব পাশের ঘরে চলে গেলেন।
প্রদীপ কুমার অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে, চোখে তার রাশিকৃত বিস্ময়।
বনহুর এবার ফিরে তাকালো, একটু হেসে বললো–প্রদীপ কুমার, আপনি এখন ওদিকের কুঠরীতে গিয়ে নিজকে পরিস্কার করে নিন। মানে মুখের আবর্জনাগুলো চেঁছে ফেলে, আপনার ইচ্ছামত পরিচ্ছদ পরে নিন। যান ঐ যে দরজা দেখছেন, ওটার মধ্যে সব পাবেন।
প্রদীপ কুমারের বিস্ময় এখনও কাটেনি, তবু সে চলে গেলো পাশের কুঠরীর মধ্যে।
জজ সাহেবকে তার গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো বনহুর।
ততক্ষণে প্রদীপ কুমার তার মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ পরিস্কার করে নিয়ে সম্পূর্ণ কালো ড্রেস পরে ফিরে এলো।
বনহুর আনন্দধ্বনি করে উঠলো। জড়িয়ে ধরলো সে প্রদীপ কুমারকে বুকে।
বনহুর প্রদীপের মত কালো ড্রেস পরে নিলো। আয়নার সম্মুখে দাঁড়ালো ওরা দু’জন। আশ্চর্য হলো বনহুর–প্রদীপের চেহারার সঙ্গে তার চেহারা সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। হাসলো বনহুর, আপন মনেই বললো সে–মীরার কি দোষ!
হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো, মীরা চোখ মেলে তাকাতেই বিস্ময়ে আড়ষ্ট হলো। এ কি! সে স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে, একটি নয় দু’টি প্রদীপ কুমার দাঁড়িয়ে তার শিয়রে।
বিছানায় উঠে বসলো মীরা, দু’চোখে তার বিস্ময়। অস্ফুট কন্ঠে বললো–আমি কি স্বপ্ন দেখছি।
হেসে বললো দস্যু বনহুর–মীরা, স্বপ্ন নয় বাস্তব। তুমি না একজন প্রদীপকে হারিয়েছিলে, তাই দু’জন প্রদীপকে তুমি ফিরে পেলে। কিন্তু একজন আসল অপরজন নকল। কে আসল, তুমি বেছে নাও।