তুলনা
পছন্দ ও অপছন্দের মাঝখানে যে শব্দটি নিজের অজান্তেই এসে হাজির হয় সেটি হল ‘তুলনা’। কোন কিছুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনিত হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের মনে যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় তাও এই শব্দ থেকে। ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে মানব শ্রেষ্ঠ। নিশ্চয় মানবের মধ্যে অনেক গুণ আছে যা অন্য প্রাণীর নেই। সৃষ্টিকর্তা নিজের মুখে একথা না বললেও আমরা মানবজাতি সমস্ত বিশ্ব চরাচরের মাঝে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠিত করেছি। প্রকৃতি নিজের নিয়মেই চলতে থাকে বটে, তাই বলে মনুষ্য সমাজের সমালোচনার বিষয়বস্তু থেকে রেহাই পেতে পারবে না। ছয়টি ঋতুর মধ্যে বসন্তকেই বলা হয় ঋতুরাজ। আমরা সুবিধার দিক থেকে তুলনা করে এই মন্তব্য করেছি।
জগতে যা কিছু বিরল তাই আদ্রিত। তবে মানব মস্তিষ্কের নির্যাস বৃদ্ধির দ্বারা প্রতিভাবানরা একই রকমের বস্তু উৎপন্নের যে প্রয়াস করেন তা বিরল না হলেও মনুষ্য গৃহে অতি আদ্রিত। কারণ তুলনামূলকভাবে নবনির্মিত বস্তুটির মূল্যায়ণ বিবিধ। বুদ্ধির দ্বারা কঠিন কাজ সহজ সাধ্য হয় বটে, তবে মনের মাঝে আনন্দের জোয়ার অহরহ খেলা করবে এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকা বেশ কঠিন। বস্তুতঃ তুলনার মাধ্যমে যাচাই করে বর্তমান সম্পদকে উপেক্ষা করে নিরানন্দ জীবনযাপন করার কোন অর্থ নেই।
সমাজে এক শ্রেণীর লোক আছে যারা নিজের কর্ম সাধনাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অহেতুক অগ্রগণ্য হবার জেদ তাদের নেই। তবে প্রতিযোগীতাকে সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধীকার দেবার যে দৌড় শুরু হয়েছে তা কিন্তু সামগ্রীক উন্নতির লক্ষ্যে হিতকর নয়। তীব্র গতিতে ছুটার পথে অনেককেই পিছনে ফেলে আসা যায়, তবে স্বীকৃতি পেতে হলে সেই ফেলে আসা লোকগুলোকেই মনে রাখতে হয়। অন্যথা হলে মানুষ অত্যাচারী রূপে কলঙ্কিত হয়।
এই তো সেদিন সুশীলবাবুর মেজ ছেলের মেডিকেল প্রবেশিকার ফল বের হল। কিন্তু উত্তীর্ণ হতে না পারায় যেন তার স্বপ্ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেল। মাঝে মধ্যেই তাকে বিলাপ করতে শুনা যায়— “হ্যায় রে, এও কি কপালে ছিল?” ছেলে ডাক্তার হতে না পারায় বাবার মনে যে দুরাবস্থা হল তা যেন আর একালে ঘুচবে না। কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল তার অনুশোচনার প্রকৃত কারণ। প্রতিবেশীর ছোট মেয়ে এবার উক্ত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। প্রতিবেশীর সফলতার খবরটি তিনি হজম করতে পারলেন না। যাকে তিনি এতদিন হেয় করে এসেছেন। তার মেয়ের সাফল্যে একেবারে লজ্জিত হয়ে পড়েছেন। এই মানসিক কষ্টের গোলোক ধাঁধায় তিনি যেন এক পথভ্রান্ত পথিক। এই মুহূর্তের জন্য তিনি প্রতিবেশীর সঙ্গে তুলনা থেকে বিরত থাকলে বুঝতে পারবেন মাত্র একটি পরীক্ষা ব্যক্তিপ্রতিভাকে রুদ্ধ করতে পারে না। সংকীর্ণ চিন্তাধারা মানুষকে বুদ্ধিশূণ্য, বন্ধুশূন্য এবং একঘরে করে।
দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বাঁচতে শিখেছি। কালক্রমে এই গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাত্রার মান অনেকটাই উন্নত হয়েছে । মাথায় তেল ও পেটের ক্ষিধের অন্ন জোগার থাকলে মানুষের মন ভালবাসায় উগ্রীব হয়ে থাকে। প্রাণের কাছাকাছি কাউকে খুঁজতে গিয়ে দেশ দেশান্তরে বিচরণ করাটা যেন নিত্য নৈমিত্যিক ব্যাপার। কারণটা কারো অগোচর নয়। কোন অপরূপা গুণময়ীর অন্বেষণ। নিজের অজান্তেই মানব হৃদয় তুলনার দ্বারস্থ হয়ে রূপ সাগরে ডুব দেয়।
সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পিছনে ‘ভাল ও মন্দ’ এই দুই বিশেষণের ভরপুর ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলায় এক প্রবাদ বাক্যের প্রচলন আছে যে “দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল।” কথাটি একেবারে খাঁটি বটে। তাই বলে শুধু দুষ্ট গরুকেই যে গোয়াল থেকে বের করে দেওয়া হয় তা নয়। এমন দৃষ্টান্ত পারিবারিক জীবনেও অনেক রয়েছে। মাইকেল মধুসুদন দত্ত এর জ্বলন্ত উদাহরণ। পিতার মতের বিরোধিতা করায় একমাত্র পুত্রকেও ত্যাজ্য করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এমনও দেখা যায় বাবা-মা নিজের ছেলেদের মধ্যে ছোটছেলেকেই বড়বেশী আদর করেন এবং শেষবয়সে ছোটছেলেকে অবলম্বন করে দিন কাটান। হতে পারে নিজ অভিজ্ঞতার বলেই বাবা-মা কিছু তুলনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন।
দৈনন্দিন জীবনে কতই না লোকের সংস্পর্শে আমরা আসি। তাদের সবাই মনের আঙিনায় সমানভাবে স্থান করে নিতে পারে না। কেউবা হাসিমুখে সামনে এসেও তিক্ততার ছাপ ছেড়ে অনেক দূরে হারিয়ে যায়।আবার অনেকে দূরে থেকেও বড় বেশী কাছের স্থান অধিকার করে থাকে। নয়ন ভরে দেখার মত হলে ক্ষণস্থায়ী রামধনুও অতি আদৃত । কণ্ঠস্বর মধুর বলে বসন্তের কোকিলকেই বেশী ভালোবাসি । কারন কালো রং এর চেয়ে মিষ্টি গান আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয়কে স্পন্দিত করে। বিবিধ দর্শন ও শান্তি প্রাপ্তির উৎস হিসাবে সেই ‘ তুলনা ‘ সময়ের অনন্যতায় উদ্ভাসিত হয়ে চারিদিকে বিচরণ করে । বুদ্ধিমান তারাই যারা প্রবল উন্মাদনায় বশবর্তী হয়ে নিছক তুলনার স্রোতে না ভেসে স্বীয় সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে।