ঘরের দরজা এবং জানালার রঙ গাঢ় বেগুনি
বেগুনি রঙ তাকে কখনো আকর্ষণ করে না। তাঁর ধারণা শুধু তাকে না এই রঙ কাউকেই আকর্ষণ করে না। তবু নিয়ম করা হয়েছে সব রেস্টুরেন্টের রঙ হবে বেগুনি। দরজা জানালা বেগুনি, পর্দা বেগুনি, এমন কি মেঝেতে যে কৃত্রিম মার্বেল বসানো থাকবে তার রঙও হবে বেগুনি। রঙের গাঢ়ত্ব থেকে বোঝা যাবে কোথায় কি খাবার পাওয়া যায়। খুব হালকা বেগুনির মানে এখানে পানীয় ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না।
তিনি যে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সে ঘরের রঙ হালকা বেগুনি। তাঁর প্রয়োজন গরম কফির। সিনথেটিক কফি নয়, আসল কফি। সব রেস্টুরেন্টে আসল কফি পাওয়া যায় না। এখানে কি পাওয়া যাবে? আসল কফি খাবার মানুষ নেই বললেই হয়। এত টাকা দিয়ে কে যাবে আসল কফি খেতে? তাছাড়া এমন না যে কৃত্ৰিম কফির স্বাদ আসলের মতো নয়। খুব কম মানুষই প্রভেদ ধরতে পারে। সব রেস্টুরেন্টে আসল কফি রাখে না এই কারণেই।
তিনি রেস্টুরেন্টে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না তা নিয়ে একটু দ্বিধার মধ্যে পড়লেন। বেশি লোকজন হয় এমন জায়গাগুলি তিনি এড়িয়ে চলেন। লোকজন তাঁকে চিনে ফেলে। তারা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে, তিনিও অস্বস্তি বোধ করেন। আজকের এই রেস্টুরেন্টে তিনি যদি ঢুকেন তাহলে কি হবে তা তিনি আন্দাজ করতে পারেন। তিনি ঢাকামাত্র লোকজনের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। শতকরা দশ ভাগ লোক এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে। শতকরা বিশ ভাগ লোক আড়চোখে তাকাবে। বাকিরা এমন এক ভঙ্গি করবে যেন তারা তাকে দেখতে পায়নি। কফির দাম দেবার সময় রেস্টুরেন্টের মালিক বিনয়ে গলে গিয়ে বলবে, আপনি যে এসেছেন এই আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমাদের কফি কেমন লাগল তা যদি একটু লিখে দেন বড় আনন্দিত হই। কফি কুৎসিত হলেও তাঁকে লিখতে হবে-আপনাদের কফি পান করে তৃপ্তি পেয়েছি। পরেরবার যদি এই রেস্টুরেন্টে আসেন তাহলে দেখবেন, তাঁর লেখা এরা ফ্রেম করে বাঁধিয়ে রেখেছে। হাস্যকর সব ব্যাপার। দীর্ঘদিন এইসব হাস্যকর ব্যাপার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে।
রেস্টুরেন্টের মালিক নিজেই চলে এসেছে। বিনয়ে মাথা এমন নিচু করেছে। যে থুতনি লেগে গেছে বুকের সঙ্গে।
খাঁটি কফি স্যার। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের কফি।
ধন্যবাদ।
কফি কেমন লাগল যদি লিখে দেন বড়ই আনন্দিত হব। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আপনি…
দীর্ঘ বক্তৃতার প্রয়োজন নেই। কফি কেমন লাগল আমি লিখে দেব।
আপনার একটি ছবি তুলে রাখার অনুমতি কি স্যার পাব?
না। আমি ছবি তুলতে দেই না।
তিনি কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। কারো দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছেন শতকরা দশজন লোক তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ চোখের পলকও ফেলছে না। এভাবে তাকিয়ে থাকার কি মনে হয়। এমন তো না যে সেকেন্ডে সেকেন্ডে তাঁর চেহারা বদলাচ্ছে। তিনি গিরগিটি নন, মানুষ। যে গিরগিটি মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ বদলায় তার দিকেও মানুষ এভাবে তাকায় না। তিনি ওভারকোটের পকেট থেকে পত্রিকা বের করলেন। নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে ফেলার একটা চেষ্টা। তাঁকে খবরের কাগজ সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হয় শুধু এই কারণেই।
স্যার, আমি কি আপনার টেবিলে বসতে পারি? তিনি খবরের কাগজ চোখের সামনে থেকে নামালেন। বাইশ তেইশ বছরের একজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একগাদা বই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অথচ তাঁকে চিনতে পারছে না। আশ্চর্য! তিনি অসম্ভব বিরক্ত হলেন। এই এক মজার ব্যাপার! লোকজন তাঁকে চিনতে পারলে তিনি বিরক্ত হন। চিনতে না পারলেও বিরক্ত হন।
স্যার, আমি কি বসব?
হ্যাঁ, বসতে পার।
মেয়েটা পরবর্তীকালে বেশ কিছু কাজ করল আনাড়ির মত। চেয়ারটা। টানল শব্দ করে। ধপ করে বসল। কিশোরীর কৌতূহল নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে লাগল।
স্যার, ওয়েটার এসে কি অর্ডার নিয়ে যাবে? না আমাকে খাবার আনতে যেতে হবে? এটা কি সেলফ সার্ভিস?
তিনি খবরের কাগজ ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন। তাঁর গলার স্বর এমনিতেই রুক্ষ। সেই রুক্ষ স্বর আরো খানিকটা কর্কশ করে বললেন, কোনো রেস্টুরেন্ট সেলফ সার্ভিস কি-না, তারা কি ধরনের খাবার দেবে তা রঙ দেখেই বোঝা যায়। তুমি বুঝতে পারছ না কেন?
আমি কালার ব্লাউন্ড। বেগুনি এবং গোলাপি এই দুটি রঙ আমি দেখতে পাই না।
ও আচ্ছা। এটা সেলফ সার্ভিস রেস্টুরেন্ট। তোমাকে গিয়ে খাবার আনতে হবে।
মেয়েটি উঠে চলে গেল। টেবিলের উপর সে কয়েকটি বই রেখে গেছে। সবচে উপরে রাখা বইটার নাম পড়ে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল—অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ, লেখকের নাম আরফব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী, সে পড়ছে। অতিপ্রাকৃত গল্প, এর কোনো মানে হয়? লজিকশূন্য একটি বিষয়ে মানুষের আগ্রহ হয় কি করে কে জানে। তিনি মনে করেন যারা এ সমস্ত বই লেখে তারা যেমন অসুস্থ আবার যারা পড়ে তারাও অসুস্থ।
মেয়েটি ফিরে আসছে। মুখ শুকননা। খানিকটা ব্ৰিত। সঙ্গে কোনো খাবারের ট্রে নেই। মেয়েটি চেয়ারে বসতে বসতে বলল, এখানে জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি। সামান্য কফির দাম চাচ্ছে একুশ লী।
তোমার কাছে কি একুশ লী নেই?
আছে। কিন্তু সামান্য কফির জন্যে এতগুলি লী খরচ করব কি-না তাই ভাবছি।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, এই যে ভাবনাটা তুমি ভাবছ তার মানে তুমি লজিক ব্যবহার করছ। যে মেয়ে লজিক ব্যবহার করে সে কীভাবে অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ পড়ে তা আমি বুঝতে পারছি না।
এই গল্পগুলির মধ্যেও এক ধরনের লজিক আছে। আপনি যেহেতু কোনোদিন এ জাতীয় গল্প পড়েননি আপনি বুঝতে পারছেন না। স্যার, আপনি এই বইটা নিয়ে যান, পড়ে দেখুন।
এ জাতীয় বই আমি আগে পড়িনি তা কি করে বললে?
আপনি হচ্ছেন মহামতি ফিহা। এ জাতীয় বই পড়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।
তুমি আমাকে চেন?
মেয়েটি হেসে ফেলে বলল, আপনাকে কেন চিনব না? আমি কি এই পৃথিবীর মেয়ে না?
কি নাম তোমার?
আমার নাম নুহাশ।
পড়াশোনা কর।
না। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির ক্যাটালগার।
পটে প্রচুর কফি আছে। তুমি ইচ্ছা করলে কফি খেতে পার।
ধন্যবাদ স্যার।
নুহাশ সাবধানে কফি ঢালল। কফির পেয়ালায় ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। ফিহার শুরুতে মনে হয়েছিল এই মেয়েটির চেহারা বিশেষত্বহীন। এখন তা মনে। হচ্ছে না। এর চেহারায় এক ধরনের মায়া আছে যা মানুষকে আকর্ষণ করে। ফিহার ভুরু কুঁচকে গেল। তাঁর চিন্তায় ভুল হচ্ছে। মায়া আবার কি? মায়া তৈরি হয় কিছু বিশেষ বিশেষ কারণে। এই মেয়েটির মধ্যে বিশেষ কারণের কি কি আছে? মেয়েটির কফি শেষ করে রুমালে ঠোট মুছতে মুছতে বলল, এত জঘন্য কফি আমি স্যার জীবনে খাইনি।
ফিহা হেসে ফেললেন। মেয়েটা সত্যি কথা বলেছে। মেয়েটির উপর মায়া তৈরি হবার একটি কারণ পাওয়া গেল, তার মধ্যে সারল্য আছে। আরেকটি জিনিস আছে—মেয়েটি লাজুক কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। লাজুক মানুষের আত্মবিশ্বাস কম থাকে।
স্যার আমি যাই? বইটা কি আপনি রাখবেন?
না। আমি আবর্জনা পড়ি না।
পড়তে হবে না স্যার। শুধু বইটা হাতে নিন। আপনি বইটা হাতে নিলে আমার ভালো লাগবে। আরব আমার খুব প্রিয় লেখক।
ফিহা কঠিন গলায় বললেন, বারবার এক ধরনের কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। তোমাকে তো একবার বলেছি এই আবর্জনা আমি হাত দিয়ে ছোব না।
নুহাশের মুখ কাল হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ চোখ ভিজে গেল। দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা তাঁর কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। এতটা রূঢ় তিনি না হলেও পারতেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের উপর দখল কমে আসছে। এটা ভালো কথা না। এই মেয়েটির একজন প্রিয় লেখক থাকতেই পারে। মেয়েটির প্রিয় লেখক যে তারও প্রিয় হতে হবে এমন তো কথা নেই।
স্যার আমি যাই? আপনাকে বিরক্ত করে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি।
মেয়েটা ঘর ছেড়ে যাচ্ছে। যে ভাবে ছুটে যাচ্ছে তাতে মনে হয় অবধারিতভাবে দরজার সঙ্গে ধাক্কা খাবে। হলও তাই। মেয়েটা দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেল।