Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জোছনা ভাঙছে আকাশ || Nitish Burman

জোছনা ভাঙছে আকাশ || Nitish Burman

জোছনা ভাঙছে আকাশ

ঢ্যাংগা মতন ছেলেটির পরনে ঢোলা হাফ প্যান্ট , তার ওপর বগল কাটা গেঞ্জি। নাম ফটিকচাঁদ, ডাকে সবাই ফটকে বলে। রোগা পটকা চেহারা । ন্যাড়া মাথায় মাস খানেকের খোঁচা খোঁচা চুল। তাল পাতার পাখা দিয়ে বাতাস করে চলেছে স্কুলের মোড়ের চা দোকানটার উনুনে। কাঠ মেরে আগুন চাঙা করে প্রস্তুতি চলছে সকাল বেলার চায়ের ।দোকানের মালিক কালিহরি ধুনো জ্বেলে লক্ষ্মীর ফটোটা ঢেকে দিতেই কালচে পড়া দেওয়াল ঘড়িটা বেজে উঠল ঢং ঢং করে । ছ’ টা বেজে গেছে । ক্যাশবাক্সের মধ্যে কিছুটা ধোঁয়া আটকে দিয়ে তাড়া লাগায় ‘এই ফটকে জোরসে মার’। ফটিক দাবনা ঘেঁষে বাঁ হাতের মাদুলিটা উপরে তুলে জোরে পাখা নাড়ায়। এক মুখ ধোঁয়া গিলে সে আগুন ধরায় । কাঠ ঠেলে দিতেই ফড়্ ফড়্ শব্দে আগুন ওপরে ওঠে। ফটিক বলে ওঠে – ‘ওস্তাদ রেডি ‘ । চা দোকানটা নিতান্তই ছোট।সামনে স্কুল আর একটু দূরে সরকারী রাস্তা । কালিহরি উনুনে চায়ের জল চাপাতে চাপাতে লক্ষ্য করে দিগম্বর মাষ্টারমশায় গায়ে কাশ্মীরী শাল জড়িয়ে লাঠিটায় ভর করে এদিকেই আসছেন। গত পাঁচ বছর হয় অবসর নিয়েছেন ।একসময় এই সামনের স্কুলটাতেই পড়াতেন ।কিন্তু এত সকালে তিনি কখনো এদিকে আসেন না।তাছাড়া দোকানে বসাও তিনি আজকাল ছেড়ে দিয়েছেন ।মাষ্টারমশায়কে আসতে দেখে কালিহরি গামছা দিয়ে বেঞ্চটা ভালো করে পরিষ্কার করে বলল,‘ বসুন মাষ্টার বাবু, এত সকালে এদিকে, শরীর ভাল ত ? ‘ দিগম্বরবাবু বেঞ্চটায় বসে পাশে বাঁকানো লাঠিটা রেখে বললেন ‘ভাই কালিহরি , চিনি ছাড়া ভাল করে এক কাপ চা খাওয়াও ত হে’।কালিহরি দ্রুত চা বানাতে যায়। দিগম্বর বাবু চোখ রাখেন সামনের স্কুলটার দিকে ।বিগত ত্রিশ বছর তিনি এই সামনের স্কুলে কাটিয়েছেন। চাকরির ফল স্বরূপ দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট্ট একটা দোতালা বাড়ি করেছেন । ছেলেদের বৌ এনেছেন ঘরে।কিন্তু এসব করেও অবসরের পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি কেমন যেন পরগাছা হয়ে গেলেন।স্কুলের সামনে দাঁড়ানো দুই পাহারাদার বুড়ো গাছ বৃষ্টি আর কৃষ্ণচূড়া । তাঁর মতই নির্বিকার ।বেঁচে আছি ,ব্যস্ এইটুকু, এতেই খুশি । সকালের ঘটনা আবার মনে পড়ে । আজ খুব সকালেই ঘুম ভেঙে যায়।জানলার ফাঁক দিয়ে শরতের ভেজা বাতাস একরাশ শিউলির গন্ধ নিয়ে ছুঁয়েছিল বিছানাতেই । দরজা খুলতেই এক ঝলক জোয়ান রোদ ব্যালকনি দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল । কয়েকটা পাখি শিউলির ডালে বসে মিঠে সুরে গলা সাধছিল ।শরতের নেশায় বয়সটা একটু পিছনে ফিরেছিল । গুনগুন গান ধরেছিলেন একটা।স্ত্রী মল্লিকা চা দিতে এলে তার হাতটা ধরে দেখাতে চেয়েছিলেন শরতের রোদঝরা আকাশটাকে। মল্লিকা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে ‘ বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে’ বলে হাওয়াই চটিতে ফট্ ফট্ শব্দে নীচে নেমে গিয়েছিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে সব কিছু ভুলতে চাইলেন, কিন্তু চায়ে চুমুক দিতেই মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। চায়ে চিনি দিয়েছে , অথচ তার চিনি খাওয়া একদম বারণ ।কিন্তু আজকাল প্রায়শই মল্লিকা ভুলে যায় এসব কথা।প্রায়দিনই তাকে অনিয়ম করতে হচ্ছে।লাঠিটায় ভর করে নীচে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এই দোকানটায় এসে বসলেন।পঁচিশ বছর ধরে তিলে তিলে টাকা জমিয়ে বাড়িটা তিনি করেছেন। অথচ অবসরের পাঁচ বছরের মধ্যেই যেন সব অচেনা ঠেকছে।ছেলেদের সাথেও আজকাল খুব একটা কথা হয় না।কেমন যেন সবাই এড়িয়ে চলে।বাড়ির অনেক কাজেই যেন কেমন অপাঙতেয় হয়ে পড়ছেন ধীরে ধীরে।চোখ দুটো জলে ভিজে আসছিল। চশমা খুলে চাদর দিয়ে চোখ দুটো মোছলেন । কালিহরির দোকানে চা খেয়ে দাম মিটিয়ে দিগম্বরবাবু লাঠিটা হাতে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন।প্রথমে স্কুল বাড়িটার কাছে গেলেন। অনেক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন স্কুলটার দিকে। অনেক সময় কাটিয়েছেন ছাত্রদের সাথে এই স্কুলে। অনেক সন্মান, অনেক ভালোবাসার সাক্ষী এই স্কুল, মাঠ আর গাছগুলো। আজ আর ঘরে ফিরতে তাঁর মন চাইল না।ঘরে না ফেরার কষ্টটা তিনি হেঁটে ভুলতে চাইছেন।গ্রামের এক সরু রাস্তা ধরে তিনি উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটতে লাগলেন । অনেক দূর হাঁটার পর তিনি একটা বাঁধ পেলেন। এ দিকে কোনদিন আগে আসেননি।বাঁধের ধারে অনেকে মাছ ধরছে। সূর্যের তাপ বাড়ছে ।একটা গাছের নীচে তিনি বসলেন। জলে চোখ রাখলেন।জলের গভীরে , কালো জলের গভীরে চোখ রাখলেন । যেখানে প্রেক্ষাপটে নিজেকে আর দেখা যায় না । নিজের অস্তিত্বকে চেনা যায় না। সেই গভীরে দৃষ্টি ফেলতে চান তিনি । কিন্তু জলের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে । দুলছে, ভাঙছে । হৃদয় ভাঙছে ।নদীর জল, বাঁধের জলে আজ ভাঙন লেগেছে । দেখে ভালো লাগছিল দিগম্বর বাবুর ।নিজের ভাঙা- গড়া খেলায় তিনি মেতে উঠেছেন আজ। নিজেক যেন নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগলেন।নিজের মৃণ্ময় মূর্তির সামনে নিজেই যেন আজ একলব্য। তিনি একলব্যের মত বাঁচতে চান । এভাবে কত সময় তিনি পার করে দিলেন হিসেব নেই।কিন্তু উঠতে মন চাইল না।দুপুর ঘনিয়ে বিকেল হল, তিনি একই ভাবে বসে রইলেন । যারা মাছ ধরছিল তারা অনেক আগেই চলে গেছে । দুয়েকজন নতুন এসেছে ওদিকটায় ।ক্রমশঃ বিকেল গড়াল ,সন্ধ্যা চলে এল ।নিজের ভাঙা গড়া খেলায় ব্যস্ত তিনি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতে চলল ।দিগম্বর বাবুর মনটা একটু শান্ত হল। পেটে এক অস্বস্তি ব্যথা অনুভব করলেন। শরতের এক ঠান্ঠা হাওয়া এসে মনটাকে আরো একটু শান্ত করল। বাড়ি ফেরার কথা মাথায় জাঁকিয়ে বসল। শালটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে হাতের লাঠিটায় ভর করে ফেরার পথে হাঁটা লাগালেন। শিরিষ আর খেজুর গাছের ধার ধরে তিনি হাঁটতে লাগলেন। অনেকদূর তিনি চলে এসেছিলেন । হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পা প্রায় অবশ হয়ে এল । মাথার ওপর কয়েকটা পেঁচা ডাকাডাকি করে উড়ে গেল ।চারদিক বেশ জঙ্গল।খস্ খস্ পায়ের শব্দ আর লাঠিটার শব্দ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না ।মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করছে ।ক্ষিদেও পেয়েছে ভীষণ ।এভাবে এদিকে কাউকে না জানিয়ে আসাটা একদম ঠিক হয়নি।যদিও বা এসেছেন অনেক আগে ফেরা উচিত ছিল ।এসব কথা ভেবে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় কালিহরির চা দোকানের কাছাকাছি পৌঁছলেন । চায়ের দোকানটাতে ফটিকচাঁদ হ্যাসাকে পাম্প মারছে। স্কুলের বৃষ্টি আর কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো ডালপালা নুইয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।একসময় দিগম্বর বাবু বাড়ির সামনে পৌঁছলেন । বাড়ির সামনে বেশ জটলা দেখতে পেলেন । একটা পুলিসের গাড়ি দাঁড়ানো বাড়ির সামনে। তিনটে পুলিসকে বাড়ির ভিতর থেকে আসতে দেখে তিনি আড়াল করে দাঁড়ালেন ।পুলিশগুলো গাড়ি হাঁকিয়ে শশব্দে চলে গেল। তিনি আরেকটু এগোলেন , কেউ একজন বলল ‘ মর্গে একবার খোঁজ নেওয়া দরকার..’ কেউ বলে উঠল ‘ কেসটা পুলিস দেখছে, কিছু ক্লু পেলে ওরাই জানাবে।’ তিনি দূর থেকে দেখতে পেলেন মেয়ে, মেয়ের জামাই, নাতনী এসেছে। ছোট কাকার ছেলে বলাই সেও এসেছে। আরে ওটা ত ছবি পিসির ছেলে মাধব। কবে সবাইকে একসাথে দেখেছেন মনে পড়ে না। আরে সাদা থান পরে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে ওটা ত ছোট মাসি, আজ প্রায় চার পাঁচ বছর পর ছোট মাসিকে দেখলেন। নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে নিশ্চয় সবাই এসেছে । এমন ঘটনা হয়ত কারও বিশ্বাসই হয়নি। পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ একা একা কোথায় যাবেন ! সবার মনেই কৌতূহল । আশেপাশে সব আত্মীয়ের বাড়িতেই হয়ত খবর নেয়া হয়ে গেছে ।কোত্থাও পাওয়া যায়নি। দিগম্বরবাবু ভয়ে ভয়ে লাঠিটায় ভর করে এগোলেন। নাতনী টুকি প্রথমে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল ‘ওই যে দাদু’। সবাই নিষ্পলক চেয়ে রইল ওনার এগিয়ে যাওয়ার দিকে। বড়ছেলে এগিয়ে এসে তীর ছুড়ল-‘তোমার আক্কেলটা কেমন শুনি, কওয়া নেই, বলা নেই সারাদিন বেপাত্তা।এদিকে সারা শহর -গ্রাম খুঁজে বেড়াচ্ছি, কোথায় যাইনি বলো, ছোট পিসি, রাঙা মাসি , পুলিস ষ্টেশন’..।দিগম্বর বাবু নিরুত্তর ।মাটির দিকে চেয়ে লাঠিটা ঘষতে লাগলেন । সহসা ভিড় ঠেলে মল্লিকা এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন দিগম্বর বাবুর ওপর। দিগম্বর বাবু পড়তে পড়তে লাঠিটায় ভর করে টাল সামলালেন ।মল্লিকা দিগম্বর বাবুর হাত ধরে হুড় হুড় করে টেনে দোতালার ব্যালকনিতে নিয়ে গেলেন আর অসাড় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পিছনে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে ,কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না, সবাই নিশ্চুপ। টুকি দৌড়ে এসে দাদুকে জড়িয়ে ধরল , দিগম্বরবাবু টুকিকে কোলে তুলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। একটু এগিয়ে ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়ালেন।দূর বাগানের শিরিষ গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখতে পেলেন।ব্যালকনিতে রাখা বোগেনভলিয়া গুলো ফুটেছে আজ। শরতের আকাশ ভরা জোছনা , সেই জোছনা ভেসে বেড়াচ্ছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে আর ভেঙে চুরমার করছে রাতের আকাশকে। দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আকাশে লুকিয়ে থাকা সব কালো মেঘকে । মনের সব কালো মেঘকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *