Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিঃস্বার্থ প্রেম || Rabindranath Tagore

নিঃস্বার্থ প্রেম || Rabindranath Tagore

দেখো ভাই, সেদিন আমার বাস্তবিক কষ্ট হয়েছিল। অনেকদিন পরে তুমি বিদেশ থেকে এলে; আমরা গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম। “আমাদের কি মনে পড়ত?’ তুমি ঠোঁটে একটু হাসি, চোখে একটু ভ্রূকুটি করে বললে, “মনে পড়বে না কেন? উত্তরটা শুনেই তো আমার মাথায় একেবারে বজ্রাঘাত হল; নিতান্ত দুঃসাহসে ভর করে সংকুচিত স্বরে আর-একবার জিজ্ঞাসা করলুম, “অনেক দিন পরে এসে আমাদের কেমন লাগছে।?’ তুমি আশ্চর্য ও বিরক্তিময় স্বরে অথচ ভদ্রতার মিষ্টহাসিটুকু রেখে বললে, “কেন, খারাপ লাগবার কী কারণ আছে?’ আর সাহস হল না। ও-রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা আর হল না। বিদেশে গিয়ে অবধি তুমি আমাকে দু-তিনখানা বৈ চিঠি লেখ নি, সেজন্য আমার মনে মনে একটুখানি অভিমান ছিল। বড়ো সাধ ছিল, সেই কথাটা নিয়ে হেসে হেসে অথচ আন্তরিক কষ্টের সঙ্গে, ঠাট্টা করে অথচ গম্ভীরভাবে একটুখানি খোঁটা দেব’, কিন্তু তোমার ভাব দেখে, তোমার ভদ্রতার অতিমিষ্ট হাসি দেখে তোমার কথার স্বর শুনে আমার অভিমানের মূল পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। তখন আমিও প্রশ্নের ভাব পরিবর্তন করলুম। জিজ্ঞাসা করলুম, “যে দেশে গিয়েছিল সে দেশের জল-বাতাস নাকি বড়ো গরম? সে দেশের লোকেরা নাকি মস্ত মস্ত পাগড়ি পরে, আর তামাক খাওয়াকে ভারি পাপ মনে করে? এখান থেকে সেকেণ্ড ক্লাসে সেখেনে যেতে কত ভাড়া লাগে?’ এইরকম করে তোমার কাছ থেকে সেদিন অনেক জ্ঞান লাভ করে বাড়ি ফিরে এয়েছিলুম! তোমার আচরণ দেখে দুঃখ প্রকাশ করেছিলুম শুনে তুমি লিখেছ যে, “প্রথমত আমার যতদূর মনে পড়ে তাতে আমি যে তোমার ওপর কোনো প্রকার কুব্যবহার করেছিলুম, তা তো মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, যদি-বা তোমার কতকগুলি প্রশ্নের ভালোরকম উত্তর না দিয়ে দু-চার কথা বলে উড়িয়ে দিয়ে থাকি, তাতেই বা আমার দোষ কী? সে রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবারই বা তোমার কি আবশ্যক ছিল?’ তোমার প্রথম কথার কোনো উত্তর দেওয়া যায় না। সত্যই তো, তুমি আমার সঙ্গে কোনো কু-ব্যবহারই কর নি। যতগুলি কথা জিজ্ঞাসা করেছিলুম, সকলগুলিরই তুমি একটা-না-একটা উত্তর দিয়েছিলে, তা ছাড়া হেসেও ছিলে, গল্পও করেছিলে। তোমার কোনোরকম দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু তবু তুমি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর নি; সে তোমাকে বা আর কাউকে আমি বোঝাতে পারব না সুতরাং তার আর বাহুল্য উল্লেখ করব না। দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে, কেন তোমাকে ও-রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলুম। আচ্ছা ভাই তোমার তো হৃদয় আছে, একবার তুমিই বিবেচনা করে দেখো না– কেন জিজ্ঞাসা করেছিলুম। তোমার ভালোবাসার উপর সন্দেহ হয়েছিল বলেই কি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, যে, “আমাদের কি মনে পড়ত’ কিংবা “আমাদের কি ভালো লাগছে’, না তোমার ভালোবাসার ওপর সন্দেহ তিলমাত্র ছিল না বলেই জিজ্ঞাসা করেছুলম? যদি স্বপ্নেও জানতুম যে, আমাকে তোমার মনে পড়ত না, কিংবা আমাকে তোমার ভালো লাগছে না, তা হলে কী ও-রকমের কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতুম। তোমার মুখে শোনবার ভারি ইচ্ছা ছিল যে, বিদেশে আমাকে তোমার প্রায়ই মনে পড়ত। কেবলমাত্র ওই কথাটুকু নয়, ওই কথা থেকে তোমার আরও কত কথা মনে আসত। আমার বড়ো ইচ্ছা ছিল যে, তুমি বলবে– “অমুক জায়গায় আমি একটি সুন্দর উপত্যকা দেখলুম; সেখেনে একটি নির্ঝর বয়ে যাচ্ছিল, জায়গাটা দেখেই মনে হল, আহা ভা– যদি এখানে থাকত তা হলে তার বড়ো ভালো লাগত!’ একটা ছোটো প্রশ্ন থেকে এইরকম কত উত্তরই শুনতে পাবার সম্ভাবনা ছিল। যখন প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিলুম তখন মনের ভিতর এইরকম অনেক কথা চাপা ছিল!

আমি তোমার কাছে দুঃখ করবার জন্যে এ চিঠিটা লিখছি নে; কিংবা তোমার কাছে অভিমান করাও আমার উদ্দেশ্য নয়! আমি ভাই, কোনো কোনো লোকের মতো ঢাক ঢোল বাজিয়ে অভিমান করতে পারি নে; যার প্রতি অভিমান করেছি, তার কাছে গিয়ে “ওগো আমি অভিমান করেছি গো, আমি অভিমান করেছি’ বলে হাঁকাহাঁকি করতেও ভালোবাসি নে। যদি আমি অভিমান করি তো সে মনে মনে। আমার অভিমানের অশ্রু কেউ কখনো দেখতে পায় না, আমার অভিমানের কথাও কেউ কখনো শোনে নি; অভিমান আমার কাছে এমনই গোপনের সামগ্রী। তাই বলছি তোমার কাছে আজ অমি অভিমান করতে বসি নি। তোমার সঙ্গে আমার কতকগুলি তর্ক আছে, তার মীমাংসা করতে আমার ভারি ইচ্ছে।

তোমার সমস্ত চিঠিটার ভাব দেখে এই মনে হল যে তোমার মতে যারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসে তারা আর ভালোবাসা ফেরত পাবার আশা করে না। যেখানে ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা পাবার আশা আছে সেইখানেই স্বার্থপরতা আছে। এ সম্বন্ধে তোমাকে একটি কথা বলি শোনো। আমরা অনেক সময়ে ভালো করে অর্থ না বুঝে অনেক কথা ব্যবহার করে থাকি। মুখে মুখে কথাগুলো এমন চলিত, এমন পুরোনো , হয়ে যায় যে, সেগুলো আমরা কানে শুনি বটে কিন্তু মনে বুঝি নে, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কথাটাও বোধ করি সেইরকম একটা কিছু হবে। যখন আমরা শুনে যাই তখন আমরা কিছুই বুঝি নে, একটু পীড়াপীড়ি করে বোঝাতে বললে হয়তো দশজনে দশ রকম ব্যাখ্যা করি। স্বার্থপরতা কথা সচরাচর আমরা কী অর্থে ব্যবহার করে থাকি? আহার করা বা স্নান করাকে কি স্বার্থপরতা অতএব নিন্দনীয় বলে? আহার না করা বা স্নান না করাকে কি নিঃস্বার্থপরতা অতএব প্রশংসনীয় বলে? মূল অর্থ ধরতে গেলে আহার বা স্নান করাকে স্বার্থপরতা বলা যায় বৈকি? কিন্তু চলিত অর্থে তাকে স্বার্থপরতা বলে না। সকল মানুষই মনে মনে এমন সামঞ্জস্যবাদী, যে, যখন বলা হল যে, “আহার করা ভালো’ তখন কেউ এমন বোঝেন না, বিরাম বিশ্রাম না দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাব্বিশ ঘণ্টাই আহার করা ভালো। তেমনি যখন আমরা স্বার্থপরতা কথা ব্যবহার করি, তখন কেউ মনে করে না যে, নিশ্বাস গ্রহণ করা স্বার্থপরতা বা বাতাস খাওয়া স্বার্থপরতা। যা-কিছু পঙ্কজ তাকে যেমন পঙ্কজ বলে না, যা কিছু অচল তাকে যেমন অচল বলে না, তেমনি যা-কিছু স্বার্থপরতা তাকেই স্বার্থপরতা বলে না। খাওয়াদাওয়াকে স্বার্থপরতা বলে না, কিন্তু যে ব্যক্তি কেবলমাত্র খাওয়াদাওয়া করে আর কিছু করে না, কিংবা যার খাওয়াদাওয়াই বেশি, পরের জন্য কোনো কাজ অতি যৎসামান্য, তাকে স্বার্থপর বলা যায়। আবার তার চেয়ে স্বার্থপর হচ্ছে যারা পরের মুখের গ্রাস কেড়ে নিজে খায়। এ ছাড়া আর কোনো অর্থে, কোনো ভাবে স্বার্থপর কথা ব্যবহার করা হয় না। তা যদি হয় তা হলে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলতে কী বুঝায়? যদি মূল অর্থ ধর তাহলে ভালোবাসC স্বার্থপরতা। যখন এক জনকে দেখতে ভালো লাগে, তার কথা শুনতে ভালো লাগে, তার কাছে থাকতে ভালো লাগে ও সেইসঙ্গে সঙ্গে তাকে না দেখলে, তার কথা না শুনলে ও তার কাছে না থাকলে কষ্ট হয়, তার সুখ হলে আমি সুখী হই, তার দুঃখ হলে আম দুঃখী হই, তখন অতগুলো ভাবের সম্মিলনকেই ভালোবাসা বলে। ভালোবাসার আর-একাট উপাদান হচ্ছে, সে আমাকে ভালো বাসুক, অর্থাৎ তার চোখে আমি সর্বাংশে প্রীতিজনক হই এই বাসনা। ভেবে দেখতে গেলে এর মধ্যে সকলগুলিই স্বার্থপরতা। এতগুলি স্বার্থপরতার সমষ্টি থেকে একটি স্বার্থপরতা বাদ দিলেই কি বাকিটুকু নিঃস্বার্থ হয়ে দাঁড়ায়? কিন্তু যেটিকে বাদ দেওয়া হল সেটি অন্যান্যগুলির চেয়ে কী এমন বেশি অপরাধ করেছে? তা ছাড়া এর মধ্যে কোনোটাকেই বাদ দেওয়া যায় না। এর একটি যখন নেই তখন বোঝা গেল যে, যথার্থ ভালোবাসাই নেই। যাকে তোমার দেখতে ভালো লাগে না, যার কথা শুনতে ইচ্ছে করে না, যার কাছে থাকতে মন যায় না তাকে যদি ভালোবাসা সম্ভব হয় তা হলেই যার ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না তাকে ভালোবাসাও সম্ভব হয়। যাকে দেখতে শুনতে ও যার কাছে থাকতে ভালো লাগে, কোনো কোনো ব্যক্তি দুদিন তাকে দেখতে শুনতে না পেলে ও তার কাছে না থাকলে তাকে ভুলে যায় ও তার ওপর থেকে তার ভালোবাসা চলে যায়, তেমনি আবার যার ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে তার ভালোবাসা না পেলেই কোনো কোনো ব্যক্তির ভালোবাসা তার কাছ থেকে দূর হয়; তাদের সম্বন্ধে এই বলা যায় যে, তাদের গভীররূপে ভালোবাসার ক্ষমতা নেই। এটা নিশ্চয় বলা যায় যে, ভালোবাসার যতগুলি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উল্লেখ করলুম, ভালোবাসা যেখানে থাকে তারাও সেইখানে থাকবেই থাকবে। তাদের মধ্যে একটাকে বাদ দিয়ে বাকিটুকুকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলাও যা আর ঘড়ির কল বা তার কাঁটা বা তার সময় চিহ্ন বাদ দিয়ে তাকে খাঁটি ঘড়ি বলাও তা। এখন এক-এক সময় হয় বটে, যখন ভালোবাসার প্রতিদান পাবার কথা মনেই আসে না– যেমন দ্বারশূন্য বাতায়নশূন্য আলোকশূন্য জনশূন্য কারাগারে রুদ্ধ ব্যক্তির মুক্তির কথা কল্পনাতেই আসে না। কিন্তু সেই কারারুদ্ধ ব্যক্তির মুক্তির কথা মনে আসে না বলে বলা যায় না যে স্বাধীনতার ইচ্ছা মানুষের স্বভাব-সিদ্ধ নহে। তেমনি যখন আমরা ভালোবাসার পাত্র আকাশের জ্যোতির্ময় জলদ-সিংহাসনে, আর আমি পৃথিবীর মৃত্তিকায় একটি সামান্য কীট ধুলায় অন্ধ হয়ে বিচরণ করছি– যখন তার পদ-জ্যোতির একটুমাত্র আভাস দেখা, যখন সংগীত নয় কথা নয়, কেবল অতি দূর থেকে তাঁর কণ্ঠের অস্ফুট স্বরটুকু মাত্র শোনা আমার অদৃষ্টে আছে, যখন তাঁর নিশ্বাস বহন ক’রে তাঁর গাত্র স্পর্শ করে তাঁর কুন্তল উড়িয়ে বাতাস আমার গায়ে অমৃত সিঞ্চন করে, ও সেইটুকু সুখেই আমার চোখ ঢুলে পড়ে, আমার গা শিউরে উঠে, তার চেয়ে আমার আর কোনো আশা নেই, তখন যদি আমার ভালোবাসার প্রতিদান পাবার কথা মনে আসে তো তা থেকে বলা যায় না যে, ভালোবাসার প্রতিদান পাবার আশা স্বভাবতই ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে যে থাকবে এমন নয়, সেইরকম অবস্থায় ভালোবাসার প্রতিদান পাবার আশা মনে স্পষ্ট না আসুক, তবু কি সে ব্যক্তির মনে তৃপ্তি থাকে? সর্বদাই কি তার মনটা হাহাকার করতে থাকে না? তার মনের মধ্যে কি এমন একটা নিদারুণ অভাব ঘোরতর শূন্যতা থাকে না, যে-শূন্য সমস্ত জগৎ গ্রাস করেও পূর্ণ হতে পারে না? তার হৃদয়ের সে মরুভাব কেন? সে কি তার প্রতিদানের মর্মভেদী আশাকে নিরাশার সর্বব্যাপী বালুকার তলে নিহিত করে ফেলা হয়েছে বলেই না? এমন কোনো অমানুষিক মানুষকে কি কেউ দেখেছে, যে ভালোবাসার প্রতিদান না পেয়েও, প্রতিদানের আশা বা কল্পনা না করেও মহাযোগীর মতো মনের আনন্দে আছে। প্রতিদানের আশা ত্যাগ করেও অনেকে ভালোবাসে বটে, কিন্তু ভালোবেসে কি সুখী হয়? আচ্ছা তর্কের অনুরোধে মনেই করা যাক যে, ভালোবাসার প্রতিদান পাবার আশা যে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে থাকবেই তা নয়, কিন্তু তাই বলে কি প্রতিদান পাবার একটা ইচ্ছামাত্রই স্বার্থপরতা? যোগাভ্যাস-ক্রমে কোনো যোগী ক্ষুধাতৃষ্ণা একেবরে দূর করে নিষ্কাম হয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু ক্ষুধাতৃষ্ণা কি স্বার্থপরতা? আমার শরীরের ধর্মই এই যে, অবস্থা বিশেষে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণার উদ্রেক হয়, সে উদ্রেকটুকু অবশ্য স্বার্থপরতা নয়; কিন্তু আমার সেই ক্ষুধাবৃত্তির জন্যে আর-একজন ক্ষুধিত ব্যক্তিকে যদি তার আহার থেকে বঞ্চিত করি, তা হলে আমার স্বার্থপরতা হয় বটে! আমার মনের ধর্ম এই যে, ভালোবাসার প্রতিদান পেতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেই ইচ্ছাটুকুই স্বার্থপরতা নয়; তবে যদি সেই ইচ্ছায় অন্ধ হয়ে এমন অন্যায় উপায়ে আমার ভালোবাসার পাত্রের কাছে প্রতিদান পাবার চেষ্টা করি যে, সে তাতে কষ্ট পায় বা বিপদে পড়ে তা হলেই সেটা স্বার্থপরতা হয়ে দাঁড়ায়।

তোমার চিঠি পড়ে একটা কারণে বড়ো হাসি পেল। ভাবে বোধ হয় যে, তোমার মতে যারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসে তারা ভালোবাসার পাত্রের কাছে যে আদর না পেয়েও কেবল সুখী থাকবে তা নয়, অনাদর পেয়েও তারা কষ্ট পাবে না। যেরকম অবস্থা হোক না তারা কেবল নিজে ভালোবেসেই সুখী থাকবে। ভালোবাসার লোকের মিষ্টি হাসিমুখখানি দেখলে যদি নিঃস্বার্থ প্রেমিকের আনন্দ হয় তবে তার কাছে আদর পেলেই বা কেন না হবে। তার মুখখানি না দেখলে যদি কষ্ট হয় তবে আদর গেলেই বা কষ্ট না হবে কেন?

আমি কাকে স্বার্থপর ভালোবাসা বলি জান? যে ভালোবাসা খাঁটি ভালোবাসা নয়। ভালোবাসার গিল্টি করা ইন্দ্রিয়-বিকার। সে ভালোবাসায় ভালোবাসার চাকচিক্য আছে, ভালোবাসার সুবর্ণ বর্ণ আছে, কেবল ভালোবাসা নেই। সেরকম ভালোবেসে যে তোমার ভালোবাসার পাত্রকে তোমার চক্ষে অত্যন্ত নীচে করে ফেলছ তাতে তোমার বুকে লাগে না। তোমার চক্ষে যে সে রক্তমাংসের সমষ্টি একটা উপভোগ্য সামগ্রী বৈ আর কিছুই দাঁড়াচ্ছে না, তাতে তোমার কিছুমাত্র আত্মগ্লানি উপস্থিত হয় না! যখন তার প্রতিমাকে তোমার হৃদয়ের মধ্যে আনো, তখন তোমার হৃদয়ের মধ্যে এমন এক তিল নির্মল স্থান রাখ নি যেখানে তাকে বসাতে পারো! তোমার বীভৎস দুর্গন্ধময় হৃদয়ে সে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে, দিনরাত তার পদে কুৎসিত লালসা ও কলুষিত কল্পনা উপহার দিচ্ছ, তেমন বীভৎস প্রতিমাপূজাকে যদি ভালোবাসা নিতান্ত বলতে হয় তা হলে একেই আমি স্বার্থপর ভালোবাসা বলি। আমার মত এই যে, দৈত্যদের যেমন দৈত্যই বলে, কুদেবতা বা কোনো রকম বিশেষত্ব-বিশিষ্ট দেবতা বলে না তেমনি উপরি-উক্ত ব্যবহারকে স্বার্থপর ভালোবাসা না বলে তার যা যথার্থ নাম তাকে সেই নামেই ডাকা উচিত, তার জাল-নাম ভালোবাসা তার যথার্থ নাম ইন্দ্রিয়পরতা। ভালোবাসার চক্ষে যাকে দেখা যায়, কল্পনা তাকে স্বর্গের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করে, তার চার দিকে স্বর্গের কিরণ দীপ্তি পেতে থাকে– আর ইন্দ্রিয়পরতার চক্ষে যাকে দেখ, সে যদি স্বর্গীয় হয় তবু তোমার কল্পনা তাকে সে স্বর্গের আসন থেকে নামিয়ে পৃথিবীর আবর্জনা-মধ্যে স্থাপন করে, এর চেয়েও কি স্বার্থপরতা আর আছে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress