ফাগুনের রোজনামচা
অনেকদিন পর হিজলী ফরেস্টের পথে হেঁটে চলেছি। বাঁধপারের লালমাটিয়া পথটা আবছা কুয়াশার ওডনায় মুখ ঢেকে রেখেছে। বসন্তের পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে বন প্রকৃতির বুকে। কচি পাতার ঝালরে সেজেছে বসন্ত বন। ঘেঁটু আকন্দ ভূত ভৈরবীর ঝোপে ফুলের বান ডেকেছে। ভ্রমর মৌমাছি প্রজাপতির মজলিস সেখানে। বাসক গাছের পান্না সবুজ পাতার ফাঁকে সাদা ফুলের মিনাকারি। মৌটুসী আর প্রজাপতি সেখানে গলাগলি করছে। দূরে লালমাটির পথের বাঁকের মহুয়া গাছটাতে কচি পাতার নরম সবজে গোলাপি— কুসুম পাতার লাল শরমে
শিউরে ওঠে মহুয়া সই।
গোলাপী আর সবুজ মিশে
বসন্ত আজ রং থৈথৈ।
দূরে ফরেস্টের বেড়াতে বাগানবিলাস আর ফাগুন বউয়ের দেমাকি উপস্থিতি—
কচি পাতার সবুজ রঙে
বসন্ত তার সোহাগ পাঠায়
ফাগুন বউয়ের হলুদ নেশা
সেই সবুজে জড়িয়ে যায়!
রাখা জঙ্গলের সবুজ অন্ধকার চিরে প্রাচী কপোল রাঙ্গা করে দিনমণির উদয় হচ্ছে। দোয়েল ফিঙে বেনেবউ হরিয়াল সমস্বরে ভোরাই জুড়েছে। রাখা জঙ্গলের প্রাণচাঞ্চল্যে প্রকৃতি উদ্বেল। বাঁধ পাডের রুদ্রপলাশ এ একটি-দুটি কুঁড়ি এসেছে। ফাগুন বন উন্মুখ হয়ে আছে ঋতুরাজের আগমন প্রতীক্ষায়।
” জলে স্থলে বনতলে” দোল লাগিয়ে রঙের বন্যা বইয়ে আসছে বসন্ত।
” আমি রইতে নারি ঘরে”—- হেঁটে চলেছি জঙ্গল পথ ধরে। রাখা জঙ্গলে র সবুজ অন্ধকারে এক আবেশী বনজ গন্ধ। নাম না জানা কোন তীব্র গন্ধী ফুল ফুটেছে সেখানে। শিরিষ গাছের ছাতারের বাসা খোঁজা পাপিয়া টা এক ভাবে ডেকে চলেছে– পিউ কাঁহা –পিউ কাঁহা –পিউ কাঁহা! ডাকটা যেন বুকের গহীনে ব্যথার লহর তুলছে। একপা দুপা করে জঙ্গলের পথে এগিয়ে গেলাম। একরাশ ঝরাপাতার বাদামি গালিচা পাতা। দূরে ছোট শাল গাছের ঝোপে স্বর্ণলতার ঝালর ঝুলছে। যেন প্রকৃতির সবুজ ওডনায় সোনালী পাড়। জঙ্গলের মাঝে একটা ফাঁকা মাঠ মত —পাথর চাট্টান। চারপাশের বড় বড় গাছের বেষ্টনী। একসময় বোল্ডার তোলা হতো এখান থেকে। পাথর খাদান এর গর্তে বর্ষার জল জমে ।অন্যসময় বেনা কাশের ঝাড় জন্মায়। তেলে মুনিয়া ,গাংশালিক সেখানে মজলিস বসায়! এই পাথর খাদান এর মাঝে মাঝে দু একটা পলাশ গাছ! আগুনে ফুলের সম্ভারে উপচে পড়ছে! এখন কালচে কুঁড়িতে ঢেকে আছে শাখা। দু-একটা কমলাকুঁডি লাজুক মুখের ঘোমটা খুলতে চলেছে। বড় ভালো লাগলো। পুরো খোয়াই টাঁডের সরজমিনে সবুজ শাল জঙ্গলের কিনারা বড় মনকাড়া প্রকৃতি। আস্তে আস্তে দিনমণির তেজ বাড়ছে। জঙ্গল পথ ধরে বড়রাস্তার অভিমুখে চললাম। নয়ানজুলি পাশে পাশে বকদের বাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। অনেক দেরি হয়ে গেছে যে ।চললাম আপন যাপন বৃত্তে।