Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » প্রাণ-পিপাসা || Samaresh Basu

প্রাণ-পিপাসা || Samaresh Basu

এক কৃষ্ণপক্ষের দুর্যোয়ময়ী রাতের কথা বলছি।

দুর্যোগটা হঠাৎ মেঘ করে হাঁক ডাক দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে মুষলধারে দুএক পশলা হয়ে যাওয়ার মতো নয়। একঘেয়ে রুগ্ন গলার কান্নার মতো কয়েকদিন ধরে অবিরাম ঝরছেই বৃষ্টি, তার সঙ্গে পুব হাওয়ার একটানা ঝড়। শহরতলীর বড় সড়কটি ছাড়া আর সব কাঁচা গলিপথগুলো সুদীর্ঘ পাঁক ভরা নর্দমা হয়ে উঠেছে। দুর্গন্ধ আর আবর্জনায় ছাওয়া। অসংখ্য বাড়ির ভিড়, ঠাসা চাপাচাপি।

পথ চলছিলাম রেল লাইনের ধারে মাঠের পথ দিয়ে। কিন্তু ভিজে ভিজে শরীরের উত্তাপটুকু আর বাঁচে না। হাওয়াটা মাঠের উপর দিয়ে সরাসরি এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল শরীরটা। রীতিমতো দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হচ্ছে। বেগতিক দেখে বাঁয়ে মোড় নিয়ে শহরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। অন্তত হওয়ার ঝাপটাটা কম লাগবে তো!

একটা নিস্তব্ধ ঝিমিয়ে পড়া ভাব চটকল শহরটার। যেন কাজ এবং চাঞ্চল্য সবটুকু এই অবিরাম বৃষ্টি ভিজিয়ে ন্যাতা করে দিয়েছে। কুকুরগুলো অন্যদিন হলে বোধ হয় তেড়ে এসে ঘেউ ঘেউ করত। আজ দায়সারা গোছের এক-আধবার গরগর করে গায়ের থেকে জল ঝাড়তে লাগল। গেরস্থদের তো কোনও পাত্তাই নেই। কোনও জানলা দরজায় একটি আলোও চোখে পড়ে না। রাস্তার আলোগুলো যেন কানা জানোয়ারের মতো স্তিমিত এক চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু অন্ধকার তাতে কমেনি একটুও।

রাস্তাটা ঠিক ঠাওর করতে পারছি না, তবে উত্তর দিকেই চলেছি তা বুঝতে পারছি। একটা ধার ঘেঁষে চলেছি রাস্তার। নিচু রাস্তা, জল জমেছে। কোনও বারান্দায় যে উঠে রাতটা কাটিয়ে দেব তার কোনও উপায়ই নেই। কারণ বারান্দা বলতে যা বোঝায়, এখানে সে রকম কিছু ঠিক চোখেও পড়ছে আর বস্তিগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ভেতরে ঘরগুলোও বোধ হয় শুকনো নেই। তা ছাড়া, অবস্থাটা তো নতুন নয়। জানা আছে, যেখানে সেখানে শুয়ে পড়লে তোকজনেও নানানখানা বলতে পারে। পুলিশের বেয়াদপি তো আছেই তার উপর।

যেতে হবে নৈহাটি রেল কলোনির এক বন্ধুর কাছে। অন্তত কয়েকটা দিনের খোরাক, শুকনো কাপড় একখানি আর এমন বিদঘুটে প্যাচপেচে ঠাণ্ডা রাতটার জন্য একটু আশ্রয় লো পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন দেখছি আজ্ঞা ছেড়ে না বেরুনোই ভাল ছিল। তবে উপায় ছিল না। বিশেষ করে, কয়েকদিন আগে আমাদের আড্ডার হা-ভাতে বন্ধুদের মধ্যে একজন যখন মরে গেল, তখন থেকেই একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ব ভাবছিলাম। বন্ধুটির মরা হয় তো ভালই হয়েছে। তা ছাড়া আর কী হতে পারত আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। বাঁচার জন্য যা দরকার তার কিছুই তো ছিল না, তবু বুকটার মধ্যে…যাক। ওটা কোনও কথা নয়। কিন্তু সে আমাকে একটা জিনিস দিয়ে গেছে, ছোট্ট জিনিস অথচ মনে হয় পর্বতপ্রমাণ, তার ভার আরও কষ্টকর। বোঝাটা হল…

আরে বাপ রে, হাওয়াটা যেন শিরদাঁড়াটার ভিত ধরে নাড়া দিয়ে গেল। জলটাও বেড়ে গেল হঠাৎ। এতক্ষণ পরে মেঘের গড়গড়ানিও যাচ্ছে শোনা। এবার আর দাঁত নয়, রীতিমতো হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগছে। গাছের মরা ডালের মতো ভিজে একেবারে ঢোল হয়ে গেছি। এসে পড়লাম একটা চৌরাস্তার মোড়ে, চটকলের মাল চালানের রেল সাইডিং-এর পাশে। জায়গাটা একটু ফাঁকা। কাছাকাছি একটা মোষের খাটাল দেখে ঢুকব কি না ভাবতে ভাবতে আর একটু এগুতেই হঠাৎ একটা ডাক শুনতে পেলাম, এই যে, এ-দিকে।

না, অশরীরী কিছু বিশ্বাস না করলেও ভয়ানক চমকে উঠলাম। আমাকে নাকি? জলের ধারা ভেদ করে গলার স্বরের মালিককে খুঁজতে লাগলাম। ডানদিকে একটা মিটমিটে আলোর রেশ চোখে পড়ল আর আধ ভেজানো দরজায় একটা মূর্তি। হ্যাঁ, মেয়েমানুষ। তা হলে আমাকে নয়। এগুচ্ছি। আবার, কই গো, এসোই না।

দাঁড়িয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে?

জবাব এল, তা ছাড়া কে আছে পথে?

কথার রকমটা শুনে চমকে উঠলাম। ও! এতক্ষণে ঠাওর হল পথটা খারাপ। ঠিক বেশ্যাপল্লী নয়, তবে এক রকম তাই, মজুর বস্তিও আছে আশেপাশে ধার ঘেঁষে।

আমি মনে মনে হাসলাম। খুব ভাল খদ্দরকে ডেকেছে মেয়েটা। তাই ভেবেছে নাকি ও? কিন্তু সত্যি, এ সময়টা একটু যদি দাঁড়ানোও যেত ওর দরজায়টায়। তবু আমাকে যেতে না দেখে মেয়েটা বলে উঠল, কীরে বাবা, লোকটা কানা নাকি? মনে মনে হেসে ভাবলাম, যাওয়াই যাক না। ব্যাপার দেখে নিজেই সরে পড়তে বলবে। আর কোনওরকমে বৃষ্টির বেগটা কমে আসা পর্যন্ত যদি মাথার উপরে একটু ঢাকনা পাওয়া যায়, মন্দ কি। এমনিতেও নৈহাটি দূরের কথা, মোষের খাটালের বেশি কিছুতেই এগুনো চলবে না। আপনি বাঁচলে বাপের নাম প্রবাদে যারা বিশ্বাস করে না তারা এ রকম অবস্থায় কখনও পড়েনি।

উঠে এলাম মেয়েটার দরজায়। একটা গতানুগতিক সংকোচ যে না ছিল তা নয়। বললাম, কেন ডাকছ?

কোন্ দেশি মিসে রে বাবা। হাসির সঙ্গে বিরক্তি মিশিয়ে বলল সে, ভেতরে এসো না।

আমি ভিতরে ঢুকতেই সে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টির শব্দটা চাপা পড়ে গেল একটু। হাওয়াটা আসবার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু দেখলাম এ ঘরের মেঝেও টালির ফাঁক দিয়ে জল পড়ে ভিজে গেছে। তক্তপোশের বিছানাটা ভেজেনি। ঘরের মধ্যে আছে দু-চারটে সামান্য জিনিস থালা গেলাস কলসি।

কোথায় মরতে যাওয়া হচ্ছে দুর্যোগ মাথায় করে? এমনভাবে বলল সে যেন আমি তার কতকালের কত পরিচিত।

বললাম, অনেক দূর, কিন্তু

বুঝেছি। মুখ টিপে হাসল সে। ঘরটা তুমি একেবারে কাদা করে দিলে। এগুলো ছেড়ে ফেলল জলদি।

ঠাণ্ডায় আর আচমকা ফ্যাসাদে রীতিমতো জমে যাওয়ার জোগাড় হল আমার। বললাম, কিন্তু এদিকে

সে বলে উঠল, কী যে ছাই পরতে দিই! ভেজা জামাটা খুলে ফেলো না।

ফেলতে পারলে তো ভালই হয়। কিন্তু…গলায় একটু জোর টেনে বলেই ফেললাম, মিছে ডেকেছ, এদিকে পকেট কানা।

এবার মেয়েটা থমকে গেল। যা ভেবেছি তাই। হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে খানিকক্ষণ। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করল, কিছু নেই?

তার সমস্ত আশা যেন ফুকারে নিভে গেছে এমন মুখের ভাবখানা।

বললাম, তা হলে আর দুর্যোগ মাথায় করে পথে পথে ফিরি?

মেয়েটা অসহায়ের মতো চুপ করে রইল। এ তো আমি আগেই জানতাম। কিন্তু মেয়েটা এখানে ব্যবসা করতে বসেছে, না, ভিক্ষে করতে বসেছে। আমি দরজাটা খুলতে গেলাম।

পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে এখন?

বললাম, ওই মোষের খাটালটায়। দরজাটা খুলে ফেললাম। ইস! হাওয়াটা যেন আমাকে হাঁ। করে খেতে এল। পা বাড়িয়ে দিলাম বাইরে।

মেয়েটা হঠাৎ ডাকল পেছন থেকে, কই হে, শোনো। রাত্তিরটা থেকেই যাও, ডেকেছি যখন। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কপালটাই খারাপ আমার।

বললাম, কেন, কপালটা ভালই থাকুক তোমার। আমি খাটালেই যাই।

–যা তোমার ইচ্ছে। হতাশভাবে বসে পড়ল সে তক্তপোশে।—আজ তো আর কোনও আশাই নেই।

ভাবলাম, মন্দ কী? এই দুর্যোগে এমন আশ্ৰয়টা যখন পাওয়াই যাচ্ছে, কেন আর ছাড়ি। কিন্তু মেয়েমানুষের সঙ্গে রাত কাটানোটা ভারী বিশ্রী মনে হল। কেননা, এটা একেবারে নতুন আমার কাছে। অবশ্য মেয়েমানুষ সম্পর্কে আমার আগ্রহ এবং কৌতূহল তোমাদের আর দশজনের চেয়ে হয় তো একটু বেশিই আছে। তা বলে এখানে? ছি ছি। সে আমি পারব না।…তবে ওর সঙ্গে না শুয়েও রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যায়। ভেতরে ঢুকে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলাম।

লম্বা ছেয়ালো গড়ন মেয়েটার। মাজা মাজা রং। গাল দুটো বসা, বড় বড় চোখ দুটো অবিকল কচি ঘাস সন্ধানী গরুর চোখের মতো। ওই চোখে-মুখে আবার রং, কাজল মাখা হয়েছে। মোটা ঠোঁট দুটোর উপরে নাকের ডগাটা যেন আকাশমুখো।

খুঁজে খুঁজে সে আমাকে একটা পুরনো সায়া দিল পরতে, বলল এইটে ছাড়া কিছু নেই।

সায়া? হাসি পেল আমার। যাক, কেউ তো দেখতে আসছে না। কিন্তু

ধ্বক করে উঠল আমার বুকটার মধ্যে। তাড়াতাড়ি পকেটে চাপ দিলাম আমি। মরবার সময় আমার বন্ধু যে ছোট্ট জিনিসটা পর্বতের বোঝার মতো চাপিয়ে দিয়ে গেছে সেটা দেখে নিলাম। জিনিস নয়, একটা রক্তের ডেলা। হ্যাঁ, রক্তের ডেলাই। ভীষণ সংশয় হল আমার মনে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকালাম। সে তখন পেছন ফিরে জামার ভিতরে বডিস খুলছে। বললাম, কিছু কিন্তু নেই আমার কাছে, হ্যাঁ।

কবার শোনাবে বাপু আর ওই কথাটা? সে হতাশভাবে বলল।

হ্যাঁ বাবা। বললাম, বলে রাখা ভাল। তবে আমার কোনও ইচ্ছে নেই কিছু। খালি মুসাফিরের মতো রাতটা কাটিয়ে দেওয়া।

মেয়েটা ওর গরুর মতো চোখ তুলে এক দৃষ্টে দেখল আমাকে। বলল, কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিচ্ছে?

তা বটে। আমি সায়াটা পরে নিলাম। কিন্তু খালি গায়ে কাঁপুনিটা বেড়ে উঠল। বাইরে জল আর হাওয়ার শব্দ দরজাতে বেশ খানিকটা আলোড়ন তুলে দিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে একপ্রস্থ হেসে নিয়ে একটা পুরনো শাড়ি দিল ছুড়ে। নাও, গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো।

বলে আমার জামা কাপড় দড়িতে ছড়িয়ে দিল। বলল, একটু আঁসিয়ে যাবেখন।

আরাম জিনিসটা বড় মারাত্মক, বিশেষ এরকম একটা দুরবস্থার মধ্যে। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম যে, আমি একটা বাজারের মেয়েমানুষের ঘরে আছি। বললাম, পেটটা একেবারে ফাঁকা দু-দিন ধরে, তাই এত কাবু করে ফেলছে জলে।

সে কোনও জবাব দিল না। হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রইল। বললাম, তা হলে শোয়া যাক।

সে মুখ তুলল। মুখটা যন্ত্রণাকাতর, তার সুস্পষ্ট বুকের হাড়গুলো নিশ্বাসে ওঠানামা করছে। বলল, খাবে? ভাত চচ্চড়ি আছে।

ভাত চচ্চড়ি? সত্যি, এটা একেবারেই আশাতীত। ভাতের গন্ধেই যার অর্ধেক পেট ভরে, তার সামনে ভাত। জিভটাতে জল কাটতে লাগল আর পেটটা যেন আলাদা একটা জীব। ভাত কথাটা শুনেই ভেতরটা নড়ে চড়ে উঠল। কিন্তু

সে ততক্ষণ টিনের থালায় ভাত বাড়তে শুরু করেছে। দেখে, আমার মনের সংশয়টা আবার বেড়ে উঠল। আমি দড়ির উপর থেকে জামাটা তুলে নিলাম তাড়াতাড়ি। গতিক তো ভাল মনে হচ্ছে না। সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, ভাতের পয়সা-টয়সা কিন্তু নেই আমার কাছে।

গরুর মতো চোখ দুটোতে এবার বিরক্তি দেখা গেল। বলল, মোষের খাটালেই তোমার জায়গা দেখছি। কবার শোনাবে কথাটা।

.

সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। হতভাগা মরবার সময় এমন জিনিসই দিয়ে গেল এখন সেই বোঝা নিয়ে আমার চলাই দায়। রাখাও বিষ, ছাড়াও বিষ। বাইরে পড়ে থাকলে এ বোঝাটার কথা হয় তো মনেই থাকত না। সে আবার বলল, মানুষের সঙ্গে বাস করোনি তুমি কখনও?

শোনো কথা। তাও আবার জিজ্ঞেস করছে কারখানা বাজারের মেয়েমানুষ। বললাম, করেছি, তবে তোমাদের মতো মানুষের সঙ্গে নয়।

সে নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে খানিকক্ষণ। তার পর বলল, রয়েছে যখন খেয়ে নাও, নইলে নষ্ট হবে। ভেবে দেখলাম, তাতে আর আপত্তি কী? বিনা পয়সায় ভাত। আর দেখছেই বা কে। জামাটি হাতে গুটিয়ে নিয়ে গপগপ করে ভাত খেয়ে নিলাম, তার পর এক ঘটি জল। এ রকম বাড়া ভাত খেয়ে ব্যাপারটা আমার কাছে চুড়ান্ত বাবুগিরি বলে মনে হল আর সেই জন্যই সংশয়টা বাঁধা রইল মনের আষ্টেপৃষ্ঠে।

তার পর শোয়া। সে এক ফ্যাসাদ। আমি শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি শশাবে কোথায়? সে নিরুত্তরে আমার দিকে তাকিয়ে খসা ঘোমটাটা টেনে দিল। তা হলে তুমি শোও, আমি বসে রাতটা কাটিয়ে দিই। আমি বললাম।

সে পাশতলার দিকে বসে বলল, তুমিই শোও, আমি তো রোজই শুই। একটা রাত তো। ডেকেছি যখন….

বলতে বলতে আমার হাতের মুঠির মধ্যে জামাটা দেখে সে দড়ির দিকে দেখল। তার পর আমার দিকে। আমিও তাকিয়েছিলাম। বলল, জামাটা ভেজা যে।

হোক। তাতে তোমার কী?

চুপ করে গেল সে। শরীরটা আরাম পেতে আমার মনে হল, সিটোনা তথ্রীগুলো স্বাভাবিক সতেজ ও গরম হয়ে উঠছে। বাইরের যে জল-হাওয়া আমাকে এতক্ষণ মেরে ফেলতে চেয়েছিল, তারই চাপা শব্দ যেন আমার কাছে ঘুমপাড়ানি গানের মতো মিষ্টি মনে হল। চোখের পাতা ভারী হয়ে এল বেশ।

ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তেমনি বসে আছে। চোখের দৃষ্টিটা ঠিক কোন দিকে বোঝা যাচ্ছে না। অত্যন্ত ক্লান্ত আর একটা চাপা যন্ত্রণার আভাস তার চোখে। কী জানি। এদের নাকি আবার ঢং-এর অভাব হয় না। হয় তো ঘুমিয়ে পড়ব, তখন—

.

নাঃ হতভাগার এ জিনিসটার একটা ব্যবস্থা আমি কালকেই করে ফেলব। কী দরকার ছিল মরবার সময় আমাকে এটা দিয়ে যাওয়ার? একটা রক্তের ডেলা! রক্তের ডেলাই তো। ঘামের গন্ধে ভরা ছোট্ট ন্যাকড়ার পুঁটলিটা। একটা রাক্ষুসে খিদে খিদে গন্ধও আছে। ছেড়া মরতে মরতে মুখের কষ বওয়া রক্ত চেটে নিয়ে বলল, এটা তুই রাখ।

এমনভাবে বলেছিল কথাটা যে, আজও মনে করলে বুকটার মধ্যে; যাক সে কথা।

মেয়েটা তখনও ওইভাবে বসে আছে দেখে হঠাৎ বলে ফেললাম, তুমিও শুয়ে পড়ো খানিকটা তফাত রেখে।

সে আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। বলল, ছিষ্টিছাড়া মানুষ বাবা।

তার পর শুয়ে পড়ল।

আমার শরীরটা তখন আরামে রীতিমতো ঢিলে হয়ে এসেছে। আর মেয়েমানুষগুলো গা যে এত গরম তা মেয়েটার কাছ থেকে বেশ খানিকটা তফাতে থেকেও আমি বুঝতে পারলাম। কী অদ্ভুত রাত আর বিচিত্র পরিবেশ! লোকে দেখলে কী বলত! ছি ছি। কিন্তু এতখানি আরাম, দুঃস্থ ক্লান্ত শরীরে এতখানি সুখবোধ আর কখনও পেয়েছি কি না মনে নেই। ঘুমে ঢুলে আসছে চোখ। কিন্তু——

নাঃ তা হবে না। সেই বন্ধুটির কথা বলছি। হতচ্ছাড়া মরবার সময় বলে গেল পুঁটলিটা দিয়ে, আমার রক্ত।

বললাম, রক্ত কীসের?

চোখের জল আর কষের রক্ত মুছে বলল, আমার বুকের। না খেয়ে খেয়ে রোজ

বলতে বলতে রক্তশুন্য অস্থির আঙ্গুলগুলো দিয়ে হাতাতে লাগল পুঁটলিটা।

আমি রাগ সামলাতে পারলাম না। বললাম, বানচোত কীসের জন্য র‍্যা?

বলল, ঘর বাঁধার আশায়।

এমনভাবে বলেছিল কথাটা যে ফের গালাগালি দিতে গিয়ে আমার গলাটার মধ্যে…

.

যাক সে কথা।

মেয়েটা একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে উঠল।

জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?

সে তাকাল। চোখ দুটো যেন যন্ত্রণায় লাল আর কান্নার আভাস তাতে। বলল, কিচ্ছু না।

তার গরম নিশ্বাসে এত আরাম লাগল আমার গায়ে। ঠাণ্ডা জমে যাওয়া গায়ে যেন কেউ তাপ বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হল হঠাৎ, খুব খারাপ নয় দেখতে। ঠোঁট আর নাকটা যা একটু খারাপ। বোজা চোখের পাতা, বুকে জড়ানো হাত দুটো আর তার নমিত বুক বিচিত্র মায়ার সৃষ্টি করল। সে জিজ্ঞেস করল আমাকে, ঘুম আসছে না তোমার?

আমি ঘুমুব না। বললাম। মনে মনে ভাবলাম, তা হলে তোমার বড় সুবিধে হয়, না? সেটি হচ্ছে না বাবা। কথা বললেই তো সংশয়টা বাড়ে আমার মনে। তার চেয়ে চুপ করে থাকুক না।

বাইরের তাণ্ডব তখনও পুরো দমেই চলেছে। টালি চোঁয়ানা জলের ফোঁটার শব্দ আসছে মেঝে থেকে, সঙ্গে ছুঁচোর কেত্তন।

সে আবার ককিয়ে উঠল।

কী হয়েছে?

একটু চুপ করে থেকে সে বলল, রোগ।

রোগ! কীসের রোগ?

সে নীরব।

বলো না বাপু।

তবুও নীরব।

আমি হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলাম। বলো না কেন রোগটা। যক্ষ্মা কলেরা টলেরা হলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ি। রোগের সঙ্গে পিরিত নেই বাবা।

সেও হঠাৎ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল। কার সঙ্গে আছে তোমার পিরিত, শুনি?

তা বটে। পিরিতের কথাই তো ওঠে না এখানে। বললাম, তা বলোই না কেন রোগটা।

যা হয় এ লাইনে থাকলে। সে বললে।

লাইনে থাকলে? সর্বনাশ! ভীষণ সিঁটিয়ে গেলাম। ভয়ে ও ঘৃণায় জিজ্ঞেস করলাম, এর উপরও সন্ধ্যারাত্র

নিশ্চয়ই..

পাঁচজন। সে বলল।

ইস! কী সাংঘাতিক! বললাম, চিকিচ্ছে করাও না কেন?

পয়সা পাব কোথায়?

কেন, নিজের রোজগার?

সে তো মনিবের পয়সা।

মনিব? এটা কি চাকরি নাকি?

নয় তো? মনিবের ব্যবসা, ঘর দোর জায়গা জিনিস। আমরা আসি খাটতে।

ভয়ানক দমে গেলাম কথাগুলো শুনে। এরা বেশ মজায় থাকে না তা হলে? এও চাকরি। বললাম, মনিব শালাই বা কেমন, চিকিচ্ছে করায় না?

যখন মরজি হয়। কলের মানুষ রাতদিন কত মরছে, কলের মালিকেরা তাদের চিকিচ্ছে করায়?

ঠিক। তার বেদনার্ত শান্ত চোখের দৃষ্টি এবার আমাকে সত্যই দিশেহারা করে তুলল। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক প্রাণ দেয়, কিন্তু জীবনের এ কী প্রতিরোধের লড়াই! বললাম, তা হলে…

সে বলল, তা হলে আর কী? মনিবের চোখে ধুলো দিয়ে যেটা রোজগার হয়, তাতে চিকিচ্ছে করাই।

বাঁচতে? হাসতে গিয়ে মুখটা বিকৃত হয়ে গেল আমার।

সকলেই বাঁচতে চায়। সে বলল যন্ত্রণায় ঠোঁট টিপে।

ঠিকই। ডাঙায় বাঘ আছে জেনেও মানুষ এ ভাঙাতেই তার বাস ও জনপদ গড়ে তুলেছে। বন্যা, ঝড়, ক্ষুধা, কী নেই! তবু। আর সেই হতচ্ছাড়া চেয়েছিল ঘর বাঁধতে। হাঁ, তবু পুঁটলির প্রতিটি পয়সা রক্তের ফোঁটা। রক্তের ডেলা একটা—এই পুঁটলিটা।

সে বলল, ঘুমোবে না?

না, ঘুম নেই চোখে। ওর নিশ্বাস লাগছে। যন্ত্রণার গরম নিশ্বাস। মিঠে তাপ তেপে তেপে গনগনে আগুনের মতো মনে হল। শক্ত করে পুঁটলিসুদ্ধ জামাটা চেপে ধরে উঠে পড়লাম। বাইরে ঝড়-জলের দুর্যোগ তেমনি। রাত প্রায় কাবার। নিজের জামা কাপড় পরে নিলাম।

সে উঠল। হাসতে চাইল। চললে?

পকেটে হাত দিয়ে শক্ত করে পুঁটলিটা চেপে ধরে বললাম, হ্যাঁ।

হতভাগা মুখের কষ বওয়া রক্ত চেটে নিয়ে বলেছিল মরতে মরতে, এটা তুই রাখ। কেন? কেন?

মেয়েটা বলল যন্ত্রণার চাপা গলায়, আবার এসো।

মেয়েটার কী চোখ! সমস্ত মুখটি লাঞ্ছনার দাগে ভরা। আকাশমুখো নাক, মোটা ঠোঁট। কিন্তু এমন মুখ তো আর কখনও দেখিনি।

ভীষণবেগে ওর দিকে ফিরে পুঁটলিটা ওর হাতে তুলে দিলাম। ওর নিশ্বাস লাগল আমার গায়ে। মুহূর্তে চোখ নামিয়ে, একটা অশান্ত ক্রোধে দাঁত দাঁত ঘষে বেরিয়ে এলাম পথের উপরে।

সে কী একটা বলল পেছন থেকে। হাওয়ায় ভেসে গেল সে কথা। বললাম, পিছু ডেকো না।

বোঝা মুক্ত আমি উত্তর দিকে এগিয়ে চললাম। বাণপ্রস্থে নয়, বন্ধুর বাড়িতে। পুবে হাওয়া ঠেলে দিতে চাইল পশ্চিমে গঙ্গার ঘাটের দিকে। পারল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress