Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu

তিমির বিদার || Bani Basu

রসিক ঘোষের লেনের মুখে দেখি ঝামেলা হচ্ছে। ধুস! সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি। মেলা কাজ। সাইক্লোনের হাওয়া যেমন উল্টোপাল্টা এলোপাথাড়ি বয় আমাকেও তেমন বাইতে হবে এখন। হোমিওপ্যাথ এস ভটচায্যির ওখানে মায়ের নামে স্লিপ লেখানো, গণাদার দোকানে ওষুধের লিস্টি ফেলা, তারপর বিশুদার ঠেকে একবার, নিতাইকাকার ঠেকে একবার খেপ মারা। এস ভটচায্যি যদি নর্থ পোল তো গণা অধিকারীর দোকান সাউথ পোল। বিশুদা আমাদের এমেলে না এলেবেলে জানি না বাবা, বিরাজ করছেন পুব দিকে আর নিতাইকাকা? সে-ও আবার মধ্যপ্রদেশ মানে এম পি। তিনি যাকে বলে ফার্দার ইস্ট। কত টাইম লাগবে বলতে হলে গণকঠাকুর ডাকতে হবে। ক্যারিয়ারে ভাইপো বসেছিল, নামিয়ে দিই, বলি—যাঃ ভাগ্‌!

—খ্যানো? —বাজে আবদারের কাঁদুনি ওর গলায়।

—দেখছিস না ঝামেলা হচ্ছে? ওই দ্যাখ—চিৎকারটা শুনতে পাচ্ছিস?

—তুঁমি তো যাঁচ্ছ!

—তোর রিস্‌ক নিতে আমি পারব না। আমি একলা ঠিক কেটে বেরিয়ে যাব। যা।

তখনও ক্যানক্যান করতে থাকে ছেলেটা। বোঝে না এই সব ঝামেলায় লোকে যখন তখন একটা পটকা টপকে দিতে পারে। তখন?

—আরে বাবা তোর সচিনের পোস্টার তো? ও আমি ঠিক এনে দেব।

—ন্‌ না, তুমি আনবে না।

অনেক দিন থেকেই সচিনের পোস্টারের আবদার ধরেছে রিন্টিটা। বলছি পাচ্ছি না, রাহুল দ্রাবিড় নে, বাঙালির ছেলে সৌরভের নে, রয়েছে স্টকে—ন্ না, সেই এক জেদ, ও সচিনের পোস্টারই নেবে। আজ কে জানে কী উটকো কারণে আবার স্কুল ছুটি। সক্কাল থেকে বসে আছে আমার সাইকেলের ন্যাজে।

ইচ্ছে হয় কানে কষে একটা প্যাঁচ দিই। অনেক কষ্টে লোভ সামলাই। যতই যাই হোক রিন্টিটা আমাদের জেনারেশনেকসট-এর একমাত্তর। আমার খুব ন্যাওটাও। তা ছাড়া ওর মা? চাকুরে দাদার চাকুরে বউ! বাপ রে! তাকে ভয় পায় না, এমন বেকার পৃথিবীতে আছে? অবশ্য পৃথিবী মানে ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া ছাড়া আর কোথাও আমার মতো এমন আকাট রেকারই কি আছে? থাকলেও তাদের অন্ন-বস্তর ওষুধ-পথ্যের জন্যে দাদা-বউদি! এই কম্বিনেশন বোধহয় আর কোথাও নেই।

আমাদের এ পাড়াটা ওপর-ওপর বেশ। আসলে একটা নুইসান্স। বারো মাস ঝামেলা, বারো মাস বোমবাজি। পুরো চত্বরটাই। আছে আছে বেশ আছে, হঠাৎ একদিন যেন ডাকাত পড়ে। হল্লা, গালাগাল, বোম ছোড়াছুড়ি। রেললাইনের এ দিকটা পুরো কানা গদাইয়ের। আর ও দিকটা সমশের বা শামুর। স্রেফ নামটা বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। কানা গদাই বললে কেউ যদি ভাবে একটা নোংরা, মোটা, খোঁচা দাড়ির একচোখো লোক, তা হলে তার কপালে কিছু সারপ্রাইজ আছে। গদাই একটা সাড়ে পাঁচ ফুটি তিলে খচ্চর, যার ফর্সা মাকুন্দ মুখ, পাথরের চোখ আর গেরেম্ভারি চাল দেখলে আপনার মনে হতেই পারে এ নির্ঘাত বিড়লা-আম্বানিদের ঘরের ছোট বাদশাজাদা। তিন হাজার টাকার জুতো, দশ হাজার টাকার রিস্টওয়াচ, গলার সোনার চেনটা কোন না ছ’ ভরির হবে! মাখনের মতো কাপড়ের ডোরা কাটা শার্ট আর ছুরির ধার পাতলুন পরে যখন ঘোরাফেরা করে তখন টপ এগজিকিউটিভ ভেবে আমার মতো চাকরিপ্রার্থীরা কুর্নিশ করতেই পারে। কার্ডবোর্ডের ব্যবসা করে যে গদাই কী করে অমন একটা কেতার বাড়ি বানাল এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই গদাই বলবে—ছিল।

কথাটা বুঝতেই পারছেন—সত্যি না। তা ছাড়া কী ছিল আর কতটা ছিল, এর থেকে মোটেই পরিষ্কার হয় না। জমিটা গদাইয়ের বাবা করুণাসিন্ধু যে কার থেকে ঝেঁপেছিল তা কেউই জানে না। আমার বাবা যে-সময়ে এখানে অনেক কষ্টে দেড়কাঠার কাঁচা একতলাটা পাকা করল তখনও ও জমি নাকি ভীষ্মের শরশয্যা ছিল। যে দিকে চাও শর আর শর। করুণাসিন্ধু স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে বস্তির মুখে থাকতেন, আর এই জমিটা সাফ করে করে ইট নামিয়ে রাখতেন। ব্যাপারটা কেউ সেভাবে লক্ষ করবার আগেই ওখানে ওদের চালা উঠে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলে করুণাসিন্ধু সংক্ষেপে বলতেন—কিনসি। আর কোনও ডিটেলের মধ্যে যাবার চেষ্টা করলেই বলতেন—ক্যান? কিনবা?—চালাঘরটা পাকাও হয়েছিল করুণাসিন্ধুরই আমলে। কিন্তু তার এই ফিলমি-কেতার প্রাসাদে পরিবর্তন তো আমরা চোখের সামনেই দেখেছি। বাকসো তৈরির কারখানাটা শুনেছি বজবজের দিকে। গদাই আমাদের স্কুলেই পড়ত। ক্লাস টেনের পর বছর দুই স্কুল ছেড়ে এই কারখানাটা নিয়ে পড়ে ছিল। সেই কারখানার এত আমদানি যে ওই প্রাসাদ, তার সামনে লন, গেটে বন্দুকধারী দারোয়ান, গারাজে অ্যামবাসাডর যেটা ইদানীং ফোর্ড আইকন-এ বদলে গেল? এ সব প্রশ্নের ভেতরে ঢুকতে পাড়া-বেপাড়ার কারওরই কোনও আগ্রহ হয়নি। সকলেই তো মোটমাট শান্তিতে-সোয়াস্তিতে বাস করতে চায়! যে যা প্রাণ চায় করুক, আমার ত্যানায় হাত না পড়লেই হল। আর হাঙর-কুমিরে কি আর পুঁটিমাছ ধরে?

আমার যেটুকু জ্ঞান-গম্যি তা শামু অর্থাৎ সমশেরের দৌলতে। সমশের পড়ত হাইমাদ্রাসায়। আমি ভবানীচরণ উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। বছর তিন-চার ফেল করে শামু আমার ইয়ার হয়ে যায়, সে একরকম গদাইও। ও যখন স্কুল ছাড়ল তখন আমার দু’ বছরের সিনিয়র। বলে পরে নাকি এক্সটারন্যাল হয়ে পাশ করেছে, বি কম ক্লাসে ওকে কয়েকদিন দেখেওছিলাম। ওদের সঙ্গে আমার আসল দোস্তি খেলার সূত্রে। তখন একই মাঠে একই ক্লাবে বল পিটতাম। দৌড় আগে শুরু করে শামু, তারপর গদাই, তারপর আমি। শামু ক’বছর ফেল করে আমার সমান হয়ে যায়। গদাই বি কম ড্রপ করে। আর আমি বি কম পাশ করে ওদের সমান হয়ে গেলাম। সমানও কি? জীবনের পাশ-ফেলের হিসেব নিলে গদা ফার্স্ট ডিভিশন, শামু সেকেন্ড ডিভিশন, আর আমি পি-ডিভিশন। গোড়ায় গোড়ায়, যখন এই ভেদাভেদটা এমন প্রকট হয়নি তখন আমরা মাঠের ওধারে কালভার্টটার ওপর বসতাম। গদা কাগজ পাকিয়ে সরু সরু সিগ্রেট বানাত। কতদিন গদাইয়ের পাকানো তামাক খেয়েছি তিনজনে। আমি বলতাম—কী রে! তামুকে ড্রাগ-ফাগ দিচ্ছিস না তো? গদা ভারিক্কি চালে বলত—নে, নে, দিচ্ছি এই না কত! —ড্রাগকে আমার মহা ভয়! লেটুদাকে দেখেছি তো! আমাদের পাড়ার হিসেবে তো ব্রিলিয়ান্টই ছিল, এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাদবপুর পাওয়া চাট্টিখানি কথা না। ফিরে এল ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে। প্রথমে ফুঁকল বিধবা মায়ের গয়নাগাঁটি, তারপর ঘরের বাটি-ঘটি, তারপর যখন লোকের বাড়ি ঢুকে এটা ওটা সরাতে লাগল তখন লজ্জায় ঘেন্নায় রাধুপিসি, ওর মা গলায় দড়ি দিলেন। তখন ওর এক দূর সম্পর্কের কাকা এসে হাল ধরলেন, মানে লেটুদাকে ওর নিজেরই বাড়ি থেকে বার করে দিলেন।

শামুর ভয়-ডর ছিল না। একদিন বলল—ড্রাগ-ফাগ পেলে আমাকে একটু দিস তো গদা! বেহেস্তোটা কেমন একবার টেস্ট করে আসি।

শামুই আমাকে বলেছিল—গদার বাকসো-ফাকসো না কি সব শো। ওর ওয়ার্কাররা আসলে সমাজবিরোধী মানে অ্যান্টি-সোশ্যাল। তাদের কাজ নানারকমের তোলাবাজি, ব্ল্যাকমেল ইত্যাদি। শামু তখনও রেল-লাইনের ওপারের গুরু হয়নি। হয়ে গেল একদিন কনস্টেবল ঠেঙিয়ে। চায়ের দোকান দিয়েছিল। লোকটা রোজ-রোজ মিনি-মাগনা ওর কাছ থেকে চা খেত, চা আর ঝাল বিস্কুট। সারা দিনমানে তা অমন বারসাতেক তো হবেই। যে দিন অষ্টমবার চা আর তার সঙ্গে নানখাটাই চায়, সেদিন মেরেছিল এক থাবড়া। কনস্টেবলটাও মার ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু শেষমেশ শামুই ওর লাঠি কেড়ে নিয়ে ওকে বেধড়ক পেটে। শামু না হয় রাগ সামলাতে পারেনি, করে ফেলেছিল একটা গোলমেলে কাজ। জেল হল, সেখানে কী সব নিয়ম ভাঙল, মেয়াদ বাড়ল, তারপর দাগী ক্রিমিন্যাল হয়ে বেরোল। যা-ই হোক, একটা কার্য-কারণ সম্পর্ক বুঝতে পারা যায়। কিন্তু গদাই কেন? যার একটা কার্ডবোর্ড বাকসোর কারখানা আছে তার তো কপাল খুলেই গেছে! গদাইয়ের ব্যাপারটা আমি সত্যিই বুঝি না। আমি তো একটা এস টি ডি ফোন বুথের ধান্দায় সাইকেলের টায়ার ক্ষইয়ে ফেললাম। এখনও লোন-টোন কিচ্ছু ল্যান্ড করতে পারিনি। বিশুদার কাছেই যাচ্ছি আজ তেরো মাস সাত দিন হয়ে গেল। নিতাইকাকার কাছে আরও আগে থেকে। কিচ্ছু গাঁথতে পারলাম না।

বিশুদার বাড়ি গিয়ে দেখি কেরোসিনের লাইন পড়ে গেছে। দীপু এসে আগে ঢুকছিল, আমরা অনেকেই প্রতিবাদ করতে বলল—এই দ্যাখ, জুতো রেখে গেছি, বড়-বাইরে পেয়ে গিয়েছিল তাই…। সত্যিই দেখি ওর খালি পা, লাইনে ওর জুতো মানে হাওয়াই-চটি, এত হাকুচ ময়লা যে ওটা যে দীপুর সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। দীপুর কেস খুব খারাপ। ওর বাবা ট্র্যাংগুলার পার্কের কাছে সায়া-শাড়ি-ব্লাউজ-ফল্‌স্ এ সবের স্টল দিয়েছিল। উচ্ছেদ হল। মাসতিনেক পর সংসার চালাতে না পেরে ছারপোকা মারার ওষুধ খায়। দীপুর ওপরে একটা দাদা, জমি-বাড়ির দালালি করত। দালালস্য দালাল। কেটেছে। নীচে একটা ভাই, দুটো বোন। দীপুর জন্যে বিশুদা আন্তরিকভাবে করছে। দীপুই বলে, আমরা আর কোত্থেকে জানব? কণ্ডিশন ওই, স্পেশ্যাল ট্রিটমেন্ট পাবে না, আমজনতার মতো কিউ মেরেই আসতে হবে। দীপুর মা ইদানীং গদাইদের বাড়ি রান্না করেন। ছোট ভাইটা গাড়ি ধোয়। দীপুর বড় বোন হরসুন্দরী ইস্কুলের থার্ড নয়, ফোর্থ নয়, একেবারে ফার্স্ট গার্ল। দিদিমণিরা না কি চাঁদা করে তার পড়ার খরচ জোগান। ছোটটা ‘লা-বেল’ বিউটি পার্লারে চুল-ফুল ঝাঁট দেয়। মুক্তাটার খুব আশা এই করতে করতেই ও পার্লারের আসল কাজগুলো শিখে যাবে, আস্তে আস্তে প্রোমোশন হতে হতে যাকে বলে স্কাই-ইজ-দা-লিমিট।

—কী রে মুক্তো, চুল ঝাঁটাতে চললি? —দেখা হলেই পেছনে লাগি।

—খবদ্দার মুক্তো-মুক্তো করবে না রুণুদা, আমার নাম মুক্তা, মুক্তামালা বুঝলে!

—দ্যাখ অন্যভাবে নিস না, একটু বিক্‌কৃতি সহ্য হবে না তো এইসব নাম রাখা কেন, বল? মুক্তা ডাকতে গিয়ে আপসে মুক্তো বেরিয়ে পড়ে।

—নামটা আমি রাখিনি, আমার বাবা রেখেছিল—মুক্তা মুখনাড়া দেয়, আর মুক্তাই রেখেছিল। এখন নিশ্চয় বাবাকে কৈফিয়ত দিতে ডাকবে না।

ঝটকা মেরে মুক্তা চলে যায়। মেয়েগুলোকে নিয়ে এই হল মুশকিল। ঠাট্টা-মশকরা বোঝে না। না হেসে কেমন করে বেঁচে থাকে, থাকতে পারে, সেটাই আশ্চর্য!

বিশুদার চেম্বার, মানে বৈঠকখানা ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে রোদ্দুর লম্বা হয়ে যায়। সানমাইকা-ঢাকা বেঞ্চির ওপরে নিশান, ফকির জ্যাঠা, রবি, অজয়, ভিকু, সঞ্জু, রতনাদের সঙ্গে বসে থাকি। কাগজগুলো ডাঁই করা থাকে টেবিলে। বাংলা কাগজ তো সব বটেই, ইংরেজিও এ দিকে যা-যা বেরোয় সব। বিশুদা নেয় না পায় জানি না। বেশিরভাগ দিনই টেবিলে একটাও পড়ে থাকে না। শরণার্থীরা যার যার মাপমতো তুলে নেয়। ঘর জুড়ে খালি খড়মড় আর খড়মড়। আজ একটা পাতা পেয়ে গেলাম।

‘বিরাটির কাছে গণ-পিটুনিতে দুই ডাকাতের মৃত্যু।’ দীপু বললে—ডাকাতগুলো কি পিটুনিতেই এমন রোগা হয়ে গেল? না, আগে থেকেই ছিল? এরা যদি ডাকাত হতে পারে তবে রুণু তুই আমি তো ডবল ডাকাত রে?

এইটা দীপুর বিশ্রী অভ্যেস। কোনও কাগজ নিজে পড়বে না। অন্য কেউ পড়লে আশপাশ থেকে ডিঙি মেরে মেরে পড়বে। কমেন্ট করবে।

‘মধ্য কলকাতার নামকরা স্কুলে টিচারের মারে ছাত্র হাসপাতালে। টিচার ফেরার। প্রিন্সিপালের সাফাই।’

দীপু বলল—মণিদের স্কুলেও একটা সিমিলার কেস হয়েছিল রে! খুব কমন হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।

আমি একটু অবাক হই। —মেয়ে-ইস্কুলেও মারে?

—তবে? হাত-টান ছিল মেয়েটার। বন্ধুদের বাকসো থেকে পয়সাকড়ি, কলম-টলম দেদার হাতাত। ধরা পড়ে বেধড়ক মার খেল। কান কালা হয়ে গিছল।

—এরাই আসল শ্রেণী-শত্ৰু বুঝলি?

—কারা?

—কারা আবার? নবম থেকে দশম, দশম থেকে একাদশে যারা এগোতে দেয় না! আমি হেসে ফেলি।

—তুই হাসছিস?

হাসিটা আমি চট করে গিলে ফেলি। দীপুর কেস খুব খারাপ। ওর ভাইটা মাধ্যমিক পাশ করতে পারেনি। কখন মাথা গরম হয়ে যাবে, ছুরি-ছোরা ভুঁকিয়ে দেবে, কিংবা ছারপোকা মারার ওষুধ… নাঃ ওর মনটা অন্যদিকে নিয়ে যাবার জন্যে বলি—বিড়ি খাবি?

হাতটা অটোম্যাটিক বাড়ায় দীপু, বলে—শেষ পর্যন্ত যাকে মন্দ বলি সেই গদাই আমাদের ভগবান হয়ে দাঁড়াচ্ছে বুঝলি দীপু? এ সব এমেলে ফেমেলে কিস্যু না।

আমি বুঝে যাই দীপুর কাছাকাছি থাকাটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এইখানে বসে যদি ও এ-সব বলে! উশখুশ করতে থাকি। জায়গাটা একবার অকুপাই হয়ে গেলে হয়ে গেল। চারদিকটা একটু দেখছি, কাকে একটু ঠেসে বসতে বলা যায়। দীপু ধোঁয়া ছেড়ে বলল—মা তো আজকাল মহাজনদের বাড়ি কাজ পেয়েছে। গদাইরা তো ছেড়ে দিল। মাসের চোদ্দো তারিখ, মা ভাবেনি পুরো মাসের মাইনেটা দেবে। দিল তো!

শুনে একটু অবাক হই! মহাজন মানে এ এস মহাজন। এ তল্লাটের নামকরা বড়লোক। আমাদের পাড়া পাঁচমেশালি। দু’-চার জন পয়সা-অলা লোক যে থাকে না তা নয়, কিন্তু আমাদের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে যে প্রাসাদটা দেখা যায়, সেটা আদিত্য শংকর মহাজনদের।

শুনতে পাই বেসিক্যালি ওদের পয়সা কয়লার। এখন, এখন বলতে বহুদিনই সে-সব বেচে-বুচে দিয়ে ইলেকট্রনিক গুডস-এ টাকা লাগিয়েছে। ওদের টিভি, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজ এ সবের খুব নাম। শিগগিরই নাকি ডাবল ডোর ফ্রস্ট-ফ্রি, কুইক-কুল ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার এ সব বাজারে আনছে। অ্যাড দেখি। মহাজনরা আদতে কোন স্টেটের জানি না, এখানে কেন পড়ে আছে তা-ও না। বাঙালিদের মতোই তো থাকে। তবে ধনী লোকেরা যেমন হয়, একটু ট্যাঁশ-মার্কা। সেই বাড়িতে দীপুর মা এনট্রি পেল কী করে? গদাইয়ের কাজ ছাড়লই বা কেন?

দীপুরা অবশ্য ভাল চক্কোত্তি বামুন। ওর বাবা হকারি করুন, আর রাত্তিরে স্টলের ঘর লোচ্চাদের ভাড়াই দিন, বামনাই মেনটেন করে গেছেন বরাবর। এত কষ্টেও ওদের বাড়ির সবারই চাল-চলনের একটা সুনাম আছে। দীপুর মা যখন কাজে বেরোন, কেউ বলবে না রাঁধুনি যাচ্ছে। বড় জোর অফিসের চাকুরে। মণি মুক্তা দুই বোনই থাকে ফিটফাট। মেয়েদের এই ক্ষমতাটা আছে। দীপুটাই পারে না। একমুখ দাড়ি। গা দিয়ে খড়ি উঠছে, হাওয়াই চপ্পল থপাস থপাস করে ঘোরে, ওর ভাইটাও আজকাল কেমন রাফ মতো হয়ে উঠেছে।

আমাদের এই পাড়াটা, মানে শুধু রসিক ঘোষের লেন নয়, আশেপাশে যতগুলো অলিগলি রাস্তা আছে পুরো কয়েক কিলোমিটার এলাকাটা ভেতরে-ভেতরে কেমন অনিরাপদ হয়ে গেছে—চোরা ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছে টের পাই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বাঃ বেশ শান্তশিষ্ট তো! শান্তিপ্রিয় লোকেদের শান্তিপূর্ণ জায়গা। কিন্তু সেটা শুধু মেক-আপ। আসলে পুরো জায়গাটা শামু আর কানা গদাই ভাগাভাগি করে নিয়েছে বলেই এমনি দেখায়। ও দিকে রিজভি হোটেল, বসাকদের গয়নার দোকান, সাউ ফার্নিচার এ সব শামুর দখলে। এ দিকে ভগৎ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কে এল ঘোষের ড্রাগিস্টস অ্যান্ড কেমিস্টস, ভজন সিং আর রফিকুলের ধাবা ইত্যাদি ইত্যাদি গদাইয়ের দখলে। শোনা কথা। কেউ জানে না। শামুরটা জানে। গদারটা ভেতরের খবর ছাড়া জানার উপায় নেই। সব মাস পয়লায় যে যার ভাগের টাকা দিয়ে দেয় তাই। শামুকে একদিন জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিলাম—হ্যাঁ রে, ফায়ার-আর্মস রেখে, দল মেনটেন করে তোদের পড়তা পোষায়? পুলিশের সঙ্গেও নিশ্চয়ই পার্সেন্টেজের ব্যবস্থা আছে। শামু চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়েছিল, হাতে খইনি ডলতে ডলতে বলেছিল—এবে ফোট।

জানতাম ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব শামু আমাকে দিতে চাইবে না। তবু একটা কৌতূহল আর কী! সবই তো ব্যবসা! ঠিক ব্যবসার নিয়ম মেনেই চলে। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। কড়ি আর তেলের মধ্যে যেটুকুন ফারাক সেইটুকুনই রোজগার। এই তো! সব রকম জীবিকা সম্পর্কেই আমার একটা কৌতূহল আছে। কীভাবে কী হয়! নিজের যেহেতু জীবিকা নেই, বিশেষ কোনও জীবিকার জন্যে তৈরি হওয়াও হয়ে ওঠেনি, তাই যা পাব আমাকে ধরতে হবে। আমি ক্রমাগত শূন্য হাতড়ে যাচ্ছি। ইন ফ্যাক্‌ট আমি রিকশঅলাদেরও জিজ্ঞেস করি—হ্যাঁ রে সিধু, মালিককে কত দিতে হয় রে?

—ওরে বাবা, রোজ তিরিশ টাকা।

—তোর কত থাকে?

অমনি সিধু ধানাই-পানাই শুরু করবে—এই রিকশা সারাই-ঝালাই লেগেই আছে, লাইনেও খুব পলিটিক্স দাদা, ওই কোনও রকমে চারটে পেট চলে যায়।

বিশুদার ওখানে আধঘণ্টাটাক থেকে কেটে পড়ি। যা লম্বা লাইন পড়েছে, আজকে কোনও চান্স নেই। এত লোকের এমেলের সঙ্গে কী কাজ থাকে এটাও আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। সবাই তো আমার মতো বেকার নয়। ধরুন ফকির জ্যাঠা, ইনি কেন আসেন? নিত্যদিন! গোড়ায় গোড়ায় ওঁর সামনে সিগ্রেট খেতাম না। তারপরে দেখলাম টূ মাচ হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ ওয়েটও করব, টেনশনে হাতে-পায়ে খিলও ধরবে, অথচ একটু ধোঁয়া ছাড়তে পারব না, ইঞ্জিন চলে? একদিন ধরিয়েই ফেললাম, ফকির জ্যাঠা কাগজটা আড়াল করে ধরলেন। আমার মনে হয় ফকির জ্যাঠা অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, কাগজ পড়তেই এখানে আসেন। এসব লোকের অখণ্ড সময়। হাজারটা কাগজ পড়ে, মিলিয়ে মিলিয়ে পড়বে, অথচ এতগুলো ছেড়ে একটা কাগজ কেনারও হয় তো সামর্থ্য নেই। কত লোকের যে কত তুচ্ছ কারণে, কত জরুরি কারণে এমেলের সই লাগে, রেকমেন্ডেশন লাগে! ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এই এমেলে লোকগুলো এতসব সামলায়ই বা কী করে! এ তো চব্বিশ ঘণ্টার চাকরি! নাঃ এমেলে এম পি-দের মাইনেকড়ি সত্যিই বাড়িয়ে দেওয়া দরকার।

যাক গে, রসিক ঘোষ লেনের মোড়ে ঝামেলাটা কেন হচ্ছিল আমাদের শান্তিপূর্ণ এলাকায়—জানতে হচ্ছে। নেই কাজ তো খই ভাজ।

অতএব সাইকেল বাই। এর থেকেই বোধহয় বাইসাইকেল শব্দটা এসেছে। বাইসাইকেল তৈরির যুগেও তা হলে সাহেবরা মেঠো বাংলা জানত! টিকটিকি দেয়াল বাইছে, মানুষ গাছ বাইছে, মজুর বাঁশ বাইছে। আর বেকার সাইকেল বাইছে। তা ঝামেলা দেখি এখনও চলছে। জম্পেশ ভিড়। ডিঙি মারি।

আই ব্বাস! জগাদা আর অরবিন্দদায় লেগে গেছে। সামনে একটা কর্পোরেশনের বাই-ইলেকশন আছে বোধহয়। সেই জন্যেই কী! জগাদা হল গিয়ে লাল-পার্টির স্লিপার, মানে স্লিপিং পার্টনার। অর্থাৎ একটা সদস্যপদ আছে, তার জন্যেই পায়ও নিয্যস কিছু। পাড়ায় কোনও কাজিয়া হলেই লোকে জগাদার কাছে ছুটে থাকে, পরিষ্কার জেনে শুনে যে কিস্যুই হবে না। জগাদা এ এলাকার একটা জগদ্দল ভগ্নপ্রায় স্তূপের তেত্রিশ শরিকের একজন। ঠাকুর্দার আমলে যখন পয়সাকড়ি ছিল তখন জগাদারা বিশুদ্ধ কংগ্রেস ছিল, মনে-প্রাণে, নিবেদিত-প্রাণ একেবারে, অতুল্য ঘোষের চ্যালা ছিলেন জগাদার ঠাকুর্দা। তারপর তালপুকুরে ঘটি ডুবতে ডুবতে কাদায় একেবারে গিঁথে যেতে এবং বামফ্রন্ট চতুর্থবার ক্ষমতায় আসতে জগাদা-বলাদারা আপাদমস্তক লাল হয়ে গেল। একেবারে এনটায়ার এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি। তারপর বছর দু’চার আগে এক কংগ্রেস ঠিকেদারকে পেঁদিয়ে রাতারাতি লাল সেলাম। অর্থাৎ কিনা পার্টির সক্রিয় কর্মী। এখন, সবাই জানে ঠিকেদারদের কোনও রাজনৈতিক চেতনা নেই, যেমন গুণ্ডাদেরও নেই। তাদের কোনও বিশেষ দলফল থাকে না। তারা নিজেরাই একেকটা দল। স্বভাবতই এই ঠিকেদারটাও কংগ্রেস ছিল না, ছিল জাস্ট একটা রামখচ্চর চাকলাদার, ফার্স্ট নেমটা ভুলে গেছি। গুহমজুমদারদের বাড়ি ভেঙে মাল্টিস্টোরিড-এর ঠিকে নিয়েছিল লোকটা। তা এমন ‘ম্যাটার’ দেয় যে এক রাত্তিরে নির্মীয়মাণ পাঁচিল ভেঙে পড়ে দুটি ভিখিরি একেবারে চেপ্টে যায়। জগাদা-বলাদা এই সুযোগে ইন নিয়ে নেয়। ভিখিরি দুটি সঙ্গে-সঙ্গে লাল হয়ে যায়, ঠিকেদার সাদা এবং সে মার খায়। শামু আমাকে পরে বলে মারটা লোক দেখানো ছিল। সিনেমায় যেমন হয় আর কী! চাকলাদারকে নিয়ে দু’ ভাই নাকি ওই ফাঁকে একটু রিহার্স্যালও দিয়ে নেয়। জনতার হাতে ধোলাই হলে চাকলাদার তো পুরোপুরি ফর্সা হয়ে যেত, সেই বুঝে সে আগেভাগেই জগা-বলাকে নেতৃত্বে ফিট করে দেয়। জগা-বলা রক্তচক্ষে ‘মজদুর হত্যার বদলা চাই ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলতে বলতে চাকলাদারকে এক পক্কড় মেরে বা মারার ভান করে থানায় নিয়ে যাবার আগে ডক্টর আসিফ আনোয়ারের নার্সিং হোমে নিয়ে যায়। তবে নাকটা নাকি সত্যিই ভেঙেছিল। ইয়া লাশ মাথামোটা বলাদা ঠিকঠাক তাক করতে পারেনি। মহলারও কিছু কমি ছিল। ডাক্তার আনোয়ারের সূত্রেই এত খবর শামুর জানা। তা সেই থেকেই জগাদা-বলাদা স্পেশ্যালি জগা আমাদের পাড়ার লাল দুর্গ। কিছু হলেই আরশুলার মতো শুঁড় নাড়ে। এখন তাকে লড়াই বলো তো লড়াই, সমাজসেবা বলো তো সমাজসেবা, সেশন জজগিরি বলো তো সেশন জজগিরি।

আর অরবিন্দদা? ওকে আমরা নিজেদের মধ্যে শ্রীঅরবিন্দ বলি। কিন্তু দেওয়ালেরও কান আছে, তাই নামটা অরবিন্দদা জেনে গেছে। তারপর থেকে ওর রোয়াব আরও বেড়ে গেছে। সাদা ধবধবে পায়জামা পাঞ্জাবি। গলায় সোনার হার, গায়ের চামড়ায় ঘি-মাখনের চেকনাই, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল, অরবিন্দদা আপাতত কংগ্রেস করছে। জগাদা যদি স্লিপিং হয়, অরবিন্দদা তা হলে ভেরি মাচ জাগিং। একজন রুলিং পার্টির পাত্তা-না-পাওয়া ফেলটুস, অন্যজন অপোজিশনের মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। যদ্দূর জানি জনান্তিকে অরবিন্দদা জগাদাকে করুণা করে থাকে—আহা জগাটা কিছু করতে পারলে না। আরে বাবা শুধু অ্যাম্বিশনে কি আর কিছু হয়! এলেম চাই, ব্যক্তিত্ব চাই।

জগাদার সরু গলার ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই কিছুক্ষণ শুনেও কিচ্ছু বোধগম্য হয় না। অরবিন্দদা মুখ খিঁচিয়ে বলছে শুনি—যা না যা, তোর আলিমুদ্দিনে যা, তড়পাচ্ছিস কেন? তড়পানোটা বন্ধ কর। ঢক থাকে তো যা! মুরোদ তো জানা আছে। বলে অরবিন্দদা একটা অশ্লীল ঝুমুর নাচের পোজ দিল। তেলে-বেগুনে জ্বলে জগাদা মারমুখো কুকুরের মতো কয়েক পা তেড়ে যায়। ‘তেখলেন তো? তেখলেন তো?’ জগাদা সব সহ্যি করতে পারে, এই আধা ক্যাপিটালিস্ট সিসটেমে সংসদীয় গণতন্ত্রের ফ্রেমে কাজ করতে করতে জগাদা অনেক অনেক সহ্যি করতে শিখেছে কিন্তু অপ-সমস্কৃত সে কিছুতেই সইবে না। প্রসঙ্গত জগাদা এইচ এস ফেল, অরবিন্দদা বলে বেড়ায় সে বি এ, এল এল-বি। কিন্তু কবে কোথা থেকে যে সে এ-সব পাশ করে এসেছে তা পাড়ার কেউই জানে না। গেঞ্জির কল আছে ওদের। চলন-বলন কথাবার্তাতে একটা গেরেম্ভারি ভাব। সেটা চেহারার জন্যে না তথাকথিত এল এল-বি’র জন্যে না গেঞ্জির কলের জন্যে তা আমরা আজও বুঝতে পারিনি। তবে ওর মোটা ফর্সা গেরেম্ভারি চেহারায় নাচের পোজটা রিয়্যাল অশ্লীল দেখাল। অশ্লীলতার একটা চুম্বুকী টান আছে আপনারা স্বীকার করবেন নিশ্চয়ই। তো সেই টানে আমি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যাই, যদি আরও পোজ-টোজ দেয়। তা সে গুড়ে বালি! স্যাকরার ঠুকঠাক, কামারের এক ঘা। অরবিন্দদা জানে কীসের ঠিক কতটা ডোজ দিতে হয়। আমাদের মতো ল্যাবাকান্ত তো আর নয়! হতাশ হয়ে আমি সাইকেলে উঠে পড়ি। আই বাই সাইকেল। ন’টায় চা-মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছি এখন বারোটার কাছাকাছি। সূর্য মাঝ আকাশে গনগন করছে। পেটের মধ্যে ছুঁচোবাজি। ফার্মাসি থেকে ওষুধগুলো তুলে বাড়ি ফিরব। এঃ। রিন্টিটার জন্যে দুটো লজেন্স কিনে নিই। নাকের বদলে নরুন, সচিনের বদলে লজিন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22
Pages ( 1 of 22 ): 1 23 ... 22পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress