বাড়িটা কেমন হয়ে গেছে
০১.
বাড়িটা কেমন হয়ে গেছে আজ। কেমন একটা বিষণ্ণতা, চাপা অস্বস্তি ঘিরে রয়েছে সারা বাড়ি। শুধু এই বাড়িটি।
আর সব অস্বস্তিটুকু এসে যেন জমেছে সুমিতার মনে। ওরই পায়ে পায়ে অস্বস্তির ছায়া ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে পড়ার ঘর থেকে শোবার ঘরে। বাবার ঘর থেকে বড়দির ঘরে। বড়দির ঘর থেকে ওর আর ওর মেজদির ঘরে। উত্তরের বারান্দা পার হয়ে খাবার এবং পাশে রান্না ঘর। সবখানে কীসের একটা ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানে যায় সুমিতা, সেখানেই। যেন ওরই পায়ে পায়ে ফিরছে।
শুধু অস্বস্তি নয়, অশান্তিও। তার সঙ্গে কেমন একটু বুক চাপা ব্যথা ভার হয়ে চেপে আছে সর্বত্র।
রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে বাগানের মধ্যে। ছোট বাগান। সামান্য কিছু ফুলগাছ। একটি কিশোরী স্বর্ণচাঁপা গাছ আছে এক কোণ ঘেঁষে। আর নিতান্ত শখ করে লাগানো কিছু শীতের আনাজ। সযত্ন হাতের ছোঁয়ায় এ সামান্যই কেমন অসামান্য হয়ে উঠেছে সবুজের সমারোহে। আজ সেখানেও সেই বিষণ্ণতা। এই শেষ শীতের দিনেও গুটি কয়েক মাঘের ফুলকপি, হাতে গোনা দুটি বাঁধাকপি। রূপ আছে যদিও, গন্ধহীন কিছু মরশুমি ফুলের গাছ। ফুটনোন্মুখ দুটি ডালিয়া আর কেমন একরকমের গাঢ় লালে হঠাৎ কালোর ছোঁয়ায় চাপা ব্যথার রং লেগেছে কিছু ফোঁটা কারনেশনে। কিছু আছে ক্রিসানথিমাম। স্বর্ণচাঁপার সুদীর্ঘ কাঁচা-সবুজ রং পাতার ঝাড়। পুবে-পশ্চিমে ছড়ানো এ ফালি বাগানের অসংখ্য উন্মুক্ত চোখের মতো পাতাগুলি। সবখানেই তার বিন্দু বিন্দু শিশিরে অশ্রু বিষণ্ণতা, জমাট হয়ে আছে নিঃশব্দ কান্না। ফাঁকে ফাঁকে মাকড়সার জালগুলিতে আলোর ছোঁয়ায় রং লাগেনি এখনও।
যেখানে যায় সুমিতা সবখানেই সেই অশান্তির ছায়া।
সামনের পুবদিকের তেতলা বাড়িটার ছাদ ডিঙিয়ে দেখা যাচ্ছে কাঁচা রোদের ইশারা। দক্ষিণের যাত্রা শেষ করে, উত্তরায়ণে বাঁক নিয়েছে সবে সূর্য। উত্তরে বাঁকা রেখা রোদ কাঁপছে তেতলার আলসের কার্নিশে। নতুন উত্তাপ তার কিরণে। সাগরপারের নতুন বাতাস আসবে পাগলা ঘূর্ণনে। সোনার মতো মাঘের রোদে তারই আভাস ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। এখানে দিগন্ত ব্যাপে রোদ ছড়াবার জায়গা নেই। জ্যামিতিক ভঙ্গিতে হঠাৎ সামনের রাস্তাটির কোথাও রোদ পড়েছে ত্রিভুজাকারে। কোনও বাড়ির দক্ষিণ দেয়াল রাঙিয়ে, পেছনের বাড়ির পুবদিকে চকিতে দিয়েছে ছুঁড়ে এক কণা রোদ। দেয়াল থেকে দেয়ালে, আলসেয়, জানালায়, হঠাৎ রোদ ঝলমল করছে ঋজুরেখায়। ফাঁকে তার কোথাও হঠাৎ এক কৃষ্ণচূড়া রাস্তার সীমানায়, কিংবা বাড়ির সীমানায় মাথা তুলেছে নারকেল নয় তো কলমের আমগাছ। শহরের এ দক্ষিণ সীমায় সবুজের দাক্ষিণ্য কিছু বেশি।
কেমন একটি সচকিত খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে এই সকালের রোদে। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রামের ঘর্ঘর ধ্বনি। কখনও-সখনও তীব্র হর্নের ক্ষীণ রেশ শোনা যাচ্ছে। কেউ শেষ অবধি ঘুরিয়ে দিয়েছে রেডিয়োটার ভলুম রেগুলেটার। হঠাৎ খুশির মতো ছড়িয়ে পড়ছে গানের সুর। সামনের রাস্তায় স্বল্পজনের রকমারি পদশব্দ। পথ চলতি কিছু কথাবার্তা, হঠাৎ একটি ডাক দিল হয়তো কেউ কাউকে। সব মিলিয়ে একটি কর্মচঞ্চল খুশি খুশি ভাব দিকে দিকে।
শুধু এখানে, এই বাড়িটি স্তব্ধ ভার। একতলা বাড়িটার হলদে মাথায় পড়েছে রোদ। স্বর্ণচাঁপার আগডালে সোনার ঝিকিমিকি। তবু যেন কী এক থম ধরা।
যেন কিছু হয়নি, যেন প্রত্যহের মতোই, সকালের রোদের আশায়, ভাললাগা মনটি নিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে সুমিতা। ও বেড়াচ্ছে আর ওঁরা, অর্থাৎ বাবা, বড়দি, মেজদি যেন প্রত্যহের মতোই ঘরে কিংবা বাগানে লাগিয়েছে তর্ক। অদ্ভুত সব কথা। কোনও কোনও কথা শুনতে সত্যি বড় লজ্জা করে সুমিতার। মুখ লাল হয়ে ওঠে। বোঝা-না-বোঝা ভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় সকলের মুখের দিকে। ও বোঝে, সব কথা ওর শুনতে নেই, বোধ হয় বুঝতেও নেই। তখন ও সরে পড়ে, ঘুরে ফিরে বেড়ায় এখানে সেখানে।
যেন তেমনিভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুমিতা। বারবার বোঝাতে চাইছে মনকে, কিছু হয়নি, কিছুই হয়নি। কিছু হয়নি, ও যেন শুধু ঘুরে ফিরে বাগানে নেমে আদরের ভঙ্গিতে হাত বাড়াতে গেল ফুলগাছের দিকে। সতেজ ডালে সবুজ পাতার পাশে শুকনো মরা পাতা ভেঙে দেবে বলে।
হাত বাড়াল, কিন্তু গাছে গিয়ে স্পর্শ করল না। আবার ফিরে তাকাল ঘরের দিকে। এখানে ওর মন নেই, মন পড়ে আছে অন্যত্র। বুকের মধ্যে খচ খচ করে উঠছে। মুচড়ে মুচড়ে উঠে কান্না পাচ্ছে কেবলি। শুধু তো অশান্তি নয়, অস্বস্তি নয়। একটি অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে আছে এ বাড়িটার হৃৎপিণ্ডে। আর সেই কাটাটি যেন আমূল বিঁধেছে ওরই বুকে। সব খোঁচাখুঁচির রক্তক্ষরা যন্ত্রণা যেন সুমিতারই। সারা বাড়িটার সমস্ত দুশ্চিন্তার কালো ছায়া তাকেই ঘিরে আছে।
বাগান থেকে দেখা যায়, প্রত্যেকটি ঘরের প্রতিটি জানালা বন্ধ। কাঁচের শার্সির আড়ালে পরদাগুলি কোনটা গুটানো, কোনটা স্প্রিংয়ের গায়ে টান টান করে মেলা। কিছু দেখা যায় না ঘরের মধ্যে। সাড়া-শব্দ নেই কারুর। এক অস্বস্তিকর স্তব্ধতা বিরাজ করছে সবখানে। কেবল রান্নাঘরে বিলাসের কাজের সামান্য শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একটু আগেই সসপেনে মাখনের ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ শব্দ শুনে সুমিতা বুঝতে পেরেছে বাবার জন্য পোচ তৈরি করছে বিলাস। জন্ম থেকে দেখে আসছে সুমিতা, সকালবেলার চায়ের সঙ্গে ওইটি তার বাবার চিরকালের খাবার। আর তাদের তিন বোনের জন্য হয়তো রুটি সেঁকবে এবার কিংবা সেঁকা হয়ে গেছে। তার সঙ্গে আরও কিছু। আরও কিছুর পর চায়ের জল চাপবে। তারপর বাবার ঘরে ডাক পড়বে সকলের।
তখন কী হবে। একই টেবিলের এপাশে ওপাশে যখন বসবে সবাই, তখন এই নিস্তরঙ্গ স্তব্ধতা হঠাৎ কেমন করে ভাঙবে। কে ভাঙবে! সে কথা ভেবে এখনই সুমিতার বুকের মধ্যে ধক ধক করছে। এটুকু ওর ভয় নয়, আনন্দও নয়, এক অপার বিস্ময়ের আলো আঁধার। কিছুক্ষণ পরের সেই ভবিষ্যতের বুকে উৎকণ্ঠিত কান পেতে আছে ও।
কিন্তু আজকের স্তব্ধতা ভাঙার পরই আসল কলরব উঠবে যখন, তখনই আসল ভয়টা দেখা দেবে।
গতকাল পর্যন্তও এবাড়ির আবহাওয়া যেন অনেকখানি স্বচ্ছ ছিল। মানুষগুলির চলায় ফেরায়, কাজে কর্মে, কথায় চাউনিতে বারে বারে এ দিনটির ছায়া উঁকি দিলেও প্রত্যহের জীবনে কোথাও ব্যতিক্রম দেখা দেয়নি। তবু এ দিনটির মুখোমুখি যাতে দাঁড়াতে না হয়, সে চেষ্টা অনেক করা হয়েছে। তলে তলে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে এ দিনটিকে প্রতিরোধ করার জন্যে। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের মতো এই দিন এসেছে।
এসেছে, তবু এখনও একটি ক্ষীণ আশা রয়েছে। তাই সুমিতা উৎকর্ণ হয়ে আছে, কখন বাড়ির সামনের লোহার গেটটা বিলম্বিত সুরে উঠবে ককিয়ে। শব্দটা বেশ জোরে হয়। কোনও কোনও অন্ধকার বাতাস হুতাশন রাত্রে, উত্তরের ডেপুটির বাড়ির সোহাগি বিড়ালীটা যেমন অদ্ভুত স্বরে তাদের বাগানে এসে ডাকে টেনে টেনে, ঠিক তেমনি শব্দ হয় গেটে। প্রতিদিনের শোনা সেই শব্দ, আজকে শোনবার জন্যে কান পেতে আছে সমস্ত হৃদয়। কখন শব্দ হবে, কখন দেখা যাবে রবিদা আসছেন ঠিক তেমনি মাথাটি একটু হেলিয়ে। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশান্ত মুখে তার সেই সহৃদয় স্বাভাবিক হাসিটুকু নিশ্চয় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে শেষ মুহূর্তের কৃতকার্যতায়। মুহূর্তে সমস্ত স্তব্ধভার অন্ধকার পালাবে মুখ ঢেকে। রবিদাকে প্রথম ছুটে গিয়ে অভিনন্দিত করবে সুমিতা। যেন তারই জীবনের এক জীবন-মরণ রুদ্ধশ্বাস সমস্যার সমাধান নিয়ে আসবেন রবিদা।
কিন্তু, সে এ বাড়ির সকলের ছোট। এখনও পর্যন্ত কোনও বিষয়ে তার মতামতের দাম নেই। কোনও গুরুত্ব নেই তার কথার। কোনও গুরুতর বিষয়ে কেউ আলোচনা করে না তার সঙ্গে। বাবা তাকে আদর করে রুমনি বলে ডাকেন। বড়দি মেজদিকে বলেন উমনি আর ঝুমনি। সে ডাকেও আদর আছে। কিন্তু আরও কিছু আছে, যা দিয়ে সুমিতার মনে হয় ওরা বড়দি আর মেজদি, সুজাতা আর সুগতা। সুমিতা শুধুই রুমনি। এ বাড়ির ছোট মেয়েটি! যাকে আদর করা যায়, ধমকানো যায়, কাজে কর্মে ফাঁই ফরমায়েশ করা যায়। বিশেষ কোনও কথার সময়ে বলা যায়, রুমনি তুমি একটু ওঘরে যাও তো এখন। হঠাৎ বাইরের কোনও নতুন নোক এলে কয়েক মুহূর্ত সুমিতা কিছু প্রাধান্য পায়। তারপর যখনই পরিচয় হয়ে যায়, সে হচ্ছে এ বাড়ির রুমনি, সেই মুহূর্তেই সমস্ত প্রাধান্য যেন যায় শেষ হয়ে। আর মানুষ কী বিচিত্র! তবুও সকলের চোখ থেকে থেকে পড়ে ওর দিকে। পড়তে হয় বলেই বোধ হয় পড়ে। রাস্তায়-ঘাটে, ট্রামে বাসে, সবাই এমন তাকায় ওর দিকে। তার কারণ আর কিছুই নয়, ওর চেহারাটার জন্যে সবাই তাকায়। হয়তো আরও কিছু মনে করে, যেমন, প্রথম দর্শনে মনে করে তাদের বাড়িতে আসা নতুন লোকগুলি। যদি জানতে পারত, সে শুধুমাত্র রুমনি, তা হলে সকলের চোখের চাউনি যেত বদলে।
এ বাড়ির কোনও দুঃখের ব্যাপারে ওর দুঃখিত হতে নেই। পারিবারিক কোনও জটিল বিষয়ে ওর কিছু নেই চিন্তা করার। এমনকী, বড়দের অনেক হাসির কথায় হাসাও উচিত নয়।
এ সীমারেখাঁটি যত না টেনে দিয়েছে বাড়ির লোকেরা, তার চেয়ে হয়তো কিছু বেশি টেনেছে সুমিতা নিজে। ও যে রুমনি, সে কথাটি নিজে ভুলতে পারে না কখনও।
কিন্তু জীবনের কোন ফাঁক দিয়ে, কবে কখন ওর মনটি আড়ালে আড়ালে টপকে গেছে সেই সীমারেখা, সে খবর রাখেনি নিজেই। গৃহস্থের বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে যেমন করে ঢোকে বনলতা, ঠিক তেমনি। যখন সে ঢোকে, তখন কারুর নজরে পড়ে না। যে ঢুকেছে, সে জীবনের স্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। প্রত্যহের কাজের মাঝে গৃহস্থের নজরে পড়ে না তা। তারপর আরও ঢোকে, আরও আরও। অনেকখানি ছড়িয়ে, লকলকিয়ে এপাশে ওপাশে বাড়তে থাকে। তখন নজরে পড়ে। তখন আর অন্ত থাকে না বিস্ময়ের।
ওর মনটিও তেমনি অদৃশ্যে টপকে এসেছে সেই সীমারেখা। কিন্তু সেটা নজরে পড়েনি কারুর। তাই বাড়ির আজকের অস্বস্তি ও অশান্তির মধ্যে সুমিতার কথা কারুর মনেও পড়ে না। ভাবেওনি কেউ।
কিন্তু যে দুর্ভাবনার অধিকার ওকে কেউ দেয়নি, যেটুকু আপনি এসেছে মনে, সেটুকু লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে ওকে। যত না ভয়ে, তত লজ্জায়। আজকের ঘটনা ওকেই বিচলিত করেছে সবচেয়ে বেশি। ওর বেদনা, কান্না, অস্বস্তি অশান্তি ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে। যে বাতাসের ঘায়ে অকম্পিত অবিচল থাকে বড় শক্ত-পোক্ত গাছগুলি, সবচেয়ে কচি লতাটি সেই বাতাসেই যেন পড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে।
সুমিতা সারা হচ্ছে ভেবে। কী হবে! কী হবে এর পরে!
বড় বড় দুটি ব্যাকুল উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাচ্ছে রাস্তার দিকে। এতক্ষণ সময়ের মধ্যে মাত্র তিন বার লোহার গেটটা উঠেছে ককিয়ে। বিলাস এক বার বাইরে গিয়েছিল, আবার ফিরেছে। আর ঝি এসেছে। সেই শেষ বার শব্দ হয়েছে। তারপর যেন বরফের মতো জমে গেছে গেটটা। আর কোনওদিন বুঝি শব্দ হবে না।
কিন্তু কখন আসবেন রবিদা। আজকের এই মাঘী সকালে, উনিই যে সত্যিকারের উত্তরায়ণের বাঁকে ফেরা সূর্য। ওই লোহার গেটের দিকচক্রবালে কখন উদয় হবেন। ওঁর সেই গম্ভীর কিন্তু অমায়িক হাসি দিয়ে ফুঙ্কারে উড়িয়ে দেবেন সব ভয়।
কিন্তু সুমিতার নিষ্পলক চোখ জ্বালা করে জল এসে গেল, তবু না, রবিদার চিহ্নও নেই কোথাও। রাস্তায় বাড়ছে লোক চলাচল। এত লোকের আনাগোনা। কিন্তু যাকে চাই, সে আসে না। এমনিটিই হয়। তবু রবিদার আসার সময় তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।
রান্নাঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে আবার বারান্দায় উঠে এল ও। এমনি করে অনেক বার করেছে ঘর বার। আবার মন টানছে ঘরের দিকে। বড়দির ঘরের দিকে। যাকে নিয়ে আজ সারা বাড়ির চেহারা গেছে বদলে। যার জীবনের একটি অধ্যায় হয়তো একেবারে শেষ হয়ে যাবে আজ। যদি না হয়, তবে হয়তো ঝুলে থাকবে ত্রিশঙ্কুর মতো। আজ বিচারক রায় দেবেন ওর জীবনের। সত্যি সত্যি বিচারক, সত্যি সত্যি কোর্ট, কাছারি, মামলা। ভাবতে ভাবতে সুমিতার বুকের মধ্যে কনকনিয়ে উঠল।
আজকে বড়দির বিয়ের তিন বছর পূর্ণ হবে। পূর্ণ হবে সন্ধ্যারাত্রি আটটার কাঁটায় কাঁটায়। তার আগেই, বেলা এগারোটা থেকে চারটের মধ্যে কোনও এক সময় হয়তো বড়দির সঙ্গে গিরীনদার বিচ্ছেদের রায় হয়ে যাবে। ভীষণ রাশভারী অথচ ভারী অমায়িক মানুষ গিরীনদা। মস্ত বড় প্রেসের মালিক। সুমিতাদের তুলনায় মস্ত বড়লোক। বিয়ের বছরখানেক আগে ওদের পরিচয় প্রেমে পরিণত হয়েছিল। আর বিয়ের এক বছর পর প্রথম শোনা গিয়েছিল ওদের বিবাদের কথা। কত কথা শোনা গেছে তখন, কত ঘটনা ঘটে গেছে এত দিনে। গত বছর এমন দিনেই বড়দি চলে এল গিরীনদার বাড়ি থেকে। স্বভাবতই বাবা নিয়েছিল বড়দির পক্ষ। মেজদিও তাই। বরং কিছু বেশি। চেষ্টা চালাতে লাগল বোঝাপড়ার। সেই ফাঁকেই যেন বিবাদের চেহারাটা হয়ে উঠতে লাগল ভয়াবহ। কথা উঠল, আলাদা হওয়া যাক উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে। সেই প্রথম ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছিল সুমিতা। সেই প্রথম নিজেরই অজান্তে রুমনির মন সকালের অলক্ষে টপকাল তার সীমারেখা। সে সীমারেখা হল ওর ব্যথা পাওয়ার অনধিকার চর্চা। আলাদা হওয়ার কথাটা কোনও সুরাহা করল না। যে দুজনকে নিয়ে ঘটনা, তলে তলে বাড়ল তাদের রেষারেষি। আগুন জ্বলল ভাল করে। ব্যাপারটা উঠল গিয়ে কোর্টে। ঘরের কথা বাইরে যেতে না যেতে হাটের আসর উঠল জমে। উভয়পক্ষেই ইন্ধন জোগাবার লোকের অভাব হল না একটুও। উপকারীর দল এলেন ছুটে। একটি কথাই বারবার শুনতে পেয়েছে সুমিতা। জুডিশিয়াল সেপারেশন। হিন্দু বিবাহ না হলে ডাইভোর্স হত।
জুডিশিয়াল সেপারেশন। আজ তার রায় পাওয়া যাবে। কী রায় পাওয়া যাবে না যাবে, সে কথা এক বারও মনে হয়নি সুমিতার। এবার কী হবে, সেই কথা ভেবে বুকে পাষাণভার।
মানুষের জীবন মনের জটিল দ্বন্দ্ব বোঝে না সে। বড়দিকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। যে কথা মুখ ফুটে কোনওদিন বলার সাহস হবে না, সে কথা হল, ওর হৃদয় মাঝের অনেক মনের একটি অস্পষ্ট মন– গিরীনদাকেও ভালবাসে। সে-ই যে ও কত বেশে কত দিন দেখেছে বড়দি আর গিরীনদাকে, কত বিচিত্র পরিবেশে, সেই ছবিগুলি আঁকা হয়ে গেছে ওর তখনকার কিশোরী বুকে। সে ছবি একটুও ম্লান হয়নি এই সবে বাড়ন্ত যৌবনের মুহূর্তে। সেই ছবিটি যেন একটি ঝকঝকে নীল আকাশ, রসসিক্ত উর্বর মাটি, একটি মসৃণ পাঁচিল, কিছু মৃদু মন্দ বাতাস। যার মাঝখান দিয়ে মনের কচি লতাটি আড়ালে আড়ালে ছড়িয়ে ছাড়িয়ে উঠেছে তর তর করে। ওদের চাউনি, হাসি, ভালবাসাবাসি, সে সবই শেষ হয়ে যাবে।
জজের বিচার কী হবে কে জানে। কিন্তু তারপরে কী করবে গিরীনদা আর বড়দি। তারপর কী হবে দুজনের, সেই কথা ভেবে ও অস্থির হয়ে উঠেছে ভয়ে ও ব্যথায়। সেই কথা ভেবেই যত বুকের কাঁপন, যত যন্ত্রণা। সে কথা বড়দি কেমন করে ভাবছে সুমিতা জানে না। মেজদির বিক্ষুব্ধ মুখে সে কথার ছায়াও দেখা যায় না। কেবল বাবাকে যখন একলা বসে থাকতে দেখে, তখন ওঁর বিশাল মুখখানিতে যেন কীসের একটি করুণ ছায়া দেখতে পায়। সে ছায়া যে কেন, কীসের জন্যে, ও তা ভেবে কূল পায় না। সব মিলিয়ে দেখতে গেলে, সবাই যেন এক। কেবল একই বাড়িতে, একই পরিবেশে ওর মনটি আলাদা হয়ে গেছে সকলের কাছ থেকে।
সত্যিই আলাদা। বাবার সঙ্গে দুই দিদির যেমন সম্পর্ক, সুমিতার সঙ্গে তেমন নয়। বাবা ওকেও ভালবাসেন, অনেক কথা বলেন। কিন্তু বড়দি মেজদি আগে জন্মেছে বলে তাদের সঙ্গে বাবার সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে অন্যরকম। সুমিতা যখন চোখ মেলে বাবাকে দেখতে শিখেছে, তখন বাবা কিছু ক্লান্ত, সৌম্য, একটু যেন করুণ। সন্তানের প্রতি একটু বেশিমাত্রায় স্নেহপরায়ণ বিপত্নীক এক ভদ্রলোক। চলায় ফেরায় কথায় ফুটে ওঠে একটু অসহায়তার আভাস। সেই মানুষটির সঙ্গেই সুমিতার ভাব, চেনাশোনা।
কিন্তু বড়দি মেজদি আর বাবা, তিনজনে মিলে আর একরকম। যাদের সবটুকু সে চেনে না, বোঝে না। আর জানে, তা বুঝতেও নেই।
কিন্তু সময় তো চলে যায়। বাইরের ঘরের পরদায় হাত দিতে গিয়ে ও থমকে দাঁড়াল। আবার তাকাল গেটের দিকে। না, রবিদার ছায়াও দেখা যায় না। শুধুই অচেনা মানুষের যাওয়া আসা।
শেষ আশা রবিদা। উনি এ বাড়ির যেমন একনিষ্ঠ বন্ধু তেমনি অন্তরঙ্গ বন্ধু গিরীনদার। গিরীনদাদের পরিবারেরও এ ব্যাপারের একমাত্র বাইরের মানুষ, প্রকৃত বন্ধুর মতো এ দুয়ের ভিতরে ছুটোছুটি করছেন শেষরক্ষার জন্যে। গতকাল রাত্রেও বাবার সঙ্গে আড়ালে কথা বলে গেছেন উনি। বলে গেছেন, আজ রাত্রে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব গিরীনের সঙ্গে কথা বলে। ওর পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত যদি কিছু করা যায়। শুনে সুমিতার ভীরু অস্থির অন্তরে মন্দ্রিত হয়ে উঠেছিল মহারব ভেরি। ইচ্ছে হয়েছিল, ছুটে গিয়ে দু হাতে জড়িয়ে ধরে রবিদাকে।
সেই ধরার ব্যাকুল-খুশি-আশায় মনে মনে হাত বাড়িয়ে আছে। কখন আসবেন রবিদা! যেন ওঁর হাতেই আছে সেই প্রসন্নময়ের ঘুম ভাঙানো সোনার কাঠি।
.
০২.
বাবার ঘরের পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে গেল সুমিতা। দাঁড়াল থমকে। ছদ্মবেশ নিতে হবে এবার। মুখের সবটুকু ব্যথা দুশ্চিন্তা উদ্বেগের ছায়া মুছে ফেলে ঢুকতে হবে। ও উৎকণ্ঠিত, ভয় পেয়েছে, সেই অনধিকার চর্চা দেখে আর কেউ অবাক হবে, সে-ই যে সবচেয়ে বড় সমস্যা, বড় লজ্জা।
যেন কিছু হয়নি, কোথায় কী ঘটছে জানে না কিছুই, ঠিক এমনি অবিকৃত নিঃশব্দে তড়িগতি রুমনিটির মতো ঘরে ঢুকল ও।
মহীতোষ টেরও পেলেন না। প্রত্যহের মতোই, এ মাঘের সকালে, লংক্লথের পাঞ্জাবিটি পরনে। বুকের বোতামগুলি খোলা তেমনি, পাশ থেকে চওড়া কাঁধে, পাঞ্জাবির গলা সরে যাওয়া পরিসরে দেখা যায় স্যান্ডো গেঞ্জিটি। পায়জামা ঢাকা পা দুটি মাটিতে রেখে দোলাচ্ছেন একটু একটু। চশমা চোখে দিয়ে ঝুঁকে আছেন খবরের কাগজের ওপর।
আজ এইটি বাবার সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম। কোনওদিন এ সময়ে বাইরের ঘরে বসেন না কাগজ পড়তে। তেমন শান্ত মানুষটি উনি কোনওকালেই নন। এতক্ষণে কত হাঁকডাক করেন। খুরপোটি নিয়ে নেমে যান বাগানে। তাতেও রেহাই নেই। ডাক পড়বে সকলের। অদ্ভুত এবং বিচিত্র সব তত্ত্ব, তথ্য আবিষ্কার করবেন গাছের পাতায়, চারায়, অঙ্কুরে, ফুলে। শুধু আবিষ্কার করলেই তো হবে না, ব্যাখ্যা করতে হবে কাউকে। সুতরাং সুজাতা, সুগতা, অর্থাৎ উমনিঝুমনির ডাক পড়বেই। দিদিরা হাসাহাসি করে। তার মধ্যে মেজদি তর্ক জুড়ে দেবেই। বড়দি শাসনের ভঙ্গিতে খুরপোটি কেড়ে নিয়ে সকালবেলার খাবার টেবিলে নিয়ে যাবে ধরে।
এ সময়ে রেডিয়োটা বাজে হয়তো নিচু সুরে। বা বিষয় থেকে যান বিষয়ান্তরে। হয়তো রবিদা কিংবা বড়দি-মেজদির বন্ধুরা আসেন কোনও-কোনওদিন। সকালবেলাটি জমজমাট থাকে।
আজ কিছুদিন থেকেই সেই জমাটি সকালের তলে তলে ধরেছে ভাঙন। পায়ে পায়ে এসেছে এই কালো-মুখ দিনটি।
বাবাকে এমনি করে বসে থাকতে দেখে সুমিতার বুকের ভয় ও ব্যথা আরও বাড়ছে। ও এই দেখতে না চাওয়ার জন্যেই বাইরে যাচ্ছে ছুটে ছুটে। বাইরে গিয়ে মনে হচ্ছে, না জানি কী ঘটে যাচ্ছে ভিতরে। তাই ছুটে ছুটে আসছে ঘরে।
ছুটে ছুটে আসছে, আর এ-ই শুধু দেখছে। সমস্ত কিছুর মধ্যে এ বাড়ির মনের অন্ধকার আছে চেপে। বইয়ের ওই আলমারি দুটিতে, নির্বাক রেডিয়োতে, ঢাকনা ঢাকা মুণ্ডহীন গাধার মতো অর্গানটায়, সোফায়, চেয়ারে, টেবিলে আর লাল টকটকে মেঝেয়। তার মাঝে মুখ-ফেরানো বাবার সর্বাঙ্গ ঘিরে যেন দেখছে শুধু ব্যথা আড়ষ্টতা। মনে হল, বাবাও যেন ওর মতো ব্যাকুল উৎকণ্ঠায় কান পেতে আছেন লোহার গেটের ওপর।
ভিতর দরজার পরদা সরিয়ে, অন্দরের বারান্দা দিয়ে ঢুকল পাশের ঘরে। সেখানে টেবিলে মুখ দিয়ে এখনও তেমনি বসে আছে মেজদি। যেন কী ভাবছিল একদৃষ্টে চেয়ে, একমনে। সুমিতাকে দেখেই চকিতে চোখ ফিরিয়ে নিল বইয়ের উপর। যেন সে কিছুই ভাবছে না এ সব, ব্যস্ত শুধু পরীক্ষার পড়া নিয়ে। এ মুহূর্তে সুমিতা না হয়ে বড়দি কিংবা বাবা হলে মেজদি এ ছলনাটুকু করত না কখনও। কিন্তু সে যে রুমনি। সে শোনে কিছু কিছু জানে, তবু থাকে আপন মনে, কলেজের পড়া পড়ে, বেড়ায় এদিক সেদিকে। তার কাছে তো ধরা দেওয়া যায় না।
ও ঢুকল তড়িৎ পায়ে, যেমন চলাফেরা করে তেমনি। মেজদির খাটের মাঝখান দিয়ে চলে গেল দেয়াল-ঘেঁষা আলমারিটার কাছে। জানে না। যেন কিছু খুঁজছে, এমনি উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল আলমারির কাঁচের ঢাকায়। ভয় হল, এ-ছলনাটুকুও ধরে ফেলবে মেজদি। কিংবা এখনি বলে উঠবে বিরক্ত গলায়, ছোড়দির পরীক্ষা কি পেছিয়ে গেল নাকি? মেজদি যখন রাগ করে, তখন রুমনির বদলে বিদ্রূপ করে বলে ছোড়দি। ওর শাসনের মধ্যে একটি বিদ্রুপের হুল থাকে সব সময়ে। সেই হুলের মধ্যে জ্বালা আছে, মধুও আছে। কিন্তু তিক্ততা নেই। ও মানুষটিই এমনি। যা মনে আসে, মুখে তা-ই বলে। কখনও সে কথা সোজা স্পষ্ট, কখনও বাঁকা ও তীব্র। হঠাৎ অচেনা মানুষের মনে হতে পারে, বিষ আছে সুগতার অন্তরে। সেজন্যে অনেকে মেজদির সঙ্গে কথা বলে ভেবে, একটু বা ভয়ে ভয়েই। কিন্তু ওকে যে চেনে, সে তার অন্ধকার মুখের সামনেও হাসতে পারে নির্ভয়ে। শাসন ও স্নেহের মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝে ও মান-অভিমানের যে মেঘটুকু সঞ্চার করে সুমিতার মনে, সে মেঘটুকু শরৎকালের মেঘের মতো এখন আসে, তখন যায়। তার মধ্যে কোনও বিদ্বেষের বিষ নেই, নেই শ্রাবণ মেঘের আবর্তন।
তবু মেজদিকেই ভয় সবচেয়ে বেশি।
হয়তো এখুনি রক্তরেখায়িত তীব্র পাতলা ঠোঁট দুটি বাঁকিয়ে বলবে, কী হল হঠাৎ তোর?
ভাবতেও কাঁপছে বুকের মধ্যে। সে যে ওর কী লজ্জা! কী ভয়! শুধু কি তাই। ওর মনের ছোট বেড়াটিকে পাশ কাটিয়ে যার মধ্যে দেখা দিয়েছে মহা বিস্তৃতির লক্ষণ, সেই প্রাণে যে অপমান হয়ে বাজবে এবার সেটুকু। সেকি তার দোষ! সেই অপমানটুকু হয়তো বুঝবে না কেউ, কিন্তু প্রাণের দিগন্তকে তো টেনে ছোট করে আনতে পারবে না।
মেজদির কাছ থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার ভয়ে ভয়ে তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে। মেজদি তেমনি রয়েছে বইয়ের মুখোমুখি। এক বেণী এলিয়ে পড়েছে পিঠে, বিনুনির ভাঁজে ভাঁজে বাসি চূর্ণ কুন্তল ছড়িয়ে কাঁধের পাশ থেকে আঁচল গেছে সরে। নীল সার্জের ব্লাউজ ওর গায়ে। ছোট গলা ব্লাউজ কিন্তু পিছন থেকে জামাটি কেউ হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। নিজেই হয়তো উঠতে বসতে অজান্তে বিস্রস্ত করেছে নিজেকে। মাঘের এই সকালে ঘরের মধ্যেও কম শীত নেই। মেজদির যেন শীত করছে না। পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে ওর শক্ত চওড়া কাঁধ। নীল জামার পাশে হঠাৎ ওই খোলা কাঁধ যেন এক ঝলক রোদ। বসেছে সারা চেয়ারখানি ছড়িয়ে। সুদীর্ঘ পুষ্ট ফরসা হাত দুখানি দেখলে এত গম্ভীর আর সুন্দর মনে হয় মেজদিকে, যেন ও এক দৃপ্ত রাজেন্দ্রাণী। তেমনি চলাফেরা। দোহারা গড়ন ওর। এক সময়ে বাংলা দেশের বাইরে থাকতে খেলাধুলা করেছে প্রচুর। হাটুতে পায়ে বুকে সারা শরীর জুড়ে উদ্ধত বলিষ্ঠতা। মেজদির এ দীপ্ত স্বাস্থ্যের জন্যে ওকে যত সুন্দর লাগে, সুমিতার ভয়ও করে তত। আর আশ্চর্য! মেজদির শরীরটিকে, প্রতিটি রেখাকে যখন বড় বেশি তীব্র মনে হয়, তখন কেন যেন সুমিতার লজ্জা করে। মেজদি চলাফেরা করে স্বচ্ছন্দে, কিন্তু সুমিতার মুখ লাল হয়ে ওঠে। ও আশেপাশের লোকের দিকে দেখে তাকিয়ে, কেমন করে দেখছে সবাই মেজদিকে। সেই ফাঁকে নিজেকেও বারেক দেখে নেয় লুকিয়ে। তুলনায় সে অনেক অপুষ্ট আর কাঁচা। তবু মনে হয়, ওরও শরীর যেন মেজদির মতো বাঁধভাঙা দিগন্তের ঢেউ হয়ে দুলছে। এই সেদিনে নিয়মিত কাপড় পরতে শেখা শরীরে, তাড়াতাড়ি নিজেরও শাড়ি টানে, জামা ঠিক করে।
কিন্তু মেজদি তেমনি। বেচারি রুমনির এই সংকোচ, অদ্ভুত সংকটে ওর কিছুই যায় আসে না। এত সাবলীল, সপ্রতিভ, দৃপ্ত, অথচ উদাসীন যে লজ্জার অবকাশ ওর নেই।
চওড়া ফরসা মুখখানিতে মেজদির এই স্বাস্থ্যের দীপ্তি একটু যেন রুক্ষতাই দিয়েছে এনে। সৌন্দর্যের বাহন যে কোমলতা, তা থেকে তার মুখখানি কিছু বঞ্চিত। কিন্তু সেইটুকুই মানানসই করেছে ওকে। সর্বাঙ্গে। রূপসী নয়, তবু রূপ দেখলে সবাই যেন অবাক হয়ে চায় ফিরে।
কেবল চোখ দুটি ওর এ সব কিছুর থেকে আলাদা। সেখানে কেমন এক ভাবের গভীরতা, তন্ময়তা, অতল দৃষ্টি। ওই চোখে যখন রাগ করে তাকায় তখন মনে হয়, সব ফাঁকি ধরা পড়ে যাবে ওর কাছে।
ও বসে আছে তেমনি, সুমিতার দিক থেকে পিছন ফিরে। মুখোমুখি রয়েছে বই। পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে মুখের একটুখানি। চোখ স্থির। পড়ছে না, বোঝাই যাচ্ছে। পাতলা তীক্ষ্ণ রেখায়িত ঠোঁট যেন খুলবে না কিছুতেই, এমনি কঠিনভাবে রয়েছে এঁটে। যত বার এসেছে সুমিতা এ ঘরে, দেখেছে, অমনি করেই বসে রয়েছে ও সারাক্ষণ। সেই যে ছোট্টকালে সিমলায় থাকতে বরফ জমে থাকতে দেখেছে, সেই যে শিশু চোখের বড় ভয়ের দেখা সেই থমথমে নির্বাক কিস্তৃত আকার পাহাড়ের পাথুরে ভূত, সবাই ঠিক তেমনি হয়ে গেছে।
সুমিতা আরও ঝুঁকে, আরও বেঁকে দেখল মেজদিকে। কে জানে মেজদি কেঁদেছে কিনা। মেজদিকে ও কোনওদিন কাঁদতে দেখেনি। কিন্তু এমন স্তব্ধ হয়ে থাকতেও দেখেনি কোনওদিন। মেজদির সর্বাঙ্গ ঘিরেও সেই আড়ষ্টতা ঠিক বাবার মতো। অথচ আজকের এই ব্যাপারে ওর শৈথিল্য ছিল না। গিরীনদার প্রতি ও বড় নিষ্ঠুর। যেন ওই সবচেয়ে বেশি মর্মাহত গিরীনদার ব্যাপারে। বড়দি যদিও বা গিরীনদাকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারে, মেজদি পারবে না! এইটিই তার চরিত্রের বিশেষত্ব। নিজে যাকে ফাঁকি বলে জেনেছে, জেনেছে পাপ বলে, সেখানে ওর কোনও আপোস নেই। গত বছর এমন দিনেই যখন বড়দি চলে এল এখানে, তখন মেজদির এম এ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েক দিন বাকি। কিন্তু কিছুতেই পরীক্ষা দিতে পারলে না। বাবা বলেছিলেন, বড়দিও বলেছিল, শুধু শুধু একটা বছর নষ্ট করবি ঝুমনো?
ও বলেছিল, তোমরা বলছ শুধু শুধু। কিন্তু আমি যে পারব না কিছুতেই। তাইতেই বোঝা গিয়েছিল, বড়দির জন্যে ওর আঘাত বেজেছে কতখানি।
বড়দি আর গিরীনদার বোঝাপড়ার ব্যাপারে, এদিকে গিরীনদা যতই জেদ করেছেন, ততই নির্দয় হয়েছে মেজদি। ওর নির্দয়তা দেখে বড় কান্না পেয়েছে সুমিতার। কেবলি ভেবেছে, মেজদি ইচ্ছে করলেই বুঝি সব মিটিয়ে দিতে পারে। ও মেজদির উত্তেজনা দেখেছে, থমথমানি দেখেছে। মেজদির ওই চোখ দুটির মতো হৃদয়ের অতলে আর কিছু আছে কি না, তা তো ও জানে না। তাই কেবলি ভেবেছে, মেজদি যদি ওর সমস্ত ব্যক্তিত্ব দিয়ে সব অন্ধকার দূর করে দিত, তবেই যেন চারদিকের সব বিবাদ-বিসম্বাদ যেত কেটে।
কিন্তু আজ সব বোঝাপড়ার, সব ভাবাভাবির, সব কথাবার্তার শেষ দিন। আজ কেন ও অমন স্তব্ধ হয়ে আছে বসে। যেন ওরও সমস্ত উত্তেজনার, সমস্ত যুক্তিতর্কের শেষ দিন আজ।
রাত পোহানো থেকে সুমিতা যেমন করে বার বার এমনি ঘরবার করেছে, গেছে প্রত্যেকের কাছে কাছে, তেমনি এ-ঘর থেকে পা বাড়াল বড়দির ঘরে। যে ঘরে গেলে ওর বুকের ভয় সশব্দে চিৎকার দিয়ে উঠতে চায়। উদ্বেল হয়ে ওঠে কান্না। তবু না গিয়ে পারে না। ওর ছোট বুকে যে আশা বাসা বেঁধেছে, তার মধ্যে তো কোনও ছলনা নেই।
ছলনা যেটুকু, সেটুকু তো ভাবের বহিরাঙ্গনের ছদ্মবেশ। বড়দির ঘরে পা বাড়াবার আগে, আরেকবার তাই ও ছদ্মবেশ ফিরিয়ে আনল। সেই কিছু না-জানা, কিছু না-বোঝা রুমনির ছদ্মবেশ। ও জানে না, যদি ওকে তেমন করে কেউ লক্ষ করত, দেখতে পেত, যতই ছদ্মবেশ ধারণের চেষ্টা করছে, ততই প্রকাশ করে ফেলছে নিজেকে। আগুন লাগা আঁচলে ঝাপটা দিলে তো সে নেভে না, আরও বাড়ে।
ঘরের ভেতর দিয়ে ঘরে যাওয়ার দরজা রয়েছে। মাঝখানে রয়েছে পদা। খাটের পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকতেই চোখাচোখি হয়ে গেল বড়দির সঙ্গে। মেজদি যেমন চকিতে নিয়েছিল চোখ ফিরিয়ে, বড়দি তা নিতে পারল না। যেমন তাকিয়ে ছিল, তাকিয়ে রইল তেমনি। কেবল এক বার চোখাচোখি হল সুমিতার সঙ্গে। চোখে শূন্য দৃষ্টি। যেন কী এক ভাবের ঘোরে ও মগ্ন রয়েছে। মনের পায়ে পায়ে চলে গেছে অন্য জগতে। সেখানেই নিবদ্ধ রয়েছে চোখ। তার মাঝখান দিয়ে কে চলে গেছে, কার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে এক মুহূর্তের, তা মনে গিয়ে ছোঁয়নি। তার ওপরে যে গেছে, সে রুমনি। সে অনেক বার গেছে, এসেছে আবার।
ত্বরিত-পায়ে এসে সুমিতা চলে গেল, বড়দির খাটের পাশতলার দিকে, ড্রেসিং টেবিলের কাছে। এলোমেলো ড্রেসিং টেবিল। আজ কিছুদিন থেকেই এমনটি হয়ে রয়েছে। জায়গা বদলে সব শিশি কৌটোগুলো ছড়িয়ে রয়েছে অজায়গায়। আয়নাটি কেমন যেন বুক চিতিয়ে হয়ে রয়েছে উধ্বমুখ। অর্ধেক বুক জুড়ে তার প্রতিবিম্বিত শুধু ছাদের কড়িবরগা। হঠাৎ নিজের ছায়া দেখলে মনে হয়, মাথাটি গিয়ে ঠেকেছে বুঝি কড়িকাঠে। পুঁতির ঝালর দেওয়া আয়নার জাল পরদাটি অসংবৃত ঘোমটার মতো একপাশে রয়েছে ঝুলে। হয়তো গতরাত্রে বড়দির আর ঢাকনাটিও টেনে দিতে ইচ্ছে হয়নি। বারে বারে, ঘুরতে ফিরতে নিজের ছায়াটি চোখে পড়েছে বলে, হঠাৎ বিরক্ত হয়ে আয়নাটিকে ঠেলে দিয়েছে উঁচু মুখ করে। পাশে একটি ছোট লেখবার টেবিল। এগুলি বড়দির ব্যবহারের। হয়তো কাল রাত্রে কিছু লিখেছে বড়দি। ফাউন্টেনপেনটি পড়ে রয়েছে খোলা অবস্থাতেই। কাগজপত্রও ছড়ানো। ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে পড়ে রয়েছে অনেক দিনের পুরনো একটি বিলাতি ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটি এ বাড়ির নয়, গিরীনদা হাতে করে এনেছিলেন। সেই থেকে ঘর আর জায়গা বদলে বদলে পত্রিকাটি ওইখানে গিয়ে ঠেকেছে। হয়তো ইচ্ছে করেই বড়দি ম্যাগাজিনটাকে কখন ফেলে দিয়েছে ওখানে। ছোট টেবিলের পাশে দুটি চেয়ার। ঘরের মাঝখানে টি-পয়। একপাশে পাশাপাশি জামাকাপড় আর অন্যান্য জিনিসের দুটি আলমারি। খাটের শিয়রের কাছে আর একটি ছোট টেবিল, পাশে একটি ছোট বইয়ের শেলফ। সেখানেও এলোমেলো অবস্থা। দেয়ালে আছে দেশি ও বিলাতি ছবি, বাবার ফটো। আর ফটো ছিল বড়দি-গিরীনদার। কিন্তু ওদের সমস্ত ব্যাপার যেদিন চাপা থাকতে থাকতে শেষপর্যন্ত ভেরি বাজিয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাইরে, সেদিন সুমিতা দেখল, দেয়ালে ছবিটি নেই। কে সরিয়ে নিয়েছে, কোথায় রেখেছে ও কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারেনি।
ভিতর বাড়িতে এ ঘরটি সবচেয়ে বেশি সাজানো। কেমন একটি মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে থাকে ঘরটির মধ্যে। আগে অবশ্য এতখানি ছিল না। বড়দির বিয়ের পরেই এ ঘরটিরও যেন বিয়ে হয়েছিল। এ ঘরের ফুলদানি থেকে দেয়ালের ছবি, সবকিছুর মধ্যেই একটা বিয়ে বিয়ে ছাপ পড়েছিল। সেটাকে ঠিক বিলাসিতা বলা চলে না। মেয়েরা বড় হলে যেমন তার ভাবে ও কথার মধ্যে ওঠে ফুটে কেমন একটি নতুন ভাব, বিয়ে হলেও বোধ হয় তাদের মনের মুকুরে কী এক নতুন রূপের আবির্ভাব হয়। যে রূপ সুমিতা সঠিক উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু ভাবতে গেলে ও একলাই বিচিত্র লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। সেই নতুন রূপেরই ছাপ সারাটি ঘরে।
তখন গিরীনদা আসতেন প্রায়ই। থাকতেনও এখানে। যখনই বড়দি আসত, তখন। এ ঘরে গিরীনদার ছোটখাটো অনেক চিহ্ন খুঁজলে পাওয়া যাবে এখনও। মলিয়েরের ওই ন্যুড-ইনকুশনটি যেদিন টাঙানো হল দেয়ালে, সেদিন শঙ্কিত লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল মেজদি। নিজের নামটি শুনে সুমিতা থমকে দাঁড়িয়ে, বাইরে থেকে শুনেছিল ওদের কথা। মেজদি বলেছিল, রুমনিটা এখনও বড়ডো ছোট। না জানি কী মনে করবে। জবাব দিয়েছিলেন গিরীনদা। উনি ঠাট্টা করে মেজদিকে কখনও মিস বিবেকানন্দ, ব্রহ্মচারিণী, কিংবা মেজদির রাজনীতি করার দিকে একটা খোঁচা দিয়ে বলতেন, ছাত্র দলনী, নয়তো সোজাসুজি মেজদিও বলতেন। বলেছিলেন, দেখ মেজদি, এটা তোমরা বড় ভুল কর। দেখতে না দিলে মানুষ দেখতে শেখে না। তখন লুকিয়ে দেখতে হয়! নইলে তো ওদের দেশে এত বড় বড় শিল্পীদের ছবিগুলি যখন ভারতবর্ষে পাঠায়, তখন নীচে লিখে দিতে হয়, ফর অ্যাডালটস্ ওনলি!
কথা শুনে হেসে উঠেছিল ওরা তিনজনেই। বড়দি মেজদি গিরীনদা।
ফটোশিল্পী নবীন হালদারের ওই ট্রাইবদের দুটি ফটোও তখুনি টাঙানো হয়েছিল। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, সেই একই। ট্রাইবদের একটি বিবস্ত্র মেয়ে-পুরুষদের নাচের ফটো, অন্যটিতে গাছপালা পাহাড় পর্বত নদনদীর মতোই উন্মুক্ত দেহ একটি যুবতী দু পা ছড়িয়ে রং দিয়ে অলঙ্কৃত করছে তার নাভিমূল।
এ সবই বড়দির বিয়ের পর। বাবার ঘরে তো শুধু মায়ের ফটোটি আছে। ওর আর মেজদির ঘরে আছে আয়ারল্যান্ডের দুজন বিপ্লবীর ছবি, মহাত্মা গান্ধীর সমুদ্রযাত্রা আর গতবছর যে মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে, সেই যুদ্ধে মুক্ত লেলিনগ্রাডের ওপর একজন বিজয়ী সৈনিকের ছবি। আর শুধু বই। ও ঘরে প্রসাধন সামগ্রীও কিছু নেই। সে সবও বড়দির ঘরেই। এ ঘরেই এক কোণে, ওই ছোট্ট কুঠরি। ওরা তিন বোন ওখানেই কাপড় পরে। এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই ঠিক করে নেয় বেশবাস।
এ বাড়িতে প্রসাধন সামগ্রী সাজানো থেকেছে, বড়দির বিয়ের পর সে সবের আমদানিও হয়েছে সুপ্রচুর। কিন্তু এ বাড়িতে প্রসাধনের বাড়াবাড়ি হয়নি কোনওদিনই। একটু স্নো, পাউডার, শীতের ক্রিম, চুলের শ্যাম্পু, এ বাড়ির প্রথানুযায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। বড়দির বিয়ের পরেই নতুন নতুন জিনিসে ভরে উঠেছে ড্রেসিং টেবিল। নতুন সাজে সেজেছে এ-ঘর।
কিন্তু সব সজ্জা-ই আজ এ বাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখ ঢেকেছে অন্ধকারে। কেমন বিবর্ণ, শ্রীহীন, রুদ্ধশ্বাস অস্বস্তিতে ভরে আছে সারাটি ঘর। এ-ঘরের অগোছালো জিনিস প্রতিদিন ঝি অচলা দিয়ে যায় গুছিয়ে। তবু যেন সবই অগোছালো, তবু যেন সবই এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, বিষণ্ণ আর একটি অস্পষ্ট অপমানের ক্ষুব্ধ ব্যথায় গুমরোচ্ছে।
বড়দিকে সকাল থেকে সেই একইভাবে এলিয়ে এলোমেলো শুয়ে থাকতে দেখে আরও বেশি করে মনে হচ্ছে সে কথা। ওরই মুখের ছায়া সারাটি ঘরের মধ্যে ওই ভাঙা সাজের রুদ্ধ যন্ত্রণা মূর্তি ধরছে। স্মৃতি দংশন করছে প্রতি কোণে কোণে, বিছানায়, টেবিল-চেয়ারে, সবকিছুতে, সবখানে। সবখানে, অনেক দুপুর, অনেক সন্ধ্যা, অনেক রাতের অলি-দংশিত-স্মৃতির অলক্ষিত ফোঁটা-ফুলগুলি বাসি আর বিবর্ণ হয়ে পড়ছে ঝরে ঝরে। অনেক মিষ্টি হাসি, আবেশ-দৃষ্টি, এখন বিদ্রূপ আর শ্লেষ কষায়, জ্বালা ছড়াচ্ছে ব্যথা ও অপমানের।
বিনুনির বাঁধন খুলতে খুলতে, বড়দির দিকে লুকিয়ে দেখতে দেখতে হাত কাঁপছে সুমিতার। ও যত খুলছে, জট পাকাচ্ছে তত।
বড়দি ঠিক তেমনি এলিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছে ওর লাল আভাসিত রং শাড়িটি দলিত করে। কেমন করে শুয়ে আছে, সে খেয়ালটুকুও নেই এখন। ওর বাঁ পায়ের ওপর থেকে শাড়িটি উঠে গেছে। খানিকটা। আঁচলটি চাপা পড়ে গেছে শরীরের তলায়, একটুখানি টেনে দেওয়া রয়েছে বুকের ওপর দিয়ে। বিলাতি লিনেনের জাম-রং-ছাপা ব্লাউভ্রূ কুঁচকে কোমরের কাছ থেকে সরে উঁচুতে উঠে গেছে। বড়দির জামার কাঁধও বড়। কাঁধ, গলা, সবই যেন দিগন্তকে বাড়িয়ে, পোশাকের বিস্তৃতিটুকু দিয়েছে সংক্ষিপ্ত করে। একমাত্র ওরই জামার ছাঁট কাট একটু এই রকমের। আগেও প্রায় এমনিই ছিল। বিয়ের পরে আরও বদলেছে। বিশেষ, গরমের দিনের জামাগুলি তো কাঁধের প্রান্তে ডানা ছুঁয়ে বিস্তৃত বাঁকে দিশেহারা গতিতে নেমে যায় বুকের দিকে। যেন সেই দুর্জয় গতি থামবে না। তারপরে হঠাৎ একসময়ে থামে, যখন সুমিতা, রুদ্ধশ্বাস হয়ে ওঠে মনে মনে। পরে নিশ্বাস যদিও বা পড়ে, তবু এক সংশয়ে মন বিলুলিত হতে থাকে। যেখানে এসে থেমেছে, সেখানেও কেমন এক বাঁধভাঙা অস্পষ্টতা। সুমিতা-ই লাল হয়ে ওঠে মুগ্ধ-লজ্জায়। মুগ্ধ হয় ও, ওই সময়ে বড়দিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। কিন্তু ওর এই নতুন বয়সের লজ্জা ছাপিয়ে ওঠে সেই মুগ্ধতাকে। বড়দি যত চলাফেরা ওঠাবসা করে, ততই ধুকধুক করে ওর বুকের মধ্যে। তাকায় সকলের চোখের দিকে, যদি কেউ থাকে আশেপাশে, বিশেষ পুরুষদের। কিন্তু সবাই হাসে, কথা বলে, বড়দিও সমান তালে চলে সকলের সঙ্গে। কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। ও-ই শুধু মরে ভেবে ভেবে।
কিন্তু বড়দি এমনি চিরদিনই। ওর বড় হওয়ার সব কালটুকুই কেটেছে বাংলার বাইরে। লেখাপড়া শিখেছে কনভেন্টে। বি এ পাশ করেছিল লাহোরে। বাংলার কোনও সমাজের সঙ্গেই পরিচয় ঘটেনি ওর সে পর্যন্ত। মেজদি কনভেন্টে ছিল কয়েক বছর। কিন্তু পুরোপুরি নয়। ওর কলেজ জীবনের সবটাই কেটেছে প্রায় কলকাতায়। কলকাতার ছাত্রী জীবনের রুচি বোধটাই রপ্ত হয়েছে ওর। তবু ওর সচকিত বলিষ্ঠতা একটু চোখে পড়ে বেশি। সেদিক থেকে সুমিতা একেবারেই কলকাতার মেয়ে। ঘরে বাইরে, মনে, শিক্ষায়-দীক্ষায় চলাফেরায়, সবকিছুতে। কলকাতার এই পাঁচমিশেলি আধুনিক ঝংকার ও শোনে, ভালও লাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু বড়দির মতো জামা পরার কথা আজও ভাবতে পারে না।
মেজদি কখনও সখনও প্রায় ওই রকমের জামা পরে। বড়দির বিয়ের সময় পরেছিল। বড়দি-গিরীনদার সঙ্গে কোনও কোনওদিন বেড়াতে যাওয়ার সময় হয়তো পরেছে। গিরীনদা বলতেন, তুমি তোমার ওই স্বদেশি পোশাকগুলো দয়া করে ছেড়ে নিয়ে মিস ঝুমনো। লোকে ভাববে, আমি দুই বাড়ির দুই মেয়েকে নিয়ে চলেছি।
মেজদি বলত, যাচ্ছি বেড়াতে। তোমার জন্যে তো যাচ্ছিনে।
গিরীনদা বলতেন, তা বললে তো হবে না। যতক্ষণ আমার সঙ্গে আছ, ততক্ষণ আমারই।
মেজদি পাতলা ঠোঁট দুটি বাঁকিয়ে বলত, ইস।
ঠিক সেই মুহূর্তে মেজদিকে মনে হত, বড়দির মতোই রহস্যপ্রিয় তরল।
এখন বড়দির ওই বড়-গলা জামা আরও অনেকখানি নেমে এসেছে সব সংশয় পার হয়ে। সেদিকেও ওর খেয়াল নেই। অন্য সময় হলে এতক্ষণে লজ্জায় মরে যেত সুমিতা। কিন্তু নিয়ত ফিটফাট বড়দিকে এমন বিস্রস্ত অবস্থায় দেখে সমস্ত ব্যাপারটি ওকে আরও শঙ্কিত করে তুলেছে।
গলায় সোনার চেন-হার গলা থেকে পিলপিল করে নেমে এসেছে ডানদিকের বুকে। হাতে মাত্র দুটি সোনার চুড়ি। কানে দুটি বড় বড় লাল পাথর সোনার সরু আংটায় আটকানো।
কিন্তু সব মিলিয়ে ও যেন কেমন দলিত মথিত হয়ে পড়ে রয়েছে। ওর পাশের লাল টকটকে কম্বল, ওর লাল আভাসিত-রং শাড়ি, জাম রং-ছাপা ব্লাউজ, তার ফাঁকে ফাঁকে ওর উন্মুক্ত ফর্সা ধবধবে নিটোল পায়ের গোছা, কোমরের উপরিভাগ, কাঁধ আর বুকের একটি অংশ যেন রং-বেরং-এর নিষ্পেষিত ফুলের মতো রয়েছে ছড়িয়ে। চুলের খোঁপাটি পড়েছে শিথিল হয়ে। চোখের চারপাশে ভিড় করেছে ছায়া। মাঝখানে অকম্পিত দীপশিখার মতো চোখ জ্বলছে। ফুলে ফুলে উঠছে নাকের পাটা। আর লাল টকটকে ঠোঁট হঠাৎ নড়ে উঠছে। কী যেন ভাবছে ও। যেন সারা রাত ধরেই ভেবেছে। তাকে এই বেশে, প্রায় এমনিভাবেই, গতকাল থেকে দেখছে সুমিতা।
বড়দি, মেজদির মতো দোহারা নয়, কিন্তু ঠিক একহারা বলতে যেমন ছিপছিপে বোঝায়, ও তাও নয়। ওর হাতে পায়ে, চোখে মুখে এক অপূর্ব রূপের দীপ্তি। কিন্তু সেই রূপ যেন মেজদির মতো গম্ভীর হয়ে ওঠেনি। বরং বড় হয়েও বড়দি সদাসচকিত তরল স্রোতের মতো তরতর করে চলেছে। ঠোঁটের কোণে নিয়তই একটু হাসি আছে লেগে। যখন ও অভিমান করে, দুঃখ পায়, রাগ করে, তখনও লেগে থাকে ওই হাসিটুকু। কেবল মুখখানি লাল হয়ে ওঠে। যখন সেটুকুও থাকে না, বুঝতে হবে, তখন দুঃখ বড় গভীরভাবে বেজেছে। এমনিতে চোখে মুখে চলায় ফেরায় গাম্ভীর্যের লেশমাত্র নেই। হঠাৎ দেখে মনে হয়, ব্যক্তিত্ব বুঝি নেই। কিন্তু যখন রাগ করে, তখন অনর্থ ঘটে যায়। অন্যথায়, ওর এই অপরূপ রূপের মাঝে একটি সহজ মানুষ, কথায় কথায় গুনগুন করে ফেরে অনুক্ষণ। মনের কোথায় যেন একটু শৈথিল্যও আছে। একাজে সে কাজে কেবলি মেজদিকে জিজ্ঞেস করবে, আচ্ছা এটা কী করব বল তো ঝুমনো? কিংবা এটা ঠিক হয়েছে ঝুমনি?
তখন গম্ভীর চিন্তাশীল মেজদির সামনে বড়দিকে রূপসী আদুরে মেয়েটি মনে হয়। মেজদি যদি বলে এইটি করো, নিশ্চিন্ত খুশিতে ও তাই করে। আবার ঝগড়া হলে কথা বন্ধ হতে দেরি হবে না। ওরা দুজনে যখন পথ চলে, তখন মেজদি চলে সামনের দিকে তাকিয়ে। বড়দি যায় চারদিকে চোখ বুলিয়ে। মেজদি যদি বলে, এটি খারাপ, এ চলবে না। বড়দি বলবে, একটু দেখলে কেমন হয়?
ওদের মিলের চেয়ে অমিল বেশি। কিন্তু ওদের ভাবও বেশি, যে ভাবের মধ্যে ছোট রুমনির জায়গা নেই।
বাবা বলেন, রুমনিটাও দেখছি উমনির মতো হয়ে উঠছে। অর্থাৎ বড়দির মতো। কিন্তু কোথায়, কোনখানে, সঠিক বুঝতে পারে না সুমিতা। এমনকী, বড়দি ওর কাছে কেমন যেন অচেনা, দূরে দূরে রয়ে গেছে। শুধু যে বয়সের অনেক তফাত, তা নয়। আরও কোনও কোনও জায়গায় বড়দিকে সবটুকু চিনে উঠতে পারেনি।
এক জায়গায় বড়দি ওর বড় চেনা। সেখানে এক স্নেহময়ী বড়দি, যে রুমনিকে মাঝে মাঝে সাজায়, আদর করে কিনে দেয় এটা সেটা। খেতে দেরি হলে বাবাকে ধমকায়, রবিদাকে খেপায়, বিলাসকে তাড়া দেয়, রান্নাঘরে গিয়ে নিজে নতুন নতুন খাবার তৈরি করে। মুখ গোমড়া করে ধমকাতে জানে না ও। মেজদি যদি গম্ভীরভাবে বলে, রুমনি চুল বেঁধে নাওগে।বড়দি সেখানে বলবে, এ কী? চুল বাঁধিসনি? বলে নিজেই চিরুনি নিয়ে, ওর ছোটকালে শেখা মেমসাহেবদের মতো অদ্ভুত ভঙ্গিতে চুল বেঁধে দেবে।
তারপর এমন ভুলে যাবে যে, তিন দিন হয়তো রুমনির সঙ্গে কোনও কথাই হবে না। চোখেই পড়বে না। যেন রুমনি এ বাড়িতে নেই, কিংবা বড়দি এখানে থেকেও ঘোরাফেরা করছে আর এক জগতে।
তখন বড় কষ্ট হয় সুমিতার মনে। অবাকও হয়, আর দূর থেকে দেখে বড়দিকে। তখন আর বড়দিকে ও কিছুতেই চিনে উঠতে পারে না।
সেই বড়দি কেমন এক স্বপ্নময়ী। নিজের ভাবেই বিভোর। আড়ালে আঁচল ঠিক করছে, ব্লাউজটি টেনে নিচ্ছে, সারা মুখে একটি রহস্যের ঝিকিমিকি। যেন ও কী এক গোপন রসের হিল্লোলে বিজয়িনীর মতো ফিরছে নিঃশব্দ হাসির রেশ ঠোঁটে নিয়ে। বিয়ের অনেক আগের থেকে, সুমিতার চোখে যখন সবেমাত্র এ সংসারের বৈচিত্র ফুটেছে তখন থেকেই দেখছে এমনি। যেন বড়দি কী একটি বস্তু পেয়েছে, কী নিয়ে কী যেন রচনা করছে মনে মনে।
ওদের বাড়িতে চিরকালই অনেক ছেলের আনাগোনা। তখন বড়দি সবসময়েই কারণে অকারণে বাইরের ঘরে যেত। ছেলেরা যখন আসত, তখন ওকে আরও বেশিভাবে বিভোর রহস্যময়ী মনে হত। পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও চিনতে পারত না রুমনিকে। বাবা কাছে বসে থেকেও পড়ে থাকতেন বহু দূরে। সবাই ওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। ও যেন মহারানি, ওকে ঘিরেই সবাই।
বাবাও রুমনির মতোই কাছে থেকেও দূর থেকে দেখতেন উঁকি মেরে। ওঁরও যেন বুকের মধ্যে রুমনির মতো একটি অস্পষ্ট ব্যথা। বাবার জন্যে কীরকম কষ্ট হত মনে মনে। কিন্তু বাবা ঠিক কথা বলতেন, হাসতেন, তবু ওই রকম মনে হত।
তারপরে রবিদার সঙ্গে প্রথম এলেন গিরীনদা। তখন থেকে বড়দিকে ওর আরও বিহ্বল আচ্ছন্ন মনে হত। কী এক আবেশে বড়দি হাসছে, কথা বলছে, চলছে, ফিরছে, নিজেই বোধ হয় জানত না। অথচ চোখের তারা তেমনি সচকিত, স্রোতস্বিনীর মতো এদিকে ওদিকে প্রবাহিত।
তখন প্রায় মাসখানেকের মধ্যে একটি কথাও বড়দি বলেনি সুমিতার সঙ্গে। কিন্তু আশ্চর্য! এত বড় একটি বিচিত্র ঘটনা কারুর যেন চোখেই পড়েনি এ বাড়ির। শুধু সুমিতাই এক অবাক ও অবুঝ ব্যথা নিয়ে সব লক্ষ করেছে।
তারপরে, বছর ঘুরতেই ও দেখল, বড়দির সঙ্গে গিরীনদার বিয়ে। ওকে কেউ কিছুই বলেনি। যে বলতে পারত, সে মেজদি। কিন্তু মেজদি কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি। বাবার তো সময়ই ছিল না। বিয়ের পূর্বমুহূর্তে রহস্যমিশ্রিত দূরাগত বাজনার মতো একটি শব্দ পাচ্ছিল সুমিতা। বিয়ের মুহূর্তেই ওর এত দিনের সব সংশয়, কৌতূহল ব্যথা এক চকিত খুশির কল্লোলে গেল ভেসে। হঠাৎ যেন ও বড়দিকে আবিষ্কার করল নতুন করে। এত ভাল লাগল ওর বড়দিকে। কেন, ও তা নিজেই জানে না। বড়দি যে এত সুন্দরী, এমন রূপসী, তা ওর চোখে এমন করে ধরা পড়েনি।
হঠাৎ বাড়িতে কী ঘটে গেল। সারা বাড়ির কোণে কোণে কেমন এক নিঃশব্দ উল্লাসের বান ডেকে উঠল। ওর ভাব হয়ে গেল গিরীনদার সঙ্গে। গিরীনদা এমন করে বড়দির দিকে চায়, এমন কাছে কাছে থাকে, দেখেশুনে ওর প্রাণের প্রথম নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেল। সেই প্রথম নিঝর হল ওর সেই সময়ের কৈশোরের অন্তিম মুহূর্তে দুটি আপন জনের মিলন দেখা। সেই সময়টা আর কাউকে দেখেনি, বড়দি আর গিরীনদাকে ছাড়া। দেখে দেখে, কী যে ভালবেসেছিল দুটিকে। যেন ছোট্ট মেয়েটির দুটি প্রাণের পুতুল।
যে অস্পষ্ট ব্যথা ও কৌতূহল নিয়ে ও আগে বড়দিকে দেখত, তখন ওই অস্পষ্ট ব্যথাটুকু চাপাখুশি-কৌতূহল হয়ে উঠল। দেখল, বড়দির সেই ভাববিহ্বলতা আরও গম্ভীর হয়েছে। লাল ঠোঁট দুটি আরও রাঙা হয়ে থাকে সবসময়। ঠোঁটের কোণে যে হাসিটুকু কী কারণে বন্দি হয়ে ছিল, সেটুকু মুক্তি পেয়ে অনাবিল হয়ে উঠল।
সুমিতা তখনও তেমনি বড়দির কাছ থেকে দূরে দূরেই। ওই দুজনকে মিলিয়ে ভালবেসেছে ও দূর থেকেই।
ওর এই খুশির আসরে মেজদির ভূমিকা কম। তবু মেজদিও ওদের কাছে গেলে অন্য রকম হয়ে যায়। বড়দির মতো মেজদিও সশব্দে হেসে ওঠে খিল খিল করে। বাবাকে মনে হত, পুতুল খেলার আসরে এসেছেন বয়স্ক মানুষটি। দেখেশুনে মজা পাচ্ছেন খুবই, তবে কিছুই করার নেই, বড় একলা।
সুমিতার এই খুশির কথাটুকু জানতেন সবচেয়ে বেশি রবিদা। বারে বারে জিজ্ঞেস করতেন, তা হলে তুমি খুবই খুশি হয়েছ রুমনি?
–খুউব।
–কেন বলো তো?
সুমিতা অবাক হয়ে বলত, বা রে! আপনি যেন কী।
রবিদাকে সুমিতাই বলত, কেমন করে বড়দির ঘর সাজানো হয়েছে। গিরীনদা কী বলেছেন। বড়দিকে নিয়ে কোথায় গেছেন। রবিদা বলতেন, তাই নাকি? ও, আচ্ছা? কখনও কখনও মনে হত রবিদা যেন বড় বেশি গম্ভীর হয়ে উঠছেন শুনতে শুনতে। কিংবা শুনছেন না, দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন কিছু। বড়দি যখন গিরীনদাদের বাড়ি যেত, তখন রবিদার সঙ্গে সুমিতা বেড়াতে যেত ওবাড়িতে। সেবাড়িও যত বড়, সাজানো-গোছানো ততই সুন্দর।
তারপরে, বছর ঘুরতেই একদিন দেখল, বড়দি লুকিয়ে কাঁদছে ওর ঘরে। বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছেন সামনে। সেদিনটি ছিল আজকের এই দিনের প্রস্তাবনা। তারপরেও বড়দি এক বছর যাতায়াত করেছে গিরীনদাদের বাড়িতে। গিরীনদাও এসেছেন। গত বছর থেকে সবই বন্ধ হয়েছে।
বাকি আছে শুধু এই দিনটি। সুমিতা চেয়েও দেখল না ওর চুলের দিকে। দুটি বিনুনি যেমন ছিল, তেমনি আছে। ও দেখছে শুধু বড়দিকে। আজও বড়দি নিজের ভাবে বিভোর। কিন্তু এমন বিষণ্ণ ক্ষুব্ধ সেদিন ছিল না। কোথায় গেল সেই সদা-সচকিত হাসিটি। বড়দি সেই তরল স্রোতের সব প্রবাহটুকু যেন রেখে এসেছে গিরীনদাদের বাড়িতে।
এইখানে গিরীনদা বসতেন, ওইখানে শুতেন, এইটি, ওইটি, সেটি গিরীনদা এনেছিলেন এ ঘরে। তার মাঝে, ওইভাবে শুয়ে আছে বড়দি। সারা ঘরের মধ্যে একটি তীব্র ব্যথা আবর্তিত হয়ে উঠছে। আজ সব শেষ, আজ এই শেষ দিনেই যেন সবচেয়ে বড় ঝড়ের প্রাক্ মুহূর্তের নিস্তব্ধতা এসেছে নেমে। চারদিকে এখন মেঘের সমারোহ। ভয়ে বিলুলিত শুধু এ বাড়ির অলক্ষিত লতাটি।
মাতৃহীন ছোট্ট মেয়ে রুমনির অনেক সুখ দুঃখ, এ বাড়ির মধ্যে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিল ওকে বড়দি আর গিরীনদা। ওর সেই দিগন্তই আজ নিদারুণ বিদ্রূপ করে ফিরে এসেছে ভয়াল কুটিল বেশে।
সুজাতা ডাকল, রুমনি!
ধক করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। চোখাচোখি হল বড়দির সঙ্গে। বলল, অ্যাঁ?
ওর চমকানি দেখে বোধ হয় চকিতে একবার সুজাতার ভ্রূ কেঁপে উঠল। বলল, রবি এসেছে?
তখনও সুমিতার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটি লাফাচ্ছে। বলল, না তো। বলতে বলতে ও প্রায় টেনে ছিঁড়তে লাগল বিনুনি। কিন্তু বড়দি আর কিছুই বললে না। তবু মুহূর্তের মধ্যে যেন কী ঘটে গেল। সুমিতার হৃৎপিণ্ডের দামামা থামল না। ও যেন কীসের এক আলোকময় ইশারা পেল দেখতে। আজকের ছায়া অন্ধকারে, এক ঝলক বিদ্যুতের মতো বড়দির প্রশ্নটি ওকে দেখিয়ে দিল নতুন পথ।
বড়দিও তবে রবিদার পথ চেয়ে আছে। জানতে চায়, কী সংবাদ আনবেন রবিদা। যেন স্পষ্টই দেখতে পেল, ব্যথায় বুক চেপে বড়দিও উৎকর্ণ হয়ে আছে ওই লোহার গেটের দিকে। এই শেষ মুহূর্তে তবে বড়দি শেষ কথাটি জানতে চায়! এখনও তবে সব বিবাদ বিসংবাদ মিটতে পারে।
ও যেমন ত্বরিত পায়ে এসেছিল, তেমনি ত্বরিত পায়ে সামনের দরজা দিয়ে চলে গেল বাইরে। মনটা নিঃশব্দে গুনগুন করছে, যেন বাইরের ঘরে গিয়ে দেখতে পায় রবিদা কথা বলছেন বাবার সঙ্গে। যেন দেখতে পায়, যেন দেখতে পায়…
.
০৩.
মহীতোষ তেমনি কাগজ পড়ছেন একাকী। দ্বিতীয় প্রাণী নেই সেখানে। এক মুহূর্তে থমকে পরদা সরিয়ে সুমিতা বাইরের বারান্দায় ছুটে এল। কেউ নেই গেটে। নিঃশব্দ পাষাণপুরীর লৌহনিগড়। ঘুম ভাঙানো সোনার কাঠি নিয়ে সেই রাজপুত্র এসে দাঁড়ায়নি সেখানে। কুতূহলী জনতার কেউ কেউ বারেক চোখ ফিরিয়ে গেল ওর দিকে। শুনতে পেল, বিলাস ডাকতে এসেছে বাবাকে বাইরের ঘরে। খাবার দেওয়া হয়েছে।
সুমিতা দাঁড়িয়ে রইল বারান্দায় অনেকক্ষণ ধরে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জ্বালা করে উঠল চোখ দুটি। হঠাৎ রবিদার উপরেই বড় অভিমান হতে লাগল ওর।
বিলাস ডাকল, আসুন ছোড়দিমণি খাবার দেওয়া হয়েছে।
সুমিতা ফিরে তাকিয়ে বলল, ওরা সবাই গেছে।
বিলাস বলল, হ্যাঁ।
সুমিতা বলল, যাচ্ছি।
বিলাস চলে গেল। সুমিতা দাঁড়িয়ে রইল তেমনি। কিছুতেই যেতে পারছে না। অথচ এখন আবার ঘরে যাওয়ার জন্যে প্রাণটা ছটফট করে মরছে। শেষ পর্যন্ত গেটের মায়া ছেড়ে ও খাবার ঘরে এসে ঢুকল। ততক্ষণে মেজদির খাওয়া হয়ে গেছে। ও ওর হাতের ঘড়িটি দেখে বলল, বাবা, আর দেরি কোরো না তোমরা। সময় বিশেষ নেই।
মেজদির গলায় কথাটি যেন একটি নির্মম দৈববাণীর মতো শোনাল। কারুর আসার জন্যে, কোনও সংবাদের জন্যেই আর সময় নেই। সুমিতার দিকে এক বার দেখে বেরিয়ে গেল মেজদি। অন্যদিন হলে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করত, কোথায় ছিলে এতক্ষণ খাবার ফেলে?
জবাব দিতেন হয়তো বাবা, রুমনো সাহেবার দেখছি খাবার কথা মনেই থাকে না।
মুখোমুখি বসেছে বড়দি আর বাবা। অস্থির ছটফটে মানুষ হয়েও বাবা আজ একেবারে শান্ত হয়ে গেছেন। বাবার সেই আড়ালের অসহায় করুণ অবস্থাটা আজ যেন প্রকাশ হয়ে পড়েছে অনেকখানি। তবু বাঁ হাতের পাঁচটা আঙুলে চলেছেন টেবিল ঠুকে, আর চেয়ে চেয়ে দেখছেন বড়দিকে। ডান হাতে ওভালটিনের কাপ ধরে রয়েছেন।
বেশ বোঝা যায়, বড়দি কোনওরকমে স্যান্ডেলটি পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কপালের উপর এসে পড়েছে রুক্ষ চুলের গোছা। সিঁথিতে সিঁদুরের আভাস। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার সময় ওর ঘাড়ের নীচে অনেকখানি উন্মুক্ত পিঠ দেখা যাচ্ছে।
বাবা আর বড়দি যেন দুটি নতুন মানুষ। কেউ কাউকে চেনে না, অথচ মুখোমুখি বসতে হয়েছে, কিন্তু অপরিচয়ের সংকোচে, যেন দুজনেই আড়ষ্ট। কে আগে কথা বলবে, সেইটিই সমস্যা।
সুমিতার কী বিড়ম্বনা! বেচারিকে এই নির্বাক আড়ষ্ট আবহাওয়ার মধ্যেও প্রত্যহের মতোই খেতে হবে হাপুস হুপুস করে, নিশ্চিন্ত ছোট মেয়েটির মতো। বড়দির খাবার প্রায় তেমনি পড়ে আছে। কেবল রুটির কোণটি একটু ভাঙা! তারপর হঠাৎ মনে হল, হয়তো ওর জন্যেই বাবা বড়দি কথা বলতে পারছে না। ওর উপস্থিতিই বোধ হয় কাজের কথায় বাদ সাধছে। ভাবতেই ও বড়দির পাশে বসে গোগ্রাসে গিলতে লাগল খাবার। কিন্তু সে যে ওর গলা দিয়ে নামবার আগেই বুক থেকে কী একটি বস্তু ঠেলে উঠতে লাগল ওপরে। ঠেলে উঠতে লাগল আর টনটন করে উঠল চোখের শিরাগুলি, তবু জোর করে চোয়াল নেড়ে চিবুতে লাগল।
ও জানে না, এই ভঙ্গিই ওর ধরা পড়ার পক্ষে কতখানি। বোঝেনি, এ বাড়িতে আজ সবাই যতখানি অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে, ও হয়ে উঠেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। সকলের ঝড় উঠেছে বুকে, ওপরে রয়েছে নিথর। ওর থরথরানি ভিতরে বাইরে।
মহীতোষ হঠাৎ বললেন, সকালবেলা শুধু ওই জামাটা গায়ে দিয়েছিস? ঠাণ্ডা লাগবে যে?
সুমিতা চোখ তুলে তাকাল। না, ওকে বলছেন না। বাবা তাকিয়ে রয়েছেন বড়দির দিকে।
বড়দিকে এতক্ষণ পরে হঠাৎ বড় লজ্জিত হয়ে উঠতে দেখা গেল। বলল, না, এ জামা বেশ গরম আছে।
যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছে বড়দি। সুমিতা তাকাল মহীতোষের দিকে! কিন্তু মহীতোষ তখন মাথা নিচু করে, আরও জোরে দ্রুত টেবিল ঠুকছেন। ওঁর গোঁফ দাড়ি কামানো প্রশস্ত মুখের পেশি দীপ্ত স্ফীত হয়ে উঠেছে। সারা মুখটি হয়ে উঠেছে আরও বিশাল রক্তাভ। যেন কী কথা রয়েছে মনের মাঝে। তারই বোবা অভিব্যক্তি উঠেছে ফুটে, ফুলে ফুলে উঠছে ভিতর থেকে। সহসা সুমিতার দৃষ্টি পড়ল, ওদের দুজনের কাপ-ই শূন্য হয়ে গেছে। তবু আছে বসে। ওর বসে থাকাটা দৃষ্টিকটু হয়ে উঠল হঠাৎ নিজের কাছেই। গরম চা-ই চোখ কান বুজে গিলে ও উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ডাইনে বাঁয়ে সামনে, কোনওদিকেই যাওয়ার পথ খুঁজে পেল না, পিছন দিকে বাগানে যাওয়ার ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গিয়েও নেমে যেতে পারল না। একটু পাশে সরে দাঁড়িয়ে রইল বারান্দার উপর। কে যেন পায়ে এঁটে দিল স্ক্রু। কান পেতে রইল ঘরের গহন হৃদয়ে।
কিন্তু ওরা দুটিতে তেমনি নীরব মুখোমুখি। কতক্ষণ থাকবে। থাকতে তো পারবে না। সুমিতা এই বয়সের মন দিয়ে অনুভব করেছে, ওঁদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব কত গভীর। ওঁরা তো শুধু বাপ আর মেয়ে নয়, আরও কিছু কথায়-গল্পে কাজে, সুখে-দুঃখে, পরস্পরের সঙ্গী। সেই সঙ্গে মেজদিও অবশ্য আছে। তিন জনের কত অতীত দিনের গল্প ও কাহিনী, পুরনো দিনের কত কথা, কত জায়গা, কত বন্ধু জুড়ে আছে মনে। সুমিতার কাছে সেগুলি সবই অচেনা বিস্ময়কর গল্প। শেষের দিকের দু-একটি অস্পষ্ট ছায়া হয়তো ভেসে ওঠে ওর চোখে। বাবার চাকরির শেষ কয়েকটি বছরের দিল্লি, তার আগে সিমলা প্রবাসের অস্পষ্ট ছবি সে সব। বড়দি মেজদি বাবার কাছে সে সব জীবন্ত। যেন সেদিনের কথা।
সেই সব দিনগুলিই ওঁদের পরস্পরকে অনেকখানি কাছাকাছি ও ঘনিষ্ঠ করে দিয়েছে। এই বন্ধুত্বে সুমিতার ঠাঁই যেমন নেই, তেমনি মনে মনে বড়দি মেজদির প্রতি ওর হিংসেও একটু আছে। এই হিংসে তখুনি কান্নায় উদ্বেল হয়ে ওঠে, যখন ওঁরা মায়ের কথা বলেন। কত হাসি, কত কান্না, কত ঝগড়া কত খুঁটিনাটি ছোটখাটো বিচিত্র সব ঘটনায় পরিপূর্ণ ওদের জীবন।
বাবা যদি বলেন, সেবারে মনে আছে তো উমনি, যেবারে আমাদের ডিপার্টমেন্টের খোদ কর্তা হয়ে এলেন মিঃ ওয়েবস্টার
বড়দি চোখ বড় করে বলবে, ওয়েবস্টার?
বাবাঃ হ্যাঁরে সে-ই যে সিমলায়—
মেজদি একটু গম্ভীরভাবে হেসে বলবে, তুমি বোধ হয় মিঃ ওয়াইলডেভের কথা বলছ?
বাবা যেন দুই দিদিরই সমবয়সি এমনিভাবে ঘাড় দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ…
অমনি ওঁরা সবাই হেসে উঠবে। বড়দি বলবে, তুমি আজকাল সব ভুলে যাচ্ছ বাবা। বাবা সেটা স্বীকার না করে বলবেন, তোর মনে আছে, ওয়াইলডেভটা কী পরিমাণ পাগল ছিল।
মেজদি তেমনি গম্ভীর স্বরেই হেসে বলবে, নইলে আর মাকে চেয়েছিল নাচ শেখাতে?
তখন চকিতে এক বার বড়দির দিকে তাকিয়ে বাবা বলবেন, তোর মাকে না-পেরে শেষটায় উমনিকে নিয়ে পড়ল।
বড়দির মুখে একটু হালকা লাল রং-এর ছোঁয়া লাগবে। বলবে, ওয়াইলডেভ মানুষটি কিন্তু খুব খাঁটি ছিল। নেটিভ বলে কোনওদিন নাক সিঁটকোয়নি আমাদের।
বাবা হ্যাঁ তোকে বেশ নাচ শিখিয়ে তুলেছিল। তোর মা খালি আমাকে বলত, কী বিপদ! মেয়েকে তো নাচ শেখাচ্ছ, ওদিকে সাহেব যে তোমার মেয়েকে ছেড়ে থাকতেই চায় না।
আর এক বার বড়দির মুখটি একটু লাল হবে। মেজদি ওয়াইলডেভের সেই গানটি সুর না করে বলে উঠবে, আই লকড মাই হার্ট অ্যান্ড থু ভার দি কী….
ওই ছোট্ট গানের কলিটি বলার মধ্য দিয়ে কী যে ঘটে যাবে! সুমিতা কিছু বোঝবার আগেই ওঁরা তিনটিতে খুন হয়ে যাবে হেসে। মেজদি আবার বলবে, বেচারি ওয়াইলডেভ!
হাসিটি উচ্চকিত হয়ে উঠবে আবার দ্বিগুণ স্বরে।
তারপর যেন খানিকটা করুণা করেই সুমিতার দিকে তাকিয়ে বাবা বলবেন, রুমনো তখন হাঁটি হাঁটি পা পা। সাহেব দেখেছে তো দশ বার আছাড় খেয়ে, চেঁচিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরত ওর মাকে।
কিন্তু ওই তিনজনের মাঝে তাতে একাত্ম হতে পারে না সুমিতা। সেই বাবা আর বড়দি বসে আছে মুখোমুখি। কিন্তু কথা নেই কারুর মুখে। এত বড় ব্যথার নির্বাক মুহূর্ত বোধ হয় কোনওদিন আসেনি ওঁদের জীবনে।
.
কিন্তু কেউ কথা না বলুক, বাবা না বলে পারবেন না। সুমিতা যে বাবাকে দূর থেকে দেখেছে, তা-ই ও মহীতোষকে চিনেছে আরেক রকমভাবে। ওঁর এই অবসরপ্রাপ্ত জীবনে কলকাতায় বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। তাঁর সবচেয়ে বড় সঙ্গী বড়দি আর মেজদি। আর বাবার কী গভীর ভালবাসা! সে ভালবাসার মধ্যে বাবার যত আনন্দ, ঠিক ততখানি যেন বেদনা আছে মিশে। বড় বেশি ঘনিষ্ঠতার মধ্যে সেটুকু দিদিরা কতখানি অনুভব করেছে, ও জানে না। কিন্তু বাবাকে বড় কাঙাল মনে হয়েছে ওর। দিদিদের এই দ্বিপ্রহরের রৌদ্রালোকে বাবা ওঁর সায়াহ্নের ছায়াটিকে আলো মাখামাখি করে রাখতে চেয়েছেন। চেয়েছেন, কিন্তু সব সময়ে পারেননি। বড়দির বিয়ের পর সেই সায়াহ্নের ছায়ায় সন্ধ্যার গাঢ়তা দেখা দিয়েছিল। যখন বড়দি গিরীনদাদের বাড়ি চলে যেত। মেজদি চলে যেত কলেজে কিংবা ওদের ছাত্র আন্দোলনের কাজে, তখন বাবার সঙ্গে মুখোমুখি হত সুমিতা। এ সেই বড়দি মেজদির বাবা নন, রুমনির বাবা। সকালবেলার দেখা সন্ধ্যার সঙ্গে। দুজনের মাঝে কেমন একটি স্বল্প কথার প্রসন্নতা বিরাজ করে তখন। একজনের কাছে পড়ে আছে অনাগত সারা বেলার সুখ-দুঃখের বিচিত্র জীবন। আরেকজনের সামনে আগতপ্রায় রাত্রির নিস্তব্ধতা। এক জন ফিরে তাকান শুধু পিছনের দিকে, সামনের দিকে আরেকজন। কেবল পার্থক্য ঘটে গেছে একটি বিষয়ে। সুমিতা বাবার এই রূপের সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছে নিজেকে। সবদিক দিয়ে সেজন্যে সে একটু চাপা হয়ে গেছে বেশি। আর ঠিক সেই কারণেই তার অনুভূতির তীব্রতাও বেশি।
কিন্তু সেদিনের সায়াহ্নের বেদনার মধ্যে মহীতোষের এই জীবনের একটি স্বাভাবিক আনন্দ ছিল। সেটুকুর চিহ্নও আজ নেই।
সুজাতার দিকে তেমনি করেই দেখছেন মহীতোষ। ওঁর ব্যথা-আড়ষ্ট মুখে একটি অস্পষ্ট অপরাধের ছায়া পড়েছে যেন। খানিকক্ষণ পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, উমনো ঘুমোসনি মনে হচ্ছে সারা রাত।
মহীতোষের গলায় কেমন একটু শঙ্কার আভাসও রয়েছে। সুজাতা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, ঘুমিয়েছি তো!
বাইরের জীবনের রীতিনীতি যা-ই থাক, বাপে-মেয়েতে কোনওদিন এ বাড়িতে মন নিয়ে লুকোছাপা হয়নি। রাত্রি জাগরণ চিহ্নিত যে মুখ সুজাতা বিশ্বের কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারবে না, সেই মুখ নিয়ে আজ সবচেয়ে কাছের মানুষকে ও সত্যি কথা বলতে পারছে না। সে-ই তো সবচেয়ে বড় শঙ্কা মহীতোষের। বললেন, দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না।
বলে এক নিমেষ জবাবের অপেক্ষা করে আবার বললেন, উমনো, তুই যদি বলিস, তবে আমি নিজেই একবার গিরীনের কাছে না হয় যেতুম।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল সুজাতা। সোজা হয়ে বসতে গিয়ে আঁচল লুটিয়ে পড়ল টেবিলের উপর। বুকের উপর চিকচিক করে উঠল সোনার হারটি। সারা মুখে রক্ত ছুটে এল। বলল, কেন?
পেছনের খোলা দরজার পাশে, বাগানের বারান্দায় ঠিক বড়দির মতোই চমকে উঠল সুমিতাও। এ যে ওর কাছে আশাতীত। এ যেন সেই সায়াহ্নের বাবার কথা। বিষণ্ণ করুণ অসহায়।
মহীতোষ বললেন, হয়তো বড় দেরি করে ফেলেছি, তবু মনে হচ্ছে, আমি আমার কর্তব্য বোধ হয় ঠিক করে উঠতে পারিনি।
এবার আর তেমন করে চমকে উঠল না সুজাতা। বলল, কেন তোমার মনে হচ্ছে এ কথা?
কেন তা জানিনে। কেবলি ভাবছি, তোর মা থাকলে কী করত। আমি তো তার কিছুই বুঝিনে। আমি শুধু তোর অপমান অভিমানের মুখ চেয়েই এত দিন চলেছি। তোর জীবনের আর একটি দিক তো আমি ভেবে দেখিনি উমনো।
সুজাতা বিস্মিত অনুসন্ধিৎসু চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, জীবনের সেই দিকটা কি অপমান মেনে অভিমান পুষে বজায় রাখতে হবে বাবা?
সহসা কোনও কথা জোগাল না মহীতোষের মুখে। মেয়ের মুখ থেকে ওঁর নিজেরই সংশয়াম্বিত প্রশ্নটি যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। উনি নিজে ছিলেন এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের দরিদ্র কেরানির ছেলে। ওই জীবনটি পার হয়েছিলেন এক অভাবিত অধ্যবসায়ের ভিতর দিয়ে। সে অধ্যায়ের হৃদয়ের গোপন রক্তক্ষয়ের কথা ওঁর সন্তানেরা কেউ জানে না। এখনও উত্তর কলকাতায় ওঁর বিধবা বড় বউদি আছেন, আরও আছেন কিছু জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। সেখানে ছেলেবউ, মেয়ে-জামাই, সব মিলিয়ে এক জীর্ণ দেয়াল-ঘেরা নিশ্ৰুপ আশাহীন জীবনের ছায়ার সমারোহ দেখেছেন। মহীতোষ যে দিগন্তে পাড়ি দিয়েছেন, সেখানকার সঙ্গে উত্তর কলকাতার বাড়ির কোনও মিলই নেই। সেই দিগন্তের পরিণতি ওঁর এই জীবন, এই রুচিবোধ, এই স্বাধীন সত্তা। একদিন যখন উনি ভেবেছিলেন, সুজাতা রবিকে বিয়ে করতে চায়, তখন সেখানে হস্তক্ষেপের কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি কিন্তু নিজের মনের কাছে তো নেই কোনও ফাঁকি। রবি উচ্চ সমাজের ছেলে, কিন্তু প্রাইভেট কলেজের গরিব অধ্যাপক। তা ছাড়া রাজনীতিও করে। তারপর সুজাতা যখন বেছে নিল বড়লোক গিরীনকে, তখন মনে মনে তারিফ করেছিলেন। এই তারিফের মধ্যে কতখানি সমাজ-মন, কতখানি স্নেহের মন ছিল ভেবে দেখেননি। কিন্তু এ জীবনে অপমানের সঙ্গে আপস না করার যে রীতি, তাকেও অস্বীকার করতে পারেননি।
সুজাতার কথায় কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু উমনো, অপমান চিরকাল থাকে না। সুজাতা বলল, চিরকাল থাকবে কি না সে ভরসা তো আমি পাইনি বাবা।
মহীতোষ জানেন, সে ভরসা দেওয়ার মালিক একমাত্র গিরীন। বললেন, উমনো, জীবনে ক্ষমা জিনিসটি কিন্তু ছোট নয়।
কয়েক নিমেষ সুজাতার রক্তাভ ঠোঁট দুটি চেপে শক্ত হয়ে রইল। বাবার দিকে চকিতে এক বার তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। ওর ক্লিন্ন চোখের পরিখার ওপরে বিষাদ কিন্তু কেমন একটি শ্লেষের ঝিলিক হানছে। বলল, ক্ষমা তো আমার কাছে কেউ চায়নি।
সে কথা এত সহজে বলা যায় না উমনো। এখানে ক্ষমা কেউ ঘটা করে, দশজনের সামনে চাইতে পারে না, কিংবা এক কথায় ছুটে এসে হাত ধরে ক্ষমা চাওয়া যায় না, করাও যায় না। সেটা ভাঁড়ামি হয়ে যায়। তাদের দুজনের ঘর করার মধ্য দিয়ে ক্ষমা চাওয়া, ক্ষমা করা কখন হয়ে যেত, তা হয়তো তোরাও জানতে পারতিসনে।
সুজাতার মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। ভ্রু কুঁচকে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, সেই ঘটনার পরেও এক বছর তো আমি সেখানেই ছিলুম। কই, তখন তো তেমন কিছু ঘটেনি। তারপরেও কেটেছে অনেক দিন। তখনকার চিঠিপত্রগুলির কথা তো ভুলে যাওনি! তোমার এ কথার আভাসও তাতে এক বিন্দু পাইনি আমি!
তখন তোমাদের দুজনেরই মন বিদ্বেষে ভরা।
আজ-ই বা মিতালি কোথায় দেখলে?
মহীতোষ দেখলেন, সুজাতার নাসারন্ধ্র উঠছে ফুলে ফুলে। কঠিন রেখায় বেঁকে উঠেছে ঠোঁট। চোখদুটি দপ দপ করছে। আবার বলল সুজাতা, বাবা, সবটাই শেষ পর্যন্ত ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও অন্যায় তো আমি করিনি। তবে আমি কেন যেচে মান, কেঁদে সোহাগ করতে যাব?
মহীতোষের এক চোখ করুণ, আরেক চোখে দ্যুতি। মেয়ের এই দৃপ্ত তেজস্বিনী মূর্তি ওঁর স্নেহান্ধ হৃদয়কে গর্বিত করে তোলে। সবকিছুর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে ওঁর স্নেহ ও ভালবাসা। এত কথা বলছেন, ওরই দুঃখের ভয়ে, সুখের আশায়। তাঁর রক্তমাংসের আত্মজন এই মেয়েদের সুখ সান্নিধ্যের আশাতেই নিজের জীবনের এই শেষ প্রহরের হেঁকে ডেকে ছুটে বাঁচবার বাসনাটুকু নিহিত রয়েছে। সুজাতার চোখে মুখে বিতৃষ্ণার বহ্নিচ্ছটা দেখে উনি সহসা আর আগের কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারলেন না।
এমন সময় সুগতা এল সময়ের তাড়া দিতে। এসে কিছু বলতে পারল না। মহীতোষ তখন স্নেহ-শঙ্কিত গলায় বলছেন, কিন্তু তুই কাল সারা রাত ঘুমোসনি উমনি। তোকে দেখে যে আমি শান্তি পাচ্ছিনে।
সুজাতা ওর বাবার দিকে ফিরে তাকাল না। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল, ঘরে বাইরে এ অপমান তো একটুখানি নয়। তাকে আমি সহ্য করে উঠতে পারছিনে।
কথাটি শুনে মহীতোষের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। সহ্য করতে না পারার কষ্ট যদি এমনি করে ফুটে ওঠে সুজাতার মধ্যে তা হলে আগামী দিনের অবস্থা কী হবে।
কিন্তু সুজাতার কষ্টের মধ্যে বিক্ষোভের সুরটুকু ওর কানে ঢোকেনি। কথার মধ্যেকার জ্বলুনিটুকু পারেননি ধরতে! আজকে যাকে ওর জীবনের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ধরে নিয়েছে, তার মধ্যে যেন নিজের মনের তীব্র ধিক্কারকে প্রতিফলিত হতে দেখেনি!
সুজাতা আবার বলল, তা ছাড়া আমি এখনও নিশ্চিন্ত হতে পারছিনে, জজ শেষ পর্যন্ত কী রায় দেবেন। যদি আমার বিপক্ষে যায়–
মহীতোষ দ্রুত ঘাড় নেড়ে উঠলেন। বললেন, অনিলবাবু আমাকে সে ভরসা খুব জোরের সঙ্গেই দিয়েছেন। রায় যে তোর পক্ষে আসবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। জজ মিঃ ব্যানার্জির মর্যালিটির বিষয়ে সবাই সশ্রদ্ধ।
অনিলবাবু সুজাতার পক্ষের উকিল।
সুজাতা বলল, কিন্তু ধর, যদি অন্য রকমই ঘটে।
তার জন্যে অন্যরকম ব্যবস্থাও আছে।
ঠিক এই মুহূর্তেই টেবিলে লুটোনো আঁচলটি ঘাড়ের উপর ফেলে সুজাতা দ্রুত রুদ্ধ গলায় বলে উঠল, কিন্তু তুমি রবিকে কেন পাঠিয়েছ ওর কাছে?
চকিতে পাংশু হয়ে উঠল মহীতোষের মুখ। তারপর ফ্যাকাশে করুণ অসহায় হয়ে উঠল ওঁর বিশাল মুখটি। কী বলবার জন্যে মুখ তুলতেই সুজাতা আবার বলে উঠল, কেন তুমি এমন করে আমাকে হীন করে দিলে? বলতে বলতে ওর বড় বড় কালো চোখের কোণে জল জমে উঠল। অরুদ্ধ গলায় ফিসফিস করে বলতে লাগল না থেমে, হয়তো রবি ভেবেছে, আমি বলেছি, তাই তুমি ওকে যেতে বলেছ।
মহীতোষ অসহায়ভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে বললেন, না উমনো, রবি সে কথা ভাববে না।
রবি না ভাবুক যার কাছে পাঠিয়েছ সে তা-ই ভাববে। হাসবে মনে মনে, বিদ্রূপ করবে। ভাববে আমিই কেঁদে কাঙাল হয়ে পাঠিয়েছি, আমিই ভেঙে পড়তে চেয়েছি তার অন্যায় অহংকারের কাছে।
মহীতোষকে যেন কেউ গলা টিপে ধরেছে। ওঁর গলায় মুখে পেশি ও শিরা স্ফীত আকুঞ্চিত হচ্ছে। চোয়াল কাঁপছে, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
স্বল্পবাক গম্ভীর সুগতা কারুর পক্ষেই কোনও কথা বলতে পারছে না। স্নান করতে যাওয়ার আগে ওর বাঁধনখোলা বিনুনি এলো-চুল ছড়িয়ে পড়েছে ঘাড়ে পিঠে। ও সুজাতার অপমান অনুভব করছে তীব্রভাবে। আর বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুমিতা কাঁপছে থরো থরো। ওর মনের আকাশ জুড়ে মেঘের পরে মেঘ এল ধেয়ে। অলক্ষের এই লতাটি বিস্মিত কান্নায় উঠল চমকে চমকে। এ কী হল! যে বাতাসটুকু আঁচ করেছিল ও কিছুক্ষণ আগে, সে শুধু নতুন মেঘের আমন্ত্রণের জন্যে! যে আশাটুকু ছিল তা তো হলই না, এ বাড়ির এই ছায়ার কোলে কোলে দেখল নিঃশব্দে পা বাড়িয়েছে আর এক ছায়া। বিভীষিকার মতো দেখল, ওদের ত্রিপদী ছন্দ অবিন্যস্ত হয়েছে।
বুকের শঙ্কা ও ভার নিয়ে পালাবার জন্যে পা তুলল ও। আবার শুনতে পেল বড়দি বলছে, তুমি হয়তো তোমার কর্তব্য ভেবে পাঠিয়েছ। কিন্তু তা কর্তব্য হবে না। তুমি আমাকে বড় করেছ, মানুষ করেছ, সেইটুকু তো তোমার কর্তব্য করেছ। তুমি তো আমাকে কারুর গলগ্রহ তৈরি করনি। তবে তোমার ভাবনা কী?
বাবা যেন চাপা গলায় প্রায় কেঁদে উঠলেন, কী বলছিস তুই উমনো। আমি তোকে কার গলগ্রহ ভাবব।
যারই হোক, আমি কারুরই গলগ্রহ হব না বাবা।
উমনো, তুই আমার গলগ্রহ হবি ভেবে আমি রবিকে পাঠিয়েছি? তুই এ কথা বিশ্বাস করিস?
জবাবে শুধু অস্ফুট একটু কান্নার শব্দ শোনা গেল। বড়দির গলার শব্দ। আবার কান্নাভাঙা গলা শোনা গেল, না, তা ভাবিনি।
তারপর গাঢ় স্তব্ধতা। সুমিতার মনে হল, এখুনি ওর রুমনি জীবনের সমস্ত বেড়াটি ভেঙে ওঁদের কাছে গিয়ে পড়ে ঝাঁপ দিয়ে।
মেজদি বলল, তোমরা ওঠো, বিলাস আসছে।
সুমিতা দ্রুত কম্পিত পায়ে নেমে গেল বাগানের মধ্যে। ঘুরে, বাইরের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে দাঁড়াল থমকে। দেখল, লোহার গেট খোলা হয়েছে নিঃশব্দে। রবিদা দাঁড়িয়ে আছেন ওর দিকে চেয়েই। নিমেষে কী ঘটে গেল ওর বুকে। দারুণ ভয়ের মাঝে নির্ভয়ের দেখা পেয়ে, দুই বেণী দুলিয়ে ও ছুটে গেল রবিদার দিকে।
রবিদাও পা দিয়েছিলেন বাগানের দিকেই। মাঝপথে ও দুহাতে জাপটে জড়িয়ে ধরল রবিদাকে।
উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ দোহারা পুরুষ রবি। গায়ে ঢিলে-হাতা খদ্দরের পাঞ্জাবি। বুদ্ধিদীপ্ত কমনীয়তা সারা মুখে। কিন্তু বড় শান্ত, সময়ে সময়ে কেমন যেন সুন্দর হাসির মাঝে একটু বিষণ্ণতার ছোঁয়াচ থাকে লেগে।
রবির কাছে ওর মনের কোনও সংকোচ নেই। লজ্জা নেই কোনও এই সবে বাড়ন্ত দেহের। দুহাত দিয়ে রবিদাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল উৎকণ্ঠাভরে, কী বলেছেন গিরীনদা?
রবি চমকে উঠল যেন একটু। তারপর মুখখানি ভরে উঠল নিরাশায়। সুমিতার মাথায় হাত রেখে বলল, ভাল কিছু বলেননি রুমনি।
সুমিতার চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। বলল, তবে কী হবে রবিদা?
রবির বিস্ময়ের চমক কাটল না। এমন করে কোনওদিন সুমিতাকে কথা বলতে শোনেনি। না শুনুক, কিন্তু এমন করে অলক্ষের বেদনা চেপে রাখা যায় না আর। একমাত্র রবিদা ছাড়া তার আর কেউ যে নেই।
রবি বললে, সে তো এখন কিছু বলা যাবে না। দেখি কী হয়।
ও বলল, রবিদা আমার একটু গিরীনদাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
রবি এক মুহূর্ত ভেবে বলল, বেশ তো যেয়ো!
তারপর ও রবির পিছন পিছন ঘরে গিয়ে ঢুকল। নিজে ছুটে গিয়ে খবর দিল, রবিদা এসেছেন।
মেজদি বললেন, ডেকে নিয়ে এসো।
রবি এসে দেখল, বড়দি মেজদি বাবা তিনজনেই দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ।
বাবা বললেন, কী খবর রবি?
রবি কী ভেবে বললে, গিরীনের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কাকাবাবু।
সকলেই মুখ চাওয়াচায়ি করল, বড়দি ছাড়া। সকলের আগে বেরিয়ে গেল বড়দিই। তৈরি হওয়ার পালা এবার সবারই।
সকলের পরে স্নান সেরে সুমিতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মেজদি প্রথমে বলল, রুমনি, তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমাদের সঙ্গে যাবে।
মেজদির মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল ও। কাপড় পরতে পালাল বড়দির ঘরের দিকে।
.
০৪.
বিলাস ট্যাকসি নিয়ে এল ডেকে। সবাই তৈরি হয়েছে বেরুবার জন্যে। বিলাসের রান্না করাই সার হয়েছে। খাবার টেবিলে কোনওরকমে সবাই বসেছিল এক বার। কিন্তু খাওয়া কারুরই ঠিক হয়নি। যার কোনওদিকে না তাকিয়ে খাবার কথা ছিল মন দিয়ে, সেই সুমিতাও পারেনি খেতে।
ওর মন জুড়ে যে এত উৎকণ্ঠা, এত অস্বস্তি ছিল, রবিদাকে পেয়ে কয়েক মুহূর্তের কান্নার আবেগে সেই বন্ধ হৃদয়ের দরজাটি গেল খুলে। যা উপচে পড়েছে, তাকে লুকিয়ে রাখার কোনও প্রশ্ন নেই। লুকিয়ে রাখতেও পারেনি।
কিন্তু ওর স্নান করতে যাওয়ার ফাঁকে যেন কী একটা ঘটে গেছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মেজদির চাউনি ও কথা শুনেই বিস্মিত লজ্জায় হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে পালাতে হয়েছিল। কিন্তু পালাবার উপায় ছিল না। সকলেই ওর দিকে ফিরে ফিরে দেখেছে কয়েকবার। বড়দি, মেজদি, বাবাও। কী যে ছিল সেই দেখার মধ্যে। তখন মনে হচ্ছিল, রবিদার পিঠে গু করে একটি কিল মেরে, ওঁরই বুকে মুখ লুকিয়ে বলে, কী বলেছেন আপনি ওদের। যেন সেই অলক্ষিত লতাটির সন্ধান পেয়ে গেছে ওরা, তাতে সবাই খুশি হয়েছে কি না বোঝা গেল না। অবাক যে হয়েছে, সেটুকু চাপা থাকেনি।
সুমিতা যেটুকু জানে না, সেটুকু হল, ওর অনুপস্থিতিতে রবি বলেছিস সুগতাকে, তোমরা সবাই চলে গেলে, সুমিতা একলা এ বাড়িতে থাকতে পারবে না।
রবিদার কথার মধ্যে কী ছিল, সহসা আর প্রতিবাদ করতে পারেনি কেউ। মহীতোষ বলে উঠেছিলেন, ঠিকই বলেছ রবি, ঝুমনো তো মাঝপথে নেমে যাবে। ওদের কী জরুরি সভা আছে উনিভার্সিটিতে। রুমনোটা ওর বড়দির সঙ্গে থাকতে পারবে।
ট্যাকসিতে ওঠার সময়ে রবিদা দাঁড়িয়ে রইলেন। সুমিতা ততক্ষণে বড়দি মেজদির মাঝখানে গিয়ে বসেছে জড়সড় হয়ে। মহীতোষ উঠতে গিয়েও দাঁড়ালেন থমকে। বললেন, কই রবি, তুমি সামনের দিকে ওঠো।
সুমিতা লক্ষ করে দেখেছে, রবিদা অনেকক্ষণ থেকেই কেমন বিমর্ষ হয়ে উঠেছেন। বাবার কথা শুনে চকিতে এক বার দেখে নিলেন বড়দিকে। কুণ্ঠিত হেসে বললেন, আমার যাওয়ার কি দরকার আছে কাকাবাবু? রবিদার কথা শুনে বাবাও এক বার বড়দির মুখের দিকে দেখলেন। বললেন, তোমার নিজের দিক থেকে যদি কোনও বাধা থাকে, তা হলে কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি ভেবেছিলুম, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।
কিন্তু এই কথার মাঝখানে বড়দি একটি কথাও বললে না। ও তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, স্থির চোখে। বাবার সঙ্গে কথা বলার পর, সে-ই যে নীরব হয়েছে, তারপর থেকে মুখ খোলেনি এক বারও। অন্যান্যদিন রবিদার সঙ্গে এতক্ষণে কত কথা হয়ে যায়। কত কথা যে ওরা বলে। চিরদিন ভেবে ভেবে অবাক হয়েছে সুমিতা, ওদের দুজনকে কথা বলতে দেখে। যেন দুজনের কথা বলা কোনওদিন শেষ হবে না।
কিন্তু, এ পরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো আজও রবিদা খাবার ঘরেই বসেছিলেন সকলের সঙ্গে। বাবা আর মেজদির সঙ্গে কয়েকটি কথা হয়েছে। সেই কথার ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে লুকিয়ে অনেক বার রবিদা বড়দির দিকে তাকিয়েছেন। সুমিতার মনে হয়েছে, বড়দির আনত চোখও যেন লক্ষ করছিল সেটুকু। এমনকী, রবিদার ভাব-ভঙ্গি দেখে দু-একবার ওকে তাকাতেও হয়েছে। তবু বড়দির গলা থেকে একটি কথাও বেরোয়নি। যেন সে নিজেকে ক্রমেই শক্ত করেছে।
মেজদি বলে উঠল, তুমি চলো রবিদা। বলছিলে, সাড়ে বারোটায় তোমার ক্লাস আছে। ওখান থেকে চলে যেয়ো কলেজে।
মেজদির দিকে তাকাতে গিয়ে আর এক বার চোখ পড়ল সুজাতার দিকে। তার দিকে তখন সকলেরই চোখ পড়ছে গিয়ে। বোঝা গেল, বড়দিরও অস্বস্তি হচ্ছে। স্থির চোখের পাতা নড়েচড়ে উঠল কয়েক বার। বাঁ হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটি ডান হাতে নিয়ে, রবিদার দিকে তাকিয়ে কোনও রকমে বলল খুব নিচু গলায়, চলো না।
লোহার গেট ধরে দাঁড়িয়েছিল বিলাস। আরও দূরে লক্ষ করলে দেখা যেত, বাইরের ঘরের জানালার পরদার আড়ালে ঝি অচলার মুখখানি। বিকৃত মুখে তার একটি অশ্রদ্ধার ভাব। বিলাসের কাছে শুনেছে যে, বড় মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির জন্যে কোর্ট কাছারি করছে। ভাবছিল, হবে না। এত বাইরের ছেলে-ছোকরার ভিড় যে বাড়িতে, সে বাড়ির মেয়েরা ছাড়াছাড়ি না করবে কেন?
ওপাশে, ডেপুটি বাড়ির দোতালায় বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল প্রৌঢ়া গিন্নি আর ছোট মেয়ে। মেয়েটি সুমিতারই সহপাঠিনী। বয়সে দু-এক বছরের বড়। নাম তাপসী। তাকিয়ে যেন মজা দেখছে।
রবিদা উঠে গিয়ে বসলেন ড্রাইভারের পাশে। সুমিতা জানত, বড়দির ওই বলাটুকুর জন্যই দাঁড়িয়েছিলেন রবিদা। ওদের দুজনের মধ্যে ওটা ভদ্রতা কিংবা সামাজিকতার ব্যাপার নয়, সম্পর্কের সংকোচ ও আড়ষ্টতা। বাইরে মস্ত বড় মানুষ রবিদা। অধ্যাপনা আর রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক সম্মান ওঁর। যখন বড়দির সামনে এসে দাঁড়ান, তখন আর বাইরের সেই মানুষটিকে চেনা যায় না। মনে হয়, বড়দির একটি অঙ্গুলি সংকেতের জন্য সর্বক্ষণ অপেক্ষা করে আছেন উনি। এর মধ্যে সুখ ও আনন্দ আছে কতখানি তা জানে না সুমিতা। কিন্তু, দুজনের মাঝখানে, কোথায় কোন অদৃশ্য একটি ব্যথার ছোট কাঁটা যেন আছে লুকিয়ে। তাকে চোখে দেখা যায় না। তাকে অনুভব করা যায় না বড়দির দিকে তাকিয়ে। রবিদার সান্নিধ্যে এলে খচখচানিটুকু টের পাওয়া যায়।
গাড়ি এসে পড়েছে ট্রাম রাস্তার উপরে। রোদে স্নান করে উঠেছে সারা শহরটি। ট্রামের ঘর্ঘর, বাসের চিৎকার, প্রাইভেট গাড়ির হর্ন, রিকশার ঠুনঠুন, মানুষের কলরবে কেমন এক সচকিত উল্লাসে উদ্দাম হয়ে উঠেছে রাস্তাঘাট। যুদ্ধের পর দাঙ্গার অবরোেধ সবে কাটিয়ে উঠেছে শহর। তার ছাপ লেগে আছে। এখনও এখানে সেখানে। দেয়ালে দেয়ালে, দাঙ্গা আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পোস্টারে গেছে ছেয়ে। কোনওটিতে গান্ধীজির শান্তির বাণী, কোনওটিতে সাম্প্রদায়িক রণহুংকার ক্রিস মিশনের বিরুদ্ধে জেহাদ কোনওটিতে। এ-আর-পি ওয়ার্ডেন পোস্টগুলির সামনে সেই নীল কুর্তা মানুষগুলির জটলা নেই আর। শুধু সরিয়ে নেওয়ার অবসর পাওয়া যায়নি এখনও সাইনবোর্ডগুলি। এখানে সেখানে এখনও জরুরি শেলটারের প্রাচীরগুলি রয়েছে দাঁড়িয়ে।
গাড়িতে সবাই চুপচাপ। সবাই বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আড়চোখে দেখল এক বার বড়দিকে। বড়দি স্নান করেনি। আঁচড়ে নিয়েছে সামনের চুলগুলি। সাবান ধোয়া মুখে একটু হিমানীর প্রলেপ মাত্র। সাদা রং-এর কাশ্মীরি সার্জের ব্লাউজের সঙ্গে পরে এসেছে আঁশপাড় সাদা তাঁতের শাড়ি।
বিয়ের এক বছর আগে এমনি সাদা জামাকাপড় খুব এত বড়দি। সে সব খদ্দরের জামাকাপড়। তখন সুমিতা সবদিক থেকেই অনেক ছোট। ওর স্কুলের বইয়ের আশেপাশে আর যে সমস্ত ভগবতী আর দেশনেত্রীদের বহু বিচিত্র চমকপ্রদ কাহিনীগুলি থাকত, সেইসব নায়িকাদের সঙ্গে হুবহু মিশিয়ে ফেলত বড়দিকে। বড়দি মেজদি আর রবিদার মুখে নানান কথা শুনে শুনে, ওর বুকের মধ্যে এক অস্পষ্ট আগুনের আঁচ লেগেছিল। কেমন একটি অস্পষ্ট ঘৃণা ও বিদ্বেষে ফুলত মনে মনে। কে যে শত্রু, কার বিরুদ্ধে এত রাগ, তা-ই ভাল করে জানত না সুমিতা। এই উত্তাপের পিছনে বড়দির সেই মূর্তিখানি আসল। বড়দি তখন ধ্যানের নায়িকা।
তখন রবিদার সঙ্গে রোজ বাইরে যেত বড়দি। রবিদার সঙ্গেই সারাক্ষণ। সেই স্রোতে মেজদিও ভেসে গিয়েছিল। কত ছেলে আসত বাড়িতে। সকলের মধ্যে বড়দিকে দেখাত রানির মতন। সেদিনের রবিদা আর বড়দি, আর আজকের এই দুই বন্ধুতে কত তফাত।
সবচেয়ে চরম হয়েছিল, বড়দির জেলে যাওয়া। সারা কলকাতাটাই যেন বড়দির জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে পুলিশ তছনছ করছে। মেজদি গেছে পালিয়ে। কী ভাগ্যি, বাবা তখন অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। জেল হয়েছিল রবিদারও।
পনেরো দিন পরেই জেল থেকে বেরিয়ে এল বড়দি। ছ মাস পরে রবিদা। গিরীনদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বড়দির, জেলে যাওয়ার আগেই। রবিদা এসে দেখলেন, গিরীনদা এ বাড়ির প্রত্যহ আসরের একজন। রবিদা আসার পরেই তো পাকাপাকি হল বিয়ের কথা।
তখনও সুমিতা রবিদার হাসির দিগন্তে বিষণ্ণতার অস্তাভা দেখেছে। যেটুকু ও আজও জানে না, সেটুকু সেদিনও জানত না যে, রবিদার দীপ্ত চোখের কোণ থেকে কোন শিখাঁটি নিভে গেছে একেবারে। সে শিখাঁটি নিভে গেলে বাইরেটাকে তো অন্ধকার করে না। যেখানটাতে ঘনীভূত হয় অন্ধকার, সে জায়গাটি থাকে সকলের অগোচরে। যেখানে বেদনা যত, তত জমে নিজের ধিক্কার। রবিদার মতো মানুষেরা সেইখানটি ঢেকে রেখে হেসে বেড়ান দশজনের সামনে।
সুমিতা জানত না, বিয়ের আগে যেদিন বড়দি রবিদাকে বলেছিল, রবি, আমি তোমার ওপর অন্যায় করছি না তো?
তীব্রবেগে রক্ত প্রবাহ ছুটে এসেছিল রবির মুখে। কী তীব্র হাসি ফুটেছিল তার ঠোঁটে। যেন আগুন জ্বলছিল দপ দপ করে। বলেছিল, আমার ওপর? না, না, তেমন দুরাশা তো আমি কোনওদিন করিনি উমনো। তা হলে তো স্পষ্ট করে তোমাকে বলতে পারতুম কোনওদিন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই ওরা দুজনেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল দুজনের কাছ থেকে। সেই দুরাশা থাকলে স্পষ্ট করে বলতে পারত রবি? এত বড় মিথ্যে কথাটা কেউ বোধ হয় চোখে চোখে তাকিয়ে বলতে পারেনি, শুনতেও পারেনি।
এর বেশি বলতে পারেনি কেউ কিছু। রবি বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেছিল, রাত্রের নির্জন রাস্তায়, একটি বাড়ির ছায়ায় যেন ঘাপটি মেরে পড়ে আছে গিরীনের মস্ত বড় গাড়িটি।
বড় রাস্তায় এসে আর এক বার হেসেছিল রবিদা। ভুল, সবটাই একেবারে ভুল। চোখে আগুন, ঠোঁটে আগুন যে রুদ্রাণীর হাতের পতাকা নিয়ে সবার আগে রবিদা মৃত্যু-উল্লাসে যাবেন ছুটে, সেই রুদ্রাণী ধরেছে রানির বেশ। সত্যি, একটুও বিদ্বেষ হয়নি রবির। ভেবেছিল, এ ছাড়া কী উপায় আছে সুজাতার। ও যেভাবে মানুষ হয়েছে, যে মন নিয়ে বেড়েছে, ঠিক সেই পথই নিয়েছে বেছে। ওইদিকেই সুজাতার সীমান্ত। তার ওপারে রবির আগুনের শিখায় কাঁপা অস্পষ্ট দিগন্তে কী আছে, কে জানে। বুকের মধ্যে কেঁপে উঠেছিল রবির। কী এক সর্বনাশের হাত থেকেই না সুজাতা বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে, বেঁচেছে নিজে। হয়তো, পরে না পেত ওর রুদ্রাণীকে, না পারত রানির মতো সমাদর করতে। তখন ধুলো মাখামাখি করে দাঁড়াতে হত দুজনকে দশজনের সামনে। কী অপমান!
আজ তো সুজাতা ধুলো মেখে দাঁড়ায়নি। দাঁড়িয়েছে রানির মতোই। রবিকে সে ধরেওনি, ছাড়েওনি। নিজের মনকে চোখ টিপে ছলনার মধ্য দিয়ে ও স্বীকার করেনি গিরীনকে। ও যেন চিরকাল ধরেই প্রতীক্ষা করছিল গিরীনের। যেদিন এসে গিরীন চাইল, দু হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
রানি বলেই, রানির মতো বেরিয়ে এসেছে আজ।
এলোমেলো হয়ে উঠেছিল সুমিতার অস্পষ্ট মন। কোন বেশটি যে বড়দির সত্যি, সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। ওই জেলে যাওয়ার বেশ, না গিরীনদার সামনের বেশ। যদিও কোনওটাই ওকে ক্ষুণ্ণ করেনি। মনে হয়েছিল বড়দি যেন একটি স্বাধীন সুন্দর পুতুল। কখনও এই বেশে, কখনও ওই বেশে বেড়ায় সেজে।
কিন্তু কোথা থেকে কী ঘটে গেল। সুমিতার মনে পড়ল সেই বিশ্রী সংবাদটির কথা। গিরীনদার চেহারার সঙ্গে কোনওদিন ঘটনাটির মিল খুঁজে পায়নি। স্পষ্ট মনে পড়ছে, বড়দিকে লেখা, সুমিতার লুকিয়ে দেখা গিরীনদার সেই পত্রটি।–তোমাকে প্রতারণা আমি কোনওদিন করতে চাইনি। যার বিষয় নিয়ে তুমি এতটা ক্ষিপ্ত হয়েছ, সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। তখন আর সামনাসামনি নয়, দূর থেকে ওরা পত্রে পত্রে আয়ুধ নিক্ষেপ করছে পরস্পরের প্রতি।
আর একটি গিরীনদার পত্র–তার সঙ্গে তো আমি কোনও সম্পর্কই রাখিনি। তোমার হিতৈষী সংবাদদাতারা আমার নামে মিথ্যে কথা বলছেন তোমাকে।
স্ত্রীর অধিকারে যে সব গালাগাল আমাকে দিয়েছ, আমার অতি বড় শত্রুও কোনওদিন তা দেয়নি। সেই জন্যই বলছি, ছোট মুখে বড় কথায় আমার বড় ঘৃণা।
পড়তে পড়তে মনে হত, সুমিতার বুকের তন্ত্রী ছিঁড়ে পড়বে। একে তো লুকিয়ে দেখার কাঁপুনি, তার ওপরে সেই ভয়ংকর কথাগুলি। এলোমেলোভাবে মনে পড়ছে সেই সব পত্রের কথা-হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কেরই শৈথিল্য ছিল না। সে কথা এখনও বলছি। তাতে তোমার যত ঘৃণা এবং রাগই হোক, এ সত্য স্বীকার না করে পারছিনে। কিন্তু সে সুন্দরী এবং বিদুষী কি না অনর্থক এ প্রশ্ন করে আমাকে খোঁচা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। হ্যাঁ, সে আমার রক্ষিতা ছিল। তুমি লিখেছ, আমার মতো নীচ সবই করতে পারে। তা ঠিক, সুতরাং তার রূপ ও বিদ্যার কথা থাক। তোমাকে যে পেয়েছিলুম, সেটা তো অস্বীকার করতে পারবে না। একটি কথা, পত্র লেখালেখি পরস্পরের প্রতি ঘৃণাটাই বাড়ালে। সুতরাং আর থাক। তবে আমার বিশ্বাস, তোমার অধিকারে আমি কোনওরকমেই হস্তক্ষেপ করিনি। তোমার ফিরে আসার পথ পরিষ্কার। আর তা না চাইলে সেটাকেও অপরিষ্কার করে রাখতে রাজি নই আমি।
আবার
তার কাছে আর যাব কি না যাব, কিংবা, আমি আমার পুরনো জীবন ত্যাগ করব কি না, তোমার ওই ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ প্রশ্নের মুখে আমি তার কোনও জবাবদিহি করতে পারব না। হ্যাঁ, যত দিন প্রয়োজন বুঝব, তত দিন তাকে আর্থিক সাহায্য না করে পারব না। তবে এত দিনে তোমার সঙ্গে আমার ব্যাপারটা পারিবারিক অপমানের শেষ সীমায় এসে পড়েছে। তুমি ফিরে না এলে আমাদের বংশে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করতে হবে আমাকে। আমি কোনও কিছুকেই আর ঝুলিয়ে রাখতে পারব না।
কত কথা সেই পত্রাবলীর। তারই পরিণতির সর্পিল পথ বেয়ে এখনও চলতে হচ্ছে।
হঠাৎ গাড়িটি দাঁড়াল। চমকে তাকাল সুমিতা। মেজদি নেমে যাচ্ছে। ব্যস্ত ছুটন্ত চৌরঙ্গি। ইংরেজি ছবিঘরের ভিড়। ভিড় চারদিকে সাদা, কালো মেয়ে পুরুষের। মাথার উপরে গম্বুজের কপালে ঘুরছে। সময়ের কাঁটা। কাঁচের গায়ে গায়ে ঝুলছে রকমারি জামা ও প্রসাধন সামগ্রী।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল মেজদি। বেশে ওর বৈরাগ্য, ভঙ্গিতে রাজেন্দ্রাণী। নেমে দাঁড়াতেই দেখা গেল, হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি ফেলে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে আসছে মৃণাল। মেজদির বন্ধু, একসঙ্গে পড়েছে। গত বছর পাশ করেছে মৃণাল। মেজদি পরীক্ষা দিতে পারেনি।
সে এসে আগে রবিদার দিকে চেয়ে হাসল একটু। তারপরে হঠাৎ মুখখানি করুণ করে তাকাল বড়দির দিকে। যেন শবযাত্রার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বড়দিও হাসল একটু। মেজদি বলল বড়দিকে, দিদি, আমি তা হলে যাচ্ছি।
বড়দিকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছিল। ঘাড় কাত করে বলল, আচ্ছা। মহীতোষ ফিরে তাকিয়ে বললেন, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস ঝুমনো।
মৃণালের পাশ ঘেঁষে ফিরতে গিয়ে মেজদি বলল, চেষ্টা করব বাবা।
বাবা ওদের দুজনকেই দেখছিলেন। মৃণাল আর মেজদিকে।
গাড়ি বেরিয়ে গেল। হঠাৎ সমস্তটাই যেন সুমিতার স্বপ্নের ঘোরে ঘটে গেল। বাবা, বড়দি, মেজদি, রবিদা, সবাইকেই ভালবেসেছিল সুমিতা। তার জন্যে ওর জীবনে নিরঙ্কুশ সুখ ছিল না। কীভাবে, কোনদিক দিয়ে কতগুলি বিচিত্র সুখ-দুঃখ গড়ে উঠেছিল ওর মনে। সেই মন, মানুষের এমন বৈচিত্র্য দেখে সভয়ে কেঁদে উঠেছে, কেঁপে উঠেছে। আজ মৃণালকে মেজদির পাশে দেখে, অন্যদিনের মতো খুশিতে ও উপচে উঠতে পারল না। এখনও বিত্ত ও অবস্থা দিয়ে সুখ-দুঃখ রচনা করার পথে পা বাড়াতে পারেনি সুমিতা। খালি ভয় আজ, মানুষ তার নিজের হাসি নিজেই দেয় ধুয়ে শেষ করে। মানুষের জীবনধারণের মধ্যে কোথায় কতগুলি মহাসর্বনাশ আছে লুকিয়ে। আর মানুষ তাকে কেমন করে যেন নিজেই ডেকে নিয়ে আসে। কী করে বলবে ও, মৃণালকে দেখলে মেজদির গম্ভীর পাতলা ধারালো ঠোঁটের কোণে একটি বিচিত্র হাসির রেখা দেখতে পায় কেন? একদিন পেয়েছিল গিরীনদার সামনে বড়দিরও। তারপর ওই পত্রগুলি। যার প্রতিটি লাইনের ফাঁকে ফাঁকে অদৃশ্য রয়ে গেছে আসল কথাগুলি। ফুটে উঠেছে শুধু ক্ষিপ্ত, অবুঝ, অপমানকর কতগুলি মিথ্যা কথার সারি।
রাস্তাঘাট, গাড়ির গতি, ভেতরে বাবা, বড়দি,রবিদা, সব মিলিয়ে ঘোর কাটল না ওর স্বপ্নের। কেবল একটি মর্মভেদী কান্না ঠেলে উঠতে লাগল বুক থেকে।
সুমিতার গল্প-সাহিত্য, হাসি-খেলা-গানের সহজ পথ দলে দুমড়ে ভাঙছে চোখের সামনে। সবটাই এত বড় মিথ্যে এই সংসারে?
এই ঘোরের মধ্য দিয়েই গাড়ি কোর্টে এল। কখন উঠে গেল বার লাইব্রেরিতে। উকিল অনিলবাবু বক বক করে গেলেন। কালো গাউন পরা শকুনের মতো উড়ে উড়ে যেন চলেছে কতগুলি মানুষ। আশেপাশে ডাইনে বাঁয়ে, সর্বত্র তাদের ছায়া। জোড়া জোড়া চোখ এসে গিলছে বড়দিকে, সুমিতাকে, সবাইকে। আলমারিতে, বইয়ে, আলোছায়াতে সর্বত্রই যুদ্ধমান তীক্ষ্ণদৃষ্টি। চারদিকের এক মহাসমারোহ এখানে যেন ঘিরে আসছে এক বিশালকায় খঙ্গ নিয়ে। বড়দি আর গিরীনদার মাঝখানের সমস্ত তন্ত্রীকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে।
ভয় নিয়ে, কান্না চেপে, কখন রবির সঙ্গে এসে দাঁড়াল সুমিতা নীচের গাড়ি ভিড় করা লনের একপাশে, সে খেয়ালটুকুও নেই। তারপর হঠাৎ ও চমকে দেখল, একটি গাড়ির দরজা খুলে নামছেন গিরীনদা। ও অস্ফুট গলায় বলে উঠল, গিরীনদা।
রবি বলল, কই?
তারপর দুজনেই নিঃশব্দে চেয়ে দেখল, গিরীনদা নেমেছেন গাড়ি থেকে। সেই গিরীনদা! দেখে কাঁপছে সুমিতার বুকের মধ্যে। হয়তো ডাক দিয়ে বসবে। ঠিক তেমনি, টাই আঁটা, কোট পরা, ফিটফাট গিরীনদা। তবু যেন সব মিলিয়ে কিছু অবিন্যস্ত। চোখ থেকে গগলস নামিয়ে ড্রাইভারকে কী বলে চলে গেলেন ওপরে। দেখতেও পেলেন না ওঁর রুমনো সাহেবাকে, বন্ধু রবিকে।
হঠাৎ রবির গলার স্বরটি কেমন গাঢ় হয়ে উঠল। সুমিতার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, আমরা এখানেই। দাঁড়াই রুমনি কেমন।
-হ্যাঁ।
আবার বলল, কী ভাবছ রুমনি?
কী ভাবছে সুমিতা? বড় ভয় পেল, চোখ ফেটে জল আসবে এখুনি। তবুও হাসল। হেসে রুদ্ধ গলায় বলল, বলব রবিদা?
অবাক হয়ে বলল রবি, বলো না।
সুমিতা সেই অসহজ পথের নির্মমতার যন্ত্রণা নিয়ে, সহজ পথের কথাটাই বলে ফেলল নির্ভয়ে। ঢোঁক গিলে, হেসে বলল, আচ্ছা রবিদা, যদি গিরীনদা এখুনি বড়দির কাছে গিয়ে দাঁড়ান হেসে?
রবি চমকে উঠে বলল, অ্যাঁ? কিন্তু সুমিতা তখন ফিসফিস করে যেন স্বপ্নের ঘোরে বলেই চলেছে, যদি গিরীনদা গিয়ে বড়দির হাত ধরে টেনে নিয়ে যান। যদি বড়দিটা কেঁদে ফেলে সত্যি সত্যি গিরীনদার সঙ্গে চলে যায়। ওরা সব ঝগড়া ভুলে যদি সেই আগের মতো হয়ে যায়। সেই আগের মতো হাসতে হাসতে, ঠিক আগেরই মতো ওই গাড়িতে চলে যায়।..
সমস্ত গলাটি ভরে উঠল সুমিতার হাসি কান্নার সুধায়। রবি কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না। খানিকক্ষণ নীরবতার পর সুমিতাকে কাছে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে, চাপা স্বরে বলল, ঠিক বলেছ রুমনি, ঠিক। এর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না।
রবিদা আর সুমিতা দুজনেই আচ্ছন্ন হয়ে রইল ওদের ঘোরে। কতক্ষণ এমনি আচ্ছন্ন হয়েছিল কে জানে। সময়ের মনে সময় পার হয়ে গেল। এই দুজনে নিঃশব্দ অথচ দ্রুত নিজের নিজের মনে অদৃশ্য ধারায় চলে গেল কোন সুদুরে। চমক যখন ভাঙল, দেখল গিরীনদা চলে যাচ্ছেন গাড়ি নিয়ে। তবে? তবে কী হল? একটু পরেই নেমে এল বড়দি বাবার সঙ্গে। পাশে পাশে উকিল অনিলবাবু। দেখল, বড়দির রংহীন সাদা শাড়িটাতে আগুন লেগেছে যেন। ওর সারা চোখেমুখে একটি অস্বাভাবিক দীপ্তি। একটি অদ্ভুত চাপা তীব্র হাসির ধারে চমকাচ্ছে ওর চোখমুখ। এমনকী, ওর চলবার ভঙ্গিটি পর্যন্ত আরও দৃপ্ত খরো হয়ে উঠেছে।
.
অনিলবাবু বিদায় নিলেন হাসতে হাসতে। কিন্তু বাবাকে তেমনি অসহায় করুণ দেখাচ্ছে।
কাউকে কিছুই বলতে হল না। বোঝা গেল, সেই অমোঘ পরিণতি ঘটে গেছে। সুমিতার সব স্বপ্ন ভেঙে, একটি ছিন্ন পত্রের মতো নেমে এল বড়দি। গিরীনদা গেছেন তার আগেই। রাজশক্তি দিয়ে ওদের বিচ্ছেদ আজ সম্পূর্ণ হয়েছে। বড়দি বলল, তোমরা বাড়ি যাও বাবা, আমি এক জায়গায় ঘুরে যাব।
বাবা যেন ভয় পেয়ে চমকে উঠে বললেন, কোথায়?
বড়দি: অনেক দিন অমলাদের বাড়ি যাইনি। আজ একটু ঘুরে যাব।
বাবা ছেলেমানুষের মতো করুণ গলায় বললেন, আজ থাক উমনো, অন্যদিন যাস।
বড়দি ওর সেই দীপ্ত হাসিমুখেই বলল, না বাবা, আমার বাড়ি যেতে এখুনি ইচ্ছে করছে না। তোমরা যাও আমি সন্ধ্যার আগেই ফিরব।
তারপর রবিদার দিকে ফিরে, নিজের হাতঘড়ি দেখল। বলল, এ কী, তুমি কলেজ কামাই করে ফেললে? সাড়ে বারোটায় তোমার ক্লাস ছিল যে?
রবিদা অপ্রস্তুত গলায় বললেন, হ্যাঁ, আজ আর যাওয়া হল না।
বড়দি এক মুহূর্ত দুরের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, বাবা, তুমি চলে যাও, আমি পরে যাচ্ছি।
বলে ও চলে গেল। দৃপ্ত পদক্ষেপে, ওর সাদা শাড়িতে আগুন ছড়িয়ে যেন গেল চলে। একটু পরে, এরা তিনজনেও অগ্রসর হল। খানিকটা এগিয়ে রবিদা বললেন, আমি আজ চলি কাকাবাবু। কাল পরশু বাড়িতে যাব। তারপর সুমিতা বাবার পাশাপাশি হেঁটে চলল।
তখনও অফিস আদালতের ছুটি হতে কিছু বাকি। মাঘের রোদে কাঁপছে অনাগত চৈত্রের দীপ্তি। রাস্তায় ভিড় কম। ট্রামবাসগুলি ফাঁকা ফাঁকা।
বাবা বললেন, রুমনো, চ, বাগবাজারে তোর জ্যাঠাইমার কাছে যাই আজ একটু।
রুমনির কথা বলতে ভয় হল। অন্য কিছু নয়, ওর সমস্ত রুদ্ধ কান্না ভেঙে পড়বে বলে। সম্মতি জানাল ঘাড় কাত করে।
.
০৫.
সারাটি রাস্তা মহীতোষ চুপ করে রইলেন। সুমিতা শূন্যদৃষ্টিতে দেখছিল দুপুরের ভিড়হীন রাস্তা। আর থেকে থেকে, লুকিয়ে দেখছিল মহীতোষকে। যেন এক মহা দুর্দৈবের পর, নতুন করে আবার সবটুকু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পর্যালোচনা করার সময় এসেছে।
ট্রাম মেডিকেল কলেজ ছাড়াতেই দেখা গেল পুলিশ ভ্যান রয়েছে দাঁড়িয়ে মির্জাপুর স্ট্রিটের মধ্যে। কোমরে রিভলবার খুঁজে দুজন অফিসার দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কোয়ারের রেলিং-এর কাছে। পুলিশবাহিনী রয়েছে একটি আলাদা গাড়িতে। হেলমেট রাইফেল রীতিমতো যুদ্ধের সাজ তাদের সর্বাঙ্গে। কিন্তু আশ্চর্য রকম অলস চাউনি তাদের চোখে। যেন তন্দ্রালু, অথচ অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে দেখছে স্কোয়ারের দিকে! মুখগুলি ভাবলেশহীন। কেবল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অফিসার দুজনকেই যা একটু বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। সেটাও বুদ্ধি ঠিক নয়, ক্রোধের দীপ্তি। দুজনেই তাকিয়ে আছে স্কোয়ারের ভিড়ের দিকে।
সবই দেখা হয়ে গেল চোখের পলকে স্কোয়ারের ছাত্রছাত্রীদের জটলা। মিটিং হচ্ছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, কোনও উত্তেজনা নেই। উত্তেজনা যেটুকু, সেটুকু রাইফেল হেলমেটেই সীমাবদ্ধ। এখন আর এ সব দেখে ভয় বিস্ময়, কিছুই হয় না। ট্রাক, ট্যাঙ্ক, কামান, কনভয়ের সারি, সৈন্যবাহিনী পুরনো হয়ে গেছে। গতবছর গোড়ার দিকে সারা কলকাতার অলিতে গলিতে গুলিবৃষ্টি হয়েছে। আগে দাঙ্গা উপলক্ষেও পুলিশ মিলিটারি অবরোধ করে রেখেছিল কলকাতা। এখন মুখ না খুলতেই এরা হাজির হয়।
ভয় নয়, দুর্ভাবনা হচ্ছে। স্কোয়ারের ওই ভিড়ের মধ্যে মেজদি রয়েছে। হয়তো কলেজে এলে, সুমিতাও পায়ে পায়ে চলে যেত ওখানে। কিন্তু এখানে এই চলন্ত ফাঁকা ট্রামে অশেষ বেদনায় নির্বাক দুজনের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া এল ঘনিয়ে। কিছুই বলার নেই। যার জন্যে দুশ্চিন্তা, সেই মেজদিকে ডেকে আনা যাবে না কোনওক্রমেই।
তারপর বাগবাজারের মোড়ে নেমে দুজন হেঁটে এসে দাঁড়াল সেই বাড়িটির সামনে। আজ আর মহীতোষ কোথাও যাবার জায়গা খুঁজে পাননি, এ বাড়ি ছাড়া। সুমিতা আরও কয়েক বার এসেছে এ বাড়িতে।
এখানে কলকাতার আর এক রূপ, আর এক রস, আর এক গন্ধ। গত শতাব্দীর নির্জীব ভাঙা জীর্ণ কলকাতা বুড়ো চোখে তাকিয়ে আছে এখানে। দক্ষিণের নতুন কলকাতা এখানে এসে করুণা ও বিতৃষ্ণা বোধ করে। কেমন যেন হতশ্রী, রূঢ় এখানকার পরিবেশ। এখানকার বাড়ি, এখানকার রাস্তা, দোকানপাট, লোজন, রকের আড্ডা, ভ্রাম্যমাণ ষাঁঢ়, সবকিছুর মধ্যে একটি ভিন্ন চরিত্রের ছাপ রয়েছে। অন্তত তার বাইরের বেশ দেখে তাই মনে হয়। এখানে মানুষ বাস করে চেঁচিয়ে হেঁকে ডেকে। পুরনো বাঙালির আস্তানা এখানে। অথচ শহুরে জীবনের বাঁধনটি আছে আষ্টেপৃষ্ঠে।
এখানেই মানুষ হয়েছে মহীতোষ, এ পাড়াতেই বড় হয়েছে। যে বাড়িতে ঢুকবেন, জন্মেছেনও সেই বাড়িতেই। তবে সে বাড়ি এ বাড়িতে এখন অনেক তফাত হয়ে গেছে। তখন এত নতুন ছোট ছোট ঘর উঠে ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি, এত লোকের বাস ছিল না। এখন দিনের বেলায় আলো জ্বালিয়ে না রাখলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যায় না। নীচের উঠোনটার দিকে তাকাতেও ভয় করে। প্রচুর ভাড়াটের ভিড়। তাদের ব্যবহৃত সমস্ত জল দিনরাত্রি অন্ধকার উঠোনটিকে ভয়াবহ রকম পিছল করে রেখেছে। তেতলার ঘেরাও থেকে এখানে আলোটুকু এসে পৌঁছুবার আগেই অন্ধকার জাঁকিয়ে বসে মুখ ভেংচায় আকাশটাকে। অনেক লোক, তাই অনেক গণ্ডগোল, চিৎকার। সবসময়েই ভিড়ের মধ্যে বাস।
বাড়ির মালিক যারা, মহীতোষের ভাইপো, তারা থাকে তেতলায়। তারা এ সব ভিড়ের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আছে অনেকখানি। সেটুকু সহ্য করতে হয়, সেটুকু আয়ের কথা চিন্তা করে করতেই হয়। সব মিলিয়ে মাসে তিনশো টাকা ভাড়া পায়।
সুমিতা ভেবে পায় না, মানুষের নিজের এত বড় বাড়ি থাকতে কেন তারা আকাশের টংএ পায়রার খোপের মধ্যে থাকে গাদাগাদি করে।
দুজনে তেতলায় এসে দাঁড়াতেই একটি বছর দশেকের ছেলে উঠল চিৎকার করে, ঠাকমা, বালিগঞ্জের দাদু এসেছে।
বলেই, খালি গা ছেলেটি চকিতে একবার বাপ-মেয়েকে দেখে উধাও হল। মহীতোষের মৃত দাদার বড় ছেলে নবগোপাল আর রামগোপালের ছেলেমেয়েদের কাছে বালিগঞ্জের দাদু বলেই তাঁর পরিচয়। আশেপাশে নড়বার জায়গা নেই। রেলিং-এ, বারান্দায়, সর্বত্র কাপড় কাঁথা শুকোচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুখদা। মহীতোষের বউঠান, সুমিতার জ্যাঠাইমা। বয়স প্রায় মহীতোষের মতোই। দু-এক বছর বেশিও হতে পারে। দেখায় আরও বুড়ি। কিন্তু এখনও বেশ চলাফেরা করতে পারেন। ছ্যাঁচা পানের দলা মুখে পুরে, বলিরেখাবহুল ঠোঁটের কষ রেখেছেন রক্তাক্ত করে। একটু চাপা গলাতেই বললেন, কী ভাগ্যি। ঠাকুরপো যে, একেবারে মেয়ে নিয়ে। এসো ভাই, এসো।
সুমিতার বড় অদ্ভুত লাগে বাবা আর জ্যাঠাইমার এই সম্পর্ক। বাবার সঙ্গে বড়দি মেজদির যেমন বন্ধুত্ব আছে, এখানে ঠিক তেমনটি নয়। তবু যেন জ্যাঠাইমার সঙ্গে বাবার কেমন এক রকমের একটি বন্ধুত্ব আছে।
জ্যাঠাইমার চাপা গলা শুনে বাবা একটু বিস্মিত হলেন মনে মনে। বললেন, এসে তোমাদের বিব্রত করলুম না তো বউঠান?
জ্যাঠাইমা ওঁর কুঞ্চিত গাল কাঁপিয়ে, ঘোলা চোখদুটি কুঁচকে বললেন, ও মা! কী যে সাহেবিপনা কর ঠাকুরপো। ঘরের ছেলে ঘরে আসবে, তার আবার ও সব কী বলছ।
কিন্তু বাবার মুখের বেদনা-ভার-গাম্ভীর্য জ্যাঠাইমা তাকিয়ে দেখেননি এখনও। সুমিতার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আয়রে, আয়। কী নাম বাপু তোদের, আমার আবার মনেও থাকে না।
অন্যদিন হলে মহীতোষ জবাব দিতেন, নেহাতই বাংলা নাম বউঠান। সুজাতা, সুগতা, সুমিতা।
কিন্তু আজ কিছু বললেন না। সুমিতার হঠাৎ মনে পড়ে গেল অনেক দিন আগের একটি ঘটনা। প্রায় দু বছর আগের কথা। কলকাতায় ফিরে বাবা বড়দি মেজদি আর ওকে নিয়ে এসেছিলেন এ বাড়িতে। বড়দি মেজদিকে শিখিয়ে রেখেছিলেন জ্যাঠাইমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে। তখন সুমিতা অনেক ছোট। ইচ্ছে হয়েছিল, বড়দি মেজদিকে নকল করে প্রণাম করবে জ্যাঠাইমাকে। কিন্তু সেরকম কোনও অনুমতি বা নির্দেশ ছিল না ওর প্রতি।
এ বাড়িতে ঢুকলে যেমন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তেমনি মানুষগুলিকেও খুব একটা নিজের বলে ভাবতে পারে না সুমিতা। সবাইকেই কেমন যেন একটু গায়ে পড়া গায়ে পড়া লাগে। পরিচয়ের অপেক্ষা না করেই ছেলেমেয়েগুলি কাছ ঘেঁষে আসে ওর। সুমিতার সামনেই হয়তো সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনা আরম্ভ করে দেয় বাড়ির লোকেরা। ছেলেমেয়েরা চেঁচিয়ে খেতে চায়, ঝগড়া করে। বাপ মা ছাড়া বাকি সবাইকে করে তুইতোকারি। কেমন যেন অভব্য রুক্ষ বেয়াড়া মনে হয় সবাইকে। তবু কী মনে হল, সুমিতা আজ হঠাৎ ওর জ্যাঠাইমাকে একটি প্রণাম করে বসল।
জ্যাঠাইমা একটু চমকে উঠে পরমুহূর্তেই বলে উঠলেন, আহা, মা আমার সোনা মানিক! এসো মা, এসো।
মহীতোষও এক মুহূর্তের জন্যে কেমন বিমূঢ় হয়ে গেলেন। ভাবতেই পারেননি, রুমনি এমন একটি কীর্তি করে বসবে। সেই লজ্জাতেই সুমিতা বাবার দিকে আর তাকাতেই পারলে না। কিন্তু জ্যাঠাইমার আহা, সোনা মানিক শুনে হঠাৎ যেন জল এসে পড়ল ওর চোখ ফেটে। বুকের মধ্যে উঠল টনটনিয়ে। জ্যাঠাইমার এই সুরের মধ্যে কী যেন আছে, যা এ বাড়ির এই পরিবেশ ও জীবনধারণের উর্ধ্বে একটি মায়ার সঞ্চার করে রেখেছে। অন্যদিন হলে এ কথা শুনে হয়তো হেসেই ফেলত সুমিতা। বড়দি মেজদিরও হাসি পেয়েছিল একদিন। কিন্তু আজ ওর নিজের ঘরের অন্ধকার থেকে এসে, এই স্নেহ আপ্যায়নের জন্য লালায়িত হয়ে উঠেছিল যেন। কতকাল ধরে যেন এই অপরিচিত আদরের তৃষ্ণা ছিল বুকে।
অথচ এ ব্যাপারের জন্যে একটুও তৈরি হয়ে আসেনি। হঠাৎ ওর ছ বছরের একটি নিরুদ্ধ আকাঙ্ক্ষার শোধ নিয়ে নিল এমনি করে। শুধু এইটুকু বুঝল না, ওকে এমনি করে প্রণাম করতে দেখে, অনেক বেদনার মধ্যেও বাবা কতখানি বিচলিত হয়ে উঠলেন। সেটুকু বিরক্ত নয়, রাগও নয়, ছোট মেয়েটির জন্যে হঠাৎ বাবার মন চিন্তা ব্যাকুল হয়ে উঠল। কী হয়েছে রুমনিটার!
তারপর ঘরের মধ্যে। কী ঘর! তেতলার ঘর, তবু যেন অন্ধপুরী। তিনটি এমনি ছোট ছোট ঘর। ছোট বড় নিয়ে পনেরোটি মানুষ থাকে। তেলচিটে তোশক গুটানো। ছেলেমেয়েগুলি খালি তক্তপোশে মেঝেয় ছুটোছুটি গড়াগড়ি করে। বিছানা-মাদুরগুলি ময়লা শ্রীহীন। দু-তিনখানা চেয়ার ছড়ানো এদিকে ওদিকে। ছেলেপুলেরাই কখন টানাহেঁচড়া করে রেখে দিয়েছে। আয়না আছে, টেবিল আছে। সবকিছুই যেন কী রকম। এ সব দেখে বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা যখন বিরক্ত হয়, মেয়েরা বলে, তা কী করা যাবে। ছেলেমেয়ের ঘর কত সাজিয়ে রাখা যায়।
মহীতোষ এখানে এসে অবশ্য সংকোচ না করারই চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন, যেখানে হোক এক জায়গায় বসে সুখদার সঙ্গে দু-চারটি কথা বলতে।
সুখদা বললেন তেমনি একটু চাপা গলায়, বসো ভাই ঠাকুরপো, একটু পা ছড়িয়ে তক্তাপোশে বসো।
সুমিতাকে বললেন, তুই একটা চেয়ার টেয়ার টেনে বোস মা।
এ ঘরের থেকে পাশের ঘরে যাওয়ার দরজায় একরাশ ছেলেমেয়ে রয়েছে ভিড় করে। সঙ্গে নবগোপালের স্কুলাঙ্গী স্ত্রীও রয়েছেন। অর্থাৎ সুমিতার বউদি। মহীতোষকে দেখেই, একটু ঘোমটা টেনে এসে প্রণাম করল। মহীতোষ এখন এ সব বিষয়ে একটু বিব্রতই বোধ করেন। তাড়াতাড়ি নিজেও কপালে হাতটি ঠেকিয়ে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা—
এ বেলা আর সুমিতার খেয়াল নেই যে, প্রণাম করলে, গুরুজন সবাইকেই প্রণাম করতে হয়। সেটাই রীতি।
পাশের ঘরে পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। বড় ছেলে নবগোপালের কণ্ঠই বিশেষ করে। সেদিকে কয়েক মুহূর্ত উৎকর্ণ থেকে সুখদা ওঁর লোলচর্ম গালে একটি অপূর্ব হাসি ফুটিয়ে মহীতোষের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। ফিসফিস করে বললেন, আজ আমাদের শিবানীকে দেখতে এসেছে।
দেখতে এসেছে! কথাটির সঙ্গে একটি অস্পষ্ট পরিচয় আছে সুমিতার। কোনওদিন চাক্ষুষ দেখেনি। শিবানীকে কে দেখতে এসেছে!নবগোপালদার বড় মেয়ে শিবানী। বাবার নাতনি, আর সুমিতাকে ডাকে ছোট পিসি বলে। সুমিতারই সমবয়সি হবে। ক্লাস নাইন অবধি পড়েছিল স্কুলে। ওকে দেখতে এসেছে।
ভাবতেই বুকের মধ্যে ছটফট করে উঠল সুমিতার, পাশের ঘরে যাবার জন্যে। সে যেন কোনও এক নতুন জীবনের রংমহল। কী এক বিচিত্র ঘটনা-ই না জানি ঘটছে ওখানে।
কিন্তু কিছু না বলে কয়ে হঠাৎ ও ঘরে যাওয়াটাই বা কেমন দেখায়। কেউ না বললে যায় কেমন করে। হয়তো যাওয়াই রীতিবিরুদ্ধ।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলি পড়েছে মহাফাঁপরে। ওদের মনের যত টান পাশের ঘরে, তত টান এ ঘরের বালিগঞ্জের দাদু আর ছোট পিসির দিকে। ওদের কাছে এ দু তরফের প্রতিই এক অনাস্বাদিত লোকের আকর্ষণ আছে।
এমন সময় কীকরে নবগোপাল খবর পেল মহীতোষের আসার কথা। অমনি ভারী আপ্যায়িত হয়ে, প্রায় চিৎকার করতে করতে ছুটে এল এ ঘরে। যেন মহীতোষের পায়ে কিছু ছিল, এমনি করে চোখের পলকে হাত দিয়ে পা ছুঁয়ে বলল, কখন এলেন কাকাবাবু।
বোঝা যাচ্ছে, এসময়ে এসে পড়ে মহীতোষও অস্বস্তি বোধ করছেন। বললেন, এই তো আসছি।
সুমিতার মনে হল, নবগোপালদাদা যেন প্রায় বাবার বয়সি। জার্ডিন কোম্পানিতে ক্লার্কের চাকরি করে। এর মধ্যেই মাথার চুলে ধরেছে পাক। পান খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলি দেখাচ্ছে ক্ষয়াটে লাল। গায়ে একটা গেঞ্জি, পরনে ধুতি, কিন্তু একটি আন্ডারওয়্যারও পরেনি। বাবার সঙ্গে কথার এক ফাঁকেই সুখদাকে কানে কানে বলল, বোধ হয় পছন্দ হয়েছে, জানলে?
সুখদা বললেন, ভগবান যদি মুখ তুলে চান।
সুমিতা যতই দেখে, ততই দুর্বোধ্য বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখে সব। আর আড়ষ্ট হয়ে থাকে শরীর ও মনের মধ্যে। এরা কী কথা বলছে, কখন কেন যে হাসছে, সহসা সব ধরে উঠতে পারে না।
নবগোপাল বলল, চলুন কাকাবাবু, আপনি একটু ও-ঘরে চলুন।
সুমিতা দেখলে, বাবা একেবারে লাল হয়ে উঠেছেন। বললেন, আর থাক না নবগোপাল। এমনি হঠাৎ এসে পড়েছিলুম, বউঠানের সঙ্গে একটু দেখা করে যাব বলে। আমি আর ওখানে গিয়ে কী করব।
নবগোপাল পান-খাওয়া দাঁতে, একটি বিচিত্র ধরনের আবদারের হাসি হেসে বলল, তা বললে হবে কাকাবাবু। আজ আমার কী ভাগ্য, আপনি এসে পড়েছেন। আপনি থাকতে শিবানীকে আমি একলা বসে দেখাব, এটা হয় না। বাবা থাকলে আজ নাতনিকে বসে দেখাতেন। বাবার হয়ে আজ আপনি রয়েছেন।
সুখদা বলছেন, হ্যাঁ, তুমি যাও ভাই এক বার ঠাকুরপো, মনে মনে নাতনিটাকে একটু আশীর্বাদ করো, যেন মেয়েটার একটা গতি হয়ে যায়।
মহীতোষ চকিতে এক বার সুমিতার দিকে তাকালেন। সুমিতাও তাকিয়েছিল। মেয়েটার গতি আবার কী! ওর মনে হচ্ছিল, বাবা নিশ্চয়ই এক বার এদিকে তাকাবেন। আর কার দিকে এখন তাকাবেন। বড়দি মেজদি তো কাছে নেই, যাদের দিকে তাকান অসহায় হয়ে। বাবার অস্বস্তি দেখে, সুমিতাও বিব্রত বোধ করল। কিন্তু এখানে তো ওর বলার নেই কিছু।
মহীতোষকে যেতে হল। সুখদা যেটুকু ভাবেননি হয়তো, সুমিতাও ভাবেনি, হয়তো মহীতোষও সম্যক ধারণা করতে পারেননি, সেটুকু হল নবগোপালের এক নিগূঢ় সম্মানবোধেআজকে নিজের বাবা নেই বলেও যেমন সে মহীতোষকে পেয়ে খুশি হয়েছে, তেমনি এত বড় একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে আত্মীয়কে পেয়েও বুক ফুলে উঠেছে তার। যেন তার মেয়েকে পছন্দ করার ব্যাপারে ছেলেপক্ষ একটি নতুন আলো পাবে।
সুমিতা বেচারির কী দুর্দশা! ওকে তো কেউ যেতে বলছে না। একটি আলগা চেয়ারে প্রায় আলগা হয়ে বসে ও ধৈর্যের বাঁধটাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। দেখছে, জ্যাঠাইমা কেমন এক স্বপ্নঘোরে কান পেতে আছেন পাশের ঘরে। তারপরে হঠাৎ নজরে পড়ল সুমিতাকে। বললেন, যাবি ও-ঘরে?
অমনি টুক করে ঘাড় নেড়ে দিল সুমিতা, হ্যাঁ যাবে।
বলেই কিন্তু জ্যাঠাইমাকে নিমেষের জন্যে চিন্তিত দেখাল। বুঝল না, জ্যাঠাইমা ওর দিকে চেয়ে ভেবে নিচ্ছেন, ছেলে-পক্ষ ওকে দেখে না আবার শিবানীকেই নাকচ করে দেয়। বোধ হয় পরমুহূর্তেই মহীতোষের মেয়ে ভেবে লজ্জায় মরে গেলেন অন্তরে অন্তরে। ও যে সাহেবের ছোট্ট মেয়ে! বললেন, যা না, যা। বড় বউমা, ওকে একটু যেতে দাও তো ও-ঘরে।
চার জন ভদ্রলোকের সামনে সেজেগুজে জড়সড় হয়ে বসেছে শিবানী। সুমিতাকে দেখেই বেচারির লজ্জারুণ মুখখানি আর এক দফা লাল হয়ে উঠল। মেয়ে দর্শকেরাও সকলে একযোগে এক বার তাকিয়ে দেখল সুমিতাকে। বোধ হয় একটু অবাক হয়েই দেখল। এ বাড়িতে এ মেয়েকে বড় বেমানান লেগেছে। এ আসরে সবচেয়ে বেমানান লাগছে মহীতোষকে। এ সব যেন ওঁর গত জন্মের ব্যাপার।
সুমিতা দেখছে আর শুনছে। নাম কী মা? কদ্দূর পড়েছ? কী রান্না জান? গান গাইতে পার? নামটি নিজের হাতে লিখে দাও তো। লজ্জাভরা গলায় সবই জবাব দিচ্ছে শিবানী। যা বলছে, তাই করছে।
হঠাৎ কেমন যেন বড় রাগ হতে লাগল সুমিতার, লোকগুলির ওপর। কী বিশ্রী! ওর কোনও আদর্শ নেই, নীতিও নেই, ওই বিষয়ে কোনও শিক্ষাও নেয়নি নিজেদের সমাজের কাছ থেকে। সমস্ত ঘটনাটির মধ্যে ওর বিরক্তি ও বিস্ময় বাড়ল। আর বড় দুঃখ হতে লাগল শিবানীর জন্য। নিজের অবচেতন মনে যেমন বড়দির সচেতন দীপ্ত বহ্নি ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, এখানে শিবানীর এই দীপ্তিহীন নিস্তেজ বাধ্যতা ততখানি রুষ্ট করে তুলেছে।
লোকগুলি মহীতোষকে হঠাৎ বড় খাতির করতে আরম্ভ করেছে। মহীতোষও যেন সে বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছেন।
কিছুক্ষণ পর মেয়ে দেখার পালা চুকল। মিষ্টিমুখ করে বিদায় হল বাইরের লোকেরা। মহীতোষ বললেন সুখদাকে, এবার চলি বউঠান।
সুখদা বললেন, এখুনি কী? যেয়ো, বসো; তোমার সঙ্গে কথা আছে। বলেই প্রায় চিল-গলায় হাঁকার দিলেন, এই দস্যিগুলো, গেলি এ ঘর থেকে? সঙ্গে সঙ্গে নবগোপাল চেঁচিয়ে উঠল।
বেচারিরা বালিগঞ্জের দাদুকে দেখার লোভ সংবরণ করে পালাল। গিয়ে জুটল পাশের ঘরে। সেখানে রয়েছে শিবানী আর সুমিতা।
দুজনের কেউই তখনও কোনও কথা বলেনি। ভিড় দেখে শিবানী বলল সলজ্জ গলায়, চলো ছাদে যাই।
দুজনে সিঁড়ির দিকে যেতেই, ছোটরা পিছন নিল। ধমকে উঠল শিবানী, দেখবি, ডাকব বাবাকে? যা বলছি।
আজকে দিদির হুকুম মানতে হবে, এটাই ছিল ওদের বিশ্বাস। অগত্যা থামতে হল। দুজনে ওরা উঠে এল ছাদে। কিছুক্ষণ সময়ের জন্যে। সুমিতার আজকের ভয়-বেদনা আড়াল হয়ে রইল। মাঘের ঢলে পড়া সূর্যের চিকন রোদে ভরা ছাদে এসে দাঁড়াল দুজনে। শিবানীর চোখে মুখে, সাজাগোজা, সব কিছুতেই একটি বিচিত্র লজ্জা যেন রোদের মতোই ঝিকমিক করছে। আলাপ আছে দুজনেরই কিন্তু কেউ-ই কথা বলতে পারছে না। সুমিতার খোলা চুলে পড়েছে রোদ। বড় বড় চোখে অবাক বিস্ময়ে দেখছে শিবানীকে। এ যেন সেই আগের শিবানী নয়। যে শিবানী ওকে সভয়ে সসংকোচে জিজ্ঞেস করে পড়ার কথা, কলেজের কথা, দাদু অর্থাৎ মহীতোষের কথা, সুজাতা আর সুগতা, বড় আর মেজ পিসির কথা। এমনি জিজ্ঞেস করে, আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সুমিতাকে। যেন ওর এই সচকিত কিশোরী প্রাণের কোথায় একটি দীর্ঘশ্বাস জমা হয়ে ওঠে ছোট পিসিকে দেখে। এই দেখার মধ্যে, শিবানীর প্রতি কেমন একটু মমত্ব বোধ এসে পড়ে সুমিতার। এ সংসারে, ওর নতুন কথা শোনাবার পাত্রী শিবানী। ছোট পিসি ডাকের মধ্যে যেমন একটু অস্বস্তি মেশানো খুশি অনুভব করে, তেমনি নিজেকে শিবানীর সামনে একটু বড় বড় লাগে। অথচ বয়সে ওরা সমান।
কিন্তু আজ শিবানীকে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। ওর জন্যে যে সুমিতা এত দুঃখ পাচ্ছিল খানিকক্ষণ আগে, তার কোনও চিহ্ন তো এ মুখে নেই। এ তো আলাদা শিবানী। ওর ঠোঁটের এই হাসি, নত চোখের ওই চাউনি, অন্য বেশে, অন্য কোথায় দেখেছে সুমিতা। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেই প্রথম গিরীনদার আবির্ভাবে বড়দি হেসেছিল এমনি করে। মৃণালের সামনে দু-একবার এরকমভাবে হাসতে দেখেছে মেজদিকে। আজ সমবয়সি শিবানীও হাসছে এমনি করে। একে তো এই আধা-চেনা পরিবেশ, তার ওপরে এ ব্যাপার দেখে একেবারে নির্বাক হয়ে রইল। নিজের মুখ নিজে দেখতে পায় না সুমিতা। জানে না, এমন হাসি কোনওদিন ফুটেছিল কি না ওর মুখে।
শিবানী বলল অস্ফুট লজ্জায়, এই ছোট পিসি, কিছু বলছ না যে?
নিজেকে কী রকম অসহায় মনে হল সুমিতার। বলল, কী বলব?
শিবানী বলল হাসির নিক্কণে, কী আবার। এই…মানে…ওই সব।
ওই সব? এক বার মনে হল সুমিতার, বুঝি বড়দির কথা বলতে বলছে শিবানী। কিন্তু তারপরেই মনে হল, না, তেমন কোনও দুশ্চিন্তার ছাপ তো নেই মুখে। এত দিন সুমিতা এসেছে অন্য রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে। শিবানী দেখেছে এবং শুনেছে। আজ শিবানীর মধ্যে আর এক রাজ্যের বিপুল বিস্ময়, সেখানে থই পাচ্ছে না সুমি। বলল, কোন সব বলল তো?
শিবানী হেসে উঠে তাকাল সুমিতার মুখের দিকে। কী এক বিচিত্র ছটায় চকমক করছে ওর চোখ দুটি। বলল কেন, এই যে দেখলে এতক্ষণ, এই সব দেখা টাকা, সে কথা।
সহসা যেন সংবিৎ ফিরে পেল সুমিতা। সত্যি, কিন্তু কী বলবে? চকিত মুহূর্তে এক বার ওর সেই অদৃশ্য লতার অনধিকারের ভয় হল।
তারপর বলল, এবার তোমার বিয়ে হয়ে যাবে তো?
শিবানীকে লাল দেখাচ্ছে রোদে। বলল, যদি পছন্দ হয়।
সুমিতা: কাদের পছন্দ। ওই লোকগুলোর?
বুঝল না, ওর গলার সামান্য অশ্রদ্ধার সুরটুকুও ব্যথা দিচ্ছে শিবানীকে। বলল, হ্যাঁ।
সুমিতা: তারপর?
শিবানী: তারপর? তারপর ওই যা বললে, তা-ই হয়ে যাবে।
সুমিতা বলল, বিয়ে হয়ে যাবে? তোমার যদি সেই লোকটিকে ভাল না লাগে?
সেই লোক, অর্থাৎ বর। শিবানী অবাক লজ্জায় বলল, যাঃ!
শিবানীর এ বিচিত্র অভিব্যক্তিতে আরও বেশি অবাক হল সুমিতা। বলল, ভাল লাগবেই?
শিবানীর লজ্জার চেয়ে এখন যুক্তিটাই বড় হয়ে উঠল। বলল, নয় কেন?
আশ্চর্য! একটি লোককে ভাল না লাগার কত কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে আবার কেন কীসের? তারপর কী যে হল সুমিতার, হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, ধরো, তার যদি আর কেউ থাকে?
শিবানী অবাক হয়ে বলল, আর কেউ? মানে–
বেচারি ঢোঁক গিলছে। বুঝতে পেরেছে ছোট পিসি আর কেউ বলতে কী বোঝাতে চাইছে। সুমিতা বুঝল না, কী তীব্র ব্যথার কষাঘাত করছে শিবানীর নতুন দেখা স্বপ্নে। অভিমানের সুরে বলল, ইস!
কিন্তু সুমিতা বেচারিরও বুকখানি ফুলে ফুলে উঠছে কান্নায়, কৌতূহলে। ওই কথাটি জানতে চায় ও এখন। বলল, তখন তুমি কী করবে?
শিবানীর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল। বলল, কী আবার? তা হবে কেন। তা হবে না।
শিবানীর দৃঢ়স্বর শুনে একটু থতিয়ে গেল সুমিতা। বলল, কেন?
শিবানী আবার লজ্জিত হয়ে উঠল। অনেক কষ্টে বলল, আমাকে তো সে ভালবাসবে।
কথাটি বলে এবং শুনে দুজনেই একেবারে চুপ হয়ে গেল। সুমিতার অন্তস্রোতের একমুখো গতিটিকে হঠাৎ আর এক পথে ভাসিয়ে দিলে শিবানী। যেন ওর বরের ভালবাসার কাছে আর কিছু থাকা না থাকা সব তুচ্ছ হয়ে গেল। বড়দি গিরীনদা, কাউকেই স্পষ্ট খুঁজে পেল না এখানে।
সোনা-চিকন রোদ রক্তিম হয়ে উঠেছে। ছাদের পরে ছাদ, উঁচুনিচু বন্ধুরতার মধ্যেও কোথায় একটি কংক্রিট ইট কাঠের সামঞ্জস্য রয়েছে। কোথাও জলের ট্যাঙ্ক, রেডিয়ো এরিয়ালের আকাশ খোঁচানো সরু বাঁশ। নীচে ও দূরে কোলাহল শহরের।
আর এখানে, দুই ভিন্ন মনের দুই কিশোরী দুটি ঝুঁটি পায়রার মতো দাঁড়িয়ে রইল মুখোমুখি। এই বিস্ময়কর রক্তিমাভার মধ্যে ওদের দুজনেরই, মন কোন সুদূরে, কোন অতলে, কোন আলোতে, কোন অন্ধকারে, কোন আনন্দে ও বেদনায় গেল হারিয়ে। সুমিতার অদৃশ্য লতায় কোথায় আজ একটি নতুন কুঁড়ির সন্ধান পেল ও নিজে।
নীচের ঘরে সুখদা আর মহীতোষ তখন বসে আছেন গম্ভীর মুখে। নবগোপালের সময় নেই, সে গেছে বাজারে। রামগোপাল তো অফিস থেকেই আসেনি। নীচের থেকে ধোঁয়া উঠতে আরম্ভ করেছে। ওপরে।
সুখদা তখন বলছেন, ঠাকুরপো, তোমার মেয়েকে তুমি মানুষ করেছ। তুমিই তাকে চেন ভাল। কীসে তোমাদের ভাল, কীসে মন্দ, তাও ছাই বুঝিনে আমি। চিরকাল জানি, তুমি সাহেবসুবো মানুষ। তোমাদের দেখে ভেবেছি, আমরা তোমার কাছে কিছু নই। লোকের কাছে বলেছি, আমার দেওর এত বড়।
মহীতোষ বেদনার মধ্যেও বিব্রত হয়ে বললেন, কী যে বলো বউঠান।
না ভাই, সত্যি বলছি। তা সে যাক। সে এক কথা, কিন্তু আমার এই সংসার দেখছ তো? তোমাদের সঙ্গে কোনও মিল নেই, বুঝিওনে। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে যে বড় অশান্তি হচ্ছে।
মেয়েটা অর্থাৎ সুজাতা। মহীতোষ বললেন, কিন্তু এ ছাড়া আর কী করার ছিল বউঠান?
সুখদা–তা-ই কি ছাই জানি। তবে তোমার জামাই ছিল মস্ত বড়লোক। টাকা পয়সা ঘর বাড়ি, অটুট লক্ষ্মী ঘরে। মিটমাট করে ফেলতে পারলেই ভাল হত।
মহীতোষ–তা তো হল না বউঠান। উমনোকে তো তুমি চেন। ওরা লেখাপড়া শিখেছে, বড় হয়েছে, তার ওপরে বড় জেদি মেয়ে। গিরীন হার মানলে না তো, উমনোও মানলে না।
সুখদার মুখের আঁকাবাঁকা রেখাগুলি যেন জায়গা বদল করে বসল। বলল, না ঠাকুরপো, তোমার মেয়েকে আমি চিনি, তা ঠিক নয়। যত দূর শুনেছি, উমনোকে বিয়ে করার আগে স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না জামায়ের। বিয়ের পরে কেমন ছিল তা জানিনে। জানিনে, কত অপমান উমনো সয়েছে। অপমান আমরা তার চেয়ে ঢের সয়েছি।
মহীতোষ বললেন, বিয়ের পরেও গিরীনের চরিত্র কেমন ছিল সেটাই তো পরিষ্কার হল না। সেটাই তো সংশয় থেকে গেল। তবে উমনো তার সঙ্গে ঘর করেছে, সে-ই বুঝেছে সবচেয়ে ভাল। পুরুষ যদি অন্যায় করে, তাকেও হার মানতে হয় বউঠান।
সুখদা হার মানে বইকী! তার একটা সময় আছে ঠাকুরপো। সেই জন্যেই তো বলছি, তোমাদের সমাজের কথা আমি বুঝিনে, কিছু বলতেও পারিনে। কিন্তু একটি কথা বলে যাও ঠাকুরপো, তোমার মেয়ে এখন কী করবে?
মহীতোষ সহসা চমকে উঠলেন। বললেন, কেন, আমি তো মরিনি এখনও। তা ছাড়া মেয়েদের তো আমি কারুর গলগ্রহ করে তৈরি করিনি বউঠান যে, তাকে বাপের হাতে, স্বামীর হাতে, তারপর ছেলের হাতে ফিরে বেড়াতে হবে।
সুখদা ওঁর ঘোলাটে চোখে সুদূরে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। কে জানে, মহীতোষের কথার অন্তর্নিহিত খোঁচাটুকু ওঁর নিজেরই লেগেছে কি না।
বললেন, তা ঠিক ঠাকুরপো। তবে, তুমি মরোনি, মরবে তো বটেই। তোমার মেয়েও হয়তো চাকরি করে খাবে, লাখ টাকা তো তুমি রেখে যাবে না। তারপর?
তারপর কী বউঠান?
ঠাকুরপো, উমনো তোমার সন্তান, তার ওপরে মেয়েমানুষ। সে কী নিয়ে থাকবে? তার কি শরীর নেই, মন নেই, তার কি সাধ নেই, আহ্লাদ নেই।
আচমকা বৃশ্চিকদংশনে পাংশু হয়ে উঠলেন মহীতোষ। সন্তান, সন্তান। ঠিক ঠিক, বড় ঠিক কথা বলেছেন বউঠান। আজ যদি সুজাতার হিন্দু বিয়ে না হয়ে রেজিষ্ট্রি বিয়েও হত, মেয়ের জন্যে এ কথা তো না ভেবে পারতেন না। সুজাতা যদি আর একটি বিয়েও করবার আইনত অধিকার পেত, তবু মহীতোষের পিতৃমনের উৎকণ্ঠা বেদনা তো দূর হত না। সে যে ওঁর সন্তান, মেয়ে। তাকে তো উনি কোনও অনাচারের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন না।
যে কথা ছিল মনের অন্ধকারে, তাকেই সুখদা সামনে টেনে দিলেন প্রকাশ্যে। সবই হবে, কিন্তু সাধ আহ্লাদ, জীবনে সুষ্ঠু সুশৃঙ্খলভাবে বেঁচে থাকা। সব পিতৃমনই চায় তার সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে। সেইটিই যে আসল বেদনা ও ভয় মহীতোষের।
বিদায় নিলেন উনি। যাবার সময় সুখদা বললেন, যদি পার তো এক দিন বড় মেয়েকে নিয়ে এসো ঠাকুরপো।
সুমিতা শিবানীর কাছে বিদায় নেওয়ার সময় কোনও কথা বলতে পারলে না। ওরা শুধু পরস্পরের হাতে হাত দিয়ে বিদায় নিল। প্রায় সন্ধ্যার মুহূর্তে বাপ-মেয়ে হেঁটে চলল ট্রাম স্টপেজের দিকে।