Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দ্বিসত্তা || Nondini Arzu

দ্বিসত্তা || Nondini Arzu

প্রমত্ত যমুনা এখন কিছুটা নমনীয় ধারায় বইছে। কিছু দিন আগেও ছিল ক্ষুব্ধ রোষে রণঙ্গিনী, ভাঙনের খেলায় মত্ত। এপারে বহু একর জমি বিলীন হয়েছে, নিশ্চিহ্ন হয়েছে অনেক ঘরদোর, গাছপালা । এই গ্রামের প্রায় অর্ধেকটা নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। স্কুল মসজিদ আর অল্প কিছু ঘরবাড়ি টিকে আছে এখনো। একটা বড় মাটির চাঁই ফাটল ধরে ঝুলে আছে। তাতে কিছু গাছ পালা। বিপদজনক তবুও কী এক অদৃশ্য টানে এখনো ভেঙে পড়েনি নদীর বুকে।
গোলাপি এ গায়ের মেয়ে তার এক হাতে একটা ছোট খাঁচা অন্য হাতে একটা নাদুসনুদুস ছাগলের বাচ্চা। কোলে জাপটে ধরে, ফাটল ডিঙ্গিয়ে গিয়ে হেলে পড়া গাছের গুড়িতে চুপ করে বসে রইলো। ছাগলের বাচ্চাটা কচি ঘাস খাচ্ছে।
খাঁচায় একটা টিয়ে পাখি খুব সুন্দর। দেখলে বোঝা যায় ঠিক মতো দানাপানি আদরযত্ন পায়। সে বিষণ্ন মনে নদীর দিকে তাকিয়ে বসে রইলো। দূরে জেলেনৌকা, মালবাহী বড় নৌকা ট্রলার যান্ত্রিক ভটভট আওয়াজ করে চলেছে গন্তব্যে।
গোলাপি মৌন নিমগ্ন নিজের ভিতরে, দ্বিসত্তার ছটফটানি তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সে নিজের পেলবহীন চিবুকে হাত বুলিয়ে শিউরে উঠলো।
সে এবার নবম শ্রেণিতে। বরাবর তার রেজাল্ট ভালো। খুব মেধাবী, ক্লাসে প্রথম স্থান তার দখলে। বুদ্ধিমত্তা আর সুন্দর ব্যবহার তাকে সবার প্রিয় করে তুলেছে। স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে সবাই তাকে ভালোবাসে। শিশু কালে বাবাকে হারিয়ে সে আর তার মা দু’জনের সংসার। গেলো বছর মায়ের চোখে কি ব্যামো হলো চোখের যন্ত্রণায় অস্থির। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে চিকিৎসা করিয়েছে, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। একচোখ অন্ধ হয়ে গেছে। অন্য চোখে ঝাপসা দেখতে পায়। কোন মতে দিনাতিপাত করছে।
আজ ক’দিন বাড়ি থেকে বের হয়নি সে। ভিতরে ভেঙেচুড়ে গেছে। কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারছে না। প্রায় অন্ধ মা কিছু বুঝতে পারছে না।
সন্ধ্যা নেমে আসছে লাল সূর্যের আভায় আগুন গোলা পানি, ঘোলা পানি এখন লোহিত বর্ণ ধারণ করেছে। গোলাপি মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। তাকে যেভাবে হোক পারতে হবেই পিছুপা হলে চলবে না।
তার পরিবর্তন গ্রামের কেউ কিছু জানে না। তাকে এই গায়ের ছেলে সবুজ খুব পছন্দ করে। সে মেম্বারের ছেলে। তার বুক চিরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার ভিতরে দুটি আলাদা অস্তিত্ব টের পায়। অন্তর্দ্বন্দ্বে সে ক্ষত-বিক্ষত। বুঝতে পারেনি কখন ঘোর সন্ধ্যা হয়েছে। ছাগল ছানা গুটিশুটি তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে।
সবুজ ক’মাস গোলাপির কোনো খোঁজ নিতে পারেনি। সে ঢাকায় লকডাউনে আটকা পড়ে ছিলো তারপর পড়ার চাপ। গত কাল ফিরেছে গ্রামে। তাদের বাড়ি গিয়েছিলো খোঁজ করতে, সেখানে না পেয়ে নদীর এই ধারটাতে এসেছে। সেখানে প্রায় অন্ধকারে গোলাপিকে বসে থাকতে দেখে জোরে ডাকলো,
“এই গোলাপি ওখানে কী করছিস, তোকে কতদিন বলেছি ওখানে যাবি না। কখন মাটির চাঁইটা তোকে নিয়ে তলিয়ে যাবে নদীর বুকে।”
ডাকে সে ফিরে তাকালো কিন্তু কোনো কথা বললো না। চেনা ডাকে তার বুকটা কেঁপে উঠলো। দু’চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অনিচ্ছায় সে উঠে দাঁড়ালো। ছাগল ছানাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ফিরে এসে সবুজের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আবছায়া অন্ধকারে গোলাপির মুখের দিয়ে তাকিয়ে সবুজ চমকে উঠলো মুখে কোন কথা জোগালো না এ কী দেখছে সে!
গোলাপি কথা বলে উঠলো,
“ভুলে যেও আমাকে।” ভারি ভাঙা কন্ঠস্বর, লালিত্যহীন।
সবুজ স্থবির স্থানুর মত দাড়িয়ে রইলো, কী বলবে!
গোলাপি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। দ্বিসত্তার মিশ্র প্রতিক্রিয়া তার বোধ কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সে সব ঝেড়ে ফেলে দিলো। সিদ্ধান্তে অটল রইলো।
চারিদিকে অন্ধকার কিছু রাতজাগা পাখি তখনো ডাকছে। গোলাপি ধড়ফড় করে উঠে বসলো। চিঠি সে রাতেই লিখে রেখেছিলো। চিঠিটা একটা কাগজে মুড়ে ছাগলের বাচ্চাটার গলায় বেঁধে দিলো। টিয়ে পাখির খাঁচার দরজা খুলে পাখিটাকে হাতে নিয়ে আদর করলো মাথায় চুমু খেলো তারপর খাঁচার উপর বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“তোকে মুক্ত করে দিলাম, সকালে উড়ে চলে যাস তোর যেখানে মন চায়।” রাতেই ছোট্ট একটা পুটুলি করে রেখেছিলো কয়েকটা জামা কাপড়। মাকে ডেকে তুললো চলো তাড়াতাড়ি ঘাটে নৌকা ছেড়েদেবে। মা কিছুই বুঝতে পারলো না। এতো ভোরভোর কোথায় যাবে! মেয়ের পরিবর্তন সে তার কথায় টের পাচ্ছিলো। তিনি কোন কথা না বলে উঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। গোলাপি ছাগলের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সবুজদের বাড়ির আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ালো।
শুনসান সবাই ঘুমে অচেতন। ছাগলটাকে সবুজের ঘরের সামনে বেঁধে রেখে কানে কানে বললো, “লক্ষ্মী হয়ে থাকবি কেমন, দুষ্টুমি একদম না।”
তারপর আর পিছনে না তাকিয়ে হন হন করে বাড়ি এসে পুটুলিটা তুলে নিয়ে মায়ের হাত ধরে ঘাটের পথে চলতে লাগলো।
একদম ছোট কাল থেকে দেখছে সবুজ গোলাপিকে। গোলাপের মতই কমনীয় সুন্দর। গোলাপি গায়ের রঙে নাম যেন সার্থক। সবুজের চাইতে বছর তিনেকের ছোট। পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে প্রায় এক সাথে বড়ো হয়েছে। সবুজের তাকে খুব ভালো লাগতো। মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। এবার ঢাকা থেকে এসেছে ভেবেছে মনের কথা খুলে বলবে তাকে কিন্তু সন্ধ্যা থেকে মনের উপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে চলেছে। ঝড়ের দাপটে তার স্বপ্ন-সাধ তছনছ হয়ে গেছে। সারারাত ঘুমাতে পারেনি শুধু ছটফট করেছে।
ভোরের দিকে একটু ঘুম এসেছে অমনি দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে বসেছে। কাক ডাকছে সবে ভোর হতে শুরু করেছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সবুজ। একটু চমকে উঠলো, গোলাপির ছাগলছানাটা দরজার কাছে বসে আছে। দরজা খোলার শব্দে উঠে তার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। সে খেয়াল করে দেখলো ছাগলের গলায় কাগজের পুটলি বাঁধা। তার বুকের ভিতর ফাঁকা হয়ে গেলো যেন। তারাতাড়ি পুটলি খুলে চিঠিটা এক নিশ্বাসে পড়ে উঠে দৌড়ে গোলাপিদের বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালো।
দরজা বাইরে থেকে শিকল তোলা। টিয়ার খাঁচার দরজা খোলা,শূণ্য। সবুজ প্রাণপণ চেষ্টায় গোলাপি বলে চিৎকার করে উঠলো।
শিকল খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো সব পড়ে আছে..
শুধু মানুষ দু’জন নেই। সে গত বছর ঈদে সখ করে তার জন্য একটা গোলাপি ওড়না এনে দিয়েছিল সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল গোলাপি। রং ওঠা আলনাটা একবুক শূন্যতা নিয়ে যেন বোবা হয়ে আছে।
সবুজ তাড়াতাড়ি ঘাটের দিকে দৌড়ালো, গোলাপিকে তার ফিরিয়ে আনতেই হবে, তাকে হারিয়ে যেতে দেবে না সে কিছুতেই। তার সব কথা জেনেছে সে চিঠিতে। এখনো সেই চিঠি সবুজের হাতে। সবুজ মুষড়ে পড়লো, দেখলো নৌকা ছেড়ে চলে গেছে এখন মাঝ নদীতে। কুয়াশা ছিঁড়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে যন্ত্র চালিত নৌকা।
পাড়ে দাঁড়িয়ে সবুজ একটা গোলাপি ওড়না ঢাকা মুখ দেখতে পেলো তার পরেই হারিয়ে গেলো।
সে চিঠিটা টুকরো করে ছিঁড়ে নদীর জলে ছুঁড়ে দিলো। ভাঙা ঢেউ আছড়ে এসে পড়ছে পাড়ে কাগজের টুকরো গুলো দুলছে। এক সময় কাগজের ছেঁড়া টুকরোগুলোও ডুবে যাবে গোলাপির সমস্ত ব্যথা বেদনার ভার নিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *