শান্ত করো , শান্ত করো এ ক্ষুব্ধ হৃদয়
হে নিস্তব্ধ পূর্ণিমাযামিনী । অতিশয়
উদ্ভ্রান্ত বাসনা বক্ষে করিছে আঘাত
বারম্বার , তুমি এসো স্নিগ্ধ অশ্রুপাত
দগ্ধ বেদনার ‘পরে । শুভ্র সুকোমল
মোহভরা নিদ্রাভরা করপদ্মদল ,
আমার সর্বাঙ্গে মনে দাও বুলাইয়া
বিভাবরী , সর্ব ব্যথা দাও ভুলাইয়া ।
বহু দিন পরে আজি দক্ষিণ বাতাস
প্রথম বহিছে । মুগ্ধ হৃদয় দুরাশ
তোমার চরণপ্রান্তে রাখি তপ্ত শির
নিঃশব্দে ফেলিতে চাহে রুদ্ধ অশ্রুনীর
হে মৌনরজনী! পাণ্ডুর অম্বর হতে
ধীরে ধীরে এসো নামি লঘু জ্যোৎস্নাস্রোতে ,
মৃদুহাস্যে নতনেত্রে দাঁড়াও আসিয়া
নির্জন শিয়রতলে । বেড়াক ভাসিয়া
রজনীগন্ধার গন্ধ মদির লহরী
সমীরহিল্লোলে ; স্বপ্নে বাজুক বাঁশরি
চন্দ্রলোকপ্রান্ত হতে ; তোমার অঞ্চল
বায়ুভরে উড়ে এসে পুলকচঞ্চল
করুক আমার তনু ; অধীর মর্মরে
শিহরি উঠুক বন ; মাথার উপরে
চকোর ডাকিয়া যাক দূরশ্রুত তান ;
সম্মুখে পড়িয়া থাক্ তটান্তশয়ান ,
সুপ্ত নটিনীর মতো , নিস্তব্ধ তটিনী
স্বপ্নালসা ।
হেরো আজি নিদ্রিতা মেদিনী ,
ঘরে ঘরে রুদ্ধ বাতায়ন । আমি একা
আছি জেগে , তুমি একাকিনী দেহো দেখা
এই বিশ্বসুপ্তিমাঝে , অসীম সুন্দর ,
ত্রিলোকনন্দনমূর্তি । আমি যে কাতর
অনন্ত তৃষায় , আমি নিত্য নিদ্রাহীন ,
সদা উৎকণ্ঠিত , আমি চিররাত্রিদিন
আনিতেছি অর্ঘ্যভার অন্তরমন্দিরে
অজ্ঞাত দেবতা লাগি — বাসনার তীরে
একা বসে গড়িতেছি কত যে প্রতিমা
আপন হৃদয় ভেঙে , নাহি তার সীমা ।
আজি মোরে করো দয়া , এসো তুমি , অয়ি ,
অপার রহস্য তব , হে রহস্যময়ী ,
খুলে ফেলো — আজি ছিন্ন করে ফেলো ওই
চিরস্থির আচ্ছাদন অনন্ত অম্বর ।
মৌনশান্ত অসীমতা নিশ্চল সাগর ,
তারি মাঝখান হতে উঠে এসো ধীরে
তরুণী লক্ষ্মীর মতো হৃদয়ের তীরে
আঁখির সম্মুখে । সমস্ত প্রহরগুলি
ছিন্ন পুষ্পদলসম পড়ে যাক খুলি
তব চারি দিকে — বিদীর্ণ নিশীথখানি
খসে যাক নীচে । বক্ষ হতে লহো টানি
অঞ্চল তোমার , দাও অবারিত করি
শুভ্র ভাল , আঁখি হতে লহো অপসরি
উন্মুক্ত অলক । কোনো মর্ত দেখে নাই
যে দিব্য মুরতি আমারে দেখাও তাই
এ বিশ্রব্ধ রজনীতে নিস্তব্ধ বিরলে ।
উৎসুক উন্মুখ চিত্ত চরণের তলে
চকিতে পরশ করো ; একটি চুম্বন
ললাটে রাখিয়া যাও , একান্ত নির্জন
সন্ধ্যার তারার মতো ; আলিঙ্গনস্মৃতি
অঙ্গে তরঙ্গিয়া দাও , অনন্তের গীতি
বাজায়ে শিরার তন্ত্রে । ফাটুক হৃদয়
ভূমানন্দে — ব্যাপ্ত হয়ে যাক শূন্যময়
গানের তানের মতো । একরাত্রি-তরে
হে অমরী , অমর করিয়া দাও মোরে ।
তোমাদের বাসরকুঞ্জের বহির্দ্বারে
বসে আছি — কানে আসিতেছে বারে বারে
মৃদুমন্দ কথা , বাজিতেছে সুমধুর
রিনিঝিনি রুনুঝুনু সোনার নূপুর —
কার কেশপাশ হতে খসি পুষ্পদল
পড়িছে আমার বক্ষে , করিছে চঞ্চল
চেতনাপ্রবাহ । কোথায় গাহিছ গান ।
তোমরা কাহারা মিলি করিতেছ পান
কিরণকনকপাত্রে সুগন্ধি অমৃত ,
মাথায় জড়ায়ে মালা পূর্ণবিকশিত
পারিজাত — গন্ধ তারি আসিছে ভাসিয়া
মন্দ সমীরণে — উন্মাদ করিছে হিয়া
অপূর্ব বিরহে । খোলো দ্বার , খোলো দ্বার ।
তোমাদের মাঝে মোরে লহো একবার
সৌন্দর্যসভায় । নন্দনবনের মাঝে
নির্জন মন্দিরখানি — সেথায় বিরাজে
একটি কুসুমশয্যা , রত্নদীপালোকে
একাকিনী বসি আছে নিদ্রাহীন চোখে
বিশ্বসোহাগিনী লক্ষ্মী , জ্যোতির্ময়ী বালা —
আমি কবি তারি তরে আনিয়াছি মালা ।