Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দুই শ্রাদ্ধের গল্প || Tarapada Roy

দুই শ্রাদ্ধের গল্প || Tarapada Roy

দুই শ্রাদ্ধের গল্প

সব ধর্মেই শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা আছে। মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্যে এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে অনুষ্ঠান।

শ্রাদ্ধ শব্দটি এসেছে শ্রদ্ধা থেকে। যদিও লোকে কথায় কথায় অন্যের মুণ্ডপাত করে, শ্রাদ্ধ করে, শ্রাদ্ধ একটা প্রাচীন ও পবিত্র সামাজিক অনুষ্ঠান। হেলাফেলায় ইয়ারকি-ঠাট্টার বিষয় নয়।

আমরাও অন্তত এবার রঙ্গতামাশায় যাব না। দুটি শিক্ষামূলক গল্প বলব।

প্রথম গল্পটি বহুকালের পুরনো, একদা স্বয়ং বিদ্যাসাগর, প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র এই গল্পটি বলেছিলেন।

বিদ্যাসাগর মহোদয়ের ঝুলিতে গ্রাম্য ধর্মকর্ম, পুরুত-পণ্ডিত অনেক উপাখ্যান ছিল, এই গল্পটি তাঁর মধ্যে আমার মতে সরসতম।

সেই জন্যেই এই গল্পটির জন্যে আমার খুব দুর্বলতা। না হলে, একই গল্প দু’বার লিখি।

একদা পৌনঃপুনিক রসিকতাঁর প্রসঙ্গে একটি প্রবাদের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে আমি ভাবছিলাম, যেমন একই নদীর জলে দুবার ডুব দেওয়া যায় না, তেমনই একই ঠোঁটে দু’বার চুমু খাওয়া যায় না, একই রসিকতা দু’বার করা যায় না।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষায় দ্বিতীয়বার একই গল্প বলার মতো দুঃসাহসী আমি নই। আমি নিজেও এর আগে কী ভাবে লিখেছিলাম, সে আমার মনে নেই। আমার সহস্রাধিক রম্য রচনার মধ্যে সেই বিশিষ্টি রচনাটি খুঁজে বার করতে পারব এমন ভরসাও আমার নেই।

সুতরাং সেই শ্রাদ্ধের গল্পটা এবার আমি নিজের মতো করে বলি।

গ্রামের এক সম্পন্ন গৃহস্থ পরলোক গমন করেছেন। তিনি একটি বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা ছিলেন। খুব ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ হচ্ছে ভদ্রলোকের। বহু দূর দূর থেকে আত্মীয়বান্ধব সব এসেছেন। উঠোনে বড় বড় গর্ত করে উনুন কাটা হয়েছে। ভিয়েন বসেছে। থরে থরে পাহাড় বানিয়ে তরিতরকারি ফেলা হয়েছে। লোকজনে বাড়ি গিজগিজ করছে।

শুধু শ্রাদ্ধের ভোজের আয়োজন নয়। শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপারটাও খুব নিষ্ঠাভরে, আন্তরিকতা সহকারে ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোনও হেঁজিপেঁজি সাধারণ গ্রাম্য পুরুত নয়, অনেক দূরে ভট্টপল্লি থেকে দিকপাল পুরোহিত আনা হয়েছে। প্রবীণ পুরোহিতেরা এইকম বড় কাজের সময়ে দু’-চারজন শিষ্য সঙ্গে করে আসেন। শিষ্যেরা সহকারীর কাজ করে, ওরই মধ্যে যারা একটু লেখাপড়া জানে, একটু পাকাপোক্ত তাঁর া এই রকম অভিজ্ঞতাঁর মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরুতগিরির যোগ্য হয়ে ওঠে।

এবার প্রবীণ পুরোহিত মহোদয়ের সঙ্গে অন্যান্যদের মধ্যে একটি বয়স্ক শিষ্যও এসেছেন। শিষ্যটির মনে খুব দুঃখ। তিনি অনেকদিন গুরুদেবের সঙ্গে আছেন। কিন্তু গুরুদেব তাঁকে কাজেকর্মে কোথাও নিয়ে যান না। পুরুতগিরির তিনি কিছুই শিখতে পারছেন না।

একদিন গুরুদেবের কাছে মনের দুঃখ ব্যক্ত করায় গুরুদেব ঠিক করলেন এবার এই শিষ্যকে সঙ্গে নেবেন। কিন্তু সংগত কারণই তিনি শিষ্যকে বাদ রাখতেন। তাঁর বিদ্যাবুদ্ধির ওপর খুব আস্থা নেই গুরুদেবের।

যা হোক এবার গুরুদেব এই শিষ্যটিকে প্রধান সহকারী করেছেন, তাঁকে বলেছেন, ‘আমি কখন কী করি, কীভাবে করি, ভালভাবে লক্ষ রাখবে। এই ভাবে দেখতে দেখতে পুজো-আর্চার কাজ শিখে যাবে।’

শিষ্য খুব মনোযোগ দিয়ে গুরুদেবের পাশে পাশে থেকে তাঁকে সব কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। কাজের বাড়ি হইচই হট্টগোল চলছে। উঠোনে সামিয়ানা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর নীচে গুরুদেব শ্রাদ্ধের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। প্রথমে যজ্ঞ করতে হবে। তাঁর আগে তিনি সন্ধ্যাহিক করতে বসেছেন।

এদিকে হয়েছে কী যেমন বড় বাড়ি, অনেক মানুষজন তেমনই এক গাদা কুকুর-বেড়াল রয়েছে। আজ বাড়িতে ভিড় দেখে সেগুলো একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। উঠোনের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গুরুদেবের আদেশে একজন শিষ্য একটা বাখারির লাঠি নিয়ে কুকুরগুলোকে তাড়িয়েছে। কিন্তু বেড়াল নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বেড়ালগুলো সহজে বাগ মানার নয়। একটা বেড়াল তো সামিয়ানার নীচে এসে পুরুতমশায়ের আসনের কোষাকুষি উলটিয়ে দিয়ে চলে গেল। অন্য একটা বেড়াল শিকার ধরার ভঙ্গিতে গুটিগুটি শালগ্রাম শিলার দিকে এগোচ্ছিল। গুরুদেব দুটো বেড়ালকেই ধরে ফেললেন। তাঁর পর এক শিষ্যকে আদেশ দিলেন, সে দুটোকে উঠোনের এক কোণে একটি খুঁটিতে বাঁধতে বললেন। এদিক ওদিকে আরও কয়েকটা বেড়াল ছিল, সবগুলোকে ধরে মোটমাট, সাতটা বেড়াল খুঁটিতে বাঁধা হল।

গুরুদেবের প্রধান সহকারী তখন কলাপাতা কাটতে গিয়েছিলেন। এসে দেখেন উঠোনের এক পাশে সাতটা বেড়াল বাঁধা হয়েছে।

যা হোক, সেদিন শ্রাদ্ধকৰ্ম মোটামুটি ভালভাবেই মিটল। ফেরার পথে গুরুদেব প্রধান সহকারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাজকর্ম সব ভাল ভাবে বুঝে নিয়েছ তো?’ শিষ্যটি বললেন, ‘হ্যাঁ, সব বুঝে নিয়েছি।’

সাতদিনের মাথায় পুরুতমশায়ের আবার ডাক এল। একদিনে দুটো কাজ। এক গ্রামে অন্নপ্রাশন, অন্য গ্রামে শ্রাদ্ধ। দু’ক্ষেত্রেই তেমন ঘটা করে কিছু হচ্ছে না, যজমানদের অবস্থা তেমন ভাল নয়।

গুরুদেব প্রধান সহকারীকে নিয়ে ধর্মকর্মে বেরলেন। তিনি ঠিক করলেন নিজে আগে অন্নপ্রাশনের বাড়িতে যাবেন। সহকারী যাবে শ্রাদ্ধের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে উদ্যোগ, আয়োজন করবে। তিনি তাড়াতাড়ি অন্নপ্রাশন সেরে শ্রাদ্ধের বাড়িতে চলে যাবেন।

অন্নপ্রাশন সেরে গুরুদেব শ্রাদ্ধের বাড়িতে তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখেন অব্যবস্থার চূড়ান্ত। সহকারীকে ধারে কাছে কোথাও দেখতে পেলেন না। এদিকে জোগাড়যন্ত্র প্রায় কিছুই হয়নি। উঠোনের একপাশে দেখলেন চারটে বেড়াল খুটিতে বাঁধা রয়েছে।

এমন সময় প্রধান সহকারী, সেই শিষ্যটি বাড়ির পিছনের বাঁশবনের ভেতর থেকে এলেন। তাঁর দুই হাত রক্তাক্ত। গুরুদেব কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একী? বাঁশবনের মধ্যে কী করছিলে? তোমার হাতে রক্ত কীসের?’

রক্তাক্ত হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে শিষ্যটি বললেন, ‘ভয়ংকর পাজি বেড়াল। কিছুতেই ধরতে পারলাম না। উলটে আঁচড়িয়ে ছালাফালা করে দিল।’

গুরুদেব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেড়াল ধরতে গিয়েছিলে কেন?’

শিষ্য বললেন, ‘আগের শ্রাদ্ধে আপনিই তো সাতটা বেড়াল খুঁটিতে বাঁধলেন। কিন্তু এখানে সাতটা বেড়াল জোগাড় করা অসম্ভব। এ-বাড়ির দুটো পাশের বাড়ির দুটো চারটেকে বেঁধেছি। আর তিনটে ধরতে গিয়ে একেবারে নাজেহাল হয়ে গেলাম।’

অতঃপর এই বুদ্ধিদিগ্‌গজ সহকারীকে নিয়ে আর কখনও অন্য কোনও ক্রিয়াকর্মে গিয়েছিলেন কি না ওই গুরুদেব সে কথা বিদ্যাসাগর মশায় অবশ্য কিছু বলেননি।

এবার একটা আধুনিক শ্রাদ্ধের গল্প বলি। কলকাতা শহরের এক ধনাঢ্যব্যক্তি মারা গিয়েছেন। তাঁর উপযুক্ত ছেলে খুব ধূমধাম করে বাবার শ্রাদ্ধ করছে।

পারিবারিক গুরুদেব এসেছেন। এসব তাঁর খুব মওকার সময়। লম্বা লিস্ট ধরিয়েছেন যজমান পুত্রের হাতে। সেই তালিকায় ধান-দূর্বা থেকে, সোনা-হীরক, খাট-পালঙ্ক, ধুতি-ছাতা এমনকী পাদুকা-গামছা পর্যন্ত রয়েছে।

এদিকে গুরুঠাকুরেরা যেমন হয়ে থাকেন, ইনিও খুব লোভী ব্যক্তি। এ লোভ জিভের লোভ, জিনিসপত্রের পরেও খাদ্যদ্রব্যের লোভ। তিনি সাত্ত্বিক মানুষ, সত্যিসত্যিই মাছ-মাংস খান না, ডিম ছোঁন না। তাঁর লোভের বস্তু হল দই, রাবড়ি, কাঁচাগোল্লা ইত্যাদি মহার্ঘ জিনিস।

সুতরাং গুরুঠাকর পরমানন্দে মনে মনে জিব চেটে যজমানপুত্রকে বললেন, ‘তোমার বাবা, কর্তাঠাকুর, বড় সাত্ত্বিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যা যা খেতে ভালবাসতেন, সে সবের একটা বন্দোবস্ত রাখবে। শ্রাদ্ধের দিন সায়াহ্নে কর্তাঠাকুরের আত্মার শান্তির জন্যে আমাকেই সেটা খেতে হবে।’

শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পর সেদিন সন্ধ্যায় গুরুদেব যজমানপুত্রের কাছে এলেন।

যজমানপুত্র বিনীতভাবে গুরুদেবকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে এক বোতল স্কচ হুইস্কি, একটা তন্দুরি চিকেন আর একট প্লেট বিফ-স্টেক দিয়ে, তারপরে শুয়োরের মাংসের সেলামি আর সসেজ পরিবেশন করে বললেন, ‘বাবা, এইসব বড় ভালবাসতেন। আপনি না খেলে বাবার আত্মা শান্তি পাবে না। আপনি না খেলে আমি আপনাকে ছাড়ছি না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *