পরিবর্তন
শুনেছিলাম তোমার জন্ম সবুজ ছোট গ্রামে। সেখানে তখনও আধুনিকতার ছোঁয়া স্পর্শ করেনি। তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। গ্রামের বেশিরভাগ রাস্তা ছিল কাঁচা। পাকা বাড়ি খুব কম দেখা যেত। বেশিরভাগ বাড়ি ছিল মাটির তৈরী বা বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরী। চারিদিকে সবুজ গাছপালা। সেখানে সবুজ স্নিগ্ধ সেই সৌন্দর্য্যকে তোমরা গভীরভাবে উপভোগ করতে।
একটা মাটির রাস্তা ছিল তোমাদের বাড়ির ডানদিকে। সেখানে ছিল কালি মন্দির।বাঁদিকে ছিল ছোট একটা বাঁশবাগান। বিভিন্নরকম গাছপালা ছিল। যেমন ফলের গাছের মধ্যে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, তেঁতুল , কলাগাছ ইত্যাদি। ফুল গাছও ছিল অনেকরকম। চন্দন গাছ ছিল, শিশু গাছ ছিল।
বাবা জমিতে ধান আলু বিভিন্নরকম সবজি চাষ করতেন। বাড়িতে লঙ্কা, টমেটো ইত্যাদি। এইসব সবজি কখনও তোমাদের বাজার থেকে কিনে খেতে হয়নি।
বাড়িতে গরু ছাগল ছিল। ঠাকুমা ও দাদুকে তুমি দেখনি।তোমাদের সাথে পিসিমা সপরিবারে থাকতেন। বললে পিসিমার যা ক্ষমতা ছিল, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
পিসিমা নিরামিষাশী ছিলেন। উনি পশুপাখি খুব পছন্দ করতেন।তোমাদের বাড়িতে হাঁসের জন্য ক্ষুদকুড়াঁ রান্না করা হত। পিসিমা ওদেরকে ভালবেসে খাওয়াতেন। পিসিমার দুপুরের খাওয়া শেষ হলে দেখতাম, ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্নরকম পাখি উড়ে আসতো এঁটোকাঁটা খেতে।কুকুর কাঠবিড়ালি ও বিড়াল এরাও হাজির হতো খাবে বলে।
পিসিমা নিয়মিত তাদেরকে খেতে দিতেন। তারপর খাওয়া শেষ হয়ে গেলেই সকলে আবার চলে যেতো।তুমি বাড়িতে যখন থাকতে সেটা লক্ষ করে
আনন্দ পেতে।
বর্ষাকালে যেদিন প্রথম বৃষ্টি পড়তো, সেই দিনটা তুমি খুব উপভোগ করতে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে খেলাধূলা করতে। সেই প্রথম বৃষ্টির আনন্দ তোমার কাছে ছিল অমূল্য।মুশল ধারায় বৃষ্টি হলে
ছুটতে পুকুরে। তখন পুকুর থেকে মাছ ডাঙায় উঠে পড়ত।সেই মাছধরার ছিল আলাদা আনন্দ।
রান্নাঘরের টালির ছাদে বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ। ব্যাঙের ডাক। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। নিঝুম রাত্রি। পাতার খসখস শব্দ।অন্ধকার ঘরে বসে তোমার বাবা রেডিওতে খবর শুনতেন বা গান যাত্রপালা শুনতেন। তুমি আর তোমার দুই ভাইবোন লণ্ঠনের আলোয় পড়াশুনা করতে। মা রান্নাঘরে কুপির আলোতে রান্না করতেন।
এখন তোমার বয়স ৫৮বছর। গ্রাম থেকে দূরে কলকাতা মহানগরীর কাছাকাছি মফস্বলে। এখানে চারিদিকে শুধু আলো আর আলো। যুগ পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। Electricity Light, Fan, AC, Gas, Smart Phone, Laptop, Smart TV, Shopping Mall, Multiplex, Park, e-commerce এমন অনেক কিছুই অপ্রত্যাশিতভাবে তোমার জীবনের অপরিহার্য্য অঙ্গতে পরিণত হয়েছে, শৈশবে তুমি তা কল্পনাও করতে পার নি।
ছোটবেলায় সেই গ্রামের দুর্গাপুজোতে, লক্ষ্মীপুজোতে তুমি যেভাবে আনন্দ করতে এখন এতো জাঁকজমকের মধ্যেও হয়তো সেরকমভাবে আনন্দ উপভোগ করতে পার না।
তুমি শৈশবে পড়েছ গ্রামের ছোট একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা মাটিতে বসতো। চেয়ার টেবিল লাইট Fan কিছুই ছিল না সেখানে। স্কুলের মাঠে তোমরা বন্ধুদের সাথে নানারকম খেলাধুলা করতে। গাছে চড়তে গাছ থেকে আম পেড়ে খেতে। বন্ধুদের সাথে মন খুলে গল্প করতে।
তুমি যখন হাইস্কুলে গেলে তখন স্কুলের লাইব্রেরী থেকে গল্পবই দিত।
রবীন্দ্রনাথের একটি গল্প পড়ে তুমি মুগ্ধ হয়েছিলে।
বইটি পড়তে গিয়ে দাদুর না থাকা তুমি উপভোগ করেছিলে।দাদু নাতনির সম্পর্ক আজ আর সেভাবে প্রকাশ পায় না। সেখানে তুমি পড়েছিলে,
পুপে নামে গুরুদেবের বড় আদরের এক নাতনি ছিল। যখন-তখন গুটিগুটি পায়ে এসে হাজির হতো তার দাদামশাইয়ের পড়ার ঘরে। গুরুদেব তাতে এতটুকুও বিরক্ত হতেন না। বরং তিনি লেখা থেকে মুখ তুলে তখন সাদরে তাকে কাছে টেনে নিতেন, তারপর মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে আদর করতেন। কখনো বানিয়ে গল্প বলতেন। তাঁর লেখা পড়ে থাকতো, তিনি পুপেকে বসিয়ে গল্প শোনাতেন।
গল্প পড়তে বসে তুমি ভাবতে তোমার দাদামশায় থাকলে এভাবেই গল্প শোনাতেন।আবার মন দিলে
গল্পে।
ভোরে উপাসনা সেরে গুরুদেব পড়ার ঘরে এলেই পুপে সেখানে হাজির হতো। উত্তরায়ণে তখন কেউ জাগত না। দাদামশাইয়ের কাছে গেলেই তখন পুপের মিলত কফি আর বিস্কুট। পুপেকে দেখে গুরুদেব এমন ভাব করতেন যেন পুপেকে ভীষণ ভয় পান।
একবার ম্যালেরিয়ার খুব প্রকোপ চলছে চারিপাশে। গুরুদেবের শরীরটাও ভাল নয়, মাঝে মাঝে জ্বর আসছে। কিন্তু গুরুদেব ইনজেকসন নিতেন না। পুপেরও ইনজেকসনে খুব ভয়। সকালে সেদিন কয়েকটা জরুরী চিঠিপত্র লিখেছেন। নিজের হাতে পোষ্ট করবেন বলে তৈরী। এমন সময় পুপে দেখে আশ্রমের ডাক্তারবাবু, মাথায় টুপি, সাইকেল চড়ে উত্তরায়ণে ঢুকছেন। পুপে ডাক্তারবাবুকে ঢুকতে দেখে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ছুটে তার দাদামশাইয়ের কাছে গিয়ে দাদামশাইকে বললো, “দাদামশাই তুমি শিগ্গির বাথরুমে লুকিয়ে পড়, ডাক্তারবাবু এসেছেন তোমাকে ইনজেকসন দিয়ে দেবেন।” নাতনির কথা শুনে গুরুদেব তো বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু এদিকে মুশকিল হল কি ডাক্তারবাবুও গুরুদেবের ঘরে ঢুকে বসে রইলেন। নড়বার নাম নেই। ডাক্তারবাবু, “দাদাশাই কোথায়” জিজ্ঞেস করাতে পুপে বলে উঠলো, “দাদামশাই নেই”। কিন্তু ডাক্তারবাবুর ওঠার নাম নেই। হেসে বললেন, “একটু বসি, এসে পড়বেন।” পুপে তখন তার দাদামশাইকে ইনজেকসনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বলে উঠলো, “দাদামশাই এখন আসবেন না।” কিন্তু ডাক্তারবাবু নাছোড়বান্দা।
শেষ পর্যন্ত ডাক্তারবাবুকে বসে থাকতে দেখে গুরুদেব বের হয়ে এলেন বাথরুম থেকে। পুপে দাদামশাইকে বের হয়ে আসতে দেখে হতাশ হয়ে পড়ল। ডাক্তারবাবু পুপের মুখের করুণ অবস্থা দেখে বললেন, “কী হল পুপেদিদির?” গুরুদেব তখন বললেন, “আমাকে ইনজেকসনের হাত থেকে বাঁচানো গেল না বলে পুপেদিদির কষ্ট হচ্ছে।” ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, “না, না আমি ইনজেকসন দেব না।” বলে, গুরুদেবকে একটু পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপসন করে চলে গেলেন। গুরুদেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ভাগ্যে তুমি ছিলে পুপেদিদি, তা না হলে ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই আমাকে ইনজেকসন দিয়ে দিতেন।”
তুমি বললে কি মধুর এই সম্পর্ক।গভীর আন্তরিকতায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়।এখনকার ছেলেমেয়েরা এইসব বই খুলেই পড়ে না।এখনকার প্রজন্ম এর মর্ম বুঝতে পারবে না।তারা তো শৈশব
কি সেটাই এখন বোঝে না।চার বছর থেকেই তাদের পিঠে ইংরেজি বইয়ের বোঝা।
বললাম ছেলেমেয়েরা এখন একটা International School-এর AC classroom-এ বসে তোমাদের শৈশবের সেইসব আনন্দকে বুঝতে পারবে না।
এখন আমাদের জীবনে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। আধুনিকতা আমাদের জীবনে অনেক কিছু দিয়েছে। তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। পুরো পৃথিবীটা এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।
এখন রান্না হয় Gas-এ। আগে রান্না হতো কয়লার উনোনে, কাঠের চুলায় ধানের ভুসিতে, গোবরের ঘুঁটেতে, কুড়িয়ে আনা শুকনো পাতায়, কাঠের টুকরোতে।বাবা কুড়োল দিয়ে কাঠ কাটতেন জ্বালানির জন্য।
তখন রান্নার Gas ছিল না আমাদের বাড়িতেও।
মাকে আমিও অনেক কষ্ট করতে দেখেছি। মা হাতুড়ি দিয়ে কয়লা ভাঙতেন। গোবরের ঘুটে দিতেন।কোলকাতায় আমাদের বাড়িতেও গরু
কুকুর পাখি ছিল। আমারই তাদের দেখাশোনা
করতাম। আমার শৈশবে দাদু ঠাকুমা ছিলেন। তবে
দাদুর কথা তেমন মনে পড়ে না।শুধু মনে আছে
দাদু আমায় টম এন্ড জেরির বাংলা গল্প বই দিয়েছিলেন।সেটাই ঠাকুমা পড়ে শোনাতেন।তাদের আদর স্নেহ ভালবাসা আমি কিছুটা পেয়েছি।
দাদু ঠাকুমা ধীরে ধীরে একদিন হারিয়ে গেল।
সবাই স্বান্তনা দিয়ে বলেছিল আকাশের তারা
হয়ে গেছে দাদু ঠাকুমা। তাদের সঙ্গে হারিয়ে গেছে
সেই স্নেহ ভালবাসা। সেই সময় যে আন্তরিকতা
বোধ সকলের মধ্যে ছিল সেই বোধটাই আজ বিলুপ্ত। পশুপাখির প্রতি আন্তরিকতাও সকলের খুব কম।
স্বামী স্ত্রী, বন্ধু বান্ধব,মা সন্তান, সমাজের সকলের
সাথে আত্মিক মিত্রতা তেমন গড়ে ওঠে না।যুগের এখানেই পরিবর্তন।মানুষের মনের পরবর্তনের
সাথে প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্র্য- এর মধ্যেও পরিবর্তন
দেখতে পাই।