প্রথমাষ্টমী বা পড়ুয়া পূজা বা প্রৌড়া অষ্টমী (উড়িষ্যা সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গের একটি লোকাচার)
বহু প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে নানারকম লোকাচার চলে আসছে! আমাদের মেদিনীপুর জেলার উড়িষ্যা সংলগ্ন অঞ্চলে বহুকাল থেকে চলে আসছে এমন একটি প্রাচীন লোকাচার হল পড়ুয়া পূজা বা প্রথমাষ্টমী। এটি মূলত ওড়িশা লোকাচার।
এই লোকাচারে বাড়ির প্রথম সন্তানের পূজা করা হয় এই সন্তান পুত্র বা কন্যা যে কেউই হতে পারে। অর্থাৎ মায়ের প্রথম সন্তান এই পূজার অধিকারী। প্রথম সন্তান যদি মারা যায় তবে আর কেউ এই পূজা করার যোগ্য নয়। এই পূজা করা হয় তুলসী মঞ্চের সামনে ফুল ও নৈবেদ্য দিয়ে। মা বা মাতৃস্থানীয়া কেউ রাস পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই পূজা করেন। একে প্রৌডা তোলাও বলে।
কলার আঙট পাতে গোময়ের নাড়ু তৈরি করতে হয়— ছেলেদের পাঁচটি ও মেয়েদের জন্য তিনটি! এবার ওই নাড়ু তে দুব্বা ও গাঁদা ফুল দিয়ে সাজাতে হয়! অঞ্চল ভেদে ওই নাড়ুতে সর্ষেফুল ও মুলা ফুল দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে! প্রথম সন্তানকে তুলসী কাঠের মালা ও রেশম বা ঘুনসি দেওয়া হয়। সম্ভব হলে নতুন জামা কাপড় পরনো হয়। তুলসী তলায় কলার আঙট পাতের গোময়নাডুর সামনে ধূপ দীপ নৈবেদ্য আতপ চাল কলা বাতাসা নারকেল ও ফলমূল সাজিয়ে পুজো করা হয়। অঞ্চল ভেদে শাকালু অবশ্যই থাকে। কোথাও কোথাও এই নাড়ুতে তিনটি বা পাঁচটি কাঁচা বা হলুদ হয়ে যাওয়া পাকা গোটা সুপারি (না ছাড়ানো )বসিয়ে দেওয়া হয়! এবার ওই সুপারীতে সিঁদুর লেপে পূজা করা হয়। মাতৃস্থানীয়া কেউ কলাপাতায় কাঁচা হলুদ বাটা ও চন্দনের মিশ্রন একসাথে মিশিয়ে গোবিন্দ পূজা করে ওই মিশ্রণের তিলক প্রথম সন্তানের কপালে এঁকে দেন। তুলসী তলায় প্রণাম করে সন্তানের সুস্থ ও সুখী দীর্ঘ জীবন কামনা করেন। এবার তুলসী তলায় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে হয় প্রথম বা প্রথমা কে। পূজা শেষে ভুরিভোজ এ আপ্যায়িত করা হয় সন্তানকে।
কিভাবে এই পূজার উদ্ভব হলো তা বলা মুশকিল। এ পূজার কোন পুথি বা পালাও নেই , মন্ত্র ,নেই। অষ্টমী তিথিতে কৃষ্ণ বা জগন্নাথ জন্মেছিলেন বলে অষ্টমী তিথি শুভদিন বলে চিহ্নিত! হয়তো সে কারণেই কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি কে বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রথম বা প্রথমা পূজা কেন প্রচলিত হলো তা দেখতে গিয়ে এই ধারণাগুলো সামনে এলো—— আজ থেকে 100 বা তারও বেশি সময় পিছিয়ে গেলে দেখতে পাই সেই সময় শিশুমৃত্যুর হার খুব বেশি ছিল! এই সময় মেয়েদের বিয়ে হত পাঁচ ছয় থেকে ন দশ বছরের মধ্যে। সেটাই স্বাভাবিক সামাজিক বিধান ছিল। ফলে 12 /13 বছরের মধ্যেই এরা মা হত। কিন্তু মা নিজেই বালিকা হওয়ায় নিজের বা সন্তানের যত্ন রক্ষায় সচেতন না হওয়ায় শিশুমৃত্যু বিশেষত প্রথম সন্তান মারা যেত। কোনক্রমে যদি প্রথম সন্তান বেঁচে থাকত তাহলে তার আদর-যত্নের সীমা থাকত না। সম্ভবত এই কারণের জন্যই প্রথম সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেবতার প্রসন্নতা প্রার্থনা করা থেকেই এই প্রথমাষ্টমী পূজার প্রচলন। এই লোকাচারের প্রধান রীতি হলো প্রথম সন্তানের যত্ন ও তার সন্তুষ্টি বিধান। নতুন জামা কাপড় না দিতে পারলে একটি নতুন লাল ঘুনসি বা রেশম যেন অবশ্যই দেওয়া হয়।
অগ্রাহায়ণ মাসের নতুন ধানের নবান্ন পিঠা-পায়েস হয়। উৎসবের আবহে গ্রামবাংলায় আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকে। ফলে উৎসবের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। পূর্ব মেদিনীপুরের কোন কোন অঞ্চলে প্রথম অষ্টমী না গেলে মুলা শাক খাওয়া হয়না হয়তো এই সংস্কারের পেছনে মূলাকে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ দিতে ই এই নিষেধ ছিল। ওড়িশার” পড়ুয়া ছুয়া”বা মেদিনীপুরের “পড়ুয়া টকা”( প্রথম সন্তান) কে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে এই লোকাচারের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনেক লোক গবেষকের মত।