Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পুষ্পিত কলি || Nondini Arzu

পুষ্পিত কলি || Nondini Arzu

পুষ্পিত কলি

এখন সকাল আটটা বাজে, আব্দুলপুর ইষ্টিশানে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিন এতো দেরি হয় না, আজ হয়তো দুটো ক্রসিং আছে! দেখতে দেখতে ইন্টারসিটি ট্রেন দ্রুত পাস হয়ে গেলো।ট্রেনে ভিড় তেমন নেই,যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করে বসে আছে কেউ বা ঝিমাচ্ছে,অবশ্য যেতে যেতে ভিড় বাড়বে। ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন ছেড়ে এসেছে সেই ভোরে। কমিউটার ট্রেন সপ্তাহে ছ’দিন রাজশাহী যায়। বিভাগীয় শহর বিশাল হাসপাতাল আর তৎসংলগ্ন মেডিকেল কলেজ। দূর দূরান্ত থেকে প্রচুর মানুষ চিকিৎসা সেবা নিতে আসে। যাত্রীদের অধিকাংশই রোগী ও তাদের আত্মিয় স্বজন। কারণ ভোরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আবার এই ট্রেনে বিকেলে ফিরতে পারে, ভালো সুবিধা।
হামিদুর রহমান বিরস মুখে, ট্রেনের জানালার বাহিরে! বিরক্তি মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আজ খুলনার ট্রেনেরও ক্রসিং হবে তাই একঘন্টা দেরি। কখন ট্রেন ছাড়বে! এতো লেট…
তবুও ট্রেনে যাতায়াত তার পছন্দ।
ইদানীং কিছু-না কিছু অপ্রিয় ঘটনা ঘটে রেলষ্টেশনে, যেমন আজ দুজন পকেট মার ধরা পড়লো। শক্তসমর্থ দুইযুবক, মোবাইল মানিব্যাগ হাত সাফাই করতে গিয়ে গণধোলাই খেলো! সব জায়গায় এদের দৌরাত্ব বাড়ছে।কাজ করবে, তা-না চুরি ছ্যাঁচড়ামিতে জড়িয়ে নিজেদের ধ্বংস করছে।
কোথায় চলেছে আমাদের যুবসমাজ?
এসব দেখেশুনে মনমেজাজ খিঁচড়ে গেছে তার।
কি এর সমাধান?
গণধোলাই রেলপুলিশের হাতে সোপর্দ, কিছু টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়ে যে-কে সেই —ভালো লাগে না,
এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে কে?
হামিদুর রহমান পেশায় স্কুল শিক্ষক। তিনি “ভাষা শহীদ বিদ্যানিকেতন ” স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্কুলের কাজে রাজশাহী বোর্ড অফিসে যাচ্ছেন। প্রায়ই আসা-যাওয়া এই পথে। অপেক্ষার সময় যেন কাটে-না, কখন ট্রেন ছাড়বে ভিতরে ভিতরে অস্থিরতা বোধ করছেন তিনি।
প্লাটফর্মে ইতস্তত যাত্রীদের আনাগোনা কেউ রুটি, কেউ ভাজি পরটা খাচ্ছে। ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি ডিম ভাজাও ভালোই বিক্রি হচ্ছে। অনেকেই অপেক্ষার ফাঁকে সকালের নাস্তা স্টেশনে সেরে নিচ্ছে। ব্যস্ত দোকানিদের হাঁকডাক ছাপিয়ে, জানালার সামনে কচি কন্ঠে কেউ বলে উঠলো, “স্যার, পেপার নেবেন পেপার…”
রহমান সাহেব ছেলেটির দিকে তাকালেন। দশ এগার বছর বয়স হবে হয়তো। উৎসুক সরল চোখ, কালোর দিকে গায়ের রং। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, পরনের জামা প্যান্ট পুরোনো কিন্তু পরিস্কার। স্যারের আগ্রহী দৃষ্টি দেখে ছেলেটি, গড়গড় করে বেশ কিছু দৈনিকের ইংরেজি, বাংলা নাম বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
“কোনটা নেবেন স্যার?”
রহমান সাহেব পছন্দের দৈনিকটির নাম বললেন, ছেলেটি বামহাতের কুনুইয়ে ভাঁজ করা বাণ্ডিল থেকে দৈনিক পত্রিকাটি দূর্বল ডান হাতে বাড়িয়ে ধরলো। হামিদুর রহমান খেয়াল করলেন, শুকনো শীর্ণ হাত, কোনমতে নাড়াতে পারে ছেলেটি…
” কি নাম তোমার?
হকারি ছাড়া আর কি করো তুমি, স্কুলে যাও কি ?
বাড়িতে কে কে আছেন? “
ছেলেটি সপ্রতিভ,
“আমি গোপা,
জী স্যার আমি স্কুলে যাই, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি।”
“বাড়িতে মা, বোন আর দাদি আছে স্যার।
বাবা তো নিরুদ্দেশ অনেক দিন…
কাগজ বেচি সকাল বিকাল, স্কুলের সময় হলে স্কুলে যাই।
মা ঘরে বসেই হাতের কাজ করে, এভাবেই দিন কাটছে স্যার ,
ছোট বেলায় পোলিও জ্বরে হাত নষ্ট, অকেজো তবুও কর্ম করে বাঁচতে চাই।”
গোপা সেই সকাল সাতটায় স্টেশনে আসে, ঝড় বৃষ্টি নাই সব প্রতিকূল অবস্থা পাশকাটিয়ে সে খবরের কাগজ ফেরি করে। যতক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে বগীতে বগীতে কাগজ বিক্রি করে। যা পায় তাতেই কোনমতে দিন চলে যায়। এতোটুকু প্রতিবন্ধী ছেলে, তবু কাঁধে তুলে নিয়েছে পরিবারের দায়িত্ব। সুচারু হিসেবি তার প্রতিটি পদক্ষেপ।
“গোপা! তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে যে,” বলে হামিদুর একশত টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন তার দিকে। “খুচরো নাই? অতো টাকা তো ভাংতি হবেনা স্যার… মাত্র কটি পত্রিকা বিক্রি করতে পেরেছি স্যার। আজকাল কেউ পয়সা খরচ করে পড়তে চায় না। মোবাইলে চোখ রেখে কাটিয়ে দেয় সময়। সব তো এখন হাতের মুঠোয়!”
স্মিত হেসে হামিদুর বলেন,


“ভাংতি ফেরত দিতে হবে না সবটা তুমি রেখে দিও।”
“না না স্যার, আমি দোকান থেকে ভাংতি এনে দিচ্ছি।”


নিষেধ সত্ত্বেও সে দোকানে গেলো…
হামিদুর মন থেকে চাইছিলেন ছেলেটিকে টাকা কটা দিতে। হঠাৎ হুইশেল বেজে উঠলো, ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে শুরু করলো।
গোপা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দোকানিকে তাড়া দিলো…
” ইসস ট্রেন ছেড়ে দিলো যে, শিগগির টাকা গুনে দাও না! “
হামিদুর দেখলেন গোপা দোকানের বেঞ্চে কাগজ গুলো রেখে, ট্রেনের দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে…
ট্রেন আর বালকের পাল্লা চলছে, সততা আর বিশ্বস্ততার কঠিন হার জিতের পাল্লা যেন।ছোট গোপা দায়িত্ব বোধের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ! একদিন বড় পরিসরে মহীরুহ হবেই — অভিভূত হামিদুর ইশারায় থামার ইঙ্গিত করলেন ,হাত নেড়ে চলে যেতে বলছেন…
যদি ছেলেটা পড়ে যায়, শঙ্কিত হয়ে উঠলেন তিনি।
গোপার যেনো কোন দিকেই ভ্রুক্ষেপ নাই! ছুটে এলো সে,ঠিক ট্রেন পূর্ণ গতি পাওয়ার আগ মুহূর্তে, অশক্ত হাতে বাড়িয়ে দিলো টাকা,নিন স্যার,সে হাপাচ্ছে! ঘামছে মুখে বিজয়ের হাসি। হামিদুর হাত বাড়িয়ে টাকা নিলেন, অচেনা বালকের এই পরিশ্রম, কর্তব্য পারায়ণ আত্মতুষ্টি তিনি নষ্ট করতে চাননি। অসীম ভালোবাসায় মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন, গোপা প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাসছে, শিশুর সারল্য খেলা করছে তার সেই পবিত্র মুখে। জীবন বেড়ির আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা কিশোরের দৃঢ়তা যেন প্রতিনিধিত্ব করছে সুস্থ সমাজের আর বিশুদ্ধ মানবিকতার।
যত দূর দেখা যায় তাকিয়ে রইলেন হামিদুর রহমান, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো তার।গর্বিত আস্বাদে বুক ভরে উঠলো। চোখে ভাসছে নতুন আগামীর স্বপ্ন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিস্তৃত কোটি কোটি পুষ্পিত কলি, প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায়… আমাদের শিশু কিশোর আমাদের ভবিষ্যৎ দেশ গড়ার কারিগরি। শুধু গড়ে নিতে হবে, অপশৃঙ্খল ভেঙে এগিয়ে নিতে হবে দেশ জাতি। চলার পথে হয়তো কোনো দিন, আবার দেখা হবে গোপার সাথে। আত্মতৃপ্তিতে বিভোর হামিদুর স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে সুন্দর আগামীর…
দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে ট্রেন সবুজ মাঠ আর গাছগাছালি পিছনে ফেলে গন্তব্যে….।

1 thought on “পুষ্পিত কলি || Nondini Arzu”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *