পোথোম পড়বো ( কুমিল্লা স্পেশাল )
আমরা, আমরা মানে আমিপাদ আর হুবহু আমার মতন সিদ্ধাচার্য আরও কয়েকজন, মানে লুইপাদ, কাহ্ণপাদ, ভুসুকপাদ, সরহপাদ, শবরীপাদ, বিরূপাদ, লাড়ীডোম্বীপাদ, কুম্বলাম্বপাদ, ঢেন্ডনপা, কুক্কুরীপাদ, কঙ্ককপাদ, গুণ্ডরীপাদ, চাটিলপাদ, ডোম্বীপাদ, শান্তিপাদ, মহিত্তাপাদ, বীণাপাদ, আজদেবপাদ, দারিকপাদ, ভাদেপাদ, তাড়কপাদ, জঅনন্দিপাদ, ধামপাদ, আর তান্তিপাদ মাঝরাতে, এই নাইটক্লাবে জড়ো হয়েছি, প্ল্যানচেটে যে বা যারা আসতে চায় বা চান তাদের আদর-আপ্যায়ন করার জন্য, প্রমাণ করার জন্য যে আধুনিকরা যে প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করতো না তা তাদের রদ্দি মগজের ফসল, আমরা এখন উত্তরাধুনিক যুগে, প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করি আর যেদিন যখন ইচ্ছা একত্র হয়ে মৃত হোক বা জীবিত, মানুষ-মানুষীদের নামিয়ে আনি, তাদের আমরা খাই, খেয়ে আবার ফুৎকারে উড়িয়ে দিই যাতে তারা যে যার দেশে সংসারে সমাজে ফিরে যেতে পারে ।
আমাদের নামের শেষে পাদ আমাদের পদবি, আমরা শাসক আর শোষকের মুখে অনন্তকাল যাবত পাদছি বলে বেদের সময়কার মুনীঋষিরা আমাদের এই পদবি দিয়ে গেছেন। কিছুকাল শাসক-শোষকের আওতার বাইরে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল, সেই তখন থেকেই আমাদের হাবভাব চল-চলন আচার-আচরণ কাজ-কম্মো পোশাক-আশাক হয়ে গেছে ঐন্দ্রজালিক ।
সংসারজীবনে সিদ্ধাচার্যদের নাম ছিল যা ওনাদের পিতৃদত্ত নাম, কয়েকজনের ইতিহাস লুম্বিনি পার্কের নথিতে আছে, যেমন ঋত্বিক ঘটক, বিনয় মজুমদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মলয় রায়চৌধুরী প্রমুখ ।
নাইটক্লাবের নাচ-গান যেমন চলে তেমন চলছে, ডিজের ঝপ্মকঝিলু বাজনার সঙ্গে আধা-ল্যাংটো মেয়েদের নাচ, বিদেশিনি উলঙ্গিনিরাও আছে , বিদেশিনি মানে চিন আফ্রিকা ইউরোপ আমেরিকা মোঙ্গোলিয়ার যুবতীরা, আর ভারতীয় যুবতীরা তো আছেই, নাইটক্লাব মানেই তো যুবতীদের গায়ের সুগন্ধে ম-ম, আর নাচিয়ে যুবকদের তাগড়া ঘামের দুর্গন্ধে ছ্যাছ্যা ।
এতোদিন লোকে অন্ধকারে একজোট হয়ে বসে প্ল্যানচেট করতো, তা ছিল প্রাগাধুনিক যুগের বোকামি, এখন বিজ্ঞানের সঙ্গে যখন উত্তরাধুনিক যুগ এসে পড়েছে তখন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আমরা এই লেজার আলোর ঝিলমিলে অন্ধকারে নাইটক্লাবের একেবারে মাঝখানের বিশাল টেবিলটা আগে থাকতে অর্ডার দিয়ে সংরক্ষণ করে রেখেছি, নাইটক্লাবের কর্তা জানেন যে আমরা সিদ্ধাচার্য, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী, তাই ছয় মাস অন্তর আমাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্হা করেন ।
হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে, সাজানো বাগানের পরের স্টপের নাইটক্লাবের উত্তেজনাপ্রবণ ঝিলঝিলে আলোয়, গোরা, মানে যার নাম লুইপাদ, আমার দিকে না তাকিয়েই, জিগ্যেস করল, আচ্ছা, আপনি লুইপাদের কাছেই বা এসেছেন কেন ? জানলেনই বা কেমন করে যে লুইপাদ প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে আসে ?
আমি মানে আমিপাদ বলল, তুমি ক্লাসিক পর্যায়ের যুবক বলে ; তোমাকে দেখতে শুনতেও ভালো, টকটকে গায়ের রঙ, এখনকার ইনডিয়ানদের মতন ল্যাদখোর নও, মাথায় ছ’ফুট লম্বা, হাড় চওড়া. দু’হাতের মুঠো যেন বাঘের থাবার মতন ; তাছাড়া তোমার চরিত্রের তো কপিরাইট আর নেই । কপিরাইট শেষ হয়ে গেলেই ক্লাসিক পর্যায়ে চলে যায়, আই মিন ধ্রুপদি । আর এই ভাষায় যারা ধ্রুপদি ভাবুক তারা সন্ধ্যায় এখানেই নিজের সঙ্গে নিজে মজে থাকে । তুমি তো হিন্দুহিতৈষী সভার সভাপতি ছিলে, কপালে সিঁদুরের তেলক কেটে বেরোলে খোট্টা ভামরাও ভড়কে যেতো ।
হ্যাঁ, লুইপাদের বাপ ছিল আইরিশম্যান, মিউটিনির সময়ে পিরালির ঠাকুর রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়ে দু’মলাটের সংসারে ঢুকিয়েছিলেন, আর লুইপাদ মানে আমি যে কেবল হিন্দু নই তা তো পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়ি গিয়ে ওনাকে প্রণাম করে জানিয়েছিলাম, জানেন তো আপনি, লুইপাদের বন্ধু বিনয়ের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, বিনয় বলেছিল আমাকে ; বিনয়কে জানেন তো ? ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইয়ের বিনয় নয়, হিন্দুহিতৈষী সভার সেক্রেটারি বিনয়ভুষণ চট্টোপাধ্যায়। সে যাকগে যাক । ‘ফিরে এসো, চাকা’র বিনয় তো নামকরা সিদ্ধাচার্য, ওই তো, কুম্বলাম্বপাদ, গণিত নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে ব্যস্ত ।
আমি, মানে আমিপাদ, মনে-মনে ভাবছিল, পিরালির ঠাকুর লুইপাদ মানে গোরার লেংটু নিয়ে দুচারকথা লেখেননি কেন ? আইরিশম্যানের ছেলে, লম্বা-চওড়া জোয়ান, লেংটু তো সাধারণ বাঙালি ছেলে-ছোকরার চেয়ে মাপে বেশ বড়ো আর ফর্সা তো হবেই । কে জানে, হয়তো মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দুচারটে ছাত্রীকে টোপ দিয়ে ফাঁসিয়েও থাকতে পারে। ছাত্রীদের কি ইচ্ছে করে না ধবধবে ফর্সা লেংটু নিয়ে খেলা করবার, একবার এই পাশ একবার ওই পাশ, তারপরে মেমসাহবকো সেলাম দেও, ট্যানট্যাট্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যান !
গোরা মানে লুইপাদ শুধোলো, আপনি তো দেবদাসের কাছে গেলেই পারতেন, ওনারও তো কপিরাইট নেই, উনি আমার চেয়েও বেশি ধ্রুপদি, যাঁর যেমন ইচ্ছে ওনার মুখে সংলাপ গুঁজে দিতে পারেন ; আপনিও আপনার যা ইচ্ছে গুঁজে দেবেন, তবে যতোটা জানি দেবদাস সমকামী ছিলেন না । দেবদাস মানে কুক্কুরীপাদ, ওই যে বোতলের সঙ্গে কথা বলছেন সন্ধেবেলার সান্ধ্য ভাষায় ।
নাইটক্লাবের এলজিবিটিরা জোড়ায় জোড়ায় নাচছে চুমু খাচ্ছে, ভাগ্যিস শুনতে পায়নি লুইপাদের কথা।
লুইপাদ মানে গৌরমোহনের কথা শুনে চটে গেলুম । বললুম, আরে ওই মাগিবাজটার কথা বোলো না, আমড়াগাছিতে গিয়ে সারাদিন বাংলা টেনে পড়ে থাকে, এরেকটাইল ডিসফাংশানে ভোগে, দিনভর পারো পারো বকতে থাকে, আমার কাছে ভায়াগ্রার টাকা চাইছিল সেদিন । একদিন গিয়ে দেখেছিলুম । চন্দ্রমুখী নামের সেয়ানা ডবকাবুকো মেয়েটা যতো বলছে হ্যাঁ পারি পারি, পারব না কেন, বিছানায় তো এসো, শুধু বোতল নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেলে চলবে নাকি ।
লুইপাদ আমার দিকে ঝিমধরা চাউনি মেলে তাকিয়ে আছে দেখে বললুম, অর্থাৎ আমিপাদ বলল, মানে কুক্কুরিপাদ সম্পর্কে বলল, ব্যাটার অতো বয়স হয়ে গেল তবু কচি খোকার মতন ছোটোবেলাকার কোন এক গেঁয়ো প্রেমিকার জন্য সিরোসিস বাধিয়ে ফেললে । ওকে দিয়ে কাজ হবে না ; সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না । তোমার সঙ্গে একই আশ্রমে থাকেন নাকি ? এড়িয়ে যেও, মাতাল-সিদ্ধাচার্যদের এড়িয়ে যাওয়াই মঙ্গল । পালিয়ে গিয়ে যখন তিব্বত, নেপাল আর চীনদেশে শুধু কুক্কুরীপাদ কেন, আমিপাদসহ সকলেই খেতুম ছাঙ, রাকসি আর তোঙবা মদ, নিষেধ ছিল না । নিষেধের ব্যাপারটা নিয়ে এলো আধুনিকতাবাদীরা । এখন উত্তরাধুনিক যুগে আর কোনো নিষেধের বালাই নেই ।
গোরা, মানে লুইপাদ, এক চুমুকে হুইস্কি শেষ করে বললে, দোষটা কুক্কুরীপাদ মানে দেবদাসের নয়, আফিমসায়েবের, সতেরো বছর যদি আফিম খাইয়ে ট্যাঁকের ডিবেতে বন্ধ করে রেখে তারপর বাইরে বেরোতে দেন তো বয়স বেড়ে যাবেই, সতেরো প্লাস সতেরো চৌত্রিশ বছর বয়স । চন্দ্রমুখীর উচিত ছিল দেবদাসের ভুট্টায় জাপানি তেল মাখানো ।
কথাটা শেষ হবার আগেই, বোধহয় প্ল্যানচেটে আদর আপ্যায়নের নেওতা দেয়া হয়েছে বলে, একাবারে খালি গায়ে উদোম ধবধবে স্কারলেট জোহ্যানসন, জেনিফার লরেন্স, চারলিজ থেরন, ন্যাটালি পোর্টম্যান, অ্যাঞঞ্জেলিনা জোলি, স্যাণ্ড্রা বুলোক, এমা স্টোন, কেট ব্ল্যানচেট, কিয়েরা নাইটলি, জেনিফার অ্যানিসটন নিকোল কিডম্যান আর জুলিয়া রবার্টস দুই বুকে দুহাত রেখে নেচে-নেচে গাইতে আরম্ভ করলে, মাই গড, বাংলা গান, আর সেকি বুকদোলানি কোমরানাচানি, মেমদের বুক দুটোকে যে লাউ বলে তা আগে সন্দেহ থাকলেও আজ যাকে বলে নিরসন হওয়া, তাই হলো, এর আগে, সত্যি, নিরসন বলতে যে কী বোঝায় জানতুম না, যখন কিনা আমি একজন আমিপাদ । গোরা, মানে লুইপাদ, মাথা দোলাতে লাগল গানের তালে তালে :
সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী
লাউয়ের আগা খাইলাম
ডোগা গো খাইলাম
লাউ দি বানাইলাম ডুগডুগি
লাউয়ের এতো মধু
জানেগো জাদু
লাউ ধরলাম সঙ্গের সঙ্গী
আমি গয়া গেলাম
কাশি গো গেলাম
সঙ্গে নাই মোর বৈষ্ণবী
সিদ্ধাচার্য আমিপাদ উঠে দাঁড়িয়ে ওদের কয়েকজনকে টকাটক খেয়ে ফেলতে লাগল, সবই ফসকা, রঙিন বাতার দিয়ে গড়া, কোনোই অসুবিধা হলো না ওদের পুরো গিলে ফেলতে । আমিপাদের দেখাদেখি আরও কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ সিদ্ধাচার্য বিরাট হাঁ করে চুমুক দেবার মতন করে খেয়ে ফেললেন বিদিশিনি উলঙ্গিনিদের, পেটে হাত বুলিয়ে ঢেঁকুর তুলতে লাগলেন । শ্বেতাঙ্গিনিদের খেয়ে ফেলার পর সিদ্ধাচার্যরা সকলেই গৌরবর্ণের হয়ে উঠলেন । নাইটক্লাবের মালিকের আনন্দ ধরে না, গিয়ে সব আলো নিভিয়ে দিলেন, গৌরবর্ণের মানুষের দেহের আলোয় পুরো নাচঘর আলোয় আলো হয়ে গিয়েছিল ।
উপস্হিত সিদ্ধাচার্যরা, আমিপাদসহ, লুইপাদ, কাহ্ণপাদ, ভুসুকপাদ, সরহপাদ, শবরীপাদ, বিরূপাদ, লাড়ীডোম্বীপাদ, কুম্বলাম্বরপাদ, ঢেন্ডনপাদ, কুক্কুরিপাদ, কঙ্ককপাদ, গুণ্ডরীপাদ, চাটিলপাদ, ডোম্বীপাদ, শান্তিপাদ, মহিত্তাপাদ, বীনাপাদ, আজদেবপাদ, দারিকপাদ, ভাদেপাদ, তাড়কপাদ, জঅনন্দিপাদ, ধামপাদ, তান্তিপাদ প্রমুখ সবাই বলে উঠলেন, সাধু সাধু, আজ প্রমাণ হয়ে গেল যে আধুনিকতা ছিল একটা বুজরুকি, এখন উত্তরাধুনিক যুগে প্ল্যানচেটে আদরের নেওতা দিলে সুন্দরীতমা সুপারস্টাররাও সাড়া দেন, তাঁদের খেয়ে ফেলার আপত্তি করেন না ।
প্ল্যানচেট করার এই সুবিধা, সুন্দরীদের না চাইতেও পাওয়া যায়, হাওয়াকে জড়িয়ে ধরার অভিজ্ঞতা হয়। আমিপাদ বসে পড়ল নিজের চেয়ারে, আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল, অন্ধকারে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকার ব্যাপারটা এমন যে কেউ যদি যেচে দেখা দেয় তাহলেই দেখা যায় । সমীর রায়চৌধুরীর ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পে আছে ।
গোরা, মানে লুইপাদকে আমিপাদ বলল, তুমি মদ খাওয়া শুরু করলে কবে ? পিরালির ঠাকুর তো অ্যালাউ করেননি ।
লুইপাদ বললে, পিরালির ঠাকুরের কথা ছাড়ুন, উনি ছিলেন নাচিয়ে-গাইয়ে, বব ডিলানের মতন মোটা টাকা পেয়েছিলেন, মেডেল পেয়েছিলেন । সে মেডেলখানাও চাটগাঁর চোরের দল নিয়ে চমপট, কপিরাইট ফুরোলে ছাড়াবে বাজারে, কিংবা সেখানের মিউজিয়ামকে বেচবে । উনি যাকে বলেছিলেন মিউটিনি তা তো প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন । আমি সেই স্বাধীনতার প্রডাক্ট । বাহাদুর শাহ জাফরকে মনে আছে আপনার ? চেঙ্গিজ খানের বংশধর ? আটটা বউ আর সাতাশিটা হারেমের বাঁদির সঙ্গে শুতো আর কবিতা লিখতো, শেষে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের সামনে কেলিয়ে পড়লো । কবিতা লিখিয়েদের শেষ পর্যন্ত বাহাদুরশাহ জাফরের অবস্হা হয় । আমাদের কুক্কুরিপাদ মানে দেবদাসও তাই, বুঝলেন কিনা, প্রেমে পাগল হয়ে সংলাপ আউড়েই ফেঁসে গেল । আপনিপাদ যেমন জানেন যে লুইপাদ প্রতি সন্ধ্যায় এখানে আসে, কুক্কুরীপাদ মানে দেবদাসও জানে, হয়তো এসেও পড়েছে অন্ধকারে, একাধজন সুন্দরীতমাকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে রেখে নিয়েছে, কেই বা বলতে পারে, ওর কোনো ঠিক নেই ।
বললুম, তাই তো তুমিপাদকেই যেতে বলছি আমার কাজে ।
এই সময় এক গ্রিক দার্শনিক আমিপাদদের টেবিলে চেঁচিয়ে উঠলো, দার্শনিককে চেনে আমিপাদ, বেহালা না ওই দিকে কোথাও থাকে, নাম ভুসকুপাদ মানে পণ্ডশ্রম সেন, সব সময় গ্রিক দেবতাদের পোশাক পরে থাকে, সারা পোশাকে মার্কস, এঙ্গলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও, চে-গ্বেভারা, রোজা লুক্সেমবুর্গ, হো চি মিন, ম্যালকম এক্স, কাস্ত্রোর মুখের ছাপ, অনেক সময়ে ফ্যানের হাওয়ায় বা ঝড়ে মুখের ছাপগুলো ওর গ্রিক পোশাক থেকে খসে উড়ে যায়, নিজেকে বলে প্ল্যাটোর সময়কার সিদ্ধাচার্য, হতেও পারে, এই উত্তরাধুনিক যুগে তো সবকুছ চলতা হ্যায়, কোনো এক সুন্দরীতমাকে অর্ধেক খেয়েছে, তার উরু থেকে পা পর্যন্ত বেরিয়ে রয়েছে মুখ থেকে, কোঁৎ পেড়ে অ্যানাকোণ্ডার মতন গিলে ফেলল আর বসেই নিজেকে নিজে জ্ঞান দিতে দিতে লাগল, লুইপাদ মানে গোরার শুনতে ভালোই লাগছিল, দার্শনিকদের ও বড্ড ভালোবাসে, ওর মতে দার্শনিকদের মতো প্রতিভা-ঝিংচাক আর নেই ।
ভুসকুপাদ, মানে পণ্ডশ্রম সেন সবাইকে একটা করে সোভিয়েত আমলের ঘুষি পাকিয়ে স্যালু্ট ঠুকলো, তেমনটাই মনে হলো অন্ধকারে, ওটা আসলে অন্ধকারকে সেলাম, ভুসকুপাদের ঢেঁকুরের গন্ধে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ছাড়া হাওয়া বেরিয়ে এলো,তারপর বলা আরম্ভ করল, একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথার সম্পর্ক ভুসকুপাদ মানে পণ্ডশ্রম সেন নিজে, আমরা আর কীই বা করি, শুনলুম বসে-বসে : “কিছুই আসে-যায় না, তাই-ই করা ; একটা ফুলের দিকে তাকিয়ে ভাবি ফুলটা আমায় পছন্দ করছে তো ; প্রতিবাদ এক ধরণের বিশ্বাস, আর পাঁচটা বিশ্বাসেরই মতো, যা সন্দেহের উর্দ্ধে নয় ; নিজের চোখে দেখা, নিজের কানে শোনা, নিজের হাতে ছোঁয়ার দৌরাত্ম্য ততদিন চলবেই যতদিন না নিজের ভাবনার লেজটা খসে পড়ছে ; এখানেই শেষ, তবে ভাষার কথাটা মনে করিয়ে দেওয়াটা বাদ দেওয়া গেল না, জীবনের হাত থেকে বাঁচতে চাওয়ায় আশ্চর্যের কী আছে ; লেখা শুরু হয়, আপত্তি কাজ শুরু করে তন্মুহূর্তে ; তবেই এই দাঁড়ায়, তা সে তিনি যে পথিকবরই হন না কেন, যখন পথ যাচ্ছে রোগ আর যুদ্ধ আর অসহায় ধ্বংসের দিকে, পথ দেখাচ্ছে অবলুপ্তির ইশারা, তোমাকে তো পা টিপেটিপেই চলতে হবে নাকি ; আলো জ্বলতেই সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে, খানিক যাতে দেখতে পায় ; যাই, থেকেই যাই ; যিনি দেশ ও দশের উপকারের কথা ভাবছেন তাঁর থেকে সাবধানে থাকাই ভালো, যদিও তাহলেই, কামড় থেকে নিস্তার পাওয়া নিশ্চিত হচ্ছে না।”
আমিপাদ বলল, ভুসকুপাদবাবু, একটু থামুন, পরে আবার বলবেন আপনার ট্র্যাজেডির কথা, ঠোঁটের কোনে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির থুতু চলে এসেছে । পণ্ডশ্রম সেন থামলেন, আমিপাদ এক পেগ জিন-মেশানো ভোদকা আনিয়ে দিতে, এক চোঁয়ে মেরে দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন । বোধহয় এর পর যা বলবেন তা ফেঁদে নিচ্ছেন সিদ্ধাচার্য সেন ভুসকুপাদবাবু । পেসিমিস্টদের আমিপাদের ভালো লাগে, তারা অন্তত নিজেদের হার স্বীকার করে না, সেই চর্যাপদের দিনকাল থেকে দেখছে তো আমিপাদ ।
লুইপাদ, মানে গোরা এমন টলছিল যে আমিপাদ টের পেলো ওকে শক্তিমাতাল মানে লাড়ীডোম্বীপাদের রোগে ধরেছে, যিনি ঝর্ণাকলমে রাম ভরে একের পর এক প্রেমের কবিতা লিখে চলেছেন । মাতাল অবস্হাতেই লুইপাদ বলল, আপনি এক কাজ করুন, ওই যে দেখছেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সিদ্ধাচার্য, উনি শান্তিপাদ, চুপচাপ লেমোনেড খাবার ভান করছেন, কিন্তু খাচ্ছেন না, ওনার পাশে যে ছোকরাগুলো বসে আছে তাদের গ্যাঁজানি শুনছেন, উনি মাল্যবান, মানে শান্তিপাদ, ওনার কাছে যান, উনি ইজিলি অ্যাভেইলেবল, যদিও ওনার কপিরাইট ফুরোয়নি, কিন্তু যার ইচ্ছে সে-ই ওনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ।
লুইপাদ কথা বজায় রাখল, উনি শান্তিপাদবাবু, আমার কাছে টাকা ধার চাইতে এসেছেন, প্ল্যানচেটে যোগ দেয়া জোর করে, সংসারে বেশ টানাটানি, আমাকে বলছিলেন কয়েকটা কবিতার বদলে কিছু টাকা দাও, একটা উপন্যাসও দিতে চাইছিলেন, বেনামে ছাপতে হবে, কেননা ওনার বউ পড়লে একসঙ্গে বিছানায় শোয়া হবে না আর এই জীবনে । লেমোনেড ধরিয়ে বসিয়ে রেখেছি, বেচারা শান্তিপাদ, হুইস্কি খাবার প্রস্তাব দিতেই আঁৎকে উঠেছিলেন । এমনিতেই বউ পাত্তা দেয় না, তার ওপর মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোলে হয়তো বাড়িতে ঢোকাই মুশকিল হবে । শান্তিপাদের পাশের ছোকরাগুলোকে চেনেন তো, নাকি, তাড়কপাদ, তান্তিপাদ আর আজদেবপাদ? কেনারাম স্ট্রিট কফিখানায় আড্ডা মারে, আজকে শনিবার তো, ওদের মদ খাবার দিন, চাপলুসিটোলায় যায় না, সেখানে অভিজাত লেখকরা যায় না, তাই এই নাইটক্লাবের অন্ধকারে এসেছে, তিনজনই সিদ্ধাচার্য ইন দি মেকিং। আর আপনি তো ডেকেই এনেছেন প্ল্যানচেটের লোভ দেখিয়ে। এবার দেখুন কোথাকার সুন্দরীরা এসে ফুল-মন্টি দোলান ।
আমিপাদ বলল, কী যে বলো ! শান্তিপাদ, মানে মাল্যবান মানুষটা সাহিত্যিক, এক্কেবারে শান্তিপাদ, ক্যাবলা, তোমার মতন স্মার্ট নয়, নিজের মনে ঘেঙিয়ে মরে, দেখে তো মনে হয় পৃথিবীর ‘প’ও জানে না, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে, কে জানে স্কিৎসোফ্রেনিয়া আছে কিনা । আর তুমি যা বলছ, আমিপাদেরও তাই মনে হয়, বাড়িতে সদর দরোজা বন্ধ দেখে ডাকাডাকি না করে রাতভর কলকাতা চষে বেড়ায় ।
মাতাল হলে কী হবে ; লুইপাদ অর্থাৎ গোরা উল্টে আমাকেই চার্জ করল, আপনি সাহিত্যের কী বোঝেন ? সাহিত্য কাকে বলে জানেন ? তখন থেকে ভ্যাজর ভ্যাজর করে আমার নেশাটা মাটি করে দিলেন । এই বোতলটা দেখছেন তো? ১৯৩০ সালের শিভাস রিগাল, যত্ন করে রেখে দিয়েছিলুম, লাতিন আমেরিকার মেমবউ পিরালির ঠাকুরকে দিয়েছিলেন, প্যারিসে চিত্রপ্রদর্শনীর সময়ে, আজকে আমার জন্মদিন বলে খেলুম, আপনি একটু আগে এলে এক পেগ খেতে পারতেন । এই নাইটক্লাব বাইরের মাল এনে খেতে দেয় না, নেহাত আমি রেগুলার কাস্টামার বলে অ্যালাউ করেছে, বলেছে খালি বোতলটা দিয়ে যাবেন । ওই আপনাদের যুগের ডবল ডেকার উপন্যাস লিখিয়েদের মতন আরকি, এই পার আর ওই পার দুই পারেই, পুরোনো বোতলে চাপলুসটোলার মাল ঢুকিয়ে ধ্রুপদি বলে চালিয়ে দেবে । ছাঙ, রাকসি, তোঙড়ার যুগ, যাকে বলে অবসিত ।
আমি, মানে আমিপাদ বলল, না মিস্টার পাদ, আমিপাদ কেবল সিঙ্গল মল্ট খায়, আর ওনাদের, মানে ডবল ডেকার লেখকদের বইপত্তর পড়ার সুযোগ হয়নি আমিপাদের, বড্ডো দাম, যদিও কেনারাম স্ট্রিট ফুটপাতে পাওয়া যায়, কিন্তু কাদের বাড়ির বই, কতোজনের কতোচামের রোগের জার্ম, শুকনো বীর্য, তাই ফুটপাতের বই কিনিনা, তাছাড়া সময় কোথায় ।
ওই যে বললুম, রূপসী বাংলার প্রেমিক শান্তিপাদ, মানে মাল্যবান লোকটাকে নিয়ে যান, বললে লুইপাদ, মানে গোরা, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল ।
আরে, ওসব সাহিত্যিকদের দিয়ে হবে না । কাজটা বেশ রিসকি। তুমিপাদের মতন তাগড়া লোকই চাই । তাছাড়া লুইপাদের ধর্মের মা-বাপ নেই, যদিও এককালে নিজেকে গোঁড়া ব্রাহ্মণ ভাবতে ।
লুইপাদ, মানে গোরা এবার চটে গেল, বলল, সাহিত্যের আপনি কী বোঝেন ? যত্তো প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছেন সাহিত্যকে, কোনো মূল্যবোধ নেই, মানদণ্ড নেই, বিদ্যায়তনিক অনুমোদন নেই ।
আমিপাদও চটে গিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, বলল, আমি আমিপাদ, বুঝলে, সার্টিফায়েড সিদ্ধাচার্য, যে সে লোক নয়, তুমিপাদ বলো, যেমন ? যেমন ?
গোরা, মানে লুইপাদ বললে আপনাদের তো শুধু নারীবাদ, মার্কসবাদ, বিনির্মাণবাদ, উত্তরঔপনিবেশিকতাবাদ, অপরবাদ, চিহ্ণবাদ, কালচারাল মেটেরিয়ালিজম, সবই সরকারদের পোঁদে বাঁশ করার তত্ব । সমীর রায়চৌধুরী নামে একজন ভাবুক ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকা যেদিন থেকে প্রকাশ করা আরম্ভ করেছেন, সেদিন থেকে ছেলে-ছোকরারা ঢুকে গেছে মহাদর্শনের ভুলভুলাইয়ায়, ওনার সঙ্গে আছে ব্রহ্মপুরের মুর্শিদ আলি মণ্ডল, আর আজকাল জুটেছে বৈদ্যনাথ মিশ্র নামের মালদা জেলার এক বামুন , একেবারে রাষ্ট্রের তিন সিংহের ছাপ্পা । এগুলো এসেনশিয়ালিজম । সাহিত্যের জন্যে ওসব তত্ত্ব-ফত্ত দরকার হয় না ।
গোরা, মানে লুইপাদের কথা শুনে মনে হল, আইরিশম্যান নয়, ও বোধহয়, ফরাসি দেশের ষোড়শ লুই-এর বংশধর । মিউটিনি নয়, ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ফুটপাথে কুড়িয়ে-পাওয়া ।
গোরা, মানে লুইপাদ, তারপর একটু শান্ত হয়ে জিগ্যেস করল, তা আমাকে কী জন্যে চাই সেটাই খোলোসা করে বলুন ।
বললুম, এক ট্রাক গোরু পাচার করতে হবে ।
গোরা, মানে লুইপাদ, আমার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে শ্লেষের মুচকি হাসি দিলো, যেন বলতে চাইছে যে গোরু পাচারের জন্যে গেরুয়াল্যাণ্ডে নানা জায়গায় চালক-বাহকদের পিটুনি দিয়ে ঠগিরা ঠেঙিয়ে মেরে ফেলছে বটে, কিন্তু লুইপাদের দিকে দশ জন লোক লাঠি হাতে এগোলেও ও তাদের ক্যাঁৎকা কোঁৎকা দিয়ে কুপোকাৎ করে দিতে পারবে ।
মাল্যবান, মানে শান্তিপাদ লোকটা বোধহয় আমাদের আলোচনা শুনতে পাচ্ছিল, নিজের অন্ধকারেই নিজের চেয়ার থেকে সঙ্গে অন্ধকার নিয়ে উঠে এসে বসল আমাদের দুজনের মাঝের অন্ধকার চেয়ারে, হাতে লেমোনেডের গেলাস, বোঝা যাচ্ছে খায়নি, হয়তো মনে করে লেমোনেড খেলেও নেশা হবে, কবিতার লাইন মগজ থেকে হাপিশ হয়ে যাবে, কিংবা জেনিফার অ্যানিস্টনকে খেয়েছে, ওর বুক দুটো জেনিফার নিজের দুই কাঁধে ফেলতে পারে বলে চকচকে পত্রিকায় কতোবার যে রসিয়ে লিখেছে । চেয়ারে কুন্ঠিত বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বসে মাল্যবান, মানে শান্তিপাদ, বললে, আপনাদের আলোচনা কানে আসছিল, এই যে আপনি গোরু পাচার করতে চাইছেন, গোরুদের প্রত্যেকের পাসপোর্ট করিয়েছেন কি, তাদের ভিসা পেয়েছেন কি ?
আমিপাদ বলল, মশায়, পাচারের ব্যাপারে পাসপোর্ট ভিসা লাগে না ; তাছাড়া আমিপাদ গোরুগুলোকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার করবে না, বুঝলেন । আমি হলুমগে আমিপাদ, হেলাফেলার লোক নই ।
মাল্যবান, মানে শান্তিপাদ, অপ্রস্তুত । লেমোনেড এক চোঁয়ে খেয়ে নিয়ে, গলায় আটকে থাকা জেনিফার অ্যানিস্টনকে ধুয়ে পাকস্হলিতে নামিয়ে, ফ্যালফ্যালিয়ে জিগ্যেস করল, তাহলে ? পাচার তো এক দেশ থেকে আরেক দেশেই হয় বলে জানি । আমাদের ক্যানিঙ আর বাংলাদেশ থেকে কতো কচি-কচি মেয়ে যে আরব দেশগুলোয় পাচার হয়ে যাচ্ছে, রোজ কানে আসে, আমাদের কাজের বউ তো ক্যানিঙে থাকে, খুলনা থেকে এসেছে মাস তিনেক হলো, ছি-ছি, এই জন্যেই আমি রূপসী বাংলার পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে রেখেছিলাম, জানতাম, একদিন বাঙালির এই দশাই হবে ।
আমিপাদ বলল, শান্তিপাদবাবু, গোরুগুলোকে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার রাজ্যে পাচার করা হবে, বুঝলেন, তাতে পাসপোর্ট লাগে না, কিন্তু পথের আনাচে কানাচে আজকাল ঠগিদের বংশধররা লাঠিসোঁটা নিয়ে লুকিয়ে থাকে, কোনো কোনো ভাষার ঠগিরা এই কিছুদিন আগেই কয়েকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেললে ।
গোরা, মানে লুইপাদ, শান্তিপাদ মানে মাল্যবানের কথা একাগ্র হয়ে শুনছিল, বললে, ওর গমগমে মোদো গলায় বললে, শান্তিপাদবাবুর পাসপোর্ট ভিসার আইডিয়াটা মন্দ নয়, হয়তো এক ভাষার লোকেরা মনে করে তাদের ভাষার এলাকা আর সংস্কৃতি হলো আলাদা দেশ, তাদের ভাষা শ্রেষ্ঠ, তাদের ভাবনাচিন্তা সবচেয়ে শ্রেয় আর কল্যাণকর । সেক্ষেত্রে প্রতিটি গোরুর পাসপোর্ট-ভিসা না থাকলেও, অন্তত ফোটো আইডেনটিটি কার্ড যদি থাকে তাহলে হয়তো বিপদের সম্ভাবনা কম ।
মাল্যবান, মানে শান্তিপাদবাবু লোকটি তার প্রস্তাবের প্রশংসা শুনে উত্তেজিত, বললে, আপনারা সাহিত্য নিয়ে কথা বলছিলেন, তা থেকে গোরুতে চলে গেলেন, অ্যাকচুয়ালি আমি সাহিত্যের কথাবার্তা শুনেই এসেছিলাম আপনাদের নিকটে বসব বলে, গলায় জেনিফার অ্যানিস্টন আটকে গিয়েছিলেন বলে বিলম্ব হলো । জানি, গোরু দুধ দেয় এবং সাহিত্য থেকেও পুষ্টিকর দুধ দই মাখন ঘি ছানা পনির খোয়া পাওয়া যায় ।
আমিপাদের দিকে ইশারা করে শান্তিপাদকে লুইপাদ বললে, এই মালটা তখন থেকে আমাকে জপাচ্ছে গোরু পাচারের ব্যাপারে, তারপর হঠাৎ সাহিত্য নিয়ে পড়ল । এরা কী জানে সাহিত্যের, বলুন শান্তিপাদবাবু, আরে নিজেদের বিকিকিনির বাজার নিয়ে মজে আছেন তাতেই থাকুন দিকি, সাহিত্য নিয়ে মেলা ফ্যাচ-ফ্যাচ করবেন না । লেখালিখির একটা মানদণ্ড আছে, সৌন্দর্যের সেই মানদণ্ড প্রয়োগ করেই বোঝা যায় একটা লেখা সাহিত্য হলো না হলো না । মানদণ্ড, যাকে ইংরেজিতে বলে ক্যানন, তা আমার পুর্বপুরুষ ইংরেজরাই এনেছিল এদেশে ।
শান্তিপাদবাবু অবাক চাউনি মেলে ধরল লুইপাদের দিকে । জিগ্যেস করল, আপনি তো গৌরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বোধহয় পরে আমার বাবার মতন ব্রাহ্মধর্ম নিয়েছিলেন, তা ঠিক জানি না, কিন্তু ইংরেজরা আবার কবে আপনার পূর্বপুরুষ হলো ? তা যাক আপনার জন্মের উৎস জানতে চেয়ে বিব্রত করতে চাই না । বরং সাহিত্যের আলোচনায় ফিরে যাওয়া যাক ।
লুইপাদ কথা বলতে আরম্ভ করে ক্রমে গলার স্বর উচ্চগ্রামে নিয়ে গেলো, সাহিত্যের মানদণ্ড বা ক্যানন এলো কোথ্থেকে, বলুন, বলুন, আপনারা, এই তো এক্ষুনি আমায় জ্ঞান দিচ্ছিলেন । লাতিন আর গ্রিক সাহিত্য থেকে, ধ্রুপদি সাহিত্য থেকে, আপনারা বাঙালিরা সেইটাই লুফে নিলেন আর ভাবলেন মানদণ্ডটা আপনাদের অধ্যাপক অচ্যুত গোস্বামী, নীহাররঞ্জন রায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, অতল সুর, সুকুমার সেন, শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্য বিশ্বাস, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, উজ্জ্বল মজুমদারদের তৈরি । ক্যানন হলো মানবের জীবনাবস্হার অভিপ্রকাশ ; তা হলো শুভচিন্তা যা মানবসমাজে ক্রিয়ান্বিত, আর লেখালিখির বিষয়বস্তু হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাকে সঠিক প্রকাশ করার জন্যই লেখার মানদণ্ড বা ক্যানন, প্রেমের আহ্লাদ, মৃত্যুর দুঃখ, দায়িত্বের ব্যথা, যুদ্ধ আর দাঙ্গার আতঙ্ক, আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নিজেকে আর নিজের আত্মাকে স্বীকৃতিদান ।
শান্তিপাদবাবু যে ছোকরাদের পাশে এতক্ষণ বসেছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে এক ছোকরা, যার নাম আজদেবপাদ, চেঁচিয়ে বলে উঠল, লুইপাদদা, এই বিষয়ে আমাদিগেররও বক্তব্য আছে ; জানেনই মদ খাইলে আমাদিগের চিন্তা চাগাড় দিয়া উঠে ।
বুঝতে পারলুম, ওল্ড মঙ্ক টেনে আজদেবপাদ ওল্ড বাংলায় ফিরে গেছে, মুখ দিয়ে সাধু বাংলায় ভকভক করে সংলাপ বেরুচ্ছে, ভাগ্যিস চর্যাপদের সময়কার ভাষা ভুলে গেছে ।
শান্তিপাদবাবু একাগ্র হয়ে শুনছিলেন । লুইপাদের কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন, ওগুলো অবাস্তব আর দমনের তর্ক । বলেই তিনি বেশ বিব্রত, অন্ধকারে অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখ দেখে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বুঝলুম, কেননা লুইপাদ যদি টাকাটা না দেয় তাহলে উনি হাতটানে পড়বেন । ধুতির কোঁচা দিয়ে লেমোনেড আর জেনিফার অ্যানিস্টন খাওয়া ঠোঁট মুছে বললেন, গতানুগতিক লেখকরা ভাষাবিদ্যাগত হাসিখুশির আড়াল তুলে এই তর্কটিকে তোল্লাই দিতেন বটে, তবে অনেকেই তাঁদের অভিজ্ঞতাকে সুবেদী এবং অতিসূক্ষ্ম তারতম্যের মাধ্যমে উপস্হাপন করতে ভালোবাসতেন, আজও বাসেন ; এবং বইগুলো ছিল জায়মান আলোচনার অংশ, যার বদলরত যোগফল, আর কিছুই নয়, ছিল এবং আছে, আইডিয়ার ইতিহাস হিসাবে । আপনি যদি মানদণ্ডের বিশৃঙ্খলা ঘটান তাহলে লোকে বলবে আপনি মানব সভ্যতায় বিশৃঙ্খলা ঘটাতে চাইছেন । অথচ মৌলিক লেখা লিখতে গেলে বিশৃঙ্খলা ঘটানো ছাড়া উপায় নেই, লুইপাদবাবু আপনি যদি সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের বই ‘খুল যা সিমসিম’ পড়ে না থাকেন, তাহলে এক কপি সংগ্রহ করে পড়ে দেখবেন ।
আমিপাদ আর লুইপাদ দুজনেই টের পেলুম শান্তিপাদবাবুর ছোঁড়া তীর কোন দিকে । আসলে লুইপাদ যতোই বলুক ওর বাপ একজন আইরিশম্যান, পাবলিক মনে করে যে লুইপাদ আসলে পিরালি ঠাকুরের আইভিএফ সন্তান । কোন যুবতী যে মিউটিনির সময়ে ফ্রোজন স্পার্ম নিয়েছিলেন তা কিছুটা রহস্য থেকে গেছে, কিছুটা এইজন্য যে মির্জা গালিব যৎসামান্য ইশারা দিয়ে গেছেন বলে গুজব শোনা যায় ।
শান্তিপাদবাবুর কথায় লুইপাদ কিছুটা আহত হয়েছে বুঝতে পারলুম, মাতাল হলে কী হবে, বাংলা টানার পর চাপলুসটোলায় জঅনন্দিপাদ মানে বাসুদেব দাশগুপ্তকে দেখেছি সত্যি কথায় টলে গেছে । ঘোষভাইদের পোঁদে-পোঁদে ঘুরতো, আমড়াগাছিতে বেবি-মীরা-দীপ্তির ন্যাওটা ছিল, সমীর রায়চৌধুরীর কাছ থেকে টাকা কড়ি চাইতো মাঝে-মধ্যে । ব্যাগপাইপার হুইস্কিকে মনে করতো অমৃত, অথচ সব কয়টা ভারতীয় মদই তৈরি হয় মোলাসেস থেকে, শুধু রঙ আর ফ্লেভার পালটিয়ে দেয়া হয় , প্যাকিঙ আলাদা হয়, তার চেয়ে রাম খাওয়া ভালো, ওটা খাঁটি মোলাসেস । আজকাল তো লোকে বেশ রামভক্ত হয়ে পড়েছে ।
লুইপাদ বলল, আপনি কী ভাবছেন আমি আঁচ করতে পেরেছি ; সব ভারতীয় মদই তৈরি হয় মোলাসেস থেকে, তাদের সঙ্গে দেশি বাংলা মদের বিশেষ তারতম্য নেই । আপনি কি ভাবছেন পিরালি ঠাকুরের আস্তাবলের লোক বলে এসব জানি না ? বিলকুল জানি । ওদের দেশে হুইস্কি তৈরি হয় শষ্য আর মল্টেড শষ্য থেকে, শাদা ওকগাছের কাস্কে রাখা থাকে অন্তত তিন বছর ; মল্টকে কাঠের আগুনে শুকিয়ে নেয়া হয় বলে ধোঁয়ার সোঁদা গন্ধ হয় যা এখানের হুইস্কিতে পাবেন না ; তার কারণ এখানের হুইস্কি তৈরি হয় গুড়ের চাসনি থেকে । ওদের দেশে ব্র্যাণ্ডি তৈরি হয় গ্যাঁজানো আঙুরের সঙ্গে চোলাই করা পোমেস মিশিয়ে । আমাদের দেশের ব্রাণ্ডি মোলাসেসের সঙ্গে সামান্য আঙুরের গ্যাঁজলা মিশিয়ে তৈরি । সুচরিতার পালক পিতাকে দুধের সঙ্গে যে ব্র্যাণ্ডি খাইয়ে বিনয় তরতাজা করে তুলেছিল, তা বিদেশের ।ওদের দেশে জিন তৈরি হয় শষ্যের অ্যালকোহলে জুনিপার মিশিয়ে, তাই ওদের জিনে জুনিপারের সুগন্ধ থাকে ; আমাদের দেশে মোলাসেসের অ্যালকোহলের সঙ্গে জুনিপারের পারফিউম মেশানো হয় । ওদের দেশে ভোদকা তৈরি হয় আলু আর অন্য আনাজের অ্যালকোহলের সঙ্গে আখের রসের পচাই মিশিয়ে । আমাদের দেশে মোলাসেসের সঙ্গে যেকোনো কারবোহাইড্রেটকে গেঁজিয়ে তৈরি হয় ।
শান্তিপাদ শুনছিলেন চুপ করে, বলে উঠলেন, দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে, বাংলা সাহিত্য আজ সবই মোলাসেসের পচাই, মহৎ সাহিত্য বলে আর কিছু রইলো না । মোটা-মোটা ডবল-ডেকার উপন্যাসগুলো খুললেই ভক করে চিনিকলের পচা মোলাসেসের দুর্গন্ধ বেরোয়, মনে হয় টেরিটিবাজারের নর্দমা ।
আমিপাদ বলল, তোমরা দুজনেই গড়বড়ঘোটালা করে ফেলছ । মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি এইজন্য হয় যে মহৎ লেখক আর কবিরা যা লিখতে চান তার টান দিয়ে তাড়িত হন । মানদণ্ড বা ক্যানন হলো মধ্যবিত্তের নিজেদের মূল্যবোধের প্রতিফলনের আকাঙ্খার ফল । ফলে দেখা গেল সাহিত্যিক মানদণ্ডকে শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে, বইয়ের বাজারের ফুলে-ফেঁপে ওঠা, উপন্যাসের চাহিদার রমরমা, কফিহাউস আর সাহিত্যিক আড্ডার প্রসার, রিভিউ আর পত্রিকার ছড়াছড়ি, গ্রামেগঞ্জে বেসরকারি গ্রন্হাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি, ধারাবাহিক উপন্যাসের জনপ্রিয়তা, ডাবল-ডেকার উপন্যাস লিখিয়েদের ঝড়তি-পড়তি দোল-দুর্গোৎসবের ফিকশান আর শয়ে-শয়ে কবিতা, আর সবশেষে সাহিত্যকে বিদ্যায়তনিক সংস্হাগুলোর কুক্ষিগত করার প্যাঁচপয়জার ।
লুইপাদ বলল, বলুন বলুন, শুনছি, ভাববেন না পুরো শিভাস রিগ্যাল বোতলটা ফাঁকা করে দিয়েছি বলে নেশা হয়ে গেছে । গোরু পাচারের প্রস্তাবটাও মনে আছে । ইউ ক্যারি অন । কিন্তু যে জন্য আমরা এখানে জড়ো হয়েছি, প্ল্যানচেটে ঝিংচাক শ্বেতাঙ্গিনি-শ্যামাঙ্গিনি-পীতাঙ্গিনিদের আদর আপ্যায়ন করব বলে, তাঁরা এখনও এলেন না ।
আমিপাদ বললে, আসবেন আসবেন, অপিক্ষে করো দিকিন । শ্বেতাঙ্গিনিরা এসেছিলেন, এবার অন্যরাও নাচতে-নাচতে আসবেন ।
আমরাও শুনছি, বলল আজদেবপাদ আর ওর সঙ্গি দুই পাদছোকরা ।
আমিপাদ কথা বলা বজায় রাখল, বলল, ইউরোপ থেকে আনা ওই যাকে তুমি বলছ মানদণ্ড বা ক্যানন, সেগুলো তিরিশের দশক থেকে পত্র-পত্রিকায় রিভিউকার আর সমালোচকদের দখলে গেল, সেগুলো অধ্যাপকরা হাতিয়ে নিয়ে স্নাতক আর স্নাতকোত্তরের সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিতে লাগল, বুঝতেই পারছ, তারপর থেকে মানদণ্ড বা ক্যানন মানেই সিলেবাস, যার লেখা সিলেবাসে ঢুকতে পারল সে ধ্রুপদি হিসাবে গজিয়ে গেঁজিয়ে ওঠার সুযোগ পেল। অবশ্য সিলেবাসে ঢোকার জন্যেও বেঁচে থাকতেই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়, ঘাপটি মেরে শাসক আর শোষকের পা চাটতে হয়, পা না পেলে অন্য কিছু চাটতে হয় ।
শান্তিপাদবাবু উত্তেজিত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, যা ওনার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না, বললেন, একথা একেবারে সত্যি, ওনারা আমার কবিতা নিয়ে কতোই না রঙ্গরসে রসোগোল্লার মতন ভাসেন, অথচ আমার উপন্যাসগুলোকে অবহেলা করেন, বলেন বাক্যগুলো বড্ডো জটিল, ছাত্ররা বুঝতে পারে না, অথচ তারা দিব্বি জেমস জয়েস আর প্রুস্ত বোঝে ।
আমিপাদ মাল্যবানবাবুর কাঁধে হাত রেখে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, মানদণ্ডের গেটকিপাররা প্রায় সকলেই অবসর নিয়েছেন, এখন নতুন যুবকদের প্রজন্ম এসেছে বাংলা আর তুলনামূলক বিভাগগুলোয়, তারা আপনার ফিকশানগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় । তারা যখন সিলেবাস তৈরি করবে তখন অনেককিছু পালটে যাবে। গেটকিপাররা যতোদিন ছড়ি ঘোরাবে ততোদিন তারা একশো শ্রেষ্ঠ কবি আর একশো শ্রেষ্ঠ গল্পকার বা একশো শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের পাঁজি তৈরি করতে থাকবে । পাঁজিগুলোর জন্য গেটকিপাররা একটা চার্জ ধার্য করে রেখেছে, কার পদ্য বা গল্প ঢুকলো তা প্রকাশক বাছাই করে দেয় আর গেটকিপারদের চেক ধরিয়ে দেয়।
শান্তিপাদ বললেন, তা জানি, ওটা ওনাদের রুজিরুটির ব্যাপার, মেয়ের বিয়ে দিতে হয়, বাপের শ্রাদ্ধ করতে হয়, ছাদের ফাটল সারাতে হয়, ছেলেকে ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে হয়, পাড়ার পুজোয় মোটাটাকা চাঁদা দিতে হয়, বউয়ের মেনোপজের হরমোনের খরচ তুলতে হয় ।
আমিপাদ বলল, দেখেছেন তো কমার্শিয়াল পত্রিকার শারদ-ঈদ সংখ্যা বা লেখনপঞ্জিকায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করাবার জন্য কবিরা ছোটো মাপের কবিতা আর গল্প লেখেন, আগে থাকতে লিখে রাখেন, ঠিক সময়ে ছাড়েন ।
যে চেয়ারে শান্তিপাদবাবু আগে বসেছিলেন, সেই চেয়ারের পাশের আজদেবপাদ, তাড়কপাদ আর তান্তিপাদ নামের যুবকপাদ সিদ্ধাচার্যরা চেঁচিয়ে উঠল, পাল্টাইতেছে কোথায় অগ্রজপাদগণ, এখনও হাংরি আন্দোলনের নাম শুনিলে এই বাংলা এবং ওই বাংলা, দুই বাংলার অধ্যাপক আলোচকগণ কাপড়ে-চোপড়ে করিয়া ফ্যালেন ।
যুবকপাদদের বক্তব্য শুনে দূর থেকে মনে হচ্ছিল ওরা বিশ শতকের প্রথম দিকের ভদ্রতা বজায় রেখেছে, হয়তো প্রাগাধুনিক যুগে গঙ্গাজলের সঙ্গে রাম মিশিয়ে খেতো ।
আমিপাদ, মানে আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বললুম, অপেক্ষা করো, সবই সময়ের ব্যাপার ।
অপেক্ষা করতে হলো না । হ্যালি বেরি, জেনিফার হাডসন, ভায়োলা ডেভিস, কেকে পামার, রেজিনা কিং উদোম শ্যামাঙ্গিনি সুন্দরীদের দল খোলা বুকে দু’হাত চেপে বুক আর পাছা দুলিয়ে নাচতে-গাইতে লাগল :
মধু হৈই হৈই বিষ খাওয়াইলা
হন কারণে
ভালোবাসার দাম নও দিলা হন দোষ আন পাই
আশা আছিল তোয়াতে লই
বাইন্দুম একখান সুখের ঘর
সুখের বদলে দুৎখ দিলা
হন কারণে
মধু হৈই হৈই বিষ খাওয়াইলা
হন কারণে
শ্যামাঙ্গিনি বিদেশিনিদের সঙ্গে আজদেবপাদ আর বাকি দুই পাদও নাচতে আরম্ভ করেছিল, গানটা ওরা জানে মনে হলো, সব যুবতীদের ওরাই খেয়ে ফেলবে আঁচ করে বাকি সবাই উঠে শ্বাস টেনে খেয়ে ফেলতে লাগল যার ভাগে যেটুকু পড়ে। আমিপাদের ভাগ্য ভালো যে জেনিফার হাডসনের সিলিকন জেল-ভরা বুক দুটো খেতে পেলো । আগের বার শ্বেতাঙ্গিনিদের খাবার ফলে সিদ্ধাচার্যরা সবাই গৌরবর্ণের হয়ে উঠেছিলেন, নাইটক্লাবের মালিক আনন্দে হাততালি দিয়ে সব আলো নিভিয়ে দিয়েছিলেন সারাঘর গৌরবর্ণ পুরুষের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল বলে । এবার উনি গিয়ে আবার লেজার আলো জ্বালাবার হুকুম দিলেন, কেননা শ্যামান্ধকারে কে কার সঙ্গে কী করবে শেষে পুলিশ কোর্ট কাছারির ঝামেলা ।
আমিপাদসহ লিউপাদ, কাহ্ণপাদ, ভুসকুপাদ, সরহপাদ, শবরীপাদ, বিরূপাদ, লাড়ীডোম্বীপাদ, কুম্বলাম্বপাদ, ঢেণ্ডনপাদ, কুক্কুরীপাদ, কঙ্ককপাদ, গুণ্ডরীপাদ, চাটিলপাদ, ডোম্বীপাদ, শান্তিপাদ, মহিত্তাপাদ, বীণাপাদ, আজদেবপাদ, দারিকপাদ, ভাদেপাদ, তাড়কপাদ, জঅনন্দিপাদ, ধামাপাদ, তান্তিপাদ প্রমুখ সিদ্ধাচার্যরা বলে উঠলেন, সাধু, সাধু, উত্তরাধুনিক যুগে প্ল্যানচেটে যে ঝিংচাক করে সুন্দরীতমাদের ডেকে এনে আদর-আপ্যায়ণ করা যায় তা গোমাতামুখখু আধুনিকরা খাটো চিন্তার ফলে বুঝতেই পারেনি, ছি-ছি ।
লুইপাদ যুবক সিদ্ধাচার্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই আদিত্যপাদ, মন্মথপাদ, নগেন্দ্রপাদ, তোরা যে-যার গেলাসের ওল্ড মঙ্ক শেষ করে নে, আরেকটা বোতলের অর্ডার দিচ্ছি, অন দি রকস খা, গোরু পাচারের আলোচনা জমে গেছে, অংশ নিবি ।
লুইপাদ যাদের সন্ন্যাস জীবনের আগের নামে সম্বোধন করল, আজদেবপাদ, ভাদেপাদ, তাড়কপাদ, তারা টলছিল, যেমন একটু আগে লুইপাদ নিজেই টলছিল । ভাদেপাদ জানতে চাইলে, গোরুপাচারের আলোচনাটা ঠিক ঠাহর করিতে পারিলাম না, আমাদিগের সুবিধার্ধে যদি ব্যখ্যা করেন ।
আমি বললুম, প্রথমে তো গোরু বাছাই, তারপর পাচার । বাছাই মানে মানদণ্ড, লুইপাদ যাকে বলছে ক্যানন, ‘হাওয়া৪৯’এর সম্পাদক সমীর রায়চৌধুরীও ক্যানন নিয়ে যুক্তিতর্ক দিয়ে গেছেন । উনি বলেছিলেন সাহিত্যের মানদণ্ডে রদবদল ঘটতে পারে সময় এবং পরিসর, কিন্তু সাহিত্য বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে মতান্তর বড়ো একটা হয় না । বার্টান্ড রাসেলের মতো আরও অনেককে সাহিত্যের জন্য নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছে যাঁদের নাম শুনে আমরা অবাক হয়েছি, সাহিত্য বলতে উন্নতামানের লেখাই বোঝায়, তা উন্নত কি না সেটা পাঠক নিজেই নির্ণয় নেয় । সে যদি উন্নত মনে করে তাহলে বাড়িতে রাখবে, নয়তো বাজেকাগজঅলাকে বেচে দেবে, তার ছেলে বা নাতি উন্নত মনে না করলে, তারা নিয়ে গিয়ে ফুটপাথে বেচে দেবে। বিদ্যায়তনিক সংস্হাদের ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও, বই বিক্রির ব্যবসাদারদের লবি সত্ত্বেও, মানদণ্ড আসলে এক ব্যক্তিগত নান্দনিকতার এলাকা, যা ক্রমে কৌমের এলাকা হয়ে যায় । অবশ্য সে-বাগানে যে চোরকাঁটা গজাবে না তা জোর দিয়ে বলা যায় না । প্রবাল দাশগুপ্ত, সমীর রায়চৌধুরীকে সাজানো বাগানের পরের স্টপের কথা বলেছিলেন ।
লুইপাদ শুনছিল, দুহাতে গাল রেখে, হয়তো শুনতে-শুনতে সুচরিতার কথা ভাবতে আরম্ভ করেছিল, সুচরিতা মুখোপাধ্যায়, ৭৮ নম্বর বাড়ির পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের পালিতা কন্যা । কিংবা নিজে কোনো আইরিশম্যানের ছেলে, অতএব জারজ, তাই হয়তো ভাবছিল, পিরালি ঠাকুরের ল্যাখা উপন্যাসে এতো বামুনের ছড়াছড়ি কেন । কিংবা পিরালি ঠাকুর হয়তো বলতে চেয়েছিলেন যে যারা ধর্ম নিয়ে বেশি হামবড়াই করে তারা সাধারণত জারজ হয় । আফিমবাবুও কুক্কুরীপাদবাবুকে বামুনবাড়িতেই খুঁজে পেলেন ।
আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে, লুইপাদ মানে গৌরমোহনের হুঁশ হলো, বলল, সাহিত্যের মানদণ্ড ব্যাপারটা অনেকটা গাছের মতন, যাদের শাখা কখনও ছিল মহাকাব্য, সংস্কৃতের ট্র্যাজিক কাব্য, তামিলভাষার কাব্য, কিছু ধর্মশাস্ত্র আর পুরাণের কাহিনি । গাছটা যেমন যেমন বড়ো হতে লাগল, তার ডালে বিদেশ থেকে আনা ফলের কলম লাগিয়ে নাটক, উপন্যাস, বিভিন্ন আঙ্গিকের কবিতা, ছোটো গল্প ইত্যাদি পাওয়া যেতে লাগলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন যেমন মানদণ্ডের গেটকিপারদের কব্জায় যেতে লাগলো, বাংলা ভাষার সিলেবাসটাই হয়ে দাঁড়ালো সবচেয়ে বড়ো বাধা । অনেক আলোচকদের দেখলাম যে তাঁরাও বিরক্ত বোধ করতে আরম্ভ করেছেন, ভালো বই বনাম খারাপ বইয়ের তরজায় । সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে ওনার বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে একবার আলোচনার সময়ে উনি বলেছিলেন যে টেরি ইগলটন প্রশ্ন তুলেছেন যে সাহিত্য বলে আদপে কিছু হয় কিনা । একটা সাহিত্যকর্মের বিশেষ কোনো চি্হ্ণ থাকে না যা দিয়ে কোনো লেখাকে দেগে দেয়া যাবে, তার চেয়ে বাংলা বিভাগগুলোকে ডিসকোর্স ডিপার্টমেন্ট বলা উচিত । কোনো একটা লেখাকে একই মানদণ্ড দিয়ে মাপা হয় না, নানা বোমক্যাওড়ার নানা মত । সমীরবাবু বলছিলেন যে কোনো উপন্যাস নিয়ে ভালো ফিল্ম হলে সেই উপন্যাসে আলোচকরা হঠাৎই উন্নতমানের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান ; বোঝো শ্যামপিয়ারির ঠেলা ।
মন্মথ নামের যুবক সিদ্ধাচার্য, মানে তাড়কপাদ, বলে উঠল, তার গেলাসে রাম ঢালতে-ঢালতে, কবি-লেখক-চিত্রকরগণ মাঝে-মাঝে পিছন ফিরিয়া তাকান, সন্মুখে অগ্রসর হইবার সুবিধার জন্য । পিছন ফিরিয়া, যাঁহাদের শিল্পকর্মকে হিংসা করেন, সেগুলিই সম্ভবত উন্নতমানের ।
শান্তিপাদ সিদ্ধাচার্য মাল্যবান বললেন, তা নয়, তা নয়, আমি পেছন ফিরে তাকানো পছন্দ করি না, হিংসেও করি না কাউকে। মহৎ রচয়িতার সংজ্ঞা যেমন যুগে যুগে পালটে যাচ্ছে, তেমনই সাহিত্য কাকে বলে তাও পালটে যাচ্ছে। তবে একথা ঠিক যে সমালোচনামূলক বিচারপদ্ধতিতে যৎসামান্য বিদ্বেষ থেকে । বুদ্ধদেব বসুকে দেখেছি বিদ্বিষ্ট হতে, তাকে হিংসে করা বলব না, তিনি সেইজন্য সিদ্ধাচার্য হতে পারেননি । মানুষ নিজের ছায়ার বাইরে যেমন লাফিয়ে বেরোতে পারে না, তেমনই নিজের মনের গড়নের বাইরে যেতে পারে না ।
আমিপাদ বুকপকেট থেকে গোরুর তালিকা বের করে লুইপাদ অর্থাৎ গৌরমোহনকে দিতে, শান্তিপাদ অর্থাৎ মাল্যবান জানতে চাইলে, গোরুগুলোর মাতৃভাষা লেখা আছে তো ? নয়তো এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় পাচার করতে গেলে জাগতিক সংকট উৎপন্ন হতে পারে ।
দিতিয় পড়বো ( ময়মনসিংহ স্পেশাল )
তালিকায় চোখ বুলিয়ে গৌরমোহন অর্থাৎ লুইপাদ বলল, আছে আছে, এই নিন হয়তো আপনার ব্রায়ান জিসিন টেকনিকে কাজে দিতে পারে ।
শান্তিপাদ অর্থাৎ মাল্যবান তালিকাটা হাতে নিয়ে সবাইকে শুনিয়ে পড়তে লাগলেন :-
গোরুর প্রজাতি এবং তার মাতৃভাষা
১) গির — গুজরাতি ( মা, মাঁ, মাতাশ্রী, মাম্মি )
২ ) সাহিওয়াল — পাঞ্জাবি, হরিয়ানভি, হিন্দি ( মাই, পাব্বো, মাঁ, মাতাশ্রী, মাম্মিজি )
৩ ) লালসিন্ধি — সিন্ধি, উর্দু ( অম্মি, অম্মা, মাতাশ্রী, মাম্মি )
৪ ) রাঠি — রাজস্হানি-হিন্দি, মারোয়াড়ি, পাঞ্জাবি, হরিয়ানভি ( মা, মাই, মাতাশ্রী, পাব্বো, মাম্মিজি )
৫ ) থারাপারকর — উর্দু, কচ্ছি, রাজস্হানি-হিন্দি ( অম্মি, আম্মা, মাই, মাতাশ্রী, মাম্মিজি )
৬ ) দেওনি — মারাঠি ( আঈ, মাম্মি )
৭ ) হরিয়ানা — হরিয়ানভি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি ( মায়, মাঁ, মইয়া, মাতৃ, মাতাশ্রী, মাম্মিজি )
৮ ) কঙ্করেজ — গুজরাতি, রাজস্হানি-হিন্দি ( মা, মাঁ, মাতাশ্রী, মাম্মিজি )
৯ ) ওঙ্গোল — তেলুগু ( আম্মা, অম্মা, মাম্মি )
১০ ) লাল কান্ধারি — মারাঠি ( আঈ, মাম্মি )
১১ ) নিমারি — ছত্তিশগড়ি হিন্দি ( মায়, মইয়া, মাঁ, মাম্মিজি )
১২ ) মালবি –মধ্যপ্রদেশি হিন্দি, রাজস্হানি হিন্দি ( মায়, মাঁ, মইয়া, মাতাশ্রী, মাম্মিজি )
১৩ ) দাঙ্গি — মারাঠি ( আঈ, মাম্মি )
১৪ ) খিল্লারি — মারাঠি, কন্নডিগা ( আঈ, অম্মা, মাম্মি )
১৫ ) হালিকার — কন্নডিগা ( অম্মা, মাম্মি )
১৬ ) নাগোরি — রাজস্হানি হিন্দি ( মাঁ, মাতাশ্রী, মাম্মিজি )
১৭ ) বারাগুরু — তামিল ( অম্মা, মম্মি )
১৮ ) সিরি — নেপালি, ভুটানি, কোচ ( মাঁ, মইয়া, মায় )
১৯ ) বাচ্ছৌর — ভোজপুরি, মৈথিলি ( মায়, মইয়া, মাম্মিজি )
২০ ) খেরিগড় — উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি ( অম্মি, মাঁ, মাতাশ্রী, পাব্বো, মাম্মিজি )
২১ ) মেওয়াতি — রাজস্হানি হিন্দি ( মাঁ, মাতাশ্রী, মাম্মিজি )
২২ ) উমব্লাচেরি — তামিল ( অম্মা, মাম্মি )
২৩ ) কৃষ্ণা — মারাঠি, তেলুগু ( আঈ, অম্মা, মম্মি )
২৪ ) পোনওয়ার — হিন্দি ( মায়, মাঁ, মাতাশ্রী, মইয়া, মাম্মিজি )
২৫ ) ভেচুর — মালায়ালি ( অম্মা, মাম্মি )
২৬ ) মালেন্দু গিদ্দা — কন্নডিগা, তুলু ( অম্মা, মম, মাম্মি )
২৭ ) কাসারগড় — মালায়ালি ( অম্মা, মম, মাম্মি )
২৮ ) জার্সি ক্রস — বাংলা – ঘটি ও বাঙাল ( ওয়াঁ, মা, মাগো, আম্মা, মম, মাম্মি )
২৯ ) হলস্টিন ফ্রিজিয়ান ক্রস — বাংলা – ঘটি ও বাঙাল ( ওয়াঁ, মা, মাগো, আম্মা, মম, মাম্মি )
পড়া শেষ হলে, সিদ্ধাচার্য শান্তিপাদের মুখে হাসি ফুটলো, বললেন, যাক, দুই বাংলার ভাষাই আছে ।
ওনার কথা শুনে আমিপাদ বললু, আজকাল পৃথিবীতে সর্বত্র মার্কিন প্রভাব । বাঙালির গোরুর ওপরেও না হয় মার্কিন প্রভাব পড়লো, দুধ তো পাওয়া যাবে মাদার ডেয়ারির প্যাকেটে, একটা কোনে ছ্যাঁদা করে জেনিফার লোপেজ বা ব্রিটনি স্পিয়ার্সের দুধের মার্কিন স্বাদ পাবেন ।
শান্তিপাদ বললেন, গোরুর গায়ে তার ভাষা লিখে দেবেন যাতে আবগারি বিভাগ তাদের দুধে ভাষানুসারি ট্যাক্স বসাতে পারে । নয়তো গোরু পাচারে ওরা মোষের ট্যাক্স ধার্য করতে পারে । আমাদের বাংলাদেশে দেখেছি পাচার করা গোরু-মোষের গায়ে আমদানিকারকের নামের আদ্যাক্ষর আর গোরু-মোষ-বলদের গায়ে নম্বর দেয়া থাকে, যাতে কমিশনদারদের ভাগবাঁটোয়ারায় অসুবিধা না হয় ।
উঠে পড়ব ভাবছিলুম । সিদ্ধাচার্য পণ্ডশ্রম সেন অর্থাৎ ভুসকুপাদ নিজের বকবকানি আরম্ভ করে দিলেন । দার্শনিক বলে তো আর ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ে নাইটক্লাবের নাঙ্গা নাচে ভিড়ে যাওয়া যায় না । তাছাড়া শান্তিপাদ আর লুইপাদ দুজনেই বেশ আগ্রহী মনে হল । শান্তিপাদ তো জানি পেসিমিস্ট কিন্তু লুইপাদের আগ্রহের কারণের হদিশ পেলুম না ।
পণ্ডশ্রম সেন অর্থাৎ ভুসকুপাদ মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেই বলতে লাগলেন, “আয়নার মানুষটিও আজ আর তেমন বন্ধু নয় ; বলি না, বিড়বিড় করি, ভয় হয়, পাছে এ-ও ‘বক্তব্য’ না হয়ে ওঠে ; ভরসা নেই, সময়ও কম, আগামীকালের স্মৃতিগুলো এখনই গুছিয়ে নেওয়া ভালো ; রাজা আজও উলঙ্গ, আজও সব্বাই পটাপট হাততালি দিচ্ছে, ওইই জন্যই, আহ রাজা ট্রুলি সৎ, রাজা বোল্ড অ্যাণ্ড বিউটিফুল, রাজা লিবারেল, রাজা ইকোলজিকালি এনলাইটেনড, রাজার ন্যুডিটিই রাজার ফ্যাশান স্টেটমেন্ট, শিশুটি আজ বৃদ্ধ, অনেককালের ব্যাপার, কোমরের ব্যথাট্যাথা সামলে, আলস্য ঝেড়ে, অবশেষে সে পোস্ট করতে বসে, ডিয়ার রাজাসাহেব, নগ্নতার পোশাকটি তোমায় ঢেকে ফেলেছে হে, ভাষাকে জিততেই হয়, সেটাই ভাষার দুর্বলতা ; লেখা লিখি, ছেঁড়া লেখা লিখি, লেখালিখি ছিঁড়ি ; পা পিছলে লেখক হলাম, দাঁড়াতে আর পারলাম কই ; এমনই তার গোগ্রাসে পড়ার ধরন, মনে হয় পাঠশেষে বইটা ডাইরি হয়ে উঠবে ; লেখা লেখে লেখাকেই ; আজ পর্যন্ত লিখিত সমস্ত শব্দের উত্তরাধিকার তোমার, সেটিই তোমার বোঝা, আজ পর্যন্ত লিখিত সমস্ত সাহিত্য তোমার, সেটিই তোমার বাধা।”
পণ্ডশ্রম সেন অর্থাৎ ভুসকুপাদ মাথার চে-গ্বেভারা টুপি দুহাতে একটু চেপে, গ্রিক পোশাকের খাঁজে হাত ঢুকিয়ে আচমকা চুপ করে গেলেন । উঠে, নাইটক্লাবের গেটকিপারকে মুঠোকরা স্যালুট ঠুকে দরোজা খুলে শীতকাল থেকে গ্রীষ্মকালে বেরোলেন, পেছন ফিরে তাকালেন না। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে টের পাওয়া গেল, উনি জুড়িগাড়িতে উঠলেন, যাবেন ঢপের রাজত্বে । কিন্তু কিছুক্ষণেই ফিরে এলেন, মেঝেয় কিছু পড়ে গেছে সম্ভবত, লাড়ীডোম্বীপাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সব কয়টা মুখই পোশাক থেকে কোথায় যে খসে পড়ে গেল, খুঁজে পাচ্ছি না, শেষে ঢপাচার্য না চটে যায় ।
আগে দু’বার নাচিয়েরা যেমন ল্যাংটো হয়ে গাইতে-গাইতে এসেছিলেন, এবার অন্ধকারের সঙ্গে মিশে মোঙ্গোলয়েড আদল-আদরার তরুণীরা দেখা দিলেন, তাঁদের চিনতে মোটেই অসুবিধে হলো না, হাজার হোক আমিপাদরা সিদ্ধাচার্য, গায়ের রঙ হলদেটে, ছোটো-ছোটো বুক, গোলাপি ছোট্টো বোঁটা, তার ওপর হাত রেখে কোমরা দোলাচ্ছেন লুসি লিউ, ফ্যান বিংবিং, ঝাঙ ঝিয়ি, গঙ লি, ঝাঙ ইউকি, ডঙ জিয়ি, জিঙ তিয়ান :
যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম
মইশখালির পানের খিলি
তারে বানাই খাবাইতাম
নয়া মুখের নয়া কথা হুনিতে সুন্দর
মাঝে-মাঝে পান চিবাইত
হাসিরও ভিতর
প্রেমের মালা দোখনো হাতে
তার গলাৎ পরাইতাম
মইশখালির পানের খিলি
তারে বানাই খাবাইতাম
আমিপাদসহ অন্য সিদ্ধাচার্যরা, ভুসকুপাদ ছাড়া, উনি তো আবার বেরিয়ে গেলেন পোশাক থেকে খসে যাওয়া মুখ খুঁজতে, চান্স মিস করলেন, আগের বারের মতনই শ্বাস টেনে-টেনে পীত সুন্দরীদের উদোম দেহকে নিজেদের ফুসফুসে ভরে নিতে লাগলেন চিরযুবক সিদ্ধাচার্যরা, আর ক্রমশ শ্যামাঙ্গ থেকে পীতাঙ্গ হয়ে উঠতে লাগলেন, তাঁদের চোখ ছোটো হয়ে এলো, তাঁদের দাড়ি আর গোঁফের চুল সংখ্যায় কমে গেল, নাক চাপা হয়ে উঠলো, তবু তাঁরা আনন্দে মাতাল তরণী, প্ল্যানচেটে ঝিংচাকে টালমাটাল ।
আমিপাদসহ অন্য সিদ্ধাচার্যরা, ভুসকুপাদ আর জঅনন্দিপাদ বাদ দিয়ে, লুইপাদ, কাহ্ণপাদ, সরহপাদ, শবরীপাদ, বিরূপাদ, লাড়িডোম্বীপাদ, কুম্বলাম্বরপাদ, ঠেণ্ডনপাদ, কুক্কুরীপাদ, কঙ্কপাদ, গুণ্ডরীপাদ, চাটিলপাদ ডোম্বীপাদ, শান্তিপাদ, মহিত্তাপাদ, বীণাপদ, আজদেবপাদ, দারিকপাদ, ভাদেপাদ, তাড়কপাদ, ধামপাদ, তান্তিপাদ প্রমুখ একসঙ্গে বলে উঠলেন, সাধু, সাধু, আধুনিকরা নিজেদের মূর্খতার কারণে প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করেনি, আর আজ আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে প্ল্যানচেটে ঝিংচাক করলেই পৃথিবীর মৃত ও জীবিত সুন্দরীদের নিজের শ্বাসের সঙ্গে বুকের ভেতরে ভরে নেয়া যায় ।
তিতিয় পড়বো ( বগুড়া স্পেশাল )
লুইপাদ অর্থাৎ গোরার কাছ থেকে এক তাড়া দুহাজার টাকার গোলাপি নোট নিয়ে শান্তিপাদ অর্থাৎ মাল্যবান চলে গেলেন । লুইপাদ অর্থাৎ গোরা, আমিপাদ আর অন্য সিদ্ধাচার্যরা মাথা ঝুঁকিয়ে শুনতে লাগল আদিত্য-নগেন্দ্র-মন্মথদের তক্কাতক্কি, মানে আজদেবপাদ, তাড়কপাদ আর তান্তিপাদের গর্মাগরম মাতলামি । শুনতে শুনতে আমিপাদ ভাবছিল, এরা বন্ধু অথচ তুই-তোকারি করে না কেন ? মনে পড়ে গেল ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ আর ‘জঙ্গলের দিনরাত্রী’ বইগুলোর গপপো— কেমন ধরনের বন্ধুর দল যে নিজেদের মধ্যে অশ্লীল গালমন্দ করে না, নোংরা ইশারা করে না, স্নান করার সময়ে কোনো যুবতী দেখে ফেললে কুয়োর পেছনে লুকিয়ে পড়ে, অথচ তারা মদ-টদ টানে, কলকাতায় মাগিবাজি করে । তারাও আসলে পিরালি ঠাকুরের বাচ্চাকাচ্চা, এই আদিত্য-নগেন্দ্র-মন্মথ অর্থাৎ আজদেবপাদ, তাড়কপাদ, তান্তিপাদের মতন, দুমিনিট ম্যাগি দিয়ে গড়া চরিত্তির ।
আজদেবপাদ : সাহিত্য জিনিসটা বিষয়ের উপর বেশি নির্ভর করে না রচনার উপরে ? লক্ষ্যের উপরে না লক্ষণের উপরে ?
তান্তিপাদ : তুমি তো একথাও জিজ্ঞাসা করিতে পার, মানুষ বাম পায়ের উপর বেশি নির্ভর করে, না ডান পায়ের উপরে ?
আজদেবপাদ : মানুষ দুই পায়ের উপর সমান নির্ভর করে, এ যেমন স্পষ্ট অনুভবগোচর, সাহিত্য তার বিষয় এবং রচনাবলীর উপর সমান নির্ভর করে সেটা তেমন নিশ্চয় বোধগম্য নয় এবং এই কারণেই সাহিত্য আজকাল কেহ-বা নীতিকে প্রাধান্য দেন, কেহ-বা সৌন্দর্যকে, কেহ-বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বপ্রচারকে । সেই জন্যই আলোচনা উথ্থাপন করা গেল ।
তাড়কপাদ : বেশ কথা । তা হইলে একটা দৃষ্টান্ত অবলম্বন করিয়া আলোচনা শুরু করা যাক । ভ্রমণকারীদের সুবিধার জন্য যে গাইড-বই রচনা করা হয় এবং ভ্রমণবৃত্তান্ত, এ-দুইয়ের মধ্যে কোনটা সাহিত্য লক্ষণাক্রান্ত সে বিষয়ে বোধকরি কারও মতভেদ নাই ।
আজদেবপাদ : ভালো, মতভেদ নাই — গাইড বই সাহিত্য নহে । কিন্তু ওই কথাতেই আমার সাহিত্যের উত্তর পাওয়া যায় । গাইড-বই এবং ভ্রমণবৃত্তান্তের বিষয় এক, কেবল রচনাপ্রণালীর প্রভেদ ।
তান্তিপাদ : আমার মতে দুয়ের বিষয়েরই প্রভেদ । ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি যেমন একই বস্তুকে ভিন্ন দিক দিয়া দেখে এবং সেইজন্য উভয়ের বিষয়কে স্বতন্ত্র বলা যায়, তেমনি গাইড-বই এবং ভ্রমণবৃত্তান্ত দেশ-বিদেশকে ভিন্ন তরফ হইতে আলোচনা করে ।
তাড়কপাদ : গাইড-বইয়ে কেবলমাত্র তথ্যসংগ্রহ থাকে, ভ্রমণবৃত্তান্তে লেখকের ব্যক্তিগত প্রভাব বিদ্যমান এবং তাহাতেই সাহিত্যের বিকাশ । ব্যক্তিত্ববর্জিত সমাচারমাত্র বি্জ্ঞানে স্হান পাইতে পারে, সাহিত্যে নহে ।
আজদেবপাদ : তাহা হইলে দেখিতে হইবে কিসে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে । কেবল মাত্র তথ্য নিতান্ত সাদা ভাষায় বলা যায়, কিন্তু তাহার সহিত হৃদয়ের ভাব ব্যক্ত করিতে গেলেই ভাষা নানা প্রকার আকার-ইঙ্গিতের সাহায্যে নিজের মতো করিয়া গড়িয়া তুলিতে হয় । তাহাকেই কি ইংরেজিতে ম্যানার এবং বাংলায় রচনাভঙ্গি বলা যায় না?
তাড়কপাদ : কেবল রচনার ভঙ্গি নহে, দেখিবার সামগ্রীটাও বিচার্য । এমন-কি কেবলমাত্র হৃদয়ের ভাবও নহে, কে কোন জিনিসটাকে বিশেষ করিয়া দেখিতেছে তাহার উপরেও তাহার ব্যক্তিত্বপ্রকাশ নির্ভর করে । কেমন করিয়ে দেখিতেছে, এবং কী দেখিতেছে এই দুটা লইয়াই সাহিত্য । কেমন করিয়া দেখিতেছে সেটা হইল হৃদয়ের এলাকা এবং কী দেখিতেছে সেটা হইল জ্ঞানের ।
আজদেবপাদ : তুমি কি বলিতে চাও, সাহিত্যের উপযোগী কতকগুলি দেখিবার বিষয় আছে ? অর্থাৎ কতকগুলি বিষয় বিশেষরূপে সাহিত্যের কতকগুলি তাহার বহির্ভূত ?
তাড়কপাদ : আমি যাহা বলিতে চাই তাহা এই — জ্ঞানস্পৃহা সৌন্দর্যস্পৃহা প্রভৃতি আমাদের অনেকগুলি স্বতন্ত্র মনোবৃত্তি আছে, বিজ্ঞান দর্শন এবং কলাবিদ্যা প্রভৃতিরা সেগুলোকে স্বতন্ত্ররূপে চরিতার্থ করে । বিজ্ঞানে কেবল জিজ্ঞাসাবৃত্তির পরিতৃপ্তি, সংগীত প্রভৃতি কলাবিদ্যায় কেবল সৌন্দর্যবৃত্তির পরিতৃপ্তি, কিন্তু সাহিত্য সমস্ত বৃত্তির একত্র সামঞ্জস্য । অন্তত সাহিত্যের সেই চরম চেষ্টা, সেই পরম গতি ।
তান্তিপাদ : সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্মন্ধে আর-একটু খোলসা করিয়া বলো, শুনা যাক ।
তাড়কপাদ : ম্যাথ্যু আর্নলড বলেন, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মনুষ্যত্ব বিকাশ করা । জ্ঞানস্পৃহা সৌন্দর্যস্পৃহা প্রভৃতি মানুষের যতগুলি উচ্চপ্রবৃত্তি আছে তাহার প্রত্যেকটার পরিপূর্ণ পরিণতির সহায়তা করা । আমার মতে শিক্ষাবিধানকে গৌণ করিয়া আনন্দ-উদ্রেককে মুখ্য করিলে সেই উদ্দেশ্য সাধন হইতে পারে ।
তান্তিপাদ : বেশ কথা । তাহা হইলে শেষে দাঁড়ায় এই যে হৃদয়ের প্রতিই সাহিত্যের প্রধান অধিকার, মুখ্য প্রভাব । এস্হলে নীতিবোধকেও আমি হৃদয়বৃত্তির মধ্যে ধরিতেছি । কারণ সাহিত্য হৃদয়পথ দিয়াই ধর্মবোধের উদ্দীপন করে, তর্কপথ দিয়া নহে ।
তাড়কপদ : এই সম্বন্ধে বক্তব্য আছে । সত্যকে দুই খণ্ড করিয়া দেখা যায় । প্রথম, চিন্তার বিষয়রূপে ; দ্বিতীয়, অনুভবের বিষয়রূপে । কিন্তু সাহিত্য সত্যকে আমাদের কাছে জীবন্ত অখণ্ড সমগ্রভাবে উপনীত করে । প্রাকৃত বিজ্ঞানের নির্দেশ অনুসারে আমরা প্রকৃতিকে কেবলমাত্র বস্তু ও ক্রিয়ার সমষ্টিরূপে মনে করিতে পারি ; কিন্তু প্রকৃতিকে তার সমগ্র বস্তু ও ক্রিয়া এবং সৌন্দর্য সহযোগে একটি অখণ্ড সত্তারূপে অনুভব করাইতে পারে যে একটি একীভূত মানসিক শক্তি, সাহিত্য সেই শক্তিরই বিকাশ ।
তান্তিপাদ : সত্য হৃদয়ের দ্বারা কিরূপে অনুভব করা যায় বুঝিলাম না । প্রকৃতির সৌন্দর্যকেই বা কী হিসাবে সত্য বলা যায় ধারণা হইল না । সৌন্দর্য বিশেষরূপে আমাদের হৃদয়বৃত্তিকে উত্তেজিত করে, এই কারণে তাহা বিশুদ্ধরূপে হৃদয় সম্পর্কীয় । ইহাকে যদি সত্য নাম দিতে চাও তবে ভাষার জটিলতা বাড়িয়া উঠিবে । নদী-অরণ্য-পর্বতের যে সমষ্টিকে আমরা প্রকৃতি বলি তাহার একটা বিভাগ হৃদয়-সম্পর্ক-বর্জিত, এইজন্য সেই বিভাগটাকে আমরা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিকভাবে আলোচনা করিতে পারি । কিন্তু তাহার যে দিকটা আমাদের হৃদয়ভাবকে উত্তেজিত করে, সেদিকে সত্য-মিথ্যা উচিত-অনুচিত নাই । এটা সুন্দর হওয়া উচিত বা উচিত নয় এমনও কোনো কথা নাই । সৌন্দর্য মানুষের মন এবং বহিঃপ্রকৃতির মধ্যগত একটা সম্বন্ধমাত্র । সে সম্বন্ধ সর্বত্র ও সর্বকালে সমান নহে, সেইজন্যই সাধারণত তাহাকে বৈজ্ঞানিক কোঠা হইতে দূরে রাখা হয় ।
তাড়কপাদ : অনেক কথা আসিয়া পড়িল । আমার মোট কথা এই, সাহিত্যের বিষয় সুন্দর , নৈতিক এবং যুক্তিসঙ্গত । ইহার কোনো গুণ বাদ পড়িলে সাহিত্য অসম্পূর্ণ হয় ।
তান্তিপাদ : সাহিত্যের লক্ষ্য হইতেছে সৌন্দর্য । তবে যাহা আমাদের ধর্মবোধকে ক্ষুণ্ণ করে তাহা আমাদের সৌন্দর্যবোধকেও আঘাত করে ; কতকগুলো যুক্তির নিয়ম আছে, তাহাকেও অতিক্রম করিলে সৌন্দর্য পরাভূত হয় । সেইজন্যই বলি, হৃদয়বৃত্তিই সাহিত্যের গম্যস্হান, নীতি ও বুদ্ধি তাহার সহায়মাত্র । অতএব, বিষয়গত সত্য এবং বিষয়গত নীতি অপেক্ষা বিষয়গত সৌন্দর্যই তাহার মুখ্য উপাদান ; এবং সেই সৌন্দর্যকে সুন্দর ভাষা সুন্দর আকারদানই তাহাতে প্রাণসঞ্চার ।
আজদেবপাদ : পুঁথির গহনা এবং হীরার গহনা গঠনসৌন্দর্যে সমান হইতে পারে কিন্তু ভালো গহনার উপকরণে পুঁথি দেখিলে আমাদের চিত্তে একটা ক্ষোভ জন্মিতে পারে ; তাহাতে করিয়া সৌর্ন্দযের পূর্ণফল নষ্ট করে । কবি বলিয়াছেন — ‘বীর রমণী রতন আর কারে শোভা পায় রে’, তেমনি পাঠকহৃদয় সাহিত্য ও সৌন্দর্যের সমাবেশ না দেখিলে সেই অসংগতিতে পীড়া এবং ক্রমে অবজ্ঞা উৎপাদন করিতে পারে ।
তাড়কপাদ : ইহার মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা এই যে, গঠনের মূল্য অপেক্ষা হীরার মূল্য নির্ণয় করা সহজ, সেইজন্য অধিকাংশ লোক অলংকারের অলংকারত্ব উপেক্ষা করিয়া হীরার ওজনেই ব্যস্ত হয় এবং যে রসজ্ঞ ব্যক্তি মূল্যলাভ অপেক্ষা আনন্দলাভকেই গুরুতর বলিয়া গণ্য করেন, নিক্তির মানদণ্ড দ্বারা তাঁহাকে অপমান করিয়া থাকে । এই সকল বৈষয়িক সাংসারিক পাঠক-সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্রোহী হইয়াই এক এক সময় রসজ্ঞের দল সাহিত্যের বিশ্বগৌরবকে একান্ত অবহেলাপূর্বক নিরালম্ব কলাসৌন্দর্য সম্বন্ধে অত্যুক্তি প্রকাশ করিয়া থাকেন ।
আজদেবপাদ, তাড়কপাদ আর তান্তিপাদের তক্কো তখনও ফুরোয়নি, নাইটক্লাবের নাচঘরে আচমকা ফ্ল্যামেঙ্কো নাচের পোশাকে এসে পড়লেন নন্দনা সেন, তনুশ্রী দত্ত, শুস্মিতা সেন, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রানি মুখার্জি, বিপাশা বসু, কাজোল দেভগণ, কোয়েল মল্লিক, মনামি বসু, কোয়েনা মিত্র, কোঙ্কনা সেনশর্মা, রাইমা সেন, রিয়া সেন, স্বস্তিকা মুখার্জি, ইন্দ্রানী হালদার, শ্রেয়া ঘোষাল আর তাঁরা আরম্ভ করে দিলেন ফ্ল্যামেঙ্কো নাচ, ওফ সেকি তাতে তাল মিলিয়ে ভাঁজকরা লালকালো ফ্রক উড়িয়ে তাঁদের নাচ আর গান :
এম্বে এম্বে পঁ, বাঙালি য্যাম্নে কবি ক
অ আ ক খ গ লইয়া ডাইনে বাঁয়ে ক
হেইল্লা দুইল্লা কোরে তোরা য্যাম্নে খুশি ক
বাঙালি এম্বে এম্বে পঁ, হাইস্যা কাইন্দা ক ।
প্রমিত রঙ্গ কইরা তোরা কইথ্থ ভাষায় ক
মনের সুখে বাংলা ভাষা পরাণ ভইরা ক
চাষাভুযা কামার-কুমোর ক্ষ্যাতে বইয়া ক
য্যাম্বে কবি ক বাঙ্গালি বাংলায় কথা ক ।
মানুষ লইয়া করে তোরা মাটি লইয়া ক
বলে যারা বাংলা ভাষা বুইজ্জ্যা লইব ক
দখলদারের চাবুক ভাষা ফিক্ক্যা দিয়া ক
তোরা বাংলা কথা কয়ে মানুষ বাংলাডারে ক ।
সাহেব টুপি পাগড়ি হগল গাঙ্গে ফেলায় ক
ঢ্যাপের খই আর মোয়ামুড়ি মিঠাই খায়া ক
গ্যান্দামালা আলতা পইরা নাইচ্চা কুইদ্দা ক
‘বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ তোরা য্যাম্নে খুশি ক ।
আমিপাদসহ অন্যান্য সিদ্ধাচার্যরা, ভুসকুপাদ আর জঅনন্দিপাদ ছাড়া, অন্য সবাই, লুইপাদ, কাহ্ণপাদ, সরহপাদ, শবরীপাদ, বিরূপাদ, লাড়ীডোম্বীপাদ, কুম্বলাম্বরপাদ, ঢেণ্ডনপাদ, কুক্কুরীপাদ, কঙ্ককপাদ, গুণ্ডরীপাদ, চাটিলপাদ, ডোম্বীপাদ, শান্তিপাদ, মহিত্তাপাদ, বীণাপাদ, আজদেবপাদ, দারিকপাদ, ভাদেপাদ, তাড়কপাদ, ধামপাদ, তান্তিপাদ প্রমুখ একস্বরে বলে উঠলেন, সাধু, সাধু, উত্তরাধুনিক যুগের এটাই সফলতা যে আমরা প্ল্যানচেটে ঝিংচাক করে জীবিত সুন্দরীতমাদের ডেকে এনে আদর আপ্যায়ন করতে পারি, যা আধুনিকদের কালে সম্ভব ছিল না ।
চতুৎথো পড়বো ( বরিশাল স্পেশাল )
ফ্ল্যামেঙ্কো নাচ সেরে সুন্দরীরা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার পর সিদ্ধাচার্যরা উনত্রিশটা গোরুর কাঁধে ডানা তৈরি করে দিলেন, গোরুরা কি খুশি ডানা পেয়ে, যে যার মাতৃভাষায় হোঙ্গা হোঙ্গা করে গান গাইতে গাইতে আকাশে উড়ে চলল, তাদের পাশে এক টুকরো মেঘের জাজিমে বসে শিভাস রিগাল খেতে খেতে গোরুগুলোকে আকাশের ঘাস খাওয়াবার জন্য লুইপাদ মানে গৌরমোহন সবুজ মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যা করল তা পরের বার যখন সবাই নাইটক্লাবে জড়ো হবে তখন শোনাবে । আমি, মানে আমিপাদ, এতো নেশা করে ফেলেছিল যা মেঝে থেকে পণ্ডশ্রম সেন মানে ভুসকুপাদের খসিয়ে যাওয়া মুখগুলোকে তুলে তুলে নাইটক্লাবের মালিককে দিয়ে দিলে, ভুসকুপাদ যদি পরের বার দর্শন ফলাতে আসে তাহলে তাকে দেবার জন্য ।
ভুসকুপাদ এসেছিল, খরগোশের চামড়ার মুকুট পরে, বললে, দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদকে মিশিয়ে ফেলে এক রকমের আইসক্রিম তৈরি করেছে, ইংরেজিতে যাকে বলে জিঙ্গোইজম, একরকমের আদর্শ, সবাইকে পিটিয়ে সমান করার আদর্শ, যেমনটা স্ট্যালিনের রাশিয়ায় ছিল, মুসোলিনির ইতালিতে ছিল, হিটলারের জার্মানিতে ছিল, পিনোশের চিলিতে ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে সঞ্জয় গান্ধির ইনডিয়ায় ছিল — ওনার বুড়ো-হাবড়া চেলারা চেঁচাতো ইনডিয়া ইজ ইন্দিরা, ইন্দিরা ইজ ইনডিয়া, এখন ভুসকুপাদ ভাবেন উনি কেন ইনডিয়া নন, ইন্দিরা কে হে, চর্যাপদের ডোম্বি কেন ইনডিয়া নন, শ্রীকৃষ্ণের গোপীরা কেন ইনডিয়া নন, রামায়ণের সীতা কেন ইনডিয়া নন, মহাভারতের দ্রৌপদী কেন ইনডিয়া নন !