প্রেমিক (Premik)
গল্পের শেষে একটি করিয়া মরাল বা হিতোপদেশ জুড়িয়া দিবার ফন্দিটা বোধ হয় বিষ্ণুশর্মা আবিষ্কার করিয়াছিলেন। সে অবধি, লাগায়েৎ বর্তমান কাল, যিনিই গল্প লিখিয়াছেন, তিনিই এই ফন্দিটি কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছেন; অর্থাৎ শুরু হইতে ক্রমাগত মুখ খারাপ করিয়া শেষের কয়েক ছত্রে দুই চারিটি তত্ত্বকথা ছাড়িয়া পিত্ত রক্ষা করিয়াছেন। ইহাই বর্তমান কথাসাহিত্যের বৈদর্ভী রীতি।
মাতাল সারা রাত্রি মাতামাতি করিয়া প্রাতঃকালে গঙ্গাস্নান সারিয়া ঘরে ফিরিতেছে।
ইহার প্রতিকার আবশ্যক। যদি কিছু উপদেশ দিবার থাকে, গোড়াতেই সারিয়া লইতে হইবে। আরম্ভে নিম্বভক্ষণ সকল রসশাস্ত্রের বিধি হওয়া উচিত। অথ—
প্রেমের ঠাকুর শ্রীগৌরাঙ্গের কয়েক শতাব্দী পরে আবার বাংলাদেশে নূতন করিয়া প্রেমের বান ডাকিয়াছে, কেহ কেহ ইহা লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন। শান্তিপুর ড়ুবুড়ুবু, নদে ভেসে যায়। মাঠে, ঘাটে, ট্রামে, রিক্সায়, কলেজে, সিনেমায়, তরুণ-তরুণীরা অনবরত প্রেম করিতেছে। এত প্রেম কিন্তু ভাল নয়। সাধু সাবধান! কোনও বস্তুর অত্যধিক প্রাচুর্য ঘটিলে জ্ঞানী ব্যক্তির সন্দেহ হয়, ইহাতে ভেজাল আছে। বর্তমানে প্রেমের কারবারে কতখানি ভেজাল চলিতেছে তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে।
বস্তুত, অহৈতুকী প্রীতি যে এই নশ্বর সংসারে অতীব দুর্লভ তাহা বহু মহাজন স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। চণ্ডীদাস হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, মনের মানুষ মাত্র কোটিকে গুটিক মিলে। বিদ্যাপতি ঠাকুর তত পরিষ্কার বলিয়াই দিয়াছেন যে, প্রাণ জুড়াইতে লাখের মধ্যে একটি মানুষও তিনি পান নাই। সুতরাং, আজকাল যে সব তরুণ তরুণী পথে ঘাটে এই দুর্লভ বস্তু কুড়াইয়া পাইতেছে, তাহাদের কি বলিব? ভ্রান্ত? মূঢ়? না—স্বার্থপর?
আধুনিকদের ভ্রান্ত বা মূঢ় বলিলে চটাচটি হইবার সম্ভাবনা। তার চেয়ে তাহাদের ভণ্ড, স্বার্থসর্বস্ব, মতলববাজ, কুচক্রী বলাই শ্রেয়।
.
শ্রীমান বিমানবিহারীর সহিত কুমারী অনিন্দ্যার প্রণয় ঘটিবার উপক্রম হইয়াছিল। যেহেতু বিমান কুকুর ভালবাসিত, সেহেতু অনিন্দ্যার সহিত তাহার প্রেম ঘটিবার যথেষ্ট কারণ ছিল। কেহ ভুল বুঝিবেন না। অনিন্দ্যা মানব-নন্দিনী। অনিন্দ্যার একটি কুকুর ছিল। কুকুরটিই এই যোগাযোগের ঘটক।
আরম্ভে পাত্র-পাত্রীর কুল-পরিচয় দান করাই বিধি। কিন্তু বিমান ও অনিন্দ্যার কুলজি ঘাঁটিবার আমাদের সময় নাই। মনে করিয়া লওয়া যাক, বিমান স্বায়ম্ভুব মনুর ন্যায় auto-fertilisation প্রক্রিয়ার দ্বারা জন্মগ্রহণ করিয়াছিল—তাহার বাপ-পিতামহ কস্মিন্ কালেও ছিল না। অনিন্দ্যাও বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশিত হইয়াছিল। তাহাতে আমাদের কাহিনীর কোনও ক্ষতি হইবে না।
একদা শহরের নির্জন প্রান্তে নবরচিত এক পার্কে বেড়াইতে বেড়াইতে বিমান লক্ষ্য করিল, একটি বেঞ্চির উপর এক তরুণী বসিয়া আছে, তাহার পায়ের কাছে খরগোসের মতো ছোট একটি কুকুর খেলা করিতেছে। বিমানের পদদ্বয় অজ্ঞাতসারে তাহাকে সেই দিকে লইয়া চলিল; একদৃষ্টে কুকুরের পানে তাকাইয়া সে বেঞ্চির এক প্রান্তে বসিয়া পড়িল। কুকুরের গায়ে কুচকুচে কালো কোঁকড়া নোম, চোখ দুটি তরমুজ বিচির মতো। মুগ্ধভাবে তাহার দিকে হাত বাড়াইতেই সে টুকটুকে রাঙা জিভ বাহির করিয়া তাহার হাত চাটিয়া লইল। বিমান আবেগরুদ্ধ স্বরে বলিল, কি সুন্দর কুকুর! পিকেনীজ বুঝি?–বলিয়া কুকুরের স্বত্বাধিকারিণীর দিকে চোখ তুলিল।
দেখিল, কুকুরের স্বত্বাধিকারিণী টুকটুকে রাঙা ওষ্ঠাধর বিভক্ত করিয়া মিশমিশে কালো চোখে কৌতুক ভরিয়া হাসিতেছে। তাহার কোঁকড়া ঝামর চুলগুলি দুলিয়া উঠিল; সে বলিল, না, সায়ামীজ।
তরুণীর কণ্ঠস্বরে কি ছিল জানি না, বিমান তীরবিদ্ধের মতো চমকিয়া উঠিল, তারপর কুকুরের পানে একাগ্র দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, তাই হবে। আমার ভুল হয়েছিল। নাম কি?
তরুণীর গালদুটি মুচকি হাসিতে টোল খাইয়া গেল, কার নাম জিজ্ঞেস করছেন? আমার?
বিমান লাল হইয়া উঠিল, না না–মানে—ওর একটা নাম আছে তো—তাই—
তরুণী টিপিয়া টিপিয়া হাসিল, বলিল, ওর নাম রুমঝুম। আর আমার নাম—অনিন্দ্যা।
বিমান অতিমাত্রায় উল্লসিত হইয়া বলিয়া উঠিল, রুমঝুম? ভারি চমৎ–! অর্থাৎ কিনা অনিন্দ্যা। ভারি চমৎকার নাম তো–
কোন্ নামটা চমৎকার?
বিমান ভীষণ লজ্জিত হইয়া পড়িল, তাহার কান ঝাঁ ঝাঁ করিতে লাগিল। সে সম্মুখে ঝুঁকিয়া রুমঝুমকে আদর করিতে করিতে তোতলার মতো অবিভক্ত ভাষায় বলিল, আঁ— দ্ দ দ—মানে দু-দুটো নামই চমৎকার—
অনিন্দ্যা স্মিতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, চল রুমঝুম, বাড়ি যাই।– নমস্কার।
হিরন্ময়ী শাললতার মতো জঙ্গমা, ফুট-বিকশিত-যৌবনা অনিন্দ্যা চলিয়া গেল; রুমঝুম তাহার চারিপাশে একটি কালো প্রজাপতির মতো নৃত্য করিতে করিতে গেল। যতক্ষণ দেখা গেল, বিমান বেঞ্চিতে বসিয়া সেইদিকে তাকাইয়া রহিল।
পরদিন—আবার সেই দৃশ্য। আবার সেই ধরনের কথাবার্তা। অনিন্দ্যার গাল মৃদু কৌতুকে টোল খাইয়া যায়, টুকটুকে ঠোঁট দুটি বিভক্ত হইয়া দাঁতগুলিকে ঈষৎ ব্যক্ত করে; বিমান ক্ষণে ক্ষণে লাল হইয়া উঠে—অপরিচিতা তরুণীর সহিত রসালাপ করা তাহার অভ্যাস নাই; রুমঝুম দুজনকে ঘিরিয়া খেলা করে, বিমানের হাত চাটিয়া দেয়।
এইভাবে আরও কয়েকদিন কাটিল। বিমান ও অনিন্দ্যার মধ্যে বেশ ভাব হইয়াছে বিমান আর ততটা সংকোচ করে না। বরং একটা অপূর্ব মোহ দিবারাত্র তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। বিমান চরিত্রবান যুবা, কিন্তু তাহার ভয় হইতেছে চরিত্র বুঝি আর থাকে না। এদিকে অনিন্দ্যার মিশমিশে কালো চোখে কিসের রং ধরিয়াছে। সমস্ত দিনটা যেন সন্ধ্যার প্রতীক্ষাতেই কাটিয়া যায়। সন্ধ্যায় পার্কে বেড়াইতে যাইবার পূর্বে প্রকাণ্ড আয়নার সম্মুখে ঘুরিয়া-ফিরিয়া নিজেকে দেখে, একখানা কাপড় ছাড়িয়া আর একখানা পরে, কানের দুল খুলিয়া ঝুমকা পরে, ঝুমকা খুলিয়া কানবালা পরে—
একদিন অনিন্দ্যা বলিল, আপনি তো প্রথম দিনই আমার নামটা জেনে নিলেন। নিজের নাম বলেন না কেন?
রুমঝুমকে কোলে লইয়া বিমান বসিয়া ছিল, চমকিয়া বলিল, আমার নাম বি-বিভূতি মিত্র।
কলেজে পড়েন বুঝি?
আবার চমকিয়া বিমান বলিল, হ্যাঁ—পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট।
সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল—আজকাল রোজই বাড়ি ফিরিতে দেরি হইয়া যায়। জনহীন পার্ক একেবারে নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। আকাশে চাঁদ নাই। অনিন্দ্যা বিমানের পাশে একটু ঘেঁষিয়া বসিল। হাঁটুতে হাঁটু ছোঁয়াছুঁয়ি হইয়া গেল।
দুজনে কিছুক্ষণ নীরব। তারপর বিমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিল।
অনিন্দ্যা বলিল, নিশ্বাস ফেললেন যে?
বিমান অবরুদ্ধ আবেগের প্রাবল্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভুল আবৃত্তি করিল
—যাহা পাই তাহা ভুল করে পাই,
যাহা চাই তাহা পাই না।
আবার কিছুক্ষণ নীরব। পূর্বাকাশ ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে—চাঁদ উঠিবে। অনিন্দ্যা অস্ফুট আধ-বিজড়িত স্বরে বলিল, আপনি কখনও ভালবেসেছেন?
আকস্মিক উত্তেজনার ফলে মানুষের বাহ্য অভিব্যক্তি কখনও কখনও উৎকট আকার ধারণ করে। বিমান সহসা ঘুমন্ত রুমঝুমকে দুহাতে বুকে চাপিয়া ধরিল, ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে প্রজ্বলিত চক্ষে অনিন্দ্যার পানে চাহিল। দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, এ পৃথিবীতে টাকা না থাকলে কাম্য বস্তু লাভ করা যায় না। আমার টাকা নেই। কেন মিছে আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন? বলিয়া রুমঝুমকে অনিন্দ্যার কোলের উপর ফেলিয়া দিয়া প্রায় ছুটিতে ছুটিতে চলিয়া গেল।
রাত্রে ঘুমাইয়া বিমান স্বপ্ন দেখিল কালো কোঁকড়া চুল, মিশমিশে দুটি চোখ, লাল টুকটুকে
ঘুম ভাঙিয়া গেল। উত্তপ্ত মস্তকে জল দিয়া সে আবার ঘুমাইল। আবার স্বপ্ন দেখিল—
সকালে উঠিয়া বিমান উদ্ভ্রান্তের মতো ভাবিল,—আর তো পারা যায় না। লোভ সংবরণ করা বড় কঠিন, চরিত্র তো রসাতলে গিয়াছেই—মনের অগোচর পাপ নাই—তবে আর বাহিরে সাধু সাজিয়া লাভ কি? যাহা হইবার হোক—আজই, হাঁ আজই সে এই কার্য করিবে। সন্ধ্যার পর পার্কে কেহ থাকে না—সেই সময়
কামনার বিষে যখন অন্তর জর্জরিত, তখন অতিবড় সাধু ব্যক্তিরও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ঘৃত ও অগ্নির সান্নিধ্য অতি ভয়ংকর। কত সচ্চরিত্র যুবা–। কিন্তু যাক, শেষের দিকে আর হিতোপদেশ দিব না।
সন্ধ্যার পর আবার দুজনে পাশাপাশি বসিয়া আছে। অনিন্দ্যার চুলের সৌরভ বিমানের নাকে আসিতেছে। একরাশ নরম রেশমের মতো রুমঝুম তাহার কোলে ঘুমাইতেছে।
পার্ক অন্ধকার, জনমানব নাই। অনিন্দ্যা কম্পিত-স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, কাল আমার কথার জবাব দিয়ে চলে গেলেন যে?
অন্ধকারে হাতে হাত ঠেকিল, বিমান তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, জবাব কি বুঝতে পারোনি?
না, বলুন না শুনি। বিমানের তপ্ত মুঠির মধ্যে অনিন্দ্যার হাতখানি যেন মাখনের মতো গলিয়া গেল।
অনিন্দ্যা, তোমাকে আমার মনের কথা বুঝিয়ে দেব। কিন্তু তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে?
হয়তো পারি, শুনিই না আগে।
তবে তুমি একটু বসো। আমি এখনই আসছি।
কোথায় যাচ্ছেন?
রুমঝুমের বোধ হয় তেষ্টা পেয়েছে, ওকে একটু জল খাইয়ে আনি।
বিমান চলিয়া গেল। তারপর পনেরো মিনিট–আধ ঘণ্টা—একটি কম্প্ৰবক্ষা তরুণী অন্ধকার পার্কে একাকিনী প্রতীক্ষা করিতেছে! কোথায় গেল বিমান?
বিমান তখন শহরের অন্য প্রান্তে নিজের ঘরে বিছানার উপর শুইয়া রুমঝুমকে চটকাইতেছে, রুমঝুম, তোকে আমি চুরি করে এনেছি। তোর মন কেমন করবে না? ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে না? আর কখনও আমরা পার্কের ত্রিসীমানায় যাব না। কি বলিস? অনিন্দ্যা নিশ্চয় খুব রাগ করবে;– কিন্তু তোকে ছেড়ে যে আমি এক দণ্ডও থাকতে পারছিলুম না।