ট্রানসেলভেনিয়ার অভিশাপ
ছেলে বেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র অতীন। স্কুলে কোনো র্যাঙ্ক না পেলেও তার লেখার বিশেষ কৌশল আর জন্য তাকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হতো। একদিন গভীর রাতে তার ঘুম ভাঙ্গলো একধরনের মধুর সুগন্ধে। গন্ধটি ক্রমাগত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। সে তখন বিছানা থেকে উঠে পরেছে মাঝ রাতে তার ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী এই গন্ধের উৎস খোজার জন্য । আগাগোড়াই এমন খুঁতখুঁতে সভাবের মানুষ অতীন।
দরজা খুলে পিতার আশ্রয়ের ছাদের গণ্ডি পেরিয়ে এবার সে বাইরের জগতে প্রবেশ করেছে যে জগৎ আপাত দৃষ্টিতে তার কাছে পরিচিত হলেও প্রচুর জিনিস আছে যা চিরকালের গুপ্ত রহস্য। মধ্যরাত্রে বাইরের মনোরম পরিবেশ যে এত পল্টিবাজ হয়ে যেতে পারে তা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। চিরপরিচিত রাস্তাঘাট গুলো এত টাই অপরিচিত লাগছিল তার কাছে যেন সে পথ ভুল করে বসবে। শুধুমাত্র গুতি কয়েক ঝিঁঝিঁ, জোনাকি, পেঁচা, বাদুরেরাই এই নিষ্প্রাণ পৃথিবীতে প্রাণের শেষ বিন্দু টুকু টিকিয়ে রেখেছে একথা ভাবতে ভাবতে কখন সে পাড়ার কালি মন্দিরের সামনে এসে পড়ল তা সে বুঝতেই পারে নি। যেনো প্রকৃতি তাকে টেনে এনেছে এখানে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করতে। হটাৎ সে একটা টান অনুভব করলো এবং মন্দিরের দিকে ঢুকে যেতে লাগলো যেনো কেউ তাকে মাতৃসুলভাবে
পরম স্নেহে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে।
“কিন্তু কেনো ?” হটাৎ এই প্রশ্নটি তার মনে খেলে গেল ।
তৎক্ষণাৎ যেনো কেউ মনের ভেতরেই তার উত্তর দিয়ে দিল,” কোনো মা কি তার সন্তানের ক্ষতি হতে দেখে চুপ করে থাকতে পারে? তুই আমার কাছে নিরাপদ রে খোকা। দেখি তোর যদি একটা চুলও ছুঁতে পারে কেউ!”
তারপর কি হল তার হয়তো কিছুই বুঝতে পারে নি
অতীন, কারণ সে তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন আসলে যে গন্ধ অতীন পেয়েছিল তা শুধুই
ছলনামাত্র কিন্তু যে এই কৃতকর্মটি করেছে তার উদ্দেশ্য সাধন হওয়ার আগেই অতীন অদ্ভুদ কোনো এক মন্ত্রবলে মন্দির এর ভেতরে প্রবেশ করে ফলে সেই ব্যাক্তি অতীন এর প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়। এবং সে মন্দির আর দরজায় উপস্থিত হয়। যেই সে মন্দির আর ভেতরে প্রবেশ করার জন্য পা বাড়িয়েছে অমনি তার বাড়িয়ে তোলা পেয়ে আগুন লেগে যায়, ভয়ংকর এক সাইক্লোন এর মত কুৎসিত গলায় চিৎকারে ফেটে পরে সে।
তার শরীর মানুষের কিন্তু নারী পুরুষ উভয়েরই সকল বৈশিষ্ট্য বর্তমান, পেছনে বাদুড়ের ন্যায় পাখা,
তার ভেড়ার মত মাথার ওপর পেছনে বাঁকানো সিং, পায়ে তার আঙ্গুল এর পরিবর্তে খুর হাতের নখ তার বাঘের চেয়েও তীক্ষ্ণ তা দেখে বোঝার বাকি নেই যে এই হলো সেই বিখ্যাত অন্ধকারের দেবতা, স্বর্গ থেকে বিতাড়িত শয়তান!
প্রচণ্ড চিৎকারে সে হুংকার দিয়ে উঠলো,”আমি আবার ফিরে আসবো, এই ছেলের আত্মা শুধু আমার। কিন্তু আজ যখন এসেছি খালি হাতে ফিরে যাবো না। আবার আসবো রাতের চাঁদকে করবো ভক্ষণ, যেদিন জীবিত এবং মৃত দুই দুনিয়ার মধ্যেকার সমস্ত প্রাচীর ভেঙে যাবে, সেদিন আমার অনুগামীরা আমায় আবার জাগিয়ে তুলবে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ……..
পরদিন সকালে যখন অতীনের ঘুম ভাঙ্গলো তখন সে তার বাড়িতে। হটাৎ একটা কান্নার শব্দে তার ঘোর কেটে গেল। যা তা কান্না নয়, মরা কান্না! এবং
কণ্ঠস্বর আর কারো নয় তার মায়ের!
সে ছুটে বাইরে বেরিয়ে যা দেখলো তার জন্য সে কখনোই প্রস্তুত ছিলো না। তার ছোট ভাই অতীশ মৃত এবং তার মা পাগলের মত কাঁদছে। আর গোটা
কয়েক পুলিশ অফিসার তার বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। অতীশ কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না, হটাৎ তার চারপাশের সমস্ত কিছু গুলিয়ে যেতে লাগলো, তার শরীর যেনো ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে…… ধপাস!!
“আমি যখন এসেছি খালি হাতে ফিরে যাবো না। আত্মার পরিবর্তে আত্মা, অতীন এর পরিবর্তে অতীশ ! হাঃ হাঃ হাঃ..”
” না… ওকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও ওকে বলছি..”
“অতীন, ওই অতীন, কি যে হয়না তোর বুঝিই না। চোখ খুলে অতীন দেখে তার অফিসের কলিগ এবং
রুমমেট শম্ভু তাকে জাগেচ্ছে। অতীশ এর ঘটনাটার প্রায় দশ বছর কেটে গেছে কিন্তু প্রায় রাতে অতীন নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে তার ভাইকে কোন পৌশাচিক শক্তি খুন করছে। অবশ্য ডাকাতদের কীর্তি ভেবেই কেস ক্লোজ করে দেয় পুলিশ আর তার বাবাও এ ব্যাপার বেশি জল ঘোলা করতে চাননি। তার মতে একটি ছেলেকে হারিয়েছি ওপর টিকে আর হারাতে চান না তিনি।
“আচ্ছা তোর মাঝেমধ্যেই কি হয় বলত ঘুমের মধ্যে কি সব ভুলভাল বকিস?” শম্ভু জিজ্ঞাসা করল।
“ও কিছুই না ছাড়তো ওসব।” হাসতে হাসতে উত্তর দিলো অতীন।”
“আচ্ছা অতীন তোর ট্রান্সফারের কি হলো?”
“ও হ্যাঁ, তোকে বলবো ভুলে গেছি। হয়ে গেছে রোমানিয়াতে পোস্টিং as a Senior Account.”
“রোমানিয়ার কোথায়?”
“ট্রান্সলভেনিয়া!”
“বাহ সেটা ভালো কথা। কিন্তু দেখিস ড্রাকুলার দেশে যাচ্ছিস ড্রাকুলা আবার তোর রক্ত চুষে না খেতে শুরু করে?” ঠাট্টার সুরে বলল শম্ভু।
সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে হেলে তার শেষকিরণ দিয়ে জগতকে আলোর শেষ স্বাদ প্রদান করতে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ হলো অতীন গঙ্গার ধারে এসে বসে আছে কিছুতেই সে রোজ রাতে দেখা এই স্বপ্নগুলোর কোনো উপায় বের করে উঠতে পারছিল না। হঠাৎ সে জলের মধ্যে একটা কম্পন অনুভব করলো যেন বিশালাকায় কিছু তার দিকে উঠে আসছে। প্রথমটায় অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল অতীন কিন্তু পরে তার মনে হঠাৎ কেন জানি একটা আকস্মিক ভীতির উদয় হল। সে দেখল জল থেকে প্রকাণ্ড একটা জন্তু উঠে এসেছে এবং তীব্র কর্কশ শব্দ চিৎকার করছে জন্তু নয় মানুষও নয়। মানুষের কেবল দেহটাই তার মাথাটা একটা ছাগলের। কিন্তু যে জিনিসটা তাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করল সেটা হলো তার হাতে সে একটা মানুষের গলা টিপে ঝুলিয়ে ধরে আছে এবং সেটা আর কেউ নয় অতিনেরি বাবা। অতীন কিছুই বুঝতে পারল না সে “বাবা…” বলে চিৎকার করে বসলো হটাৎ তার একটা স্পর্শের অনুভূতি হলো, সে এক পরম স্নেহময় স্পর্শ।অতীন কিছুই বুঝতে পারল না সে “বাবা…” বলে চিৎকার করে বসলো হটাৎ তার একটা স্পর্শের অনুভূতি হলো, সে এক পরম স্নেহময় স্পর্শ। সে পিছনে না ঘুরে থাকতে পারলো না। পিছনে ফিরে দেখল একজন ধুতি এবং সাদা উত্তরীয় পড়া বৃদ্ধ ব্যাক্তি তার কাঁধে হাত রেখে বলছেন ,”কি হয়ছে বাবা? তোমার কি সমস্যা আমায় বলতে পারো।”
অতীন মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না শুধু হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল ওই দিকে। ঠিক যেমন করে ছোট শিশুরা কোনো কিছুকে দেখিয়ে দেয়। বৃদ্ধ বলে উঠলেন,” কই কিছুই তো নাই ওই দিকে। বলে অতীন এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন যেনো উনি তাকে কতকালের পরিচিত অথচ আজই ওনাকে সারাজীবনে প্রথম দেখলো অতীন। কিন্তু সে তাকে বাধা দিল না। ভালই লাগছিল কাজের সূত্রে বাড়ি থেকে এতদূরে থাকতে হয় তাতে এমন স্নেহ থেকে বহুদিন বঞ্চিত থাকতে হয় তাকে। এবার উনি তার পাশে এসে বসলেন,”এবং আবার জিজ্ঞাসা করলেন,”বলো কিসের সমস্যা তোমার?”
অতীন চিন্তার ঘোর কাটিয়ে উত্তর দিলো,” না না তেমন কিছুই না। অফিসে একটু কাজের চাপ আরকি।” বলে বিদায় জানিয়ে উঠে এলো। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সূয্যিমামা কখন যে তার সুইচ অফ করে দিয়েছেন বুঝতেই পারে নি। ইতিমধ্যে ছুঁচোরা নৃত্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে। হাতঘরটা উঠিয়ে দেখি সাতটা বেজে গেছে তাই হাতের কাছেই একটা পরিচিত দোকানে ঢুকে পড়লাম কলকাতার একটা ব্যাপার আমাকে খুব শান্তি দেয় যে এখানে সকাল সন্ধ্যা সব সময় গরম কচুরি আর ছোলার ডাল পাওয়া যাবেই আর কিছু পাওয়া যাক চাই না যাক। আর মদন দার কুচুরির তো কোনো তুলনাই হয়না ঢুকতেই মদন দা বলে উঠলো,”আরে অতীন যে , এতদিন কোথায় ছিলে? বসো বসো।”
আমিও কনার দিকের একটা টেবিলে বসে পড়লাম। মদন দা দুটো কচুরি আর ছোলার ডাল দিয়ে বলল ,” এটা খাও ময়দা মাখা হচ্ছে ভেজে আরো দিচ্ছি।”
অতীন সম্মতি জানিয়ে বলল,”আচ্ছা।”
সবে মাত্র কচুরিটাতে হাত দিতে যাচ্ছে অতীন অমনি একটা আওয়াজ তার কানে এলো। ও দেখল ওই বৃদ্ধ রেগে ফুঁসে গিয়ে বলছে ,”এটা কোনো কথা,দেরি হবে মনে টা কি, সন্ধার সময় কচুরি শেষ কি করে হয়?”
ওনাকে কাছে ডাকলো অতীন। বৃদ্ধ গজ গজ করতে করতে তার দিকে এগিয়ে এলো। এবং অতীন তাকে বসতে অনুরোধ করায় নিঃসংকোচে উনি বসে পড়লেন। অতীন তাকে বলল,” নিন আমার থেকে খান। দুটো আছে আপনি একটা আমি একটা।”
উনি একটু দ্বিধা প্রকাশ করায় অতীন তাকে অনুরোধ করে বলল,”দেখুন আমি বুঝি খিদের যন্ত্রণা কেমন হয়! আপনি খান। এটা খেয়ে ক্ষুদা একটু শান্ত করুন তারপর আরো আসছে।”
খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গ এলো অতীন নিজেই দুজনের বিল দিলো।
বাইরে এসে বৃদ্ধ বললেন ,”তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ তুমি যে আমার কি উপকার করলে তা তুমি নিজেও জনো না। আমি কামনা করি ঈশ্বর তোমাকে সমস্ত রকম বিপদ থেকে রক্ষা করুন।”
বলে উনি একটা অদ্ভুত ধরনের মালা বের করে অতীন হাতে দিলেন বললেন,”এটা তোমাকে সঠিক সময়ে সমস্ত ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করবে আর একটা কথা জীবন সবসময় নিজের জন্য নয় আরো দশটি মানুষের কথা ভাববে সঠিক পথে চলবে তবেই সব ঠিক থাকবে। সামনে তোমার ঘোর বিপদ। অশুভ শক্তিরা সবসময় চাইবে তুমি কোনো খারাপ অপবিত্র কাজ করো যাতে তারা তাদের উদ্দশ্যে সাধনে সক্ষম হয়। প্রথমে এটা নিতে চাইছিল না অতীন কিন্তু তার পরের কথাটা শুনে সে আর মানা করতে পারলো না।”
শীঘ্রই বাবার সঙ্গে দেখা করো সে তোমাদের পিচ ছাড়বে না। কথাটা শেষ হওয়ার আগেই হাঁটতে শুরু করেছিলেন বৃদ্ধ শেষ হতেই রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। ঘরে ফিরতে ফিরতে নটা বেজে গেলো অতীন এর। এমনিতে সে ভূত, প্রেতে বিশ্বাসী না অতীন কিন্তু সেই বৃদ্ধের কথাগুলো যেনো বারংবার তার মনের মধ্যে পাক খেতে শুরু করেছে তাই সে মালাটি পরেই নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
লোহাজাতীয় ধাতুর ওপর রুপোর প্রলেপ দেওয়া, অত্যন্ত যত্ন সহকারে পালিশ করা। তার ওপর একটিমাত্র ক্রিস্টাল এর ন্যায় পুঁথি বা মনির মত জিনিসটি আছে তার ভেতরে জলের ন্যায় কোনো তরল রয়েছে। জলের সাথে এর মূল পার্থক্য এটাই যে এটা অত্যন্ত চকচক করছে।
অতীনের ট্রান্সফারের জন্য তার প্যাকিং এবং যাবতীয় কাজকর্মের জন্য তাকে তিন দিনের ছুটি দেওয়া হয়ছে। শনিবার অফিসে তার ফেয়ারওয়েল সেলিব্রেট করে এই রবিবারই তার রোমানিয়ার ফ্লাইট। সে ভেবেছিল মা বাবাকে এখানেই ডেকে নেবে কিন্তু এখন সে ঠিক করেছে কাল নিজেই বাড়ি গিয়ে দুদিন থেকে আসবে। সেকথা শম্ভূকে জানিয়ে ডিনার সেরে শুয়ে পড়লো অতীন। পরদিন সকালে অতীনের আবার ঘুম ভাঙলো শম্ভূর ডাকে কিন্তু আজ শম্ভূকে অত্যন্ত অবাক দেখাচ্ছে। অতীনের শরীরটা অত্যন্ত হালকা লাগছে যেনো কতকালের চাপা বোঝা তার কাঁধ থেকে কেউ নামিয়ে নিল। তাকে উঠতে দেখেই শম্ভূ বলে উঠলো,” কিরে আজ ঘুমের মধ্যে প্রলাপ বকলি না যে!”
“ধুর মাথা খারাপ করিসনা তো” অতীন শম্ভূর ওপর গর্জে উঠলো।
তাকে এমন রূপে দেখে শম্ভূ আর কথা বাড়াতে চাইলো না। তাই সে চলে গেলো। আজ এত দিন পর ভালোমত ঘুমিয়ে কতটা আনন্দিত হয়েছে অতীন তা একমাত্র সেই জানে।
দুপুর সোয়া দুটো নাগাদ সে মালদার ট্রেনে উঠলো। মালদা থেকে আরো ঘন্টা দুয়েকের পথ অতীনদের গ্রাম। মালদা পৌঁছাতে লাগলো পাঁচ ঘন্টা। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সাতটা পার হয়ে গেলো তার। গ্রামে প্রবেশ অতীন দেখলো কত বদলে গেছে তার গ্রাম। মালদা থেকে যেই বাসটাতে অতীন এসেছে সেটাই এই রুটের শেষ বাস ছিলো ওটা। মিস করলেই ব্যাস আজ আর বাড়ি ফেরা হতো না অতীনের ভাগ্যিস একটুর জন্য মিস হয়নি। রিকশা থেকে নেমে বাড়িতে প্রবেশ করতেই সে দেখল তার মা তার জন্যই
অপেক্ষা করে বসে আছে। কিন্তু তার বাবা কই কথাটা নিজের মনে ভাবছে অতীন অমনি একটা প্রবল আর্তনাদে তার কান ফেটে গেলো। “একি বাবার গলা না ?” ব্যাপার টা বুঝতেই একছুটে অতীন পৌঁছে গেলো তার বাবার ঘরের সামনে। ঘরে ঢুকেই সে দেখলো তার বাবা মাটিতে পরে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে আছেন। পেছন পেছন তার মাও তাকে অনুসরণ করছিলেন উনি এসব নিতে পারলেন না কান্নায় ফেটে পড়লেন। অতীনের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে কেউ তার বাবা কে গলা টিপে মারতে চাইছিল, বাবার গলার আঙ্গুলের দাগগুলোই সব পরিষ্কার করে দিলো তার কাছে। কিন্তু এগুলোকে “দেখেতো মানুষের বলে মনে হচ্ছে না!” মনে মনে পরিষ্কার করে নিল অতীন।
অতীন তার বাবাকে তুলতে গেলো। যেইনা সে তার বাবাকে তোলার জন্য তাকে স্পর্শ করেছে অমনি যেনো তার বুকে থাকা মনিটি অত্যন্ত গরম হয়ে গেলো আর তা থেকে তরলজাতীয় কিছু তার বাবার শরীরের ওপর পড়লো। সবকিছু এত দ্রুত হচ্ছিল যে অতীন কিছু বোঝতে পারলো না, সে শুধু তার বাবাকে সুস্থ করে তুলতে চায়। হটাৎ তার বাবার জ্ঞান ফিরতেই কিছুটা কেসে নিলেন তিনি, তারপর বললেন,”আমার হটাৎ কি যে হলো বুঝতেই পড়লাম না। কেনো যে নিশ্বাস নিয়ে এত কষ্ট হচ্ছিল, যেনো কেও আমাকে শ্বাস রোধ করে মারতে চাইছে কিন্তু পিছনে ঘুরে দেখি কেও কোত্থাও নেই।”
অতীন গতকালের গঙ্গার ধারের ঘটনাটা চেপে গেল।কিন্তু একটা প্রশ্নই তাকে তারা করে বেড়াতে লাগলো যে কে এই ব্যাক্তি,কেনো সে তার পরিবারের পিছনে পরে আছে? আর কেইবা ছিলেন গত কালের ওই বৃদ্ধ যিনি তাকে এত সাহায্য করলেন?”
এসব চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়েই কখন রাতের খাওয়ার ডাক সময় হয়ে গেলো বুঝতে পড়লো না অতীন সে শুধু প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজে বের করতে চায়।
রাতের খাওয়া শেষ করে অতীন এবং তার বাবা, বাবার ঘরে একসঙ্গে কিছু সময় কাটাচ্ছিলেন। বাবা তার ব্রিটিশ আমলের সেগুন কাঠের তৈরি আরমকেদারায় বসে সিগারেট খেতে খেতে একটা বই পড়ছিলেন। অতীন সেই সুযোগে বাবার পুরোনো বইয়ের সেলফটা একটু হাতিয়ে নিচ্ছিল ‘যদি কোনো ছোটবেলার স্মৃতি মেলে!’ এই উদ্দেশ্য নিয়ে।
হটাৎ একটা বই এর কভারের দিকে চোখ যেতেই তার চোখ কপালে উঠলো। বইটার ওপরে ‘Codex Gigas’ লেখা! শুধু এটাতেই শেষ নয় আরো আছে না না লেখা নয় একটা অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা। একটা বড় বৃত্তের মধ্যে একটা সোজা ত্রিভুজের ওপর দিয়ে আরেকটা উল্টানো ত্রিভুজ!
Codex Gigas হলো শয়তান এর লেখা একটা বড় অপবিত্র বই এটা অতীন জনে। “কিন্তু এজে বড় অপবিত্র আর সাংঘাতিক জিনিস এটা তার বাড়িতে আসলো কোত্থেকে?” এটা ভেবে একটু ভয় পেয়ে গেলো ।
সে বিলম্ব না করে ছুটে গেলো তার বাবার কাছে গিয়ে সামনের আরামকেদারায় বসে পড়লো এবং জিজ্ঞাসা করলো,” এটা কোথা থেকে আসলো তোমার ঘরে?”
বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়েই বললেন,” আরে এটাকে কেনো বের করলি, এটা যে তোর ঠাকুরদার শেষ স্মৃতি এটা এতদিন একটা ট্রাংক আর মধ্যেই পরে ছিল তাই হয়তো এই জিনিস তোরা আগে দেখিস নি।”
“তা কবে বের করলে এটা ওই ট্রাংক থেকে ?” প্রশ্ন করলো অতীন।
“এই তো দুই সপ্তাহ হলো।”
” তা ঠাকুরদা এই জিনিস কোথা থেকে পেলেন ?”
” দেখ আমার যখন দুই বছর বয়স তখনই তোর ঠাকুরদা নিখোঁজ হয়ে যান তাই এই বই তার কাছে কথা থেকে আসলো তা সম্মন্ধে আমার কোনো ধারণা নাই।”
” ও আচ্ছা। আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই ওখানে গিয়ে কোন চার্চে দিয়ে দেব ওদের জিনিস ওরাই হ্যান্ডেল করতে পারবে। তুমি কিন্তু আমাকে বাধা দিতে পারবে না বলে দিলাম।”
“আচ্ছা তুই যা ভালো বুঝিস কর, তুই যখন বলছিস নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই বলছিস।” অতীনের বাবা অত্যন্ত প্রসন্নচিত্তে উত্তর দিলেন।
রাতে নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে বইটা সম্বন্ধে ইন্টারনেটে খুঁজতে লাগলো অতীন হঠাৎ একটা আর্টিকেলের দিকে তার নজর পড়তে সে বুঝতে পারলেও যে এই বইটি আসল ‘Codex Gigas’ নয় এর একটা কপি মাত্র! এক গুপ্ত সংগঠন শয়তানের আরাধনায় এই বইটি উল্লেখিত মন্ত্র ব্যাবহার করে। মনে করা হয় এই বইটিতে একটি মঞ্চ সঠিকভাবে আড়াতে পারলে শয়তানকে জাগানো সম্ভব। নিচের দিকে কিছুটা স্ক্রোল করতেই একটা ছবির দিকে নজর পড়ল তার। ছবিটা দেখে তার রক্ত হিম হয়ে গেল অতীনের। হুবহু একই ছবি যেটা সে গতকাল কালীঘাটে দেখেছে এবং এতক্ষণে তার মনে পড়ল যে এই এই সেই মূর্তি যেটাকে সে রোজ রাতে তার ভাইকে মারতে দেখে কিন্তু করার ইচ্ছা থাকলেও কিছু করে উঠতে পারে না। এবার যেন অতীন একটু অধৈর্য হয়ে পড়ল। সে তাড়াতাড়ি বইটাকে নষ্ট করার কোন উপায় বের করতে চাইছিল। তার কেন জানি মনে হচ্ছিল এই বইটাই সব নষ্টের গোরা বইটাকে নষ্ট করার কোন উপায় না পেলেও সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করার উপায় পেল অতীন।
‘Holy Water’ ছিটিয়ে পবিত্র কাপড়ে বেঁধে রাখলেই হবে। ছুটে ঠাকুর ঘর থেকে আনা ‘Holy Water’ থুরি গঙ্গাজল এনে ছিটিয়ে দিল বইটির উপর এরপর ঠাকুর ঘর থেকে আনা লালসালুকাপড়ে বেঁধে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। আজকের মত এটাকে এখানেই গুডনাইট জানিয়ে শুয়ে পড়লো অতীন।
পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিদায় নিল অতীন আগামীকাল ফার্স্ট মর্নিং এর ফ্লাইট।
রাতে কলকাতার ঘরে ফিরে সমস্ত প্যাকিং সেরে নিল অতীন সঙ্গে সাহায্য করল শম্ভূও। পরদিন সকালে যথাসময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল অতীন তার সঙ্গে শম্ভু সহ আরো দু চারজন কর্মচারীও এসেছে তাকে অভ্যস্ত না জানাতে। সকলকে বিদায় জানিয়ে এতদিনে প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে এখন সম্পূর্ণ নতুন একটা স্থানে রয়েছে উপস্থিত হতে চলেছে অতীন যেটা তার কাছে সম্পূর্ণই অজানা। ফ্লাইটের অভিজ্ঞতাটা নেহাত মন্দ হলোনা অতীনের ট্রান্সলভেনিয়ার এয়ারপোর্ট এ নেমেই অচিন প্রথমে তার লাগেজ কালেক্ট করল এবং তারপর তাকে রিসিভ করতে আসা ব্যক্তির খোঁজে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো।
অমনি পাশ থেকে একজন ব্যক্তি বুলগেরিও ভাষায় তাকে জিজ্ঞাসা করল,”আপনিই কি অতীন রায়চৌধুরী?”
ভাগ্যিস এখানে আসার আগে রোমানিয়া স্থানীয় ভাষা গুলি শিখে নিয়েছিল বলে নিজেকে মনে মনে ‘সাবাস’ বলে উঠল অতীন।
অতীন উত্তর দিল,”হ্যাঁ, আমি অতীন।”
“আমি আপনাকে নিতে এসেছি স্যার আসুন বাইরে আপনার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে” লোকটি বলে উঠলো।
লোকটি লাগেজ হাতে নিয়ে বাইরের দিকে চলতে লাগলো এবং অতীনকে তাকে অনুসরণ করতে বলল, “চলতে চলতে লোকটি বলল আমার নাম ‘পাদ্র’ আমি আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট।”কথা বলতে বলতে তারা বাইরে এসে পৌঁছেছে। গাড়ির ড্রাইভারকে অতীনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বলল,”ইনি আমাদের নতুন বস এখন থেকে তোমাকে এনার আন্ডারেই ডিউটি করতে হবে আর স্যার এ হলো নিকোল, আপনার ড্রাইভার।”
পরিচয় পর্ব শেষ হলে তারা রওনা হয় পাদ্র লোকটা অত্যন্ত মিশুকে স্বভাবের সারা রাস্তা ধরে শুধু গল্প আর রাস্তায় পরা দর্শনীয় স্থানগুলি অতিনকে দেখাতে থাকলো।
ফ্ল্যাটে পৌঁছে অতিনসহ তার সব জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার পর তারা বিদায় নিল।
অতীন অবশ্য খুব বেশি কিছু সাথে করে আনেনি কারণ সে জানে তা ট্রান্সফারটা ট্রানসলভেনিয়াতে পার্মানেন্ট নয়। কিছু বিশেষ প্রজেক্ট এর জন্যই তাকে এখানে ডাকা। আগামীকাল অফিসে গিয়ে সেসব বিষয়ে বিশদে জানতে পারবে অতীন। পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় হলে জেটল্যাগের কারণে তার উঠতে দেরি হয়ে যায় ফলে তৈরি হয়ে অফিসে ঢুকতে ঢুকতে তার প্রায় ৩০ মিনিট দেরি। তাতে অবশ্য বিশেষ কোনো সমস্যা হল না অতীনের অফিসের সবাই আগে থেকেই অনুমান করেছিল যে প্রথম দিন তার দেরি হবেই। কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলো অতীন। নানা দেরির জন্য নয়, প্রজেক্ট নিয়ে! অচিনদার কোম্পানি U.A.I. Limited একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানি। অচিন তাতে অ্যাকাউন্টেন্ট এবং ভ্যালুয়েশন অফিসারের চাকরি করে। তাকে এখানে প্রথমেই যে প্রজেক্টটি দেওয়া হয়েছে তা হলো ট্রানসেলভেনিয়ার কাউন্ট Vlad the second Dracul এর পুত্র Vlad the third Dracul অর্থাৎ যাকে আমরা সকলে ড্রাকুলা বলে চিনি, তার প্রাসাদের মূল্য নিরূপণ করে রিপোর্ট তৈরি করা। এটা কোন সমস্যাই নয় কিন্তু তাকে ওখানেই কাছে পিঠে কোথাও থেকে কাজটা করতে হবে। আসলে কাউন্ট-
এর প্রাসাদ এখান থেকে প্রায় 100 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই রোজ যাতায়াত করার থেকে ওখানে থেকে কাজটা করলেই ভালো হবে বলে কোম্পানির বড়কর্তারা মনে করেন।
অফিসে বসে বসে নিজের হতভাগ্যের জন্য বিধাতাকে গালমন্দ করতে করতে আসন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার একটা পরিকল্পনা তৈরি করতে লাগলো অতীন। সে ঠিক করল আগামীকালই সে রওনা হবে, লোকালয় থেকে কাউন্টের ক্যাসেল ছিল প্রায় মাইল খানেক ভেতরে। বনজঙ্গলে ঢাকা কর্পেথিয়ান পাহাড়ের ওপরে। জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠা অন্ধ বিশ্বাসের কারণেই হয়তো এখনো সেখানে লোকালয়ের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অতীন ঠিক করল আগে সে একাই গিয়ে দেখবে তারপর টিম ডাকবে। যদি দেখা যায় সেই প্রাসাদের ইন্সুরেন্স করা না করা একই ব্যাপার তবে অযথা এতগুলো লোক
ডেকে হ্যারাসমেন্ট করার কোন মানেই হয় না। বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে গেল আজ নতুন দেশে প্রথম দিন বলে তাকে শহর ঘুরে দেখার জন্য ছুটিটা দেওয়া হয়েছে। গাড়িতে যেতে যেতে ওয়ালাচিয়া শহরটিকে ভালো করে দেখতে লাগল অতীন। স্বপ্নের মত শহর সেই পুরনো কাঠামোকে রেনুয়েট করে যুগোপযোগী করে তোলা হলেও সেই পুরনো ক্লাসি রয়ালিটিটা রয়েই গেছে। কিন্তু তাকে এই নিস্তব্ধ রাতের কালো মধুর সৌন্দর্যের চেয়েও মনের দুশ্চিন্তায় বেশি প্রভাবিত করছে। সে নিকলকে বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলল। বাড়ি ফিরে অতীন তার পিঠ ব্যাগে পার্সোনাল ল্যাপটপ, খাতা, পেন, এবং তার জামাকাপড় সহ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিপত্র গুছিয়ে নিল। যে জিনিসটা অতীত নিতে ভুলে যাচ্ছিল সেটা ছাড়া এখন যে কারোরই জীবন অচল। তার স্মার্টফোনের চার্জার! চার্জার ঢুকিয়ে অতীন সর্বশেষে সেই বইটি ঢুকিয়ে রাখল কিন্তু সঙ্গে পেচিয়ে দিল আশেপাশে নিকলকে দিয়ে জোগাড় করা ক্রসটাকে। এমন একটা ভয়ংকর জায়গায় যাচ্ছে অতীন তাই নিকোল নির্দ্বিধায় তাকে এই ফিতাযুক্ত কাঠের ক্রস টা জোগাড় করে দিলো। রাতে ডিনার সেরে শুতে যাচ্ছ অমনি সে দেখে ফ্ল্যাটের জানালার ওপাশে একজন কালো আল-খাল্লা পরা ব্যক্তি জানালার শিক ভেঙে তার ঘরের ভেতর প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। সে শীঘ্রই পাশের রুম থেকে একটা লাঠি জোগাড় করে একটা দরজার পিছনে ঘাপটি মেরে বসে রইল নির্ঘাত লোকটা চোর না হলে ওর অন্য কোন বদ মতলব আছে। তাই ঠিক লোকটা যারা লক ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করল। কিন্তু একটা বিষয় অতীনকে ভারী চিন্তিত করে তুললো সামনেই তার টাকা ভর্তি ওয়ালেট এবং অত্যন্ত দামি স্মার্ট থাকা সত্ত্বেও লোকটি সেগুলোর দিকে ফিরেও তাকালো না। সে যেন কোন বিশেষ কিছু খুঁজছে। অতীন এবার ভারী অধৈর্য হয়ে পড়ল তাই সে এক মুহূর্তও দেরি না করে হাতে থাকা লাঠিটা দিয়ে লোকটার মাথায় সজোরে একটা বাড়ি দিল। লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। লোকটার মুখ থেকে ঢাকা সরাতে চেষ্টা করলো অতীন অমনি সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ লোকটি তাকে এক ধাক্কা দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। অতীন ছিটকে পড়ল পেছনে থাকা দেওয়ালের উপর, তার মাথা ঠুকে গিয়ে সে জ্ঞান হারালো।অতীনের জ্ঞান যখন ফিরল তখন সকাল সাড়ে সাতটা। উঠেই তার মাথার মাথার পেছনে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করতে পারলো অতীন। উঠে পড়ে ফ্রেশ হয়ে তার ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে গতকাল রাতের ঘটনাক্রম মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো অতীন। “আচ্ছা, লোকটার মতলবটা কি ছিল? সামনে এত টাকা, দামি জিনিসপত্র থাকতে সে কি খুঁজছিলো আমার ঘরে?”
মনে মনে প্রশ্ন করলো অতীন। এসব ঘটনার অংক কষতে গিয়ে অতীন প্রায় ভুলেই গেছিল তার প্রজেক্টের কথা। কোম্পানি একটা ইমেইলের দিকে নজর যেতে আবার মনে পরে গেলো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গেল অতীন। কথা ছিল শহরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গাড়ি করে যাবে অতীন কিন্তু তারপর গাড়ি যাওয়ার কোন নিরাপদ রাস্তার না থাকায় সেই জঙ্গলময় পথ তাকে ঘোড়ার গাড়িতেই পার করতে হবে। বর্গপাসের থেকে শুরু জঙ্গলের। তারপর মাইল খানে গেলে কার্পেথিয়ান পাহাড়ের চূড়ায় কাউন্টের ক্যাসেল। সময় মত গাড়ি এসে গেল এবং ব্যাগসহ গাড়িতে উঠে পড়ল অতীন। গাড়িতে বসে সে তার গোটা শরীরে মস্কিটো রেপেলেন্ট লাগাতে লাগাতে অতীন বলল,”জানিনা কোন বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হবে তাই প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর।”
নিকোল জিজ্ঞাসা করল,”স্যার, ওটা কেন মাখছেন? রাতের আগেই তো ফিরে আসবো আমরা।”
অতীন একটু ঠাট্টার সুরেই উত্তর দিল,”তোমাদের ড্রাকুলাকে দূরে রাখার জন্যই মাখছি, যদি মশাদের মত ড্রাকুলাও…..”
“তাছাড়া কে বলেছে তোমায় যে আমরা আজ ফিরব?”
“মানে আপনি আজ ফিরবেন না?”
“না মিস্টার নিকোল আমি ফিরব দুদিন পর।”
Oh God! ওই অভিশপ্ত জায়গায় আপনি রাত কাটাবেনা, ড্রাকুলা না খেলেও চোর-ডাকাত কিংবা বুনোশেয়ালের খপ্পরে পড়বেনি দয়া করে এমনটা করবেন না স্যার এটা আমার অনুরোধ আপনার কাছে।”
“দুর ছাড়োতো আমি ওখানে না গেলে আমার চাকরি চলে যাবে এমনিতেই শেষ হয়ে যাব এর চেয়ে অন ডিউটি মরলে অন্তত ইন্সুরেন্সের টাকাটা তো আমার বাড়ির লোক পাবে!”
অনেকবার করে অনুরোধ করা সত্ত্বেও যখন অতীন শুনলো না নিকোল বাধ্য হয়েই তাকে তার গন্তব্যস্থলে তাকে নামিয়ে দিল। কিন্তু যাওয়ার আগে তার হাত থেকে একটা ব্রেসলেট খুলে অতীনের হাতে দিল এবং বলল,”স্যার আমি চাইনা আপনার কোন বিপদ হোক আপনি আমাদের অতিথি। এটা আপনার হাতে পড়ে নিন। আর রাস্তায় কিছু দূরে গিয়ে একটা গির্জা আছে একমাত্র সেখানেই আপনি নিরাপদে বিশ্রাম এবং খাওয়াটা সারতে পারবেন।” বলে সে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
অতীনের কোম্পানি শহর থেকে আগেই একটা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে তাই কোন সমস্যাই নেই অতীন ঘোড়ার গাড়িতে উঠে চালককে চলার জন্য বলতেই গাড়ি চলতে লাগলো ঘন অরণ্য ভেদ করে। ঘোড়া ছটা শব্দে যেন কেঁপে উঠল অরন্যরে যেন কোন মহাশক্তিশালী ব্যক্তি ছুটে আসছে কার্পেট পাহাড়ের কাসেল ড্রাকুল এর দিকে। অত্যন্ত ঘন অরণ্যটি।
ঘন্টাখানেক চলার পর নিকোলের কথামতো একটা চার্জ দেখতে পেল অতিন। এই প্রত্যন্ত অরণ্যের মাঝে এমন অদ্ভুত এক চোখ কেড়ে নেওয়া স্থানও যে থাকতে পারে তা বোঝা দুষ্কর। গাড়ি চালককে সেদিকে গাড়ি ঢোকাতে বলল অতীন। গাড়ি থেকে নেমে বাইরে কাউকে দেখতে পাওয়া গেলো না। নিকোল তাকে এখানে পাঠালো একদিকে ভালোই হলো। যদি তেমন কাউকে পাওয়া যায় তবে বইটার সদগতি করা যাবে। চার্চে বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করল অতে এবং ঈশ্বরকে প্রণাম করে কিছুক্ষণ একটা বেঞ্চে বসে রইল এবং প্রার্থনা করতে লাগলো যেন তার জীবনে আসন্ন বিপদেবিপদের হাত থেকে ঈশ্বর তাকে রক্ষা করে। হঠাৎ কেউ ইংরেজিতে বলে উঠলো,”oh God, please protect us from all evil spirits!”
অচিন চোখ খুলে দেখলো একজন প্রিস্ট তার সামনে দাঁড়িয়ে। মধ্যবয়সী ব্যক্তির সাজসজ্জা দেখেই তাকে বড় মাপের সাধক বলে মনে হচ্ছে হঠাৎই অতীনের মুখ ফসকে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে আসে,”ক্যাথলিক?”
লোকটি একটু গম্ভীর স্বরে বললেন,”হ্যাঁ, ভ্যাটিকান সিটি।”ক্যাথলিক চার্চকে প্রাচীন কালে সর্বোচ্চ মান্যতা দেওয়া হতো, আর ভ্যাটিকান সিটি ছিল তাদের কেন্দ্র। ওখানকার প্রত্যেক সদস্যকে স্পেশাল ট্রেনিং দেওয়া হতো ‘exorcism’ আর ‘spiritology’- তে।
লোকটি বললেন আমি হলাম,”ফাদার অ্যাডাম গ্রিন।আমি এখানকার রক্ষক। এই ঘন জঙ্গলে হঠাৎ একজন ভারতীয় কি মনে করে?”
অতীন কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ফাদার এর নজর যায় ওর হাতে থাকা ব্রেসলেটের দিকে এবং উনি যেনো তার চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছেন না এমন দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“এটা তোমার কাছে কোথা থেকে এলো?”
অতীন সরাসরি উত্তর দিল,”ওহ ওটা এটা তো আমার বন্ধু আমায় দিয়েছে।”
“আমি এটার কথা বলছি না”
” তবে।”
“বইটা তুমি কোথা থেকে পেলে সব সত্যি করে বলো।”
“আসলে এটা আমার ঠাকুরদার কাছে ছিল বলে আমার বাবা দাবি করেন। কিন্তু উনি এটা কোথা থেকে পেয়েছেন তা আমি বলতে পারছি না।”
“এটা পাওয়ার পর তোমার কাছে নিশ্চয়ই কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা চোখে পড়েছে?”
“হ্যাঁ অনেক কিছু কিন্তু তখনো এটা আমার হাতে আসেনি।”
“বুঝলাম, আচ্ছা এটা কেউ চুরি করার চেষ্টা করেনি?”
“না কেউ তো এক ব্যাপারে কিছু জানেই না তবে চুরি করবে কিভাবে?”
“কি! এখানে আসার পরও নয়?”
“না তেমন কিছু না।”
“তবে ওদের উদ্দেশ্যটা কি? সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
“হ্যাঁ, মনে পরল গতকাল রাতে আমার ঘরে কেউ ঢুকেছিল জানিনা কেন কিন্তু সামনে টাকা ভর্তি পার্স থাকতেও ওইদিকে চোখও দিল না। যেন সে অন্য কিছুর খুঁজে এসেছিল।”
“বুঝেছি, তবে বইটা বর্তমানে কোথায় আছে?”
“এইতো আমার ব্যাগে”- বলে ব্যাগ থেকে বইটা বের করে দেখালো। বইটা হাতে নিয়ে বইটার দিকে কম বরং ওর উপর থাকা ক্রসটার দিকেই বেশি নজর দিচ্ছিলেন ফাদার গ্রিন যেন এই ক্রস তার কত দিনের পরিচিত। ফাদার বইটা অতীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,”এটা একটা অতি অপবিত্র জিনিস আমি এটাকে রাখতে পারব না, এটা তোমার কাছেই রাখো কিন্তু একটা কথা এই বই যেন তুমি তুমি বাদে অন্য কেও স্পর্শ না করতে পারে। কারণ এই বইতে যে একবার স্পর্শ করবে তার সঙ্গে কিছু না কিছু হবেই মৃত্যুও হতে পারে”
অতীন মনে মনে ভাবল উনার সাথে সব কথা খুলে আলোচনা করা দরকার। তাই সে ফাদারকে সমস্ত ঘটনা বলি একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে লাগলো। যে কি করে সেদিন সে বাইরে গেল, তার ভাইয়ের মৃত্যু, গঙ্গার ঘাটের ঘটনা, রোজ দেখা স্বপ্ন, তার বাবার অস্বাভাবিক হার্ট অ্যাটাক এবং এখানে আসার উদ্দেশ্য সমস্ত কিছু।
অতীনের কাছে সব শুনতে শুনতে ফাদার গ্রীন অতীনের পাশে একটি বেঞ্চে বসে পড়লেন। তার কথা শেষ হলে ফাদার বললেন,”দেখো অতীন আমি একজন ক্যাথলিক প্রিস্ট আমি সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আরো অনেক কিছু এমন শিখেছি যা সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্ন বলে মনে হবে আর তোমার বিবরণ অনুসারে তুমি যা দেখেছ তা বাফমেট ছাড়া আর কেউ নয়।”
“আর ফাদার কে এই বাফমেট ?” অতীন একটু ভীতিসহকারে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল ফাদারের উদ্দেশ্যে।
বাফমেট হল নরকের অধীশ্বর শয়তানের একটি রূপ।
“কি শয়তান কিন্তু হঠাৎ শয়তান আমার পেছনে লাগবে কেন?”
“কারণ এই বইটাতে সর্বপ্রথম এই বইটাতে তোমারই হাত পড়ে হয়তো ছোটবেলায় কোনদিন ভুলবশত এটা তো তোমার হাত লেগে যায় যার ফলে আজ এই বিপত্তি।”
“কিন্তু শুধুমাত্র হাত দেওয়ার কারনে এটা তো হওয়ার কথা না, শয়তানকে জাগাতে হলে বিশেষ মন্ত্রের উচ্চারণ করতে হয়।”
“তাহলে ফাদার?”
“তারমানে ওরা জাগিয়েছে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।”
“কারা ফাদার, কিইবা তাদের উদ্দেশ্য?”
“শয়তানের অনুগামীরা, তাদের উদ্দেশ্য তোমার মৃত্যু।”
“শোনো অতীন তুমি যেখানে যেতে চাইছ সেটা অত্যন্ত বিপদজনক জায়গা তাই তো এতদিন পরও ওই জায়গার আশেপাশে কোন জনবসতি গড়ে ওঠেনি। ওখানে যেও না প্লিজ!”
“তা কি করে হয় ফাদার? আমি ওখানে না গেলে আমার চাকরি চলে যাবে যে!”
“দেখো অতীন ছেলে মানুষই করো না এটা তোমাদের ভারত নয় ট্রানসেলভেনিয়ার জঙ্গল এখানে এমন অনেক কিছুই হয় যা শিক্ষিত সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। দিনের বেলাতে যে পাহাড় পর্বত বেষ্টিত সুন্দর বনভূমি সকলকে মুগ্ধ করে সূর্যের আলো কমে আসার সাথে সাথে সেটাই হয়ে ওঠে অশরীরীদের আড্ডা। রাতের বেলা নরকের দ্বার খুলে যায় এখানে। দুই দুনিয়ার মধ্যেকার প্রাচীর ভেঙে যায়। ওরা বিভিন্নরূপে ঘুরে বেড়ায় কখনো বাদুড় কখনো নেকড়ে কখনো মানুষ।”
“কি যে বলেন না ফাদার ব্রাম স্ট্রকারের গল্প থেকে দুই চারটা লাইন তুলে দিয়ে আপনি ভাবছেন আপনি ভয় পাব তা হচ্ছে না ফাদার। তাছাড়া কারণ তো কাউন্ট কবেই মরে গেছে তবে ভয় কিসের?”
“ছেলেমানুষী করোনা অতীন। তুমি কেন বুঝতে চাইছ না। তার ওপর আজ সেন্ট জর্জিয়াস ডে আজ ওদের দিন। বহু অশরীরীরা পৃথিবীতে নেমে এসে তাদের আসর বসাবে। তুমি আজ যেও না।”
ফাদারের কথা শেষ হওয়ার আগেই অতীনের কোচম্যান পেছন থেকে বলে উঠল,” স্যার, চলুন এখনই বেরোতে হবে নাহলে সূর্য ডোবার আগে আর জঙ্গল পেরোনোর কোনো উপায় হবে না।”
অতীন ফাদারকে গুডবাই জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো পিছন পিছন ফাদারও। ফাদার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বলার আগেই অতীন গাড়ি ছোটানোর আদেশ দিল।
তক্ষক ধক ধক শব্দ করে আবার জঙ্গল ফাটিয়ে চলতে শুরু করলো অতীতের ঘোড়া গাড়ি।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর অতীন একটি বসতি জাতীয় কিছু একটা দেখতে পেল কোটম্যান বলল,”স্যার, আজ রাত এখানেই কাটাতে হবে। অন্ধকার নামার পর বনে বাঁদাড়ে ঘুরলে আর কিছু হোক চায় না হোক পথ ভুল হবেই।”
অতীনও তার রাতটা কাটানোর জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে সামনের বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজায় দুবার টোকা করতেই সামনে থেকে একজন অতীনেরই বয়সী এক সুন্দরী নারী বেরিয়ে ভাঙা ভাঙা জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করল,” কি চাই?”
অতীন জার্মান কিছুটা জানে তাই সে তার থাকার বিষয়টা মেয়েটাকে জানাতেই সে অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে তাকে রাতটা কাটানোর আশ্রয় দিতে রাজি হয়ে গেল।
কোচম্যান রাতে তার গাড়িতেই থাকবে পাছে যদি কেউ তার গাড়ি বা ঘোড়া নিয়ে চম্পট দেয় তাই আরকি। অতীন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো এবং দেখলো বাইরে থেকে যেমনি হোক ভেতরে অত্যন্ত পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন এবং গুছিয়ে রাখা বাড়ির প্রত্যেকটি কোনা। লিভিং রুমে একটা সোফায় বসে ছিল অতীন। ভাবছিল এমন ঘন জঙ্গলে এত সুন্দর কাঠ পাথর দিয়ে তৈরি বাড়িও পওয়া যাবে ত কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি অতীন। “ফাদার বেকারী ভয় করছিলেন।” মনে মনে ভাবলো সে। বাড়িটিতে আমার প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেছে কিন্তু সেই মেয়ে ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পায়নি অতীন।
এইবার মেয়েটি সামনে এলে তাকে প্রশ্নটা করবে মনে মনে। ভেবে নিল সে। মেয়েটির আবার দেখা মিলল আরো মিনিট দশেক পর, অতীন তার ল্যাপটপে কাজ করছিল। সে হটাৎ এসে তাকে এক কাপ কফি দিয়ে চলেই যাচ্ছিল কিন্তু অতীন তাকে আটকে নিল। এবং জিজ্ঞেস করলো ,” বাড়ির অন্যরা কোথায়?”
“অন্যরা বলতে শুধু আমি আর আমার বাবাই থাকি এখানে।”
“ওহ আচ্ছা। তা কোথায় তোমার বাবা?”
“বাবা কাজে গেছে ফিরতে দেরি হবে। ততক্ষনে আপনি ঘুমিয়ে যাবেন।”
“বুঝলাম।” বলে অতীন মনে মনে বললো ” ইশ আগে জানলে যে এখানে এ একাই আছে তবে থাকার জন্য কক্ষনো রাজি হতাম না আমি। কিন্তু কি করবো এখন তো আর এভাবে বেরিয়ে যাওয়া যাবে না। অগত্যা থেকেই যাই।”
দেখতে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত গভীর হলো অতীন ততক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হঠাৎ পাশের ঘর থেকে আসা একটা খটখট শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল যেন কেউ নিজের মাথা দেওয়ালে ঠুকছে। অতীন ভয় পেয়ে গেল,”শেষটায় হিতে বিপরীত হবে নাকি? কাছে এসে মার্ডার কেসে ফাসতে হবে?”
ওদিনের পাশের যে ঘর থেকে আওয়াজ আসছিল সেটাতেই মেয়েটি শুয়ে ছিল। অতীন জানে কারণ মেয়েটাই তাকে বলেছিল রাতে কোন প্রয়োজন হলে ডাকতে। অতীনের মাথায় কিছু ঢুকছিল না সে ছুটে গিয়ে মেয়েটির ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“কি যেন নাম বলেছিল মেয়েটা?”
“হ্যাঁ মনে পড়েছে, মেরি।”
মেরি! মেরি! কি হয়েছে তোমার? চিৎকার করতে করতে সে দরজায় ধাক্কাচ্ছিল হঠাৎ সজোরে এক ধাক্কা মারলো দরজার ওপর তাতে সশব্দে দরজা খুলে গেল।
ভেতরে তো মূল অন্ধকার ঐ কালো আঁধারের মধ্যে তার চোখ চারিদিকে ঘুরিয়ে নিল কিন্তু,”সে কি মেরি কই?”
হঠাৎ নাকের কাছে একটা মিষ্টি গন্ধ অনুভব করলো। গন্ধটা তার খুব চেনা কিন্তু সে মনে করতে পারছে না যে ঠিক কোথায় সেটা অনুভব করেছে। হঠাৎ তার মনে হল এ ঘরে সে একা নয় তার পেছনে কেউ আছে। অতীন তৎক্ষণাৎ পিছনে ঘুরতেই দেখল সেখানে কিছুই নেই! এবার ঘরের ভেতর থেকে এক শব্দ ভেসে এলো অতীনের কানে অতীন ঘরের দিকে তাকাতেই দেখে, এজে মেরি কিন্তু যে শব্দটি তার কানের কাছে আসছিল। তা যাতা শব্দ নয় কোনো গান বা কবিতা জাতীয় কিছু কেউ না না ভুল হলো কারা বিশেষ সুর অনুসরণ করে আওয়ারে যাচ্ছে।
কিন্তু অতীনের সেদিকে ধ্যান গেল না সে এখন মেরির সৌন্দর্য এবং সেই গন্ধের নেশায় মত্ত হয়ে আছে যেন এই বিষয়গুলো তাকে সম্মোহিত করে রেখেছে অতীন দেখলো মেরি তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে যেন তার শরীরের উপরে নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে এটাও দেখতে পেলো না যে তার গলায় থাকা মনিটা উজ্জল ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। অতীন মেরির একদম কাছে পৌঁছে গেছে যেই মেরি তাকে স্পর্শ করতে গেল অমনি অতীন পেছন থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেল “এক পাও এগোবে না অতীন ওটা কোনো মানুষ নয়।”
অতীনের ঘোর কেটে গেলো সে পিছনে ফিরে দেখলো ফাদার গ্রীন তাকে পিছিয়ে আসতে বলছেন। অতীন এক মুহূর্তও দেরি করলো না। একছুটে ফাদারের দিকে চলে গেলো। ফাদার মন্ত্র উচ্চারণ করলেন,” আতাস্টা স্যাকুবাসা ডিমোনোস্টা স্পিরিটুয়া হ্যালিসাকাম!”
এবং একটি তীব্র আলোকরশ্মি এসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য অতীন কিছুই দেখতে পেল না যখন চারিদিক পরিষ্কার হলো তখন সে দেখল সে আর ফাদার জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে। “সে কি বাড়ি কই?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো অতীন।
“এখানে কোন বাড়ির ছিল না, না কোনো গ্রাম। এটা একটা ছলনা ছিল। যার সাথে তুমি ছিলে সেটা কোনো মানুষ নয় ওটা একটা সে স্যাকুবাস! আমি যথা সময় না এলে এখনই সব শেষ হয়ে যেত।”
“কিন্তু আমার গলার মণিটা আমায় রক্ষা করল না কেন যদি ওই বৃদ্ধের কথা সত্যি হয়ে থাকে তবে আমার তো কিছু হওয়ার কথা নয়।”
অতীনের কথা শেষ হতে না হতেই আকাশ ফাটিয়ে একটা দৈববাণী শোনা গেল,”বৃদ্ধের সব কথা মনে নেই তোর? তোকে বলা হয়নি কোনো অশুভ, অপবিত্র কাজের অংশ না হতে। একটু আগেই কি করতে যাচ্ছিলিস? আমি এখানকার অভিশপ্ত মাটিতে পা দিতে পারব না। তাই বলে তোকে মরতেও দেবো না আমি। ফাদার গ্রীন তোকে রক্ষা করবে।” বলেই আবার সব চুপ।
অতীন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,”এসব কি হচ্ছে ফাদার, আমাকে একটু খুলে বলবেন?”
ফাদার একটা পাথরের উপর বসলেন এবং বলতে শুরু করলেন,”বহুকাল ধরেই পৃথিবীতে একদল অসৎ মানুষের গোষ্ঠী শয়তানের পূজা করে আসছে তাকে বারবার জাগিয়ে তুলছে এসব চার্জের নিয়মের বিরুদ্ধে। তাই চার্জ ঠিক করে একটা গুপ্ত বাহিনী তৈরি করবে যারা শয়তানের সেবকদের বাধা দেবে এবং শয়তানকে আবার নরকে পাঠিয়ে দেবে। তোমার ঠাকুরদাও কোনো ভাবে এর মধ্যে কোনভাবে জড়িয়ে পড়েন আর আমি ট্রেনিংয়ের পর এসে পৌঁছাই এখানে আমি এবং আমার সঙ্গীরা কাউন্টকে বন্দি করে রাখি। কিন্তু তোমার ঠাকুরদা অমরেশ যে কিনা আগে আমাদের সঙ্গী ছিল হঠাৎ বিশ্বাসঘাতকতা করে। শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে তার দাসত্ব স্বীকার করে নেন তাই তিনি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তার বাড়ি থেকে। কিন্তু তার বইটা এখানে পড়ে থাকে যায়। এটা ‘Codex Gigas’- এর কোনো কপি নয় এটা আসল কিন্তু পরে তৈরি। আর এই ক্রসটা যেটা তুমি বইটার উপর রেখেছো এটা ভ্যাটিকানে বিশেষভাবে তৈরি করা একমাত্র এটার মাধ্যমে আঘাত করলেই শয়তানকে আবার নরকে পাঠানো সম্ভব।”
অতীনের মাথায় কিছু ঢুকলো না হঠাৎ তার নাকে একটা আস্ত ধরনের বিশ্রী গন্ধ প্রবেশ করল। অতীন বুঝলো গন্ধটা ক্রমশ বাড়ছে। ফাদারের একটা প্রবল আর্তনাদে অতীন চমকে উঠল ফাদারের দিকে তাকাতেই সে দেখল শয়তান ফাদারকে তার বাঘের চেয়েও তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে আঘাত করে গলা টিপে ঝুলিয়ে ধরে আছে। ফাদারের সমস্ত দেহ থেকে টুপ টুপ করে রক্ত ঝরছে।
অচেনা সহ্য করতে পারছিল না এসব সে বলে উঠলো তোমার আমাকে চাই তুমি আমাকে নিয়ে যাও কিন্তু দয়া করে উনাকে ছেড়ে দাও কথা শুনতেই ফাদার গ্রিনকে শয়তান জোরে পাশে একটা গাছের গুড়ির উপর ফেলে দিল। শয়তান অতীনের দিকে এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে আসতে লাগলো অতীন তার এক হাত দিয়ে মনিটা খুলে নিলো অপর হাতে ক্রসটা নিয়ে শক্ত করে ধরে থাকলো অতীন প্রথমে খেয়াল করেনি সেই ক্রসটার নিচের দিকটা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। যেই শয়তান অতীনের একদম কাছাকাছি পৌঁছেছে অমনি সে তার ক্রসের তীক্ষ দিকটা দিয়ে মনিটাতে আঘাত করে মনির ভিতরের তরলটা ক্রসে ভালো করে মাখিয়ে নেয়। অতীন তারপর অত্যন্ত শীঘ্রই তা শয়তানের বুকে ছুড়ে মারে এবং একঘায়ে তার বুকে ক্রসটি গেঁথে যায়। তীব্র কান ফাটানো আর্তনাদ করে ছাই হয়ে বাতাসে মিশে যায় শয়তান।
ঘটনাটার দুদিন কেটে গেছে অতীন আর ড্রাকুলার প্রাসাদে যাইনি, চার্চেই আছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নিজের দেশেই কিছু একটা করবে। সময় তখন সকাল আটটা অতীন বাইরের বাগানে দাঁড়িয়েছিল, ফাদার তার পাশে এসে দাড়ালেন এবং বললেন,”দেখ অতীন এটার শুরু কিভাবে হয়েছে তা তুমি অবশ্যই জানতে পারবে। কিন্তু এই অভিশাপ তোমার পুরো পরিবারকেই ভুগতে হবে বংশানুক্রমে। বারবার শয়তান ফিরে আসবে যতদিন না তাকে জাগানো বন্ধ হবে।”
“আমি হতে দেবো না ফাদার অনেক হয়েছে আমি কাটিয়ে ছাড়বো এই অভিশাপ। মা কালী আমার পাশে আছেন আমি জানি, বুঝতে পারি। আমি কটাবই এই অভিশাপ, ট্রানসেলভেনিয়ার অভিশাপ। মনে রাখবেন ফাদার আমরা যতই ধর্মে বিভক্ত থাকি না কেন ঈশ্বর এক। যার প্রমাণ আমরা এই ঘটনাবলী থেকেই পেয়েছি।