নব একলব্য
মহাভারতের একলব্য ভাবগুরু দ্রোণাচার্যকে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে গুরু দক্ষিণা দিয়েছিল, কিন্তু গুরু প্রতিবন্ধী শিষ্যের কোন দায়ভার নেননি। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল একলব্য তার উল্লেখ আমরা মহাভারতে কোথাও পাইনি। আমার গল্পের একলব্য এক শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মে ছিল। তার হাত ও পায়ের আঙ্গুল গুলো সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি।
একলব্যের বাবা,নিবারণ ভট্টাচার্য ভারতমাতার সেবক হিসাবে সীমান্তরক্ষায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। মা অসীমা পরিবারে,সুগৃহীনি হয়ে সংসার ও সন্তান পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নিবারণের বাল্যবন্ধু পরাণ মুখার্জী এলাকার পরাণ মাষ্টার স্কুলের দায়িত্বের সাথে বন্ধুর পরিবারের খোঁজখবর নিতেন ও বন্ধুকে পাঠাতেন। ছেলেবেলা থেকেই পরাণ মাষ্টার একলব্যর পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন , পাশের পাড়ায় তাঁর বাড়িতে দিয়ে আসতো অসীমা , পরাণবাবু নিজের স্কুলেই ভর্তির ব্যবস্থা করে ছিলেন। প্রথম প্রথম সুস্থ ছেলেরা তাকে বিরক্ত করত তার শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে। একলব্যর মা তাকে সাহস যুগিয়ে শান্ত ও ধৈর্য্যশীল হতে, বলেছিলেন পরীক্ষায় ভালো ফল করলেই ওদের সঠিক উত্তর দেওয়া হবে। অক্ষরে অক্ষরে মায়ের কথা পালন করেই সকলের সমীহ আদায় করেছিল। আর একজন ও তাকে এগিয়ে চলার উৎসাহ দিত , সে হল একলব্যর চেয়ে তিন বছরের ছোট পরাণবাবুর একমাত্র মেয়ে সোনালী, সমস্ত মুস্কিলের আসান ছিল সে। ক্রমশ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জেলার প্রথম স্থান অধিকার করেছিল একলব্য । এরপর পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে কলকাতার এক নামী কলেজে স্থান পেতে, পরাণবাবু তাঁর পরিচিত একজনের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। এভাবেই স্নাতকস্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথমস্থান অধিকার করে ,স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা চলাকালীন , সীমান্তে শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদের মৃত্যু বরণ করলেন নিবারণ বাবু। ইতিমধ্যে সোনালী উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করে কলকাতায় এলে, পরাণ বাবু একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে স্ত্রী অনুভা ও সোনালীকে সেখানে রাখলেন আর নামকরা মহিলা কলেজে মেয়েকে ভর্তি করলেন।
কিছুদিন পর নিবারণের মৃত্যুবার্ষিকীর কাজকর্মের জন্য গ্রামে ফিরল একলব্য , শ্রাদ্ধের শেষে পরাণ বাবু অসীমাকে বললেন কলকাতার ভাড়া বাড়িতে তাঁর পরিবারের সাথে একলব্যকে নিয়ে থাকতে। মনে সায় না দিলেও একলব্যর কথা ভেবে চলে এলেন কলকাতায়। স্নাতকোত্তরের ফল বেরানোর পর এর খুশির খবর, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার থেকে ডাক পেল বিঞ্জানী হিসাবে যুক্ত হবার জন্য। মাকে নিয়ে পাড়ি দিল কর্মক্ষেত্র শ্রীহরিকোটার উদ্দেশ্যে ,সেখানেই থাকার ব্যাবস্থা হল। এদিকে স্নাতক হওয়ার পর সোনালী ঠিক করল আইন নিয়ে পড়ে আইনজীবী হবে। সর্বভারতীয় ভর্তির পরীক্ষা দিয়ে কলিঙ্গ আইন কলেজে ভর্তি হল। আইনের স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষে, ওড়িশার উচ্চ ন্যায়ালয়ে সু -আইনজীবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এরমধ্যে পরাণ বাবু শিক্ষকতার থেকে অবসর নিয়ে সপরিবারে ভুবনেশ্বরে সপরিবারে মেয়ের কাছে চলে এসেছেন। দুই পরিবার এখন ওড়িশা নিবাসী, এমত অবস্থায় পরাণ বাবু তাঁর বহুদিনের সুপ্ত ইচ্ছা পূরণে জন্য অসীমাকে যোগাযোগ করে ভুবনেশ্বর আসার আমন্ত্রণ জানালেন। ওরা আসার পর তিনি প্রস্তাব দিলেন সোনালীকে যেন পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করে অসীমা। বিনাবাক্যব্যয়ে অসীমা রাজি হয়ে গেলেন। একলব্য সোনালীকে একান্তে জিঞ্জাসা করল ,সে এই প্রতিবন্ধী মানুষটাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে মন থেকে রাজি কিনা, সোনালী সলাজে জানাল বহুদিন আগে থেকেই একলব্যকে অন্তরের অন্তঃস্থলে স্থান দিয়ে ঈশ্বরের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। আজ মহাপ্রভু জগন্নাথ সেই ইচ্ছা পূরণ করলেন। এইভাবেই নব একলব্য তার গুরু দক্ষিণা দিল।