প্রেতসাধনা
এক.
ওই দেখো! কিশোরকে দেখেই বলে। উঠলেন মেরি চাচী। সাঁতারের পোশাক পরেই চলে এসেছে! তোকে না কতবার বলেছি এসব পরে নাস্তা খেতে আসবি না কখনও।
স্পোর্টস শার্টের হাতা কনুইয়ের কাছে গুটিয়ে তুলে দিয়ে কমলার রসের দিকে, হাত বাড়াল কিশোর পাশা। সাঁতার কাটতে যাচ্ছি, শান্ত কণ্ঠে বলল সে। মুসা আর রবিন এই এল বলে।
তাই বলে এসব পরে? খেয়ে গিয়ে পরলে চলত না?
কালো মস্ত গোঁফে লেগে থাকা রুটির কণা মুছলেন টেবিলের ওপাশে বসা রাশেদ চাচা। হালকা কিছু খা। ভরাপেটে সাঁতরাতে অসুবিধে হয়।
আরে, না না, সবই খাক, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন মেরি চাচী। না খেলে পরিশ্রম করবে কী করে? কফির কাপ, সেই সঙ্গে টেবিলে পড়ে থাকা দৈনিকটা টেনে নিলেন।
পাউরুটির টুকরোতে পুরু করে মাখন মাখতে শুরু করল কিশোর।
আরে! বিস্মিত কণ্ঠ মেরি চাচীর।
কৌতূহলী চোখে তাকাল কিশোর। সহজে কোন ব্যাপারে তো অবাক হয় না চাচী!
অনেক আগে অডিয়নে দেখেছিলাম ছবিটা! আপন মনেই বললেন। চাচী। এই ষোলোসতেরো বছর বয়েস তখন আমার।
শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন রাশেদ চাচা।
দেখার পর পুরো এক হপ্তা ঘুমোতে পারিনি, বলতে বলতে কাগজটা স্বামীর দিকে ঠেলে দিলেন চাচী।
ঘুরে এসে চাচার কাঁধের ওপর দিয়ে কাগজটার দিকে তাকাল। কিশোর। হালকা-পাতলা একজন মানুষের ছবি, ঠেলে বেরিয়ে আছে। চোয়াল, তোতাপাখির ঠোঁটের মত বাঁকানো নাক, কালো চোখের তারা। উজ্জ্বল একটা কাঁচের গোলকের ওপর দৃষ্টি স্থির।
র্যামন ক্যাসটিলো, বিড়বিড় করল কিশোর। দ্য ভ্যাম্পায়ারস লেয়ার ছবিতে। অভিনয় তো বটেই, মেকাপেও মাস্টার ছিল লোকটা।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মেরি চাচীর। উফফ! ক্রাই অভ দ্য ওয়্যারউলফ ছবিতে যদি দেখতি ওকে!
দেখেছি, বলল কিশোর। গত মাসে টেলিভিশনে দেখিয়েছে।
লেখাটা পড়া শেষ করে মৃত অভিনেতার ছবির দিকে চেয়ে রইলেন রাশেদ চাচা কয়েক মুহূর্ত। মুখ তুললেন। ক্যাসটিলোর প্রাসাদে নিলাম। হবে, একুশ তারিখ। যাওয়া দরকার।
ভ্রূকুটি করলেন মেরি চাচী। জানেন, বাধা দিয়ে লাভ হবে না, যাবেনই রাশেদ পাশা। আশপাশে যেখানে যখন পুরানো জিনিসপত্র নিলাম হয়, তার যাওয়া চাই-ই। যা পান, কিনে এনে স্তূপ দেন পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে। দেখে মনে হয়, অদরকারী জিনিস, কিন্তু এসব জিনিসেরও দরকার পড়ে লোকের, কিনতে আসে তারা। বেশ ভালই লাভ পুরানো জিনিসে। তবে এমন সব জিনিসও নিয়ে আসেন রাশেদ চাচা, যেগুলো একেবারেই বাতিল। হয়তো কোনদিনই বিক্রি হবে না, সেসব নিয়েই মেরি চাচীর আপত্তি। কিন্তু চাচীর কথায় থোড়াই কেয়ার করেন। চাচা।
ক্যাসটিলোর জিনিসপত্র সব বেচে দেবে ওরা, আবার বললেন চাচা। এমনকী এই ক্রিস্টাল বলটাও, ছবিতে আঙুল রাখলেন। দ্য ভ্যাম্পায়ারস লেয়ারে ব্যবহার করা হয়েছিল এটা।
ওসব অ্যানটিক জিনিস কেনার মানুষ আলাদা, তাদের আলাদা। ব্যবসা, প্রতিবাদ করলেন চাচী। তা ছাড়া দামও নিশ্চয় অনেক উঠবে।
তা উঠবে, কাগজটা এক পাশে সরিয়ে রাখলেন চাচা। অ্যানটিক যারা জোগাড় করে, তারা তো পাগল হয়ে ছুটে আসবে।
তা হলে আর গিয়ে কী করবে? উঠে টেবিল পরিষ্কার করতে শুরু করলেন চাচী। কাপ-প্লেটগুলো নিয়ে গিয়ে সিঙ্কে চুবিয়ে রাখলেন। একটা একটা করে তুলে ধুয়ে মুছে সাজিয়ে রাখতে লাগলেন তাকে। পথে ঘোড়ার খুরের শব্দ হতেই কান পাতলেন। ওই যে, পারকারদের মেয়েটা যাচ্ছে।
জানালার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। হ্যাঁ, পারকারদের মেয়েটাই। অন্য দিনের মতই ঘোড়ায় চেপে চলেছে। চমৎকার একটা মাদী আপালুসা, বাদামী লোম থেকে যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে। লেজের কাছে খানিকটা সাদা ছোপ আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে ঘোড়াটাকে। খুব সুন্দর! আপন মনেই বলল কিশোর। আপালুসা আরও দেখেছি, কিন্তু এমনটি দেখিনি!
ঘোড়ার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল কিশোর, কিন্তু আরোহিণীর ব্যাপারে কোন মন্তব্যই করল না। মাথা উঁচু করে বসে আছে মেয়েটা, নজর সামনে, ডানে-বায়ে কোন দিকেই ফিরছে না।
সৈকতে যাচ্ছে বোধহয়, কাজ করতে করতেই বললেন মেরি চাচী। দৌড় করাতে। মেয়েটা বড় বেশি একা। রুজের কাছে শুনলাম, বাবা-মা ইউরোপে থাকে।
জানি, বলল কিশোর। সে আরও জানে, পারকারদের বাড়ি দেখাশোনা করে রুজ, মেয়েটাকেও। বিকেলে প্রায়ই ইয়ার্ডে আসে রুজ, মেরি চাচীর সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করে। আশপাশে ঘুরঘুর করে তখন কিশোর, কথা শোনে।
মাস কয়েক আগে মোড়ের কাছের পুরানা প্রাসাদটা কিনেছেন। মিস্টার পারকার। আগে যা ছিল তা-ই রয়েছে বাড়িটা, সারানো দরকার মনে করেননি তিনি। কিশোর জানে, বাড়িটার খাবার ঘরে পুরানো আমলের মস্ত এক ঝাড়বাতি ঝোলানো আছে। বাতিটা আগে ছিল। ভিয়েনার এক জমিদারের প্রাসাদে। জানে, মিসেস পারকারের একটা হীরের হার আছে, ওটার আগের মালিক ছিল ইউজেনি-র এক সম্রাজ্ঞী। পারকারদের মেয়েটার নাম জিনা, ঘোড়াটা তার খুব প্রিয়। কিশোর। এটাও জানে, বর্তমানে জিনার এক খালা আছে তাদের বাড়িতে। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে দিন কয়েক আগে এসেছে মহিলা। রুজের মন্তব্য: বুড়িটার কাণ্ডকারখানা ভারি অদ্ভুত!
মোড়ের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল আলুসা।
কিশোর, মেরি চাচী বললেন। মেয়েটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস না। তোর তো যতসব উদ্ভট কাণ্ড! রাস্তার ওপারে বাড়ি, হাজার হোক আমাদের প্রতিবেশী।
কিন্তু প্রতিবেশীসুলভ ব্যবহার তো করে না, সাফ জবাব দিল। কিশোর। ঘোড়াটা ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলে বলেও মনে হয় না।
বেশি লাজুক আরকী।
জবাব দিল না কিশোর, পথের মাথায় মুসা আর রবিনকে দেখা যাচ্ছে। সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা লাগিয়েছে যেন দুজনে। ওরাও তার মতই স্পোর্টস শার্ট গায়ে চড়িয়েছে, নিচে সাতারের। পোশাক, পায়ে স্নিকার।
আমি যাই, চাচীকে বলেই আর দাঁড়াল না কিশোর, বেরিয়ে এল। ঘর থেকে।
সাইকেল নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিল কিশোর। এবারে সত্যিই প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সাই সাই প্যাডাল ঘুরিয়ে অন্য দুজনের আগে চলে এল সে। এমনিতে মুসার সঙ্গে পারার কথা নয় কিশোরের, কিন্তু মুসা আর রবিন অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে, আর সে সবে শুরু করেছে। চালানো।
দেখতে দেখতে পথের মোড়ে পৌঁছে গেল ওরা। ছোট্ট পাহাড়ের জন্যে ওপাশের কিছু দেখা যায় না, সৈকতের দিকে চলে গেছে যে সড়কটা, ওটাও চোখে পড়ে না।
হঠাৎ, হেইই, কিশোর! বলে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
কিশোরও দেখেছে, কিন্তু সামলে নেয়ার সময় পেল না। সামনে আচমকা বিশাল মূর্তিটা উদয় হতেই সাইকেলের কথা ভুলে গিয়ে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুহাত মাথার ওপর তুলে ফেলল সে, ভারসাম্য হারিয়ে হুড়াম করে কাত হয়ে পড়ে গেল এক পাশে। উরুর ফাঁক থেকে ঝনঝন শব্দ তুলে পিছলে সরে গেল সাইকেল।
উঁচু পর্দায় চিৎকার শোনা গেল, ঘোড়ার ডাক নয়, মেয়ে কণ্ঠ।
মুহূর্ত পরেই আলকাতরা মেশানো পথের নুড়িতে নাল লাগানো ঘোড়ার খুরের বিচিত্র শব্দ উঠল, ব্রেক কষে নিজেকে থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে জানোয়ারটা। ঠিক চোখের সামনে খুর দুটো দেখতে পেল কিশোর। দ্রুত এক গড়ান দিয়ে পাশে সরে গেল সে, তারপর উঠে বসল।
পেছনের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে আপালুসা, নামিয়ে আনছে সামনের পা। দুকান লেপ্টে আছে মাথার সঙ্গে। পথের ওপর চিৎপাত হয়ে আছে পারকারদের মেয়ে।
মাটিতে সাইকেল শুইয়ে রেখে সাহায্য করতে ছুটে গেল মুসা আর রবিন। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে কিশোরও ছুটল।
নিচু হয়ে জিনার কাঁধে হাত রাখল মুসা।
হাঁপাচ্ছে মেয়েটা, হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠল, হা-হাত সরাও!
ইলেকট্রিক শক খেল যেন মুসা, হাত সরিয়ে আনল।
খুব বেশি লেগেছে? মেয়েটার দিকে ঝুঁকে মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করল রবিন।
কোনমতে উঠে বসল জিনা। হাঁটু চেপে ধরে রেখেছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত, জিনসের প্যান্টের এক হাঁটুর কাছে ছেঁড়া, জায়গাটার চারপাশ ভিজে গেছে রক্তে। কান্নার মত ফোপানি বেরোচ্ছে তার গলা থেকে, কিন্তু চোখ শুকনো, কাঁদছে না। হাপাচ্ছে। এখনও।
নাহ, সত্যিই খুব চোট পেয়েছ! গলায় সহানুভূতি ঢালল মুসা।
মুসার কথায় কানই দিল না জিনা, কড়া চোখে তাকাল কিশোরের দিকে। হঠাৎ সামনে কিছু দেখলে চমকে ওঠে ঘোড়া, জানো না!
সরি! বলল কিশোর। আমি দেখিনি।
আস্তে করে উঠে দাঁড়াল জিনা। ঘোড়াটাকে এক নজর দেখে আবার কিশোরের দিকে ফিরল। মেয়েটার চুলের রঙের মতই চোখের মণিও তামাটে, জ্বলছে। যদি আমার ঘোড়ার কোন কিছু হয়… দাঁতে দাঁত চাপল মেয়েটা।
মনে হচ্ছে হয়নি, ভোতা গলায় বলল কিশোর।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে আপালুসার পাশে গিয়ে দাঁড়াল জিনা। গায়ে হাত রাখল। লক্ষ্মী মেয়ে! শান্ত হও!
বিশাল থুতনি জিনার কাঁধে রাখল আপালুসা।
খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছে তোমাকে, না? আস্তে করে ঘোড়ার মাথায় চাপড় দিল জিনা।
পথের মাথায় মেরি চাচীকে দেখা গেল, চেঁচামেচি শুনে ছুটে এসেছেন। এই, কিশোর! কী হয়েছে রে?
রাশ ধরে ঘোড়ার পাশে চলে এল জিনা, পিঠে চড়ার ইচ্ছে। কিন্তু আরোহী নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করল ঘোড়া, পিছিয়ে গেল এক পা।
মুসা, কিশোর বলল। রাশটা সামনের দিকে টেনে ধরো তো। আমি ওকে তুলে দিচ্ছি।
হয়েছে হয়েছে, কারও সাহায্য লাগবে না আমার! খেঁকিয়ে উঠল জিনা।
কাছে এসে দাঁড়ালেন মেরি চাচী। জিনার উস্কোখুস্কো চুল, ধূলি ধূসরিত মুখ, ছেঁড়া প্যান্ট, রক্তাক্ত হাঁটু দেখলেন। কী হয়েছে?
ও আমার ঘোড়াকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, কিশোরকে দেখিয়ে। গোমড়া মুখে বলল জিনা।
জিনা পড়ে গিয়েছিল, যোগ করল মুসা।
ইচ্ছে করে করিনি, বলল কিশোর। এত বড় একটা জানোয়ার যে এমন ভীতুর ডিম, তাই বা কে জানত!
এই, চুপ কর! কিশোরকে ধমক দিলেন মেরি চাচী। যা, দি গিয়ে তোর চাচাকে বল পিকআপটা নিয়ে আসতে
মেয়েটার হাঁটুর যা
অবস্থা, ঘোড়ায় উঠতে পারবে না।
না, না, পারব, প্রতিবাদ করল জিনা।
কানেই তুললেন না চাচী। কিশোরকে বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মুসার দিকে ফিরলেন। তুমি লাগামটা ধরো তো শক্ত করে। জিনার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, দেখছ না।
ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকাল মুসা। যদি কামড়ায়?
আরে, নাহ, কামড়াবে না! ঘোড়ার ব্যাপারে তার জ্ঞান কতখানি, ভুলে প্রকাশ করে দিলেন মেরি চাচী। ঘোড়া কামড়ায় না। তবে লাথি মারে।
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা।
দুই.
ঘোড়াটাকে পারকার হাউসে নিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। গাড়ি-বারান্দায় স্যালভেজ ইয়ার্ডের পিকআপটা দাঁড়িয়ে আছে, মেরি চাচী কিংবা জিনাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
বারান্দার ছাতকে ঠেকিয়ে রেখেছে যেন বড় বড় থাম, সেদিকে চেয়ে বলল মুসা, মেরি চাচী তার দাদীর স্কার্টটা পরে এলে মানাত এখানে।
হাসল কিশোর। কোন্ আমলের বাড়ি এটা!
মধ্যযুগের হলেও অবাক হব না! রবিন বলল। কিন্তু ঘোড়াশালটা কোথায়?
বাড়ির পেছনের সীমানা দেখাল মুসা। ওই যে একটা মাঠ, কাঁটাতারে ঘেরা।
চলো, ওখানেই নিয়ে যাই, প্রস্তাব দিল কিশোর।
প্রাসাদের এক পাশে পাথরে বাঁধানো চতুর প্রায় ঢেকে গেছে। ওইসটেরিয়া লতাঝাড়ে। তার এক পাশে কংক্রিটের সরু পথ ধরে পেছনের মাঠে ঘোড়াটাকে নিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা।
বাড়ির পেছনে বিশাল আঙিনা। তার পরে তারে ঘেরা মাঠ, মাঠের পরে পাশাপাশি তিনটে গ্যারাজ। একটা গ্যারাজের মস্ত দরজা হাঁ হয়ে খোলা, ভেতরে ঘোড়া বাঁধার জায়গা দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে গাঁথা বড় বড় পেরেকে ঝুলছে দড়ি।
বাড়ির পেছনের দরজা খুলে উঁকি দিল রুজ। এই যে, ছেলেরা, কমেটকে নিয়ে এসেছ? মাঠে ছেড়ে দিয়ে ভেতরে এসো। মিস মারভেল তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান।
আবার দরজা বন্ধ করে দিল রুজ।
ঘোড়াটার দিকে চেয়ে আপন মনেই বলল মুসা, কমেট!
হ্যাঁ, বাংলায় বলে ধূমকেতু, বলল কিশোর। চাচীকে রুজ বলেছে, ঘোড়াটাকে নাকি শুধু মেট বলে ডাকে জিনা।
তার মানে বাংলায় কেতু?
আরে, না, হেসে উঠল কিশোর। মেটের বাংলা, বন্ধু।
এই মিস মারভেলটা কে, জানো? জিজ্ঞেস করল রবিন।
জিনার খালা। এখানেই থাকবে, কিশোর জানাল। রুজ বলে, এই খালাটা নাকি অদ্ভুত!
অদ্ভুত?
জানি না কেন বলে, মহিলার আচার-আচরণ নাকি ভাল লাগে না রুজের। আমরা তো যাচ্ছিই, দেখব, কেন ভাল লাগেনি।
ঘোড়ার জিন আর লাগাম খুলে নিল কিশোর। রবিন গেট খুলে দিতেই মাঠে ঢুকে পড়ল কমেট।
গ্যারাজে জিন রাখার জায়গায় জিন রাখল কিশোর, লাগাম ঝুলিয়ে রাখল একটা পেরেকে। তারপর প্রাসাদের পেছনের একটা দরজা খুলে দুই সঙ্গীকে নিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। রান্নাঘর। জানালা দিয়ে এসে পড়া রোদের আলোয় ঝলমল করছে মস্ত ঘরটা।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা চওড়া বিরাট এক হলঘরে। বায়ে খাবার ঘর। হলের ছাতে ঝুলছে, সেই বহুল আলোচিত ঝাড়বাতি। ওপাশের জানালা দিয়ে চোখে পড়ে ওইসটেরিয়া ঝাড়ে ঢাকা চতুর। ডানে একটা শোবার ঘর, খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে হালকা সবুজ দেয়াল, ওপরের দিকে সোনালি রঙের কারুকাজ। শোবার ঘরের পাশে আরেকটা দরজা, ওই দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরেকটা ঘর, দেয়াল আলমারির তাকে তাকে ঠাসাঠাসি করে রাখা বই।
হলঘরের সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে জিনা, আহত হাঁটুর নিচে একটা তোয়ালে। ওর পাশে বসে আছে এক বয়স্কা মহিলা। পরনে নীলচে-লাল মখমলের গলাবন্ধ লম্বা গাউন, গলায় রূপার একটা চেপ্টা আঙটা। লালচে-ধূসর চুল। বাতাসে ল্যাবিণ্ডারের গন্ধ, পুরানো গির্জার শব-রাখা ঘরের কথা মনে করিয়ে দেয়।
খালা, সোফায় রক্ত লাগালে মা মেরে ফেলবে আমাকে, জিনা বলল। আমি ওপরতলায়…।
চুপ করে বসো এখানে, শান্ত কণ্ঠে বলল মিস মারভেল। এতবড় একটা আঘাত। ছেলেদের দিকে একবারও তাকাল না মহিলা। কাঁচি দিয়ে জিনার প্যান্ট হাঁটুর কাছ থেকে কেটে নামিয়ে দিল। ইসস, অনেকখানি কেটেছে!
ও কিছু না, অভয় দিলেন মেরি চাচী। ফায়ারপ্লেসের কাছে একটা চেয়ারে বসেছেন। ওষুধ লাগালেই সেরে যাবে।
মাকড়সার জাল দরকার, আনমনে বলল মিস মারভেল।
মাকড়সার জাল! মেরি চাচীর ভুরু কুঁচকে গেছে।
মাকড়সার জাল! চমকে উঠল জিনার কাছে দাঁড়ানো রুজ, হাতের গরম পানির পাত্র থেকে ছলকে পড়ল পানি।
নড়েচড়ে উঠল সহকারী, দুই গোয়েন্দা, অস্বস্তি বোধ করছে। গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকাল মুসা, চোখে জিজ্ঞাসা।
হেসে রুজকে বলল কিশোর, খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে? মাকড়সার জাল নেই নাকি এ-বাড়িতে?
রেগে উঠল রুজ। জাল কী করে থাকবে? এক কণা ধুলো রাখি না আমি, ঝেটিয়ে দূর করি, আর জাল থাকবে! লাল হয়ে গেছে তার মুখ।
হায় রে কপাল! আক্ষেপ করল মিস মারভেল। সাধারণ মাকড়সার জাল, তা-ও মেলে না এখানে! কী আর করা। যাও, আমার ওষুধের বাক্স থেকে সোনার ছোট বয়মটা নিয়ে এসো।
রুজ চলে গেল। ছেলেদের দিকে মুখ তুলে তাকাল মিস মারভেল, জিনাকে সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ দিল। তারপর বলল, আমার কথা
তো শোনে না। কতবার বলেছি, আর কিছু না হোক, গলায় অন্তত লাল একটা রুমাল বেঁধে নাও, সব রকম অঘটন থেকে রেহাই পাবে। লাল রঙ দুর্ঘটনা ঠেকায়, জানো তো?
নিশ্চয়ই, জবাব দিল কিশোর।
ছোট একটা সোনার বয়ম এনে মিস মারভেলের হাতে তুলে দিল রুজ।
এতেও চলবে, বলল জিনার খালা। মাকড়সার জালের মত তত কাজের নয়, তবে ভাল। আমি নিজে বানিয়েছি। ছিপি খুলে মলম বের করে বোনঝির আহত জায়গায় ডলে লাগিয়ে দিল।
মেডিক্যাল অ্যাসোশিয়েশনের অনুমোদন আছে? জানতে চাইল জিনা।
কী যে বলো না তুমি, মেয়ে, অনুমোদন দিয়ে কী হবে? কাজ হলেই হলো, বলল মিস মারভেল। অমাবস্যার রাতে নিজে শেকড়-পাতা জোগাড় করেছি আমি। ওই দেখো, লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্ত বন্ধ হয়ে। গেছে।
অনেক আগেই রক্ত বন্ধ হয়েছে আমার, ওই আজেবাজে জিনিস না লাগালেও চলত, খালা। এবার কী? হুইলচেয়ার আনতে বলবে?
একটা ব্যাণ্ডেজ হলে, তাতে মাছির ডিম ভেঙে মাখিয়ে… খালার কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়াল জিনা। লাগিয়ে পচে মরি। ওসব কিছু লাগবে না আমার! সিঁড়ির দিকে রওনা হলো সে। ছেলেদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থামল, থ্যাঙ্কস! শুনলাম, মেটকে জায়গামতই এনে রেখেছ।
না না, এর জন্যে ধন্যবাদ আবার কেন? এ তো আমাদের কর্তব্য ছিল, হাসিতে ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে মুসার। আড়চোখে একবার তাকাল বন্ধুদের দিকে
ঘোড়া আনার কাজে সে কোন সহায়তাই করেনি, ভয়ে দূরে দূরে ছিল, সেটা না আবার বলে দেয় ওরা।
ওপরতলায় উঠে গেল জিনা।
শিগগিরই মত বদলাবে ও, বলল মিস মারভেল। যখন ব্যথা কমে যাবে, কালকের মধ্যেই ক্ষত শুকিয়ে যাবে, তখন বুঝবে মলমের গুণ আছে কিনা। বাচ্চা মেয়ে তো, এতবড় একটা ব্যথা পেয়েছে…ও, হ্যাঁ, মেরি চাচীর দিকে চেয়ে বলল মহিলা। আপনারা কে, তাই তো জানা। হয়নি।
মেরি চাচী উঠে দাঁড়ালেন। আমি মিসেস রাশেদ পাশ, ও আমার ছেলে কিশোর। বাইরের লোকের কাছে কিশোরকে নিজের ছেলে বলেই পরিচয় দেন তিনি। ও হলো মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড।
কিশোরকে দেখতে দেখতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল মিস মারভেলের। দৃষ্টি, বেগুনী চোখের তারায় বিস্ময়। আরে, কিশোর পাশা! মানে, কমিক পাশা?
ঠিকই চিনেছেন, বন্ধুগর্বে আধহাত ফুলে গেল মুসার বুক। ও কমিক পাশা। টেলিভিশনে কমিক দেখিয়ে এই বয়সে এত সুনাম আর কেউ কামাতে পারেনি।
তা, খোকা, সিনেমায় ঢুকছ না কেন? বাচ্চাদের ছবি বানান হলিউডের বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেকটর মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার, তাকে গিয়ে ধরো… জানালার বাইরে চোখ পড়তেই থেমে গেল মিস মারভেল। চেঁচিয়ে উঠল, আরে, মিস্টার ভ্যারাড।
ফিরে তাকাল ঘরের আর সবাই। আগাগোড়া কালো পোশাক পরা একজন মানুষ নামছে ট্যাক্সি থেকে। অবাক হলো কিশোর। মানুষের মুখ এত ফেকাসে! সারাজীবন অন্ধকার গুহায় কাটিয়ে মাত্র যেন বেরোল!
হাতে একটা সুটকেস নিয়ে সরু পথ ধরে সদর দরজার দিকে এগোল। লোকটা।
শেষ পর্যন্ত তা হলে এলেন উনি! খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছে মিস মারভেল। আশা পুরো হলো আমার।। আমরা তা হলে আসি, ছেলেদের ঠেলে নিয়ে দরজার দিকে রওনা হলেন মেরি চাচী। চওড়া বারান্দা পেরিয়ে এল ওরা। সরু পথে পাশ। কাটাল আগন্তুককে।
পিকআপে ওঠার আগে থমকে দাঁড়ালেন মেরি চাচী। তোরা তো সাঁতার কাটতে যাবি। এগিয়ে দিয়ে আসব?
না না, লাগবে না, হাত তুলল কিশোর। হেঁটেই যেতে পারব।
যা, এখানে আর থাকিস না! মাথা নাড়লেন তিনি। কাণ্ড! কাটা ক্ষতে মাকড়সার জাল, মাছির ডিম! মেরে ফেলার জোগাড়! গাড়িতে চড়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
মাছির ডিমের কথা শুনিনি, তবে মাকড়সার জালের কথা শুনেছি, বলল কিশোর। বইপত্র প্রচুর ঘাটাঘাটি করে সে, উদ্ভট লেখা দেখলেই তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। রক্ত বন্ধ করতে নাকি খুব কাজ দেয়। পুরানো আমলে লোকে ব্যবহার করত।
পুরানো আমলে তো ছাইপাঁশ কত কী-ই ব্যবহার করত লোকে, মরতও! যত্তসব! গজগজ করতে করতেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন মেরি চাচী। গাড়ি পিছিয়ে নিয়ে চললেন গেটের দিকে।
অদ্ভুত! বলল মুসা। রুজ ঠিকই বলেছে। জিনার খালা জানি কেমন!
কুসংস্কার ছাড়তে পারেনি, কিশোর বলল।
সেরাতে ঘুমানোর আগে অনেক ভাবল কিশোর। জিনার খালার বানানো মলমের কথা মনে করে হাসি পেল। অমাবস্যার রাতে শেকড় বাকড় জোগাড় করে…হাহ! হেসে কম্বলটা গলার কাছে টেনে নিল সে। চোখ লেগে এসেছে, এই সময় দরজায় দমাদম কিল পড়তেই তন্দ্রা টুটে গেল।
মিসেস প্যাশাআ! মিসেস প্যাশাআ! দরজা খুলুন!
লাফিয়ে বিছানা থেকে নামল কিশোর, এক টানে ড্রেসিং গাউনটা নিয়ে গায়ে চড়িয়েই দরজা খুলে সিঁড়ির দিকে ছুটল। মাঝামাঝি নেমে গেছেন মেরি চাচী, তার পিছনে রাশেদ চাচা। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকে চাচা-চাচীর পেছনে চলে এল সে।
দরজা খুলে দিলেন চাচী।
প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে ঘরের ভেতরে পড়ল ক্লজ। আউহহ…মিসেস, প্যাশা! হাঁপাচ্ছে। পরনে শুধু ড্রেসিং গাউন, পায়ে চপ্পল।
কী হয়েছে, রজ? মেরি চাচী অবাক।
আজ রাতটা থাকতে দেবেন? ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল রুজ। মেরি চাচী না বললেই কেঁদে ফেলবে যেন।
রুজ, হয়েছে কী?
গান!
কী?
গান! কেঁপে উঠল রুজ। কিছু একটা এসে ঢুকেছে ও-বাড়িতে, গান জুড়েছে! মেরি চাচীর হাত আঁকড়ে ধরল সে। ভয়ঙ্কর! জিন্দেগীতে ওরকম গান শুনিনি! আমি আর ওখানে ফিরে যাব না!
তিন.
আস্তে করে রুজের হাত সরিয়ে দিলেন মেরি চাচী। ঠিক আছে, ফোন করছি আমি।
নাক কোঁচকাল রুজ। তা করুন। কিন্তু আমি আর ওখানে ফিরে যাচ্ছি না।
পারকারদের বাড়ির নাম্বারে রিং করলেন মেরি চাচী। ফোন ধরল মিস মারভেল। সংক্ষিপ্ত কথাবার্তার পর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন চাচী। মিস মারভেল নাকি তেমন কিছু শোনেনি।
ওই বুড়ি তো বলবেই! চেঁচিয়ে উঠল রুজ।
কেন? বলবে কেন?
মানে…ইয়ে…ও, ও নিজেই তো অদ্ভুত! যেসব কাণ্ড ঘটছে ও বাড়িতে, লাখ টাকা দিলেও আর ফিরে যাচ্ছি না।
ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু বলতে চাইল না রুজ, পারকারদের বাড়িতে আর ফিরেও গেল না। রাতটা কিশোরদের বাড়িতে শোবার ঘরে। কাটাল। সকালে গিয়ে রুজের জিনিসপত্র নিয়ে এলেন রাশেদ চাচা, সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছে জিনা। তারপর লস অ্যাঞ্জেলেসে রুজের মায়ের। কাছে তাকে পৌঁছে দিতে চললেন।
কী এমন শুনল! রুজ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বলল কিশোর।
কী জানি! হাত নাড়লেন চাচী। নিজের কাজে চলে গেলেন।
পরের কদিন ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবল কিশোর। সেদিন সকালেও একই কথা ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরোল, স্যালভেজ ইয়ার্ডের ভেতরের খোয়া বিছানো পথ ধরে এগোল তার নিজস্ব ওয়ার্কশপের দিকে। কাজে ব্যস্ত দুই ব্যাভারিয়ান ভাই, বোরিস আর রোভার, মারবেলের তৈরি একটা চুলা ঘষেমেজে পরিষ্কার করছে। হলিউড পাহাড়ের ধারে এক পুড়ে যাওয়া বাড়ির নষ্ট জিনিসপত্র কিনে এনেছেন রাশেদ চাচা, চুলাটা ওসবের ভেতর থেকেই বেরিয়েছে।
মুসা এসেছে, মুখ তুলে বলল বোরিস। ওয়ার্কশপে।
ছাপার মেশিন চালু করেছে, রোভার যোগ করল।
মাথা ঝোকাল কিশোর। মেশিন যে চালু হয়েছে, এটা না বললেও চলত। মেরামত করা পুরানো মেশিনের ঘটাং-ঘট ঘটরাং-ঘট এখান থেকেই কানে আসছে। ইসস, ভাঙা একটা আধুনিক মেশিন যদি কোন জায়গা থেকে জোগাড় করতে পারত চাচা!-ভাবল কিশোর, এই বিশ্রী। আওয়াজ থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
এক জায়গায় তূপ করা আছে বড় বড় গাছের কাণ্ড; ইস্পাতের কড়িবরগা আর কিছু লোহার জাল। ওগুলো ঘুরে অন্য পাশে চলে এল। কিশোর, স্যালভেজ ইয়ার্ডের মূল আঙিনা দেখা যায় না এখান থেকে, মেরি চাচীর কাঁচে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম অফিসটাও চোখে পড়ে না। উঁচু কাঠের তক্তার বেড়া দিয়ে ঘেরা পুরো ইয়ার্ড, একদিকের বেড়ার ওপাশেই রাস্তা। কিছুটা জায়গায় বেড়ার মাথায় ছয় ফুট চওড়া চাল, চালের ভার রেখেছে লোহার খুটি। রোদবৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। যেসব জিনিস, ওগুলো রাখা হয়েছে এই চালার নিচে।
ওয়ার্কশপে ঢুকল কিশোর। ছাপার মেশিনের ওপর ঝুঁকে আছে মুসা, কার্ড ছাপছে। কিছু দিন পর পরই কার্ডের ডিজাইন পাল্টায় কিশোর। কারণ আছে। তিন গোয়েন্দার দেখাদেখি অনেক ছেলেই গোয়েন্দা সাজতে শুরু করেছে; দুই গোয়েন্দা, চার, পাঁচ, ছয়, সাত গোয়েন্দাও গজিয়ে উঠেছে; আগের ছুটিতে টেরিয়ার ডয়েল তো এগারো গোয়েন্দা বানিয়ে বসেছিল। যদিও কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি। একবার তো গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ডাকাতের ধোলাই খেয়ে এসে পুরো পনেরো দিন বিছানায় পড়েছিল শুঁটকি টেরি আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
ছাপানো কার্ডের তূপ থেকে একটা কার্ড তুলে নিল কিশোর।
মেশিন থামিয়ে ফিরে তাকাল মুসা। কেমন হয়েছে?
খুব ভাল, প্রশংসা করল কিশোর। ভাবতেই পারিনি, এত উন্নতি। করব আমরা, আমাদেরকে নকল করবে লোকে!
চুপ করে রইল মুসা। তিন গোয়েন্দা-র গোড়াপত্তনের সময় ভাবতে পারেনি সে-ও, সংস্থাটা এভাবে টিকে যাবে, কিশোর যখন প্রস্তাব দিয়েছিল, বিদ্রূপ করতেও ছাড়েনি তাকে মুসা। আরও একটা ব্যাপারে ক্ষীণ আপত্তি ছিল তার, কিশোর কেন গোয়েন্দাপ্রধান হবে, মুসা কেন। নয়? তার গায়ে কিশোরের চেয়ে জোর অনেক বেশি, তার বয়েসী যে কোন ছেলেকে পিটিয়ে তক্তা করে দিতে পারে অনায়াসে। কিন্তু কিশোর প্রমাণ করে দিয়েছে, গোয়েন্দা হতে হলে গায়ের জোরের চেয়ে মগজের জোর অনেক বেশি দরকার। রবিনও প্রমাণ করে দিয়েছে, সে একটা চলন্ত বিশ্বকোষ।
তিরিশ ফুট লম্বা একটা মোবাইল হোমের ভেতর তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার। জঞ্জালের তূপের ভেতরে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেছে। ট্রেলারটা, বাইরে থেকে এর কিছুই দেখা যায় না। ওটা এত বেশি পুরানো আর নষ্ট হয়ে গেছে, মেরামত করেও বিক্রি করা যাবে না, তাই ছেলেদেরকে দান করে দিয়েছেন রাশেদ চাচা। অনেক সময় লাগিয়ে অনেক পরিশ্রম করে ট্রেলারটাকে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছে তিন গোয়েন্দা।
ট্রেলারের ভেতর সুন্দর একটা ল্যাবরেটরি করেছে ছেলেরা। ছবি প্রসেস করার জন্যে ছোট্ট একটা ডার্করুমও আছে। টেলিফোন আছে-তার খরচা ছেলেরাই জোগাড় করে অবসর সময়ে স্যালভেজ ইয়ার্ডে কাজ করে; চাচা-চাচীর কাছে কিশোর চাইলেই টাকা পায়, কিন্তু হাত পাততে রাজি নয় সে। ছোট্ট র্যাকে চমৎকার করে সাজানো রয়েছে। কিছু প্রয়োজনীয় বই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কয়েকটা ফাইল-রবিনের দপ্তর। এ-যাবৎ যতগুলো রহস্যের সমাধান করেছে তিন গোয়েন্দা, সবগুলোর বিস্তারিত রিপোর্ট লেখা রয়েছে ওসব ফাইলে।
আগের কার্ডটার চেয়ে ভাল হয়েছে, কী বলো? মুসা বলল।
হ্যাঁ, হাতের কার্ডটা দেখছে কিশোর। প্রশ্নবোধকগুলো উড়িয়ে। দেয়া হয়েছে, কার্ডের কোণে এখন বড়সড় একটা আশ্চর্যবোধক। এই চিহ্নটাই বরং ভাল। রহস্যময়, অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য বোঝাতে এটাই ব্যবহার হয়, প্রশ্নবোধক দেয়াটা ভুলই হয়েছিল।
হু। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল মুসা, আচ্ছা, জিনাদের বাড়ির কোন খবর আছে?
না, মাথা দোলাল কিশোর। রুজ যাওয়ার পর আর কোন খবর পাইনি। কী শুনে যে এত ভয় পেল সে! সত্যিই শুনেছে, না কল্পনা তাই বা কে জানে! প্রায় বলত, মিস মারভেল অদ্ভুত, কিন্তু কেন এটা মনে হয়েছে তার, বলেনি কখনও।
বলবে আবার কী? সে তো আমরা নিজেরাই দেখেছি। অদ্ভুত না হলে কাটা ক্ষতে মাকড়সার জাল দিতে চায়…
শশশশ! হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল রাখল কিশোর। জঞ্জালের ওপাশে মৃদু একটা শব্দ শুনেছে।
ঝট করে সোজা হলো মুসা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল জঞ্জালের ওপাশে। পরক্ষণেই তার উত্তেজিত চিৎকার কিশোরের কানে এল: তাই তো বলি! ঘোড়ার গন্ধ আসে কোত্থেকে! অনেকক্ষণ থেকেই পাচ্ছিলাম।
গটমট করে এসে ওয়ার্কশপে ঢুকল জিনা, পেছনে এল মুসা। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, বাহ, বেশ জমিয়ে নিয়েছ!
কতক্ষণ আড়ি পাতা হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অনেকক্ষণ, কারও বলার অপেক্ষায় থাকল না জিনা, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল, মেশিনটার কাছাকাছি।
কেন? গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর।
কার্ডের তূপ থেকে একটা কার্ড তুলে দেখছে জিনা। হুম! হাতখরচ যা পাই, তা দিয়ে প্রফেশনাল ডিটেকটিভ ভাড়া করতে পারব না, মুখ তুলল। তোমার রেট কত?
তিন গোয়েন্দাকে ভাড়া করতে চাও?
যদি সম্ভব হয়।
তা কাজটা কী? না শুনে কিছু বলতে পারছি না। আমরা আগ্রহী না-ও হতে পারি।
হবে না মানে? হয়ে বসে আছ, বলল জিনা। তোমাদের আলাপ আলোচনা সব শুনেছি। আমাদের বাড়িতে কী হচ্ছে না হচ্ছে জানার জন্যে মাথা কুটে মরছ তোমরা। তা ছাড়া, রাজি না হয়ে উপায়ও নেই তোমাদের।
মানে? ভুরু কুঁচকে গেছে মুসার।
মানে, তেমন সাবধান নও তোমরা। পেছনের বেড়ার এক জায়গায় একটা ছবি আঁকা আছে না, অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য, ওই যে উনিশশো পাঁচ সালে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল স্যান ফ্রানসিসকোতে?
উনিশশো ছয় সালে, শুধরে দিল কিশোর।
উনিশশো বত্রিশ হলেই বা কী এসে যায়? আসল কথা হলো, দৃশ্যটাতে ছোট্ট একটা কুকুরের ছবি আছে। ওটার চোখ টিপলেই বেড়ার এক জায়গায় একটা ছোট দরজা খুলে যায়, খুলতে দেখেছি তোমাদেরকে। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার গোপন পথ নিশ্চয়? টেরিয়ার ডয়েল জানে?
ব্ল্যাকমেইল! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
যা খুশি মনে করতে পারো, জিনা বলল। টাকা দেব না বলে। করছি, ভেব না। টাকা দেব ঠিকই। আসলে, সাহায্য চাই আমি। তিন গোয়েন্দার খুব নাম শুনলাম, তাই তোমাদের কাছেই এসেছি।
খুব ভাল করেছ, হাসল মুসা।
বেশ। এখন বলল, আমাকে সাহায্য করবে, না শুঁটকির কাছে যাব!
ও এখন শহরে নেই, হাসি মুছে গেল মুসার মুখ থেকে।
ওর চেলারা আছে। এগারো গোয়েন্দা বানিয়েছে ওরা। শুনলাম, তোমাদের সঙ্গে ওদের আদায়-কাঁচকলায় বন্ধুত্ব। যাব?
একটা খালি বাক্সের ওপর বসে পড়ল কিশোর। সাহায্য? কী সাহায্য চাও?
ওই ভ্যারাডের বাচ্চাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাই, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল জিনা।
ভ্যারাড? কালো পোশাক পরে যে লোকটা এসেছে, ফেকাসে মুখো?
হ্যাঁ। ফেকাসে হবে না তো কী হবে, সারাদিন থাকে ঘরে বসে! রাতে বেরোয়। শিওর, ওর বাপ একটা ছুঁচো ছিল।
ও যেদিন এল, তুমি ঘোড়া থেকে পড়ে পা কাটলে। সেরাতেই রুজ পালাল, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করেছে কিশোর, তার মানে জোর ভাবনা চলেছে মাথায়। অদ্ভুত কিছু একটা শুনেছে। না, কল্পনা করেনি, ঠিকই শুনেছে।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছে, কিন্তু গলায় জোর নেই জিনার। অস্বস্তি বোধ করছে। হাতের কার্ডটা একবার ভাজ করছে, আবার খুলছে। এর জন্যে ভ্যারাডই দায়ী, ধীরে ধীরে বলল সে। কোন উপায়ে সে-ই সৃষ্টি করেছে শব্দটা। ও আসার আগে আর ওরকম শব্দ শোনা যায়নি।
ও কি এখনও তোমাদের বাড়িতেই থাকছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
না হলে তাড়াতে চাইছি কেন? খালার ধারণা, হিউগ ভ্যারাডের মত মহাপুরুষ আর হয় না। খালার মাথায় আগে থেকেই গণ্ডগোল ছিল। রোজ রাতে বিছানায় ছুরির ডগা দিয়ে অদৃশ্য চক্র আঁকত, ভূত-প্রেত যাতে তার কোন ক্ষতি করতে না পারে। ভ্যারাড আসার পর আরেকটা নতুন কাণ্ড যোগ হয়েছে। মোমবাতি। ডজনে ডজনে জেলে রাখে সারারাত। যে-সে মোম হলে চলবে না, হলিউডের এক বিশেষ দোকান থেকে বিশেষ মোম আনায়। বিভিন্ন রঙের। নীলচে-লাল মোম নাকি বিপদ ঠেকায়, শুধু নীল দিয়ে আরেকটা কী উপকার হয়, কমলা রঙ শুভ, এমনি একেক রঙের একেক গুণ। রোজ রাতে লাইব্রেরিতে গিয়ে ঢেকে খালা আর ভ্যারাড, মোম জ্বালে, দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়।
কী করে? আগ্রহে সামনে ঝুঁকল কিশোর।
কী করে, কে জানে! মাঝে মাঝে বিচিত্র শব্দ শোনা যায়, নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল জিনা। দোতলা থেকেও শুনেছি। তবে হলরুম থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। লাইব্রেরি থেকে আসে।
রুজ বলেছে, গান নাকি গায়?
গান? নিজের হাতের দিকে তাকাল জিনা। তা…হ্যাঁ, গান বলতে পারো! … তবে এমন গান জন্মেও শুনিনি! শুনলেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়।
দুই ভুরু সামান্য কাছাকাছি হয়ে গেছে কিশোরের রুজ বলেছে, কিছু একটা গান গায়। মানুষের কথা বলেনি।
সোজা হয়ে বসল জিনা, সরাসরি তাকাল কিশোরের দিকে। কে কী বলেছে না বলেছে, ওসব শোনার দরকার নেই। আমি বলছি, কাজটা ভ্যারাডের। আমি চাই, ওর শয়তানী বন্ধ হোক।
এতই খারাপ শব্দ?
তা হলে আর বলছি কী? কাজের লোক থাকছে না। এজেন্সিতে ফোন করে দু-দুজন লোক আনিয়েছি, রুজের মতই ওরাও পালিয়েছে এক রাত থেকেই। এতবড় বাড়ি, কে পরিষ্কার করে, কে কী করে? হাঁটু সমান ধুলো জমেছে, না খেয়ে মরার জোগাড় হয়েছে আমার। রাধে কে? আমি পারি না, খালা তো আমার চেয়ে আনাড়ি। দিনের বেলা টু শব্দটি করতে পারি না আমি আমার নিজের বাড়িতে। কেন? না, ভ্যারাড ছুঁচোটা সারারাত কেঁচো ধরে খাওয়ার জন্যে সজাগ থেকেছে, দিনে তো ঘুমোতে হবে তাকে! শয়তান কোথাকার! ওকে বড় মেরে বিদেয় করতে চাই আমি।
কিন্তু, অবাঞ্ছিত মেহমান তাড়ানোর কাজ তো আমাদের নয়, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। তোমার খালাকে সব খুলে বলে দেখো…
বলে বলে মুখ ব্যথা করে ফেলেছি, নিমের তেতো ঝরল যেন জিনার কণ্ঠে। খালি হাসে। বেশি বললে অন্য কথায় চলে যায়। ফিল্মের রদ্দিপচা যেসব জিনিসপত্র জোগাড় করে এনেছে, ওগুলোর কথা তোলে।
ফিল্মের জিনিসপত্র? মুসার প্রশ্ন।
আরে, বুড়িটার কি এক দোষ? কোথায় কোথায় গিয়ে রাজ্যের সব পচা মাল কিনে আনে! স্প্রিং ফিভার ছবিতে ডেলা লাফনতি যে আলগা। চোখের পাতা ব্যবহার করেছে, সেগুলো এনেছে। মারকোস রিভেঞ্জ-এ জন মেঝাঙ্ক-এর ব্যবহার করা তলোয়ারটা জোগাড় করেছে চড়া দাম দিয়ে। ফিল্ম স্টারদের ফেলে দেয়া বাতিল জিনিসের নিলাম হবে শুনলেই ছোটে খালা। ওসবের পেছনেই যায় তার টাকা।
এতে দোষের কিছু দেখছি না, বলল কিশোর।
আমিও দেখতাম না, যদি ওসব চক্র আঁকা আর মোমবাতি জ্বালা বাদ দিত। তা-ও না হয় সওয়া গেল, কিন্তু ওই ভ্যারাড ব্যাটাকে আমি একদম সইতে পারছি না। ও আর ওর বিচ্ছিরি গান!
ছাপার মেশিনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল মুসা। কিশোর, আমার মনে হয়, ব্যাটাকে তাড়ানো কঠিন কিছু না। ওর বিছানায় শুয়োপোকা ছেড়ে দিতে পারি আমরা, বাথটাবে ব্যাঙ ছেড়ে দিতে পারি, জুতোর ভেতরে সাপ ভরে রাখতে পারি…
না না, ওসবে কাজ হবে না! বাধা দিয়ে বলল জিনা। বরং খুশিই হবে। সাপ ভীষণ পছন্দ ওর! ছুঁচোটার দুর্বলতা কোথায় জানা দরকার।
ওকেও ব্ল্যাকমেইল? শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।
অনুচিত কিছু হবে না। আমার বাড়িতে ঢুকে বসে অত্যাচার করছে। সে। এমনই চশমখোর, আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না; পাত্তাই দিতে চায় না। যেন বাড়িটা তার বাপের, আমিই অন্যায়ভাবে ঢুকে পড়েছি। ওর ব্যাপারে জানা খুব কঠিন হবে, খালাও মুখ খুলতে চায় না।
হয়তো তোমার খালাও জানেন না, মুসা বলল।
হতে পারে, মাথা ঝোকাল জিনা। নিশ্চয় ভাল জানে। খারাপ কিছু জানলে ব্যাটাকে বাড়িতে ঢুকতে দিত না। খালাটা ভীষণ বোকা, তবে মানুষ খারাপ না। ওসব কথা থাক। আসলে, ভ্যারাডের ব্যাপারে ইনফরমেশন চাই আমি। ও কে, কোথা থেকে এসেছে, কী করে, জানতে চাই। সেজন্যে তোমাদের সাহায্য দরকার। একটু চুপ থেকে বলল, শোনো, আজ রাতে পার্টি দিচ্ছে খালা। টেলিফোনে দাওয়াত করছে, শুনে এসেছি। অতিথিদের খাওয়ানোর জন্যে কী জানি রাধছে ভ্যারাড ব্যাটা। বেশি লোক মানেই বেশি কথা। কিছু না কিছু জেনে যাবই আমরা। পার্টিতে তোমাদেরও দাওয়াত, আমার তরফ থেকে।
ভ্যারাডের রান্না খাওয়ার জন্যে? খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। মুসার।
না, দূর থেকে দেখার জন্যে। ইচ্ছে হলে গন্ধ শুঁকতে পারো যত, খুশি। পার্টি শেষে অতিথিদের অনুসরণ করবে তোমরা; দেখবে, কে কোন্ গুহায় গিয়ে ঢুকছে। তারপর ভাব, কী করা যায়। হ্যাঁ, গ্যারাজের কাছে হাজির থেকে রাত আটটায়। পেছন দিয়ে ঢুকো, তা হলে কারও চোখে পড়বে না। উঠে দাঁড়াল জিনা। ঠিক আটটা, মনে থাকে যেন। নইলে শুঁটকির সঙ্গে দেখা করব গিয়ে, হ্যাঁ।
স্যালভেজ ইয়ার্ডের আঙিনার দিকে চলে গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ।
নতুন মক্কেল পাওয়া গেল, কিশোর বলল।
কিন্তু ও যে ব্ল্যাকমেইল…
আরে, দূর, ব্ল্যাকমেইল, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। এভাবে এমন একটা সুযোগ এসে যাবে ভাবতেই পারিনি। রুজ পালিয়ে আসার পর থেকেই ভাবছি, কী করে ঢোকা যায় ও-বাড়িতে। তা ছাপার মেশিনের পেছনে একটা শয়গায় হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একটা লোহার পাত, উঠে গিয়ে ওটা এক পাশে সরিয়ে রাখল কিশোর। বেরিয়ে পড়ল ইয়া মোটা এক পাইপের মুখ। ভিতরে, নিচের দিকে পুরানো কার্পেট ফালি করে কেটে বিছানো; হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় হাতে-হাটুতে ঘা লেগে চামড়া যাতে ছিলে না যায় সে জন্যে। এটা হেডকোয়ার্টারে ঢোকার আরেকটা গোপন প্রবেশপথ, দুই সুড়ঙ্গ। জঞ্জালের তূপের নিচ দিয়ে চলে গেছে পাইপটা, আরেক মাথা শেষ হয়েছে গিয়ে একেবারে ট্রেলারের মেঝের তলায়। মেঝেতে গোল গর্ত কেটে তার মুখে গোল দরজা বসিয়ে দেয়া হয়েছে, ঠেলা দিলেই খুলে যাবে।
ভিতরে যাচ্ছ? জানতে চাইল মুসা।
হ্যাঁ। রবিনের বোধহয় আজ সকালে কাজ নেই লাইব্রেরিতে। ওকে খবরটা দিতে হবে। বলব, আজ রাতে এক পার্টিতে দাওয়াত পেয়েছি আমরা।
আমিও আসি, বলল মুসা। পেরেক আর হাতুড়ি নেব। লাল কুকুর চার বন্ধই করে দিতে হচ্ছে। জিনাকে বিশ্বাস নেই। পান থেকে চুন খসলেই হয়তো গিয়ে বলে দেবে শুঁটকির দলকে, হেডকোয়ার্টারে ঢুকে সব তছনছ করে দিয়ে যাবে ওরা। তার চেয়ে পথ বন্ধই করে দিই আপাতত।
চার
সাঁঝের বেলা পারকার হাউসকে পাশ কাটিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
পার্টি খুব বড় না, বলল কিশোর। গাড়ি-বারান্দায় মাত্র তিনটে গাড়ি দেখেছে। একটা কমলা স্পোর্টস কার, একটা সবুজ সরকারি গাড়ি, আরেকটা ধূলি-ধূসরিত ছাই রঙের স্যালুন।
বাড়ির পিছনের খানিকটা খোলা জায়গা পেরিয়ে গ্যারাজের পিছনে এসে দাঁড়াল ওরা। ওদের অপেক্ষায় রয়েছে জিনা। নিচু গলায় বলল, সবাই এসে গেছে। ডাইনিং রুমে। চত্বরের দিকের দরজা খুলে রেখেছি, এসো। আস্তে, শব্দ কোরো না।
পা টিপে টিপে এসে দাঁড়াল ওরা চত্বরের ধারে, ওইসটেরিয়া ঝাড়ের ছায়ায়। চোখের সামনে একটা লতা সরিয়ে জিনার কাঁধের ওপর দিয়ে ডাইনিং রুমে উঁকি দিল কিশোর। এমন পার্টি জীবনে দেখেনি সে। পাঁচজন লোক, একটা গোল টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়েছে নীরবে। লালচে-লাল নতুন একটা পোশাক পরেছে মিস মারভেল, আস্তিনের প্রান্ত অস্বাভাবিক ছড়ানো, গলা পুরোপুরি ঢেকে দিয়েছে উঁচু কলার। তার উল্টো দিকের লোকটা হিউগ ভ্যারাড, আগাগোড়া কালো পোশাক পরনে, রূপার ভারি মোমদানিতে জ্বলছে দুটো লাল মোমবাতি, ম্লান আলোয় চকচক করছে লোকটার ফেকাসে চেহারা। ছোট করে ছাটা কালো চুল আঁচড়ে কপালের ওপর এনে ছড়িয়ে ফেলেছে, ঘন ভুরু ছুঁই ছুঁই করছে চুলের ডগা।
ভ্যারাডের বাঁ পাশে ছিপছিপে এক মহিলা, পরনে কমলা রঙের গাউন। মিস মারভেলের মতই চুলে কলপ লাগিয়েছে সে, কিন্তু রঙ পছন্দ ঠিক হয়নি তার। কমলা পোশাকের সঙ্গে হালকা লাল হাস্যকর রকম বেমানান লাগছে।
লাল-চুলো মহিলার পাশে সোনালি-চুলো আরেক মহিলা। আঁটসাট হালকা সবুজ পোশাক ছিঁড়ে-ফেটে বেরিয়ে যাবে যেন থলথলে মাংসল শরীর। তার পাশেই দাঁড়িয়েছে পঞ্চম লোকটা, পার্টিতে বেমানান। অন্য সবাই দাঁড়িয়েছে সোজা হয়ে, সে দাঁড়িয়েছে সামান্য কুঁজো হয়ে, সুযোগ পেলেই বসে পড়তে ইচ্ছুক যেন। অন্যেরা পার্টির জন্যে বিশেষ পোশাক পরে এসেছে খুব সাবধানে বাছাই করে, কিন্তু ওই লোকটা অতসবের ধার ধারেনি, হাতের কাছে যা পেয়েছে, তা-ই তাড়াহুড়ো করে পরে চলে এসেছে বোধহয়। পুরানো মলিন জ্যাকেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ময়লা স্পোর্টস শার্ট, তার নিচ থেকে বিচ্ছিরিভাবে বেরিয়ে আছে টি শার্টের খানিকটা। উস্কোখুস্কো ধূসর চুলে কতদিন চিরুনি আর নাপিতের কাচি পড়েনি, কে জানে!
এখান থেকে কথা শোনা যাবে না, আরও সামনে এগোনোর ইশারা করল জিনা। ফিসফিস করে বলল, সব কটার মাথায় ছিট আছে!
ওরা ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জানি না, মাথা নাড়ল জিনা। মেহমানদের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছিলাম, ভ্যারাডের বাচ্চা এমন একখান চাউনি দিল না আমাকে! মরা মাছের চোখের মত ঠাণ্ডা ব্যাটার চোখ, গা শিরশির করে তাকালে! ময়লা জ্যাকেট পরে আছে যে লোকটা ওর নাম রাসলার, খাবারের দোকানের মালিক। কমলা গাউন পরা কঙ্কালটার নাম জেরি গ্যানারিল, নাপতিনী, খালার চুল ও-ই ড্রেসিং করে। কমলা রঙের কাপড় পরলে নাকি সে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। সেজন্যেই বোধহয় খালি ঝাঁকি খেতে থাকে তার শরীর। আর ওই যে সোনালি-চুলোটা, ওর একটা বড়সড় দোকান আছে, স্বামী হেলথ ডিপার্টমেন্টের বড় অফিসার।
মৃদু একটা শব্দ হলো, কোন দিকে ঠিক বোঝা গেল না। কিশোরের মনে হলো, গ্যারাজে। কী জানি, ঘোড়াটার খুর ঠোকার শব্দ হবে হয়তো!
কিছু একটা ঘটবে, ফিসফিস করে বলল জিনা। চলো, এগিয়ে দেখি।
আরও এগিয়ে আরেকটা ওইসটেরিয়া ঝাড়ের আড়ালে দাঁড়াল ওরা।
একটা কাঁচের বাটিতে পানির মত কী একটা তরল পদার্থ ঢেলে ভ্যারাড়ের দিকে এগিয়ে দিল মিস মারভেল। দুহাতে ধরে বাটিটা তুলল। ভ্যারাড, মোমের শিখার দিকে দৃষ্টি স্থির, কোনরকম ভাবান্তর নেই রক্তশূন্য চেহারায়। সাপের চোখের মত ঠাণ্ডা চোখের তারা চকচক করছে। মোমের আলোয়।
শুরু করা যায়, বলল ভ্যারাড।
টেবিলে আরও কাছাকাছি হলো অতিথিরা। একটা দীর্ঘশ্বাস শুনল বলে মনে হলো কিশোরের।
সবাই আসেনি আজ, গম্ভীর গলায় বলল ভ্যারাড। ডাক্তার শয়তান আজ দেখা না-ও দিতে পারেন। যোজন যোজন দূরে রয়েছেন মহাসর্প, তিনি কথা বলবেন কিনা, তাই বা কে জানে! তবু চেষ্টা করে দেখা যাক।
বাটিটা একবার ঠোঁটে চুঁইয়েই কমলা পোশাক পরা মহিলার হাতে তুলে দিল ভ্যারাড।
আমাদের বৈঠক সার্থক হোক! কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল জেরি গ্যানারিলের গলা থেকে। বাটিতে চুমুক দিল। হবে, হবে! কেন, সেই যে, বাড়িওলীর সঙ্গে যখন আমার লাগল…
চুপ! ধমক দিল, ভ্যারাড। আবেশই নষ্ট করে দেবেন!
কুঁকড়ে গেল গ্যানারিল, বাটিটা তুলে দিল মিস মারভেলের হাতে। চুমুক দিয়ে খানিকটা তরল খেয়ে সে আবার তুলে দিল রাসলারের হাতে। সে খেয়ে দিল সবুজ পোশাক পরা মহিলার হাতে। তার হাত থেকে আবার বাটি ফিরে এল ভ্যারাডের কাছে।
এবার বসতে পারি আমরা, ভ্যারাড বলল।
যার যার চেয়ার টেনে বসে পড়ল বৈঠকের সদস্যরা।
মিস মারভেল, আপনার ইচ্ছে কী, বলুন, আদেশের সুর ভ্যারাডের গলায়।
মাথা নুইয়ে-অদৃশ্য কারও উদ্দেশে সালাম জানাল মিস মারভেল। আমি ক্রিস্টাল বলটা চাই। অ্যানি পলকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা হোক, কিছুতেই যেন সে ওটা কিনতে না পারে।
বিলিয়ালকে অনুরোধ করব?
করুন। মোট কথা আমি বলটা চাই।
অন্য সদস্যদের দিকে তাকাল ভ্যারাড। আপনাদের কী মত?
আমার নিজের সমস্যা নিয়েই বাঁচি না! ঘোঁত ঘোত করে উঠল রাসলার।
এখানে এক ভাইয়ের সমস্যা সবারই সমস্যা, মনে করিয়ে দিল ভ্যারাড।
অ্যানিকে দূরে কোথাও বেড়াতে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? শরীর ঝাঁকি খেল গ্যানারিলের। এই…দিন পনেরোর জন্যে…কবে পাঠালে সুবিধে, আপা?
একুশ তারিখের আগে, বলল মিস মারভেল।
মিস মারভেলের ওপর থেকে সবুজ পোশাক, তারপর রাসলারের ওপর এসে থামল ভ্যারাডের কালো চোখ। তা হলে আমরা সবাই একমত, চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে।
থিরথির করে কাঁপছে মোমের শিখা। কয়েক মিনিট কিছুই ঘটল না। পাথরের মূর্তির মত নিথর হয়ে আছে ঘরের সব কজন লোক।
শোনা গেল শব্দটা, ঘন কালো রাতের অন্ধকারে ভর করে যেন ভেসে এল। প্রথমে অস্পষ্ট, মোলায়েম একটা কাঁপা কাঁপা আওয়াজ, স্থির বাতাসকে ঘুটছে যেন ধীরে ধীরে। গানের মত, কিন্তু গান বলা চলবে না কিছুতেই, শরীর হিম-করা বেসুরো সুর আছে, কথা নেই; তাল লয় ছন্দ, কিছু নেই। একবার চড়া পর্দায় উঠছে সুর, পরক্ষণেই নেমে যাচ্ছে; একবার তীক্ষ্ণ, একবার মোলায়েম। কমছে, বাড়ছে, থামছে, গোঙাচ্ছে, বিড়বিড় করছে, ফোপাচ্ছে; তারপর হঠাৎ করেই হাঁসফাঁস করে উঠছে, যেন গায়কের গলা টিপে ধরেছে কেউ!
আতঙ্কে রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে তিন গোয়েন্দার। এমন বিচ্ছিরি গান জীবনে শোনেনি ওরা। ভয়ঙ্কর এক কালো জগৎ থেকে উঠে আসছে যেন দুরন্ত শয়তান, মানুষকে টেনে নিয়ে যাবে শব-গন্ধে ভরা নরকে! ঢোক গিলল রবিন, কাঁপা কাঁপা শ্বাস পড়ছে মুসার।
শান্ত রয়েছে কিশোর, গভীর মনোযোগে দেখছে অতিথিদের কাণ্ড! নতুন কেউ ঢোকেনি ঘরে। ছাতের দিকে চেয়ে আছে ভ্যারাড, স্থির।
অবশেষে পিছিয়ে যেতে শুরু করল জিনা। ছেলেরা অনুসরণ করল। তাকে। নিঃশব্দে চলে এল খোয়া বিছানো পথে। গান চলছেই, জ্যান্ত অশরীরী কিছু একটার মত তাদের সঙ্গে চলেছে যেন কুৎসিত শব্দ।
পেছনের চত্বরে চলে এল চারজনে। প্রাসাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল জিনা। আস্তে আস্তে ভয় কেটে যাচ্ছে রবিন আর মুসার।
এই গান শুনেই পালিয়েছিল রুজ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল শুধু জিনা, মুখে কিছু বলল না।
আমিও পালাতে চাই, চুলে আঙুল চালাচ্ছে মুসা।
গভীর শ্বাস টানল জিনা। আমি চাই না, কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা। এটা আমার বাড়ি। খালা থাকতে চাইলে থাকবে, কিন্তু ভ্যারাডকে যেতে হবে। এখান থেকে!
কিন্তু অকাজটা ভ্যারাডের নয়, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। ওর মুখের একটা পেশীও নড়েনি, দেখেছি। ও শব্দ করেনি।
ও করেনি, কিন্তু এতে ওর হাত আছেই, ভোতা গলায় বলল জিনা।
গ্যারাজে অস্থিরভাবে পা ঠকল কমেট, মৃদু চিহিহি করে উঠল।
মে-ট! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। গ্যারাজে ঢুকেছে কেউ!
প্রায় লাফিয়ে উঠে ছুটল কিশোর। গিয়ে এক টান মেরে খুলে ফেলল গ্যারাজের দরজা, পরক্ষণেই জোরে এক ধাক্কা খেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। দুপদাপ পা ফেলে খোলা জায়গাটার দিকে ছুটে গেল কালো একটা মূর্তি।
কিশোর! চেঁচিয়ে উঠে গোয়েন্দাপ্রধানের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল মুসা।
আমি ঠিকই আছি, ধীরে ধীরে বলল কিশোর। লোকটা কে, দেখেছ?
মোটকা! জবাবটা দিল রবিন। বেশি লম্বা না। গোঁফ আছে মনে হলো, আঁটার মত গোঁফ।
নজর তো খুব কড়া! জিনার কণ্ঠে শ্রদ্ধা। অন্ধকারে দেখলে কী করে এত কিছু?
অন্ধকার কোথায় দেখছ? কিশোর বলল। তারার আবছা আলো আছে না? নজর কড়া না হলে গোয়েন্দা হবে কী করে? গান যে থেমে গেছে খেয়াল করেছ?
রান্নাঘরে আলো জ্বলল, গ্যারাজের ছায়ায় লুকিয়ে পড়ল ছেলেরা।
দরজা খুলে গেল রান্নাঘরের। কে? মিস মারভেলের গলা।
আমি, খালা, জবাব দিল জিনা।মেটকে দেখতে এসেছি।
বড় বেশি বেশি করো তুমি ঘোড়াটাকে নিয়ে! বিরক্তি ঝরল মিস মারভেলের কণ্ঠে। এসো, জলদি এসো। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
গাড়ি-বারান্দায় ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো।
পার্টি বোধহয় ভাঙল, চাপা গলায় বলল রবিন।
সকালে এসো আবার, জিনা অনুরোধ করল।
আসব, বলল কিশোর।
খোয়া বিছানো পথে জিনার হালকা পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
চলো, আমরাও কেটে পড়ি, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে মুসা। আবার। কখন শুরু হয়ে যায় গান, কে জানে!
পাঁচ
পরদিন সকালে, বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। তারের বেড়া দেয়া মাঠে ঘাস খাচ্ছে আপালুসাটা, তা-ই দেখছে।
চমৎকার স্বাস্থ্য! মুসা বলল এক সময়। অনেক মানুষেরই থাকে না।
এবং কোন মানুষই ঘাস খায় না, পিছন থেকে শোনা গেল জিনার গলা। তোমার যে কথা! ঘোড়া আর মানুষ এক হলো নাকি?
ঘুরে তাকাল ছেলেরা। জিনার পরনে জিনসের প্যান্ট, কড়া ইস্ত্রী করা শার্ট। তারপর? কিছু ভেবেছ! কীসে গান গায়, বুঝেছ কিছু?
গতরাতে আর কিছু ঘটেছে? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর, পারকার, হাউসের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।
না, গলা সমান উঁচু বেড়া ডিঙিয়ে এপাশে চলে এল জিনা। আচ্ছা, লোকটা গ্যারাজে লুকিয়ে ছিল কেন, বলো তো?
জানি না, হেসে মাথা নাড়ল রবিন। ওর সঙ্গে তো আর আমাদের। কথা হয়নি। তবে অনুমান করতে পারি। হয়তো চোর, বাড়িতে ঢোকার পথ খুঁজছিল। কিংবা ভবঘুরে, রাত কাটানোর জন্যে ঢুকেছিল গ্যারাজে।
ওই বিচ্ছিরি গান গাওয়ার জন্যেও ঢুকে থাকতে পারে, কিশোর। বলল। মনে আছে, ভ্যারাড বলেছিল, অনেক দূর থেকে আসতে পারে মহাসর্পের গান?
কিন্তু সাপ তো গান গায় না, প্রতিবাদ করল জিনা। সেটা মহাই হোক, আর সাধারণ সাপই হোক। কেবল হিসহিস করতে পারে।
একটা কথা ভুলে যাচ্ছ, যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর। হিউগ ভ্যারাড আসার আগে ওই গান কখনও শোনোনি। তার মানে ওসবের সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত লোকটা। তবে এ-ও ঠিক, গতরাতে গান যখন চলছিল, ডাইনিং রুমে চেয়ারে চুপচাপ বসেছিল সে, স্পষ্ট দেখেছি, যেন ঘোরের মধ্যে ছিল।
টেপরেকর্ডার ব্যবহার করে না তো? মুসা প্রশ্ন রাখল। হয়তো গোঁফওয়ালা লোকটার সঙ্গে আগেই পরামর্শ করে নিয়েছিল ভ্যারাড। ঠিক সময় এসে ডাইনিং রুমের কাছাকাছি কোথাও যন্ত্রটা বসিয়ে চালু করে। দিয়ে, গ্যারাজে গিয়ে লুকিয়ে বসেছিল লোকটা। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়াতক অপেক্ষা করত ওখানে, কমেটের জন্যে পারেনি।
তা হতে পারে, সায় দিল কিশোর। কিন্তু চট করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। এমনও হতে পারে, গোঁফের সঙ্গে ভ্যারাডের কোন সম্পর্কই নেই।
ঠোঁট বাকাল জিনা। তার মানে, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই রয়ে গেছি! ভ্যারাড ব্যাটাও যাচ্ছে না আমার বাড়ি থেকে, ওই নাট-ঢিলা লোকগুলোও আসতেই থাকবে!
গতরাতের অতিথিরা তো? কিশোর বলল। ঠিকই বলেছ, সত্যিই নাট-ঢিলা! ওই রাসলারটা তো একটা খাটাস, স্বভাব-চরিত্রও বিশেষ সুবিধের মনে হলো না।
ব্যাটা খাবারের দোকান চালায় কী করে! স্বাস্থ্য দপ্তর যে ওর লাইসেন্স এখনও ক্যানসেল করেনি, সেটাই আশ্চর্য!
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, কিশোর বলল। ওরা কোন একটা সাধনার জন্যে জমায়েত হয়। শয়তানকে ডাকে তো, সম্ভবত প্রেতসাধনা। করে। গতরাতে তোমার খালার সমস্যা সমাধানের জন্যে এসেছিল। শুনবে না, কোন এক অ্যানি পলকে শহর থেকে তাড়াতে চাইছে ওরা।
পাগলামি! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। স্রেফ পাগলামি!
বিজ্ঞের ভঙ্গিতে হাসল কিশোর। কোন্ বলের কথা বলেছে ওরা, আমি জানি।
জানো?
একুশ তারিখে একটা নিলাম হবে, বিখ্যাত অভিনেতা মরহুম র্যামন ক্যাসটিলোর বাড়িতে। অন্যান্য অনেক জিনিসের মাঝে কাঁচের বলটাও রয়েছে, এটা তিনি ব্যবহার করেছিলেন দ্য ভ্যাম্পায়ারস লেয়ার ছবিতে। সেদিন খবরের কাগজ পড়ে আলোচনা করছিল চাচা চাচী ব্যাপারটা নিয়ে। অভিনেতাদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র কেনার জন্যে পাগল তোমার খালা, কাঁচের বলটা কিনতে আগ্রহী তো হবেনই।
এখন বুঝতে পারছি, ভ্যারাডকে কেন এত খাতিরযত্ন করছে খালা।
শয়তান-সাধকের ক্ষমতা ব্যবহার করে অ্যানি পলকে তাড়াতে চান শহর থেকে, নিলামের সময়।
খালার সঙ্গে অ্যানি পলের সাপে-নেউলে সম্পর্ক, আমি জানি।
ওই মহিলাও তোমার খালার মত জিনিস কালেকশন করেন নাকি?
করে। খালার চেয়ে বড় পাগল। বিধবা, মস্ত ধনী। ওই মহিলা নিলামে হাজির থাকলে কাঁচের বল আর খালার ভাগ্যে জুটছে না। অত টাকা নেই খালার।
সেজন্যেই শয়তানের বৈঠক বসিয়েছেন ভ্যারাডকে দিয়ে, যাতে মহিলা নিলামেই হাজির হতে না পারে।
তাই তো মনে হচ্ছে, বলল জিনা। কিন্তু ভ্যারাডের এতে কী লাভ? টাকার জন্যে করছে না। নগদ টাকা প্রায় নেই খালার। সামান্য যা আছে, খাঁটিয়ে রেখেছে শেয়ারের ব্যবসায়; লাভ যা আসে, খাওয়া-পরা আর বাতিল জিনিস কিনতেই শেষ। তার মানে টাকার লোভে কাজটা করছে না ভ্যারাড!
হুম! মাথা দোলাল রবিন। উদ্দেশ্য জানা যাচ্ছে না তা হলে!
তবে, কিশোর বলল, খুঁজলে বাড়িতেই যন্ত্রটা পেয়ে যেতে পারি। জিনা, তোমার খালাকে বললে কি তখন বিশ্বাস হারাবেন ভ্যারাডের ওপর।
থেকে?ল জিনা। কানসেছিল ভ্যারাতে
হাসল জিনা। কানটা ধরে বের করে দেবে সোজা। আজই খুঁজতে পারবে। সকালে ফোন এসেছিল ভ্যারাডের কাছে।
নতুন কোন ব্যাপার? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
হ্যাঁ। এখানে এই প্রথম ফোন এসেছে তার কাছে। আমিই ফোন ধরেছিলাম। একটা লোক ভ্যারাডকে চাইল। ঘুমিয়ে ছিল ছুঁচোটা, দরজা ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম ভাঙাতে হলো।
এক্সটেনশন আছে নিশ্চয়, মুসা বলল। শুনেছ?
এ সময় পাইনি, জিনা বলল।ফোন ধরল আর ছাড়ল। শুধু শুনলাম, ভেরি গুড, তারপরেই লাইন কেটে দিল। খালাকে ডেকে বলল, আজ রাতে আবার বৈঠক বসবে, সব ভাইয়েরাই আসবে।
ওই বৈঠকের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করোনি তোমার খালাকে? জানতে চাইল রবিন।
করেছি। খালা ভারি খুশি, তার কাজের ব্যাপারে আমার আগ্রহ দেখে। অবশ্য কায়দা করে বলে তাকে ফুলিয়ে দিয়েছিলাম, নইলে কি আর মুখ খুলত? আজ রাতে ভ্যারাডের সঙ্গে যাচ্ছে খালা, বৈঠকে। বাড়িতে কেউ থাকবে না, আজই আমাদের সুযোগ। যন্ত্র লুকানো থাকলে, আজই খুঁজে বের করতে হবে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, গভীর চিন্তায় মগ্ন। যন্ত্রটা যদি সঙ্গে করে নিয়ে যায়?
তাই বলে চেষ্টা করেও দেখবে না একবার? জিনা বলল। ঘরের কোণে, কার্পেটের তলায়, কিংবা পর্দার আড়ালে…
তা থাকতে পারে, মাথা দোলাল কিশোর কী করে খুঁজতে হয়, জানো?
এসব কাজ করিনি তো কখনও, সত্যি কথাটাই বলল জিনা। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি।
ফাইন। তা হলে আজ রাতে তুমিই খোঁজ। গ্যারাজেও বাদ দেবে না।
বাহ, কী চমৎকার! মুখ বাঁকাল জিনা। আমিই যদি এসব কাজ করব, তোমাদেরকে ডেকেছি কেন?
কোন জায়গা বাদ দেবে না, বুঝেছ? জিনার কথা কানেই নিল না। কিশোর। টেবিলের নিচে, সাইনবোর্ডের আড়ালে…
…কিংবা ওইসটেরিয়া ঝাড়ের আড়ালে, মনে করিয়ে দিল জিনা।
তা-ও দেখতে পারো। তবে সাবধানে জাফরিতে উঠবে। পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙো না আবার।
ভাঙব না। তা আমি যখন হাত-পা ভাঙার ঝুঁকি নেব তোমরা তখন কী করবে?
তোমার খালা আর ভ্যারাডকে অনুসরণ করব। দেখব, আজ রাতে কোথায় বৈঠক বসায়।
ছয়
সানসেট বুলভারের দিকে যাচ্ছে, বোরিস বলল।
জোরে। চেঁচিয়ে উঠল পাশে বসা কিশোর। আরও জোরে! ট্রাফিক লাইটে আটকা পড়বেন না!
পড়ব না, গ্যাস প্যাড়ালে পায়ের চাপ হঠাৎ বাড়িয়ে দিল বোরিস। প্রচণ্ড গোঁ গোঁ করে প্রতিবাদ জানাল পুরানো ইঞ্জিন, কিন্তু নিমেষে গতি বেড়ে গেল গাড়ির, সিগন্যাল পোস্ট পেরিয়ে এল চোখের পলকে, আর এক মুহূর্ত দেরি হলেই লাল আলোয় আটকা পড়ে যেত।
বেগুনি-লাল ছোট্ট করভেটকে অনুসরণ করে চলেছে ইয়ার্ডের হাফট্রাক। সাগর পেছনে ফেলে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে উঠে যাচ্ছে। দুটো গাড়ি। পথের দুধারে বেশ দূরে দূরে ছিমছাম বাড়িঘর, সুন্দর বাগানে উজ্জ্বল রঙের জিরেনিয়াম ফুটে আছে। মাঝে মাঝে বাকের। ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে করভেট, কিন্তু ট্রাকটা মোড় পেরিয়ে এলেই। আবার দেখা যাচ্ছে। অবশেষে গতি কমাল গাড়ি।
টরেনটি ক্যানিয়ন, বিড়বিড় করল বোরিস। সামনে পথ শেষ, করভেটকে হারানোর ভয় নেই আর।
হাফট্রাককে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল আরেকটা কমলা রঙের গাড়ি।
জিনার খালার হেয়ারড্রেসার, কিশোর বলল। মিস গ্যানারিল।
নাপতিনী, হাসল মুসা। বোরিস, আর কোন অসুবিধে হবে না। আপনার। অন্ধকারেও দেখা যাবে ওই লাল চুল, অনুসরণ করতে পারবেন সহজেই।
বোরিসও হাসল। কমলা গাড়িটাকে অনুসরণ করল। করভেটটাকে দেখা যাচ্ছে না, গিরিপথে মোড়ের ওপাশে হারিয়ে গেছে আবার। মোড় পেরোতেই ইটের উঁচু একটা দেয়াল চোখে পড়ল, পথের ওপর সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো গাড়ি। ওগুলোর পাশে থেমেছে করভেট, মিস মারভেল আর হিউগ ভ্যারাড় নামছে গাড়ি থেকে।
ঘাসে ঢাকা ঢালের গা ঘেঁষে গাড়িগুলোর দিকে পেছন করে ট্রাক রাখল বোরিস। জিনার খালা কিংবা ভ্যারাডের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছিল তিন গোয়েন্দা, আবার সোজা হয়ে বসল।
রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে আছে বোরিস। মিস মারভেলের দিকে হাত নাড়ছে গ্যানারিল।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল রবিন আর মুসা।
আরে! ছাই রঙের স্যালুন! উত্তেজিত কণ্ঠে বলল রবিন। জিনাদের বাড়িতে যেটাকে দেখেছিলাম!
নিশ্চয় ওই নোংরা রাসলার, অনুমান করল মুসা। মেলা লোক। এসেছে তো আজ রাতে! গাড়িগুলোর দিকে চেয়ে আছে সে।
এগোরাটা, গুনে বলল বোরিস।
জেরি গ্যানারিল আর মিস মারভেলকে নিয়ে বিরাট লোহার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ভ্যারাড। গেটের মাথায় লোহার চোখা শিক বসানো। দুই মহিলাকে কিছু বলে গেটের পাশের দেয়ালের কাছে সরে গেল ভ্যারাড। একটা খোপের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে আনল।
টেলিফোন? আপন মনেই বাল রবিন।
টেলিফোনই। রিসিভার কানে ঠেকাল ভ্যারাড়, বোধহয় কিছু বলল, তারপর আবার রেখে দিল আগের জায়গায়। খানিক পরেই ঝনঝন করে খুলে গেল গেট। মহিলাদেরকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল ভ্যারাড, বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা।
নীরবে অপেক্ষা করছে গোয়েন্দারা। আর কোন গাড়ি এল না। মিনিট পনেরো পর কেবিনের দরজা খুলল কিশোর। অতিথিরা সব এসে গেছে, আর কেউ আসবে না। কীসের বৈঠক, দেখা দরকার।
নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। কিশোরকে অনুসরণ করে এগোল অন্য দুজন।
কারুকাজ করা পাল্লার একটা সর্পিল তামার পাতে হাত বুলিয়ে বলল রবিন, ইস, রাশেদ চাচা এ-জিনিস পেলে পয়সার দিকে চাইত না।
চকচকে পালিশ করা পিতলের হাতল ধরে জোরে টান দিল কিশোর, নড়ল না পাল্লা। তালা লাগানো। এটাই আশা করেছিলাম।
দেয়ালের খোপটা দেখছে মুসা। করে দেখব নাকি? ডায়াল নেই। বাড়ির ভিতরে সরাসরি কানেকশন।
পায়ে পায়ে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বোরিস। দেখো না করে।
হুকে ঝোলানো রিসিভারটা বের করে আনল মুসা। কানে ঠেকাতেই ক্লিক করে একটা শব্দ শুনল, তারপরই ভেসে এল ভারি কণ্ঠ, অন্ধকার রাত।
অ্যাঁ! থতমত খেয়ে গেল সহকারী গোয়েন্দা। রাত হয়নি এখনও, শিগগিরই হবে! ইয়ে, স্যর, একটা বিস্কুট কোম্পানি থেকে এসেছি…
আবার ক্লিক শব্দ করে নীরব হয়ে গেল ফোন, কানেকশন কেটে দিয়েছে।
বিস্কুট পছন্দ না ওদের, হাসল কিশোর, মুসার মুখ দেখেই বুঝেছে। কী ঘটেছে।
তাই তো মনে হচ্ছে, রিসিভার আগের জায়গায় রেখে দিল মুসা। তুলেই কী বলেছে জানো? অন্ধকার রাত!
কোন ধরনের কোড় ওয়ার্ড সদস্যরা জানে জবাবটা কী হবে।
পাল্লার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি দিল রবিন। একটা আলোও নেই, এ কী-রকম বাড়ি!
এগারোটা গাড়ি, বিড়বিড় করল, কিশোর!
মিস মারভেলের গাড়িতে এসেছে দুজন, তার মানে অন্তত বারোজন অতিথি এসেছে আজ রাতে।
করছে কী ব্যাটারা? বোরিসের কণ্ঠে বিস্ময়। কিছু আলো তো অন্তত থাকবে!
মোটা পর্দা লাগিয়েছে হয়তো, কিশোর বলল।
তা ছাড়া মোম, জ্বালে ওরা, রবিন যোগ করল। ওদের কাছে মোম খুব প্রিয়। এত কম আলো পর্দা ভেদ করে আসতে পারছে না।
আবছা অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে আগের রাতের কথা ভাবছে তিন গোয়েন্দা, পারকার হাউসের ডাইনিং রুমের দৃশ্য ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়: কাঁচের বাটিতে তরল পদার্থ, মেহমানদের হাতে হাতে ঘুরছে, মোমের আলোয় ঘরের দেয়ালে ছায়ার নাচন…তারপর, তারপর সেই অপার্থিব রক্ত হিম-করা বেসুরো গান..
আজ রাতেও শোনা যাবে না তো! হঠাৎ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল মুসা।
কী শোনা যাবে? বুঝতে পারছে না বোরিস।
জানি না, মাথা নাড়ল কিশোর। ভ্যারাড় বলেছে মহাসর্পের কণ্ঠস্বর। কিন্তু এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই জানতে পারব না।
আরও গেট থাকতে পারে, সম্ভাবনার কথা বলল রবিন।
তা পারে, সায় দিল কিশোর। হয়তো ওটাতে তালাও নেই। অনেকেই সামনের গেটে তালা লাগায়, পিছনের গেট এক্কেবারে খোলা থাকে। কতরকম মানুষ যে আছে! খামখেয়ালীপনা করে পুলিশের কাজ বাড়ায়।
চলো, দেখি, মুসা বলল।
বোরিস, গাড়িতে গিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বসে থাকুন। আর হ্যাঁ, গাড়িটা গেটের আরও কাছে নিয়ে এলেই বোধহয় ভাল হয়। কীসের বৈঠক বসিয়েছে ব্যাটারা, কে জানে! ছুটে পালানোর দরকার পড়তে পারে আমাদের।
দ্বিধা করল বোরিস। কী ভাবল, তারপর বলল, ঠিক আছে।ট্রাকের দিকে রওনা হলো সে।
ইঞ্জিন স্টার্ট হলো, জ্বলে উঠল হেডলাইট। ট্রাকটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এল বোরিস, গেটের সামনে দিয়ে গিয়ে ফুট পঞ্চাশেক দূরে পথের পাশে দাঁড় করাল। নিভে গেল আলো। উজ্জ্বল আলো হঠাৎ নিভে যাওয়ায় অন্ধকার অনেক বেশি মনে হচ্ছে এখন।
টর্চ আনা উচিত ছিল, আফসোস করল মুসা।
আনিনি যখন, বলে আর কী হবে? বলল কিশোর। তবে আনলেও জ্বালতাম না, ওদের চোখে পড়ত। চলো।
সাবধানে দেয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে চলল তিন গোয়েন্দা, মাঝে মাঝেই থেমে কান পাতছে। কোনরকম আওয়াজ আসছে না দেয়ালের ওপার থেকে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন, লাফিয়ে সরে গেল এক পাশে, পায়ের ওপর এসে পড়েছে একটা ছোট্ট জানোয়ার, ভয় পেয়ে ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে ছুটে পালাল ওটা।
শেয়াল, বলে উঠল মুসা।
দেখেছ? জানতে চাইল রবিন।
না। কিন্তু শেয়ালই তো হওয়া উচিত!
চুপ! চাপা গলায় হুশিয়ার করল কিশোর।
দেয়ালের ধার ধরে বাড়ির পুরো সীমানায় চক্কর দিয়ে এল ওরা, কিন্তু আর কোন গেট পাওয়া গেল না। যেখান থেকে শুরু করেছিল, আবার সেখানে এসে দাঁড়াল। বাড়ির ভিতর ঢোকার কোন পথ খুঁজে পেল না গোয়েন্দারা; শুধু জানল, বিরাট সীমানা, আশপাশ নির্জন, কাছেপিঠে আর কোন বাড়ি-ঘর নেই। অন্ধকার ঘন হয়েছে আরও, আলোর কোন চিহ্ন নেই এখন ও-বাড়িটাতে।
দেয়াল ডিঙাতে হবে, মুসা, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর। আমার আর রবিনের কাঁধে চড়ে উঠে যাও।
ইয়াল্লা! বলে কী! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। মাথা খারাপ!
আর কোন উপায় নেই, মুসার কথা কানেই নিল না কিশোর। তুমি উঠলে আমি চেষ্টা করব। কিন্তু, কাজটা তোমারই করা উচিত। তুমি উঠলে আমাকে আর রবিনকে টেনে তুলতে পারবে। আমি বা রবিন, কেউই তোমাকে তুলতে পারব না। বাড়িটাতে ঢোকার এই একটাই উপায়।
অনেক বারের মত আরেকবার নিজেকে মনে মনে গাল দিল মুসা: কেন মরতে তিন গোয়েন্দায় যোগ দিয়েছিল! কিন্তু সত্যিই কি ঢুকতে চাই আমরা? বলেই বুঝল, অহেতুক মুখ নষ্ট। রবিনকে টেনে নিয়ে দেয়ালের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর, দুজনের কাঁধে দুজনে হাত রেখে চমৎকার একটা মাচা তৈরি করে ফেলেছে।
কী আর করবে? বিড়বিড় করে নিজের ভাগ্যকেই বোধহয় একটা গাল দিয়ে এসে মাচায় উঠল মুসা। দেয়ালের মাথা দুহাতে ধরে মুখ বাড়িয়ে দিল সামনে। অন্ধকার বাড়িটার দিকে চোখ রেখে দুহাতে ভর দিয়ে এক ঝাঁকুনিতে উঠে বসল দেয়ালের ওপরে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটল ঘটনা। কান ফাটানো তীক্ষ্ণ আওয়াজে বেজে উঠল অ্যালার্ম বেল।
জলদি নামো! মুসার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
জ্বলে উঠল ফ্লাডলাইট, একসঙ্গে, আটটা, দেয়ালের একেক কোণে দুটো করে। দেয়ালের মাথা আঁকড়ে ধরে বসে আছে মুসা, তীব্র নীলচে সাদা আলো ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ, পাতা মেলে রাখতে পারছে না।
লাফ মারো! আবার চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
তাড়াহুড়ো করে ঘুরে বসতে গিয়ে হাত পিছলাল মুসার, সামলানোর চেষ্টা করল, পারল না, পড়ে গেল ধুপপ করে। এপাশে নয়, দেয়ালের ওপাশে!
সাত
নরম ঘাসের ওপর চিত হয়ে পড়েছে মুসা, তাই ব্যথা পেল না। পড়েই এক গড়ান দিয়ে হাঁটুতে ভর করে উঠে বসল। থেমে গেছে বেল। চোখ পিটপিট করল সে, আশপাশে কী আছে দেখার চেষ্টা করল।
গাঁট্টাগোট্টা একজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে।
চোর কোথাকার! চেঁচিয়ে উঠল গার্ড, কণ্ঠস্বরে কিছু একটা রয়েছে, শিরশির করে উঠল মুসার মেরুদণ্ডের ভিতর। মতলব কী?
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু শব্দ বেরোল না, গলার ভিতরটা খসখসে শুকনো-সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে দিয়েছে যেন কেউ। উঠে দাঁড়াতে গেল, কিন্তু এক হাঁটুতে ভর রেখে থেমে গেল মাঝপথেই, শাসানোর ভঙ্গিতে এক পা সামনে বেড়েছে লোকটা।
মুসাআ? ওপার থেকে শোনা গেল কিশোরের ডাক। পেয়েছ ওকে?
ভুরু কুঁচকে তাকাল গার্ড। কে? দ্রুত গেটের দিকে এগোল।
গেটের সামনে দেখা গেল কিশোরকে। এই যে, মিস্টার, ওকে দেখেছেন?
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন মুসার। অভিনয় শুরু করেছে শক্তিমান অভিনেতা।
কাকে? কিছুই বুঝতে পারছে না গার্ড।
হুগো।
মুসার দিকে তাকাল গার্ড।
আরে, না না, ও না, হাত নাড়ল কিশোর। বেড়াল। একটা হুলো, সিয়ামিজ ক্যাট। আমার মা এখনও জানে না ওটা হারিয়েছে। আপনাদের দেয়ালের ওপাশে যেতে দেখেছি।
ভাল গপ্পো! লোকটা ভয়ানক গম্ভীর।
সত্যি বলছি, গার্ডকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছে কিশোর। হয়তো কোন গাছে উঠে বসে আছে।
এমনভাবে বলছে কিশোর, মুসারই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। ঘাড়ে নেমে আসা ধূসর চুলের বোঝায় আঙুল চালাল লোকটা, মুসার দিকে ফিরল।ওঠো! হাতের নির্দেশে গেট দেখাল। বেরোও!
উঠে দাঁড়াল মুসা।
প্লিজ! অনুনয় ঝরল কিশোরের কণ্ঠে। একটু সাহায্য করুন। বেড়ালটাকে একবার খুঁজেই বেরিয়ে আসবে আমার বন্ধু।
বেড়াল নেই! মুসার কনুই ধরে টেনে গেটের কাছে নিয়ে এল গার্ড।
মা আমাকে মেরে ফেলবে, কেঁদেই ফেলবে যেন কিশোর।
আমাকে মারারও লোক আছে, বলল গার্ড। ধমকে উঠল, জলদি যাও এখান থেকে! নইলে পুলিশ ডাকব!
নিরাশ ভঙ্গিতে এক পা পিছিয়ে এল কিশোর। কড়া নজর লোকটার দিকে।
গেটের পাশে দেয়ালের ভিতরের দিকে আইভি লতার ঝাড়, তার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল গার্ড। কিছু একটা করল, মৃদু ক্লিক শব্দ হলো। খুলে যেতে শুরু করল পাল।।
এক ধাক্কায় মুসাকে বাইরে বের করে দিল গার্ড। আর যেন ভিতরে দেখি! তা হলে কপালে ভীষণ দুঃখ আছে বলে দিলাম। আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গেট।
যদি বেড়ালটা দেখেন… শুরু করেই থেমে যেতে হলো কিশোরকে।
ভাগো! চেঁচিয়ে উঠল গার্ড।
ঘুরে হাঁটতে শুরু করল মুসা আর কিশোর। চলে এল রবিনের কাছে, তাকে দেখেনি গার্ড। ফ্লাডলাইট নিভে গেল, কালিগোলা অন্ধকার যেন গ্রাস করে নিল তিন কিশোরকে।
উফফ! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।
ফিক করে হাসল রবিন। কান মলেনি তো!
এই, ভাল হবে না বলে দিচ্ছি! হাত তুলল মুসা।
আহ্, থামো তো! চাপা গলায় ধমক দিল কিশোর। কান পেতে শুনছে।
খোয়া বিছানো পথে গার্ডের বুটের শব্দ হচ্ছে। কয়েক কদম চলেই থেমে গেল।
আমরা গেছি কিনা, বোঝার চেষ্টা করছে, কণ্ঠস্বর আরও খাদে নামাল কিশোর। চলো, হাঁটি। এমনিতেই সন্দেহ করেছে গার্ড। গাড়িতে করে এসেছি দেখলে শিওর হয়ে যাবে, বেড়াল খুঁজতে আসিনি আমরা।
চলো তা হলে, তাড়াতাড়ি পালাতে পারলে বাঁচে মুসা, গার্ডের হাতে পড়তে চায় না আর।
জোরে কথা বলতে বলতে চলল ওরা পথ ধরে, খালি বেড়ালটার আলোচনা করছে। সিয়ামিজ ক্যাটের দাম কত, ওটা না পেলে মা কী পরিমাণ বকবে কিংবা পেটাবে, আরেকটা বেড়াল জোগাড় করা যায় কিনা, এসব। হাফট্রাকের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় নিচু গলায় বলল। কিশোর, বোরিস, কয়েক মিনিট পর আমাদের পিছনে আসবেন।
হাঁটতে হাঁটতে একটা মোড় পেরিয়ে এল ছেলেরা; পিছনে চেয়ে দেখল, গেট দেখা যায় না; তার মানে গার্ডের চোখের আড়ালে চলে এসেছে। থামল ওরা।
অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার! কিশোর বলল। পার্টি চলছে, কিন্তু একটা আলোও জ্বালেনি। ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি বসিয়েছে, তার ওপর গার্ড। এত কড়া পাহারা কেন? চুরি করে ঢোকার উপায় নেই, অ্যালার্ম বেল বেজে ওঠে, সার্চলাইট জ্বলে ওঠে! সাঙ্কেতিক কথার জবাব যে জানে না, তাকে ঢুকতে দেয়া হয় না। কী কাণ্ড চলছে ভিতরে?
পিছন থেকে ট্রাকটা এসে দাঁড়াল পাশে, উঠে বসল ছেলেরা। রবিন দরজা বন্ধ করে দিল।
পাক্কা হারামি লোক! পিছন দিকে হাত নাড়ল বোরিস। সব কথা শুনেছেন? মুসা জিজ্ঞেস করল।
শুনেছি। একবার ভাবলাম, যাই! আরেকটু বাড়াবাড়ি করলেই যেতাম। মুসা, ব্যথা পেয়েছ?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিল মুসা আমান। এখন আর পাচ্ছি! তবে পড়ার পরে মনে হয়েছিল, মেরুদণ্ড দুটুকরো!
একটা দুই রাস্তার মোড়ে এসে গতি কমাল বোরিস। বাঁ দিকে টরেনটি ক্যানিয়ন রোড ধরে তীব্র বেগে ছুটে আসছে আরেকটা ট্রাক, ওটাকে পথ ছেড়ে দেয়ার জন্যে থেমেই দাঁড়াতে হলো। পিছন থেকে এসে ঘ্যাচ করে হাফট্রাকের পাশে থামল একটা কমলা রঙের স্পোর্টস কার।
আরে! চাপা গলায় বলল রবিন। মিস গ্যানারিল, হেয়ারড্রেসার!
বাড়ি ফিরছে! উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল কিশোর। জলদি জিনার কাছে। ফোন করতে হবে! নিশ্চয় খোঁজাখুঁজি করছে। ভ্যারাড় কিংবা মিস মারভেল দেখে ফেললে কী ভাববে, কে জানে!
সামনে আধ মাইল দূরে একটা পেট্রল স্টেশন আছে, বোরিস জানাল।
তাড়াতাড়ি চলুন, বার বার পিছন ফিরে তাকাচ্ছে কিশোর, মিস মারভেলের গাড়ি আসছে কিনা দেখছে।
পেট্রল স্টেশন থেকে পারকার হাউসে ফোন করল কিশোর। দ্বিতীয় বার রিং হওয়ার আগেই ওপাশে রিসিভার তুলল জিনা।
বৈঠক শেষ, কোনরকম ভূমিকা করল না কিশোর। আমরা কিছুই করতে পারিনি। তোমার কদ্দূর? পেয়েছ?
না।
সব জায়গায় দেখেছ?
কিচ্ছু বাদ দিইনি। চুম্বকও ব্যবহার করেছি। খালি ধুলো, রুজ যাওয়ার পর আর ঝাড়া হয়নি।
তার মানে, যন্ত্রটা সঙ্গে নিয়ে গেছে ভ্যারাড। কিংবা তার সহকারীর। কাছে রয়েছে ওটা।
সহকারী? তাই হবে। নতুন একজন লোক আসছে বাড়িতে।
কে?
রুজের জায়গায়। খানিক আগে এসে বলল, কত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চায়।
তারপর?
জানালাম, মা বাড়িতে নেই। যা বলার আমাকে বলতে পারে…
অপরিচিত একজনের সঙ্গে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোমার, জিনা!
শুধু তাই না, জিনার হাসি শোনা গেল। চাকরিটাও দিয়ে ফেলেছি তাকে।
চুপ করে রইল কিশোর। বুঝতে পারছে, আরও কথা বলার আছে। জিনার।
এভাবে হুট করে কেন রাজি হয়ে গেছি, জিজ্ঞেস করলে না?
কেন?
কারণ, চোখা গোঁফ আছে লোকটার। গতরাতে গ্যারাজে লুকিয়েছিল যে লোকটা, তারও গোঁফ ছিল। একই লোক কিনা, জানি না, কিন্তু যদি হয়, কোন বিশেষ কারণ আছে এভাবে যেচে এসে চাকরি চাওয়ার। হয়তো ও-ই ভ্যারাড় ইবলিশের সহকারী। তা হলে কী বলো, ওকে আসতে বলে ভালই করেছি, না? চোখে চোখে রাখা যাবে। কাল সকাল আটটায় কাজে যোগ দেবে সে। এসেই ভ্যারাডের কফিতে মাকড়সার ডিম মেশাতে শুরু করবে কিনা, কে জানে।
তোমার খালা জিজ্ঞেস করলে কী বলবে?
গল্প একখানা বানিয়ে রেখেছি মনে মনে। হ্যাঁ, কাল সকালে দেখা কোরো আমাদের বাড়িতে।
লাইন কেটে দিল জিনা। ট্রাকে ফিরে এল কিশোর।
কী ব্যাপার? কিশোরের চিন্তিত ভঙ্গি লক্ষ করল মুসা।
ঠিক বুঝতে পারছি না! হয় মেয়েটা অতি চালাক, নইলে এক্কেবারে বোকা, কিংবা দুটোই!
কী বলছ? একই সঙ্গে চালাক আর বোকা হয় কী করে একজন!
তা-ও জানি না! তবে জিনার ক্ষেত্রে হয়তো তা-ই ঘটেছে!
আট
পরদিন সকালে পারকার হাউসে এল তিন গোয়েন্দা। বারান্দায় সিঁড়িতে বসে আছে জিনা, হাসিতে উজ্জ্বল মুখ-চোখ।
শুনছ? বলল জিনা।
শুনছে তিন গোয়েন্দা। বাড়ির ভিতর থেকে আসছে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের গুঞ্জন।
কিছুই বলে দিতে হয়নি ওকে, জিনা বলল। সুটকেসটা রুজের ঘরে রেখে এসেই কাজে লেগে গেছে। ঝাড়টা নিয়ে আগে কুলি-ময়লা পরিষ্কার করেছে। খালার মাকড়সার জালের আশা একেবারেই খতম। হি
তার মানে রাতেও এখানে থাকছে সে? রবিন জানতে চাইল।
সেটাই ভাল হবে, না? পাল্টা প্রশ্ন করল জিনা। দিনে-রাতে সব। সময় নজর রাখতে পারব ওর ওপর।
লোক ভাল হলে হয়, কিশোরের কণ্ঠে সন্দেহ। তোমার খালা কী বলেন? তাঁকে বলেছ?
বলেছি। খুব ভাল বলে সোজা গিয়ে বিছানায় উঠেছে।
এর আগে কোথায় কাজ করত লোকটা?
বলেনি, আমিও চাপাচাপি করিনি।
খুব ভাল করেছ! নইলে হয়তো… বলতে গিয়ে বাধা পেল মুসা।
ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও? জিনা বলল। দেখলে চিনতে পারবে?
সন্দেহ আছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। রবিন চিনলে চিনতে পারে।
মাথা ঝোকাল রবিন।
চিনতে পারলেও এমন ভাব দেখাবে, যেন নতুন দেখছ, রবিনকে সাবধান করে দিল কিশোর।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে চলল জিনা।
বসার ঘরে কাজে ব্যস্ত লোকটা। সবুজ-সোনালি কার্পেট থেকে ধুলো ঝাড়ছে। সারা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ছেলেদের দিকে। এগিয়ে গিয়ে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সুইচ অফ করে দিল জিনা।
কিছু লাগবে, মিস পারকার? জিজ্ঞেস করল লোকটা।
না, মাথা নাড়ল জিনা। আমিই নিতে পারব। লেমোনেড়।
নিন, যন্ত্রের সুইচ অন করে দিয়ে আবার কাজে লেগে গেল লোকটা।
বন্ধুদেরকে রান্নাঘরে নিয়ে এল জিনা। ফ্রিজ খুলে চারটে লেমোনেডের বোতল বের করল। চাপা গলায় বলল, ওই লোকই?।
শিওর না, অনিশ্চিত রবিন। আকার-আয়তন এক রকম, গোঁফেরও মিল রয়েছে, তবে ও কিনা, কে জানে! মাত্র এক পলক দেখেছিলাম তো।
দেখে তো খারাপ লোক মনে হলো না, মন্তব্য করল মুসা। ওই লোক কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পালাবে…নাহ, বিশ্বাস হচ্ছে না।
বর্ণচোরা! জোর গলায় বলল জিনা। আস্ত এক বর্ণচোরা। লম্বাও, খাটোও না, পাতলাও না, মোটাও না। ধূসর চুল, আর দশজনের মতই স্বাভাবিক। রাস্তায় বেরোলে ওরকম লোক অনেক দেখা যায়। মস্ত গোফ বাদ দিলে লোকের ভিড়ে অতি সহজেই মিশে যেতে পারে, আলাদা করে চেনা মুশকিল, একটা বটল ওপেনার নিয়ে বোতলের ছিপি খুলতে লাগল সে। তা গতরাতে কী কী ঘটেছে বললে না তো।
সংক্ষেপে সব জানাল কিশোর।
এখনও তোমাদের চেয়ে এগিয়ে আছি আমি, হাসল জিনা। তোমরা শুধু দেয়াল থেকে পড়ার কেরামতি দেখিয়েছ, আর আমি? হার্ডে পার্সেন্ট রহস্যময় একটা লোককে আবিষ্কার করে তাকে কাজে লাগিয়েছি।
রহস্যময় আরেকটা লোককে তাড়ানোর জন্যেই আমাদের সাহায্য চেয়েছিলে, মনে আছে? মনে করিয়ে দিল মুসা। কিন্তু, ব্যাপারটা কী? ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের আওয়াজেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে না কেন নিশাচরদের?
ভ্যারাড বাইরে, লেমোনেডের বোতলে চুমুক দিল জিনা।
দিনের বেলা কক্ষনো গুহা থেকে বেরোয় না বলেই তো জানতাম!
আজ সকালে বেরিয়েছে। কোন গোরস্থানে মড়ার হাড্ডি চুষতে গেছে, কে জানে! খালার গাড়িটা নিয়ে গেছে।
দরজায় দেখা দিল মিস মারভেল। জিনা, লোকটা কে রে? সারা। বাড়ি মাথায় তুলেছে! খালার পরনে ফিকে নীল হাউসকোট, বেগুনি-নীল বেল্ট এটেছে কোমরে। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলে নতুন করে রঙ লাগিয়েছে।
নতুন কাজের লোক, খালা, জিনা বলল। তোমাকে না বললাম। গতরাতে?
ও, হা হা! খুব ভাল। কী নাম যেন বলেছিলে?
নাম বলিনি। ওর নাম ফোর্ড।
ফোর্ড! ফোর্ড! ভেরি গুড, গাড়ির নামে নাম। মনে রাখতে পারব। ছেলেদের দিকে চেয়ে আনমনে হাসল খালা। ছেলেরা গুড মর্নিং জানাল, মহিলা খেয়াল করল কিনা বোঝা গেল না। রাঁধতে পারে তো? জিনাকে জিজ্ঞেস করল।
বলল তো পারে।
তা হলে যাই, ডিনারের জন্যে কী কী রাঁধতে হবে, বলি গিয়ে। চলে গেল মিস মারভেল।
সিঙ্কে হেলান দিয়ে দাঁড়াল জিনা। বহুদিন পরে খাওয়া জুটবে মনে হচ্ছে। জানালার দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল। জনাব এসে গেছেন! দেখ দেখ, গর্ত থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছে যেন ছুচোটা!।
হেসে ফেলল ছেলেরা। ছোট্ট করভেট থেকে বেরোতে গিয়ে প্রাণান্তকর অবস্থা ভ্যারাডের। দুমড়ে মুচড়ে বাঁকা হয়ে স্টিয়ারিঙের তলা থেকে বেরোনোর চেষ্টায় অস্থির, আটকে গেছে লম্বা লম্বা পা! কাত হয়ে অনেক কষ্টে শরীরটাকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে বেরিয়ে এল অবশেষে, প্যান্টের ভিতর থেকে খুলে এসেছে শার্টের নিচের দিক টানের চোটে, প্রায় বুকের কাছাকাছি উঠে গেছে, বেরিয়ে পড়েছে রোমশ পেট।
ব্যাটা কোথায় গিয়েছিল জানতে পারলে হত, জিনা বলল।
পিছনের দরজা খুলে ঘরে এসে ঢুকল ভ্যারাড। ছেলেমেয়েদেরকে দেখে থমকে গেল, দৃষ্টি এক মুহূর্ত স্থির রইল জিনার ওপর, তারপর তাকে পাশ কাটিয়ে এগোতে গেল। নীরবে।
পথরোধ করে দাঁড়াল জিনা। মিস্টার ভ্যারাড, আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করবেন না?
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিচয় করার জন্যে দাঁড়াল ভ্যারাড। খুশি খুশি ভাব করে হাত বাড়িয়ে দিল রবিন, নিষ্প্রাণ একটা রবারের হাত ধরে যেন ঝুঁকি দিল বার কয়েক।
নীরবে সব অত্যাচার সহ্য করল ভ্যারাড। পরিচয়ের পালা শেষ। হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়াল; জিনা যেন একটা খুঁটি, এমনভাবে তাকে পাশ কাটিয়ে এগোল। বেরিয়ে গিয়েই দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজার পাল্লা।
কেমন বুঝলে? হাসিতে উদ্ভাসিত জিনার মুখ। সুযোগ পেলেই খোঁচাই লোকটাকে। ও ভাব করে, যেন আমি জ্যান্ত কিছু নই। তাই আমিও ছাড়ি না। কবে যে যাবে ইতরটা!
মিস্টার ভ্যারাড? মিস মারভেলের উঁচু কণ্ঠ শোনা গেল রান্নাঘর থেকেও। কাজ হয়েছে?
দুই লাফে দরজার কাছে চলে গেল জিনা, ফাঁকে কান পেতে দাঁড়াল।
কোন ভাবনা নেই, হলঘর থেকে জবাব এল ভ্যারাডের। আপনার ইচ্ছে পেশ করা হয়েছে। পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে মহাসর্পকে। বিলিয়াল দায়িত্ব নিয়েছেন। চুপচাপ বসে বসে শুধু দেখুন এখন কী ঘটে।
কিন্তু একুশের আর দেরি নেই, নিশ্চিন্ত হতে পারছে না মিস মারভেল। এর মধ্যে হবে তো? তেমন কিছুই না, তবু, জিনিসটা আমার চাই। আগেই যদি অ্যানি পল…
ঈমান নষ্ট করছেন! গম্ভীর কণ্ঠ ভ্যারাডের।
না না! আঁতকে উঠল যেন খালা। আমি সে-কথা বলিনি! ঈমান ঠিকই আছে…
তা হলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকুন গে। আমি যাই, রেস্ট নেয়া দরকার। বড় কঠিন কাজ করতে হয়, মাঝে মাঝে একেবারে কাহিল হয়ে
হ্যাঁ হ্যাঁ, যান!
সিঁড়িতে ভ্যারাডের জুতোর শব্দ মিলিয়ে গেল।
ব্যস, গিয়ে ঢুকল আবার গর্তে, সরে আসতে আসতে বলল জিনা। ছুঁচোও লজ্জা পাবে!
মহাসৰ্পকে পাঠানো হয়েছে! নিজেকেই প্রশ্ন করল যেন কিশোর, মানেটা কী?
ডাকে সাপ-টাপ পাঠায়নি তো খালার কাছে? মুসা বলল।
মাথা নাড়ল জিনা। না। সাপ দেখলেই মূৰ্ছা যায় খালা। ভ্যারাড আর তার ভক্তরা ওভাবেই কথা বলে। ওদের কথার মানে ওরাই শুধু বোঝে! মনে আছে, সেদিন রাতে বলেছিল, যোজন যোজন দূরে রয়েছেন। মহাসর্প, তিনি কথা বলবেন কিনা, তাই বা কে জানে!
কথা অবশ্য বলেছিলেন মহাসর্প! চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে। এমন বেসুরো সুরে, শুনলে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চায়! কী যে করছে। ওরা, ওরাই জানে! বৈঠক বসাচ্ছে, একবার এখানে, একবার ওখানে! …তোমাদের নতুন কাজের লোকটাও এসবে জড়িত কিনা, কে বলবে! যাই হোক, এখন আর এখানে কিছু করার নেই আমাদের। আবার কিছু ঘটলে খবর দিয়ো। যাই, চাচী বলেছিল কী নাকি জরুরি কাজ আছে।
আমারও লাইব্রেরিতে যেতে হবে, রবিন বলল। ডিউটির সময় হয়েছে।
আমিই বা আর থাকি কেন? বলল মুসা। কদিন ধরেই মা তাগাদা দিচ্ছে লনটা পরিষ্কার করার জন্যে।
দারুণ ছেলে তো হে তোমরা! প্রশংসায় উজ্জ্বল হলো জিনার মুখ। গোয়েন্দাগিরি, লেখাপড়া, তার ওপর আবার বাড়তি কাজ! নাহ, তোমাদের ওপর ভক্তি আমার বাড়ছে! তা যাও, নতুন কিছু ঘটলে ফোন করব। মুসার দিকে ফিরে বলল, তোমার বোতল তো খালি। দেব আরেকটা?
তা দিতে পারো, হাসল সে।
বাড়তি আরেকটা অবশ্য ওর প্রাপ্য, টিপ্পনী কাটল রবিন। বেচারা গতরাতে যেভাবে দেয়াল থেকে পড়ল। যদি দেখতে! হাহ হা!
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা, আরেকটা বোতল তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে জিনা।
লেমোনেড শেষ করে জিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে-যার পথে চলে গেল তিন গোয়েন্দা।
ইয়ার্ডে ফিরে দেখল কিশোর, সাংঘাতিক ব্যস্ত বোরিস আর রোভার; দুটো ট্রাকে উঁচু হয়ে আছে মালপত্র, ওগুলো নামাচ্ছে।
এত দেরি করলি? মেরি চাচী বলে উঠলেন কিশোরকে দেখে।
হ্যাঁ, চাচী, একটু দেরিই হয়ে গেল।
তোর চাচার কাণ্ড দেখেছিস? দেখ, কী-সব নিয়ে এসেছে!
দেখল কিশোর। ঢালাই লোহার তৈরি পুরানো আমলের এক গাদা চুলো।
লাকড়ির চুলো! চাচীর গলায় প্রচণ্ড ক্ষোভ। বল, এসব জিনিস আর আজকাল রাখে কেউ? ব্যবহার করে? শহরের পুবে কোন এক পুরানো গুদামে পড়ে ছিল অনেক বছর। নতুন শহর হচ্ছে ওদিকে, গুদাম ভেঙে ফেলা হচ্ছে, তাই বাতিল মাল সব নিলামে বেচে দিচ্ছে। কী জানি, মরতে কেন ওদিকে গিয়েছিল তার চাচা! চোখে পড়েছে, আর কী রেখে আসে! আরও পেয়েছে কমদামে! কিশোরের দিকে তাকালেন। তোর কী মনে হয়? বিক্রি হবে এগুলো?
হবে, হবে, নির্দ্বিধায় জবাব দিল কিশোর। আজকাল অনেকেরই তো পুরানো আমলের জিনিস ব্যবহারের শখ চাপে। দেখো, একটাও থাকবে না, সব বিক্রি হয়ে যাবে।
কী জানি, বাপু! আমার তো মনে হয়, শখানেক বছরেও ওগুলো পার করা যাবে না, বোরিস আর রোভারের দিকে ফিরলেন। ওই ওদিকে জঞ্জালের ধারে কোথাও নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখো। আমার চোখে যেন না পড়ে!
রাগে গটমট করে অফিসে চলে গেলেন মেরি চাচী।
চুলো নামাতে বোরিস আর রোভারকে সাহায্য করল কিশোর। ইয়ার্ডের এক ধারে নিয়ে গিয়ে তূপ করে ফেলতে লাগল। ভীষণ ভারি জিনিস, তার ওপর লাকড়ি ঢোকানোর ফোকরের দরজা আলগা, বয়ে নেয়ার সময় যখন-তখন খুলে পড়ে, সে আরেক ঝামেলা। ফলে কাজে দেরি হতে লাগল।
লাঞ্চের সময় হয়ে গেল, একটা ট্রাক খালি হয়েছে, আরেকটা তখনও পুরো বোঝাই।
খেয়েদেয়ে এসে আবার কাজে লাগল তিনজনে।
তিনটের দিকে বোরিস আর রোভারের ওপর বাকি কাজের ভার ছেড়ে দিয়ে গোসল করতে চলল কিশোর। হলঘরে ঢুকে দেখল, চাচা বসে বসে টেলিভিশন দেখছেন।
কিশোরকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন রাশেদ পাশা, ভয়ানক!
কী ভয়ানক? দাঁড়িয়ে পড়ল কিশোর।
আরে, লোকের কাণ্ডজ্ঞান নেই! এত অসাবধানে গাড়ি চালায়! হাইওয়েতে উঠলে যেন আর দুনিয়ার খেয়াল থাকে না! দেখ! টেলিভিশনের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি।
কিশোর তাকাল। পরিচিত দৃশ্য। প্রায়ই দেখে টেলিভিশনে, খবরের কাগজে। হলিউড ফ্রিওয়ে-তে একটা পুলের রেলিঙে বাড়ি খেয়ে বেঁকেচুরে পড়ে আছে একটা স্যালুন গাড়ি। পথ প্রায় বন্ধ। ট্রাফিক জ্যাম ছাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
স্পিকারে ভেসে আসছে ঘোষকের কণ্ঠ: মিস অ্যানি পল নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাঁকে অ্যাঞ্জেল অভ মারসি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন, তার অবস্থা তেমন আশঙ্কাজনক নয়…
মিস অ্যানি পল! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
চিনিস নাকি? ভুরু কোঁচকালেন চাচা।
নামটা পরিচিত, বলেই আর দাঁড়াল না কিশোর, টেলিফোনের দিকে ছুটল।
নয়
কাজ আছে, ফিরতে দেরি হবে, সে-সন্ধ্যায় ঢাচীকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল কিশোর। ওয়ার্কশপে পৌঁছে দেখল সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছে রবিন আর মুসা।
সোয়ানসন কোভ-এ যাব, কিশোর বলল। ওখানে থাকবে জিনা।
সবুজ ফটক এক দিয়ে বেরোব? জানতে চাইল রবিন।
মাথা ঝোকাল কিশোর। ও-পথেই সুবিধে। চাচীর ঘর থেকে দেখা যাবে না।
বেড়ার কাছে গিয়ে ছোট্ট একটা ফোকরে দুই আঙুল ঢুকিয়ে গোপন সুইচে চাপ দিল মুসা। নিঃশব্দে খুলে গেল দুটো পাল্লা। মাথা বের করে উঁকি দিল সে, রাস্তার এ-মাথা ও-মাথা দেখল, নির্জন। জানাল বন্ধুদেরকে। ছাপার মেশিনের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটা নিয়ে আগে বেরোল কিশোর, তার পিছনে অন্য দুজন।
পাল্লা দুটো আবার বন্ধ হয়ে গেল। চিন্তিত দৃষ্টিতে বেড়ার দিকে। তাকিয়ে আছে রবিন। বেশ বড়সড় একটা ছবিতে সাগর আকা রয়েছে, ঝড় উঠেছে, ডুবতে বসেছে একটা জাহাজ, মুখ তুলে তা দেখছে একটা বড় মাছ। ওই মাছের চোখ টিপে ধরলেই খুলে যাবে আবার সবুজ পাল্লা দুটো। তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার থেকে বেরোনোর অনেকগুলো গোপন পথের একটা এটা।
লাল কুকুর চার গেল! বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রবিন। বড় বেশি ছেক ছোঁক করে মেয়েটা! কী করে যে দেখে ফেলল! কবে আবার সবুজ ফটকটাও দেখে ফেলে, কে জানে!
দেখলে দেখবে, কিশোর বলল। আরেকটা পথ বানিয়ে নেব। ওসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মুসা বলল। চলো।
সাইকেলে চাপল তিন গোয়েন্দা। পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ড থেকে কোস্ট হাইওয়ে ধরে সোয়ানসন কোভ মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ।
বড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে আছে জিনা, কাছেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আপালুসাটা, লাগামের মাথা ঝুলছে সামনের হাটুর কাছে।
বেশ ভালই ব্যথা পেয়েছে মিস অ্যানি পল, পাথরের ওপর বসে পড়ল জিনা।
জিনার মুখোমুখি আরেকটা পাথরে বসল কিশোর।তোমার খালা কী বলেন? আমি ফোন করার পর কিছু ঘটেছে?
খালার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। কাঁদছে। খবরটা শোনার পর থেকেই খালি কাঁদছে।
পাথরের গায়ে হেলান দিল রবিন। ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে!
এবং খুব তাড়াতাড়ি, যোগ করল কিশোর। মাত্র আজ সকালে ভ্যারাড় বলল, মহাসকে পাঠানো হয়েছে, ব্যস, দুপুর পেরোতে না। পেরোতেই কর্ম সারা! মিস মারভেলের ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেল। ক্যাসটিলোর বাড়িতে নিলামে আর যেতে পারছে না মিস পল। ক্রিস্টাল বল গেল তার হাতছাড়া হয়ে।
কিন্তু এরকম কিছু ঘটুক এটা চায়নি খালা, একটু যেন লজ্জিতই মনে হলো জিনাকে। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছে: হায় হায়, এ-কী করলাম! মহিলা মারা যেতে পারত! সব দোষ আমার, সব আমার দোষ! তাকে ঘর থেকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হয়েছে ভ্যারাডকে।
স্বাভাবিক, মন্তব্য করল মুসা।
তার কথায় কান দিল না জিনা। খালার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল ভ্যারাড। হল-এ থেকে ওদের কথাবার্তা শুনেছি। সব শুনিনি, তবে এটুকু বুঝেছি, কোন একটা ব্যাপারে খালাকে চাপাচাপি করছে ভ্যারাড। বলল, অপেক্ষা করতে রাজি আছে সে, তবে বেশি দিন নয়। খালাকে কান্নাকাটি করতে বারণ করে নিচে চলে গেল সে। খালার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে দেখেই ধমকে উঠল খালা। বেরিয়ে এলাম, তবে রইলাম কাছাকাছিই, লুকিয়ে।
নিশ্চয় হল-এ? মুসা বলল।
হ্যাঁ। ফোন করল খালা, মিস্টার ফন হেনরিখকে চাইল।
বাড়তি রিসিভারটা তুলতে কত দেরি করেছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অনেক, জিনার কণ্ঠে বিরক্তি। নিচে নেমে রিসিভার তুলে শুনলাম, খালা বলছে: …একটা চিঠি সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি তা হলে। জবাব এল: হ্যাঁ, দিন। তারপরই কেটে গেল লাইন।
তারপর? প্রশ্ন করল রবিন।
ওপরতলায় খালার পায়ের আওয়াজ শুনলাম। ফোর্ডকে ডাকল। একটা ছোট্ট বাদামী কাগজের মোড়ক হাতে নিয়ে নেমে এল ফোর্ড, খালার গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
ভ্যারাডের আগ্রহ কেমন দেখলে? কিশোরের প্রশ্ন।
কামানের গোলার মত ছুটে গেল সে ওপরতলায়। খালা তৈরিই হয়ে ছিল। চেঁচাতে শুরু করল ভ্যারাড়, পাল্টা জবাব পেল। খালা বলল, ফোর্ডকে বেভারলি হিল-এ পাঠিয়েছে একটা ফেসক্রিম কিনে আনতে।
বিশ্বাস করেছ?
না। ভ্যারাডও করেনি। এক কৌটা ক্রিম নিয়ে ফিরতে দেখল ফোর্ডকে, তাই আর কিছু বলারও থাকল না ওর। কিন্তু আমি জানি, মিথ্যে কথা। গোলাপের পাপড়ি, গ্লিসারিন আর আরও কী কী দিয়ে নিজের ক্রীম নিজেই বানিয়ে নেয় খালা, বাজারের জিনিস কক্ষনো কেনে না।
খালাকে জিজ্ঞেস করেছ কিছু? নাকি ফোর্ডকে?
কাউকেই করিনি। আমি জানতাম, কোথায় গেছে ফোর্ড। মিস্টার। ফন হেনরিখ বেভারলি হিলের অনেক বড় একটা জুয়েলারি শপের মালিক। আমাদের বাড়ির সেফের কম্বিনেশনও আমার জানা। মা-র ঘরে গিয়ে সোজা সেটা খুললাম। নেকলেসটা গায়েব।।
স্তব্ধ হয়ে গেল ছেলেরা। খবরটা হজম করতে সময় নিল। ( অবশেষে বলল কিশোর, কোন নেকলেস? ইউজেনির সম্রাজ্ঞীরটা? এত দামী জিনিস প্রায় অপরিচিত একটা লোকের হাতে পাঠাতে সাহস করলেন তোমার খালা?
খালার বুদ্ধিশুদ্ধি এমনিতেই কম, জিনা বলল। মা-ই কম্বিনেশনটা বলেছে খালাকে। কত রকমের অঘটনই তো আছে, বাড়িতে আগুন লাগতে পারে, ভূমিকম্পে ধসে যেতে পারে, তা-ই বলে রখেছে, যাতে দরকার পড়লে নেকলেসটা সরিয়ে ফেলতে পারে খালা।
নেকলেস নেই, এটা যে জানো, জানেন তোমার খালা?
জানে। নেই দেখেই তো গিয়ে ধরেছি। বলল, মা নাকি বলেছে, নেকলেসটা পরিষ্কার করার জন্যে পাঠিয়ে দিতে।
নিশ্চয় বানানো গল্প?
তা তো বটেই, মুখ বিকৃত করল জিনা। মা বাড়িতে নেই, তবু নেকলেসটা পরিষ্কার করাতেই হবে, এতই তাড়াহুড়ো! আর যদি করাতেই হয়, দোকানে পাঠাতে হবে কেন? ফন হেনরিখকে ফোন করলেই সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠিয়ে দিত, বাড়িতে বসে কাজ সেরে দিয়ে যেত।
তার মানে কোন ধরনের গোলমালে জড়িয়েছেন তোমার খালা, কিশোর বলল। কয়েকটা ব্যাপারে উপসংহার টানতে পারি আমরা।
যেমন?
এক, অ্যানি পলের দুর্ঘটনার জন্যে নিজেকে দায়ী করছেন মিস মারভেল। ভাবছেন, শয়তানের সাহায্য নিয়ে কাজটা ভাল করেননি তিনি। পস্তাচ্ছেন এখন।
দুই, তার ওপর কোন ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে ভ্যারাড। সম্মানিত অতিথির অভিনয় বাদ দিয়ে, খোলস ছেড়ে আসল রূপ ধরেছে। ফোর্ডকে প্যাকেট হাতে দেখেছে ভ্যারাড?
না। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছে শুধু।
ও জানে, নেকলেসটা সেফে রাখা ছিল?
কী জানি! মনে হয় না। সেফের কাছে যেতে দেখিনি তাকে কখনও। ও শুধু জানতে চেয়েছে, কেন ফোর্ডকে তাড়াহুড়ো করে বাইরে পাঠাল খালা।
সেই রহস্যময় ফোর্ড! আবার সেই সব প্রশ্ন: সে-রাতে গ্যারাজে সে-ই কি লুকিয়েছিল? নাকি তোমাদের কাজের লোক দরকার শুনে কাজ করতেই এসেছে? সে-রাতের সেই রহস্যময় লোকটা যদি সে হয়, তা হলে এ-বাড়িতে কী করছে? একটা ব্যাপার অবশ্য শিওর হয়ে গেলাম, ভ্যারাডের সহকারী সে নয়, চুপ করে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটছে। কয়েকটা ব্যাপার খুব তাড়াতাড়ি জানা দরকার। প্রথমেই জানতে হবে, নেকলেসটা জুয়েলারের দোকানে সত্যিই দিয়ে আসা হয়েছে কিনা।
তাই তো! জিনা বিস্মিত। আগে ভাবিনি কেন? যাচ্ছি, এখুনি। ফোন করব।
সকালে, বাধা দিল কিশোর। আমাদের অফিস থেকে ফোন করবে, তা হলে তোমাদের বাড়ির কেউ জানবে না। সকালে জানার চেষ্টা করব, মিস পলের অ্যাকসিডেন্টের সঙ্গে শয়তান-সাধকদের কোন যোগাযোগ আছে কিনা। আনমনে বলল, কিন্তু, ভ্যারাড কি সত্যিই সাপ পাঠিয়েছিল?
মনে হয় না, মাথা নাড়ল জিনা। সাপ পাঠানো হয়েছে বলছে। বটে, কিন্তু তার অর্থ অন্য কিছু।
সেই অন্য কিছুটা কী? কী পাঠানো হয়েছে?
কী জানি। হাত নাড়ল জিনা।
তা হলে এত নিশ্চিত হয়ে বলছ কী করে?
আগেই বলেছি, ওরা ঘুরিয়ে কথা বলে। তা ছাড়া বাক্সে বা অন্য কিছুতে ভরে জ্যান্ত সাপ পাঠাবে? মোটেই রাজি হবে না খালা। তার সবচেয়ে বড় শত্রুকেও ওভাবে চমকে দিতে চাইবে না, কামড়াতে পাঠানো তো দূরের কথা!
রবিন বলল, আরেকটা ব্যাপার আছে এখানে। বিলিয়াল শব্দটা। বলেছিল ভ্যারাড। লাইব্রেরিতে বইপত্র ঘেঁটে জেনেছি, বিলিয়াল শয়তানের আরেক নাম
আর শয়তানকেই শ্রদ্ধাভরে ডক্টর কিংবা ডাক্তার শয়তান বলে ডাকে তার পূজারিরা।
গায়ে কাটা দিয়ে উঠল মুসার। খাইছে রে! শয়তানের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক! আল্লাই জানে, কী ঘটবে!
এক মুঠো বালি তুলে নিয়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ল। জিনা। কার সঙ্গে যে ভাব জমাল খালা!
সেটা আমিও ভাবছি, রহস্যময় শোনাল কিশোরের কথা। আসল। ইবলিশ না হলেও মানুষ-শয়তান তো বটেই।
দশ
বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে পরদিন সকালে পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে হাজির হলো জিনা, দেখেই বোঝা যায় সারারাত ঘুমোতে পারেনি। অফিসের কাছে তার অপেক্ষা করছে তিন গোয়েন্দা।
খালা কাঁদছে, জানাল জিনা। ভ্যারাড ঘুমোচ্ছে। আর ফোর্ড দেখে। এলাম জানালা পরিষ্কার করছে।
মেরি চাচী বাসন-পেয়ালা ধুচ্ছে, কিশোর বলল। এই সুযোগে ফোনটা সেরে ফেলো।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অফিসে ঢুকে রিসিভার তুলে ডায়াল করল জিনা। হারটার কথা জিজ্ঞেস করে জবাব শুনল চুপচাপ, তারপর থ্যাঙ্কিউ বলে নামিয়ে রাখল রিসিভার।
ওরা হার পেয়েছে, উকণ্ঠা দূর হয়েছে জিনার। দিন কয়েক রাখবে হারটা, কাজ হয়ে গেলেই পাঠিয়ে দেবে। যাক, বাঁচা গেল! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
তা হলে নিরাপদেই আছে, কিশোর বলল। আর যাই হোক, তোমাদের নতুন লোকটা রত্নচোর নয়। এখন সাপের ব্যাপারটা কী, জানা দরকার। অ্যাকসিডেন্টটা কী করে ঘটল জানতে হবে।
তোমার কী ধারণা? কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। মিস পলের গাড়িতে সাপ ফেলে রাখা হয়েছিল?
কেঁপে উঠল জিনা।
খুব সম্ভব, জবাব দিল কিশোর। গাড়ির ভেতর হঠাৎ জ্যান্ত সাপ দেখলে চমকে উঠবে না এমন মানুষ কমই আছে।
এখন কী করবে? জিনা জিজ্ঞেস করল।
আমি লাইব্রেরিতে যাব, রবিন বলল। সাপ, শয়তান আর প্রেতসাধকদের ব্যাপারে পড়াশোনা করব। দেখি, আর কী কী জানা যায়।
আমি আর মুসা যাব হাসপাতালে, কিশোর বলল। মিস অ্যানি পলকে দেখতে। লস অ্যাঞ্জেলেসে যাবে বোরিস, আমাদেরকে নামিয়ে দিতে পারবে।
আমি বাড়ি যাচ্ছি, দরজার দিকে রওনা হলো জিনা। সব কটার ওপর নজর রাখতে হবে।
তেমন কিছু যদি জানতে পারি, ফোন করব তোমাকে, কথা দিল কিশোর।
জিনা বেরিয়ে গেল।
দরজায় দেখা দিল বোরিস। রেডি?
হ্যাঁ, বলল কিশোর। মুসাকে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ট্রাকে চড়ল।
লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে ছুটে চলেছে ট্রাক। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে কিশোর, মুসা চুপচাপ।
ভারমন্ট বুলভারে ঢুকল গাড়ি, ছোট্ট একটা ফুলের দোকান চোখে পড়তেই বোরিসের বাহুতে হাত রাখল কিশোর। আফ্রিকান ভায়োলেটের একটা তোড়া কিনল সে, উপহারের কার্ডে গুটি গুটি করে কিছু লিখল। তারপর আবার এসে উঠল ট্রাকে।
অ্যাঞ্জেল অভ মারসি হাসপাতালের গেটে গাড়ি রাখল বোরিস। আমি থাকব?
থাকবেন? …আচ্ছা, থাকুন, আমরা আসছি, কেবিনের দরজা খুলল কিশোর।
এবার কীসের খোঁজে?
এক মহিলার সঙ্গে দেখা করব। সাপ!
সাপ! চমকে উঠল বোরিস! এমনভাবে বলেছে কিশোর, যেন গাড়ির ভেতরেই কোথাও রয়েছে সরীসৃপটা।
তা-ও আবার যে-সে সাপ নয়, গান-গাওয়া সাপ! বোরিসকে আরও তাজ্জব করে দিল মুসা।
নামল কিশোর। মুসাকে নামতে মানা করল। বলল, আমি একাই যাই। লোকের চোখে যত কম পড়া যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।
ঠিক আছে, যেতে হলো না বলে খুশিই মুসা। আমি বসছি।
হাসপাতালে এসে ঢুকল কিশোর। রিসেপশন ডেস্কের ওপাশে বসা মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, মিস অ্যানি পলের সঙ্গে দেখা করা। যাবে?
একটা বাক্সে সাজানো কার্ডে আঙুল চালাল মহিলা নীরবে। নির্দিষ্ট কার্ডটা তুলে পড়ল: রুম নাম্বার দুশো তিন, ইস্ট উইং। মুখ তুলে কিশোরকে বলল, করিডর ধরে চলে যাও, লিফট পেয়ে যাবে। দোতলায় গিয়ে কোন নার্সকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে ঘর।
রিসেপশনিস্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে করিডর ধরে রওনা হলো। কিশোর। লিফটে করে উঠে এল দোতলায়। সামনেই একটা অফিস, লোকজন খুব ব্যস্ত। ফোনে উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন একজন ডাক্তার, ওষুধ আর যন্ত্রপাতির ট্রে নিয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে এক নার্স, আরও কিছু ওষুধ নিয়ে ছুটে এল আরেকজন নার্স। তাদের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর, কিন্তু দেখতেই পেল না যেন তাকে কেউ।
রিসিভার নামিয়ে রেখে এক নার্সকে নিয়ে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। ডাক্তার। দ্বিতীয় নার্স রইল ফোনের কাছাকাছি, চোখ একটা চাটে।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল কিশোর। মিস অ্যানি পলের সঙ্গে দেখা করব, প্লিজ। দুশো তিন নাম্বার।
চার্ট থেকে চোখ ফেরাল নার্স। হবে না। ঘুমের বড়ি খাইয়ে এসেছি।
প্লিজ, সিসটার…
বললাম তো, এখন দেখা করতে পারবে না। নিজের কাজে মন দিল নার্স।
অ! চোখের পলকে চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল কিশোরের। আমার…আমার চাচী! …চাচী ছাড়া আর কেউ নেই দুনিয়ায়! ফোঁপাতে শুরু করল সে। বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে! এখন চাচীও যদি যায়… আর বলতে পারল না সে, ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল।
বিস্ময় ফুটল প্রথমে নার্সের চোখে, সেটা করুণায় রূপ নিল। হাত তুলল, দাঁড়াও, খোঁজ নিয়ে দেখি, ঘুমিয়ে পড়ছে কিনা।
দুহাতে চোখ ডলতে শুরু করল কিশোর।
ইউনিফর্মে খসখস আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল নার্স, ফিরে এল। আধ মিনিট পরেই। এখনও জেগেই আছে, যাও। কিন্তু দেরি করবে না, ঠিক? হাত তুলে একটা দিক দেখিয়ে দিল।
থ্যা-থ্যাঙ্কিউ, সিসটার! হাসি ফুটল কিশোরের মুখে, বড় বড় অপূর্ব সুন্দর দুটো চোখ কান্নাভেজা।
দরজার গায়ে নম্বর দেখে পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। বিছানায় শুয়ে আছেন এক গোলগাল চেহারার মহিলা, ধবধবে সাদা চুল, ঢুলুঢুলু চোখ। কোমর পর্যন্ত কম্বল টানা।
কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। মিস পল? তোড়াটা বাড়িয়ে দিল।
মহিলার ঘুমজড়ানো ধূসর চোখের তারা উজ্জ্বল হলো। বাহ্, কী সুন্দর!
স্পেশাল ভায়োলেট, হাসল কিশোর। একটা লোক আপনাকে দিতে দিল।
বালিশের পাশ থেকে আস্তে করে চশমাটা নিয়ে পরলেন মিস পল। কার্ডটা দেখি?
বিছানার পাশের টেবিলে ফুলদানিতে তোড়াটা গুঁজে রাখল কিশোর, কার্ডটা খুলে নিয়ে দিল মহিলার বাড়ানো হাতে।
কার্ড চোখের সামনে এনে বিড়বিড় করে পড়লেন মিস পল: শুভেচ্ছা-তাড়াতাড়ি সেরে উঠুন। উল্টেপাল্টে দেখলেন। অবাক। আরে! নাম-টাম কিচ্ছু নেই!
চুপ করে রইল কিশোর।
কালও একই কাণ্ড ঘটেছিল, আবার বললেন মহিলা। একটা প্যাকেট, সঙ্গে কার্ড.. নামঠিকানা কিছু নেই! এত ভুলো মন লোকটার!
আমারও তাই মনে হলো, কিশোর বলল। লম্বা ছিপছিপে মানুষ, কালো চুল, ফেকাসে চেহারা।
হুমম! চোখ মুদলেন মিস পল।
ঘুমিয়ে পড়ছেন না তো! অধীর হয়ে উঠেছে কিশোর, এই সময় ঘুমিয়ে পড়লে…হঠাৎ চোখ মেললেন মহিলা। মনে পড়েছে! গতকাল ওই লোকটাই সাপ দিয়েছিল। আজ দিল ফুল।…আশ্চর্য!
সাপ!
হ্যা! …ছোট্ট… চোখ মুদলেন আবার মিস পল, ঘুমিয়ে পড়ছেন।
সাপ? তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। সাপ সংগ্রহ করেন নাকি আপনি?
আবার মেললেন ধূসর চোখ জোড়া। না না! ওটা আসল সাপ না! ব্রেসলেট। পছন্দ হলো না… চোখের পাতা কাছাকাছি হতে শুরু করল। মহিলার।
তার মানে সাপের মত? মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করল কিশোর।
হ্যাঁ। …ঠিকানা জানি না তো, নইলে ফেরত পাঠাতাম। দেখাচ্ছি, ড্রয়ারের দিকে হাত বাড়ালেন মিস পল। আমার হ্যান্ডব্যাগে।
তাড়াতাড়ি ড্রয়ার খুলে হাতব্যাগটা বের করে দিল কিশোর।
ব্যাগ খুলে ভেতরে হাতড়ালেন মহিলা। এই…এই যে…বিচ্ছিরি না?
হুঁ! ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের। বেসলেটটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। খুদে একটা ধাতব সাপ, কারিগরের বাহাদুরি আছে, স্বীকার করতেই হবে। ফণা তুলে আছে অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি একটা সোনালি রং করা গোখরো, গাঢ় লাল পাথরে তৈরি দুটো চোখ, জীবন্ত মনে হয়।
সাপের মসৃণ পেটে আঙুল চালিয়ে দেখল কিশোর, যতভাবে সম্ভব পরীক্ষা করল। গতকাল গাড়িতে এটা ছিল আপনার সঙ্গে?
ছিল, পরেছিলাম। গতকালই তো? হ্যাঁ, অথচ মনে হচ্ছে অনেক দিন আগের কথা, চোখ মুদলেন। কী করে যে খুলে এল চাকাটা!
চাকা খুলে এল? গাড়ির ভেতরে তা হলে গোলমাল ছিল না?
আবার চোখ খুললেন মিস পল। না…চাকাটা খুলে গেল, সামনের…। গড়াতে গড়াতে ছুটল, পরিষ্কার দেখলাম! সামনে পুল…তারপর আর কিছু মনে নেই…
দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল কিশোর। নার্স। কড়া দৃষ্টি।
যাচ্ছি, অনুনয়ের সুরে নার্সকে বলল কিশোর। ব্রেসলেটটা মিস পলের হাতে গুঁজে দিয়ে রওনা হলো দরজার দিকে।
এতক্ষণ জ্বালাবে জানলে ঢুকতে দিতাম না, কঠোর গলায় বলল নার্স।
সরি, করুণ হাসি হাসল কিশোর। যেতে মন চাইছে না…
বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল নার্স। ঠিক আছে, ঠিক আছে, অন্য সময় এসে কথা বোলো আবার, তাড়াতাড়ি বলল সে, আশঙ্কা, ছেলেটা আবার না কেঁদে ফেলে!
চেহারা বিষণ্ণ করে নার্সকে দেখিয়ে দেখিয়ে লিফটে উঠল কিশোর, দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই আয়নার দিকে চেয়ে দরাজ হাসি হাসল নীরবে।
কিছু জানলে? কিশোর কাছে আসতেই জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে। দিল মুসা।
অনেক কিছু, গাড়িতে উঠল কিশোর। সাপটা মহিলার ব্যাগেই রয়েছে।
সা-প! চেঁচিয়ে উঠল বোরিস। হাসপাতালে সাপ সঙ্গে রেখেছে?
ধাতুর সাপ। একটা ব্রেসলেট, গোখরোর হুবহু নকল।
বুঝেছি, আস্তে মাথা দোলাল মুসা। যত গোলমাল এই ব্রেসলেটেই! কোন মাদক ছিল, গাড়ি চালানোর সময় ঢুকে গেছে মিস পলের শরীরে। বরজিয়া আঙটির কথা শোনোনি? গোপন কুঠুরি ছিল আঙটির ভেতরে, তার ভেতরে রাখা হত মারাত্মক বিষ। গোপন অতি সূক্ষ্ম একটা সূচ লাগানো ছিল, ওটা বিষ ইনজেক্ট করে দিত যে পরত তার শরীরে…।
জানি, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। সেজন্যেই ভালমত পরীক্ষা করে দেখেছি ব্রেসলেটটা। বরজিয়া আঙটির মত ভেতরে কোন কৌশল। নেই। চেহারা বাদ দিলে অতি সাধারণ একটা অলঙ্কার, ভ্যারাড নিজে দিয়েছে মিস পলের হাতে। কোন জ্যান্ত সাপ ছিল না মহিলার গাড়িতে, সামনের একটার চাকা হঠাৎ খুলে গিয়েছিল। মুসার দিকে ফিরল সে। কী মনে হয়? ব্রেসলেটে খুলেছে চাকাটা? যদি প্রমাণ করতে পারো, রাশেদ চাচার সব কটা লোহার চুলো চিবিয়ে খাব আমি, কসম।
এগারো
ইয়ার্ডে ফিরে সোজা হেডকোয়ার্টারে রওনা হলো মুসা আর কিশোর। ওয়ার্কশপে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছাপার মেশিনের ওপরে চালায় লাগানো লাইটটা জ্বলছে-নিভছে। তার মানে হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন বাজছে।
জিনা হবে, কিশোর বলল। তাকে আমাদের নাম্বারটা দিয়েছি।
দুই সুড়ঙ্গের মুখে রাখা ধাতব পাতটা সরিয়ে পাইপে ঢুকে পড়ল মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে এসে পড়ল শেষ মাথায়, ঢাকনা তুলে উঠে এল ট্রেলারের ভেতরে।
কিশোর ঢাকনা তুলেই শুনল মুসার গলা: …সাপ সত্যিই পাঠানো হয়েছে, তবে নকল সাপ। একটা ব্রেসলেট। …না না, সাপে কিছু করেনি। সামনের চাকা খুলে গিয়েছিল। স্রেফ দুর্ঘটনা…কিন্তু মাত্র পৌঁছেছি আমরা, এখুনি…ঠিক আছে, ডিনারের পর যাব।
রিসিভার নামিয়ে রেখে কিশোরের দিকে ফিরল মুসা। জিনা। মিস। মারভেল আর ভ্যারাড লাইব্রেরিতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। ফোর্ড গেছে বাজারে। আগে কোথায় চাকরি করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করেছিল জিনা। দুজায়গার কথা বলেছে। মিসেস জেরিনাল নামে এক মহিলার বাড়িতে, আর জনৈক প্রফেসর হ্যারিডানের বাড়িতে। মিস্টার জেরিনাল সরকারি চাকুরে, কানসাস সিটিতে বদলী হয়ে গেছেন। ওখানে ফোন করার চেষ্টা করেছে জিনা, পারেনি, ফোন গাইডে নামই নেই। প্রফেসর হ্যারিডানকেও পায়নি, লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
সুবিধের মনে হচ্ছে না, কিশোর বলল। লোকটাকে কাজ দেয়ার আগে ভালমত খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল।
নেয়নি, এখন সেটা নিতে বলছে আমাদেরকে। কায়দা করে–ফোর্ডের বাসার ঠিকানা জেনে নিয়েছে জিনা, সান্তা মনিকার নর্থ টেনিসনে। এখুনি যেতে বলেছিল, মানা করে দিয়েছি।
ডিনারের পর যাবে বলেছ।
হ্যাঁ। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এখুনি বাড়ি না গেলে মা আর ঢুকতেই দেবে না।
ডিনারের পরই ভাল। আমারও তখন কোন কাজ থাকবে না।
কিন্তু, গলা চুলকাঁচ্ছে মুসা। জিনার কথায় বড় বেশি নাচছি না আমরা! ও বলল চিলে কান নিল, আর অমনি চিলের পেছনে ছুটলাম!
ও আমাদের মক্কেল, কিশোর যুক্তি দেখাল। ওভাবে ফোর্ডকে ঘরে জায়গা দিয়ে ভুল করেছে, কিন্তু ভুল তো করেই মানুষ। যাই হোক, এখন ওকে সাহায্য করতে হবে আমাদের। হ্যাঁ, রবিনকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি, ঠিক সাতটায় যেন সুপারমার্কেটের সামনের রাস্তায় থাকে। তুমিও ওখানেই এসো। নাকি?
আচ্ছা।
ঠিক সাতটা, দেরি কোরো না।
সন্ধে সাতটা পাঁচ মিনিটে কোস্ট হাইওয়ে ধরে সান্তা মনিকার দিকে সাইকেল চালাল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে আনা ম্যাপ দেখে নর্থ টেনিসন প্লেস খুঁজে বের করল কিশোর। মূল সড়ক থেকে বেরিয়ে গেছে একটা সরু গলি, তার মাথায় একটা বড় পুরানো বাড়ি, লাল টালির ছাত। জিনার দেয়া নাম্বার মিলিয়ে দেখে নিল মুসা।
গ্যারাজ অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়িটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। তোমরা এখানে দাঁড়াও, আমি আসছি। সরু গাড়িপথ ধরে এগিয়ে। গেল সে, ফিরে এল খানিক পরে। একটা ডবল গ্যারাজের ওপর। আরেকটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। একই নম্বর।
কিন্তু কোনটাতে থাকে ফোর্ড, কী করে জানব? মুসা বলল।
বড় বাড়িটায় কাউকে জিজ্ঞেস করব। বলব, আমরা ফোর্ডের ভাইপোর বন্ধু, ওয়েস্টউড় যাচ্ছিলাম; ভাবলাম, ফোর্ড চাচার সঙ্গে দেখা করে যাই, হাসল কিশোর।
ফোর্ডের ভাতিজা। হা হা! সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল রবিন।
সাইকেলটা পথের ওপর শুইয়ে রেখে হেঁটে গিয়ে সদর দরজায় দাঁড়াল কিশোর, বোতাম টিপল। পুরো এক মিনিট অপেক্ষা করল, কেউ এল না, আবার বেল বাজাল। দরজা খুলল না কেউ। ফিরে এল সে।
বুদ্ধি খাটল না, মুসা বলল। এবার কী?
আগে ওই ছোট গ্যারাজটাতেই দেখব, সাইকেল তুলছে কিশোর। আমার মনে হয় ওখানেই থাকে সে। অনেক সময় মানুষকে দেখেই অনুমান করা যায় সে কেমন জায়গায় বাস করে।
চুরি করে ঢুকব? মুসার প্রশ্ন।
জানালা দিয়ে দেখব।
খুব সহজেই দেখা সম্ভব হলো। গ্যারাজের পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে, সিঁড়ির মাথায় খুদে একটা চতুরমত, সামনে দরজা, পাশে জানালা, জানালার খড়খড়ি ওঠানো।
কপাল ভাল আমাদের, জানালার কাছে নাক চেপে ধরল কিশোর।
তার গা ঘেঁষে এল মুসা। জুতোর ডগায় ভর রেখে মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল রবিন।
ডুবন্ত সূর্যের সোনালি আলো জানালা দিয়ে এসে ঘরে ঢুকেছে, ফলে বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভেতরটা। এক দিকের দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটা তাক, বইয়ে ঠাসা। একটা কাজের টেবিল, তাতে নানারকম ফাইল-ফোল্ডার আর বইয়ের স্তূপ। ছোট আরেকটা টেবিলে একটা টাইপরাইটার, পাশে একটা ফ্লোর ল্যাম্প, একটা সুইভেল চেয়ার…বসে টাইপ করার জন্যে। বড় একটা কাউচ আছে, চামড়ায় মোড়া গদি।
বাড়ি না অফিস? মুসা বলল।
জানালার কাছ থেকে সরে এল কিশোর। লোকটা বইয়ের পোকা। লেখালেখির দিকেও ঝোঁক আছে মনে হচ্ছে।
শিস দিয়ে উঠল রবিন। বইয়ের নাম দেখেছ? উইচক্র্যাফট, ফোক মেডিসিন অ্যাণ্ড ম্যাজিক, আনকোরা নতুন বই। লাইব্রেরিতে এসেছে গত হপ্তায়, অনেক দাম। আরেকটা বই দেখলাম টেরিলে, ভুড়-রিচুয়াল অ্যাণ্ড রিআলিটি।
সাপ সংক্রান্ত কোন বই? মুসা জিজ্ঞেস করল।
থাকতে পারে, অনেক বই-ই তো আছে। সব টাইটেল পড়তে পারছি না এখান থেকে।
দরজার নব ঘোরানোর চেষ্টা করল কিশোর, তালা আটকানো। ফিরে এসে জানালার শার্সি টান দিল, খুলে গেল। ঢাকা যাবে! দুই বন্ধুর দিকে তাকাল সে।
গ্যারাজের নিচের চত্বরের দিকে তাকাল মুসা, শূন্য, নির্জন। বড় বাড়িটার কাছেও লোকজন দেখা যাচ্ছে না।
ধরা পড়লে বিপদ হবে, ফিসফিস করে বলল মুসা।
পড়ব না, জানালার চৌকাঠে উঠে ভেতরে লাফিয়ে নামল কিশোর।
মুসা আর রবিনও ঢুকল ঘরে। পায়ে পায়ে তিনজনেই এগিয়ে গেল কাজের টেবিলটার দিকে। তাকের বইগুলোর দিকে তাকাল রবিন। আদিম মানুষের আচার-ব্যবহার, উপকথা, লোককথা, ব্ল্যাক ম্যাজিকের ওপর লেখা নানারকম বই।
কয়েকটা বইয়ের নাম পড়েই মুসা বলে উঠল, ভ্যারাড আর মিস মারভেলের সঙ্গে ব্যাটার মিল হবে ভাল!
লোকটার ওপর ভক্তি এসে যাচ্ছে আমার, রবিন বলল। কঠিন কঠিন সব বিষয়, আজ দুপুরে পড়ার চেষ্টা করেছিলাম, মাথায়ই ঢুকল না। বেশির ভাগ।
অকাল্ট-বিশেষজ্ঞ দেখা যাচ্ছে! বিড়বিড় করল কিশোর। সত্যিই এটা ফোর্ডের ঘর তো? এমন একজন মানুষ লোকের বাড়িতে চাকর থাকতে গেছে! টেবিলের ওপর ঝুঁকে ফাইলে লাগানো ট্যাগে নাম পড়তে শুরু করল সে, আউরোস ক্লায়েন্ট, দ্য গ্রিন ট্রায়াঙ্গল, দ্য ফেলোশিপ অভ দ্য লোয়ার সার্কেল…আরিব্বাপরে। কী সব নাম! আপন মনেই বাংলা করল ওগুলোর, আউরোর মক্কেল, সবুজ ত্রিভুজ, নির্মচক্রের সঙ্… বলতে বলতেই মোটা ফাইলটা টেনে নিল। আমাদের ভ্যারাড মিয়ার সঙ্ কিনা, এখনি বোঝা যাবে, ফিতের বাঁধন খুলে ফেলল সে।
কী? তাকের দিক থেকে ফিরল রবিন।
ঘেটে ঘেঁটে দুই শিট কাগজ বের করল কিশোর ফাইল থেকে। এই যে, মিস মারভেলের নাম! হু, ফোর্ডের চোখ তার ওপর পড়েছে। নামধাম, নাড়ি-নক্ষত্র সব লেখা: গোটা পাঁচেক অস্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান। কিংবা সঙ্ঘের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল মিস মারভেল, অতীতে দুটো অ্যাস্ট্রলজি ম্যাগাজিনে ছবি ছাপা হয়েছে তার, সাধুদের সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ভারতেও গিয়েছিল একবার। বেশিদিন থাকেনি ওখানে, সন্ন্যাসগিরি বিশেষ ভাল লাগেনি বোধহয়। রকি বিচে পারকার হাউসে কবে উঠেছে মিস মারভেল, তা-ও পরিষ্কার করে লেখা আছে, এমনকী হিউগ ভ্যারাড কবে ঢুকেছে তা-ও।
আর কিছু? মুসা জানতে চাইল।
আরেক শিট কাগজ বের করল কিশোর। মিস মারভেলের সয় সম্পত্তি কী আছে না আছে, তার লিস্ট। নাহ্, বড়লোক নয় মহিলা।
টাকা চায় নাকি ফোর্ড?
ফাইলের কাগজ উল্টেপাল্টে দেখল কিশোর। তাই তো মনে হচ্ছে। রাসলারের নামধামও লিখেছে, ওই যে, খাবারের দোকানের নোংরা মালিক। ইস্ট লস অ্যাঞ্জেলেসে সম্পত্তি আছে তার। চেহারা দেখলে তো ভিখিরি মনে হয়; আসলে টাকাপয়সা আছে, দেখা যাচ্ছে।
কমলা লেডি?
জেরি গ্যানারিল, হেয়ারড্রেসার? ফাইলের পাতা উল্টে চলল কিশোর, এক জায়গায় এসে থামল। এই যে, বেশ কয়েকটা অস্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। নিজের ব্যবসা আছে, যথেষ্ট ভাল আয়। হেয়ারড্রেসিঙের দোকান ছাড়া আরও ব্যবসা আছে। স্টক। স্যান। ফারনানদো ভ্যালিতে অফিস, নিজের অ্যাকাউনটেন্ট আছে।
আর কারও নাম? রবিন জানতে চাইল।
আছে। এই যে, আরেকটা মনে হয় সেই মোটা মহিলা, সবুজ পোশাক পরেছিল যে। লোনের জন্যে ব্যাঙ্কে দরখাস্ত করেছে, আরেকটা দোকান করবে। আরও অনেকের নাম লেখা আছে, তাদেরকে চিনি না আমরা।
ম্যাজিক অ্যাণ্ড উইচক্র্যাফট, টেবিলে রাখা বইটায় আঙুল রাখল রবিন। সেই সঙ্গে টাকা!
টাকার সঙ্গে প্রেততত্ত্বের সম্পর্ক আছে বোধহয়, কিশোর বলল।
টান দিয়ে একটা ড্রয়ার খুলল মুসা। কয়েকটা পেপার ক্লিপ আর। একটা ছোট টেপরেকর্ডার, ব্যস, আর কিছু নেই। রেকর্ডারে টেপের ছোট একটা স্কুল লাগানো রয়েছে! দারুণ জিনিস। মেরে দিলে কেমন হয়?
যন্ত্রটা তুলে নিল রবিন। সত্যিই ভাল! ব্যাটারিতে চলে। ছোট একটা বোতাম টিপতেই এক প্রান্তের একটা খোপের দরজা খুলে গেল। ভেতরে খুদে মাইক্রোফোন। বাহ! চমৎকার! পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার জিনিস। জেমস বণ্ড এটা পেলে বর্তে যেত।
কিন্তু কী টেপ করা হয়েছে? যন্ত্রটার দিকে চিন্তিত চোখে চেয়ে। আছে কিশোর। দেখো তো, প্লে করা যায় কিনা।
বোতামের কাছে নির্দেশ চিহ্ন রয়েছে, একটা বোতাম টিপল রবিন। মৃদু হিররর শব্দে ঘুরতে শুরু করল ফিতে, পুরোটা রিভার্স করে নিয়ে প্লে লেখা বোতামটা টিপল সে। কয়েক সেকেণ্ড খুটখাট করার পর ভেসে এল। একটা পুরুষ কণ্ঠ: শুরু করা যায়!
ভ্যারাড! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
সবাই আসেনি আজ রাতে। ডাক্তার শয়তান আজ দেখা না-ও দিতে পারেন। যোজন যোজন দূরে রয়েছেন মহাসর্প, তিনি কথা বলবেন কিনা, তাই বা কে জানে! তবু চেষ্টা করে দেখা যাক!
টেপরেকর্ডারটা পারকারদের বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রাখা। হয়েছিল! মুসা বলল।
ডাইনিং রুমের কাছাকাছি কোথাও হবে, ভেবে বলল রবিন।
স্পিকারে জেরি গ্যানারিলের কোলা ব্যাঙের মত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, রাসলারের ঘোঁত ঘোত আর অন্যান্য কথাবার্তা সবই শোনা গেল স্পষ্ট। তারপর ভেসে এল সেই গা-শিউরানো গান, ভরে দিল যেন ঘর!
মহাসর্প! ফিসফিস করল কিশোর।
শিউরে উঠে আস্তে করে যন্ত্রটা টেবিলে নামিয়ে রাখল রবিন। বিচ্ছিরি গান গেয়েই চলেছে মহাসৰ্প।
ধীরে ধীরে শেষ মাথায় পৌঁছে গেল ফিতে, গুঙিয়ে উঠে আরেকবার ফুঁপিয়েই শেষ হয়ে গেল গান। স্পিকারের স্বাভাবিক অতি মৃদু সসস ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল কিশোরের, শীতেই বোধহয়। হঠাৎই খেয়াল করল, ঘরে আলো নেই, কখন ডুবে গেছে সূর্য। আবছা অন্ধকার।
দরজায় শব্দ হতেই একসঙ্গে ঘুরল তিন গোয়েন্দা। ফোর্ড!
বারো
ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
লাফ দিয়ে গিয়ে টেপরেকর্ডারের সুইচ অফ করে দিল রবিন।
স্থির দাঁড়িয়ে আছে কিশোর; ফোর্ডকে কী বলবে, ভাবছে। আমতা আমতা করে বলল, আমরা চলে যাচ্ছিলাম।
দরজায় একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোঁফওয়ালা লোকটা। যে পথে ঢুকেছ সে-পথে? জানালা দিয়ে ঢুকেছ, না? ঝাঝাল কণ্ঠস্বর, খোলস। পাল্টে ফেলেছে, বাড়ির নম্র কাজের লোক আর নয় এখন না। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে ফোর্ড; কিশোরের মনে হলো, ডিনামাইট ছাড়া তাকে ওখান থেকে নড়ানো যাবে না। পালানোর উপায় খুঁজল। রবিন, হাত বাড়াল সে। টেপটা।
রেকর্ডার থেকে খুলে টেপের শুলটা কিশোরের হাতে দিল রবিন।
ওটা আমার। কপাল কুচকে গেছে ফোর্ডের।
স্পুলটা বাড়িয়ে ধরল কিশোর। রেকর্ড করলেন কী করে? ডাইনিং রুমে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন?
প্রায় অন্ধকার ঘরের ভেতরে লাফিয়ে এসে পড়ল ফোর্ড। খপ করে চেপে ধরল কিশোরের হাত।
দৌড় দাও! বন্ধুদেরকে চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
খোলা দরজার দিকে দৌড় দিল দুই সহকারী গোয়েন্দা। হাত থেকে শুলটা ছেড়ে দিল কিশোর। ফোর্ডের বা হাটুর পেছনে ডান পা বাধিয়ে হ্যাঁচকা টান মারল।
পেছনে বাঁকা হয়ে গেল ফোর্ডের শরীর, গাল দিয়ে উঠল সে। স্কুলের ফিতের এক প্রান্ত ধরে রেখেছিল কিশোর, মেঝেতে ছড়িয়ে পডেছে ফিতে, প্রান্তটা ছেড়ে দিয়ে আচমকা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়েই দৌড় দিল।
কিশোর দরজার কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে, এই সময় পেছন থেকে তার শার্ট চেপে ধরল ফোর্ড। কিন্তু গতি সামান্যতম শিথিল করল না। কিশোর। শার্টের পিঠের খানিকটা ছিঁড়ে ফোর্ডের হাতে রয়ে গেল, কেয়ারই করল না গোয়েন্দাপ্রধান, একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকে নিচে নেমে চলল।
অনুসরণ করল না ফোর্ড। হাতে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো নিয়ে হাঁ। করে চেয়ে আছে। সাঁই সাঁই প্যাড়াল করে সাইকেল নিয়ে চলে যাচ্ছে তিন কিশোর।
.
গোলমাল রাধাবে না তো ফোর্ড? পাশাপাশি সাইকেল চালাতে চালাতে এক সময় বলল মুসা। হয়তো পুলিশে ফোন করবে। করলে আমরা বলে। দেব টেপ আর ফাইলের কথা।
ও-দুটো জিনিস সহজেই নষ্ট করে, কিংবা লুকিয়ে ফেলা যায়, কিশোর বলল। আমরা রীতিমত অপরাধ করেছি। চুরি করে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করেছি, অভিযোগ করতে পারবে সে। জিনাদের বাড়িতে দেখেছে আমাদের; কোথায় থাকি, সহজেই বের করে ফেলতে পারবে।
তো, আমরা এখন কী করব? রবিনের প্রশ্ন।
ইয়ার্ডে ফিরে আগে জিনাকে ফোন করব। হয়তো কিছুই করবে না। ফোর্ড। ও যে রাতে চুরি করে পারকারদের গ্যারাজে ঢুকেছে, এটা তো মিথ্যে নয়। তা ছাড়া লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে খোঁজখবর করে। তাদের সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করেছে। অপরাধবোধ আছে তার মনে। পুলিশকে ফোন করার আগে অন্তত দশবার ভাববে।
আচ্ছা, উদ্দেশ্য কী ছিল ওর? মুসা বলল। ব্ল্যাকমেইল?
হতে পারে।
জিনা আমাদেরকে বললে পারত, তিক্ত শোনাল মুসার কণ্ঠ। আজ রাতে ফোর্ড বাসায় যাবে!
জানে না হয়তো।
হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। টেলিফোন বাজছে।
লাইনের সঙ্গে স্পিকারের কানেকশন রয়েছে, সুইচ অন করে দিয়ে রিসিভার তুলল কিশোর। জিনার কণ্ঠ শোনা গেল। কিশোর?
হ্যাঁ, কিশোরের চাঁছাছোলা জবাব। ফোর্ড ধরে ফেলেছিল আমাদেরকে।
সরি, আন্তরিক দুঃখিত মনে হলো জিনাকে। জানার পর তোমাদেরকে জানানোর অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু বেরিয়ে গেছ তোমরা তখন। ও বলল, বাসায় কী জরুরি কাজ আছে। কী করে আটকাই, বলো? চাপাচাপি করতে পারতাম, তাতে লাভ হত কী?
করে দেখতে পারতে, ক্ষোভ যাচ্ছে না কিশোরের। আমার শার্ট ছিঁড়ল; ও জেনে গেল, ওর ওপর আমরা গোয়েন্দাগিরি করছি; তোমারও আরেকজন কাজের লোক গেল।
আর ফিরে আসবে না বলছ?
দ্বিধা করল কিশোর। গরু হলে আসবে! ওর ঘরে ঢুকে এমন সব জিনিসপত্র পেয়েছি, প্রমাণ করতে পারলে কয়েক বছর জেল হয়ে যাবে। ওর। তোমার খালাকে বোধহয় ব্ল্যাকমেইল করার তালে ছিল ফোর্ড। সেরাতে গ্যারাজে লুকিয়ে ছিল ও-ই, বৈঠকের কথাবার্তা আর গান রেকর্ড করেছে।
ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা! খালাকে ব্ল্যাকমেইল করবে কী কারণে? কী অপরাধ করেছে খালা?
মিস অ্যানি পলের অ্যাকসিডেণ্টের জন্যে কে দায়ী?
চুপ করে রইল জিনা।
তোমার খালা কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওপরে। মন খারাপ।
ভ্যারাড?
লাইব্রেরিতে। কিছু একটা করছে।
ওই গান আর শুনেছ?
না। বাড়িটা কবরের মত নীরব।
ঠিক আছে, চোখ খোলা রাখো। সন্দেহজনক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। ফোর্ড ফিরলে তা-ও জানাবে।
কিন্তু ফোর্ড ফিরল না। পরদিন সকালে ইয়ার্ডে ফোন করে। কিশোরকে জানাল জিনা। দুপুরের আগে রবিনকে নিয়ে আবার সান্তা মনিকায় গেল কিশোর। আগের দিনের মতই বড় বাড়িটার সদর দরজায়। গিয়ে বেল বাজাল। আজ জবাব পেল, দরজা খুলে দিল এক শীর্ণকায় বৃদ্ধা। জানাল, সকাল বেলায়ই ঘর খালি করে মালপত্র নিয়ে চলে গেছে। ফোর্ড।
কোথায় গেছে বলতে পারেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর। দোকানে বিল বাকি ফেলে গেছে।
জানি না, মাথা নাড়ল বৃদ্ধা। কোত্থেকে একটা গাড়ি আর ট্রেলার এনে মালপত্র তুলে নিয়ে চলে গেল।
তেরো
খুব অসুবিধে হচ্ছে, কিশোরকে বলল জিনা। ফোর্ড গেছে তিন দিন হয়েছে। অন্তত খাওয়া-দাওয়াটা তো ঠিকমত করতে পারতাম। সারাদিন গুম হয়ে বসে থাকে খালা। ভ্যারাড় আছে আগের মতই, সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে খালাকে।
এখন কোথায়? নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে? বেড়ার বাইরে রয়েছে কিশোর।
না, চুল কাটাতে গেছে।
এই সক্কাল বেলা!
আজকাল ভোরে ভোরেই উঠে পড়ে, ছুঁচোবাজি কমিয়ে দিয়েছে কেন জানি!
কী কী আলোচনা করে দুজনে? তারের বেড়ার ভিতরে ঘাস খাচ্ছে। আপালুসাটা, দেখছে কিশোর।
কোন আলোচনাই নয়।
উদ্ভট কিছুতে জড়িয়ে পড়েছেন তোমার খালা। প্রেততত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছে রবিন কদিন ধরে; ও বলছে, তোমার খালা প্রেতসাধকের পালায় পড়েছেন, প্রেতসাধনা চালাচ্ছেন। ছুরির ডগা দিয়ে। বিছানায় চক্র একে তাতে বসে থাকা, মোম জ্বেলে মন্ত্র পড়া, কিংবা রঙের ওপর বিশেষ জোর দেয়া, এসব প্রেত পূজারিরাই সাধারণত করে থাকে।
কদিন ধরে মোম জ্বালছে না খালা।
আগামী হপ্তায়ই তো র্যামন ক্যাসটিলোর বাড়িতে নিলাম, কথার মোড় ঘোরাল কিশোর। তোমার খালা যাচ্ছেন? ক্রিস্টাল বল কেনার জন্যে বোধহয় যেতে পারবেন না মিস পল।
আগামী এক মাসও কোথাও যেতে পারবে না। পায়ের হাড় দু জায়গায় ভেঙেছে। খালা খালি নিজেকে দোষ দিচ্ছে। রোজ সকাল বিকাল ফোন করে হাসপাতালে, নার্সের কাছে খবর নেয় মিস পল কেমন আছে।
ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন শুনে দুজনেই তাকাল বাড়ির সামনের দিকে। চকচকে কালো একটা লিমাজিন ঢুকছে। গাড়ি-বারান্দায় এসে থামল গাড়িটা, শোফার নেমে পেছনের দরজা খুলে ধরল। খুব দামী পোশাক আর, দস্তানা পরা একজন বেঁটেখাটো লোক বেরিয়ে এল।
ভুরু কোঁচকাল জিনা। মিস্টার ফন হেনরিখ!
কিশোরও দেখছে লোকটাকে।
সাধারণ জিনিস হলে কর্মচারী দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, আবার বলল জিনা। বোধহয় নেকলেসটা নিয়ে এসেছে। চলো তো, দেখি।
বেড়া ডিঙিয়ে এপারে চলে এল কিশোর। জিনার সঙ্গে রান্নাঘর দিয়ে। হল-এ ঢুকল। ফন হেনরিখের হাত থেকে একটা প্যাকেট নিচ্ছে মিস। মারভেল। কিশোর লক্ষ করল; সেই নীলচে-লাল গাউনটাই পরে আছে মহিলা, তবে আগের মত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়, জায়গায় জায়গায় কুঁচকে গেছে, ময়লা; ধোয়া হয় না কতদিন, কে জানে। এক কাপড় অনেক দিন পরছে মনে হচ্ছে।
মাল ডেলিভারি দিয়ে রিসিপ্ট এবং ধন্যবাদ নিয়ে চলে গেল ফন হেনরিখ।
জিনা… বলতে বলতেই কিশোরের দিকে চোখ পড়ল মিস মারভেলের। ভুরু কোঁচকাল। আরে, কিশোর। গুড মর্নিং! কখন এলে?
এই তো, এক পা এগোল কিশোর! কেমন আছেন, খালা?
ভাল না। জিনার দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল খালা। নে, নেকলেস। খুলে দেখ তো, কেমন পরিষ্কার করেছে?
সাদা কাগজের আবরণ ছিঁড়ে গাঢ় সবুজ রঙ করা চামড়ার একটা বাক্স বের করল জিনা। বাক্সের ডালা তুলতেই ঝিলিক দিয়ে উঠল একশোরও বেশি পাথর, ঠাণ্ডা, সাদা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
দারুণ, না? কিশোরকে দেখিয়ে বলল জিনা। দারুণ হবে না?
সীসের মত ভারি! জিনা বলল। ভারি বলেই পরে না মা। আরেকটা হালকা হার আছে, ওটা পরে সব সময়। হীরা আমারও পছন্দ, তার চেয়ে মুক্তো ভাল। হালকা। তবে কিনেছে যখন, এই হারটাই পরে থাকা উচিত ছিল মা-র। যে-কোন আয়রন, সেফের চেয়ে গলায় থাকা অনেক নিরাপদ।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল মিস মারভেল। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই বলল, ওই যে, এসেছে!
রকি বিচের আপদ! মুখ কালো করে ফেলল জিনা। নাপিত ওর গলাটা কেটে দিল না কেন!
জিনা, জলদি সেফে রেখে দে নেকলেসটা!
দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। গাউনের পকেটে হাত ঢোকাল মিস মারভেল, হাতটা যেন দেখাতে চায় না, তাই লুকিয়ে ফেলল। যা, দেরি করছিস কেন!
বাক্সসহ হারটা নিয়ে চলে গেল জিনা। ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে এসে ঢুকল ভ্যারাড, আর এক মুহূর্ত আগে ঢুকলেই জিনার হাতে বাক্সটা দেখতে পেত। হেয়ার টনিকের মিষ্টি ঝাঁঝাল গন্ধ এসে লাগল কিশোরের নাকে।
খানিক পরেই সিঁড়ির মাথায় দেখা দিল আবার জিনা। কিশোর, পরে কথা বলব।
আচ্ছা, আমি যাই, দরজার দিকে পা বাড়াল কিশোর।
সারাদিন ইয়ার্ডে কাজ করল কিশোর, কান টেলিফোনের দিকে। বিকেল পাঁচটায় জিনার ফোন এল।
আজ সকালে খালার ব্যবহারে অবাক হওনি? জিনা বলল।
হয়েছি, জবাব দিল কিশোর। একটা ব্যাপার পরিষ্কার, নেকলেসটা আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে, এটা কিছুতেই ভ্যারাডকে জানতে দিতে চান না।
হ্যাঁ। ভ্যারাড নাপিতের দোকানে যাওয়ার পর নিশ্চয় ফোন। করেছিল খালা, তাড়াতাড়ি হারটা ডেলিভারি দিয়ে যেতে বলেছিল ফন হেনরিখকে। কিন্তু এতসবের কী দরকার ছিল? হারটা থাকত পড়ে হেনরিখের দোকানে, মা এসে আনিয়ে নিতে পারত।
তার মানে হারটা তোমার খালার দরকার।
কী দরকার! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। ওটা আমার মায়ের জিনিস! খালার না!
সে তো ঠিকই। এক কাজ করতে পারবে? জিনিসটা একবার নিয়ে আসতে পারবে আমাদের এখানে? কাজ আছে।
নিশ্চয়ই, সামান্যতম দ্বিধা নেই জিনার গলায়। জ্যাকেটের পকেটে করেই নিয়ে আসতে পারব। কেউ দেখবে না।
ভেরি গুড। নিয়ে এসো। আমি ওয়ার্কশপে আছি।
ছটা নাগাদ জিনা এল। বাক্সসহ হারটা কিশোরের হাতে দিয়ে। খানিকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে চলে গেল।
পরদিন ওয়ার্কশপে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা আর জিনা। বোরিসকে এক জায়গায় পাঠিয়েছে কিশোর, তার ফেরার অপেক্ষা করছে। ওরা!
দুপুর দুটোয় ফিরল বোরিস। একটা বাক্সে বসে পকেট থেকে সবুজ বাক্সটা বের করে ডালা খুলল। খুবই সুন্দর জিনিস, মিস পারকার, জিনার দিকে চেয়ে হাসল সে। কিন্তু কোন দাগ নেই।
দাম নেই! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জিনা। জানেন, ওটা ইউজেনির সম্রাজ্ঞীর জিনিস! অনেক দামী, ঐতিহাসিক মূল্য ধরলে তো কথাই নেই!
একটু যেন থমকে গেল বোরিস। সরি, মিস পারকার, কিন্তু আমি ঠিকই বলছি। সম্রাজ্ঞীর জিনিস নয় এটা, মেকি। তিনটে বড় বড় দোকানে দেখিয়েছি, একই কথা বলল। একজন তো হেসে রসিকতাও করল, ইনশিওরেন্স করাতে বলল।
মেকি! দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন জিনার। দিন!
বাক্সটা জিনার হাতে দিয়ে উঠল বোরিস। আমি যাচ্ছি। কিশোর, মিসেস পাশা কিছু বলেছেন? খুঁজেছেন আমাকে?
খুঁজেছিল, আমি বলেছি।
আচ্ছা, বেরিয়ে গেল বোরিস।
ওকে পাঠালে কেন? জিনা বলে উঠল। তুমি গেলেই পারতে?
না, পারতাম না, মাথা নাড়ল কিশোর। আমার বয়েসী কারও হাতে ওই জিনিস দেখলে লোকে সন্দেহ করত। বোরিস বড় মানুষ…তখন অবশ্য জানতাম না ওটা নকল!
আমি যাচ্ছি!
তোমার খালাকে জিজ্ঞেস করবে নিশ্চয়?
করব মানে! কঠিন গলা জিনার। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব! পেয়েছে কী? আসলটা কী করেছে না জেনে ছাড়ব মনে করেছ?
কী করেছেন, অনুমান করতে পারি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। নকল একটা বানিয়ে এনেছেন তোমাদের সেফে রাখার জন্যে। আসলটা রয়ে গেছে ফন হেনরিখের কাছে। ইচ্ছে করেই আনাননি তোমার খালা।
ধীরে ধীরে আবার বাক্সের ওপর বসে পড়ল জিনা। তাই তো! এটা তো ভাবিনি! আগাথা ক্রিস্টির পোয়ারোকে হার মানাচ্ছ তুমি, কিশোর পাশা, নাহ, স্বীকার করতেই হচ্ছে। তার মানে আসল হারটা নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে খালা!,
কিন্তু নকল হার বানানোর দরকার কী ছিল? মুসা ঠিক বুঝতে পারছে না। কী করবে এটা দিয়ে?
ভ্রূকুটি করল জিনা। ওই ছুচো ভ্যারাডটা বোধহয় কোনভাবে ভয় ঢুকিয়েছে খালার মনে! আসল হারটা তাই ব্যাটাকে দেখতে দিতেই রাজি নয় খালা।
ভ্যারাড হারটা চুরি করবে, এই ভয়? রবিন বলল।
তা হলে তো ভালই, বলে উঠল মুসা। পালাক না! নকল হার নিয়ে ভাগুক ছুঁচোটা, জিনাও বাঁচুক।
এত সহজ চুরির কেস বলে মনে হচ্ছে না আমার, কিশোর বলল। সাংঘাতিক কোন ঘাপলা রয়েছে! মিস অ্যানি পলের অ্যাকসিডেন্ট, প্রেতবৈঠক, মহাসর্পের গান, সব কিছু মিলিয়ে কোথায় জানি একটা মস্ত প্যাঁচ রয়েছে। তারই মাঝে কোনভাবে জড়িয়েছে এই হারের ব্যাপারটা।
এখনও কি গান শোনা যায়? জিনাকে প্রশ্ন করল রবিন।
না। আর একদিনও শুনিনি।
ভয় করে বাড়িতে থাকতে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
একটু যে করে না, তা বলব না!
এক্ষুণি তোমার কোন বিপদ নেই, কিশোর অভয় দিল, এটুকু বলতে পারি। তোমাকে ভ্যারাড যতক্ষণ না সন্দেহ করছে, তুমি নিরাপদ। ব্যাপারটাতে ফোর্ড জড়িত, আবার ফিরে আসবে সে কোনভাবে, তবে তাকে বিপজ্জনক লোক মনে হলো না। আর যা-ই করুক, মানুষের রক্তে হাত রাঙাবে না।
নিজের চেয়ে খালার জন্যে বেশি ভাবছি আমি, জিনা বলল। আমাকে কচি খুকী ভাবে ওরা, ভাবুক, ভালই। কিন্তু খালা যে বিপদে পড়তে যাচ্ছে। আজ রাতে আবার প্রেতবৈঠক বসবে টরেনটি ক্যানিয়নের সেই বাড়িতে। ডক্টর শয়তান আজ দেখা দিতে পারে, বলল ভ্যারাড। খালা প্রথমে যেতে রাজি হয়নি, কিন্তু পরে শুনলাম যাবে।
চমৎকার! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
মোটেই চমৎকার নয়! পাল্টা চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করল জিনা। ভয়ঙ্কর এক প্রেতবৈঠকে খালাকে দেখতে চাই না আমি!
প্রেতসাধনা করছে, না কী করছে, শিওর না হয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে। না। তোমার খালাকেও ভ্যারাডের খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে আনার কোন উপায় দেখছি না। …আজ রাতেও আমরা যাব…
আমিও যাব, ধরে বসল জিনা।
জিনা, প্লিজ! অনুরোধ করল মুসা।
না, আমি যাবই, গোঁ ধরল জিনা। তোমাদের চেয়ে আমার দায়িত্ব বেশি, কারণ, আমার খালা! ভ্যারাড় আমার বাড়িতে থাকছে, আমাকে জ্বালাচ্ছে। তা কখন রওনা হচ্ছ?
সন্ধ্যায়, কিশোর বলল। এই সাড়ে সাতটার দিকে।
কোথায় দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে?
এখানেই চলে এসো। দেখি, চাচীকে গিয়ে ধরতে হবে। পিকআপটা নিতে পারলে ভাল।
আমি যাই, বাক্সটা জ্যাকেটের পকেটে নিয়ে বেরিয়ে গেল জিনা।
রাজি হলে কেন? মুসা আপত্তি করল। গিয়ে বিপদে পড়লে?
ওকে দেয়ালের ওপরে উঠতে না দিলেই হলো, মুচকি হাসল। রবিন।
দেখো, এক কথা বার বার ভাল্লাগে না! রেগে গেল মুসা।
আরে, দূর, ঝগড়াঝাটি রাখো তো, হাত তুলল কিশোর। এক কাজ করো, তোমরা আজ আমাদের এখানেই খাও। সকালে দেখলাম, অনেকগুলো আনারস আনিয়েছে চাচী, মোরব্বা বানাবে, মুসার দিকে চেয়ে হাসল সে।
ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ল মুসার, রাগ পানি। রবিনের দিকে চেয়ে বলল, যাও, মাফ করে দিলাম।
চোদ্দ
আমিও ঢুকব, জেদ ধরল জিনা।
ঢুকবে! বিরাট গেটের দিকে চেয়ে আছে কিশোর, চিন্তিত। দেখা যাক!
করবীর ঝোপে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে চারটি ছেলেমেয়ে। নজর বাড়ির গেটের দিকে, মেহমানরা কখন আসে, সেই অপেক্ষায় আছে। পথের মোড়ে পাহাড়ের গা ঘেষে পিকআপ থামিয়ে তাতে বসে আছে বোরিস।
আমি ওটাতে চলে যাই, গেটের আরও কাছে আরেকটা করবীর ঝোঁপ দেখিয়ে বলল রবিন। কে কী বলে, শুনতে পাব।
মাথা কাত করল কিশোর।
ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে এক ছুটে গিয়ে অন্য ঝোঁপটায় ঢুকে পড়ল রবিন।
প্রথম গাড়িটা এল। জেরি গ্যানারিল নেমে রাস্তা পেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, খোপ থেকে রিসিভার নিয়ে কানে ঠেকাল। এই সময় এল নীলচে-লাল করভেট, ড্রাইভিং সিটে হিউগ ভ্যারাড। আবছা ধূসর আলোয় পেছনের সিটে বসা মিস মারভেলের মূর্তিটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের কাছে, বার বার চোখের কাছে হাত নিয়ে। যাচ্ছে, নিশ্চয় রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। ধরে ধরে তাকে নামাল ভ্যারাড। গুঞ্জন উঠল গেটের পাল্লায়, খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল তিনজনে।
মিনিট কয়েক পরে ফেকাসে-নীল একটা ক্যাডিলাক এসে থামল। হালকা-পাতলা একজন লোক নামল গাড়ি থেকে, বাদামী চুল। গেটের
কাছে গিয়ে রিসিভার বের করে কানে ঠেকাল।
একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে রবিন; যে ঝোপে রয়েছে, সেখান থেকেও কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। ঝুঁকি নিল। নিঃশব্দে বেরোল ঝোঁপ থেকে, পা টিপে টিপে এসে থামল লোকটার পেছনে।
লোয়ার সার্কেলে নেমে যাব আমি, বলেই রিসিভার রেখে দিল। লোকটা।
গুড ইভনিং, বলল রবিন।
ঝট করে মুখ ফেরাল লোকটা।
এটা কি আঠারোশো বত্রিশ টরেনটি সার্কেল?
না। এটা টরেনটি ক্যানিয়ন ড্রাইভ। রাস্তা ভুল করেছ।
গুঞ্জন তুলে খুলে গেল পাল্লা। লোকটা ভেতরে ঢুকে যেতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল।
প্রথম ঝোঁপটায় ফিরে এল রবিন। লোয়ার সার্কেলে নেমে যাব আমি।
হাঁ করে চেয়ে রইল অন্য তিনজন।
বুঝলে না? হাসল রবিন। এটা ওদের কোড। দারোয়ান বলে: অন্ধকার রাত। তার জবাবে বলতে হবে: লোয়ার সার্কেলে নেমে যাব আমি।
তা হলে আর দেরি কেন? জিনা বলল। চলো নেমে যাই।
গেটের কাছে এসে দাঁড়াল চারজনে। রিসিভার কানে ঠেকাল কিশোর। ভেসে এল একটা খসখসে গলা: অন্ধকার রাত! কণ্ঠস্বর যতখানি সম্ভব ভারি করে তার জবাব দিল কিশোর।
ক্লিক করে কেটে গেল কানেকশন। রিসিভার রেখে দিল কিশোর। মুহূর্ত পরেই গুঞ্জন তুলে খুলতে শুরু করল পাল্লা।
জিনাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল। পাল্লা। হ্যাঁণ্ডেল টেনেটুনে দেখল রবিন, নড়ল না দরজা।
ওভাবে টানাটানি করে লাভ নেই, খুলবে না, মুসা বলল। গেটের এক পাশে আইভি লতার ঝাড় দেখাল। ওর ভেতরে দেয়ালে একটা খোপ আছে, তাতে সুইচ-টুইচ কিছু একটা আছে। সেদিন রাতে দারোয়ান ব্যাটাকে খুলতে দেখছিলাম।
ভুরু কুঁচকে আইভি-ঝাড়ের দিকে তাকাল রবিন। তাই! তার মানে কোন ধরনের সারকিট ব্রেকার!
আহাহা, হাত দিয়ো না! বাধা দিল কিশোর। অ্যালার্ম কানেকশন থাকতে পারে, বেজে উঠবে! কোথায় আছে জানলাম তো, জরুরি দরকার পড়লে খুলে বেরিয়ে যেতে পারব।
চলো, ব্যাটারা কী করছে দেখি! তাড়া দিল জিনা।
না, এখুনি বাড়ির ভেতরে ঢুকব না, কিশোর বলল। মেহমানরা সবাই আসেনি। আসুক, তারপর।
বাড়ির এক কোণে একটা অন্ধকার জায়গায় লুকিয়ে রইল, ওরা। চোখ গেটের দিকে। খানিক পর পরই খুলতে লাগল গেট, মেহমানরা ঢুকল। পনেরো মিনিটে আরও আটজন লোক এল, লম্বা গাড়িপথ ধরে চলে গেল বাড়ির ভেতরে।
আটজন, প্লাস, জেরি গ্যানারিল, মিস মারভেল আর ভ্যারাড, বলল কিশোর, এগারোজন। বাড়ির ভেতরে আছে আরেকজন, নিশ্চয় বাড়ির মালিক, মোট বারোজন। সেরাতেও বারোজনই ছিল। তার মানে মোট। সদস্য এই-ই!
চুপ করে রইল অন্য তিনজন।
আরও মিনিট দশেক গেল, কেউ এল না। নিশ্চিত হলো কিশোর, বারোজনই। ওঠার সিদ্ধান্ত নিল সে।
হুশিয়ার! সতর্ক করল মুসা। সেই দারোয়ান ব্যাটার হাতে পড়া চলবে না!
নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে ঘাসে ঢাকা আঙিনা ধরে এগোল ওরা। লম্বা একটা জানালায় অতি ম্লান আলো দেখা যাচ্ছে, ভারি পর্দা ভেদ করে আলো বেরোতে পারছে না ভালমত। জানালার কাছ থেকে দূরে রইল, ওরা, ঘুরে চলে এল বাড়ির পেছন দিকে।
দরজা, ফিসফিস করে বলল কিশোর। সামান্য ঝুঁকে অন্ধকারে এগোল সাবধানে, যাতে কোন কিছুতে হোঁচট খেয়ে না পড়ে। দরজার নব ধরে মোচড় দিল, নড়ল না নব; তালা লাগানো।
কিশোরের কাঁধে হাত রাখল জিনা। ওই যে, কানের কাছে বলল, সে। একটা জানালা। খোলা আছে মনে হয়। এত ওপরে, ছিটকিনি লাগানোর কথা ভাববে না ওরা।
ভাঁড়ার বোধহয়, জানালাটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। খুব বেশি ছোট।
আমি ঢুকতে পারব, বলে উঠল জিনা।
না, তুমি পারবে না, রবিন মাথা নাড়ল। আরও সরু শরীর হতে হবে।
ঠিকই বলেছ, কিশোর বলল। তার মানে তোমাকেই যেতে হচ্ছে। আমিও ঢুকতে পারব না। পারবে?
খুব পারব।
সাবধান!
জানালার নিচে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল মুসা। তার কাঁধে উঠে দাঁড়াল রবিন।
খোলা? নিচ থেকে জিজ্ঞেস করল জিনা।
শশশ! আস্তে! কান পেতে শুনছে কিশোর, কাঠে কাঠ ঘষার শব্দ।
গুঙিয়ে উঠল রবিন, হাতে ভর দিয়ে টেনে তুলল শরীরটা, জানালা দিয়ে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেটে গেল দীর্ঘ এক মিনিট। ক্লিক করে মৃদু একটা শব্দ হলো, আস্তে করে খুলে গেল পেছনের দরজা, একটু আগে যেটা খোলার চেষ্টা করেছিল কিশোর।
এসো, চাপা গলায় ডাকল রবিন। ওরা সামনের কোন একটা ঘরে রয়েছে।
আরেকটা ঘরে এসে ঢুকল ওরা, রান্নাঘর। সামনের দিকে ম্লান। আলো দেখা যাচ্ছে। ঘরের অন্য পাশের দরজার কাছে এসে ওপাশে উঁকি দিল কিশোর, একটা হলঘর। বাঁয়ে চওড়া সিঁড়ি, ডানে সিঁড়ির ঠিক উল্টো দিকে একটা দরজা, ওপর দিক ধনুকের মত বাঁকানো। ওই দরজা দিয়েই আসছে আলো।
আবার আগের জায়গায় ফিরে এল কিশোর। জানালায় পর্দা নেই, বাইরে গাছের মাথায় ঘোলাটে জ্যোৎস্না, আবছা আলো এসে পড়েছে। ঘরে। একটা স্টোভের আদল চোখে পড়ছে। কাছেই কোথায় জানি একটা কলের চাবি ঠিকমত লাগানো হয়নি, পানি পড়ার টুপটাপ শব্দ। কানে আসছে। বায়ে দেয়ালের গায়ে মস্ত এক কালো ফোকর, না না, আরেকটা দরজা, পাল্লা খোলা।
রবিনের কাঁধে হাত রাখল কিশোর, মাথা কেঁকাল রবিন। জিনার হাত ধরে তাকে নিয়ে তৃতীয় দরজাটার আরেক পাশে চলে এল কিশোর, তাদেরকে অনুসরণ করল অন্য দুজন।
গাঢ় অন্ধকার। দৃষ্টি পুরোপুরি অচল। অনুমানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোল ওরা। নানারকম জিনিস হাতে ঠেকছে, পায়ে ঠেকছে। নরম একটা কিছু হাতে ঠেকল মুসার, চাপ দিয়ে বুঝল সোফা।
অবশেষে অন্ধকারে চিড় ধরল, আলোর সূক্ষ্ম একটা চুল দেখা গেল, দরজার ফাঁক দিয়ে আসছে। জিনার হাত ছেড়ে দিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর, মসৃণ পাল্লায় হাত বোলাল। হাতে নব ঠেকতেই মোচড় দিল আস্তে করে। নিঃশব্দে ঘুরে গেল নব। টেনে পাল্লাটা কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করল সে।
চোখে পড়ল খিলানে ঢাকা আলোকিত পথ, তার ওপারে বিরাট এক হলঘর।
বৈঠক শুরু করা যায়, কানে এল ভ্যারাডের পরিচিত খসখসে কণ্ঠ।
দরজা আরও কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করল কিশোর। অন্য তিনজনও এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। সবারই নজর হলঘরে। রূপার মোমদানীতে জ্বলছে লম্বা কালো কালো মোম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা গোল টেবিল, কালো কাপড়ে ঢাকা। টেবিল ঘিরে বারোটা চেয়ার, প্রতিটি চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়েছে একজন করে। ভ্যারাডের সামনের চেয়ারটাকে ছোটখাট একটা সিংহাসন বলা চলে, হাতল দুটো কাঠের তৈরি দুটো কালো গোখরো, ফণা উঁচিয়ে রেখেছে। তার পাশে জিনার। খালা। বিষণ্ণ, নিষ্প্রাণ চাহনি।
সদস্যরা সব নীরব, নিথর, অথচ ঘরের সর্বত্র যেন নড়াচড়ার আভাস! কিশোরের মনে হলো, মানুষগুলোকে ঘিরে নাচছে অন্ধকারের কালো চাদর, হাসছে বিকট হাসি, নীরবে। চারদিকে শুধু কালো আর কালো। দেয়াল ঢাকা কালো কাপড়ে, দরজা-জানালায় কালো পর্দা। এ যেন কালোর রাজত্ব!
নড়েচড়ে দাঁড়াল ভ্যারাড, এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভর বদল করছে। বৈঠক শুরু করা যায়, সেই একই কথা, একই কণ্ঠ।
খিলানে ঢাকা পথের এক পাশ থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে, তাতে পায়ের শব্দ হলো। লম্বা আলখেল্লা পরা একটা কালো মূর্তি নেমে এল, হালকা পায়ে গিয়ে দাঁড়াল টেবিলের ধারে। সাপ-সিংহাসনে বসল সে এদিকে ফিরে।
ইয়াল্লা! বিড়বিড় করল মুসা, ভীষণ চমকে গেছে।
চমকে দেয়ার মতই চেহারা আগন্তুকের। ভ্যারাডের চেহারা আর কী এমন ফেকাসে! এই লোকটাকে দেখে মনে হলো, গায়ে এক বিন্দু রক্ত নেই। কবর থেকে উঠে এসেছে যেন একটা লাশ। সারা গা কালো কাপড়ে ঢাকা, এমনকী মাথার চুলও কালো টুপি দিয়ে ঢেকে রেখেছে, সার্জনদের টুপির মত আঁটসাট টুপি। মোমের চেহারা যেন, তাতে টকটকে লাল দুটো চোখ।
মোম-সাদা হাত দিয়ে টুপিটা আধ ইঞ্চিমত পেছনে সরাল লোকটা, মাথা একটুখানি নুইয়ে সালাম জানাল।
একে একে যার যার চেয়ারে বসে পড়ল সদস্যরা।
দুবার হাততালি দিল আগন্তুক।
টেবিলের কাছ থেকে নিঃশব্দে যেন উড়ে চলে গেল ভ্যারাড, ফিরে এল হাতে ট্রে নিয়ে। তাতে একটা রূপার বড় কাপ, ট্রেসহ কাপটা বাড়িয়ে দিল সে সিংহাসনে বসা লোকটার দিকে।
বিলিয়াল আমাদের সহায় হোন! বলে কাপ তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াল লোকটা।
মোলক শুনছেন সব! জবাবে সুর করে জারিগান গেয়ে উঠল যেন বারোটা কণ্ঠ।
কাপটা মিস মারভেলের হাতে তুলে দিল কালো আলখেল্লা। বিলিয়াল সবার মঙ্গল করুন! গলা কাঁপছে মিস মারভেলের, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। কাপে চুমুক দিয়ে সেটা তুলে দিল পাশের লোকের হাতে।
হাতে হাতে ঘুরতে থাকল কাপ, বিলিয়ালের জয়ধ্বনিতে ভরে উঠল। ঘর। বার বার সুর করে জারিগান গেয়ে, মোলক যে সব শুনছেন সেটা ঘোষণা করল সদস্যরা। কাপটা আবার ফিরে এল কালো আলখেল্লার হাতে, সে রেখে দিল ভ্যারাডের ট্রেতে।
এ কয়লা রাখার চার পা-ওয়ালা ছোট একটা তাওয়া নিয়ে এল ভ্যারাড, টেবিলে রাখল কালো টুপির সামনে। তাওয়ায় জ্বলন্ত কয়লা। উঠে দাঁড়িয়ে কয়লার ওপরে হাত ছড়াল লোকটা, চেঁচিয়ে বলল, অ্যাসমোডিউস, অ্যাবাড়ন, ইবলিশ, দয়া করে আমাদের দিকে তাকান!
রূপার একটা ডিশ এনে দিল ভ্যারাড। ওটা থেকে কী যেন খানিকটা নিয়ে জ্বলন্ত কয়লায় ছিটাল কালো পোশাক পরা লোকটা, প্রায় লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল ঘন ধোয়া, বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল মিষ্টি একটা গন্ধ।
বিলিয়াল, শুনছেন! মিনতিভরা কণ্ঠ লোকটার, মহাসর্পের শক্তিকে পাঠান আমাদেরকে পাহারা দিতে! দেখা দিন দয়া করে! শোনান আপনার মিষ্টি গলা!
চুপ হয়ে গেল লোকটা। চুপ হয়ে গেল অন্যরাও। স্থির হয়ে অপেক্ষা করছে।
আস্তে আস্তে কানে এল শব্দটা, সেই বিচ্ছিরি গানের শুরু।
এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়াল জিনা, পালাবে, খপ করে তার হাত ধরে ফেলল কিশোর। ফেরাল।
বাড়ছে শব্দ। বাড়ছে, আরও বাড়ছে, মাংস চিরে ঢুকে যাচ্ছে যেন শব্দের ফলা, হাড় ভেদ করে মজ্জায় ঢুকতে চাইছে!
আবার রূপার ডিশ থেকে খানিকটা জিনিস তুলে নিয়ে কয়লায় ছিটাল লোকটা। ভক্ করে লাফিয়ে উঠল আবার ঘন ধোঁয়ার স্তম্ভ। স্তম্ভের মাথায় কী যেন নড়ছে!!
অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল রবিনের গলা থেকে, তার টুটি টিপে ধরেছে যেন কেউ।
বিলিয়াল দয়া করেছেন আমাদের! কালো টুপির গলায় আনন্দ। অমর মহাসর্প দেখা দিয়েছেন!
মানুষগুলো যেন সব পাথর হয়ে গেছে, দৃষ্টি ধোয়ার স্তম্ভের মাথায় স্থির। মস্ত এক গোখরো সাপ দেখা যাচ্ছে, নীলচে-সবুজ রঙ, ছড়ানো ফণা, টকটকে লাল চোখ জ্বলছে!
বেড়েই চলেছে শব্দ। কানের পর্দা ফুড়ে মগজে ঢুকে যাবে যেন। আর সইতে না পেরে কানে আঙুল দিল কিশোর। হঠাৎ করেই কমতে শুরু করল তীক্ষ্ণ আওয়াজ, পাতলা হয়ে এসেছে ধোঁয়ার স্তম্ভ, মিলিয়ে যাচ্ছে সাপটা। থেমে গেল গান। মহাসৰ্প-ও গায়েব।
এ ধপ করে সিংহাসনে বসে পড়ল কালো পোশাক পরা লোকটা। মঙ্গল হোক আমাদের। আসুন, হাত মেলাই।
হাত বাড়িয়ে দিল মিস মারভেল, বোধহয় লোকটার হাতেই রাখতে চাইল, কিন্তু ভুলে পড়ল টেবিলে। হাতটা তুলে নিল লোকটা।
মুসার গায়ে কনুইয়ের খোঁচা লাগাল কিশোর। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, পরক্ষণেই নেমে এল একটা মূর্তি, ছেলেদের দৃষ্টিপথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। পেশীবহুল লোকটাকে দেখেই চিনল মুসা, সেদিন দেয়াল থেকে সে পড়ে যাওয়ার পর ওই লোকটাই এসে ধরেছিল তাকে। গার্ড। চুপ করে দাঁড়িয়ে হলের দৃশ্য দেখল, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে পায়ে পায়ে এগোল টেবিলের দিকে। সিংহাসনে বসা লোকটার কানে কানে কী বলল।
অসম্ভব! বলে উঠল লোকটা। আরা সবাই হাজির এখানে?
তেরোজন হওয়ার কথা, গার্ড বলল। মিস গ্যানারিল, মিস মারভেল আর মিস্টার ভ্যারাড় একসঙ্গে ঢুকেছেন। এগারোবার গেট খুলেছি আমি, তার মানে অন্তত আরও একজন এখানে থাকার কথা।
উঠে দাঁড়াল কালো টুপি। তার মানে ফাঁকি দিয়ে ঢুকেছে কেউ! বৈঠক বাতিল! সময় করে আবার ডাকব আপনাদের, এখন যার যার বাড়ি যান।
আস্তে দরজা বন্ধ করে দিল কিশোর।
ব্যাটারা টের পেয়ে গেছে! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা।
হলরুমে চেয়ার টানাহেঁচড়ার শব্দ, কথা বলছে সবাই।
ব্যাটা সাংঘাতিক হুশিয়ার! কিশোর বলল। ঠিক সন্দেহ করে বসেছে!
চলো, পালাই! তাড়া দিল রবিন। খোঁজা শুরু করবে এখুনি?
তোমরা যাও, কিশোর বলল।
এটা মজা করার সময়?
মজা করছি না, গলা আরও খাদে নামাল কিশোর। যেদিক দিয়ে ঢুকেছ, ওদিক দিয়ে বেরোবে। বেরোনোর সময় ইচ্ছে করেই শব্দ করবে। তারপর দেয়ালে চড়ে বসে দেবে অ্যালার্ম বাজিয়ে। ওদের বোঝাবে, ফাঁকি দিয়ে যে ঢুকেছিল, সে পালিয়েছে। ট্রাক নিয়ে চলে যাবে। সানসেট অ্যাণ্ড টরেনটিতে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব। ঠিক আছে?
কিশোরকে সাবধানে থাকতে অনুরোধ করে অন্য দুজনের সঙ্গে চলে গেল রবিন।
রান্নাঘরের দরজা দড়াম করে বন্ধ হলো, বাইরে গার্ডরা হৈ-চৈ করে উঠল। জিনার চিৎকার শোনা গেল হঠাৎ, তারপরই বেজে উঠল ঘণ্টা।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। ধীরে ধীরে থেমে এল গোলমাল, হৈ-চৈ। বাইরে নীরবতা, ঘরও নীরব। আস্তে করে আবার দরজাটা খুলে হল-এ উঁকি দিল সে। নির্জন। এক ছুটে খিলানে ঢাকা পথ পেরিয়ে হল-এ ঢুকল এসে, দেয়াল-ঢাকা একটা কালো কাপড়ের তলায় লুকিয়ে
পড়ল। বাইরে পায়ের আওয়াজ, ঘরে ঢুকল, দরজা বন্ধ হলো জোরে।
কটা ছেলে, বলল একটা কণ্ঠ, কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
ওদের কৌতূহল মিটিয়ে দেয়া উচিত ছিল তোমার, রড, কালো আলখেল্লা পরা লোকটার গলা। যাতে কোন সন্দেহ না থাকে ওদের মনে। সব কটা বেরিয়ে গেছে তো?
হ্যাঁ।
কাপড়ের আড়ালে থেকে হাসি পেল কিশোরের। গেছে, তবে সবাই নয়, মিয়া, শয়তানের চেলা-মনে মনে বলল সে, একজন রয়ে গেছে। সে এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, কী নিয়ে কী কারণে শয়তানী শুরু করেছ তোমরা!
পনেরো
ছোট্ট একটা ফুটো দেখতে পেল কিশোর কালো কাপড়ে, ওটাতে আঙুল ঢুকিয়ে অতি সাবধানে ছিঁড়ে বড় করতে শুরু করল। ফুটোটা বড় হতেই তাতে চোখ রেখে দেখল, দরজার কাছে একটা সুইচে আঙুল রাখছে। গার্ড। রড়। ক্লিক করে একটা শব্দ হলো, মাথার ওপরে জ্বলে উঠল উজ্জ্বল আলো।
শঙ্কিত হলো কিশোর। মোমের আলোয় কাটেনি ঘরের অন্ধকার, যেখানে যেখানে আলো পড়েছিল, সেখানেও ছিল ছায়ার নাচন, ফলে তার লুকিয়ে থাকা চোখে পড়েনি কারও। কিন্তু এখন? উজ্জ্বল আলোয় চোখে। পড়ে যাবে না ওদের? গোল টেবিলে ধুলো দেখতে পাচ্ছে এখন সে পরিষ্কার দেয়াল ঢাকা দেয়ার কাপড় পুরানো, মলিন, একেবারেই বাজে, কমদামী জিনিস। রূপার মোমদানীগুলো আরও পুরানো, ঘষেমেজে চকচকে করা হয়েছে।
ঘর আর আসবাবপত্রের চেয়ে শোচনীয় লোক দুটোর অবস্থা। ধূসর চুলওয়ালা গার্ড ফুঁ দিয়ে দিয়ে নেভাচ্ছে মোমগুলো। মুখের চামড়ায় গভীর ভজ, চোখের কোণ থেকে শুরু করে ঠোঁটের কোণে এসে শেষ হয়েছে। মেদ জমেছে শরীরে, চলাফেরা ভারি, থুতনির নিচটা ঝুলে পড়েছে।
সিংহাসনে বসে আস্তে আস্তে সাপের মাথায় টোকা দিচ্ছে কালো আলখেল্লাধারী, চিন্তিত। চেয়ার পেছনে ঠেলে পা তুলে দিল টেবিলে। উজ্জ্বল আলোয় তার চেহারা আর তেমন রক্তশূন্য লাগছে না। আলগা রঙ, বুঝল কিশোর। সাদাটে-সবুজ কোন পাউডার মেখেছে মুখের ভাজ আর নাকের দুপাশে।
টেলিফোন সিসটেম একেবারে ফেল মারল!হঠাৎ বলল লোকটা।
শেষ মোমটা নিভিয়ে, গিয়ে একটা চেয়ারে বসল রড। দেখো, আমি গিয়ে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম, কে আসছে কে যাচ্ছে, ভাল মত খেয়াল রাখতে পারতাম। কিন্তু তাতেও কিছু হত না। বাচ্চাদেরকে ঠেকানো শয়তানের অসাধ্য, আর আমি তো মানুষ। কোন না কোনভাবে ঢুকে পড়তই ওরা। মনে হচ্ছে, তল্পি গোটানোর সময় এসে গেছে। চলো, কেটে পড়ি। স্যান ফ্রানসিসকো কিংবা স্যান ডিয়েগো কিংবা শিকাগোতে গিয়ে আবার নতুন খেল শুরু করা যাবে। অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আগেই চলো কাটি। এখানে তোমার ডক্টর। জিহাভোগিরি আর বেশিদিন চলবে না।
কিন্তু, রড, এখনও অনেক আসা বাকি, এক টানে মাথার কালো টুপিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলল ডক্টর জিহাভো। মাথায় আগুন-লাল চুল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে ঘষতে শুরু করল লোকটা। মুখের সবজে পাউডার ঝরে যেতেই বেরিয়ে পড়ল লাল চামড়া।
কষ্টে হাসি চাপল কিশোর।
এখানে না ফেললে চলত না? বিরক্ত মুখে বলল রড। ঝাড়বে কে ওগুলো?
ভাবছি, রুমালটা মুঠোয় দলা পাকাচ্ছে জিহাভো, আরও কিছু দিন দেখা দরকার। পুরো সেটআপটা ঠিক করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। গরুগুলোকে খুঁজে বের করতে কম কষ্ট করেছি? ওই নাপতিনীটা, গ্যানারিল, ওর কাছ থেকে বেশ কিছু পাওয়া গেছে, তাকে এখন বাদ দিলেও চলে। আর ওই কন্ট্রাকটার ব্যাটার কাছ থেকেও প্রচুর পাওয়া গেছে। মিস মারভেল এখনও কিছু দেয়নি, তবে দেবে শিগগিরই। এত ভাল ব্যবসা কয়েকটা বাচ্চার ভয়ে হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে পালাব?
ভাল ব্যবসাটা কতদিন ভাল থাকবে, ভাবছি!
ঠিকমত চালানো গেলে থাকবে আরও আনেক দিন, হাসল জিহাভো। শুধু জানতে হবে কীভাবে কী করা দরকার। ওই রলির কথাই ধরো। চমৎকার দেখিয়েছে। অচল করে দিল অ্যানি পলকে, কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারল না। মিস মারভেলের ভাবগতিক দেখেছ আজকে?
ভয় পেয়েছে।
মূৰ্ছা যেতে বাকি রেখেছে। দাবি পূরণ না করলে সেটাও যাওয়াব। তবে, রাসলারকে ভয় পাওয়ানো কঠিনই হবে। ওর ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হচ্ছে।
নাক দিয়ে ছোঁক ছোঁক শব্দ করল রড। ও-ব্যাটার কাজটা করে দিলেই তো হয়ে যায়। রাস্তার ওপারের রেস্তোরাঁর মালিককে কোনভাবে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দিলে সব কাস্টোমার আসবে রাসলারের ওখানে।
ভুল করছ। শুধু টাকাই চায় না রাসলার, ক্ষমতাও চায়। সেটা কী করে দেব তাকে?
আমি কী জানি! হাত ওল্টাল রড।
তোমাকে জানতে বলছিও না, বার বার হাতের আঙুলের মাথা এক করছে, আর সরিয়ে আনছে জিহাভো। কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। দরকার পড়লে… হাই তুলল। যাক গে, যখনকারটা তখন ভাবা যাবে। ঘুম পেয়েছে। উঠে দরজার দিকে রওনা দিল সে।
টুপি ফেলে যাচ্ছ, মনে করিয়ে দিল রড।
থাক গে, সকালে তুলে নেব, বেরিয়ে গেল জিহাভো। সিঁড়িতে মিলিয়ে গেল পায়ের শব্দ।
বিড়বিড় করে গাল দিল রড, কাকে বোঝা গেল না। চেয়ার ঠেলে উঠে দ্রজার দিকে রওনা দিল। সুইচ টিপে আলো নেভাল।
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনল কিশোর, বোধহয় জিহাভোকে অনুসরণ করেছে রড। দড়াম করে দরজা বন্ধ হলো! পানির পাইপ থেকে পানি পড়তে শুরু করল বাড়ির পেছনে কোথাও
কাপড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে অনুমানে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল কিশোর; যে পথে ঢুকেছিল, সে-পথ ধরে আবার ফিরে এল প্রথম হলঘরটায়। রান্নাঘরের দরজা খোলাই রয়েছে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেটের দিকে চলল সে। ফিরে তাকাল একবার, ওপরতলায় কয়েকটা জানালায় আলো। একটা পর্দায় মানুষের ছায়া পড়েছে। হাসল কিশোর। ডক্টর জিহাভো মুখ ওপর দিকে তুলে ধরেছে, কুলকুচা করছে বোধহয়। ইস, এই মুহূর্তে যদি ওর একটা ছবি তোলা যেত!
গেটের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। চাঁদের আলো বিচিত্র আলো আঁধারি সৃষ্টি করেছে আইভি লতার ঝাড়ে, এরই কোন একটা ফাঁকে রয়েছে খোপ, তাতে সুইচ। অনুমানে একটা ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে দিল সে, পয়লা বারেই হাত লাগাল সুইচে। সুইচ মানে প্রাস্টিকের একটা লিভার। চাপ দিতে গিয়েও থেমে গেল। ঘণ্টা বেজে উঠবে না তো? কিন্তু উঠলেও কিছু করার নেই। কাঁপা হাতে চাপ দিল। ঘণ্টা বাজল না, আলো জ্বলল না। গুঞ্জন তুলে খুলতে শুরু করল পাল্লা। ঠিক এই সময় দপ করে জ্বলে উঠল ফ্লাডলাইট।
এই! এই, ছেলে! দাঁড়াও! চিৎকার শোনা গেল দোতলা থেকে।
ফিরেও তাকাল না, কিশোর, গলা শুনেই বুঝতে পেরেছে, রড। গেটের দিকে লাফ দিল সে।
দাঁড়াও! আবার ধমকে উঠল রড।
দাঁড়াল না কিশোর, এক লাফে গেট পেরিয়ে এল। গায়ের ওপর এসে পড়ল ভারি একটা শরীর, তাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়। ভ্রামম। করে বিকট শব্দ হলো, মাথার ওপর দিয়ে শা করে উড়ে গেল কিছু।
ওঠার চেষ্টা করল কিশোর।
কানের কাছে ধমক দিল কেউ, চুপ! নোড়ো না!
আবার গর্জে উঠল শটগান, শাঁ শাঁ করে উঠে গেল ছররা, প্রায় কান ঘেঁষে।
কিশোরকে চেপে ধরে রেখেছে লোকটা। দ্বিতীয় গুলি হওয়ার পরই ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, দৌড় দাও!
লাফিয়ে উঠে মাথা নিচু করে করবীর ঝোঁপের দিকে ছুটল লোকটা। কিশোরও দৌড় দিল তার পেছনে। ঝোঁপ পেরিয়ে ঘুরে এসে রাস্তায় পড়ল দুজনে।
থেমো না! কিশোরকে হুশিয়ার করেই মোড় নিয়ে আরেক দিকে ছুটল লোকটা।
থামল না কিশোয়। পা কাঁপছে, বুকের ভিতর যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
সানসেট অ্যাণ্ড টরেনটি রোডের মোড়ে অপেক্ষা করছে পিকআপ। কিশোরকে দেখেই জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল বোরিস। হোকে (ওকে)?
কোন মতে মাথা ঝোকাল কিশোর। পিকআপের পিছনে তাকে টেনে তুলল মুসা আর রবিন। গাড়ি ছেড়ে দিল বোরিস।
কী হয়েছে? জিনা জিজ্ঞেস করল।
চুপ করে বসে জিরিয়ে নিল কিশোর। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল গোঁফওয়ালা।
ফোর্ড?
হ্যাঁ। ওকে ধন্যবাদ জানানোরও সময় পাইনি।
কেন?
ফোর্ড না থাকলে ঝাঁজরা হয়ে পড়ে থাকতাম এখন। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি রড। ব্যাটার একটা ডবল ব্যারেল শটগান আছে, গুলি করে বসেছিল।
ষোলো
ডাইনীবিদ্যা, ঘোষণা করল রবিন।
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা মোটা বই নিয়ে এসেছে রবিন। তার একটা: উইচক্র্যাফট, ফোক মেডিসিন অ্যাণ্ড ম্যাজিক। বইটাতে টোকা দিল সে। হয়তো এটা থেকেই তথ্য জোগাড় করেছে ওরা, অন্য কোন বইও হতে পারে অবশ্য। সেটা কথা না; কথা হলো, ওরা ডাইনীবিদ্যা নিয়ে চর্চা করছে। একেক দেশে এর একেক নাম। ইংরেজরা বলে ব্ল্যাক ম্যাজিক, ওয়েস্ট ইণ্ডিজের লোকেরা বলে ভুডু, ইণ্ডিয়ানরা বলে প্রেতসাধনা কিংবা কালিসাধনা। যে যা-ই বলুক, সোজা কথা, শয়তানের পুজো করে ওরা, কালো পথে ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। আমাদের টরেনটি ক্যানিয়নের জনাবরাও এই কাজই করছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারছে বলে মনে হয় না।
বলির পাঁঠারা বিশ্বাস করছে না বলে? কিশোর বলল।
হ্যাঁ, বিশ্বাস করছে না বলে, সায় দিল রবিন।
তোমাদের কথা কিছু বুঝছি না আমি, অনুযোগ করল মুসা। দয়া করে খুলে বলবে?
খুব সহজ, উইচক্র্যাফটের ওপর লেখা বইটা তুলে দেখাল রবিন। এতে সব লেখা আছে। রুকসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নরবিজ্ঞানের প্রফেসর ডক্টর জন এ, স্মিথের লেখা। ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে গবেষণা করার জন্যে অনেক দেশে ঘুরেছেন তিনি; আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মেকসিকো, অস্ট্রেলিয়া, কোথাও বাদ রাখেননি। ওঝাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন। তিনি দেখেছেন, যারা ভুডুর চর্চা করে, তারা কাউকে মারতে চাইলে ওই লোকের নাম করে একটা পুতুলের গায়ে পিন বিধিয়ে দেয়। তারা বলে, পুতুলের যেখানে পিন বেঁধানো হলো, মানুষটাও ঠিক ওখানেই ব্যথা পাবে। পুতুলের বুকে পিন বেঁধাল, মানুষটারও বুকে বিধবে, ফলে মারা যাবে সে। মেকসিকোতে প্রেতপূজারিরা গিয়ে ঢোকে কোন অন্ধকার গুহায়, মোম জ্বেলে মন্ত্র পড়ে। তারপর একটা বিশেষ সুতো কেটে দুটুকরো করে ফেলে। তার মানে, কোন একজন মানুষের আয়ু কমিয়ে দিল। লোকটা যখন জানতে পারে, তার নাম করে সুতো কেটেছে ওঝা, সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তারপর মরে যায়।
বুঝলাম না, মুসা বলল।
মানে, মানুষটা ওঝার কথায় বিশ্বাস করে, বুঝিয়ে দিল কিশোর, ভয় পেয়ে যায়। ফলে অসুস্থ হয়ে মারা পড়ে সে।
শুধু বিশ্বাসে এত মারাত্মক কাণ্ড ঘটে? ফেকাসে হয়ে গেছে মুসার চেহারা।
আন্তরিকভাবে যদি কোন কথা বিশ্বাস করো, সেটা ঘটতে বাধ্য, আবার বইটাতে টোকা দিল রবিন। প্রফেসর ব্যারিস্টার তাই বলেছেন। তিনি দেখেছেন, ওঝা ঘোষণা করার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে মানুষটা, মারা গেছে কয়েক দিন পর। প্রফেসরের ধারণা: মন্ত্র-ফন্ত্র সব বাজে কথা! তীব্র আতঙ্কই কাহিল করে করে মেরে ফেলেছে লোকটাকে।
হুমম! বুঝলাম! মাথা দোলাল মুসা। ভ্যারাড আর জিহাভোও একই কাণ্ড করছে! ব্যাটারা পুতুল কিংবা সুতো বাদ দিয়ে সাপ ব্যবহার করছে। যার ক্ষতি করতে চায়, তার কাছে জাদুর সাপ পাঠাচ্ছে!
হ্যাঁ, কিশোর বলল। কিন্তু জাদুর জ-ও জানে না ব্যাটারা। তা ছাড়া যাদের কাছে পাঠাচ্ছে, তারাও বিশ্বাস করছে না, ভয়ও পাচ্ছে না। মিস অ্যানি পল বিশ্বাস করেনি। তার কাছে ওটা স্রেফ একটা সস্তা অদ্ভুত ব্রেসলেট। জিনার খালাই শুধু বিশ্বাস করে কেঁদেকেটে মরছে, তার ধারণা, সাপই বুঝি অ্যাকসিডেন্টটা ঘটাল। ফলে নিজেকে দোষ দিচ্ছে। খুব স্বাভাবিক। তার মত মহিলা এই-ই তো করবে।
কিন্তু আমরা জানি, সাপের জন্যে হয়নি অ্যাকসিডেন্ট। জিহাভো কাউকে দিয়ে চাকার নাট ঢিল করিয়ে রেখেছে, ফলে খুলে এসেছে। চাকাটা। অ্যাকসিডেন্ট করেছে মিস পুল।
এখন রাসলারের সুবিধের জন্যে অন্য কারও ক্ষতি করার প্ল্যান করছে জিহাভো! রবিনের কণ্ঠে অস্বস্তি।
কপাল ডলল কিশোর। ওই রকমই কিছু করবে মনে হলো ওদের কথা শুনে।
পাগলামি! স্রেফ পাগলামি! বলে উঠল মুসা।
আমাদের কাছে, কিশোর বলল। কিন্তু মিস মারভেল? সে তো বিশ্বাস করে বসে আছে, মহাসর্প তাকে র্যামন ক্যাসটিলোর ক্রিস্টাল বল পাইয়ে দেবে। মিস গ্যানারিলের বাড়িওলীর সঙ্গে গোলমাল চলছিল, সেটাও নাকি মিটমাট করে দিয়েছে মহাসৰ্প।
রাসলার চাইছে ক্ষমতা। যে যা চাইছে, টাকার বিনিময়ে তাকে তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে জিহাভো। কিছু কেরামতি দেখিয়েছে সে।
কিন্তু ফোর্ডের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না! সে কী চায়!
ওরও হয়তো টাকা চাই, রবিন অনুমান করল। তবে ব্ল্যাকমেইলার হোক, আর যা-ই হোক ওর কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকতেই হবে। তোমাকে বাঁচিয়েছে।
তা রয়েছি। কিন্তু লোকটা কি সত্যি সত্যিই টাকা চায়?
বড় একটা রহস্য! গলা চুলকাল রবিন। তবে তথাকথিত শয়তান। উপাসকদের উদ্দেশ্য জানা গেছে। ওরা একদল ঠকবাজ, বোকাদেরকে ঠকিয়ে দুপয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। তো, এখন কী করব আমরা?
পুলিশকে জানাব, পরামর্শ দিল মুসা।
বিশ্বাস করবে পুলিশ? কিশোর বলল।
কেন করবে না? মিস পলের অ্যাকসিডেন্ট তো মিথ্যে নয়।
অ্যাকসিডেন্ট? গাড়ির চাকা খুলে গেছে, অমন তো খুলতেই পারে। টরেনটি ক্যানিয়নে পুলিশকে নিয়ে যেতে পারি হয়তো। কিন্তু গিয়ে কী পাবে? দুজন মানুষ, আর কিছু কালো, মোমবাতি! না, এখনও পুলিশকে বলার সময় আসেনি। প্রমাণ দরকার।
ভ্যারাড প্রমাণ নয়? রবিন বলল। মিস মারভেলকে কিছু একটার জন্যে চাপাচাপি করছে না সে?
ভ্যারাড কি স্বীকার করবে সে-কথা? না মিস মারভেল তার বিপক্ষে বলবে? ঠোঁটে তালা এঁটে থাকবে সে।
কিন্তু ব্যাটারা কী চাইছে তার কাছে? মুসার প্রশ্ন।
টাকা নয়, অন্য কিছু। বোধহয় নেকলেসটার ওপর চোখ পড়েছে ব্যাটাদের।
কিন্তু ওটা পাচ্ছে না ওরা। ফন হেনরিখের ভল্টে… কথা শেষ
করতে পারল না রবিন, বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল।
কিশোর! কিশোর পাশা! ট্রেলারের ছাতের ভেন্টিলেটার দিয়ে ভেসে এল তীক্ষ্ণ কণ্ঠ।
জিনা! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর।
এক টানে দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা তুলে ফেলল মুসা। নিশ্চয় কোন বিপদ!
পাইপের ভেতর দিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারল, ওয়ার্কশপে বেরিয়ে এল ছেলেরা। ছুটল।
ছোট অফিসটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জিনা। কাঁদো কাঁদো ভাব। এক গালে লাল একটা দাগ। বলল, ডক্টর জিহাভো! আমাদের বাড়িতে!
শিস দিয়ে উঠল মুসা। ও-ই মেরেছে?
কী! মুসার দিকে ফিরল জিনা।
গালে লাল দাগ। চড় মেরেছে বুঝি?
পেছনে চুল সরাল জিনা। না, খালা।
দূর, কী বলছ! তোমার খালা মেরেছেন?
মারতে চায়নি! খুব ভয় পেয়ে গেছে, তাই। জানালা দিয়ে দেখল, কালো একটা গাড়ি ঢুকছে। গাড়ি-বারান্দায় থামল গাড়িটা, কালো আলখেল্লা আর টুপি পরা জিহাভো নামল। গার্ড ছুঁচোটা শোফার সেজেছে। আমাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলল খালা। মানা করে দিলাম। রেগে গিয়ে চড় মারল আমাকে খালা, ঠেলে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দরজা লাগিয়ে দিল। এই সময় সামনের দরজায় বেল বাজল, বিষণ্ণ হাসি হাসল জিনা।
এখন তো পুলিশের কাছে যাওয়া যায়? কিশোরের দিকে ফিরল মুসা।
না, যায় না, জবাবটা দিল জিনা। সময় নেই। বুঝতে পারছ না, তিনটে শয়তানের সঙ্গে বাড়িতে একা খালা। ওরা যা খুশি করতে পারে।
চলো, তোমাদের বাড়িতেই যাই! ব্যস্ত হয়ে বলল কিশোর। জলদি!
চারজন দৌড় দিল একই সঙ্গে। কিন্তু তবুও দেরি হয়ে গেল। দেখল, গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে কালো গাড়িটা। গাড়ি চালাচ্ছে রড, তার পাশে ভ্যারাড। জিহাভো পিছনের সিটে।
সদর দরজার তালা খোলা। এত জোরে ধাক্কা মারল জিনা, ভ্রামম করে দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেল পাল্লা। খালা! খালাআ! চেঁচিয়ে ডাকল সে।
সোনালি-সবুজ বসার ঘরে গুম হয়ে বসে আছে মিস, মারভেল। দেখেই বলে উঠল, জিনা, জিনা, কিছু মনে করিস না, মা! আমার মাথার ঠিক ছিল না!
ছুটে গেল জিনা। তোমার কিছু হয়নি তো, খালা!
না, আমি ঠিক আছি, থিরথির করে গলা কাঁপছে মিস মারভেলের। চিবুকে চোখের পানি শুকিয়ে দাগ লেগে আছে। মিস্টার ভ্যারাড, আর. আর…
ডক্টর জিহাভো? বলল কিশোর।
অন্ধের মত দুহাত বাড়িয়ে এগোল মিস মারভেল, একটা চেয়ার হাতে ঠেকতেই তাতে বসে পড়ল।
নেকলেসটা চায় ওরা? আবার প্রশ্ন করল কিশোর। নকলটা দিয়ে দিয়েছেন তো?
স্থির দৃষ্টিতে এক মুহূর্ত কিশোরের দিকে চেয়ে রইল মিস মারভেল, একে একে নজর দিল অন্য তিনজনের দিকে। তোমরা জানো?
জানি, কিশোর জবাব দিল। আপনাকে শাসিয়েছে ওরা, খালা?
আবার কেঁদে ফেলল মিস মারভেল। আরিব্বাপ রে! কী সাংঘাতিক! সাংঘাতিক! বলল, বিনিময়ে কিছু দিতেই হবে! গাউনের পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছল। নাকের পানি মুছল। কিন্তু ফাঁকি দিতে পেরেছি ওদের। বুদ্ধিটা ঠিকই হয়েছে, না? নকলটা নিয়ে চলে গেছে ওরা, আসলটা নিরাপদ।
ফন হেনরিখের কাছে? জানতে চাইল কিশোর।
না, তা হবে কেন? ও দুটোই দিয়ে গেছে। আসলটা এনেছিল সাধারণ কাগজে পোটলা করে। চট করে গাউনের পকেটে রেখে দিয়েছিলাম ওটা, তারপর সুযোগ বুঝে লুকিয়ে ফেলেছি।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল জিনা। তার মানে এই বাড়িতেই!
নিশ্চয়! আর কোথায় রাখব? তবে নিরাপদেই আছে। আমি বের করে না দিলে কেউ খুঁজে পাবে না। আর কাউকে বলিওনি।
খালার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল জিনা। খুব ভাল করেছ, খালা। আমাদেরকেও বলার দরকার নেই। পুলিশকে জানব? খুব নরম গলায় বলল সে।
এখন প্রমাণ রয়েছে আমাদের হাতে, কিশোর বলল। পুলিশকে বলতে পারবেন, নেকলেসের জন্যে ওরা আপনাকে চাপ দিয়েছে, না দিলে ক্ষতি করবে বলে হুমকি দিয়েছে।
না!
খালা, ওরা ভয়ানক লোক। লস অ্যাঞ্জেলেসেই ওদের শয়তানী শেষ নয়, অন্য জায়গায় গিয়েও করবে। তার আগেই পুলিশকে বলা দরকার। নইলে আরও অনেকের সর্বনাশ করবে।
কিন্তু কী করে বলি! আমার দোষে এক বেচারী পা ভেঙে শুয়ে আছে! না না, আমি বলতে পারব না! তোমরা জানো না, বললে কী হবে!
বেশ, অন্যভাবে ভেবে দেখুন, কিশোর বলল। নেকলেসটা নকল। বুঝতে কতদিন লাগবে জিহাভোর? তারপর কী ঘটবে? কী করবে সে আপনাকে?
চুপ করে রইল মিস মারভেল।
ভাবুন, খালা। নকল নেকলেস গছিয়ে ফাঁকি দিয়েছেন, বুঝতে বেশি সময় লাগবে না ওদের! তখন কী করবে?
সতেরো.
ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন মিস মারভেল। তাকে এখন আর কোন কথা বলে লাভ হবে না, বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
মাথামোটা মেয়েমানুষ! রাগে জ্বলছে মুসা।
আহ, ভদ্রভাবে কথা বলো, মুসা, বিরক্তি ঝরল, রবিনের গলায়। কেউ নিজের ভাল না বুঝলে, তাকে বোঝাতে যাবে কে?
এক কাজ করতে পারি আমরা, কিশোর বলল। জিহাভোর প্ল্যান আমরা জানি, ও রাসলারের শত্রুকে ধ্বংস করতে যাচ্ছে। খাবারের দোকানটা খুঁজে বের করে ওটার মালিককে সাবধান করে দিতে পারি।
বিশ্বাস করবে? রবিন প্রশ্ন রাখল।
হয়তো করবে না। কিন্তু একটা কার্ড দিয়ে বলতে পারি, দরকার মনে করলে যেন আমাদের ফোন করে। সাপটা এলেই কৌতূহল জাগবে তার। আমার ধারণা, তখন আমাদের ডাকবে সে।
ইয়ার্ডে পৌঁছে সোজা অফিসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। টেলিফোন ডিরেকটরি ঘেঁটে রাসলারের দোকানের নাম-ঠিকানা বের করল কিশোর। বলল, রাসলারস ফুড। বেভারলি অ্যাও থার্ড স্ট্রিট।
যাব কী করে? ভুরু নাচাল রবিন। বোরিসকে বলবে?
নাহ, বার বার ওকে বলা বোধহয় উচিত হবে না। তার চেয়ে। বাসেই যাওয়া ভাল। রাসলারের শত্রুর দোকানটা সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ওই রাস্তায় শুধু দুটো খাবারের দোকান। কিন্তু তিনজনেরই যাওয়ার দরকার আছে কি? যদি জিনাদের বাড়িতে জিহাভো আসে আবার? আমি বরং এখানেই থাকি, কী বলো?
ইচ্ছে করলে তুমিও থাকতে পারো, মুসা তাকাল রবিনের দিকে। কাজটা এমন কিছু না, আমি একাই গিয়ে সেরে আসতে পারব।
সান্তা মনিকার বাস ধরল মুসা। সেখান থেকে গাড়ি বদল করে লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসে চাপল। দুপুর নাগাদ এসে ঢুকল বেভারলি অ্যাণ্ড থার্ড স্ট্রিটে।
ঢুকেই রাসলারের দোকানটা চোখে পড়ল মুসার। বাস স্টপেজের উল্টো দিকে। দোকানের সঙ্গে দোকানের মালিকের হুবহু মিল রয়েছে। রাসলারের শার্টের মতই অপরিষ্কার তার দোকানের জানালা। গাড়ি রাখার জায়গাটায় ছেঁড়া খবরের কাগজের স্তূপ, মুসার সামনেই এক লোক একটা লেমোনেডের খালি বোতল সেখানে ছুঁড়ে ফেলল। ভাঙা কাঁচের টুকরো, খাবারের খালি টিন, এটা-ওটা নানারকম আবর্জনায় বোঝাই, যেন ডাস্টবিনের বদলে ব্যবহার হচ্ছে জায়গাটা।
পাশে তাকাল মুসা। একটা টেলিভিশন মেরামতের দোকান, তারপরে আরেকটা খাবারের দোকান। রঙ করা পরিষ্কার দেয়ালে পিতলের তৈরি ঝকঝকে হরফে বসানো: ডলফ টারনারস ফুড। কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভেতরে বিশালদেহী এক লোক, কালো চুল, বাক্সে খাবার ভরছে। তার কাছেই এক মহিলা, ইয়া বড় ভুড়ি, লিস্ট মিলিয়ে নিচ্ছে। সাদা ফরমাইকার কাউন্টারে একটা দাগ নেই; কাছে গেলে হয়তো দেখা যাবে, ধুলোও নেই এক কণা। আশপাশে আর কোন খাবারের দোকান চোখে পড়ল না।
রাসলারের শত্রুকে পাওয়া গেছে, বুঝল মুসা। মোটা মহিলা বেরিয়ে যাওয়ার পর সে গিয়ে ঢুকল। মিস্টার টারনার?
হ্যাঁ? তাকাল কাউন্টারের ওপাশের বিশালদেহী লোকটা।
আপনি মিস্টার টারনার? মানে, এই দোকানটা আপনার?
মুসার দিকে চেয়ে রইল লোকটা এক মুহূর্ত। মুসাও তাকে দেখল ভাল করে। মস্ত শরীর, কিন্তু এক বিন্দু বাড়তি মেদ নেই। বাইরে থেকে যা মনে হচ্ছিল, চুল একেবারে কালো নয়, ধূসর একটা ছোঁয়া রয়েছে: বাদামী চোখের তারা স্থির, উজ্জ্বল, পরিষ্কার। দেখেই বোঝা যায়, শরীরের যত্ন নেয় টারনার। কাজ চাইছ, খোকা? অবশেষে বলল সে। গত সপ্তায় একটু ছেলে নিয়ে ফেলেছি, তবু যদি চাও…
না না, চাকরির জন্যে আসিনি, হাত তুলল মুসা। আমি শিওর হতে চাইছি, এটা আপনারই দোকান কিনা।
হুঁ! টমাটোর আচার খারাপ পড়েছে? অসম্ভব…
…আমি ওসব কিছুই বলতে আসিনি! আপনিই মিস্টার টারনার তো?
হ্যাঁ, আমিই ডলফ টারনার, এ-দোকানের মালিক। কী চাও?
আপনাকে সাবধান করতে এসেছি, মিস্টার টারনার। কথাটা অবিশ্বাস্য শোনাবে হয়তো, কিন্তু অবিশ্বাস্য কাণ্ডই ঘটতে যাচ্ছে। ঠিক কী ঘটবে, এখনও জানি না; তবে খারাপ কিছু, সন্দেহ নেই। তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে কাউন্টারে রাখল মুসা, হেডকোয়ার্টারের টেলিফোন নম্বর লিখল। কী ভেবে তার তলায় ইয়ার্ডের নম্বরটাও লিখল। যদি সাপ দেখেন…
…তো চিড়িয়াখানায় ফোন করব, কথা শেষ করে দিল টারনার।
আরে, না না, ওই সাপের কথা বলছি না, জ্যান্ত সাপ নয়। হয়তো পাথরের, রবারের, কিংবা ধাতুর। হয়তো সাপের চেহারার টাই-পিনও পাঠাতে পারে। তবে সাপটা হবে, গোখরো। যা-ই আসুক না কেন, সাপের চেহারা হলেই ফোন করবেন, সঙ্গে সঙ্গে, এই ওপরেরটায় প্রথমে করবেন, কেউ না ধরলে নিচেরটায়।
কার্ডটা চুল, না টারনার। থমথমে হয়ে গেছে চেহারা।
দোকানের মালিকের চেহারা দেখে অস্বস্তি বোধ করছে মুসা, তাড়াতাড়ি বলল, আশা করি, আপনাকে সাহায্য করতে পারব। খুব। সাংঘাতিক ব্যাপার! কেউ একজন আপনার ক্ষতি করতে চায়। সাপ দেখলেই বুঝবেন, খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমাদেরকে ডাকবেন…
ভাগো! হাত নাড়ল টারনার।
বুঝতে পারছেন না, মিস্টার টারনার…
ভাগো বলছি! বাদামী চোখ দুটো কঠিন।
সাপটা দেখলে হয়তো মত বদলাবেন… টারনারকে কাউন্টার ঘুরে আসতে দেখে থেমে গেল মুসা, পিছিয়ে গেল এক পা এক পা করে। যে-কোন সময় ফোন করবেন, কোন…
এখনও দাঁড়িয়ে… টারনারের কথা শেষ হওয়ার আগেই এক টানে। দরজা খুলে বেরিয়ে এল মুসা, রাস্তা পেরিয়ে একেবারে বাস স্টপেজে। বাস দাঁড়িয়েই আছে।
ভাবছে মুসা, সুবিধে করতে পারেনি সে। কিশোর হলে হয়তো অন্য রকম ঘটত। মানুষকে বোঝানোর ব্যাপারে ওস্তাদ কিশোর; অভিনয় করে, এভাবে-সেভাবে কথা বলে কী করে জানি আজগুবি কথাও বিশ্বাস করিয়ে ফেলে মানুষকে! টারনারের ব্যাপারে মুসা যা পারেনি, কিশোর হয়তো পারত।
বিকেলের দিকে ইয়ার্ডে ফিরে এল মুসা। রবিন আর কিশোর আছে। কোথা থেকে জানি পুরানো একটা সূর্যঘড়ি কিনে এনেছেন রাশেদ চাচা, ময়লা আর মাটিতে একাকার, হোস পাইপ দিয়ে পানি ছুঁড়ে সেটা ধুচ্ছে কিশোর।
কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। রাসলারের শত্রুর নাম ডলফ টারনার। কঠিন ঠাই!
হুঁশিয়ার করেছ? জানতে চাইল রবিন।
করতে চেয়েছি। কাউন্টারে কার্ডও ফেলে এসোছ, দরকার মনে করলে আমাদের ফোন করবে। দোকান থেকে বের করে দিল সে আমাকে, আরেকটু দাঁড়িয়ে থাকলে মেরেই বসত।
বিশ্বাস করেনি, হোসের চাবি বন্ধ করে দিল কিশোর। জানতাম। কিন্তু সাপটা পেলেই অন্য রকম ভাববে। মানে, ভাবতে পারে।
ওর ফোনের অপেক্ষা না করাই ভাল, রবিন বলল। চলো, পুলিশের কাছেই যাই। কেউ তার নিজের ভাল না বুঝতে চাইলে, আমরা কী করতে পারি?
গেটে গাড়ির শব্দ হলো। তিনজনেই ফিরে তাকাল সেদিকে। পুলিশের গাড়ি ঢুকছে, একটা পেট্রোল কার। ড্রাইভিং সিটে লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশের প্রধান, ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার।
আমাদেরকে আর পর্বতের কাছে যেতে হলো না, কিশোর বলল। পর্বতই চলে এসেছে!
গাড়ি থেকে নামলেন ক্যাপ্টেন। এই যে, ছেলেরা, এবার কী নিয়ে মেতেছ?
আমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আছে, স্যর? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
জুভেনাইল ডিভিশন ফোন করল। তোমাদেরকে চিনি কিনা, জিজ্ঞেস করল। বলে দিয়েছি, চিনি, মুসার দিকে আঙুল তুললেন ফ্লেচার। টারনারের খাবারের দোকানে গিয়েছিলে।
ঢোক গিলল গোয়েন্দা সহকারী।
কার্ড আর ফোন নম্বর রেখে এসেছ, আবার বললেন ক্যাপ্টেন। ওরা ভাবছে, তুমি টারনারকে হুমকি দিতে গিয়েছিলে।
হুমকি! চমকে গেছে মুসা। হুমকি, কে বলল! হুশিয়ার করতে গিয়েছিলাম।
টারনারের সেটা মনে হয়নি। ও ধরে নিয়েছে, হুমকি। খুলে বলবে?
ও আনন্দের সঙ্গে, গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর, ভারি শব্দ ব্যবহার শুরু হলো তার।
ফাইন, বললেন ফ্লেচার। বলো।
জিনা আর মিস মারভেলের কথা বাদ দিয়ে, এ-যাবৎ আর যা যা ঘটেছে, সব খুলে বলল কিশোর। শেষে বলল, আমাদের অনুমান, মিস্টার টারনার বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। গান-গাওয়া সাপের, ক্ষমতা…
ব্যস ব্যস, হাত তুললেন ফ্লেচার, হয়েছে। ওসব কথা বাদ। এটা লস অ্যাঞ্জেলেস, খুঁজলে অনেক পাগল পাবে। প্রায়ই অঘটন ঘটিয়ে বসে ওরা। এক এক করে যদি ধরতে শুরু করি, জেলে জায়গা দিতে পারব না। যাক গে, গিয়ে এখন তোমাদের জন্যে সাফাই গাইতে হবে আরকী। জুভেনাইল পুলিশের কাছে। আমার একটা কথা শুনবে? ওভাবে আর কক্ষনো লোকের বাড়িতে চুরি করে ঢুকো না। নইলে সত্যি সত্যি একদিন গুলি খাধে।
চলে গেলেন ক্যাপ্টেন।
মুসা বলল, মিস মারভেল আর নেকলেসটার কথা বললে না কেন?
কী করে বলি? হাত নাড়ল কিশোর। হাজার হোক, জিনা আমাদের মক্কেল, তার খালার বদনাম ঢেকে রাখতে হবে আমাদের।
অফিসে ফোন বাজল। কেউ নেই, কিশোরই এসে রিসিভার তুলল। কয়েক সেকেণ্ড পরই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এল। জিনা! তার খালাকে সাপ পাঠানো হয়েছে! এইমাত্র!
আঠারো
দরজায় দাঁড়িয়ে তিন গোয়েন্দার অপেক্ষা করছে জিনা, উত্তেজিত, হাতে একটা গোখরো। চমৎকার একটা শিল্পকর্ম, ধাতুর তৈরি, একেবারে জ্যান্ত মনে হয়। কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে, তবে ভেতর থেকে উঁচু করে রেখেছে ফণা, ছোবল মারতে প্রস্তুত। জিনা মূর্তিটা উঁচু করতেই চকমক করে উঠল সাপের দুটো লাল পাথরের চোখ।
কে নিয়ে এসেছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
ছেলেদের আগে আগে বসার ঘরে এসে ঢুকল জিনা। মূর্তিটা কফির টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, জানি না। বেল বাজতেই গিয়ে দরজা খুললাম। দেখি, একটা বাক্স পড়ে আছে।
হবে না কিছু, মুসা বলল।
আমারও মনে হয়, হবে না। তবে খালাকে নিয়ে ভাবনা। পিছন থেকে এসে আমার আগেই বাক্সটা তুলল খালা, ডালা খুলেই কাঁপতে শুরু করল।
তারপর? রবিন জানতে চাইল।
সাপটা দেখল। ওটার গলায় ঝোলানো কার্ড পড়ল, টেবিল থেকে তুলে বাড়িয়ে ধরল জিনা। এই যে, এটা।
সাদা কার্ডটা দেখাল কিশোর। জোরে জোরে পড়ল: বিলিয়াল তার পাওনা চায়। হীরার চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বেশি আকর্ষণীয় তার কাছে।
দেখেছ, জিনা বলল, বড় বড় হরফে পরিষ্কার করে লিখেছে! পাঠকের মনে ছাপ ফেলবার জন্যে!
সফল হয়েছে নিশ্চয়? জিনার দিকে তাকাল রবিন।
হয়েছে। টলে উঠেই পড়ে গেল খালা। আগে কাউকে বেহুশ হতে দেখিনি! ভয়ই পেয়ে গেলাম। খানিক পরেই গোঙাতে শুরু করল খালা, চোখ মেলল। ধরে ধরে অনেক কষ্টে তাকে ওপরে নিয়ে গেছি।
পুলিশকে বলতে রাজি হয়েছে?
না। অনেক বার বলেছি, বুঝিয়েছি, শুনতেই রাজি না। বলেছি, সাপটা আছে, কার্ডটা আছে, পুলিশকে প্রমাণ দেখাতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু শুনলই না আমার কথা। খালি বলে, জিহাভোকে নেকলেস দেয়া ছাড়া নাকি আর কোন উপায় নেই।
তার মানে নেকলেসটা দিতে যাচ্ছেন? কিশোর বলল।
না। ওটা পেয়ে গেছি, আমার কাছে।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, খুলে বলল জিনা। স্পাই ছবি। মেয়েদের বাথরুমে টুরানো সাবানের বাক্সে একটা মাইক্রোফিল্ম লুকিয়ে রাখল গুপ্তচর। খালাও দেখেছে ছবিটা। নিজের বুদ্ধিতে কিছুই করতে পারে না খালা, ভাবতেই বুঝে গেলাম। নেকলেস কোথায় লুকিয়েছে। তোমরা যাওয়ার পর গিয়ে খুঁজলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই।
তুমি নিশ্চয় আরও ভাল জায়গায় লুকিয়েছ, মুসা বলল।
তোমাদেরকে জানিয়ে রাখি, রসিকতার সুরে বলল জিনা, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তো গ্যারাজে খুঁজো। ঘোড়ার ওট বিনের টিনে।
মন্দ না, মাথা নাড়ল মুসা।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, খালার অবস্থা ভাল না। বিছানায় পড়ে আছে, দেয়ালের দিকে চোখ। মনে হলো, অসুখ করবে।
অসুখ খুব খারাপ হতে পারে, সাবধান করল কিশোর। এমনিতেই দুর্বল, না?
আগে ভালই ছিল। মিস পলের অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই কাহিল হয়ে পড়েছে।
তাকে এখন একা থাকতে দেয়া ঠিক নয়। দাঁড়াও, চাচীকে আসতে ফোন করছি।
জিনার মুখ উজ্জ্বল হলো। খুব ভাল হবে। তোমার চাচী খুব শক্ত মনের মহিলা! তাকে সব কথা বলব। হয়তো খালাকে পুলিশের কাছে মুখ খুলতে রাজি করাতে পারবেন।
শুধু শক্ত বললে ভুল হবে, কিশোর শুধরে দিল। চাচীর স্নায়ু ইস্পাতে তৈরি। কিন্তু, এই অবস্থায় চাচীও কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। তোমার খালা ভ্যারাড আর বিলিয়ালের ভয়ে কাতর, এখন অন্য কিছু ভাবতেই চাইবেন না। চাচীকে শুধু বলব, তোমার খালার অবস্থা খারাপ, তুমি একা সামলাতে পারছ না।
তা-ও ঠিক।
উঠে গিয়ে বাড়িতে ফোন করল কিশোর।
ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় হাজির হয়ে গেলেন মেরি চাচী। মিস মারভেলের ঘরে ঢুকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন ঘরের আর মহিলার অবস্থা। গভীর ভ্রূকুটি করলেন জিনা আর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এক্ষুণি ঘুমাতে যাওয়া উচিত জিনার, ছেলেদের বাড়ি ফেরা উচিত।
কিশোরের দিকে তাকালেন মেরি চাচী। তুই আর তোর চাচা বাইরে খেয়ে নিস রাতে, আমি থাকছি। সকালে ফোন করব। বলেই রান্নাঘরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি। খুটখাট আওয়াজ শুনেই বোঝা গেল, রেফ্রিজারেটর আর তাকগুলো খোঁজাখুঁজি করছেন।
জিনা, আজ রাতে পেট ভরে খেতে পারবে, হেসে বলল কিশোর। খবরদার, একবারও বলবে না, ওটা আরেকটু দিন। চাচী যদি মনে করে তোমার পেট ভরেনি, বুঝবে ঠেলা।
আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, বার বার রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছে মুসা। আজ রাতে আমরাও এখানেই থেকে যাই না কেন? কত কী। লাগতে পারে রাতে, তখন কাকে ডাকবেন চাচী?
পারলে চাচীকে গিয়ে বলো সে-কথা, হাসল কিশোর, জিনার দিকে ফিরল। আসলে আর থাকার দরকারই নেই আমাদের। ওসব গান গাওয়া সাপ-টাপের পরোয়া-মেরি চাচী করবে না; আর হ্যাঁ, তোমার খালা সাহস পাচ্ছেন না, কিন্তু তুমি তো জানাতে পারো পুলিশকে? বলবে, ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে তোমার খালাকে।
না না, বাপু, আমি পারব না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল জিনা। খালাকে ভূতে ধরেছে, একথা গিয়ে পুলিশকে বলতে পারব না। খালাও পরে শুনলে খুব দুঃখ পাবে।
ঝটকা দিয়ে রান্নাঘরের দরজা খুলে গেল। কিশোর! মেরি চাচীর তীক্ষ্ণ কষ্ট, এখনও দাঁড়িয়ে বকবক করছিস কেন তোরা? মেয়েটাকে ঘুমোতে দিবি না নাকি?
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল ছেলেরা।
সন্ধ্যার পরে ফোন করল কিশোর। ধরলেন মেরি চাচী। কড়া গলায় জানালেন, জিনা ঘুমোচ্ছে, মিস মারভেল ঘুমায়নি, তবে শান্তই রয়েছে। বিছানায় না গিয়ে এত রাত অবধি কী করছে কিশোর, কৈফিয়ত চাইলেন। শেষে ধমক দিয়ে বললেন, সকালের আগে যেন আর কোন ফোন না করে।
চিত হয়ে শুয়ে ছাতের দিকে চেয়ে রইল কিশোর, ভাবছে। ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়, দুঃস্বপ্ন দেখল: অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পোড়ো বাড়িতে কালো মোম জ্বলছে। বীভৎস সব ছায়ারা নেচে বেড়াচ্ছে আলোর আশপাশে। কাক-ভোরের আগে নীরব এক মুহূর্তে ঘুম ভাঙল তার, ঘামছে দরদর করে। মনে পড়ল সাপের মূর্তিটার কথা, আতঙ্কে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মিস মারভেলের কথা।
মনের পর্দায় ভেসে উঠল ডক্টর জিহাভোর কালো পোশাক পরা মূর্তি, ভীষণ ফেকাসে চেহারা। দুদিন আগেও এত তাড়াহুড়ো ছিল না লোকটার। এখন এতই অস্থির হয়ে উঠেছে, পারকারদের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করছে মিস মারভেলকে হুমকি দিতে। কেন?
ইস, যদি জানা যেত জবাবটা! ফ্লাডলাইটের আলোয় কিশোরকে দেখেছে নিশ্চয় জিহাভো, আর তাকে দেখে থাকলে ফোর্ডকেও অবশ্যই দেখেছে। তাতে ভয় পেয়ে গেছে ঠকবাজটা?
নড়েচড়ে শুল কিশোর। এখন ফোর্ডকে খুঁজে পেলেই অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যেত। কিন্তু পাবে কোথায়? পুরো ব্যাপারটার চাবিকাঠিই বোধহয় ওই রহস্যময় লোকটা! ওদিকে মস্ত বিপদ, ধীরে ধীরে অসুস্থতা বাড়ছে মিস মারভেলের, এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। আর টারনার? তার কী হবে? সাপ কি পাঠানো হয়েছে তার কাছে?
ডাইনীবিদ্যার ওপর লেখা বইটার কথা মনে পড়ল কিশোরের, রবিন যেটা লাইব্রেরি থেকে এনেছিল; ফোর্ডের বাসায় যেটা দেখেছিল, সেই বই। লেখক রুকসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, রকি বিচ থেকে রুকস্টন মাত্র দশ মাইল। হাসি ফুটল কিশোরের ঠোঁটে। পেয়েছে, সমাধান। পেয়েছে! ফোর্ডকে ছাড়াও চলবে, মিস মারভেলের জন্যে কিছু করতে পারবে এখন। ডক্টর জিহাভোর তাড়া রয়েছে, এটা খারাপ না হয়ে ভালই হতে যাচ্ছে জিনার খালার জন্যে।
উপায় একটা পেয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান, দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। আবার ঘুমিয়ে পড়ল সে।
উনিশ
সকাল সকালই পারকারদের বাড়িতে এল তিন গোয়েন্দা। হাতে খাবারের
ট্রে নিয়ে ওপরতলায় যাচ্ছেন মেরি চাচী। রান্নাঘরে ঢকঢক করে কমলার রস গিলছে জিনা।
নেকলেসটা নিয়ে কী করব ঠিক করে ফেলেছি, ছেলেদের দেখেই বলে উঠল সে। ফন হেনরিখের কাছে দিয়ে আসব। ও-ই সামলাক।
ভাল! সমর্থন করল রবিন।
তা তোমরা কী করেছ? মানে করবে?
লস অ্যাঞ্জেলেসে এক লোক আছে, তার নাম উলফ টারনার, একটা খাবারের দোকানের মালিক, গল্প বলছে যেন কিশোর। আশা করছি, এতক্ষণে তার কাছে সাপ পৌঁছে গেছে। জিহাভোর তাড়া আছে, কাজেই দেরি করবে না সে। রাসলারের প্রতিদ্বন্দী টারনার, বিলিয়ালেরও শত্রু, বলার ঢং পাল্টাল গোয়েন্দাপ্রধান। আমরা লস অ্যাঞ্জেলেসে যাচ্ছি।
খালার কী হবে? তার অবস্থা খুব খারাপ।
চাচী আছে, মনে করিয়ে দিল কিশোর। খালাকে দেখবে। তুমিও আছ। ফন হেনরিখকে ফোন করে বাসাতেই থাকতে হচ্ছে তোমাকে। কখন ওদের লোক আসে, কে জানে।
তা ঠিক। কিন্তু জিহাভো যদি আসে?
আসবে না। দেখে, জিনা, তোমার খালা সাপের ক্ষমতায় বিশ্বাসী। এতেই অসুখ বাড়ছে তার। জিহাভো জানে এটা। জানে বলেই আসবে না, কখন তার চাহিদামত জিনিস যাবে সে-অপেক্ষায় থাকবে।
জিনিস যাবে না। খালা উঠতেই পারে না, পাঠাবে কে? একেবারে অচল হয়ে গেছে।
তোমার খালাকে বাঁচানোর একটা উপায় আছে, জিনা, কিন্তু টারনারের কথা আগে ভাবতে হবে আমাদের। তোমার খালার হাতে সময় আছে, কিন্তু টারনারের একেবারেই নেই।
কী করতে যাচ্ছ? ভুরু কোঁচকাল জিনা।
টারনারের দোকান বাঁচাতে যাচ্ছি, রবিন আর চেপে রাখতে পারল না।
তা হলে আমিও যাব, ঘোষণা করল জিনা।
না, তুমি যাচ্ছ না, সাফ বলে দিল মুসা। টারনার দুর্বল লোক না, তাকে নোয়াতে কষ্ট হবে জিহাভোর। গোলমাল হতে পারে।
হোক, আমি যাবই! জেদ ধরল জিনা। মেরি চাচী থাকছেন, জিহাভো আসছে না। নেকলেসটাও এখনও যেখানে আছে, নিরাপদেই আছে। আমার যেতে বাধা কী? তোমরা ওদিকে মজা লুটবে, আর আমি বসে বসে আঙুল চুষব? তা হবে না। আমি যাব।
ট্রে হাতে এসে ঢুকলেন মেরি চাচী। কোথায়?
লস অ্যাঞ্জেলেসে যাব, চাচী, বলতে একটুও দেরি করল না জিনা। খালার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিশোরকে আমার সঙ্গে যেতে বলুন না!
অবাক হলেন মেরি চাচী। অবস্থা খুব খারাপ, একটা দানাও মুখে দেননি সকালে, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকারই, কিন্তু যাওয়া লাগবে কেন? লস অ্যাঞ্জেলেস কি কম দূর? ফোন করলেই পারো।
ডাক্তারের নাম ভুলে গেছি, ফোন নম্বরও জানি না। তবে তার চেম্বার চিনি, উইলশায়ারে, গির্জার পাশে একটা বাড়ি।
এত কষ্ট করবে? তার চেয়ে তোমার খালাকে জিজ্ঞেস করে দেখো না। নাম, নাম্বার, দুটোই হয়তো পেয়ে যাবে। আ খালা বলবে না। জিজ্ঞেস করিনি ভাবছেন? করেছি। আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। ভূতে ধরেছে, ডাক্তারের কথা শুনতে চাইবে কেন!
নীরবে জিনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মেরি চাচী। দুহাত নাড়লেন। ঠিক আছে! কিশোর, দৌড়ে যা তো, বোরিসকে বল গে পিকআপটা নিয়ে আসতে। বাসে গেলে সারাদিন লেগে যাবে।
আনন্দে মেরি চাচীকে জড়িয়ে ধরল জিনা। ও, মাই সুইট আন্টি!
ছেলেরা মুখ গোমড়া করে থাকল। কিশোরের পেছনে বেরোল জিনা, তাদেরকে অনুসরণ করল অন্য দুজন। রাগে ফুলছে। টারনারকে সাহায্য করতে যাচ্ছে, কিছুতেই বলা যাবে না চাচীকে। বিপদ আছে শুনলে যেতেই দেবেন না চাচী।
ইয়ার্ডে প্রচুর কাজ, তা থেকে মুক্তি পেয়ে খুশিই হলো বোরিস। চুপচাপ পিকআপের পেছনে উঠে বসল ছেলেরা, জিনা বসল ড্রাইভারের পাশে।
বেভারলি অ্যাণ্ড থার্ড স্ট্রিটের মোড়ে গাড়ি পার্ক করল বোরিস। দরজা খুলে গলা বাড়াল। আমি আসব?
না, বলল কিশোর। এখানেই থাকুন। বসে বসে জিরোন। আমাদের দেরি হতে পারে।
হোক! একটা খবরের কাগজ খুলে আরাম করে বসে তাতে মন দিল বোরিস।
জিনাকে হা-না কিছুই বলল না ছেলেরা। অনেকটা বেহায়ার মতই তাদের সঙ্গে সঙ্গে এল সে।
ওই যে, রাসলারের দোকান, হাত তুলে দেখাল মুসা।
নাক বকাল জিনা, থুথু ফেলল মাটিতে, নোংরামি দেখে।
টারনারের দোকানের দরজা খুলে একটা ছেলে বেরোল। তার পিছনেই মালিকের মুখ দেখা গেল। আজ আর এসো না।
বড় বড় কদমে কাছে চলে এল কিশোর, দরজায় তালা লাগাচ্ছে টারনার।
সরি, ফিরে চেয়ে বলল লোকটা, বন্ধ করে দিয়েছি।
সাপটা পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ঝট করে সোজা হলো টারনার, মুসাকে চোখে পড়ল। তুমিও আবার এসেছ।
আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই, মিস্টার টারনার, নরম গলায় বলল মুসা।
তাই, না? পুলিশ সব কথা বলেছে আমাকে। তোমরা কিশোর গোয়েন্দা, প্রেতসাধকদের পেছনে লেগেছ। কী বলব? ছেলেমানুষী, না পাগলামি? যা খুশি করো গে। আমি যাচ্ছি। দোকান বন্ধ।
সাপটা পেয়েছেন? একইভাবে জিজ্ঞেস করল আবার কিশোর।
কিশোরের শার্ট খামচে ধরল টারনার। তুমি রেখে গিয়েছিলে? ঘাড় মটকে দেব!
শার্ট ছাড়ানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না কিশোর। আমরা কেউ রাখিনি। তবে জানি, ওটা একটা গোখরোর মূর্তি, কুণ্ডলী পাকানো, চোখ দুটো লাল পাথরের।
স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের মুখের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ টারনার, তারপর আস্তে করে ছেড়ে দিল শার্ট। আবার দরজা খুলে কাউন্টারের দিকে ইঙ্গিত করল। সাদা ফরমাইকার ওপর বসে আছে মূর্তিটা; মিস মারভেলকে যেটা পাঠানো হয়েছে, তার অবিকল নকল।
মিনিট দুয়েকের জন্যে দোকানের পিছনে গিয়েছিলাম, টারনার বলল। ফিরে এসে দেখি ওটা।
হুঁ! কিশোর গম্ভীর।
আমি যাচ্ছি, তোমরাও কেটে পড়ো। কিছু যদি ঘটেই, নির্জন জায়গায় ঘটুক। পুলিশকে ফোন করে জানিয়েছি। যাও যাও, সরে যাও।
রাস্তা পেরিয়ে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। কাঁধ ধরে এক ঝটকায় তাকে আবার রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে দিল টারনার। বাড়ি যাও! তোমার মাকে বলবে, সে-ও যেন আজ আর না বেরোয়! যাও!
হাঁ করে টারনারের দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা।
দেখছ কী! ধমকে উঠল দোকানদার।
কিছুই না বুঝে প্রায় ছুটে পালাল মেয়েটা।
খদ্দেরের জ্বালায় আর পারি না! আক্ষেপ করল, টারনার। একেবারে উইপোকা! ঝাঁকে ঝাকে আসে, ছাড়াতে পারি না!
দালানের কোণের দিক থেকে একটা লোক এসে দাঁড়াল। নীল প্যান্ট আর কালো কোটের বয়েস কত সে নিজেও বলতে পারবে না হয়তো। ময়লা, ছেঁড়া, কোঁচকানো কাপড়-চোপড়। অনুনয় করল, কফি হবে?
আগ্রহের সঙ্গে লোকটাকে দেখছে জিনা। জীবনে ভিখিরি খুব কমই দেখেছে সে, এই লোকটা তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। গায়ে শুধু কোট, শার্টও নেই। লালচে ঘাড় বেরিয়ে আছে। কতদিন চুল কাটেনি, কে জানে! ধুলোয় ধূসর, শিগগিরই পরিষ্কার না করলে জটা পড়বে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে।
হবে, ভাই? আবার অনুনয় করল লোকটা। এক-আধটা স্যাণ্ডউইচও যদি পেতাম! দুদিন খাইনি!
পকেট থেকে নোটের তাড়া বের করে একটা খুলে নিল টারনার। লোকটার দিকে না তাকিয়ে বাড়িয়ে ধরল, নোটটা। আমার দোকান বন্ধ। ওই যে, ওই দোকান থেকে কিনে খাও গে, রাসলারের দোকান দেখিয়ে দিল।
ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন! টাকাটা নিয়ে কপালে ছোঁয়াল ভিখিরি। ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই খবরের কাগজ রাখার স্ট্যাণ্ডে হোঁচট খেল, সামলানোর চেষ্টা করল, পারল না, স্ট্যাণ্ড আর কাগজগুলো নিয়ে পড়ল হুড়াম করে।
আরে, দূর! চেঁচিয়ে উঠল টারনার। জ্বালা!
হাঁচড়ে-চড়ে কোনমতে উঠল ভিখিরি। সোকে! (ইটস ওকে) টলতে টলতে পা বাড়াল।
এই, মিয়া! জিনা ডাকল। দাঁড়াও! এগিয়ে গিয়ে উবু হয়ে ছোট একটা কালো বাক্স তুলে নিল। তোমার রেডিও ফেলে যাচ্ছ!
দৌড় দিল লোকটা।
জিনা! হাত বাড়াল কিশোর। জলদি দাও আমার হাতে!
গুড লর্ড! চেঁচিয়ে উঠল টারনার। ছোঁ মেরে জিনার হাত থেকে বাক্সটা নিয়েই ছুঁড়ে ফেলল অন্ধের মত। উড়ে গিয়ে রাসলারের দোকানের দেয়ালে বাড়ি খেল ওটা, ভ্রামমম্ করে বিকট আওয়াজ তুলে ফাটল। চোখ ধাঁধানো আলো। কালো ধোঁয়া সরে যেতেই দেখা গেল, রাসলারের দোকানের জানালা-দরজার একটা কাঁচও নেই, সব গুড়ো। রাসলারের নোংরা ফেকাসে মুখটা চকিতের জন্য দেখল কিশোর।
ক্ষণিকের জন্য থ হয়ে গিয়েছিল টারনার, সংবিৎ ফিরে পেয়েই ঘুরে তাকাল। পথের মোড়ের কাছে চলে গেছে ভিখিরির পোশাক পরা লোকটা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল টারনার সেদিকে।
বোমা! থরথর করে কাঁপছে এখনও জিনা। জীবনে দেখিনি! আমি ভেবেছি রেডিও!
মাই ডিয়ার লেডি, হাসিমুখে বলল মুসা, আমাদের সঙ্গে থাকলে আরও অনেক কিছুই দেখবে। সারাজীবন ঘরের ভেতরেই কাটিয়েছ
জিনার ওপর থেকে রাগ দূর হয়ে গেছে ছেলেদের।
বিশ
ফেরার পথে পিকআপের পিছনে বসল জিনা। এক সময় বলল, আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না। এবার নিশ্চয় খালার সঙ্গে কথা বলবে পুলিশ।
ভদ্রভাবেই বলবে, জিনার আশঙ্কা দূর করতে চাইল কিশোর। তিনি তো আর অপরাধী নন।
পুলিশের ঝামেলা থেকে যদি দূরে সরিয়ে রাখা যেত!
সম্ভব না, মাথা নাড়ল রবিন। তা ছাড়া পুলিশের কাছে চেপে রাখাও আর উচিত হবে না আমাদের। ভয়ানক লোক জিহাভো, মানুষ খুন করতেও বাধে না তার। আজ আরেকটু হলেই তো দিয়েছিল টারনারকে শেষ করে!
জিনা, আজ একটা কাজের কাজ করেছ, মুসা বলল। বোমাটা আমাদের চোখে পড়েনি, তুমি না দেখলে… হাসল সে। এত তাড়াতাড়ি চলে আসা উচিত হয়নি। লোকটাকে ধরতে পারলে ধোলাই যা একখান দেবে না টারনার! আহ, থাকলে পারতাম!
রাসলারের চেহারা দেখেছ! হাহ্ হাহ! হাসি ঠেকাতে পারছে না। কিশোর। ওর জানালা ধসে পড়বে, এটা কল্পনাও করেনি সে।
পারকারদের বাড়িতে ঢুকল পিকআপ। মেরি চাচী বোধহয় ওদের অপেক্ষায়ই ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজা খুলে উঁকি দিলেন। এতক্ষণ! মিস মারভেলের অবস্থা আরও খারাপ। এখানকার ডাক্তারকেই ডেকেছি, কী করব! জিনা, ডাক্তারকে পেয়েছ?
না, লাফ দিয়ে নামল কিশোর। মেরি চাচীকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ল।
জিনা ছুটল পেছনে।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার, ডাক্তার বললেন। কিন্তু রাজি হচ্ছেন না উনি।
একেক লাফে দুটো করে সিঁড়ি টপকে উঠতে লাগল জিনা, কিশোর তার পেছনে পড়ে গেছে।
চুপসে যাওয়া মস্ত একটা পুতুলের মত বিছানায় নেতিয়ে পড়েছে। মিস মারভেল। জিনার গলা শুনে ফিরে তাকাল।
খালা, আর চিন্তা নেই, জিনা বলল। জিহাভোর শয়তানী ফাঁস হয়ে গেছে। একটা ঠকবাজ, খুনী। পুলিশ খুঁজছে এখন তাকে।
নড়ল না মিস মারভেল।
হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল জিনা। ভাবনাচিন্তা এক্কেবারে বাদ দাও। তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।
জিনার হাতে হাত রাখল মহিলা। ফিসফিস করে বলল, জিনা, নেকলেসটা…
এক ঝটকায় সরে এল জিনা। না! দেব না! কী বলছি, শুনছ না? জিহাভো একটা ঠকবাজ খুনী। ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে জেলে ভরবে।
পুলিশ। কারও আর কিছু করতে পারবে না সে।
ওর বিরুদ্ধে কিছু করেছিস! তাজা আতঙ্ক ফুটল মিস মারভেলের চেহারায়। জিনা, ও আমাকে দুষবে!
যত্তসব! খালার কব্জি ধরে টানল জিনা। হয়েছে, ওঠো।
জিনার বাহুতে হাত রাখল কিশোর। ছেড়ে দাও। তাকে নিয়ে। হল-এ এল সে।এভাবে খালাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে লাভ হবে না, বোঝাল কিশোর। দেখছ না, জিহাভো জেলে যাবে শুনে আরও ভয়। পেয়ে গেছেন? একটাই উপায় আছে। কাটা দিয়ে কাটা তুলতে হবে।
কীভাবে?
ভূত ছাড়াতে হবে।
জনাব কিশোর পাশা, মাথামুথা ঠিক আছে তো তোমার?
ওঁর ভূত ছাড়াতে হবে, জিনার কথা শুনতেই পায়নি যেন কিশোর। অভিশাপ তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ওঝা ডাকব। এক ওঝা কাউকে বাণ মারলে সেটা ছাড়ানোর জন্যে আরেক ওঝা দরকার। বাংলাদেশে অহরহ ঘটছে এসব। চাচা বলতে বলতে একেক সময় খেপে ওঠে।
হতাশ ভঙ্গিতে দেয়ালে হেলান দিল জিনা। বাংলাদেশ এখান থেকে অনেক দূর! ওঝা কোথায় পাব?
পাব, পাব, হাত তুলল কিশোর। বোকা মানুষ দুনিয়ার সব দেশেই আছে। আমার তো ধারণা, লস অ্যাঞ্জেলেসে আরও বেশি আছে। পাগলও বেশি এখানে। বোকা মানুষ বেশি যেখানে, সেখানে ঠকবাজও বেশি। আমি জানি, কোথায় ওঝা পাওয়া যাবে।
নিচে নামল কিশোর। উদ্বিগ্ন মেরি চাচীকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে রবিন আর মুসা। গম্ভীর মুখে পায়চারি করছেন ডাক্তার।
রবিন, কিশোর বলল, রুকসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রফেসর, পুরো নাম কী যেন?
জন এ. স্মিথ।
হ্যাঁ, জন স্মিথ, রান্নাঘরে এসে ঢুকল কিশোর। জানালা দিয়ে তাকাল পাহাড়ি উপত্যকার দিকে। রবিন আর মুসাও ঘরে ঢুকল।
প্রফেসরকে দরকার? জানতে চাইল রবিন।
হ্যাঁ। ওঝা দরকার একজন। কীভাবে কী করতে হবে, প্রফেসর স্মিথ ভাল বলতে পারবেন।
অনুসন্ধান-এ ফোন করল কিশোর। প্রফেসর জন এ, স্মিথের নাম্বারটা বলবেন, প্লিজ? …হা হা, রুকসটন ইউনিভার্সিটি।
কাগজ-কলম নিয়ে রবিন তৈরি। জোরে জোরে নম্বরগুলো বলল কিশোর, রবিন লিখে নিল। থ্যাঙ্ক ইউ, বলে লাইন কেটে দিল কিশোর। এখন তাকে পেলে হয়। আবার ডায়াল ঘোরাল সে। ডক্টর স্মিথ আছেন?
খানিকক্ষণ নীরবতা। রিসিভার কানে ঠেকিয়ে অপেক্ষা করছে। কিশোর। ওপাশ থেকে সাড়া আসতেই বলল, প্রফেসর? স্যর, আমি কিশোর পাশা, রকি বিচ থেকে বলছি। একটা সাহায্য করতে পারেন? টেলিফোনে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। একজন মহিলাকে, মানে তাকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে। আমরা…
চুপ করে শুনল কিশোর। তারপর বলল, হ্যাঁ, স্যর, খুব অসুস্থ।
আবার চুপ। শুনে বলল, গতকাল, স্যর। প্যাকেটে করে একটা সাপের মূর্তি পাঠানো হয়েছে। আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওপাশের কথা শুনে বলল, পারকার হাউস। মহিলার নাম মিস মারভেল। আবার। চুপচাপ। থ্যাঙ্ক ইউ, স্যর, থ্যাঙ্ক ইউ, বলে প্রফেসরকে পারকার হাউসের ঠিকানা দিয়ে রিসিভার রেখে দিল।
আসছেন, রবিন আর মুসার কৌতূহল নিরসন করল কিশোর। সঙ্গে করে ওঝা নিয়ে আসবেন, অভিশাপ দূর করার জন্যে।
খাইছে রে, বিড়বিড় করল মুসা। আল্লাই জানে কী হবে! ভুডুর ওস্তাদ নিশ্চয়?
এলেই জানা যাবে।
দরজা খুলে উঁকি দিলেন মেরি চাচী। কিশোর, কী করছিস?
ডাক্তারকে পেয়েছি, চাচী।
অউ, গুড! যাক, বাঁচা গেল। চেনা ডাক্তারের কথা হয়তো শুনবে। মহিলা।
দেখা যাক, কী হয়। তিনি আসছেন।
গুড। আমি গিয়ে বসি জিনার খালার কাছে। আর এই, শোনো তো, একজন গিয়ে ওই ঘোড়াটাকে বাঁধো! জানালা দিয়ে দেখলেন মেরি চাচী। ঝাড়-টাড় সব নষ্ট করে ফেলবে!
চাচীর পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে জিনা। বলল, আমিই যাচ্ছি।
জিনা, কিশোর ডেকে বলল, ডাক্তার আসছেন।
পেয়েছ তা হলে! খুব ভাল!
জিনা চলে গেল। মেরি চাচী গেলেন মিস মারভেলের ঘরে। বারান্দার সিঁড়িতে পা রেখে বসল ছেলেরা। খানিক পরেই ফিরে এল জিনা। কতক্ষণ লাগবে?
বেশি দেরি হবে না, কিশোর বলল।
সত্যিই দেরি হলো না, গেট দিয়ে একটা গাড়ি ঢুকল। এসে থামল গাড়ি-বারান্দায়। ইঞ্জিন বন্ধ হতেই ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে। লাফিয়ে নামল একজন লোক। কিশোর প্যাশাআ!
অবাক হয়ে লোকটার দিকে চেয়ে আছে চার ছেলেমেয়ে।
জিনা, লোকটা বলল, আমি সত্যিই দুঃখিত! জানতাম না, এতখানি গড়াবে!
আস্তে করে উঠে দাঁড়াল কিশোর। আপনি!
আমি ডক্টর জন স্মিথ।
হাঁ হয়ে গেছে জিনা। আপনি…আপনি গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন, মিস্টার ফোর্ড!
ওপরের ঠোঁটে আঙুল বোলালেন প্রফেসর। হাসলেন। ওটা নকল গোঁফ ছিল। ফোর্ড নামটাও বানানো। আমি আসলে ডক্টর জন এ. স্মিথ, রুকসটন ইউনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপলজির প্রফেসর।
একুশ
হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মূর্তিটা দেখলেন প্রফেসর। চমৎকার কাজ। এ জিনিসে ভয় না পেলে আর কীসে পাবে?
সত্যিই কি কাজ হয়? মুসা জানতে চাইল।
সাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন প্রফেসর। যার বিরুদ্ধে করা হলো, সে না জানলে কিছুই হবে না। ভয় পেল কি, মরল!
আপনি খালাকে ভাল করতে পারবেন? জিনা বলল। বোঝাতে পারবেন, তার ওপর থেকে অভিশাপ দূর হয়েছে?
না, আমি পারব না। আমাকে কি ওঝার মত দেখাচ্ছে?
দেখাচ্ছে না, স্বীকার করল জিনা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নিখুঁত পোশাক। তোমার খালা আমাকে বাড়ির কাজের লোক হিসেবে দেখেছেন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে বালি পরিষ্কার করতে দেখেছেন, আমি বললে কি বিশ্বাস করবেন? না। এজন্যেই আউরোকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। গাড়িতে বসে আছে। কী কী করতে হবে, বুঝিয়ে দিয়েছি তাকে, করতে পারবে।
তিনি কি ওঝা? জানতে চাইল কিশোর।
জিপসি, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন প্রফেসর। ভূতে পাওয়া এরকম আরও অনেককেই ভাল করেছে। আঁচিল সারাতে পারে, ভবিষ্যৎ বলতে পারে, শত্রুর পিঠে মাথা গজিয়ে দিতে পারে…)
দূর! তাই কি হয়? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
নিজের চোখেই দেখবে, হাসলেন প্রফেসর। যাই, ওকে নিয়ে আসি।
মহিলাকে নিয়ে এলেন প্রফেসর। বৃদ্ধা, গালের চামড়া কোঁচকানো। মাথায় কয়েকটা রঙিন রুমাল বেঁধেছে, তাতেও পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি লম্বা জটা। ব্লাউজ ফেকাসে নীল, সবুজ গাউন পায়ের পাতা ঢেকে দিয়েছে। কাপড়-চোপড়ে কেমন একটা পুরানো পুরানো গন্ধ, বালি নেই, তবু মনে হয় বালিতে ঢাকা। ঘন কাঁচাপাকা ভুরুর নিচে গভীর কালো উজ্জ্বল দুটো চোখ।
মূর্তিটা তুলে নিল মহিলা। এটাই?
হ্যাঁ, বললেন প্রফেসর।
হাহ! অবজ্ঞা দেখাল আউবো। এই, মেয়ে, এই, তোমরাও, ছেলেদের দিকে হাত তুলল সে। এসো আমার সঙ্গে। যা যা বলব, করবে। টু শব্দ করবে না। বুঝেছ।
বুঝেছি, কিশোর বল।
মেয়েমানুষটা কোথায়?
ওপরে, দোতলা দেখাল জিনা।
চলো, মূর্তিটা হাতে নিয়েই সিঁড়ির দিকে এগোল আউরো।
সিঁড়ির মাথায় দেখা হয়ে গেল মেরি চাচীর সঙ্গে। আরে, এ-কী! এই পাগল ধরে এনেছে কেন! আরে, এই, কিশোর…
ঠিকই আছে, চাচী, দুহাত তুলল কিশোর। ডক্টর স্মিথই নিয়ে এসেছেন ওকে।
ডক্টর স্মিথ? কখন এলেন? কই, আমাকে ডাকলি না কেন? এসব হচ্ছে কী?
পরে বলব, প্রফেসরের দিকে ফিরে বলল কিশোর। আমার চাচী।
সালাম জানালেন প্রফেসর।
মাথাটা সামান্য একটু নুইয়ে আবার কিশোরের দিকে ফিরলেন মেরি চাচী। পরে-টরে না, আমি এক্ষুণি জানতে চাই কী হচ্ছে এসব!
এই, বেটি, সরো! ধমক লাগাল আউরো।
কী! চেঁচিয়ে উঠলেন মেরি চাচী।
প্রমাদ গণল তিন গোয়েন্দা। বড় কেশ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। ওঝা!
বলছি, সরো, আউরোও গলা চড়াল। আমার জরুরি কাজ আছে! শিগগির সরো, নইলে পরে পস্তাবে বলে দিচ্ছি!
দীর্ঘ এক মুহূর্ত দুজনের চোখে চোখ আটকে থাকল। তারপর তিন গোয়েন্দাকে অবাক করে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ালেন মেরি চাচী।
জিনার সঙ্গে মিস মারভেলের ঘরে ঢুকল আউরো, পেছনে তিন গোয়েন্দা। ওঝার ওপর ভক্তি বেড়েছে। দুর্ব্যবহার করে মেরি চাচীকে কুপোকাৎ করে দেয়া…আরিব্বাপ রে!
চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে আছে মিস মারভেল। তার পায়ের কাছে এসে ডাকল আউরো। অই, ভূতের বাসা! শুনছ? চাও!
চোখ পিটপিট করে তাকাল মিস মারভেল, শিউরে উঠে গায়ের চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে দিল।
বেটির মাথার তলায় বালিশ দাও, জিনাকে আদেশ দিল আউরো। ওরও দেখা দরকার।
এই যে, দেখো! মূর্তিটা উঁচু করে ধরল আউরো। শয়তানের বাহন।
আবার কেঁপে উঠল মিস মারভেল। বিলিয়াল, বিড়বিড় করল। বিলিয়ালের দূত!
হাহ! অবজ্ঞায় মুখ বাকাল আউরো। অমন কত দূত আছে আমার। যে-কোন একটা পাঠালেই বিলিয়ালের অস্তিত্ব বিনাশ করে দিয়ে আসবে! ঘুরে এসে মূর্তিটা বাড়িয়ে ধরল ওঝা। ধরো! এটা হাতে নাও!
না, না, আমি পারব না। দুহাত নাড়তে লাগল মিস মারভেল।
একশোবার পারবে, কড়া গলায় ধমক দিল আউরো। খপ করে মিস মারভেলের একটা হাত তুলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা আঙুলে গুঁজে দিল মূর্তিটা। বাঁচতে চাও? ধরো শক্ত করে!
এই প্রথমবার মিস মারভেলের চোখে আলো ঝিলিক দিয়ে গেল, আশার আলো। মূর্তিটা ধরল শক্ত করে।
ঢোলা গাউনের অসংখ্য পকেটের একটা থেকে সবুজ কাপড়ের থলে বের করল আউরো। ভারি গলায় একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করল, সবুজ বসন্তের প্রতীক! জীবনের রঙ! থলেটা মিস মারভেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, দাও, সাপটা ঢুকিয়ে দাও এর মধ্যে।
আউরোর চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে থলের ভেতরে মূর্তিটা রেখে। দিল মিস মারভেল।
ব্যস, তাড়াতাড়ি থলের মুখ শক্ত, মোটা সুতো দিয়ে বেঁধে ফেলল আউরো। জিনাকে বলল, দরজা বন্ধ করো। মোম জ্বালো! এই, মেয়ে, নড়তে-চড়তে পারো না!
মোমের অভাব নেই ঘরে। সবুজ, নীলচে-লাল, লাল, সাদা, কালো; যত রঙের পাওয়া যায়, সব আছে।
লাল মোম জ্বালো, বলল আউরো। লাল মানে শক্তি।
মোম জ্বলল।
খবরদার! কেউ কথা বলবে না! হুঁশিয়ার করে দিল আউরো।
কেউ বলল না, আউরো ছাড়া। ভাবি কেমন এক গলায় মন্ত্র পাঠ শুরু করল সে, ভাষাটা বিচিত্র, এক বর্ণও বুঝতে পারল না আর কেউ। সবুজ থলেটা মোমের আলোর দিকে উঁচু করে ধরল; একবার জোরে, একবার আস্তে, একবার ফিসফিস করে, তারপরই নাকি সুরে, কী সব। বকবক করল, সে-ই জানে!
মাথা সামনে-পেছনে তালে তালে দোলাচ্ছে ওঝা, বিড়বিড় করতে করতেই ঝট করে সোজা হয়ে গেল হঠাৎ। গুঙিয়ে উঠে বন্ধ করে ফেলল। চোখের পাতা, গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে হাতের থলে ছাড়েন।
চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে মিস মারভেল। আউরোর মুখ ফাঁক, গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নানারকম বিচিত্র শব্দ। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে শুরু হলো গান, সেই মহাসর্পের গান! ভাল। করে দেখল কিশোর। উঁহু! আউরোর মুখ থেকে আসছে না আওয়াজ! সারা ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বেসুরো সুর, দুর্বোধ্য শব্দ। জবাই করা ছাগলের মত ঝাঁকুনি খাচ্ছে আউরোর দেহ। হঠাৎ গড়াতে শুরু করল। সে সারা ঘরে। একের পর এক রুমাল খুলে পড়ছে মাথা থেকে, হুঁশই নেই যেন। লম্বা জটাগুলোকে মনে হচ্ছে খুলি আকড়ে থাকা এক ঝাক বিষাক্ত সাপ!
গান বাড়ছে, জোরাল হচ্ছে, আরও জোরাল। তীক্ষ্ণ, বাতাস চিরে কান ফুড়ে যেন ঢুকে যাচ্ছে মগজে।
বিছানায় সোজা হয়ে বসেছে মিস মারভেল। বালিশের দরকার পড়ছে না আর।
প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেয়ে স্থির হয়ে গেল আউরোর শরীর। মেঝের ঠিক মাঝখানে এসে চিত হয়ে পড়েছে। চোখ খোলা, ছাতের দিকে চেয়ে আছে, প্রাণ নেই যেন।
কিশোর! দরজায় করাঘাত হলো। এই, কিশোর, দরজা খোল! হচ্ছে কী ভেতরে! খোল!
গুঙিয়ে উঠল আউরো। উঠে বসল। থলেটা এখনও হাতে ধরা, এত কিছুতেও ছাড়েনি। সেটার দিকে চেয়ে বলল, দেখেছি ওকে। কালো আলখেল্লা পরা এক লোক, ফেকাসে চেহারা, খুব বিপদে পড়েছে। সাপের। পাকে আটকা পড়েছে সে।
কিশোর, খুললি না এখনও! চেঁচিয়ে চলেছেন মেরি চাচী।
উঠে দাঁড়াল আউরো। মিস মারভেলের কাছে গিয়ে থলেটা বাড়িয়ে ধরল, খুলে দেখো।
কাঁপা হাতে বাধন খুলে থলের ভেতরে হাত ঢোকাল মিস মারভেল। বিস্ময় ফুটল চোখে। মূর্তিটা নেই।
বলেছি না, বিলিয়ালের চেয়ে আমার প্রেত ক্ষমতাশালী? এই প্রথম হাসল আউরো। যে পাঠিয়েছে, তাকেই কামড়াতে গেছে মহাসৰ্প। বিলিয়ালকে ঘুরিয়ে দিয়েছি, জিহাভোকেই আক্রমণ করেছে এখন সে। তোমার আর কোন ভয় নেই।
গিয়ে দরজা খুলে দিল আউরো। কোমল গলায় ডাকল মেরি চাচীকে, এসো, মেয়ে, এসো। আর ভয় নেই। ভূত ভেগেছে।
বাইশ
আশ্চর্য! জিনা বলল। গতরাতে পুরো এক বাটি সুপ খেয়েছে খালা। ঘুমানোর আগে দুধ আর বিস্কুট খেয়েছে। আজ সকালে উঠেই ডিম খেয়েছে দুটো। এই তো, এক ঘণ্টাও হয়নি, খিদে পেয়েছে বলে চিল্লাচিল্লি লাগিয়েছে আবার!
টোস্টার থেকে দুই টুকরো টোস্ট তুলে নিল জিনা। তাতে মাখন মাখাতে মাখাতে বলল, মেরি চাচী না থাকলে কী যে করতাম! জান বেচেছে আমার!
হাসল কিশোর।
আরও দুএকদিন যদি থাকতেন, ট্রেতে টোস্টের প্লেট রাখল জিনা, আর এক গ্লাস দুধ।
দরকার পড়লেই আবার চলে আসবে, কিশোর বলল। ইয়ার্ডে মেলা কাজ পড়ে আছে। চাচীর ধারণা, নিজে হাজির না থাকলে, খালি ফাঁকি দেবে বোরিস আর রোভার। একটু চুপ থেকে বলল, ও, হ্যাঁ, সকালে ক্যাপ্টেন ফ্লেচার এসেছিলেন, লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ চিফ।
কোন খবর? কিশোরের দিকে ফিরল জিনা।
বোমা এনেছিল যে, লোকটা এখন জেলে, রবিন জানাল।
ওর মত লোকের উপযুক্ত জায়গা!
ক্যাপ্টেন বললেন, মুসা জানাল, দুএক ঘা খেতেই মুখ খুলে গেছে। লোকটার। হড়হড় করে বলে দিয়েছে সব। ভ্যারাড আর রড ধরা পড়েছে। রাসলারকে কিছু বলেনি পুলিশ; সে সত্যিই জানত না, বোমা মেরে টারনারের দোকান উড়িয়ে দেয়ার তাল করেছে ডাক্তার জিহাভো।
জিহাভো কই? ধরা পড়েনি?
না, ওই একটাই বাকি, কিশোর বলল।
একটা চেয়ারে বসে পড়ল জিনা। জিহাভো ধরা পড়েনি!
টরেনটি ক্যানিয়নের বাড়িতে পায়নি তাকে পুলিশ। সব কিছু ফেলে পালিয়েছে, এমনকী গাড়িটাও ফেলে গেছে। ক্যাপ্টেনের ধারণা, এতক্ষণে সে পগার পার, এক্কেবারে ক্যানাড়ায়।
চেয়ারের পায়ায় গোড়ালি ঠুকতে শুরু করল জিনা। তোমার কী ধারণা?
এখনও তুমি আমাদের মক্কেল। জিহাভো এভাবে পালিয়ে যাবে, আমার বিশ্বাস হয় না।
ঠিক বলেছ, দরজার কাছ থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
চেয়ারেই পাঁই করে ঘুরে গেল জিনা। যার যার জায়গায় পাথর হয়ে গেল যেন ছেলেরা।
হলের দিকে পিছন করে দাঁড়িয়েছে ডক্টর জিহাভো। সেরাতে যেমন দেখেছিল, তেমনি দেখাচ্ছে লোকটাকে, সেই একই পোশাক। তবে কাপড়গুলো এখন ময়লা, কোঁচকানো, ধুলো লেগে আছে। হাতে একটা পিস্তল।
আমি একটা গাধা! বিড়বিড় করে নিজেকে গাল দিল জিনা। দরজা খুলে রেখেছি! যে খুশি ঢুকে পড়তে পারে।
কদিন ধরে তো এ-বাড়ির দরজা খোলা দেখছি, একা তোমার দোষ না, লোকটা বলল। বেশি দোষ তোমার ওই মাথামোটা খালাটার।
বাহ, খবর-টুবর ভালই রাখেন, কিশোর বলল। দেখলেন কোত্থেকে? ওই পাহাড়ের মাথায় লুকিয়ে বসে ছিলেন?
তোমার বুদ্ধি আছে, খোকা, কিশোরের দিকে চেয়ে মাথা সামান্য নোয়াল জিহাভো। ঠিকই ধরেছ। একটা গুহা আছে, ওখানেই লুকিয়ে থেকেছি। বাজে জায়গা!
একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, টরেনটি ক্যানিয়ন থেকে পালালেন কী করে? মুসা জিজ্ঞেস করল। ভ্যারাড় আর রডকে তো পুলিশ ধরে ফেলল।
বাগানের পেছনে ছিলাম। পুলিশের গাড়ি দেখলাম।
ব্যস, অমনি দেয়াল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়লেন ঝোপে, না? রবিন বলল। বন্ধুদেরকে বিপদে রেখে।
কথায় আছে না, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! হাসি হাসি ভাবটা হঠাৎ দূর হয়ে গেল জিহাভোর চেহারা থেকে। ওই মাথামোটা মেয়েমানুষটা কোথায়? নিশ্চয় দোতলায়। সিঁড়ির দিকে পিস্তলের ইঙ্গিত করে বলল, চারজনই ওঠো। আমি পেছনে থাকছি।
যাব না, গ্যাঁট হয়ে বসে রইল জিনা।
বোকামি কোরো না, মুসা বলল। ওর হাতে পিস্তল!
আমি কেয়ার করি না। খালার সঙ্গে আর দেখা করতে দিচ্ছি না আমি ওকে, যথেষ্ট করেছে। আস্তে করে উঠে দাঁড়াল জিনা। কোমরে দুহাত রেখে মুখোমুখি হলো জিহাভোর। আমি জানি, তুমি কী চাও। ওই নেকলেসটা। ওটা নেই এখানে, কাজেই, যেতে পারো এবার।
তা হলে কোন ব্যাঙ্কে কিংবা জুয়েলারের দোকানে আছে, শান্ত কণ্ঠে বলল জিহাভো। মিস মারভেল ফোন করে ওটা আনাতে পারবে।
না, ওটা…
জিনা! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। বোলো না!
জিনার ওপর থেকে চোখ সরে গেল জিহাভোর, নীরবে এক মুহূর্ত দেখল কিশোরকে, তারপর আবার জিনার দিকে ফিরল।
ব্যাঙ্কে নেই, না? জিহাভো বলল। জুয়েলারের দোকানেও না? তা হলে কোথায়? এত দামী একটা জিনিস কোথায় থাকতে পারে? হাত নেড়ে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করল ছেলেদেরকে। তারপর এসে দাঁড়াল জিনার একেবারে সামনে। তুমি জানো। কোথায়?
পিছিয়ে গেল জিনা। জানি না।
নিশ্চয় জানো, হঠাৎ বাঁ হাতে জিনার কাধ খামচে ধরল জিহাভো। কোথায়?
হাত সরান! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ছাড়ন! ছাড়ন ওকে।
আমি বলব না! জিনাও চেঁচাল। বলব না!
বলবে, কাধ ধরে জিনাকে ঝাঁকাতে শুরু করল লোকটা।
ছাড়ুন বলছি! নইলে ভাল হবে না! রবিনও চেঁচিয়ে উঠল। পিস্তলের জন্যে সামনে বাড়তে সাহস করছে না।
গ্যারাজ থেকে ঘোড়ার উত্তেজিত চিহিহিহি শোনা গেল। জিনা। বিপদে পড়েছে, কল করে জানি টের পেয়ে গেছে কমেট।
আরে! কী ব্যাপার! ভুরু কোঁচকাল জিহাভো।
ঘোড়ার ডাক চেনেন না? খেঁকিয়ে উঠল জিনা।
চিনি, নিশ্চয় চিনি! আনমনে মাথা দোলাল জিহাভো। সারাদিন ঘোড়া নিয়েই থাকো, দিনের মধ্যে অসংখ্য বার গ্যারাজে ঢুকতে দেখেছি। তোমাকে…ওখানেই বেধে রাখো, না?
চুপ করে রইল সবাই।
গ্যারাজ! বলে উঠল জিহাভো। হ্যাঁ, গ্যারাজেই আছে! ঘোড়াটার অগোচরে কেউ সরাতে পারবে না ওটা। ভাল বুদ্ধি করেছ!
ঝটকা দিয়ে কাধ ছাড়িয়ে নিল জিনা।
বেরোও। আদেশ দিল জিহাভো। সবাই!
আবার ডেকে উঠল ঘোড়া।
বেরোও! ধমকে উঠল জিহাভো। কোথায় রেখেছ হারটা, দেখাও!
না! চোখে পানি এসে গেছে জিনার।
যা বলছে করো, জিনা, কিশোর বলল। তোমার শরীর বুলেটপ্রুফ।
হ্যাঁ, দেখাও, রবিনও বলল। নিয়ে বেশিদূর যেতে পারবে না ও।
সেটা দেখা যাবে, পিস্তল নাচাল জিহাভো।
পেছনের আঙিনায় বেরিয়ে এল ওরা। গ্যারাজের দরজা ফাঁক হয়ে আছে। গিয়ে টেনে পুরো খুলে দিল কিশোর।
কোথায় ওটা? ভুরু নাচাল জিহাভো।
জবাব দিল যেন কমেট, বিরাট মাথাটা ঝাঁকিয়ে জিনার দিকে চেয়ে ডেকে উঠল।
গ্যারাজের ভেতরে চেয়ে আছে জিহাভো। কোথায় আছে! গামলায় নয়, ঘাসের মধ্যে নয়, তা হলে খেয়ে ফেলতে পারে ঘোড়া। তা হলে? ওট বিন…হা হা, ওট বিনের টিনে!
স্থির হয়ে গেল জিনা।
তা হলে ওট বিনেই আছে! জিনার পরিবর্তন লক্ষ করেছে জিহাভো। টিনে।
চারজনকেই গ্যারাজে ঢোকার হুকুম দিল জিহাভো। পেছনে ঢুকল সে। এবার বের করো, জিনাকে বলল, শীতল কণ্ঠস্বর! চালাকির চেষ্টা করলে ঘাড় ভেঙে দেব।
আস্তে করে হাত বাড়াল মুসা, তার দিকে পেছন ফিরে রয়েছে। জিহাভো। ঘোড়ার বাধন খুলতে শুরু করল সাবধানে।
বের করো! ধমকে উঠল জিহাভো। জিনার এক হাত ধরে মুচড়ে নিয়ে এল পিঠের ওপর।
উহ্ উহ্, ব্যথা পাচ্ছি! ছাড়ুন! ককিয়ে উঠল জিনা।
গিঁট খুলে দিয়ে সরে গেল মুসা। ধীরে ধীরে মাথার সঙ্গে কান লেপ্টে ফেলছে আপালুসা।
কমেট, ধরো! আচমকা চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
লাফিয়ে পেছনের দুপায়ের ওপর খাড়া হয়ে গেল কমেট। চেঁচিয়ে। উঠল প্রচণ্ড রাগে।
জিনার হাত ছেড়ে দিয়ে এক লাফে সরে দাঁড়াল জিহাভো। খবরদার! পিস্তল তুলল সে ঘোড়ার দিকে।
না, না! বলতে বলতেই জিহাভোর হাতে থাবা মারল জিনা।
বদ্ধ জায়গায় গুলি ফোঁটার বিকট আওয়াজ হলো। মনে হলো, ধসে পড়বে গ্যারাজটা। কারও কোন ক্ষতি করল না বুলেট, মেঝেতে বাড়ি খেয়ে পিছলে গিয়ে বিধল দেয়ালে, আস্তরণ খসিয়ে দিল খানিকটা জায়গার।
কমেটের সামনের পা খটাস করে আবার মেঝেতে পড়েছে। মাথা দোলাল সামনে। মুগুর দিয়ে বাড়ি মারল যেন কেউ জিহাভোকে। উড়ে গিয়ে বাড়ি খেল দেয়ালের সঙ্গে। কিন্তু পিস্তল ছাড়ল না হাত থেকে। আবার তুলতে শুরু করল গুলি করার জন্যে।
এক লাফে কাছে গিয়ে দাঁড়াল কমেট। বড় বড় দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল পিস্তল ধরা হাত। চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে অস্ত্রটা ছেড়ে দিল জিহাভো। খটাস করে মেঝেতে পড়ল পিস্তল। কমেটের পায়ের ফাঁক দিয়ে ঢুকে চট করে ওটা তুলে নিয়ে এল কিশোর।
জিনা! চেঁচিয়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। ঘোড়াটাকে সরাও!
ছুটে গিয়ে ঘোড়ার গলা পেঁচিয়ে ধরল জিনা। হয়েছে, মেয়ে, এবার ছাড়ো। শান্ত হও।
কামড় ছাড়ল ঘোড়া।
ধপ করে গ্যারাজের কোণে বসে পড়ল মহাগুরু, ক্লান্ত, আহত, বিধ্বস্ত। কাটা জায়গা চেপে ধরল আরেক হাতে। হাঁপাচ্ছে। কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোচ্ছে গলা দিয়ে।
চুপচাপ বসে থাকুন, পিস্তল তুলে ধরেছে কিশোর। নিশানা মোটেই ভাল না আমার, তবে এত কাছে থেকে মিস করব না। বাই চান্স বুকে কিংবা কপালে লেগে যেতে পারে।
নীরবে আহত হাত চেপে ধরে বসে রইল জিহাভো।
আমি যাই, দরজার কাছে চলে গেছে রবিন। ক্যাপ্টেনকে ফোন করতে হবে। পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাবেন।
অত তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে, বোলো, খুশি খুশি গলায় বলল কিশোর। কমেটের সামনে দিয়ে পালাতে পারবে না।
জিনা হাসল। বিচিত্র শব্দ করল কমেট।
হাসল না তো! জিনার দিকে তাকাল মুসা। সেদিনই মনে হয়েছিল আমার, ঘোড়া কামড়ায়। মেরি চাচী বললেন, না! ভাগ্যিস কাছে যাইনি! ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকাল মুসা, নিজের অজান্তেই পিছিয়ে গেল এক পা।
তেইশ
এসো, এসো, তিন গোয়েন্দাকে দেখেই ডাকলেন হলিউডের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার। তোমাদের জন্যেই বসে আছি। বসো।
বিশাল টেবিলে পড়ে আছে এক গাদা খবরের কাগজ, তার ওপাশে পরিচালকের গলার ওপরের অংশ শুধু দেখা যাচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসে বোমা বিস্ফোরণের খবর পড়েছি। জানলাম, রকি বিচের তিনজন কিশোর ছিল তখন ওখানে, আর একটা মেয়ে। সন্দেহ হলো, তোমরা ছাড়া কেউ না। তাই সেক্রেটারিকে বলেছি তোমাদের ডাকতে।
মোটা একটা ফাইল বাড়িয়ে দিল রবিন। ঠিকই অনুমান করেছেন, স্যর, আমরাই ছিলাম।
কোন কেস? ফাইল খুলতে শুরু করলেন চিত্রপরিচালক।
নীরব ঘর, মাঝে মাঝে শুধু ফাইলের পাতা ওল্টানোর শব্দ, গভীর মনোযোগে পড়ছেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। অবশেষে মুখ তুললেন, সব নেই এখানে।
বাকিটুকু বলেনি কিশোর পাশা, রবিন জানাল।
কী মানুষ ওরা! নাক কোচকালেন চিত্রপরিচালক। কিশোর, ধোয়ার ওপরে সাপের ছবি কী করে তৈরি করল, বুঝেছ?
হ্যাঁ, স্যর, মাথা নোয়াল কিশোর। সিনেমা প্রোজেক্টর। রঙিন একটা খেলনা সাপের ফিল্ম তৈরি করেছে। আগুনে কেমিকেল পুড়িয়ে ধোয়া সৃষ্টি করে তাতে ফেলেছে সাপের ছবি। এর জন্যে স্পেশাল গ্লাস ব্যবহার করেছে ওরা। ধোয়ার পর্দার মধ্যে দর্শকদের মনে হয়েছে, জ্যান্ত সাপ দেখেছে। একটু থেমে বলল, তোমাদেরকেও বোকা বানিয়ে ফেলেছিল। পরে ভালমত চিন্তাভাবনা করতেই বুঝে গেছি আসল ব্যাপারটা।
আর গান?
ওটা ভ্যারাডের কাজ। প্রথমে ভেবেছি, টেপরেকার ব্যবহার করেছে। কিন্তু পরে বুঝলাম, যন্ত্র নয়, নিজেই শব্দটা করেছে। ভেনট্রিলোকুইজম। শব্দ আর সুর ব্যবহারের বাহাদুরি আছে তার, স্বীকার করতেই হবে। বিকট গান প্রোজেক্টরের ঝিরঝিরও ঢেকে দিয়েছে। আউরোও এই ব্যাপারে ওস্তাদ।
সে-ও ভেনট্রিলোকুইস্ট?
হ্যাঁ, স্যর। ডক্টর স্মিথের কাছে টেপ করা আছে ভ্যারাডের বিকট গান, সেটা শুনে শুনে প্র্যাকটিস করে নিয়েছে আউরো। মিস মারভেলের। চিকিৎসা করার সময় ব্যবহার করেছে।
আউরো খুব চালাক। মিস মারভেলকে কীভাবে যে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ল! আমি শিওর, তার গাউনের অন্য পকেটে আরেকটা সবুজ থলে ছিল। গড়াগড়ি করার সময় হাত সাফাই করে কোন এক ফাঁকে সাপভরা। থলেটা পকেটে চালান করে দিয়ে, খালি থলেটা বের করে নিয়েছে।
ওঝাদের পুরানো কৌশল, বললেন চিত্রপরিচালক। তা, ডক্টর স্মিথের এত আগ্রহ কেন মিস মারভেল আর প্রেতসাধকের ব্যাপারে, জিজ্ঞেস করেছ?
কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানসিক রোগীদের ওপর একটা বই লিখতে যাচ্ছেন তিনি, বলল কিশোর। লস অ্যাঞ্জেলেসে নাকি আজকাল বড় বেশি ছড়িয়ে পড়েছে এসব, লোককে হুঁশিয়ার করে দিতে চান। তাই, ব্ল্যাক ম্যাজিকের গন্ধ পেলেই ছুটে যান তিনি সেখানে, ঝুঁকিও নিতে হয়। অনেক সময়। সাধকরা বাইরের লোককে বৈঠকে ঢুকতে দেয় না, ফলে। লুকিয়ে-চুরিয়ে কাজ সারতে হয় ডক্টরকে। ওরা কী করে না করে, দেখেন; দরকার মনে করলে তাদের কথাবার্তা, মন্ত্র, গান টেপ করে নেন, পরে গবেষণার জন্যে।
ওই কারণেই মিস মারভেলের প্রতি তার আগ্রহ? হ্যাঁ। এতবড় বাড়ি পারকারদের, কাজের লোকও নেই, সুযোগ পেয়ে গেলেন ডক্টর। তাই কাজের লোকের ছদ্মবেশে কাছে কাছে থাকতে চেয়েছেন তিনি। আমরা মাঝখান থেকে গিয়ে পড়ে ভণ্ডুল করে দিয়েছি। সব।
ও না থাকলে বিপদে পড়তে, বললেন চিত্রপরিচালক। গুলি
হ্যাঁ, স্যর, রবিন বলল। তবে মুসা যেদিন দেয়াল থেকে পড়ল, সেদিন বোধহয় ছিলেন না উনি।
হাসলেন পরিচালক। ঠিক। তবে মুসা না থাকলে তোমরাও জিহাভোর হাত থেকে মুক্তি পেতে না। অন্তত নেকলেসটা তো যেতই। ও-ই বুদ্ধি করে কমেটের বাধন খুলে দিয়েছিল।
হাসি ফুটল মুসার মুখে।
হ্যাঁ, একটা ব্যাপার, হাত তুললেন পরিচালক। ওই গ্যারাজের ওপরে বাসা ভাড়া নিতে গেল কেন ডক্টর? তার তো ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারই আছে।
রকি বিচ থেকে বাসাটা কাছে, তাই, বলল কিশোর। জিজ্ঞেস করেছিলাম; তিনি বললেন, ওখান থেকে যখন খুশি চলে আসতে পেরেছেন পারকার হাউসে।
আউরোকে জোগাড় করল কোত্থেকে?
আউরো তার স্ত্রী। জিপসি, ওঝাদের কাজকারবার দেখে দেখে অভ্যস্ত মহিলা। তাই ছদ্মবেশ নিতে আর অভিনয় করতে কোন অসুবিধে হয়নি।
হুম! আচ্ছা, ডক্টর জিহাভোর আসল পরিচয় জানা গেছে?
গেছে, স্যর, জবাব দিল মুসা। নাম্বার ওয়ান ক্রিমিনাল, আসল নাম হগ রিমার। চুরি, জালিয়াতি, বাটপাড়ি, পকেট মারা, সব ব্যাপারে ওস্তাদ। ভ্যারাড আর রড তার সহকারী, অনেক দিন থেকেই। সব কজনের নাম আছে পুলিশের খাতায়। মেকসিকো আর নিউ ইয়র্কের পুলিশ অনেক দিন থেকে খুঁজছে ওদের। টাকার জন্যে সব করতে পারে ব্যাটারা, এমনকী খুনও।
হুঁ। জিনার খালার খবর কী?
ভাল অনেকটা। শিগগিরই নাকি আউরোর সঙ্গে আবার দেখা করতে যাবেন। চিকিৎসা করাতে, রবিন জানাল।
এসব মানুষ নিয়ে ভয়। লোককে অযথা বিপদে ফেলে দেয়।
হ্যাঁ, মিস পলের পা ভাঙার জন্যে তিনি কিছু হলেও দায়ী। তবে প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে, যে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন! জিনাকে পাঠিয়ে র্যামন ক্যাসটিলোর ক্রিস্টাল বলটা কিনিয়েছেন, ওটা উপহার পাঠিয়েছেন মিস পলকে।
ভাল। জিনার কী খবর?,
হোস্টেলে চলে যাবে, শিগগিরই। গেলে বাঁচি। ওর তো মুখের ঠিক-ঠিকানা নেই, আর এত মিছে কথা বলতে পারে! ওদিকে শুঁটকি টেরিরও আসার সময় হলো, কোন দিন রেগেমেণে গিয়ে তাকে আমাদের গোপন পথগুলোর খবর জানিয়ে দেবে, কে জানে!
খুব জেদি মেয়ে। এরা কিন্তু একদিক থেকে ভাল হয়। দলে টানতে পারো যদি, দেখো, বিপদের সময় তোমাদের জন্যে দরকার পড়লে প্রাণ দিয়ে দেবে। নিয়ে এলে না কেন ওকেও?
আসার সময় দেখলাম, ঘোড়া নিয়ে সৈকতে চলেছে, তাই আর ডাকলাম না, কিশোর বলল।
এই সুযোগে ঘোড়ায় চড়াটা শিখে নাও না তার কাছে? কাজে লাগবে, দেখো, পরে।
আমি বাদ, স্যর, দুহাত দুদিকে নাড়ল মুসা। আরিব্বাপ রে, যে কামড় মারে! আর লাথি!
মুসার কথার ধরনে হেসে ফেললেন স্বভাবগম্ভীর মানুষটাও।
আজ তা হলে উঠি, স্যর? কিশোর উঠে দাঁড়াল।
মুসা, মিটিমিটি হাসছেন পরিচালক। আইসক্রিম?
উঠে দাঁড়িয়েছিল, বসে পড়ল আবার মুসা। খুশিতে দাঁত বেরিয়ে। পড়েছে। তা, স্যর, আনাতে পারেন!
নিষ্পাপ সুন্দর হাসিতে ভরে গেছে মিস্টার ক্রিস্টোফারের কুৎসিত মুখটা। ইন্টারকমের বোতাম টিপলেন।