পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 01
একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘরভর্তি নীল আলোর মধ্যে আস্তে আস্তে আতুর হয়ে জেগে উঠছিল অরিত্র। মাথার দিকে জানলার পর্দা টানা। ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো বোল্ডারে বোল্ডারে বাধা-পাওয়া জলস্রোত, হুড় হুড় করে ঢুকে নীল রঙের রাত-আলোটাকে ফিকে করে দিয়ে গেছে। এক পৃথিবী আকাশ নীল। গভীর রাতের ঘর তার অনতিআসবাব পরিসর নিয়ে বাইরের পরিমণ্ডলের সঙ্গে নিঃশব্দ স্রোতে মিশে গেছে। ঘরকে আর ঘর বলে চেনা যাচ্ছে না, তার ছ দেয়াল বুঝি ছ দিক থেকে খুলে পড়ে গেছে। শুদ্ধু মাথার কাছে জানলার গায়ে সামান্য সাদা বিকিনি। পুরো পশ্চিমের দেয়ালে ডানা ছড়ানো ঈগল। আরো হা হা জানলা। হু হু শূন্যতা এবং বিপুল এক পরিসরের বোধ। ঘর নয় পৃথিবী, পৃথিবী নয়, আকাশ নীল রং যখন তখন আকাশ। স্বয়ং আকাশই। ঘুমে জাগরণে একাকার, স্বপ্নে-বাস্তবে। গভীর হাওয়ার রাত ছিল বুঝি কাল। সুষুপ্তি আর নিদ্রার সন্ধিতে তাই এসেছিল নিরবয়ব স্বপ্ন। রাতের হাওয়া শরীরের অরিত্রর থেকে তার দেশকালাতিক্রমী মনের অরিত্রকে আলাদা করে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। নিদ্রা আর তন্দ্রার মধ্যলগ্নে একটা চকিত রূপ তার সন্ধ্যাভাষা নিয়ে নির্জ্ঞান থেকে জ্ঞানে বিদ্যুতের মতো ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। কোনও কোনও স্বপ্ন দেখে বোঝা যায় তারা কোন ইচ্ছে, ভয়, ক্রোধ লোভের তলানি। দশ-পঁচিশের কাঁইবিচি, চৈতন্যভূমিতে ছড়িয়ে জড়িয়ে রয়েছে। এ স্বপ্নটা কিন্তু তা নয়। কে যেন কি বলতে এসেছিল। ঘুমের কান নেই। তাই দৃশ্যপ্রতীকে যা বলার তা বলে গেল।
এখন তন্দ্রা আর জাগরণের সন্ধিপুজো হচ্ছে। শুয়ে শুয়ে সেই জয়ধ্বনি শুনতে শুনতে অরিত্র বুঝতে পারছে সে চার পাঁচ হাতের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। অস্তাচলে ছড়ানো তার পা, পূর্ব দিগন্ত পর্যন্ত মুঠি ছড়িয়ে তার অনুসন্ধান ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। তার স্মৃতি এবং সত্ত্বা অতীত ভবিষ্যতের গণ্ডি ছাড়িয়ে দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, বেধে বহু বহু যোজন বিস্তৃত। স্পেস-সমুদ্রে ভাসমান তার দিকচিহ্নহীন মানস অস্তিত্ব। জাগ্রত অবস্থাটাই তাহলে আসলে সত্যিকার ঘুমন্ত অবস্থা! ছোট্ট একটা কুঠুরির মধ্যে আবদ্ধ চলাফেরা তখন। যা ঘুম, চেতনার পক্ষে তাই আসল জাগরণ। উদার বিপুল বিস্ফারণে সেখানে নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেললে তবেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
ঘুম ভেঙে অরিত্র প্রথমে তার হাত পা খুঁজে পেল না। শুধু মস্তিষ্কের কাছটুকুতে ‘আমি অরিত্র’ এই বোধটুকু আলগা বোঁটায় ঝুলছে। অন্য সময় হলে ভয় পাবার কথা। বিশেষ করে যে মানুষ সাঙ্ঘাতিক স্কুটার-অ্যাকসিডেন্টে সত্যি-সত্যিই তার হাত পা হারাতে বসেছিল। কিন্তু অরিত্র ভয় পেল না। সে যে এখন শিবাজীনগরের রাস্তায় হাত পা দুমড়ে পড়ে নেই বা সাসুন হসপিট্যালে তার এইমাত্র অপারেশন-উত্তর জ্ঞান ফিরছে না—একথা সে ভালোই বুঝতে পারছে। এই ভয়হীন অবস্থাটাকে টিঁকিয়ে রাখতে পারলেই বুঝি গহন ঘোরে যা এক ভৌতিক কিউনিফর্ম লিপিতে চমকে উঠেই মিলিয়ে গেল সেই চকিত স্বপ্ন-চিত্রকে পুরোপুরি স্বরূপে চিনতে পারা যাবে। উদ্ধার করা যাবে। নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে। সুতরাং অরিত্র আবার চোখ বুজল। যদি আরেকবার ফিরে যাওয়া যায় সেই নিদ্রায় যা নাকি আসলে জাগরণ! আর একবার। কোথাও বহুদূরে দুর্বার স্বরে ভোরের কোনও পাখি ডাকছে। অরিত্র সেই মধুর রোম্যান্টিকতার ওপর ভর করে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু নীল আকাশের পৃথিবী খুব দ্রুত রং পাল্টে পাঁশুটে ভোরের আলখাল্লা পরে নিল। হাত, পা, বুক, পিঠ, উদর, কণ্ঠ এসবের অধিষ্ঠাত্রী দেবগণ যে যার রাজ্যপাটে ফিরে এলেন। জলের তলা থেকে ভেসে ওঠার মতো টলমল করতে করতে স্থির হল ঘরের একপ্রান্তে একটা লম্বা দেয়াল-আয়না। পাশে মাঝারি টেবিল, তার ওপরে ছোট বড় নানা মাপের ওষুধের শিশি ও উল্টো দিকের দেয়ালে অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো লাস্ট সাপার, বেরিয়াল অফ ক্রাইস্ট আর পিয়েতা—তিনটি খ্রীষ্ট সম্পর্কিত ছবি—কেন শোবার ঘরে এই পাপ-মৃত্যু-বিশ্বাসঘাতের সাবলিমিটি কে জানে; এবং টেবিলের সামনের চেয়ারে অরিত্রর দিকে পাশ ফিরে কপালে হাত দিয়ে বসা ফিরোজা রঙের সিল্কের রাত্রিবাস পরা বিনিদ্র নীলম। মাথার ওপরে কুচো বাসি কোঁকড়া চুলে ধোঁয়াটে একটা বলয় তৈরি হয়েছে। এটা নীলমের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অরিত্র বলে নীলম’স অরিওল। কেশপ্রসাধনের অব্যবহিত পরেই নীলমের মাথা এই আকার ধারণ করে। কারণ আর কিছুই না। গোটা মাথায় কিছু কিছু বালখিল্য চুল যারা জন্ম থেকেই কোন দিনও বাড়বে না প্রতিজ্ঞা করেছে। অথচ যাদের কারুর কারুর এঁচড়ে পেকে যেতে বাধেনি। দ্বিতীয় কারণ, নীলমের প্রচণ্ড মাথা নাড়ার অভ্যাস।
পেছনের মাঠের গাছের জটলা থেকে ভোরের পাখিদের কাকলি ক্রমে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চোখটা সিকি খুলে নীলমকে গভীরভাবে দেখতে দেখতে অরিত্র বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল ও কতক্ষণ, ঠিক কতক্ষণ ওখানে বসে আছে। ঢুকতে দেখেনি; চোখের কোল বসা। তাহলে কি সারা রাত ও ওখানে⋯ওইভাবে? কেন? অরিত্র এখন তো অনেক ভালো আছে! রাত-পাহারা দেবার প্রশ্নই নেই। নিজে নিজেই বাথরুমে যায়। বাঁ পাটা সামান্য একটু টেনে চলতে হচ্ছে এখনও পর্যন্ত। ডান হাতের অনামিকা ও তর্জনীর দুটো পর্ব কাটা গেছে। অর্থাৎ বিধাতাপুরুষ বাকি জীবনটা কাউকে শাসানোর অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করেছেন। আংটি পরতে হলে হাত বদলাতে হবে। কিন্তু অরিত্র সম্পূর্ণ সুস্থ। বরং দীর্ঘ বিশ্রাম এবং শুশ্রূষায় একরকম নব যৌবন ফিরে পেয়েছে। উদ্বিগ্ন হবার কোনও কারণ নেই। তবুও নীলম এখন ওখানে ওভাবে কেন? কপালে হাত রেখেছে যেন একেবারে বসে পড়েছে। চিন্তাবিষ্ট ভাব। অরিত্রর মনে হল জিজ্ঞেস করে—‘নীলম, তুমিও কি আমার স্বপ্নটাই দেখেছো?’ একই স্বপ্ন একই সময়ে দেখা কি—রূপকথা ছাড়া সম্ভব? জিজ্ঞেস করলে শুধু শুধুই চুড়ান্ত ঘাবড়ে যাবে নীলম। রোগশয্যায় অরিত্র যথেষ্ট প্রলাপ বকেছে। কিছু না বলে তাই অরিত্র শুধু পাশ ফিরল। বাঁ কাতে ছিল। অর্থাৎ টেবিল এবং নীলমের দিকে। লাস্ট সাপার, পিয়েতা ইত্যাদির দিকে কাত হল। সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নোত্থিতের মত উঠে দাঁড়াল নীলম। কাছে আসতে আসতে বলল—‘উঠলে? উঠবে? চা আনবো?’
কথাগুলো এই-ই উচ্চারিত হল অথচ অরিত্র যেন শুনলো নীলম বলছে—‘শুনলে? শুনবে? শীগগিরই শোনো একটা কথা।’ মুখের ওপর উদ্বেগের ছাপ ওর এতই স্পষ্ট। অরিত্র সেই না-করা প্রশ্নগুলোরই জবাব দিল, বলল—‘বলো শুনছি।’ নীলম চমকে উঠল একবার। তারপর বলল—‘কাল রাত্রে শুনেছিলে নাকি?’
—‘কি শুনবো?’
—‘মহানামজী আমাদের এই রাস্তা দিয়ে গেলেন। মহানামজী এসেছেন।’
অরিত্র এবার উঠে বসে গায়ের চাদরটা ঝেড়ে ফেলে দিল, বলল—‘কি বলছো নীলম? ঠিক করে বলো!’
নীলমের গলা কাঁপছে ঈষৎ—‘রাত দুটো নাগাদ গাড়ির হর্ন গেটের ওধারে শুনতে পাওনি, না? রাত ডিউটির নতুন দারোয়ান শম্ভাজী আমাদের ফ্ল্যাটের বেল বাজাল এসে, বলল—কারা এসেছে তোমার তলাশ করছে। আমি বললুম—আমিই যাচ্ছি, গেটের তালা কভী খুলবে না। গাড়ি থেকে ও নেমে দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে চিনি চিনি করছিল মন, শুধু ফর্মটা, পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম না অন্ধকারে। গেটের কাছে পৌঁছতে মহানামজী রাস্তা কাঁপিয়ে বলল—কি নীলম? অরিকে পাঠাতে ভয় পেলে নাকি? আমি তোমার অ্যাকসিডেন্টের কথা কিছু বলিনি, শুধু বললুম গেট খুলতে বলি, ভেতরে আসুন। এত রাত্তিরে? কি ব্যাপার? সহ্যাদ্রি এক্সপ্রেস মিস করেছেন না কি? মহানামজী বললেন—মিস তো অনেক কিছুই করলুম। মিস করারই কপাল। তো ভয় নেই। সুখে নিদ্রা যাও সব। আমি যাচ্ছি পিঁপরির দিকে। ওখানেই আস্তানা মিলেছে।’
—‘কার বাড়ি গেল?’ অরিত্র জিজ্ঞেস করল—‘পিঁপরির দিকে! বাঙালি হলে চিনতে পারার কথা।’
—‘কি জানি! সাদা ফিয়াট ওখানে কার কার আছে? অন্ধকারে আর কিছু বুঝতে পারিনি। এমন নাটকীয়ভাবে আসলো আর গেলো!’
ভুরু কুঁচকে অরিত্র ভাবল—“ওটাই তো ওর চাল। তবে ওই চালে আর বাজি মাত হওয়া শক্ত।’ মুখে বলল—‘চা আনো।’
নীলম ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হবামাত্র অরিত্রর মস্তিষ্কের মধ্যে বিজলি সম্পাত হল। হালকা নীলের মধ্যে গাঢ় নীল একটা ঘরমতো, গহ্বর। দুটো কালো পাখি ডানা মেলে তার মধ্যে দিয়ে উড়ে আসছে। ঠিক সমান দূরত্বে, সমান ছন্দে ডানা মেলে আসছে পাখি দুটো যেন পরস্পরের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা। কিছুদূর এসে আবার পেছন দিকে হটতে লাগল, আস্তে আস্তে। তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎ-গতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। স্বপ্নটা ছিল এইরকম। এখন ভোরবেলাকার প্রথম আলোর চরণধ্বনির রণনময় ঘরে, বিস্রস্ত বিছানার ওপর মহানামের আবির্ভাবের কূট সংবাদ শ্রবণে নিয়ে দপ করে বুঝতে পারল অরিত্র—এ পাখি পাখি নয়। আসলে চোখ। উড়ন্ত পাখির চোখ মেলে কেউ আসছিল, এসেছিল। আবার ফিরে গেছে। কি অদ্ভুত যোগাযোগ। একি কাকতালীয়! না জীবনরহস্যের আদি-অন্ত-মধ্যে বরাবর একটা যোগসূত্র রয়ে গেছে। সশরীরে মহানাম এসে উপস্থিত আজ আঠার বছর পরে। এবং সেই একই দণ্ডকালের মধ্যে স্বপ্ন-শরীরে আরেকজন! উড়ন্ত বিহঙ্গের চোখ মেলে, আধেক ঘুমে, নয়ন চুমে।
অরিত্র যেন এখনও ঘোরে। ক্লান্ত আক্ষেপের সুরে বলল—‘আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।’
এষা বলল—‘ঘুমের আর অপরাধ কি? অত রাত অবধি কবিতায় আর বিয়ারে, বিয়ারে আর কবিতায় কাটালে অসময়ে ঘুমই নিয়তি।’
অরি বলল—‘নিয়তিই। তুমি যখন চলে গেলে আমি নিশ্চয়ই সর্বৈব আচ্ছন্ন ছিলুম। আমার এক অলুক্ষুণে মোহনিদ্রার মধ্যে তুমি চুপিচুপি চলে গেছো। নইলে যেতে পারতে না। আর ওইভাবে গেছো বলেই আজও ঘুমঘোরেই তুমি ফিরে ফিরে আসো। এমন কিউবিস্ট ছবির মতো টুকরো টুকরো হয়ে। কখনও উড়ন্ত চুলের ভয়ঙ্কর আঁধি, কখনও য়ুক্যালিপটাস-দণ্ডের মতো আকাশস্পর্শী দেহকাণ্ড, কখনও পাখি, মেঘ, জল। এষা, প্রত্যেকবার আমি কেন বিভ্রান্ত হই! কে কি কেন কবে—হাজার প্রশ্নের ঝড় ওঠে। সেই মহাকালবৈশাখীর ঘূর্ণিতে তোমার দুর্লভ পদচিহ্ন শুকনো পাতার মতো উড়ে চলে যায়। উড়ে হারিয়ে যাওয়ার পরে, অনেক পরে আমার অন্তরাত্মা বুঝতে পারে তুমি এসেছিলে, তবু আসো নি।
নীলম চা এনেছে। দু জনের। পশ্চিমের জানলা দিয়ে ভোররাতের ঠাণ্ডা ঢুকছে। অরিত্র গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিল। হাত বাড়িয়ে নিজের কাপটা নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল—‘পুপু কোথায়?’
—‘ওঠেনি এখনও। আমিও ইচ্ছে করেই ডাকিনি।’
—‘কেন? তিন চার দিন সকালে একসঙ্গে চা খাওয়া হয়নি। আজও হল না।’
নীলমের চোখে অভিমান ঘনিয়ে উঠেছে। বলল—‘যা বললুম একটু আগে তার পরও কি তুমি মনে করো পুপুর আড়ালে আমাদের একটু কথা বলে নেওয়ার দরকার নেই? মহানাম তো যে কোনও সময়েই এসে পড়তে পারেন!’
অরি বলল—‘তুমি কি জানো না, নীল, কথা বলে কোনও লাভ নেই। মহানামের আঘাত কোন দিক দিয়ে আসবে তা তুমি আমি কল্পনাও করতে পারব না। কাজেই, কোনও প্রস্তুতি না রাখাই ভালো।’
—‘পুপুকে কি বলবো?’
—‘পুপু যথেষ্ট বড় হয়েছে, ওকে সিচ্যুয়েশন থেকে সরাসরি ইমপ্রেশন নেবার সুযোগ দাও। ও যদি কোনও প্রশ্ন করে তখনই তার উত্তর দেবার কথা ভাবা যাবে।’ তারপর একটু হালকা গলায় বলল—‘অত ভাবছ কেন? ভাববার কি আছে এতো?’
নীলম অপ্রসন্ন গলায় খালি বলল—‘তোমার আর কি!’ বলে দুম করে চায়ের ট্রে তুলে নিয়ে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অরিত্র মনে মনে বলল—‘নিজের সমস্যার সমাধান তোমাকে নিজেকেই করতে হবে নীলম। আমার দায়িত্ব আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু তোমার দায়িত্বও তোমায় স্বীকার করে নিতে হবে। পাশে দাঁড়াতে পারি। কিন্তু তোমার বিবেকের সমস্যা সম্পূর্ণই তোমার।’
পুনের মার্চ-ভোর রীতিমত পাহাড়ি ঠাণ্ডার আমেজে মাখামাখি থাকে। খড়কিবাজার প্রিয়লকরনগর দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর চলন পথে পিঠ পেতে রেখেছে। স্থানীয় লোকের কাছে এই ঠাণ্ডা খুব আরামের। পূর্বভারতের লোকেদের কাছে কখনও রোমহর্ষক এই শিরশিরোনি। কখনও কখনও ভারি মধুর আরামদায়ক আদরের মতো। বৃষ্টিটা মাঝে মাঝেই আসে, এক ঝাপটায় তাপমাত্রা নামিয়ে দেয় আরও। নইলে, বেলা যত বাড়ে আবর্জনাহীন আকাশের রোদ সন্তাপে ততই কাংসোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই রোদের মধ্যে স্কুটার চালিয়ে শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, পিঁপরি শহরতলি থেকে প্রিয়লকরনগর, প্রিয়লকরনগর থেকে শিবাজিনগর স্টেশন, য়ুনিভার্সিটি, ডেকান কলেজ, চতুঃশৃঙ্গী মন্দির, ক্যানটনমেন্ট এলাকা ছাড়িয়ে পুনে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন অঞ্চল নানান কাজে যাতায়াত করতে করতে ঘাম চকচকে না হলেও তাতে লাল হয়ে ওঠে চামড়া। ভ্রূক্ষেপ করবার দরকার পড়ে না। এই গরমে কাহিল করে না তেমন। চওড়া রাস্তা ভর্তি খালি স্কুটযান। পুপুর স্কুটারের রাগী গরগরে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে অরি বাথরুম থেকে। সে পড়ে থাকার জন্য যাবতীয় সংসারের কাজ, মায়ের ফরমাশ খাটা একমাত্র পুপুকেই করতে হচ্ছে। নীলম রোগী এবং সংসারের অভ্যন্তর নিয়ে এতই বাতিকগ্রস্ত যে বাইরে যাবার সময় পায় না। আজকে বোধহয় অর্ধ-সপ্তাহের বাজার আনতে হবে পুপুকে। তাই এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ফিরে স্নান-টান সেরে তারপর কলেজ। নীলম যথেষ্ট সুগৃহিণী হলেও আজকাল একটু ভুলো মনের হয়েছে। গোঁয়ারও বেশ। কোনও জিনিস আনতে বলতে ভুলে গেলে পরের দিনের জন্যে অপেক্ষা করতে চায় না, আবার পুপুকে পাঠায়। মেয়েটা নির্বিকার। ফরমাশগুলো যান্ত্রিকভাবে খেটে যায়। দুবার, কোন কোন সময় তিনবার যেতেও ওর আপত্তি নেই। স্কুটার চড়ে বোধহয় ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ পায়। গত বছরই ওকে একটা স্কুটার কিনে দিয়েছে অরিত্র। তার আগে সাইকেলে চলত। সাইকেলে এতো দূরত্ব পারাপারি করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মেয়েদের এতো সাইকেল-চালনা বোধহয় খুব স্বাস্থ্যসম্মতও না। স্কুটারটাকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে পেয়ে পুপু একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল প্রথমটায়। আনন্দ প্রকাশ করতেও যেন ভুলে গিয়েছিল। একটু মৃদু ধমকই দিয়েছিল বাবাকে।
—‘এটা আমার? একা আমার? হঠাৎ! গাড়িই তো রয়েছে বাবা একটা, তুমি বড় বাড়াবাড়ি করো এক একসময়।’
‘বাড়াবাড়ি না রে। আমি বেরিয়ে গেলে তো তুই আর ব্যবহার করতে পারিস না। বাইসিকলে তোর অসুবিধে হচ্ছে আমি ঠিকই বুঝতে পারিরে মামন।’
তখন হঠাৎ ছুটে এসে পুপু বাবার কণ্ঠলগ্ন হয়েছিল। গা শিরশির করে অরিত্রর পুপু তাকে এভাবে আদর করলে। বড় হয়ে গেছে অনেক। পাওয়ার কথা না। অথচ নিজের অধিকারেই পাচ্ছে এই ভাবটা টিঁকিয়ে রাখতে প্রচণ্ড একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়—এ-কথা নীলম বোঝে না। বা বুঝলেও খুব সম্ভব জানতে দেয় না। অবশ্য পুপু স্বভাবে খুব ধীর, আত্মস্থ। ওর আচরণে এরকম মাত্রাছাড়া ছেলেমানুষি প্রকাশ পায় কমই।
তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে মাথা মুছতে মুছতে বাইরে বেরোল অরিত্র। গায়ের জল ভালো করে না মুছেই পাঞ্জাবি চাপিয়েছে। ভিজে-ওঠা জায়গাগুলো ঠাণ্ডায় দপদপ করছে। উঁকি মেরে দেখল ওর শোবার ঘর শুচিশুদ্ধ হয়ে উঠেছে। পুব দিকে ঘরের দেয়াল ফাঁক হয়ে একটা ছোট্ট অ্যানটিরুম মতো আছে, অরি বলে গর্ভগৃহ। এই অণুঘরের দেয়ালে একটা ঈগলপাখি ডিম্বাকৃতি মেহগনীর র্যাকটাকে ধরে আছে। এরই ওপর নীলমের তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর কিছু বাছাই করা প্রতিনিধি। শ্রী এবং হ্রী-এর ভক্ত সে, সুতরাং লক্ষ্মীদেবী, অল্পে সন্তুষ্ট হন সুনাম আছে, সুতরাং শিব-লিঙ্গ, দুর্গতিনাশিনী বলে দুর্গার ছবি একটি এবং মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেবতা, গণপতি। পূজারিণী এখনও চুল আঁচড়ায়নি, চওড়া ফর্সা মুখ সদ্যস্নানের ফলে ঘষা-মাজা, লালচে, চোখ নিবিড় ভাবে বুজোনো। শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে সভ্য ভব্য বিনম্র। সামান্যই আয়োজন। আরতি নয়, মন্ত্র নয়, কয়েকটা এলাচদানা রুপোর থালায়, এবং এক ফোঁটা রুপোর গ্লাসে গণেশ মন্দিরের পেছনের হাজা-মজা মূলামুথা নদীর খাল থেকে সংগৃহীত জল। কিছু ফুল গণেশবাবাজি এবং লক্ষ্মীমায়ীর পায়ের কাছে জড়ো করা। পুজো করছে নীলম। অন্য দিনের চেয়েও আজকের ভক্তি বোধহয় একটু বেশি। মনে হচ্ছে।
এখন ওকে বিরক্ত করা বৃথা। হাজার ডাকলেও সাড়া দেবে না। অথচ স্নানের পর অরিত্র আর একদম দাঁড়াতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে চা এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রাতরাশ। নইলে পেটের মধ্যে একগাদা কেঁচো কিলবিল করতে থাকে। নীলম এটা জানে। যে কদিন সে শয্যাশায়ী ছিল, নিখুঁত নিয়মে গা মুছিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে খাবারের থালা এনে হাজির করত। নীলমের পূজারিণী মূর্তির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অরি। লম্বাটে এক ধরনের বেলুন থাকে খোপ খোপ করা। ছোটবেলায় ওরা খুব ভালোবাসত। এখনকার বাচ্চারা ভালোবাসে কি না কে জানে। সেইরকম বেলুনের মতো নীলমের চেহারাটা ছিল এককালে। গোলালো, মসৃণ, টানটান। বেলুনঅলা যদি কোথায় থামতে হবে না জেনে তাকে আরও ফুলিয়ে যায় যেরকম সব জিনিসটারই একটা অপরিমিত স্ফীতত্ব আসে, এখন নীলমের চেহারাটা সেইরকম। নাকের সূক্ষ্মতা, চিবুকের ধার, চোখের কোণের সেই অপূর্ব টান, ঠোঁটের মোচড় সব যেন কি রকম ধেবড়ে গেছে।
ওর খুব দোষ নেই। জিনিসটা হয়েছে ওর হিসটেরেকটমির পরে। এরকমটা যে হতে পারে সে বিষয়ে ডাক্তার আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। বহুদিন খুব স্পর্শকাতর বিষয় ছিল বলে অরির পক্ষে কিছু বলা মুশকিল ছিল। তবু কখনও কখনও ইঙ্গিত দিতে ভোলেনি। নীলম তো বোকা নয়। বুঝেও না বুঝলে কে কি করতে পারে! ডাক্তারের দেওয়া ওষুধগুলোও তো খেতে সব সময়ে গা করত না। বাধ্য হয়ে ইনজেকশনের শরণাপন্ন হতে হত। —‘সব যখন যেতে চায়, তখন সবই যাক। কিছু ধরে রাখবার চেষ্টা করে লাভ কি?’ উদাস চোখে তাকিয়ে বলত। তারপর হঠাৎ মাঝরাত্তিরে উঠে আসত—‘অরি, অরি, আমার বড্ড ভয় করছে। বুকের ভেতর কেমন সব হিম হয়ে যাচ্ছে।’ অরিত্র বলত—‘তোমাকে কতবার বলেছি ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাও।’ অকালসন্ধ্যা এসে গেল জীবনে। মানসিক ধাক্কায় যেন বিবশ হয়ে গেছে নীলম।
ডাক্তার বুঝদার লোক। বলেছিলেন—‘এ অবস্থা চলতে দিলে নাইন্টি পার্সেন্ট কেসেই ইউটেরাইন ক্যানসার হয়। বলুন কি করবেন?’
—‘শী ইজ ওনলি থার্টি।’
—‘সেইজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি।’
—‘আফটার-এফেক্ট্স কি? এ অপারেশনের?’
—‘শরীর খুব ভালো হয়ে যাবে। কর্মক্ষমতা বাড়বে। অসুখবিসুখ করবে না চট করে। শী মে বিকাম অ্যান অ্যামাজন।’ ডাক্তার বেশ কিছুক্ষণ সিগারেট মুখ থেকে নামালেন না। —‘কিন্তু!’
—‘কি?’ অধৈর্য হয়ে অরিত্র প্রশ্ন করল।
—‘শী উড নো লঙ্গার বি ওয়াইফ।’
—‘অর্থাৎ?’
—‘ইনস্টেড, ইউ মে গেট আ মাদার।’
—‘হোয়াট ডু ইউ মীন ডক্টর?’
—‘আপনার স্ত্রীর মধ্যবয়সটা খুব তাড়াতাড়ি এসে যাবে মিঃ চৌধুরী। চেহারায়, প্রকৃতিতে। গৃহিণী, মা—এগুলোই হবে ওঁর ঠিক ভূমিকা। রমণীর ভূমিকাটা উনি হয়ত তেমন করে আর পালন করতে পারবেন না। শী উড লুজ ইনটারেস্ট ইন দ্যাট কাইন্ড অফ লাইফ। মানে এক অর্থে আপনাদের দুজনেরই যৌবন শেষ হয়ে যাচ্ছে এই অপারেশনটার সঙ্গে সঙ্গে।’
—‘কিন্তু আমি তো অসুস্থ নই! আমি যে পূর্ণ যুবক’— অরিত্র উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার থেকে।
ডাক্তারের মুখ গম্ভীর। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। অরিত্র চৌধুরীর অন্তস্তল পর্যন্ত পেশাদার এক্স্পার্টের দৃষ্টি চলে যাচ্ছে। বললেন—‘সেইজন্য। সেইজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি। ডু য়ু ওয়ান্ট হার লাইফ, অর হার ইয়ুথ অ্যাট দিস মোমেন্ট। যু কান্ট কীপ বোথ।’
অরিত্রর দাম্পত্য-সম্পর্কের সারসত্যকে কেউ যেন কাঠগড়ায় তুলেছে। গূঢ় সন্দেহের চোখ দেখছে তাকে—তার বুকের সমস্ত ধুকপুকুনি, আত্মার হা হা চিৎকার, উল্লম্ফ ক্রোধ, ভয়। দম-আটকানো গলায় অরিত্র বলল—‘অফ কোর্স আই ওয়ান্ট হার—হার লাইফ। দ্যাট ইজ দি ফাস্ট কনসিডারেশন’, একটু থেমে বলল—‘অ্যান্ড অলসো দি লাস্ট।’
ডাক্তারের চেম্বার যেন শ্বাস রুদ্ধ করেছিল। কে কোথায় নিশ্বাস ফেলল। ডাক্তারের গলা মৃদু, মমতাময়—‘কিন্তু জীবনই বলুন, যৌবনই বলুন, সবটাই আপনাদের যৌথ, কমিউনিটি প্রপার্টি—কি বলেন? মিঃ চৌধুরী, আপনি মিসেসের সঙ্গে ভালো করে কথা বলে নিন। উনি কি চান। আমি বলেছি নাইন্টি পার্সেন্ট কেসে বিপদ। তারপরেও টেন পার্সেন্ট থাকে। সেই দশের মধ্যেও পড়তে পারেন ভাগ্যে থাকলে। উনি কি চান সেটাও খুব ইমপরট্যান্ট। আপনি যান, বুঝিয়ে বলুন।
শুনে নীলম কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর বলে উঠল—‘জী নহী। অপারেশন করাবার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। আমাকে রিস্কটা নিতে হবে। অরি, আমাকে মাপ করো।’
—‘কিন্তু নীলম, এক দিন না একদিন তুমি স্বাভাবিকভাবেই এই জীবনে প্রবেশ করবে। চেঞ্জ অফ লাইফ শুধু। সে-ও কি জীবন নয়? হয়ত অন্য অনেক আনন্দের দুয়ার খুলে যাবে। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো কেন? অপারেশন না করালে ক্যানসার, বুঝেছো? এবং দুঃসহ যন্ত্রণা, এবং সব শেষ।’
যন্ত্রণাকাতর গলায়, সংশয়ভরা চোখে, বদ্ধ গলায় নীলম বলেছিল—‘ভয় আমি নিজের জন্য থোড়ি পাই অরি। ভয় পাচ্ছি তোমার জন্য। তোমাকে। আমি তাহলে আর তোমার কোন কাজে লাগব!’
অরিত্রর মুখ খড়ির মতো শাদা হয়ে গেছে। কি বলছে নীলম? সে ঠিক শুনছে তো? সে কি এই নিষ্ঠুর বিচারের যোগ্য? এই রায় কি তার পাওনা ছিল? নীলম আমাকে তবে প্রমাণ করতে দাও তোমাদের বিচার, তোমাদের রায় সর্বৈব ভুল। তোমার যৌবন তোমার অনন্য মনুষ্যত্বের অঙ্গ বলেই আমার কাম্য ছিল। বিহ্বল, ব্যাকুল অরির বুকে মাথা রেখে কাঁদছে নীলম। বুঝেছে তার যন্ত্রণা—‘আমি অন্যায় বলেছি, আমায় মাপ করো অরি। ভোগতৃষ্ণা তো আমারও।’ কত কাল, কত কত কাল পরে নীলম এসেছিল নিজে নিজে। প্রিয় নারী যখন দীর্ঘ খরার পর এমন বর্ষাধারায় আসে তখন সে বর্ষার কী অসাধারণ উন্মাদনা! নীল আকাশের ঘরে সে কি অদ্ভুত মধুযামিনী সেদিন কেটেছিল! যৌবন বিসর্জন দেবার ঠিক আগে।
কত কাল হয়ে গেল অরিত্র সে রাত ভোলেনি। নীলম বোধহয় ভুলে গেছে। ভুলে যেতেই সে চায়। এখন নিমীলিত চোখ, গলায় আঁচল, মাথার চারপাশে না আঁচড়ানো কোঁকড়া চুলের জ্যোতির্বলয়। নীলম পুজো করছে, পুজো করছে। অরিত্র ওকে বিরক্ত করো না। সারাটা দিন ধরে ও তোমার ঘর গোছাবে, ফুল সাজাবে, রাশি রাশি বই দেবে চীনে, মোগলাই, য়ুরোপীয় রাঁধবে। পুপুর লেখাপড়া, টেনিস, রোয়িং, কিছু দেখতে হয় না অরিত্রকে। ব্যাঙ্ক, বাজার, পোস্ট অফিস, কলকাতার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ। কিছু না, কিছু না। শুধু ঘরটাই যা আলাদা হয়ে গেছে।