দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা
হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে দেবতাদের শিল্পী তাই তিনি দেবশিল্পী নামে পরিচিত— দেব বিশ্বকর্মা– তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি বাস্তুকার!
পুরান মতে অষ্ট বসুর অন্যতম প্রভাসের ঔরসে ও দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী বরবর্ণিনী বা যোগসিদ্ধার গর্ভে তাঁর জন্ম। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে প্রজাপতি ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে বিশ্বকর্মার উৎপত্তি। বেদে বিশ্বকর্মা কে অজাতপুরুষ বা সনাতন পুরুষ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি নানান শিল্প রচনা করেছেন—কুবেরের মহল, স্বর্গের দেবত সভা , ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা পুরী ,জগন্নাথ বিগ্রহ, রাবণের স্বর্ণলঙ্কা ভগবান শিবের ধনুক সবই তাঁর সৃষ্টি।
মার্কন্ড পুরাণে দেখতে পাই তিনি দেবীকে অভেদ্যকবচ , পরশু অন্যান্য অস্ত্র প্রদান করেছিলেন।
বিশ্বকর্মার হাতে দাঁড়িপাল্লা থাকে। এটির দুই পাল্লা জ্ঞান ও কর্মের প্রতীক। উভয়ের সমতা বজায় রেখেছেন তিনি। হাতুড়ি ধারণ করেন যা শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি যে শিল্পের দেবতা।
বিশ্বকর্মা বৈদিক দেবতা। ঋকবেদের দশম মন্ডলের একাশিও বিরাশি সূক্তদ্বয়ে বিশ্বকর্মার উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদ অনুসারে তিনি সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞ। তাঁর চক্ষু মুখমণ্ডল বাহু পদ সবদিকে পরিব্যাপ্ত। তিনি বাচস্পতি ,মনোজব ,বদান্য কল্যাণকর্মাও বিধাতা অভিধায় ভূষিত। তিনি ধাতা বিশ্ব দ্রষ্টা ও প্রজাপতি।
হিন্দু পুরাণ জুড়ে তার বিভিন্ন নির্মাণ। সত্য ,ত্রেতা, দ্বাপর ,কলি চার যুগ ধরে ছড়িয়ে রয়েছে তার অমর কীর্তিরা। সত্যযুগে তাঁর সৃষ্টির স্বর্গলোক! দেবরাজ ইন্দ্র এখান থেকেই মর্ত্যলোক শাসন করতেন! ত্রেতা যুগের বিশ্বকর্মা সৃষ্টি করেন স্বর্ণলঙ্কা। দ্বাপর যুগে সৃষ্টি করেন দ্বারকাও কলিযুগে তার অমর সৃষ্টি হস্তিনাপুর ও ইন্দ্রপ্রস্থ।
বিশ্বকর্মা বিশ্বভুবন নির্মাণ করেছিলেন। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র ,শিবের ত্রিশূল ,কুবেরের অস্ত্র ,ইন্দ্রের বজ্র ,কার্তিকেয়র শক্তি প্রভৃতি তিনি সৃষ্টি করেছেন।
শ্রী ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মূর্তিও তিনি নির্মাণ করেছিলেন।ভাদ্র সংক্রান্তির দিন তাঁর আরাধনা করা হয়। সব ধরনের শিল্পকার রা এঁর আরাধনা করেন। স্বর্ণকার কর্মকার দারুশিল্পী স্থাপত্য শিল্পী মৃৎশিল্পী সবাই নিজের কর্মে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশ্বকর্মা পূজা করে থাকেন। কোথাও কোথাও পূজার পর ঘুড়ি ওড়ানো হয়।
পুরানে উল্লেখ আছে যে চারটি বেদের মত চারটি উপবেদ ও আছে। উপবেদ গুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ ,গন্ধর্ববেদ ও স্থাপত্যবেদ। এই উপবেদ স্থাপত্যবিদ্যা বা বাস্তুবিদ্যা র রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান বাস্তুকার। আর্যাবর্তের শিল্পধারা বিশ্বকর্মা দ্বারা প্রবর্তিত বলে মনে করা হয়। তাঁর রচিত অন্তত 10 খানি পুঁথি এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্র টির নাম “বিশ্বকর্মা বাস্তুশাস্ত্রম”! এই বাস্তুশাস্ত্রের প্রথমেই বলা হয়েছে জগতের কল্যাণ কামনায় এই শাস্ত্র প্রচার করছেন–” বাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যয়া”
হাতিকে দেব শিল্পীর বাহন বলা হয়েছে! বিশ্বকর্মার মন্ত্রে দেবশিল্পীকে মহাবীর আখ্যা দেওয়া হয়।হাতির মহাবলের কথা সর্বজনবিদিত। এই দিক থেকে হাতি বাহন হিসেবে খুবই উপযুক্ত। এছাড়া হাতি দিয়ে কাজ করানোর প্রথা অতি প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। কর্ম— কর্মের ফলে শিল্পের বিকাশ! তাই বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের দেবতা ও কর্মঠ হাতি তার বাহন!
দেবশিল্পীর চরণ বন্দনা করে বলি–
” ওঁ দেবশিল্পী মহাভাগ দেবানাং কার্যসাধক
বিশ্বকর্মন্নস্তূভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদায়ক।”
তথ্যসূত্র- মহাভারত ,পুরান ও গুগোল!