Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দলবদলের আগে || Moti Nandi

দলবদলের আগে || Moti Nandi

দমদম থেকে ভি আই পি রোড

০১.

দমদম থেকে ভি আই পি রোড ধরে কলকাতার দিকে যেতে ডান দিকে পড়বে সুশোভন পল্লি। তিরিশ ফুট চওড়া একটা পাকা রাস্তা ভি আই পি রোড থেকে বেরিয়ে ঢুকে গেছে এই পল্লির মধ্যে। রাস্তাটা বেড় দিয়ে রয়েছে বাইশ বিঘার এই বসতিকে। নামের সঙ্গে পল্লি শব্দটা থাকায় অনেকেরই মনে হতে পারে এখানে মাটির বা ছ্যাঁচা বাঁশের দেয়াল দেওয়া খড় বা টালির চালের ঘর, চালের ওপর লাউ বা কুমড়ো গাছের পাতা, কাঁচা নর্দমা আর তাতে জমে থাকা পাঁক, দড়িতে বাঁধা দু-চারটে গোরু বা ছাগল এবং প্রতি বাড়ির সামনে কুকুর আর শুকোতে দেওয়া ভিজে শাড়ি-ব্লাউজ, পাজামা ইত্যাদি দেখা যাবে, তা হলে তিনি কিন্তু ভুল করবেন।

সুশোভন পল্লি সম্পন্ন গৃহস্থদের একটা ছোটখাটো উপনিবেশ। পঁচাত্তরটি প্লট নিয়ে এটি গড়ে উঠেছিল কুড়ি বছর আগে। প্রতি বাড়ির সামনে পনেরো ফুট চওড়া রাস্তা, বাড়িগুলোর অধিকাংশেরই বুকসমান ছোট্ট লোহার ফটক, তারপর সিঁড়ি আর ছোট একটা দালান, যেটা গ্রিল ঘেরা। চেয়ার পেতে সেটা বৈঠকখানাও করা যায়। অধিকাংশ ফটকের পাশের দেয়ালে পাথরের ফলকে বাড়ির নাম আর নম্বর। নামের সঙ্গে স্মৃতি, ভিলা, কুঞ্জ, নীড়, কুটির, নিকেতন প্রভৃতি যোগ করা।

একটি ছোট পুকুর ও চিলড্রেনস পার্ক আছে সুশোভনে। পুকুরে স্নান করা বারণ এবং মাছধরাও। তবে পুঁটি ও মৌরলা ছাড়া আর কিছু যে নেই, সে সম্পর্কে পল্লির বাসিন্দারা নিশ্চিত। কেননা, মাছ-চোরেরাই জানিয়ে দিয়েছে, এই পুকুরে জাল ফেলে তারা আর বোকামি করবে না। আধ বিঘার ছোট্ট পার্কটিতে দুটি দোলনা ও দুটি সি-শ্য ছাড়া আছে মুখোমুখি দুটি কংক্রিটের বেঞ্চ। পার্কের চারদিক ঘিরে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ এবং রাস্তা। পার্কটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার কালে দোপাটি, গাঁদা, কামিনী, জবা প্রভৃতি ফুলগাছ দিয়ে সাজানো হয়েছিল। পল্লির অ্যাসোসিয়েশন থেকে একজন মালিও রাখা হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যে অধিকাংশ গাছ উধাও হওয়ায় সুশোভনকে শোভনীয় করার চেষ্টা থেকে অ্যাসোসিয়েশন ক্ষান্তি দেয়। পার্কের চারধারে যে বাড়িগুলি তার কয়েকটি চারতলা, কয়েকটি দোতলা এবং বাকিসব একতলা। পল্লির পেছন দিকে, যাঁরা দেরিতে প্লট কিনেছিলেন, তাঁদের বাড়িগুলির অধিকাংশই একতলা। কয়েকটা প্লটে প্লাস্টার ছাড়াই অসমাপ্ত বাড়িতে লোক বসবাস করছে। এই বাড়িগুলির পেছনে, অর্থাৎ সুশোভন পল্লির এলাকার বাইরেই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার মাঠ।

স্থানীয় লোকেরা এটাকে বলে ইলেকট্রিকের মাঠ। এখানে সকাল-বিকেল ফুটবল খেলা হয়, একটা ফাইভ-এ-সাইড, হাইটের টুর্নামেন্টও পাঁচ বছর আগে শুরু হয়েছে। বিন্দুবাসিনী চ্যালেঞ্জ শিন্ড বিজয়ীর জন্য, আর পাঁচকড়ি দে কাপ বিজিতের জন্য। কারখানা মালিকরা চার বছর আগে জমিটা বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল এক বিল্ডিং প্রোমোটারের কাছে। কিন্তু কীভাবে যেন সেটা জানতে পেরে নেতাজিনগর আর শহিদ কলোনির ছেলেরা বিক্রি বন্ধের দাবিতে লাঠি, বোমা এবং আরও কী সব জিনিস নিয়ে এমন রইরই কাণ্ড বাধিয়ে দেয় যে, মালিকরা আজও কারখানামুখো হতে সাহস পাচ্ছে না।

এপ্রিলের মাঝামাঝি চৈত্রের শেষাশেষি এমন একটা দিনের ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সুশোভন পল্লির চারজন রাস্তা দিয়ে স্বাভাবিক গতির থেকে একটু জোরে হাঁটছেন। বেড়ানোও নয় জগিংও নয়, সমীরণ নাম দিয়েছে বেগিং। এইভাবে যাঁরা ভোরে রাস্তায় হনহনিয়ে হাঁটেন তাঁদের সে বলে বেগার বাংলা করে বলে, স্বাস্থ্য ভিক্ষুক। ওর বোন শ্যামলা (শ্যামলী নয়) আর ভাই হিমাদ্রি ছাড়া এই নামকরণের ব্যাপারটা আর কেউ জানে না।

আর কেউ বলতে অবশ্য একজনকেই বোঝায়, তাদের পিসিমা রেখা গুপ্ত। মধ্য কলকাতায় মৌলালির কাছে মেয়েদের একটা স্কুলে ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টরের কাজ করেন আর কখনও কোনও শিক্ষিকা অনুপস্থিত থাকলে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্লাস ঠাণ্ডা রাখতে। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি, সত্তর কেজি ওজনের, ছেচল্লিশের কাছাকাছি বয়সি রেখা গুপ্ত তখন ক্লাসে ঢুকেই সারা ঘরে প্রথমে চোখ বুলিয়ে শুধু একবার হুম বলেন। সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ জোড়া চোখ ডেস্কের ওপর দৃষ্টি নামিয়ে আনে। তোমরা কি চাও এখন আমি তোমাদের পড়াই? ক্লাস নিরুত্তর থাকে। গুড। তোমরা কি চাও এখন আমি গল্প করি? মুহূর্তে একটা হ্যাঁ-আ-আ শব্দ সিলিংয়ের দিকে উঠতে উঠতে রেখা আন্টির আর একটা হুম-এর ধাক্কায় ডেস্কের ওপর গোঁত খেয়ে নেমে আসে। কিন্তু দশাসই ধড়ের ওপর বসানো মিষ্টি মুখটিতে ঝকঝকে আয়ত চোখজোড়া যখন প্রশ্রয়মাখা দুষ্টুমিতে পিটপিট করে ওঠে, তখনই আন্টি, গ অল—পোও এই শব্দটা এবার প্রজাপতির মতো উঠতে উড়তে সিলিং ছুঁয়ে ঘরে ছড়িয়ে যায়। ঘণ্টা বাজলে আন্টি যখন বেরিয়ে আসেন, তখন সারা ঘর হাসিতে লুটোপুটি কিংবা ছলছল চোখে গম্ভীর। টিচার্সরুমে রেখা গুপ্তকে বলতে শোনা যায়, মেয়েগুলো গল্পের কাঙাল; এদের বাবা-মায়েরা কেমন লোক! রোজ গল্প শোনায় না কেন? কল্পনাপ্রবণ না করে তুললে মনের বিকাশ ঘটবে কী করে? আমি তো রোজ রাতে গল্প শোনাতাম।

তিনি গল্প শোনাতেন নাককানমলা-দের। ডাকনাম অনুসারে নাক হল নাকু অর্থাৎ সমীরণ, কান হল কানু বাহিমাদ্রি আর মলা বলাবাহুল্য শ্যামলা। রেখা গুপ্ত বাস্কেটবল খেলায় ইউনিভার্সিটি আর স্টেটের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন কুড়ি বছর আগে পর্যন্ত। যখন তাঁর বউদি তিনটি শিশুকে রেখে মারা গেলেন এবং দাদা সুনীলবরণ আধা-সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন শুরু করলেন, তখন ছাব্বিশ বছরের পিসি চার ও দুই বছরের নাকু কানু আর তিন মাসের মলাকে বুকে তুলে নিয়ে একই সঙ্গে ওদের বাবা-মা হয়ে যান। রেখা গুপ্ত বিয়ে করেননি।

সমীরণ যাদের বেগার বলে, তাদের মধ্যমণিটি হলেন তারই পিসি! সুতরাং বেগার শব্দটি যাতে কোনওক্রমেই ওই একজনের কানে না পৌঁছয় সেই ব্যাপারে তিন ভাইবোন হুঁশিয়ার। পৌঁছলে কী হতে পারে সে বিষয়ে সমীরণের মোটামুটি একটা ধারণা আছে।

পাঁচ বছর আগে তিনটি শোবার ঘর, রান্নাঘর, কলঘর এবং খাবার দালানের মোট দশটি ছোট ও বড় জানলার কুড়িটি কাচের পাল্লা সাবান জল ও ন্যাতা দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়েছিল এবং এমনভাবে, যেন ন্যাতা বোলানোর দাগ না থাকে। ছিল বলে তিনটি জানলার রিপিট পরিষ্কার করতে হয়। যখন সে প্রথম ফাস্ট ডিভিশন লিগে দর্জিপাড়া একতা-য় খেলতে শুরু করেছে তখন যুগের যাত্রীকে সে গোল দিতেই রেফারি অফসাইড জানিয়ে গোলটি বাতিল করে। অবশ্যই অনসাইড থেকে করা গোল, তা ছাড়া সমীরণের মতো আনকোরা ফুটবলারদের কাছে যাত্রীর মতো গত বছরের চ্যাম্পিয়ান দলকে ঘেরা মাঠে প্রথম খেলতে নেমেই গোল দেওয়া তো চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার। রাগে জ্বলে উঠে সে মনের ভারসাম্য নষ্ট করে রেফারিকে বলেছিল, যাত্রীর চাকর এবং আরও কিছু কথা। সঙ্গে সঙ্গে লাল কার্ড তাকে দেখতে হয়েছিল। পরদিন কাগজে তাকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার খবরটা পড়ে বেগারদের একজন, রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কম্যান্ডান্ট জি. সি. দত্ত, এই আনস্পোর্টিং, ইনডিসিপ্লিন্ড বিহেভিয়ার-এর দুঃসংবাদটি পিসির কানে তুলে দেন। লজ্জায় মাথাকাটা যাওয়া রেখা গুপ্ত অতঃপর অপরাধী ভাইপোর আত্মপক্ষ সমর্থন শোনা ও রায় দেওয়ার জন্য কতক্ষণ সময় নিয়েছিলেন?

রেফারিকে তুই চাকর বলেছিস! এই পরিবারের ছেলে এমন অভব্য, অসভ্য, জন্তু, এমন আনকাস্টার্ড হবে ভাবতেও পারি না!

পিসি, এর থেকেও খারাপ নোংরা কথা ছেলেরা রেফারিকে বলে। আমি তো সেই তুলনায়—

চুউপ।

পিসি, রেফারি ইচ্ছে করেই আমার গোলটা—

আবার কথা!

রেফারি যাত্রীর টাকা— সমীরণের চুল ততক্ষণে পিসির হাতের মুঠোয় বন্দি। চা

কর বলেছিলিস? ঠিক আছে, চাকরের কাজই করবি। বাড়ির সব জানলার কাচ…।

সমীরণ হিসাব করে দেখেছে। বিচার ও শাস্তিদানপর্ব দুমিনিটেই সারা হয়েছিল। এখন যদি পিসি শোনে তার বন্ধুদের সে আড়ালে বেগার বলে, তা হলে নিশ্চিত তাকে বেগিং-এ নামিয়ে দেবে। হয়তো বলবে, যাও, শ্যামবাজার কি মৌলালি মোড়ে এই বাটিটা হাতে নিয়ে ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করো। ভিক্ষের পয়সা থেকে আট আনা খাবার জন্য খরচ করে বাকিটা আমায় রাত্রে দেবে। বেগারদের জিলিপি কিনে খাওয়াব। পিসিমার বেগার মানে সত্যিকারের ভিখারি, যারা রাস্তায় ভিক্ষা করে।

মাঝে মাঝেই বাজার করে ফেরার সময় হিমাদ্রি গরম জিলিপি কিনে রাস্তা দিয়ে খেতে খেতে আসত। বলাবাহুল্য, বাড়ি পৌঁছনোর আগেই জিলিপিগুলো শেষ করে ফেলত। হপ্তার ছটা দিন তাকে বাজার যেতে হয়। রবিবারে রবিবারে শ্যামলাকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করতে যান পিসি নিজেই। হিমাদ্রির জিলিপি খাওয়াটা একদিন দেখে ফেলে বেগারদের একজন, স্বাস্থ্য দফতরের রিটায়ার্ড ডেপুটি সেক্রেটারি অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য। যথারীতি পিসির কাছে নোংরা হাতে, ধুলোবালি বীজাণু ওড়া রাস্তা দিয়ে, আন-হাইজিনিক পরিবেশে তৈরি চিনির রসে ডোবানো জিলিপি, যা খেলে ডায়বিটিস হতে পারে, এমন জিনিস খাওয়ার সাঙ্ঘাতিক খবরটা পৌঁছে গেল।

সুশোভন পল্লিতে ঢোকার মুখে ভি আই পি রোডের ওপরই জয় মা তারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। হিমাদ্রি যথারীতি সেদিন বাজার থেকে বাঁচানো পয়সায় আটটা জিলিপি কিনে, ঠোঙাটার মুখ খুলে দুআঙুলে ধরে, একটাকে টেনে সবেমাত্র বের করেছে আর ঠিক তখনই পেছন থেকে ঠোঙাটা আমায় দে তো কানু। আঙুল থেকে জিলিপিটা প্রথমেই জমিতে খসে পড়েছিল। তারা মা-র সামনে বসে থাকা কুকুর জগা অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে একটা গোটা জিলিপি, সম্ভবত জীবনে প্রথম, পাওয়ার জন্য যার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেজ নেড়েছিল, সে তখন ফ্যাকাশে মুখের পিসির দিকে তাকিয়ে।

তোর হাতটা দেখি।

হিমাদ্রি ডান হাতের তালু মেলে ধরল। রেখা গুপ্ত তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করতে করতে নাক কোঁচকালেন। এই তো আলুর মাটি, মাছের গন্ধ লেগে রয়েছে…এই হাতে…।

ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ সঙ্গে বাচ্চা একটা ছেলেকে নিয়ে দোকানের একধারে হাত পেতে চুপ করে দাঁড়িয়ে। পিসি হাতছানি দিয়ে ছেলেটিকে ডেকে জিলিপির ঠোঙা তার হাতে দিয়ে বলল, খেয়েনে।

হিমাদ্রি তখন ক্ষীণস্বরে বলেছিল, পিসি ওর হাতেও ময়লা আছে।

থাকুক, ও আমার ভাইপো নয়।

এহেন পিসি প্রতিদিন ভোরে শ্যামলা আর সাত-আটটি বাচ্চা ছেলেমেয়েকে নিয়ে, ট্র্যাকস্যুট পরে সুশোভন পল্লিতে চক্কর দিয়ে ছোটেন। খুব জোরে নয়, আবার বেগারদের মতো অত ধীরেও নয়। ট্র্যাকস্যুটটা সমীরণের। গত বছর ইন্ডিয়া টিমের ক্যাম্পে নতুন একটা পাওয়ায় সে পিসিকে বলেছিল, শাড়ি পরে কি জগ করা যায়! কোনওদিন হোঁচট খেয়ে পড়বে, হাত পা ভাঙবে, বরং আমার একস্ট্রা একটা রয়েছে, তুমি এটা পরেই ছোটো।

পিসি-ভাইপোর উচ্চতা এবং ওজন সমান সমান। বাড়িতে ট্র্যাকস্যুট পরে নাককানমলাদের সামনে ট্রায়াল দিতে পিসি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় আটবার ছুটে ওঠানামা করে বলেছিলেন, জিনিসটা ভালই মনে হচ্ছে। অনেক ফ্রি লাগছিল। ওদেরও বলব ট্র্যাকস্যুট পরে দৌড়তে।

ওঁরা অর্থাৎ বেগাররা একদিন আলোচনায় বসেছিলেন রেখা গুপ্তর প্রস্তাবটা বিবেচনা করতে। বসাক দম্পতি অর্থাৎ বিল্ডিং কন্ট্রাক্টর সরোজ ও তাঁর স্ত্রী মালবিকা তাঁদের প্রধান অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন এই বলে—ট্র্যাকস্যুট পরলে তাঁদের যে হাইট তাতে আরও বেঁটে মনে হবে। স্বামী পাঁচ-এক, স্ত্রী চার-দশ। উচ্চতার ঘাটতি দুজনেই পুষিয়ে নিয়েছেন প্রস্থে। ঢোলা জিনিসটার মধ্যে ঢুকে দৌড়লে তাঁদের যে চলমান পিপের মতো দেখাবেই, তাতে কোনওরকম সন্দেহ তাঁরা পোষণ করছেন না।

এহেন অকপট স্বীকারোক্তির পর ট্র্যাকস্যুট পরিধানের জন্য তাঁদের ওপর আর চাপাচাপি কেউ করলেন না। জি. সি. দত্ত অবশ্য বলামাত্র রাজি, তবে একটা শর্তে, আমাদের স্পিড বাড়াতে হবে। যে স্পিডে তিনি সাব ইন্সপেক্টর থাকাকালীন একবার খোকাগুণ্ডার পশ্চাদ্ধাবন করে তাকে ধরেছিলেন তিন মাইল দৌড়িয়ে (প্রতি দশ দিন অন্তর গল্পটা বলে থাকেন, তিনি সেই স্পিডে ফেরার বাসনাটাই জানিয়ে দিলেন। প্রাক্তন পুলিশ অফিসারের বক্তব্যের বিরুদ্ধে ঘোর প্রতিবাদ জানালেন প্রাক্তন ডেপুটি সেক্রেটারি।

আমরা চোরগুণ্ডা ধরার জন্যই কি তা হলে রোজ সকালে দৌড় প্র্যাকটিস করব? ব্লাড সুগার, অম্বল, ডিসপেপসিয়া, এই তিনটেকেই আমি কন্ট্রোলে রাখার জন্য ঘড়ি ধরে মেপে হিসাব করে পা ফেলি, এর একটা ছন্দ আছে, তাল আছে। হুট করে স্পিড বাড়ানোটা উচিত হবে কি না সেটা ভেবে দেখা দরকার।

এরপর ট্র্যাকস্যুট পরার জন্য অনুরোধ জানিয়ে ফললাভ হবে না বুঝে আর কথা বাড়ানো হয়নি। রেখা গুপ্ত একাই পরেন। আজও তিনি দৌড়চ্ছিলেন। প্রথমে রেল এঞ্জিনের মতো, তারপর সাত-আটটি ক্ষুদ্র বগি, শেষ গার্ডের মতো শ্যামলা। চারজন বেগার উলটো দিক দিয়ে বেগিং করেন। আজও তাঁরা মুখখামুখি হতেই শ্যামলা বলল, আট। অর্থাৎ, তাঁদের আট চক্কর দৌড় সম্পূর্ণ হল।

ছয়। গম্ভীর স্বরে জি. সি. দত্ত নিজেদের সংখ্যাটি জানিয়ে দিলেন।

ছয় নয়, তিন। ভটচাষ ভৎসনা করলেন, মিছে কথা বলে লাভ কী?

আজ শনিবার, কার বাড়িতে চা খাওয়া সেটা কি ভুলে গেছেন? দত্ত খিচিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন।

সপ্তাহের পাঁচ দিন সকালের চা এবং কিঞ্চিৎ টা পাঁচ জনের বাড়িতে পর্যায়ক্রমে ওঁরা খান। শনিবারের পালা রেখা গুপ্তর, এইদিন ওঁর স্কুলের ছুটি থাকে। সাধারণত তিনি চায়ের সঙ্গে লুচি দেন, সহযোগে আলুহেঁচকি। অথবা লুচির বদলে হালুয়া। দেওয়ার পরিমাণটা নির্দিষ্ট হয়, ক চক্কর দেওয়া হল তার ওপর। ছয় চক্কর মানে ছটি লুচি অথবা বৃহৎ ছ চামচ হালুয়া।

চার চক্করের পরই চার বেগার পার্কের বেঞ্চে বসে পড়লেন। রেখা গুপ্ত পার্কের মধ্যে তখন বাচ্চাদের ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করাচ্ছেন। সাইকেলে দুটি খবরকাগজওলা তিরবেগে সুশোভনে ঢুকল। একজন অন্যদিকে চলে গেল, অন্যজন ওদের কাছে এসে ঝটপট তিনটি কাগজ হাতে ধরিয়েই সাইকেলে লাফিয়ে উঠল। রেখা গুপ্তর কাগজ বাড়িতে দেওয়া হয়। তার দাদা প্রথম পড়ার পর অন্যরা হাতে পায়।

তিনজন তিনটি কাগজ খুলে চোখের সামনে ধরলেন। মালবিকা খবরটবরের ধার ধারেন না। তিনি বাচ্চাদের ব্যায়াম করার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কপিলদেব কলকাতায় এসে কী বলেছে সেটা পড়ে দেখুন। দত্তমশাই গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন।

কী বলেছে? ভটচায অবাক চোখে তাকালেন ওর মুখের দিকে।

আপনার হাতেও তো একটা কাগজ রয়েছে। দত্ত প্রাক্তন পুলিশি স্বর বের করলেন। ভটচায তাড়াতাড়ি হাতের কাগজটা তন্ন তন্ন দেখে বললেন, নাহ্, আমার কাগজে নেই।

আমার কাগজেও নেই। বসাক যোগ করলেন।

তা হলে শুনুন— ট্যালেন্ট থাকলেই হয় না, বড় ক্রিকেটার হতে গেলে চাই নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছে আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়ার ইচ্ছে।..কেউ যদি সত্যি যোগ্য হয় তা হলে তাকে আটকে রাখা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি না। সে ঠিক ফুঁড়ে বেরোবেই।…যে কোনও খেলাকে ঘিরেই কলকাতার লোকের এত উৎসাহ যে, আমার দারুণ লাগে। একই সঙ্গে এটা ভেবেও খারাপ লাগে যে, কেন এই শহর একটা টেস্ট ক্রিকেটার তৈরি করতে পারছে না।দত্ত অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে দুজনের দিকে কয়েক। সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন? কপিলদেব কী বলতে চায় সেটা হৃদয়ঙ্গম হল?

একটু একটু। বসাক আমতা আমতা করে বললেন।

আমি পুরোটাই হৃদয়ঙ্গম করেছি। ভটচাযের মুখে হাসি ছড়ানো।

তা হলে বলুন। দত্ত দাবি জানালেন।

বাংলায় কিসসু ক্রিকেট খেলা হয় না। এখানে সবাই হুজুগে। ট্যালেন্ট হয়তো আছে, কিন্তু সবাই ফুলবাবু, একটুও পরিশ্রম করে না, কারণ ইচ্ছেটাই নেই। শুধু খবরের কাগজে ছবি বেরোলেই এখানে লোকে ভাবে সে বোধ হয় খুব বড় প্লেয়ার। ভটচায কথাগুলো বলে উদ্বিগ্ন চোখে দত্তর দিকে তাকিয়ে রইলেন। দত্ত চোখ বন্ধ করে মাথাটা ঈষৎ কাত করে অনুমোদন দিলেন।

আমাদের নাকু কিন্তু খুব খাটে। ইলেকট্রিক মাঠে সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, শুধু বল নিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। বসাক ফাঁক পেয়ে তাঁর কথাটা ঢুকিয়ে দিলেন।

কথা হচ্ছে ক্রিকেট নিয়ে, ফুটবল নিয়ে নয়। ভটচায ছোট্ট একটা দাবড়ানি দিলেন।

কথাটা আসলে সব খেলা নিয়েই, শুধু ক্রিকেট নিয়ে নয়। বসাকবাবু ঠিকই বলেছেন, এই শুনুন কপিলদেবের আর-একটা কথা। ওকে জিজ্ঞেস করা হয় পরিশ্রম করার ইচ্ছা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন কী করে? তাইতে বলছে,—এখানেই আমার মনে হয় পেশাদারদের সঙ্গে সাধারণ মানসিকতাসম্পন্ন লোকেদের তফাত। পেশাদারকে সবসময় সামনের দিকে চোখ রাখতে হয়। আরও, আরও, আরও, আরও। আমি এই নীতিতে বরাবর বিশ্বাসী। হাতির খিদে আমার।

ওরে বাপস, হাতির! চমকে উঠলেন ভটচায, আমার তো দুটো লুচি খেলেই অম্বল। আচ্ছা, হাতিরা কটা লুচি খেতে পারে?

দুটো। দত্ত খবরের কাগজে চোখ রেখে বিড়বিড় করে বললেন।

আচ্ছা দত্তবাবু, আমরা কি সাধারণ মানসিকতাসম্পন্ন লোকদের দলে পড়ি? বসাক কাঁচুমাচু মুখ করে জানতে চাইলেন।

সাধারণ মানসিকতা… দত্ত চিন্তায় ডুবে গেলেন এবং আধ মিনিট পর ভেসে উঠে জানালেন, পরিস্থিতি-বিশেষে সাধারণ মানুষও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। আমি যখন খোকাকে তাড়া করি কোনও ওয়েপন আমার কাছে ছিল না, কিন্তু ওর কাছে পিস্তল ছিল। এর পর তোমরা বুঝে নাও গোছের একটা হাসি দত্তর ঠোঁট মুচড়ে দিল।

রেখা গুপ্ত বাচ্চাদের বাড়ি পাঠিয়ে তখন হাজির হলেন ওঁদের সামনে। চলুন, চলুন। রাতে লেচি করে রেখে দিয়েছি, বেলব আর ভাজব। তবে আজ কিন্তু শুধু আলুভাজা, আমি এগোলাম, বাঙ্গালোর ক্যাম্প থেকে নাকুর আজই ফেরার কথা।

দ্রুত পায়ে শ্যামলাকে সঙ্গে নিয়ে রেখা গুপ্ত বাড়ির দিকে এগোলেন। ওঁদের। বাড়িটা সুশোভনের পেছন দিকে ইলেকট্রিক মাঠের লাগোয়া। মাঠে কয়েকটি ছেলে ফুটবল নিয়ে ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত। বরেন মুখখাটির একটা লন্ড্রির দোকান আছে নামে মাত্রই, আসলে গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ফুটবলার তৈরি করার কাজেই বেশি সময় দিয়েছেন। এখন পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও, কি শীত কি বর্ষা প্রতিদিন সকালে মুখখাটি একটা হুইসল গলায় ঝুলিয়ে মাঠে আসেন।

পাঁচ বছর আগে তাঁরই হাতে গড়া সমীরণকে তিনি দর্জিপাড়া একতার সেক্রেটারির কাছে নিয়ে যান। ছেলেটা ভাল খেলবে, ফুটবল সেন্সটা আছে, খাটিয়েও। সবথেকে বড় কথা স্বভাবচরিত্র ভাল। একে কয়েকটা ম্যাচ খেলিয়ে দেখুন। মুখোটির এই কটি কথাই যথেষ্ট ছিল। অবশ্য সমীরণ তার প্রথম ম্যাচেই রেড কার্ড দেখে। সেক্রেটারি তখন বলেছিল, নিমাই আর দুলালকে এক ঝটকায় টলিয়ে ভেতরে ঢুকে কী শটটা নিল দেখলি? ওকে সব ম্যাচ খেলাব।

সমীরণ সে বছর তেরোটা গোল দেয়। ষাট হাজার টাকায়, পরের বছর যুগের যাত্রী তাকে সই করায়। সই করাবার জন্য কথাবার্তা বলেছিল ঘুনু মিত্তির। তার পোশাকি নামটা যে কী, কেউ আর তা জানে না। পঁয়ত্রিশ বছর আগে খেলার দিন ক্লাবের সদস্য গেটে দাঁড়িয়ে সে কার্ড দেখে লোকেদের ভেতরে যেতে দিত। এরপর সেক্রেটারি নারায়ণ সেন-এর গাড়ির দরজা খুলে দেওয়ার অধিকার অর্জন করে। যাত্রীর কোনও ফুটবলার চোট পেলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন লোক পাওয়া যায় না তখন ঘুনু মিত্তিরই এগিয়ে যেত। এইভাবেই ধাপে ধাপে উন্নতি বা কুরে কুরে সেঁধিয়ে এখন সে কার্যকরী সমিতির সদস্য এবং নতুন সেক্রেটারি পতিতপাবন ওরফে পতু ঘোষের প্রায় ডান হাত।

ঘুনু প্রথমেই সমীরণকে জানিয়ে দিয়েছিল, তোর গোলটা ঠিকই হয়েছিল। তবে বড় ক্লাবের এগেনস্টে ছোট ক্লাব গোল করে সিজনের শুরুতেই দুটো পয়েন্ট নিয়ে নেবে আর বিশ লাখ টাকা দামের টিমের সাপোর্টাররা সেটা দাঁত বের করে দেখবে, তা তো হতে পারে না। সেটা ময়দানের নিয়ম নয়। সারথিকে গোল দিলেও রেফারি অফসাইড করে দিত। নইলে টেন্ট জ্বলে যাবে। কিছুদিন ময়দানের ঘাস চেন, তখন নিজেই সব বুঝতে পারবি। যাকগে, তোকে আমি যাত্রীতে নিয়ে যাব। বড় ক্লাবে খেলার সুযোগ এক বছর ছোট ক্লাবে খেলেই পাওয়াটা যে কত ভাগ্যের ব্যাপার সেটা কি তুই বুঝিস? আকাশবাণী ভবনের ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে তাদের কথা হচ্ছিল। সমীরণ আবেগে আপ্লুত হয়ে শুধু মাথা কাত করে জানিয়েছিল, সে বোঝে।

কিন্তু একটা কথা। ঘুনু গলা নামিয়ে চাপা স্বরে বলেছিল, যা কনট্রাক্ট হবে তার টেন পার্সেন্ট আমার। অ্যাডভান্স পাবি সিক্সটি পার্সেন্ট, ক্যাশ।

সমীরণ এবারও মাথা কাত করে ঢোঁক গিলে বলেছিল, বেশ, তাই হবে। কিন্তু কত দেবে আমায়?

চেষ্টা করব যাতে বেশি পাস, তুই বেশি পেলে তো আমিও বেশি পাব।

ষাট হাজার টাকার টেন পার্সেন্ট ছহাজার ঘুনু কেটে নিয়েছিল ছত্রিশ হাজার টাকার অ্যাডভান্স থেকে। একশো টাকার তিনশোখানা নোট যখন সে পিসিমার সামনে খাওয়ার টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে প্রণাম করেছিল তখন তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে বা বলতে পারেননি। শ্যামলা আঁতকে উঠে বলেছিল, দাদা পুলিশ টুলিস আসবে কি? ব্যাঙ্ক ডাকাতি করিসনি তো? হিমাদ্রি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে মন্তব্য করেছিল, কমই দিয়েছে। দাদার যা খেলা তাতে এক লাখ ষাট হাজার পাওয়া উচিত।

নোটগুলো গুছিয়ে দুহাতে তুলে রেখা গুপ্ত ছুটে গিয়েছিলেন কোণের ঘোট ঘরটায়, তার দাদার কাছে। একটু পরে চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে এসে বলেছিলেন, খুব অবাক হয়ে গেল, বলল, ফুটবল খেলে এত টাকা পাওয়া যায় জানতাম না তো! বললাম আরও চব্বিশ হাজার পাবে। তুই গিয়ে প্রণাম করে আয়।

সমীরণ গোঁজ হয়ে বসে থেকেছিল। বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের কোনওরকম সম্পর্ক নেই বললেই চলে। অফিস থেকে এসে ঘরে ঢোকেন, শুধু স্নান আর খাওয়ার সময়ই তাঁকে ঘরের বাইরে দেখা যায়, কারও সঙ্গে কথা বলেন না।

যা না, খুব খুশিই হবে।

সমীরণ ঘরে ঢুকে সুনীলবরণকে প্রণাম করতেই হাতের বইটা নামিয়ে তিনি ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসেন। বড় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন, এত টাকা যখন নিচ্ছ, সেইমতন খেলাটাও দিয়ে। নিজেকে অপমান কোরো না।

বাবার কথাগুলো সমীরণের মাথায় কীভাবে যেন গেঁথে গেছল। খাওয়ার টেবিলের কাছে এসে দেখল, পিসি কিছু নোট আলাদা করে গুনে রাখছেন।

ওগুলো কী জন্য? সমীরণ রীতিমতো অবাক হয়ে বলে।

প্রণামীর টাকা। যে গুরুর কাছে প্রথম শিক্ষা নিয়েছিস, যিনি তোকে হাতে ধরে এগিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ঋণ কোনওদিনই তো শোধ করতে পারবি না। তবু প্রণামী বলে এই ছ হাজার কাল সকালেই দিয়ে আসবি। খুব কষ্টে আছে ভাইপোদের সংসারে। দোকানটারও যা হাল হয়েছে।

দাদার আরও টেন পারসেন্ট গেল। হিমাদ্রি হালকা স্বরে বলতেই হাত তুলে সমীরণ তাকে চুপ করিয়ে দেয়।

কানু, এটাকে গেল বলিসনি। পিসি কেন গ্রেট লেডি জানিস? যে কাজটা সবার আগে করা উচিত সেটাই মনে করিয়ে দিয়ে অপরাধের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। বরেনদার কাছে কাল ভোরেই যাব। কিন্তু পিসি, আমাকে দিয়ে আবার যদি জানলার কাচ পরিষ্কার করাও তা হলে আমার মান-ইজ্জত আর থাকবে না।

কথাটা গ্রাহ্যে না এনে পিসি – কুঁচকে সমীরণকে একপলক দেখে নিয়ে বলেন, মান-ইজ্জত বলতে কী বুঝিস? নিজের বাড়ির জানলা নিজের হাতে পরিষ্কার করলে ইজ্জত খোয়া যায়? কতবার তোদের বিদ্যাসাগর মশায়ের গল্প শুনিয়েছি না? আসলে তোর মান-ইজ্জত নির্ভর করবে তো তোর খেলার ওপর। টিম যেদিন হারবে, গোল যেদিন দিতে পারবি না সেদিন তোর ইজ্জত থাকবে কি?

সিরিয়াস কথাবার্তায় পরিবেশ ভারী হওয়ার দিকে গড়াচ্ছে দেখে শ্যামলা হালকা করার জন্য বলেছিল, ওসব মান-ইজ্জতের কথা রাখো তো এখন, বলো এতগুলো টাকা নিয়ে তুমি কী করবে? তবে আমায় জিজ্ঞেস করলে বলব, একটা কালার টিভি আর—

আর দাদার জন্য একটা স্কুটার। হিমাদ্রি থামিয়ে দিয়েছিল বোনকে। থতমত হয়ে শ্যামলা বলে, তা তো দাদা কিনবেই, তবে একতলা বাড়িতে থাকাটা এতবড় প্লেয়ারের পক্ষে একদমই মানায় না। ছাদে একটা অন্তত ঘর না তুললে দোতলা বাড়ি বলা যাবে না।

সবাই কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেছল। অবশেষে পিসিই বলেন, ঘরে কে থাকবে?

তুমি। সমীরণ বলেছিল।

না। ওপরে আমায় তুলে দিয়ে নীচে তোমরা ভূতের নাচ নাচবে, এসব মতলব ছাড়ো। যদি ঘর হয় তো থাকবে দাদা, সঙ্গে বাথরুমও থাকবে।

হাঁপ ছাড়ার নীরবতাটা কাটিয়ে উঠে সমীরণ বলেছিল, কারেক্ট ডিসিশন। আমার প্রস্তাবটা প্রত্যাহার করছি। কিন্তু, পিসি, তোমার কি কিছু দরকার নেই?।

আমার দরকার! পিসি হতচকিত হলেন এবং তিনজনের পীড়াপীড়িতে অবশেষে বলেন, একদিন আমার সকালের বন্ধুদের পেটভরে বেঁধে খাওয়াব।

তোমার সকালের বন্ধুদের? হিমাদ্রি চোখ কপালে তুলে বলেছিল, তার মানে বেগা-আ-আ-আকথাটা সে শেষ করতে পারেনি যেহেতু শ্যামলার এক প্রচণ্ড রামচিমটি তখন অতি তৎপরতায় তার বগলের নীচে কামড় বসিয়েছিল। হিমাদ্রি অবশ্য খুব স্মার্টলি আ-আ-আ-টাকে দম আটকানো কাশিতে রূপান্তরিত করে কাশতে কাশতে চেয়ার থেকে উঠে বেসিনের দিকে ছুটে গেছল।

কী হল তোর? বেগা বলে বিষম খেলি কেন? পিসি উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন।

কানু হয়তো বলতে চেয়েছিল, রান্নাবান্নার মতো কাজে কেন ব্যাগার খাটবে তার থেকে চিনে দোকানের খাবার এনে তাই তো রে? সমীরণ ভাইয়ের দিকে তাকায়। মুখে জল দিতে দিতে হিমাদ্রি শুধু বলে, হুউ।

রান্না করে খাওয়ানোটাকে ব্যাগার খাটা বলছিস! কী আনন্দ হয় জানিস লোককে খাওয়াতে? টাকা থাকলে আমি রোজ ধরে এনে লোক খাওয়াতাম।

রেখা গুপ্ত তাঁর সকালের বন্ধুদের অবশ্যই ভূরিভোজন করিয়ে ছিলেন। কালার। টিভি এবং স্কুটারও কেনা হয়েছিল। দোতলায় সে বছর আর ঘর তোলা যায়নি। পরের মরসুমেই সারথি সংঘ একলাখ দশ হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমীকরণকে সই করায়। যুগের যাত্রীর কাছে তখন তার পাওনা ছিল দশ হাজার টাকা। সেটা আর সে পায়নি।

ময়দানের ঘাস এরপর থেকেই সে চিনতে শুরু করে।

.

০২.

না, না, আর না, আমার চারখানা খাওয়া হয়ে গেছে।ভটচায় তাঁর প্লেটের ওপর দুই তালু ছড়িয়ে রেখা গুপ্তর লুচি নামাবার পথ বন্ধ করলেন। হাতিরা নাকি দুটো খায়, এই দত্তবাবুই বললেন।

হ্যাঁ দুটোই খায়…মিস গুপ্ত আমায় আর-একটা, আজ সাত চক্কর টোটাল

খুক খুক করে মালবিকা কেশে উঠলেন। দত্ত কটমটিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিসেস বসাকের গণনায় কি সাত চক্কর হয়নি?

সাত মানে! আট হয়ে নয় হচ্ছিল তখনই তো ভটচাযদা বসতে বললেন। মালবিকা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন।

তা হলে বোধ হয় গুনতে ভুল করেছি, ইয়ে, আমায় তা হলে আর-একখানা। দত্তবাবু বলা শেষ করেই জুড়ে দিলেন, আর মিসেস বসাককেও।

নাকুও ঠিক গুনে আটখানা খায়। রেখা গুপ্ত তাঁর কাজ শেষ করে বসলেন সরোজ বসাকের পাশের চেয়ারে। বসাকদা আপনি তো ভটচাদার মতোই চারটের বেশি নিলেন না!

আমরা এক পালকের পাখি তো, ওনার অম্বল আমার মেদ, চারটের বেশি হলেই প্রবলেম দেখা দেবে।

ভটচায় জোরে জোরে মাথা নাড়লেন দক্ষিণ ভারতীয় ঢঙে। আর সেই সময় বাইরে ফটকের কাছ থেকে কে বলল, এটা কি সমীরণ গুপ্তর বাড়ি?

মলা, দ্যাখ তো কে একজন নাকুকে খুঁজছে। রেখা গুপ্ত চেয়ার থেকে নিজেকে সামান্য তুলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। দলবদলের সময় এসে পড়ল আর সেইসঙ্গে সমীরণ, সমীরণ, নাকু, নাকুদা, ভিখিরিদের মতো ফটকের কাছে ডাকাডাকিও শুরু হয়ে গেল। এরপর চলবে হাত-পা ধরে টানাটানি। কী অদ্ভুত যে এই দলবদলের নিয়মকানুন!

বাড়িতে কেউ আছেন?

ফটকের কাছ থেকে উঁচু গলায় ডাক এল।

ওরে মলা, দ্যাখ না।

রেখা, যত ডাকাডাকি আর টানাটানি, ততই তো দরবৃদ্ধি। মালবিকা চোখ পিটপিট করলেন আড়চোখে তাকিয়ে।

মিস গুপ্ত, এবার যদি হাত-পা ধরে টানাটানি করে, টেলিফোনটা তুলে আমাকে শুধু একটা খবর দেবেন, তারপর দেখব কার হাত কোথায় কার পা কোথায় থাকে। দত্তবাবু দুই মুঠো পাকিয়ে সেই দুটি টেবিলে ঠুকলেন। অনেকদিন অ্যাকশনে নামিনি তো, শরীরটা কেমন যেন মাখন মাখন হয়ে যাচ্ছে।

শ্যামলা বাইরে থেকে ঘুরে এসে বলল, দাদাকে খুঁজতে এসেছে যুগের যাত্রী থেকে। বললাম, দাদার তো আজ সকালে হাওড়ায় নামার কথা। বললেন, তিনি জানেন, বাঙ্গালোর থেকে মাদ্রাজ, সেখানে মাদ্রাজ মেলে উঠে আজ সকাল সাতটায় হাওড়া স্টেশনে নামবে। ট্রেন অবশ্যই লেট হবে। সেই সময়টা ধরেই স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে কম করে দশটা বেজে যাবেই।

এখন তো আটটাও বাজেনি! ভটচায় বললেন, তা হলে উনি এত হিসেব কষেও এখন কেন হাজির হয়েছেন?

আমিও তাই বললাম। পিসির সঙ্গে দেখা করতে চায় বলল।

যুগের যাত্রীর লোক রেখার সঙ্গে দেখা করতে চায়! মালবিকা চোখ ছানাবড়া-প্রায় করে রেখা গুপ্তর দিকে তাকালেন, তুমি আবার কবে থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করলে?

আরে, ফুটবলারের পিসিমাসিরাও দলবদলের আগে ভি আই পি হয়ে যায়। সরোজ বসাক স্ত্রীকে বোঝাবার জন্য জুড়ে দিলেন, আমাদের দেশের ফুটবলাররা খুবই পরিবার-অন্ত-প্রাণ তো, তারা দিদি বউদি, মা-মাসি, ভাই-বোন, এদের মত না। নিয়ে দল বদলায় না, সেজন্য প্লেয়ারদের আগে এদেরই ধরাধরি করা হয়।

সরোজের কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই দরজার কাছ থেকে মিহিস্বর ভেসে এল, আমি কি ভেতরে আসতে পারি? বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ভেতরে ঢুকে এলেন।

নাতিউচ্চ মাঝারি গড়ন, ঈষৎ কটা চোখ, গায়ের রং এককালে গৌরবর্ণ ছিল, এখন তামাটে, বয়স ষাট-পঁয়ষট্টির মধ্যে, পাতাকাটা কাঁচাপাকা চুল, বিস্কুট রঙের ট্রাউজার্স ও একরঙা নীল বুশ শার্ট, পাম্পশুটা অন্তত চারশো টাকা দামের। না বলেই প্রায় ঢুকলাম। হাতজোড় করে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বললেন, আমার নাম ঘুনু মিত্তির, বিখ্যাত লোক নই যে, নামটা শোনা থাকবে। যুগের যাত্রীকে ভালবাসি, ওদের কমিটিতেও আছি, আর প্লেয়ারদের সঙ্গে দুঃখেসুখে একাকার হয়ে গেছি। ওরা মুশকিলে পড়লে আমি সাহায্য করি, আমি অসুবিধায় পড়লে ওরা আমায় দেখে। এইমাত্র শুনলাম, কে যেন বলছিলেন ছেলেরা দলবদলের আগে মা-মাসি। দিদি বউদিদের মত নেয়! কথাটা ওয়ান-ফোর্থ সত্যি। বাকিটা খবরের কাগজের বানানো। ওরা কি দুগ্ধপোষ্য শিশু যে, এখনও মা-মাসির কথামতো চলবে? কেউ কেউ চলে, কারণ তাদের মা কি বউ টাকাকড়ির ব্যাপারটা তাদের থেকেও ভাল বোঝে। আমি কি বসতে পারি?

নিশ্চয় নিশ্চয়, বসুন। রেখা গুপ্ত উঠে দাঁড়ালেন। ডাইনিং টেবিলে খালি চেয়ার আর নেই। তাই দেখে বেগারদের অন্য চারজনও চেয়ার থেকে উঠে পড়ল।

আরে আপনারা বসুন বসুন। মা, একটা টুল কি মোড়া থাকলে এনে দাও তো। ঘুনু মিত্তির বললেন শ্যামলাকে।

প্রায় ছুটে গিয়ে শ্যামলা পিসির ঘর থেকে মোড়া আনল।

নাকুর বাড়ি তো আমারও বাড়ি। এখানে আমি মেঝেতেও বসতে পারি। এই বলে ঘুনু অবশ্য মোড়াটাতেই বসলেন। মনে হচ্ছে কারুরই চা বোধ হয় এখনও খাওয়া হয়নি।

না, এইবার চা হবে। আপনাকেও— রেখা গুপ্ত ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন।

চিনি ছাড়া, আমার ব্লাড সুগার একটু বেশির দিকেই।

কত এখন? ভটচায দমবন্ধ অবস্থায় জানতে চাইলেন।

দুশো একানব্বই। ঘুনু খুব সহজ স্বরে বললেন। ওষুধপত্তর খাই না। ডাক্তার বলেছে স্ট্রেস আর টেনশন থেকে শুধু দূরে থাকবেন, আমি তাই থাকারই চেষ্টা করি।

রেখা গুপ্ত ইশারায় শ্যামলাকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। সমীরণের কাছে তিনি ঘুনু মিত্তির সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন। তাই মনে মনে হুঁশিয়ার হয়েও কিঞ্চিৎ সিঁটিয়ে রইলেন।

যুগের যাত্রীতে কেউ কি টেনশন ছাড়া থাকতে পারে? শুনেছি ক্লাবের কুকুরগুলো পর্যন্ত নাকি ক্লাবের খেলা থাকলে টেনশন সইতে না পেরে বাবুঘাটে চলে যায়! ভটচায় কিন্তু কিন্তু করে বলে ফেললেন।

কার কাছে শুনেছেন?

আমার শালার ছেলে যাত্রীর মেম্বার, সে বলেছে।

বাজে কথা, একদমই বাজে কথা। টেনশন একটু হয় ছোট ক্লাবের সঙ্গে খেলা থাকলে। তা সেজন্য তো আমি আছি। ওদের গোলকিপার আর একটা স্টপার কি একটা ব্যাককে ম্যানেজ করে ফেলি, সেটা মোটেই শক্ত ব্যাপার নয়।

নাকুকে কিন্তু পারেননি। লাস্ট ফাইভ ইয়ার্সে চার বছর যাত্রীর এগেনস্টে খেলেছে, রোভার্স, ডুরান্ড, ফেডারেশন, লিগ, শিল্ড সব মিলিয়ে সাতটা গোল দিয়েছে, তিনটে ডিসঅ্যালাউড হয়েছে। গত দশ বছরে কে পেরেছে…সোজা কথা, দশবার যাত্রীর জালে বল! ভটচায় উত্তেজনা দমন করতে করতে মুখ লাল করে ফেললেন। কিন্তু আমাদের নাকুকে ম্যানেজ করতে পারেননি।

জীবনে আমার এই একটাই ফেলিওর। দশ হাজার টাকা ক্লাব ওকে দেয়নি, সেই রাগটা দ্বিগুণ বিক্রমে ওকে খেলিয়ে দেয় যাত্রীর এগেনস্টে। তবে এবার তো একেবারেই নতুন কমিটি, নাকুকে টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওর দশ হাজার পাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব।

পাঁচ কাপ চায়ের ট্রে নিয়ে শ্যামলা প্রথমেই ঘুনুর সামনে ধরে বলল, ডান দিকে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছেরটা চিনি ছাড়া।

ঘুনু হাসিমুখে কাপটা তুলে নিয়ে বললেন, ফুটবলারের বাড়ি তো, কথাবার্তাও সেরকম! আপনার বাড়িতে আজই প্রথম এলাম। বেশ বাড়িটা করেছেন। রেখা গুপ্তর উদ্দেশে কথাগুলো বলে, ঘুনু ঘরটায় চোখ বুলিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন।

বাড়ি আমার নয়, দাদার।

ওই হল। জায়গাটা ভাল, বেশ নিরিবিলি, খোলামেলা। দোতলায় কখানা ঘর?

একখানা।

কেন! আরও দুখানা করতে পারেন, জায়গা তো রয়েছে! কতলার ভিত তিনতলার নিশ্চয়।

হ্যাঁ।

তা হলে আরও দুটো ঘর তুলে ফেলুন।

সেজন্য টাকা লাগে। রেখা গুপ্ত সন্তর্পণে কথাটা বলে ভাবতে শুরু করলেন, লোকটা শেষপর্যন্ত কোথায় আলোচনাটাকে নিয়ে যাবে।

টাকার জন্য আপনার ভাবনা! ওসব নিয়ে কিছু ভাববেন না, আমি করে দেব।

আপনি করে দেবেন মানে! রেখা গুপ্তর আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হল। আপনি কেন করে দেবেন?

কত লাগবে দুটো ঘর করতে? হাজার তিরিশ? সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যাত্রীতে নতুন যে কমিটি এবার এসেছে, টাকার ব্যাপারে কোনওরকম কেপ্পনি তারা করবে না। দুলাখ দেব বললে দুলাখই দেবে, দেড় লাখ অ্যাডভান্স। চাইলে গুঁড়োও দেবে।

গুঁড়ো কী জিনিস? জি. সি. দত্ত কৌতূহলী হলেন।

সব টাকা তো আর কাগজেকলমে থাকে না, পঁচিশ-তিরিশ হাজার এধার-সেধার করে দেওয়া হয়। ওটা হিসাব ছাড়াই, লিখিত চুক্তির বাইরে। ওটাকেই গুঁড়ো বলি।

ধরুন, একটা প্লেয়ার অ্যাডভান্স নিল, গুঁড়োও নিল, তারপর অন্য ক্লাবে সই করে বসল।

সরোজ বসাকের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘুনু কথাটা ছোঁ মেরে তুলে নিল। ঠিক এই ব্যাপারই তো গত বছর দুলাল চক্রবর্তী করল। সওয়া লাখ অ্যাডভান্স আর কুড়ি হাজার গুঁড়ো নিয়ে বলল যাত্রী ছাড়া আর কোনও ক্লাবে মরে গেলেও খেলবে না। ব্লেড দিয়ে হাতে আঁচড় কেটে রক্ত বের করে বলল, দেখুন, এর প্রত্যেক কণিকায় যুগের যাত্রীর নাম লেখা রয়েছে।

অ্যাঁ! রক্তে নাম লেখা? মালবিকা চমৎকৃত হয়ে বললেন, তাও কখনও হয় নাকি!

হয়। কলকাতার ফুটবলাররা ক্লাবের প্রতি এতই অনুগত, ক্লাবের ভালমন্দ, মানমর্যাদা নিয়ে এতই ভাবিত যে, ওদের রক্তে ক্লাব মিশে যায়, ওদের নিশ্বাসেও ক্লাবের নাম বেরিয়ে আসে।

কী জানি বাবা, আমি তো সায়েন্স পড়েছি, বটানিতে বি.এসসি, এমন কথা তো কখনও চোখে পড়েনি। মালবিকা মিনমিন করে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন।

আপনার চোখ নিশ্চয়ই ভাল। কিন্তু আমাদের ফুটবলারদের শরীরে বিশেষ এক ধরনের রক্তে বয়, সেটা ভাল চোখে দেখা যায় না। ঘুনু মিত্তির এমনভাবে হাসলেন যার সাত-আটরকম অর্থ হয়। এই বছর যে প্লেয়ারের রক্তে যুগের যাত্রীর নাম, পরের বছর তারই রক্তে পাবেন সারথি সংঘের নাম, তার পরের বছর হয়তো লেখা থাকবে জুপিটারের নাম।

খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার তো! জি.সি. দত্তর ঘাবড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। এদের আসল রক্ত, মানে বাপ-মার কাছ থেকে পাওয়া রক্তটা তো দেখছি আর নেইই। এদের রক্ত যদি ক্লাব-রক্ত হয় তা হলে মানুষের শরীরে দিলে তারা তো মারা। যাবে!

যেতে পারে। ফুটবলার জানলে ব্লাড ব্যাঙ্ক হয়তো ভবিষ্যতে এদের রক্ত নেবে না। অবশ্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, এরা কখনও ব্লাড ডোনেট করে না। ঘুনু মিত্তির সহজ স্বরে কথাটা বলেই পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরলেন। হ্যাঁ, গুঁড়োর কথা হচ্ছিল। দুলাল অ্যাডভান্স আর গুঁড়ো নিয়ে সই করার দুদিন আগে সারথি-র বটা বিশ্বাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে ফোন করে আমায় বলল, বটার ছেলেরা ওকে রাস্তা থেকে ধরে, পিস্তল দেখিয়েই অবশ্য, গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে।

আপনারা পুলিশের হেল্প নিলেন তো? ভটচায বলতে বলতে আড়চোখে জি.সি. দত্তর দিকে তাকালেন।

মাথা খারাপ! পুলিশের কাছে গিয়ে কী হবে? দুলাল তো নিজেই ট্যাক্সি করে বটার ডেরায় গিয়ে উঠেছে। খবর আমি দশ মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেছলাম। আমাদের থেকে পঁচিশ হাজার বেশি দেবে বলাতেই দুলাল টোপ খেয়ে নিল।

কিন্তু রক্তে যে যাত্রীর নাম লেখা! মালবিকা আঁতকে উঠে বললেন। ঘুনু তাতে কান না দিয়ে বলে চললেন, আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কত বেশি দেবে বলেছে? বলল, পঁচিশ হাজার। আমি বললাম, আরও তিরিশ হাজার দেব, চলে আয়। বলল, যাব কী করে, দরজার বাইরে, রাস্তায় ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে। তখন ফোন রেখে আমি দৌড়লাম দুলালের বাড়ি। ওর বউ মধুছন্দাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার স্বামী তিরিশ হাজার টাকা হারাবে যদি সারথিতে সই করে। তুমি ওকে সারথির ডেরা থেকে এখুনিই উদ্ধার করে আনো।

তারপর মধুছন্দা উদ্ধার করে আনল? ভটচায় চেয়ারের কিনারে টানটান হয়ে বসলেন। ঘরের সবাই উদগ্রীব।

মধুছন্দা তখন আট মাসের ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আমায় বলল, চলুন তো, কোথায় ও রয়েছে সেখানে আমায় নিয়ে চলুন। তিরিশ হাজার টাকা ফ্যালনা নাকি! হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে দেওয়া! পা দিয়ে ফুটবল খেলে বলে কি লক্ষ্মীকেও খেলবে? ঘুনু অবিকল মধুছন্দার কণ্ঠস্বরে কথাগুলো বললেন।

আপনি ওকে নিয়ে গেলেন তো? উৎকণ্ঠিত মালবিকা জানতে চাইলেন।

অবশ্যই। নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো গেছি। ট্যাক্সি করে বটা বিশ্বাসের বেহালার ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে ছেলেকোলে মধুছন্দাকে নামিয়ে দিয়ে বললাম, তিনতলায় ডান দিকে, আমি ট্যাক্সি নিয়ে এখানে অপেক্ষা করছি, দুলালকে একেবারে সঙ্গে করে আনা চাই। মনে রেখো তা না হলে তিরিশ হাজার হারাবে। ট্যাক্সি থেকে নামতে গিয়েও থমকে গেল মধুছন্দা, বলল, হারাব আমি? তিরিশটা পঁয়ত্রিশ করুন।

কী মেয়ে ভাবুন তো! দরাদরি শুরু করল কিনা এই সময়ে, ট্যাক্সি থেকে এক পা রাস্তায় রেখে।

আপনি কী বললেন, পঁয়ত্রিশ দেবেন? জি.সি দত্ত যে মনে মনে হিমশিম হয়ে পড়েছেন সেটা তাঁর ঢোঁক গেলা থেকে বোঝা গেল।

তা ছাড়া তখন আর উপায় কী। বললাম, পঁয়ত্রিশ দেব যদি দুলালকে এখনিই বের করে আনতে পারো।

কিন্তু বাইরে যে ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে? সরোজ মনে করিয়ে দিলেন।

কোথায় ছেলেরা! ঘুনু মিত্তির পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করলেন। ছেলে ফেলে পাহারা দিচ্ছে, ওসব দুলালের বাজে কথা। যাই হোক, আমি তো ট্যাক্সিতে বসে রইলাম। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, আধঘণ্টা কেটে গেল। বাড়ি থেকে ওরা কেউ আর বেরোয় না! ভাবলাম হলটা কী! মধুছন্দাকেও আটকে রাখল নাকি? ডিবে থেকে একটিপ নস্যি বের করে ঘুনু নাকের কাছে এনে থমকে গেলেন। তারপর দেখি ছেলেকে কাঁখে নিয়ে মধুছন্দা বেরিয়ে আসছে, একমুখ হাসি, সঙ্গে দুলালও।নস্যিটা ঘুনু নাকে খুঁজে হাত ঝাড়লেন।

সাকসেসফুল! অ্যাাঁ, মধুছন্দা তা হলে পারল! ভচটা প্রায় হাততালি দিয়ে ফেলেছিলেন যদি না তখন মালবিকা হ্যাঁচ্চো করে উঠতেন।

ওহহ, আই অ্যাম সরি। ঘুনু কাঁচুমাচু হলেন।

নস্যি একটা খুব বাজে নেশা। এতক্ষণে রেখা গুপ্ত মুখ খুললেন। ঘুনু মিত্তিরকে এই প্রথম কোণঠাসার মতো দেখাল। শুধু নস্যির গুঁড়ো ছড়িয়ে একজন মহিলাকে হাঁচিয়ে দেওয়ার জন্যই নয়, রেখা গুপ্তর বিরক্তি উৎপাদনের কারণ হওয়াটাই তাঁকে কিছুটা ঘাবড়ে দিল। আসলে তিনি এসেছেন তো নাকুর পিসিকে তুষ্ট করতে। ঘুনু খবর নিয়ে জেনেছেন; সমীরণ গুপ্তকে তুলতে হলে জালটা ফেলতে হবে তার পিসির ওপর। পিসি হ্যাঁ বললে ভাইপো কখনও না বলবে না।

নস্যি আমি এখনিই ছেড়ে দেব। ঠিক বলেছেন, খুব বাজে নেশা। ঘুনু ডিবেটা বাড়িয়ে দিল শ্যামলার দিকে, মা, তুমি এটা এখুনি বাইরে ফেলে দাও তো।

সারা ঘরে থতমত অবস্থা। চারজন বেগার সমস্বরে না না না বলে উঠলেন। শ্যামলা নিজের হাত টেনে নিল। রেখা গুপ্ত রীতিমতো অপ্রস্তুত।

না কেন? আমি এখনই…ওঁর সম্মান, ওঁর কথা, ওঁর নির্দেশ আমি এখনই রক্ষা করব। ঘুনু উত্তেজিত হয়ে মোড়া থেকে উঠে জানলার কাছে গেলেন। ডিবেটা কপালে ঠেকিয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুড়ে বলে উঠলেন, হতভাগা নস্যি, দূর হ। জীবনে আর তোকে নাকে ঢোকাব না।

আমি তো আর ফেলে দিতে বলিনি। রেখা গুপ্তর গলায় অনুশোচনার মতো ক্ষীণ সুর। ঘুনুর কানে সেটা ধরা পড়ল। একটা নস্যির ডিবে, কটাই বা টাকা! কিন্তু চার ভাগের তিনভাগ কাজ তো এগিয়ে রইল।

হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম? ঘুনু যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠলেন এমনভাবে তাকালেন।

মধুছন্দা বেরিয়ে আসছে বটা বিশ্বাসের ফ্ল্যাট থেকে, সঙ্গে দুলাল আর কোলে বাচ্চা। ভটচায় সঙ্গে সঙ্গে সূত্র ধরিয়ে দিলেন।

হ্যাঁ, ওরা বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে উঠল। ট্যাক্সি ওদের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করল। মধুছন্দা তখন খুশিতে ডগমগ হয়ে কী বলল জানেন? ঘুনু চোখ বিস্ফারিত করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বটা বিশ্বাসের কবজা থেকে দুলালকে বের করে এনেছি। সরোজ বললেন।

সারথির টাকার ফাঁস খুলে দুলালকে বাঁচিয়ে দিলাম। জি.সি. দত্তর অনুমান।

পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা বেশি দেবেন বলেছেন, মনে থাকে যেন। মালবিকা নিশ্চিত স্বরে আন্দাজ করলেন।

ভটচায মাথা নেড়ে জানালেন তিনি কিছু বলতে চান না।

মধুছন্দার গলায় একটা সোনার হার ঝুলছে যেটা আগে দেখিনি। সেইটা হাতে করে তুলে আমায় বলল, বটাদা এত ভাল, এত সুন্দর মানুষ, দেখুন হারটা, প্রায় দুভরি তো হবেই। জানেন, বউদিকে উনি বললেন, তোমার বোন আজ প্রথমবার এসেছে, ওকে একটা উপহার তো দেবে। তারপর নিজেই বউদির গলা থেকে হারটা খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, সুন্দর মেয়ের গলাতেই এই হার মানায়। উহ্, বটাদা যে কী ভাল! না না, দুলাল সারথিতেই থাকবে, বাড়তি পঁয়ত্রিশ হাজারে আমাদের দরকার নেই। বুঝলেন এবার? ঘুনু সবার মুখের দিকে না তাকিয়ে এবার জানলার বাইরে দৃষ্টি পাঠালেন।

খুক খুক করে প্রথমে হেসে উঠল শ্যামলা। তারপর ঘুনু বাদে অন্যরা।

কিন্তু দুলাল যে অ্যাডভান্স আর গুঁড়ো নিয়েছিল, তার কী হল? জি সি দত্ত মনে করিয়ে দিলেন।

ট্যাক্সি থেকে নেমে মধুছন্দা বাচ্চা কোলে বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার পর দুলাল আমার হাত ধরে বলল, ঘুনুদা পারিবারিক অশান্তির মধ্যে আর যাব না। অ্যাডভান্সের টাকা আমি ফিরিয়ে দেব তবে গুঁড়োটা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু ভেবো না যে মেরে দেব। সামনের বছর যাত্রীতেই আবার ফিরে আসব, তখন অ্যাডজাস্ট করে নিয়ো।

অ্যাঁ, সারথিতে সইসাবুদ করার আগেই বলে দিল পরের বছর দল পালটাবে! এ কী রে বাবা! সরোজকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।

কলকাতায় হাতে গোনা যে কজন ফুটবল খেলতে পারে, দুলাল তাদের একজন। গত এগারো বছরে সাতবার সারথি আর যাত্রী করেছে। বয়স হয়ে গেছে, সত্তর মিনিটের ম্যাচ আগের মতো আর খেলতে পারে না। না পারলেও এক্সিপিরিয়েন্সের তো দাম আছে। সেটাও অনেকখানি কাজ দেয়। বহুবার ইন্ডিয়া টিমে খেলেছে, নাম আছে, সাপোর্টাররাও নামী প্লেয়ার চায়। ঘুনু মিত্তির এর বেশি আর কিছু বললেন না।

তা হলে এ-বছর দুলাল চক্রবর্তী যাত্রীতে আসছে। মালবিকা জানতে চাইলেন না, ঘোষণা করলেন। ঘুনু স্মিত হেসে মাথা কাত করলেন।

তা আপনি এই সাতসকালে নাকুর খোঁজে এখানে এসেছেন, কী ব্যাপার? রেখা গুপ্ত গম্ভীর গলায় সোজা প্রশ্ন রাখলেন।

বুঝতেই তো পারছেন। যাত্রীতে নাকু এই বছর খেলবে এই প্রার্থনা নিয়েই আপনার কাছে আসা। ঘুনু প্রার্থনা বোঝাতে হাতজোড় করলেন।

ইয়ে, জি সি দত্ত হাতঘড়ি দেখে খবরের কাগজ হাতে উঠে দাঁড়ালেন। নাতিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসার টাইম হল।

বাকি তিনজনও উঠলেন। টাকাকড়ি, দলবদল-সংক্রান্ত আলোচনায় বাইরের লোকেদের থাকা উচিত নয়। অবশ্য ওরা জানেন, যা কিছু কথাবার্তা হবে সবই কাল। সকালে জেনে যাবেন।

ভেতরের ঘরে ফোন বেজে উঠল। শ্যামলা ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলল।

কে, মলা?

দাদা! কোখেকে ফোন করছিস?

হাওড়া স্টেশন থেকে, ট্রেন বেশি লেট করেনি। পিসি কী করছে?

ঘুনু মিত্তির নামে একটা লোক এসেছে তোমায় খুঁজতে, ডাইনিংয়ে বসে আছে।…

কী সব্বোনাশ, বাড়িতে এসে গেছে! বাঙ্গালোরেও এসেছিল যাত্রীর একজন, মহাদেব সামুই…কার সঙ্গে কথা বলছে?

পিসির সঙ্গে এবার কথা শুরু করবে। বেগাররা এতক্ষণ ছিল তাই…

শিগ্নিরি পিসিকে ডাক আমি কথা বলব, কায়দা করে ডাকিস ঘুনুদা যেন বুঝতে না পারে।

শ্যামলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, পিসি ফোন, তোমার এক ছাত্রীর মা কথা বলবেন।

রেখা গুপ্ত তাড়াতাড়ি এসে ফোন ধরলেন, হ্যালো, আপনি…

পিসি আমি নাকু, লোকটা কেন এসেছে?

বোধ হয় তোকে ওদের ক্লাবে খেলতে বলবে।

তুমি কিচ্ছু কমিট করবে না, বলবে যা বলার নাকুকেই বলুন।

তাই বলব। তোর ভাত তা হলে রাখব তো?

না, রাখার দরকার নেই। এখন আমি বাড়িমুখোই হব না। দুপুরে কোথাও খেয়ে নেব, রাতে ফিরব। এখন একবার দুলালদার মানে দুলাল চক্রবর্তীর অফিসে যাব। ঘুনুদা আশপাশে কোথাও নির্ঘাত ঘাপটি মেরে থাকবে। সন্ধে পর্যন্ত আমি বাড়ির দিক মাড়াব না।

তা হলে ওকে এখন কী বলব?

বললাম তো, নাকুর সঙ্গে কথা বলবেন, নাকুর ফুটবলের ব্যাপারে আমি নাক গলাই না, ব্যস। এখন রাখলাম।

রেখা গুপ্ত চিন্তিত মুখে রিসিভার রাখলেন। সেই মুখ নিয়েই এসে বসলেন ঘুনু মিত্তিরের সামনে।

কোনও দুঃসংবাদ?

হ্যাঁ। আমার এক ছাত্রীকে কারা যেন কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছে। ওর মা ভয় পেয়ে মেয়েকে আমার কাছে কিছুদিন রাখতে চাইছে। রেখা গুপ্ত খুবই অস্বস্তিভরে। বললেন। মিথ্যা কথা অম্লানবদনে তিনি বলতে পারেন না।

কী ভয়ঙ্কর কথা! পুলিশে খবর দিয়েছে? ছাত্রীর বয়স কত? নিশ্চয় খুব বড়লোক। উত্তেজিত ঘুনু মোড়া থেকে নিজেকে বিঘতখানেক তুলে আবার নামিয়ে রাখলেন।

দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ কী করতে পারে? তারা বলেছে মেয়েকে এখন বাড়ি থেকে বের করবেন না। আট বছর বয়স, সারাদিন বাড়িতে বন্দি থেকে বেচারার কী কষ্ট হচ্ছে ভাবুন তো? ওকে বরং আমার এখানেই নিয়ে আসি।

কিন্তু এখান থেকেও তো কিডন্যাপ হতে পারে।ঘুনু বিপদ সম্পর্কে হুশ করিয়ে দিলেন।

আমার এখান থেকে! রেখা গুপ্ত যেন স্তম্ভিত হলেন ঘুনু মিত্তিরের অজ্ঞতার পরিচয় পেয়ে। আমি রয়েছি, মলা রয়েছে, এই ওঁরা এতক্ষণ যাঁরা এখানে ছিলেন, পেছনের নেতাজিনগর আর শহিদ কলোনির লোকেরা—কিডন্যাপওলাদের সাহস হবে? বরং ওদের ধরে আমিই কিডন্যাপ করে রেখে দেব।

কিন্তু তাদের পাবেন কী করে? তারা তো মোটরে করে আসবে, মেয়েটার মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলেই বোঁওও করে…দেখেন না টিভি সিরিয়ালে কীভাবে বাচ্চাদের ধরে?

দেখেছি। ওইভাবে ধরতে আসুক না। তা হলে আমিও এইভাবে… রেখা গুপ্ত হঠাৎ ঝুকে হাত বাড়িয়ে ঘুনু মিত্তিরের বুশ শার্টের কলার ধরে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুনুও উঠলেন। কিডন্যাপ করতে আসা?…অ্যা কিডন্যাপ? দেখাচ্ছি মজা। কলার ধরে পাকা জাম পাড়ার মতো ঘুনুকে ঝাঁকি দিয়ে আবার বললেন, কিডন্যাপ করে টাকা কামাবে ভেবেছ?

আ-আমি কিডন্যাপার নই, উঁহুহু লাগছে, ছাড়ুন ছাড়ুন। ঘুনুর মুখে রক্ত জমে। লাল, চোখ দুটি গর্ত থেকে প্রায় এক মিলিমিটার বেরিয়ে এসেছে।

রেখা গুপ্ত লজ্জিত হয়ে কলার ছেড়ে দিলেন। একসাইটেড হয়ে…ছি ছি, আমায় মাফ করবেন। হাত জোড় করলেন তিনি।

উফফ কী গায়ের জোর! বিড়বিড় করলেন ঘুনু মিত্তির। শ্যামলা চুপচাপ ব্যাপারটা দেখছিল। নম্রস্বরে বলল, বরফ আনব? গলায় ঘষলে ব্যথা আর থাকবে না।

না না, বরফ টরফ দরকার নেই, আমার কিছু হয়নি।

পিসি একটু রাগি, নইলে মানুষটা খুবই নরম। শ্যামলা ঢোক গিলল কটমট তাকিয়ে থাকা পিসির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে।

সত্যিই আমার মনটা খারাপ লাগছে। আমার এখন মুন্নির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে, মলা যাবি আমার সঙ্গে? বলেই রেখা গুপ্ত ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। হ্যাঁ, বলছিলেন কী যেন দরকার আছে আমার সঙ্গে? তাড়াতাড়ি বলুন।

ঘুনু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছেন পিসির এলোমেলো কথা আর আচরণে। নিজেকে ধাতস্থ করতে করতে বললেন, নাকু এ বছর যাত্রীতে আসুক…ওর পুরনো যা পাওনা সবই পেয়ে যাবে আর সারথিতে যা পাচ্ছে তার থেকে…আপনি জানেন তো নাকুকে আমিই দর্জিপাড়া থেকে যাত্রীতে এনেছিলাম ষাট হাজার টাকায়? আজ আবার আমি এসেছি এক লাখ ষাট হাজার দর নিয়ে।

তা আমার কাছে কেন? নাকুর আর ফুটবলের ব্যাপার এটা, আমি এর মধ্যে নাক গলাতে চাই না। রেখা গুপ্ত মৃদু শান্ত স্বরে বললেন।

আপনি যে নাকুর কতখানি তা কি আমি জানি না? রোজগারের এটাই বয়স। টপ ফর্মে থাকার সময় কিছু কামিয়ে নেওয়া। এবার আমরা খুব ভাল টিম করব, ওর মতো একটা স্ট্রাইকারের যা দাম তা আমরা নিশ্চয়ই দেব। সারথিতে পাচ্ছে তো এক-তিরিশ, আমরা এক-ষাট দেব। ঘুনু ধীরে মেপে মেপে কথাগুলো বলার সময় রেখা গুপ্তর মুখভাব লক্ষ করছিলেন। কিন্তু কোনও ভাবান্তর দেখতে না পেয়ে অস্বস্তিতে পড়লেন।

আপনি এসব কথা নাকুকেই বলবেন। আমি চাকরি করি, দাদা চাকরি করেন, নাকু তো করেই, আমাদের এতেই মোটামুটি চলে যায়। রেখা গুপ্ত আরও মৃদু স্বরে বললেন।

না, না, টাকার লোভ আপনাদের দেখাব, এত ধৃষ্টতা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নাকু এখন বড় প্লেয়ার। ইন্ডিয়া ক্যাম্পে রয়েছে, ক্যাপ্টেন হবে বলেই শুনেছি। দেশের ক্যাপ্টেন হওয়া তো বিরাট মর্যাদা। আমাদের ক্লাবও সেই মর্যাদার কিছুটা পাবে যদি নাকু যাত্রীতে আসে। ঘুনুর অস্বস্তি আরও বাড়ল কারণ রেখা গুপ্তর মুখভাব এখনও ধ্যানী বুদ্ধের মতোই রয়ে গেছে।

পিসি, মুন্নিদের বাড়ি যাবে না? শ্যামলা মনে করিয়ে দিল।

ওহ হ্যাঁ, স্নানটা করেই… রেখা গুপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে আলোচনায় ইতি টেনে দিয়ে বললেন, যা বলার নাকুকেই বলবেন। আমায় বলে কোনও লাভ নেই।

ঘুনু মিত্তির চলে যাওয়ার পরই পিসি আর ভাইঝির খুকখুক হাসি হোহো-তে রূপান্তরিত হল।

.

০৩.

দুলাল চক্রবর্তী চাকরি করে ব্যাঙ্ক অব বেনারসের চৌরঙ্গি শাখায়। হাওড়া স্টেশন থেকে সমীরণ ট্যাক্সিতে যখন ব্যাঙ্কের সামনে নামল তখন বেলা প্রায় এগারোটা। সঙ্গে একটা সুটকেস। কয়েকবার সে এই ব্যাঙ্কে দুলালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, অনেকের সঙ্গেই তার চেনা। এখানে সারথি এবং যাত্রী দুই ক্লাবেরই কিছু সমর্থক কাজ করে। কাউন্টারের বাইরে সমীরণকে দেখেই অল্পবয়সি একজন টেবিলের কাজ ফেলে উঠে এল।

সমীরণদা, বাঙ্গালোর থেকে কবে ফিরলেন?

এইমাত্র। হাওড়ায় নেমেই সোজা এখানে। সমীরণ সুটকেসটা দেখাল। অরুণ, দুলালদা কোথায়?

এই তো মিনিট কুড়ি আগে সারথির নির্মাল্য রায় এসে ওঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সামনেই তো ক্লাবের ইলেকশন, হয়তো ভোট ক্যানভাসিংয়ের জন্য গেছে। আপনাকেও যদি পায় তো কাজে নামিয়ে দেবে। অরুণ গলা নামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল।

পাবে না। এসব কাজ যে আমি করি না সেটা সবাই জানে।

কারা জিতবে মনে হয়? বটা বিশ্বাসরা তো খুব তোড়জোড় করেই নেমেছে।

বটাই জিতুক কি নির্মাল্যই জিতুক, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার কাজ যেটা, আমি শুধু সেটাই করি। সমীরণ হাসল। তার কাজটা যে কী সেটা আর বলার দরকার হল না।

দুলালদার কাছে শুনেছি কেরল থেকে বিনু জন-কে আনার জন্য তোক গেছিল। গোয়ার আলবুকার্কের সঙ্গেও নাকি কথাবার্তা চলছে। দুজনেই তো স্ট্রাইকার। ওরা এলে তো আপনার… অরুণের মুখে বিপন্নতার মতো একটা ভাব ফুটে উঠল। যেন সমীরণ নয়, সে নিজেই মুশকিলে পড়বে, এই দুজন সারথিতে এলে।

সমীরণের কপালে একটা ভাঁজ উঠেই মিলিয়ে গেল। কথাটা সে দিনদশেক আগে বাঙ্গালোরেই শুনেছে কেরলের নুর মহম্মদের কাছে। বিনু জনের বাবার কাছে সারথি থেকে একজন গেছল। সে নাকি বলেছে সমীরণের সঙ্গে ক্লাব অফিসিয়ালদের সম্পর্ক ভাল নয়, তাই সারথি ওকে ছেড়ে দেবে যদি বিনু খেলতে রাজি হয়। সেদিন শুনে সমীরণ মনে মনে হেসে কথাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল।

তার সঙ্গে অফিসিয়ালদের সম্পর্ক খারাপ, এমন একটা কথা ক্লাবে বছর দুই ধরে চাউর হয়েছে। ক্লাবের দুটো গোষ্ঠীর কোনওটির সঙ্গেই তার মাখামাখি নেই, সে কোনও কর্তার অনুগ্রহে খেলছে না, নিজস্ব কোনও চক্র সে তৈরি করেনি। এই তিনটিই তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। সবার সঙ্গে সদ্ভাব রেখে যে চলবে কলকাতার তারকা ফুটবল সমাজে সে সন্দেহজনক লোক বলে চিহ্নিত হবে। সমীরণেরও তাই হয়েছে। শত্রু নেই এ কেমন লোক! সুতরাং এ বিপজ্জনক, একে ভাগাও।

সমীরণকে ভাগাবার চেষ্টা গত বছরই হয়েছিল পঞ্জাব থেকে কার্নাইল সিং আর আলিগড় থেকে ইরানি ছাত্র রফসঞ্জানিকে এনে। দুজনে মোট চারটে ম্যাচ খেলে কলকাতা থেকে বিদায় নিয়ে আর আসেনি। রটনা হয়েছিল, সমীরণ এবং আর কয়েকজন প্লেয়ার ক্লিক করে ওই দুজনকে খেলার সময় বল না দিয়ে বা ধরা যায় না এমন পাশ দিয়ে হাজার হাজার সমর্থকের সামনে অপদস্থ করেছে। আরও কী, বন্ধু খবরের কাগজের রিপোর্টারদের দিয়ে নাকি ওদের বিরুদ্ধে ঝাঁঝালো মন্তব্যও লিখিয়েছিল। এই সবই নাকি সমীরণের মস্তিষ্কপ্রসূত!

সমীরণ জানে, সব রটনাই বটা বিশ্বাসের কোটারি থেকে বেরিয়েছে। রটনাকে সে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। মাথার মধ্যে গেঁথে থাকা একটা কথাকেই শুধু সে সারসত্য বলে মেনে রেখেছে: এত টাকা যখন নিচ্ছ, সেইমতন খেলাটাও দিয়ো। সারথির সাপোর্টাররা স্বচক্ষেই মাঠে দেখেছে সমীরণের খেলায় আন্তরিকতা। সে জানে ওরাই তার রক্ষাকবচ।

কিন্তু এই জানাটাই তো এখনকার কলকাতার ফুটবলে শেষ কথা নয়। বড় ক্লাবে ক্ষমতা দখল আর প্রতিপত্তি বিস্তারের লড়াই অবিরাম চলেছে। কর্তাদের এক একজনের তাঁবে থাকে দু-চারজন অনভিজ্ঞ, চলনসই, নবাগত ফুটবলার আর ফর্ম ঝরে যাওয়া, বয়স্ক, নামী ফুটবলার। উভয়েই কর্তাদের দলাদলিতে দাবার বেড়ে হয়ে তাদের নির্দেশমতো মাঠে খেলে, পয়েন্ট খুইয়ে কোনও কর্তাকে বিপদে ফেলে দেয়, কোনও প্লেয়ারকে খেলার মধ্যেই অপ্রতিভ করিয়ে তাকে বসিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে, চোট আঘাতের অজুহাতে শক্ত ম্যাচগুলোয় না খেলে ক্লাবকে জব্দ করে। বিনিময়ে পায় অনুগ্রহ, আরও এক বছর ক্লাবে থাকার ছাড়পত্র অর্থাৎ টাকা বাড়িয়ে নতুন চুক্তি। সমীরণ এইসব নীচতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। সে শুধু নিজের খেলাকে আরও ওপরে তোলার চেষ্টা করে গেছে। সব কর্তারাই জানে সমীরণকে দরকার, কিন্তু একটা গোষ্ঠী তলায় তলায় চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে, বাইরে থেকেও সমমানের কাউকে আনিয়ে সমীরণকে সারথি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য।

দুলালদার কথা থেকে মনে হয়েছে, অরুণ দুপাশে আড়চোখে তাকিয়ে গলা। নামিয়ে বলল, আপনি সারথিতে থাকুন এটা উনি চান না।

কেন? সমীরণের কপালে আবার ভাঁজ পড়ল।

মনে হয়, উনি নিজেও বোধ হয় থাকবেন না, আবার যাত্রীতেই ফিরে যাবেন।

যদি থাকবেনই না আবার, তা হলে ভোট ক্যানভাসিংয়ে নেমেছে কেন!

যদি বটা বিশ্বাসের গ্রুপকে হারানো যায়, মানে একটা চান্স নিচ্ছে।

বটাদাই তো ওকে যাত্রী থেকে এনেছে, এখন তাকে হারানোর জন্য দুলালদা। চেষ্টা করবে কেন? আমি এই ক্লাব পলিটিক্সের মাথামুণ্ডু এখনও বুঝতে পারলাম না। কে যে কখন কার দিকে হয়! কখন যে কার স্বার্থে ঘা লাগে। যাক গে, এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, এখন আমি চলি। সমীরণ সুটকেসটা তুলে নিল।

শুনছি মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুর টুরে আপনিই ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন হবেন। সমীরণের হাত থেকে সুটকেসটা প্রায় কেড়ে নিয়েই দরজার দিকে যেতে যেতে অরুণ বলল।

এইরকম একটা কথা নোভাচেকের কাছে আমিও শুনেছি। তবে এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

নোভাচেক কেমন কোচ?

সেটা এখন কী করে বলি! সবে তো কয়েক মাস হল এসেছে। তবে খাটাচ্ছে। স্পিড আর স্ট্যামিনার ওপরই জোরটা বেশি দিচ্ছে, মর্ডান ফুটবলের মূল জিনিস এই দুটো তো একদমই আমাদের নেই। থাক, তোমায় আর যেতে হবে না, আমি ট্যাক্সি ধরে নিচ্ছি। সমীরণ সুটকেসটা অরুণের হাত থেকে নিয়ে হাত তুলে থামাল একটা খালি ট্যাক্সিকে।

এরপর সে মুশকিলে পড়ল ট্যাক্সিতে বসে, কোথায় যেতে বলবে ট্যাক্সিওলাকে? ঘুনুদা এতক্ষণ বাড়িতে বসে নেই নিশ্চয়, কিন্তু যদি কাছাকাছি কোনও লোক রেখে থাকে? তাকে বাড়ি ফিরতে দেখলেই ওর কাছে খবর পৌঁছে যাবে! কিছু বিশ্বাস নেই এই লোকটিকে। সব পারে।

কোথায় যাবেন? ট্যাক্সিওলা গন্তব্য জানতে চাইল।

নাগেরবাজার।

কেন যে নামটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল সমীরণ বুঝতে পারল না। দমদম এলাকার মধ্যে জায়গাটা বাড়িরও কাছাকাছি, এটা একটা কারণ, তা ছাড়া নাগেরবাজারে একটা গলিতে থাকে তার স্কুলের বন্ধু বাসব। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। বাসবের একটা নাটকের দল আছে। একাধারে সে নাট্যকার, নির্দেশক আর অভিনেতা। এমন একটা লোককে হঠাৎই এখন মনে পড়ে যাওয়া কেন? বছর চারেক আগে যখন সে প্রথম যুগের যাত্রীতে খেলছে তখন কিছুদিনের জন্য তার অভিনয় করার ইচ্ছা জেগেছিল। তিন-চারবার মহলা দিয়েই ইচ্ছাটা লোপ পায়। স্টেজে নামা আর মাঠে নামার মধ্যেকার তফাতটা সে দ্রুত বুঝেছিল।

সমীরণ হেসে ফেললা একটু আগেই অরুণ নোভাচেকের নাম করেছিল। বাসবের চেহারার সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে চোকোশ্লোভাকিয়ার এই লোকটির। দুজনেই তামাটেফরসা, পাতলা, লম্বা, ওপরের দুটি দাঁত একটু বেরিয়ে থাকে। মাথার গড়নটা একই রকম। তবে কারেলের গলা মিহি, বাসবের জলদগম্ভীর। তবে ওদের যতটুকু চেহারার মিল তাইতেই হয়তো বাসবকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে।

কারেল নোভাচেক ডিসিপ্লিন মানেন কঠোরভাবে। বাঙ্গালোর থেকে আসার সময় সমীরণকে বারবার বলেছিলেন, বাইশ তারিখের মধ্যে না ফিরলে এই ক্যাম্প থেকে তোমাকে ছাঁটাই করব। ছজনকে তিনি পত্রপাঠ বিদায় করেছেন মাত্র একদিন দেরিতে পৌঁছনোর জন্য। এ. আই. এফ. এফ সেক্রেটারি অনুরোধ করেছিলেন, ছজনকে মাফ করে ক্যাম্পে যোগ দিতে দেওয়া হোক। কারেল জানিয়ে দেন, তা হলে পদত্যাগপত্র আপনার দপ্তরে পৌঁছে দেব।

সমীরণের মাথার মধ্যে বাইশ শব্দটা কানামাছির মতো বোঁ বোঁ করে উড়ে চলেছে আর ঠোক্কর খাচ্ছে। বাইশ থেকেই হয়তো বাসবকে মনে পড়ল। চব্বিশে তারা কোঝিকোড় যাবে নাগজি টুর্নামেন্টে খেলতে। টিম কেমন সেট করেছে কারেল তা পরখ করে নেবেন বলেই নাগজিতে তাদের নামাচ্ছেন। ওঁর কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সমীরণের কাছেও। এ. আই. এফ. এফ. দলের ক্যাপ্টেন সে হচ্ছেই, এটা কারেলই তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। বারো বছর আগে যেদিন সে ফাইভ বুলেটস-এর ক্যাপ্টেন হয়ে, পাতিপুকুর থেকে শিল্ড জিতে বাড়ি ফিরেছিল পাড়ার ছেলেদের কাঁধে চড়ে, সেদিন পিসিকে সে বলেছিল, আমি ইন্ডিয়ার হয়ে খেলব, তুমি দেখে নিয়ে। তারপর বলেছিল, আমি ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেনও হব। প্রথম স্বপ্নটা সম্ভব হয়েছে, দ্বিতীয়টা বাকি রয়ে গেছে। বাইশে তাকে কোঝিকোড় পৌঁছতেই হবে। কারেল বড় কড়া মানুষ।

নাগেরবাজার থেকে দমদম স্টেশনের দিকে যেতে ডান দিকে মতিঝিল কমার্স কলেজের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে ভেতর দিকে চলে গেছে। ট্যাক্সিটা ঢুকতে গিয়েই বাধা পেল। একটা লরি ধাক্কা দিয়েছে আরোহী সমেত সাইকেল রিকশাকে। দুই মহিলা আরোহীর রাস্তায় ছিটকে পড়া ছাড়া বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি, তুমুল কাণ্ড ঘটাবার পক্ষে এটাই যথেষ্ট। বিতণ্ডা চলছে, লরিটাকে পুড়িয়ে ফেলা হবে কি না। আশপাশের বাড়ির বাসিন্দা ও দোকানদাররা চাইছে, বড় রাস্তায় নিয়ে গিয়ে পোড়াও, নইলে আগুনে তাদেরও সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিছু লোক চাইছে, ঘটনা যেখানে পোড়ানো সেখানে।

ট্যাক্সিভাড়া চুকিয়ে সমীরণ সুটকেস হাতে, ভিড় ঠেলে কয়েকমিনিট হেঁটে পৌঁছল বাসবের বাড়ি। একতলায় বড় একটা ঘরে বাসব একাই থাকে, পরিবারের সবাই দোতলায়। এই ঘরেই অভিনয়ের মহলা হয়। চাকরি করে না, একমাত্র ছেলে, যথেষ্ট বিষয়সম্পত্তি আছে, তাই বাসব সামান্য মাত্রায় অলস। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছে। সমীরণ তাকে এখন বাড়িতে পাবে আশা করেই ডোর-বেলের বোতাম টিপল, বেল বাজার শব্দ হল না। তা হলে বোধ হয় পাওয়ার কাট।

সমীরণ দরজা খটখটাল, একবার, দুবার।

কে-এ-এক-এ! ঘুমজড়ানো গলার ভেতর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল, আর ঠিক সেই সময়…।

সমীরণদা, আমাদের খুব বিপদ।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমীরণ দেখল তিনটি যুবক, কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স, গলির মধ্যে ছুটে এল। একজন গোলকিপারের মতো ডাইভ দিয়ে তার পায়ের দুটো গোছ আঁকড়ে ধরল। আর-একজন নিলডাউন হয়ে করজোড়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তৃতীয়জন ফাঁকা জায়গা না পেয়ে ছুটে তার পেছনে এসে জড়িয়ে ধরল।

একী, একী! হচ্ছে কী? সমীরণ সুটকেস আঁকড়ে ধরে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল। ছিনতাই করার নানান পদ্ধতির এটাও একটা বলে তার মনে হচ্ছে।

আমরা ডুবে যাব, বিশ্বাস করুন আমরা গাড্ডায় পড়ে যাব, পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না আর। নিলডাউন যুবক সকাতরে বলল।

পায়ের গোছ ধরা যুবক প্রায় ডুকরে উঠে বলল, আপনি, শুধু আপনিই আজ আমাদের বাঁচাতে পারেন।

জাপটে ধরা তৃতীয়জন তাদের আশ্বাস দিয়ে বলল, পিন্টু কাঁদিস না, ভগবান আমাদের সহায় তাই সমীরণদাকে ঠিক সময়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন।

হচ্ছে কী? অ্যাাঁ, ছাড়ো, ছাড়ো বলছি। সমীরণ কনুই দিয়ে কোঁতকা দিল জাপটে ধরাকে। টান মেরে ডান পা, বাঁ পা তুলে গোছ ছাড়িয়ে নিল।

রাগ করবেন না সমীরণদা। আজ আমাদের ফুটবল ফাইনাল, আটদিন আগে তুষার মৈত্র রাজি হয় প্রধান অতিথি হতে। বলেছিল তিনটের সময় বাড়িতে গাড়ি নিয়ে যেতে। আমরা সকাল থেকে রিকশায় মাইক নিয়ে অ্যানাউন্স করে ঘুরেছি, হাতে লিখে পোেস্টারও মেরেছি অন্তত গোটা কুড়ি। আজ সকাল দশটায় তুষার ফোন করে বলল আসতে পারবে না, তাকে নাকি দুপুরে বর্ধমানে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। সেখানে ওর শালাদের ক্লাবেরও ফুটবল ফাইনাল, ওকে চিফ গেস্ট হতে হবে তাই আমাদের এখানে আসতে পারবে না।

তুষার মৈত্র শুধু যাত্রীরই সেরা নয়, ভারতেও একসময় ওর মতো স্টপার দু-তিনজন মাত্র ছিল। ভীষণ জনপ্রিয়। এগারো বছর ধরে ক্লাব বদলায়নি। ওর সঙ্গে সমীরণের বহুবার কলকাতার এবং বাইরের মাঠে লড়াই হয়েছে। ফলাফল প্রায়। সমান-সমান। তবে গত দু বছর ধরে সমীরণ লক্ষ করেছে পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি বয়সি তুষার আগের মতো আর ঝটতি ঘুরতে পারছে না, দ্রুতগতির ফরওয়ার্ডরা ওকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে, স্পট জাম্পে ততটা আর শরীর উঠছে না। বহু জুনিয়ার ছেলের কাছে শুনেছে, এখন জার্সি টেনে ধরে বা পেটে ঘুসি মেরে তাদের আটকায়, রেফারিরা ওর বিরুদ্ধে ফাউল দিতে ভয় পায়। যাত্রীর এক কর্তা সুবোধ ধাড়ার গ্রুপের প্লেয়ার বলেই সবাই তুষারকে জানে। সেক্রেটারি পতিতপাবন ওরফে পতু ঘোষের বিরোধী গোষ্ঠী হল ধাড়া গোষ্ঠী।

তুষারদা আসতে পারবে না তো আমি কী করব? বর্ধমান থেকে তাকে ধরে আনব? সমীরণ ঝাঁঝালো চোখে তিনজনকে তার বিরক্তি জানিয়ে দিল।

আপনি রাগ করবেন না সমীরণদা, আজ আমাদের উদ্ধার করে দিন। বলতে বলতে আবার নিলডাউন।

আমরা আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব। বলার সঙ্গে ডাইভও। কিন্তু সমীরণ সাইড স্টেপ করে পায়ের গোছ সরিয়ে নিতে পেরেছে।

তৃতীয়জন আর জাপটে না ধরে, বিগ্রহের সামনে ভক্ত যেভাবে জোড় হাতে দাঁড়ায় তেমনভাবে শুধু দাঁড়িয়ে রইল।

বাড়ির দরজা খুলে এই সময় বাসব বেরোল, পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে জড়ানো স্বরে বলল, কী রে নাকু, ব্যাপার কী? এই অসময়ে? আয়।

বাসব আবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে, তখন নিলডাউন লাফিয়ে উঠে বাসুদা, বাসুদা, বলে তার পিছু নিল।

মরে যাব আমরা। আপনি বলুন সমীরণদাকে। মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য। দুটো টিমের সঙ্গে ইন্ট্রোডিউস আর প্রাইজ দেওয়া।

এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়লাম রে! দুটো রাত ট্রেনে কাটিয়েছি বাঙ্গালোর থেকে হাওড়া পর্যন্ত। এখনও বাড়ি যাইনি, খাওয়া হয়নি, ভীষণ টায়ার্ড লাগছে, ঘুম পাচ্ছে—সমীরণ হতাশভাবে শুকনো স্বরে তার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে করুণ চোখে তাকাল বাসবের দিকে।

দাদা, শুধু পাঁচটা মিনিট।

খেলার আগে ইন্ট্রোডাকশন, খেলার পর প্রাইজ দেওয়া—পাঁচ মিনিটে হয়? চালাকি করার আর তোক পাওনি? সমীরণ তেরিয়া গলায় বলল।

তুই এখনও খাসনি! বাসব ব্যস্ত হয়ে পড়ল, এই শোন, এখন তোরা ওকে ছেড়ে দে। আগে চান-খাওয়া করে নিক তারপর কথা বলিস।

বাসুদা আপনি ওকে…

আরে বাবা বলব, বলব। যাবে, যাবে। এখন তোরা ভাগ তো। বাসব নিশ্চিন্ত স্বরে তিনজনকে আশ্বাস দিল।

সমীরণ দাঁতে দাঁত ঘষে বাল্যবন্ধুর দিকে তাকানো ছাড়া আর কী করবে ভেবে পেল না।

অ্যাই চল, বাসুদা যখন ভার নিয়েছে আর কিছু ভাবতে হবে না। সমীরণদা আপনি এখন রেস্ট নিন। একটু ঘুমিয়েও নিন। আমরা ঠিক সময়ে এসে তুলে নিয়ে যাব। এই রানা তুই এখানে থাক। নিলডাউনের হাবভাব গলার স্বর মুহূর্তে কড়া, রুক্ষ হয়ে উঠল। এই থাক-এর অর্থ বুঝতে সমীরণের অসুবিধা হল না। পাহারায় থাক, যেন না পালায়।

যাত্রীর প্লেয়ার পেলাম না তো কী হয়েছে, সারথির এত নামী একজনকে তো পেয়েছি! সমীরণদা আমাদের এলাকায় দুদলের সাপোর্টারই আছে।জাপটেধরার ভাবভঙ্গিতে স্বস্তি এবং সাফল্য দুটোই টানটান।

পিন্টু, মাইক নিয়ে বেরো।

ওরা চলে যেতেই সমীরণ বলল, বাসু, এটা কী হল?

কী আবার হবে! পাড়ার ছেলে, জলে বাস করে কুমিরদের সঙ্গে…আগে চান কর, মাকে বলছি, ভাতটাত করে দিতে।

কথামতোই ওরা এসে সমীরণকে ঘুম থেকে তুলল। হাঁটলে মাঠটা মিনিট পাঁচেক দূরে, ওরা সাইকেল রিকশায় জোর করেই তুলল।

এতবড় প্লেয়ার হেঁটে যাবে? তাই কখনও হয়। আমাদের নিন্দে হবে না? সেই নিলডাউন একদম নতুন ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বলল এবং উঠে সমীরণের পাশে বসল।

আমি তো চিফ গেস্ট, আজকের সভাপতি কে?

নীলমণি গড়গড়ি, আপনি চেনেন? খুব বড় প্লেয়ার ছিলেন একসময়ে।

আলাপ হয়নি, নাম শুনেছি, উনি যখন খেলতেন তখন আমি জন্মাইনি।

দূর থেকে লাউডস্পিকারে ভেসে আসছে নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালনায় সেভেন-এ-সাইড ফুটবল প্রতিযোগিতা, শহিদ বিপুল কুণ্ডু চ্যালেঞ্জ কাপ ও তিনকড়ি চ্যালেঞ্জ শিল্ডের ফাইনাল খেলা এখনই শুরু হতে যাচ্ছে। আজকের খেলায় সভাপতি অতীত দিনের প্রখ্যাত খেলোয়াড় এবং কোচ নিলু গড়গড়ি..নীলমণি গড়গড়ি, আর প্রধান অতিথি…, একটু থেমে, সমীরণ গুপ্ত, যার কোনও পরিচয় দেওয়ার দরকার হবে বলে মনে করি না।

শুনলেন?

হু।

আবার ভেসে এল, নির্দিষ্ট প্রধান অতিথি তুষার মৈত্রর শাশুড়ি মারা যাওয়ায়। তিনি আজ সকালে বর্ধমান চলে গেছেন, এজন্য আমরা দুঃখিত।

সমীরণ চোখ বড় করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিলডাউনের দিকে তাকাল।

এসব না বললে পাবলিক ম্যানেজ করা যায় না। ফুটবলারদের চরিত্র যে কী, দাদা আপনি কিছু মনে করবেন না, লোকে একদমই জানে না। আমরা ছোটখাটো ক্লাব করি, এইসব টুর্নামেন্ট থেকেই তো ফুটবলার বেরিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের দিকে বড় বড় ক্লাব, বড় বড় ফুটবলার কোনও নজর দেয় না। পাড়ার লোক, দোকানদার। এদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে টুর্নামেন্ট চালাই। দেনাও হয়। আস্তে আস্তে শোধ করি। আমাদের দোষ-ত্রুটি-অপরাধ আপনি মাফ করে দেবেন সমীরণদা।

শুনতে শুনতে সমীরণের মাথা নীচের দিকে নেমে গেল। ফুটবলটা আসলে কারা বাঁচিয়ে রেখেছে তা সে বোঝে। এইরকম ছোট ছোট ক্লাব বাংলার সর্বত্র রয়েছে। তাদের পাড়াতে এমন একটা ক্লাব থেকেই তো সে খেলা শুরু করেছিল। যদি ক্লাবটা না থাকত, যদি বরেন মুখখাটি তাকে ফুটবলের গোড়ার জিনিসগুলো না শেখাতেন তা হলে আজ সে এত খ্যাতি, এত টাকার মুখ কি দেখত?

রিকশা মাঠের ধারে পৌঁছে গেছে। তক্তপোশের ওপর মঞ্চটা সাদা কাপড় ঢাকা। একটা টেবিলে একটি কাপ ও একটি শিল্ড আর ছোট দুটি কাপ। পিতলের ফুলদানিতে রজনীগন্ধার গোছা। জমিতে রাখা একটা টেবিলে পুরস্কার সামগ্রী শস্তার কিটব্যাগ ও তোয়ালে।

সমীরণ গুপ্ত এসে গেছেন। খেলা এখনই আরম্ভ হবে। প্রতিযোগী দল দুটিকে অনুরোধ করা হচ্ছে প্রধান অতিথি সমীরণ গুপ্তর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তারা যেন এবার সেন্টার লাইনের কাছে সার দিয়ে দাঁড়ায়। রেফারি, লাইন্সম্যান, আপনারাও দাঁড়াবেন।

সভাপতি ও প্রধান অতিথিকে মালা দেওয়া হল। সমীরণের মনে হচ্ছে সে যেন ইলেকট্রিক মাঠে রয়েছে। চারদিকে বাড়ি, অসমান ঘাসহীন জমি, মাঠ ঘিরে বালক, মাঝবয়সি, এমনকী বৃদ্ধরাও ঠেলাঠেলি করছে সাইড লাইনের ধারে। ছাদে, বারান্দায়, গাছেও মানুষ। এদের বেশিরভাগই কলকাতার ময়দানে কখনও খেলা দেখেনি, যদিও এখান থেকে বাসে ময়দান যাওয়া যায়। ছোট মাঠে, আজীবন এই ফুটবল দেখেই খুশি থাকবে কত লোক! তার নাম শুনেছে, কাগজে ছবি দেখেছে, হয়তো টিভিতেও খেলা দেখেছে, কিন্তু তাকে সামনাসামনি এই প্রথম দেখছে। এরা কী ভাবছে তার সম্পর্কে?

টিম দুটোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য মাঠের মাঝে যেতে যেতে সমীরণ মাথা ঘুরিয়ে দর্শকদের দিকে তাকাল। হাততালি পড়ছে।

তার জন্যই কি? সে খেলতে নামছে না, তবু এই উচ্ছ্বসিত হওয়া কেন? এখানে তো শুধুই সারথির সাপোর্টার নেই, যাত্রীরও আছে। তারাও তো তাকে হাততালি দিল!

এইভাবে আমিও দাঁড়াতাম। সার দিয়ে দাঁড়ানো প্লেয়ারদের সঙ্গে হাতে হাত দিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সরে যাওয়ার সময় সমীরণের মনে হল এদের মধ্যে কেউ একজন সে নিজেও। কোনজন সে? সবাইকেই তার একাকার লাগছে। ওরা এক পা বেরিয়ে এসে সামান্য ঝুকে নিজের নাম বলে যাচ্ছে—হোসেনুর আলম, অরূপ মুখার্জি, রামকুমার সাউ, প্রশান্ত বর্মন…সমীরণ গুপ্ত, সমীরণ গুপ্ত, সমীরণ গুপ্ত…।

পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর গ্রুপ ফোটো তোলা হল। মঞ্চে ফিরে আসার সময় সমীরণ দর্শকদের উদ্দেশে নমস্কার জানাতেই আবার হাততালি পড়ল।

নিলু গড়গড়ি মঞ্চেই থেকে গেছেন। দুটো টিমের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য মাঠের মধ্যে যেতে অস্বীকার করে বলেছিলেন, আমি কে? ওরা কি আমায় চেনে, জানে? আমার নামও বোধ হয় শোনেনি। আমি যখন খেলেছি তখন ওদের বাবারা। খেলা দেখতে যেত। এখন এই বাচ্চাদের হিরো তো সমীরণরা। ওরা আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে মোটেই ধন্য বোধ করবে না। সমীরণ, তুমিই যাও।

সমীরণ বুঝে গেছল, নিলু গড়গড়ির শরীর যেমন শুকনো কাঠের মতো, কথাগুলো ঠিক তেমনই হওয়ার একমাত্র কারণ, আশাভঙ্গ। পুরনো যুগের এইরকম ফুটবলার সে কিছু দেখেছে। এখনকার ফুটবলারদের এঁরা সহ্য করতে পারেন না, বিশেষত এত পাবলিসিটি, এত টাকা পাওয়াটাকে। ওঁরা খেলার জন্যই খেলেছেন, সেজন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন, অনেক কিছু হারিয়েছেন, পেয়েছেন শুধু প্রশংসা। এখন আর কি তা মনে রেখেছে?

সমীরণের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কয়েকটি ছেলে মঞ্চের পাশে ভিড় করে এল। সে একে একে সই করে দিল। তার পাশে বসা নীলমণি গড়গড়ির দিকে ওরা ফিরেও তাকাল না। তার বলতে ইচ্ছা করছিল, ওঁর সইটাও তোমরা নাও। কেন জানি বলতে পারল না।

সমীরণ আর গড়গড়ি পাশাপাশি বসে খেলা দেখল, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলল না। খেলা শেষ হতেই মঞ্চের সামনে ভিড় জমে গেল। পুরস্কার দেওয়া দেখতে তো বটেই, কাছের থেকে সমীরণকে দেখা আর তার ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা লক্ষ করা এবং শোনার জন্য

বারাসাতের তরুণ মিলন সঙ্ঘ দুগোলে পাইকপাড়ার ফ্রেন্ডস ইউনিয়নকে হারিয়েছে। ঘেমে যাওয়া, শ্রান্ত দুটো টিম মঞ্চের সামনে মাটিতে বসে। সভাপতি বক্তৃতা দেওয়ার পর প্রধান অতিথি পুরস্কার হাতে তুলে দেবে আর তারপর দু-চার কথা বলবে। সমীরণ ইতিমধ্যেই নিলডাউনকে বলে দিয়েছে, বক্তৃতা দেওয়ার প্রতিভা তার নেই সুতরাং দিতে পারবে না।

আপনারা একটু পিছিয়ে দাঁড়ান। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান এখনই শুরু হবে। তার আগে আজকের এই ফাইনালের সভাপতি শ্রীনীলমণি গড়গড়ি, ভাষণ দেবেন।

গড়গড়ি মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। চশমার কাচ মুছলেন পাঞ্জাবির খোঁটায়। গলা খাঁকারি দিয়ে, মাথাটা নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে শুরু করলেন, উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী, পুত্রবৎ সমীরণ গুপ্ত, আজকের দুই দলের খেলোয়াড়রা। এই ফুটবল ফাইনাল অনুষ্ঠানে আমাকে সভাপতিত্ব করার জন্য যখন আমন্ত্রণ করা হয় তখন আমি, যাঁরা আমার কাছে গেছলেন আমন্ত্রণ জানাতে, তাঁদের বলেছিলাম, আমাকে কেন? আমি তো পুরনো দিনের একটা ফসিল। এখনকার ফুটবল, তার পরিবেশ, হালচাল সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমার চিন্তা-ভাবনা অন্যরকম, কোনও যোগাযোগই নেই ময়দানের ফুটবলের সঙ্গে। আমি আপনাদের অনুষ্ঠানে গিয়ে যদি কিছু কথা বলি সেটা অন্যরকম শোনাবে। শুনে লোকে হাসবে। ওঁরা বললেন, আপনি যা বলবেন লোকে তা শুনবে, কেউ হাসবে না।

না, হাসির কথা বলে আপনাদের হাসাবার জন্য আমি এখানে মাইকের সামনে দাঁড়াইনি। আমাদের ফুটবল যে-জায়গায় পৌঁছেছে তাতে হাসির বদলে এখন কান্নার সময় এসে গেছে। তার কারণ আমাদের ফুটবল এখন মারা গেছে। তবে আমরা মৃতদেহটাকে না পুড়িয়ে বা কবর না দিয়ে নিজেদের স্বার্থে সেটা মমি করে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঠিকমতো নিয়ম না জানায় মমিটাও ঠিকমতো করা হয়ে উঠছে না, ফলে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।

দুর্গন্ধ কী? আপনারে জানেন দুবছর আগে ময়দানেই একটা খেলা গড়াপেটা করে হচ্ছে বুঝতে পেরে দর্শকরা-সাপোর্টাররা হাঙ্গামা বাঁধায়, টেন্টে আগুন ধরাতে যায়, প্লেয়ারদের মারে, ক্লাবকর্তাদের মারে। এটাই হল দুর্গন্ধ। গত বছর কাগজে পড়ি একজন বড় প্লেয়ার দলবদলের আগে ক্লাবে থেকে যাবে বলে অ্যাডভান্স নিয়েছে, নেওয়ার সময় বলেছে এই ক্লাবের তাঁবু তার কাছে মন্দিরের মতো। পড়ে কী ভাল যে লাগল! এই অবিশ্বাস, দুর্নীতি আর অবক্ষয়ের যুগে, ম্যানেজ আর গড়াপেটার যুগে। একজনও অন্তত ফুটবলকে ঈশ্বর উপাসনার মতো ব্যাপার মনে করে। টাকাকড়িটা, তার কাছে বড় কথা নয়। কিন্তু তিনদিন পর কাগজেই দেখলাম সেই ফুটবলার। আর-এক বড় ক্লাবের এক কর্তার ফ্ল্যাটে গিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে দরাদরি করছে। এটাও হল দুর্গন্ধ।

ফুটবলকে মেরে ফেলল কারা? প্রাণবন্ত ছিল আমাদের সময়ের ময়দান, এখন তা শ্মশান। ঘুরে বেড়াচ্ছে শেয়াল-কুকুর, যাদের বলা হয় ক্লাব কর্মকর্তা। এখন বিখ্যাত হওয়ার শর্টকাট রাস্তা হল বড় ক্লাবের অফিসিয়াল হওয়া। ট্যাঁকের জোর থাকলে ভাল, না থাকলেও ক্ষতি নেই। এক পয়সাও ইনভেস্ট না করে লাখ টাকার পাবলিসিটি পাওয়া যায়। অফিসিয়াল হতে পারলে তখন যা বলবেন কাগজে বড় বড় করে ছাপা হয়ে যাবে, লোকের কাছে পরিচিতি পেয়ে যাবেন। ক্লাব ভাঙিয়ে কানেকশান বাড়ানো যাবে, তাই দিয়ে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে অনেক কর্তার দুনম্বরি কারবার চলছে বলেও কাগজে পড়েছি। এইসব প্রচারলোভী, ময়দানে না এলে লোকে যাদের কোনওদিনই চিনত না, এইসব ক্ষমতালোভী, যারা ফুটবলকে ভালবাসে না, সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রমের কোনও দাম যাদের কাছে নেই, তারা মনে করে যেহেতু তাদের টাকা আছে তাই ময়দানটাকে ইচ্ছে করলেই কিনে নিতে পারে, ফুটবলারদের যারা কুকুর-বেড়ালের মতো মনে করে, তাদের মুখের সামনে টাকার থলি ধরে তু তু করে টেন্টে নিয়ে আসে। এই টাকার লোেভই আমাদের ফুটবলের সর্বনাশ করেছে।

নিলু গড়গড়ি হঠাৎ থামলেন। অনর্গল বাক্যস্রোতে শ্রোতারা ভেসে যাচ্ছিল। তাদের পাড়ে ভিড়িয়ে দিতেই বোধ হয় তিনি বক্তৃতা বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে সমীরণের দিকে তাকালেন। শ্রোতারাও তাকাল। সমীরণ বিব্রত বোধ করল।

সমীরণ আমার ছেলের বয়সি। এখনকার ফুটবলারদের সম্পর্কে কিছু বললে সেটা নিশ্চয় ওর গায়ে লাগবে তাই আগেই মার্জনা চেয়ে রাখছি। কুকুর-বেড়াল পর্যায়ে আজকের ফুটবলারদের নেমে আসার জন্য কিন্তু তারা নিজেরাই দায়ী। এরা বলে ক্লাব গুরুত্ব দিচ্ছে, মর্যাদা দিচ্ছে তাই রয়ে গেলাম বা গুরুত্ব-মর্যাদা দিচ্ছে না বলে ক্লাব ছাড়লাম, কিন্তু লক্ষ-লক্ষ ফুটবলপ্রেমী মানুষ কাগজে যা এদের সম্পর্কে পড়ছে তাতে তো মনে হয় এক মিলিগ্রাম মর্যাদাবোেধও এদের নেই। দলবদলের সময় তো এসে গেছে, আর চার-পাঁচদিন পরই সই করা শুরু হবে। কাগজেই আপনারা পড়ছেন কত নাটক হচ্ছে, ফুটবলাররা ডায়লগ ঝাড়ছে। কিন্তু সইটা করার আগে কত রকম ডিগবাজি যে খাবে, শুধু সেটাই এখন লক্ষ করার।

ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল সমীরণের কান। মাথাটা একটু নিচু হয়ে গেল। নিলু গড়গড়ির কথার মধ্যে এখনও সে অন্যায্য কোনও বস্তু পায়নি। কিন্তু তার সামনে এসব কথা তোলা কেন? সে নিজে তো কখনও মর্যাদা হারাবার মতো কোনও কাজ করেনি! শুধু পাঁচ বছর আগে যখন সে প্রথম ময়দানে খেলতে নেমেছিল, যখন অনভিজ্ঞ কাঁচা ছিল তখন লাল কার্ড দেখেছিল রেফারিকে অপমান করে। পরের বছর ছোট ক্লাব থেকে বড় ক্লাবে, যা সব তরুণ ফুটবলারই চেষ্টা করে। তার পরের বছর অন্য ক্লাবে গেছে বেশি টাকার অফার পেয়ে। এতে অন্যায়টা কী? এ তো তার উন্নতিরই স্বীকৃতি।

কিন্তু তারপর তো সে আর ক্লাব বদলায়নি টাকাকড়ি নিয়ে দরাদরি, প্যাঁচ কষে দর বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কাগজে আজেবাজে কথা বলা, গ্রুপবাজি করা এসব তো সে কখনও করেনি। ইন্ডিয়া ক্যাম্প থেকে বাংলার অনেকে ছাঁটাই হয়েছে। নোভাচেকের কঠিন মাপকাঠিতে অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায়। সে কিন্তু রয়ে গেছে। তাই নয়, দেশের ক্যাপ্টেনও হতে চলেছে। তার পক্ষে মর্যাদাহানিকর কাজ করা সম্ভবই নয়।

এরাই সব মর্যাদাবান ব্যক্তি, এই বলে নিলু গড়গড়ি শ্লেষ মাখানো কণ্ঠে একের পর এক উদাহরণ দিয়ে গেলেন, কোন ফুটবলার মাঠের মধ্যে রেফারির গায়ে থুথু দিয়েছে, রেফারির কান ধরেছে, রেফারিকে লাথি কিল চড় মেরেছে। কোন ফুটবলার এটাই আমার শেষ বছর, তারপর রিটায়ার করব বলেও পরের বছর বলল ক্লাবের জনতা চাইছে তাই অসবর নেব না। কোন ফুটবলার খেলার কয়েক ঘণ্টা আগে বলেছে বাকি টাকা হাতে না পেলে পায়ে বল ছোঁবে না। গড়গড়ি বলে যাচ্ছেন আর সমীরণ আড়চোখে লক্ষ করল নানান বয়সি শ্রোতা, হাঁড়ি থেকে রসগোল্লা টপাটপ মুখে ফেলে চিবোবার মতো বক্তৃতাটা পরমানন্দে চিবোচ্ছে, চোখেমুখে গড়াচ্ছে মজা পাওয়ার রস।

বক্তৃতা শেষ হল প্রচুর হাততালি পেয়ে চেয়ারে বসে গড়গড়ি পাশে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, তুমি হয়তো অন্যদের মতো নও, কিন্তু পাপের ভাগ তোমাকে তো নিতেই হবে।

জবাবে সমীরণ শুকনো হাসি ছাড়া আর কিছু দিতে পারল না, নিলু গড়গড়ি তা লক্ষ করলেন।

এমন একটা সময় শিগগিরই আসবে যখন গাল দিতে গাধা-গোরু বলা হবে না, বলা হবে ফুটবলার। এক সময় ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল খেলেছি, একথা ভাবলে এখন। আমি কষ্ট পাই। হয়তো তুমিও পাবে। গড়গড়ি আলতোভাবে সমীরণের বাহু স্পর্শ করলেন, যেন আগাম সমবেদনা জানিয়ে।

সমীরণ কাপ, শিল্ড এবং অন্য প্রাইজগুলো হাতে হাতে তুলে দিল। দেওয়ার সময়। সবার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে হাসলও, কিন্তু কিছুই তার মনে ছাপ রাখছে না। সে কিছুই দেখছে না, কিছুই শুনছে না। তার ভেতরে কোথায় যেন একটা শর্ট সার্কিট ঘটে গিয়ে ইন্দ্রিয় নামক ডায়নামোটাকে বিগড়ে দিয়েছে।

সমীরণদা, আপনি কিছু বলুন, অন্তত দুটো কথা। ছোট ছোট ছেলেরা আপনার মুখ থেকে দুটো কথা শোনার জন্য খুব আশা করে আছে।

ক্লান্ত দৃষ্টিতে সমীরণ সামনের ভিড়ের দিকে তাকাল। যা বলব এরা কি বিশ্বাস করবে? নিলু গড়গড়ির কথাগুলো কানে নেওয়ার পর এদের শোনাবার মতো কোনও কথাই সে খুঁজে পাচ্ছে না।

সমীরণদা…

সে মাইকের সামনে উঠে এল। কোনও ভণিতা না করেই শুরু করল, গড়গড়িদা আমার পিতৃতুল্য, তাঁর বক্তব্য আমি মাথা পেতে গ্রহণ করলাম। আমাদের দুজনের খেলার সময়ের মধ্যে অন্তত চল্লিশ বছরের ফারাক, এর মধ্যে ময়দানে প্রচুর পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেটা ভালর না মন্দের দিকে গেছে তা ভবিষ্যৎকালই বিচার করবে। যদি মন্দের দিকে গিয়ে থাকে তা হলে আমাদের জ্যেষ্ঠরা তা যেতে দিলেন কেন? দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে তাঁরা বাধা দিতে পারতেন।

খারাপ লোকেরা এখন ক্লাব চালাতে আসছেন, কিন্তু তাঁরা ক্লাবের কর্তা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন কী করে? আমাদের ফুটবল সেট-আপটা কারা গড়েছেন? নিশ্চয়ই এখনকার ফুটবলাররা নয়। আমরা পেশাদারের মতো টাকা নিই, কিন্তু ফাঁকি মারি এই সেট-আপের গলদের সুযোগ নিয়ে। ফুটবলকে মেরে ফেলা ফুটবলারদের একার ক্ষমতায় সম্ভব নয়, কলকাতার ফুটবলে মৃত্যুর বীজাণু বহুকাল আগেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর সেটা করেছেন আমাদের পূর্বসূরিরা। হ্যাঁ, ফুটবলকে মমি করে রাখতে চাওয়া হচ্ছে কিন্তু সেই কাজটা তো বয়স্ক লোকেরাই করছেন। সমীরণ লক্ষ করল ভিড়ের নজর মাঝে মাঝেই নিলু গড়গড়ির দিকে সরে যাচ্ছে। সেই নজরে মজার ঝিলিক নেই।

টাকার প্রতি লোভ নেই, টাকার প্রয়োজন নেই এমন কেউ যদি এখানে থাকেন, অনুগ্রহ করে এগিয়ে আসবেন কি?

সমীরণ কথা বন্ধ করল। ভিড় থেকে একটা গুঞ্জন উঠেই নীরবতা নেমে এল। সে ধীরে মাথাটাকে দুবার ঘুরিয়ে দুপাশে তাকাল। অর্থবহ একটা নৈঃশব্দ্য তৈরি হল।

এখনকার ফুটবলাররা আপনাদের মতো ঘরেরই ছেলে। তাদেরও টাকার প্রয়োজন আছে। আপনাদের নমস্কার জানিয়ে আমার নিবেদন শেষ করলাম।

সমীরণ চেয়ারে ফিরে না গিয়ে মঞ্চের সিঁড়ির দিকে এগোল। ছোট ছোট ছেলেদের জন্য কোনও কথাই বলা হল না। এজন্য মনটা ভার লাগছে বটে আবার কিছুটা হালকাও বোধ করল নিলু গড়গড়ির থমথমে মুখটা দেখে।

তুই পরশুই আমার রিহার্সালে হাজির হবি। উচ্ছ্বসিত বাসব ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। দাঁড়িয়ে শুনছিলাম তোর বক্তৃতা। কী গলা, কী ডেলিভারি, কী ড্রামাটিক পঅজ, কী পিচ কন্ট্রোল, কী.. বাসবের দমবন্ধ হয়ে এল।

তাড়াতাড়ি চল, সুটকেসটা নিয়েই বাড়ি রওনা হব, অনেক কাজ আছে।সমীরণ জোরে পা চালাল।

সমীরণদা একটু বসবেন না, একটু মিষ্টি…

না, না, মিষ্টি আমি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

সমীরণদা, আপনার জন্য রিকশা…

দরকার নেই, হেঁটেই…

সমীরণদা, মালাটা অন্তত নিয়ে যান।

ওটা গড়গড়িদাকে দিয়ো।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress