ড্রাকুলা
(অনুসারী সময়-লিপি অরুণাভ দত্তগুপ্তের পার্থিব পারিপার্শ্বিকে লেখা কিছু মানসিক চিন্তার প্রতিফলন, অপার্থিব চিন্তার অনুপ্রবেশের সন্ধিক্ষণে যার সমাপ্তি।)
প্রথম দিন : সূত্রপাত
ব্র্যাম স্টোকারের কুখ্যাত (?) ড্রাকুলা আমি পঁয়তাল্লিশের কাঠ-সিঁড়িতে দাঁড়িয়েও পড়িনি শুনে কিঞ্চিৎ মূল্যবান উপদেশ এবং কৃপাবর্ষণ করে (ঈশ্বর, এর এই অনবধানজনিত অপরাধকে ক্ষমা করো বাণী দানও বাদ যায়নি) অভিজিৎ এক কপি বই আমাকে কিনেই দিয়েছিল। দ্বিধা এবং কৌতূহলের দ্বৈরথকে মস্তিষ্কে অনুভব করে সন্ধের মুখেই বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। ফিরে এসে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে শমিতাকে ডেকে নিয়ে এলাম। খাটে পাশাপাশি বসে বাদামি কাগজে মোড়া প্যাকেটটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম, বলো তো, এতে কী আছে?
শমিতা যথারীতি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জবাব দিল, ডায়েরি আমার জন্যে।
বছরের শুরু। অতএব শমিতার দোষ নেই।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাবধানতা দেখিয়ে প্যাকেটটা খুলে বইটা বের করলাম। তুলে ধরলাম ওর চোখের সামনে। প্রচ্ছদের বিবর্ণ মেয়েটির চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে শমিতা বলে উঠল, তুমি আর আমি যে-সিনেমাটা দেখেছিলাম সেই বইটা?
আমি অভিজিতের কাছ থেকে আহরিত জ্ঞানের স্মৃতি থেকে বললাম, না, সেটা ড্রাকুলা চরিত্রের ওপর নির্ভর করে ওয়ার্নার কোম্পানির লেখা গল্প। আর এটা ব্রাম স্টোকারের লেখা, এক এবং অদ্বিতীয় ক্ল্যাসিক ড্রাকুলা।
শমিতা বলে উঠল, যত সব গাঁজাখুরি গপপো।
হঠাৎ কী হল জানি না, মনে হল আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শিরা-উপশিরা টনটন করে উঠল। মাথার মধ্যে ঘটে গেল হাজার-হাজার মেগাটনের বিস্ফোরণ। খাট ছেড়ে কাঁপতে কাঁপতে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে শমিতাকে লক্ষ করে সংযত স্বরে বলতে চেষ্টা করলাম, গাঁজাখুরি? অমন ছেলেমানুষের মতো মন্তব্য আর কোরো না। এবারের মতো ক্ষমা করলাম।
আমার গম্ভীর স্বরে শমিতা অবাক হয়ে গেল, থতোমতো খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ আমার, আমার হাতের বইটার দিকে তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মাথার চুলে হাত চালিয়ে বইটা খাটে নামিয়ে রেখে এক গ্লাস জল ঢেলে নিলাম কুঁজো থেকে। ঢকঢক করে গিলে ফেললাম। খাটে ফিরে এসে বসতেই ড্রাকুলার প্রচ্ছদে চোখ পড়ল। প্রথমে লক্ষ করিনি, এখন দেখলাম, মেয়েটির উন্মুক্ত কাঁধে রুপোলি নখের একটা হাত। হাতের মালিক পশ্চাৎপটের অন্ধকারে অদৃশ্য।
ড্রাকুলা-সংক্রান্ত গোটা চার-পাঁচ ছবি আমি দেখেছি। শমিতা বিয়ের পরে আমার সঙ্গে একটা ছবিই দেখেছে–আর সর্বক্ষণ আমার কানের কাছে বিড়বিড় করেছে, উদ্ভট-আজগুবি কল্পনারও একটা সীমা আছে। এসব ছেলেভোলানো গল্প ইত্যাদি। সুতরাং ড্রাকুলা-সংক্রান্ত পরবর্তী ছবিগুলোতে আমি একাই গিয়েছি। মনে-মনে কেমন একটা রোখ চেপে গিয়েছিল, শমিতাকে কাউন্টের অস্তিত্বে বিশ্বাস করাবই। রোখের কারণ বলতে পারি না।
ছোটবেলাকার কয়েকটা কথা আমার বেশ মনে পড়ে। ঘটনাগুলো ছোটখাটো হলেও ভুলতে পারি না।
একবার আমাদের গ্রামে নররাক্ষস এসেছিল খেলা দেখাতে। ধবধবে একটা সাদা পায়রা নিয়ে লোকটা কাঁচাই ছিঁড়ে-ছিড়ে খাচ্ছিল, আর খেতে-খেতেই রক্তাক্ত মুখে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করছিল। তার পাশের লোকটি বারবার চেঁচিয়ে বলছিল, বাবুমশায়েরা, ইয়া আর যে পারিব, তারে আমরা দশ টাকা দিব। বাবুমশায়েরা– আমি আর থাকতে পারিনি। দশ বছরের শরীরটাকে দর্শক বৃত্তের পরিধি ছাড়িয়ে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি পারব। এবং আমার সেই পুঁচকে সাহসের ঢঙ দেখে দর্শক তথা কুশীলব মহলে প্রচণ্ড অট্টহাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। তখন অপমানে ক্ষোভে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল। অন্ধের মতো ছুটতে শুরু করেছিলাম বাড়ির দিকে।
বাড়ি ফিরে মা-কে সাতকাহন করে সে-ঘটনা শুনিয়েছি। মা-ও যথারীতি সান্ত্বনা দিয়ে আমাকে ভুলিয়েছে। কিন্তু সেদিনকার অপমান আমি আজও ভুলিনি।
অভিজিৎ আমার ছোটবেলার বন্ধু। একমাত্র ওরই সঙ্গে এই বয়েসেও আমার যোগাযোগ আছে। মনে পড়ে, সন্ধের আঁধারে যখন আমরা লুকোচুরি খেলতাম, তখন আমার লুকোনোর প্রিয় জায়গা ছিল বরাটদের ভাঙাচোরা প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। কারণ, বাদুড়, পাচা এবং অন্ধকার (তা ছাড়া না জানি আরও কত কী!)–এই তিনের ভয়ে আমার অসমাসহসী বন্ধুবান্ধবরাও কেউই ভাঙা বাড়িতে ঢুকত না। অন্ধকারে গাছের আড়াল দেওয়া কাঁচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওরা তারস্বরে চিৎকার। করত, অরুণ–অরুণ-বেরিয়ে আয়!
সুতরাং অবশেষে আমারই জয়লাভ।
এই যে অন্ধকার-আসক্তি, এটা ক্রমশ একটা নেশার মতো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু তবুও সবসময়ই মনে হয়েছে অন্ধকার আমার প্রত্যাশা পূর্ণ করেনি, আমাকে সে ফাঁকি দিয়েছে। সেইজন্যে মাঝে-মাঝে অন্ধকারের ওপর প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে। আমাকে যে-সুযোগ (কী সুযোগ জানি না) থেকে সে বঞ্চিত করেছে, সেই সুযোগের ফলকে আয়ত্ত করে ইচ্ছে করে, চিৎকার করে বলি, তোমরা দ্যাখো, আমি প্রাক্তন পার্থিব শ্রীঅরুণাভ দত্তগুপ্ত…।
ক্রি-রি-রিং–ক্রি-রি-রি-রিং—
চমকে উঠলাম। টেলিফোন।
এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম।
৪৫-৯৫৯৩। অরুণাভ দত্তগুপ্ত বলছি।
শালা, তোর বাবা বলছি।-ও-প্রান্ত থেকে অভিজিৎ সান্যালের স্বর ভেসে এল, বসে-বসে কী করছিস? ড্রাকুলা?
এক পলক চোখ রাখলাম বইটার ওপর। বললাম, না, এখনও শুরু করিনি।
অপদার্থ! তা হলে শোন, একটা কথা বলি! ঠিক রাত বারোটায় বইটা শুরু কর। কিন্তু ঝট করে শেষ করিস না যেন। বেশ তারিয়ে-তারিয়ে নেশা করার মতো রোজ পড়বি। বুঝলি?
হুঁ।
যাকগে, কাল ক্লাবে আসছিস তো? একটু খাওয়াটাওয়া যাবে।
ঠিক আছে, যাব। রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। এগিয়ে এসে ড্রাকুলা বইটা হাতে তুলে নিলাম। মনে মনে উচ্চারণ করলাম, আজ রাত বারোটায়…মাত্র আর কয়েক ঘণ্টা বাকি…।
প্রথম রাত : জোনাথান হার্কার
দেওয়ালঘড়ির ঘণ্টার শব্দে লুপ্ত হল শমিতার গভীর নিশ্বাসের ছন্দ। রাত বারোটা। সুতরাং মাথার কাছে বেডসুইচ টিপে জ্বেলে দিলাম রিডিং ল্যাম্প। আয়েশ করে গা এলিয়ে হাতে তুলে নিলাম বইটা বুকের মধ্যে তৃষ্ণার তরঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠল।
প্রথম পর্বে জোনাথান হার্কারের কাহিনি আমাকে মুগ্ধ করল। কিন্তু যেখানে সে কাউন্ট ড্রাকুলাকে বেলচা দিয়ে আঘাত করল, সেখানে মনে হল আমার সমস্ত শরীর যেন ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। রক্তস্রোত হয়ে উঠল চঞ্চল।
চট করে উঠে বসলাম। ঘুমন্ত শমিতাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে শুরু করলাম।
শমি–শমিতা।
কী?–ঘুমজড়ানো স্বরে ও উত্তর দিল। তারপর পাশ ফিরে আবার মাথা গুঁজে দিল বালিশের মধ্যে।
আমি ক্ষান্ত হলাম না। আবার ওকে আঁকুনি দিয়ে ডাকলাম। এবারে ও উঠে বসল। ঘড়িতে রাত দুটোর ঘণ্টা বাজল।
কী, ব্যাপার কী?–একটু রুক্ষ স্বরেই প্রশ্ন করল ও।
আমি হাতের বইটার দিকে ইশারা করে বললাম, তোমার গাঁজাখুরি শব্দটা এবারে তুমি পালটাতে বাধ্য হবে। জানো, বইটার প্রথম পঞ্চাশ-ষাট পৃষ্ঠায় কী লেখা আছে?
শমিতা আমার মুখের দিকে হাঁ করে বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। রাত দুটোয় কোনও স্বামী যে-কোনও স্ত্রী-কে ঘুম ভাঙিয়ে এই ধরনের উদ্ভট প্রশ্ন করতে পারে তা সম্ভবত ওর কল্পনাতেও আসেনি।
আমি হাসলাম। বললাম, দ্যাখো, এই জায়গায় পড়ে দ্যাখো।
এবং একইসঙ্গে বইয়ের একটা বিশেষ পাতা (যে-পাতায় লেখা আছে, কাউন্ট ড্রাকুলা রাতের অন্ধকারে কালো পোশাকে শিকার করতে বেরোচ্ছে–টিকটিকির মতো প্রাসাদের দেওয়াল বেয়ে…) ওর বিস্মিত চোখের সামনে মেলে ধরলাম।
এই রাত দুটোয় রসিকতা করার কোনও মানে হয়?শমিতার সুরে ঈষৎ কাঠিন্যের পরশ।
সব জিনিসকে রসিকতা বলে মনে কোরো না।
আমি এখনও তোমার মতো পাগল হইনি!বলে শমিতা শুয়ে পড়ল।
ওই একটা মুহূর্ত আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কী ঘটত জানি না। কিন্তু সামনের আয়নায় আমি আমার নৃশংস প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম, এবং সংযত হলাম। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আলো নিভিয়ে বইটাকে মাথার কাছে রেখে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম সহজে এল না। বিপন্ন জোনাথানের সঙ্গে কাউন্টের মানসিক সংঘাতের মুহূর্তগুলো শ্লথগতি চলচ্চিত্রের মতো তারিযে-তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম। নাঃ, অভিজিৎ সান্যাল আমার কাছ থেকে অন্তত একটা ধন্যবাদ আশা করতে পারে।
দ্বিতীয় দিনঃ বিপন্ন সকাল
সকালে ঘুম ভাঙল এক আকস্মিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে। স্বপ্ন দেখছিলাম কি না জানি না, মনে হল বুকের কাছটা যেন হঠাৎই শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। এক অদ্ভুত চোরাবালিতে আমার শরীরটা ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইছে। কোনওরকমে চারপাশের জমি আঁকড়ে আমি মাথাটাকে ওপরে ভাসিয়ে রাখতে চেষ্টা করছি। বিস্ময়াহত দৃষ্টি যখন মেলে ধরেছি, তখন আর সইতে পারিনি। এক শীৎকৃত আর্তনাদে মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে উঠলাম। মাথার কাছের জানলা (বিশ্বাসঘাতক কোথাকার!) দিয়ে সূর্যের প্রখর রোদের এক পেনসিল-প্রমাণ রশ্মিরেখা এসে আছড়ে পড়েছিল আমার চোখের ওপর। সেই আলো আমাকে যেন হঠাৎই বেসামাল করে দিয়েছে।
প্রকৃতিস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। অবশেষে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে করমচা-লাল চোখজোড়াকে পরখ করছি, তখনই আমার পাশে ভেসে উঠল শমিতার প্রতিবিম্ব।
কী হয়েছে?
দেওয়ালঘড়ি ঢং-ঢং শব্দে সকাল নটার সঙ্কেত ঘোষণা করল। পলকের জন্যে চমকে উঠেছিলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিলাম, হঠাৎ কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
নিশ্চয়ই এই বইটা পড়ার জন্যেই হয়েছে। শমিতা দৃঢ় স্বরে বলল। এবং অপার-অবাক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কারণ, আমি তখন উন্মত্তের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছি।
আধ মিনিটের পরও আমার হাস্যকর অবস্থার পরিবর্তন না দেখে শমিতা চলে গেল নিজের কাজে হয়তো রাগ করেই। কিন্তু কী করে ওকে বোঝাই, বইটার সঙ্গে আমার যে-আত্মীয়তার সম্পর্ক, তাতে বই পড়ে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এই পার্থিব দুনিয়ার প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলো আমাকে কেমন অস্বস্তিতে ফেলছে। সূর্যের কিরণ আমি আর সহ্য করতে পারছি না (যেমন কাউন্টও পারেনি দিনের আলো সহ্য করতে)।
বেশ কিছুক্ষণ চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, অফিসে যাব না। শমিতা প্রথমে গজগজ করলেও পরে খুশি হল। বলল, চলো, তা হলে একটা ছবি দেখে আসি। আমি সটান সেই প্রস্তাবকে না মঞ্জুর করে দিয়ে উত্তর দিলাম, উঁহু, সারা দুপুর বসে-বসে বইটা শেষ করব। হ্যাঁ, আর একটা কথা, দুপুরে আমার রান্না কোরো না খিদে নেই।
তার মানে?–শমিতা যথেষ্ট অবাক হল।
মানে খিদে নেই ব্যস। বলে দ্রুত পা ফেলে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম।
মনে পড়ল, জোনাথান হার্বার কখনও কাউন্টকে খাওয়ার টেবিলে দেখেনি। কারণ? কী জানি, বলতে পারি না…।
দ্বিতীয় দিনঃ অবসন্ন দুপুর
শরীরের অভ্যন্তরে তখন বেপরোয়া সাইক্লোন বয়ে চলেছে। দুটো কারণে। এক, খিদের জ্বালায়। দুই, জাহাজের ক্যাপ্টেনের রোজনামচাটা পড়ে (যেখানে জাহাজ থেকে একের পর এক যাত্রী এবং নাবিকরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কাউন্টের শিকার হয়ে) মনের মধ্যে অনুভব করছি এক অজানা উল্লাস। অনেকটা কৃতিত্বের অথবা যুদ্ধজয়ের উল্লাসের মতো। হয়তো কাউন্টের এই অভাবনীয় কার্যকলাপ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
শমিতা শোওয়ার ঘরে প্রাত্যহিক দিবানিদ্রায় মগ্ন। আমি বসবার ঘরে বসে বইটা গোগ্রাসে গিলছি। ঠিক করেছি, আজ সন্ধ্যায় ক্লাবে যাওয়ার আগে বইটা পুরোটা না পারলেও প্রায় শেষ করে ফেলব। কারণ, অভিজিৎ হয়তো আমার মতামত জানতে চাইবে।
অতএব সমস্ত চেতনা কেন্দ্রীভূত হল বইয়ের পাতায়…ক্রমে-ক্রমে পেরিয়ে গেল লুসি ও উন্মাদ আশ্রমের রোগী রেনফিল্ডের অধ্যায়। যখন রেনফিল্ডের মৃত্যু হল তখন আমার চমক ভাঙল দেওয়াল-ঘড়ির ঘণ্টার শব্দে। সন্ধে সাতটা বাজে। অবাক হলাম, শমিতা আমাকে একবারের জন্যেও ডাকতে আসেনি বলে। বইটা রেখে শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখি ও তখনও ঘুমোচ্ছে। বেশবাসের পারিপাট্য স্বভাবতই আয়ত্তের বাইরে। সুন্দর ফরসা মুখের পর তিন ভাঁজওয়ালা নিটোল গলা..আমার মনে পড়ল অসহায় লুসির কথা। বইয়ের গল্পটার মতো এখানেও শমিতার মাথার কাছের জানলাটা খোলা। কিন্তু বাইরের আঁধারি আকাশে কোনও উড়ন্ত স্থৈর্যশীল কালো বাদুড়কে দেখা যাচ্ছে না। ঠিক ওই মুহূর্তে একটা বাদুড়ের অভাব অনুভব করলাম। যদি একটা বাদুড় পেতাম! তখনই মনে মনে ঠিক করলাম, একটা বাদুড় আমাকে জোগাড় করতেই হবে–তা সে যেমন করেই হোক!
কিছুক্ষণ দ্বিধার পর ঝুঁকে পড়লাম শমিতার ওপর। আমার ঠোঁট আলতোভাবে স্পর্শ করল ওর ঠোঁট, তারপর ধীরে-ধীরে নেমে এল গলায়…।
এক ভয়ংকর আর্তচিৎকার করে বিস্ফারিত চোখে এক ঝটকায় উঠে বসল শমিতা। আমি মুহূর্তের জন্যে দিশেহারা হয়ে পড়লেও নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সময় লাগল না। চেষ্টা করে কাষ্ঠহাসি হাসলাম।
ও, তুমি! শমিতার নিশ্বাস গম্ভীর হয়ে উঠেছে। ও শাড়িটাকে ঠিকভাবে শরীরে জড়িয়ে নিতে লাগল।
হ্যাঁ। অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিলাম । স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি? অমন চমকে উঠলে যে?
শমিতা কিছুক্ষণ নীরব। তারপর মুখ খুলল, না, মনে হল কেউ যেন আমার গলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে–তাই।
সতর্ক স্বরে বললাম, কী জানি! যাকগে, তুমি এবার ওঠো, আমি একটু ক্লাবে যাব।
শমিতা খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। ওর মনের পরদায় সংশয়ের ছায়াটা তখনও বোধহয় পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি।
দ্বিতীয় রাতঃ মিনা হার্কার
আমি শুয়ে। শমিতাও শুয়ে।
আমি জেগে। ও ঘুমিয়ে।
সারাদিনে দু-চার পেগ ও কিছু স্ন্যাকস্ ছাড়া আমার পেটে আর কিছু পড়েনি, কিন্তু তার জন্যে অস্বস্তি বা কোনওরকম কষ্টও অনুভব করিনি। তবে একটা মানসিক হোঁচট খেয়েছি ক্লাবে ঢুকেই।
ক্লাবে যেতেই প্রথম নজরের মিলন অভিজিতের সঙ্গে। ওকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে সন্ধের উত্তাল চিন্তাটার কথা চুপিচুপি বলেছি, আমাকে একটা বাদুড় কিনে দিতে পারিস?
দীর্ঘ এক মিনিট আমরা নীরব। কিন্তু অভিজিতের ছলছলে ঘোলাটে চোখ আমাকে পাগল, নির্বোধ ইত্যাদি শব্দে নিঃশব্দে গালাগাল দিতে লাগল।
অবশেষে উচ্চারণ করল, রাবিশ।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অভিজিতের প্রতি আমার চিরন্তন ঘৃণার জন্ম হল। কারণ মুখে বললেও ওর অভিব্যক্তি আমাকে জানিয়ে দিয়েছে–ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বলে দিয়েছে– ওর মনের ভাব। সুতরাং বাদুড় কেনার কার্যকারণ ওকে খুলে বলার প্রবৃত্তি আমার হয়নি। ক্লাব থেকে সটান ফিরে এসেছি। মনে মনে ভেবেছি সব ব্যবস্থা আমাকে নিজেই করতে হবে। কারণ শমিতাকেও যখনই কিছু বলতে গেছি, ও বিস্ময়ভরা চোখ মেলে তাকিয়েছে, তারপর হেসে উঠেছে। (যতসব আজগুবি চিন্তা!)।
শমিতার এই বদ্ধমূল অবিশ্বাস ক্রমশ আমাকে একরোখা করে তুলেছে। আমার জীবনের ধ্যান, জ্ঞান, উদ্দেশ্য সব কেন্দ্রীভূত হয়েছে ড্রাকুলার অস্তিত্ব প্রমাণের সাফল্যে। কোনওকালেই বেশি কথার মানুষ আমি ছিলাম না। তাই বউয়ের সঙ্গে অযথা তর্ক করিনি। মনকে সংযত করে পালটা প্রশ্ন করেছি, ভগবানকে কোনওদিন চোখে দেখেছ?
আমার বক্তব্যে শমিতা কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল। তারপর হালকা সুরে বলেছে, উঁহু, কেউই দেখেনি।
অথচ ভগবানে বিশ্বাসের ব্যাপারে তোমাদের কমতি নেই!–আমার তিক্ত স্বর শমিতার মস্তিষ্কে যেন কেটে কেটে বসল। ও কোনও জবাব দিতে না পেরে ইতস্তত করতে লাগল।
আর যখনই আমি কাউন্ট ড্রাকুলার কথা বলছি, তখনই তোমার সমস্ত অবিশ্বাস ঝরে পড়ছে, ব্যঙ্গ করেছ আমার নির্বুদ্ধিতাকে নিয়ে, তাই না? যেহেতু কাউন্ট ড্রাকুলাকে তুমি চোখে দ্যাখোনি!
আমার রূঢ় স্বরে শমিতা হয়তো আঘাত পেল। কিন্তু আমি নিরুপায়। ওর কাঁপা ঠোঁটে এক পলক চোখ রেখে শোওয়ার ঘরে গিয়ে খাটে গা এলিয়ে দিয়েছি। বইটার অসমাপ্ত অধ্যায়গুলো পড়তে শুরু করেছি। রাতে কিছু মুখে দেওয়ার প্রবৃত্তি আর হয়নি।
বইটা শেষ করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলাম। যথারীতি বইয়ের পরিণতি আমার মোটেই ভালো লাগেনি। ইংরেজি ফিল্মগুলোতে যে-পরবর্তী অধ্যায়ের আশ্বাস পেয়েছিলাম, এখানে তার আভাসমাত্র নেই। বরং এখানে কাউন্ট ড্রাকুলা পরাজিত ও ধ্বংস হয়েছে সামান্য মানুষের হাতে! অবাস্তব তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মিনা হার্কারের অধ্যায় আমাকে মুগ্ধ করেছে।
বইটা রেখে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসতে দেরি হল। ভাবতে লাগলাম অদূর ভবিষ্যতের কথা, অভিজিতের কথা, শমিতার কথা, আর সবশেষে কাউন্ট ড্রাকুলার কথা।
কালো বাদুড় ও কালো পোশাক
হাটবারে পাখির বাজার তন্নতন্ন করেও কোনও বাদুড়ের সন্ধান পাইনি। অনেকে অবাক হলেও বাদুড়ের বদলে পাচা হলে চলবে কি না প্রশ্ন করেছে–কোনও জবাব দিইনি। বহু অনুসন্ধানের পর একজন দোকানদার স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই আমার প্রয়োজনের কারণ জানতে চেয়ে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। আমি তাকে শুধু প্রয়োজনটাই (প্রয়োজনের কারণ নয়) জানিয়েছি। অবশেষে দীর্ঘ দু-ঘণ্টার জন্যে আমাকে প্রতীক্ষায় রেখে সে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা খাঁচা নিয়ে ফিরে এল। কিঞ্চিৎ দরাদরির পর সে পারিশ্রমিক, খাঁচা ও পাখি (পাখি?) বাবদ পঁয়ষট্টি টাকা চেয়ে বসল। আমি আর কোনওরকম প্রতিবাদ না করে টাকাটা তার হাতে তুলে দিয়ে খাঁচা নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। শমিতাকে না জানিয়ে খাঁচাটাকে চুপিচুপি লুকিয়ে রেখেছি খাটের নীচে। তারপর চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে (ইদানীং সানগ্লাস ছাড়া আমি দিনের বেলায় মোটেই রাস্তায় বেরোতে পারি না) বসবার ঘরের চেয়ারে বসে চোখ বুজে বিশ্রাম করছি, শমিতা এসে ঘরে ঢুকল।
অভিজিৎবাবুর ফোন এসেছিল।
কী বলল?
আজ রাতে আসবেন।
চমকে উঠলাম। আনন্দ, ঘৃণা, তৃপ্তি, একসঙ্গে প্রকাশ পেল আমার উত্তরে, তাই বুঝি? কেন?
কী জানি, শমিতা নির্বিকার। তবে চলে যেতে গিয়ে ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে গেল, পাশের বাড়ির ওদের তোমার এই ড্রাকুলাপুঙ্গবের কথা (শমিতা, খবরদার, মুখ সামলে কথা বলো! নইলে এক টানে তোমার ওই কচি গলা ছিঁড়ে…) বলছিলাম। সব শুনে ওরা তো হেসেই খুন (খুন? হ্যাঁ, তাই তো বলে একে–)! শেষে বলল, তোমার নাকি রাঁচির হাসপাতালের সাহায্য নেওয়া (পাগল রেনফিল্ড? না, রেনফিল্ডকে আমার ভালো লাগে না। বিশ্বাসঘাতক কোথাকার!) দরকার।
আমি জানি, এসব শুনে আমার প্রচণ্ড উত্তেজিত হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল রাগে পাগল হয়ে শমিতার গলা টিপে ধরা–কিন্তু দুইয়ের কোনওটাই আমি করলাম না। খুব শান্তভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, শমি, পাশের বাড়ির ওদের আর কয়েকদিন পরে ওই একই প্রশ্ন করলে দেখতে, ওদের উত্তরটা একটু অন্যরকম হত।
শমিতা কেন জানি চুপ। দৃষ্টি দিশেহারা।
তৃতীয় রাত : অভিজিৎ সান্যাল
অভিজিৎ যখন এল, আমার শোওয়ার ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং-ঢং শব্দে রাত নটা বাজল।
শমিতাকে সেই সন্ধেবেলাতেই পাঠিয়ে দিয়েছি পাশের বাড়ির ওদের সঙ্গে গল্প করতে। বলেছি, রাত দশটার আগে যেন না ফেরে, কারণ, অভিজিৎ সান্যালের সঙ্গে আমার কিছু জরুরি আলোচনা আছে। আমি চাই না সে-সময়ে ও হাজির থাকুক ইত্যাদি ইত্যাদি।
ও কোনও প্রতিবাদ না করেই চলে গেছে।
বসবার ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। আমি ছিলাম প্রতীক্ষায় অভিজিতের প্রতীক্ষায়। ও প্রথমে বসবার ঘরের দরজা খুলেই দেখল ঘন অন্ধকার, (যে-অন্ধকার বরাবর আমাকে প্রতারিত করে এসেছে, কিন্তু আজ আমি ঈপ্সিত বস্তুর সন্ধান পেয়েছি। অন্ধকারকে আমি এখন, এই মুহূর্তে, পরমাত্মীয় বলে ভাবতে পারছি…) এবং দেখেই থামল।
অরুণাভ–অরুণ!
অভিজিতের স্বর যেন একটু কাঁপা কাঁপা মনে হল।
আমি স্পষ্ট স্বরে জবাব দিলাম, কী রে, তুই এসেছিস?
সঙ্গে-সঙ্গেই দেওয়াল-ঘড়ির ঘণ্টায় সশব্দে রাত নটার সংকেত পড়ল।
অভিজিৎ আমার গলার শব্দ অনুসরণ করে শোওয়ার ঘরে এসে ঢুকল। তখনই দেখল, দেওয়ালে যে-ঈষৎ আলোর ইশারা দূর থেকে চোখে পড়েছিল, তার উৎস এক কোণের টেবিলে বসানো একটা মোমবাতি। এবং ঘরের সব জানলা-দরজা বন্ধ।
হঠাৎই একটা ডানা ঝাপটানোর ঝটপট শব্দ শোনা গেল।
চমকে উঠল অভিজিৎ। দেখল, একটা কালো ছায়া হাওয়ায় ভর করে ক্ষিপ্রভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে শোওয়ার ঘরের আকাশে। ভয়ে চোখ ঢাকল অভিজিৎ। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঝটকা মেরে ঘুরে দাঁড়াল। লক্ষ্য, দরজা।
ঠিক তখনই আমাকে ওর চোখে পড়ল। শোওয়ার ঘরের বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে তৃপ্ত অভিব্যক্তি নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
আমার গায়েও লম্বা কালো-লাল আলখাল্লার দিকে তাকিয়ে ওর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এল, মাই গড!
আমি যেন হাওয়ায় ভেসে চট করে ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম। মুচকি হাসলাম। বললাম, তুই এসেছিস বলে ধন্যবাদ।
হঠাৎ কাঁধের কাছে কোনও স্পর্শে লাফিয়ে উঠল অভিজিৎ।
কালো ছায়াটা ওকে পাশ কাটিয়ে সামনের দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল–পড়ে গেল মাটিতে। আবার উঠল।
কী কী ওটা? –ওর গলার স্বরে কি ভয় ও বিস্ময় যুগপৎ ক্রিয়া করছে?
বললাম, বাদুড়–আজই কিনে এনেছি।
হোয়াট? রাগে ফেটে পড়ল অভিজিৎ : কিনে-এনে-ছিস?
হ্যাঁ। আর এই কালো পোশাকটাও।–মাথা নীচু করে আলখাল্লাটা দেখালাম : এখন বল, কেমন মানিয়েছে?
আমার হাসি অভিজিৎকে সংক্রামিত করতে পারল না। ও গম্ভীরভাবে বলল, এসব কাণ্ডকারখানার জন্যেই কি অফিস যাওয়া বন্ধ করেছিস? অল দিজ ননসেন্স?
শাট ইয়োর ট্র্যাপ।আমি হিসহিস করে বলে উঠলাম, এর মর্ম তুই বুঝবি না। অন্ধকারের আনন্দ আলোর আনন্দের চেয়ে কিছু কম নয়! তুই তো ড্রাকুলা পড়েছিস।
ব্যস। আর কিছু বলে ওঠার আগেই অভিজিৎ উন্মাদের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ওর হাসিতে আলো-আঁধারিতে উড়ন্ত বাদুড়টাও বুঝি চমকে উঠল। মোমবাতির কাঁপা আলো চকিতে পিছলে গেল আমাদের যুযুধান মুখে। হাসতে-হাসতেই নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করল অভিজিৎ। বলল, ওঃ বয়! কান্ট য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড ফ্লু হ্যাভ গন রাউন্ড দ্য বেন্ড?
আমার পায়ের নখ থেকে চুল পর্যন্ত শিরশির করে উঠল। উড়ন্ত বাদুড়ের ছায়া কেঁপে উঠল আমার রক্তিম চোখে। একটা ঝাপসা পরদায় ভাসতে লাগল অভিজিতের আতঙ্ক-বিকৃত মুখ…।
সামনে পা ফেলার আগে বললাম, আমি দুঃখিত, অভিজিৎ..।
অভিজিতের সঙ্গে সেই আমার শেষ কথা।
এবং শেষ রাতঃ শমিতা
রাত দশটা। বসবার ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল শমিতা।
ঘর যথারীতি এখনও অন্ধকার।
আমার নাম ধরে ডাকতে-ডাকতে অনিশ্চিত পায়ে ও চলে এল শোওয়ার ঘরে। মোমবাতিটা জুলতে-জুলতে ছোট হয়ে এসেছে। বাদুড়টাও ক্লান্ত ডানা নিয়ে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর আমি? আমি সেই কালো আলখাল্লা পরেই টান-টান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।
শমিতা প্রথমে বাদুড়টাকে দেখে প্রচণ্ড এক চিৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করল ঘরের মধ্যে। অবশেষে থামল এসে বিছানার কাছে। হাঁপাতে-হাঁপাতে আমাকে ডাকল, এই, শুনছ, ওঠো।
ওর গলা থরথর করে কঁপছে।
তখনই ওর চোখ পড়ল আমার শুয়ে থাকার বিচিত্র ভঙ্গির ওপর, কালো আলখাল্লার ওপর, টুকটুকে লাল ঠোঁটের ওপর। সুতরাং ও থমকে গেল। রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করল, কী হচ্ছে এসব বাড়ির মধ্যে?
আমি ধীরে-ধীরে উঠে বসলাম বিছানার। শমিতা হুস-হুঁস করে বাদুড়টাকে তাড়াতে লাগল।
পোশাকটা কীরকম? পছন্দ হয়?–ওকে প্রশ্ন করলাম।
ও সেই পুরোনো কথাই উচ্চারণ করল, যতসব উদ্ভট আজগুবি চিন্তা।
আমি তরল ভঙ্গিতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম এখনও অবিশ্বাস?–হ্যাঁসলাম ঠোঁট টিপে।
ওই বইটা পড়ে আর সিনেমা দেখে-দেখে তোমার মাথাটা একেবারে গেছে। সব রকম গাঁজাখুরি ব্যাপার বিশ্বাস করতে শুরু করেছ।
কথা বলতে-বলতে ও অন্ধকারের মধ্যেই ব্ৰস্তপদে এগিয়ে চলল আলোর সুইচের দিকে। এবং কয়েক পা গিয়েই হোঁচট লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাড়তে-হাতড়ে এই পতনের কারণ অনুভব করতে গিয়ে ওর মুখে ফুটে উঠল অন্ধ আতঙ্কের ছাপ, বিস্ময়ের জোয়ার, অনিশ্চয়তার মেঘ।
এ কী? কী এটা? শমিতার স্বর আমার অচেনা লাগছে।
আমি বিছানার পাশে দাঁড়িয়েই জবাব দিলাম, মানুষ–আমার বন্ধু অভিজিৎ সান্যাল।
চকিতে উঠে দাঁড়াল শমিতা : কী হয়েছে ওঁর? উনি পড়ে আছেন কেন?
আমি ধীরে ধীরে পা ফেলে শমিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফিশফিশ করে বললাম, এখনও অবিশ্বাস, শমিতা? নিজের স্বামীকে অবিশ্বাস?
শমিতা পাগলামো ছাড়ো বলতেই আমি ওর দুকাঁধে হাত রাখলাম আলতো করে। বললাম, পাগলামো?
তারপর ওর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে নিঃশব্দে হাসলাম।
বাদুড়ের কালো ছায়াটা সারা ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে। মোমবাতির আলো কমে এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার দেখতে অসুবিধে হল না। অনুভবে ভুল হল না।
আমার দু-হাতের মধ্যে শমিতার শরীরটা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠল। ওর আতঙ্কে ভেজা চোখের চকচকে তারায় আমায় মুখের প্রতিবিম্ব কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল আমার ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট, এবং সেইসঙ্গে ভেসে উঠল আমার ঝকঝকে শূদন্তের ধারালো নির্মোঘ প্রতিবিম্ব।
শমিতার সরব সম্মতি না পেলেও ওর অভিব্যক্তি আমার এতদিনকার প্রশ্নের (এখন বিশ্বাস করো, শমিতাঃ) জবাব দিয়ে গেল।
আমাদের পরস্পরের ব্যবধান আরও কমে আসতেই বাদুড়ের ভাসমান ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
কারণ, প্রদীপ (প্রকৃতপক্ষে, মোমবাতি) নিভিয়া গেল।
(অরুণাভ দত্তগুপ্তকে এই পার্থিব পরিবেশে আর দেখা যায়নি। তবে একটা ছোট্ট কাগজে তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছের কথা প্রকাশ করে গেছেন। তাতে তাঁর ট্রাসিলভ্যানিয়া যাত্রার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এর বেশি আর কিছু জানা যায়নি।)