Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝুলা || Buddhadeb Guha

ঝুলা || Buddhadeb Guha

বোম্বে শহরের এই দিকটি বেশ নিরিবিলি। দোকান-পাটও কম। কাফ-প্যারেডের এই হোটেলটা থেকে পিছনে তাকালে চোখে পড়ে দূরে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড-সেন্টার। তার পিছনে আরব সাগরের একফালি ব্যাকওয়াটার। এবং ব্যাকওয়াটার পেরিয়ে মূল সমুদ্র।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড-সেন্টারের সামনের রাস্তাতে সার সার কুড়ি-বাইশতলা ছিমছাম মাল্টিস্টোরিড সব বাড়ির সারি। চুপচাপ, ফর্মাল, শুধু হ্যালো বলা আত্মমগ্ন, বম্বেবাসীদের আবাস।

বোম্বে শহরে থাকলে মনে হয় না দেশেরই কোনো শহরে আছি। বিদেশি গাড়ির মেলা, কোটি কোটি টাকার খেলা। কলকাতাবাসীদের মতো বেতো-ঘোড়ার মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ডিজেলের কালো প্রাণহারী ধোঁয়া গিলতে গিলতে যাতায়াত করতে হয় না ওদের। চল্লিশ থেকে ষাট কিলোমিটার গতিতে গাড়ি ও বাস চলে এখানে। সফল কেজো লোক গিসগিস করে।

রাতের ফ্লাইটে পৌঁছেছিলাম। এই প্রথমবার উঠলাম এই হোটেলটাতে। কনফারেন্সের জন্যে। ঘরের পর্দা সরিয়ে দিতেই দেখি কংক্রিটের পাহাড়শ্রেণিতে আলোর মালা। নানারঙা পর্দা-ঘেরা, এয়ারকন্ডিশনার লাগানো অগণ্য মণিমুক্তোর মতো আলো-জ্বলা সব পায়রা

খুপি-ঘর।

সকালে ঘুম থেকে উঠে, চা খাওয়ার সময়ে ঘরের পর্দাগুলো আবার সরালাম। ঘরটা পশ্চিমমুখো। আলো এসে পুবমুখো মাল্টিস্টোরিড বাড়িগুলোকে হালকা সোনা রঙে ভরিয়ে দিয়েছে। বোম্বে শহর জেগে উঠেছে। দলে দলে মেয়ে-পুরুষ ধবধবে সাদা শর্টস আর গেঞ্জি অথবা জগিং-স্যুট এবং সাদা এবং রঙিন কেডস পায়ে প্রাত্যহিক সকালের ব্যায়ামে নেমে পড়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনের রাস্তায়। কয়েক হাজার সাদা সি-গাল জোড়ায় জোড়ায় ভাটা পড়া কালচে ব্যাকওয়াটারকে ভালোবাসার স্নিগ্ধ আভায় উজ্জ্বল করে বসে আছে।

আমার ঘরের ঠিক সামনেই যে বাড়িটা, যার বেসমেন্ট ও ফার্স্ট ফ্লোরে গারাজ, সার সার বিদেশি গাড়ি, সেই বাড়িরই একটা ফ্ল্যাটের বসার ঘরে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।

একটি ঝুলা।

গুজরাটিদের বাড়িতে যেমন দেখা যায়।

তাতে সাদা পায়জামা আর গেঞ্জি পরা একজন মানুষ আর দারুণ সুন্দর শরীরের একজন মানুষী পাশাপাশি বসে দোল খাচ্ছেন। ভদ্রমহিলা বসেছেন বাঁ-পাশে। তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছি না। পরনে একটা মেরুন-রঙা শাড়ি। বাঁ-পায়ের উপর ডান পা তুলে বসে আছেন দোলনাতে। ভারি সুন্দর পায়ের গড়ন তাঁর। রুপোর পায়জোড় পায়ে। ঝুলা দুলছে।

ওঁরা বড়ো প্রেমে, প্রভাতী ভালোবাসায় দুজনে দুলতে দুলতে গল্প করছেন।

আশ্চর্য হলাম আরও দেখে যে, ঠিক তাঁদের সামনেই, বসার ঘরের বারান্দাতে একটি সবুজ গাছ, কাল রাতে যা চোখে পড়েনি। গাছটি বাবলা গাছের মতো। মহারাষ্ট্রে শুকনো লালচে পাহাড়ি রুক্ষ পটভূমিতে যেমন গাছ সচরাচর জন্মায়, তেমন কোনো গাছ। আদিগন্ত কংক্রিটের প্যাস্টেল-রঙা পটভূমিতে ওই এক ঝলক সবুজ এবং তার পিছনে পরম প্রেমে ঝুলায় দুলতে থাকা দম্পতির দিকে চেয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

মোহাবিষ্টের মতো ওই বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইলাম, চা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল।

ঝুলা দুলছে। প্র্যত প্রেমে কত কী কথা বলছেন ওঁরা দু-জনে। আর একজোড়া সুন্দর পা, মেয়েলি পা, একবার কাছে আসছে আবার দুরে সরে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে, সঙ্গমলিপ্ত জোড়া পাখির মতো।

আমারও ইচ্ছে হল কোনো পাখি হয়ে, কাচ খুঁড়ে উড়ে গিয়ে, সেই পায়জোড়-পরা পায়ের পাতায় চুমু খাই। নতজানু হয়ে বলি, হে ঈশ্বরী, প্রেমের প্রতিমাঞ্জ, পরম প্রেমময়ী, তোমারই মাধ্যমে। মানুষের আদিমতম ও প্রথমতম বোধকে বাঁচিয়ে রেখেছ, তোমার সুন্দর হাতে জলসিঞ্চন করে চিকন ও সবুজ করেছ উদবাস্তু গাছকে। তুমি প্রণম্য।

ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে আবার তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের বেশ একটু ভুঁড়ি আছে। বসার ভঙ্গিটিও অতি প্রাকৃত, অভব্য। অতি, অতি, অতীব সাধারণ সেই লোক। অথচ এই রকম। মানুষদের জন্যেই ঠিক এই রকম সুন্দরী দেবীসুলভ মানুষীরা তাদের মহার্ঘ্য প্রেমের এমন বেহিসেবি অপব্যবহার চিরদিন করে এসেছেন। যোগ্যজনের সঙ্গে কখনোই যোগ্যা জনের মিল হয়নি। হবে না। এই-ই হয়তো-বা প্রাকৃতিক নিয়ম।

রোদ আস্তে আস্তে জোর হচ্ছে। নারী উঠে গিয়ে একটি থালায় করে কিছু খাবার নিয়ে এসে দু জনের মধ্যে রাখলেন।

দোলনা আবার দুলতে লাগল। সুন্দরীর যত ক্রিয়াকর্ম সবই মনে হল ঘরের বাঁ-দিক ঘেঁষে। আমি শত চেষ্টা করেও প্রেমময়ীর মুখ দেখতে পেলাম না।

মনে হল, তাঁর বয়স তিরিশের নীচে। কিন্তু তাঁর প্রেম অনাদিকালের, পবিত্র, স্বচ্ছতোয়াঞ্জ, প্রাণদায়িণী।

মুখ দেখতে পেলাম না বলেই ওইশ্রীমুখ দেখার লোভ আমার বেড়ে যেতে লাগল ক্রমশ।

অমন মাঝবয়সি র্ভুড়িওয়ালা, ফাটকা-খেলা অথবা লোহালক্কড়ের কারবারি স্বামীর প্রতি এমন অনুরক্তা সুন্দরী প্রেমবিলানো স্ত্রী কি এখনও আছেন? যিনি ঝুলায় ঝুলতে ঝুলতে সাত সকালে স্বামীর মুখে সোহাগে খাবার খুঁজে দেন? কী জানি! এমন সব স্ত্রীদের সান্নিধ্যে এসেই বোধহয় স্বামীরা বড়ো হন, বড়ো ব্যবসায়ী, ধনপতি, বড়ো শিল্পী, লেখক, গায়ক।

ভদ্রলোক ধনে যে বড়ো বুঝতেই পারছি, কারণ এ অঞ্চলের ফ্ল্যাটের দাম নাকি দশ হাজার

টাকা, প্রতি স্কোয়ার ফিট। এই এক একটি ফ্ল্যাট নিদেন পক্ষে এক হাজার স্কোয়ার ফিটের। অতএব দাম সোজা হিসেবে এক কোটি টাকা। ভাবলেই, মাথা ঘোরে। এই ফ্ল্যাটের ধনবান মালিকের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে হীনম্মন্যও লাগে। যিনি স্ত্রীর এমন মান পেয়েছেন তাঁর অন্য মানে প্রয়োজনই বা কী?

চান করে কাজে বেরোবার জন্যে তৈরি হয়ে নিতে উঠলাম চেয়ার ছেড়ে। ঠিক দশটাতে কনফারেন্স। এই হোটেলেরই কনফারেন্স রুমে, চ্যান্সারিতে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি দোলনাটা শূন্য। কিন্তু তখনও শূন্য দোলনাটা দুলছে।

একটু আগেই নিশ্চয়ই ওঁরা উঠে গেছেন।

কনফারেন্স। সোয়া এগারোটায় কফি-ব্রেক। দেড়টায় সুইমিং পুলের পাশে লাঞ্চ। তারপর বিকেল সাড়ে চারটেয় টি-ব্রেক–আবার একটানা ছটা অবধি।

কিন্তু কনফারেন্স চলাকালীন সমস্ত সময়টাতে আমার মাথার মধ্যে হয় একটি শূন্য দোলনা দুলতে লাগল, নয় পায়জোড়-পরা একজোড়া সুন্দর পা ও একটি মেরুন-রঙা শাড়ি-ঘেরা মুখ-না দেখা পরি দোলনায় দোলায় এগোতে পেছোতে লাগল মস্তিষ্কের কোষে কোষে।

কে কী বললেন, স্লাইড প্রোজেক্টারে কী কী স্লাইড দেখানো হল, কোন রিজিয়নের ম্যানেজারের বাজেট ফোরকাস্ট কী হল কিছুই মাথায় ঢুকল না আমার।

বিকেলে ঘরে ফিরে চানটান করে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে আবার পর্দা সরিয়ে বসলাম।

ঠিক এমন সময় ফোনটা বাজল। মিস্টার রথম্যান ফোন করে সি-রক হোটেলের রিভলভিংরুফ টপ রেস্তোরাঁতে চাইনিজ ডিনার খাওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন।

তারপরেই নন্দু পারেখ ফোন করল, বলল, গাড়ি পাঠাচ্ছি। বাড়িতে বসে চিভাস-রিগ্যাল হুইস্কি খেতে খেতে ভিডিয়োতে দারুণ সফট-পর্ণো দেখব।

আমি দু-জনের নেমন্তন্নই সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। পর্ণো দেখার বয়স আর নেই। যে বয়সে দেখা যেত, সে বয়সেও দেখার কুরুচি ছিল না।

সি-রক হোটেলও বোম্বেতেই থাকবে। তার রুফটপ রিভলভিং রেস্তোরাঁও রোজ রাতে চাঁদের মতো নরম উজ্জ্বল হয়ে বোম্বে শহরকে প্রদক্ষিণ করবে প্রায় অনন্তকাল ধরে। কিন্তু এর পরের বার এই হোটেলে উঠতে নাও পারি। এখন আমি এই দোলনা-দোলা রহস্যময়ী নারীর প্রতি অন্য সব কিছু থেকে বেশি মনোযোগী। গোয়েন্দার মতো আমার ঔৎসুক্য এখন তীব্র, তীক্ষ। না-দেখা মুখটি দেখতে পরম ব্যগ্র আমি। এবং জানতে যে, কোন মন্ত্রে এই দম্পতি এমন মোহময় করে রেখেছেন তাঁদের বিবাহিত প্রেমকে? দৈনন্দিনতার কালি লাগতে দেননি একটুও, মধুচন্দ্রিমার দিনকে কোন যাদুতে কলতলগত করে রেখেছেন চিরদিনের মতো?

আলো জ্বলছে। কিন্তু উনিশ তলার ফ্ল্যাটটির বসবার ঘর শূন্য। দোলনা স্থির। আমার ঘর অন্ধকার করে, রুম-সার্ভিসে হুইস্কির অর্ডার দিয়ে আমি বসে আছি। ইস একটা বায়নাকুলার জোগাড়। করতে পারলে বড়ো ভালো হত। রহস্যভেদের সুরাহা হত।

একটা হুইস্কি শেষ হল। দোলনা তবুও নিষ্কম্প, নির্দোল, দ্বিতীয় হুইস্কি এল। হঠাৎ মঞ্চে

নায়কের প্রবেশ ঘটল। নীলরঙা সাফারি-স্যুট পরা ভদ্রলোক এলেন। সাহেবি পোশাকে ভুড়িটা। একটু কম মনে হল, রঙটাও একটু বেশি ফর্সা। হয়তো রাতের বিজলি আলোর জন্যেই।

ভদ্রলোক দোলনার পিছনের সোফায় বসলেন। ব্রিফকেস খুলে কি যেন রাখলেন সাইড টেবলে।

কাগজ? টাকার বাণ্ডিল?

কিছু স্পষ্ট বোঝা যায় না এত দূর থেকে। প্রৌঢ়ত্বের শুরু এসে শৈশবের দিকে চাইলে যেমন কুয়াশা কুয়াশা ঠেকে, তেমন লাগছে এখন আলো-জ্বলা বসার ঘরটিকে।

হঠাৎ বাঁ-দিকের শোওয়ার ঘরে আলো জ্বলল। প্রেমময়ীর পরনে এখন হালকা নীল শাড়ি।

বেডরুমের দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ওঁকে একটু দেখা গেল। চমৎকার চলার ভঙ্গিটি। লেটেস্ট মডেলের মার্সিডিস গাড়ির মতো। মুখ স্পষ্ট দেখা গেল না। হতাশা বাড়ল।

পরি অনেক দূরে। ভীষণ কষ্ট আমার, এমন আবছা আবছা দেখতে পাওয়ার চেয়ে দেখতে না পাওয়া অনেক ভালো ছিল, সুখ, প্রেম, উষ্ণতা এসব বোধহয় সব সময়ই আমার কাছ থেকে দূরে।

ভদ্রলোক সোফা থেকে উঠে শোবার ঘরে এলেন। তারপর শোবার ঘরের আলো নিভে গেল। হালকা নীল ছোটো আলো জ্বলতে লাগল। কিছু বোঝা গেল না আর। আমার চোখের ক্ষমতায় কোনো দৃশ্য নেইঞ্জ, এখন চলচ্চিত্র, কল্পনায়। একটু পরেই এয়ার কন্ডিশনড ঘরের জানলা কাচ পর্দাতে ঢেকে গেল।

দোলনাটা শূন্য এবং নিষ্কম্পই পড়ে ছিল সন্ধ্যে থেকে। হঠাৎ একজন বুড়ি মতো আয়া এসে বারান্দার রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়াল। তারপর সে দোলনায় বসে দোল খেতে লাগল।

আমার ভীষণ রাগ হল।

রাক্ষসী!

দু-হাতে পর্দা টেনে দিয়ে রথম্যানকে ফোন করলাম।

বললাম, চলো ডিক, ডিনারই খেতে যাব সি-রকের রুফ-টপে।

২.

রাতে ফিরতে দেরি হয়েছিল। সাড়ে সাতটাতে মর্নিং এলার্ম কল দিতে বলে রেখেছিলাম। আর চা। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বোম্বেতে সকালও হয় সাড়ে সাতটাতেই।

টেলিফোন বাজতেই উঠে পড়ে পর্দা সরালাম। চা-ও নিয়ে এল সেই সময়। চা নিয়ে ওই দোলনা টাঙানো বারান্দার দিকে মুখ করে বসলাম সোফাতে।

উনিশ তলায় দোলনা দুলছে। হালকা নীল শাড়ি পরা প্রেমময়ী এবং ফিকে হলুদরঙা স্লিপিংস্যুট পরা ভদ্রলোক। স্লিপিংসুটে ভদ্রলোককে গেঞ্জি পায়জামার চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে অনেক, একটু রোগা এবং বেশি ফর্সাও দেখাচ্ছে কাল থেকে। অনেক সভ্য এবং সম্রান্তও।

প্রেমময়ী কালকেরই মতো পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। সকলে, মেয়েদের মুখ-চোখ বুকেই সৌন্দর্য খোঁজে। আমার কাছে পায়ের ভূমিকা অসামান্য। পায়ের এবং পায়ের পাতার গড়নে মেয়েদের পেডিগ্রি খুঁজে নিতে হয়। সুন্দর পা ব্যতিরেকে কোনো মেয়ে কখনো সুন্দরী হতে পারে না। হয়তো পুরুষও নয়।

দোলনা দুলছে। বাঁ-পায়ের গোড়ালির একটু উপর অবধি দেখা যাচ্ছে প্রেমময়ীর। সোহাগে কথা হচ্ছে। একটু আধটু আদর টাদর। নিশ্চয়ই চোখ দিয়েই বেশি হচ্ছে আদর। দিনের বেলায় রাতের বেলার চেয়ে বেশি অস্পষ্ট। বড়ো দূর, বড়ো অস্পষ্টতা, এই ভালোবাসা।

একটু পর, কালকেরই মতো একটি থালায় করে খাবার নিয়ে এলেন। দু-জনে দুলতে দুলতে খেলেন। একটু পর হঠাৎ দু-জনে একসঙ্গে উঠে গেলেন।

শূন্য ঝুলা দুলতে লাগল, এগোতে লাগল, পিছোতে লাগল।

হঠাৎ সেই বুড়িমতো আয়াটি কোত্থেকে এসে আবার রেলিং ধরে দাঁড়াল।

ডাইনি, অপ্রেমঞ্জ, অসুন্দর। ঘেন্না, ঘেন্না, ঘেন্না।

৩.

সেদিন বিকেলে কনফারেন্স শেষ হবার পর ঘরে ফিরে আমার খুব ইচ্ছে হল চানটান করে ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। তারপর ওই ফ্ল্যাটে। আমায় জানতেই হবে এত প্রেম আসে কোত্থেকে? প্রেমময়ী আর তার স্বামী কতদিন বিবাহিত? কোন গুপ্তবিদ্যাতে এই প্রেম, এই সবুজ গাছ সঞ্জীবিত আছে এমন চিকনতায়, ঔজ্জ্বল্যে?

এমন সময় ফোনটা বাজল।

নন্দু।

বলল, আপনার হোটেলে আসছি এক্ষুনি। কোথাও বেরোবেন না।

আমি বলতে গেলাম, এক্ষুনি…।

ও কথা না-শুনেই ফোন নামিয়ে রাখল।

আমার চান শেষ হতে-না-হতে নন্দু এসে হাজির হল।

টিপিক্যাল গুজরাটি। গলায় হার। পায়ে কোলাবার রিগ্যাল থেকে কেনা চটি, পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। গা থেকে ভুর ভুর করে দামি পারফিউমের গন্ধ বেরুচ্ছে।

ঘরে ঢুকেই বলল, তোমার হয়েছেটা কী বাঙালিবাবু? বোম্বেতে কেউ এত তাড়াতাড়ি ঘুমোয় নাকি? বাচ্চারা ছাড়া? সন্ধ্যেই তো হয় আটটাতেঞ্জ, সকাল হয় সাড়ে সাতটায়। এত ঘুমোলে ব্রেন ডাল হয়ে যাবে।

আমাকে অন্যমনস্ক দেখে বলল, চলো, আমার নতুন এয়ার কন্ডিশনড শেভ্রলে গাড়িতে মেরিন ড্রাইভে একটা চক্কর দিয়ে তারপর খাইয়ে-দাইয়ে আবার পৌঁছে দিয়ে যাব তোমায়। গজল। শুনবে? ভালো গজল? যেমন গাইয়েঞ্জ, তেমন গান।

আমি বললাম, আমি একটা সমস্যায় পড়েছিনন্দু। আমার কিছুই ভালো লাগছে না।

নন্দু হাসল।

ওর নীচের পাটির দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। গুজরাটিরা সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধাতে ভালোবাসে।

হেসে বলল, সমস্যা?

বলল, আজীব আদমী। বোম্বাই শহরে নন্দু পারেখ যার চেলা তার ভালো লাগছে না কীরকম? ভালো-না-লাগা কাকে বলে?

নন্দুর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, ও যেন মৃদ্যু মৃদ্যু হেসে নীরবে বলতে চাইছে, কত টাকা লাগবে বলো তোমার ভালোবাসা কিনতে? কী করলে তোমার ভালো লাগবে শুধু বললো, এক্ষুনি আরব সাগরের হাওয়া-বওয়া শহরের সব ভালোলাগা তোমাকে কিনে দিচ্ছি।

আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম।

ও বলল, কী হল? কথা বলো।

আমি ঘরের পর্দাসরানো কাচের জানালা দিয়ে ফ্ল্যাটটির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম, জান নন্দু, ওই বাড়ির উনিশ তলায়, ওই ফ্ল্যাটে একটি কাপল থাকে, বড়ো প্রেম তাদের। আর একটি গাছও থাকে, টবে, অনেক সবুজ নরম পাতা সে গাছে, অনেক…

তুমি চুপ করবে।

নন্দু আমাকে ধমক দিল।

বলল, তোমাকে তো কতদিন বলেছি, বম্বে চলে এসো। এখানে আমার একটা ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। বেয়ারা-কাম বাবুর্চি আছে। এখানে থাকো আর লেখো৷ নোংরা, প্রাগৈতিহাসিক কলকাতায় কি ভদ্রলোক থাকতে পারে? মাসে মাসে তোমার সংসার খরচা আমি পাঠিয়ে দেব। আমার তিনটে কোম্পানিতে তোমাকে ডিরেক্টর করে নেব। আমার কাজে একটু আধটু সাহায্য কোরো, আর বেশি সময়টা এখানে হিন্দি ছবির জন্যে স্ক্রিপ্ট লেখো। কত পয়সা। তোমার দুটো প্রফেশন এক করলেও তার এক-শো ভাগও পাবে না এঁদো কলকাতায়।

আমি চুপ করে রইলাম।

নন্দু আমাকে গম্ভীর দেখে ওর স্বগতোক্তিতে ভাটা দিয়ে সিরিয়াসলি বাড়িটির দিকে তাকাল।

নিজের মনেই বিড় বিড় করে বলল, এটা কোন দিক? তারপর নিজেই এদিক-ওদিক আলোজ্বলা বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে বলল, বুঝেছি, বুঝেছি। কোন তলার ফ্লাট বললে?

উনিশতলা।

আরে…উ-নি-শ-ত-লা…।

নিজের মনেই বলল নন্দু।

তারপর আবার বলল উনিশ তলা। ওই ফ্ল্যাটে! আরে…

তুমি চেন?

আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম।

বললাম, তাহলে চলো। ওদের কাছেই চলো।

নন্দু উঠে দাঁড়াল।

বলল, বেশ। তাই-ই চলো। তোমার যা হুকুম।

আমি কাবলিটা পায়ে গলাতে গলাতে ওকে বললাম, কতখানি চেন?

নন্দু টেলিফোন ডায়াল করতে করতে হেসে বলল কারোকে যতখানি চেনা সম্ভব তারপরই ফোনে গুজরাটিতে ছে ছে করে কথাবার্তা বলল কার সঙ্গে যেন। বলেই জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

অবাক হয়ে আমি দেখলাম, প্রেমময়ী একটা ফিকে বেগুনি শাড়ি পরে দোলনায় এসে বসল। আমার ঘরের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।

নন্দু আমার দিকে ফিরে বলল, ওই ফ্ল্যাট তো! আমি স্ত্রী-আচারে কাবু-হওয়া জামাইয়ের মতো ক্যাবলা, ভ্যাদভেদে গলায় বললাম, হ্যাঁ।

নন্দু বলল, এবার চলো বাঙালিবাবু। বলেই, বলল, শালার রবিঠাকুরের জাতের কিসসু হবে না। আনপ্র্যাকটিক্যাল রোম্যান্টিক ফুলস।

তারপর আরও কিছু বলল মহান বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে ভালোবাসামিশ্রিত অশ্রাব্য ভাষায়, যা লেখা সম্ভব নয়।

যখন আমরা রকেটের মতো গতিসম্পন্ন একটি এলিভেটরে চড়ে মাল্টিস্টোরিড বাড়িটির উনিশ তলাতে পৌঁছে বেল বাজালাম, তখন সেই ডাইনি আয়া এসে দরজা খুলল। নন্দুকে কুর্নিশ করল।

নন্দু বলল, কোথায়?

শোবার ঘর দেখিয়ে আয়া সসম্মানে বলল, ভেতরে যান।

নন্দু এমনভাবে এগিয়ে গেল যেন ওটা ওরই বাড়ি।

দোলনাটা চোখে পড়ল। সবুজ গাছটাও। দোলনাটাতে একবার বসতে ভারি ইচ্ছে হল আমার। কিন্তু দোলনাতে একা বসলে আমাকে রাক্ষস মনে হবে। শ্রীকৃষ্ণ আর রাধা ছাড়া এই ঝুলাতে।

অন্য কারো দোলাটা মানায় না।

ঘরের দরজা খুলে নন্দু ঢুকল, পিছনে পিছনে আমি।

কার্পেট-মোড়া এয়ার কন্ডিশনড ঘর। বিরাট ডাবল-বেড খাট। পুরু ডানলোপিলো পাতা। এক কোনায় সোফা। টেবলের উপর ব্ল্যাক-ডগ হুইস্কির বোতল। বরফ, সোডা গ্লাস সব সাজানো।

প্রেমময়ী সোফা ছেড়ে উঠে এলেন আমাকে দেখে অবাক হয়ে।

নন্দুবলল, আমার বাঙালি দোস্ত। খুব মানী লোক। প্রেমময়ী নমস্কার করল জোড়হাতে। আহা কী রূপ! ঘরের নীল আলোর চেয়েও স্নিগ্ধ, নরম। কী চুল, কী চিবুক! কী চোখ!

নন্দু আমার দিকে ফিরে বাংলায় বলল, পছন্দ তোমার? আজ রাতটা তুমি তাহলে এখানেই থাকো। আমার মেহমান হয়ে। এর ফিস পঁচিশ হাজার। ট্রাইবুনালে ধড়াচূড়া পরে দাঁড়ালে তুমি নিশ্চয়ই এর চেয়ে অনেক অনেকই কম পাও। জীবনে কিছু করতে পারলে না বাঙালিবাবু। বিজনেস তো করলেই না। প্রোফেশানেও তোমরা আটারলি আনসাকসেসফুল।

তুমিও প্রফেশনাল, এও প্রফেসনাল। ফুঃ!

একটা হুইস্কি খাবার পর আমি বললাম, আমি এবারে যাব নন্দু।

কিছু ভালো লাগছিল না। কিছু না।

নন্দু আমার দিকে ভৎসনার চোখে তাকাল।

তারপর বিরক্তির সঙ্গে বলল, নীচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভারকে নিয়ে যাও। আমি পরে যাচ্ছি।

প্রেমময়ী আবার উঠে দাঁড়িয়ে হেসে নমস্কার করলেন।

বসবার ঘরে দোলনাটা স্থির হয়ে ছিল।

সমুদ্র থেকে হু-হু হাওয়া বইছিল কিন্তু তবু গাছটার পাতা নড়ছিল না একটাও।

সকালের আলো ফুটতেই পর্দা সরিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলাম আজ অন্যদিকে মুখ করে।

ঝুলাটাকে আমি আর দেখতে চাই না। একবারের জন্যেও নয়।

ব্যাকওয়াটারের দিকে তাকালাম। আশ্চর্য! আজ একটা সি-গালও নেই। নরম, পবিত্র ভালোবাসার প্রতীক সুগন্ধি সব সি-গালেরা কাল রাতে আরব সাগরের ওপরের কোনো অন্ধ ঝড়ে ডানা ভেঙে পড়ে, অবুঝ অন্ধকারে জোড়ায় জোড়ায় ভেসে গেছে প্রমত্ত ঢেউয়ের দোলায়। আর। সেই ঢেউয়ের দোলনা চেপে রাতারাতি উধাও হয়েছে পৃথিবী থেকে মনের সব ভালোবাসা, জলজ দুর্গন্ধের মধ্যে থিকথিক করা পোকার মতোঞ্জ, নন্দুদের আর তাদের শরীরের শরিক

বারাঙ্গনাদের প্রতি দুর্মর ঘৃণায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress