টাকার গাছ
ভোর হয়ে গেছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এতক্ষণে রোদে ঝকমক করত চারদিক। এখন উদোম আকাশের নীচে কাজল-রঙা মেঘলা-ভোরের জলজ আবহাওয়া থমথম করছে।
নিশ্বাস নিতেও ভার লাগে বুকে। কচু বনের ভিতরে আর গভীরে সিঁদুর-রঙা ব্যাঙের ছাতার নীচে নীচে অনেকগুলো কটকটে ব্যাংকুটুর কুটুর করে কুরে কুরে খাচ্ছে এই আষাঢ়ের আলসে সকালকে।
ঝমঝমিয়ে নামবে আবার একপশলাশীগগিরই। সকালের গায়ের গন্ধ শুকেই বুঝতে পেলো কেতো।
ভরসা হয় না, সাহসও হয় না ভাইবতে। সেই ছোট্টবেলা থেইক্য তা কত কী-ই কামনা কইরল, হল কোতা? একটা না একটা ফ্যাচাং কিছু ঘইটে যাবেই সময়মতো। নাঃ, কিসুই আর কামনা কইরবে না সে। ঠিক কইরেছে কেতো।
গামছাটাকে ভালো করে বেঁধে নিয়ে বিড়িতে শেষ দুটো সুখটান লাগিয়ে নেমে পড়ল বলদটার লেজ ধরে জল কাদায়। ধানের শিষগুলো সবে মাথা চাগিয়েছে পাশের জমিতে। যেখানে রোঁয়া বুনেছে ওরা। তাইচুং লাগিয়েছে এবার।
হিটর, র–র-র-র–হট হট।
হাঁইটতেও ভুল গেল নাকি বলদটা? কী জ্বালা রে বাবা। চল চল।
চলতে লাগল বলদ। পিছনে পিছনে লাঙলের উপর দাঁড়িয়ে কেতো। একবার দাঁড়িয়ে, একবার নেমে, একবার হেঁটে, একবার দৌড়ে কাদায় কাদায় ছপছপ, সড়সড় শব্দ করে লাঙলে চড়ে চলতে লাগল।
পাশেই বাবুদের পুকুর। মস্ত পুকুর। মেঘলা-সকালে সেই পুকুরের জলকে অন্ধকার ঘরের আয়নার মতো দেখাচ্ছে। তার মধ্যে ঝুঁকে পড়ে মুখ দেখছে। নারকোল, তাল, ফলসা, আতা আর একটা গর্ব গর্ব মুখের গোলাপজামের গাছ।
লাঙল-চড়া কেতো উদ্দেশ্যহীনভবে, সামনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মাটি, ঘাস, পাতা, জল ব্যাং, গাছ, বলদ, লাঙল, সবকিছুই যেন একটু একটু করে গন্ধ ধার দিয়েছে এই সকালকে। দল বেঁধে ফড়িং উড়ছে তিড়িং তিড়িং করে কেতো আর বলদটার মাথার উপরে। ফড়িংগুলোর ডানায় সেই গন্ধটা চারিয়ে যাচ্ছে। যেন ফুতুবাবু মাছ ধরার চার ফেলেছেন গোপীপুরের পুকুরে–এমনই মিষ্টি লাগছে গন্ধটা।
একটা হেলে সাপ কাঁচকাটা হীরের মতো তার মাথা দিয়ে আয়নার মতো পুকুরের জলটাকে কেটে দু-ভাগ করে পুব থেকে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে দু-পাশে। তেউগুলো দৌড়ে যাচ্ছে পারের দিকে। সাপটা গিয়ে পশ্চিমের পারে উঠেই তালগাছের নীচের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
এই সবে-ঘুম-ভাঙা সকালের অলস ছবি-ছাঁদ, আলসেমি-মাখা গন্ধর মধ্যে, খেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘুম পেতে লাগল কেতোর।
এই ক্ষ্যান্তমণির জন্যে কী রাতে একটুও ঘুমোবার জো আছে! মা-বাবার কাছে যখন ঘুরঘুর করে মাথা নীচু করে, ঘোমটা দিয়ে ভালোমানুষ খুকিটির মতোন তখন বোঝার জো-টি নেই যে দিনের হেলে সাপের রূপখানি রাতের বেলা কেমন কেউটে হয়।
বিয়ের পর পর কেতোর ভালোই লাগত। বেশ বেশিই ভালো। ও যেন ভেসে যেত কুচকুচে কালো জোড়া কলাগাছের পিছল পিছল ভেলায় চড়ে বিল পেরিয়ে, গ্রাম ছাড়িয়ে, আশ্বিন মাসের উজলা জ্যোৎস্নায় ভাসা চকচকে কোনো উদলা নদী বেয়ে।
ক্ষ্যান্তমণির ছেলেপুলে হয়নি। তা-ই বোধহয় সে নতুনই আছে। একেবারে আনকোরা বিয়ের। দিনের বউ-এর মতোই। গায়ে এখনও নেবু-পাতা নেবু-পাতা গন্ধ, নেকু নেকু, পুষু পুষু, মুনু মুনু। ক্ষ্যান্তমণি বোধ হয় ক্ষ্যান্ত দেবে না কখনো।
মাটির ঘরের মেঝেতে শুতে বিয়েতে-পাওয়া শীতলপাটি আর ছোটো ছোটো দু-টি তেলচিটে বালিশ সম্বল করে ক্ষ্যান্তমণি কেতোকে নিয়ে যেসব সার্কাস-মার্কাস করে, তা সার্কাস কোম্পানির লোকে জানলেও শিউরে উঠত।
মাঝে মাঝে কেতোর বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে হয়। সূর্য ওঠা থেকে সূর্য ডোবা ইস্তক কাজ, খালি কাজ আর কাজ। দিনে কাজ, রাতে কাজ। আরাম বলতে, সুখ বলতে কিছু নেই। এই মেহনতের বদলে তেমন কিছু সুখ-সুবিধেও পাবার নেই। কেবল কোনোক্রমে দু-বেলা দু-টি ভাত। ভাগচাষের ভাত, ভাগচাষের ডাল, কখনো-সখনো ল্যাটা কী মৌরলা কী পুঁটি। অথবা মিরগেলের বাচ্চা, বাবুদের পুকুর থেকে চুরি করে আনা।
সে একটা হতভাগা।
ভাবে কেতো। একটা টাকার গাছ থাকলে ভালো হত। সব সুখই তার কজার মধ্যে থাকত তাহলে।
কেতো তার বাপ মানকেকে চিরদিন কেতোর মাকে বলতে শুনেছে, মায়ে কিছু চাইলেই বাপ বলত টাকার তো গাছই আছে আমার।
কেতো লাঙল চালায়, টাগরায় জিভ ঠেকিয়ে শব্দ করে টিগ-টি-র-র-রর, হির রর, টু-উ-উ-উস আর ভাবে, সকাল থেকে সন্ধ্যে এই জলে-কাদায়-রোদে-শীতে এই কষ্ট আর সয় না।
টাকার গাছ! মাথায় ঘোরে। সব সময়ে।
কেতোর একটা টাকার গাছ থাকলে বড়োই ভালো হত। মা, বাবা, বউ, ছোটো ভাই, বোন, ক্ষ্যান্তমণি সকলকেই ও হাত খুলে কত কী দিতে পারত। জীবনটা কী সুখেরই হত তাহলে। যা চাইত, তাই-ই পেত। আরামের বান বয়ে যেত, দুঃখের জীবনের মরা সোঁতা দিয়ে। দিতে তো অনেককেই অনেক কিছু ইচ্ছে যায়। কিন্তু…
টাকার গাছ?
বন-বাদাড়ে, খাল-পাড়ে, ঝোপে-ঝাড়ে কোথাওই কী পাওয়া যায় না? টাকার গাছ?
তারপর লাঙলটা ঘুরোতে ঘুরোতে ভাবে দেব-দেবতা, দৈত্য-দানোর দয়া ছাড়া এসব ভাগ্য কারো হয় না। টাকার গাছ আছে নিশ্চয়ই কোনো জঙ্গলে, বাদায়, কিন্তু তার হদিস জানে না কোনো মানুষ।
তারপর বলদটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে কেতো ভাবে, কিন্তু থাকতই যদি সে গাছ তবে কেতোর বাপ মানকে কী তাহলে খুঁজতে বেরুত না এতদিনে? শুধু মানকে কেন? গাঁয়ের সব লোকই তো দৌড়ে যেত খোঁজ পেয়ে।
শুধু যেত না মুনসের চাচা।
অদ্ভুত মানুষ এই মুনসের চাচা।
এই তো সেদিন দেখা হল। কেতো বলল, কেমন আছ মুনসের চাচা।
খুব ভালো আছি বাপ। খোদার বড়ো দয়া। খোদা বড়ো ভালোবাসেন আমাকে। ভালোবাসেন সকলকে। বড়োই সুখে আছি। তোমার লুঙিটা যে একেবারে ছিঁড়ে গেছে গো চাচা।
কেতো বলেছিল।
মুনসের চাচা চমকে উঠে বলেছিল, তাই নাকি? ওহো তাই-ই তো!
তারপর বলেছিল, তা সেলাই করে দেবখন তোর চাচি। না ছিঁড়লে সেলাই করবেটা কী?
কেতো বলেছিল, এখন চললে কোথায়?
হামিদের বড়ো জ্বররে! কচুপাতা কাটতে। মাথায় জল না ঢাললে জ্বর কমবে না।
সে কী? ডাক্তারের কাছে যাও চাচা দুপুরে।
না না বাপ। ডাক্তারে কী কইরবে? ও যিনি অসুখ দেছেন তিনিই সাইরে দেবেন। আমরা কে? হাকিমই বা কে। কম্পাণ্ডারই বা কে?
তারচারদিন পর হামিদ মারা গেছিল। কবর দেওয়া হল হামিদকে পুবের মাঠের গোরস্থানে। অনেক ফুলের গাছ সেখানে।
পরদিন চাচার সঙ্গে আবার পথে দেখা হতে কেতো বলল, কাইজটা বড়োই খারাপ কইরলে চাচা। গুণা হবে তোমার। অত কইরে বইললাম, তবু তুমি কোনোরকম ছিকিচ্ছেই কইরালে না, মেইরে ফেইললে জোয়ান ছেলেটাকে গো। আমাদের হামিদকে।
আরে বাপ, সি কতা তো বলছে সকলেই। কিন্তু যার গাছের ফুল তিনিই নেন। কেন নেন কখন নেন, তার মানে কি আমরা বুঝি?
তারপরই দাঁড়িয়ে পড়ে উপরে দু-হাত তুইলে বইলেছিল চাচা, সবই খোদার দয়া। ছালাম।
কেতো বলেছিল, কী জানি! খোদাই বল, ভগমানই বল, তুমি যে এত বিশ্বেস কর, কই তোমাকে তো সি কোনো সুখই দেলোনা। তবু দেকি তোমার ভক্তি ছেরেদ্দা মরে না।
তওবা, তওবা।
বলল, মুনসের চাচা।
তারপর আকাশের দিকে চেয়ে বলল, দেয়নি কি মেহেরবান আমাকে? সবই তো দেছেন। সুখ দেছেন শান্তি দেছেন তাঁকে বোঝার ক্ষমতা দেছেন, আর কোনটা চাইবার ছিল রে আমার?
কেতো অবাক হয়ে তাকিয়েছিল চাচার দিকে। লোকটা পাগল-টাগল হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। নইলে যার সতেরো বছরের ছেলে মারা গেছে দু-দিন আগে, সে কি না এমন করে বলতে পারে যে খোদা শান্তি দিয়েছেন, সুখ দিয়েছেন।
কেতোর রাগ হল। বলল, তোমাকে তো খোদা সবই দেছেন, তা তেনাকে একটা টাকার গাছ দিতে বলো না তোমাকে। তোমার দইরকার থাক আর নাই-ই থাক আমার বড়ো উপগারে আসে।
মনসুর চাচা সাদা দাড়ি নাড়িয়ে কী যেন বলতে গেছিল কেতোকে।
তারপর বিড়বিড় করে বলেছিল, আচ্চা বলব, বলব এখন তেনাকে। আমার জইন্যে লয়। তোর জইন্যেই বইলব বাপ।
২.
বেয়ান-বাড়ি যাবে বলে গোলা-সাবানে কাচা নীল রঙের হাফশার্ট পরেছে বাপ। পেলাস্টিকের পাম্পশু। টেরি কেটেছে তেল মেখে। ক্ষ্যান্তমণির মা নেত্যমণির যৈবন যেতে যেতেও শরীলের গাঙে লইটকে আছে। এখনও সে কাঁটা মারলে কেতোর বাপ মানকে ভিরমি খায়। ক্ষ্যান্তমণির বিদ্যে-শিক্ষে সব মায়ের কাছেই শেখা নিশ্চয়ই।
কেতোর মা আলু আর পাঁজ ফেলে মসুর ডালের খিচুড়ি রান্না করেছিল। বাড়িতে কেতো আর কেতোর বাবা মাকে ছাড়া আর কেউই প্যাঁজ খায় না। প্যাঁজ রসুনে শরীল গরম করে। মানকের ফিরে আসার কতা ছেল। কিন্তু রান্না হবার পর ট্যাঁরা পটলা এসে খবর দিল যে তার সঙ্গে মানকেদের দেখা হয়েছিল পঞ্চমুণ্ডির সাঁকোতে। তার বাবা খবর পাঠিয়েছে যে সে রাতটা বেয়াই বাড়ি থেকেই আসবে।
কেতো বলল, ভালো কইরে ঢেইকে রেইকে দাও মা। ভোরের বেলা মাটে যাবার সময় বাসি খিচুড়ি খেইয়েই যাব।
ক্ষ্যান্তমণি নেই। কেতো ঠিক করল আজ শোবে আর সঙ্গে সঙ্গে কুম্ভকর্ণ হবে। ফিসফিস, পুটুর পুটুর, হাচোর-প্যাঁচোড় কিছুই লয়।
পেটভরে খিচুড়ি খেয়ে, মাথার কাছে এক ঘটি জল রেখে জোনাকি জ্বলা বাঁশঝাড়ের দিকে জানালা দিয়ে চেয়ে, সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে নিয়ে ব্যাঙের ডাক শুনতে শুনতে কেতো আরামে ঘুমিয়ে পড়ল।
৩.
ঘুটঘুটে অন্ধকারে পঞ্চমুণ্ডির সাঁকো পেরিয়ে কেতো চলেছিল। খুব সাবধানে। আগে পিছে দেখতে দেখতে। ভয়ে, উত্তেজনায় বুক কাঁপছিল কেতোর। এদিকে খুব ফণীমনসার ঝাড়। ঠিক ঠিক মনে রেখেছে সব। বুড়ো বটের নীচে মা শেতলার ভাঙা দেউল। আরও এগিয়ে গেলে পিসাহেবের দরগা। এখন আর কেউ এদিকে মোটে আসে না, গোখরো আর শঙ্খচূড়ের আড্ডা এখানে। কখনো কারো গোরু ছাগল ভুল করে এদিকে চরতে এলে আর ফেরে না। তেনাদের কামড়ে মুখে গ্যাঁজলা উঠে পড়ে থাকে।
কিন্তু কার্তিক, অর্থাৎ কেতো, তবু রাতের বেলাই এসেছে। গভীর রাত। মুনসের চাচার নির্দেশ অনুযায়ী। হাতে লণ্ঠন। এখন পশ্চাতে বাঁশ না হলেই হয়! ভয়ে সারা শরীল ঘেমে উঠেছে কেতোর।
অতি সাবধানে পা ফেলছে। ভাঙা দেউল আর পোড়ো দরগার মাঝামাঝি যে শ্যাওড়া গাছ তা। থেকে দক্ষিণে কুড়ি পা হাঁটলে একটা প্রকাণ্ড সন্ধ্যামালতীর ঝাড়। সেই ঝাড়ের একেবারে ভিতরে সাদা ছোটো ছোটো, গোলগোল পাতাওয়ালা একটি ছোট্ট নাম-না-জানা গাছ। সেইটেই টাকার গাছ। সেই গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লা, টাকা দে টাকা দে, দে টাকা, টাকা দে বললেই সাদা পাতাগুলোর বদলে ফস ফস করে টাকা বেরোতে থাকবে। একাদশী, চতুর্থী আর অমাবস্যার রাত ছাড়া অন্য রাতে ওখানে যাওয়া বারণ। ঈদের চাঁদ দেখার পর পনেরো দিন একেবারেই যাওয়া মানা।
লণ্ঠনটা উঁচু করে তুলে ভয়ে দুরু দুরু বুকে কেতো শ্যাওড়া গাছটা থেকে গুণে গুণে কুড়ি পা। গিয়েই সন্ধ্যামালতীর ঝোপটা দেখতে পেল। গা ছমছম করে উঠল কেতোর। দূরে পঞ্চমুণ্ডির আসনের কাছে শেয়াল ডেকে উঠল। একসময়ে হত, আজকাল আর শিবাডভাগ হয় না দেউলে। শেয়ালগুলো মাটিতে পোঁতা মুণ্ডু টেনে বার করছে নাকি? একদল বাদুড় ঝপ ঝপ করে উড়ে এল শ্যাওড়া গাছটা থেকে। যেন কেতোকেই দেখতে। দুটো প্যাঁচা উড়ে উড়ে ঝগড়া করতে লাগল দূরে নানারকম শব্দ করে। দুরগুম, মারগুম, হাড়গুম, ধরগুম, লাশগুম।
গাঁয়ের সাহসী ছেলে কেতোর বুকও ভয়ে শুকিয়ে এল।
সন্ধ্যামালতীর ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে কেতো এবারে। বড়ো ভয় করছে। মুনসের চাচা যখন এই টাকার গাছের হদিস দেয় তখন অদ্ভুতভাবে হেসে বলেছিল, আমাকে পরে দোষ দিসনি যেন। বাপজান।
কী যেন ফোঁস করে উঠল ঝোপের মধ্যে থেকে। সাপ। প্রকাণ্ড কেউটে সাপ। ফণা ধরে উঠেছে। কেতোর বুক সমান।
হুঁ! এমনই কতা ছেল।
কেতো বলল, আল্লা টাকা দে, টাকা দে, দে টাকা, টাকা দে।
আশ্চর্য!
অমনি সাপটা সরে গেল আর সাপটার আড়ালে একটা ছোট্ট সাদা ঝোপ দেখতে পেল কেতো। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল কেতো সেইদিকে। দেখতে দেখতে সেই সাদা পাতাগুলো ফস ফস ফস করে এক-শো টাকার নোট হয়ে গেল।
কেতো এক-শো টাকার নোট হাটে-বাজারে ব্যাপারীদের কাছে দেখেছে। কখনো হাতে ধরে নি। পটাপট বোঁটা থেকে ছিড়তে লাগল। সবচেয়ে মজা লাগল দেখে যে, যেই নোট ছিড়ছে অমনি সেই বোঁটাতে নোট গজাচ্ছে নতুন। লন্ঠনের আলোয় ভালো করে দেখল, ঠিকই টাকা, একেবারে নতুন নতুন গন্ধ, অশোকচক্রর ছাপটাপ, অপিসারের সই-টই সব ঠিকঠাক।
শ-খানেক পাতা ছেঁড়ার পর কেতোর হঠাৎ মনে হল, এক-শো, এক-শো টাকার নোট মানে দশ হাজার টাকা। তাদের বাড়িতে তো ডাকাত পড়বে জানাজানি হলে। এতটাকা দিয়ে কি করবে ও। এত তো তার প্রয়োজন নেই। সারাজীবনেও ত খরচ করে উঠতে পারবে না। ভাবল কেতো। এও ভেবে নিশ্চিত হল যে, আর এই গাছের কাছে তাকে আসতে হবে না এ জন্মের মতো। এই প্রথম। এই-ই শেষ।
কোঁচড় থেকে আদ্ধেক টাকা বের করে ও টাকার গাছকে ফেরতও দিতে গেল। কিন্তু গাছ নিল না। উলটে সেই সাপটা কোথা থেকে হঠাৎ আবার ফোঁস করে উঠল।
কেতো তাড়াতাড়ি টাকাগুলো কোঁচড়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরল।
কেত বলল, আল্লা তোমার বেবাক দয়া।
এক্কেবারে ভোরেভোরে উঠে পড়ল কেতো।
শহরে পৌঁছে প্রথমেই যে সমস্যা হল কেতোর, তা হচ্ছে টাকা ভাঙাবে কোথায়? এক-শো টাকার নোট ভাঙাতে গেলেই লোকে ভাববে কেতো নিশ্চয়ই চুরি করেছে কারো কাছ থেকে। টাকা না থাকার হরেক সমস্যা ও এতদিন জানত, কিন্তু টাকা থাকাও যে কম সমস্যা নয়, তা সবে বুঝতে শুরু করল।
এ শহরে হবে না। এখান থেকে দশমাইল দূরে অন্য গঞ্জ আছে সেখানে সে চলল বাসে চড়ে। প্রায় সেখানে পৌঁছে গেছে এমন সময় ভাড়া চাইল কনডাকটর। কেতোর কাছে খুচরো নেই। এক-শো টাকা যে আছে, সে কতা বললেও বিপদ।
ভাড়া না দিতে পারায় কনডাকটর চড় মেরে নামিয়ে দিল বাস থেকে, বাপ-মা তুলে গালাগালি করে।
কেতো এই প্রথমে জানল যে, যে-টাকা দেখানো যায় না, থাকলেও যা লুকিয়েই বেড়াতে হয়, তা বড়ো বোঝা।
বাকি এক মাইল পথ হেঁটে গেল কেতো। এ গঞ্জে কেউই ওকে চেনে না।
দু-হাজার টাকা ভাঙাল প্রথমে। ব্যাঙ্কের লোক তার দিকে এমন করে তাকাল যে, কেতোর মনে হল পুলিশেও দিতে পারে। ছোট্ট জায়গা। দশের-পাঁচের নোট মিলিয়ে দু-হাজার টাকা নিল সে। সেই টাকা রাখল কাঁধের ব্যাগে। বাকি সব এক-শো টাকার নোট রইল কোঁচড়ে, যেমনকে তেমন। কেতোর তলপেট গরম হয়ে উঠল। টাকার গরমে।
তারপর এ-দোকান ও-দোকান ঘুরে বাপের জন্যে, মায়ের জন্যে, ভাই বোনের জন্যে এত কিছু কিনল যে, তা বলার নয়। ক্ষ্যান্তমণির জন্যে পাছাপেড়ে শাড়ি কিনল। পাউডার, স্নো, আলতা, ছেন্ট সব। ভালো দেরাদুন চাল কিনল দুবস্তা। পোলাউ খাবে। মাছ কিনল,ইলিশ। ইস…কত্তদিন খায়নি। দুপুরের খাওয়াটা হোটেলই খেল। মাংস, ভাত, দই মালপো পেট ভরে। তারপর পান। খেয়ে সিগারেট কিনল এক কার্টনই। কিনে ফেলল। রোজ আর আসবে না। দেশলাই দুডজন। হ্যাজাক চারটে। কেরোসিন আর সরষের তেল এক টিন করে। পেট্রলও।
ছাগল-পাঁঠার গলার দড়ি ধরে মুটের সঙ্গে মালপত্র নিয়ে কেতো যখন গ্রামে পৌঁছোল তখন বেলা যায় যায়।
ওকে দেখে সকলে দৌড়ে এল। সকলকে সে যার যার জিনিস দিল। সে রাতেই কেতো রাতারাতি কর্তা হয়ে গেল বাড়ির। আর বাবা মা ভাই-বোন সবাই তার প্রজা। আর রাজা
সে-ই। টাকা থাকলে মেহনত করতে হয় না তাই-ই শুধু জানত ও। কিন্তু প্রথম দিনই ও বুঝতে পারল যে টাকা থাকার আরো অনেক ব্যাপার আছে। এতদিনে যেন ও হঠাৎ বুঝতে পারল যে, যাদের অনেক টাকা, যাদের খাওয়া-পরার চিন্তা নেই, আরাম-বিরামের চিন্তা নেই, তারাও কেন টাকা, আরও টাকা করে মরে। টাকা ক্ষমতা দেয়, এই যুগে সম্মান দেয়, প্রতিপত্তি আনে।
নিজেদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কেতোর তলপেট টাকার গরমে পুড়ে যেতে লাগল।
টাকা রোজগার করতে পারলেই হল। সকলে সেই টাকার ভাগ পেলেই হল। সকলেই খুশি। কেউই জিগেস করল না, অথবা জিগেস করার সাহস করল না, অথবা কোনো অশান্তি করল না, একথা জিগগেস করে যে, কী করে এত টাকা তাদের কেতো পেল।
রাতে যখন কেতো খেতে বসল, তখন মা-বাবা-ভাই বোন সকলেই তাকে সমীহ করতে লাগল। বাবার পাতে সবচেয়ে বড়ো কোলটা না দিয়ে মা কেতোর পাতেই দিল। কেতো আপত্তি করতে যেতেই, বাপ মানকে হাঁ হাঁ করে উঠল।
খেয়ে-দেয়ে উঠে কেতো শুতে গেল। শুতে যাওয়ার আগে মানকেকে বলল, চারজন লোক। দেখো। কাল সকালে আমি বলদ আর হাল কিনে আনব। খোঁজ লাগাও গ্রামে কার কার জমি। বিক্রি হবে। যা দাম চায় তাই-ই দেব। বাবুদের মতো পুকুর কাটাব। পাকা বাড়ি তুলব। তুমি এই সব বন্দোবস্ত, দেখাশোনা করো। এখন থেকে টাকার ভার আমার।
বলেই, সিগারেটের কার্টন খুলে বাপকে আদ্দেক সিগারেটের প্যাকেট আর এক প্যাকেট দেশলাই দিল।
মানকে ছেলের বেয়াদবি মাপ করে দিয়ে সিগারেটে সুখটান দিয়ে ভাবল, তার কপালে শেষ জীবনে এত সুখই ছিল তা কে জানত সবই ভগবানের দয়া। ছেলে তার টাকার জাহাজ। চাঁদ সদাগরের ময়ূরপঙ্খী নাও লেগেছে তাদের ভিটেতে।
৪.
এখন মানকেদের বাড়ি গ্রামের সবচেয়ে বড়ো বাড়ি। খেত-খামার কুলি-কামার, কুয়ো, টিউবওয়েল, গাই-বাছুর, ছাগল-পাঁঠা, হাঁস-মুরগি। গোলা ভরা ধান। সব কিছুই ওদের আছে। লোজন, দাস-দাসী, অতিথি-অভ্যাগততে বাড়ি সবসময় গম গম করে। ওরা বাপ-বেটা কেউই গতর খাটায় না আর। লোক খাটায়। যাদের টাকা নেই, তাদের খাটায় ওরা টাকা দিয়ে।
কেতোর মায়ের দু-জন ঝি। রান্নাবান্নাও তারাই করে। ধান শুকোয়, ডাল ঝাড়ে, ঢেঁকিতে চিঁড়ে কোটে, নাডু বানায়, মুড়কি বানায়, পাটিসাপটা, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের পুতুল বানায়। বসে শুয়ে, গেদে খেতে কেতোর মায়ের কোমরে গেঁটে বাত হল। বাপ মানকের এক নতুন অসুখ হল। ডায়াবিটিস। বহু-মুতুরে রোগ। ডাক্তার এল। ওষুধপত্র পড়ল। কিন্তু এই অসুখ নাকি সারে না। বড়োজোর কমে। যারা বসে বসে কাজ করে, অথবা বসেও কাজ না করে, শুধুই বসে খায় মানকের মতো, কেতোর মতো, তাদেরই নাকি এই অসুখ হয়।
ক্ষ্যান্তমণিরও আলাদা লোক আছে। ক্ষ্যান্তমণি, বাবুদের মেয়েদের দেকাদেকি তাকে আইয়া বলে ডাকে। ক্ষ্যান্তমণির আলকেউটের মতো চকচকে লিহিলে কেলে-রঙা শরীরটা, যে শরীরটা নিয়ে। ও সার্কাস করত কেতের সঙ্গে, ওলটাত, পালটাত ছিটকে সরে যেত, ঝাঁপিয়ে বুকে আসত, সেই শরীরটা এখন হারিয়ে গেছে। প্রচুর মেদ জমেছে খাঁজে খাজে। শরীরের পাহাড় নদী, জোনাকজ্বলা নরম মাঠ সবই ঢেকে গেছে মেদের নোনা জলে। আজকাল ক্ষ্যান্তমণি আদর করতেও পারে না, খেতেও পারে না। খালি গুচ্ছের খায় আর ঘুমোয়, আর সাজে।
যদিও তার সাজ কেউই দেখে না।
কেতোদের বাড়িতে ঘুঘু, বুলবুলি, মুনিয়া, মৌটুসিদের শিষ আর শোনা যায় না আজকাল। ডিজেলের পাম্প চলে, ধান ছাঁটাই-এর কল চলে, জিনারেটারে আলো জ্বলে, পাখা চলে ঝম ঝম, ঝা ঝা। সবসময় চৈ চিঙ্কার।
একটুও শান্তি নেই আর।
কিন্তু অনেক টাকা আছে।
যখন ক্ষ্যান্তমণির শরীর ছিপছিপে ছিল, মুখ রোগ ছিল তখন ছেঁড়া লালপেড়ে মোটা শাড়িতেও তাকে সুন্দরী দেখাত। কেতোর বুকে চমক লাগত। এখন দামিনি শাড়ি, ভারী গয়না উগ্র সব ছেন্ট মেখেও তাকে পচা কলাই-এর বস্তার মতো দেখায়। বড়োলোকি তার সব সৌন্দর্য গিলে খেয়েছে মৌরলা মাছকে যেমন ভেটকিতে খায়। আরামে খেয়ে গেছে তার সব শরীর-মনের আনন্দ।
কেতোর মনেও একটুও সুখ নেই। এই কেতে অন্য কেতো। বসে বসে খেয়ে খেয়ে, শুয়ে শুয়ে, টাকা নিয়ে ভেবে ভেবে একেবারে হাড়ে-মজ্জায় বিরক্ত হয়ে গিয়ে একটু ঝিং-চাক করার জন্যে দূরের গঞ্জে কেতো রাখন্তী করেছে একজন ছিপছিপে মেছুনী মেয়েকে। ক্ষ্যান্তমণির গড়-পেটন আগে যেমন ছিল তেমনই তার গড়ন-পেটন, নড়নচড়ন, চলন-বলন। কেতো সপ্তাহে দু-দিন যায় তার কাছে। রাত কাটায় না, বদনামের ভয়। যার যত টাকা, তার তত বদনামের ভয়, প্রাণের ভয় টাকার পরিমাণের সঙ্গে সমান তালে বাড়ে। কেতো জেনেছে।
দুপুরবেলা গিয়ে মেয়েটাকে আদর করে কেতো, আর আদর খায়। টাকার গাছ থেকে ছিঁড়ে এনে মুঠো মুঠো টাকা দেয়।
মেয়েটার নাম মনোহারিণী। বড়ো ভালোবাসে কেতোকে। খলসের মতো গায়ের রং, ইলিশের মতো গন্ধ গায়ের। আর পুঁটির মতো ছটফটে। মাছটাকে টাকার পোলোতে বন্দি করেছে কেতো। মেয়েটার সমস্ত পৃথিবী, যৌবন, জীবন কেতোরই হাতে। শুধু ভালোবাসা দিয়েই যে ভালোবাসা পাওয়া যায় এসব ফালতু কথাতে কেতো বিশ্বাস করে না।
কেতোর হাঁটুতে কিছুদিন হল একটা ব্যথা হচ্ছে প্রায়ই। আজকাল ও একেবারেই হাঁটে না। মোটর সাইকেল কিনেছে একটা। গঞ্জের ডাক্তার বলেছে, এই অসুখের নাম আর্থরাইটিস। একরকমের বাত।
ক্ষ্যান্তমণির বা-বাবাকেও কম দেয়নি কেতো। যার টাকার গাছ আছে তার ভাবনা কীসের? তাদের বাড়িও পাকা করে দিয়েছে ও। শ্বশুর-শাশুড়িকে মাসে পাঁচ-শো করে টাকা দেয়। শাশুড়ি বড়ো ভালোবাসে কেতোকে। যদিও মাগুর মাছ নয় কেতো তার বাপের মতো, তবু হাতে বানানো মিষ্টি পাঠায় শ্বশুরকে দিয়ে শাশুড়ি কেতোর কাছে, যখন প্রতি মাসের পয়লাতে টাকা নিতে আসে শ্বশুর।
আজকাল কত লোক যে ভালোবাসে কেতোকে! কেতো জেনে অবাক হয়ে যায়। টাকার গাছটার মতোই কেতোরও যে এত গুণ ছিল তা কেতো কখনোই জানেনি। এতদিন।
কেতোর কাছে দুর দূর থেকে আত্মীয়স্বজন আসে এখন। যাদের সে জীবনে দেখেনি। যারা আছে, বা ছিল বলে কখনো জানেনি পর্যন্ত। বন্ধুবান্ধবও আসে–যারা বলে, পাঠশালায় একসঙ্গে পড়ত নাকি তারা কেতোর সঙ্গে। কেতো তাদের মুখ ভুলে গেছে। সকলেই টাকা চাইতে আসে। মোসাহেবির মোচ্ছব লাগায়। কারো অসুখ, কারো মেয়ের বিয়ে, কারো ঘর পড়ে গেছে, কারো ছেলে-মেয়ে হবে। কারো চাষ হয়নি, কারো গ্রামের নদীতে বান। এত লোক যে কেতোকে চিনত, জানত, কেতোর উপরই তাদের ভালোমন্দ শুভাশুভর জন্যে নির্ভর করত এমন নিশ্চিন্ত হয়ে, তা কেতো একেবারেই জানত না আগে।
টাকা, কেতো সকলকেই দেয়।
টাকার গাছ থাকতে তার ভাবনা কী?
সকলেই ধন্য ধন্য করে। টাকাওয়ালা কেতোকে। কিন্তু আজ কেতো মানুষটাকে, যারা তাকে কাছ থেকেও জানত, তারাও ভুলে গেছে। গাঁয়ের লোকেরা সকলে জয়জয়কার করে। আগে গাঁয়ের মধ্যে মুনসের চাচার ইজ্জৎ ছিল সবচেয়ে বেশি, এখন কেতোর। টাকা থাকলে সব কেনা যায়। লজ্জা, মান, ভয়–সব।
মাঝে মাঝে কেতো ভটভট করে মোটর সাইকেল চালিয়ে গ্রামের পথে যেতে যেতে দেখতে পায়, খালি গায়ে, মুনসের চাচা খেতে কাজ করছে। রোদে, জলে, কাদায়। কখনো চাচার বাড়ি গেলে। দেখে, বড়োই দুঃখ চাচাদের। ঘরে খাবার নেই, চালে খড় নেই, চাচির শাড়ি ঘেঁড়া, হামিদের ভাই-বোনের পিঠ আর পেট এক।
কেতো একদিন চাচাকে টাকা দিতে গেছিল। চাচা ওর সামনেই টাকাগুলো ছিঁড়ে ফেলেছিল। কেতো হায়! হায়! করে উঠেছিল।
চাচা হো হো করে হেসে বলেছিল, বাপজান তোর দুঃকু কীসের? তুই তো গাছতলাতে গেলেই আবার পাবি।
তারপর বলেছিল, বাপরে। এই টাকার জন্যেও এত দরদ তোর? নিজের ঘাম ফেলে রোজগার করলে না জানি কি হত রে? তোর টাকাই নেব যদি, তবে গাছের হদিশ তোকে না দিয়ে আমি তো নিজেই বড়োলোক হতে পারতাম। কী রে?
কেতো লজ্জা পেয়ে চলে যায়। আর ভাবে, এই লোকটার বড়ো সুখ। এই লোকটার এত কষ্ট, অথচ এত আনন্দ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেতো ভাবে, এত কিছু পেয়েও এই লোকটাকে বোঝার মতো বুদ্ধি পেল না। ওকে কেনবার মতো টাকা পেল না।
চাচাকে বুঝতে পারে না ও। চেষ্টাও করে না আর।
একদিন কেতো টাকার গাছের সামনে গিয়ে দশ হাজার টাকা নিয়ে আসার সময় ভেবেছিল যে, আর কখনো এ-জীবনে তাকে সেখানে যেতে হবে না। এখন প্রায়ই আসতে হয়। নিয়ে যেতে না যেতেই ফুরিয়ে যায়। কেতো জেনেছে, মানুষের প্রয়োজন বাড়ালেই বাড়ে। প্রয়োজনের কোনো শেষ নেই।
কেতোর জীবনে এখন কোনোই বৈচিত্র্য নেই আর। শুধুই সুখ, শুধুই আরাম। শুধু গাছ থেকে পাতা ছেড়া, আর খরচ করা।
৫.
এমনি করেই চলছিল কেতোর। চলছিল কেতোর কেতময় জগৎ। হঠাৎ…একদিন সর্বনাশ হল। এক অমাবস্যার রাতে কেতো টাকার গাছের কাছে গিয়ে পৌঁছোতেই দেখল জোড়া-কেউটে।
ফোঁস ফোঁস করে কিছুতেই তাকে কাছে যেতে দিলো না। সে রাতে ফিরে এল কেতো প্রাণটি বাঁচিয়ে। কিন্তু আবার সে ফিরে না গেলে, প্রাণ, মান কিছুই যে, বাঁচবে না আর তাই একাদশীর দিনে বন্দুক সঙ্গে নিয়ে সে গেল। এখন তার দোনলা বন্দুক আছে। গুড়ুম গুড়ুম করে মেরে ফণা গুঁড়িয়ে দিল জোড়া সাপের।
মরা সাপ পেরিয়ে গিয়ে টাকার গাছের কাছে গিয়েই দেখে সর্বনাশ! সেখানে সেই গাছটাই নেই। একটা কাঁটাওয়ালা ফণীমনসা হাত-পাত ছড়িয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে টান-টান দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে।
কেতো পাগলের মতো খুঁজল এদিক-ওদিক। কিন্তু না। গাছ নেই। টাকার গাছকে আর কোথাও খুঁজে পেল না কেতো।
সাত সকালে কেতোর শ্বশুর এল। বলল, বাবা কেতো, হাজারখানেক টাকা না হলে তো নয়, ক্ষ্যান্তর মাকে নিয়ে সামনের হপ্তাহে একবার বক্রেশ্বর তারাপীঠে যেতেই হবে। মানত করে এসেছিল। চুল ফেলতে হবে।
চুল?
কেতো বিমর্ষ হয়ে বলল, অমন সুন্দর চুল..
কেতোর শ্বশুর বলল, না না, মাথার নয়, বগলের চুল। তোমার বাবার বহুমুতুরী রোগের জন্যে মানত করেছিল।
কেতো জবাবে বলল, টাকা নেই। সত্যিই নেই। বিশ্বাস করুন।
শ্বশুর চলে যেতেই বাপ মানকে এল।
বলল, সামনেই জামাই ষষ্ঠী আসছে। পুঁটি আর মাখনকে আনবার জন্যে ছোটোকে পাঠাব। তাদের ফাস্টোকেলাশের ভাড়া, টেসান থেকে ট্যাকসি ভাড়া, ছোটোর যাতায়াত বাবদশ-চারেক টাকা দে কেতো।
কেতো বলল, টাকা নেই বাবা।
টাকা নেই?
মানকে অবিশ্বাসের গলায় বলল। তারপর বলল, আচ্ছা।
ছেলের মুখের দিকে ঘৃণার সঙ্গে তাকিয়ে চলে গেল বাপ।
উজলাপুরের মাসি এল। তার মেজো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কেতো তার বড়ো মেয়ের বিয়েতে তিন হাজার টাকা দিয়েছিল। তখন তো গাছটা ছিল। এখন মেজো মেয়ের বিয়ে।
মাসি চৌকাঠের সামনে মোড়া পেতে বসে মুখে পান দিয়ে বলল, তোকে দেখলে যেন বুক জুড়োয়। কত লোকের গবব তুই, আমাদের গরব, গাঁয়ের গবব, গুষ্টির গবব।
তারপর বলল, এখন থেকেই টাকাটা না পেলে বন্দোবস্ত তো কিছুই করা যাবে না ধন। তাইই এলাম এতদূর পথ নিজেই যাবার সময় স্যাকরাকে সঙ্গে নিয়ে যাব একেবারে।
কেতো বলল, মাসি টাকা নেই। যখন ছিল, তখন দিয়েছি। আজ সত্যিই নেই। বিশ্বাস করো।
নেই! বলিস কী ধন? অমন অলক্ষ্মীর কথা মুখেও আনতে নেই। নেই নেই করতে করতে সত্যিই লক্ষ্মী পালায়। তবে, আমাকে দিবি না, সে অন্য কথা।
তোর উপর দাবি তো নেই কোনো। আমি আর তোর কে?
তারপর একটু চুপ করে থেকে মাসি বলল, আমাকে না দিলি নেই, তবে তোর নিজের সম্মান, নিজের মান মিথ্যে কথা বলে নষ্ট করিস না! উজলা মাসির কথা তো ভুলবিই। হয়তো গরববতী মাকেই ভুলে যাবি একদিন।
কেতো হতভম্ব হয়ে মাসির দিকে চেয়ে রইল। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না, বড়ো মেয়ের বিয়ের সময় টাকা চাইতে আসার আগে, মাসিকে কেতো কখনো চোখে দেখেচিল কী না। নাঃ দেখেনি। কখনো চোখেও দেখিনি। মনে পড়ল পরিষ্কার।
মানকে গিয়ে কেতোর মাকে বলল, তোমার ছেলের কাছে তুমিই যেও! আমি অপমান হতে আর যাব না। তোমার বড়োলোক ছেলের মোসাইবি আমার দ্বারা হবে না।
ক্ষ্যান্তমণি আছড়ে কেতোর ঘরে এসে বলল রইল তোমার ঘর সংসার পড়ে। আমি চললাম, বাবার সঙ্গে। বেয়াই বাড়িতে বাবা অপমান সইবে, আর আমি তা সহ্য করব, এমন মেয়ে ক্ষ্যান্ত নয়। বাবা হাজার চেয়েছিল, তুমি দাওনি। এখন আমি দু-হাজার চাইছি আমাকে দাও। না দিয়ে দেখোই তুমি। কী পলয়টাই ঘটাই!
কেতো মুখ নীচু করল। কাশল। বলল, সত্যি বলছি খেমি, টাকা নেই। বিশ্বাস করো, নেই।
তোমার সব কথাই বিশ্বাস করি আর এইটে করব না? বলেই, কেতোকে একটা খোঁটা দিল মনোহারিণী সম্বন্ধে।
ক্ষ্যান্তমণি একটু-আধটু শুনেছে। কিন্তু পয়সাওয়ালা পুরুষের অমন একটু-আধটু গুণ থাকেই। তার নিজের সঙ্গে তো কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি কেতো কখনো। তাকে ফেলেও দেয়নি। যদি সে
সুখ পায় দুপুরবেলা লুকিয়ে-চুকিয়ে একটু-আধটু তো পাক না। গঞ্জের মনোহারিণী তো তার বিয়ে-করা ইস্ত্রী নয়, কেতোর মাগ। মাগ-এর জাঁক ত বন্ধ দরজার ঘরেই। গেরামে, গঞ্জে, সমাজে মাগ-এর আবার কোন বড়াইটা?
কিন্তু টাকাও দেবে না, আবার এসব। তা হবার নয়। যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে।
ক্ষ্যান্তমণি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমার বেলা টাকা নেই, আর অন্য অনেকের জন্যে তো…
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আজকে হিসেবটা নেবোই আমি। তোমার গুণের কের্তন গাইব। হাটে হাঁড়ি ভাঙব। তোমার ভাই-ই সব বলেছে আমাকে। আমি উকিলের কাছে যাব। আমার বাবাও ফ্যালনা লোক নয়। আমি তোমাকে ডেরাইভোস করব।
কেতো চুপ করে তাকিয়ে রইল ক্ষ্যান্তমণির মুখে ডেরাইভোস-এর কথা শুনে।
ঠিকই কথা। ক্ষ্যান্তমণির বাবা ফ্যালনা লোক নয় আজকে। জমি-জমা, পুকুর, পাকাবাড়ি বলদ, দুধেল গোরু, সবেরই মালিক। যদিও এক এক করে সব কেতোই দিয়েছে।
অনেকই দিয়েছে কেতো। দিয়েছে অনেককেই। আজ আর দিতে পারছে না। সত্যিই পারছে না দিতে, কাউকেই আর কিছুই। সেই জন্যেই চারধারে এত সোরগোল। এত অশান্তি, অসন্তোষ। বিদ্বেষের ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় চার ধার অন্ধকার হয়ে উঠেছে।
বারান্দায় কেউই ছিল না। কেতের পাশে এখন ভীড় নেই। কেতো একা। অনেক কিছু ভাবতে পারবে, পারছে কেতো।
কেতো ভাবছিল, হাত একবার খুললে, যারা সেই উপুড় হাতের গুড় পায় তারা আর কিছু শুনতেই রাজি থাকে না। তারা ভাবছে, কেতোর অনেক আছে, এখনও আছে। যে পরের জন্যে এত করত ও করে, সে নিজের জন্যে না-রেখেই করে এমন কতা একেবারেই বিশ্বাসের নয়। আছে, নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ইচ্ছে করেই দিচ্ছে না।
এক এক করে অনেক কথা বুঝতে পারছিল কেতো। যেকথা গরিব থাকার সময়, এমনকী বড়োলোক হয়ে যাওয়ার পরও বোঝেনি। আজ বড়োলোক থেকে হঠাৎ গরিব হয়ে পড়ায় তার চার ধারের লোকজন, দাবিদার, আত্মীয়স্বজন সকলকে দেখে তার মনে হচ্ছে কারো জন্যে কিছু করা, প্রাণ ভরে করা, দরদ দিয়ে করার মতো ভুল আর দু-টি নেই।
খোলা হাত বন্ধ করলেই বিপদ, বেদম বিপদ।
আজ মনোহারিণীর জন্মদিন। গত বছরের জন্মদিনে অনেক কিছু দিয়েছিল কেতো। এবার শুধু দু-টি চকোলেট কিনে নিয়ে গেল দুপুর দুপুর। টাকা নেই। টাকার গাছ নেই। তবু এই ভয়ংকর সময়ে মনোহারিণীর কাছে গেলে হয়তো শান্তি পাবে একটু।
মনোহারিণী কেতোর ভাইয়ের কাছ থেকে কেতোর হঠাৎ পরিবর্তনের কথাটা ইতিমধ্যেই শুনতে পেয়েছিল। চকোলেট দুটো হাতে নিয়েই, জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরের কচুরিপানা-ঢাকা পুকুরে ফেলে দিল।
বলল, থাক। অত সোহাগে কাজ নেই। আগের কথা ভুলে যাও।
কেতো বড়ো দুঃখ পেল। ও ভেবেছিল মনোহারিণী হয়তো তার সঙ্গে অন্যদেরই মতো নিষ্ঠুর ব্যবহার করবে না। ও অন্তত ভালোবাসে কেতোকে।
কেতো হাসল বোকার মতো, ওর দুঃখটা ঢেকে। মুখে বলল, মনো, আমি গরিব হয়ে গেছি। আমার আর টাকা নেই। সত্যিই।
মনো বলল, টাকা নেই তো আমিও নেই। তোমার কেউই নেই। ফেলো কড়ি মাখো তেল। ওসব যাত্রা অন্যখানে কোরো। আমার সময় নষ্ট করো না। মাঝিগাঁর বীরেন সাপুই এখনই আমার ঘরে। ঘর খালি করো। কাটো দিকি এখান থেকে।
কেতো যখন বের হয়ে এল মনোহারিণীর ঘর থেকে, তখন হঠাৎই ওর বড়ো হালকা হালকা লাগতে লাগল। ও যেন এতদিন টাকার গাছের নীচে চাপা পড়েছিল। কেতোর সমস্তটুকু কেতোই একেবারে হেজে, মজে গেছে ওই টাকার গাছতলায়। কেতো যে একটা মানুষ, মানুষ হিসেবেও যে ওর সামান্য কিছু প্রেম ভালোবাসা, ভালো ব্যবহার পাওয়ার ছিল অন্য মানুষের কাছ থেকে, এই কথাটা ওর কাছের সকলেই ভুলে গেছে। ওর টাকাকেই সকলে ভালোবেসেছিল। ওকে ওর নিজের জন্যে একজনও আর চায় না। কখনোই চায়নি।
বাড়ি ফিরতেই আবার সকলের আক্রমণের মুখে পড়ল কেতো। কেউই ওকে বিশ্বাস করছে না। সকলের চোখেই অবিশ্বাস। যার একদিন অনেক টাকা ছিল তারও একদিন যে টাকা ফুরোতে পারে একথা যারা প্রাপক, গ্রাহক, তারা বিশ্বেই করতে চায় না।
কেতো বুঝল, সংসারে সব মানুষই নিজের চোখ দিয়েই অন্যকে দেখে। যে যেমন চোখ নিয়ে জন্মেছে। মানকে, ক্ষ্যান্তমণি, ওর ছোটো ভাই, ক্ষ্যান্তমণির বাপ, এরা সকলেই নিজের নিজের বুদ্ধি ও বিচার দিয়েই কেতোকে ওজন করেছে। তাদের বিবেক অন্যরকম। কেতো যে টাকার গাছের পাতা ছিঁড়েছে আর অকাতরে লোককে দিয়ে দিয়েছে, নিজের জন্যে কোথাও কিছু লুকিয়ে রেখে একথা বিশ্বাস করা কেতোর বাপ মানকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অন্যদের পক্ষেও নয়। কেতোর গববধারিণী মা পর্যন্ত কেতোকে টাকা না থাকার অপরাধে ক্ষমা করল না।
কেতো সে রাতে কিছুই খেল না। কেউ খেতে বললও না। ও ঘরে গেল শুতে। কিন্তু ক্ষ্যান্তমণি শোওয়ার ঘরে ঢুকতে দিল না। দোর বন্ধ করে রইল। ভিতর থেকে বলল, গঞ্জের মাগ-এর কাছে যাও। যাকে পায়জোর আর বিছে হার আর হিরের নথ দিয়েছ, তার ছুন্দরী গন্ধ-কোলে শোও। গিয়ে। আমার দরজা তোমার জন্যে বন্ধ।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুকুর পাড়ে ঝোপে-ঝাড়ে বাঁশবনে লটকা গাছের ডালে ডালে জোনাকি জ্বলছে। হুক্কাহুয়া করছে দূর নদীর পারের শেয়াল।
হাম্বা-আ-আ-করে ডেকে উঠল বাদামি-রঙালক্ষ্মী গোরুটা।
ও-ও কিছু বলছে নাকি?
না?
এই গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি,কুকুর-বেড়ালরাই টাকা থাকা-না-থাকায় ভালোবাসার কিছুমাত্র তফাত করে না। কেলো কুকুরটা পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল। কেতো ঘড়ঘড়ে, চাপা গলায় ডাকল, কেলো। কেলোরে। কেলোর কালো লেজটা অন্ধকার নাড়িয়ে নিঃশব্দে নড়ে উঠল ভালোবাসায়।