Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিন পুলিশের গল্প || Tarapada Roy

তিন পুলিশের গল্প || Tarapada Roy

তিন পুলিশের গল্প

মাননীয়া সম্পাদিকা মহোদয়া আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। পুজোয় বড় করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখতে হবে, না হলে নাকি পুজো সংখ্যার পক্ষে মানানসই হবে না।

কিন্তু কোনও কিছু বড় করে লিখতে গেলে আমার কলমে কালি শুকিয়ে যায়, ডান হাতে কবজিতে ব্যথা হয়, বুড়ো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়।

সুতরাং প্রাণের দায়ে রচনাটি তেমন বড় না করে দুই থেকে তিনে যাচ্ছি। তবে এবারের বিষয় খুব জবরদস্ত। রীতিমতো পুলিশ নিয়ে এবারের এই রচনামালা, এই মারাত্মক বিষয় নিয়ে রসিকতা করতে রীতিমতো ভয় ভয় করছে। কিন্তু এই পুজোর বাজারে এর কমে আর কী করা যেতে পারে।

গল্পগুলোর প্রথমে একটা দুঃখের কাহিনী বলে নিই। বছর কয়েক আগে, আমি তখন হুগলিতে, সেখানে এক দারোগাবাবু আমার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, ‘দেখুন, লোকে আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না।’

আমি বলেছিলাম, ‘সে কী? তা কেন হবে?’

দারোগাবাবু বললেন, ‘আজকে সকালবেলার কথাটাই তা হলে বলি আপনাকে। এক পাড়ায় একটা ছোটখাটো গোলমালের এনকোয়ারি করতে গেছি। সেই সূত্রে পাড়ারই এক ভদ্রলোকের বাসায় যেতে হল। সঙ্গে ওখানকারই আরও দু’জন ভদ্রলোক। সেই বাসায় গিয়ে বাইরের দরজায় বেল দিয়েছি। সেই বাড়ির কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিয়ে আমাদের দেখে সেই দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়ির মধ্যে খবর দিতে গেল। ভিতরের ঘরেই বাড়ির কর্তা ছিলেন, শুনলাম তাঁকে কাজের মেয়েটি বলছে, বাইরে দু’জন ভদ্রলোক আর একজন পুলিশ এসেছে।’

অতঃপর দুঃখের গল্পের পরে হাসির গল্প।

পুলিশের জমাদার এক ব্যক্তিকে ধরেছেন। লোকটি রাস্তায় মাতলামি করছিল।

জমাদারজি তাকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নাম তোমার?’

লোকটি একে মাতাল তার ওপরে তোতলা এবং দেহাতি কী যে অংবং নাম বলল জমাদার সাহেব মোটেই বুঝতে পারলেন না।

জমাদারজি তখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লেখাপড়া জানো? পড়াশুনো করেছ?’

অনেক তোতলামি করে লোকটি যা বলল তার মানে দাঁড়াল, সে লেখাপড়া জানে না কিন্তু নাম সই করা শিখেছে।

জমাদারজির এতেই কাজ হবে। নামটা জানতে পারলেই লোকটিকে চালান করে দেওয়া যাবে। তিনি এক টুকরো কাগজ আর পেনসিল লোকটিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে এখানে। তোমার নাম লেখো।’

লোকটি সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে পেনসিলটা ধরল তারপর পুরো পাতা জুড়ে লম্বা, হিজিবিজি কয়েকটি টান দিল।

জমাদারজি অনেক চেষ্টা করেও সেই লেখার পাঠোদ্ধার করতে পারলেন না, কোনও একটি অক্ষরও স্পষ্ট নয়। এ কী নাম সইরে বাবা।

অনেক চেষ্টা করার পর ক্লান্ত জমাদারজি লোকটিকে বললেন, ‘এখানে কী লিখেছ, পড়ে দাও দেখি।’

এবার লোকটি বোকার মতো হেসে ফেলল, তারপর বলল, ‘পড়ব কী করে? আপনাকে যে আগেই বললাম আমি মোটেই লিখতে পড়তে জানি না।’

এরপর সেই বেনামা আসামিকে নিয়ে জমাদার সাহেব কতটা নাজেহাল হয়েছিলেন তার বিস্তৃত বর্ণনার প্রয়োজন নেই। তবে এটা জানি যে সাধারণত আসামির নাম নিয়ে পুলিশ খুব একটা মাথা ঘামায় না। সব সময় আসামিরা সত্যি নাম বলেও না। আর নাম না মিললে আসল নাম জানার পরে আগের নামটা ওরফে করে দিলেই হবে।

তা ছাড়া অনেক কাল আগে একটা গল্প শুনেছিলাম, সে গল্পটাও সম্ভবত খুব বানানো নয়।

সাতকড়ি নামে এক ব্যক্তির নামে একটি ওয়ারেন্ট বেরোয়। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে খুঁজে পায়নি। কিন্তু পুলিশ সেটা পুষিয়ে নেয় সেই এলাকারই পাঁচকড়ি এবং দুকড়ি নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। পাঁচ এবং দুই মিলে সাত, সাতকড়ির ওয়ারেন্টে এই দু’জনকে চালান দেওয়া হয়।

এরই পাশাপাশি একটু আধুনিক গল্পের কথা মনে পড়ছে। আজকাল পলাতক অপরাধীর ফটো, হাতে আঁকা ছবি মিলিয়ে পলাতক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা হয়।

বহু নিরপরাধ লোক এর জন্যে যথেষ্ট বিপদে পড়ে। শুধু ফটো বা ছবির চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বলে অনেককে থানায় বা লক-আপে যেতে হয়। হয়তো শেষে সে ছাড়া পায়, কিন্তু হয়রানি কিছু কম হয় না।

যে যা হোক, বাঘে ছুঁলে যে আঠারো ঘা সে সবাই জানে। এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। বরং ফটো মিলিয়ে আসামি ধরার প্রচলিত গল্পটা বলি।

যখন কোনও পলাতক আসামির ফটো প্রচার করা হয় তখন চেনার সুবিধের জন্যে সম্ভব হলে মুখের বাঁ এবং ডানদিকের প্রোফাইল এবং সামনাসামনি ছবি দেওয়া হয়, এতে পুরোটা মিলিয়ে লোকটিকে শনাক্তকরণের সুবিধে হয়।

দু’দিকের প্রোফাইল এবং সামনাসামনি এই তিনটি ফটো এক বাঘা দারোগার হাতে পৌঁছায়। হেড কোয়ার্টারের ধারণা ওই দারোগা সাহেবের থানার এলাকাতেই আসামি লুকিয়ে আছে।

পরের দিনই তিন ব্যক্তিকে কোমরে দড়ি বেঁধে দারোগাসাহেব হেড কোয়ার্টারে এসে বড় সাহেবকে সেলাম দিয়ে জানালেন, ‘স্যার তিন ব্যাটাকেই ধরেছি।’

তিন পুলিশের গল্পের কথা বলেছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই তিনের অধিক গল্প হয়ে গেল, লেখা কিন্তু বড় হল না। তাই আমাকে আরেকটু লিখতে হচ্ছে।

আমার এই শেষ গল্পের ঘটনাটি মাত্র দু’দিন আগে ঘটেছে।

মধ্য ভাদ্রের গনগনে দুপুর। পরপর দু’দিন দু’রাত্রি মেঘবৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়ার পরে একেবারে যাকে রাঢ়ভূমিতে বাবা-খাই, মা-খাই রোদ্দুর বলে সেই চাঁদিফাটা রোদ উঠেছে কলকাতায়।

আগস্টের চতুর্থ সপ্তাহের দুপুর দুটো। বাৎসরিক গ্রাফে এটাই কলকাতায় মিটিং-প্রসেশন মিছিলের মাহেন্দ্রক্ষণ। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে প্রায় দশ মিনিট একটি মাঝারি মাপের মিছিলের ধাক্কায় ট্রাফিক আটকিয়ে রয়েছে।

সাধারণত মোটর সাইকেলের আরোহীরা এর মধ্যেই পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিন্তু আজকের মিছিলের প্রহরা খুব কড়া। মিছিল অতিক্রম করে একটি মাছি পর্যন্ত গলতে পারছে না।

যেমন হয়, মিছিলে অবরুদ্ধ ট্রাফিকের ঠিক প্রথম ভাগেই রয়েছে বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি, প্রাইভেট গাড়ি ইত্যাদির ফাঁক দিয়ে নাক বাড়িয়ে কয়েকটি স্কুটার, মোটর সাইকেল, টু হুইলার।

এরই মধ্যে একটা ভারী, প্রাচীন, পাকাপোক্ত মোটর সাইকেলে বসে আছেন রমারঞ্জন। তিনি একজন পাকা মোটর সাইক্লিস্ট, বয়েস বাড়বার আগে মাথার চুলগুলো পেকে ধবধবে হয়ে গেছে। এখন এই মুহূর্তে, বিবাহ-বিচ্ছেদ জনিত খোরপোষের মামলায় আংশিক জয়লাভ করে, গভীর উত্তেজনা সহকারে বর্তমান বান্ধবী শ্রীমতী জয়প্রভাকে তাঁর রবীন্দ্র সরণির পোদ্দার কোর্টের অফিসে রমারঞ্জন খবরটা দিতে যাচ্ছিলেন।

পথে আটকিয়ে গেলেন। এ রকম আটকিয়ে যাওয়া রমারঞ্জনবাবুর এই প্রথম নয়। তাঁর প্রথম যৌবনের এবং মধ্য যৌবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়েছে মোটর সাইকেলের সিটের ওপর বসে। আজও তিনি ধৈর্য ধরে সিটের ওপরে স্থির হয়ে বসেছিলেন যতক্ষণ না মিছিলটা পার হয়ে যায়।

সব প্রতীক্ষারই অবসান আছে। মিছিলও এক সময় এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের গাড়িগুলো অস্থির হয়ে উঠল। ড্রাইভাররা এক সঙ্গে সমবেত ভাবে অধৈর্য হয়ে উচ্চনিনাদে তাদের গাড়িতে হর্ন বাজাতে লাগল।

কিন্তু চৌরাস্তার দু’দিকের, মানে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের পথ তো একসঙ্গে খুলে দেওয়া যায় না। রমারঞ্জনের দুর্ভাগ্য, ট্রাফিক পুলিশ তাদের দিকটা আগে না ছেড়ে পার্ক স্ট্রিট মেয়ো রোডের ট্রাফিক আগে ছেড়ে দিল।

এই অবিচারে এদিকের দুই পাশের গাড়িগুলো উদ্দাম প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। শুধু গাড়ির হর্ন বাজানো নয় তারা চেঁচামেচি, গালাগাল শুরু করে দিল। বলা বাহুল্য সবই পথে কর্তব্যরত ট্রাফিকের পুলিশ এবং হোমগার্ডের বিরুদ্ধে।

তালপাকা গরমে এতক্ষণ তীব্র রোদে রাস্তায় আটকিয়ে থেকে চালকদের মাথা গরম হয়ে গেছে। অন্য দিকে রাস্তায় ঘামতে ঘামতে, রোদে পুড়তে পুড়তে ডিউটিতে ব্যস্ত পুলিশদেরও মাথা গরমে গনগন করে জ্বলছে।

এই সময়ে কী একটা খারাপ গালাগাল শুনে আর সহ্য করতে না পেরে ঠিক সামনের ট্রাফিক সেপাই এসে রমারঞ্জনকে ধরল।

রমারঞ্জন কিন্তু গালাগাল দেননি, অত নিম্নমানের, নিচু রুচির মানুষ তিনি নন। কিন্তু কেন যেন সেই ভোজপুরি সেপাইয়ের সন্দেহ হল যে সমস্ত খিস্তির উৎস হলেন রমারঞ্জন।

ইতিমধ্যে রমারঞ্জনের একটা গাফিলতিও সেপাই পেয়ে গেছে। রমারঞ্জনের মাথায় হেলমেট নেই। মোটর সাইকেল আরোহীদের শক্ত, গোল টুপি মাথায় দেওয়া আবশ্যিক, অন্যথায় এটি একটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

সুতরাং সেপাই এসে রমারঞ্জনকে ধরল, লোকটাকে এই অজুহাতে শিক্ষা দেওয়া যাক।

কিন্তু হেলমেট ছাড়া রাস্তায় বেরনোর মতো বোকা রমারঞ্জন মোটেই নন। এই গরমে মাথার হেলমেট রোদে তেতে গেছে। তাই তিনি সেটা খুলে দুই হাঁটুর মধ্যে রেখেছেন।

সেপাই এসে রমারঞ্জনকে ধরল; ‘আপনার মাথায় কিছু নেই কেন?’ তাঁর শূন্য মস্তকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল সে।

রমারঞ্জন নির্বিকার ভাবে কোমরের সামনে রাখা হেলমেটটা দেখালেন।

না, তা চলবে না। আইনে বলা আছে মাথায় হেলমেট রাখতে হবে।

রমারঞ্জন বললেন, ‘আধঘণ্টা আটকিয়ে আছি। গাড়ি চালানোর সময় মাথায় টুপি পরে নেব।’

সেপাই বলল, ‘তা হবে না। আইন ভঙ্গ হয়েছে, জরিমানা দিতে হবে।’

রমারঞ্জন চুপ করে রইলেন।

এবার ট্রাফিক পুলিশের মোক্ষম অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ হল, ‘দেখি আপনার লাইসেন্স।’

রমারঞ্জন লাইসেন্স দেখালেন না। বরং উলটে আইন রক্ষককে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার মাথায় কী আছে?’

সেপাইটি আরও রেগে গেল।

রমারঞ্জন বললেন, ‘আপনার মাথায় কিছু নেই। একদম ফাঁকা।’

অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে রমারঞ্জন এই কথা বলায় সেপাইটি নিজের মাথায় হাত দিয়ে দেখল, তারপর বলল, ‘এই তো টুপি রয়েছে।’

‘না কিছু নেই। একদম ফাঁকা।’ এই বলে রমারঞ্জন মোটর সাইকেলটা হুশ করে ছেড়ে দিলেন। এদিকের ট্রাফিক এই মাত্র খুলে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *