Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » টুকুনের অসুখ || Atin Bandyopadhyay

টুকুনের অসুখ || Atin Bandyopadhyay

খরা, প্রচণ্ড খরা। কবে কোন বছরে একবার বৃষ্টি হয়েছিল এ অঞ্চলে, কবে কোন বছরে সবুজ শ্যামল মাঠ ছিল এ অঞ্চলে—মানুষেরা তা যেন ভুলে গেছে। গ্রাম মাঠ খা খা করছে। নদী—নালা সব হেজে মজে গেছে। শুকনো বাতাস আর মাঠে মাঠে শুধু ধুলো উড়ছে।

ফাল্গুন মাস, বৃষ্টি হচ্ছে না। মনে হয় কোনোদিন আর বৃষ্টি হবে না। মাঠে শুধু ধুলো উড়ছিল। গোরু—বাছুর নিয়ে দেশ ছেড়ে মানুষেরা সব চলে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের মতো। ধান—চাল নেই, মাঠে শস্য নেই। দু’সাল হল দুর্ভিক্ষের মতো চলছে।

গ্রামের পর গ্রাম মাঠের পর মাঠ সব জলবিহীন। নদী যেখানে গভীর ছিল সেখানে সামান্য মাটি খুঁড়ে গত সালেও জল পাওয়া যেত—এবার তাও নেই।

যা কিছু অবশিষ্ট মানুষ গ্রামে রয়েছে, নারী যুবক—যুবতী, ছেলে বুড়ো সকলে মাটি খুঁড়ছিল নদীর ভিতর। ভিতর থেকে যদি সামান্য পরিমাণ জল পাওয়া যায়। সামান্য জল পেলে ওরা সংরক্ষণ করে রাখবে। অন্তত আগামী বর্ষা পর্যন্ত ওরা সেই জল নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।

সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি সকলের আগে আগে কাজ করছিল। তার হাতে যেন গুপ্তধন আবিষ্কারের চাবিকাঠি। সে দাগ দিয়ে যাচ্ছিল লাঠি দিয়ে। বালির ওপর একটা করে গুপ্তচিহ্ন রেখে যাচ্ছে। আর প্রতিটি গুপ্তচিহ্ন প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাত দূরে, এঁকেবেঁকে গেছে অনেকটা সাপের মতো—কারণ কেউ জানে না নদী কোথায় অন্তঃসলিলা। এ নদী যদি মরে যায়, মানুষরা তবে সব মরে যাবে। ওদের হাতে সামান্য শস্য—দু’সাল আগের সামান্য শস্য—সঞ্চিত শস্য এখন প্রায় নিঃশেষ, তবু এই জল পেলে তৃষ্ণার হাত থেকে বাঁচবে, জল পেলে পাতা ঘাস এবং অন্য যা কিছু আছে এ অঞ্চলে, পাহাড়ে, ছোট পাহাড় অঞ্চলে এখনও যেসব লতাগুল্ম রয়েছে, তার শিকড়—বাকড় আছে, বনআলু রয়েছে, জল পেলে যে—কোনোভাবে সিদ্ধ করা যাবে, খাওয়া যাবে, খেলে পরে এ বর্ষাকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে।

এই মাটি, বাপ—পিতামহের মাটি। সোনার ফসল হত মাটিতে। সব ফসল হায় কোথায় এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটির হাতে লাঠি। সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। নদীর দু’ধারে ছোট ছোট পাহাড়। ঝরনার জল আর নামছে না। গাছে গাছে কোনো পাখির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সকলেই যেন মন্বন্তরের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে।

বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছেন, মাটিতে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন। একজন করে মানুষ কেউ চিহ্নের ওপর বসে পড়ছে মাটি খোঁড়ার জন্য। যেখানে জলের সন্ধান পাওয়া যাবে সেখানেই পরদিন জড়ো হবে সব অন্য মানুষেরা—সারাদিন খেটে জল বের করবে। নিজেরা জল ভরে রাখবে ঘড়াতে। জলের জন্য ওরা প্রায় মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ল।

বৃদ্ধ মানুষটিকে মোজেসের মতো মনে হচ্ছিল। লম্বা আলখাল্লার মতো জামা গায়, পায়ে নাগরি জুতা, মাথায় ফেটি বাঁধা। উঁচু লম্বা মানুষ, চুল ছোট করে ছাঁটা, শক্ত চোয়াল মানুষটার। রোদে, জলে অথবা খরার সময়ে মুখে শক্ত সব রেখা—যেন দেখলেই মনে হয় মানুষটা আজ হোক কাল হোক এ অঞ্চলে জল নিয়ে আসবে।

গেরস্থের বউরা, বিবিরা, যুবক—যুবতীরা ছোট—বড় সকলে লম্বা লাইন দিয়ে এঁকেবেঁকে জলের জন্য মাটি খুঁড়তে বসে গেছে। বৃদ্ধ যেখানে পাহাড়ের ঢালু জায়গাটা ছিল, সেখানে উঠে দাঁড়ালে, পেছনে প্রায় দু—তিন মাইল পর্যন্ত শুধু নদীর বালি চোখে পড়ে—খরার জন্য, গ্রীষ্মের জন্য বালি চিকচিক করছিল। নদীটাকে এখন মরা একটা সাপ মনে হয়। আবার মনে হয়—চিত হয়ে আছে অজগরটা। এক লম্বা অজগর—দু—তিন মাইল লম্বা, চার মাইল লম্বা, আরও কত লম্বা হবে কে জানে। বালিয়াড়ি, দিগন্তের দিকে ছুটে গেছে—যেন নদীটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে কারু জানা নেই।

পাহাড়ের পর পাহাড়, কোথাও সমতল মাঠ আবার পাহাড়, ছোট পাহাড়, কত রকমের লাল—নীল পাথর, পাহাড়ে কত রকমের গাছ—গাছালি, গুল্মলতা আর কত রকমের পাখি ছিল। সব পাখিরা উড়ে চলে গেছে। গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে। গাছগুলো মৃতের মতো পাহাড়ময় দাঁড়িয়ে—সমতলভূমিতে সব কুঁড়েঘর, খড়ের চাল। ঝোপে—জঙ্গলে শুধু শুকনো পাতার খস খস শব্দ। ঘাস আর নেই। মাটির নীচে ঘাসের শেকড় মরে যাচ্ছে। বৃদ্ধের মুখে দুশ্চিন্তার রেখা।

ঠিক সামনেই বালুবেলাতে এই অঞ্চলের ছোট ছেলেটি বসে মাটি খুঁড়ছিল। বৃদ্ধ দেখল ছোট ছেলেটি সকলের শেষে মাটি খুঁড়তে বসেছে। ওর গায়ে লম্বা ঝুলের জামা। জামাটি ওর নয়, সুদিনে কী দুর্দিনে ওর বাবা হয়তো তৈরি করেছিল। পার্বণের দিনে ওর মা—বাপ একবার মেলায় গিয়েছিল এবং পরে, এই মাস দুই পরে হবে, ওলাওঠায় বাপ—মা দু’জনই গেছে। তখনও সামান্য জল ছিল পাতকুয়াতে, সামান্য জল তুলে রাখা যেত। এখন এই সামান্য বালকের হাতে একটা খুরপি। পিঠের নীচে বাঁশের এক হাত লম্বা একটা চোঙ। ভিতরে কিছু যত্ন করে রেখে দিয়েছে মনে হয়। বালিমাটি খোঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেই লম্বা একটা চোঙ থেকে ম্যাজিকের মতো ছোট একটা পাখি বের করে আনছিল এবং বোধ হয় শুকনো বটফল খাওয়াচ্ছিল। সে, এই বালক কাজে ফাঁকি দিচ্ছে দেখে পাহাড়ের ঢালু থেকে হেঁকে উঠল—হেই সুবল।

দূরে দূরে এই হাঁক ভেসে যাচ্ছিল। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল।

সুবল তাড়াতাড়ি পাখিটাকে বাঁশের চোঙের ভেতর ভরে মুখটা সামান্য একটা ছোট্ট কাঠ দিয়ে ঢেকে দিল, তারপর আপন মনে এবং একনাগাড়ে সে মাটি খুঁড়তে থাকল। দলের লোকেরা মাটি খুঁড়ছে। ওদের কোচড়ে শুকনো চানা ছিল। ক্ষুধার জন্য ওরা শুকনো চানা চিবিয়ে খাচ্ছিল। শুকনো চানা গালে এবং দাঁতের ফাঁকে সাদা অথবা হলুদ রঙের ফেনা তুলছে। দেখলেই বোঝা যায় ওরা জলের বিনিময়ে নিজের রক্ত চুষে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। মানুষগুলোর মুখ, যুবতীর মুখ, বউ—বিবিদের মুখ, মিঞা—মাতব্বরদের মুখ যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, বৃদ্ধের জন্য ওরা এখনও গ্রাম ছেড়ে পালায়নি, যেন এক বৃদ্ধ সকলকে আটকে রেখেছে। সকলকে বলছে—কোথাও না কোথাও নদীর অন্তঃস্তলে জল আছে, আমাদের এই জল অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।

নদী অন্তঃসলিলা। বৃদ্ধ বড় একটা অর্জুন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবল, নদী অন্তঃসলিলা। নদী কোথাও না কোথাও এইসব লোকালয়ের জন্য জল সঞ্চয় করে রেখে দিয়েছে। কী এমন পাপ ছিল, কী এমন জঘন্য অপরাধ ছিল মানুষের, যার জন্য হায়, ঈশ্বর বাধ সাধলেন। বৃদ্ধ ঈশ্বর বিশ্বাসী। ঈশ্বর মঙ্গলময়। তিনি মানুষের দুঃখ অনন্তকাল ধরে সহ্য করেন না। তিনি নিশ্চয় সরল এবং গরিব এই মানুষগুলোর জন্য নদীর বালুগর্ভে জল সঞ্চয় করে রেখেছেন।

শুধু এখন প্রচেষ্টা। সমবেত প্রচেষ্টা। আজ প্রায় পনেরো দিন ধরে এই সমবেত প্রচেষ্টা—জলের জন্য সপ্তাহে যে মোষের গাড়ি তিনটি আসে, যারা জল আনতে বিশ ক্রোশ দূরে যায়—তাদেরও ক’দিন ধরে আর দেখা নেই। লোকগুলো জলের অভাবে মরে যাবে এবার।

শহর অনেক দূরে—শহরের দিকে যে গেছে সে আর ফেরেনি। ক্রমশ এক—দুই করে গ্রামের মানুষেরা সরে পড়ছে। বৃদ্ধের দু’চোখে জ্বালা এবং যন্ত্রণায় জ্বলছিল। মানুষগুলো বলে দিয়েছে আজই ওরা শেষ চেষ্টা করবে, জল না পেলে শহরের দিকে চলে যাবে। গ্রামে আর একজন মানুষও থাকবে না। মাঠ এবং নদী ভেঙে ওরা সকলে শহরের দিকে চলে যাবে।

দুপুর পর্যন্ত জল পাওয়া গেল না। বালিয়াড়ি তেতে উঠেছে। উত্তপ্ত এই বালিয়াড়িতে মানুষগুলো বসে থাকতে পারছিল না। ওরা বালি খুঁড়ে খুঁড়ে আট—দশ—বারো হাত পর্যন্ত গর্ত করে ফেলেছে, ভিতরে ঠান্ডা ভাব, অথচ জলের কোনো চিহ্ন নেই।

পাহাড়ের ওপারে রেললাইন। দুপুরের গাড়ি চলে যাচ্ছে। পাহাড় এবং মাঠ অথবা দিগন্তের ওপারে ওই রেলের হুইসল ওদের বুকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যেন। ওরা একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল—এই ট্রেনে উঠলে অনেক দূরে এক শহর আছে, বড় শহর, বড় ইটের সব বাড়ি, আকাশ ছুঁয়ে আছে সেই সব উঁচু বাড়ি, কলকারখানা এবং নদীর ওপরে বড় জাহাজ, নদীতে কত জল, জলের জন্য বালি খুঁড়ে মরতে হয় না, সুতরাং সেই শহরে চলে যাবার হাতছানি ওদের মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল।

বৃদ্ধ মানুষটি অর্জুনগাছের নীচে বসে দূরে, বহু দূরে যাদের এখান থেকে পিঁপড়ের মতো মনে হচ্ছিল—লম্বা বালিয়াড়ি, দিগন্তে ভেসে গেছে এই নদী, সোজা, কোথাও বেঁকে নদীর বালুবেলা সূর্যের উত্তাপে আগুনের মতো ঝলসে যাচ্ছিল। মানুষগুলোকে কালো কালো কীটপতঙ্গের মতো মনে হচ্ছে। যেন একটা বড় পিঁপড়ের সারি নদীর মোহনা খোঁজার জন্য নদীর ঢালুতে নেমে যাচ্ছে। পাহাড় উঁচু বলে এবং এখানে সামান্য ছায়া রয়েছে বলে, ঝোপজঙ্গলের শেষ সুষমাটুকু নষ্ট হয়নি। বৃদ্ধ কোথায় এবং কোনদিকে গেলে বনআলু প্রচুর সংগ্রহ করা যেতে পারে—অর্থাৎ এই মানুষ যিনি আপ্রাণ তার মানুষের বেঁচে থাকার এলাদ সংগ্রহের জন্য ভেবে চলেছেন।

কবে একবার এ—অঞ্চলে মহারানির মতো এক সম্রাজ্ঞী এসেছিল—খরা অঞ্চল তিনি দেখে গেছেন। বড় বড় পরিকল্পনা হচ্ছে। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই—জল এ অঞ্চলে আজ হোক কাল হোক আসবে। মানুষগুলো সম্রাজ্ঞীর কথায় প্রাণের ভিতর জীবনধারণের আকুল ইচ্ছায় গ্রাম ছেড়ে পালায়নি। ওরা দিনের পর দিন জলের জন্য অপেক্ষা করছে। জল আসবে। এই গ্রীষ্মের খরা রোদ আজ হোক কাল হোক মরে যাবে। ওরা সকলে একবার আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাল, কোনও দিগন্তে যদি সামান্য মেঘের আভাস চোখে পড়ে। কোথাও কোনও মেঘের আভাস নেই। খালি আকাশ। নীল হরিদ্রাভ বর্ণ, যা শুধু মাঠের ওপর এবং ঘাসের ওপর আগুন ছড়াচ্ছে।

ঘাস নেই, শুকিয়ে কবে ধুলোবালির সঙ্গে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে অন্য কোনও নদী অথবা মাঠের ছায়ার সঙ্গে যেন বাতাসে ভেসে চলে গেছে। মানুষগুলো এখন কোনও মেষপালকের মতো আজগুবি স্বপ্ন দেখছিল। কারণ দুপুরের রোদে, কবে একবার ওরা পেটপুরে তৃষ্ণার জলপান করেছিল মনে নেই—মানুষগুলো সব ঝিমিয়ে পড়ছে। ওদের হাত অসাড় হয়ে পড়ছে। চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মাথা ঘুরছে। ওরা উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিল না। কারণ সারাদিন মাটি খুঁড়ে ওরা জলের সন্ধান পেল না। ওরা ক্লান্ত। এবং প্রায় হতচেতন। ওরা প্রায় কিছুই ভাবতে পারছিল না। ওরা বালিয়াড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এবং এক আজগুবি স্বপ্ন সেই মেষপালকের মতো। হাতে বড় এক শক্ত লাঠি মেষপালকের—আগুন, লাঠি তুললে আগুন। জল, লাঠি তুলতে জল। অন্নবস্ত্র, লাঠি তুললে অন্নবস্ত্র। এমন এক মানুষ কী তাদের জন্য কোথাও অপেক্ষা করছে না! যে তাদের জন্য এই মাটিতে জল নিয়ে আসবে। অন্নবস্ত্র নিয়ে আসবে।

ঠিক তখনই অর্জুনগাছের নীচ থেকে বৃদ্ধ চিৎকার করে বলল, তোমরা সকলে উঠে এসো।

সেই শব্দে আবার পাহাড়ের সঙ্গে সমতল ভূমিতে এবং ঢালু বালিয়াড়িতে প্রতিধ্বনি তুলে নেমে গেল। মানুষগুলো কোনও স্বপ্নলব্ধ আদেশের মতো সেই উঁচু পাহাড়ের দিকে যেতে থাকল।

সেই বালকটি তার পাখিটাকে চোঙের ভিতর রেখে পিঠে ছোট্ট একটা হুক দিয়ে ঝুলিয়ে দিল। তার সঙ্গে টিনের থালা—মগ ছিল একটা এবং সামান্য কাপড়জামা। কালো নোংরা পুঁটলিটা সে পিঠের বাঁ দিকে ঝুলিয়ে সকলের সঙ্গে উঠে যেতে লাগল পাহাড়ের দিকে।

বৃদ্ধ পাহাড়ের নীচে সামান্য এক সমতলভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুসন্ধান করে এই স্থানটুকু আবিষ্কার করেছে। কিছু গুল্মলতা দেখে সে বুঝে নিয়েছিল এই মাটির নীচে রসাল একরকমের শিকড় রয়েছে। সুতরাং খুঁড়ে খুঁড়ে এক পাহাড় রসাল শেকড় তুলে রেখেছে। তার শক্ত বাহু কাজ করার জন্য বড় বেশি পাথরের মতো কঠিন মনে হচ্ছিল।

বৃদ্ধ সকলকে প্রায় সমানভাবে ভাগ করে দিল। এবং বলল, চুষে খাও। তোমাদের তেষ্টা নিবারণ হবে।

মানুষগুলোর কাছে এই বৃদ্ধ মোজেসের মতো। এই দুর্দিনে এই একমাত্র মানুষ যে তাদের আশা দিয়ে বাঁচবার জন্য অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। তিনি কেবল বলছেন, জল হবে। এবার বর্ষায় জল হবে। জল হলে নদীর সব জল আমরা নেমে যেতে দেব না। বাঁধ দিয়ে আমরা জল আটকে রেখে দেব। সুদিনে দুর্দিনে জল আমাদের কাজে আসবে।

বৃদ্ধ আরও বলছিল, এই মাটি সোনার ফসল দেবে। এই মাটি ছেড়ে কোনো শহরে চলে গেলে—ভিখারি বনে যাবি, এই মাটিতে জল হলে আমরা সকলে মিলে সোনার ফসল ফলাতে পারি। বৃদ্ধ এইটুকু বলে পিতামহের আমলের এক মন্বন্তরের গল্প শোনাল।

সুবল কান খাড়া করে রাখল। নানারকমের বীভৎস দৃশ্য চোখের ওপর ভাসছিল সুবলের। বৃদ্ধ পুরাতন এক মন্বন্তরের গল্প শুনিয়ে বলল, সংসারে এমন হয় মাঝে মাঝে। তাতে ভেঙে পড়লে চলে না। মানুষ, গোরু—বাছুর পথে—ঘাটে মরে পড়ে থাকে। ঘরের ভিতর মৃতের দুর্গন্ধ। মহামারী আসে। গ্রামের পর গ্রাম ক্রমশ খালি হয়ে যায়।

পাহাড়ে পাহাড়ে ধুলোর ঝড় উঠছে। ওরা দলবেঁধে হাঁটতে থাকল। ওরা জানত, এই সামনের ঢালু বেয়ে নেমে গেলে বড় এক পাকা রাস্তা পাওয়া যাবে। তারপর দু’ক্রোশের মতো হেঁটে গেলে রেললাইন, লাইনের ধারে লঙ্গরখানা খুলেছে সরকার, সেখানে পৌঁছুতে পারলে এক হাতা খিচুড়ি পাওয়া যাবে। এই সামান্য আহার সারা রাত্রির জন্য ওদের সামান্য শান্তি দেবে। তারপর ফের আগামীকাল নদীর ঢালুতে জলের সন্ধান চলবে। ক্রমশ এভাবে চলবে। কতদিন চলবে এভাবে ওদের জানা ছিল না। শুধু বৃদ্ধ আগে আগে হাঁটছে। হাতে লাঠি। সে মাঝে মাঝে হাতের লাঠি আকাশের দিকে তুলে দিচ্ছে, পথে—ঘাটে গোরু—বাছুর মরে পড়ে ছিল, পচা দুর্গন্ধ। কোনও গ্রামে ওরা মানুষের চিহ্ন দেখতে পেল না। কেবল দূরে ট্রেনের হুইসল শোনা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে।

ওরা সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় রেললাইনের ধারে পৌঁছাল। গ্রামটাকে উৎসবের মতো মনে হচ্ছিল। বড় বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। দূর দূর গ্রাম থেকে মানুষেরা এসে বসে রয়েছে। বড় বড় অর্জুন গাছের নীচে খড়বিচালি বিছিয়ে বউ—বিবিরা শুয়ে আছে, খাবার হয়ে গেলে টিনের থালা এবং মগ নিয়ে সকলে লাইন দেবে। অবশ্য শিশুদের এবং বালক—বালিকাদের খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। ওরা খেলে খাবে বুড়ো—বুড়িরা এবং বউ—বিবিরা। তারপর যুবক এবং মরদ মানুষেরা।

উৎসবের মতো এই গ্রাম। ব্যাজ পরা একদল মানুষ। বড় বড় তাঁবু খাটানো হচ্ছে। ডে—লাইট জ্বলছে, কোনও পরিত্যক্ত ধনী গৃহস্থের বাগানবাড়ি হবে এটা। প্রায় দশ—বারোটা উনুনে লোহার বড় বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি ফুটছে। ত্রিপাল গোল করে মাটির গর্তে খিচুড়ি রাখা হচ্ছে। বড় বড় কাঠের হাতা নিয়ে বড় বড় বালতি নিয়ে ব্যাজ পরা মানুষগুলো ছুটোছুটি করছে। কিছু লোক কোথায় গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, একদল স্বেচ্ছাসেবক সেদিকে ছুটল। ওরা লুকিয়ে খাবার চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।

বড় বড় মোষের গাড়িতে শহর থেকে জল এসেছে। বড় বড় মাটির জালা জল ভর্তি ছিল, এখন সেই জল নিঃশেষ। কেউ খিচুড়ি খাবার পর এক ফোঁটা জল খেতে পারছে না। মানুষগুলোর মুখে বিরক্তির ছাপ এবং উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে।

জল নেই, খাবার জল নেই। এই অঞ্চলে পাঁচ—সাত ক্রোশ এমনকি দশ ক্রোশ হবে জল নেই—খাবার জল নেই, পাতকুয়াতে কোথায় সামান্য জল একজন গেরস্থ মানুষ লুকিয়ে রেখেছিল—সেখানে খণ্ডযুদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের। কারণ কে যেন বলছিল এই দুর্দিনে জল লুকিয়ে রাখতে নেই।

তখন তাঁবুতে তাঁবুতে সরকারের লোক সব ফিরে যাচ্ছিল। জলের কথা বললে ওরা না শুনি না শুনি করে পেতল—কাঁসা যা ছিল কিছু সামনে তা দিয়ে কান ঢেকে দিল। অর্থাৎ ওরা কিছু শুনতে চাইল না। উপরন্তু তাঁবু থেকে হ্যাট পরা মানুষটা বের হয়ে বলল, কাল থেকে লঙ্গরখানা বন্ধ। কতদিন বন্ধ থাকবে জানা নেই, গুদামখানায় চাল—ডালের মজুত শেষ। আবার কোথা থেকে গম আসছে, আসার যদি কথা থাকে তবে এখানে দু’—চারদিন রুটি মিলতে পারে আবার নাও মিলতে পারে। সরকারের লোকটি নিজের দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে তাঁবুর ভিতর ঢুকে গেল।

মানুষগুলো, কত মানুষ হবে—প্রায় হাজার মানুষ, ছেলে বউ—বিবি নিয়ে হাজারের ওপর হতে পারে, বিশেষ করে সুবল, যার বাঁশের ভেতর ময়না পাখির বাচ্চা, বাচ্চাটাকে সুবল একটা মরা গাছের নীচে কুড়িয়ে পেয়েছিল। কারণ পাখিরা পর্যন্ত ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে, জলের অভাবে, শস্যের অভাবে এখন আর কোনও পাখি পর্যন্ত ডাকে না—সুবল সেই মরা গাছের ডালে একটা ভাঙা বাসা দেখেছিল। বোধ হয় পাখিটা বাসা থেকে পড়ে গেছে। পাখিটা জলের জন্য অথবা ক্ষুধায় দু’ঠোঁট ফাঁক করে দিচ্ছিল—সুবল পাখি নিয়ে ছুটে ছুটে ওর যে শেষ সামান্য সঞ্চিত জল ছোট কাচের শিশিতে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই জল থেকে প্রায় মধুর মতো একটু একটু করে জল দিতেই পাখির বাচ্চাটা যেন প্রাণ ফিরে পেল। সুবল হাতে তালি বাজাল এবং এতবড় খরা চলেছে, মন্বন্তর এসে গেল দেশে—এই পাখি মিলে যাওয়ায় ওর ভয় যেন কেটে গেল। সেই সুবল যাকে দেখলে এখন ভিড়ের মধ্যে মনে হল বড় কাঙাল, সরল সহজ—গোবেচারা সুবল পিঠে বাঁশের ভেতরে পাখি নিয়ে এগিয়ে গেল। বলল, আমরা খেতে না পেলে মরে যাব।

তাঁবুর ভিতরে বোধ হয় কী নিয়ে হাসি—মশকরা হচ্ছিল। ওরা খুব জোরে হাসছে। ওরা সুবলের কথা শুনতে পায়নি। সুতরাং সুবল পেছনের দিকে তাকাতেই দেখল সেই বৃদ্ধ লাঠি উঁচু করে রেখেছে। যেন এই লাঠিতে মোজেসের প্রাণ আছে। লাঠি এখন ওদের সব আশা পূরণ করবে। সে লাঠি তুলে ওপরে কী নির্দেশ করতেই সকলে বুঝে নিল, ওদের এবার এ স্থান পরিত্যাগ করতে হবে। ওরা বৃদ্ধের কথামতো পিছনে পিছনে চলতে থাকল। তাঁবুর চারপাশে পুলিশ ছিল কিছু… ওদের হাতে বন্দুক ছিল, গ্রামের মানুষেরা হিংস্র, ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠছে অথচ এই বন্দুক দেখলে তাদের প্রাণ শুকিয়ে যায়—ওরা অর্থাৎ এই—এই মানুষেরা, যারা হা—অন্নের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকছে, তাদের নীরবে অন্ধকারে নেমে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকল না।

অন্ধকারে বৃদ্ধ বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি সুবল?

—জানি না কর্তা।

—আমরা কোথাও যাচ্ছি না। আমরা এই পাহাড়ের ওপর আগুন জ্বেলে দেব। সব পুড়িয়ে দেব। যখন মাটি এত নেমকহারাম, ঈশ্বর এত বেইমান—যখন বৃষ্টি হচ্ছে না, যখন ঘাসমাটি পুড়ে গেল, সব তখন আমরা আগুন জ্বেলে বাকি যা আছে সব পুড়িয়ে দিয়ে চলে যাব শহরে।

কিন্তু ভিতর থেকে কে যেন রুখে উঠল। বলল, আমরা জল খেতে চাই কর্তা। তুমি সারাদিন বালুর ভিতরে পুরে রেখেছিলে জল দেবে বলে, কিন্তু জল কই?

দলের ভিতর শিশুদের কান্না, জল খাব। ওদের সকলের ভয়ঙ্কর তেষ্টা। বৃদ্ধ নিজেও তেষ্টায় মরে যাচ্ছে। ভিতরে এক ভয়ঙ্কর হিংস্রতা কাজ করছে। ক্ষণে ক্ষণে বুদ্ধি পালটায়। মনে হয় এই মাটি সোনার ফসল দেবে, আবার মনে হয় জল বুঝি এখানে আর কোনওদিন হবে না, মাটি আর সোনার ফসল দেবে না। সব শুকিয়ে যাবে তারপর একদিন এই অঞ্চল মরুভূমি গ্রাস করে নেবে।

তখন দূরের ট্রেনের হুইসল। বড় একটা ট্রেন বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসছে। কোথায় এক দিল্লি বলে শহর আছে, কোথায় এক কলকাতা বলে নগর আছে, সেখানে ট্রেনটা যাবে। দিল্লি থেকে কলকাতা। বৃদ্ধ এবার লাঠিটা শক্ত করে ধরে ফেলল। তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা এই লাইনের ওপর বসে যাও। শহর থেকে নগরে যাবার জন্য বড় ট্রেন আসছে। আজ আমরা ট্রেনটা থামিয়ে দেখব কী আছে, যদি ভিতরে জল থাকে, তবে আমরা জল নিয়ে চলে যাব। জলের জন্য অন্নের জন্য আমাদের এই দস্যুবৃত্তি। আমাদের কোনো পাপ হবে না।

সুবলের ভয় ছিল, ট্রেনটা হুড়মুড় করে এসে ওপরে উঠে যেতে পারে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, কর্তা, আমরা যে তবে সব মরে যাব।

—মরে যাবে কেন?

—ট্রেনটা আমাদের ওপর দিয়ে চলে যাবে।

—আরে না, ট্রেন মানুষের ওপর দিয়ে যায় না। এতগুলো লোক দেখলে ড্রাইভার ট্রেন থামিয়ে দেবে।

কর্তামানুষ এ বৃদ্ধ, এই অঞ্চলের পুরোহিত মানুষ, বিদ্যায় বুদ্ধিতে সকলের চেয়ে প্রবল সুতরাং সুবলের আর কোনও ভয় থাকল না। সে তার পাখি পিঠে রেখে দিল, সে তার ঝোলাঝুলি, বগলের নীচে ঝুলিয়ে রাখল। সুবল অন্ধকারে টিপে টিপে দেখল ঝোলাঝুলিতে ওর সংগ্রহ করা পোকামাকড়গুলো রয়েছে কিনা! কারণ সে খুব ভোরে উঠে পোকামাকড় সংগ্রহ করে রেখেছে পাখিটার জন্য। খুব ভোরে উঠে সে পাখিটাকে আকাশে ওড়াবার চেষ্টা করেছে। কারণ তখন প্রবল খরা থাকে না, ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকে, এবং খুব ভোরেই পাখিটা যেন সামান্য সতেজ থাকে। তারপর সূর্য ওঠার সঙ্গে পাখিটা গরমে ছটফট করতে থাকে। সুবলের মনে হয় সে পাখিটাকে আর বুঝি বাঁচাতে পারবে না। সে যখনই সামান্য অবসর পায় পাখিটাকে বাঁশের চোঙ থেকে তুলে এনে হাতের ওপর বসিয়ে রাখে। এবং নিজে সূর্যের দিকে পিঠ রেখে পাখিটাকে ছায়া দেয়। যদি ফুরফুরে হাওয়া থাকে তবে পাখিটাকে হাওয়া লাগাবার জন্য হাতের কবজিতে বসিয়ে সে আপন মনে শিস দিতে থাকে এবং গ্রাম্য কোনো সংগীত অথবা লোকগাথা সে কবিতার মতো উচ্চারণ করতে করতে, এই প্রবল খরা, মন্বন্তর আসছে, দুর্ভিক্ষ সারা দেশে, আবার ওলাওঠা মহামারীর আকারে দেখা দিচ্ছে, সুবল পাখিটাকে রক্ষা করার জন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন সে অন্য কোথাও পালাতে পারলে বাঁচে।

ভয়ঙ্কর অন্ধকার। এতগুলো মানুষ নিঃশব্দে হাঁটছে। পাতার শুধু খস খস শব্দ উঠছিল। ওরা প্রায় সকলেই বনবেড়ালের মতো চুপি চুপি রেললাইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের কান্না মাঝে মাঝে বড় ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল।

শালগাছের জঙ্গল সামনে। জঙ্গল পার হলে রেললাইন। শালগাছগুলো প্রায় মৃতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে গাছের ডালপালাগুলোকে খুব ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল। কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। কোনও গ্রাম থেকে একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না। মাঝে মাঝে শেয়ালের চিৎকার—আর এক ঝিল্লির ডাক, মনে হয় এই সংসারে জীবনধারণের আর কিছু থাকল না, কোনও আলো অথবা হাওয়া, সর্বত্র ভয়াবহ মৃতের গন্ধ শুধু।

বৃদ্ধ পুরোহিত রেললাইনে ওঠার আগে বললেন, বিবি—বউদের এবং শিশুদের আলাদা রেখে দাও। ওরা বড় কড়ুই গাছের নীচে বসে থাকুক।

বৃদ্ধ এবার যুবকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা হাতে সামান্য কাপড় নাও। ট্রেনের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাত ওপরে তুলে গাড়ি থামাবার নির্দেশ দেবে। বৃদ্ধ পুরোহিত এই সব বলে রেলের লাইনে কী নুয়ে যেন দেখল। তারপর সে সকলের আগে হাতে সেই লাঠি নিয়ে সামান্য সময় স্থির হয়ে দাঁড়াল। অপলক সে যেন কিছু দেখছে,—অন্ধকার, না এই জগৎসংসার, না পূর্বস্মৃতি তার কাজ করছিল। কী ছিল এই অঞ্চলে। বড় মাঠে সোনার ফসল ছিল, বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল, গোয়ালে বড় বড় গোরু, মোষ ছিল, শীতের সময়ে রামায়ণ—গান ছিল আর গ্রীষ্মকালে ঢোলের বাজনা ছিল, রামাহই রামাহই গান ছিল। এখন সব নিঃশেষ। কেবল ভয়, যা কিছু সামান্য মানুষ আছে তারাও চলে যাবে সব বাড়ি ছেড়ে। ভয়, মহামারী, মন্বন্তর এসে গেল। সামান্য খয়রাতি সাহায্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে আর কী থাকল মানুষগুলোর, কীজন্য আর অপেক্ষা করা। এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে মানুষগুলো বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বৃদ্ধ পুরোহিত অন্ধকারের ভিতর কোনও আলোর চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না।

ট্রেনটা বোধ হয় তখন নদী পার হচ্ছিল, কোনও বড় সেতু পার হচ্ছিল, অথবা বাঁকের মুখে কোনও পাহাড়ের ভিতর ট্রেনটা ঢুকে যাচ্ছে—সুতরাং গম গম, খুব দূর থেকে গম গম শব্দ, মনে হয় খুব দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ, যেন হাওয়ায় ভর করে শব্দটা কানের পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে।

তারপর সেই আলো, ট্রেনের আলো, দূর থেকে ওরা ট্রেনের আলো দেখতে পেল। ট্রেনটা যত দ্রুত এগিয়ে আসছে তত ওদের বুক দুরু দুরু করছিল। তত ওরা মরিয়া হয়ে উঠছে। যেন ওরা কোনও দীর্ঘ মরুভূমি পার হবে এখন—সুতরাং সকলের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই, সকলের রক্তে এক অমানুষিক উত্তাপ সঞ্চিত হচ্ছে।

হাড়গোড় বের করা মানুষগুলোর দিকে এখন আর তাকাচ্ছে না। লাইনের ওপর যেন শত শত কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষদের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, স্নান না করার জন্য চুল শনের মতো হয়ে গেছে, গায়ে খড়ি ওঠা, পেটের ভিতর যন্ত্রণা, ক্ষুধার যন্ত্রণা। সামান্য লঙ্গরখানার দান এই সামান্য পথটুকু অতিক্রম করতেই হজম হয়ে গেছে।

ওরা সকলে আলোটা দেখে ভয় পাচ্ছে। ওরা এই ভয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য কী করবে ভেবে পাছিল না। ওরা অন্ধকারে পরস্পর মুখের দিকে তাকাল। বৃদ্ধ পুরোহিত পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেছে। দৈত্যের মতো ঝড়ের বেগে ট্রেনটা ছুটে আসছে, পাহাড়ের ওপর পড়লে রক্ষা থাকছে না। সব মানুষগুলোর রক্তে এই লাইন ভেসে যাবে, শকুনের আর্তনাদ শোনা যাবে দূরে—বৃদ্ধ ভয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন ডেকে উঠল, জল চাই, আমরা জল চাই।

সঙ্গে সঙ্গে সুবল ওর পাখিটাকে বুকের কাছে এনে বলল, হ্যাঁ, আমরা জল চাই। যুবক—যুবতীরা বলল, জল চাই, জল চাই।

কড়ুই গাছের নীচে থেকে বউ—বিবিরা চিৎকার করে উঠল, জল চাই, জল চাই।

ভূতের ভয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন ওই মানুষগুলো জল চাই, জল চাই বলে হরি নামের মতো মন্ত্র উচ্চারণ করছে। এই উচ্চারণ কেবল দীর্ঘ মাঠে শব বহনকারী মানুষের কান্নার মতো শোনাচ্ছে। বড় মাঠ সামনে, লাইনের পাশে বড় পাহাড়, শালগাছের মাথায় ভাঙা চাঁদের আবছা অন্ধকার, এতগুলো মানুষের ভয়াবহ কণ্ঠ চারপাশের পরিবেশকে খুব বিষণ্ণ করে তুলছে।

ট্রেনটা হুইসল দিচ্ছে, ড্রাইভার টের পেয়ে গেছে বুঝি। আবছা কী যেন দেখা যাচ্ছে লাইনের ওপর। প্রথম কুয়াশার মতো মনে হচ্ছে, তারপর মনে হচ্ছে মরীচিকার মতো হাজার সরলরেখা পুতুলনাচের দড়িতে ঝুলছে।

ড্রাইভার চোখ মুছে নিল। এই অঞ্চলে ভয়ঙ্কর খরা চলছে, এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত নেই এবং এই অঞ্চলে মহামারী আরম্ভ হয়ে গেছে—ড্রাইভার ভালো করে দেখে নিল। কিছুদিন আগে ড্রাইভার দেখেছে দূরে মাঠে সব মৃত গোরু—বাছুর—মোষ, হাজার হবে প্রায়, লাইনের ধারে ধারে মরে আছে। মাঝে মাঝে সে মৃত মানুষের মুখও দেখেছে। লোকালয়ে আর কোনও লোক নেই, সকলে শহর গঞ্জে চা—বাগানে এবং দূরদেশে চলে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর দুর্দিন মানুষের।

আর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা বাঁক নিলে ড্রাইভার টের পেল, শত শত কঙ্কাল যেন রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ভূতের মতো নৃত্য করছে। সে এবার প্রাণপণে রড চেপে ধরল, প্রাণপণে সে হুইসল বাজাতে থাকল। এরা সব মানুষের কঙ্কাল, চোখ—মুখ কোটরাগত, লাইন থেকে একটা প্রাণী সরছে না এবং ড্রাইভার ভূতের ভয়ে প্রথম ভাবল যদি ওরা যথার্থই মানুষের অভুক্ত আত্মা হয় তবে আর ট্রেন থামিয়ে কী হবে, বরং সে জোরে বের হয়ে যাবে, ট্রেন থামালে মৃত আত্মারা ওর ট্রেনটাকে এই নির্জন মাঠে আটকে দিতে পারে। সুতরাং ফের চাকা ঘুরিয়ে দিতে গেল—ফায়ারম্যান শক্ত হাতে বাধা দিল, বলল, না। ওগুলা ভূত নয় দাদা। ওগুলো মানুষ। সে ড্রাইভারকে সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেনটা থামিয়ে দিল।

মানুষগুলো কোলাহল করতে থাকল, জল চাই, জল চাই। মানুষগুলো কামরায় উঠে গেল। বলল, জল চাই, জল চাই।

ভিতরের যাত্রীরা ভয় পেয়ে গেছে। সব কঙ্কালের মতো মানুষের চেহারা, ক্ষুধার্ত, চোখ কোটরাগত, হাত—পা শীর্ণ, ক্লান্ত এবং অবসন্ন। এই সব মানুষের শরীরে জীর্ণ—বাস, ময়লার জন্য দুর্গন্ধ, ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ, যাত্রীরা সকলে নাকে কাপড় দিচ্ছে। ভয়ে ওরা কথা বলতে পারছে না। যেন শয়তানের প্রতীক এইসব মানুষেরা। যাত্রীদের সুন্দর সুদৃশ্য কামরার প্রাচুর্য ওদের পৈশাচিক করে তুলেছে। ওরা প্রেতের মতো ভিতরে ঢুকে দু’হাত ওপরে তুলে জলের জন্য, জল চাই, বলে নামকীর্তনের মতো নাচতে থাকল।

যাত্রীদের মনে হল, ক্ষুধার্ত সব রাক্ষস অথবা ডাইনির মতো মানুষগুলো আকাশে বাতাসে দুঃখের খবর পাঠাচ্ছে, ওরা ভিতরে ঢুকে সব তছনছ করে দিচ্ছিল। জল কোথায়, জলের জন্য ওরা ওদের মগ, থালা এবং চামড়ার ব্যাগ খুলে রেখেছে, অথচ জল কোথায়, বৃদ্ধ পুরোহিত শুধু জানতেন জল কোথায়, তিনি সকলকে দু’হাত তুলে শান্ত থাকতে বলেছেন, সামান্য জলটুকু সকলকে সমান ভাগ করে দিতে হবে। তিনি প্রতি কামরায় একজন করে যুবককে জলের কল দেখিয়ে দিলেন, কী করে খুলতে হবে বন্ধ করতে হবে দেখিয়ে দিলেন, প্রত্যেককে লাইন দিয়ে যেমন মানুষগুলো সরকারের লঙ্গরখানাতে লাইন দিয়ে খাদ্যবস্তু থালায় নিত, তেমন লাইন দিয়ে সামান্য জলটুকু সকলকে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে বললেন।

সুবলের কামরায় খুব অল্প মানুষ। সুখী মানুষ, তাঁর স্ত্রী এবং রুগণ এক বালিকা নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে। এতবড় কামরা—রিজার্ভ প্রথম শ্রেণীর কামরা, মাত্র তিনজন মানুষ। রুগণ বালিকা মোমের মতো সাদা। সাদা চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে। মাথায় আলো জ্বলছিল। খুব অনুজ্জ্বল আলো। ওরা সকলে ভয়ে কেমন চোখ—মুখ সাদা করে রেখেছে। বালিকাটি পর্যন্ত মুখ—নাক দেখে আঁৎকে উঠেছে। সুবলের পিছনে বড় বড় সব মানুষ। মানুষ বলে চেনা যায় না। যেন বড় এক রাজপুরী। সুন্দর সব বাদামি রঙের গাছ। গাছে হিরে—পান্নার ফুল। নীচে রাজকন্যা আঙুর খেতে খেতে কোনও রাজপুরের জন্য অন্যমনস্ক। অথবা এও হতে পারে রাজকন্যার জানা ছিল না, রাজ্যের কোথাও দুর্ভিক্ষ হচ্ছে। জানা ছিল না, রাজ্যের রাজা বনের হরিণ অনুসন্ধানে মত্ত। রাজা, রাজ্যের খবর রাখছে না। হাজার হাজার গ্রামে মড়ক লেগেছে। অনাবৃষ্টির জন্য ফসল ফলছে না। অল্প বৃষ্টির জন্য মাটি ক্রমশ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। হায়, তখনও রাজা মনোরম রাজপ্রাসাদে নূতন অরণ্যের সৃষ্টি করছে। কারণ ওর প্রিয় হরিণটি এই বনের ভিতর হারিয়ে যাবে। সে সেই হরিণের জন্য শুধু ব্যস্ত থাকবে। রাজকার্যের জন্য বনের হরিণটি ওর বড় প্রিয়। মরীচিকার পেছনে ছোটার মতো রাজা শুধু ছুটছেন। তখন রাজকন্যা দেখতে পেল হাজার হাজার কঙ্কালপ্রায় মানুষ তাকে ঘিরে ফেলেছে, হাউ মাউ কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ—এই সব কথা বলছে।

সুবল হাতের ইশারা করলে সকলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সুখী মানুষটি প্রথম খুব চেঁচামেচি করছিল, পুলিশের ভয় দেখাচ্ছিল। কিন্তু এতবড় নির্জন মাঠ, একদিকে দীর্ঘ পাহাড়, অন্যদিকে এক মরা নদী, নদীতে মানুষগুলো জলের জন্য দিন নেই, রাত নেই মাটি খুঁড়ে চলেছিল, অথচ জল নেই, জল নেই, হাহাকার জলের জন্য। সুতরাং সামান্য পুলিশের ভয় সুবল অথবা এইসব কঙ্কালপ্রায় মানুষদের এতটুকু বিচলিত করতে পারল না।

বরং মানুষগুলো, সুদৃশ্য এই কামরা, আসবাবপত্র দেখে কৌতুকবোধ করতে থাকল। ওরা সুবলকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছে। অথবা সুবলকে অনুনয়ে বলছে, ওরা এই কামরার ক্ষতি করবে না। শুধু ঢুকে দেখবে, মোটা গদি, এবং আলোর কাছে হাত রেখে দেখবে—কেমন ভিতরে অনুভূতি জন্মায়। সুবল ওদের এক এক করে জল খেতে দিচ্ছে, আর এক এক জন কামরার ভিতর ঢুকে দেওয়ালে হাত রাখল, অথবা একটু আরাম করে গদিতে বসে শুয়ে কেমন লাগে দেখতে থাকল। বা বেশ তো, ওদের কেউ কেউ যেন চোখ বুজে আরামটুকু অনুভব করছে। বাংকের ওপর বসে, হাঁটু মুড়ে বসে শুধু চারিদিকের দৃশ্য,—জানালা দিয়ে শুধু অন্ধকার মাঠ, পেছনের করিডোরে মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে, কোলাহল করছে। গার্ডের লালবাতি, যেন মাঠ, মরা নদী অথবা শুকনো পাহাড়ের উদ্দেশ্যে লালবাতি জ্বেলে বসে আছে।

কামরার ভিতর সুখী মানুষ, তাঁর স্ত্রী এবং রুগণ বালিকা ভয়ে থর থর করে কাঁপছে, ওরা ভয়ে কামরার এক পাশে, যেন ভয়ঙ্কর কোনও দুর্ঘটনার অপেক্ষায় আছে ওরা।

ড্রাইভার নীচে নেমে দেখল, পিপীলিকার মতো মানুষগুলো কামরায় কামরায়, ছাদের ওপরে উঠে হৈহুল্লোড় করছে। শিশুদের মতো চিৎকার, যেন এই ট্রেন ওদের কাছে খেলনার মতো অথবা যুদ্ধে প্রতিপক্ষের পরিত্যক্ত কামান, কামানের গোলাগুলি শেষ, গ্রামের দুষ্ট বালকবালিকারা কামানটা টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার যাত্রীদের পার হয়ে গার্ডের ঘরে গিয়ে দেখছে, ভয়ে গার্ডসাহেব লালবাতি জ্বেলে বসে রয়েছে।

এবার ড্রাইভার মরিয়া হয়ে বলল, এবার নীলবাতি জ্বালুন, ট্রেন ছেড়ে দিই, একটা মানুষও লাইনের ওপর আর নেই। শালা সকলকে নিয়ে এবার স্টেশনে নিয়ে ফেলি।

ড্রাইভারের চিৎকারে গার্ডসাহেব ভয়ে তিড়িংবিড়িং করতে থাকল। ঘুরেফিরে কেমন মাতালের মতো কিছুক্ষণ নেচে বেড়াল। ড্রাইভার বুঝল গার্ডসাহেব ভয়ে ভিরমি খেয়েছে। সে বলল, গার্ডসাহেব, বেশি দেরি করলে বয়লার থেকে জল ঢেলে নেবে। ট্রেন তবে আর চলবে না!

গার্ডসাহেব কী যেন ভাবলেন। এদের এত তেষ্টা?

—তেষ্টা, কী যে জল খাচ্ছে! কেবল জল খাচ্ছে।

—কেবল জল খাচ্ছে?

—কেবল জল খাচ্ছে। জল খাচ্ছে। জল খাচ্ছে। কেবল জল খাচ্ছে।

—অন্য কিছু না?

—না, কিছু না। কোনোদিকে আর ভ্রূক্ষেপ নেই। বড় সজ্জন।

—তবে এবার শালা সজ্জনদের চল শহরে নিয়ে তুলি। বলে তিনি বসে টুক করে লাল বাতিটাকে নীল করে দিলেন।

ড্রাইভার নামার সময় বলে এল, আপনি সাব হুইসল বাজাবেন না। আমি সেকেন্ডে এমন গতি বাড়িয়ে দেব না, শালা একটাকেও নামতে দেব না। বলে ড্রাইভার অন্ধকারের ভিতর নিচু হয়ে হাঁটতে থাকল। এবং দেখল ট্রেনের নীচে আবার কেউ বসে রয়েছে কিনা। সে কোনো মানুষ দেখতে পেল না। কেবল মনে হল নীচে ঠিক বড় একটা গাছের অন্ধকারে একজন আলখাল্লা পরা মানুষ দাঁড়িয়ে দুঃখী লোকদের যেন জলপান দেখছে।

ড্রাইভার বলল, শালা, তুমি লিডার আছে। তোমাকে ফেলে দেখ শালা, কেমন সব ফাঁক করে দিই। তুমি শালা এখানে পড়ে পড়ে এবার ঘাস খাও। মুরগি খাও। মুরগির নাম মনে হতেই ড্রাইভারের জিভে জল এসে গেল।

ওদের এত জলতেষ্টা যে, কোথায় ড্রাইভার, কোথায় ফায়ারম্যান দেখবার ফুরসত নেই। আর এতগুলো মানুষ একসঙ্গে ট্রেনে উঠে পড়বে সেও, কেউ ভাবেনি।

বৃদ্ধ পুরোহিত ওদের জল খেতে দেখে, ওদের হইচই দেখে খুব খুশি। দীর্ঘদিন পর জল পান, তৃষ্ণার জল কতদিন পর পান করা গেল। তিনি নিজেও জল এনে গাছের নীচে পান করছেন। মনে হচ্ছিল পেটে আর জায়গা নেই, তবু মনে হচ্ছিল জলের আর এক নাম জীবন, এই জল এবং জীবনকে চেটে চেটে খাবার জন্য তিনি কিছুক্ষণ পর পরই গলায় জল ঢেলে দিচ্ছেন, এবং জল খাবার সময় যেন অন্ধকারে টের পেলেন, ট্রেনটা নড়ছে, ট্রেনটা সহসা এমন গতি বাড়িয়ে দিল যে, তিনি অনুমানই করতে পারলেন না কী করে চোখের পলকে এতগুলো লোক নিয়ে ট্রেনটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

তিনি চিৎকার করতে করতে ট্রেনটার পিছনে ছুট দিলেন। তিনি অন্ধকারেও দেখতে পেলেন সেইসব দুঃখী মানুষদের হাত—ওরা যেন বলছিল, দেখ দেখ, কেমন বেইমান এই ট্রেন, আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। তিনি শুধু চিৎকার করছিলেন, তোরা সব নেমে পড়। তোদের নিয়ে ট্রেনটা চলে যাচ্ছে, তোরা লাফিয়ে পড়।

কিন্তু সুবল ট্রেনের ভেতর জানালাতে সামান্য সময়ের জন্য উঁকি দিয়েছিল। অন্ধকারে গাছপালা আবছা আবছা, সে কোনও মানুষকে কোনও বড় গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখেনি। সে ভেবেছিল হয়তো দু—একজন পড়ে থাকল—আর সকলকে নিয়ে ট্রেনটা মোটামুটি শহরে পৌঁছে যাবে। কারণ এই মন্বন্তর মানুষের আত্মবিশ্বাস হরণ করে নিয়েছে। ট্রেন ছেড়ে দিলে কেউ লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেনি। সকলে যেন মোটামুটি ভিতরে ভিতরে খুশি।

ট্রেনটা ওদেরকে কোনও না কোনও শহরে পৌঁছে দেবে। অন্ন—জল এবং বস্ত্রের অভাব হবে না। একবার শুধু পৌঁছে যাওয়া। সেখানে পুলিশের ভয় সামান্য থাকবে। সুতরাং ওরা সকলেই প্রায় ভদ্রলোকের মতো কামরায় টিকিটবিহীন যাত্রীর মতো বসে থাকল। ওরা আর কিছু তছনছ করছে না। যাত্রীদের মনে সাহস ফিরে এসেছে। ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে বড় নিস্তেজ মনে হচ্ছিল। শরীর শক্তিবিহীন। অনেকের ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম পাচ্ছিল।

সুবল প্রথম শ্রেণীর যাত্রীর ঘরে এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকল। সাদা মোমের মতো বালিকার মুখ। চোখ বড় বড়। সুবলকে বালিকাটি দেখছে। ঘরে অন্য যারা ছিল তারা জল খেয়ে চলে গেছে।

এই কামরায় অবশিষ্ট জলটুকু নিঃশেষ। প্রৌঢ় মানুষটি কী যেন বই পড়ছিলেন। তাকে এখন আর উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তিনি যেন ভেবে নিয়েছেন, এইসব দেহাতি মানুষেরা কোনও কিছু আর অনিষ্ট করবে না। ফাঁক বুঝে জলের জন্য ট্রেন আক্রমণ করতে এসে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে। এক ঢিলে দুই পাখি। রথও দেখা হল, কলাও বেচা হল। সুবলের মুখ দেখে তাই মনে হয়।

সুবল এখন ট্রেনে চড়ে কোথাও চলে যেতে পারছে ভেবে খুশি। অন্তত জলের জন্য আর মাঠ—ঘাট ঘুরে মরতে হবে না। সুবলের মুখ দেখলে তাই হয়। বালিকাটি অসুস্থ। সাদা মোমের মতো মুখে শুধু চোখ দুটোই অবশিষ্ট। চোয়ালে সামান্য মাংস। হাত—পা বড় শীর্ণ। শুধু মুখে সামান্য সতেজ ভাব। চোখ দুটো বড় টল টল করছিল। সুবলের আশ্চর্য লাগছে—এই মুখ, সুন্দর সতেজ মুখ রুগণ এবং পীড়িত। ভিতরে ভিতরে অসামান্য কষ্ট। শিয়রে বসে আছেন যিনি—বালিকাটির মা হবে নিশ্চয়ই। তিনি বুক পর্যন্ত সিল্কের চাদরটা মাঝে মাঝে টেনে দিচ্ছেন। যারা পরে তৃষ্ণার জল খেতে এসেছিল—অবশিষ্ট জল, এমনকি এই রুগণ বালিকার জন্য যে মাটির জারে অল্প জল ছিল, জলের স্বাদ পেয়ে সবটুকু জল খেয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছিল, বালিকার এখন তৃষ্ণা পেয়েছে। বালিকা তৃষ্ণায় জলের জন্য ঠোঁট চাটছে। শিয়রে মা বসে। তিনি উদ্বিগ্ন চিত্তে বললেন, টুকুন জল খেতে চাইছে।

প্রৌঢ় মানুষটি উঠে বসলেন, তিনি দেখলেন জল কোথাও নেই। দরজার গোড়ায় সুবল বসে বসে ঝিমুচ্ছে। এখন আর স্টেশন না এলে জল পাওয়া যাবে না। কোনও বয়কে ডেকে অথবা খাবার ঘরে অনুসন্ধান করলে হয়। তিনি সুবলকে অতিক্রম করে বাইরে বের হতেই দেখলেন বারান্দায় সেইসব দেহাতি মানুষেরা ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছে। কোথাও এতটুকু স্থান নেই যে, তিনি পা ফেলে তাদের অতিক্রম করে যাবেন। এবং এইসব দেহাতি মানুষদের দেখেই মনে হয়, জল কোথাও আর অবশিষ্ট নেই। শুধু এনজিনে জল আছে এবং তিনি ঈশ্বরের নিকট কেমন অন্যমনস্কভাবে হাতজোড় করে ফেললেন। বললেন, ঈশ্বর, এই নির্জন মাঠে ট্রেন ফের থেমে পড়লে মেয়েটাকে আর জল দিতে পারব না। জল না পেলে বড় ছটফট করবে।

সুবল ঝিমুচ্ছিল। সহসা আর্তনাদে সুবলের ঘুম ভাবটা কেটে গেল। সুবল দেখল সেই সুন্দর সতেজ মুখ বালিকার, অথচ চিৎকার করছে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কোথাও চলে যাব, কষ্ট আর সহ্য হয় না মা! কী যে এক ভীষণ রোগ মেয়ের, মা পর্যন্ত তার দুঃখে আর্তনাদ করছিলেন।

বড় শহরে যাচ্ছে মা—বাবা, মেয়েকে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছে। অথবা মনে হচ্ছিল এই মেয়ের জন্যই মা—বাবা প্রবাস ছেড়ে নিজের দেশে চলেছেন। অনেক ডাক্তার দেখানো হল। জলবায়ু পরিবর্তন করা হল। কত টোটকা, কবিরাজি কি—না করেছেন প্রৌঢ় মানুষটি হায়, মনের অসুখ মেয়ের, কেউ কিছু করতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে বালিকার শুধু জলতেষ্টা পায়।

ছেঁড়া জামা সুবলের গায়ে। সুবলের পরনে প্রায় নেংটির মতো একটু কাপড়। জামাটা হাঁটু পর্যন্ত সুবলের ফুলে—ফেঁপে ছিল। দেখলে মনে হবে, দুটো সুবলকে ভিতরে পুরে রাখা যায়।

সুবল উঠে দাঁড়াল এবং ওর মাথায় লম্বা টিকি দেখে মেয়েটি প্রথমে চিৎকার থামিয়ে দিল। সুবলের বড় বড় চুল, প্রায় চুলে মুখ ঢেকে যাচ্ছে, সুবলের শরীরে ঘাম এবং ময়লায় অথবা বলা যেতে পারে অপরিচ্ছন্নতার গন্ধ। সুবলকে দেখে মেয়েটি এবার ভয়ে যেন গুটিয়ে যাচ্ছে ফের। সে সন্তর্পণে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফেলল।

সুবল বলল, মা, আমার একটু জল আছে। জলটা ওকে দিতে পারি মা। ওর খুব তেষ্টা পেয়েছে।

মা বললেন, তুমি জল দেবে কী বাছা! জল তোমার কোথায়?

সুবল বলল, এই যে! সে একটা বাঁশের চোঙ বের করে দেখাল।

—এই চোঙায় জল আছে মা। আমার একটি পাখি আছে মা! পাখির জন্য একটু জল নিয়েছি মা।

মা বললেন, না বাছা। জল তোমার বড় নোংরা।

সুবল কোনও কথা বলল না। সে তার পাখিটাকে পাশের পকেট থেকে তুলে এনে হাতের কবজিতে বসাল। নীচে ছোট ছোট পুঁটলি সুবলের। সংসার বলতে যা—কিছু সবই শেষদিকে সুবলের সঙ্গে সঙ্গে থাকত। কারণ ওদের কোনও ঠিক ছিল না কখন কোথায় ওরা থাকবে। বৃদ্ধ পুরোহিত মানুষটি তাদের সকলকে নিয়ে স্থানে স্থানে জলের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। বৃদ্ধের কথা মনে হতেই অন্য একটা চোঙে পাখিটাকে পুরে রাখল। পোকামাকড় যা—কিছু পাখিটার জন্য, পোঁটলা খুলে দেখল। পোঁটলা খুলতেই ট্রেনের ঝাঁকুনিতে সেটা হাত থেকে খসে পড়ল, আর পোকামাকড়গুলো পর পর ছড়িয়ে পড়ল। বৃদ্ধের কথা মনে পড়েছে, কামরায় কামরায় খুঁজে দেখলে হয়, কোনও কামরায় তিনি হয়তো আছেন। কারণ সুবল ভেবেছে ভিড়ের সঙ্গে তিনি নিশ্চয় উঠে এসেছেন। কিন্তু পোকামাকড়গুলো ছড়াতেই যাত্রী তিনজন, বিশেষ করে রুগণ মেয়েটি হইচই বাধিয়ে দিল ভয়ে।

পোকামাকড়গুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে। আলোর ভিতর ওরা চোখে দেখতে পাচ্ছে না—বালিকার অথবা প্রৌঢ় ব্যক্তিটির পিঠে শরীরে মুখে বেয়ে বেয়ে উঠে যাচ্ছে। সুবল ভয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমনটা হবে জানা ছিল না। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে হাত থেকে পোঁটলা খসে পড়বে এবং ঘরময় কীটপতঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে ভাবতে পারেনি সুবল।

ট্রেন বেগে চলছে, মাঝে মাঝে ট্রেনের হুইসল কানে বড় বেশি বাজছে! পাখিটা সুবলের মাথায় হাতে এবং ঘাড়ে উড়ে উড়ে বসছে। পাখিটাকে দেখে মেয়েটি ওর সব দুঃখ যেন ভুলে যাচ্ছে। এমনকি এই যে কীটপতঙ্গ মেঝের ওপর, দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। কী সুন্দর পাখি, সোনার রঙের ঠোঁট, পায়ে সবুজ ঘাসের রঙ, পাখা কালো, গলার নীচে লাল রিবন যেন বাঁধা, নরম এবং কোমল পাখি। সুবলকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে পাখিটা, পাখিটার বয়স আর কত, পাখিটা উড়ে উড়ে দেয়ালের দিকে চলে যেতে থাকল এবং একটা একটা করে কীটপতঙ্গ ধরে এনে সুবলের জেবে ভরে দিতে থাকল।

সুবল দেখল, তার পোষা পাখিটা বড় তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে। সে যেন ইচ্ছা করলে এই পাখি নিয়ে সকলকে এখন খেলা দেখাতে পারে।

সুতরাং এখন কামরায় চারজন। বিশেষ করে মা—বাবা এই পাখিয়ালা সুবলকে আর ঘৃণার চোখে দেখতে পারছে না। মেয়েটা এই যে এতক্ষণ কেবল ছটফট করছিল—আমার কিছু ভালো লাগছে না মা, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কোথাও চলে যাব মা, মা আমাকে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? এইসব দুঃখকর কথা আর বলছে না। একটা পাখি, সাধারণ পাখি আর এক পাখিয়ালা, কোথাকার এক পাখিয়ালা, ময়লা, বিশীর্ণ চেহারা, দেহাতি—কোনো আশা—আকাঙ্ক্ষা নেই, শুধু যেন এই পাখি বেঁচে থাক, পাখি থাকলেই সব থাকল, পাখির খেলা দেখিয়ে সে সকলকে বুঝি মুগ্ধ করতে চায়।

টুকুন বলল, এই পাখিয়ালা।

সুবল চোখ তুলে তাকাল।

—পাখিয়ালা, দ্যাখো এখানে একটা লম্বা গঙ্গাফড়িং।

পাখি কী দেখল, সুবল পাখিকে কী বলল বোঝা গেল না। পাখি উড়ে গিয়ে ফড়িংটাকে ঠোঁটে ঠেসে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে টুকুন অতীব আনন্দে হাততালি দিতে থাকল। আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চোখে জল এসে গেল। যেন বলতে চাইল—পাখিয়ালা, তুমি জাদুকর, জাদু তোমার হাতের খেলনা। এই মেয়ে কতকাল তার হাসি ভুলে ছিল, কতকাল এই মেয়ে আমার হাততালি দেয় না, আনন্দ করে না। পাখিয়ালা, তুমি আমার এই মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছ, তুমি বুঝি জাদুকর!

এই করে এখন আর কোনও বেদনার চিহ্ন আঁকা নেই। কোনও জলতেষ্টা নেই।

টুকুন বলল, পাখিয়ালা, তুমি এই পাখি কোথায় পেলে?

—গাছের নীচে দিদিমণি।

—কী গাছ ছিল ওটা?

—একটা শিরিষ গাছ ছিল।

—পাখিটার বুঝি কেউ ছিল না?

—কেউ ছিল না। ওর মা—বাবা ওকে ফেলে রেখে চলে গেছে। কী খরা আমাদের দেশে! কী রোদ ছিল, কী দুঃখ। আমাদের লোকগুলো টুকুনদিদিমণি, তোমাকে কী বলব, আমাদের লোকগুলো সতেরো আঠারো দিন জল খেতে পায়নি।

বাবা বললেন, সুবল, তোমাদের কোনও সরকারি সাহায্য মেলেনি?

সুবল কী বলবে ভেবে পেল না, কিছুদিন কিছু লোক বড় বড় গাড়ি করে পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে ফিরে গেছে, বড় বড় পরিকল্পনার কথা বলে গেছেন। ঐসব পরিকল্পনার কথা সুবল বোঝে না। বড় বড় নেতাগোছের মানুষ এসেছিল। দেশের জননী এসেছিলেন। তিনি খিচুড়ি মুখে দিয়ে কেমন খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে সকলকে, তার স্বাদ চেখে গেছে। কিন্তু মানুষের তেষ্টা দেখে যাননি।

হায়, সুবল যেন বলতে পারত, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো আর। গোরু—ভেড়া নিয়ে মানুষেরা চলে যাচ্ছে, মাটি ফেটে গেছে, শুকনো উত্তাপ, লু বইছে এবং গাছে মৃত ডাল শুধু, মাঝে মাঝে কোনও পাহাড়ের গায়ে দাবানল জ্বলতে দেখা গেছে। এক বুড়ো ঠাকুর সেই দাবানল দেখে বলেছে, দেশের পাপ, এত পাপ আর ধরণী সহ্য করবে না। পাপে দেশ ছেয়ে গেছে, অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মরুভূমির মতো হাহাকার করছে গোটা দেশ। বুড়ো ঠাকুর এই বলতে বলতে একটা গাছের ডালে নিজের বস্ত্র বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল।

আর কী দেখেছিল! দেখেছিল সেই চৌবেজীর বউকে। বউটা এমন খরা দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল। অভাব দেখে চৌবেজীর বউ অন্ন—বস্ত্রের সব আশা ত্যাগ করা যায় কিনা তার পরীক্ষা করত। সে অন্ন পেলে বলত, বিষ্ঠা খেতে নেই, জল পেলে বলত, বিষ, বিষ খেতে নেই। কাপড় পরতে দিলে বলত, আগুন, আগুন পরতে নেই। চৌবেজীর বউটা রাতে মাঠে নেমে উলঙ্গ হয়ে নাচত। ভয়ে বিস্ময়ে সকলে একদিন দেখেছে, চৌবেজীর বউ শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

সবই অভাবের জন্য এবং অন্নের জন্য। সারা গ্রামময় যখন ওলাওঠা, তখন মহাবীর মা শীতলার একটা মূর্তি বানিয়ে দিনরাত অশত্থ গাছটার নীচে বসে থাকত। মূর্তিটাকে সে সবসময় বগলের নীচে চেপে রাখত। যেন বগল থেকে ছেড়ে দিলে তার শরীরে মায়ের দয়া হবে। বগল থেকে ছেড়ে দিলেই মা শীতলা ওর ভিতরে ঢুকে ওলাওঠা বানিয়ে দেবে।

বস্তুত মহাবীর অভাবের জন্য, অন্নের জন্য, এবং এমন অনাবৃষ্টি আর আকাল দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল। সে সেই খড়ের তৈরি মা শীতলাকে বগলে চেপে সারাদিন চুপচাপ বসে থাকত। বিড় বিড় করে বকত। তারপর একদিন সকলে দেখল মহাবীর মাথায় পাগড়ি বেঁধে মা শীতলাকে বগল তলায় রেখে উত্তরের দিকে যাচ্ছে। লোকটা আর এ—অঞ্চলে ফিরে এল না। লোকটা অভাবের জন্য, খরার জন্য পাগল হয়ে গেল, নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

সুবল খুব নিবিষ্টমনে পোঁটলাটা বাঁধছে। এখন আর একটাও পোকামাকড় কামরার ভিতর উড়ে বেড়াচ্ছে না। পাখিটা উড়ে উড়ে সব ক’টি পোকামাকড় ধরে দিয়েছে সুবলকে। তারপর বড় জেবের ভিতর ফুর ফুর করে উড়তে উড়তে ঢুকে গেছে।

ট্রেন চলছিল। বেগে চলছিল। জানালা খুলে সুবল দেখল সারা মাঠে শুধু অন্ধকার। মাঝে মাঝে কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে। বোধহয় দূরে কোথাও অন্য ট্রেন লাইন আছে। দূরে একটা ট্রেন বাঁক নিচ্ছে। ঠিক একটা আলোর মালা, সুবলের এই আলোর মালা দেখতে বড় ভালো লাগছিল।

ওর ঘুম পাচ্ছে, মিষ্টি ঠান্ডা বাতাস মনে হচ্ছিল ভিতরে ঢুকছে—বোধহয় রাত শেষ হয়ে আসছে। এই শেষ রাতটুকুতে মনেই হয় না কোথাও কোনও অঞ্চল এখন জলাভাবে পুড়ে যেতে পারে। সুবলের চোখে ঘুম এসে গেল। জেবের ভিতর পাখিটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22
Pages ( 1 of 22 ): 1 23 ... 22পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *